১৬. টার্গেট ফিলিস্তিন

–  আমীরে মুশেল সাইফুদ্দিন গাজী।

ভোর রাতে কমান্ডারকে ডেকে তুলে সাইফুদ্দিন গাজী বললো, ‘তোমাকে এ অন্ধকারের মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে। তোমাকে যেন গ্রামের কোন লোক দেখতে না পায় সে জন্যই এ সতর্কতা। যত দ্রুত পারো এ চিঠি হলবে পৌছবে এবং সরাসরি সালেহের হাতে এ চিঠি দেবে’।

সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডার সে চিঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। এ চিঠির জবাবই ভাগ্যক্রমে পড়েছিল সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর হাতে। কিন্তু এ চিঠিতে কি লেখা হয়েছে জানতে পারলো না ফৌজি। আর ফৌজির না জানার কারণে তা জানতে পারলো না দাউদ বা হারেস,কেউ। ফৌজি যে সব আলোচনা শুনেছিল সবই দাউদকে বলে দিয়েছিল। তথ্যগুলো খুব কাজেরও ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত তারা এইসব নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সকালে ফজর নামাজের পর হারেস ও তার বাবা ঘুমিয়ে গিয়েছিল। দাউদ বাড়ীর পেছন দিক দিয়ে ভোরের মুক্ত হাওয়া সেবনের জন্য একটু বাইরে বেরিয়ে এলো। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দাঁড়ালো তার ঘোড়ার কাছে। ফৌজিও আলতো পায়ে বেরিয়ে এলো তার পেছন পেছন।

‘তুমি এর চেয়ে বড় কাজ আমাকে বলো’। ফৌজি বললো, ‘আমি তোমার জন্য আমার জীবনও দিয়ে দিতে পারি’।

‘আমার জন্য নয়। প্রাণ দেবে তোমার জাতির জন্য, তোমার ধর্মের জন্য’। দাউদ বললো, ‘তুমি যে কাজ করছো, এটাও অনেক বড় কাজ। আমরা যারা গোয়েন্দা, এ কাজের মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের জীবন কোরবানী করি। এটাই এখন আমার কাছে সবচে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, এটাই আমার দায়িত্ব। আমার এ কাজ আমি তোমাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছি। এতে তোমাকে কিন্তু অনেক বড় বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে’।

‘বিপদ কেমন?’

‘ এ কাজটাই বিপদজনক। তুমি যে তথ্য পাচার করছো তা জানতে পারলে তোমার খুব বিপদ হবে’ দাউদ বললো, ‘সাইফুদ্দিন একজন বাদশাহ। এই কুটিরেও তিনি বাদশাহই আছেন’। ‘তাতে কি? বাদশাহ কি আমাকে খেয়ে ফেলবে?’ ফৌজি বললো, ‘আমি খুব চালাক  মেয়ে না হলেও একেবারে সহজ সরল বোকা মেয়েও নই’।

‘কিন্তু তার বাদশাহীর চমক দেখতে বোকা হতে কতক্ষণ!’ দাউদ বললো, ‘এ সব লোকেরা জৌলুস দেখেই অন্ধ হয়ে তাদের ঈমান বিক্রি করেছে এবং ইসলামের মূল কাটছে। আমার ভয় হয় তুমি না আবার তার জালে আটকা পড়ে যাও’।

‘তোমার বাড়ী কোথায়?’

‘আমার কোন বাড়ী নেই’। দাউদ উত্তর দিল, ‘আমি এক গোয়েন্দা ও কমান্ডো বাহিনীর লোক। কমান্ডোদের কোন বাড়ীঘর থাকতে নেই। যেখানে শত্রুদের হাতে ধরা পড়বো, সেখানেই মারা যাবো। সেই বধ্যভূমিই আমার মাতৃভূমি। সেখানকার মাটিই আমাদের দেহকে তার কোলে আশ্রয় দিবে। শহীদের রক্ত যে মাটিতে পড়ে সে জমিল মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তুর্ভুক্ত হবেই। সে মাটিকে কুফর থেকে পবিত্র করা প্রত্যকে মুসলমানের দায়িত্ব হয়ে যায়। আমাদের মা ও বোনেরা আমাদের লালন-পালন করে বড় করেছে, আর আল্লাহর পথে সঁপে দিয়েছে। তারা তাদের বুকের ওপর পাথর বেঁধে আমাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আশাও ত্যাগ করেছে’।

‘তোমার কি কখনো বাড়ী যাওয়ার ও তোমার মা-বোনদের সাথে দেখা করার ইচ্ছা হয় না?’ ফৌজি আবেগ ভরা কন্ঠে বললো।

‘মানুষ ইচ্ছার দাস হয়ে গেলে ফরজ কাজ শিথিল হয়ে যায়’। দাউদ বললো, ‘জীবনের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য আবেগের ইচ্ছাকে কোরবানী করতে হয়। এ কাজ করতে হলে তোমাকেও মনে সব স্বপ্ন-আশা কোরবানী দিতে হবে’। ফৌজি তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো, ‘তাহলে কি সব সময় আমাকে তোমার পাশে রাখবে?’

‘না,অসম্ভব! সব সময় তোমাকে কি করে পাশে রাখবো?’ দাউদ বললো।

‘কেন, তোমার সাথে আমাকে নিয়ে যাবে, আর যদি নিতে না পারো তাহলে তুমিই এখানে থেকে যাও!’ ফৌজির কন্ঠে আবেগ।

‘আমার দায়িত্ব যতদিন প্রয়োজন মনে করবো, ততদিন তো আমি এখানে অবশ্যই থাকবো’। দাউদ বললো, ‘কিন্তু আমাকে তুমি তোমার কাছে রাখতে চাচ্ছো কেন?’

‘আমি তোমাকে কাছে রাখতে চাইনি। কিন্তু আমার মন সারাক্ষণ তোমার কাছে কাছে থাকতে চায়’। ফৌজি বললো, ‘তুমি যখন থেকে এসেছো আর আমি তোমার কথা শুনেছি, তখন থেকেই আমার মন তোমার কাছে বাঁধা পড়ে গেছে। এমন আবেগ ও উদ্দীপনার কথা আমি আগে কখনো শুনিনি। আমার মন বলে, আমি তোমার সাথেই থাকি, আর সারাক্ষণ তোমার কথা শুনি’।

‘আমার পায়ে শিকল পড়াতে চেষ্টা করো না ফৌজি!’ দাউদ বললো, ‘তুমি নিজেকেও আবেগের শিকল থেকে মুক্ত করে ফেলো। আমাদের সামনে এখন কঠিন পথ। এ পথ আমাদের অবশ্যই অতিক্রম করতে হবে। যতক্ষণ প্রয়োজন এক সাথে চলবো আমরা কিন্তু তাই বলে একে অন্যকে বন্দী করার চেষ্টা করবো না’। দাউদ একটু চিন্তা করে বললো, ‘ফৌজি, তুমি বেশী দূর আমার সাথে চলতে পারবে না। আমার দায়িত্ব বড় ভয়ংকর। এ কাজ পুরুষেরই সাজে’।

‘কিন্তু এখন যে এ কাজ আমাকে দিয়ে করাচ্ছো! আমি তো এক নারী!’ অভিমানী কন্ঠে বললো ফৌজি।

দাউদ এর কোন জবাব দিল না। ফৌজির চেহারা ছেয়ে গেল আশ্চর্য এক উদাসীনতায়। সে দাউদকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে সেখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো। দাউদ ঝট করে তার বাহু টেনে ধরে তার চোখে চোখ রাখলো। ফৌজি তার চোখের দিকে তাকিয়ে কি বুঝলো, আস্তে গিয়ে মিশে যেতে চাইলো দাউদের সাথে।

দাউদ তাকে ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল। ফৌজি আবেগ কম্পিত কন্ঠে বললো, ‘ যে কাজ পুরুষের, সে কাজ নারীও করতে পারে। আমার সম্ভ্রম ছেলের হাতের মোয়া নয় যে, ইচ্ছে হলেই যে কেউ কামড় বসাতে পারবে’। ফৌজি বললো, ‘তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তোমার কথা আমার মনে নতুন স্বপ্নের ইমারত গড়েছে। তুমি আমাকে যে রাস্তা দেখিয়েছ সে পথটিও আমার মনে ধরেছে। আমি তোমার পাশে এ জন্য থাকতে চাই’।

‘কিন্তু ফৌজি, এপথ বড় বন্ধুর! বড় ভয়ংকর! নিরূপায় না হলে এ কাজে মেয়েদের ব্যবহার করতে নেই!’

‘বুঝি! কিন্তু এটাও জানি, এ বন্ধুর পথে চলার জন্যই চাই নারীর সান্বিধ্য। চাই মায়ের স্নেহ, বোনের মমতা ও স্ত্রীর ভালবাসা। না হলে পুরুষ চলতে চলতে হাঁপিয়ে উঠে। তুমি খুব ক্লান্ত হয়ে উঠেছো দাউদ! আমার ভাবী আমাকে বলেছে, পুরুষ যখন ক্লান্ত হয়ে ঘরে আসে, তখন তার ক্লান্তি একমাত্র নারী ছাড়া কেউ দূর করতে পারে না। নারী না থাকলে পুরুষের মন শুকিয়ে যায়। আমি ভয় পাচ্ছি, একাকী চলতে গিয়ে তোমার আত্মা যদি শুকিয়ে যায়, তখন কি হবে দাউদ?’

দাউদ হেসে উঠলো। তার লাগে টোকা দিয়ে বললো, ‘তোমার এ মন ভুলানো কথা শুনেই আমার আত্মা তাজা হয়ে গেছে’।

‘আমার কথায় তুমি কিছু মনে করোনি তো? আমার ভাইকে আবার বলে দিও না, আমি তোমার কাছে এসেছিলাম!’

‘না, তা বলবো কেন?’ দাউদ বললো, ‘তোমার ভাইকে আমি এসব কথা কিছুই বলবো না। আর তোমার কোন কথাই আমার খারাপ লাগেনি’।

‘দাউদ! আমাদের স্বপ্ন এক, লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যও এক’। ফৌজি বললো, ‘তাই তো তোমার সাথে কথা বলে আমি মনে শান্তি পাই’।

‘তুমি তোমার মনে কথাই বলেছো ফৌজি!’ দাউদ বললো, ‘আমি তোমার মনের কথা বুঝে নিয়েছি। তুমি ঠিকই বলেছো, আমাদের লক্ষ্য ও গন্তব্য এক! কিন্তু এ কথা ভুলে যেও না, সামনে প্রবাহিত হচ্ছে রক্তের নদী। এ নদীতে কোন সাঁকো নেই। আমাকে এ নদী পার হতে হবে সাঁতরে। যদি তুমি আমার চির সঙ্গী হতে চাও, তবে আমাদের কাবিননামা লিখতে হবে রক্তের কালিতে। সত্য পথের সৈনিক ও যাত্রীদের বিবাহ উৎসব হয় আকাশে। তাদের বরযাত্রীরা পথ চলে ধুমকেতুর রাস্তা ধরে। আকাশের তারকারাজি তো সেই উৎসব- আনন্দেই হেসে উঠে আলো ছড়ায়!’

ফৌজি যখন সেখান থেকে বিদায় নেয়, তখন তার মুখে ছিল আনন্দের হাসি। সে হাসিতে প্রকাশ পাচ্ছিল দৃঢ়তা ও সংকল্পের প্রত্যয়দীপ্ত আভা।

এর দু’দিন পরের কথা। সাইফুদ্দিন যে কমান্ডারকে হলব পাঠিয়েছিল, সে ফিরে এলো। কমান্ডার জানালো, সে আল মালেকুস সালেহের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেনি, তবে তাকে সাইফুদ্দিনের চিঠি পৌঁছে দিয়েছে।

‘তুমি কি তার কাছ থেকে এ চিঠির কোন জবাব নিয়ে আসতে পারোনি?’ জানতে চাইলো সাইফুদ্দিন।

‘না। তবে আমি বলে এসেছি, তিনি যেন সত্ত্বর এ চিঠির লিখিত উত্তর পাঠান’।

‘তুমি কি তাকে আমার ঠিকানা দিয়ে এসেছো?’

‘জ্বী’। কমান্ডার বললো, ‘আপনার বর্তমান ঠিকানা এবং এখানে আসার একটি নকশাও এঁকে দিয়ে এসেছি’।

সাইফুদ্দিন তার চিঠির উত্তরের আশায় বসে রইলো। একদিন গেলো, দু’দিন গেলো, কিন্তু কোন উত্তর এলো না। অস্থির হয়ে উঠলো সাইফুদ্দিন। তৃতীয় এবং চতুর্থ দিনেও কোন জবাব না পেয়ে নিজেই হলব যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

‘আমি নিজেই হলব চলে যাই না কেন?’ সহ-সেনাপতিকে বললো সাইফুদ্দিন, ‘হলবের সেনাবাহিনী সালাহউদ্দিনের সঙ্গে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি করে থাকলে খুব ভেবে-চিন্তে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গুমাস্তগীনের ওপর ভরসা করা যায় না। আমার একার পক্ষে তো যুদ্ধে নামা সম্ভব নয়। এ নিয়ে খৃস্টানদের সাথে আলাপ করা দরকার। সম্মিলিত পরিকল্পনা গ্রহণের চিন্তা তো তারাও করছে’

‘এটা কি সম্ভব, আইয়ুবীর সাথে চুক্তি ভঙ্গ করে সালেহ যুদ্ধের ফায়সালা নেবে?’ সহ-সেনাপতি বললো।

‘হ্যাঁ, এটা সম্ভব!’ কমান্ডার বললো, ‘আমি সেখানে তার যে সব সেনাপতি ও কমান্ডারের সাথে আলাপ করেছি, তারা প্রায় সবাই বলেছে, আল মালেকুস সালেহ সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে সুলতানের সাথে প্রতারণা করেছে মাত্র। এটা স্রেফ ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়। তার কোন সেনাপতি ও আমীরই চাই না, সালেহ এ চুক্তি মেনে চলুক। খৃস্টান উপদেষ্টারাও তাকে শীঘ্র আক্রমণের পরামর্শ দিয়েছে’।

‘তাহলে আপনার শীঘ্রই হলব চলে যাওয়া উচিৎ’। সহ-সেনাপতি বললো, ‘আর আমি মুশেল চলে যাই’।

‘তুমি আরো একবার হলব যাও!’ সাইফুদ্দিন কমান্ডারকে বললো, আল মালেকুস সালেহকে গিয়ে বলো, আমি আসছি। তুমি আজ যাত্রা করতে আমি আগামীকাল রাতে রওনা করবো। এমনও হতে পারে, সে আমার সাথে নাও দেখা করতে পারে। হলব শহরের বাইরে আল মুবারক নামে যে ঝরণা ও উদ্যান আছে, সেখানে আমি ক্যাম্প করবো। আল  মালেকুস সালেহকে বলবে, ওখানেই সে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে। সে যদি আমার সাথে দেখা করতে না চায়, সে কথাও আমাকে তুমি আল মুবারকে এসে বলে যাবে’।

‘ওখানে কি আপনার একা   যাওয়া উচিৎ হবে?’ কমান্ডার বললো।

‘এ এলাকায় তো কোন ভয় নেই’। সাইফুদ্দিন বললো, ‘আমি রাতে রওনা হবো। পথ চলবো সাধারণ বেশে। কেউ কি আর জানতে পারবে, তাদের সামনে দিয়ে মুশেলের আমীর যাচ্ছে!’

‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা ও কমান্ডো বাহিনী বড় হুশিয়ার।‘

সহ-সেনাপতি বললো, ‘সে ভয় নিয়ে তো আর ঘরে বসে থাকা যাবা না। ওভাবে ভাবলে তো বলতে হয়, তাদের থেকে আমরা কোথাও নিরাপদ নই’।

‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো’। সাইফুদ্দিন বললো, ‘এটুকু ঝুঁকি আমাকে নিতেই হবে। তাহলে আজই তুমি মুশেল যাত্রা করো, ও রওনা হোক হলবে। তার আমি কাল রাতে হলব যাত্রা করছি’।

ওরা যখন এসব বলাবলি করছিল, হারেস ও দাউদ দরজায় কান লাগিয়ে শুনছিল সব কথা। সাইফুদ্দিনের পুরো কর্মসূচীই জানা হয়ে গেল ওদের। দু’জনই সেখানে থেকে সরে তাদের কামরায় চলে এলো। তারা গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো। দাউদকে তো সাইফুদ্দিনকে অনুসরণ করতেই হবে কিন্তু কি ভাবে করবে তাই সে ভাবছিল। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর হারেসের মাথায় একটি বুদ্ধি এলো। সে বললো,  ‘আমরা সাইফুদ্দিনের দেহরক্ষী সেজে তার সাথে হলব যাত্রা করতে পারি না! আমরা হঠাত তার সামনে গিয়ে উপস্থিত হবো। আমার কথা তো তিনি জানেনই। তাকে বলবো, আমরা তার বাহিনীরই সৈনিক। যুদ্ধের পরাজয়ের পর এ ক’দিন এক জায়গায় লুকিয়ে থেকে আজ ফিরলাম। তারপর তিনি যখন রওনা করতে যাবেন, আমরা তাকে বলবো, আমরা বেঁচে থাকতে আমাদের আমীরকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় নিরাপত্তাহীনভাবে কোথাও যেতে দিতে পারি না। আপনি যেখানেই যাবেন, আপনার দেহরক্ষী হিসাবে আপনার সাথে থাকবো’।

‘যদি তিনি বলেন, তোমরা মুশেল চলে যাও, তখন কি করবে?’ দাউদ তাকে প্রশ্ন করলো।

‘তখন অন্য কোন কৌশল বের করতে চেষ্টা করবো’। হারেস বললো।

‘যদি তোমার সে কৌশলও ব্যর্থ হয়ে যায়, তবে?’

‘তবে তিনিও হলব যেতে পারবেন না’। হারেস মুখমন্ডল কঠিক করে বললো।

দাউদ বললো, ‘তোমার প্রস্তাবটি মন্দ নয়। তবে এখনি সিদ্ধান্তে পৌঁছার দরকার নেই। তুমি আরো একটু ভাবো, আমিও ভেবে দেখি’।

সে রাতেই সাইফুদ্দিন কামরার দরজা বন্ধ করে তার সহ-সেনাপতি ও কমান্ডারকে শেষ নির্দেশ দান করছিল।

রাতের প্রথম প্রহর শেষ হতে চললো, প্রথমে সেখান থেকে বিদায় নিল কমান্ডার। হারেসের বাবা তার ঘোড়া খুলে এনে তুলে দিল তার হাতে। একটু পর সহ-সেনাপতিও বিদায় নিল। কামরায় এখন শুধু একা সাইফুদ্দিন গাজী।

সঙ্গীদের বিদায় করে সাইফুদ্দিন গাজী শুয়ে পড়েছিল। সহসা ভেতর দিকের দরজা জোরে ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললো কেউ। এমন জোরে আওয়াজ হলো দরজা খোলার, তিনি ভয় পেয়ে উঠে বসলেন। দেখলেন, ফৌজি খুশীতে বাগ বাগ হয়ে দৌড়ে আসছে। সাইফুদ্দিন সহাস্যে বললো, ‘কি ব্যাপার ফৌজি! আনন্দে দেখি একদম আটখানা হয়ে গেছো!’

ফৌজি ছুটে সাইফুদ্দিনের পাশে গিয়ে তার দুই হাত চেপে ধরে বললো, ‘ভাইয়া এসেছে! তার সঙ্গে তার এক বন্ধুও এসেছে!’ ফৌজি খুশীতে ডগমগ করছিল।

সাইফুদ্দিনের চেহারা মুহুর্তে পাল্টে গেল। তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি তাদের বলে দিয়েছো, আমি এখানে আছি!’

‘হ্যাঁ!’ ফৌজি উত্তর দিল, ‘আমি আপনার কথা বলতেই তারা তো আকাশ থেকে পড়লো। ভাইয়া আমার কথা বিশ্বাস করতে পারলো না, বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আব্বা! তোমার মেয়ের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’ আব্বা বললো, ‘নারে বেটা, ওর মাথা খারাপ হয়নি। সত্যি আল্লাহ আমাদের ঘরে এক সম্মানিত মেহমান পাঠিয়ে দিয়েছেন’। এ কথা শুনে ওরা তো মহা খুশী! ভাইয়া বললো, ‘যা তো ফৌজি, মেহমান যদি না ঘুমিয়ে থাকে, বলবি, ভাইয়ারা আপনাকে সালাম করা অনুমতি চাইছে’।

সাইফুদ্দিন অন্তরের পেরেশানী লুকিয়ে রেখে মুখে হাসি টেনে বললো, ‘যাও , ওদের নিয়ে এসো’।

দাউদ ও হারেস আদবের সাথে সাইফুদ্দিনের কামরায় উপস্থিত হয়ে সামরিক কায়দায় স্যালুট করে দাঁড়ালো। সাইফুদ্দিন তাদেরকে ইশারায় বসতে বললো।

তাদের পরনে তখনো সামরিক পোশাক। চেহারায় ধূলোবালি ও পথশ্রমের ক্লান্তি। তারা সে ক্লান্তি লুকোবার চেষ্টা করে এক পাশে বসে পড়লো। হারেস বসতে বসতে বললো, ‘আমি হারেস। আর ও আমার বন্ধু দাউদ’।

সাইফুদ্দিন হারেসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কোন ব্যাটেলিয়ানে আছো?’

হারেস তার ব্যাটেলিয়ানের নাম বললো। সাইফুদ্দিন দাউদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আর তুমি?’

‘আমি আপনার এক গোয়েন্দা কমান্ডো’। বলল দাউদ।

‘তোমরা এতদিন কোথায় ছিলে?’ সাইফুদ্দিন প্রশ্ন করলো।

‘যুদ্ধের ময়দান থেকে সবাই যখন পালাচ্ছিল, আমাকে বলা হলো, ‘আইয়ুবীর বাহিনীর গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখো’।আমি ময়দান থেকে অনেক দূরে সরে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে আইয়ুবীর বাহিনীর গতিবিধি দেখছিলাম। আমাদের সৈন্যরা পিছু হটে পালাচ্ছিল, হারেসও ছিল একটি দলের সাথে। আমি দূর থেকে হারেসকে দেখতে পেয়ে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলাম। ও বললো, ‘চলো। লড়াই খতম হয়ে গেছে। আমাদের বাহিনী পিছু হটে এসেছে। কমান্ডার হুকুম করেছে, যেভাবে পার আত্মরক্ষা করো। আমরা আবার সংগঠিত হয়ে ময়দানে আসবো’।

আমি ওকে বললাম, ‘আমার যাওয়ার উপায় নেই। আইয়ুবীর বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করার ডিউটি পড়েছে আমার। তুমি চলে যাও, আমি দুশমনের পিছু নেবো’।

হারেস বললো, ‘যুদ্ধ তো শেষ। এখন পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোন কাজ নেই। তারচে এক কাজ করে, আমিও থেকে যাই তোমার সাথে। তারপর আমরা দু’জন পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ওদের দেখতে লাগলাম। সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা হারান ও মুশেলের সৈন্যদের পিছু ধাওয়া করার পরিবর্তে হলবের সৈন্যদের পিছু নিল। ময়দান ফাঁকা হয়ে গেলে ওরাও যাত্রা করলো হলবের দিকে। আমরা সতর্কতার সাথে ওদের পিছু নিলাম। আপনার হয়তো স্মরণ হবে, আপনি খৃস্টান উপদেষ্টাদের দিয়ে আমাদের গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। সে প্রশিক্ষণ আমাদের খুব কাজে লেগেছে।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্যবাহিনী সামনে এগিয়ে চললো। আমাদের সাথে আরো কিছু কমান্ডো থাকলে আমরা চোরাগুপ্তা কমান্ডো হামলা চালিয়ে ওদের অনেক ক্ষতি করতে পারতাম’।

দাউদ বললো, আমরা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে অনুসরণ করে তুর্কমান পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সেখানে তার সেনাবাহিনী ক্যাম্প করে অগ্রাভিযান মুলতবী করলে আমরা ফিরে এসেছি। মুশেল যাচ্ছিলাম আমরা। আপনাকে না পেলে এতক্ষণে হয়তো আবার পথে নেমে যেতাম। এখন আমাদের জন্য আপনার হুকুম কি? আমরা কি এখানে আপনার সাথে থাকবো, নাকি মুশেল গিয়ে রিপোর্ট করবো?’

সাইফুদ্দিন এ প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘তুর্কমানে আইয়ুবীর সৈন্যরা যে ক্যাম্প করেছে তাতে কি মনে হয়, তারা সেখানে সাময়িক যাত্রা বিরতি করেছে, নাকি দীর্ঘদিন থাকবে?’

‘না, সাময়িক বিরতি নয়, দেখে মনে হয় ওরা ওখানে বেশ কিছুদিন থাকবে’।

হারেস বললো, ‘মুহতারাম আমীর! পরাজয়ের কারণে আমার খুব দুঃখ ও আফসোস হচ্ছে। আমাদের সৈন্যরা আর কিছুক্ষণ ময়দানে টিকে থাকতে পারলে এ পরাজয়ের গ্লানি এবার আইয়ুবীকেই ভোগ করতে হতো। একেই জিজ্ঞেস করুন, শত্রুদের যা লাশ দেখেছি তা কয়েক শত নয়, কয়েক হাজার হবে। আর আহতদের সংখ্যার তো কোন হিসেবই নেই। তুর্কমান থেকে ফেরার আগে আমরা খুব সাবধানে গভীর রাতে তাদের ক্যাম্পের একেবারে কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। হায় আল্লাহ! আহতদের চিৎকার সহ্য করা যায় না। চিৎকার শুনে মনে হলো, তাদের অর্ধেক সৈন্যই আহত’।

হারেসের কথা শেষ না হতেই দাউদ বলে উঠলো, ‘আমীরে মুহতারাম! আল্লাহ আপনার ভাগ্য সু-প্রসন্ন করুন! আপনি ভাল জানেন এখন কি করতে হবে। আমরা আপনার চাকর, যে আদেশ করবেন আমরা তাই পালন করবো। আমার ধারণা, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বাহিনী এখন আর যুদ্ধ করার মত অবস্থায় নেই। আপনি যদি আপনার সৈন্য একত্রিত করে জলদি তাদের ওপর আক্রমণ করেন, তবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে আপনি দামেশকে ফেরত পাঠাতে পারবেন।‘ আমীর সাইফুদ্দিন হারেস ও দাউদের কথা অতি মনোযোগের সাথে শুনছিল। এমন কথা শোনার জন্য প্রানটা যেন তার তৃষ্ণার্ত হয়েছিল। সাইফুদ্দিন ওদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কিন্তু এত তাড়াতাড়ি পরাজিত সৈন্যদের একত্রিত করা কি সম্ভব?’

দাউদ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘মুহতারাম আমীর! আমাদের পরাজয় হয়নি, সম্মিলিত বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়েছে মাত্র!’

দাউদের এ কথায় তার মনে প্রশান্তি নেমে এলো। দুর্বলতা কাটিয়ে সবল হয়ে উঠতে লাগলো তার মত। যুদ্ধের পর এই প্রথম তার মনে স্বস্তিবোধ ফিরে এলো।

‘আমরা মুশেল যাচ্ছিলাম।‘ দাউদ বললো, ‘হারেসের গ্রাম রাস্তায় পড়ায় হারেস বললো, ‘এসো বাড়ীর সবাইকে একটু দেখেই যাই’। এখানে আমাদের জন্য এমন সৌভাগ্য্য অপেক্ষা করছে, তা আমাদের জানা ছিল না। একেই বলে ভাগ্য! আমরা যেন তাড়াতাড়ি আপনার কাছে এ খবর পৌঁছাতে পারি, এ জন্যই হয়তো কুদরত এখানে আমাদের নিয়ে এসেছে। নইলে এ সংবাদ পেতে আপনাকে আরো অন্তত দু’দিন অপেক্ষা করতে হতো’।

হারেস বললো, ‘ফৌজি যখন বললো আপনি এখানে আছেন, আমরা প্রথমে বিশ্বাসবি করতে পারিনি। এখনো আমার বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না, সত্যি কি আমরা আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি? নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর বড় রকমের দয়া, তাঁর অপার মেহেরবানী’।

‘আমি তোমাদের কথা শুনে খুবই খুশী হয়েছি’। সাইফুদ্দিন ঠিক রাজার মত ভাব-গম্ভীর স্বরে বললো, ‘তোমাদের এ বীরত্বের পুরষ্কার তোমরা অবশ্যই পাবে’।

‘আমাদের জন্য এর চেয়ে বড় পুরষ্কার আর কি হতে পারে যে, আমরা আপনার পাশে বসেছি, আপনার সঙ্গে কথা বলছি’। হারেস বললো, ‘আমাদের জন্য সবচে বড় পুরষ্কার হচ্ছে, আপনার জন্য জীবন দিয়ে আত্মার সন্তুষ্টি লাভ করা’।

‘এখানে আপনার সাথে আর কে আছে? কোন ফৌজ কি সঙ্গে আছে আপনার? তারা কোথায়?’ প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন করলো দাউদ।

‘এখানে এখন আমি একাই আছি। আমার সাথে সহ-সেনাপতি ও আরেক কমান্ডার ছিল। তারা দু’জনই যার যার কাজে চলে গেছে।‘ সাইফুদ্দিন বললো, ‘আমিও চলে যাবো’।

হারেস সঙ্কোচ জড়িত কন্ঠে বললো, ‘আমি আপনার কাছে খুবই লজ্জিত যে, আপনাকে এমন নোংরা ও নিকৃষ্ট কামরায় থাকতে হচ্ছে। আপনি মেঝেতে বিছানা পেতে থাকছেন, এ দেখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে’।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 5 | 6 | 7 | 8 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top