১২. গোপন বিদ্রোহী

 আনতানুস ঘোড়া নিয়ে দূরে ছুটে গেল। সেখান থেকে তীর বেগে ছুটে আসছিল ঘোড়া, আনতানুস ধনুকে তীর জুড়লো। বডিগার্ড প্লেটটি শুন্যে ছুঁড়ে দিলে আনতানুস ছুটন্ত অশ্ব থেকে তীর বর্ষণ করলো। প্লেটটি শুন্যে খান খান হয়ে ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে।

 কেউ জানতো না, আনতানুস একজন সুদক্ষ গোয়েন্দা ও দুর্ধর্ষ কমান্ডো। প্রতিটি যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহারে যেমন সে পারদর্শী তেমনি উস্তাদ অশ্ব চালনায়। তার সুগঠিত দেহ, বলিষ্ঠ শরীর, আকর্ষণীয় চেহারা, ফর্সা গায়ের রং ও চমৎকার নৈপুণ্য দেখে গুমাস্তগীন খুব আকৃষ্ট হলো। সাধারন সৈন্যদের সাথে না দিয়ে গুমাস্তগীন তাকে তার বডিগার্ডের দলে নিয়ে নিল।

 দু’জন করে বডিগার্ড গুমাস্তগীনের মহলের দরজায় পালা করে ডিউটি দিত। কিছুদিনের মধ্যেই মহলে গার্ড দেয়ার ডিউটি পেল আনতানুস। সপ্তাহের সাত দিনই সেখানে তার ডিউটি থাকে।

 মুসলিম আমীরদের রীতি অনুযায়ী গুমাস্তগীনের মহলেও চলতো সৌন্দর্যের লীলাখেলা। হারেমে ছিল বারো-চৌদ্দজন সুন্দরী।

 আন তানুস প্রথম দিন গিয়েই মহলের চারদিক, মহলে প্রবেশের সব দরোজা, প্রতিটি কামরা ও কামরার কোথায় কি আছে দেখে নেয়। সে সেখানকার সমস্ত চাকর চাকরানী ও নারী পুরুষকে বলে, ‘মহলের প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের নিয়োগ করা হয়েছে, সে জন্য পুরো বাড়ীর কোথায় কি আছে সব খোঁজখবর ও বিষয় সম্পর্কে আমাদের জানা থাকা দরকার’।

 সে যখন কামরাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিল, এক যুবতীর সাথে দেখা হয়ে গেল তার। এ মেয়ে গুমাস্তগীনের নতুন এক বেগম, অন্দর মহলের শোভা বর্ধনকারীদের অন্যতম।

 সে আনতানুসকে ডাঁটের সাথে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে তুমি, এখানে কি করছো?’

 ‘আমি এখানকার নতুন গার্ড!’ সে উত্তর দিল, ‘দেখছি, এ মহলে কোন কোন পথে আসা যাওয়া করা যায়। আর এখানে যারা থাকে তাদেরও চিনে রাখা দরকার’।

 ‘গার্ড তো এখানে আগেও ছিল, কেউ তো কোনদিন ভেতরে আসেনি!’ মেয়েটি বললো, ‘তোমার এভাবে মহলে ভেতর আসা ঠিক হয়নি’।

 ‘এটা আমার দায়িত্ব। যদি অন্দর মহল থেকে কোন মেয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়, জবাবটা কে দেবে, তুমি না আমি? কেল্লার মালিক যদি সে সুন্দরীর পরিবর্তে আমার বোনকে দাবী করে বসে, তখন?’

 ‘ও, তার অর্থ তুমি এখানে ডিউটি করার সময়ও নিজের বোনের হেফাজতের চিন্তাতেই ব্যস্ত থাকো? ধন্য তোমার বোনেরা, এমন ভাই ক’জনের ভাগ্যে জোটে! মেয়েটি একটু হেসে কিছুটা তিরস্কারের সুরেই বললো।

 সঙ্গে সঙ্গে আনতানুসের চেহারা বেদনায় মলিন হয়ে উঠলো। দুঃখ ভারাক্রান্ত স্বরে সে বলে উঠলো, ‘আফসোস! যদি আমি তাদের রক্ষা করতে পারতাম! আমি তো এক নাদান ভাই, যে তার বোনদের জন্য কিছই করতে পারেনি!’

 মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সে আরো বললো, ‘যদি সেদিন আমি তাদের রক্ষা করতে পারতাম তবে তোমাদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় আমি এতটা পেরেশান থাকতাম না। তোমাদের নিরাপত্তার চিন্তায় অস্থির হয়ে আমাকে মহলের ভেতরও আসতে হতো না, আর তুমিও আমাকে এ নিয়ে তিরস্কার করতে পারতে না’।

 মেয়েটি সমবেদনার সুরে বললো, ‘দুঃখিত, আমি বুঝতে পারিনি আমার কথায় তুমি কষ্ট পাবে’।

 আন তানুস তার চেহারায় উদাসভাব নিয়ে বললো, ‘আমি আমার বোনদের রক্ষা করতে পারিনি বলেই তোমাদের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকি। সেও ঠিক তোমার মতই ছিল। দয়া করে আমাকে আমার কাজে বাঁধা দিও না’।

 সে অন্ধকারে তীর ছোঁড়ার মত মেয়েটির আবেগের ওপর যে তীর নিক্ষেপ করলো, সে তীর ব্যর্থ হলো না। মেয়েটি প্রশ্ন করলো, ‘তোমার বোনদের কি হয়েছে? কেউ কি তাদের হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে?’

 ‘যদি ছিনতাইকারী কোন মুসলমান হতো, কিংবা আমার বোন কোন মুসলমানের সঙ্গে বেরিয়ে যেতো, তবে আমার কোন আফসোস থাকতো না’।সে বললো, মনকে এই বলে প্রবোধ দিতাম, সে তাকে বিয়ে করে নিয়েছে অথবা কোন আমীরের মহলে আশ্রয় পেয়েছে। কিন্তু আমার একটা নয়, দুটো বোনকেই খৃষ্টানরা ধরে নিয়ে গেছে। আমি তাদের রক্ষা করতে পারিনি’।

 মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, ‘তারা কোত্থেকে কিভাবে হাইজ্যাক হলো?’

 সে জেরুজালেমের সেই কাহিনী ও তার পালিয়ে আসার লোমহর্ষক এক বর্ণনা দিয়ে মেয়েটির আবেগের ওপর আঘাত হানলো। মেয়েটির চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছিল, তার কথার তীর মেয়েটির বুকে ঠিক মতই বিদ্ধ হচ্ছে। সে আরো বললো, ‘আমি সেখান থেকে পায়ে হেঁটে এখানে এসেছি। আমি সৈন্য বাহিনীতে ভর্তি হয়েছি শুধু আমার বোনের নয়, এমন আরও যেসব বোনদের খৃষ্টানরা লাঞ্ছিত করেছে তার প্রতিশোধ নিতে।

 সে মেয়েটিকে আরও অনেক আবেগময় কথা শোনালো, যেসব কথা মেয়েটার অন্তরে গিয়ে বিধলো।

 আনতানুস ভালমতোই জানতো, মহলের এসব রক্ষিতা মেয়েরা খুব আবেগী হয়। চারিত্রিক দিক থেকেও এরা থাকে দুর্বল স্বভাবের। কারণ সুস্পষ্ট, যদি একটি পুরুষের এক ডজন কিংবা তার চেয়েও বেশী স্ত্রী ও রক্ষিতা থাকে, তবে কোন নারীই আশ্বস্ত হতে পারে না, স্বামী কাকে বেশী ভালবাসে। ফলে, এরা থাকে ভালবাসার কাঙাল।

 যুবতী মেয়েরা হয় আরো আবেগী। হেরেমের আশ্রিতা এসব মেয়েরা জানে, কয়েক বছর পর তার চাহিদা থাকবে না, জীবনেরও কোন মূল্য থাকবে না তার।

 আন তানুস এটাও জানে, হেরেমের মেয়েরা তাদের স্বপ্ন ও ভালবাসাকে দাবিয়ে রাখে। তারা স্বামী বা মালিকের যুবক বন্ধুকে বা কোন যুবক চাকরকে দিয়ে তাদের প্রেমের নেশা পূর্ণ করে।

 গোয়েন্দাগিরীর জন্য হেরেমের কোন মেয়ের বন্ধুত্ব তার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। এ মেয়েটিকে সে ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায় কিনা সেটাই বাজিয়ে দেখতে চাচ্ছিল সে। তাই মেয়েটা হঠাৎ আনতানুসের সামনে এসে পড়ায় মেয়েটির আবেগ নিয়ে একটু খেলে দেখলো।

 গুমাস্তগীন ছিল বিলাসপ্রিয় শাসক। নিয়মিত মদের আসর বসতো তার মহলে। হেরেমের এসব মেয়েরা সে আসর গুলজার করে তুলতো।

 মদ ও নারীর নেশায় যখন কেউ পড়ে তখন তার কথায় কোন বাঁধন থাকে না। সুতরাং গোপন তথ্য এসব মাহফিল ও আসর থেকেই জানা যায় বেশী।

 আনতানুস ও তার সঙ্গীরা আলী বিন সুফিয়ানের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। দক্ষ গোয়েন্দা বাহিনী যেন নিশ্চিন্তে ও নির্ভাবনায় দায়িত্ব পালন করতে পারে সে জন্য আলী তাদের সব প্রয়োজন পূরণ করতেন। কখনো কোন অভিযোগ করার সুযোগ দিতেন না তাদের। সুলতান আইয়ুবীও তাদেরকে প্রচুর অর্থ ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিতেন, যাতে তাদের মনে কোন কষ্ট ও অভিযোগ না থাকে।

 কোন গোয়েন্দা শত্রু এলাকায় ধরা পড়ে মারা গেলে সুলতান আইয়ুবী তার পরিবারকে এত অর্থ দান করতেন যে, তার পরিবার ভবিষ্যতে কোন অভাব অনটনের শিকার হতো না। কারো মুখাপেক্ষী হওয়ার চিন্তা থাকতো না বলে তারা মন প্রাণ ঢেলেই গোয়েন্দা কাজে সক্রিয় থাকতো এসব গোয়েন্দারা।

 আনতানুস মেয়েটির ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করলো, মেয়েটির চেহারা বলছিল, সে তার প্রেমে পড়ে গেছে। আনতানুস যখন সেখান থেকে বিদায় নিচ্ছিল, মেয়েটি তাকে চাপা গলায় বললো, ‘পেছনের দিকে একটা বাগিচা আছে, শেষ রাতের দিকে ওদিকেও একটু টহল দিও। অনাহুত কেউ প্রবেশ করতে চাইলে ওদিক দিয়েই ঢুকতে চেষ্টা করবে আগে’।

 মেয়েটির ঠোঁটে তখন অর্থপূর্ণ হাসির রেখা। আন তানুস সে হাসির অর্থ বুঝতে পেরে নিজেও হেসে ফেললো। তারপর মেয়েটির দিকে আরেকবার তাকিয়ে হাসি মুকে বেরিয়ে এলো প্রাসাদ থেকে।

 রক্ষী বাহিনীর দায়িত্ব মালিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দেহরক্ষী থেকে শুরু করে বাড়ী পাহারা দেয়াও এদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।

 সে দিনই রাতের বেলা। কেল্লার ভেতর মহলের গেটে বর্শা হাতে ফিটফাট পোশাক পড়ে দাঁড়িয়ে ছিল আনতানুস। ধোপদুরস্ত পোশাক ও চকচকে বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা আনতানুসকে দেখাচ্ছিল বীরপুরুষের মত।

 সঙ্গী গার্ড বললো, ‘তোমাকে একেবারে অফিসারের মত লাগছে’।

 রাতের শেষ প্রহর। আনতানুস সঙ্গীকে বললো, ‘তুমি থাকো, আমি একটু চারদিকটা চক্কর দিয়ে আসি’।

 সে ঘুরতে ঘুরতে বাগানে চলে এলো এবং ওখানে পায়চারী করতে লাগলো।

 বাড়ীটা ছিল রাজমহলের মত। ভেতর থেকে গান-বাজনা ও নাচের ঝংকার ভেসে আসছিল। আনতানুস আসরের মেহমানদের এরই মধ্যে দেখে নিয়েছে। আমন্ত্রিত মেহমানদের মধ্যে দু’তিনজন খৃস্টানও ছিল।

 সে বাগানে কিছুক্ষন পায়চারী করলো। একসময় পিছন দরোজা দিয়ে বেরিয়ে এলো সেই মেয়েটি। আনতানুস কে দেখতে পেয়েই দ্রুত তার কাছে এসে দাঁড়ালো।

 ‘তুমি এত রাতে কি জন্য এখানে এসেছো?’ মেয়েটি কাছে আসতেই আনতানুস তাকে জিজ্ঞেস করলো।

 ‘আর তুমিই বা কেন বাগানে ঘুরাঘুরি করছো?’ মেয়েটি পালটা প্রশ্ন করলো।

 ‘তোমার আদেশ পালনের জন্য’। আন তানুস উত্তর দিল, ‘তুমিই তো বলেছিলে, রাতের শেষ প্রহরে বাগানে টহল দিতে!’

 ‘তাই! তুমি তো দেখছি খুব দায়িত্ববান লোক!

 আনতানুস এর কোন জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘এমন করে সরগরম আনন্দময় জলসা ছেড়ে বাইরে চলে এলে যে!

 ‘সেখানে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে!’ মেয়েটি বললো, ‘শরাবের গন্ধে আমার মাথা ঘুরে যায়, বমি বমি ভাব হয়’।

 ‘তোমার মদের নেশা নেই?’

 ‘না!’ মেয়েটি বললো, ‘আমি এখানকার কোন কিছুতেই অভ্যস্থ হতে পারিনি’।

 মেয়েটি একটি পাথরের বেঞ্চের ওপর বসলো। বললো, ‘বসো, তোমার সাথে গল্প করি’।

 আনতানুস বল লো, ‘কেউ যদি দেখে ফেলে!’

 ‘যারা দেখবে তারা তো মদের নেশায় চুর হয়ে আছে’ মেয়েটি বললো, ‘পাশে বসো আর তোমার বোনের গল্প বলো,আমি শুনি’।

 আন তানুস দ্বিধাজড়িত পায়ে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলো। কথা বলতে বলতে এক সময় দ্বিধা ও ভয় কেটে গেল তার। তার কথা বলার ভঙ্গী ছিল চমৎকার। মেয়েটি ক্রমশ তার দিকে ঝুঁকে পড়তে লাগলো।

 সে বোনের কথা বলতে বলতে শেষে তার নিজের কাহিনীতে চলে এলো। মেয়েটি মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনতে লাগলো এক সুন্দর যুবকের বিচিত্র জীবন কাহিনী। তাদের মধ্যে যে সংকোচ ও জড়তা ছিল তা উড়ে গেল আনতানুসের গল্পের তোড়ে।

 এক সময় আনতানুস বল লো, ‘বেশীক্ষন এভাবে থাকা ঠিক নয় আমাদের। তাতে বিপদ হতে পারে! শেষে যদি কেল্লার মালিক তোমাকে খোঁজ করার জন্য চাকর বাকরদের পাঠিয়ে দেয়, তবে আমরা ধরা পড়ে যাবো!’

 মেয়েটি বললো, ‘ভয় নেই, আমার অনুপস্থিতির কথা কেউ তাকে বলবে না। আর তার হাতের নাগালে এত নারী, আমার অভাব সে অনুভবও করবে না!

 ‘তবু, অনেকক্ষণ হয় এসেছি। সঙ্গী প্রহরী যদি খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে!’

 ‘তাহলে বলো, কাল আবার আসবে?’

 আন তানুস ফাতেমার কাছে আগামী রাতে আবার দেখা করার অঙ্গীকার করে চলে গেল ডিউটিতে। ডিউটি মানে, গেটের পাশে দুই প্রহরীর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা।

 ডিউটিতে ফিরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটির কথাই ভাবছিল আনতানুস। ফাতেমা তাকে বলেছে, সে মদকে ঘৃণা করে। তাকে যেভাবে আনন্দ-স্ফূর্তির উপকরন বানানো হয়েছে,তাতেও তার বড় ক্ষোভ ও ঘৃণা।

 মেয়েটি হলবের বাসিন্দা। তার বাবা তার প্রভাবশালী বন্ধু গুমাস্তগীনকে খুশী করার জন্য নামকাওয়াস্তে বিবাহের অনুষ্ঠান করে তাকে তুলে দিয়েছে তার হাতে।

 ফাতেমার এ বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, বর্তমান জীবনটা তার পছন্দ নয়। সে ভালবাসা ও প্রেমের কাঙাল এক প্রস্ফুতিত গোলাপ।

 পরের রাতে সেই বাগানে আবার তাদের দেখা হলো। ফাতেমা আনতানুসের অপেক্ষায় খুবই অধীর ও পেরেশান হয়ে বসেছিল পাথরের এক বেঞ্চের ওপর। বসে বসে আনতানুস এলে তাকে কি বলবে মনে মনে তার রিহার্সাল দিচ্ছিল।

 আনতানুস এলে ফাতেমা তাকে দেখেই বললো, ‘যদি তুমি আমার রূপ ও যৌবনের আকর্ষণে মনে কোন খারাপ বাসনা নিয়ে এসে থাকো তবে তুমি ফিরে যাও! তেমন লোকের আমার কোন প্রয়োজন নেই’।

 ‘যদি তুমি কোনদিন আমার কাছ থেকে কু-মতলবের আভাসও পাও, আমার মুখে থু দিয়ে চলে যেও’। আনতানুস বললো, ‘আমি তোমাকে আমার বোনের মতই মনে করি’।

 ‘না না, আগেই তুমি আমাকে তোমার বোন বানিয়ে নিয়ো না’। ফাতেমা বললো, ‘কারণ আমি এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি, আমি তোমার বোন হবো, না অন্য কিছু’।

 ‘অন্য কিছু মানে!’

 ‘ন্যাকা সেজো না। ভালবাসার কাঙাল এক যুবতীর সাথে একজন যুবকের কি সম্পর্ক হতে পারে এটা বুঝার বয়সও এখনো হয়নি তোমার?’

 হেসে দিল আনতানুস। বললো, ‘তবে কি তুমি আমার সাথে পালিয়ে যেতে চাও?’

 ‘এটা নির্ভর করছে তোমার ওপর’। মেয়েটি বল লো, ‘সারা জীবন তো আর চোরের মত এভাবে লুকিয়ে দেখা করা সম্ভব হবে না! আর তুমিও চিরদিন এখানে ডিউটিতে থাকবে না। জানি, হয়তো দশ দিন, বিশ দিন বা এক মাস থাকবে, তারপর? তারপর চলে যাবে অন্য কোথাও।

 তুমি চলে গেলেও তোমার কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। হয়তো তোমার কথা মনে হলে অন্তরে কষ্ট পাবো। হয়তো তোমার কথা স্মরণ করে গোপনে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবো। কিন্তু আমার করার আর কিছুই থাকবে না। কারণ তোমার মনে কি আছে তা তো আর আমি জানি না!’

 এ রাতের সাক্ষাত তাদের উভয়ের জীবনে এক অক্ষয় স্মৃতি হয়ে গেল। একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেললো ওরা।

 তার পরের দিন।

 ভালবাসার জোয়ার ফাতেমাকে এতই উতলা করে তুললো যে, আবেগের বশে সে ভয়ানক এক দুঃসাহসী কাজ করে বসলো। আনতানুসের আপত্তি সত্তেও সে তাকে নিজের কামরায় নিয়ে গেল।

 গুমাস্তগীন সে রাতে বাড়ি ছিল না। তাই এ দুঃসাহসী কাজ করতে সাহস পায় ফাতেমা। এ সাক্ষাৎ উভয়ের জন্য ছিল আতংকজনক। ফাতেমা আবেগের মোহে সব কিছুই ভুলে গেল। ভুলে গেল মহলের মধ্যেও ষড়যন্ত্রের বীজ লুকিয়ে আছে। বেগম থেকে বাঁদী সকলেই একে অন্যের দোষ ত্রুটি খুঁজে বেড়ায়। বেগমরা স্বামীর কাছে, বাঁদীরা প্রভুর কাছে একে অন্যকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকে। আন তানুসের ব্যক্তিত্ব ও কথার যাদু তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। ভালবাসা ও প্রেম পিপাসার আবেগের মোহে সে এসব কথা ভুলেই গিয়েছিল।

 গভীর রাত। আনতানুস বসেছিল ফাতেমার কামরায়। কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব ছিল প্রখর। সে এমন কোন ইঙ্গিতও করলো না, যাতে ফাতেমার যৌবন বা শরীরের প্রতি সামান্য লোভ-লালসা প্রকাশ পায়। তার এই চারিত্রিক দৃঢ়তা ফাতেমাকে আরো অভিভূত করে তুললো। আপাদমস্তক পবিত্র এক ভালবাসার মানুষ হয়ে গেল আনতানুস।

 সে যখন তার কামরা থেকে বের হয়ে গেল, তখন ফাতেমার এমন অবস্থা, পারলে তখুনি সে তার সাথে বের হয়ে যায়।

 আনতানুস যখন কামরা থেকে বের হচ্ছিল, তখন অন্দর মহলের অন্য এক মেয়ে তাকে দেখে ফেলে। কিন্তু মেয়েটি এ কথা ওদের বুঝতে না দিয়ে দ্রুত নিজেকে অন্ধকারে লুকিয়ে ফেলে।

 অন্য এক রাতের ঘটনা। গুমাস্তগীন এ রাতেও মহলে অনুপস্থিত। ফাতেমা রাতের আঁধারে বাগানে চলে এলো। আনতানুস ও এসে পৌঁছলো ওখানে। এখন দু’জনের মাঝে কোন পর্দা নেই, নেই কোন বাঁধার দেয়াল।

 ফাতেমা তাকে বল লো, ‘তুমি তো আমাকে বলেছিলে, তুমি তোমার বোনের প্রতিশোধ সুলতান সালাউদ্দিনের সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য বাড়ি ছেড়ে ছিলে। তবে তুমি এই বাহিনীতে ভর্তি হলে কেন?’

 ‘কেন, এটা কি সুলতানের বাহিনী নয়?’ আনতানুস এমন ভাবে বললো, যেন সে এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। সে বললো, ‘এটাই তো মুসলিম সৈন্য বাহিনী। আর আমি তো জানি, মুসলিম সৈন্য বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী!

 ‘এ বাহিনী মুসলিম বাহিনী বটে, তবে এ বাহিনী গঠন করা হয়েছে সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য’। ফাতেমা বললো।

 ‘এ তো বড় অন্যায় কথা!’ আনতানুস অবাক হয়ে বললো, ‘কি বলছো তুমি! তবে কি আমাদের এমন বাহিনীতে থাকা উচিত, যে বাহিনী সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায়? তারা তো মুসলমানদের সর্বনাশ করবে’।

 ‘আমিও তাই মনে করি’। ফাতেমা বল লো।

 ‘আনতানুস বললো, ‘তুমি জানো না, জেরুজালেম ও আশেপাশের যেসব অঞ্চলে খৃষ্টানদের আধিপত্য আছে, সেখানকার মুসলমানরা সুলতান আইয়ুবীকে তাদের ইমাম ও নেতা মনে করে। তারা খৃষ্টানদের অত্যাচারে সদা জর্জরিত ও আতংকগ্রস্থ। তারা বিশ্বাস করে, সুলতান আইয়ুবী তাদেরকে একদিন এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেবেন।

 ওসব অঞ্চলের মসজিদের ইমামগণ বলেন, ‘এ জাতি তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে। জেহাদের কথা ভুলে গেছে তারা। সুলতান আইয়ুবীর জেহাদীমন্ত্রে উজ্জীবিত মুজাহিদরা যদি কখনো এদিকে আসে, তাহলে হয়তো নাজাত পেতে পারো। তুমিই বলো, এখন আমি কি করবো?’

 ‘তুমি এখান থেকে পালিয়ে যাও!’

 ‘কিন্তু তোমাকে রেখে আমি কি করে অন্য কোথাও পালিয়ে যাই!’

 ‘যদি তোমার সাহস থাকে তবে তুমি আমাকেও সঙ্গে নাও’।

 ‘কিন্তু কোথায় যাবো?’

 ‘ফাতেমা বললো, ‘আমি তোমাকে সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবো। তোমাকে আর এই সেনা বাহিনীতে থাকতে হবে না’।

 ‘তুমি কি জন্য তোমার স্বামীর কাছ থেকে পালাতে চাও? সে তোমাকে দাসী বানিয়ে রেখেছে এ জন্য, নাকি সে বুড়ো বলে?’

 ‘আমি এ ব্যক্তিকে ঘৃণা করি’। ফাতেমা উত্তর দিল, কেন ঘৃণা করি সে কারণ তো তুমি নিজেই বলে দিয়েছো! সে আমাকে দাসীর মত মহলের চার দেয়ালে বন্দী করে রেখেছে, সে বৃদ্ধও বটে। কিন্তু সবচে বেশী ঘৃণার কারণ, সে আমার প্রাণপ্রিয় নেতা সুলতা্ন সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরোধী। মুসলমান হয়েও সে খৃষ্টানদের বন্ধু। যখন দেখি মুসলমানদের স্বার্থের চাইতে খৃষ্টানদের স্বার্থ তার কাছে বড়, তাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করে আমার।

 এ মহলে বউ হয়ে আসার আগে আমার মনে একটি আকাংখা ছিল। আমার মনে হতো, আমি নুরুদ্দিন জঙ্গীর কাছে গিয়ে বলি, আমাকে আপনার সামরিক বাহিনীতে নিয়ে নিন। আমি খৃষ্টান ও তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করতে চাই।

 সুলতান সালাউদ্দিনের নাম আমি আগেও শুনেছি। তীর নিক্ষেপে আমি যথেষ্ট পটু। নিশানা ঠিক করতে এক সময় বহু প্রাকটিস করেছি। কিন্তু আমার সব আশা ও স্বপ্ন এ হতভাগার মহলে এসে নিঃশেষ হয়ে গেছে।

 যখন আমি এ মহলে আসি, মনে মনে একটু গর্ব ছিল, আমি এক যোদ্ধার স্ত্রী হয়ে এসেছি। যে যোদ্ধা দেশ, জাতি ও দ্বীনের খেদমতে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। কিন্তু সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর একমাত্র হিতৈষী সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্ততি নিচ্ছে’।

 ‘তিনি আসলেই সুলতান আইয়ুবীর বিপক্ষে কি না, সে খবর তুমি সঠিক জানো?’ আনতানুস জিজ্ঞেস করলো।

 ‘হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই’। ফাতেমা বললো, ‘কিন্তু এ লোক বড় গভীর জলের মাছ!খলিফা আল মালেকুস সালেহের সাথেও তার বন্ধুত্ব, আবার তার বিরোধী ওমরাদের সাথেও তার ঘনিষ্ঠটা রয়েছে। এরা সবাই সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। গুমাস্তগীন তাদের আশ্বাস দিয়ে রেখেছে, যুদ্ধের সময় সে তাদের সৈন্য দিয়ে সাহায্য করবে। আবার খৃষ্টানদের সাথেও সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য গোপনে চুক্তি করে রেখেছে। তার আশা, আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সম্মিলিত অভিযানের সময় সে বহু স্থান দখল করে নিতে পারবে। একদিন সে হারান ও বিজিত অঞ্চলের বাদশা হওয়ার স্বপ্ন দেখে’।

 ‘এ নিয়ে তিনি কি কখনো তোমার সাথে আলোচনা করেছেন?’

 ‘হ্যাঁ! সে জানে আমি সুলতান আইয়ুবীর ভক্ত ’।ফাতেমা বল লো, ‘সুযোগ পেলেই সে সুলতান আইয়ুবীর বিরদ্ধে আমাকে কথা শোনাতো। কিন্তু আমি তাতেও সুলতানের ব্যাপারে আমার মনোভাব পাল্টাইনি দেখে রাগ করে সে আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিল। তাতেও কাজ না হওয়ায় সে আমাকে মারপিটও করেছে।

 এ নিয়ে একদিন তার সাথে আমার তুমুল ঝগড়া হয়। শেষ পর্যন্ত সে রাগ করে এ পর্যন্ত বলেছে, ‘আইয়ুবী কি তোকে জাদু করেছে? আমার এখানে থাকতে হলে সুলতানের নাম কোনদিন মুখেও আনতে পারবি না’।

 এ ঘটনার পর কয়েকদিন আমাদের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ ছিল। হঠাৎ এক রাতে সে আমার কামরায় এলো। আমার মন গলানোর জন্য মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে লাগলো। শেষে বললো, ‘আরে শরিয়তের হুকুম হচ্ছে, এক মুসলমানের সাথে আরেক মুসলমানের তিন দিনের বেশি কথা বন্ধ রাখতে নেই। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া তো মামুলি ব্যাপার। স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া না হলে মোহাব্বত বাড়ে না’।

 তবু আমি চুপ করে রইলাম। সে বললো, ‘ শোন, তুমি যদি আমাকে অপছন্দ করো এবং আমার কাছ থেকে মুক্তি চাও, রাগ না করে থেকে আমাকে খোলাখুলি বলো। আমি এতটা নিষ্ঠুর নই যে তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাকে আমি এই মহলের মধ্যে বন্দী করে রাখবো’।

 তার এ কথায় আমি তো অবাক! বলে কি লোকটা! ভুতের মুখে রাম নাম! বললাম, ‘দেখো, মারতে চাও আরো মারো, কিন্তু এ ধরনের নিষ্ঠুর ঠাট্টা করো না’।

 ‘আমাকে বিশ্বাস করছো না! খোদার কসম, আমি তোমার সাথে কোন ইয়ার্কি করছি না। চাও তো কোরআন ছুঁয়ে শপথ করতে পারি। তুমি যদি চাও তোমার পছন্দের ছেলের কাছে আমি নিজ হাতে তোমাকে তুলে দেবো। সারা জীবন শুয়ে বসে কাটাতে পারো এমন সম্পদ সে বিয়েতে তোমাদের আমি উপহার দেবো’।

 ‘কিন্তু কেন? কিসের বিনিময়ে এত বড় উদারতা দেখাতে চাও?’

 ‘তুমি আমার ছোট্ট একটা উপকার করে দেবে এটুকু ওয়াদা শুধু চাই’।

 ‘কি উপকার? আমার মত সামান্য এক নারী তোমার মত ক্ষমতাধরের এমন কি উপকার করতে পারবো, যার বিনিময়ে তুমি এতো ত্যাগ স্বীকারের ওয়াদা করছো!’

 ‘পারবে, পারবে, তুমিই পারবে। তুমি তো জানো না, তুমি কি অসামান্য সুন্দরী! তোমার মত ষোড়শী রুপসীদের পক্ষেই এ কাজ করা সম্ভব’।

 অবাক হয়ে বললাম, ‘কি কাজ?’

 ‘তোমাকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে পাঠাবো। ওখানে তুমি সুলতানের বড় বড় সেনাপতিদেরকে তোমার রূপ দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে নিয়ে যাবে। যাদের পারো তাদেরকে আমার পক্ষে নিয়ে আসবে’।

 সে আরো বললো, ‘তোমার সাথে তোমার মতই আরো দু’জন খৃষ্টান মেয়ে থাকবে। তারা খুবই চালাক ও সতর্ক। তোমরা তিনজনে যদি চেষ্টা করো, মানুষ কেন, পাথরকেও গলাতে পারবে তোমরা’।

 সে আমাকে কি করে কি করতে হবে সব বলতে লাগলো। বললো, ‘সেখানে গিয়ে গোয়েন্দাদের মত কাজ করতে হবে তোমাদের। যদি তোমরা এই কাজ করে আসতে পারো, তবে এমন সীমাহীন সম্পদ পাবে, যা কোনদিন তুমি কল্পনাও করোনি। আর তোমাকে মুক্ত করে দিয়ে তোমার পছন্দসই যুবকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবো’।

 কিন্তু আমি তার কোন শর্তই মানিনি’।

 ‘তুমি মেনে নিলেই পারতে!’ আনতানুস বললো, ‘তাহলে আমরা নির্বিঘ্নে এখান থেকে বের হয়ে সুলতান আইয়ুবীর কাছে চলে যেতে পারতাম’।

 ‘এই শয়তানটা ও তার খৃষ্টান বন্ধুরা এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে, শত্রু এলাকায় গিয়ে যদি কোন মেয়ে গাদ্দারী করে তবে তাকে সেখানেই হত্যা করে ফেলবে। তাদের সাথে গুপ্তঘাতক ফেদাইন দলের যোগাযোগ রয়েছে। তার কথা শুনে আমার অন্তরাত্মা খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড়’।

 ফাতেমা আরো বললো, ‘একবার মনে করেছিলাম, তার প্রস্তাব মেনে নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলালো না’।

 ফাতেমা আরো বললো, ‘তখনও তোমার সাথে আমার পরিচয় হয়নি। হলে হয়তো অন্য রকম সিদ্ধান্ত নিতাম। বিশ্বাস করো, তোমাকে পেয়ে আমার প্রানে নতুন করে সাহস ফিরে এসেছে, বুকে বল এসেছে। আমি তোমার অনুগ্রহ জীবনেও ভুলতে পারবো না। তুমি আমাকে তোমার মনের মধ্যে স্থান দিয়েছো, সেইটেই যথেষ্ট। চলো, আমরা এখান থেকে পালিয়ে যাই’।

 ‘পালিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। তুমি এখানে, এ কেল্লাতে থেকেই খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে এবং সুলতান আইয়ুবীর পক্ষে কাজ করতে পারবে’।

 ফাতেমা অবাক হয়ে বললো, ‘কি কাজ? কেমন করে?’

 ‘যে কাজ তোমার মালিক গুমাস্তগীন সুলতান আইয়ুবীর অঞ্চলে গিয়ে করতে বলেছিল, এখানেও আমরা সেই কাজ করবো, তবে তার পক্ষে নয়, বিপক্ষে। সুলতান আইয়ুবীরও নিশ্চয়ই গোয়েন্দার প্রয়োজন আছে। এখানে থেকেই তাঁকে এখানকার গোপন তথ্য জানিয়ে সাহায্য করতে পারি আমরা’।

 ‘তুমি কেমন করে জানলে, সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দার প্রয়োজন আছে এবং আমরা তার কাজে লাগতে পারবো?’ ফাতেমা বললো।

 ‘কারণ আমি নিজেই সুলতান আইয়ুবীর পাঠানো এক গোয়েন্দা!’

 আনতানুসের এ বাক্যটি শুনে ফাতেমা এমন চমকে উঠলো, সহসা পথ আগলে তার বুকে কেউ খঞ্জর বসিয়ে দিলেও এতটা চমকাতো কিনা সন্দেহ।

 ‘কেন? তুমি এত অবাক হচ্ছো কেন? সত্যি বলছি, আমি জেরুজালেম থেকে নয়, কায়রো থেকে এসেছি। আমার কোন বোনকে কেউ অপহরণ করেনি। গুমাস্তগীনের আস্থাভাজন হওয়ার জন্যই এ রকম গল্প ফাঁদতে হয়েছে আমাকে’।

 ‘তুমি যেখানে এতবড় মিথ্যা বলতে পারো, সেখানে তোমার অঙ্গীকার ও ভালবাসা সবই মিথ্যা হতে পারে’। ফাতেমা বললো, ‘ তোমাকে আর কেমন করে বিশ্বাস করতে পারি’।

 ‘একমাত্র ভালবাসার খাতিরেই আমি তোমাকে আমার গোপন পরিচয় জানিয়েছি’। আনতানুস বললো, ‘বলতে পারো, আমি আমার জীবন তোমার পায়ের তলায় সমর্পণ করে দিয়েছি। তুমি ইচ্ছে করলে আমার ভালবাসা অস্বীকার করে তোমার স্বামীর কাছে আমার আসল পরিচয় ফাঁস করে দিয়ে আমাকে হত্যা করতে পারো।

 তবে একটা কথা মনে রেখো, কোন গোয়েন্দাই তার পরিচয় অন্যকে জানায় না। কেবল তোমাকে প্রতারনা করতে পারবো না বলেই তোমার কাছে আমার সত্যিকারের পরিচয় প্রকাশ করেছি। আমার আবেগ ও ভালবাসাই আমাকে এ কথা বলতে বাধ্য করেছে। তাই আমি নির্ভয়ে বলে দিয়েছি।

 তোমার প্রতি ভালবাসার আরো প্রমাণ তখনি দেবো, যখন আমি এখানকার কাজ সমাধা করে ফিরে যাবো। সেদিন এখান থেকে আমি একাই যাবো না, তুমিও থাকবে আমার সাথে।

 কিন্তু একটা কথা তোমাকে পরিষ্কার করে বলতে চাই, যদি আমার ভালবাসা ও আমার দায়িত্বের মাঝে কখনো সংঘাত বাঁধে, যদি ভালবাসা ও দায়িত্ব একে অন্যের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, তবে আমি ভালবাসা কোরবানী দিয়ে আল্লাহ্‌র দ্বীনের স্বার্থে আমার দায়িত্ব পালনে অটল থাকবো। তোমাকে ধোঁকা দেবো না, আমার আসল পরিচয় গোপন রেখে তোমার ভালবাসা নেয়ার অন্যায় থেকে বাঁচার জন্যই তোমাকে এতগুলো কথা বললাম।

 তুমি হয়তো জানো না, দায়িত্ব পালনের জন্য গোয়েন্দাদের কাছ থেকে কেমন কঠিন ওয়াদা ও কোরবানী নেয়া হয়। সৈনিকরা যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হয়ে যায়, সাথীরা তার লাশ সসম্মানে দাফন করে। কিন্তু গোয়েন্দারা মারা যায় না, তারা ধরা পড়ে শত্রুদের হাতে।

 শত্রুরা তাকে বন্দী করে নিয়ে যায়। তার কাছ থেকে কথা আদায় করার জন্য এমন সব শাস্তি দেয়, যে কথা শুনলে তুমি অজ্ঞান হয়ে যাবে। সেখানে সে মারা গেলেও পৃথিবীর কেউ তার দায়িত্ব নেয় না। কেউ এগিয়ে আসেন তার লাশটা দাফন পর্যন্ত করতে।

 গোয়েন্দাদের জীবন বড়ই ঝুঁকিপূর্ণ জীবন। ঈমানের বলিষ্ঠতাই ওদের সম্পদ। সে ঈমান নিয়েই আমি এখানে এসেছি। তোমার সঙ্গে ভালবাসা করেছি, কিন্তু দায়িত্বের ব্যাপারে আমি ইস্পাতের মত কঠিন থাকবো। কখনো অবিশ্বাসীর মত কাজ করবো না’।

 ফাতেমা তন্ময় হয়ে শুনছিল তার কথা। আবেগে থরথর করে কাঁপছিল আনতানুসের হাত। ফাতেমা তার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে চুমু খেলো। মুখে বললো, ‘তুমিও আমাকে অনুরুপ সুদৃঢ় পাবে। এখন বলো কি করবো?’

 আনতানুস তাকে কি করতে হবে সবকিছু বুঝিয়ে বললো।বললো, ‘গান বাজনার আসরে এখন থেকে আর অনুপস্থিত থাকা যাবে না। বিশেষ করে যে মাহফিলে খৃষ্টানরা থাকে সেসব মাহফিলে সারাক্ষণ তোমাকে উপস্থিত থাকতে হবে।

 যদি এ জন্য দু’ঢোক মদও পান করতে হয়, মেহমানের সন্তুষ্টির জন্য তাও করতে হবে। তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশায় সংকোচ বোধ করবে না। তাদের সব কথা মনোযোগ সহকারে শুনবে।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 4 | 5 | 6 | 7 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top