১১. চারদিকে চক্রান্ত


“হ্যাঁ, তাই। সাহস ও নিষ্ঠা ছাড়া কেউ সৈনিক হতে পারে না ।’
এভাবেই চলছিল তাদের খোশালাপ । তারা এমন কোন কথা বললো না, যাতে তাদের নিয়ে সৈনিকদের মনে কোনরকম সন্দেহ জাগতে পারে।
ততক্ষণে সেই মেয়েরা কাপড় পরে চুল আচড়ে সেজোগুজে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু তারা একটু লজ্জিত ও সংকোচ ভরা মনে সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল।
এ বিরাণ মরুভূমিতে দীর্ঘ দুই আড়াই বছর পর বাইরের কোন কাফেলা দেখলো সৈনিকরা । যে কাফেলায় আছে ভরা যৌবনের যুবতী চার মেয়ে। তাদের লাবন্যময় চেহারার ছবি বুকে সেঁটে রইল তাদের। ইচ্ছে করছিল না, এদের সঙ্গ ছেড়ে এখনি এখান থেকে চলে যায়।
ওরা আপন পরিচিত নারীর সাথে এই মেয়েদের বিভিন্ন রূপ কল্পনা করে মিলিয়ে নিতে চাইলো। এরা এমন নারী, যাদেরকে মা হিসাবে কল্পনা করা যায় না। বোন বা স্ত্রী হিসাবেও নয় । কন্যা তো নয়ই।
দু’জনেই কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। মেয়েরা নতুন দু’জন পুরুষ মানুষ দেখে একটু লজ্জাবোধ করছিল এবং আড় চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে মুখ লুকিয়ে হাসছিল। তাদের লাজুক লাজুক ভাব ও আড়াল হওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, এরা কোন অভিজাত বংশের আদুরে কন্যা।
কাফেলার লোকদের আন্তরিক ব্যবহার ও প্রশংসা শুনে এ দুই সীমান্ত প্রহরী বিগলিত হয়ে গেল। লজাবতী মেয়েদের লাবন্যময় রূপ ও যৌবনের আকর্ষণ তাদের মনে সৃষ্টি করল মোহগ্ৰস্ত মুগ্ধতা। ডিউটির কথা ভুলে গিয়ে ওরা ওখানেই পড়ে রইল।
কাফেলার একজন বললো, “আমরা এখানে থাকবো কি থাকবাে না, এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। অচেনা জায়গা, সঙ্গে মেয়েরা, বিপদাপদের কথা তো বলা যায় না!” লোকটি বললো, “আপনাদের দেখে মনে সাহস এলো।”
‘আরে না না, এ এলাকায় ভয়ের কোন কৃারণ নেই। এখানকার শান্তি শৃংখলার পরিস্থিতি যথেষ্ট ভাল।”
“এটা আপনাদের সততা, যোগ্যতা ও নৈপুণ্যের ফল। আরে, রাজা ভাল তো দেশ ভাল। আপনারা আছেন বলেই দেশের মানুষ একটু শান্তিতে ঘুমোতে পারছে, নির্বিয়ে পথ চলতে পারছে।”
“আমন করে বলবেন না, এটা তো আমাদের দায়িত্ব।”
“দায়িত্ব থাকলেই ক’জন আর এমন নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে!” লোকটি বললো, “আপনাদের যদি অসুবিধা না হয়। আমাদের আতিথ্য গ্ৰহণ করুন, আমরা খুবই খুশী হবো।”
দীর্ঘ দিন যাবত নিরানন্দ জীবন কাটাতে কাটাতে হাঁপিয়ে উঠেছিল ওরা। এ আমন্ত্রণ ওদের কাছে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতই মনে হলো। দু’জনেই রাজি হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে ।
কাফেলার এক লোক ছিপ নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে গেল। আরো দু’তিনজন সঙ্গী হলো ওর। বড়শীতে টোপ গেথে পানির ওপর মাছের খাদ্য ছিটিয়ে দিল লোকটি। মাছেরা ভীড় করলো এসে সেখানে। লোকটি ছিপ ফেললো সে টোপের ভেতর ।
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে বাকীরা দেখছিল তার কাজ।
মাছ বড়শীর টোপ গিললো, আটকে গেল বড়শীতে, সঙ্গে সঙ্গে লোকটি বড়শী টেনে মাছটি ডাঙ্গায় তুলে ফেললো। যারা তামাশা দেখছিল তারা ছুটে গিয়ে ধরে ফেলল মাছটি। এভাবে সে একটার পর একটা অনেকগুলো মাছ ধরে ফেললো ।
এক লোক মেয়েদের ডেকে বললো, “এই, মাছ নিয়ে যাও, ভাল মত তেল মশলা দিয়ে আগুনে ভেজে নাও, দেখবে খেতে দারুণ লাগবে ।”
চারজন মেয়েই আনন্দে ছুটে গেল। সেখানে। মাছ এনে কেউ কুটে ধুয়ে পরিষ্কার করলো, কেউ মশলা পিষলো, কেউ বা উনুন জ্বলিয়ে রান্না শুরু করলো। সিপাইদের জীবনে এমন আনন্দময় পিকনিক উপভোগ করার সুযোগ কোন দিন হয়নি।
অশ্বারোহী সৈনিকরা ফাঁড়িতে যে একঘেয়ে জীবন কাটাচ্ছিল, সে জীবনে ক্ষণিকের জন্য হলেও নেমে এলো আনন্দের জোয়ার।
যদিও তাদের খাবার দাবার যথেষ্ট উন্নত ছিল তবু প্রতিদিনের রুটিন বাধা খাবারে কোন বৈচিত্ৰ্য ছিল না। নীল নদের পাড়ে বাগানের ফুল্ল হাওয়ায় বসে নদীর তাজা মাছ ভেজে খাওয়ার স্বাদ আলাদা ।
মাছ ভাজছে মেয়েরা, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে মাছ ভাজার সুস্বাদুঘাণ। জিভে পানি এসে গেল সৈনিক দু’জনের।
সবাই মিলে খেতে বসলো, চমৎকার রান্না হয়েছে। পুরুষরা খাচ্ছে, মেয়েরা পরিবেশন করছে। এক সৈনিক খুব তারিফ করলো রান্নার। পরিবেশনকারী মেয়েটি লজ্জিতভাবে প্রশংসাটুকু উপভোগ করলো।
পুরুষদের আহারের পর খেতে বসলো মেয়েরা। পুরুষরা ঘাসের ওপর বিছানা পেতে আরাম করতে লাগলো।
মেয়েরা খাচ্ছে, আড় চোখে তাকিয়ে দেখছে ওদের। যখনি চোখে চোখ পড়ে লাজুক চোখ দুটো লজ্জায় নামিয়ে নেয়। এই লুকোচুরি ও লজ্জার সৌন্দর্যই আলাদা। এর আকর্ষণ এমন সুতীব্ৰ যে, বার বার এ ফাঁদে পড়তে চায় ব্যাকুল মন। মেয়েদের খাওয়া হয়ে গেলো। সৈন্যরা কাফেলার দু’তিনজন পুরুষের সাথে এক বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় গল্প করছিল, হঠাৎ এক সৈনিকের দৃষ্টি গেল তাদের ঘোড়ার দিকে।
এক যুবতী তার ঘোড়ার গর্দান ও কেশরে আদর করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হাত দিয়ে জীন নাড়াচাড়া করছে আর গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে ঘোড়াটিকে ।
ঘোড়ার মালিক সৈনিকটি মেয়েটির কার্যকলাপ আগ্রহের সাথে লক্ষ্য করছিল। মেয়েটি ঘোড়ার গায়ে ও গর্দানে আদর করে চোখাচোখি হয়ে গেল ওর সাথে । ওর চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি একটু হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
ঘোড়ার মালিক তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছে না। এমন সুন্দরী মেয়ে জীবনে আর কখনও দেখেনি সে। মেয়েটির প্রতি ক্ৰমেই সে দুর্বল হতে লাগলো ।
বয়ষ্ক এক লোক বসেছিল সৈন্যদের পাশে। বললো, “এই মেয়েদের ঘোড়ায় চড়ার খুব শখ। ঐ যে দেখছো মেয়েটা ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, সবচে বেশী আগ্রহ ওর। তুমি কি ওদের এ আকাঙ্খাটুকু পূরণ করবে?”
‘খুশীর সাথেই আমি ওদের এ সখ পূরণ করবো।” সিপাইটি বললো । সে উঠে তার ঘোড়ার কাছে গেল। মেয়েটি সংকোচে সরে গিয়ে একটু দূরে দাঁড়াল।
‘লজ্জা কিসের, এসো! আমি তোমাদের প্রত্যেকেরই সখী পূরণ করে দেবো। এসো ঘোড়ার পিঠে তুলে দেই।” সিপাহী বললো ।
বুড়ো বললো, ‘আরে, এদের দেখে লজ্জা পাচ্ছে কেন? এরা আমাদের গর্ব ও অহংকার। দেশের অতন্দ্র প্রহরী। তোমাদের ইজত ও সম্মানের রক্ষক। এরা না থাকলে তো তোমাদের ইজ্জত-সম্মান খৃস্টান ও সুদানীরা কবেই শেষ করে দিতো!’
মেয়েটি সংকোচ মাখা পায়ে ঘোড়ার কাছে এগিয়ে গেল। সিপাহী তার পা রেকাবে উঠিয়ে দিয়ে বললো, “হ্যাঁ, এখানে পা রেখে উঠে পড়ো।”
সে মেয়েটিকে উচু করে ধরে তাকে ঘোড়ায় উঠে বসতে সাহায্য করলো।
এ সময় ক্যাম্পের দিক থেকে তার বন্ধু ডেকে বললো, “এই, কি করছো?”
সে ওদিকে তাকাতেই সহসা ঘোড়া ছুটতে শুরু করলো। মেয়েটি চিৎকার জুড়ে দিলো। সিপাইটি ফিরে দেখলো, ঘোড়া পূর্ণ বেগে চলতে শুরু করেছে।
ঘোড়ার ওপর মেয়েটি এদিক-ওদিক দোল খাচ্ছে। প্ৰাণপণ চেষ্টা করছে টিকে থাকার।
সবাই ছুটে এলো। মেয়েটি চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘ঘোড়ায় লাগাম নেই। আমি পড়ে যাচ্ছি। বাঁচাও আমাকে ৷” সৈনিকের পাশেই তার সাখীর ঘোড়া দাঁড়ানো ছিল, সে দ্রুত লাফিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলো এবং জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল ।
মেয়েটির লাগামহীন ঘোড়া তীর বেগে ছুটছে। মেয়েটি ঘোড়ার পিঠে শুয়ে পড়ে খামছে ধরেছে তার পিঠ। চােখের পলকে মেয়েটিকে নিয়ে সামনের পাহাড়ী টিলার ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল ঘোড়া।
সিপাহী তার ঘোড়ার গতি সর্বোচ্চ সীমায় নিয়ে গেল। তার ভয় হলো, মেয়েটি হয়ত ঘোড়ার পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়ে যাবে। সে কল্পনার চোখে দেখতে পেল, মেয়েটি গড়িয়ে পড়েছে ঘোড়া থেকে। তার পা আটকে আছে রেকবে । সেই অবস্থাতেই তাকে টেনে নিয়ে ছুটছে ঘোড়া।
হয়তো এরই মধ্যে তার পায়ের হাড় ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে গেছে, পাথরে বাড়ি খেতে খেতে মাথা থেতলে গেছে।
ও আর কিছু ভাবতে পারছিল না। ঘোড়া নিয়ে সে টিলা অতিক্রম করলো। লোকজনের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল মেয়ে এবং সৈনিক উভয়েই। লোকগুলো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
সামনে উন্মক্ত মাঠ। সৈনিক দেখতে পেল, এখনো ঘোড়ার পিঠ আকড়ে আছে মেয়েটি। দেহে প্ৰাণ ফিরে এলো তার। আরোহীকে নিয়ে প্রাণপণ ছুটছে ঘোড়া।
আরও কিছু দূর গিয়ে ঘোড়া মোড় ঘুরে আরেক টিলার আড়ালে চলে গেল। আবার চোখের আড়াল হয়ে গেল ঘোড়া।
সৈনিকের কানে তখনও মেয়েটির চিৎকার ও ঘোড়ার পদধ্বনি ভেসে আসছে।
সিপাহীও সামনে গিয়ে মোড় নিল, কিন্তু অবাক কাণ্ড, কোথাও ঘোড়ার অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, মেয়েটির কোন চিৎকার ধ্বনিও শোনা যাচ্ছে না আর ।
মেয়েটির চিৎকার এবং অশ্বপদধ্বনি শুনতে না পেয়ে সিপাহী ভাবলো, ঘোড়া হয়ত কোন আরোহীসহ কোন গিরিখাদে পড়ে গেছে।
সে ঘোড়ার গতি সামান্য কমিয়ে এগিয়ে গেল। আরেকটু এগুতেই সহসা পাহাড়ের আড়াল থেকে শোনা গেল মেয়েটির ডাক, ‘এদিকে এসো, জলদি আমার কাছে এসো।”
যুবক সৈনিক আওয়াজ লক্ষ্য করে যখন তার দিকে তাকালো রাজ্যের বিস্ময় এসে জমা হলো তার চোখে । সে দেখলো, শান্তভাবে দাড়িয়ে আছে ঘোড়া। তার পিঠে ততোধিক শান্ত মনে হাসি মুখে বসে আছে মেয়েটি। সম্পূর্ণ অক্ষত।
তার চেহারায় কোন ভয় ও আতংকের লেশমাত্রও নেই। বরং সে মুখে লেগে আছে মোহিনী হাসির আভা। যুদ্ধজয়ী বীরের মত উদ্ভাসিত সে হাসি।
সিপাহী একবার ভাবলো, ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যাই। এ কোন মানুষ নয়, নিশ্চয়ই কোন পরী কিংবা প্ৰেতাত্মা হবে। তাকে ধোঁকা দিয়ে নির্জন গোপন প্ৰান্তরে নিয়ে এসেছে। এখন সে আমার রক্ত পান করবে ।
কিন্তু মেয়েটির সৌন্দর্যের সুষমা তাকে পাগল করে দিল। তার মিষ্টি হাসির সম্মোহনী শক্তি যেন সৈনিকটির ঘোড়াকে টেনে নিয়ে গেল তার কাছে। ভয়ে যুবকের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল ।
যুবক সৈনিক তার কাছাকাছি পৌঁছতেই খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটি। ‘তুমি না পুরুষ। আইয়ুবীর সেনাবাহিনীর চৌকস এক যোদ্ধা! তবে তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছে কেন? আমি তো এক নারী ছাড়া আর কিছু নাই!’
মেয়েটি তার পাশে গিয়ে তার হাত তুলে নিল নিজের হাতে। বললো, “ঘোড়াটি আসলে লাগামহীন ছিল না, আমিই ঘোড়াকে তাড়া করে চিৎকার দিয়ে বলছিলাম, আমার ঘোড়া লাগামহীন হয়ে গেছে, আমি পড়ে যাব, মরে যাব। আমি জানতাম, তুমি আমার পেছনে ছুটে আসবে। তোমার চেহারাই বলছিল তুমি আমাকে চাও।”
সৈনিক কোন কথা বলল না, অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। মেয়েটিই আবার বললো, “আমি আনাড়ী সওয়ারী নই। নিজেই তো দেখলে অশ্ব চালনায় কতটা পটু আমি।”
“তবে তুমি আমাকে ধোঁকা দিলে কেন?” সিপাহী জিজ্ঞেস করলো ।
মেয়েটি পালটা প্রশ্ন করল, ‘তুমি কেন তোমার চোখে নেশার আগুন নিয়ে তাকালে আমার দিকে! তোমার চাহিনীর তীর দিয়ে কেন আমাকে আহত করলে?’
এ প্রশ্নের কোন জবাব ছিল না সৈনিকের মুখে । মেয়েটিই আবার মুখ খুললো, “তোমার চাহিনীর তীরবিদ্ধ হয়ে যখন আমি তোমার দিকে তাকালাম, তখন আমার মনেও নেশার ঘোর লেগে গেল। তোমার মত সুঠামদেহী সুন্দর যুবককে দেখে হৃদয় আমার ওলট-পালট হয়ে গেল । আমি তো এসব কথা সবার সামনে বলতে পারি না, তাই মনের কথা বলার জন্য তোমাকে একটু নিরালায় নিয়ে এলাম।”
সৈনিক এতক্ষণে একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করলো, “আশ্চর্য!”
মেয়েটি বললো, “তুমি যে বুড়োর সাথে কথা বলছিলে, সে বৃদ্ধই আমার স্বামী। এখন তুমিই একটু বিবেচনা করো, আমার স্বামীর বয়স আর আমার যৌবনটা কি মিলমিশ খাওয়ার মতো?
আমার সঙ্গে যে মেয়েগুলো আছে তাদের মধ্যেও আরো একজনের অবস্থা আমার মতই। সেও এক বৃদ্ধের স্ত্রী হয়ে জীবন কাটাচ্ছে।
মেয়েদের দুর্ভাগ্য, তারা তাদের পছন্দমত পুরুষ বেছে নিতে পারে না। যার সঙ্গে তোমরা মেয়েদের বেঁধে দাও, তার সঙ্গেই তার সারাটা জীবন কাটাতে হয়। একটু প্ৰতিবাদ করারও সুযোগ নেই। আমাদের।
এই বুড়ো আমাকে খুশী করার জন্য সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু নারীর সুখ কোথায় তা এই বুড়ো বুঝবে কি করে?”
সিপাহীর ভয় কিছুটা দূর হলো। মুখ দিয়ে কথা বেরোলো তার, আর বাকী মেয়ে দুটাে?”
‘ওরাও বিবাহিত, কেউ কুমারী নেই।’ মেয়েটি উত্তরে বললো, “তারা যুবক স্বামীকে সাথে নিয়ে ভ্রমণের আশায় আমাদের সঙ্গ নিয়েছে।”
‘এখন তুমি কি করতে চাও?’
“আমি বাঁচতে চাই। যে যৌবন আল্লাহ আমাকে উপভোগ করার জন্য দিয়েছেন, তা এভাবে বিনষ্ট করতে চাই না আমি । আমাকে বাঁচাও তুমি।”
“যদি তোমাকে ওরা চুরি করে বা ছিনতাই করে নিয়ে আসতো তবে আমি ওদেরকে আমাদের ফাঁড়িতে নিয়ে যেতে পারতাম। ওদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারতাম তোমাকে।” সিপাহী বললো, “কিন্তু তুমি একজনের বিবাহিতা স্ত্রী।’
“আমি ঐ বুড়োকে স্বামী বলে মানিনা। বুড়ো আমাকে জোর করে আমার অমতে বিয়ে করেছে। মেয়েটি বললো, ‘আমি তাকে ঘূণা করি। যখন তোমাকে দেখলাম, তখন আমার ঘূণা আরও বেড়ে গেল।”
সে আবেগময় স্বরে বলতে লাগলো, “তোমাকে প্রথম দেখেই আমার মনে হলো, এই তো তোমার জীবন সাখী! আল্লাহ তোমাকে এই সুন্দর যুবকের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।”
দেখো, তুমি যেমন বলছো, তেমন সুন্দর আমি নই।” সিপাহী বললো, “কেন মিথ্যে আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে? তোমার আসল উদেশ্য কি বলো তো?”
“একমাত্র আল্লাহই জানেন, আমার অন্তরে কি ঝড় বইছে!” মেয়েটি বললো, ‘যদি তুমি আমার ভালবাসাকে প্রত্যাখ্যান করো, তবে আমার জীবন সম্পর্কে আমাকে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মনে রেখো, আমি আর আমার স্বামীর কাছে ফিরে যাবো না। তুমি আমাকে নিরাশ করলে আমি সোজা নদীর দিকে ঘোড়া ছুটাবো। এই অশ্বসহ আমি ঝাঁপিয়ে পড়বো নদীতে। পরে আল্লাহর কাছে গিয়ে বলবো, এই যুবক আমার হত্যাকারী।”
এ সৈনিক সালাহউদ্দিন আইয়ুবী নয়, আলী বিন সুফিয়ান বা তকিউদ্দিনও নয়। সে এক সাধারণ সৈনিক!! তার পেশীবহুল শরীরে যৌবনের জোয়ার, কিন্তু মরুভুমির হাহাকার ছাড়া এ জীবন আর কিছুই পায়নি। না একটু আনন্দ, না একটু সুখ। তার এ নিরানন্দ জীবনে অপ্রত্যাশিত আনন্দ যদি এসেই যায়, সে তা পায়ে ঠেলবে কিসের জোরে? কোথেকে পাবে সেই মনোবল আর শক্তি?
মেয়েটির অসহ্য যৌবন, লাবন্যময় সৌন্দৰ্য সুষমা এবং আবেগদীপ্ত কথা তাকে একেবারে বশীভুত করে ফেললো। সে বললো, “দেখো, আমি এক সাধারণ সিপাই আর তুমি শাহজাদীর মত অনন্যা। মখমলের বিছানা ছেড়ে আমার সঙ্গে এই বালির বিছানায় তুমি কেমন করে বাঁচবো?”
“মখমলের বিছানা আর ধন-সম্পদ কখনো কোন নারীর কষ্ট দূর করতে পারে না। যদি তাই হতো। তবে আমার স্বামীর চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি আর কেউ হতে পারতো না । তিনি আমার পদতলে তার সমস্ত ধন-সম্পদ ঢেলে দিয়েছেন। কিন্তু আমি যে অসহ্য যৌবন যন্ত্রণা ভোগ করছি, সম্পদ দিয়ে কি এ যন্ত্রণার উপশম হবে? বালি দিয়ে নদীর জোয়ার আটকানো যায়, কিন্তু সম্পদ দিয়ে যৌবন জোয়ার বাঁধা যায় না।
জীবনভর স্বপ্ন দেখেছি কোন সৈনিকের ঘরণী হওয়ার। আমার বাবা সৈনিক, বড় দুই ভাইও । তারা দামেশকে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছেন।
আমাকে এই বৃদ্ধের হাতে তুলে দিয়েছে আমার মা। হরিণের দুশমন তার নরম গোশত, আর গরীব ঘরের সুন্দরী মেয়েদের দুশমন তার রূপ-যৌবন। নইলে কি আর বাবার বয়সী বুড়ো আমাকে কিনে আনতো!
আমার স্বামী জানে না, আমি ভাল ঘোড়া চালাতে জানি। কিন্তু অশ্ব চালনায় সেনাবাহিনীতে আমার বংশের যথেষ্ট খ্যাতি ও সম্মান রয়েছে। আমারও সাধ ছিল, আমি সুলতান আইয়ুবীর সেনা দলে ভর্তি হবো। যদি তা সম্ভব না হয় তবে কোন সৈন্যের স্ত্রী হয়ে সে সাধ মিটাবো।
তুমি বালির কথা বলেছো, আমি এই বালি ও পাথরের উপরেই জন্ম নিয়েছি। বেড়ে উঠেছি বালির ওপর খেলা করতে করতে, আবার এই বালিতেই একদিন আমার রক্ত-মাংস মিশে যাবে। আমার সব সুখ-আনন্দ তো এই বালিতেই লুকিয়ে আছে!’
“কিন্তু আমি তোমাকে কেমন করে সাহায্য করবো?” চিন্তিত কণ্ঠে সিপাইটি বললো।
“চলো, ফিরে যেতে যেতে কথা বলি।” মেয়েটি বললো, ‘এতক্ষণে দলের লোকেরা নিশ্চয়ই আমাদের খুজঁঁতে বেরিয়ে গেছে। যেতে যেতেই বলবো, আমি কি প্ল্যান নিয়েছি।”
দু’জন যাত্রা করলো। মেয়েটি বলতে লাগলো, “আমি তোমাকে এ কথা বলবো না যে, আমাকে তুমি সাথে নিয়ে চলো। এটা বলা অন্যায় হবে। আগে আমাকে আমার স্বামীর কাছ থেকে মুক্ত হতে হবে। তাকে তালাক দেয়া সম্ভব নয়, সে শক্তি বা ক্ষমতা আমার নেই। তার হাত থেকে বাঁচার একটিই পথ, কৌশলে তাকে হত্যা করা। এটা এমনভাবে করতে হবে, যাতে তাকে হত্যা না বলে স্বাভাবিক মৃত্যুই মনে হয়। না, ভয় পেয়ো না, এ হত্যাকাণ্ড তোমাকে করতে হবে না। যা করার আমিই করবো।
“তুমি মেয়ে মানুষ, তুমি কেমন করে তাকে হত্যা করবে?” বিস্মিত হয়ে বললো সৈনিক ।
“ভয় পেয়ো না, দেখো, আমি তা ঠিকই পেরে যাবো। তাকে যখন মদ পান করাবো। তখন তার সাথে একটু বিষ মিশিয়ে দেবো। এরপর তাকে নিয়ে যাব নদীর তীরে। নেশার ঘোরে টলতে টলতে সে যখন পথ চলবে তখন সুযোগ বুঝে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেবো ।
দম আটকে সে মারা গেলে আমি চিৎকার করে লোকজনকে ডাকবো “বাঁচাও, বাঁচাও” বলে। লোকজন যখন তাকে উপরে তুলে আনবে ততক্ষণে সব শেষ। আমি বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়বো।
লোকজনকে বলবো, মদ খেয়ে তিনি আমাকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। নদীর ধার দিয়ে হাঁটছিলাম আমরা । হঠাৎ মাথা ঘুরে তিনি নদীতে পড়ে গেলেন। আমি চিৎকার করে তোমাদের ডাকলাম, কিন্তু তোমরা তাকে আর জীবিত তুলতে পারলে না।’
ব্যাস, সবাই আমার কথা বিশ্বাস করবে। কারণ এখনো মাঝে মধ্যে আমরা এভাবে হাঁটতে বেরোই । এরপর হয়তো কিছুদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। হয়ে যাবো।” “তোমার কাছে কি কোন বিষ আছে?” সিপাই আশ্চৰ্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো। মেয়েটি হাে হাে করে হেসে উঠলো। বললো, “তুমি বোকা সিপাই। আমরা কায়রো থেকে দূরে এই নীলনদের পাড়েই বাস করি। সেখান দিয়ে এই নদী কুলকুল বয়ে চলেছে। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য এই মাছ। মাছের পিত্ত বিষে পূর্ণ থাকে । তুমি তো দেখেছি। এখানেও আমরা মাছ ধরে রান্না করে খেয়েছি। আমি মাছের পিত্তের বিষ কয়েক ফোটা শিশিতে ভরে রাখবো। তারপর তা বুড়োর শরাবের সাথে মিশিয়ে (द ।’ “কিন্তু দলের লোকেরা তোমাকে আমার সাথে বিয়ে দেবে কেনো?” যুবক জিজ্ঞেস করলো। “সে মরে গেলেই আমি মুক্ত হয়ে যাব। পরে ওরা আমাদের বিয়েতে বাঁধা দিতে আসলে বলবো, “তোমরা কেউ আমার অভিভাবক নিও। নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করার বয়স আমার হয়েছে।” তখন কেউ আর কোন বাঁধা দিতে পারবে না। শেষে হয়ে যাবে।”
“তোমাকে আমি কোথায় খুঁজে পাবো? তোমরা তো আর ততদিন এখানে থাকবে না।”
“শোন, এখানে আমরা আরো কয়েকদিন থাকবো। বুড়োকে আমি এখানেই খুন করবো। তখন তোমাকে অনুরোধ করবো আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। তুমি আমাকে বাড়ী পেঁৗছে দেয়ার সুযোগে চিনে আসবে আমাদের বাড়ী। আর শোন! যে কদিন এখানে থাকি আমার সঙ্গে নিয়মিত দেখা করবে।”
“আমি তো শুধু ডিউটির সময় এখানে আসতে পারবো।” সিপাইটি বললো, “আমাদের সেনা ক্যাম্প এখান থেকে অনেক नों।’
“আবার কখন ডিউটি পড়বে তোমার?”
“আমার ডিউটি এই সঙ্গীর সাথেই আগামী কাল মধ্যরাতে । তখন আমি তোমার সাথে দেখা করতে পারবো ।”
“তোমরা আমাদের ক্যাম্পে এসো না। বাগানের বাইরে যে বড় বট গাছটি আছে তার নিচে অপেক্ষা করো। আমি ওখানেই তোমার সাথে দেখা করবো । তারপর তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবো, যেখানে কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না। সেখানে দু’জনে বসে প্ৰাণ খুলে কথা বলবো, কেউ জানতে পারবে না। আমাদের এই গোপন অভিসারের খবর।”
চলতে চলতে মেয়েটি সৈনিকের হাত চেপে ধরলো। সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে তাকালো তার দিকে। মেয়েটি তার চোখ সেন্ট্রির চোখে গভীর ভাবে গেথে দিল । সেই চোখের দিকে তাকিয়ে সিপাহীর আর কোন সন্দেহ রইলো না, এ মেয়ে সত্যি তার প্রেমে পড়ে গেছে।
সে মেয়েটির হাতে চুমু খেয়ে গভীরভাবে তা বুকে চেপে ধরলো।
টিলার মোড় ঘুরেই ওরা কাফেলার লোকজনকে দেখতে পেল। লোকগুলো তাদের খুঁজতে যাচ্ছিল, দেখতে পেয়ে দৌড়ে এলো তাদের কাছে। ওরাও ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এলো দু’জন।
মেয়েটির বৃদ্ধ স্বামী গিয়ে জড়িয়ে ধরলো সিপাইকে। ভয়ে তখনো তার গলার স্বর কাপছে। অন্যরাও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো।
মেয়েটি বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথাই বললো ওদের । লোকজনকে শোনালো তাকে উদ্ধার করার এক লোমহর্ষক কাহিনী। বললো, “এই সিপাই নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাকে উদ্ধার করতে ঝাপিয়ে না পড়লে আমার কপালে নিৰ্ঘাত মরণ লেখা ছিল।
ঘোড়াটি যখন আমাকে নিয়ে পাহাড়ী খাদে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল ঠিক সে সময় এই বীর সিপাই তার ঘোড়া নিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ায়। ফলে ঘোড়াটি আর লাফিয়ে পড়তে পারেনি, কিন্তু তার ধাক্কায় সৈনিকটির ঘোড়ারই এক পা খাদে পড়ে গিয়েছিল, আরেকটু হলেই জীবন সাঙ্গ হতো এ যুবকের।”
ডিউটি শেষে দুই সিপাই সেনা ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছে। একজন বললো, “দোস্ত, আজ যা দেখালি না। তুই! মেয়েটা যেভাবে তোর গুণ গাইছিল, মনে হয় তোর জন্য দিওয়ানা হয়ে গেছে। আসলে কি ঘটেছিল রে?”
অভিযোগ অস্বীকার করলো না সিপাই। মোটামুটি খুলেই বললো সবকিছু। তার প্রতি মেয়েটির আকর্ষণের কথাও স্বীকার করলো। কিন্তু বুড়োকে খুন করে তারা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে, এ কথাটুকু বললো না।
বন্ধুর কথায় উৎসাহিত হয়ে সেও তাকে শোনালো নতুন এক কাহিনী। বললো, “তােমরা যখন টিলার ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেলে তখন আমরা সবাই সেদিকে তাকিয়ে আছি, একটি মেয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো।
সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে তাকিয়েছিল তোমাদের হারিয়ে যাওয়া পথের দিকে, মেয়েটি তাকিয়েছিল আমার দিকে। বুড়ো বললো, “চলো এগিয়ে দেখি।”
বুড়োর কথায় লোকজন এগুতে শুরু করলে মেয়েটি আমাকে বললো, “আপনি যাবেন না?”
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, চলো।”
সবাই এগিয়ে যাচ্ছিল, আমরাও হাঁটা ধরলাম। মেয়েটি খুব ধীরে ধীরে হাটছিল। লোকেরা আমাদের পিছনে ফেলে অনেক দূরে এগিয়ে গেল। অন্য মেয়ে দুটােও সামনে চলে গিয়েছিল। মেয়েটি আমার সাথে কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে আমার কাছে প্ৰেম নিবেদন করলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আবার কবে দেখা হবে?
আমি তাকে বলেছি, আগামী কাল মধ্যরাতে আবার আমার ডিউটি পড়বে এখানে।”
“মেয়েটি কি বলে প্ৰেম নিবেদন করলো রে?”
“মেয়েটি বললো, তাকে এক বৃদ্ধের সাথে বিয়ে দেয়া হয়েছে। এই বৃদ্ধকে সে চায় না। সে আমার সাথে পালিয়ে গিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধতে চায়।’
দু’জনের ঘটনা প্রায় একই রকম। তারা দু’জনেই এই সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলো। কেমন করে এ মেয়েদের পাওয়া যায়, এই তাদের চিন্তা।
তারা ঠিক করলো, যদি মেয়েরা তাদের স্বামীকে হত্যা করতে না পারে। তবে তারা নিজেরাই তাদের হত্যা করবে। কিন্তু কেমন করে হত্যা করবে। তার কোন সুরাহা করতে পারলো না ।
দুই সিপাই রঙিন স্বপ্লের জাল বুনতে বুনতে তাদের ক্যাম্পে গিয়ে পৌছলো। ক্যাম্পে গিয়ে তারা কমাণ্ডারের কাছে রিপোর্ট দিল, অমুক স্থানে কায়রোর এক বণিক কাফেলা ক্যাম্প করেছে। তাদের আসবাবপত্র ও মালামাল চেক করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, তারা প্রকৃতই ব্যবসায়ী, কোন সন্দেহভাজন বা শক্ৰ দল নয় ।”
সৈন্যরা কাফেলার বর্ণনা দিতে গিয়ে বণিকদের সুন্দরী মেয়ে চারটির কথাও বললো ।
ক্যাম্পের কমাণ্ডার আগের রিপোর্ট তেমন মনোযোগ দিয়ে শোনেননি। কিন্তু মেয়েদের কথা বলতেই তিনি এদিকে মনোযোগী হলেন। তিনি প্রশ্ন করে মেয়েদের সংখ্যা, বয়স, রূপ, গঠন, গায়ের বর্ণ, আকৃতি সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শোনলেন। সিপাইরা তার মনের ভাব বুঝতে পেরে চুপ করে রইলো।
কমাণ্ডারের কাছে বসেছিল একজন অপরিচিত সৈন্য। সে এই ক্যাম্পের লোক নয়, পাশের ক্যাম্পের। ওই ক্যাম্পটি এখান থেকে আট দশ মাইল দূরে। সে তার কমাণ্ডারের কাছ থেকে এ ক্যাম্পের কমাণ্ডারের জন্য জরুরী চিঠি নিয়ে এসেছে। , চিঠিতে আজ সন্ধাতেই ওই ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য দাওয়াত দেয়া হয়েছে এ ক্যাম্পের কমাণ্ডারকে। বলা হয়েছে, “বিশেষ কাজ আছে, অবশ্যই চলে আসবেন।”
কমাণ্ডার চিঠি বাহককে বললো, “একটু অপেক্ষা করো, যাবো যখন দু’জনে এক সাথে যাওয়াই ভালো।”
এইমাত্র সূর্য ডুবিলো। মাগরিবের নামাজ পড়েই কমাণ্ডার আগত সৈনিকটিকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করলো ।
যখন তারা অপর ক্যাম্পে গিয়ে পৌছলো তখন নিকষ রাতের আঁধার সারা প্রকৃতিকে জড়িয়ে নিয়েছে।
এই ক্যাম্পটি ছিল খুবই সুন্দর জায়গায়। এক কমলার বাগানের ভেতর। পাশেই ছিল শস্য শ্যামল বাগান ও ক্ষেতখামার ।
সন্ধ্যার পর পরই আলোকমালায় সাজানো হলো ক্যাম্প ।
রাতের জন্য ক্যাম্পের সৈন্যদের অবকাশ দেয়া হলো ডিউটি থেকে। সবাই আনন্দ উৎসব শুরু হওয়ার আশায় একস্থানে জটলা করে বসেছিল।
মশালের আলোয় স্থানটি আলোকিত হয়ে উঠেছে। ক্যাম্পের কমাণ্ডার জটলার কাছে নেই। তিনি আসেননি বলেই এখনো শুরু হয়নি অনুষ্ঠান।
আগত কমাণ্ডার এখানকার দায়িত্বশীলের সাথে দেখা করার জন্য ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে গেলো। দেখলো, কমাণ্ডারের সামনে বসে আছে দুজন মেয়ে ও তিনজন মরুচারী বেদুইন। তাদের পাশে পড়ে আছে বাজনার সাজ-সরঞ্জাম ও তবলা ।
মেহমানরা সবাই এসে পৌঁছলে কমাণ্ডারের নির্দেশে খানা পরিবেশন শুরু হলো। খাওয়া শেষ হলে কমাণ্ডার মেহমানদের উদ্দেশ্যে বললো, “বাইরে চলুন সবাই। আপনাদের জন্য আরো কিছু আপ্যায়নের ব্যবস্থা আছে।”
মেহমানরা বাইরে এলো। বাইরের খোলা মাঠ মশালে মশালে আলোকিত করে তোলা হয়েছে। মেহমানদের জন্য এক পাশে বিছানাে হয়েছে ফরাশ।
কমাণ্ডার তার এক সৈন্যকে বললো, “বাজনাদার ও মেয়েদের নিয়ে এসো।”
বাজনাদার ও মেয়েরা এলে এক মেহমান জিজ্ঞেস করলো, “এ লোকগুলো কারা, এখানে কি হচ্ছে?”
“এই মেয়েরা নর্তকী ও গায়িকা।” কমাণ্ডার উত্তর দিল, “এদের সাথে বাজনাদারও আছে। এদিক দিয়েই যাচ্ছিল ওরা । পানি পান করার জন্য এখানে থামলে আমি এদের পরিচয় পেয়ে থামিয়ে দিলাম। বললাম, আজ রাতে এখানেই থেকে যাও। আমার সৈন্যদের জীবন একঘেয়ে হয়ে উঠেছে, ওদের একটু আনন্দ দিয়ে যাও।’
“আমার কিন্তু এসব ভাল লাগছে না।” মেহমান কমাণ্ডারকে বললো, ‘সীমান্তে প্রহরায় নিয়োজিত সিপাইদের আমোদ-স্ফূর্তিতে ডুবিয়ে দিলে তাদের চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে, দায়িত্বে অবহেলা আসবে।”
“এ ছাড়াও সৈন্যরা নষ্ট হচ্ছে।” মেজবান কমাণ্ডার বললো, “আমাদের অন্য সাখীরা আজ শহরে আরাম-আয়েশ্যে জীবন কাটাচ্ছে। আর আমরা বেওয়ারিশ কুকুরের মত মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তোমাকে কি তোমার সিপাইরা উত্যক্ত করে না? বলে না, এখানে থাকবো না, আমাদের অন্যত্র বদলী করে দিন।’
মেহমান বললো, ‘সিপাইদের মাথায় চড়ার সুযোগ দিতে হয় না, ওদেরকে সৈনিকের মতই রাখতে হয়।”
“আমি তো আমাদের সেনাপতির কাছেও আবেদন করেছি, “আমাদের ওপর একটু দয়া করুন, আমাদের অন্য কোথাও বদলী করুন।” মেজবান কমাণ্ডার বললো, “তিনি এখনো তার কোন উত্তর দেননি। আমি আরও বলেছি, “আমাদের সেই সেক্টরে পাঠিয়ে দিন, যেখানে কঠিন লড়াই হচ্ছে। নিষ্কর্ম জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে এখানকার সৈন্যরা, এদেরকে এখান থেকে সরিয়ে দিন। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি, এখন অন্যদের পাঠান।”
মেহমান কমাণ্ডারও ঠিক এই বিষয়টিই চিন্তা করছিলেন। কমাণ্ডারের সামান্য ভুল ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনতে পারে। শক্ৰদের উপরে বিদ্যুতের মত ঝাঁপিয়ে পড়া মুজাহিদরা এখন মানসিক বিষন্নতায় ভুগছে, এটা ভাল কথা নয়। ডিউটি ফেলে তারা নাচ-গান ও স্ফূর্তিতে ডুবে গেলে সীমান্ত রক্ষা করবে কারা, কারা প্রতিরোধ করবে চোরাচালানী ও বিদেশী দুস্কৃতকারী?
রাত ক্রমশ: বেড়ে চলেছে। পালাক্রমে নাচছে মেয়েরা। তারা ক্লান্ত হয়ে পড়লে বাজনাদাররা গান শুনিয়ে সাময়িক বিশ্রাম দেয় ওদের।
আবারো একটি মেয়ে উঠে দাঁড়ালো। নৃত্যের তালে তালে উন্মাতাল বাজনা বাজছে। উল্লাসে ফেটে পড়ল সৈন্যরা। চিৎকার করে নাচের প্রশংসা করছে ওরা । আনন্দে টাকা পয়সা ছুড়ে মারছে।
কিন্তু মেয়েরা নাচ থামিয়ে হাত জোড় করে এই বলে ক্ষমা চাইল, মাফ করবেন আমাদের। নাচ আমাদের নেশা এবং পেশা। কিন্তু যারা দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে সীমান্ত পাহারা দেয়। তাদের একটু আনন্দ দেয়ার পরিবর্তে আমরা কোন মূল্য গ্ৰহণ করতে পারবো না। আপনাদের দেখে আমাদের মধ্যে যে দেশপ্রেম জেগে উঠেছে, টাকা পয়সা দিয়ে আমাদের সেই দেশপ্ৰেমকে অপমান করবেন না।
আল্লাহরাওয়াস্তে।’
বাজনাদাররাও বাজনা থামিয়ে বলে উঠলো, “দেশরক্ষা বাহিনী যদি আমাদের নাচগানে খুশী হন, এটাই আমাদের বড় পাওয়া। দেশের জন্য আমরা কিছু করতে না পারি, দেশ রক্ষায় নিয়োজিত ভাইদের একটু সেবাও কি করতে পারবো না?’
দলের সর্দার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আমি আমার যন্ত্রী ও নর্তকীদের দেশপ্ৰেম দেখে অভিভুত। আমি ঘোষণা করছি, আপনাদের যখন ইচ্ছা আমাদের ডেকে পাঠাবেন, এর জন্য কখনো কোন মূল্য দিতে হবে না আপনাদের।”
উপস্থিত সৈনিকরাও অভিভূত হলো ওদের এই আন্তরিকতা দেখে । এখানে দর্শকদের মধ্যে বসে ছিল দুই ক্যাম্পের দুই সামরিক কমাণ্ডার। তাদের পদমর্যাদা যদিও তেমন উচ্চ নয়, তবুও তারা একেকটি ক্যাম্পের ইনচার্জ।
দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যে যে দুরদর্শিতা ও সতর্কতা প্রয়োজন তার কিছুই তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। তাদের মনে দায়িত্বের কোন অনুভূতি আছে, এমনটিও মনে হচ্ছিল না। তাদের আচরণে ।
এই দায়িত্বশীল কমাণ্ডাররা এ কথা খতিয়ে দেখলো না, এই নর্তকী ও বাজনাদারেরা আসলে কারা? এরা কোথেকে এসেছে আর কোথায় যাবে? বাজনাদাররা যে পরিচয় ও বক্তব্য দিয়েছে, সে বক্তব্য কতটুকু সত্য ও গ্রহণযোগ্য? তাদের এই আগমন কোন ষড়যন্ত্রের অংশ। কিনা তাও খতিয়ে দেখার চেষ্টা করলো না। এমনকি বেদুঈন পোষাকে দর্শকের মধ্যে কিছু বহিরাগত লোক বসেছিল, এই লোকগুলো কারা এবং কোথেকে এসেছে তাও তলিয়ে দেখার কথা ভাবলো না এই কমাণ্ডাররা ।
যে কোন অবস্থায় ক্যাম্পের সেন্ট্রিবক্সে চারজন পাহারাদার থাকে। কিন্তু কখন যে তারা সেন্ট্রিবক্স ছেড়ে নাচের আসরে চলে এসেছে এ খবরও হয়তো জানে না কমাণ্ডার। অথবা জানলেও নাচ দেখায় তারা এতটাই বিভোর, ও নিয়ে কিছু চিন্তা করার মত সময় ছিল না। তাদের ।
ক্যাম্পের কিছু দূর দিয়ে রাতের আধারে কালো বর্ণের কমবেশী পঞ্চাশজন লোক একে অন্যের পিছনে লাইন দিয়ে সুদানের দিক থেকে এগিয়ে এলো। এদের আগে আগে যাচ্ছে দু’জন লোক। পিছনের লোকেরা এদের অনুসরণ করছে এবং এদের ইঙ্গিতে কখনো থামছে, কখনো এগিয়ে যাচ্ছে।
ইঙ্গিত পেয়ে লোকগুলো থামল। সামনের দু’জন আধারে কোথায় কি শব্দ হচ্ছে শোনার চেষ্টা করলো। ওরা। এরপর শেয়ালের লম্বা ডাক ছাড়লো। এ ডাকের অর্থ কি কাফেলার লোকেরা তা বোঝে। পেছনের লোকগুলো এ শব্দ শোনার সাথে সাথে আবার সামনে অগ্রসর হতে থাকলো ।
আবার সামনে থেকে শিয়ালের হুক্কা হুয়া শব্দ ভেসে এলো।
থেমে গেলো লোকগুলো। আবার কিছুক্ষণ পর শিয়ালের সেই লম্বা ডাকে চলতে আরম্ভ করলো ।
দূর থেকে ক্যাম্পের নাচগান ও বাজনার অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পাচ্ছিল ওরা। সামনেই পাহাড়ী এলাকা। কালো রাতের অদৃশ্য হয়ে গেল।
তাদের হাতে ছিল বর্শা, সঙ্গে তলোয়ার ও খঞ্জর। এ ছাড়াও ছিল চার পাঁচটি করে ধনুক এবং প্রচুর তীর।
আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এই জংলী নিগ্রোদের স্বাগত জানানোর অভ্যর্থনাকারী। একজন এগিয়ে এসে আগত দলের সরদারকে বললো, তাহলে ঠিক মতই আসতে পেরেছেন। যাক, মেয়েরা ভালই কাজ দেখাতে পেরেছে।”
“হ্যা!’ সরদার বললো, “আমিও তাদের বাজনার সুর ও নাচের ঝংকার শুনতে পেয়েছি। দশ-বারো জনকে আমি সেখানে দর্শক হিসেবে পাঠিয়েছিলাম। তাদের একজন এসে সংবাদ দিল, মাহফিল খুব জমে উঠেছে, এখন রাস্তা একদম ফাঁকা। সমস্ত প্রহরী ও সৈনিক আসরে চলে গেছে।” এ খবর পেয়ে আর দেরী করিনি, সাথে সাথে চলে এসেছি।”
“নীল নদের পাড় থেকেও ভাল সংবাদ পাওয়া গেছে।” অপর এক অভ্যর্থনাকারী বললো, “ওখানকার মেয়েরাও কাজ গুছিয়ে নিতে পেরেছে। আগামী কাল রাতে যে দু’জন সেন্ট্রি পাহারায় আসবে তাদরেকে এরই মধ্যে ফাঁসিয়ে নিয়েছে ওরা। আমি সংবাদ পাঠিয়েছি, আগামী কাল রাতে কমপক্ষে তিনটি বিশাল নৌকা বােঝাই করে আমাদের লোকেরা যেনাে চলে আসে।” তারা সামনে এগিয়ে চললো। পাহাড় ক্রমশ: উচুতে উঠে গেছে। বেশ কিছুটা পথ উঠার পর সরদার এক জায়গায় দাড়িয়ে পড়ল। সাথে সাথে দলের সবাই দাঁড়িয়ে গেল। এরপর আরেক দল লোক এসে ওদের পাহাড়ের অভ্যন্তরে ফেরাউনের তৈরী যে অসংখ্য গুহাঘর ছিল ওখানে নিয়ে গেল । চারদিকে পাহাড়ের অভ্যন্তরে অসংখ্য গুহাঘর, মাঝখানে এক মাঠ। সবাইকে নিয়ে হাজির করা হলো সে মাঠে।
দলের সরদার দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল নেতৃস্থানীয়দের সাথে। যেতে যেতে সরদার বললো, “আপনারা ভুলে যাবেন না, এরা সবাই কুসংস্কার ও পূজা-পার্বনে বিশ্বাসী । এরা কোন উদ্ভট ও হাস্যকর আচরণ করলে বিস্মিত হবেন না, বরং সেগুলোকে সম্মানের চােখে দেখবেন।
আমরা তাদেরকে ধর্মের নামে ডেকে এনেছি। তাদেরকে প্রলোভন দেখিয়েছি, তোমাদেরকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবো, যেখানে ভগবান স্বয়ং বাস করেন। যে ভগবান বালিকে গরম রাখেন, সূর্যকে উত্তপ্ত করেন, আকাশ থেকে পানি ও বিজলী বর্ষণ করেন।”
“এ নিয়ে ভাববেন না আপনি । কোন সমস্যা হবে না।”
সমস্যা একটা আছে। এ সব লোকেরা কোন অভিযানে বেরোনোর আগে ভগবানের নামে মানুষ কোরবানী দিয়ে অভ্যস্ত।”
‘কোরবানী কি পুরুষ দিতে হবে, না নারী? নাকি নারী ও পুরুষ উভয়কেই দিতে হবে?”
“মানুষ হলেই চলবে। যদি আমরা তাদের এই প্রথা পূরণ করি তবে তারা নিঃশঙ্ক চিত্তে লড়াই করতে পারবে। তারা তখন এমন বেপরোয়া হয়ে যায় যে, কোন বাঁধাকেই পাত্তা দেয় না। কায়রো শহরে ওরা একবার ঢুকতে পারলে ইট দিয়ে ইট ভাঙবে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ওদের সামনে একদিনের বেশী টিকতে পারবে না।”
মাঠে পৌঁছলো সরদার ও নেতৃবর্গ। সরদার সামনে দণ্ডায়মান নিগ্রো বাহিনীকে বললো, “তোমরা সিজদায় পড়ে যাও। কারণ তোমরা এখন ভগবানের ঘরে এসে গেছো ।”
সবাই সঙ্গে সঙ্গে সিজদায় পড়ে গেল। একটু পর সরদারের আদেশে আবার তারা উঠে দাড়ালো ।
এ দলটি ছিল সুদানের হাবশী ক্রীতদাসদের। এদের মিশরে প্রবেশ করানো হচ্ছিল নাশকতামূলক কাজের জন্য। সীমান্ত রক্ষীদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে গোপনে এদের মিশর অনুপ্রবেশ নিশ্চিত করার জন্যই নীলনদের পাড়ে বাণিজ্য কাফেলা এবং এখানে নর্তকী ও গায়ক দলের সমাবেশ ঘটানো হয়। অনুপ্রবেশের জন্য বেছে নেয়া হয় সেই দুৰ্গম ফেরীঘাট, যা পার হয়ে সামান্য এগুলেই অভিশপ্ত পার্বত্য অঞ্চলের ভয়ানক ও বিস্তৃত এলাকা অবস্থিত। ।
এলাকাটি ভীষণ দুৰ্গম এবং ছোট বড় অসংখ্য পর্বতমালায় সজ্জিত। এখানে আছে ফেরাউনের যুগের পর্বত গহবর, যেখানে মাটির নিচে ফেরাউনের তৈরী মহলের অসংখ্য ছোট বড় কামরায় বিরাট সৈন্য দল, ঘোড়া ও উটের বহর অনায়াসে লুকিয়ে রাখা সম্ভব।
সুদানের এই নিগ্রো হাবশীরা রক্তের হােলি খেলায় ছিল ওস্তাদ। মানুষকে তারা পশুর মতই এক প্রকার জন্তু ভাবতো। পশু শিকারের মতই মানুষ শিকারেও ওরা ছিল সিদ্ধহস্ত।
মিশরে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এদের সর্বাত্মক ও গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হলো এই দুৰ্গম পাহাড়ের অভ্যন্তরে।
এমনিতেই যুদ্ধে তারা খুবই পারদশী। তাদের মধ্যে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ লেগেই থাকে। এ জন্যই তীরন্দাজী ও বর্শা নিক্ষেপে এদের জুড়ি পাওয়া ভার।
সুদান সরকার খৃস্টানদের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে অনেক খৃস্টান সৈন্য ও সামরিক অফিসারকে তাদের বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। এরাই সুদানী হাবশীদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের কমান্ডো প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলছে।
এর আগে সুদানী বাহিনী মিশরীয় বাহিনীর কাছে দু’বার পরাজিত হয়েছে। তৃতীয়বার সুলতান আইয়ুবীর ভাই তকিউদ্দিন সুদানের ওপর আক্রমণ চালালে সুদানীরা সে আক্রমণ প্ৰতিহত করে।
তকিউদ্দিনের সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে মরুভূমিতে ছড়িয়ে পড়লে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী দ্রুত তাদের সাহায্যে এসে কোন রকমে অবশিষ্ট সৈন্যদের ফিরিয়ে এনেছিলেন।
তকিউদিনের বাহিনীর এই বিপর্যয়ের পরও সুদানীরা মিশরীয়দের পিছু ধাওয়া করা বা মিশর আক্রমণের সাহস করেনি। ঐতিহাসিকদের মতে, যদি তখন সুদানীরা মিশর আক্রমণ করতো। তবে তকিউদিনের পক্ষে মিশর রক্ষা করা কঠিন হয়ে যেত।
বারবার ব্যর্থতার কারণে খৃস্টানরা যুদ্ধের পদ্ধতি পরিবর্তন করলো। তারা সুলতান আইয়ুবীর মত গেরিলা যুদ্ধের কথা চিন্তা করতে লাগলো। তারা দেখলো, সুলতান আইয়ুবীর অল্প সংখ্যক কমাণ্ডো বিশাল বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্ধকারে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তছনছ করে দেয় তাদের। ওরা সামনাসামনি যুদ্ধ করে না, চোরাগুপ্ত হামলা চালিয়ে মুহুর্তে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু এই অল্প সময়েই আক্রান্তরা সম্মুখীন হয় বিপুল ক্ষতির।
এ ধরনের আক্রমণের জন্য দরকার বাছাই করা সৈন্য এবং পর্যাপ্ত ট্রেনিং। সাধারণ সৈন্যরা সামনাসামনি দল বেঁধে যুদ্ধ করতে পারলেও এ ধরনের ঝটিকা আক্রমণে সুবিধা করতে পারে না। এ জন্যই সুদানীরা হাবশীদের নিয়ে এই নতুন বাহিনী গড়ে তোলার জন্য তৎপর হলো ।
এদের মধ্যে যুদ্ধের উন্নয়াদনা আছে, আছে ক্ষিপ্ৰতা ও অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার ট্রেনিং। এই ট্রেনিং আরেকটু শানিয়ে নিলে এরা হবে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তারা কায়রোবাসীদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালালে হয়তো কায়রো দখল করা সম্ভব হতে পারে। কারণ এখন সুলতান আইয়ুবী মিশরে নেই।
এই সুবৰ্ণ সুযোগ ব্যবহারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল সুদানীরা। তাদের বিশ্বাস, সুলতান আইয়ুবীর অবর্তমানে তাদের এ আক্রমণ প্ৰতিহত করার ক্ষমতা মিশরে আর কারো নেই। তারা অনায়াসেই কেল্লা ফতেহ করে নিতে পারবে।
তারা আরো ভাবল, যদি এ আক্রমণের নেতৃত্ব মিশরের কোন গাদ্দার সেনাপতির হাতে দেয়া যায়, তবে সে ভাল করেই জানবে কোথায় কেমন করে আঘাত হানলে সহজে বিজয় অর্জন সম্ভব। অল্প সময়ে, অল্প শক্তি ব্যয় করে বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য তারা সুলতান আইয়ুবীর বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ সেনাপতি আলকিন্দিকে বাছাই করলো। আলকিন্দি সুদানীদের টােপ গিলে রাজি হয়ে গেল এই আক্রমণে নেতৃত্ব দিতে।
সুদানের হাবশী সৈন্যদের গোপন স্থানে রাখার ব্যবস্থা আলকিন্দিই করেছিল। সে মিশরের সেনাবাহিনীর চার পাঁচজন জুনিয়র কমাণ্ডারকে কৌশলে তার সঙ্গী বানিয়ে নিল। গোয়েন্দাদের মাধ্যমে সুদানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিল সে।
ষড়যন্ত্র সফল করার জন্য হাবশী সৈন্যদের সে এবং তার অনুগত কমাণ্ডাররা গোপনে মিশরের মাটিতে প্ৰবেশ করাচ্ছিল ।
সারারাত ক্যাম্পে নাচ-গানের আসর চললো । সকালে অন্য
ক্যাম্পের কমান্ডার বিদায় নিয়ে যাত্রার সময় এই ক্যাম্পের কমান্ডারকে বললো, ‘আগামী রাতে তোমার দাওয়াত আমার ক্যাম্পে ।”
সে বাদক দল এবং নর্তকীদেরও দাওয়াত দিল এক রাত তার ওখানে থেকে যাওয়ার জন্য। বাদক দল খুশী হয়েই কবুল এ দাওয়াত।
এরা ছিল আলকিন্দির প্রেরিত লোক। ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করার স্বার্থে আলকিন্দি চাচ্ছিল, সুদানী গেরিলারা সীমান্ত রক্ষীদের চােখে ধুলো দিয়ে মিশরে ঢুকে পড়ুক। তাদের অনুপ্ৰবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই আলকিন্দি এই ফন্দি এঁটেছিল ।
এরা অন্য গ্রামে যাচ্ছিল, এটা ছিল মিথ্যা কথা। তারা আগেই প্ল্যান করে এসেছিল, ক্যাম্পের কাছে গিয়ে পানি পান করার বাহানায় তারা ক্যাম্পে ঢুকে যাবে। এরপর ক্যাম্পের লোক ও কমাণ্ডারকে জালে ফাসানোর চেষ্টা করবে।
এদের সাথের নর্তকী দু’জনের চেহারা ছিল খুবই আকর্ষণীয়। কমাণ্ডার দেখেই তাদের প্রতি আকৃষ্ট হলো। সে এই আনন্দে শরীক হওয়ার জন্য অন্য ক্যাম্পের কমাণ্ডারকেও আমন্ত্রণ জানালো। আর এই আনন্দ উৎসবের সুযোগে পঞ্চাশজন অঞ্চলে প্ৰবেশ করলো।
পরের দিন। সন্ধ্যার পর পর নর্তকী ও বাদক দল নদীর পাড়ের ক্যাম্পে গিয়ে উপস্থিত হলো। সেখানেও নাচ-গানের আসর জমজমাট করে তুললো ওরা।
রাতের দ্বিপ্রহর। নদীর পাড়ে পাহারা দিতে রওনা হলো দুই সিপাহী। সঙ্গীরা বললো, “এমন আসর ছেড়ে ডিউটিতে গিয়ে কি লাভ? থাক না আজ ডিউটি।
কমাণ্ডার তখন রূপসী নর্তকীদের নিয়েই মহা ব্যস্ত। কে ডিউটিতে যাচ্ছে, আর কে আসছে। সে দিকে তার কোন খেয়াল নেই।
কিন্তু তারা এই বলে যাত্রা শুরু করলো, “তোমরা মউজ করো। আমাদের কপাল মন্দ, কি আর করা! ডিউটিতে অবহেলা করে কমাণ্ডারের গালমন্দ খেয়ে কি লাভ?”
আর মনে মনে বলছিল, “তোমরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাও, দুধ টুকু আমরাই খেয়ে আসি।”
ওদের জন্য যে এর চেয়েও আকর্ষণীয় আসর পড়ে আছে, সে কথা কাউকে বললো না। মধুর স্বপ্ন দেখতে দেখতে এগিয়ে চললো দুই সিপাহী। বুকের মধ্যে সেই সুন্দরী মেয়েদের ছবি, যারা কাল প্ৰেম নিবেদন করেছে ওদের কাছে। ওরা বলেছে, তাদের দু’জনেরই স্বামী বৃদ্ধ, তারা সেই বুড়ো স্বামীর হাত থেকে মুক্তি চায়। ঘর বাঁধতে চায় এই সিপাহীদের সাথে ।
তাই ডিউটির গরজের চেয়ে রূপসীদের সাথে মিলিত হওয়ার গরজটাই ওদের বেশী । এই গরজটাই ওদের টেনে নিয়ে চললো সেই বাগানের দিকে।
এতদিন ডিউটিতে যাওয়ার জন্য তাদের তেমন তাড়া ছিল না। ধীরে সুস্থে ঘোড়াকে হটিয়ে নিয়ে পথ চলতো। কিন্তু সে রাতে দু’জন ক্যাম্প থেকে বেরিয়েই বিপুল বেগে ছুটিয়ে দিলো ঘোড়া। বনভুমির কাছে এসে নদীর পাড়ে এক জায়গায় ঘোড়া থামিয়ে নেমে পড়লো। ঘোড়া দু’টাে বেঁধে রেখে এগিয়ে গেল দুজন।
কোথায় ওরা মিলিত হবে। আগেই বলে দিয়েছিল মেয়েরা । সে অনুযায়ী আরেকটু এগিয়ে দুই বন্ধু আলাদা হয়ে গেল। ধীর পদে এগিয়ে গেল নির্দিষ্ট জায়গায়।
সময় মতই অভিসারে বেরিয়ে আসে দুই মেয়ে। নির্দিষ্ট জায়গায় বসে সৈন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে ওরা।
নদীর পাড় থেকে সামান্য দূরে পাহাড়ের নির্জন গুহায় অভিসারে মেতে উঠলো দুই যুগল। মেয়েরা তাদের রূপ ও যৌবনের পসরা মেলে ধরল সৈন্যদের সামনে। ভালবাসার যাদুর বাণ ছুড়ে দিল তাদের ওপর। দুজনেই বললো, ঘুমের ওষুধ মেশানো মদ খাইয়ে ঘুমে বিভোর করে রেখে এসেছি স্বামীকে। সারারাত সে আর চোখের পাতা মেলতে পারবে না। আজ সারারাত তোমার সাথে গল্প করে কাটিয়ে দেবো।” ডিউটি ভুলে দুই সিপাই পাহাড়ের নির্জন গুহায় পড়ে রইল মোহময় আচ্ছন্নতায় । জগত সংসারের সব কিছু ভুলে ওরা যখন স্বপ্নময় জগতে, ওখান থেকে একটু দূরে, নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে গেল চারটি ছায়ামূর্তি।
কুল কুল রবে বয়ে যাচ্ছে নদীর পানি। লোকগুলো অন্ধকারের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছে পানির ওপর। কোন কিছু অনুসন্ধান করছে ওরা।
নদীর পাড়ে ঘোরাফেরা করতে করতে অধীর হয়ে উঠল। ওরা। একজন বলে উঠলো, “এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়। ওদের আসতে
অন্য একজন দূরে তাকিয়েছিল। সে বলে উঠলো, মনে হয় ওরা আসছে। ওদিকে তাকিয়ে দেখো, ওগুলো নৌকা নয়?” চারজনই তাকালো সেদিকে । “হ্যাঁ, আসছে। ওরা!”
জলদি করে তারা একটি লণ্ঠন জ্বালিয়ে এদিক-ওদিক দোলাতে লাগলো। একটু পর নদীর মাঝেও জ্বলে উঠলো। দুটি প্রদীপ, কিন্তু সাথে সাথেই তা আবার নিভেও গেল।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top