১৬. টার্গেট ফিলিস্তিন

‘আরে এতে তোমার লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। আমি তো এমন একটি সাধারণ কুঁড়েঘরই তালাশ করছিলাম। ভাগ্য ভাল যে, আমি আমার পছন্দ মত যে ঘরটি খুঁজে পেয়েছি তা আমার খুব আপন লোকদের। আত্মগোপন করার জন্য এমন পরিবেশেরই দরকার ছিল।‘ সাইফুদ্দিন বললো, ‘এখানকার সবাই খুবই বিশ্বস্ত। ফৌজি তো আমার আপনজনই হয়ে গেছে। তোমরা শুধু খেয়াল রাখবে, যতক্ষণ এখানে আছি, কেউ যেন আমার এ আত্মগোপনের কথা জানতে না পারে’।

‘আপনি বলছিলেন, আপনি কোথাও চলে যাবেন। কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’ দাউদ প্রশ্ন করলো।

‘আমি হলব যাবো’। সাইফুদ্দিন উত্তর দিল, ‘সেখান থেকে মুশেল ফিরে আসবো’।

‘কিন্তু আপনি তো একা! যাবেন কেমন করে?’ দাউদ বললো, ‘আপনার সঙ্গে তো দেখছি কোন দেহরক্ষীও নেই?’

‘এ এলাকায় তেমন কোন ভয় নেই’। সাইফুদ্দিন বললো, ‘একাই যেতে পারবো’।

‘আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন।‘ দাউদ বললো, ‘এ এলাকায় দুশমনের চর নেই এমনটি মনে করবেন না। আমি যা জানি, আপনি তা জানেন না। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ আপনাকে চিনে ফেললে ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে। খোদা না করুন, এমন কিছু ঘটে গেলে নিজেদের আমরা কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবো না। চিরকার এ জন্য আপসোস ও অনুতাপ করে কাটাতে হবে’।

‘ঘটনাক্রমে আল্লাহ যখন আমাদের এখানে পৌঁছেই দিয়েছেন, আমরা দু’জন আপনার সঙ্গী হই না কেন?’ হারেস বললো, ‘আমাদের দু’জনের সাথেই ঘোড়া আছে, অস্ত্র আছে। আপনার হেফাজতের অন্য অন্তত দু’জন দেহরক্ষী তো আপনি সাথে পাচ্ছেন। কোন আমীর কি এমনভাবে রক্ষীবিহীন একা বাইরে বেরোতে পারে?’

সাইফুদ্দিনও মনে মনে এ কথাই ভাবছিল। আসলেই তার দেহরক্ষীর প্রয়োজন ছিল। এমনিতেই পরাজয়ের পর তার মধ্যে আইয়ুবীর ভয় কাজ করছিল, তার উপর দাউদ তাকে আরো ভীত করে তুলল। সাইফুদ্দিন তাদের বললো, ‘তোমরা কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করে আজকের দিনটা বিশ্রাম নিয়ে নাও। আগামীকাল রাতে আমরা রওনা করবো। তোমরা ক্লান্ত, যাও, এখন গিয়ে একটু আরাম করো’।

তারা দু’জন উঠে দাঁড়িয়ে আদবের সাথে স্যালুট করলো সাইফুদ্দিনকে, তারপর কামরা থেকে বেরিয়ে  ভেতরের ঘরে চলে গেল। সাইফুদ্দিন ফৌজির কথা কল্পনা করতে করতে নিজেও একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।

পরদিন সাইফুদ্দিন ফৌজির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু ফৌজি সে কামরাতে আর গেল না। দিনের বেলা হারেস ও দাউদই ব্যস্ত রইল তার খেদমতে। তারাই তার খাবারের ব্যবস্থা করলো এবং সারাক্ষণ তার পাশে বসেই কাটিয়ে দিল। সাইফুদ্দিন ভাবলো, হারেস ও দাউদ কামরায় আছে বসেই ফৌজি আসতে লজ্জা পাচ্ছে। এ কথা মনে হতেই তার পেরেশানী কিছুটা কমলো, কিন্তু কল্পনায় সারাক্ষণই ভাসতে লাগলো ফৌজির ছবি।

সাইফুদ্দিন গাজী যখন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ওপর আক্রমণ করার প্রস্তুতির কথা চিন্তা করছিল অখ্যাত এক পর্ণকুটিরে শুয়ে, ঠিক সে সময় হলবের অদূরে খৃস্টান কমান্ডার, সেনাপতি ও সম্রাটরা এক কনফারেন্সে বসে আল মালেকুস সালেহ, গুমাস্তগীন ও সাইফুদ্দিনের সম্মিলিত বাহিনীর পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করছিল। সুলতান আইয়ুবীর মোকাবেলা করতে গিয়ে এ বিশাল বাহিনী কি করে পরাজিত হলো তখনো এর কোন কারণ তাদের বুঝে আসছিল না।

‘এ তিন মুসলমান আমীরের সম্মিলিত বাহিনীর পরাজয় আসলে আমাদেরই পরাজয়’। রিমান্ড বললো, ‘যতদূর আমি জানি, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর শক্তি ও সৈন্য সংখ্যা খুব বেশী ছিল না’।

‘আমি আপনার সাথে একমত হতে পারছি না’। প্রসিদ্ধ ফরাসী সম্রাট রিনাল্ট বললো, ‘যদিও আমাদের উদ্দেশ্য মুসলমানরা আপোসে মারামারি করুক আর তাদের একটা দল আমাদের হাতের পুতুল হয়ে যাক, কিন্তু তার চেয়েও বড় উদ্দেশ্য আমাদের কঠিন ও জঘন্যতম দুশমন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিনাশ। আমরা চাই, তার পথে মুসলমানরাই প্রধান বাঁধা হয়ে থাক। তারাই তার শক্তি নষ্ট করুক। তাতে যদি আমাদের তল্পিবাহক মুসলমান শক্তি ধ্বংস হয়ে যায়, তাতেও আমার কোন দুঃখ থাকবে না। আমি চাই, তারা সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত করুক, আর এর জন্য যতদিন প্রয়োজন, তাদেরকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।‘

‘মুসলমান এলাকায় আমাদের প্রেরিত তাদের যে সব উপদেষ্টারা আছে, তাদের দেয়া রিপোর্টগুলো আমি আপনাকে শোনাতে চাই’। এক কমান্ডার বললো, ‘তারা রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সম্মিলিত মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ করার শক্তি ও মনোবল একেবারে নিঃশেষ করে দিয়েছে। ব্যাপক জীবনের ক্ষতি, অসংখ্য অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র ময়দানে ফেলে রেখে পালিয়ে এসেছে তারা। এ মুহূর্তে যুদ্ধ করার কোন অবস্থা ওদের নেই’।

‘আমি জানি’। বললো আরেক সম্রাট, ‘শুনেছি সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তুর্কমানের মনোরম অঞ্চলে ক্যাম্প করে বসে আছে। তারও এখন অভিযান শুরু করার মত অবস্থা নেই। আমাদের উপদেষ্টারা সম্মিলিত বাহিনীকে বুঝানোর চেষ্টা করছে, তারাই যেন আইয়ুবীকে আগে আক্রমণ করে। আমি আশা করি, তারা যদি দ্রুত সংগঠিত হয়ে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে অতর্কিত আক্রমণ করতে পারে, তবে এ ধাক্কায় আইয়ুবীর ধ্বংস অনিবার্য’।

‘যদি এ পদ্ধতি সফল না হয়’। আগাস্টাস বললো, ‘কারণ আইয়ুবী কখনো অসতর্ক থাকে না। তার গোয়েন্দা বাহিনী সব সময় চারদিকে সতর্ক ও সজাগ দৃষ্টি রাখছে। তার কাছে আক্রমণের খবর আসন্ন ঝড়ের সংবাদেরও আগে পৌঁছে যায়। আমাদের উপদেষ্টাদের বলা দরকার, তারা যেন সবকিছুর আগে গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করে। প্রয়োজনে তাদের সংখ্যা বাড়ানো হোক। তাদের ওপর হুকুম জারি করা হোক, যেন তারা সর্বত্র চরকির মত ঘুরে বেড়ায়। সংবাদ সংগ্রহ করা ছাড়াও তাদের কাজ হবে, আইয়ুবীর গোয়েন্দাদের খুঁজে বের করা এবং তাদের অপহরণ করা। সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমনের আগে এসব গোয়েন্দা ও কমান্ডোরা দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়বে। যেখানেই কোন সন্দেহজনক লোক পাবে, সাথে সাথে তাকে পাকড়াও করবে। এমনকি কোন পথচারীও এ অভিযানের খবর যেন আইয়ুবীকে পৌঁছাতে না পারে, সে জন্য দরকার হলে তাদেরও গ্রেফতার করবে’।

‘আপনি ঠিকই বলেছেন। সুলতান আইয়ুবী যেন আমাদের তৎপরতার কোন সংবাদ না পায়, সে ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। এ গোপনীয়তা বজায় রাখতে পারলেই কেবল সম্মিলিত মুসলিম বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ সফল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আরো একটি বিষয়, ওরা যেমন প্রতিপক্ষের রসদ ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য কমান্ডো অভিযান চালায়, সম্মিলিত বাহিনীকেও সেই পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। তারা আইয়ুবীর তাঁবুতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে সেখানে আগুন লাগিয়ে দেবে, অপ্রস্তুত সৈন্যদের হত্যা করবে নির্মমভাবে। সম্মিলিত বাহিনী হাত বাড়ালেই রসদ পাবে, কারণ তারা যুদ্ধ করছে নিজের দেশে, কিন্তু আইয়ুবীকে রসদ সংগ্রহ করতে হয় সুদূর কায়রো ও তার বিজিত অঞ্চল থেকে। তাই তাকে পরাজিত করার চাইতেও সম্মিলিত বাহিনীর নজর থাকবে তার রসদ ও অস্ত্র ভান্ডারের দিকে। এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে হবে, যাতে সে অসহায় হয়ে যায়’।

‘আমি আপনার কথার বিরোধিতা করছি না। তবে আমাদের জানা থাকা ভাল, এখন আর তাকে কায়রো থেকে রসদ আনতে হবে না। সংবাদ পেয়েছি, সুলতান আইয়ুবী বিজিত অঞ্চল থেকে সৈন্য ভর্তি শুরু করেছে। লোকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার সেনাদলে ভর্তি হচ্ছে। এ তথ্য সত্য হলে রসদ সে বিজিত অঞ্চল থেকেই সংগ্রহ করতে পারবে’।

এ কথা শুনে এক কমান্ডার বলে উঠল, ‘তার এ সৈন্য ভর্তির গতি বন্ধ করতে হবে। আর তার একটাই পথ, সেখানে যদি আক্রমণ করা। নইলে যত সময় পাবে ততই সে এ সুযোগ গ্রহণ করবে’।

‘আরো একটা পথ আছে’। বললো আরেক সেনাপতি, ‘এ সুযোগে আমাদের কিছু গোয়েন্দা ও কমান্ডোকে আইয়ুবীর বাহিনীতে ঢুকিয়ে দিতে হবে। তারা সেখানে কৌশলে ভীতি, সন্দেহ, সংশয়সহ নানা অপঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে পারবে। এতে আইয়ুবীর বাহিনীর মধ্যে যে অটুট দৃড়তা আছে তাতে ধ্বস নামবে’।

অগাস্টাস বললো, ‘আমি তোমাদের আরো একটি পথের সন্ধান দিতে পারি। সেখানে চরিত্র নষ্ট ও লোভ লালসার মিশন চালাতে হবে। মিশরে আমরা এ মিশনের আশাতীত সফলতা পেয়েছি’।

‘কিন্তু এ মিশন তো খুব বিপদজনক। আমাদের দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েদেরও হারানোর ভয় আছে। ধরা পড়লে ওরা কেউ জীবন নিয়ে ফিরতে পারবে না’।

‘ভয় আছে বলে কি আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো? যুদ্ধের সময় আমাদের সৈন্যরা মারা যায় না! আমরা তো তাদেরকে এ জন্যই লালন পালন ও প্রশিক্ষণ দেই, যাতে প্রয়োজনের সময় তারা আমাদের স্বার্থে জীবন বিলিয়ে দিতে পারে। এটুকু ঝুঁকি ও কোরবানী আমাদের অবশ্যই দিতে হবে’। অগাস্টাস বললো, ‘কয়েকটা মেয়ে কেন, ক্রুশের জন্য আমাদের নিজেদের জীবনও দান করতে হবে। প্রয়োজনে সন্তানদেরও জীবন দেয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। তারপরও মুসলমানদের চিন্তাধারা ও বিশ্বাসের ওপর আঘাত করতে হবে আমাদের’।

সম্রাট রিনাল্ট বললো, ‘আপনাদের প্রতিটি পরামর্শই যুক্তিযুক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। মিশরে তিনি তার ক্ষমতা দৃঢ় করে রেখেছেন। আবার এখানে এসেও ক্ষমতা বিস্তার করে চলেছেন। তার সফলতার মূল কারণ, তিনি অসাধারণ সমরনায়ক, রণাঙ্গনের কুশলী উস্তাদ। দ্বিতীয় কারণ, তিনি ত্বরিত ব্যবস্থাপনায় নিপূন, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসম্ভব দক্ষ। তৃতীয় মৌলিক কারণ হলো, তিনি তার সৈন্যদের মাঝে ইসলামী জাতীয়তাবোধ ও ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিতে সর্বাধিক সফল ব্যক্তিত্ব। আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা তাদের ঈমানী দায়িত্ব বা ধর্মীয় কর্তব্য মনে করে। ফলে তার কমান্ডোরা আমাদের ওপর নেকড়ে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ বিশ্বাস ও উন্মাদনা তাদের মধ্যে থেকে বিদায় করতে হবে।‘।

‘আমরা সব সময় ওদের এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছি। এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই আমরা ওদের মধ্যে পলায়নী মনোবৃত্তি ও বিলাসিতা ঢুকিয়ে দিয়েছি’।শাহ অগাস্টাস বললো, ‘যে মুসলমানের কাছে ধন-সম্পদ আছে সে আমীর হতে চায়। যে আমীর আছে সে বাদশাহ হতে চায়। আর এ লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সে তার আদর্শ ও বিশ্বাস জলাঞ্জলী দিতেও পিছপা হয়ে না। আমাদের কোন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের প্রয়োজন নেই’।

অন্য এক সেনাপতি বললো, ‘আমাদের আরেকটি মিশন চালু করতে হবে। সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রপাগান্ডা ও ঘৃণা ছড়াতে হবে। তার এমন সব দুর্ণাম ছড়াতে হবে, যা শোনা মাত্রই মানুষের মধ্যে ঘৃণার উদ্রেক হয়। এ কাজ আমরা করতে পারবো না, বরং মুসলমানের কারো মুখ দিয়ে এ অপবাদ ছড়াতে হবে’।

‘হ্যাঁ, এ অপবাদ আরোপও ফলপ্রসু ভূমিকা রাখবে। সবাই বিশ্বাস না করলেও কিছু লোক তো বিভ্রান্ত হবে! বাকীরাও সন্দেহের ঘোরে পড়বে’।

‘এ সময় নিজেদের যুদ্ধ প্রস্তুতিও অব্যাহত রাখতে হবে’। এক কমান্ডার বললো।

সম্রাট অগাস্টাস বললো, ‘সে তো অব্যাহত আছেই। তোমাদের প্রস্তুতির জন্য তো অনেক সময় পাইয়ে দিলাম। আমি যদি কৌশল করে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষমতা ও  কর্তৃত্বের লোভ এবং লালসার ব্যাধি প্রবেশ করিয়ে না দিতাম এবং তারা একে অপরের সাথে সংঘাতে লিপ্ত না হতো, তবে এতদিনে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ফিলিস্তিনে থাকতো। আমরা মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্ব করে তাদের জাতিকেই তাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি’।

‘কিন্তু আমি বিস্মিত এ জন্য যে, সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা যেমন মুসলমান, আমাদের মিত্র বাহিনীর সৈনিকরাও তেমনি মুসলমান। কিন্তু আইয়ুবীর সৈন্য একজন দশজনের সমান ভারী হয়ে দেখা দেয়।‘ সম্রাট রিমান্ড বললো, ‘এরাও তো একসময় সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য দলেই ছিল। তাহলে এখন কেন সবাই পালিয়ে যায়! কেন সুলতান বাহিনীর কাছে মার খেয়ে পরাজিত হতে হয়ে ওদের!’

‘এটা বিশ্বাস ও আদর্শের কেরামত, যাকে মুসলমানরা ঈমান বলে’। সম্রাট রিনাল্ট বললো, ‘যে সৈন্য বা সেনাপতি তার এ ঈমানকে নিলামে বিক্রি করে দেয়, তার আর যুদ্ধ করার মনোবল থাকে না। তার কাছে তখন পরিশ্রমের মূল্য ও জীবনটাই প্রিয় হয়ে উঠে। এ জন্যই আমাদের মিশনারী তৎপরতা জোরদার করা প্রয়োজন। মুসলমানদের মধ্যে যৌন উন্মাদনা ও নেশার অভ্যাস গড়ে তোল, তখন আর তাদের সৈন্য ও ঘোড়া ধ্বংস করার প্রয়োজন থাকবে না’।

এ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, ‘তিন মুসলমান আমীরকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের সম্মিলিত বাহিনীকে আবার আইয়ুবীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিতে হবে। তাদেরকে একক কমান্ডের অধীনে যুদ্ধ করতে বাধ্য করতে হবে। যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সব রকম সাহায্য জরুরী ভিত্তিতে প্রদান করতে হবে। তাদেরকে এক কমান্ডে রাখা হবে ঠিকই, কিন্তু তাদের মধ্যে এমন কিছু মত পার্থক্য ও বিভেদ জিইয়ে রাখা হবে, যেন প্রয়োজনের সময় আবার তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়।

রাতের প্রথম প্রহর অতীত হয়ে গেছে। গভীর নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে হারেসদের গ্রাম। বাড়ীর পেছনের আস্তাবল থেকে তিনটি ঘোড়া বের করা হলো। একটির উপর আমীর সাইফুদ্দিন গাজী, দ্বিতীয়টির ওপর হারেস ও তৃতীয়টির ওপর চড়ে বসলো দাউদ। দাউদ ও হারেস দু’জনের হাতেই বর্শা। বর্শা তারা ফৌজি কায়দায় সমুন্নত করে রেখেছে।

তাদেরকে বিদায় জানাতে হারেসের বাবা, বোন ও স্ত্রী দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো। ফৌজির বাবার হাতে মশাল। সাইফুদ্দিন তাকিয়েছিল ফৌজির দিকে। ফৌজি অপলক দৃষ্টিতে দেখছিল দাউদকে।

রওনা করলো ওরা। দরজায় দাঁড়িয়ে ফৌজি, তার ভাবী ও বাবা একসঙ্গে বলে উঠলো, ‘খোদা হাফেজ!’

‘খোদা হাফেজ!’ বলে ওরাও ঘোড়ার পাছায় লাথি কষলো।

দেখতে দেখতে তিন অশ্বারোহী রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। ফৌজি দরজায় দাঁড়িয়ে তাদের অশ্বখুরধ্বনি শুনতে লাগলো। শব্দ যত দূরে যেতে লাগলো, ফৌজির কানে দাউদের বলা কথাগুলো আর উচ্চ থেকে উচ্চতর হতে লাগলো। তার কানে বাজতে লাগলো, ‘সত্য পথের সৈনিক ও যাত্রীদের বিবাহ উৎসব হয় আকাশে। তাদের বরযাত্রীরা পথ চলে ধুমকেতুর রাস্তা ধরে। আকাশের তারকারাজি তো সেই উৎসব-আনন্দেই হেসে উঠে আলো ছড়ায়!’

সে যখন ভেতরে গিয়ে ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়লো, তার কানে দাউদের সেই শব্দ তখনো গুঞ্জন করে ফিরতে লাগলো। শুয়ে শুয়ে সে দাউদের কথাই ভাবছিল। সহসা তার মনে হলো, ‘আচ্ছা, আমি কি সত্যি দাউদকে ভালবেসে ফেলেছি। সেও কি ভালবাসে আমাকে। ও কি আমাকে বিয়ে করবে?’ বিয়ের কথা মনে হতেই একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরলো তাকে।

তার মনে আবার উদয় হলো দাউদের কথা। দাউদের সকালের বেলা প্রতিটি কথা তার অন্তরে যেন গুঞ্জন করতে লাগলো। মনে হলো দাউদ তাকে বলছে, ‘সামনে প্রবাহিত হচ্ছে রক্তের নদী। এ নদীতে কোন সাঁকো নেই। আমাকে এ নদী পার হতে হবে সাঁতরে। যদি তুমি আমার চির সঙ্গী হতে চাও, তবে আমাদের কাবিননামা লিখতে হবে রক্তের কালিতে’।

এ কথা মনে হতেই তার মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিয়ে উঠলো। মনে হলো সে রক্তের প্রবাহিত স্রোতের ওপর শুয়ে আছে। বিয়ের চিন্তা তার মাথা থেকে দূর হয়ে গেল। মনে হলো, এতক্ষণ ধরে একটা অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে ভাবছে সে। মুজাহিদের চোখের সামনে কখনো বিয়ের দুলহীন থাকে না। তার সামনে থাকে দুশমনের নেযা ও তলোয়ার। থাকে রক্তাক্ত বর্শার ফলা, ছুটন্ত তীরের শনশন আওয়াজ।

সাইফুদ্দিন ও তার রক্ষীরা বাড়ী থেকে বেরিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেল। তারপর এক পাহাড়ের পাদদেশে নিরিবিলি জায়গা দেখে ক্যাম্প করে বাকী রাতটুকু তারা সেখানেই কাটিয়ে দিল। যখন সকাল হলো, সাইফুদ্দিন বললো, ‘চলো, আবার রওনা করা যাক’।

ওরা আবার পথে নামলো। আগে চলতে লাগলো সাইফুদ্দিন। দাউদ ও হারেস বেশ কিছুটা দুরত্ব রেখে পেছনে যাচ্ছিল। ওরা কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে। সাইফুদ্দিন্র কানে গিয়ে পৌঁছতে পারছিল না তাদের কোন কথা। উল্টো বাতাস ও ঘোড়ার পদ শব্দের আড়ালে সব হারিয়ে যাচ্ছিল।

‘জানি না তুমি কেন আমাকে বাঁধা দিচ্ছ?’ হারেস বিরক্ত হয়ে বললো, ‘এখানে তাকে হত্যা করে তার লাশ কোথাও গোপন কর দিলে কে আমাদের সন্দেহ করবে?’

‘তাকে মেরে আমি তার পুরো বাহিনীকে বাঁচিয়ে দিতে চাই না। বরং তাকে জীবিত রেখে আমি তার সমগ্র বাহিনীকে ধরতে চাই’। দাউদ বললো, ‘একে হত্যা করতে তার বাহিনীর কমান্ড অন্যজন গ্রহণ করবে। তার মত তারাও আবার খৃস্টানদের পোষা কুকুর হয়ে কামড়াতে আসবে আমাদের। তুমি নিজেকে একটু নিয়ন্ত্রণে রাখো, সময় মত তার ফয়সালা  আমরা অবশ্যই করবো’।

দুপুরের আগেই তাদের চোখে হলবের মিনার ভেসে উঠলো। হলবের অদূরেই আল মুবারকের সবুজ প্রান্তর, প্রান্তরের পাশে প্রাকৃতিক স্রোতস্বিনী ঝর্ণধারা।

ওরা ঝর্ণাধারার কাছে পৌঁছলো। সাইফুদ্দিনের সেই কমান্ডার যাকে চিঠি দিয়ে আগেই আল মালেকুস সালেহের কাছে পাঠানো হয়েছি, দৌড়ে এসে বললো, ‘আল মালেকুস সালেহ আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন’।

সাইফুদ্দিন আল-মুবারকের সবুজ প্রান্তরে প্রবেশ করলো। আল মালেকুস সালেহের দুই সেনাপতি তাকে স্বাগত জানিয়ে সামরিক কায়দায় স্যালুট করলো। সাইফুদ্দিন তাদের বললো, ‘আমি এ ঝর্ণাধারার পাশেই ক্যাম্প করতে চাই’।

সাইফুদ্দিনের ইচ্ছামত সেখানেই তার ক্যাম্প স্থাপন করলো হারেস ও দাউদ। কিন্তু সাইফুদ্দিন কেন আল মালেকুস সালেহের মহলে যাওয়া পছন্দ করেনি এর কোন কারণ আজো ইতিহাস বলতে পারেনি।

দাউদ ও হারেস তার সংগেই রইলো। তাদের জন্য মহল থেকে এলো উন্নতমানের খাবার ও প্রশস্ত তাঁবু। মহলের চাকর-বাকর খানসামারাও এসে গেল তার সেবায়। মহলের মত করে সাজানো হলো তাবু। আল মালেকুস সালেহ তাকে কেল্লার ভেতর নৈশ ভোজের আমন্ত্রণ জানালো। রাতের খাবারের পর সেখানেই সাক্ষাতের ব্যবস্থা হলো আইয়ুবী বিরোধী জোটের দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে।

সন্ধ্যা। সাইফুদ্দিন তার ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে রওনা হলো আল মালেকুস সালেহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। আল মালেকুস সালেহ মহল থেকে বাইরে এসে সাইফুদ্দিনকে অভ্যর্থনা জানালো। সাইফুদ্দিন অল্প বয়সী শাহজাদাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর দু’জনের  মধ্যে কি কথা হলো সে খবর তারা দু’জন ছাড়া বাইরের আর কেউ জানতে পারলো না।

তবে দু’জন বর্ণনাকারী লিখেছে, সাক্ষাতের সময় কোলাকুলির পর সাইফুদ্দিন প্রথম কথা বললো তার চিঠি প্রসঙ্গে। বললো, ‘তুমি আমার চিঠির উত্তর দাওনি কেন?’

আল মালেকুস সালেহ বিস্মিত হয়ে বললো, ‘কি বলছেন আপনি! আপনার চিঠি পাওয়ার পরের দিনই তো আমি লিখিতভাবে তার জবাব দিয়েছি! তাতে আমি স্পষ্ট করে লিখেছিলাম, ‘চুক্তি নিয়ে আপনি কোন চিন্তা করবেন না।

আমি তো সন্ধি করেছি একটু প্রস্তুতির সুযোগ নেয়ার জন্য। চুক্তির মাধ্যমে আমি সুলতান আইয়ুবীকে প্রতারণা জালে জড়িয়েছি মাত্র’।

‘তোমার কোন চিঠিই আমি পাইনি’। সাইফুদ্দিন বললো, ‘আমি তো এ নিয়ে দারুণ পেরেশানীতে ছিলাম। ভেবেছিলাম, তুমি একটু মারাত্মক ভুল করে বসেছো। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে চুক্তি করে ধোঁকা দিয়েছো আমাদের’।

একথায় আল মালেকুস সালেহের বিস্ময় রূপান্তরিত হলো পেরেশানীতে। সঙ্গে সঙ্গে সালেহ তার এক সেনাপতি ডাকলো। বললো, ‘গোয়েন্দা প্রধানকে এখনি আমার সাথে দেখা করতে বলো’।

তলব পেয়ে ছুটে এলো গোয়েন্দা প্রধান। সালেহ বললো, ‘উনার চিঠির জবাবে আমি যে পত্র দিয়েছিলাম, সেটা কাকে দিয়ে পাঠিয়েছো! সে কাসেদ কি ফিরে এসেছে?’

গোয়েন্দা প্রধান ফিরে গেল কাসেদের সন্ধান নিতে। একটু পর হন্দদন্ত হয়ে ফিরে এলো, তার চেহারায় উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। সালেহ বললো, ‘কি ব্যাপার!’

‘যে কাসেদকে চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছিলাম, সে আর ফিরে আসেনি। রেকর্ড খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, তার কোন ঠিকানাও আমাদের দপ্তরে জমা নেই’।

স্বাভাবিকভাবেই এ সংবাদের পর সেখানে এক হুলস্থুল কান্ড ঘটে গেল। কাসেদের আর কোন পাত্তাই পাওয়া গেল না। কেউ বলতেও পারলো না, সে কোথাকার লোক। সে যেখানে থাকতো, সেখানে তার বিছানাপত্র পড়ে আছে কিন্তু সে কোথাও নেই।

এ ঘটনার পর সবাই ধারণা করতে বাধ্য হলো, সে নিশ্চয়ই সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কোন গোয়েন্দা ছিল। এমন গুরুত্বপূর্ণ চিঠি শেষ পর্যন্ত সুলতান আইয়ুবীর হাতে গিয়ে পড়লো!

এ ঘটনা যখন খৃস্টান উপদেষ্টার কানে গেল, তারাও বললো, ‘কাসেদ সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা ও কমান্ডো ছিল। অথবা এমনও হতে পারে, কাসেদ চিঠি নিয়ে সাইফুদ্দিনের কাছে যাওয়ার পথে সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডোরা তাকে ধরে চিঠি কেড়ে নিয়ে তাকে হত্যা করেছে। এতে তাদের বুঝতে বাকী রইলো না, সুলতান আইয়ুবী তাঁর প্রস্তুতি আরো ত্বরান্বিত করবে। এমনও হতে পারে, তাদের আগেই তিনি আক্রমণ করে বসবেন।

সালেহ সাইফুদ্দিনের উপস্থিতিতেই গুমাস্তগীন ও খৃস্টান উপদেষ্টাদের ডেকে পাঠালেন। সবকিছু বিবেচনার পর সিদ্ধান্ত হলো, জলদি তিন বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ করে সুলতান আইয়ুবীর ওপর চড়াও হতে হবে। খৃস্টানরা তো এটাই চাচ্ছিল। তারা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ চালু রাখতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে মুশেল ও হারানে চিঠি পাঠানো হলো। চিঠিতে বলা হলো, ‘পত্র পাওয়ার সঙ্গে সংগেই যেন সেখানকার সৈন্যরা হলব অভিমুখে যাত্রা করে। তারা যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায়ই রওনা করতে হবে, প্রস্তুতির জন্য সময় নেয়া যাবে না’।

বিশ্বস্ত কাসেদদের হাতে চিঠি দিয়ে বলা হলো, ‘তোমরা এ চিঠি অনতিবিলম্বে হলব ও হারানে পৌছে দেবে’।

হারানের আমীর গুমাস্তগীন ভেতর ভেতর ইতস্ততঃ করছিল, কিন্তু সবার মাঝে বসে বিরোধিতা করার সাহস পেলো না। বৈঠকে এ সিদ্ধান্তও নেয়া হলো, ‘তিনটি সেনা দলই একক হাইকমান্ডের অধীনে থাকবে আর এর সুপ্রিম কমান্ডে থাকবে সাইফুদ্দিন গাজী’।

গুমাস্তগীন তার বাহিনী হাইকমান্ডে যুক্ত করলো বটে তবে নিজে সাইফুদ্দিনের অধীনে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে বসলো। বললো, ‘সম্মিলিত সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি আমার বাহিনী আমীর সাইফুদ্দিনের হাওলা করে দেবো। তবে আমি নিজে কারো অধীনে যুদ্ধ করতে পারবো না। এ অবস্থায় আমাকে অভিযান থেকে নিস্কৃতি দিয়ে হলবে থাকার অনুমতি দিতে হবে।‘ বৈঠক গুমাস্তগীনের এ অযাচিত আবদারও মেনে নিল। কয়েদ দিনের মধ্যেই তিনটি সেনাদল হলবে সম্মিলিত হলো। খৃস্টানরা তাদেরকে সব রকম যুদ্ধাস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জাম পাঠিয়ে দিল। তারা আরো সাহায্য দেয়ার অঙ্গীকার করে সৈন্যদলকে অভিযানে বেরিয়ে পড়ার তাগাদা দিল।

অতর্কিত আক্রমণের প্লান নিয়ে বেরিয়ে পড়লো তিন বাহিনী। অভিযানের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য সর্বাত্মক সতর্কতা অবলম্বন করা হলো। রাতের বেলা পথ চলতো, দিনে কোথাও গোপন স্থানে ক্যাম্প করে বিশ্রাম নিত। এ ছাড়া গোয়েন্দা ও কমান্ডোদের রাস্তার ডান ও বামে ছড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, ‘কোন মুসাফির চোখে পড়লে তাকে ধরে নিয়ে হলবে পাঠিয়ে দেবে’।

অভিযান নিয়ে বেরোনোর আগে সাইফুদ্দিন দাউদ ও হারেসকে কাছে ডাকলো। তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে বললো, ‘নিদারুন বিপদের সময় তোমরা আমাদের সঙ্গ দিয়েছো। তোমরা যে উপকার করেছো সে কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। যুদ্ধের পর ফিরে আমার প্রথম কাজ হতে তোমাদের পদোন্নতি ও পুরষ্কার দেয়া’।

একটু চুপ থেকে কথা গুছিয়ে নিয়ে হারেসকে আবার বললো, ‘তোমার বোনের জন্য আমার মাথার ওপর এক বোঝা চেপে আছে। আমি তার সামনে তখন যাবো, যখন আমি ওয়াদা পূর্ণ করে তার সামনে যাবার যোগ্য হবো”।

হারেসকে এ কথা শুনে বিস্মিত হতে দেখে সাইফুদ্দিন বললো, ‘ফৌজি বলেছিল, সুলতান আইয়ুবীর তলোয়ার নিয়ে তার অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে যখন তার সামনে যাবো তখন সে আমার সাথে যাবে। হারেস! আমি জয় লাভ করে ফিরে এলে, তোমার বোন মুশেলের রানী হবে’।

‘ইনশাআল্লাহ!’ হারেস বললো, ‘আমরা আপনাকে বিজয়ী করে আনবো। তিন বাহিনী কি তবে এক সাথেই যাচ্ছে?’

‘হ্যাঁ!’ সাইফুদ্দিন উত্তর দিলো, ‘আর আমি তিন বাহিনীর হেড অব কমান্ড’।

 ‘জিন্দাবাদ!’ দাউদ খুশী প্রকাশ করে বললো, ‘এখন তো সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পালানোর পালা’।

দাউদ ও হারেস তাকে উৎসাহিত করার জন্য খুব আবেগের সাথে ফৌজির কথা বার বার বলে তার প্ল্যানের নকশাও জেনে নিতে লাগলো। সাইফুদ্দিন কিভাবে অভিযান চালাবে প্রশ্ন করে তার খুঁটিনাটি জেনে নিল।

‘তোমরা এখন দু’জনই তোমাদের নিজ নিজ ব্যাটেলিয়ানে চলে যাও’। সাইফুদ্দিন বললো, ‘এখন আমার রক্ষী দল এসে গেছে। আবারও বলছি, আমি তোমাদের দু’জনকে চিরকাল মনে রাখবো’।

তিনটি বাহিনী একত্রিত হয়ে রাতের অন্ধকারে যাত্রা করলো। দাউদ ও হারেস মুশেলের সেনাবাহিনীর একটি দলে ঢুকে পড়লো। হারেসকে সিপাইরা চিনতো। কারন সে ওদের দলেরই ছিল। দাউদ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে হারেস বললো, ‘মুশেলের আমীর তাকে আমার সঙ্গে পাঠিয়েছে। সে অন্য ব্যাটেলিয়ানে ছিল, এখন এখানে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন আমীর’।

ফলে দাউদের পরিচয় নিয়ে কেউ আর প্রশ্ন তুলল না।

তিনটি বাহিনী সতর্কতার সাথে পথ চলতে লাগলো। মধ্যরাত। বাহিনী একটি পাহাড়ী এলাকায় এসে পড়লো। পাহাড়ের সংকীর্ণ পথে সৈনিকদের লাইন ঠিক রাখা সম্ভব হল না। লাইন এলোমেলো হয়ে যেতেই দাউদ হারেসকে বললো, ‘জলদি এখান থেকে বের হও। পালাবার এটাই উত্তম সময়!’

রাতের অন্ধকার  ও এলোমেলো কাফেলার সুযোগে দু’জন তাদের ঘোড়াকে ধীরে ধীরে একদিকে সরিয়ে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাহিনী থেকে দূরে সরে গেল ওরা। দাউদ হারেসকে বললো, ‘ভোর হলেই সম্মিলিত বাহিনী কোথাও ক্যাম্প করে রাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে। দিনে ওরা পথ চলবে না। আমরা সারাদিন পথ চললে রাতের মধ্যে তুর্কমান পৌঁছে যেতে পারবো। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে আসন্ন হামলার খবর আমরা একদিন আগেই পৌঁছে দিতে পারবো। তখন সুলতান আইয়ুবী বুঝবেন, কিভাবে শত্রুদের স্বাগত জানালে উত্তম হবে’।

দাউদ তার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিল। তার পরিপূর্ণ ভরসা ও আশা ছিল, এ অভিযানে সে অবশ্যই সফল হবে। কিন্তু তার জানা ছিল না, আশেপাশের এলাকাগুলোতে সম্মিলিত বাহিনীর অজস্র গোয়েন্দা ও কমান্ডোরা ছড়িয়ে আছে।

তারা দু’জনই বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ডান দিকে বহু দূর চলে এসেছিল। যখন বুঝলো, তারা নিরাপদ স্থানে চলে এসেছে, তখন তারা দিক পরিবর্তন করে তুর্কমানের রাস্তা ধরলো।

এতক্ষণ তারা হালকা গতিতে পথ চলছিল, এবার অশ্বের গতি কিছুটা দ্রুততর করলো। হারেস বললো, ‘গতি খুব দ্রুত করো না,কারণ আমাদের অবিরাম পথ চলতে হবে। ঘোড়াকে বেশী ক্লান্ত ও দুর্বল করা যাবে না’। দাউদও তার সাথে একমত হলো এবং বিরতিহীনভাবে মধ্যম গতিতে এগিয়ে চললো। সারা রাত এভাবেই পথ চললো তারা। আসতে আস্তে রাতে অন্ধকার ফিঁকে হয়ে এলো। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়লো পাহাড়ী রাস্তায়।

দাউদ ঘোড়া থেকে নেমে পাহাড়ের এক উঁচু চূড়ায় উঠে গেল। নিচে ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো হারেস। দাউদ চারদিকে দৃষ্টি বুলালো। কোথাও কোন জনমানব নেই। রাস্তায় কোন পথিক বা কাফেলা নেই। পেছনে অনেক দূরে ধুলোর আবছা মেঘ দেখা যাচ্ছ। এ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না তার। ধূলোর মেঘ দেখে আশ্বস্ত হলো সে, বাহিনী এখনো পথ চলছে ঠিকই, তবে তারা অনেক দূরে এবং একটু পরই তারা কোথাও লুকিয়ে পড়বে। ফলে অগ্রযাত্রা থেকে যাবে তাদের। কিন্তু হারেস ও দাউদ কোথাও থামবে না, ফলে বাহিনীর অনেক আগেই তারা তুর্কমান পৌঁছে যেতে পারবে।

কিন্তু তার জানা ছিল না, দুশমন গোয়েন্দা জালের মত ছড়িয়ে আছে তার চলার পথে। সে নিচে নেমে এলো। ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে দু’জনই আবার আগের গতিতে চলতে শুরু করলো।

অঞ্চলটি ছিল বালি ও পাথরে ভরা। কোথাও কোন সবুজ নেই, ঘাস বা বৃক্ষ নেই। নিরেট দুর্গম পাথুরে ভূমি।

দু’জন টিলার মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। সামনে একটা মোড়। ওরা মোড়ের কাছে পৌঁছে যেই ঘোড়ার মুখ ঘুরালো, চারজন অশ্বারোহী বর্শা হাতে ওদের পথ রোধ করে দাঁড়ালো।

 ‘অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নামো’। এক অশ্বারোহী গম্ভীর কন্ঠে হুকুম করলো, ‘আগে বলো, তোমরা কারা, কোত্থেকে এসেছো এবং কোথায় যাচ্ছো!’

‘আমরা মুসাফির!’ ঘোড়া থেকে না নেমেই বললো দাউদ।

‘মুসাফির মুশেলের সেনা পোষাকে কোথাও যেতে পারে না’। অশ্বারোহী বললো, ‘মুসাফিরের হাতে সেনাবাহিনীর অস্ত্র থাকে না, যেমন তোমাদের হাতে আছে। তোমরা যে কেউ হওনা কেন, তোমাদের হলব ফিরে যেতে হবে। আমরা তোমাদের আর এক কদমও সামনে বাড়তে দেবো না।‘

এরা ছিল হলবের চার কমান্ডো। রাস্তায় সন্দেহজনক ব্যক্তি পেলে তাদেরকে ধরে হলবে নিয়ে যাওয়ার হুকুম ছিল ওদের ওপর। হলব থেকে তুর্কমান পর্যন্ত পুরো পথেই ছড়িয়ে ছিল এই কমান্ডো ও গোয়েন্দা বাহিনী।

অশ্বারোহী চারজন ওদের দু’জনকে ঘিরে ফেললো। দাউদ হারেসকে আস্তে করে বললো, ‘সময় হয়ে গেছে ভাই’।

হারেস তার ঘোড়ার লাগাম ঝটকা মেরে টেনে ধরলো। ঘোড়া সামনের পা শূন্যে তুলে লাফিয়ে উঠলো। পা নামাতেই তীরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল হারেস।

তার আগেই, ঘোড়া যখন লাফিয়ে উঠেছিল, হারেস সঙ্গে সঙ্গে সামনের লোকটির বুকে বর্শা দিয়ে আঘাত করলো। আঘাতের ধকল সইতে না পেরে লোকটি নিচে পড়ে গেল। কিন্তু তার বাম পাশের লোকটি ততক্ষণে বর্শা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হারেসের ওপর। লোকটির বর্শা বিদ্ধ হলো হারেসের কাঁধে। হারেস জবাবী হামলা করার পরিবর্তে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

দাউক ছিল কমান্ডো যোদ্ধা। এ ধরনের পরস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে আত্মরক্ষার কৌশল জানা ছিল তার। সে তার ঘোড়া ছুটানোর সাথে সাথে প্রতিপক্ষের একজনকে পিছন থেকে ছোঁ মেরে উঠিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো ঘোড়ার সামনে। লোকটির দেহ পিষ্ট হয়ে গেলো ঘোড়ার পদতলে। হামলাকারীরা ছিল চারজন, দু’জন এরই মধ্যে ধরাশায়ী হলেও বাকী দু’জন ছিল অক্ষত। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়েই ওরা ধাওয়া করে ছুটিল ওদের পেছনে।

হারেস ছিল আহত। সে ঠিকমত ঘোড়া ছুটাতে পারছিল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই ওদের ধরে ফেললো ধাওয়াকারীরা।

এ স্থানটা ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধ করার উপযুক্ত ছিল না। দু’দিকেই ছিল উঁচু টিলা। ঘোড়া লাফাতে ও চিৎকার করতে লাগলো। বর্শার সাথে বর্শার ঘর্ষণের কর্কশ আওয়াজ আচ্ছন্ন করে ফেলল হারেসকে। বেশীক্ষণ সে ওদের প্রতিরোধ করতে পারলো না। উপর্যুপুরি বর্শার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে হারেস অশ্বপৃষ্ঠ থেকে পড়ে গেল।

দাউদও এর মধ্যে আহত হয়েছে, আহত হয়েছে তার প্রতিপক্ষও।হারেস পড়ে যেতেই তার আহত প্রতিপক্ষ দাউদের দিকে ফিরল। লড়াইয়ের অবস্থা তাদের অনুকূলে বুঝতে পেরে ছুটলো তাদের দিকে। ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য জ্ঞান হারিয়েছিল হারেস। হুশ ফিরতেই দেখলো, যে বর্শাধারী তাকে আহত করেছিল, সে তাকে মৃত ভেবে এবার ছুটে যাচ্ছে দাউদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে যেন খোদায়ী শক্তি ভর করলো। সে তার বর্শাটি কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারলো ছুটন্ত দুশমনের দিকে। পথের মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল লোকটি, আর উঠতে পারল না।

তখনো লড়াই হচ্ছে দাউদ ও তার প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে। দু’জনের অবস্থাই গুরুতর। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত উভয়ের দেহ। আরেকজনকে আঘাত করে চলেছে, কিন্তু সে আঘাতের সুষ্পষ্ট টার্গেট কেউ ঠিক রাখতে পারছে না। এলোমেলোভাবে যেন অভ্যাসের বশে একজন আরেকজনকে আঘাত করে চলেছে। দাউদের ঠিক মনে নেই এরপর কি ঘটেছিল। যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলো ছয়টি আহত ঘোড়া পাহাড়ের সংকীর্ণ কুচিতে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের আরোহীদের রক্তাক্ত নিথর দেহগুলো পড়ে আছে পাথুরে মাটির ওপর।

দাউদ উঠে বসলো। লম্বা করে দম নিল কয়েকবার। ক্ষত থেকে তখনো গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। সে খঞ্জর বের করে জামা ছিঁড়ে কয়েক জায়গায় ব্যান্ডেজ করলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল ঘোড়ার দিকে। উঠে বসলো ঘোড়ার পিঠে।

যুদ্ধ শেষ। আহত রক্তাক্ত দাউদ তুর্কমানের পরিবর্তে হারেসের বাড়ীর দিকে যাত্রা করলো।

হারেসকে একনজর কাছে গিয়ে দেখার কথাও মনে এলো না তার। সে ধরেই নিয়েছিল, তার কমান্ডোর মত হারেসও মারা গেছে। হয়তো একটু পর সে নিজেও মারা যাবে।

তখনি তার মনে পড়লো, দুশমন এসে পড়ার আগেই সুলতানের কাছে খবর পৌঁছানো দরকার। আর এ খবর পৌঁছাতে হতে তাকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে।

তার শরীর থেকে এত বেশী রক্ত ঝরে গিয়েছিল যে, ঘোড়ার জ্বীন ও পিঠ ভিজে গিয়েছিল। সে অনুমান করে দেখলো, তুর্কমান অনেক দূর। তারচে হারেসের গ্রাম অনেক কাছে। তার লক্ষ্য হারেসের বাবা। একবার ওখানে পৌঁছতে পারলে নিশ্চয়ই বৃদ্ধ তার শহীদ সন্তানের আত্মার শান্তির জন্য তুর্কমান ছুটে গিয়ে সুলতান আইয়ুবীকে সংবাদ দিতে রাজি হবে।

সে প্রানপণে ঘোড়া ছুটাচ্ছিল। ঘোড়ার দোলা ও ঝাঁকিতে রক্ত ঝরা বেড়ে যাচ্ছিল। পিপাসায় শুকিয়ে আসছিল তার কন্ঠ। চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল। একটু পর পর সে মাথা ঝাঁকি দিয়ে চেতনা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল। সে পথ চলছিল আর কোরআনের আয়াত পাঠ করছিল। মাঝে মাঝে কোরআন তেলাওয়াত বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছিল, ‘হে আকাশ ও মাটির মালিক, দোহাই তোমার রাসূলের, তুমি আমাকে আর সামান্য কিছু সময় বেঁচে থাকার সুযোগ দান করো’।

ঘোড়া দ্রুত তালে দৌঁড়ে চলেছে। দাউদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে উঠলো। সে অনুভব করলো, মৃত্যু তার একদম কাছে চলে এসেছে। তার সর্ব শরীর নিঃসাড় হয়ে যাচ্ছিল। বার বার মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে কোন রকমে নিজেকে সামলিয়ে নিচ্ছিল।

সে অনুভব করলো, হারেসদের বাড়ী আর বেশী দূরে নেই। কিন্তু সে আর অশ্বপৃষ্ঠে বসে থাকতে পারছিল না। সে ঘোড়ার পিঠে শুয়ে পড়লো, খামছে ধরলো ঘোড়ার পশম।

এভাবে এগিয়ে গেলো আরো কিছু পথ। ঘুমে জড়িয়ে এলো চোখ দুটো। নিজকে সামলে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করলো দাউদ, কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারলো না। এক সময় সে পায়ের তলায় মাটি অনুভব করলো। ধীরে ধীরে সুপ্তির অতলে হারিয়ে গেল সে, জ্ঞান হারালো দাউদ।

তার যখন হুশ হলো, অনুভব করলো, কেউ একজন তাকে ধরে রেখেছে। নিশ্চয়ই এখন রাত, অন্ধকার দূর করার জন্য পাশেই মশাল জ্বলছে।

সে নিজেকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করলো। তার কানে ভেসে এলো নারী কন্ঠের আওয়াজ, ‘দাউদ তুমি বাড়ীতে, ভয় পেওনা!’

নারী কন্ঠটি চিনতে পারলো দাউদ। এ যে ফৌজির কন্ঠ! সে অজ্ঞান অবস্থায় তাহলে এখানে এসে পৌঁছে গিয়েছিল! আল্লাহর দরবারে তার ফরিয়াদ তাহলে বৃথা যায়নি!

‘বাবা কোথায়?’ শুয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করলো দাউদ।

‘তিনি বাইরে গেছেন!’ ফৌজি বললো।

‘কখন ফিরবেন?’ দাউদের কন্ঠে অস্থিরতা।

 ‘তিনি কাল অথবা পরশু আসবেন’।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 5 | 6 | 7 | 8 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top