১৫. উমরু দরবেশ

তৃতীয় এক লোক বললো, ‘এখানে বসে কথা বলে সময় নষ্ট না করে তাঁর পিছু নেয়া দরকার! এ লোক ভয়ংকর, তাকে চোখে চোখে রাখতে হবে।’

অপর জন তার কথায় সায় দিয়ে বললো, ‘তুমি ঠিক বলেছো, চলো।’

তারা দু’জন সেখান থেকে উঠে গমনরত লোকদের দলে মিশে গেল। আলী বিন সুফিয়ানকে খুজলো তন্ন তন্ন করে, কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পেল না। লোকজনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘লম্বা দাড়িওয়ালা এক চোখে সবুজ পট্টি বাঁধা লোকটাকে কেউ দেখেছো? ওই লোক কোথায় বলতে পারো কেউ?’ কিন্তু কেউ বলতে পারলো না, তিনি কোথায়? আলী বিন সুফিয়ান ততক্ষণে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে সেখানে থেকে বহু দূরে সরে পড়েছেন।

তাঁবুর মধ্যে এখন শুধু আশী ও উমরু দরবেশ। আশী তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এ লোকটি কে? তোমার সাথে এমন ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলছিলেন, মনে হয় তোমার সাথে আগে থেকেই পরিচয় আছে? তিনি গেলেনই বা কোথায়?’

‘শোনো আশী!’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘আজ রাতে একটা কিছু ঘটবে। আমি বলতে পারছি না কি ঘটবে। কারণ আমি লোকটাকে চিনতে পারিনি। পরিচয় জিজ্ঞেস করার পরও তিনি তাঁর পরিচয় দিলেন না। কিন্তু এ লোক কোন সাধারণ ব্যক্তি নয়। জানি না আজ রাতে আমি নিখোঁজ হবো, নাকি অপঘাতে মারা যাবো। আজই তোমার পরীক্ষার দিন। আজ রাতে তোমাকে প্রমাণ করতে হবে, তুমি প্রকৃতই মুসলিম বাপ-মায়ের সন্তান। তাঁদেরই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তোমার শিরায়। যদি তুমি আমাকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করো, তবে তুমি নির্মম মৃত্যুর শিকার হবে।’

‘আমার যা বুঝার বুঝে নিয়েছি। এখন বলো তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি।’ আশী বললো, ‘আমি তোমার জন্য মরতেও প্রস্তুত। কিন্তু তোমার উদ্দেশ্য সফল না হলে মরেও যে আমি শান্তি পাবো না!’

‘কি করতে হবে আমি নিজেও জানি না। তবে একটা কাজ তোমাকে করতেই হবে।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘কখনও দলের লোকদের ভয়-ভীতি ও চাপের মুখে নতি স্বীকার করবে না। চেষ্টা করবে তাদের মনের খবর নিতে এবং সময়ের আগেই আমাকে তা জানিয়ে দিতে। কারণ আমি জানি না, আজ রাতে কি হবে। শুধু জানি, আজ আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রয়োজন, প্রয়োজন যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকা।’

‘তুমি আমাকে কয়েকবারই বলেছো, আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস নেই।’ আশী বললো, ‘কিন্তু আমি তোমাকে একটিবারও বলিনি, তোমার প্রতি আমার ভরসা ও আস্থা নেই। তুমি এ চক্রের হাত থেকে মুক্ত হয়ে গেলে আমাকে কি তোমার সাথে নেবে?’

‘তুমি ফিরে যেতে চাইলে আমি বাঁধা দেবো না, তুমিই বলো, তুমি কি করতে চাও? তুমি কি ফিরে যেতে চাও?’

‘না! কখনো না।’ আশী বেদনাবিধুর কণ্ঠে বললো, ‘তার চেয়ে আমি মৃত্যুই শ্রেয় মনে করবো।’

‘আশী, তুমি  তো সুখের পায়রা!’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘কষ্টকর জীবনের সাথে তোমার পরিচয় হয়নি। যখন থেকে বুদ্ধি হয়েছে তখন থেকেই তুমি দেখে আসছো রঙ তামাশার জীবন। আমি ভাবতেই পারি না, তুমি আমার সাথে যাবে! আমার সাথে গেলে তোমার ভবিষ্যৎ কি হবে ভেবে দেখেছো? তুমি অবশ্যই আমার মত ভয়ংকর জীবন পছন্দ করবে না! কারণ এ জীবনে আছে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি। তবে আমি তোমাকে কায়রো নিয়ে যেতে পারি। সেখানে তোমার সম্পর্কে চিন্তা করার অনেক উন্নত মাথা রয়েছে।’

‘তাঁর মানে তুমি আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাও?’ আশী প্রশ্ন করলো, ‘তবে কি তুমি আমাকে তোমার সাথে রাখবে না?’

‘না, এ শর্তে তোমাকে আমি সঙ্গে নিতে রাজী নই।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘তাতে লোকে বলবে, তোমাকে পাওয়ার লোভে আমি সুদানীদের টোপ গিলেছি। ঘরে আমার স্ত্রী আছে। তার হোক নষ্ট করে তোমাকে আমি স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবো না। আশী, আমি সৈনিক! আমার ঠিকানা যুদ্ধের ময়দান! আমি আমার স্ত্রীর মুখ দেখি না প্রায় তিন বছর। কোন ভরসায় আমি তোমাকে সঙ্গে নেব! যে তীর আমার বুকে বিদ্ধ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে, তোমার ভালবাসা বা দোয়া আমাকে সে তীরের আঘাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। আমার মত লোকের সঙ্গী হতে চাইলে তুমি নিরাশ হবে। এমন ভুল তুমি করো না।’

‘আমি আমার এ ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত জীবন থেকে মুক্তি চাই।’ আশী বললো, ‘এ জন্য তোমার সাহায্যের প্রয়োজন! তার পরে কি হয় সেটা পরে দেখা যাবে। তবে এটুকু কথা দিতে পারি, আমি তোমার চলার পথের প্রতিবন্ধক হবো না।’

‘তুমি এ চক্রের হাত থেকে বাঁচতে চাইলে আমার সাহায্য ও সহযোগিতা থাকবে তোমার সাথে।’

আলী বিন সুফিয়ানকে কথাও খুঁজে না পেয়ে তাঁবুতে ফিরে চললো সুদানী সেই গোয়েন্দা দু’জন। পথে অপর সঙ্গীর সাথে দেখা হতেই সে জানতে চাইল, ‘পেলে সেই কানা বুড়োকে?’

‘না, ভাই।’ একজন আক্ষেপের সুরে বললো, ‘বলতো দেখি কি অবাক কাণ্ড! নিমিষে লোকটি হাওয়া হয়ে গেল?’

‘সত্যি অবাক ব্যাপার, আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে শেষ পর্যন্ত লোকটি কোথায় লুকিয়ে পড়লো বলতো?’

উমরু দরবেশের তাঁবু থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আলী বিন সুফিয়ানকে নিয়ে কথা বলছিল ওরা। একজন বললো, ‘এমনও তো হতে পারে, উমরু দরবেশ তার মন জয় করার পরিবর্তে নিজের মনটাই তাকে দিয়ে বসে আছে! এখন আমাদের আরও বেশী সাবধান হতে হবে। উমরু দরবেশকে চোখে চোখে রাখার জন্য আমাদের তো আগেই সতর্ক করা হয়েছে।’

‘লম্বা দাড়িওয়ালা লোকটি পানিতে আগুন ধরানোর গোপন রহস্য জানার পরও কেন উমরু দরবেশকে ছেড়ে দিল এটা একটা গুরুতর প্রশ্ন।’ একজন বললো, ‘উমরু দরবেশ তার উপর প্রভাব ফেললো, নাকি সে লোকই বশ করে গেল উমরু দরবেশকে, বিষয়টি জানতে হবে আমাদের।’

‘এটা জানা তেমন কঠিন হবে না। আশী আছে না দরবেশের সাথে! এমন ঔষধ থাকতে আর ভাবনা কি?’ তৃতীয় ব্যক্তি বললো।

‘আশীকে নিয়ে এত উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। এ মেয়েটা যে কি করছে কিছুই বুঝতে পারছি না। সে তো উমরু দরবেশের মনের কোন অবস্থাই আমাদের বলছে না!’

‘তুমি কি বলতে চাও উমরু দরবেশ কোন ষড়যন্ত্র করলে মেয়েটা তারই সহযোগী হয়ে যাবে?’

‘তা বলছি না, তবে এমনটি হতেই বা কতক্ষণ?’

‘আশী যদি সত্যিই ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ে তবে তাকেও হত্যা করার হুকুম আছে। মেয়েটি যদি নিজেই তার মরণ ডেকে আনে তবে আমাদের কি করার আছে?’ অন্য একজন বললো।

‘কি বললে!’ এক গোয়েন্দা বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বললো, ‘তুমি এমন মহামূল্য জিনিস নষ্ট করে ফেলবে?’ সে আরও বললো, ‘না, তাকে বরং উঠিয়ে নিয়ে যাবো, আর কোন ধনীর দুলালের কাছে উপযুক্ত মূল্যে বিক্রি করে দেবো। এমন হীরা হাতে পেলে কে তা পায়ে ঠেলে!’

‘এটা কি ঠিক হবে?’

‘কেন, সুদান গিয়ে রিপোর্ট করলেই হবে, ষড়যন্ত্রের দায়ে আশীকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাকে সেখানেই দাফন করা হয়েছে।’

তারা তিন জনেই এক অন্যের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালো, যেন তারা ঐকমতে পৌঁছেছে। তাদের একজন বললো, ‘আজ রাতে আবার তুরের তাজাল্লি দেখাতে হবে। তখনই বুঝা যাবে, উমরু দরবেশের মনের মতলবটা কি? রাতে আমাদের একজন আশীর কাছে পাহারায় থাকবে। এমন যেন না হয়, আমাদের সামান্য ভুলের কারণে মেয়েটা শেষ পর্যন্ত হাতছাড়া হয়ে না যায়।’

তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, কে আশীর কাছে থাকবে আর কে কে যাবে তাজাল্লি দেখানোর কাজে। সিদ্ধান্ত হয়ে যেতেই তারা পা বাড়ালো তাঁবুর দিকে, যেখানে আশী ও উমরু দরবেশ একান্তে বসে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করছিল।

‘চারজনই যথেষ্ট।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আমি থাকবো উমরু দরবেশের কাছে। তোমরা তার তিন সহযোগীর কাছে। তার সহযোগীদের নিশ্চয়ই তোমরা চিনে রেখেছো?’

‘হ্যাঁ, যে তিনজন উমরু দরবেশের পক্ষে কথা বলছিল তাদের আমরা ভাল করেই চিনি। তারা এ অঞ্চলেরই মুসলমান।’

‘এ এলাকায় ওরাই সুদানীদের চর। উমরু দরবেশ ওদের দিকে ইঙ্গিত করেই বলেছেন, তিনি খুনীদের বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে আছেন। ওদেরকে সবসময় চোখে চোখে রাখবে। প্রয়োজন হলে শেষ করে দেবে, কিন্তু জীবিত ধরে রাখাই উত্তম!’

আলী বিন সুফিয়ান ইমাম সাহেবকে নিয়ে তার মসজিদে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে বসেই নির্দেশ দিচ্ছিলেন সহকর্মীদের। পাশে বসেছিলেন ইমাম সাহেব। আছরের নামাজের অজু করবেন আলী বিন সুফিয়ান। তিনি তাঁর লম্বা দাড়ি ও চোখের পট্টি খুলে ফেললেন। অজুর জন্য উঠতে উঠতে বললেন, ‘আমার যে সন্দেহ ছিল তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আশা করি রাতেও আমরা সফল হবো।’

সূর্য ডোবার একটু আগে উমরু দরবেশের নির্দেশিত পাহাড়ে একজন লোককে আরোহণ করতে দেখা গেল। কেউ যেন তাকে দেখে না ফেলে সে জন্য সে অতি সাবধানে পাহাড়ে উঠছিল। অন্য দিক থেকেও সে পাহাড়ে উঠছিল আরও দু’ জন লোক। তারাও থেমে থেমে অতি সঙ্গোপনে উপরে উঠছিল। প্রথম লোকটিকে অনুসরণ করে তার পিছু পিছু উঠছিল আরো এক লোক। প্রথম লোকটি উপরে উঠে হামাগুড়ি দিয়ে একটি বড় গাছের কাছে পৌঁছলো। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সন্তর্পণে গাছের ওপর চড়ে বসলো লোকটি। অন্য দিক থেকে যে দু’জন উঠছিল তারা একটা মস্ত বড় পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। পাথরটি গাছ থেকে বেশী দূরে ছিল না। চতুর্থ ব্যক্তিও উপরে উঠে নিরাপদ জায়গা দেখে গা ঢাকা দিল। গাছের ওপর চড়ে বসা লোকটি গাছের উপরের একটি মোটা ডালে আরাম করে বসলো। গাছের ঘন পাতার কারণে বাইরে থেকে তাকে দেখা যাচ্ছিল না। আরাম করে বসার পর লোকটি আস্তে করে পাখির মত শীষ দিল। অন্য তিনজনও প্রতিউত্তরে সে ডাকের নকল করে তাকে জানিয়ে দিল তাদের অবস্থান।

সূর্য পাহাড়ের আড়ালে নেমে গেছে। অন্ধকার হয়ে আসছে পৃথিবী। দেখতে দেখতে নেমে এলো রাত।

সন্ধ্যার পরপরই আরও তিনজন লোক একসাথে পাহাড়ের উপরে গিয়ে উঠলো। তাদের হাতে আগুন জ্বালানোর তেলের হাড়ি। কোমরে খঞ্জর।

ততক্ষণে অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয়ে এসেছে। অন্ধকারের মধ্যেই পাহাড়ের চুড়ায় গিয়ে পৌছুলো লোক তিনজন। এখানে এ রাতের অন্ধকারে তাদের জন্য কোন বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে এমন কোন সন্দেহও কারো মনে জাগলো না। লুকানো চারজন নিজ নিজ জায়গা থেকেও তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পেলো।

লোক তিনজন তাকিয়ে আছে উমরু দরবেশের ক্যাম্পের দিকে। সেখান থেকে দূরে নিচে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে উমরু দরবেশের ক্যাম্প। তাঁবুর সামনে বাইরে দু’টো জ্বলন্ত মশাল। মশালের আলোয় পাশের খানিকটা জায়গা আলোকিত হয়ে আছে।

‘খোদার দূত তৈরি হয়ে গেছেন।’ তিনজনের একজন বললো, ‘জিনিসপত্র নিয়ে তৈরি হয়ে যাও।’

ওরা তেলের ভাণ্ড একটি সমতল পাথরের ওপর রেখে সাথের পোটলা খুলে জিনিসপত্র গুছাতে লাগলো। একজন বললো, ‘আজ কেন যেন মনটা আমার অকারণে কাঁপছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, আজ কোন অঘটন ঘটতে পারে। পানিতে আগুন লাগানোর ব্যাপারটায় ঝামেলা বাঁধার পর থেকেই মনটা আমার খুঁত খুঁত  করছে।’

‘আমারও মনটায় খোঁচা দিচ্ছে অহেতুক ভয় ও সন্দেহ। চোখে সবুজ পট্টি বাঁধা লম্বা দাড়িওয়ালা লোকটার কথা কিছুতেই তাড়াতে পারছি না মন থেকে। কেন যেন মনে হচ্ছে লোকটা ভয়ংকর।’

অন্য লোকটি বললো, ‘চিন্তা করো না তো! আমরা তুরের তাজাল্লি দেখিয়ে সবার সব সন্দেহ দূর করে দেবো। এ নূর দেখলে লোকেরা ওই লোকটাকে আর পাত্তাই দেবে, না। চাই কি সে লোকটাও উমরু দরবেশের ভক্ত হয়ে যেতে পারে। আর যদি সে লোক বশে না আসে তাতেই বা কি আসে যায়। মাত্র একজন লোক আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এখন ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে যার যার কাছে হাত লাগাও। সময় ঘনিয়ে আসছে।’

তাদের একজন হাড়ির মুখ খুললো। হাড়ির তেল ঢেলে দিল শক্ত পাথরের ওপর। পাথরের ওপর দিয়ে সে তেল অনেক দূর গড়িয়ে গেল, কারণ পাথর তেল শোষণ করতে পারেনি। তেল গড়িয়ে যেখানে গিয়ে শেষ হলো সেখান থেকে একটু দূরে একজন একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দাঁড়াল। মোমবাতিটি একটি চামড়ার কৌটার ভেতর, যাতে তাঁর আলো বাইরে থেকে দেখা না যায় এবং বাতাসে তা না নিভে। আশেপাশে কোন ঘাস বা লতাপাতা নেই, সবটাই নিরেট পাথর। লোকটি মোমবাতি হাতে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। পাশের জনকে বললো, ‘ভাল করে খেয়াল রেখো। আজকে মশাল ডাইনে বামে পাঁচবার ঘুরানোর পর মোমবাতি তেলের উপর ফেলতে হবে।’

এ বিশাল পাথরটি ছিল গাছের একবারে নিচেই। খোলা জায়গার চেয়ে গাছের নিচে অন্ধকার ছিল বেশ ঘন। লোকগুলো দাঁড়িয়েছিল সে ঘন অন্ধকারের মধ্যে। কৌটার ভেতর থাকায় মোমবাতির আলো সামান্য দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে না। পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তিনজন শুধু তাদের কথাই শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু ওপর যে বসে আছে সে ওদের সবাইকে দেখতে পাচ্ছিল।

তিনজনই নির্ণিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছে উমরু দরবেশের তাঁবুর দিকে। গাছের উপর বসা লোকটি পাখির মত শীষ দিল। তিন দিক থেকে ডেকে উঠল আরো তিনটি পাখী। পাখীর ডাক শুনেও লোকগুলোর মনে কোন ভাবান্তর এলো না, তারা আগের মতই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

সহসা গাছের ওপর বসা লোকটি একজনের ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেল লোকটি। অন্য দু’জন ভাবলো সঙ্গীকে ভুতে ধরেছে। ওরা ভুতের ভয়ে ছুটলো সেখান থেকে। কিন্তু দশ কদমও পার হয়নি, পাথরের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো আরও দুই ভূত। দাঁড়াল একেবারে ওদের দু’জনের সামনে। ভয় ও আতঙ্কে চোখ কপালে উঠে গেল পলায়নপর দুই বীরের। থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ওরা। ভূত দু’জন ওদেরকে ঝাপটে ধরলো এবং ক্ষিপ্র হাতে বেঁধে ফেললো তাদের। তাদের সাথে খঞ্জর ছিল কিন্তু তারা খঞ্জর বের করার সুযোগই পেল না।

গাছের ওপর থেকে যার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়েছিল সে লোকটি কেবল স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী ছিল না, সাহসেও সে ছিল সঙ্গীদের চেয়ে ব্যতিক্রম। ভুত-প্রেতে তাঁর কোন বিশ্বাস ছিল না। সে ঠিকই বুঝেছিল, দুপুরের মত এখানেও কোন দুশমন ওঁৎ  পেতে ছিল, যে তার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়েছে। সে কাঁধের ওপর থেকে এক ঝটকায় ফেলে দিল আক্রমণকারীকে।

আলী বিন সুফিয়ানের নির্দেশ ছিল, ‘পারলে ওদের জীবিত ধরবে। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখলে হত্যা করতে দ্বিধা করবে না।’

লোকটি মুক্ত হয়েই সঙ্গে সঙ্গে ছুরি বের করলো, ‘কট’ করে আওয়াজ হলো ছুরি খোলার। বাধ্য হয়ে নিজের হাতের খঞ্জর তার বুকে আমূল বসিয়ে দিলো সে। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল লোকটি। একটু পর। আলীর সঙ্গীরা দু’জনকে রশি দিয়ে বেঁধে খোলা আকাশের নিচে পাথরের ওপর বসে অপেক্ষা করতে লাগলো আলী বিন সুফিয়ানের জন্য।

উমরু দরবেশের তাঁবুর সামনে লোকজন জমা হয়ে অপেক্ষা করছিল নূরের তাজাল্লি দেখার জন্য। দর্শকের মধ্যে আছেন আলী বিন সুফিয়ান। তার সাথে মিশরের একদল কমান্ডো গোয়েন্দা। সাধারণ  বেশে গ্রামের লোকের সাথে মিশে গিয়েছিল ওরা। এদের মধ্যে কিছু কমান্ডো ছিল অশ্বারোহী, তাদের কাছে ভারী অস্ত্রও আছে।

জনতার মধ্যে লুকিয়ে ছিল উমরু দরবেশের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সুদানী গোয়েন্দারাও। কিন্তু তাদের সংখ্যা পাঁচ-ছয় জনের বেশী ছিল না। আলী বিন সুফিয়ান তাদের চিনে রেখেছিলেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ আলী বিন সুফিয়ান ও ইমাম সাহেবকে ছাড়া আর কাউকে তাদের শত্রু বলে সনাক্ত করতে পারেনি। তারা বুঝতে পেরেছিল, চোখে পট্টি বাঁধা সাদা দাড়িওয়ালা লোকটি একা উমরু দরবেশকে চ্যালেঞ্জ করতে আসেনি, নিশ্চয় তার সাথে আরো লোকজন আছে। কিন্তু সে লোক কয়জন এবং কারা, এ সম্পর্কে তারা কোন ধারনাই করতে পারল না। সংঘর্ষ একটা আসন্ন, কিন্তু শত্রু কতটা প্রবল এবং কাদের সঙ্গে তাদের মোকাবেলা করতে হবে বুঝতে পারল না সুদানী গোয়েন্দা দল!

আশী তার মোহিনী পোশাক পড়ে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলো। আগের মতই দুই মশালের মাঝখানে বিছিয়ে দিলো মখমলের জায়নামাজ। উমরু দরবেশ তাঁবু থেকে বের হয়ে নেশাগ্রস্থের মত টলতে টলতে এসে জায়নামাজের ওপর দাঁড়ালেন। তারপরদু’বাহু প্রসারিত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে মন্ত্র পাঠ করা শুরু করলেন। আশী তাঁর পায়ের কাছে সেজদায় লুটিয়ে পড়লো। শেষে সেজদা থেকে মাথা তুলে হাঁটু গেড়ে বসে করজোড়ে বলতে লাগলোঃ ‘হে, খোদার পবিত্র দূত! আপনাকে সম্মান করা আমাদের সবার ওপর ফরজ! মানুষের এই দল সে তুরের তাজাল্লি দেখতে এসেছে, যেমনটি আপনার খোদা হযরত মুসা (আঃ) কে তুর পাহাড়ের চূড়ায় দেখিয়েছিলেন। আর জ্বীনদের মধ্যে থেকে তুর পাহাড়ের এ তাজাল্লি দেখতে এসেছি আমি।’

‘আমি যে খোদার বাণী নিয়ে এসেছি তাতে কি এ লোকদের বিশ্বাস নেই?’ উমরু দরবেশ প্রশ্ন করলেন।

‘যদি প্রশ্ন করা অপরাধ হয় তবে আমাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু হে আল্লাহ্‌র দূত! দয়া করে তুরের তাজাল্লি দেখিয়ে আমাদের মত পাপীদের মনের সমস্ত সন্দেহ দূর করে দিন।’ এক লোক বললো। আলী বিন সুফিয়ান লোকটাকে ভাল করে দেখে নিলেন। চিনতে পারলেন লোকটাকে, উমরু দরবেশের মিশনেরই লোক।

‘হ্যাঁ, হে পবিত্র ব্যক্তি!’ আলী বিন সুফিয়ান সামনে অগ্রসর হয়ে বললেন, ‘আমরা সবাই সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছি; আমাদের তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখান এবং এ মেয়েটি যদি জ্বীনদের  মেয়ে হয়ে থাকে তবে তাঁকে কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে যেতে বলুন। তাহলে আমাদের সব সন্দেহ দূর হয়ে যাবে।’

উমরু দরবেশ পাহাড়ের ওপর সেই বিরাট বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তোমরা ওদিকে তাকাও! অন্ধকারে তোমরা কিছু দেখতে পাচ্ছো?’

‘না, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না হুজুর!’

‘পাবে, পাবে, এখনি পাবে। আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করে তাকিয়ে থাক ওদিকে।’

তিনি মাটি থেকে একটি মশাল উঠিয়ে উঁচু করে তুলে ধরলেন এবং উচ্চ স্বরে বলতে লাগলেন, ‘হে খোদা! তোমার সহজ সরল মূর্খ বান্দারা সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে। তুমি তাদের সেই তাজাল্লি দেখাও, যেমন হযরত মুসা (আঃ) কে তুর পাহাড়ে দেখিয়েছিলে। আর তার জ্যোতিতে তুমি ফেরাউনের তখত-তাউস জ্বালিয়ে দিয়েছিলে! তুমি সেই জ্যোতি আবার দেখাও প্রভু!’

তিনি মশাল ডানে বামে কয়েকবার ঘুরালেন, কিন্তু পাহাড়ের ওপর কোন আলো জ্বললো না। আবার তিনি মশাল নাড়লেন, কিন্তু এবারও পাহাড়ের ওপর কোন আলো বা তাজাল্লি দেখা গেল না। উমরু দরবেশ অস্থির হয়ে এদিক ওদিক তাকালেন এবং আরো একবার মশাল উপর নিচ করলেন, তবুও সামান্যতম আলোর কিরণও দেখা গেল না পাহাড় চূড়ায়।

উমরু দরবেশ তখনো জানেন না, পাহাড়ের ওপর তার এক সঙ্গী নিহত অবস্থায় পড়ে আছে আর দু’জনকে রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছে আলীর সঙ্গীরা। উমরু দরবেশের সঙ্গীরা দেখতে পাচ্ছিল বার বার তিনি মশাল নাড়াচ্ছেন, কিন্তু তখন তাদের করার কিছু ছিল না। আলীর এক সঙ্গী তা দেখে বলে উঠলো, ‘আজ আর তুরের তাজাল্লি দেখা যাবে না দরবেশ। কষ্ট করে লাভ নেই।’ অন্যরা এ কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো।

‘আজ সত্যি তুরের তাজাল্লি দেখা যাবে না।’ আলী বিন সুফিয়ান উচ্চস্বরে বললেন। তিনি উমরু দরবেশকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘উমরু দরবেশ! আজ যদি তুমি পাহাড় থেকে আলোর শিখা দেখাতে পারো তবে আমি চিরকাল তোমার ভক্ত হয়ে থাকবো। জলদি তোমার কেরামতি দেখাও।’

এক ব্যক্তি খঞ্জর হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল আলী বিন সুফিয়ানের দিকে। তাঁর পেটের ভেতর খঞ্জর সেঁধিয়ে দেয়ার জন্য যেই সে হাত উপরে তুলল, অমনি পেছন থেকে তার দুই বগলের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে এমনভাবে গলা চেপে ধরলো কেউ, লোকটির দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে গেল। কে যেন তার কানে কানে বলল, ‘খঞ্জর ফেলে দাও।’ সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে খঞ্জর ছেড়ে দিল লোকটি।

সবাই তাকিয়ে আছে পাহাড়ের দিকে। এদিকে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে এক ব্যক্তি তাঁবুর পিছন দিয়ে তাঁবুর ভেতর ঢুকে গেলো। আশী আগেই তাঁবুর ভেতর ঢুকে পড়েছিল, সে আশীকে বললো, ‘আশী, শীঘ্র বের হও। আমাদের গোপন রহস্য ফাঁস হয়ে গেছে। যে লোক উমরু দরবেশের সঙ্গে কথা বলছে তাকে এ অঞ্চলের মানুষ বলে মনে হয় না। সম্ভবত সে মিশর থেকে এসেছে। এ লোক ঠিকই বলছে, আজ আর তুরের তাজাল্লি দেখা যাবে না! আমাদের পাহাড়ের সঙ্গীরা হয়তো ধরা পড়ে গেছে। উত্তেজিত জনতার হাতে পড়লে আর রক্ষে নেই। ওরা আমাদের ধরতে পারলে খুন করে ফেলবে। মনে হচ্ছে উমরু দরবেশের কপালে খারাবি আছে। তাঁকে নিঃসন্দেহে ওরা হত্যা করবে। আমি পালিয়ে যাচ্ছি। যদি বাঁচতে চাও, পিছু নাও আমার। ধরতে পারলে তোমার সঙ্গে ওরা পশুর মত ব্যবহার করবে।’

‘না আমি যাবো না। কখনোই না।’ আশী হেসে বললো, ‘বন্য পশুদের নিয়ে কোন ভয় নেই আমার। উমরু দরবেশকে সঙ্গ দেয়ার যে দায়িত্ব নিয়ে আমি এসেছি, বিপদ দেখে সে দায়িত্ব ফেলে পালিয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই আমার।’

‘তুমি পাগল হয়ে গেলে!’

‘না! আমি আগে পাগল ছিলাম।’ আশী বললো, ‘এখন আমার চোখ খুলে গেছে। বিবেক ও বুদ্ধি সঠিক পথে এসে গেছে। এখন আমি সেখানেই যাবো, যেখানে উমরু দরবেশ যেতে বলেন।’

বাইরে আলী বিন সুফিয়ানের ইশারায় ইমাম সাহেব লোকদের বললেন, ‘মুসলমান ভাইয়েরা আমার! আমরা তোমাদের সেখানে নিয়ে যাবো, যেখানে তুরের তাজাল্লি দেখানো হয়। আমাদের বোকা বানিয়ে যে অভিনয় গত রাতে দেখানো হয়েছে এবং আজ দেখানোর আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে গেলেই তোমরা তা দেখতে পাবে।’

আলী বিন সুফিয়ানের কমান্ডো বাহিনী লোকদের মধ্য থেকে এরই মধ্যে সে তিনজনকে সরিয়ে নিয়েছিল, যারা সুদানী গোয়েন্দা। কিন্তু জনগণ এর কিছুই টের পায়নি। তাদের বুকের সাথে তখনো খঞ্জরের মাথা ঠেকানো। অন্ধকারে ওরা তখন দাঁড়িয়ে আছে তাঁবুর পেছনে, তাদের ঘিরে রেখেছে আলীর কমান্ডোরা। উমরু দরবেশ তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন আগের জায়গায়।

তাঁবুর মধ্যে সুদানী গোয়েন্দা আশীকে বুঝাবার চেষ্টা করছিল। বলছিল, ‘আশী, আমাদের বাঁচার আর কোন পথ নেই। দেরী করলে আমরা কেউ রক্ষা পাবো না। জেদ করার সময় এটা নয়, চলো আমরা পালিয়ে যাই।’ কিন্তু আশী কিছুতেই তার সাথে যেতে রাজি হলো না, আর আশীকে রেখে সে গোয়েন্দাও যেতে চাচ্ছিল না।

সুদানী গোয়েন্দা খুবই অবাক হলো, মেয়েটি কেন তাঁর সঙ্গে যেতে অস্বীকার করছে? যতই তাকে বুঝানো হচ্ছে, চূড়ান্ত বিপদ মাথার ওপর, কিছুতেই কেন সে তা বুঝতে পারছে না? কেন আশী প্রতিবাদ করে বার বার বলছে, ‘তুমিও মুসলমান! আমিও মুসলামান। আর এই জনতাও মুসলমান!’ কেন বলছে, ‘আমি উমরু দরবেশকে ছেড়ে কোথাও যাবো না?’ তবে কি এর মাঝে কোন ‘কিন্তু’ আছে? উমরু দরবেশ এবং আশী কে আগেই দুশমনের সাথে হাত মিলিয়েছে! এসব ভেবে গোয়েন্দার মাথা খারাপ হয়ে গেল।

বাইরে শোরগোল ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। প্রায় নিরূপায় হয়ে সুদানী গোয়েন্দা খঞ্জর বের করে আশীকে খুন করার হুমকি দিল। সঙ্গে সঙ্গে আশী খাপ থেকে তলোয়ার বের করে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। উমরু দরবেশই তাকে বলেছিল, ‘তলোয়ার সব সময় হাতের কাছে রাখবে। বিপদ এলে এ তলোয়ারই তোমার সম্ভ্রম ও জীবনের নিরাপত্তা দেবে।’

আশী দ্রুত তলোয়ার হাতে নিয়েই বললো, ‘আমাদের দু’জনের কেউই এখন আর বাইরে যাবো না।’

একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুরুষ গোয়েন্দার মোকাবেলায় একটি মেয়ের চ্যালেঞ্জ খুবই হাস্যকর ব্যাপার! সে বুঝতে পারছিল, ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এমন মহামূল্যবান মেয়ে হাত ছাড়া হয়ে যাবে, এটাই বা কিভাবে মেনে নেয়া যায়! মহা সমস্যায় পড়ে গেল লোকটি। এখন হয় তাকে জোর করে নিয়ে পালাতে হবে নতুবা হত্যা করতে হবে। তার ধারণা ছিল, আশী তলোয়ার চালনায় তেমন পটু হবে না। লোকটি খঞ্জর হাতে তার ওপর আক্রমণ চালালো। আশী খঞ্জরের ওপর এমন জোরে তলোয়ারের আঘাত করলো যে, খঞ্জর তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল। হাত থেকে খসে পড়া খঞ্জর তাঁবুর খুঁটির সাথে বাড়ি খেয়ে ছিটকে ফিরে এসে পড়লো লোকটির পায়ের কাছে। ত্রস্ত হাতে সে আবার খঞ্জর উঠিয়ে নিল। আশী আবার তার খঞ্জরের ওপর আঘাত করলো আর মুখে বললো, ‘যে ওস্তাদের কাছে তুমি তলোয়ার চালাতে শিখেছো আমিও সে ওস্তাদের কাছেই প্রশিক্ষণ নিয়েছি।’

এরপর তাঁবুর সেই সংকীর্ণ পরিসরে চলতে লাগলো অসম লড়াই। একদিকে নারী, অন্য দিকে পুরুষ। এক জনের হাতে তলোয়ার, অন্য জনের হাতে খঞ্জর। এক পর্যায়ে আশীর একটি তীব্র আঘাত কৌশলে ফিরিয়ে দিয়েই অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় নিজেকে আশীর নাগালের মধ্যে নিয়ে গেল এবং তাঁকে নিয়ে গড়িয়ে মেঝেতে পড়লো সুদানী গোয়েন্দা। আশী তলোয়ার সামলে নেয়ার আগেই লোকটি তাকে কাবু করে তার বুকের ওপর চড়ে বসলো। সে আশীর কব্জিতে আঘাত করল। আশীর হাত থেকে খসে পড়লো তলোয়ার। কিন্তু লোকটি আশীকে হত্যা না করে তাঁর দুই বাহু মাটির সাথে চেপে রেখে বললো, ‘আমি তোমাকে হত্যা করবো না আশী! তুমি বুঝতে চেষ্টা করো।’

প্রচণ্ড ক্রোধে আশী তখন বাঘিনী হয়ে গেছে। সে মুখভর্তি থুতু ছুঁড়ে মারল লোকটির চেহারায়। চেহারা থেকে থুতু মোছার জন্য হাতের বাঁধন আলগা করলো লোকটি, সঙ্গে সঙ্গে সর্বশক্তি দিয়ে তার নাকের ওপর ঘুষি মারলো আশী। লোকটি সে আঘাত সামলাতে না পেরে নাক চেপে ধরে গড়িয়ে পড়লো তার গায়ের ওপর থেকে।  আশী চকিতে উঠে বসে সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার হাতে নিল। শুয়ে থেকেই খঞ্জর হাতে নেয়ার জন্য থাবা মারলো লোকটি, আশীর তলোয়ার নেমে এলো নিচে, লোকটার হাত দেহ থেকে আলাদা হয়ে গেল। পিছনে সরে যেতে চাইল সে, কিন্তু আশী দ্বিতীয় আঘাত পড়লো তার কোমরের ওপর। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এলো তাজা রক্ত, আশী সে রক্তের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমিও মুসলমান পিতা-মাতার সন্তান, এটা তোমার ভুলে যাওয়া উচিত হয়নি।’ সে এবার তলোয়ারের মাথা চেপে ধরলো তার শাহরগে। লোকটি অস্ফুট কণ্ঠে ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠলো, ‘না, আশী, না!’

আশী বললো, ‘চুপ গাদ্দার! আমি আর তোদের খেলার পুতুল নই। আমার ভেতর লুকিয়ে ছিল যে ঈমান, সে ঈমান আবার জেগে উঠেছে। সে ঈমানের বলেই তোকে আমি পরাজিত করতে পেরেছি। জাতির কোন গাদ্দারকে ক্ষমা করার কোন প্রশ্নই উঠে না। তোর মউত এখন লাফালাফি করছে এ তলোয়ারের ডগায়।’

বাইরে তখন রচিত হচ্ছিল অন্য ইতিহাস। আলী বিন সুফিয়ান একটি মশাল তুলে নিলেন, অন্য মশালটি হাতে নিলেন মসজিদের ইমাম সাহেব। চার-পাঁচজন কমান্ডো দাঁড়িয়ে ছিল উমরু দরবেশকে ঘিরে। কমান্ডোরা তাকে হত্যা নয় বরং হত্যাকারীদের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করছিল। সুদানী গোয়েন্দাদের আক্রমণ থেকে হেফাজতের জন্যই তাকে ঘিরে রেখেছিল ওরা।

আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছিল, তার কোন সাথীই আর মুক্ত নেই। কিন্তু বলা যায় না, দৃষ্টির অগোচরে আরো কেউ না কেউ থেকে যেতে পারে। তাই আলী বিন সুফিয়ান কয়েকজনকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, ‘বিবাদ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই উমরু দরবেশের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে নেবে তোমরা।’

উমরু দরবেশ এক কমান্ডারকে বললেন, ‘তাঁবুর মধ্যে একটি মেয়ে আছে, তাকেও সঙ্গে নিতে হবে। মেয়েটিও মুসলমান।’

কমান্ডোরা তাঁবুর মধ্যে ঢুকলো মেয়েটিকে ডেকে আনতে, ঢুকেই তারা অবাক করা দৃশ্যের সম্মুখীন হলো। দেখতে পেল, আশী এক ব্যক্তিকে তলোয়ারের মুখে বসিয়ে রেখেছে। লোকটির চেহারা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে আছে।

এ লোকটিকেও বন্দী করা হলো। আলী বিন সুফিয়ান উমরু দরবেশকে বললেন, ‘নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো, আমার লোকেরা যথাসময়েই ওই পাহাড়ে গিয়ে পৌঁছে ছিল। তাই সেখান থেকে কোন অগ্নিশিখা উঠতে পারেনি। সবচে উত্তম হয়, লোকদের সেখানে নিয়ে গিয়ে দেখানো, কিভাবে অগ্নিশিখা সৃষ্টি হতো। তাতে এই ভেলকিবাজী খেলায় বিশ্বাসী লোকদের ঈমান ঠিক হয়ে যাবে, আবার সঠিক বিশ্বাসে ফিরে আসবে বিভ্রান্ত লোকেরা।’

‘কিন্তু আমার মনমগজ আচ্ছন্ন করে আছে অন্য এক গুরুতর সমস্যা। সে জটিল সমস্যার দিকে সত্বর দৃষ্টি দেয়া উচিত!’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘ইসহাককে কারাগার থেকে মুক্ত করতে হবে। এ এলাকায় সুদানীদের বহু গুপ্তচর ছড়িয়ে আছে। তারা আজকের এ ঘটনার সংবাদ সুদানী সরকারকে অবহিত করার জন্য এক্ষুনি ছুটে যাবে। ফলে ইসহাককে নজরবন্দী অবস্থা থেকে কঠিন কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে এবং অবর্ণনীয় কষ্ট দিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলবে সুদান সরকার। আমি সুদানী সেনাপতিকে ধোঁকা দিয়ে বেরিয়ে এসেছি। এখানকার মুসলমানদের মনোভাব ও চিন্তাধারার পরিবর্তন করে সুদানীদের অনুগত করার জিম্মা নিতে রাজি হওয়ায় মুক্তি পেয়েছি আমি। এ শর্ত মেনে নেয়ার আগে আমি ইসহাকের সাথে শলাপরামর্শ করেছি। তাকে বলেছি, আমাদের মুক্তির এছাড়া আর কোন খোলা নেই। আমি যে সুদানীদের শর্ত মেনে নিয়েছিলাম তাদের ধোঁকা দেয়ার জন্য, এ ষড়যন্ত্রে ইসহাকও শরীক, এটাই ধরে নেবে ওরা। ফলে ইসহাকের জীবন এখন চরম ঝুঁকির সম্মুখীন।

আমার ইচ্ছা ছিল, এখনে এসে গোপনে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করবো। আশা ছিল, সুদানী কারাগারে আমাদের সৈন্যরা কি অবস্থায় আছে সে খবর কায়রোতে জানানোর কোন না কোন সুযোগ পেয়েই যাবো। তারপর আমি এ অভিনয় চালিয়ে যেতে থাকবো আর আপনারা ইসহাককে পালিয়ে আসার কোন একটা ব্যবস্থা ও সুযোগ সৃষ্টি করে দেবেন।

কিন্তু এখানে এসে দেখতে পেলাম, সুদানী গোয়েন্দারা আমার চারপাশে দুর্ভেদ্য প্রাচীর দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এখানকার গাদ্দার মুসলমানরা সারাক্ষণ চোখ রাখছে আমার প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর। আমি তাদের কঠিন আবেষ্টনীর মধ্যে পড়ে আছি। ভাগ্যক্রমে এ মেয়েটির মুসলিম পরিচয় জানা গেল।’

তিনি আশীর অতীতের সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। তারপর আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘চারদিকে তাকিয়ে আমি কোন আশার আলোই দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিভাবে আমার উদ্দেশ্য সফল করবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না তার কোন পথ। আমি খুবই দুঃখিত, আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা এতই সরল ও সোজা যে, তারা আমার মিথ্যা অভিনয়কে অবলীলায় সত্য বলে মেনে নিলো। আমি সর্বদা সুদানী গোয়েন্দাদের দৃষ্টিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা থাকতাম, কি যে করবো আমি কোন দিশাই পাচ্ছিলাম না।

আল্লাহ্‌ আমার নিয়ত পূরণ করেছেন। তিনি আমার কাছে আপনাকে মুক্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। এখন দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনার সময় নেই। আমি সবার আগে ইসহাককে মুক্ত করতে চাই। সুদানী গোয়েন্দারা ওখানে পৌঁছার আগেই আমি সেখানে পৌঁছে যেতে চাই। আপনি দু’জন সাহসী, বীর ও হুশিয়ার কমান্ডো দিয়ে আমাকে সাহায্য করুন।’

কিভাবে ইসহাককে উদ্ধার করা যায় তিনি সে পরিকল্পনা আলী বিন সুফিয়ানকে খুলে বললেন। আলী বিন সুফিয়ান পরিকল্পনা শুনে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ করে রইলেন। একটু পর মাথা তুলে পরিকল্পনা কিছুটা রদবদল করে বাছাই করা দু’জন কমান্ডো ও আশীকে সঙ্গে নিয়ে উমরু দরবেশকে রওনা হওয়ার অনুমতি দিলেন। বললেন, ‘আমি জনগণকে তুর পাহাড়ের তাজাল্লির আসল রহস্য উদঘাটনের জন্য পাহাড় চূড়ায় নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ওদের নিয়ে এখুনি এখান থেকে রওনা হয়ে যাও।’ অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উমরু দরবেশ দুই কমান্ডো ও আশীকে সঙ্গে নিয়ে তাঁবুর ভেতর ঢুকে গেল এবং তাঁবুর পেছন দিয়ে বেরিয়ে দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে বসলো। ধীর পায়ে ইসহাককে মুক্ত করার জন্য  চারজনের ছোট্ট কাফেলা নেমে এলো রাস্তায়। তারপর ক্ষিপ্রবেগে ঘোড়া ছুটতে শুরু করলো সুদানী কারাগারের উদ্দেশ্যে।

জনতা ক্রমেই উত্তেজিত ও ক্ষিপ্ত হচ্ছিল। অশান্ত কণ্ঠে বলাবলি করছিল, ‘কি হতে কি হয়ে গেল!’ আলী বিন সুফিয়ান উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘যদি তোমরা তুর পাহাড়ের জ্যোতির সত্যতা দেখতে চাও তবে আমার সাথে এসো। তোমরা অবশ্যই জানো, রাসুলে আকরাম (সঃ)-এর পর আর কোন নবী ও রাসুল আসবেন না। কারণ আমাদের প্রিয় নবীর আগমনের সাথে সাথে নবুয়তের সিলসিলা বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরে আল্লাহতায়ালা আর কোন দূত পাঠাননি এবং পাঠাবেন না। আল্লাহর দূত তো কেবল নবী ও রাসুলই হতে পারেন। বাকীরা বড়জোর সে নবীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বুজুর্গানে দ্বীন হতে পারেন। তারা মানুষকে ডাকবেন আল্লাহ্‌ ও রাসুলের পথে, কোরআন ও হাদীস ছাড়া আর কোন মোজেযা দেখিয়ে দ্বীনের পথে মানুষকে আহবান করার প্রয়োজন হবে না তাদের। মোজেযা বা কেরামতি দেখানোর কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ভণ্ড ও প্রতারকরা। উমরু দরবেশকে দরবেশকে প্রতারণার কৌশল শিখিয়ে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছে সুদান সরকার। উদ্দেশ্য তোমাদের ঈমান ও আকিদা নষ্ট করা। তোমরা দীর্ঘদিন সুদানী সরকার ও তার সেনাবাহিনীকে এ এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছো। এ জন্য রক্ত দিয়েছে এ মাটির সন্তানেরা। ওরা বুঝতে পেরেছে, শক্তি দিয়ে তোমাদের পদানত করা সম্ভব হবে না। তাই তারা তোমাদের গোলাম বানাবার জন্য এ পদক্ষেপ নিয়েছে। তোমরা নিজের কানেই শুনেছ, তিনি বার বার বলছিলেন, সুদানীদের সহযোগী হতে। এতেই তোমাদের বুঝা উচিত ছিল, তিনি কি চান।

হে মুসলমান ভাইয়েরা আমার! তোমরা সাবধান হও! সতর্ক হও! শত্রুরা যখন কৌশল ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়, তখন এ কথা দিবালকের মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তারা তোমাদের সম্মুখ যুদ্ধে মোকাবেলা করতে ভয় পায়। কারণ তোমরা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছো, আর ওদের ভয় এ সত্যকে। হক ও বাতিলের এ সংঘাতে তোমরা হকের পথ থেকে সরে দাঁড়াও এটাই ওদের একমাত্র লক্ষ্য।

প্রিয় ভাইয়েরা! এ দেশ ও এ দেশের মাটি তোমাদের। ইনশাল্লাহ শীঘ্রই এদেশে ইসলামী শাসন কায়েম হবে। কাফেররা তোমাদের মন থেকে ধর্মীয় ও জাতীয় অনুভুতিকে বিলীন করার যে চেষ্টা চালিয়েছে তা ব্যর্থ হয়ে গেছে। কিন্তু এটাই শেষ নয়। আজ তোমাদেরকে তুরের তাজাল্লি দেখিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে তোমাদের সামনে পাঠানো হবে খৃস্টান যুবতীদের। তাদের রূপ লাবণ্য দেখিয়ে তোমাদেরকে নির্লজ্জ বানাবার চেষ্টা করা হবে। সে ফাঁদে পড়ে তোমরা মানুষ থেকে পশুতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। তখন তোমরা বুঝতেই পারবে না, তোমাদের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ববোধ কোথায় বিলীন হয়ে গেছে। তোমরা তখন শ্রেষ্ঠত্বের গুণাবলী থেকে বঞ্চিত হয়ে ধীরে ধীরে পরিণত হবে কাফেরদের দাসে। সুদানের বাদশাহ মুসলমান নয়, সে কাফের! সে ইসলামের শত্রু এবং খৃস্টানদের বন্ধু! তোমরা কি খৃস্টান মেয়েদের মত তোমাদের বোন ও মেয়েদের পরপুরুষের সাথে বসে মদ পান করতে দেবে? তাদেরকে বেহায়া ও ব্যভিচারী হতে উৎসাহিত করবে? তোমরা কি চাও তোমাদের মসজিদগুলো বিরাণ হয়ে যাক? মানুষের পদতলে দলিত মথিত হোক কোরআনের ছিন্ন পাতা?’

‘কাবার প্রভুর কসম, আমরা তা চাই না।’ একজন আবেগে চিৎকার দিয়ে বললো, ‘উমরু দরবেশকে আমাদের সামনে এনে দাও। সে কেমন খোদার দূত আমরা দেখতে চাই।’

‘উমরু দরবেশ নির্দোষ, তিনি পরিস্থিতির শিকার!’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তিনি তোমাদেরই লোক! এখন তিনি তাঁর আসল রূপে ফিরে এসেছেন।

বন্ধুরা! আল্লাহর হাজার শোকর যে, তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত দিয়ে তোমাদের ধন্য করেছেন, মুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে তোমাদের। কাফেররা আল্লাহর সেই নেয়ামত থেকে তোমাদের বঞ্চিত করতে চায়।’

‘তুমি কে?’ দর্শকের সারি থেকে একজন উচ্চস্বরে বললো, ‘তোমাকে বেশ বিজ্ঞ ও পণ্ডিত মনে হয়। তুমি কি আমাদেরকে তার কেরামতির রহস্য দেখাতে পারবে?’

‘হ্যাঁ, তাই আমি তোমাদের দেখাচ্ছি।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন। তিনি তাঁবুর মধ্য ধেকে একটি পাত্র নিয়ে এলেন। পাত্রটি জ্বালানি তেলে ভর্তি। তিনি সেই তেল কাপড়ে মাখিয়ে মাটিতে রেখে দিলেন। তারপর তার ওপর পানি ঢাললেন। পরে সে কাপড়ের কাছে মশাল নিয়ে ছোঁয়াতেই দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। তিনি সকলকে বললেন, ‘যে কাপড়ের ওপর পানি ঢেলে উমরু দরবেশ আগুন ধরিয়েছিল, তাতে এই তেল মাখানো ছিল।’

‘এখন তোমাদেরকে সেই লোক দেখাবো, যে লোক এ কাজের সাথে জড়িত ছিল।’ আলী বিন সুফিয়ান তার এক সঙ্গীকে ডেকে বললেন, ‘তাকে নিয়ে এসো।’

জনতার ভীড় থেকে সামান্য দূরে অন্ধকারে লোকটিকে ধরে দাঁড়িয়েছিল কয়েকজন কমান্ডো। উমরু দরবেশের সেই সঙ্গীকে আলীর সামনে হাজির করা হলো। সহসা ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনে জনতা পিছন ফিরে তাকালো। দেখা গেল এক লোক ঘোড়া নিয়ে তীব্র বেগে পালিয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে। জনতা চিৎকার করে বললো, ‘একজন পালিয়ে যাচ্ছে!’

জনতার ভীড়ে তখনো সুদানী গোয়েন্দা লুকিয়ে ছিল এবং তাদেরই একজন পালিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আলীর দুই সঙ্গী ঘোড়া নিয়ে তৎক্ষণাৎ ছুটলো তার পেছনে। ঘোড়ার খুরের আওয়াজ দূরে মিলিয়ে যেতেই শোরগোল কমে এলো। আলী বিন সুফিয়ান জনতাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘দেখো, এই সে লোক, যে উমরু দরবেশের সহযোগী হিসাবে এখানে কাজ করছিল।’

মশাল উঁচু করে ধরে তার চেহারা সকলকে দেখানো হলো। কয়েকজন সমস্বরে চিৎকার করে বললো, ‘একে তো আমরা চিনি! আমাদের এলাকারই লোক।’

অন্য একজন বললো, ‘এ লোক তো মুসলমান!’

‘হ্যাঁ, এ ব্যক্তি মুসলমান!’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘এবং এ এলাকারই লোক। কিন্তু এ লোক বিশ্বাসঘাতক, বেঈমান।’ আলী বিন সুফিয়ান এ ব্যক্তির কার্যক্রম বিস্তারিত তুলে ধরলেন জনতার সামনে।

‘একে হত্যা করা হোক।’ উত্তেজিত জনতা চিৎকার করে উঠল, ‘মারো, শেষ করে দাও এ গাদ্দারকে।’ লোকজন তার দিকে ছুটে এলো প্রচণ্ড আক্রোশে। কেউ কেউ খাপ থেকে বের করে ফেললো তলোয়ার। মশালের আলোয় দেখা গেল সে তলোয়ারের চমক।

‘থামো।’ গর্জে উঠল আলী বিন সুফিয়ানের কণ্ঠ, ‘তোমরা আইন নিজের হাতে তুলে নিও না। বিচারের পর এর যা শাস্তি তা সে পাবে। এখন তোমাদের কাজ হচ্ছে একে হেফাজত করা। আরো কাজ আছে তোমাদের। এখনো তোমরা নুরের তাজাল্লি দেখানোর রহস্য দেখোনি। আমার সাথে এসো, আমি তোমাদের সে রহস্যও খুলে দেখাবো।’

আলী বিন সুফিয়ান হাঁটা ধরলেন। সমস্ত লোক পিছু নিল তার। তিনি সবাইকে নিয়ে সে পাহাড়ে চললেন, যেখানে কমান্ডোরা একজনকে হত্যা ও অন্য দু’জনকে রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল।

পরবর্তী বই ক্রুসেড – ১৬

টার্গেট ফিলিস্তিন

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top