১১. চারদিকে চক্রান্ত


অগ্রযাত্রা নিরাপদ ও নিষ্কণ্টক করার জন্য কমাণ্ডো দল পাঠানো হয়েছে আগে। তারা সামরিক পোষাকে নয়, মুসাফিরের বেশে আছে। তাদের সাথে আছে দ্রুতগামী কাসেদ । সে তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবে। সামনের পরিবেশ পরিস্থিতির সংবাদ জানাবে তোমাকে । বাহিনী নিয়ে তুমি সোজা হেম্মাত দুৰ্গে চলে যাবে। সেখানে দুর্গের অধিপতি তোমাদের অভ্যর্থনা জানাবেন।”
সুলতান আইয়ুবী কমাণ্ডারকে আরো বলে দিলেন, “হেম্মাত দুৰ্গ যুদ্ধ ছাড়াই আমাদের হস্তগত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তোমরা সতর্ক ও সাবধান থাকবে। কোন অবস্থাতেই প্রবঞ্চণায় পড়বে না। দুর্গ থেকে দূরে উপযুক্ত স্থানে থেমে যাবে। লক্ষ্য করবে, দুর্গাধিপতির মনের ভাব। যদি জুরাদিক আপোষে দুর্গ হস্তান্তর করতে রাজি হয়, তবে তাকে দুর্গের বাইরে আসতে বলবে।
সে দুর্গের বাইরে এলে দুৰ্গ আক্রমণের কোন দরকার নেই। কিন্তু তুমি নিজে তার সাথে আপোষ বা চুক্তি কোনটাই করবে না। তাকে বলবে, সুলতান আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তিনিই আপনার সাথে সন্ধির শর্ত নির্ধারণ করবেন।
খবরদার! তার কথায় প্রভাবিত হয়ে তোমরা কেল্লায় প্রবেশ করবে না। আর যদি জুরদিক মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে মুজাহিদদের ঈমানের শক্তি কেমন তা তাকে বুঝিয়ে দেবে। কাসেদ মারফত সাথে সাথে এ খবর পাঠিয়ে দেবে আমার কাছে।”
সুলতান আইয়ুবী দেয়াল ভাঙ্গায় পারঙ্গম এক দল সৈন্যকে আলাদাভাবে আগেই পাঠিয়েছিলেন হেম্মাতের পথে। প্রথম দলটি যাত্রার তিন চার ঘন্টা পর আরও দুটাে সৈন্য দলকে হেম্মাতের পথে যাত্রা করার হুকুম দিলেন। এক দলকে প্রথম দলের ডাইনে এবং দ্বিতীয় দলকে প্রথম দলের বায়ে অবস্থান নিয়ে এগিয়ে যেতে বললেন ।
তাদের বলে দিলেন, “যদি প্রথম দলের সাথে হেম্মাত দুর্গের সৈন্যদের মোকাবেলা শুরু হয়, তবে তোমরা দু’দল দুদিক থেকে অগ্রসর হয়ে দুর্গ অবরোধ করে ফেলবে। তোমরা দুর্গের ওপর এমনভাবে তীর বর্ষণ করবে, যেন দেয়াল ভাঙ্গা বাহিনী দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে।”
এ দুই দল যাত্রা করার কিছুক্ষণ পর। সুলতান আইয়ুবী স্বয়ং একদল সৈন্য নিয়ে যাত্রা করলেন হেম্মাতের পথে। এই নিয়ে পর পর চারটি দল হেম্মাতের উদ্দেশ্যে দামেশক ত্যাগ করলো ।
অবশিষ্ট সমস্ত সৈন্য দামেশকেই রয়ে গেল। তিনি অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়েই যুদ্ধ জয়ের চিন্তা করছিলেন।
রসদপত্র সরবরাহের দায়িত্ব ছিল কমাণ্ডো বাহিনীর একাংশের ওপর । তারা রসদসহ ছোট ছোট দলকে হেম্মাতের পথে পাঠিয়ে দিল ।
হেম্মাত থেকে হলবের পথ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল ছদ্মবেশী কমাণ্ডো বাহিনী । কোন কাসেদ যেন হেম্মাতের খবর হলবে পৌঁছাতে না পারে। এ জন্যই এ ব্যবস্থা। ওদের ওপর নির্দেশ ছিল, “কোন দিক থেকে সাহায্য আসা শুরু হলে কমাণ্ডো আক্রমণ চালিয়ে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে।”
দিন গড়িয়ে রাত এল। রাতও ক্রমেই গভীর হতে থাকলো। মুজাহিদদের অগ্রযাত্রা থেমে নেই, এগিয়েই চলেছে তারা। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে প্রথম দলটি হেম্মাত দুর্গ থেকে দু’তিন মাইল দূরে এসে অবস্থান নিল।
৯ ডিসেম্বরের সকাল। কেল্লার ওপর দাড়ানো প্রহরীরা তাকিয়েছিল। খোলা প্ৰান্তরের দিকে । অন্ধকারের প্রকোপ কমে এল, কুয়াশা হালকা হলো সামান্য। ওদের মনে হলো, দূরে মরুভূমিতে কালো কালো আবছা ছায়া দেখা যাচ্ছে। ভাল করে তাকালো ওরা। হ্যাঁ, মনে হচ্ছে অনেক মানুষ ও ঘোড়া। ওরা ভাবল, কোন কাফেলা হবে হয়ত।
সূর্য ওপরে উঠতে লাগলো, প্রহরীরা দেখলো, এটা কোন সাধারণ কাফেলা নয়, নিয়মিত সেনাবাহিনীর একটা দল। কেল্লার ডাইনে বায়ে সৈন্যদের যে ঘেরাও, তা তখনো ওদের চোখে পড়েনি।
সঙ্গে সঙ্গে হেম্মাত দুর্গে বেজে উঠলো জরুরী বিপদ সংকেত । এক কমাণ্ডার দৌড়ে ওপরে গেলো। তাকিয়ে দেখলো সৈন্যদের। ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটলো নিচে, দৌড়ে গিয়ে কেল্লার অধিপতি জুরাদিককে খবর দিল।
“ভয় পেয়ো না!” জুরদিক কমাণ্ডারকে বললেন, “এটা কোন আকরমণকারী সেনাদল নয়। আক্রমণকারী হলে রাতেই ওরা আঘাত হানতো। হতে পারে, খৃস্টানরা আমাকে হত্যা করতে না পেরে অন্য কোন ষড়যন্ত্রে আছে। হয়ত খলিফা আস সালেহের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে হেম্মাত কেল্লা আমার কাছে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে দিতে চায়। পেরেশান হওয়ার দরকার নেই, বাইরে গিয়ে ওরা কারা এবং কি চায় আগে খোঁজখবর নাও।”
কমাণ্ডার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বেরিয়ে গেলো কেল্লা থেকে। সুলতান আইয়ুবীর প্রথম বাহিনীর দিকে এগিয়ে গেল সে। দেখলো সুলতান আইয়ুবীর পতাকা উড়ছে ওখানে। ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসতে চাইলো সে।
আইয়ুবীর দলের কমাণ্ডার ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে গেল তার কাছে। কাছাকাছি হতেই দু’জন দু’জনকে চিনতে পারলো। দু’জনই নূরুদ্দিন জঙ্গীর সেনাবাহিনীতে একত্রে কাজ করেছে। “এই আমাদের ভাগ্যে ছিল!” আইয়ুবীর কমাণ্ডার বললো, ‘জঙ্গী যদি বেঁচে থাকতেন। তবে আমরা থাকতাম পরস্পর বন্ধু ও সঙ্গী। তিনি মারা গেছেন আর আমরা পরস্পর শক্র হয়ে গেলাম!”
“তোমরা কেন এসেছ?” কেল্লার কমাণ্ডার জিজ্ঞেস করলো ।
“তোমরা এ দুর্গ আর নিজেদের দখলে রাখতে পারবে না।” আইয়ুবীর কমাণ্ডার বললো, “তোমার দুর্গাধিপতিকে গিয়ে বলো, কেল্লা আমাদের হাতে তুলে দিতে। কোন রক্তাক্ত যুদ্ধে জড়িয়ে লাভ নেই। ওতে কেবল হতাহতের সংখ্যাই বাড়বে। আপোষে সংঘর্ষ না এড়ালে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা কেল্লা অবরোধ করতে বাধ্য হবো ।
কোথাও থেকে কোন সাহায্য পাবে না তোমরা, তোমাদের সাহায্যের সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অস্ত্ৰ সমৰ্পণ করে অযথা রক্তক্ষয় এড়ানোর জন্য আমি অনুরোধ করছি তোমাদের।”
কেল্লার কমাণ্ডার এর কোন জবাব না দিয়ে ফিরে গেলো জুরদিকের কাছে। জুরাদিককে বললো, “সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ফৌজ আক্রমণ করেছে আমাদের। তারা অন্ত্র সমৰ্পণ করে রক্তক্ষয় এড়াতে বলছে।”
জুরদিক চিৎকার করে বললো, “তুমি ঠিক বলছো! সালাহউদ্দীন আইয়ুবী এসেছেন! তাহলে আর বসে আছো কেন? কেল্লার ওপর থেকে খলিফার পতাকা নামিয়ে নাও । ওখানে উড়িয়ে দাও সাদা পতাকা। না, কোন সংঘাত নয়, আইয়ুবীর সাথে লড়াই করে মরতে দেবো না আমার কোন সৈন্যকে! উড়াও, জলদি শান্তির পতাকা উড়িয়ে দাও কেল্লার ওপর ।”
তিনি আবেগে দৌড়ে বাইরে চলে এলেন। অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে এগিয়ে গেলেন আইয়ুবীর বাহিনীর দিকে।
আইয়ুবীর সেনাদলের কাছে গিয়ে পৌঁছলেন তিনি। তিনি মনে করেছিলেন, সুলতান আইয়ুবী নিজেই আছেন সৈন্যদের সাথে। বললেন, “কোথায় মোহতারাম আইয়ুবী?”
“তিনি এখনো এসে পৌঁছেননি। জবাব দিল আইয়ুবীর বাহিনীর সালার।
“কিন্তু আমি তো তাঁর সঙ্গেই কথা বলতে চাই’।
“অবশ্যই তাঁর সাথে কথা বলবেন । আগে বলুন, আপনি কি লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নাকি আত্মসমৰ্পন করবেন?” ।
“আমি এর কোনটাই করবো না। আমি কি করবো তা কেবল সুলতানকেই বলবাে।”
“ঠিক আছে। আপনি কি তাহলে সুলতান আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন?”
‘না, সুলতান কোথায় আছেন। ওখানে আমাকে নিয়ে চলো। আমি যত শিগগির সম্ভব সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে চাই।” সুলতান তখনো অনেক পেছনে। জুরদিক তখুনি আইয়ুবীর সেদিকে রওনা হয়ে গেলেন।
সুলতান আইয়ুবী জুরাদিককে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। জুরাদিক তার পূর্ব শত্রুতার কথা তুলে ক্ষমা চাইলেন সুলতানের কাছে। উভয়েই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। অতীতের কথা ভুলে নতুন করে বন্ধুত্বের বন্ধনে জড়িয়ে নিলেন পরষ্পর পরম্পরকে ।
এরপর জুরদিক আইয়ুবীকে নিয়ে হেম্মত দুর্গে গেলেন। সমস্ত সৈন্যসহ দুর্ভেদ্য কেল্লা তুলে দিলেন সুলতান আইয়ুবীর হাতে। সুলতান আইয়ুবী তার কেন্দ্রীয় কমান্ডকে সঙ্গে নিয়ে কেল্লায় প্ৰবেশ করলেন । সৈন্যরা সাদা পতাকা নামিয়ে সেখানে সুলতানের পতাকা উড়িয়ে দিলো।
জুরদিক কেল্লার ছোট বড় সকল কমাণ্ডারকে ডেকে হাজির করলেন সুলতান আইয়ুবীর সামনে। সুলতান বললেন, “প্রিয় মুজাহিদ ভাইয়েরা! আমাদের জীবন, আমাদের মরণ, আমাদের সকল কাজ আল্লাহর জন্য, ইসলামের জন্য। ইসলামের পথে আছি বলেই তোমরা আমাকে বরণ করে নিয়েছে। আমিও ইসলামের স্বার্থেই তোমাদের কাছে ছুটে এসেছি। তোমরা দেখেছে, তোমাদের কারো কাছ থেকে অস্ত্ৰ কেড়ে নেয়া হয়নি। কাউকে অস্ত্ৰ জমা দিতেও বলা হয়নি । তার মানে হচ্ছে, কেউ তোমাদের পরাজিত করে এ কেল্লা দখল করেনি। তোমাদের সকল সৈনিককে বলে দিও, তারা যেন নিজেদেরকে পরাজিত মনে না করে। বরং ইসলামী জেহাদের প্রয়োজনে, দেশ, জাতি এবং মিল্লাতের স্বার্থে আমরা আজ পরস্পর মিলিত হয়েছি শুধু। আমরা সবাই মুসলিম ভাই ভাই। আমাদের লড়াই খৃস্টান ও তার তল্পীবাহকদের বিরুদ্ধে।”
সুলতান আইয়ুবী যে বিরাট পরিকল্পনা নিয়ে বের হয়েছিলেন তার প্রথম মঞ্জিল বিনা যুদ্ধেই জয় হয়ে গেল। তিনি দুরাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে এর শুকরিয়া আদায় করলেন। এরপর জুরাদিককে নিয়ে বসলেন। পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করতে ।
সমস্যা দেখা দিল, জুরদিকের সৈন্যরা শীতকালে যুদ্ধ করার কোন প্রশিক্ষণ পায়নি। ঠিক হলো, হেম্মাত দুৰ্গকে কেন্দ্র বানিয়ে এখান থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে। জুরদিকের সৈন্যরা কেল্লায় থাকবে এবং অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করবে।
কিন্তু সৈন্যরা এ সিদ্ধান্তে ঘোর আপত্তি জানালো। তারা দাবী করলো, তারাও সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের সাথে মিলে সরাসরি যুদ্ধে যাবে।
সামনে হেমসের দুর্গ। সুলতান আইয়ুবী এমনভাবে অভিযানের সময় নির্ধারণ করলেন, যাতে গভীর রাতে তার বাহিনী সেখানে গিয়ে পৌঁছে।
তিনি প্রথম সেনা দলকে পূর্বের মত আগে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু অন্যান্য পরিকল্পনায় কিছু কৌশলগত পরিবর্তন আনলেন। কারণ হেমসের দুর্গ বিনা যুদ্ধে জয় করতে পারবেন, তেমন কোন আশা ছিল না।
তিনি পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য একটি টিম পাঠালেন সবার আগে। এ টীম রাস্তাতেই সংবাদ পেল, কেল্লার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পার্শ্ববতী এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে টহল বাহিনী।
যেসব দিক থেকে হেমসে সাহায্য আসতে পারে সেসব এলাকায় সুলতান আইয়ুবী ছোট ছোট কয়েকটি দলকে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, “বাইরে থেকে কোন সাহায্য যেন হেমন্স দুর্গে প্ৰবেশ করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে তোমাদের।”
অতিরিক্ত খাদ্যশস্য ও রসদ হেম্মাত দুর্গে রেখে তিনি বাকী রসদপত্র বহনের দায়িত্ব দিলেন একদল কমাণ্ডোকে। আরেকদল কমাণ্ডোকে পাঠিয়ে দিলেন রাস্তা নিরাপদ রাখতে। এদের সঙ্গী হলো হেম্মাতের এক দল সৈনিক।
সুলতান আইয়ুবী চাচ্ছিলেন, তিনি হ’লব পৌঁছার আগ পর্যন্ত যেন তার আক্রমণের সংবাদ ওখানে না পৌঁছে। সকলের অজ্ঞাতসারে অতর্কিতে তিনি সেখানে আঘাত হানতে চান।
এ জন্য তিনি নিজের কিছু লোককে হলবের রাস্তায় ছড়িয়ে রেখেছিলেন। তাদের বলে রেখেছিলেন, আমরা যাত্রা করার পর কোন পলাতক সৈন্য বা সাধারণ লোককেও তোমাদের অতিক্রম করে হেমসে যেতে দেবে না। ওদের থামিয়ে দেবে, বেশী বাড়াবাড়ি করলে তাকে ধরে আটক রাখবে।
রাত অনেক গভীর। কেল্লার অধিপতি ও অফিসাররা একটা । প্রশস্ত কামরায় বসে শরাব পান করছিল। দু’জন নর্তকী নাচছিল ওদের সামনে। কামরায়, তবলা, সরোদ ও অন্যান্য বাজনায় সুর তুলছিল বাদক দল। কামরা ভেসে যাচ্ছিল সুসজ্জিত আলোয়।
সাধারণ সৈন্যরা নিশ্চিন্তে ডুবেছিল গভীর ঘুমে।
প্রহরীরা শীতের তীব্ৰতা থেকে বাঁচার জন্য খোলা জায়গা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে বসে বিমুচ্ছিল।
বাইরে তখন কনকনে ঠাণ্ডা ও হিমেল বাতাস বইছে। তুষার পড়ছে হাড় কাঁপানো শীতের সাথে ।
পাহারাদাররা জানতো, শীতকালে যুদ্ধের কোন ভয় নেই। তাই পাহারায়ও কোন সতর্কতার দরকার মনে করতো না কেউ । কেবল রুটিন ওয়ার্ক হিসাবেই পালাবদল ঘটতো। পাহারাদারের।
“আমরা এ জন্যই নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যু কামনা করতাম। দুনিয়াটাকে সে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছিল। আহ কি আরাম! এ আরাম রেখে জান্নাতে যেতে চায় কোন আহাম্মাক!”
দুৰ্গাধিপতি শরাবের পাত্র উপুড় করে বললো, “এখন আবার সালাহউদ্দিন আইয়ুবী লক্ষঝফ শুরু করেছে। খোদা যে কবে। ওকে উঠিয়ে নেবেন!”
তাকে আল্লাহর উঠানোর দরকার নেই, আমরাই উঠিয়ে নেবো।” এক কমাণ্ডার বললো, “কয়টা দিন সবুর করো! শীতকালটা যেতে দাও, দেখো কি করি।”
কেল্লার প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে এক প্রহরী আরেক প্রহরীকে বললে, “ঐ দেখো! আগুন জলছে।” “জ্বলতে দাও।” তার সাখী বললো, “কোন কাফেলা হবে হয়ত!’
ইতিমধ্যে আগুনের তিন-চারটি গোলা শূন্যে উঠে গেলো। ওরা অবাক হয়ে দেখলো, গোলাগুলো কেল্লার দিকে ছুটে আসছে।
প্রহরীদের মাথার ওপর দিয়ে ছুটে ওগুলো কেল্লার ভেতর গিয়ে পড়লো। এরপর ছুটে এলো আরও গোলা। এই অগ্নি গোলার একটা গিয়ে পড়ল কেল্লার ভেতর এক জায়গায় স্তুপ করে রাখা কাঠের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে তাতে আগুন ধরে গেল।
হঠাৎ বিপদ সংকেত বেজে উঠলো, বেজে উঠলো ঘন্টাধ্বনি। কেল্লা অধিপতির আনন্দ মাহফিলে ছন্দপতন ঘটলো। হৈ চৈ ও হুলস্থূল কাণ্ড বেঁধে গেল সেখানে। সকলেই দৌড়ে গেল কেল্লার প্রাচীরের ওপর।
অকস্মাৎ ছুটে এল ঝাঁক ঝাঁক তীর। এই আকস্মিক বেপরোয়া তীর বৃষ্টিতে পড়ে হতাহত হলো বেশ ক’জন অফিসার। প্রাচীরের ওপর শোনা গেল তাদের মরণ চিৎকার।
এসময় গেটের দিক থেকে ভেসে এল গেট প্রহরীদের চিৎকার। তারা দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে, ‘গোটে আগুন লেগে গেছে, সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী গেটের ওপর অগ্নি বর্ষণ করেছে, আগুনের বারুদ নিক্ষেপ করেছে, চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।”
শোরগোল ও চিৎকার শুনে দুর্গের ঘুমন্ত সৈন্যরা জেগে উঠলো। বাইরে থেকে তখনাে অবিরাম তীর বৃষ্টি হচ্ছে। এ তীর বৃষ্টিতে কারো পক্ষে প্রাচীরের ওপর দাঁড়ানাে অসম্ভব।
সুলতান আইয়ুবীর মিনজানিকের নিক্ষিপ্ত গােলা ও তীর কেল্লাকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেললো। কেল্লার কমাণ্ডাররা চিৎকার করে সৈন্যদের সাহস বাড়াতে চাইল। কমাণ্ডারের ধমকে সৈন্যরা এলাপাথাড়ি তীর চালাতে লাগলো।
“অস্ত্ৰ সমৰ্পণ করো।” সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী থেকে কোন এক কমাণ্ডার উচ্চস্বরে বলে উঠলো, “অস্ত্ৰ সমৰ্পণ করো!
বাইরে থেকে তোমাদের কোন সাহায্য আসবে না! চারদিক থেকে কেল্লা আমরা ঘেরাও করে ফেলেছি। হাতিয়ার ফেলে দাও! হাতিয়ার ফেলে জীবন বাঁচাও।”
এর কি প্রতিক্রিয়া হয় দেখার জন্য আইয়ুবীর সৈন্যরা সাময়িক বিরতি দিল তীর বর্ষণে । কমাণ্ডার আবার ঘোষণা করলো, ‘সুলতান আইয়ুবীর কাছে অস্ত্ৰ সমৰ্পণ করো! হাতিয়ার ছেড়ে দিলে কাউকে বন্দী করা হবে না। যাদের ইচ্ছা! এখান থেকে চলে যেতে পারবে, আর যারা চাও তাদেরকে আমরা আমাদের সেনাদলে ভর্তি করে নেবো। হেম্মাত দুর্গ এখন আমাদের দখলে । ওখানকার সকল সৈন্য এখন আমাদের সাখী। চাইলে তােমরাও আমাদের সাথী হতে পারো ।”
কিন্তু কেল্লার ভেতর থেকে এর কোন সাড়া মিলল না। সারা রাত থেমে থেমে তীর বর্ষণ ও ঘোষণা চলতেই থাকলো । কিন্তু কেল্লার সৈন্যরা হাতিয়ার সমৰ্পন করলো না। ভোর হলো। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়লে কেল্লার অধিপতি বাইরের দৃশ্য দেখলেন। দেখলেন কেল্লার প্রাচীরের ওপর তার সৈন্যদের লাশের সংখ্যা। তিনি তাড়াতাড়ি সাদা নিশান উড়িয়ে দিতে আদেশ দিলেন।
এ দুর্গাঁও দখল হয়ে গেল। কেল্লার অধিপতি, কমাণ্ডার এবং সৈন্যরা অন্ত্র সমর্পণ করলো। সুলতান আইয়ুবী যখন কেল্লার মধ্যে প্ৰবেশ করলেন তখন কেল্লার অধিপতি ও কমাণ্ডারদের শুধু এইটুকুই বললেন, “আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন!”
কমাণ্ডাররা বললো, “আমরা আপনার বাহিনীতে শামিল হয়ে জেহাদে অংশ নিতে চাই।”
তিনি তাকালেন উপস্থিত কমাণ্ডার ও সৈন্যদের দিকে। বললেন, “বন্ধুরা! তোমাদের এ আবেগকে স্বাগত জানাই। এই প্রচণ্ড শীতে যুদ্ধ করতে হলে সে জন্য উপযুক্ত ট্রেনিং দরকার। আমার বাহিনী দীর্ঘদিন ট্রেনিংয়ের পর ময়দানে এসেছে। তাও সবাইকে সঙ্গে আনিনি। যখন দরকার হবে। তখন তোমাদের অবশ্যই ময়দানে ডেকে নেয়া হবে। আপাততঃ তোমরা দামেশকে আমার যে বাহিনী আছে তাদের কাছে চলে যাও। ওখানে তোমাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হবে।”
সুলতান আইয়ুবী ওদেরকে দামেশকে পাঠিয়ে দিলেন। ওদের আনুগত্যের ব্যাপারে এখনো তিনি নিশ্চিত নন, কিন্তু এ কথা তিনি তাদের বললেন না ।
এ কেল্লায় যথেষ্ট পরিমাণ অন্ত্র ও খাদ্য সামগ্ৰী মজুদ ছিল। ছিল শরাবের ছড়াছড়ি ও দু’জন নর্তকী।
সুলতানের নির্দেশে সমস্ত শরাব বাইরে ফেলে দেয়া হলো। দুই নর্তকীকে সৈন্যদের সাথে পাঠিয়ে দেয়া হলো দামেশকে। সুলতান আইয়ুবী হেমসের দুর্গকে দ্বিতীয় কেন্দ্ররূপে গ্ৰহণ করলেন। এ কেল্লার দায়িত্বও অর্পণ করলেন হেম্মাত দুর্গের সৈন্যদের ওপর।
সামনে এখন হলবের কেল্লা ও শহর। এখান থেকে একটু বেশী দূরে। সেখানে রয়েছে খলিফা আল মালেকুস সালেহ, তার খৃস্টান উপদেষ্টােবৃন্দ এবং রক্ষী সেনা। হলবের পতন মানেই খৃস্টানদের এক পুতুল খলিফার পতন। খৃস্টানদের ষড়যন্ত্রের একটি অধ্যায়ের অবসান।
হেমসের মত একই পদ্ধতি গ্ৰহণ করলেন সুলতান এ কেল্লা ও শহর বিজয়ে । সকলের অজ্ঞাতসারে অতি গোপনে তিনি অতর্কিতে চড়াও হলেন ওখানে। চড়াও হলেন গভীর রাতে যখন ওখানকার সৈন্য ও রক্ষীরা সবাই ঘুমিয়েছিল।
দু’টি দুর্গ জয় করার পর তাঁর সেনাবাহিনীর মনােবল আরও বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। দুর্বার গতিতে তারা গিয়ে টুটে পড়লো কেল্লায়। পরদিন ভোরে তুমুল সংঘর্ষের পর তিনি হলবের কেল্লা অধিকার করতে সমর্থ হলেন।
কমাণ্ডারসহ সেখানকার পুরা সেনাদলকেও তিনি আগের মত দামেশকে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। যে গোপনীয়তা এসব বিজয়কে সহজ করে দিয়েছিল। সেই গোপনীয়তা আর রক্ষা করা গেল না। অস্ত্ৰ সমৰ্পনকারী সৈন্যদের একজন পালিয়ে গিয়ে হলব শহরে খবর দিল, “সুলতান আইয়ুবী হেমস ও হলব দুর্গ অধিকার করে এখন হলব শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন।”
সুলতান আইয়ুবী জানতে পারেননি, তার গোপনীয়তা রক্ষাকারী দলের ফাঁক গলে কেউ বেরিয়ে গেছে। তিনি সামনে অগ্রসর হওয়ার আগে সেনাবাহিনীকে একটু বিশ্রামের সুযোগ দিতে চাইলেন। কারণ একটানা বিরতিহীন সফর করেছে এই বাহিনী। প্ৰচণ্ড শীত উপেক্ষা করে হেমস ও হলবের কেল্লা অবরোধ ও অধিকার করেছে। শীতের রাতে অবিরাম যুদ্ধ করে ওরা বেশ কাবু হয়ে গেছে। ওদের চাঙ্গা করার জন্য একটু বিশ্রামের এখন খুবই প্রয়োজন।
তা ছাড়া হলব শহর তো আর কেল্লা নয়। এর অবরোধ ও আক্রমণের ধরণ হবে ভিন্ন। এই ব্যবস্থা ও প্ল্যান ওদের বুঝিয়ে দিতে হবে।
সুলতান আইয়ুবী অত্যন্ত সাবধানতার সাথে সুপরিকল্পিতভাবে এগুতে চাচ্ছিলেন। কারণ আসল যুদ্ধ তো সামনে। ওখানে মুসলিম রক্ষী ছাড়াও আছে খৃস্টান সৈন্য, তাদের গোয়েন্দা বাহিনী এবং উপদেষ্টারা।
হলব শহরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল, সুলতান আইয়ুবী আসছেন।”
খলিফা আস সালেহ ছাড়াও ওখানকার আমীর ওমরা, রক্ষী বাহিনী ও খৃস্টান উপদেষ্টারা এ খবর শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। কি! সুলতান আইয়ুবী এই শীতের মধ্যেই আক্রমণ চালিয়েছে?”
কিন্তু মনে মনে একটা সাস্তুনা তাদের ছিল, সে তো মরুভূমির যোদ্ধা, এই পার্বত্য এলাকায় যুদ্ধ করে সে সুবিধা করতে পারবে না। কিন্তু পরক্ষণেই তাদের মনে হলো, হলবের সৈন্যরাও তো এই এলাকায় এমন প্ৰচণ্ড শীতে যুদ্ধ করতে পারবে না! এই নিয়ে তারা খুব চিন্তায় পড়ে গেলো।
তারা ঠিক করলো, সুলতান আইয়ুবীকে আমাদের সুবিধা মত ময়দানে নিয়ে যেতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এখনি খৃস্টান সৈন্যদের খবর দিতে হবে। ইউরোপ থেকে আসা যেসব খৃস্টান সেনা রিমাণ্ডের সৈন্য বিভাগে আছে, ময়দানে নিয়ে আসতে হবে তাদের।
সুতরাং জলদি করে রিমাণ্ডের কাছে কাসেদ পাঠালো তারা। চিঠিতে লিখলে, “সুলতান আইয়ুবী, হলবের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। সে হলব অবরোধ করলে তাকে পিছন থেকে আক্রমণ করতে হবে আপনার। দেরী করবেন না, হলবের সৈন্যরা বেশীক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না ওকে।”
এরপর খলিফা এবং তার সমস্ত আমীরের রক্ষী সেনাদের একত্র করলো তারা। ওদের বললো, ‘সুলতান আইয়ুবী হলব শহর অবরোধ করতে আসছেন। রিমাণ্ডের কাছে এ খবর পাঠানো হয়ে গেছে। তিনি আসা অবধি তাকে ঠেকিয়ে রাখতে হবে।
রিমাণ্ডের সৈন্য এসে গেলে আর চিন্তা নেই। আইয়ুবীকে এবার উপযুক্ত শিক্ষা দেবেন তিনি।”
খৃস্টান উপদেষ্টারাও গোপনীয়তা বজায় রাখার ওপর খুবই গুরুত্ব দিলেন। বললেন, ‘শহরে সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা আছে। তাদের মাধ্যমে আমাদের প্রস্তুতির খবর সে জেনে ফেলতে পারে। এজন্য এখন থেকে আর কাউকে শহরের বাইরে যেতে দেয়া যাবে না ।”
শহর কোতোয়াল সারা শহরে ঘোষণা করে দিল, “এখন থেকে কেউ আর শহরের বাইরে যেতে পারবে না। কেউ নিষেধাক্কা অমান্য করে বেরোবার চেষ্টা করলে তাকে কঠোর হাতে দমন করা হবে। শহরের দেয়াল টপকে কেউ পালাতে চেষ্টা করলে কোন সতর্ক সংকেত ছাড়াই তীর মেরে তাকে হত্যা করা হবে।”
একই ঘোষণা মসজিদ থেকেও বার বার প্রচার করা হলো। আরো প্রচার করা হলো, ‘সুলতান আইয়ুবী সাম্রাজ্যবাদী নেশায় পাগল হয়ে তোমাদের ওপর আক্রমণ করতে আসছে। নিজেদের জান মাল হেফাজত করার জন্য তৈরী হও সবাই। সে ইসলামী খেলাফত চায় না, খলিফার বিরুদ্ধে অন্ত্র ধরেছে। এই মুরতাদকে খতম করা আজ প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফরজ হয়ে গেছে। আসুন, যার যা আছে তাই নিয়ে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।”
খৃস্টানরা গুজব ছড়ানােয় উস্তাদ! তারা ঘরে ঘরে, অলিতে গলিতে, মসজিদে, হাটবাজারে সর্বত্র এমন সব গুজব ছড়াতে লাগলো, যাতে মানুষ তাকে ঘূণা করতে শেখে, তার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।
তারা প্রচার করতে লাগলো, সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা যে শহরে প্রবেশ করে, সে শহরের সমস্ত যুবতী মেয়েদের একত্রিত করে তাদের শ্ৰীলতাহানি করে। শহরে তারা লুটতরাজ চালায়, বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। সুলতান আইয়ুবী নবুয়ত দাবী করেছে। নতুন এক ধর্ম সৃষ্টি করেছে সে, যারা তার এ ধর্ম কবুল করবে। তারা কাফের হয়ে যাবে।” এমন সব উদ্ভট গুজব ছড়িয়ে তারা জনমতকে বিভ্ৰান্ত করছিল।
সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টির কাজ তো ছ’মাস আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। এর ফলে জনমনে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল সে ক্ষোভ এবার যুদ্ধের উন্মাদনায় গিয়ে ঠেকল। হলবের সাধারণ জনতা আইয়ুবীর আক্রমণের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্ৰস্তৃত হয়ে গেল। যুবকরা অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শরের রাস্তায় রাস্তায় মহড়া দিতে লাগল।
শহরের জনগণের এই যুদ্ধ উন্মাদনা সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দাদেয় চিন্তায় ফেলে দিল । শহর থেকে বেরোনোর নিষেধাজ্ঞা নিস্ক্রিয় করে ফেলল তাদের। সুলতানের কাছে শহরের পরিস্থিতি জানাবে তার কোন সুযোগই নেই। একদিকে সুলতানের প্রতি মানুষের প্রচণ্ড রাগ ও আক্ৰোশ, অন্যদিকে শহর থেকে বেরোনোর নিষেধাজ্ঞায় তারা বেশ বেকায়দায় পড়ে গেল।
এই অসহায় পরিস্থিতিতেও এক গোয়েন্দা শহর থেকে বেরোনোর কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু শহরের দেয়াল টপকাতে যেয়ে সে সৈন্যদের তীরের আঘাতে মারা পড়ল।
গোয়েন্দা কমাণ্ডার, যিনি মশহুর আলেম হিসাবে সকলের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন, তিনিও সুলতানের বিরুদ্ধে প্রচারণায় শামিল হয়ে গেলেন। ফলে তিনি যে সুলতানের গোয়েন্দা এ কথা বুঝার উপায় রইল না কারো।
আস সালেহ খৃস্টানদের উপদেষ্টার পরামর্শ অনুযায়ী মুশালের শাসনকর্তা সাইফুদ্দিনকে সংবাদ পাঠালেন, তিনি যেন আস সালেহের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। হাসান বিন সাকবাহির ফেদাইন দলের নেতা শেখ মান্নানকেও সংবাদ দেয়া হলো। তাকে বলা হলো, তিনি যে মূল্য দাবী করেন। সেই মূল্যই তাকে দেয়া হবে। সুলতান আইয়ুবীকে খুন করা হােক, তাতে তার যত লোকই শেষ হয়ে যাক না কেন সে যেনো পরোয়া না করে।
শেখ মান্নান আরো একবার সুলতানকে হত্যার চেষ্টা করল। কিন্তু তার এ আক্রমণও ব্যর্থ হয়ে গেল। সুলতান আইয়ুবীর এক দেহরক্ষীকে সম্মোহিত করে এ প্রচেষ্টা চালানো হয়।
সে ব্যর্থ হলে শেখ মান্নান ফেদাইন দলের এমন একজনকে ডাকলো, জীবন ও মৃত্যু কি জিনিস তাই সে বােঝে না। যদিও সে মানুষ কিন্তু কোন মানবিক বোধ কাজ করে না তার মধ্যে। মরে যাওয়া বা কাউকে মেরে ফেলা তার কাছে খেল তামাশার ব্যাপার। বহু খুনের পলাতক আসামী সে। শেখ মান্নান তাকে বললো, সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করতে পারলে তুমি যা চাও তাই পাবে।”
প্রস্তাবটি লোভনীয়। খুনী তার নয়জন সহযোগী নিয়ে রওনা হলো আইয়ুবীকে খুন করতে।
আস সালেহের দলে হিংসুটে ও ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তি হিসাবে গুমাস্তগীনের বদনাম ছিল । সালেহের গভর্ণরের পদে অধিষ্ঠিত ছিল এই ব্যক্তি ।
প্রকাশ্যে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে থাকলেও সে আসলে বন্ধু ছিল না কারোরই। আস সালেহকে সন্তুষ্ট করে ফায়দা লুটার জন্যই সে তার সহযোগী হয়েছিল।
খৃস্টানদের সাথেও সে বেশ ভাল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলল। এই বন্ধুত্বের প্রমাণ দেয়ার জন্য সে সালেহের কয়েদখানায় নূরুদ্দিন জঙ্গী যেসব খৃস্টানকে যুদ্ধ বন্দী হিসাবে কয়েদ করেছিল সবাইকে মুক্ত করে দিয়েছিল।
হলবে সুলতান আইয়ুবী সৈন্য নিয়ে ছুটে আসছে। খবর পেয়ে সে নিজের বাহিনী নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্ৰস্তৃত হলো।
এ ছিল এক প্ৰলয়ংকরী সাইক্লোন। চারদিকে কেবল যুদ্ধের তাণ্ডব। সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন শক্তি এক সাথে উঠে দাঁড়িয়েছে। এত শক্রর মোকাবেলা করা কোন চাট্টিখানি কথা নয়!
গোয়েন্দা বিভাগ অকেজো হয়ে যাওয়ায় সুলতান হলব শহরের কোন সংবাদই পাচ্ছিলেন না । জানতে পারছিলেন না তার বিরুদ্ধে শত্ৰু শিবিরে কি হচ্ছে। কিন্তু তবু তিনি খুব বেশী বিচলিত হননি। মোটামুটি সন্তুষ্ট চিত্তেই পরবতী অভিযানের পরিকল্পনা করে যাচ্ছিলেন।
তখন পর্যন্ত তার ধারনা ছিল, হলব্বাআসীর অজ্ঞাতেই সেখানে তিনি আঘাত হানতে সক্ষম হবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার এ ধারনা আর টেকেনি। সাধারণ আকারের যুদ্ধের পরিবর্তে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলেন তিনি।
কিছুটা বিশ্রাম ও অবকাশের পর মুজাহিদরা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল। সৈন্যদের নিয়ে হলব শহরের দিকে যাত্রা করলেন তিনি।
যত কম সম্ভব সৈন্য ক্ষয় করে বিজয় ছিনিয়ে আনা ছিল তার টার্গেট । এ জন্য আগের মতই সৈন্য চালনা করলেন তিনি। সাবধানে এগিয়ে যেতে বললেন প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দলকে ।
কমাণ্ডোরা আগেই রওনা হয়ে গিয়েছিল, এবার সসৈন্যে তিনি এগিয়ে চললেন হলবের পথে ।
সামনে কংকরময় পাহাড়ী এলাকা। উচু নিচু টিলার ফাঁক দিয়ে রাস্তা । মাঝারী একটি নদী বয়ে গেছে পাশ দিয়ে। নদীপারের কাছাকাছি এসে পৌঁছলেন আইয়ুবী।
১১৭৫ খৃস্টাব্দের জানুয়ারী মাস। শীতের তীব্ৰতা বেড়ে গেছে আরও। সুলতান আইয়ুবীর সাথে ময়দানে আছে তার এক চতুর্থাংশ সৈন্য। তিন ভাগই রয়ে গেছে রিজার্ভ বাহিনীতে। দামেশকে বসেই ওরা আইয়ুবীর অগ্রযাত্রা ও বিজয়ের খবর পাচ্ছিল। এই বিজয়াভিযানে সরাসরি অংশ নিতে পারেনি বলে আফসোসের সীমা ছিল না তাদের। তারা উনমুখ হয়ে বসেছিল, যদি ডাক আসে!
নদী পার হতে যাবেন আইয়ুবী, দেখলেন অগ্রগামী বাহিনী অগ্রযাত্রা মুলতবী রেখে পাহাড়ের আড়ালে অবস্থান নিয়ে আছে। এক গোয়েন্দা এসে খবর দিল, “নদীর ওপারে পাহাড়ের কয়েকটি টিলা পেরোলেই রয়েছে এক বিস্তৃত নিম্নাঞ্চল। কিভাবে খবর পেয়েছে জানিনা, কিন্তু সেখানে একদল শত্ৰু সেনা ওঁৎ পেতে বসে আছে।”
সুলতান চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি আসবেন এটা তো তাদের জানার কথা নয়! তাহলে এটা হলো “কি করে? কেমন করে হলববাসী খবর পেলো এই আগমনের?
তিনি তাড়াতাড়ি তার বাহিনীকেও পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে বললেন। যতটা সম্ভব লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে গেল কাফেলা। দূর থেকে তাকালে শূন্য টিলা ছাড়া আর কিছুই দেখার উপায় নেই। এতবড় একটা সেনাবাহিনী লুকিয়ে আছে বুঝার কোন উপায় নেই বাইরে থেকে।
শীতকাল। নদীতে পানি বেশী নেই। স্থানে স্থানে বড় বড় পাথর মাথা তুলে আছে পানির ওপর। মানুষ ও ঘোড়া অনায়াসে পার হয়ে যেতে পারে ওই পানি ভেঙ্গে । নদী পার হওয়াটা কোন সমস্যা ছিল না, কিন্তু সমস্যা দেখা দিল সামনে শক্রর অবস্থান। ভাবতে লাগলেন সুলতান। একবার ভাবলেন, এখান দিয়ে নদী পার না হয়ে অন্য কোন দিক দিয়ে পার হয়ে যাবেন। গোয়েন্দাকে বললেন, এরকম কোন জায়গা খুঁজে বের করো। গোয়েন্দা ঘুরে ফিরে এসে খবর দিল, “আশপাশে এরকম কোন জায়গা নেই। খাঁড়া পাহাড় ডিঙিয়ে বরফ ভেঙে ওপারে গিয়ে উঠার মত সুবিধাজনক কোন জায়গা খুঁজে পেলাম না।”
অগত্যা আইয়ুবী সিদ্ধান্ত নিলেন, ওদের সাথে, একটা বোঝাপড়া করেই সামনে এগুবেন তিনি।
খুব তাড়াতাড়িই শীতের রাত নেমে এল। সুলতানের বাহিনীর।
কোন সাড়াশব্দ নেই। চুপচাপ প্রহর গুণছে দুশমন কাফেলাও । অনেক রাতে ফিরে এল আইয়ুবীর এক গোয়েন্দা। বললো, “টিলার ওপাশে দুশমন বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্যই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছু প্রহরী পাহারায় থাকলেও তাদের মধ্যে কোন উত্তেজনা বা টান টান ভাব নেই। গা ছাড়া ভাবে এদিক-ওদিক টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে অল্প ক’জন সৈন্য ।”
তিনি সেই গোয়েন্দার সাথে একদল কমাণ্ডো বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন। শত্রু সৈন্যরা বেশ শান্তিতেই ছিল। এমন তুষার রাতে কারো দ্বারা তারা আক্রান্ত হবে, এ কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি ।
এখন মধ্য রাত। খোলা মাঠে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। শক্ৰ সেনারা ক্যাম্পের ভেতর গভীর ঘুমে অচেতন। কমাণ্ডারও ঘুমে বিভোর। রাতিজাগা প্রহরীরা জুবুথুবু হয়ে গরম কাপড়ে নাক মুখ ঢেকে শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে।
এক প্রহরী শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে থারথার করে কাপছিল। পিছন থেকে কে যেন তার গলা পেচিয়ে ধরলো। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্য একজন চ্যাংদোলা করে উঠিয়ে নিল তাকে । তখনো সে বুঝতে পারেনি, আইয়ুবীর কমাণ্ডো বাহিনীর পাল্লায় পড়েছে সে।
একটু তফাতে এনে ওরা তাকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমাদের ঘোড়াগুলো কোথায়?”
তার বুকে তলোয়ারের মাথা ঠেকানাে। প্রহরী জানতো, যে কোন সময় সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা এসে পড়তে পারে। সে বুঝতে পারলো, আইয়ুবীর সৈন্যদের পাল্লায় পড়ে গেছে।
ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল তার। মিনমিন করে সে বললো, “ভাই, আমিও তোমাদের মত মুসলমান। আমাকে মেরো না। এটা রাজা বাদশাহর বিবাদ! আমরা শুধু শুধু কেন একে অন্যের রক্ত ঝরাবো!”
‘ভয় নেই, তোমাকে আমরা মারবাে না। তবে বাঁচতে চাইলে তোমাকে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে। বলো, তোমাদের ঘোড়াগুলো কোথায়?”
সে বললো, “ঘোড়া এক জায়গায় বাঁধা নেই। কখন আইয়ুবীর সৈন্যরা এসে পড়ে এই ভয়ে সৈন্যদের সাথেই আছে ঘোড়াগুলো। প্রত্যেক তাবুর পাশেই সৈন্যরা নিজ নিজ ঘোড়া বেঁধে রেখেছে।”
কমাণ্ডোরা তাকে নিয়ে গেল তাবুর পাশে। জিজ্ঞেস করলো, “তোমাদের কমাণ্ডার কোন তাঁবুতো?”
সে কমাণ্ডারের তাবু দেখিয়ে দিল। ওরা তাকে পিছনে সরিয়ে নিয়ে এসে বললো, ‘এবার এখানে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখো।”
সৈন্যদের তাবু থেকে সামান্য দূরে ওরা ছােট আকারের একটা মেনজানিক স্থাপন করলো। এরপর কমাণ্ডোরা তাতে গোলা ভরে ছুড়ে দিল ক্যাম্পের দিকে। প্রথম গোলা ক্যাম্পে আঘাত হানার সাথে সাথেই দ্বিতীয় গোলা নিক্ষেপ করলো।
জ্বলন্ত অগ্নিগোলা ক্যাম্পে আঘাত হানতেই আগুন ধরে গোল তাতে। প্রহরীরা ‘কে এলো! কে এলো!” চিৎকার শুরু করে দিল ।
এই অগ্নি গোলাগুলো ছিল বিশেষ ধরনের। একটি হাড়িতে পেট্রোল ভেজা ছোট ছোট কাপড়ের টুকরা ভরে গোলার সাথে ছুঁড়ে মারা হতো। মাটিতে পড়েই হাড়ি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতো আর কাপড়ের টুকরো গুলোয় আগুন ধরে ছড়িয়ে পড়তো চারদিকে ।
বিভিন্ন তাঁবুতে আগুন ধরে গিয়েছিল। বাতাসের তোড়ে সে আগুন আরও বিস্তার লাভ করতে লাগলো।
ঘুমন্ত সৈনিকরা জেগে উঠল। ক্যাম্পে শোরগোল ও দৌড়াদৌড়ির হুলুস্কুল পড়ে গেল।
ঘোড়াগুলো দড়ি ছিড়ে ছুটতে লাগল দিগ্বিদিক। সেই দড়িতে পেঁচিয়ে এবং খুরের আঘাতে আগুন জ্বলা কাপড়গুলো এদিক ওদিক ছিটকে পড়তে লাগল। ফলে অক্ষত তাবুগুলোতেও আগুন ধরে গেল ।
সৈন্যরা দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে লাগলো।
এ সময়ের জন্যই অপেক্ষা করছিল কমাণ্ডো বাহিনী । ওরা বেপরোয়া তীর চালাতে শুরু করলো। আহত সৈন্যদের আর্তচিৎকারে নরক গুলজার হয়ে গেল ক্যাম্পের পরিবেশ ।
দীর্ঘ প্রায় এক মাইল জুড়ে ক্যাম্প করে সুলতানের বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করছিল এ ফৌজ।
প্রথম গোলাতেই আক্রান্ত হয়েছিল কমাণ্ডারের তাবু। তিনি ছুটে বাইরে এসেই বুঝতে পারলেন সুলতানের বাহিনীর তোপের মুখে পড়ে গেছেন তিনি এবং তার বাহিনী।
তিনি কাউকে কিছু না বলে ছুটে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলেন। ওখানে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন কমাণ্ডো বাহিনীর ধ্বংসলীলা এবং নিজের বাহিনীর শোচনীয় পরিণতি ।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top