১৪. তুমুল লড়াই

এভাবেই আবু ওয়াক্কাস ও আনতানুসের অপরিচিতির ব্যবধান দূর হয়ে গেল। আবু ওয়াক্কাস আনতানুসকে বললো, ‘আপনারা আমার মেহমান। ইফতারীর সময় ঘনিয়ে এসেছে, এখন আর কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। আপনারা সবাই আমাদের সাথে ইফতারী করবেন’।

আবু ওয়াক্কাসের নির্দেশে লোকজন এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লো। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আনতানুস ও ফাতেমা দীর্ঘদিন পর একান্ত সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে অভিভুত হয়ে গেল।

একটু পরই দামেশক থেকে অনেক দূরে এ নির্জন এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো আজানের পবিত্র ধ্বনি। স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর সাথে ইফতারে শামিল হলো আনতানুস ও তার সাথে আসা অন্য এগারোজন কমাণ্ডো সৈনিক। ইফতারের পর জামাতের সাথে সালাতুল মাগরিব আদায় করলো সবাই। নামাজের পর খাওয়া দাওয়া শেষে সৈন্যরা যার যার তাবুতে ফিরে গেল। সারা দিনের বিরামহীন সফরের পর বিশ্রামের সুযোগ পেয়ে অনেকেই তাবুতে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো। কেউ কেউ মেতে উঠলো গল্প গুজবে। মেয়েরা তাদের তাবুর সামনে গোল হয়ে বসে গল্প গুজব ও গান শুরু করে দিলো। কমাণ্ডো দল স্বেচ্ছাসেবীদের তাবু থেকে একটু দূরে তাদের তাবু টানালো। আনতানুস তার দলকে বললো, ‘তোমরা বিশ্রাম নাও, আমি একটু আবু ওয়াক্কাসের ওখানে যাচ্ছি’। আনতানুস বেয়ে গেল তাবু থেকে।

রাত আরেকটু গভীর হলো। ফমো এক ফাঁকে গোপনে সের পড়লো মেয়েদের জটলা থেকে। তাঁবুর বাইরে এসে সে ব্যাকুল হয়ে আনতানুসকে তালাশ করতে লাগল। আনতানুস মেয়েদের তাবু থেকে একটু দূরে এক বালিয়াড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন নিশ্চিত হলো মেয়েদের তাবু থেকে বেরিয়ে আসা মহিলা ফাতেমা ছাড়া আর কেউ নয়, আনতানুসও বেরিয়ে এল আড়াল থেকে।

আনতানুসসের মনে পড়ছিল ফামেতার সাথে তার প্রথম সাক্ষাতের কথা। সে সময় আনতানুস ছিল সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা। হারানো গগুমাস্তগীনের দূর্গে প্রবেশ করেছিল তথ্য সংগ্রহের জন্য। গুমাস্তগীনের অন্দর মহলের তথ্য সংগ্রহের জন্য তার দরকার ছিল অন্তপুরের কোন নারীর সাথে যোগাযোগ। এ কাজে ব্যবহারের জন্যই সে ফাতেমার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। কিন্তু সে সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত তাদের নিয়ে যায় প্রেমের রাজ্যে।

ফাতেমা ছিল হারানের শাসক গুমাস্তগীনের এক বেগম। তাকে গোয়েন্দা কাজে লাগাতে গিয়েই আনতানুস জড়িয়ে পড়েছিল বিপদে। ফতেমা গুমাস্তগীনের এক খৃষ্টান উপদেষ্টাকে হত্যা করে ফেলে। আনতানুস গ্রেফতার হয়েও ফাতেমাকে নিয়ে পালাতে সমর্থ হয়েছিল সেনাপতি শামস বখতের সহায়তায়। সুলতান আইয়ুবী আনতানুসকে রেখে ফাতেমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দামেশকে। আনতানুসকে শামিল করে দিয়েছিলেন কমান্ডো বাহিনীতে। সেই থেকে ওদের মাঝে এই বিচ্ছিন্নতা। দীর্ঘদিন পরে তার সাথে ফাতেমার এই আকস্মিক দেখা।

আনতানুস এক সময় তীব্রভাবে অনুভব করতো, ফাতেমাকে ছাড়া তার জীবন একেবারেই অচল। এ মেয়ে তার অন্তরের গভীরে এমন আসন করে নিয়েছে, যেখান থেকে তাকে সরানো অসম্ভব। কিন্তু সুলতানের সাথে সাক্ষাতের পর সে প্রয়োজনের তীব্রতা কমে আসে। সে অনুভব করে, সবকিছুর আগে তার প্রয়োজন, গোয়েন্দা হিসেবে সাফল্য অর্জন। ফাতেমাকে আজ নতুন করে দেখার পর সে অনুভূতিতে আবার ফাটল ধরে। তার মনে হতে থাকে, ফাতেমাকে ছাড়া তার জীবন অর্থহীন।

ফাতেবা আইয়ুবীর সামনে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেছিল, ‘আমি এ যুবকের জীবন সাথী হতে চাই’। আইয়ুবী তাকে আশ্বাস দিয়েছিল, ‘সময় আসুক, তোমার আশা পূরণ করা হবে’। এ আশ্বাসের কথা স্মরণ করেই বিচ্ছেদের দিনগুলো সে পার করছিল আনতানুসের স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে। আনতানুসকে আজ এ অবস্তায় দেখতে পেয়ে তার আবেগের দরিয়ায় আবার অজানা স্রোতের ঢেউ উঠলো। ভালবাসার মধুর রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো মন।

তাদের এ সাক্ষাৎ হলো প্রচণ্ড আবেগময়। ক্ষণিকের জন্য ওরা উভয়েই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। কিন্তু আনতানুস দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে ফাতেমার বাহু বেস্টনী থেকে মুক্ত হয়ে বললো, ‘ফাতেমা! এখনও আমাদের শাদীর ফরজ সম্পন্ন হয়নি। আবেগের বশে একবার আমরা শরীয়তের সীমারেখা লঙ্ঘন করেছি। তার খেসারত আমাদের কম দিতে হয়নি। এ জন্য আমি সুলতান আইয়ুবীর সামনে বড়ই লজ্জিত। লজ্জিত আমার জাতির সামনেও!

তোমার সাথে দেখা হওয়া একটা আকস্মিক ব্যাপার ছিল। প্রথম দেখার সময় এ কথা কখনো ভাবিনি, তোমার সাথে এভাবে প্রেমের বন্ধনে জড়িয়ে পড়বো। কিন্তু কয়েকদিনের মেলামেশা এবং বিপদের মোকাবেলা করতে গিয়ে কখন যে আমাদের দুটি হৃদয় এক হয়ে গেছে  আমি তা  টেরও  পাইনি।

আমি কমাণ্ডো বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম একটি নির্দিষ্ট ফরজ আদায়ের জন্য। সে ফরজ আজো আমার আদায় হয়নি। সম্মানিত সুলতান একবার আমার অপরাধ ক্ষমা করেছেন। আমার ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন একটি কমাণ্ডো গ্রুপের। তোমাকে আমি গভীর ভাবে ভালবাসি কিন্তু আগে আমাকে আমার ফরজ আদায় করতে দাও’।

‘আমিও এক ফরজ আদায় করতেই বেরিয়েছি!’ ফাতেমা বললো, ‘আমি তোমাকে বলতে চাই, গুমাস্তগীনকে হত্য করবে এক নারী! এবং সে নারী এখন তোমার সামনে!’

‘অসম্ভব!’ আনতানুস বললো, ‘সম্মানিত সুলতান কখনোই মেয়েদেরকে সম্মুখ যুদ্ধে পাঠাবেন না। আমার তো মনে হয়, তিনি তোমাদের সবাইকে ফেরত পাঠাবেন’।

‘না, আমাকে তিনি ফেরাতে পারবেন না’। ফাতেমা তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বললো, ‘আমি প্রমাণ করে দেখিয়ে দেব, মেয়েরা শুধু অন্দর মহল ও গৃহ কোণে বন্দী থাকার জন্য জন্মায়নি, জিহাদের ময়দানেও তারা পুরুষের মতই সাহসী ভূমিকা রাখতে পারে’।

আনতানুস কিছু বলতে যাচ্ছিল, সহসা সে আনতানুসের হাত চেপে ধরে বললো, ‘আনতানুস, আমার একটি আশা তুমি পূরণ করো! আমাকে তুমি ‘সঙ্গে নিয়ে চলো। নারী নয়, আমি এক পুরুষের পোশাকেই তোমার সাথে পথ চলবো’।

‘না’। আনতানুস দৃঢ়তার সাথে বললো, ‘এমনটি কখনো হতে পারে না। তোমাকে আমার সঙ্গে রাখলে তোমাকে রক্ষা রকার চিন্তাই আমার মন-মগজকে সব সময় আচ্ছন্ন করে রাখবে। তাহলে আমি আমার ফরজ পালন করতে পারবো না’।

‘না, আনতানুস, না। আমি কোন অবলা নারী নই। দুর্বল এবং ভীতুও নই। আমর স্বপ্ন ও সাহসের সাথে আজ একটু হলেও যুক্ত হয়েছে ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণ। আমি কেবল আমাকে রক্ষা করবো ভেবে না, প্রয়োজনে তোমাকেও সহায়তা করতে পারবো। বিশ্বাস করো, কখনো আমাকে তোমার বোঝা ভাবতে দেবো না’।

‘না, তবু এমনটি সম্ভব নয়। কর্তৃপক্ষ যদি কখনো জানতে পারে, আমি সামরিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে কর্তৃপক্ষের অগোচরে কোন মেয়েকে সঙ্গে রেখেছি, তবে সে অপরাধে আমাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে। ফাঁসী না হলেও কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠের পথ আমি আড়াতে পারবো না। তোমর ও আমার অন্তর যতই পবিত্র হোক, আমাদের উদ্দেশ্য যতই সৎ ও মহত হোক, পৃথিবীর কোথাও আমরা এর যথার্থতা প্রমাণ করতে পারবো না। ফাতেমা! যুদ্ধ কখনো শুধু মনের আবেগ দিয়ে হয় না। সৈনিক কখনো মনের খেয়াল খুশী মত চলতে পারে না। তুমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করো যেখানে যাচ্ছিলে, যাও। হয়তো সুলতান আইয়ুবী তোমাদেরকে আহতদের সেবার কাজে লাগাতে পারেন। আল্লাহর যদি মঞ্জুর হয়, আম যেমন আমাদের দেখা হলো, তেমনি আবার আল্লাহ আমাদেরকে একত্রিত করবেন’।

‘আনতানুস! এতদিন পর তোমার দেখা পেলাম। তোমাকে দেখে আমার মনে হচ্ছিল, আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। তুমি যে ময়দানে লড়াই করছো, আমিও সে ময়দানের পথ ধরেছি। হয়তো আল্লাহ আমাকে এগিয়ে নেয়ার জন্যই তোমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। এখন তেকে আমরা দু’জন একই সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছুটে যাবো লড়াইয়ের ময়দানে। সে ময়দান থেকে আল্লাহর মঞ্জুর হলে আমরা বিজয়ী হয়ে ফিরে আসবো, আর নয়তো হাতে হাতে হাত ধরে একসাথে পান করবো শাহাদাতের পেয়ালা। আনতানুস! তুমি কি আমাকে বলতে পারো, আবার আদৌ আমাদের সাক্ষাৎ হবে? হলে সেটা কবে, কোথায়?’

আনতানুস কতক্ষণ মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল। তাৎক্ষণিক এর কোন জবাবাদিতে পারল না। এক সময় মাথা তুলে ধীর কণ্ঠে বললো, ‘ফাতেমা! তোমার এ প্রশ্নের জবাব দেয়অ বড়ই কঠিন। এক অনিশ্চিত জীবনের পথ ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা। হয়তো আবার আমাদের সাক্ষাৎ হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে! আবার এমনও হতে পারে, আমাদের দু’জনের যখন সাক্ষাৎ হবে তখন একজন জীবিত, অন্যজন মৃত। ফাতেমা! একজন কমাণ্ডো কখনো নিজের ব্যাপারে কিছু বলতে পারে না। কোন মানুষ যেমন বলতে পারে না। কতক্ষণ সে বেঁচে আছে, তেমনি পারে না কোন কমাণ্ডোও। কিন্তু মানুষের একটি ঠিকানা থাকে, ভাল-মন্দ জানার একটি ব্যবস্থা থাকে। কমাণ্ডোদের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। সে নিজেই জানে না, কখন কোথায় সে থাকবে। আর আমার মত যারা গোয়েন্দা কমাণ্ডো, তাদের অবস্থা আরো করুণ! আর আমার মত যারা গোয়েন্দা কমাণ্ডো, তাদের অবস্থা আরো করুণ! গোয়েন্দাদের লাশেরও কোন হদিস থাকে না। কিন্তু কথা দিচ্ছি, যদি বেঁচে থাকি, যুদ্ধ শেসে তুমি যেখানেই থাকে, আমি খুঁজে বের করে নেবো। আর কিছু নয়, যুদ্ধ শেষে তোমার সাথে দেখা করাই হবে আমার প্রথম এবং একমাত্র কাজ’।

‘এমনও তোহ তে পারে, তুমি আহত হয়ে ফিরে আসবে ক্যাম্পে। আর তোমার ব্যাণ্ডেজে মলম লাগিয়ে দেয়া ও সেবা করার জন্য যে মানুষটিকে আল্লাহ মনোনিত করবেন, সে মানুষটি আমি?’ বললো ফাতেমা।

আনতানুস পরিবেশকে একটু হালকা করার জন্য বললো, ‘এমনটি কল্পনা করতে দোষ কি! তবে গোয়েণ্দা কমাণ্ডোদের মলম-পট্টি সাধারণত শত্রুরাইকরে থাকে’। তারপর একটু বিরতি দিয়ে বললো, ‘ফাতেমা! বেশী আবেগপ্রবণ হয়ো না। মুজাহিদদের শুধু জীবনই কুরআনী দিতে হয় না, আবেদ এবং আশাকেও কুরবানী দিতে হয়। যদি তুমি চাও, তোমার মত মেয়েরা আর ধনী ও আমীরদের হেরেমের সৌন্দর্য সামগ্রী হবে না; খৃস্টানদের পশুত্ব ও বর্বরতা থেকে নিরাপদে থাকবে তারা, তবে আপাতত ব্যক্তিগত ক্রোধ ও রাগ। গুমাস্তগীনকে হত্যা করার দায়িত্ব পালন করতে হবে নিষ্ঠার সাথে। কেবল সে দায়িত্বের কথাই শুধু মনে থাকবে তোমার, আর কিছু নয়’।

একটু পর। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একে অন্যকে বিদায় জালালো ওরা। পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে এগিয়ে গেল নিজ নিজ তাবুর দিকে। আনতানুস যতই উপদেশ খয়রাত করুক, সে নিজে যেমন ফাতেমাকে ভুলতে পারল না, তেমনি ফাতেমাও ভুলে যেতে পারল না আনতানুসের প্রতি তার ভালবাসার কথা। এমনটি আনতানুসের উপদেশের পরও মন থেকে কিছুতেই দূর করতে পারল না গুমাস্তগীনকে খুন করার সেই অদম্য নেশাও।

সুলতান আইয়ুবীর সময় কাটছিল যুদ্ধ ক্ষেত্রের নকশা দেখে। কখনো তিনি নকশার রেখাগুলোর দিকে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন। কখনো অশ্বারোহী সৈণ্যদের যুদ্ধ প্রস্তুতি ও মহড়া দেখতেন। কখনো নকশায় নতুন করে দাগ দিতেন। তিনি তাঁর মেধা ও বুদ্ধির সব শক্তি নিয়োজিত রেখেছিলেন যুদ্ধের পরিকল্পনাকে নিখুঁত ও পরিপূর্ণতা দান করতে।

তিনি মূল যুদ্ধ পার্বথ্য উপত্যকা ও তৎসংলগ্ন সমতল ভূমিতে চালানোর পরিকল্পনায় অটল রইলেন। পরিকল্পনার ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করতে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন, বাম দিকের উচুঁ প্রান্তর ও তার পিছনের পর্বতশ্রেণী মাড়িয়ে শত্রুর এগিয়ে আসার সম্ভাবনা মোটেই নেই। কিন্তু ডািন দিকের পার্বত্য টিলা তেমন দুর্গম ছিল না। টিলার পেছনের খোলা ময়দানে শত্রুসেনারা জমায়েত হলে এ পার্বত্য টিলা অতিক্রম করা তাদের পক্ষে তেমন দুঃসাধ্য নয়। দুশমন এদিক দিয়ে আক্রমণ করলে সুলতান আইয়ুবীর প্ল্যান হুমকীর সম্মুখীন হওয়ার আশংকা আছে। তাঁর কাছে এত অধিক সৈন্য নেই যে, তিনি সেদিকে সৈন্যদের প্রাচীর দাঁড় করাতে পারেন। অবশ্য এদিকের টিলার আড়ালে তিনি তীরন্দাজদের একটি ক্ষুদ্র বাহিনীকে মোতায়েন রেখেছেন। কিন্তু এ ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। এখানে যুদ্ধ করার জন্য তিনি দু’টি অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীকে প্রস্তুত রেখেছিলেন। কিন্তু তাদেরকে এক গোপন স্থানে লুকিয়ে রেখেছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ের আগে তাদের ময়দানে আসার অনুমতি ছিল না। এ বিষয়টি সুলতান আইয়ুবীকে ভাবিয়ে তুললো। তিনি তাঁর সঙ্গের বাহিনীকে ডান দিকে আরেকটু এগিয়ে নেবেন কিনা এটা দেখার জন্য এক উচুঁ টিলার ওপর চড়ে সেদিকে তাকালেনা। সহসা দূর দিগন্তে তিনি দেখতে পেলেন ধূলি ঝড়। এমন ধুলি মেঘের সাথে সৈন্যরা ভালমতই পরিচিত। ধূলির এ মেঘ দেখেই তিনি বুঝতে পারলের, ওদিক দিয়ে ছুটে আসছে কোন অশ্বারোহী বাহিনী। একটু পরেই ঘোড়া চোখে পড়লো তাঁর। ধূলি মেঘের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, অশ্বারোহীরা এক লাইনে নয়, বরং পাঁচটি লাইন ধরে এগিয়ে আসছে। বাহিনী ছোট নয়, অন্তত চার-পাঁচশ অশ্বারোহীর এক বিশাল বাহিনী।

এর শত্রু ছাড়া আর কে হতে পারে? সুলতান আইয়ুবী গর্জন করে বললেন, ‘কেন, এ রাস্তায় প্রহরী, কমান্ডো বা গোয়েন্দাদের কেউ কি ছিল না? এত বড় বাহিনী এগিয়ে আসছে, এদের কেউ বাঁধাও দেয়নি, কোন খবরও দেয়নি, এটা কেমন করে হলো?’

তিনি দ্রুত টিলা থেকে নেমে এলেন এবং বাহিনীকে বললেন, ‘তোমরা জলদি তৈরী হও! মুজাহিদ, মনে রেখো, অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি থেকে বিজয় ছিনিয়ে নেয়াই বাহাদুর সৈনিকের কাজ!’ যুদ্ধের নাকারা বেজে উঠলো। নাকারা বাজার সাথে সাথে সমস্ত সেনাবাহিনী প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে ময়দানে দাঁড়িয়ে গেল। সুলতান আবার ছুটে গেলেন সেই টিলার ওপর। তারপর ছুটে আসা বাহিনীর দিকে দৃষ্টি ছোড়ে অনড় দঁড়িয়ে রইলেন।

কিছুক্ষণ পর। ঘোড়া আরো নিকটতর হলো। এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অশ্বারোহীদের। তাদের চলার ভঙ্গি আক্রমণাত্মক নয়। সহজ সচ্ছন্দ পতিতে এগিয়ে আসছে কাফেলা। সুলতান একটু অবাক হলেন। সঙ্গের এক কমাণ্ডারকে আদেশ দিলেন, ‘কয়েকজন অশ্বা রাহী নিয়ে সামনে দৌঁড়াও। দেখো এরা কারা?’

চারজন অশ্বারোহী নিয়ে ছুটলো কমাণ্ডার। একটু পর ফিরে এলে বাহিনীর আগে আগে। দূর থেকেই চিৎকার করে ওরা বলছিল, ‘এর দামেশক থেকে আসেছে। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। তাদের সাতে নারী ফৌজও আছে’।

‘কি! নারী ফৌজ!’ সুলতান আইয়ুবী বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘মেয়েদের সেনা দল?’

‘জ্বি, চারশ নারী ও একশ পুরুষ এ বাহিনীতে’।

তিনি আবেগে উদ্বেলিত হয়ে বললেন, ‘বুঝেছি, এ বাহিনী আমার বিধবা বোন পাঠিয়েছেন। ওস্তাদ জঙ্গীর বিধবা পত্নী আবারো প্রমাণ করলেন, তিনি মরহুমের উপযুক্ত সহধর্মিনী ছিলেন। যে জাতি এমন মায়েদের স্নেহ ও সেবা পায়, সে জাতির সন্তানদের চেয়ে সৌভাগ্যবান আর কে আছে?’

সুলতান আইয়ুবীর চেহারা আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। উৎফুল্ল কন্ঠে হাসতে হাসতে তিনি পাশে দাঁড়ানো সেনাপতিদের বললেন, ‘এ জাতির মেয়েরা দেখছি মেষ পর্যন্ত তোমাদেরকে বিজয়ী করেই ছাড়বে’।

‘আমরা এত অপমানিত নই, বরং সম্মানিত বোধ করছি সুলতান। পুলকিত বোধ করছি এ জন্য যে, জেহাদের প্রেরণা জাতির প্রতিটি হৃদয়কে আলোকিত করে তুলেছে। জেহাদ করার দায়িত্ব গুটিকয় সৈনিকের নয়, সমগ্র জাতির। জাতি এখন সে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। আর এ সত্যের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ময়দানে নেমে এসেছে অন্তপুরবাসী মায়েরা ও মেয়েরা। তবে ওদের কষ্ট করতে হবে না, আপনি এ বোনদের আশ্বস্ত করতে পারেন, তোমাদের ভাইদের শিরায় খুন এখনও নিঃশেষ হয়নি, ইনশাআল্লাহ তাদের খুনই তোমাদের মান-সম্ভ্রম ও বিজয়ের জামিনদার। এ জাতির একটি মেয়েও শত্রুদের হাতে লাঞ্ছিত হলে আমরা মরেও শান্তি পাব না’।

সুলতান আইয়ুবী উপত্যকা থেকে নেমে সামনে অগ্রসর হলেন। মেয়ে ও পুরুষ স্বেচ্ছাসেবকদের সম্মিলিত বাহিনী ক্রমশ এগিয়ে তার কাছে এসে থেমে গেলো। এ বাহিনীর কমাণ্ডার আবু ওয়াক্কাস ঘোড়া থেকে নেমে সুলতান আইয়ুবীর সামনে এসে যথারীতি সালাম দিয়ে নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর লিখিত চিঠি পেশ করলেন।

চিঠি খুলে চোখের সামনে মেলে ধরলেন আইয়ুবী। তাতে লিখা ছিলঃ

প্রিয় ভাই সালাহউদ্দিন আইয়ুবী! আল্লাহ তোমার ও তোমার বাহিনীর সকলের মদদ দান করুন। যদি আমার স্বামী বেঁচে থাকতেন, তবে বিশাল শত্রুর মোকাবেলায় নিশ্চয়ই এত অল্প সৈন্য নিয়ে তোমাকে ময়দানে এগিয়ে যেতে হতো না। তোমর সাহায্যে অবশ্যই তিনি সেনা সাহায্য পাঠাতেন। আমি তোমাকে তেমন কোন সাহায্য পাঠাতে পারছি না। তবে তোমার শান্তনার জন্য বলি, এখানে আমি বসে নেই। এ মুহূর্তে আমার দ্বারা যতটুকু সম্ভব হলো তা পাঠিয়ে দিলাম। এ মেয়েদেরকে আমি আহতদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরানো ও তাদের ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ করার প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ওদের সাথে ঔষধ এবং ব্যান্ডেজের সামগ্রীও পাঠিয়েছি। ওদের সাথে রয়েছে একশ স্বেচ্ছাসেবী পুরুস সেনা। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকরা ওদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এরা সকলেই রাতের অতর্কিত আক্রমণের ট্রেনিং পেয়েছে। এদের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার কোন অভাব নেই। তবে একটু বেশী আবেগপ্রবণ।

আমি জানি, তুমি মেয়েদেরকে যুদ্ধের ময়দানে রাখতে মোটেই পছন্দ করবে না। আমি তোমার এ মনোভাব জানার পরও বলছি, যদি এদের তুমি দামেশকে ফেরত পাঠাও, তবে দামেশকের জনসাধারণ খুবই কষ্ট পাবে। তাদের উৎসাহ ও মনোবল ভেঙ্গে যাবে। তুমি জানো না, দামেশকে এখন মানুষের মনে কি প্রচণ্ড জযবা বিরাজ করছে। সমস্ত পুরুষরাই এখন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উন্মুখ। মেয়েরাও তোমার নেতৃত্বে যুদ্ধ করতে আগ্রহী। এ বাহিনীকে শহরের সর্বস্তরের জনতা তাদের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা দিয়ে তোমার কাছে পাঠিয়েছে। এখানে এখন শিশুরাও যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে। এ চেতনা অটুট থাকলে জেহাদের ময়দানে তোমার সৈন্যদের কোন ঘাটতি হবে না ইনশাআল্লাহ’।

ইতি তোমার বিধবা বোন।

চিঠি পড়ে সুলতান আইয়ুবী আবগে অভভুত হয়ে পড়লেন। তাঁর চোখ ভরে উঠল আনন্দশ্রুতে। তিনি মেয়েদের দিকে ফিরে তাকালেন। অশ্বপৃষ্ঠে তাদেরকে দেখাচ্ছিল বীর যোদ্ধার মত। সুলতান আইয়ুবীর আদেশ মেয়েরা অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তিনি তাদের বললেন, ‘আমি তোমাদের সবাইকে যুদ্ধের ময়দানে খোশ আমদেদ জানাচ্ছি। দেশ ও জাতির খেদমতে তোমরা যে আবেগ ও প্রেরণা নিয়ে এসেছো, তার মূল্য আমি দিতে পারবো না, তার প্রতিদান আল্লাহই তোমাদের দেবেন। আমি কোন দিন চিন্তাও করিনি, মেয়ে দরকে আমি যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহবান জানাবো। আমর বড় সংকোচ ও লজ্জা হয়, ইতিহাস হয়ত বলবে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর নারী সমাজকে নামিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তোমাদের আশাকে আহত করবো না। তবে রনাঙ্গণে রাখার আগে আমি তোমাদের সুযোগ দিচ্ছি, তোমরা আবারো চিন্তা করো, যারা এখানে আবেগের বশে চলে এসেছো, তারা পৃথক হয়ে যাও নিজ নিজ সারি থেকে। আর তারাও সরে দাঁড়াও, যাদের মনে সামান্যতম ভয় এবং দ্বিধা রয়ে গেছে’।

কিন্তু একটি মেয়েও সারি থেকে সরে দাঁড়ালো না। সুলতান আইয়ুবী তখন তাদেরকে বললেন, ‘যদি তোমরা যুদ্ধই করতে চাও, তবে শুনে নাও যুদ্ধের নিয়ম। নেতার নির্দেশের বাইরে কেউ এক পা-ও এগুবে না। নির্দেশ পেলে কেউ তা পালন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাও করবে না। কোন নির্দেশ তোমার পছন্দ হোক আর না হোক বিনা প্রশ্নে তা মান্য করবে। এবার যুদ্ধে তোমদের অবস্থান জেনে নাও। আমি তোমাদেরকে তুলনামূলক নিরাপদ স্থানে থাকতে নির্দেম দিচ্ছি। যুদ্ধের সময় পুরুষদের অতিক্রম করে কেউ সামনে যাবে না। এবার যুদ্ধের অবস্থা বর্ণনা করছি। যুদ্ধের সময় এ অঞ্চল শত্রুর কবলে পড়তে পারে। হয়ত তীরের আঘাতে তোমরা কেউ মারা যেতে পারো। লড়াইতে শরীক হওয়ার আগে তোমাদের জানা দরকার, বর্শা ও তলোয়ারের আঘাত বড় কঠিন ও বেদনাদায়ক। এবার বলো, কে কে এ যুদ্ধে অংশ নিতে চাও’। একটি মেয়ে হাত উপরে তুলে উচ্চ স্বরে বললো, ‘আপনি ইতিহাসের কথা বলেছেন। আমরাও ইতিহাসকে ভয় পাই। যদি আমরা আজ এখান থেকে ফিরে যাই, ইতিহাসকে ভয় পাই। যদি আমরা আজ এখান থেকে ফিরে যাই, ইতিহাস বলবে, জাতির কন্যারা তাদের নেতা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে রণাঙ্গণে ফেলে রেখে নিজেরা ভয়ে ঘরের কোণে ফিরে গিয়েছিল। এ অপবাদ আমরা কেউ মাথা পেতে নিতে পারি না’।

অন্য এক মেয়ে বললো, ‘আল্লাহ সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বাহুতে অনেক শক্তি দান করেছেন। কিন্তু আমাদেরকে তিনি পঙ্গু করে পাঠাননি যে, জাতির দুর্দিনে শুধু গৃহকোণে বসে অশ্রু বিসর্জন করবো’।

আরেক মেয়ে কিছু বলার জন্য হাত তুলল। সুলতান বললেন, ‘বলো, তুমি কি বলতে চাও’।

‘মাননীয় সুলতান! তিন মাস আগে আমার বিয়ে হয়েছে। আমি আমার স্বামীর অনুমতি নিয়েই এখানে এসেছি। আমি আপনাকে বলতে চাই, আমাকে যুদ্ধের সুযোগ না দিলে আমি আর কোনদিন আমার স্বামীর ঘরে ফিরে যাবো না’।

‘তোমার স্বামী নিজে যুদ্ধে না এসে তোমাকে পাঠাল কেন?’

সুলতান আইয়ুবী প্রশ্ন করলেন, ‘সে কেমন স্বামী, যে তার নববধূকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দিল?’

‘সুলতান! সে তো অকেন আগেই আপনার বাহিনীতে শামিল হয়ে আছে! মেয়েটি উত্তর দিল।

এ মেয়ে থামতেই সমস্ত মেয়ে সমস্বরে চিৎকার শুরু করে দিল, ‘সুলতান! আপনি আমাদের সুযোগ দিন। আমরা আপনাকে নিরাশ করবো না’।

সুলতান হাত তুলে ওদের থামতে ইশারা করলেন। থেমে গেল মেয়েদের কলরব। সুলতান বললেন, ‘যুদ্ধের ময়দানে তোমাদেরকে পুরুষদের আগে আগিয়ে দেবো, এমন চিন্তা কারো থাকলে সে কথা ভুলে যাও। তোমাদের জন্য ছোট ছোট গ্রুপ করে দিচ্ছি। প্রত্যেকেই নিজ নিজ গ্রুপ লিডারের নির্দেশ মত চলবে। সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। তোমাদের কারো বিররুদ্ধে যেন শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ শুনতে না হয়’।

তিনি সে দিনই মেয়েদেরকে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে দিলেন। প্রত্যেক গ্রুপের সাথে দিলেন দু’জন করে পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক। এসব স্বেচ্ছাসেবকরা সবাই ছিল সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত। কিন্তু সুলতাম আইয়ুবী তাদেরকে যথারীতি আহতদের সেবা কাজে নিয়োগ করলেন। কারণ তারা সামরিক প্রশিক্ষণ পেলেও নিয়মিত সৈনিক ছিল না।

মেয়েদের ক্যাম্প পুরুষদের তাবু থেকে দূরে পর্বতের এক নিরাপদ স্থানে স্থাপন করা হলো। যারা আহতদের রণাঙ্গণ থেকে সরিয়ে আনা ও চিকিৎসার কাজে নিয়োজিত ছিল, তাদের জায়গায় নিয়োগ দেয়অ হলো এ স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীকে, আর ওদেরকে ফেরিয়ে নেয়া হলো মূল সেনাবাহিনীতে। এসব স্বেচ্ছাসেবী সৈনিক ও মেয়েদের আরও প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য কয়েকজন অভিজ্ঞ সালারদের দায়িত্ব দিলেন সুলতান।

ফাতেমা, মানসুরা, হুমায়রা ও সাহারা এই গ্রুপে পড়ল। তাদের এই এক গ্রুপে পড়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। তাদের পরস্পরের মধ্যে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছিল গভীর সখ্যতা ও বন্ধুত্ব। তারা একসাথে দামেশকে পৌঁছে ছিল এবং এসকাথেই ট্রেনিংও নিয়েছিল। জেহাদে শরীক হওয়ার ব্যাপারে ওদের মধ্যে কাজ করছিল একই রকম চিন্তা-চেতনা ও আশা-আকাঙ্খা। তাদের সাথে পুরুষ স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে যারা পড়ল তাদের একজনের নাম ছিল আজাদ বিন আব্বাস। দেখতে খুবই সুপুরুষ ও নওজোয়ান। মেয়েদের বড় তাবুর দু’পাশে ছোট দুই আলাদা তাবুতে পুরুষ স্বেচ্ছাসেবীদের থাকার ব্যবস্থা হলো। উদ্দেশ্য, মেয়েদের কিছু লাগলে যেন দ্রুত তা জানাতে পারে এবং একজন কোন কাজে দূরে গেলে অন্যজন যেন পাহারায় থাকতে পারে মেয়েদের বড় তাঁবুর। এই মেয়েদের মধ্যে খতিবের মেয়ে মানসুরা শারীরিক দিক থেকে ছিল যেমন নিখুঁত, তেমনি ছিল হুশিয়ার ও অসম্ভব বুদ্ধিমতি।

বিকেল বেলা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। মনসুরা দেখলো, তাদের সঙ্গী স্বেচ্ছাসেবক আজান বিন আব্বাস এক পাহাড়ী টিলায় উঠে দ্রুত সরে যাচ্ছে ক্যাম্প থেকে। সে যাচ্ছে আর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছে, কেউ তাকে দেখতে পেলো কিনা! আজাদের এ সতর্কথা দৃষ্টি এড়াল না মানসুরার। তার মনে খটকা লাগলো। সন্দেহ হলো, সে এমন কিছু করছে যা অন্যকে দেখতে দিতে চায় না।

মানসুরা পিচু নিল তার। একটু পর সেও টিলার উপরে চলে এলো। দেখলো আজাদ তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। আজাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও সেদিকে দৃষ্টি ফেললো। সামনে পাহাড়ের ঢালুতে দেখা যাচ্ছে অনেক সৈন্য। আজাদ মানসুরার উপস্থিতি টের পেয়ে তার দিকে ফিরে মিষ্টি করে  হাসল। বললো, ‘তাকিয়ে দেখো, আমাদের মূল ফৌজ। চলো, আরেকটু এগিয়ে আরো কাছ থেকে তাদের দেখে আসি’।

সে হাঁটা ধরলে মানসুরাও তার সাথে চলতে লাগল। আজাদ গল্প জুড়ে দিল মানসুরার সাথে। আজাদ যেমন সুদর্শন ছিল, তেমনি ছিল বাকপটু। কথা দিয়ে মানুষের মন জয় করায় ওস্তাদ। তার প্রাণ চাঞ্চল্য ও আবেগঘন কথায় বেশ পুলক অনুভব করল মানসুরা। সেই মজে গেল কথামালার রাজ্যে। আজাদ এখানকার পাহাড়ী এলাকা ও প্রাকতিক দৃশ্যের প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠল।

সে মানসুরার সাথে দীলখোলা আলাপ করতে করতে বাহিনীর কাছে গিয়ে পৌঁছল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল, মানসুরা বলল, ‘চলো ফিরে যাই’।

ফিরতি পথ ধরলো ওরা। আজাদের মুখে তখন কথায় খই ফুটেছে। মানসুরা যত তার কথা শুনছে, ততই মুগ্ধ ও তার প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলো। সূর্য ডোবার সময় তারা তাবুঁতে ফিরে এলো। ইতিমধ্যে আজাদ মানসুরার মন জয় করে নিয়েছে।

ইফতারীর পর মেয়েরা তাদের তাঁবুতে খানা খাচ্ছিল। একজন সেনা কমাণ্ডার তায়বুর পর্দ ঈষৎ ফাঁক করে মেয়েদের জিজ্ঞেস করলো, কারো কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। মেয়েরা জানাল, তারা সবাই শান্তি ও নিরাপদে আছে। কমাণ্ডার সরে গেল সেখান থেকে। আজাদ তাবুর বাইরে দাঁড়িয়েছিল। সে কমাণ্ডারকে সরে যেতে দেখে এগিয়ে গেল তার দিকে, তারপর তার সাথে আলাপ জুড়ে দিল। অনেকক্ষণ তারা তাবুর বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বললো। মানসুরা কান খাঁড়া করে ওদের কথা মনযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করছিল। আজাদ কমাণ্ডারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এত অল্প সৈন্য নিয়ে বিশাল তিনটি বাহিনীর সাথে কেমন করে আমরা মোকাবেলা করবো?’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top