১৬. টার্গেট ফিলিস্তিন

ফৌজি ও তার ভাবী ক্ষত ধুয়ে পরিষ্কার করছিল, পানি চাইলো দাউদ। ফৌজি মশক থেকে পানি ঢেলে ওর ঠোঁটের কাছে তুলে ধরলো, কাত হয়ে পানি পান করে সে।

পানি খাওয়া হয়ে গেলে দাউদ নিঃসাড় হয়ে কিছুক্ষণ পড়ে রইলো ওভাবে। চোখ বন্ধ করে ভাবলো কিছুক্ষণ। এক সময় চোখ মেলে ফৌজির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ফৌজি, তুমি বলেছিলে পুরুষের কাজ মেয়েরাও করতে পারে’। তার কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তবু সে কথা বন্ধ না করে বলতে লাগলো, ‘আমার ক্ষত পরিষ্কার করার বৃথা চেষ্টা বাদ দাও। আমার শরীরে আর কোন রক্ত নেই। আমি যদি সুস্থ্য থাকতাম, তবে তোমার বাইরে যাওয়া আমি কিছুতেই সহ্য করতাম না। যা করার আমি নিজেই করতাম। কিন্তু এখনকার অবস্থা ভিন্ন। আমি এখন যে কথা বলছি, এটা শুধু আমার ও তোমার নিজস্ব ব্যাপার নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের রাসূলে পাকের সম্মান। জড়িয়ে আছে জাতীয় মর্যাদা ও ইজ্জতের প্রশ্ন’।

‘বলো দাউদ! তোমার আমার স্বপ্ন এক, আশা এক। জাতীয় কোন দায়িত্ব আমাদের দেয়ার কথা ভেবে থাকলে এটাকে আমি আমার পরম সৌভাগ্য মনে করবো। আমাদের উদ্দেশ্য আমাদের জীবনের চাইতেও মহৎ, প্রাণের চেয়েও মূল্যবান। জাতির কোন সেবা করার সুযোগ পেলে সে দায়িত্ব আমি প্রাণ দিয়ে পালন করবো’। দাউদ ফৌজিকে তুর্কমানের রাস্তা বলে দিল। আর বললো, ‘একটু কাগজ নাও, আমি যা বলছি লিখে নাও’।

দাউদ ফৌজিকে দিয়ে একটি চিঠি লিখালো। তারপর সে চিঠিতে দস্তখত দিয়ে তুলে দিল ফৌজির হাতে। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘হলব, হারান ও মুশেলের সম্মিলিত বাহিনী তুর্কমানে আক্রমণের জন্য হলব থেকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। তারা যে গতিতে অগ্রসর হচ্ছে তাতে আগামী দু’তিন দিনের মধ্যে তুর্কমানে চড়াও হয়ে যেতে পারে’।

চিঠিটি ফৌজির হাতে দিয়ে দাউদ বললো, ‘ফৌজি, এ চিঠির গুরুত্ব বুঝানোর জন্য তোমাকে শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট মনে করি, এ খবর পৌঁছানোর জন্যই আমার এ আহত ও রক্তাক্ত অবস্থা, এ ফরজ আদায় করতে গিয়েই শহীদ হয়ে গেছে তোমার একমাত্র সহোদর প্রিয় ভাই। দুশমন চড়াও হওয়ার আগেই এ চিঠি আইয়ুবীর কাছে পৌঁছাতে হবে। যাওয়ার পথে যদি দুশমন গোয়েন্দার হাতে ধরা পড়ে যাও, নষ্ট করে ফেলবে চিঠি। তারপর যদি ওদের হাত গলে বেরিয়ে যেতে পারো তবে সোজা তুর্কমানে গিয়ে সব কথা সুলতান আইয়ুবীর কাছে খুলে বলবে’।

ফৌজি প্রস্তুত হয়ে গেল, তার সাথে রওনা হলো হারেসের স্ত্রীও। একটা ঘোড়া বাড়ীতে ছিল, দ্বিতীয় ঘোড়াটি নিল দাউদের। কিন্তু দাউদকে এ অবস্থায় ফেলে যেতে ভয় পাচ্ছি ফৌজি ও তার ভাবী।

‘ফৌজি!’ দাউদ দুর্বল স্বরে বললো, ‘আমার কাছে এসো’।

ফৌজি যখন তার কাছে গেলো, দাউদ তার হাত ধরে বললো, ‘সত্য পথের সৈনিক ও যাত্রীদের বিবাহ উৎসব হয় আকাশে। তাদের বরযাত্রীরা পথ চলে ধুমকেতুর রাস্তা ধরে। আকাশের তারকারাজি তো সেই উতসব-আনন্দেই হেসে উঠে আলো ছড়ায়! তুমি ভেবো না, আমাদের বিয়ের আনন্দ-উতসব আকাশের তারকারাজিই করবে’।

দাউদের জবান বন্ধ হয়ে গেল। একদিন ঢলে পড়লো তার মাথা। ফৌজি আবেগে তাকে জড়িয়ে ধরে ডাকলো, ‘দাউদ! দাউদ!’ কিন্তু ততক্ষণে বর বেশে ধুমকেতুর পথে যাত্রা শুরু হয়ে গেছে দাউদের। দুনিয়ার মায়া ছেড়ে তার আত্মা বিলীন হয়ে গেছে অসীম শূন্যতায়।

ফৌজিকে সব কিছুই বুঝিয়ে বলেছিল দাউদ। তার মৃত্যুর পর শোক যেন শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। সংকল্পে দৃঢ় হলো তার চোয়াল। বললো, ‘ভাবী, দাউদ তার প্রভুর কাছে রওনা হয়ে গেছে। এখন আর তাকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। সে যে জিম্মাদারী দিয়ে গেছে আমাদের ওপর, আগে সে জিম্মাদারী পূরণ করতে হবে। চলো, এখানে আর এক মুহূর্তও নয়’।

‘কিন্তু তার লাশ!’

‘লাশ এখানেই থাকবে’। তার বান্দার লাশের ফায়সালা করবেন তার প্রভু। উদ্দেশ্যের জন্যই জীবন, উদ্দেশ্যের জন্যই মরণ। তার লাশের চাইতে তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নই আমার কাছে অধিক গুরুত্বপুর্ণ। উদ্দেশ্যের কথা ভুলে লাশ নিয়ে পড়ে থাকলে পাপ হবে ভাবী’।

বাড়ী এবং দাউদের লাশ আল্লাহর হাওলা করে ফৌজি ও তার ভাবী বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ঘোড়ার ওপর জ্বীন এঁটে দু’জনে চড়ে বসলো দুই ঘোড়ার ওপর। ফৌজি চড়লো দাউদের ঘোড়ায়। ঘোড়ার জীনে তখনো লেগে আছে রক্ত।

তারা যখন ঘর থেকে বেরোয় তখন পৃথিবীর সৌন্দর্য ঢেকে দিয়েছিল রাতে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যেই দু’টি ঘোড়া গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ পথে ঢুকে গেল। দু’জন নারী পথ চলছিল একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করে। রাস্তাঘাট সবই তাদের অচেনা। নক্ষত্রের দিকে লক্ষ্য রেখে দাউদের এঁকে দেয়া নকশা অনুযায়ী ছুটে চললো ওরা। পথ হারাবার ভয় এবং পথের যাবতীয় বিপদ আপদকে তুচ্ছ করে অন্ধকার পথে তীব্রবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে চলছে তুই নারী।

তিন বাহিনীর যুক্ত কমান্ড সারাদিন ক্যাম্প করে শুয়ে থেকে রাতে আবার যাত্রা করলো। তুর্কমান এখন আর খুব বেশী দূরে নেই। আজ সারা রাত পথ চললে তুর্কমানের খুব কাছাকাছি চলে যাওয়া যাবে। কাল দিনের বেলা ইচ্ছা করলে হামলা  করা যায়, কিন্তু সাইফুদ্দিন ভেবে দেখলো, যদি কালকের দিনটা কোন মতে গোপনে তুর্কমানের কাছে কোন পাহাড়  কুচিতে কাটিয়ে দেয়া যায় সেটাই ভাল হবে। তাহলে রাতের অন্ধকারে অপ্রস্তুত অবস্থায় আইয়ুবীর ওপর অতর্কিত হামলা চালানো যাবে।

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এ বাহিনীর আগমন সম্পর্কে মোটেই ওয়াকিফহাল ছিলেন না। তার কোন গোয়েন্দা হয়তো এখনো এ বাহিনীর আগমন সংবাদ পায়নি অথবা যারা পেয়েছে তারা সবাই সম্মিলিত বাহিনীর গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়া গেছে।

কারণ যাই হোক, মূল কথা হচ্ছে, আইয়ুবী ওদের আগমন এখনো টের পাননি। তিনি তার বাহিনীর সৈন্যদের দেখাশোনা ও নতুন ভর্তি সৈন্যদের প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। শত্রুরা যে আটঘাট বেঁধে সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করে দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসছে তাকে আঘাত করার জন্য, এমন কোন ধারনাও ছিল না আইয়ুবীর। তিনি তখন ভাবছেন, শত্রুরা এত তাড়াতাড়ি সংগঠিত হতে পারবে না।   সালেহ ও সাইফুদ্দিনের যোগাযোগের মাধ্যম যে চিঠি, সেই চিঠি তো এখন তারই হাতে!

সাইফুদ্দিন তার কমান্ডো বাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল, ‘বরাবর আইয়ুবী গোয়েন্দা তৎপরতায় আমাদের থেকে এগিয়ে থাকে। তার সাফল্যের এটা অন্যতম কারণ। যুদ্ধে জিততে হলে এবার প্রথম থেকেই জিততে হবে। আমাদের আগমনের খবর যেন আইয়ুবী না পায় তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে’।

সাইফুদ্দিন আরো বললো, ‘তুর্কমানের আশেপাশে এমন লোকও দেখা যাবে, যারা গ্রাম্য পোষাকে এবং ভবঘুরে ও দিনমজুরের বেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরা ভবঘুরে, দিনমজুর বা গ্রাম্য লোক নয়, ওরা সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা। আইয়ুবীর পক্ষে রাস্তা দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত আছে ওরা। এ ধরনের লোকদেরও পাকড়াও করে হলবে পাঠিয়ে দেবে, যাতে আইয়ুবী আমাদের অভিযানের খবর কিছুতেই জানতে না পারে’।

সাইফুদ্দিন গাজীর এ সতর্কতার কারণে জীবনে এই প্রথম সুলতান আইয়ুবী প্রতিপক্ষের আগমন সম্পর্কে সম্পুর্ণ বে-খবর ছিলেন। এ বাহিনী যেভাবে এগুচ্ছে, যদি শেষ পর্যন্ত সুলতান আইয়ুবীকে অন্ধকারে রেখে তারা আইয়ুবীর অপ্রস্তুত বাহিনীর ওপর সত্যি আঘাত হানতে পারতো, তবে আইয়ুবীর আসলেই নিষ্কৃতির কোন পথ নেই।

ফৌজি ও তার ভাবী পাগলিনীর মত ছুটতে ছুটতে রাত পার করে দিল। ক্ষুধা, পিপাসা, ক্লান্তি, ভয় কোন কিছুরই বোধ ছিলনা ওদের। ওরা ছুটছে তো ছুটছেই। এভাবে ছুটতে ছুটতেই ওরা সারারাত ঘোড়ার ওপর কাটিয়ে দিল।

ভোরের আলো ফুটলো পাহাড়ের চুড়ায়, এখানে ওখানে। ফৌজি একটি পাথরে হেলান দিয়ে এক লোককে বসে থাকতে দেখলো। তার কাপড়ে রক্তের দাগ, মাথা একদিকে হেলে পড়ে আছে। ফৌজি তার ভাবীকে বললো, ‘ভাবী, দেখো! দেখো! সামনে এক আহতকে দেখা যাচ্ছে’।

‘থাক, ওর দিকে নজর দেয়ার সময় নেই আমাদের’।

‘লোকটা বেঁচে আছে, না মরে গেছে তাও দেখবো না!’

 ‘না, থামার সময় নেই ফৌজি! সবার আগে আমাদের তুর্কমান পৌঁছতে হবে’।

রাস্তার পাশেই বসেছিল লোকটি। দেখতে দেখতে ওরা তার কাছে চলে এলো। অচেতন অবস্থা থেকে জেগে উঠলো লোকটি। ঘোড়ার আওয়াজ  পেয়ে চোখ মেলে চাইল সেদিকে। ওদের এগিয়ে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল।

ঘোড়া একদম কাছে চলে এসেছিল, লোকটির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো ফৌজি, ‘ভাইয়া!!”

তারা ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামলো। কিন্তু ফৌজির চিৎকার শুনতে পেলো না সে, তার আগেই উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালো হারেস।

হারেস লড়াইয়ের সময় প্রচন্ডভাবে আহত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে শহীদ হয়ে যায়নি। তার বেঁচে থাকাটা এক অলৌকিক ব্যাপার। শরীরে বর্শার অসংখ্য আঘাত খেয়ে পড়ে যাওয়ার পরই সে অজ্ঞান হয়ে যায়। কতক্ষণ অজ্ঞান ছিল সে জানে না। যখন  চেতনা পেল, পাশের এ পাথরের গায়ে এসে হেলান দিয়ে বসেছিল।

ফৌজির ঘোড়ার সাহতে পানি ছোট মশক ছিল। ফৌজি তাড়াতাড়ি মশক এনে হারেসের চোখেমুখে পানির ছিটা দিল। হারেস অস্ফুটকন্ঠে বললো, ‘পানি! পানি!’

ওরা ওর মুখে পানি ঢেলে দিল, পানি পান করে হারেস চোখ খুললো। নিজের বোন ও বেগমকে তার মুখের ওপর ঝুঁকে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি এখন কোথায়? বাড়ীতে? দাউদ কোথায়?’

ফৌজি তাকে সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে খুলে বললো। সব শুনে হারেস বললো, ‘তোমরা আমাকে জলদি ঘোড়ায় উঠাও। তাড়াতাড়ি করো, আমাকে তুর্কমানে দিকে নিয়ে চলো’।

অসীম সাহসী দুই নারী অনেক কষ্টে তাকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দিল। ফৌজি বসলো ভাইয়ের পিছনে। হারেস শুধু তার অসম্ভব আত্মশক্তি বলে বেঁচে ছিল নতুবা তার শরীরে শক্তি বলে কিছুই ছিল না। একটা ফরজ সমাধা করার জন্যই যেন আল্লাহর তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।

ফৌজি তাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছিল, যেন সে ঘোড়া থেকে পড়ে না যায়। হারেস অস্ফুটস্বরে ফৌজিকে রাস্তা বলে দিচ্ছিল।

সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে তিনটি বাহিনী সাইফুদ্দিনের কমান্ডে তুর্কমানের দিকে অগ্রসব হচ্ছিল। অন্যদিকে ফৌজি, হারেস ও হারেসের স্ত্রী কে নিরাপদ পথে ধরে ছুটছিল তুর্কমানের দিকে।

ভোরের সূর্য বেশ উপরে উঠে এলো। আকাশের দিগন্তে ক্রমশ বাদামী আভা ছড়িয়ে পড়ছিল।

দিগন্তের বাদামী আভা ক্রমশ উপরে উঠতে লাগলো। ক্রমে সে আভা গাঢ় হয়ে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করছিল। দেখতে দেখতে রোদের তেজ ঢেকে দিল উড়ন্ত ধূলি মেঘ। ফৌজির ভাবী ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘ফৌজি, ওদিকে তাকাও’!

হারেস অনুচ্চ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ফৌজি?’

‘ধূলি ঝড়!’ ফৌজি বললো ভীত কম্পিত কন্ঠে।

এই পাহাড় ও মরুভূমির লোকেরা ধূলিঝড় কি জিনিস খুব ভাল করেই জানে। ধূলিঝড়কে ওরা বলে খোদার অভিশাপ। যে অঞ্চল দিয়ে এ ধূলিঝড় বয়ে যায়, সে অঞ্চলটি মুহূর্তে পরিণত হয়ে যায় ধ্বংসস্তুপে। সম্পদের বিনাশ আর অগণিত প্রাণের আর্ত আহাজারীতে মুখর হয়ে উঠে সাজানো লোকালয়। মানুষ ও পশুদের জন্য এ ঝড় নিয়ে আসে কিয়ামতের প্রলয়।

ধুলিঝড় মরুভূমির বালিকে উড়িয়ে নিয়ে প্রবল শক্তিতে একদিকে ছুটে যেতে থাকে। সেই বালির নিচে উপত্যকা, লোকালয় যা কিছুই পড়ে, সবকিছু ঢেকে যায় অন্ধকারে। বালির পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে মানুষ, পশু, ঘরবাড়ি, সবকিছু।

ফৌজি, তার ভাবী ও হারেস তাকিয়েছিল এই ভয়ংকর ঝড়ের দিকে। চোখেমুখে শঙ্কা ও ভয়ের কাঁপন। দেখতে দেখতে চারদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল।

আল মালেকুস সালেহ, গুমাস্তগীন ও সাইফুদ্দিনের সম্মিলিত বাহিনী সুলতান আইয়ুবীর ওপর অতর্কিত আক্রমণের জন্য তুর্কমানের কাছাকাছি এসে এক পাহাড়ের কোলে আশ্রয় নিয়ে তখন বিশ্রাম করছিল। আজ সারাদিন এখানে অবস্থান করে রাতে আইয়ুবীর বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিকল্পনা তাদের। সারা রাত ওরা নির্ঘুম পথ চলেছে। পথ চলেছে আগামী রাত
টির জন্য। আজ রাতেই আইয়ুবীর ওপর অতর্কিত এমন আক্রমণ চালানো হবে, যেন দুনিয়া থেকে মুছে যায় আইয়ুবীর নাম। তাবু ফেলার পরপরই সৈন্যরা তড়িঘড়ি নাস্তা সেরে শুয়ে পড়লো। দুই রাতের ঘুম একসাথে সেরে নিচ্ছিল ওরা।

পাহাড়ের কোলে ছায়ার মধ্যে তাবু টানিয়ে ঘুমিয়ে আছে সম্মিলিত বাহিনী। ভয়ংকর মরু সাইমুম ছুটে আসছে ওদের নাস্তানাবূদ করতে, তাবুর ভেতর শুয়ে এ কথা কেউ জানতেও  পারল না। যারা ছাউনি পাহারায় ছিল, ঘুমে ঢুলছিল ওরাও, তাই ওদের চোখেও প্রথমে ধরা পড়েনি সেই মরুঝড়।

ওদিকে আইয়ুবীর ক্যাম্পে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী প্রশিক্ষণরত সৈনিকদের সামনে তখন বক্তৃতা করছিলেন। তিনি ওদের বলছিলেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জীবন বিলিয়ে দেয়ার জন্য পাগলপারা মুজাহিদ বাহিনী! আল্লাহ তোমাদের বাহুর শক্তি আরো বাড়িয়ে দিন! তোমাদের হিম্মত ও কুওত বৃদ্ধি করে দিন। তোমাদের তলোয়ারে হযরত আলী (রাঃ)-এর তেজ ও চমক দান করুন। তোমাদের তীরের গতি হোক চোখ ধাঁধানো। ঘোড়াগুলো হোক দুলদুল অশ্বের মত গতিশীল ও তেজস্বী! আমাদের দুশমন কখনো হারানের গুমাস্তগীন, মুশেলের সাইফুদ্দিন বা হলবের আমীর আল মালেকুস সালেহ নয়। দুশমন আমাদের ক্রুসেডাররা! আগ্রাসী খৃস্টানরা! যারা আমাদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে আমাদের প্রথম কেবলা মসজিদুল আকসা। ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করেছে আমাদের ভাইদের। অপবিত্র করেছে আমাদের একমাত্র বাতিঘর পবিত্র কোরআন। লুন্ঠন করেছে আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত ও সম্ভ্রম। মুজাহিদ ভাইয়েরা আমার! ফিলিস্তিনের পবিত্র মাটি থেকে নাপাক শক্তিকে উচ্ছেদ করতে হবে। আমাদের ভাইদের কান্না, বোনদের আহাজারী ব্যাকুল কন্ঠে ডাকছে আমাদের। মনে রেখো, এখন আমাদের টার্গেট ফিলিস্তিন! এখানে যথেষ্ট সময় আমরা পেয়েছি প্রস্তুতির। এই প্রস্তুতিকে সম্বল করে আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা ও ভরসা রেখে এবার টার্গেটের দিকে কদম বাড়াতে হবে আমাদের। যদি আমাদের লাশ আল্লাহর মঞ্জুর হয়, তবে সে লাশ যেন পড়ে ফিলিস্তিনের মাটিতে, আর যদি আল্লাহর মঞ্জুর নয় আমাদের বিজয়, তবে মসজিদুল আকসায় শোকরানা নামায পড়ার আগে আমরা কোথাও থামবো না। আমাদের গতি হবে ঝড়ের মত উদ্দাম! টার্গেটে পৌঁছার আগে এ ঝড় কোথাও থামবে না, এ শপথ ও সংকল্পে দৃঢ় করা সবার চিত্ত। মনের ভেতর গেঁথে নাও একটি মাত্র শব্ধ, ফিলিস্তিন! ফিলিস্তিন!

আইয়ুবীর কন্ঠ থেমে গেল। মরুভূমির বাতাসে, ইথারে ইথারে ভাসতে লাগল আইয়ুবীর সেই কন্ঠধ্বনিঃ বন্ধুরা আমার! ভাইয়েরা আমার! এখন আমাদের টার্গেট ফিলিস্তিন! ফিলিস্তি……

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 5 | 6 | 7 | 8 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top