১৩. পাপের ফল

সুলতান আইয়ুবীর কেবলি মনে পড়ছে, তিনি ‘মুসলমান হয়ে মুসলমানদের ওপর অভিযান চালিয়েছেন’, এই অপবাদের কথা। আব্বাসীয় খেলাফতের এক আমীর এ অপবাদ ছড়াচ্ছিল। তাকে মিশর থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল খৃস্টানদের সাথে যোগসাজশের অভিযোগে। অথচ প্রকৃত ঘটনা ছিল ভিন্ন রূপ। সুলতান আইয়ুবী খৃস্টানদের কবল থেকে ফিলিস্তিন ও বাইতুল মুকাদ্দাস মুক্ত করার অভিযানে বেরোলে খৃস্টানদের পদলেহী শাসকরা তার পথ আগলে দাঁড়ায়। ফলে তিনি বাধ্য হন তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে। এ সত্য গোপন করে তার বিরুদ্ধে ইসলামী জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এ অপবাদ ছড়াচ্ছিল দুশমন। ক্ষমতার লোভে অন্ধ শাসকরা এভাবেই চেষ্টা করছিল ইসলামী জনতাকে জেহাদের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতে।

মুসলমানদের প্রথম কেবলা এখানে কাফেরের অধীন, সুলতান আইয়ুবী কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। জেরুজালেমকে শত্রুমুক্ত করার চিন্তা অহর্ণিশ ঘুরপাক খেতো তার মাথায়। তার প্রতিটি পদক্ষেপের পিছনে কাজ করতো এই চিন্তা। এ চিন্তা কখনো তাকে এক জায়গায় শান্তিতে বসতে দেয় নি। পথের প্রতিটি বাঁধা সরিয়ে তিনি কেবল সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। দুশমনের বাঁধা, গাদ্দারের গাদ্দারী তার পথ রোধ করতে পারেনি কখনো। তার প্রতিটি পদক্ষেপের পেছনে ছিল জেরুজালেমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দুর্মর আকাঙ্খা। ইহুদীদের পরিকল্পনাও তার অজ্ঞাত ছিল না। তিনি ভালমতই জানতেন, ইহুদীরা ধুরন্ধর ও অসম্ভব কূটকৌশলী। এমন ধুরন্ধর জাত পৃথীবিতে আর দ্বিতীয়টি নেই। তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছিলেন, কেন পবিত্র কোরাআন একমাত্র ইহুদীদেরকেই মুসলমানদের প্রকাশ্য শত্রু বলে ঘোষনা করেছে।

তারা কখনো সম্মুখ যুদ্ধে উপস্থিত হয় না। যুদ্ধের ময়দানে তারা লেলিয়ে দেয় মাথা মোটা খৃস্টানদেরকে। বিনিময়ে তাদের দেয় অঢেল আর্থিক সুবিধা। এই সুবিধার পরিমাণ চিন্তা ও কল্পনারও অতীত। এভাবেই খৃস্টনদের বন্ধুত্ব ক্রয় করে নিয়েছে ওরা। আর এই বন্ধুত্বের উসিলায় তাদের বিবেক এবং মাথাগুলোও তারা কিনে নিয়েছে। খৃস্টানরা এখন বিশ্বময় দৃশ্যতঃ সবচে বেশী বিত্ত বেসাতের মালিক। ইহুদীরা তাদের শুধু এই সম্পদই দান করেনি, তাদের অসাধারণ সুন্দরী, রূপসী মেয়েদেরকেও তুলে দিয়েছে ওদের হাতে। এই মেয়েরা কেবল রুপে গুণেই অনন্যা নয়, ইহুদীদের জাতীগত কুটবুদ্ধি এবং চাতুর্যেও এরা অতুলনীয়া। খৃস্টানদের জাতীগতভাবে কব্জা করার পর এবার এসব মেয়েদের ওরা লেলিয়ে দিচ্ছে গাদ্দার মুসলিম আমীরদের পেছনে। নিজেরা না এসে ওদের পাঠাচ্ছে খৃস্টানদের মাধ্যমে। সেই সাথে সেই একই লোভ, সম্পদ ও ক্ষমতার প্রলোভন!

এ ষড়যন্ত্রের কথা যখনই মনে হয় তখনই সুলতান আইয়ুবী কাতর হয়ে পড়েন। খৃস্টানরা তাদের পেছনে ছায়ার মত লেগে আছে। উচ্চ পদস্থ সামরিক আফিসার, দুর্ধর্ষ সেনা কমান্ডার, প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, রাজ্যের আমীর ওমরা, এমন কে নেই, যাদের পেছনে ওরা লাগেনি! এরা শত্রুর বেশে আসে না, আসে বন্ধুর বেশে। ফলে ওদের মোকাবেলা করা কত যে দূরূহ তা কেবল ভুক্তভোগীই জানে! কত ভাবে ও কত কায়দায় যে ওরা মুসলমানদেরকে মুসলমানের বিরুদ্ধে কাজে লাগায় তার কোন ইয়ত্তা নেই। যাদের টোপ গেলাতে পারে না, তাদের কাজে লাগায় একভাবে, যারা টোপ গেলে তাদের অন্যভাবে। মোট কথা, ওদের নজরে পড়লে কারো রেহাই নেই। আজ মুসলমানে মুসলমানে যুদ্ধের উস্কানী দিচ্ছে তাদেরই নিয়োজিত লোকজন। তাদেরই নীলনকশায় মুসলমানরা পরষ্পরের বিরুদ্ধে তাক করেছে অস্ত্র।

এমন কঠিন সময়ে সব সময় চোখ-কান খোলা না রাখলে পতন অনিবার্য। সুলতান আইয়ুবী তাই তার বাহিনীকে সদা সতর্ক ও সর্বদা প্রস্তুত অবস্থায় রেখেছেন। সামরিক বিভাগকে তিনি এমন ট্রেনিং দিয়েছেন এবং গোয়েন্দা সংস্থাকে এমন সচল রেখেছেন, দুশমনের যে কোন চাল ও পরিকল্পনা চাইতে যা সবসময় অধিক কার্যকর ও ফলপ্রসু। ফলে শত্রুরা কোন ময়দানেই মুজাহিদদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তারা তাদের মেধা, মনন, শ্রম ও যোগ্যতাকে এমনভাবে কাজে লাগাতে পেরেছিল যে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য লাভের হকদার হয়ে উঠেছিল তারা।

মুসাল প্রদেশে গিয়ে পৌছলো হলবের দূত। সঙ্গে তার সুলতান আল মালেকুস সালেহের চিঠি ও উপহার সামগ্রী। এখানেও উপহার হিসাবে পাঠানো হয়েছে অন্যান্য সামগ্রীর সাথে হারানের মত দুই সুন্দরী মেয়েকে। হারান কেল্লার অধিপতি গুমাস্তগীনের কাছে পাঠানো মেয়ে দুটিকে সেনাপতি শামস বখত ও সাদ বখত নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের পাঠাতে গিয়ে হত্যা করেছিলেন কাজী ইবনুল খাশিবকে। আর সেই অপরাধে নিজেরা বরণ করেছিলেন করাগারের বন্দী জীবন। কিন্তু মুসালের গভর্ণর সাইফুদ্দিন তার উপহার ও পয়গাম ঠিকমতই পেয়েছিলো। মেয়ে দুটি তার অন্দর মহলের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুললো। হলবের দূত তাকেও সে রকম চিঠিই দিলো, যে রকম চিঠি গুমাস্তগীনকে দিয়েছিলো।

তাতে আরো উল্লেখ ছিল, ‘খৃস্টানরা হলববাসীদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পূরন করেনি। ওরা একবার যেহেতু ধোঁকা দিয়েছে, আবারো দিতে পারে। ফলে তাদের আশ্বাসের ওপর ভরসা করা যায় না। আবার চারদিকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন, তাদের বন্ধুত্ব সরাসরি অস্বীকার করাও এ মুহূর্তে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার উত্তম পন্থা হলো, নিজেরা পরষ্পর ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও ঐক্যবদ্ধভাবে সুলতান আইয়ুবীর ওপর আক্রমণ চালানো। সাফল্যের সম্ভাবনা দেখলে তারা যে তাদের দুয়ার খোলা রাখবে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু রিস্ক নিয়ে তারা আমাদের বিজয়ী করতে আসবে না।

সুলতান আইয়ুবী এখন আর রিস্তান পর্বতের দূর্গম শৃঙ্গের ওপর তাবু টানিয়ে বসে আছেন। ভাল খেলোয়াড়ও খেলতে খেলতে এক সময় ভুল করে বসে। পাগল গাছের মাথায় চড়ে ভাবে, কেউ আর তার নাগাল পাবে না। আমাদের জন্য এ এক মহা সুযোগ! আমরা একসাথে তাঁকে আক্রমণ করলে আর খৃস্টানরা একটু সহায়তা করলে তাকে সহজেই পরাস্ত করা সম্ভব। আমি তো মনে করি, তার সাথে যুদ্ধ করার ও প্রয়োজন হবে না, কেবল অবরোধ করে বসে থাকলে একদিন খাদ্যাভাবেই ধরাশায়ী হয়ে যাবে। এ চিঠিতেও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সেখানে বরফ গলতে শুরু করেছে। গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, সুলতান আইয়ুবীর সামরিক শৃংখলা বরফ গলা পানির প্রবাহে তছনছ হয়ে গেছে। আমাদের ঐক্যজোটের তিন শরীক একত্রে সামরিক অভিযান চালালে, পাহাড়ী প্রান্তরেই সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত ও চিরতরে ধ্বংস করে দিতে পারবো।’

চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, ‘গুমাস্তগীনকেও অনুরূপ চিঠি দেয়া হয়েছে। আশা করি আমাদের ঐক্যবদ্ধ সামরিক জোটকে কার্যকরী করতে আপনিও সচেষ্ট হবেন। সময় নষ্ট না করে আপনার সৈন্য বাহিনী ঐক্যজোটের কমান্ডে নিয়ে আসুন, যাতে সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত করে আমরা আমাদের নিজ নিজ রাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি।’ সাইফুদ্দিন এই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে তার ভাই আজিম উদ্দিন, দু’জন সিনিয়ার জেনারেল এবং মুসালের সম্মানিত খতিব ইবনুল মাখদুম কাকবুরীকে ডেকে পাঠালেন। সকলে সমবেত হলে তিনি খলিফার চিঠি সবার সামনে পুনরায় পাঠ করলেন। এরপর তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনারা সকলেই জানেন, আমরা সুলতান আইয়ুবীর বিরোধী। তার আনুগত্য করার কোন ইচ্ছে আমাদের নেই। আমার দেহের শিরায় যে রক্ত প্রবাহিত, তার দেহের শিরাতেও ঠিক একই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। এখন আপনারা বলুন, এ পত্রের আমি কি জবাব দেবো?’

‘এ ব্যাপারে আপনার ইচ্ছা কি?’ জানতে চাইলেন খতীব ইবনুল মাখদুম কাকবুরী। ‘আমার ইচ্ছে, প্রকাশ্যে এই ঐক্যজোটে যোগ দেয়া। কিন্তু শর্ত থাকবে, যে এলাকা আমাদের সৈন্য দ্বারা বিজিত হবে সে এলাকা আমাদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে। সেখানে অন্য কেউ আধিপত্যের দাবী করতে পারবে না।’ এক সেনাপতি বললো, ‘আপনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারচে উত্তম আর কোন সিদ্ধান্ত হতে পারে না। আমাদের সৈন্যরা যে এলাকা জয় করবে, সে এলাকার হকদার আপনি, এতে কারো কোন আপত্তির প্রশ্ন উঠতে পারে না।’ ‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবী খৃস্টান ও সুদানীদের পরাজিত করতে পারলেও আমাকে পারবে না। কারন আমাদের উভয়ের শরীরে একই রক্তধারা প্রবাহিত এবং আমি তার যুদ্ধ কৌশল ভাল করেই জানি।’ বললো সাইফুদ্দিন।

অপর এক সেনাপতি বললো, ‘আপনি আপনার সৈন্য বাহিনী ঐক্যবদ্ধ জোটে শামিল করে দিন কিন্তু সৈন্য পরিচালনার কমান্ড আপনার হাতেই রাখবেন। আপনি আপনার সৈন্য বাহিনীকে এমনভাবে পরিচালনা করবেন, যেন আমাদের সফলতা হলব ও হারানের থেকে সম্পূর্ন পৃথক থাকে।’ ‘শাহানশাহে মুসাল! আমি আপনার আদেশের ওপর জীবন কোরবানী করে দেবো।’ প্রথম সেনাপতি বললো, ‘আমরা আপনাকে এই মুসলিম সাম্রাজ্রের শাহানশাহ বানিয়ে দেবো, যে স্বপ্ন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী দেখছেন।’ ‘গাজী সালাহউদ্দিনের মাথা এনে আপনার পদতলে রেখে দেবো।’ বললো অপর সেনাপতি, ‘তার সৈন্য বাহিনীকে আর রিস্তানের পাহাড়ী এলাকা থেকে বেরই হতে দেবো না। আপনি সত্বর যুদ্ধ যাত্রার আদেশ দিন। আমাদের সেনাবাহিনী যুদ্ধ যাত্রার জন্য সম্পূর্ন প্রস্তুত হয়ে আছে।’

দুই সেনাপতিই উচ্ছাস ও আগ্রহে টইটম্বুর। কার চেয়ে কে বেশী তাবেদারী ও খোশামুদি করতে পারে তার যেন প্রতিযোগিতা চলছিল। সেনাপতি আজিম উদ্দিন চুপচাপ বসে শুনছিলো ওদের বক্তব্য। খতীব ইবনুল মাখদুম কখনও সেনাপতিদের মুখের দিকে, আবার কখনো সাইফুদ্দিনের মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন ওদের মনোভাব। ‘আজিম উদ্দিন, তোমার কি ধারনা?’ সাইফুদ্দিন তাঁর ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন। ‘আপনার এই সিদ্ধান্তে আমরা একমত, আমরা সুলতাই আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো।’ আজিম উদ্দিন বললো, ‘কিন্তু আমাদের সেনাপতিদের এমন আবেগপ্রবণ কথা শোভা পায় না, যেমন আমাদের দুই সেনাপতি বলেছেন। সুলতান আইয়ুবীকে এতটা হালকভাবে দেখা কোন অভিজ্ঞ সেনাপতির কাজ নয়।

আমি বলছি না, সুলতান আইয়ুবীকে আমরা পরাজিত করতে পারবো না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, যিনি অল্প ক’জন সৈন্য নিয়ে খৃস্টানদের বহুগুণ সৈন্যের মোকাবেলা করে তাদের পরাজিত করেছেন, যিনি মরুভূমির সৈন্য নিয়ে পাহাড়ের বরফ ঢাকা প্রান্তরে যুদ্ধ করে শত্রুদের পরাজিত করতে পারেন, যিনি সম্রাট রিমান্ডের সৈন্য বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেছেন, তিনি বরফ গলা পানি প্রবাহের মধ্যেও ভালমতই যুদ্ধ করতে পারবেন, এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। আমাদের আগেই খুশী হওয়ার কোন কারন নেই। শক্রকে কোন সময় দূর্বল ভাবতে হয় না। আপনি নিজেই চিন্তা করুন, যাঁর সঙ্গে আপনি যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন, তার সামরিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কেমন? চিন্তা করুন সেই যুদ্ধের ময়দানের কথা, যেখানে কেবল তার সৈন্যরাই যুদ্ধ করবে না, জিততে হলে আপনাকেও সেখানে যুদ্ধ করতে হবে। তার সৈন্যদের মোকাবেলায় আপনার সৈন্যরা সে ময়দানে যুদ্ধ করতে কতটা বেশী পারঙ্গম, সেটাও আপনাকে চিন্তা করতে হবে।’

এরপর আজিম উদ্দিন সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের যোগ্যতা ও গুণের প্রশংসা শুরু করলো। সুলতান আইয়ুবীর রণকৌশল সম্পর্কে আলোচনা করলো বিজ্ঞ সেনাপতির মতো। এরপর যে ময়দানে যুদ্ধ হচ্ছে সে ময়দানের অবস্থার ওপর আলোকপাত করে বললো, বরফ গলতে শুরু করেছে এবং বসন্তের ঋতুতে প্রবল বর্ষনের সম্ভাবনাও আছে। এ বৎসর বৃষ্টি একটু দেরিতেই হচ্ছে। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্যরা এখনও তাবুতেই আছে। কিন্তু ঘোড়া তো আর তাবুর মধ্যে নেই। এ সময় তাদের সামরিক অশ্বগুলো নিশ্চয় পর্বতের গুহায় ও গাছের নিচে আছে। উট ও ঘোড়া এ অবস্থায় বেশীক্ষণ সবল ও সুস্থ থাকে না।

আমরা এ আশাও করতে পারি, আইয়ুবীর সৈন্যরা পাহাড়ী অঞ্চলের ভয়ংকর শীতে থাকতে থাকতে বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছে। আবার এ কথাও খেয়ার রাখতে হবে, যদি আমাদের সৈন্য হলব ও হারানের সৈন্যদের সাথে মিশিয়ে ফেলি, তবে সুলতান আইয়ুবী আমাদের সকলকে অবরোধ করে ফেলতে পারে। বিশেষ করে এ কথাও স্বরণ রাখা দরকার, মুসলমান সৈন্যরা যখন অন্য মুসলিম বাহিনীর সামনা-সামনি হবে, তখন এমনও হতে পারে, তারা পরষ্পর যুদ্ধ করার পরিবর্তে আপোষে মিলেও যেতে পারে। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে তলোয়ার উন্মুক্ত করবে, কিন্তু সেই তলোয়ার সহসাই আবার কোষবদ্ধও হয়ে যেতে পারে। রক্ত প্রবাহের পরিবর্তে এক অন্যের সাথে মেতে উঠতে পারে কোলাকুলিতে।’

‘আজিম উদ্দিন!’ সাইফুদ্দিন তার কথার মাঝখানে বলে উঠলেন, ‘তুমি একজন সৈনিক! তুমি শুধু রক্ত, তীর ও তলোয়ারের চমক সম্পর্কেই চিন্তা করতে পারো, বাকী খবর আমার কাছে শুনে নাও। যুদ্ধের চাল আমারাও কম জানি না। মুসলমান সৈনিককে কেমন করে মুসলমানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করানো যায় শিখে নাও আমার কাছ থেকে। আর মাত্র দু’দিন পর রমজান মাস শুরু হতে যাচ্ছে। সালাউদ্দিন আইয়ুবী সেমন নামাজ রোজার অনুসারী ও পাবন্দ, তার সৈনিকরাও তেমনি নামাজ রোজার পাবন্দ ও অনুসারী। তার সৈন্যরা যুদ্ধের অবস্থায়ও রোজা রাখবে। ফলে তারা হবে খুবই ক্লান্ত ও দূর্বল।

আমি আমার সৈন্যদের ফতোয়া দিয়ে দেবো, যুদ্ধের ময়দানে রোজা রাখা ফরজ নয়। আমাদের মাননীয় খতীব সাহেব তো সামনেই আছেন, আমি তাঁকে দিয়েই এ ঘোষনা প্রচার করাবো, যুদ্ধের সময় রোজা মাফ আছে! আমরা দুপুরের পর থেকে আক্রমণ আরম্ভ করবো। কারণ সকালে তার সৈন্য বাহিনী তরতাজা থাকবে। কিন্তু দুপুরের পরে তারা হয়ে পড়বে ক্ষুধায় কাতর। আমাদের সৈন্যরা খেয়ে দেয়ে তরতাজা হয়ে যখন যুদ্ধে নামবে, তখন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ক্ষুধা-পিপাসায় ক্লান্ত সৈন্যদেরকে সহজেই পরাস্ত করতে পারবে। আপনার সবাই যুদ্ধের সপক্ষে রায় দিয়েছেন। এখন আমি ঘোষনা করতে চাই, আপনাদের সকলের পরামর্শের আলোকে আমি যে পরিকল্পনা আপনাদের শুনিয়েছি, আমার সে প্ল্যানই তাহলে এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসাবে গণ্য হবে। আমরা সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো এবং অচিরেই আমরা যুদ্ধ যাত্রায় এ শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাবো।’

‘আপনার এ সিদ্ধান্ত সম্পূর্ন সঠিক।’ একজন সেনাপতি বললো। ‘আপনার এই প্ল্যান কার্যকরী করে প্রমাণ করবো, আপনি সঠিক।’ অপর সেনাপতি বললো। ‘আপনার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন কথা আমি বলিনি।’ আজিম উদ্দিন বললো, ‘আর একটি পরামর্শ দেবো, আপনি নিজেকে সবসময় নিরাপদ অবস্থানে রাখবেন। যদি প্রয়াজন হয়, তবে আপনি সামনে যাবেন। প্রথম আক্রমণের ঝুঁকি আমাদের হাতেই থাকবে।’‌ ‘হ্যাঁ, তাই হবে!’ সাইফুদ্দিন বললো, ‘সৈন্য বাহিনীকে দুই ভাগে ভাগ করে নাও। আর জলদি অভিযানের জন্য প্রস্তুত হতে বলে দাও। সম্মুখ বাহিনী থাকবে তোমার কমান্ডে, আর রিজার্ভ বাহিনীর সৈন্যদেরকে আমার কমান্ডেই রেখে দেয়া হবে।’

খতীব ইবনে মাখদুম-এর দিকে তাকিয়ে সাইফুদ্দিন হেসে বললেন, ‘সম্মানিত খতীব, আপনি এস্তেখারা করে কয়েকবারই বিপদ থেকে আমাকে সর্তক করেছেন। আপনি আমার সফলতা ও নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়াও করেছেন। আপনি জানেন আপনার চেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি আমি আর কাউকে জানি না। যদি কোন লোকের কাছে মাথা নত করতে হয়, সে ব্যক্তি আপনি। এখন আমি এমন এক অভিযানে যাচ্ছি যার সফলতা সম্পূর্ন অনিশ্চিত! আমি এমন এক শক্তিশালী শত্রুর সাথে মোকাবেলা করতে যাচ্ছি, খৃস্টানদের মত বিশাল শক্তিও যার সাথে টক্কর দিয়ে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ফিরে গেছে। এখন আপনিই আমার ভরসা। আবার একটু এস্তেখারা করে দেখুন, আমার ভাগ্যে বিজয়ের সম্ভাবনা কতটুকু!’

‘সম্মানিত আমীর!’ খতীব বললেন, ‘এ কথা অবশ্যই সত্য, আপনি কয়েকবার আমার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছেন। সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর সময় একবার এক সশস্ত্র ডাকাত দলের পিছু ধাওয়া করেছিলেন আপনি। তখন আমি আপনাকে আপনার সফলতার সুসংবাদ শুনিয়েছিলাম এবং আপনি সফলতা লাভ করেই ফিরে এসছিলেন। খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যখন আপনি অভিযান চালিয়েছিলেন, আমি আপনার বিপদ ও কামিয়াবী সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলাম। আল্লাহর হাজার শুকুর, আমার প্রতিটি ইঙ্গিত অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু ……..’ খতীব প্রথমে আজিম উদ্দিন ও পরে দুই সেনাপতির দিকে তাকিয়ে দেখলেন এবং বললেন, ‘হে মুসালের আমীর! আমি এস্তেখারা ছাড়াই আপনাকে বলে দিতে চাই, আপনি যে লক্ষ্যস্থলে আপনার বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে যাচ্ছেন, সেখানে আপনি সফল হবেন, কি ব্যর্থ হবেন, আপনি কি সত্যি সে ব্যাপারে আমার মতামত চান?’

‘হ্যাঁ! জলদি বলুন সম্মানিত খতীব!’ সাইফুদ্দিন অধীর হয়ে বললেন। ‘আপনি এমন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবেন, যদি সুযোগ মত পলায়ন না করেন, তবে সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবেন।’ খতীব বললেন, ‘যদি আমার পরামর্শ আপনি সত্যি শুনতে চান, তাহলে আমি আপনাকে এ পরামর্শই দেবো, আপনি সে রণাঙ্গনে নিজেও যাবেন না, আপনার বাহিনীও পাঠাবেন না। আমি এই সতর্কবাণী আপনাকে জানিয়ে দিলাম।’ সাইফুদ্দিনের চেহারার রং ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ভয় ও আতংক খেলা করতে লাগলো সে চেহারায়। আজিম উদ্দিন ও সেনাপতিরা নীরব। খতীব গভীর দৃষ্টিতে দেখছিলেন সাইফুদ্দিনকে। ‘আপনি তো এস্তেখারা করেননি!’ সাইফুদ্দিন বললেন, ‘তাহলে আপনি কেমন করে এমন মন্তব্য করলেন? আর আমি কেনই বা আপনার এ অশুভ ইঙ্গিত সত্য বলে মেনে নেব?’

‘শুনুন মুসালের আমীর!’ খতীব ইবনুল মাখদুম বললেন, ‘আমি আপনাকে যতবার সতর্ক ও সুসংবাদ দান করেছি তার সঙ্গে এস্তেখারার কোন সম্পর্ক ছিল না। কোরআন কোন যাদুকরের লেখা কিতাব নয়। কোরআন হাদীস পড়ে আল্লাহর কুদরতের যে রহস্য আমি বুঝতে পেরেছিলাম এবং আল্লাহর দেয়া জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে যা বুঝেছিলাম, তাই শুধু বলেছিলাম আপনাকে। কোরআনে আল্লাহ জয়-পরাজয়ের কিছু সুস্পষ্ট নীতিমালা ঘোষনা করেছেন। এ ঘোষনা মিথ্যা হতে পারে না। যে কোরআনের নির্দেশ মত চলবে সে সফল হবে, আর যে কোরআনের নির্দেশ অমান্য করবে সে ব্যর্থ হবে। আপনাকে দেয়া প্রতিটি পরামর্শই ছিল কোরআনের সেই জ্ঞানের আলোকে। তখন আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক। কিন্তু বর্তমানে যে দিকে আপনি অগ্রসর হচ্ছেন তা আল্লাহর নির্দেশের সম্পূর্ন বিপরীত।’

‘আপনি কেমন করে বলতে পারেন, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী রাসূলের(সা.) আদর্শ ও সুন্নাতের উপর প্রতিষ্ঠিত?’ সাইফুদ্দিন উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘আমি বলছি তিনি এক বিশাল সাম্রাজ্যের সম্রাট হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। আমি তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে দেবো না। মৃত্যুই তাকে আর রিস্তানে টেনে এনেছে। আমি তাকে শেষ করে পরে খৃস্টান সহযোগীদের মুখোমুখি হবো।’ ‘আপনি কথার যাদু দিয়ে যতই আমাদের ধোঁকা দিতে চান, আল্লাহকে তো আর ধোঁকা দিতে পারবেন না।’ খতীব বললেন, ‘আল্লাহ সমস্ত গোপন খবর জানেন, যে সব মতলব আমরা নিজেদের অন্তরে গোপন রেখেছি, তাও জানেন! বিজয় ও সফলতা তারই হাতে। যে তার নফসকে পরাজিত করতে পেরেছে, কেবল সেই আল্লাহর সাহায্য আশা করতে পারে। আমি আরো ভবিষতবাণী করছি, পরাজয় আপনার ভাগ্যে নির্ধারিত হয়ে আছে। যদি আপনি আল্লাহর সত্য পথের সৈনিক ও যোদ্ধা হন আর জেহাদের জন্য বের হতে পারেন, তবে আপনার ভাগ্যের এ লেখা পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু ইসলামের পতাকাবাহী কাফেলার মোকাবেলায় এগিয়ে গেলে আপনার পতন কেউ ঠেকাতে পারবে না।’

‘সম্মানিত খতীব, আপনি আপনার বক্তব্য মসজিদের মধ্যে ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ রাখুন। যুদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় পলিসি কখনোই আপনার বুঝে আসবে না। আপনি এমন বক্তব্য দিয়ে আমাদের আবেগ ও প্রেরণাকে নষ্ট করার চেষ্টা করবেন না। যুদ্ধের ময়দানে বিজয় লাভ অর্জন করতে হলে যা অর্জন করতে হয়, তার সবই আমরা অর্জন করেছি। যুদ্ধের শ্রেষ্ঠ উপকরণ ও সরঞ্জামে সাজিয়েছি আমাদের বাহিনী। পরাজিত হওয়ার কোন ট্রেনিং আমাদের সৈনিকরা, ওরা শুধু বিজয় ছিনিয়ে আনারই প্রশিক্ষণ পেয়েছে।’ খতীবের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে আবেগদীপ্ত কন্ঠে বললো আজিম উদ্দিন। ‘যদি আপনি রাজনীতিকে ধর্ম থেকে আলাদা করতে চান, তবে রাজনীতিতে সত্য বলে কিছু থাকবে না। ঈমানী জযবা বলে কিছু থাকবে না। মুসলমান অস্ত্র ও সামরিক শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করে না, তারা জেহাদ করে ঈমানের বলে। আর এ ঈমানী চেতনা মানুষকে দান করে তার ধর্ম।

যেখানে ধর্ম নেই সেখানে বাস করে অধর্ম। রাজনিত ও ধর্ম আলাদা হয়ে গেলে রাজনীতিতে অধর্মের চর্চা শুরু হয়ে যাবে। হয় তোমাকে ধর্মের পক্ষ নিতে হবে, নয়তো অধর্মের, মাঝামাঝি কোন পথ নেই। একটি মুদ্রার দুটিই পিঠ থাকে, কোন কথা সত্য না হলে মিথ্যা হবে, কোন কাজ ন্যায় না হরে অন্যায় হবে। পক্ষ তোমাকে একটি নিতেই হবে, এখানে নিরপেক্ষতার কোন অবকাশ নেই। ‘তত্ত্বকথা হিসাবে এ মন্দ নয়, কিন্তু যুদ্ধে কেবল কথার জোরে জেতা যায় না, সেখানে দরকার হয় শক্তি, ক্ষমতা ও কৌশলের। ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তা অর্জন করতে হয়।’ বললেন সাইফুদ্দিন। খতীব বললেন, ‘আপনি সত্যিই বলেছেন, যুদ্ধের ব্যাপারে আমার কোন প্রশিক্ষণ নেই, এসব ব্যাপার আমি বুঝতেও পারি না। কিন্তু কোরআন, হাদীস ও ইতিহাস পড়ে এ কথা খুব ভাল করেই বুঝেছি, কখন মানুষ পরাজয় বরণ করে।

আমার কথা আপনাদের খারাপ লাগতে পারে। সাধারণভাবে সব কালেই আমার মত হিতৈষীদের কথাকে উড়িয়ে দিয়েছে তৎকালীন শাসকবর্গ। কিন্তু মনে রাখবেন, নেতারা যখন তোষামেদ প্রিয় হয়, নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের আন্তরিকতার চেয়ে লোভী চাটুকাররা যখন নেতার কাছে বেশী প্রিয় হয়ে যায়, তখন তাদের পতন কেউ ঠেকাতে পারে না। আমি আমার বিবেক বিসর্জন দিয়ে আপনাদের উচ্চাশায় বাহবা দিলে নিশ্চয়ই আপনারা খুশী হতেন। কিন্তু এটা আমার আপনার ব্যক্তিগত লাভালাভের প্রশ্ন নয়, এর সাথে জড়িত জাতির মান-সম্ভ্রম ও অস্তিত্ব। এ সময় হটকারী সিদ্ধান্ত নিলে নিজেরাও ডুববেন, আর জাতিকেও ডুবাবেন।’ আলোচনা এ পর্যায়ে এসে বেশ তিক্ত হয়ে উঠল। সেনাপতিরা এর কোন প্রতিবাদ না করলেও রাগে ফুঁসছিল।

সাইফুদ্দিনের কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট। আজিম উদ্দিন মাথা নিচু করে গভীরভাবে চিন্তা করছিল। খতীব থামলে সে বললো, ‘আপনি হঠাৎ করে এমন উত্তেজিত হয়ে পড়লেন কেন বুঝলাম না?’ উত্তেজিত হওয়ার নিশ্চয়ই কারন আছে। তোষামোদকারী ও গোলাম শ্রেণীর লোকের হাতে দায়িত্ব ন্যাস্ত হলে জাতির চিন্তা তাদের মাথায় থাকে না। তাদের সব সময় চিন্তা থাকে একটাই, কি করলে নেতা খুশী হবে? ফলে তোষামোদকারী সেনাপতি তার অধীনস্তদেরকে তোষামোদী শেখায়। তারা শেখায় তাদের অধীনস্তদের। শেষ পর্যন্ত সেই সামরিক বাহিনী দেশ ও জাতির জন্য যুদ্ধ করার পরিবর্তে শাসকশ্রেণীকে খুশী করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।’ সাইফুদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, ‘আমি আপনার দরবারেও লক্ষ্য করেছি, দু’জন সেনাপতি আপনার সুরে সুরে মিলিয়ে এমন চাটুকারী ভাষায় কথা বললো, যে চাটুকারীতা কোন সৈনিকের মুখে শোভা পায় না। আপনি লক্ষ করেছেন কিনা জানি না, তারা শুধু আপনার প্ল্যানের তারিফ ও গুনগান করেই শেষ করলো, কিন্তু এ অভিযানের অসুবিধার বিষয় নিয়ে একটি বাক্যও উচ্চারণ করলো না। কোন বিপদের সম্ভাবনা আছে কিনা তাও বললো না।

খৃস্টানরা আজ মুসলমানদের গ্রাস করার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে। মসজিদুল আকসায় আজ কাফেরের আধিপত্য। এই অবস্থায় আপনি, গুমাস্তগীন ও হলবের শাসক সকলের উচিত সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে এক জোট হয়ে খৃস্টানদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত অভিযান চালানো। আপনি যদি ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিতেন তবে ইসলামের দুশমনরা আপনার বিরুদ্ধে চলে যেত। কিন্তু খৃস্টানরা আপনার পরিবর্তে সালাহউদ্দিনকে টার্গেট করেছে, এতেই প্রমাণিত হয় সে সত্যিকার অর্থেই রাসূলের(সা.) আদর্শের ওপর অটল আছে। সে একজন রাজ্যলিপ্সু ব্যক্তি, এটা দুশমনেরই অপপ্রচার।

আপনার সেনাপতিরা আপনাকে এমন কোন পরামর্শই দেয়নি, যা আপনার সাহায্যে আসবে। তারা আপনাকে এ কথাও বলেনি, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী শুধু আর রিস্তানের পার্বত্য এলাকায় ঘাঁটি করেই বসে নেই, তার বিভিন্ন দলের সেনা কমান্ডো, গোয়েন্দা ও রিজার্ভ বাহিনী চারদিকের দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদেরকে অবরুদ্ধ করতে গেলে সেখানে আপনাদেরই অবরোধের আওতায় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। আপনি তার কমান্ডো বাহিনীর ক্ষিপ্রতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে ভালমতই জানেন। আইয়ুবীর গোয়েন্দা বাহিনী কি পরিমাণ চৌকস তাও আপনার অজানা নয়। তারা আপনার শুধু গতিবিধির খবরই রাখে না, আপনার মনের খবরও তারা বের করে নিতে পারে। আপনি এখান থেকে বের হয়ে আপনার এলাকা ত্যাগ করার আগেই সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে আপনার সৈন্য সংখ্যা, সৈন্যদের গতিবিধি ও গমনের রাস্তার পুরো নক্সা পৌঁছে যাবে।’ ‘সুলতানে মুসাল!’ এক সেনাপতি রাগান্বিত হয়ে বললো, ‘আমরা কি আপনার দরবারে এসেছি এই অপমান সহ্য করার জন্য? মসজিদে বসে রাত দিন আল্লাহ আল্লাহ করা ছেড়ে এই লোক আমাদের যুদ্ধ শেখানোর দুঃসাহস দেখাচ্ছে?

 

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top