১২. গোপন বিদ্রোহী

 খৃষ্টান কমান্ডার তাকে পাশে নিয়ে ঘাসের ওপর বসেছিল। এই মানসিক অস্থিরতার মধ্যে ফাতেমা এমন এক কাণ্ড করে বসলো, যা সে এক মুহূর্ত আগেও চিন্তা করেনি। সে কমান্ডারকে সজোরে ধাক্কা মারল। কমান্ডার এই ধাক্কা খেয়ে চিত হয়ে উল্টে পড়লো।

 মেয়েদের মাঝে যখন ঘৃণার প্রকাশ ঘটে তখন তারা ক্ষিপ্ত বাঘিনীর চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠে। এই খৃষ্টানটি ছিল মদে মাতাল। ব্যাপারটাকে সে হাসি তামাশা মনে করলো। ভাবলো, ফাতেমা তার সাথে হাসি-মজাক করছে। সে উল্টে পড়ে শুয়ে থেকেই হো হো করে হাসতে লাগলো।

 কাছেই একটি ভারী পাথর পড়েছিল। ফাতেমা তখন হিতাহিত জ্ঞান শুন্য এক উন্মাদিনী। সে ঐ পাথরটি উঠিয়ে দু’হাতে মাথার ওপর তুলে খৃষ্টান কমান্ডারের মুখ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলো। ১৩৮ শুয়ে শুয়ে হাসছিল কমান্ডার। যেই ভারী পাথরটি তার কপালে গিয়ে পড়লো সঙ্গে সঙ্গে তার হাসি বন্ধ হয়ে গেল। কমান্ডারের মাথা ফেটে বেরিয়ে এলো রক্ত, পাশ ফিরে অজ্ঞান হয়ে গেল কমান্ডার।

 পাথরটি ছুঁড়ে মেরে আর দাঁড়ালো না ফাতেমা, ছুটে মহলে গিয়ে কোন এক কামরার অন্ধকারে ঢুকে পড়ল। ভয়, আতঙ্ক, উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা তাকে এমনভাবে পেয়ে ধরলো, সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো।

 মাহফিল তখনও তেমনি জমজমাট। নাচের নুপুর নিক্কন ও গানের সুর ঝংকার তখন তুঙ্গে। নেশার ঘোরে আবোল তাবোল বকছে সব সম্মানিত লোকজন। এ অবস্থায় কে কোথায় খুন হলো, কে জীবিত, কে সুস্থ, কে তার খোঁজ নেয়? একটুপর চেতনা ফিরে এলো ফাতেমার। মনে পড়লো, গাছের নিচে অন্ধকারে তার জন্য অপেক্ষা করছে আনতানুস। সে দ্রুত আবার কামরা থেকে বেরিয়ে ছুটলো বাগানের দিকে। আনতানুসের ভালবাসা, দায়িত্বের অনুভূতি, সবকিছু ছাপিয়ে তার কেবলি মনে হতে লাগলো, সে এইমাত্র একটি মানুষকে খুন করে ফেলেছে। আর লাশটি হচ্ছে এক খ্রিস্তানের।

 সে ছুটছিল আর ভাবছিল, গর্ব ভরে সে আনতানুস কে বলবে, ‘আন তানুস, আমি আমার সতীত্বকে রক্ষা করতে পেরেছি। সতীত্ব বাঁচাতে গিয়ে আমি এক খৃষ্টান কমান্ডারকে খুন করে ১৩৯ ফেলেছি’।

 কিন্তু কোথায় আনতানুস! নির্দিষ্ট জায়গায় এসে আনতানুস কে না দেখে সে ঘাবড়ে গেলো। তবে কি সে আসেনি? নাকি আমাকে না পেয়ে সে এসে ফিরে গেছে!

 সে গাছের পেছনে দেয়ালের কাছে গিয়ে দেখলো, রশিটা বাইরে ঝুলছে না, ঝুলছে ভেতরের দিকে।

 রশি ভেতরের দিকে! তার অর্থ আন তানুস এসেছে, এবং এখনো ফিরে যায়নি। যদি সে ফিরে যেত তবে রশিটা বাইরের দিকে ঝুলতো। কিন্তু কোথায় সে? গাছের গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল ভাবছিল ফাতেমা। এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছিল আনতানুসকে।

 হঠাৎ মনে হলো, ওদিকে, ফুল ঝাড়ের ওপাশে অন্ধকারে একটি ছায়া নড়ে উঠলো।

 সে গভীরভাবে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। হ্যাঁ, আবারো নড়েছে। তাহলে কি তার চাকরানী এখনো ওখানে অপেক্ষা করছে ওর জন্য?

 ফাতেমা আস্তে ডাক দিল চাকরানীর নাম ধরে। চাকরানীর জন্য এই একটু আওয়াজই যথেষ্ট ছিল। সে দৌড়ে এলো ফাতেমার কাছে।

 ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, বেগম সাহেবা!’ চাকরানী ফাতেমাকে বল লো, ‘তাকে আর এখানে খুঁজে পাবেন না। তিনি এসেছিলেন, আমিও তার অপেক্ষায় নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ১৪০ আমি তাকে প্রাচীরের উপরে উঠতে দেখলাম। প্রাচীরের ওপর বসে তিনি এপারে রশি ফেললেন এবং রশি বেয়ে নিচে নামতে লাগলেন।

 তিনি তখনো মাটিতে পা দেননি, হঠাৎ দু’দিক থেকে দু’জন লোক ছুটে এলো। তিনি ততক্ষনে রশি বেয়ে নিচে নেমে পড়েছেন। আমি তাকে সাবধান করারও সুযোগ পেলাম না। তারা দু’জন তাকে এমনভাবে চেপে ধরলো, তিনি কিছুতেই তাদের হাত থেকে মুক্ত হতে পারলেন না। লোক দু’জন তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে তার হাত-পা-মুখ বেঁধে ফেললো। এরপর উনাকে নিয়ে ওরা অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

 আমি এত ভয় পেয়েছিলাম যে, অনেকক্ষণ কোন নড়াচড়া করিনি। যখন বুঝলাম লোকগুলো ধারে কাছে নেই, আপনাকে খুঁজতে শুরু করলাম । কিন্তু বাগানে আপনাকে কোথাও দেখলাম না, ওদিকে মেহমানদের ওখানে যাওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই, আপনার অপেক্ষায় আমি আবার এসে এখানেই লুকিয়ে রইলাম’।

 চাকরানীর কথা শুনে ফাতেমার মাথা ঘুরে গেলো। এইমাত্র সে এক খৃষ্টান কমান্ডারকে খুন করে এসেছে। আনতানুসের কাছে ছুটে এসছিল একটু শান্তনার আশায়, একটু নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। এখন আনতানুসই গ্রেফতার হয়ে গেছে।

 ব্যাপারটা তার কাছে আরব্য উপন্যাসের সেই আলিফ লায়লার ঘটনার মতই অবিশ্বাস্য ও রহস্যময় মনে হচ্ছিল। ফাতেমা বুঝতে পারছিল না, এখন তার কি করা উচিত। ১৪১ এখন কি রশি বেয়ে পালিয়ে যাবে নাকি মহলে ফিরে যাবে।

 সে গোয়েন্দাদের কাজ করেছে ঠিকই, কিন্তু এ কাজের বিপদ ও ঝুঁকি সম্পর্কে তার যেমন কোন ধারনা নেই, তেমনি নেই প্রকৃত ট্রেনিং।

 সে ভয় ও আতংকে হতবুদ্ধি হয়ে গাছের নিচে অন্ধকারে নিশ্চল পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলো।

 এক সময় তার মনে পড়ল, মহলের এক মেয়ে তাকে সাবধান করেছিল। এক দেহরক্ষী সিপাহীর সাথে ভালবাসার খেলা শুরু করার ভয়ানক পরিনতি সম্পর্কে সতর্ক করেছিল তাকে। সেই ভয়ংকর পরিনতি এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে, ভাবতে পারেনি ফাতেমা। আনতানুস ধরা পড়ে গেছে। ফাতেমার বদ্ধমুল ধারনা হলো, এখন সেও গ্রেফতার হয়ে যাবে।

 হঠাৎ তার চাকরানীর ওপর সন্দেহ হলো। সে-ই গোপনে সংবাদ দিয়ে আনতানুস কে ধরিয়ে দেয়নি তো? কিন্তু মনের ভাব গোপন রেখে চাকরানীকে বললো, ‘রশিটা কোথাও গোপন করার চেষ্টা করো’।

 তারপর সে দৌড়ে আবার মহলে ঢুকে গেল। মাহফিলে গিয়ে খুজলো সেনাপতি শামস বখত ও সাদ বখতকে।

 তখনো মদ ও নাচের আসর জমজমাট। ফাতেমা সেনাপতি সাদ বখতকে দেখতে পেলো এক কোণায় বসে আছে। মাহফিলের অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে, খৃষ্টান কমান্ডারের খুন বা আন তানুসের বন্দী হওয়া, কোন খবরই এখনও জানাজানি ১৪২ হয়নি।

 সে ধীরে ধীরে ও ভয়ে ভয়ে সাদ বখতের পাশে গেল এবং তাকে ইঙ্গিতে ডাকলো। বারান্দার এক অন্ধকার কোণে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা।

 ওকে নিরালায় পেয়েই ফাতেমা কোন রকমে শুধু উচ্চারন করলো, ‘আমি এক খৃষ্টান কমান্ডারকে খুন করে ফেলেছি’। তারপর সে খুন করার কারণও তাকে বললো, কিন্তু আনতানুসের গ্রেফতারের খবর বলার আগেই সাদ বখত বলে উঠলো, ‘ খৃষ্টান কমান্ডারের সাথে বাগানে যেতে কেউ তোমাদের দেখেছে?’

 ‘না, তবে যেখানে তার লাশ পড়ে আছে, বাগানে কেউ গেলেই দেখতে পাবে’।

 বিপদ কতটা ভয়ংকর বুঝতে পারলো সেনাপতি। ভয়ের এক অজানা শিহরণ বয়ে গেল তার সারা অঙ্গে। এ মেয়ের এখনি ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় চিন্তিত হয়ে পড়লো সাদ বখত। বল লো, ‘তোমার আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়।তুমি গ্রেফতার হয়ে গেলে গুমাস্তগীন তোমার মত সুন্দরী মেয়েকে কারাগারে কি শাস্তি দেবে, আমি টা ভাল করেই জানি। যদি তার বাবাও মারা যেতো তবু সে এতটা ক্ষিপ্ত হতো না, যতোটা ক্ষিপ্ত হবে এক খৃষ্টান কমান্ডার খুন হয়েছে শুনলে। সে এমন কঠিন প্রতিশোধ নেবে, যা তুমি কল্পনাও করতে পারো না’।

 ‘এখন উপায়! আমি কি করবো, কোথায় যাবো’? ১৪৩ ফাতেমা ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো।

 সাদ বখত বললো, ‘আমার ভাই শামস বখত এলে তার সাথে আলাপ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবো’।

 ‘তিনি কোথায়? ফাতেমা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো।

 ‘তিনি কারাগারে গেছেন। কিছুক্ষন আগে বাগানের পেছনের দেয়াল টপকে কে যেন ভেতরে এসেছিল। কে এসেছিল জানা যায়নি, কেন এসেছিল, তাও জানা যায়নি’।

 ‘সেনাপতি শামস বখত কি তাকেই দেখতে গেছেন?’

 ‘হ্যাঁ, বন্দীকে জেরা করে তার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিরে আসবেন তিনি। যদি তিনি কিছুক্ষনের মধ্যে না আসেন, তবে আমি নিজেই তার কাছে চলে যাবো। ভয় পেয়ো না, মঙ্কে শক্ত করো, তোমাকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা আমরাই করবো’।

 ফাতেমা নিশ্চিত গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি আনতানুস ছাড়া আর কেউ নয়। তার একটাই ভরসা, আনতানুস সেনাপতি শামস বখতের হাতে ধরা পড়েছে। নিশ্চয়ই তিনি তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করবেন।

 আসলেও সে আনতানুসই ছিল। তাকে যে দুই সিপাহী গ্রেফতার করেছে তারা শামস বখতের বিভাগেরই সৈন্য ছিল। তবে তারা যেমন তাদের সেনাপতির আসল পরিচয় জানতো না, তেমনি আনতানুসের পরিচয়ও জানা ছিল না তাদের। তাই তাকে গ্রেফতার করেই তারা সেনাপতিকে এ খবর পৌঁছে দিল। ১৪৪ খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেনাপতি শামস বখত বাইরে এলেন। বাইরে এসে তিনি দেখতে পেলেন, আনতানুস ধরা পড়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আসামী দেয়াল টপকে ভেতরে এসেছে।

 অপরাধীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। তিনি আসামীকে জেরা করার জন্য এক কামরায় নিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি তো সম্ভবত রক্ষী বাহিনীর এক সৈনিক। তুমি কেন দেয়াল টপকাতে গেলে? সত্যি কথা বলো, নইলে তোমার মৃত্যুদণ্ড কেউ ঠেকাতে পারবে না’।

 আন তানুস নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। সেনাপতি শামস বখতের রাগ হচ্ছিল এ জন্য যে, তাকে তিনি বারবার সাবধান করে দিয়েছিলেন, সে যেন সতর্ক থাকে। দায়িত্ববোধের ওপর যেন অন্য কোন কিছু প্রাধান্য না পায়। ফাতেমার সাথে যেন বেশী দেখা করার চেষ্টা না করে। কিন্তু সে তার নির্দেশ মানেনি। তার নির্দেশ মানলে এখন আর তাকে ধরা পড়তে হতো না। গোয়েন্দা বিভাগের আইনে এটা খুবই অন্যায় কাজ। কিন্তু এখন তাকে এ অপরাধের শাস্তি দেয়ার সময় নয়।

 আগে তাকে এ বিপদ থেকে বাঁচাতে হবে। আর তাকে বাঁচাতে হলে তাকে এখান থেকে সরাতে হবে। শামস বখত ভাবছিলেন, এই সাথে ফাতেমাকেও সরাতে হবে। কারণ আন তানুস যে ফাতেমার কাছেই যাচ্ছিল এবং ফাতেমাই তার ভেতরে আসার সুবিধার জন্য রশি টানানোর ব্যবস্থা করেছিল, এ কথা গোপন থাকবে না। ১৪৫ সেনাপতি শামস বখত দু’জন সিপাইকে ডেকে বললো, ‘বন্দীকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। ওকে আমার নিজস্ব টর্চার সেলে নিয়ে যাও’।

 সিপাইরা তাকে নিয়ে শামস বখতের টর্চার সেলের দিকে রওনা হলো।

 সিপাইরা সরে যেতেই তিনি তার বিশ্বস্ত বডি গার্ডের ডেকে কিছু গোপন নির্দেশ দিলেন। বডিগার্ডরা তার নির্দেশ মত কাজে লেগে গেল।

 শামস বখত মাহফিলে ফিরে তার ভাই সাদ বখতকে ডাকলেন। তখনও পুরোদমে নাচ-গান চলছে। মেহমানরা আনন্দে ‘সাবাস! সাবাস!’ করছে। মদও পরিবেশন চলছে সমানে। সকলেই পান ভোজনে মত্ত। খৃষ্টান কমান্ডারের লাশটি তখনো পড়ে আছে আগের জায়গাতেই।

 এমনি এক পরিবেশে শামস বখত ও সাদ বখতের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। সাদ বখত তার ভাই শামস বখতকে বললেন, ‘ফাতেমা এক খৃষ্টান কমান্ডারকে হত্যা করে ফেলেছে’।

 তিনি ফাতেমাকে কাছে ডেকে দ্রুত নিজের কামরা থেকে পোশাক পাল্টে আসতে বললেন। বললেন, ‘ তোমাকে এখনি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। জমকালো পোশাক নয়, খুব সাদামাটা পোশাক পরে আসবে, যাতে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তোমাকে চিনতে না পারে এবং সন্দেহ না করে’।

 ফাতেমা চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে আস্তে বেরিয়ে গেল কামরা ১৪৬ থেকে।

 কিছুক্ষন পর দারোয়ান এসে সেনাপতি শামস বখতকে সংবাদ দিল, ‘বাইরে এক কমান্ডার দাঁড়িয়ে আছে’।

 শামস বখত আবার বাইরে গেলো। সেখানে এক কমান্ডার ভীত সন্ত্রস্ত ভাবে দাঁড়িয়েছিল। সে রিপোর্ট দিল, ‘আনতানুস নামে যে রক্ষীটি ধরা পড়েছিল সে পালিয়ে গেছে’।

 ‘কেন সেই দুই সিপাহী কি মারা গেছে, যাদের আমি তাকে রেখে এসেছিলাম? শামস বখত ধমকে উঠলেন।

 ‘মনে হচ্ছে ব্যাপারটির সাথে একা আনতানুস জড়িত নয়, তার সাথে আরও কিছু লোকের যোগসাজশ আছে’। কমান্ডার বল লো, ‘দুই সিপাইকে আমরা কারাগারের পথে বেহুশ অবস্থায় পেয়েছি। তাদের মাথায় আঘাতের চিহ্ন’।

 সেনাপতি শামস বখত ঘটনা সরেজমিনে দেখতে গেলেন। ততক্ষনে সিপাহীদের জ্ঞান ফিরে এসেছিল। তারা বল লো, ‘আমরা বন্দীকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, অন্ধকারে কে বা কারা আমাদের পিছন থেকে মাথায় আঘাত করলো। আমরা বেহুশ হয়ে পড়ে গেলাম’।

 সেনাপতি শামস বখত তাড়া দিলেন উপস্থিত অন্যান্য সৈনিকদের, দেখছো কি দাঁড়িয়ে! বন্দী নিশ্চয়ই পালিয়ে বেশিদূর যেতে পারেনি। খোঁজো, চারদিকে খুঁজে দেখো কোথায় পালিয়েছে বন্দী’।

 সৈনিকদের মাঝে দৌড়াদৌড়ি পড়ে গেল।

 ঠিক সেই সময় একজন মহিলা আপাদমস্তক কালো বোরকা ১৪৭ পরে বেরিয়ে এলো গুমাস্তগীনের মহল থেকে।

 দরজার প্রহরীরা তাকিয়ে ছিল তার দিকে, কিন্তু মহিলার চোখ দুটি ছাড়া ওরা আর কিছুই দেখতে পেলো না। মহিলাটি দরজার বাইরে এসেই অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রহরীরা জানতো, আজ জবরদস্ত মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে মহলে।অতএব চেনা অচেনা বহু মেহমান রাতভর আসা-যাওয়া তো করবেই। সুতরাং কে এলো আর কে গেল এ নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা ছিল না।

 রাতের শেষ প্রহর।

 মেহমানদের এবার বিদায়ের পালা। অলস পায়ে মহল থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে লাগলো মেহমানরা। প্রহরীরা কেল্লার প্রধান ফটক উন্মুক্ত করে দু’পাশে দাঁড়িয়ে গেল, যেন মেহমানরা স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে যেতে পারেন।

 প্রাসাদের বাইরে কেল্লার চার দেয়ালের ভেতরেই ছিল মেহমানদের ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ি রাখার স্থান। সেখান থেকে নিজের বাহন নিয়ে কেউ বেরোচ্ছিলেন ঘোড়ায় চড়ে, কেউবা ঘোড়ার গারিতে চড়ে।

 একে একে বের হচ্ছেন মেহমানরা, প্রহরীরা দেখলো দুই অশ্বারোহী এগিয়ে আসছে ফটকের দিকে, তাদের একজনের মুখ ঢাকা, অন্য ঘোড়ায় বোরকাপরা এক মহিলা আরোহী। একটু আগে এ মহিলাই গুমাতগীনের মহল থেকে বের হয়ে এসেছিল। ১৪৮

 এ দুই অশ্বারোহী ছিল আনতানুস ও ফাতেমা। এদের এভাবে পালাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সেনাপতি শামস বখত ও সাদ বখত।

 তিনিই বন্দীকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিয়ে তার বিশ্বস্ত বডিগার্ডদের বলেছিলেন, কিভাবে আনতানুস কে মুক্ত করবে। তার নির্দেশেই বডিগার্ডরা দুই সিপাইকে আহত করে আনতানুস কে মুক্ত করে।

 ফাতেমা প্রাসাদ থেকে সফলভাবে বেরিয়ে এলে শামস বখত ও সাদ বখতের বিশ্বস্ত বডি গার্ড, যারা মূলত সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা ছিল, তারা আনতানুস ও ফাতেমা কে একত্রিত করে সেখান থেকে তাদের পালিয়ে যাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করে।

 রাতটি মদ ও নাচ-গানে বিভোর হয়ে কেটে গেলেও পরদিন ভোরেই গুমাস্তগীনের কাছে পৌঁছলো এক দুঃসংবাদ। মহলের এক রক্ষী তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জানালো, ‘বাগানে এক খৃষ্টান কমান্ডারের লাশ পড়ে আছে’।

 মুহূর্তে ঘুমের আমেজ ও অলস তন্দ্রার ভাব কেটে গেল গুমাস্তগীনের।

 সে অবিশ্বাস ভরা চোখে প্রহরীর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কি আবোল তাবোল বকছো! আমার মহলে একজন খৃস্টানকে খুন করতে যাবে কে? কার এমন বুকের পাটা? কে সেই খুনী?’

 গুমাস্তগীনের চেহারা যখন রাগে লাল সে সময় মহলের আরেক গার্ড এসী বললো, ‘রক্ষী আন তানুস পালিয়েছে। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না’।

 এ সময় এক দাসী ছুটে এসে বললো, ‘হুজুর, আপনার ছোট বেগম ফাতেমা মহলে নেই। ঝাড়ুদার তার কামরা পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখে তিনি কামরায় নেই। সারা বাড়ি ঝাড়ু দেয়া শেষ করে কোথাও তাকে না দেখে আমাদের বলে। তখন আমরা বাড়ির প্রতিটি কামরায় তাকে তালাশ করি। কিন্তু তিনি কোথাও নেই’।

 গুমাস্তগীনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। প্রায় একই সময়ে ঘটে যাওয়া তিনটি মারাত্মক দুর্ঘটনার মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে কিনা এখনো তার জানা নেই, কিন্তু তার মনে হলো, এর মধ্যে কোন যোগসূত্র না থেকেই পারে না।

 একই দিনে খৃষ্টান কমান্ডারের খুন হয়ে যাওয়া, রক্ষীর পলায়ন ও স্ত্রীর নিখোঁজ সংবাদের মধ্যে কি রহস্য লুকিয়ে আছে তাকে খুঁজে বের করতে হবে।

 তিনি দ্রুত উপস্থিত এক গার্ডকে বললেন, ‘রক্ষী প্রধান ও সেনাপতিকে খবর দাও জলদি এখানে আসার জন্য’।

 তারপর তিনি পোশাক পাল্টাতে নিজের রুমে গিয়ে ঢুকলেন। একটু পর সামরিক পোশাকে বৈঠক খানায় এসে দেখেন সেনাপতি শামস বখত, সাদ বখত ও রক্ষী প্রধান বসে আছে।

 তিনি বললেন, ‘এসব কি শুনছি? আপনারা কি গতকালের দুর্ঘটনার সম্পর্কে কিছু শুনেছেন?’

 এরপর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে ওদের মাঝে বিস্তারিত আলাপ হলো। সবকিছু শুনে তিনি আদেশ জারী করলেন, ‘যে দু’জন সিপাহীর অসতর্কতার কারণে রক্ষী পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো তাদের দু’ জনকে সারা জীবনের জন্য কারাগারে পাঠিয়ে দাও। আর খৃষ্টান কমান্ডার কে কে খুন করলো এবং ফাতেমা কেন এবং কোথায় পালিয়ে গেল জলদি তা অনুসন্ধান করে বের করো’।

 গুমাস্তগীনের এক খৃষ্টান বন্ধু খুনহয়ে গেছে, ব্যাপারটা নিয়ে হৈ চৈ কাণ্ড পড়ে গেল। আনতানুস ও ফাতেমার পালানোর ব্যাপারটাও আলোড়ন তুললো, তবে তা মহলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল। মহলের বাইরে এ নিয়ে আর তেমন কেউ মুখ খুললো না।

 গুমাস্তগীন বন্ধুর খুন হওয়া নিয়ে বাইরে যত দুঃখ প্রকাশ ও প্রোপাগান্ডা করছিল, সত্যি কথা বলতে কি, মনে মনে ততটা আফসোস ও দুঃখ তার হয়নি। কারণ এই কমান্ডার কেবল চাটুকারই ছিল না, মহা ধড়িবাজও ছিল। সে গুমাস্তগীনকে ফুসলিয়ে তার কাছ থেকে বেশী বেশী সুবিধা আদায় করতো। সব কাজেই সে অতি উৎসাহ দেখাতো এবং বাড়াবাড়ি করতো।

 খৃষ্টানরা ভালমতই জানতো, মুসলমানদের হেরেমখানায় আরব্য উপন্যাসের মত কাহিনী প্রায়ই তৈরি হয়। সেখানে মেয়েদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, নারী ঘটিত কারণে রহস্যজনক খুন, এ সবই স্বাভাবিক ঘটনা। সবাই ধরে নিল, কমান্ডারের মৃত্যু সে রকমই একটি ঘটনা। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে গুমাস্তগীনকে একটু চাপের মুখে রাখার এই সুযোগ ওরা হাতছাড়া করবে কেন? ওরা এ ঘটনার বিচার ও ক্ষতিপুরন দাবী করলো। ওদের এই চাপের কারণে গুমাস্তগীন একটু অসহায় অবস্থায় পড়ে গেল। ওরা চাচ্ছিল, সে যেন তার মাথা ওদের পায়ের নিচে রেখে দেয়। আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুমাস্তগীন যাদের সাহায্য চেয়েছিল ওরা এমন সব শর্ত আরোপ করলো, তা মানতে গেলে তাকে ওদের গোলাম হয়ে যেতে হয়। গুমাস্তগীন বুঝতে পারলো, খৃষ্টানদের নিয়ত মোটেই ভাল নয়। এসব ঘটনা ও অবস্থার প্রকৃত রূপটা আর গোপন রইল না। হলব পর্যন্ত পৌঁছে গেল এ খবর।

 সেখানকার আমীর উমরা ও পারিষদবর্গ, যারা সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, তারা গুমাস্তগীনকে তাদের ঐক্যজোটে শামিল ও সক্রিয় দেখতে চাচ্ছিল। স্বাধীনভাবে লড়ার চেয়ে জোটবদ্ধ হয়ে লড়ার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য আল মালেকুস সালেহ গুমাস্তগীনের কাছে এক দূত পাঠাল। সে সাথে প্রথা অনুযায়ী মুল্যবান উপঢৌকন ও দুই নবীন তরুনী পাঠালো শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরুপ। গুমাস্তগীন আরাম করছিল। দূত উপহার ও মেয়ে দু’টিকে নিয়ে সেনাপতি শামস বখতের সাথে দেখা করল। কারণ গুমাস্তগীনের পরেই এখানকার সর্বাধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন সেনাপতি শামস বখত। তিনি গুমাস্তগীনের পক্ষে সরকারী কাজকর্মও দেখাশোনা করতেন। সেনাপতি শামস বখত মেয়েদেরকে পাশের কামরায় বসিয়ে রেখে দুতকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি সংবাদ নিয়ে এসেছো?’ দূত তার সফরের উদ্দেশ্য তুলে ধরলো। তার হাতে তুলে দিল আল মালেকুস সালেহের দীর্ঘ চিঠি।

 সেনাপতি শামস বখত চিঠি পাঠ করলেন।

 চিঠিতে আল মালেকুস সালেহ উল্লেখ করেছেন, ‘সুলতান আইয়ুবী হলব অবরোধ করলে চুক্তি অনুযায়ী রিমান্ড খৃষ্টান বাহিনী নিয়ে রওনা দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সুলতান আইয়ুবী অবরোধ উঠিয়ে তার মোকাবেলায় এগিয়ে গেলে সে ভয়ে পালিয়ে যায়। আইয়ুবীর সাথে কোন যুদ্ধ না করেই বিপুল অর্থের বিনিময়ে তার সাথে আমার যে সহযোগিতা চুক্তি হয়েছিল সেই চুক্তি সফল ও শেষ হয়ে গেছে দাবী করে সে আমার এখানে তার যে উপদেষ্টারা ছিল তাদের ফেরত নিয়ে যায়। এভাবে সে আমার বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নেয় কিন্তু বিনিময়ে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধই করেনি।

 সুতরাং আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে খৃষ্টানদের সহযোগিতার আশা বৃথা। আমি মনে করি খৃষ্টানরা আমাদের কাছ থেকে তাদের স্বার্থ ঠিকই আদায় করে নেবে, কিনু আমাদের কোন উপকারে লাগবে না তারা। আগামীতেও তারা আমাদের এমনিভাবে ধোঁকা দেবে। যদি আমরা পৃথক পৃথকভাবে সালাউদ্দিনের সাথে মোকাবেলা করি, তবে সামরিক বিবেচনায় আমদের কারোরই বিজয়ের নিশ্চয়তা নেই। দুর্ভাগ্যজনক পরাজয়ের গ্লানি থেকে বাঁচতে হলে, আমি মনে করি আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। কেবলমাত্র ঐক্যবদ্ধ অভিযানই সুলতান আইয়ুবীকে চিরদিনের মত নিঃশেষ করার গ্যারান্টি দিতে পারে’।

 এই চিঠির সাথে কিভাবে যৌথ অভিযান পরিচালিত হতে পারে তার একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা ছিল। পরিকল্পনাটি এ রকম, ‘আর রিস্তানের পাহাড়ী এলাকার বরফ গলতে শুরু করেছে। গোয়েন্দারা জানিয়েছে, পাহাড়ের যে উঁচু শৃঙ্গে সুলতান আইয়ুবী গাঁট হয়ে বসেছিল, ওখানকার বরফ গলতে শুরু করায় বেকায়দায় পড়ে গেছে সুলতানের বাহিনী। বরফের মাঝে সৃষ্টি হচ্ছে ফাটল। বরফগলা পানির স্রোত হচ্ছে, সেই স্রোত নামতে শুরু করেছে নিচের দিকে। ফলে পাহাড়ের চেহারা যাচ্ছে পাল্টে। সৈনিকরা এক জায়গায় বসতে পারছে না। পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে তাদের। এটাই সুলতানকে আক্রমণ করার মোক্ষম সময়। আমাদের জন্য এক মহা সুযোগ। আমরা সবাই একজোট হয়ে সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে আইয়ুবীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে তারা এক মস্ত ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যাবে। চারদিক থেকে পাহাড় গুলো ঘিরে রাখলে আমরা অবরোধের মধ্যে ফেলেই ওদের পরাজিত করতে পারবো।

 আরেকটি বিষয়। খৃষ্টান রাজা রিজনেল্টকে আমাদের সাথে শামিল করে নেয়ার জন্যও আমি একটি উদ্যোগ নিয়েছি। আপনিও সেইসব খৃষ্টানদের সহযোগিতা আদায়ের চেষ্টা করুন, যাদের আপনি যুদ্ধবন্দী হিসাবে কারাগারে পচে মরার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। নুরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর পর ওদের শর্তহীন মুক্তি দিয়ে আপনি যে নজীর সৃষ্টি করেছিলেন, সে কথা ওদের স্মরণ করিয়ে দিন’। সেনাপতি শামস বখত এই চিঠি তার ভাই সাদ বখতকে পড়তে দিলেন। চিঠি পড়া শেষ হলে দুই ভাই পরামর্শ করলেন, এখন কি করা যায়।

 সাদ বল লো, ‘এ চিঠি গুমাস্তগীনের কাছে পৌঁছানো ঠিক হবে না। আলাদা আলাদা মোকাবেলা করলে সুলতানের কোন কষ্টই হবে না ওদের পরাজিত করতে। কিন্তু সম্মিলিত আক্রমণ ঠেকাতে মুজাহিদদের যথেষ্ট বেগ পেতে হবে’।

 ‘তুমি ঠিকই বলেছো’। সেনাপতি শামস বখত বললেন, ‘সুলতানের সাথে এখন যথেষ্ট পরিমান সৈন্য নেই। এ অবস্থায় তাঁকে সম্মিলিত আক্রমনের ঝুঁকিতে পড়তে দেয়া যায় না’। এভাবে অনেক চিন্তা-ভাবনার পর তারা সিদ্ধান্ত নিলো, এ চিঠি তারা গুমাস্তগীনের কাছে পৌঁছতে দেবে না। গুমাস্তগীন সুলতান আইয়ুবীর সাথে একাই যুদ্ধ করবে। এতে তার পরাজয় নিশ্চিত। এভাবেই তারা গাদ্দারদের একে একে নিঃশেষ করার পরিকল্পনা করলো। দুই ভাই তাদের এই একান্ত গোপন পরিকল্পনা নিজেদের অন্তরেই লুকিয়ে রেখেছিল কিন্তু একটি ঘটনা তাদেরকে এ ব্যাপারে আবেগ তাড়িত করে তুললো। এই আবেগ সিঞ্চনে মুখ্য ভুমিকা পালন করলো দুতের নিয়ে আসা সেই দুই মেয়ে।

 মেয়েরা জানালো, তারা দু’জনই মুসলিম পরিবারের মেয়ে। বয়সের দিক থেকে ওরা ছিল খুবই অল্প বয়সের, সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ দুই নবীন তরুনী। তাদের দেখে দুই ভাইয়েরই খুব মায়া হলো। বুকের ভেত্রবয়ে গেল কষ্টের বিদ্যুৎ।

 হায়! মুসলমানদের আজ একি অধপতন! ফুলের মত নিষ্পাপ দুটি মেয়েকে এই পাপের পথে ঠেলে দিতে একটুও কাপলো না বাপ-মায়ের বুক। কেমন করে তারা পারলো নিজের মেয়েদের অধঃপতনের এই পঙ্কিল আবর্তে ঠেলে দিতে!

 যারা নিজের সুন্দরী মেয়েদের ইজ্জত বিক্রি করতে পারে, নিজেদের চরিত্র ও ঈমান তো তারা আগেই বিক্রি করে ফেলে! এ সব অবলা সুন্দরী মেয়েদের যেখানে সম্মানিত ও ভদ্র ঘরের বধু হয়ে সম্মানের জীবন কাটানোর কথা , লোভী পিতামাতার ইচ্ছার বলী হয়ে আজ তারা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। নিজের ইচ্ছা ও সপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে ধনীদের অন্দর মহলে দাসী হিসেবে নিকৃষ্ট জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে।

 ‘তোমরা কোথাকার বাসিন্দা?’ সাদ বখত তাদের জিজ্ঞেস করলো, ‘এদের হাতে কেমন করে পড়লে? মেয়েরা যে উত্তর দিল তাতে দুই ভাইয়েরই শরীরের রক্ত গরম হয়ে উঠলো। সেনাপতিদ্বয় জানতো, খৃষ্টান অধ্যুষিত অঞ্চলে মুসলমানদের ইজ্জত ও সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার কোন উপায় ছিল না। নিরাপদ ছিল না মেয়েদের মান-সম্ভ্রম। খৃষ্টানদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে মুসলমানরা তাদের চিরদিনের সাজানো ঘরবাড়ি ছেড়ে পথে নামতো নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। কিন্তু পথও তাদের জন্য নিরাপদ ছিল না। তারা যখন অন্যত্র যাওয়ার জন্য যাযাবরের মত পথে নামতো তখন সে কাফেলায় হামলা করে তাদের সব সহায় সম্পদ লুট করে নিত খৃষ্টানরা। এমনকি দলে যে সব যুবতী মেয়ে থাকতো, তাদের অপহরণ করতো। এই লুটতরাজ সংঘবদ্ধ খৃষ্টান যুবকরা শুধু করতো এমন নয়, বহু ক্ষেত্রে সে সব অঞ্চলের খৃষ্টান সেনাবাহিনীও এ ধরনের লুটপাটে সক্রিয় অংশ গ্রহন করতো। লুটের মালের মধ্যে থাকতো ধন-সম্পদ , থাকতো সুন্দরী যুবতী নারী, আর থাকতো কাফেলার উট, ঘোড়া ও পশুর পাল।

 এসব উট, ঘোড়া ও পশুর পাল তারা বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দিত। মেয়েদেরও বাজারে নিয়ে চড়া দামে নিলামে তুলতো। এদের কিনে নিত ধনাঢ্য খৃষ্টানরা। কখনো কখনো মুসলমান আমীররাও খরিদ করতো এসব মেয়েদের।

 খৃষ্টান সৈন্যরা যেসব মেয়েদের লুট করতো তাদের অধিকাংশকে তারা পতিতা ও গোয়েন্দা বানাতো। চরিত্র হনন ও গোয়েন্দা কাজের প্রশিক্ষন দিয়ে তাদের পাঠিয়ে দিত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায়। ওখানকার আমীর ওমরা ও যুবকদের নষ্ট করার কাজে ব্যবহার করা হতো ওদের। এই দু’টি মেয়েকে এমনি এক কাফেলা থেকে লুট করা হয়েছিল। তখন তাদের বয়স ছিল একজনের নয়, অন্যজনের তের। তারা ফিলিস্তিনের খৃষ্টান অধ্যুষিত এলাকা থেকে পরিবারের লোকজনের সাথে নিরাপদ এলাকায় চলে যাচ্ছিল। ওদের কাফেলাটি ছিল বিরাট। খৃষ্টান সেনাবাহিনীর একটি দল রাতের বেলায় হঠাৎ ওদের আক্রমণ করে বসে। কাফেলার রক্ষী যুবকরা ওদের প্রতিহত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়, কিন্তু একটি সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সাথে কুলিয়ে উঠতে পারে না। অনেকেই হতাহত হয়। বাকীরা পরাজিত হয়ে ধরা পড়ে সৈন্যদের হাতে। এ সময় অনেক মেয়েই ওদের হাতে ধরা পড়ে, যার মধ্যে এ দু’জনও ছিল। এ মেয়ে দু’টি ছিল অসাধারণ সুন্দরী। সৈন্যরা তাদেরকে ছাউনিতে নিয়ে গিয়ে বিশেষভাবে লালন-পালন করতে থাকে। প্রথম দিকে তাদের সাথে খুব অমানবিক আচরণ করা হয়। বিভিন্ন রকম নিপীড়ন ও নির্যাতন চালানো হয়। তারপর তাদের বলা হয়, ‘তোমরা যদি আমাদের কথা মত চলো তবে তোমাদের ওপর আর কোনদিন কোন রকম নির্যাতন করা হবে না’। এরপর থেকে ওদের সাথে সদয় ব্যবহার করা শুরু করে খৃষ্টান সৈন্যরা। তাদেরকে নানা রকম শারীরিক ও মানসিক প্রশিক্ষন দেয়। এক সময় তাদের সাথে এমন আচরণ শুরু করে যেন ওরা রাজকুমারী। দেখতে ওরা শাহজাদীর মতই সুন্দরী ও রুপসী ছিল। খৃষ্টান গোয়েন্দা বাহিনী তাদেরকে রাজকীয় আদব-কায়দা ও প্রটোকল শেখালো। কিভাবে প্রভুদের মনোরঞ্জন করতে হয়, কিভাবে দরবারে মদ পরিবেশন করতে হয় সব বিষয়েই তাদেরকে পারদর্শী করে তোলা হলো। তাদের শিখালো নৃত্য ও গান। পাঁচ বছর পর সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যু হলে খৃষ্টানরা এ দুই মেয়েকে উপহার স্বরুপ দামেশকে পাঠায়। খলিফা আল মালেকুস সালেহের সাথে ওরা হলবে এসেছিল। সেখান থেকে দূতের সাথে ওদেরকে এখানে পাঠানো হয়। মেয়েরা বললো, ‘আমাদের মন থেকে ধর্মীয় ও জাতীয় চেতনা একেবারে নিঃশেষ করে দেয়া হয়েছে। মানুষ আমাদেরকে সুন্দর খেলার পুতুল মনে করে, আমারা নিজেরাও নিজেদেরকে তাই ভাবতে শুরু করি। কিন্তু যখন আমাদেরকে দামেশক পাঠানো হয় তখন আমাদের মনে নতুন করে ধর্মীয় চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। আমাদের মনে পড়ে, আমাদের শরীরে বইছে মুসলমানের রক্ত। মনে পড়ে, আমাদের পূর্ব পুরুষরা একদিন ইসলামের জন্য জীবন দিত, তাদেরই উত্তরসুরী হয়ে আমরা ইসলাম ও মুসলমানদের বারোটা বাজানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছি! এ কথা মনে হতেই নিজেদের জীবনের ওপর ধিক্কার নেমে আসে আমাদের। আমরা আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোন ও সেই পরিবার আর খুঁজে পাবো না। কিন্তু স্বজাতির কাছে ফিরে আমাদের মনে হলো, আমরা তো এই জাতিরই সন্তান! আমরা মুসলমান আমীর ও শাসকদেরকেই আমাদের মা-বাবা ও অভিভাবক মনে করলাম। কিন্তু আফসোস! এদের কোন একজনের কাছ থেকেও পিতা ও ভাইয়ের আদর ও আচরণ পেলাম না। খৃষ্টানদের কাছে সবকিছু হারিয়েও যে দুঃখ বেদনা পাইনি, সেই কষ্ট পেলাম মুসলমান ভাই ও গুরুজনের কাছে এসে। আমরা তাদের কাছে দু’হাত জোড় করে দয়া ভিক্ষা করেছি; দু’পা ধরে মিনতি করেছি।

 দ্বীন ইসলাম, আল্লাহ্‌ ও তার রাসুলের দোহাই দিয়ে বলেছি, আমরা আপনাদেরই বোন বা কন্যা! আমরা মজলুম, আমরা লাঞ্চিত! আমাদেরও মান-সম্মান আছে, আল্লাহ্‌রওয়াস্তে আমাদের ওপর রহম করুন! একটু দয়া করুন আমাদের ওপর! কিন্তু তাদের কাছ থেকে খৃষ্টানদের মতই বরং কারো কারো কাছ থেকে তার চেয়েও বেশী বীভৎস ও নোংরা আচরণ পেয়েছি। ওরা জঘন্য প্রকৃতির ব্যভিচারী, ভয়ানক মাতাল ও কুৎসিত শয়তানী আচরণে অভ্যস্ত!

 ওদের নোংরামী দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি। অনুভব করেছি, এসব মুসলমান আর খৃষ্টান কাফেরদের মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই’। ওরা আরো বললো, ‘এখন আমাদের চোখের মধ্যে জ্বলছে প্রতিশোধের দাউ দাউ আগুন। সুলতান আইয়ুবী দামেশকে প্রবেশ করলে আমরা খুবই খুশী হয়েছিলাম। খৃষ্টান অধ্যুষিত অঞ্চলের মুসলমানরা সুলতান আইয়ুবীর পথ পানে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়েছিল। তারা তাঁকে তাদের অবিসংবাদিত ইমাম ও নেতা মনে করতো। তিনি যখন সত্যের পতাকা উড়িয়ে দামেশক পৌঁছলেন, আমরা স্থির করলাম, আমরা তাঁর কাছে চলে যাবো। তাঁকে বলবো, ‘আমাদের মত মজলুম মেয়েদের সামরিক বিভাগে নিয়ে নিন। আমরা এতদিন যে পাপ করেছি, দ্বীনের পথে কাজ করে সে পাপ মোচন করতে চাই। কিন্তু খলিফা আমাদেরকে জোরপূর্বক হলবে নিয়ে এলো। আমাদের ভাগ্য আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ওদের হাত থেকে এবার আমরা আপনাদের হাতে এসে পড়েছি। এখন আর আমাদের কোন প্রত্যাশা নেই। আপনাদের কাছে আমরা এমন আশাও করি না, আপনারা আমাদেরকে নিজের বোন বা কন্যার মত গ্রহন করবেন। কিন্তু একটি কথা আপনাদের বলে দিতে চাই, যে ইজ্জত ও সম্মান হারিয়ে ফেলেছি, টা হয়তো আর ফিরে পাবো না, কিন্তু ইসলামের সাথে আমাদের যে আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে তা ফিরে পাওয়ার জন্য আমৃত্যু চেষ্টা করে যাবো। আমরা খৃষ্টানদের কাছে ছিলাম, সেখানে ইসলামের বিরুদ্ধে ও সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সর্বত্র ষড়যন্ত্রের ভয়াল রূপ দেখেছি। আবার মুসলমানদের কাছে এসেও সেই একই তৎপরতা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের রূপ যৌবন আপনারা আপনাদের ইচ্ছেমত ব্যবহার করুন, কিন্তু দয়া করে ইসলামের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রে আমাদেরকে ব্যবহার করবেন না’।

 ‘কিন্তু তোমাদেরকে যদি ইসলামের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করতে বলি, তাহলে কি তোমরা তা করবে?’

 ‘দেখুন, আপনারা আইয়ুবীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ইসলামের জন্যই আইয়ুবী অস্ত্র ধরেছেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। ফলে ইসলামের পক্ষে আমাদের কাজে লাগাবেন, এটা অবিশ্বাস্য। তবু আপনারা যে প্রশ্ন করেছেন তাঁর উত্তরে বলতে চাই, যদি আপনারা আমাদেরকে খৃষ্টান এলাকায় পাঠান, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে মোটেও ত্রুটি করবো না। এখন আমাদের আর ইজ্জত হারানোর ভয় নেই। মান-সম্মানের প্রশ্ন নেই। যে সম্পদ হারানোর ভয়ে নারীরা শঙ্কিত থাকে সে সম্পদ তো আমাদের আগেই নিলাম হয়ে গেছে। এখন যদি আমাদেরকে ইসলামের প্রতিরক্ষা ও উন্নতির জন্য কেউ কাজ করার সুযোগ দেয়, তার কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ থাকবো’। মেয়েদের এই তেজোদীপ্ত বক্তব্য ও বেদনাদায়ক কাহিনী শুনে সেনাপতি শামস বখত ও সাদ বখত দু’জনেই মনে মনে কঠিন আঘাত পেলেন। তাঁরা মেয়েদের বললেন, কোন বিলাসপ্রিয় ও ফুর্তিবাজ শাসকের হাতে তোমাদের আর তুলে দেয়া হবে না’।

পরবর্তী বই ক্রুসেড-১৩

পাপের ফল

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 4 | 5 | 6 | 7 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top