১০. সর্প কেল্লার খুনী

কিছুক্ষণ পর।

তাদের চোখে নেমে এলো রাজ্যের ঘুম। যখন তাদের ঘুম ভাঙ্গল তখন বেলা অনেক। সূর্য দিগন্ত থেকে অনেক উপরে উঠে গেছে। সারা রাত ও দিনের অনেক বেলা পর্যন্ত তারা শুয়েই কাটিয়ে ছিলো।

মরুভূমির উত্তপ্ত রোদ, শরীর ঝলসানো গরমও তাদের জাগাতে পারলো না। নির্দিষ্ট সময় পরে নেশার রেশ কাটতেই তারা হতচকিত হয়ে উঠে বসলো। সেখানে কোন কাফেলা ছিল না, তাদের নিজেরদেরও উট ছিল না। আর তারা সে জায়গায়ও ছিল না, যেখানে তারা রাত কাটানোর জন্য থেমে ছিল।

‘একি! কাফেলা কোথায়? আমাদের উট কোথায়?’ উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠলো খলিল।

‘আমরা যেখানে থেমেছিলাম এটা সে জায়গা নয়! এ আমরা কোথায় এলাম!’ বললো তার সঙ্গী।

তারা উঠে দাঁড়ালো। আশে পাশে মাটি ও বালির টিলা। দু’জন দৌড়ে একটি টিলার উপরে গিয়ে উঠলো। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো। একটি নিরেট পাহাড়ী অঞ্চল ও সুদূর বিস্তৃত বালুকাময় প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না তাদের।

‘সেই বৃদ্ধ লোকটি ছিলাম আমি, যার সঙ্গে তুমি কাফেলা চলার পথে কথা বলেছিলে।’ রিমান্ডের গোয়েন্দা বিভাগের কমান্ডার উইগুসার খলিলকে বললো, ‘আমি তোমাদের কথাবার্তায় বুঝতে পেরেছিলাম, তোমরা গোয়েন্দা। সে জন্যই তুমি বার বার জানতে চাচ্ছিলে, আমরা কারা এবং কোথায় যাচ্ছি?’

‘সে তো তুমি ছিলে না।’ খলিল বললো, ‘সে ছিল এক বৃদ্ধ লোক।’

‘সেটা আমার ছদ্মবেশ ছিল!’ উইগুসার বললো, ‘আমি খুশী যে, তোমরা দু’জনই স্বীকার করেছ, তোমরা গোয়েন্দা এবং এখনও তোমরা গোয়েন্দাগিরি করতেই এখানে আছো। আমি তোমাদের জানাতে চাই, যে দুই মেয়ে তোমাদের বেহুশ করেছিল তাদেরই একজন এই মেয়ে!’

‘আমরা এখন আর গোয়েন্দা নই।’ খলিল বললো, ‘এখন আমরা খলিফার অনুগত সৈনিক।’

‘তুমি বাজে বকছো!’ উইগুসার বললো, ‘আলী বিন সুফিয়ানকে আমি সব সময় শ্রদ্ধার চোখে দেখি। প্রশংসা করি তার নৈপুণ্যের। কিন্তু তোমাদের আরো প্রশিক্ষণ দরকার ছিল। তুমি এখনও নিজেকে গোপন করতে এবং ছদ্মবেশ বদলাতে শিখনি।’

উইগুসার তাকে জানালো, ‘সে কাফেলায় আমরা যুদ্ধের অনেক সাজ সরঞ্জাম ও অর্থ সম্পদ নিয়ে সুদান যাচ্ছিলাম। কাফেলায় যে সব লোক যাযাবরের পোশাক পরেছিল, তারা সব সামরিক উপদেষ্টা ছিল এবং সকলেই খৃস্টান ছিল। আর আমিই সুদানী ফৌজ গঠন করে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ভাই তকিউদ্দিনকে এমন শোচনীয় অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলাম যে, শেষে অর্ধেক সৈন্য সুদান ফেলে পালাতে বাধ্য হয়।

যদি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী নতুন রণকৌশল প্রয়োগ না করতেন তবে তকিউদ্দিনের অবশিষ্ট সৈন্যও সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারতো না।

তোমাদের এ বিরাট বিপর্যয় ও পরাজয়ের কারণ ছিল ওই দুই মেয়ে। ওরা তোমাদের কাবু করতে না পারলে এতসব যুদ্ধ সামগ্রী নিয়ে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা ছিল আমাদের।’

উইগুসার তাকে আরো বললো, ‘সে রাতে বিশ্রামের সময় আমাদের কেউ ঘুমায়নি। তোমাদের দু’জনকে বেহুশ করার জন্যই আমরা আমাদের দুই মেয়ে সদস্যকে পাঠিয়েছিলাম তোমাদের কাছে। তোমরা বেহুশ হওয়ার সাথে সাথেই কাফেলা আবার যাত্রা শুরু করেছিল। কারণ আমরা জানতাম, এই অস্ত্র সুদানে না পাঠাতে পারলে বড় রকমের সাফল্য থেকে বঞ্চিত হবো আমরা।’

খলিলের সে সব ঘটনা খুব ভাল মতই মনে আছে। এত বড় শত্রু কাফেলা হাত থেকে বেরিয়ে গেছে এ কথা সব সময়ই কাঁটার মত বিঁধতো তার বুকে। তার জীবনে এমন ঘটনা আর ঘটেনি।

এই হাহাকারের সাথে যুক্ত আরেক অপরাধবোধ। এ ঘটনার রিপোর্ট ওরা হেডকোয়ার্টারে জানায় নি। শত্রুরা তাদেরকে চরম ধোকা দিয়েছে এই অপমানের কথা তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ জানতো না। নিজেদের অযোগ্যতার কাহিনী বর্ণনা করে অপমান ক্রয় করার ইচ্ছে হয়নি তাদের, তাই এ কাহিনী তারা গোপন করেছিল।

যে দুই মেয়ে জীবনে কলংকের এতো বড় দাগ দিয়েছিল, তাদেরই একজন এখন তাদের সামনে! খলিল ও তার সাথী দু’জনেরই মনে হলো কথাটা। কিন্তু এখন কিছু করার নেই তাদের। আবারো ওরা ধরা পড়ে গেছে সেই ধুরন্ধর খৃস্টান গোয়েন্দার হাতে।

আগের বার ওদের হাতে কোন প্রমাণ ছিল না, তাই প্রাণে মারার প্রয়োজন বোধ করে নি ওরা। কিন্তু এবার কিছুতেই প্রাণ নিয়ে পালাতে দেবে না।

এসব ভাবতে ভাবতে খলিল মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, ‘মরতে যদি হয় লড়াই করেই করেই মরবো, কিছুতেই অস্ত্র সমর্পণ করবো না।

তার সাথীও একই রকম চিন্তা করছিল। সেও মনে মনে আমৃত্যু লড়াই করার সংকল্প গ্রহণ করলো।

‘আমার একটা শর্ত তোমরা মেনে নাও।’ উইগুসার বললো, ‘আমি তোমাদের এমন দয়া করব যা কোনদিন করিনি। তোমরা দু’জনই আমার গোয়েন্দা দলে শামিল হয়ে যাও। যত বেতন চাও দেবো। যদি চাও তো দামেশক পাঠাবো, অথবা যদি চাও কায়রো পাঠিয়ে দেবো। সেখানে তোমরা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা সেজে থাকবে, কিন্তু কাজ করবে আমাদের। আমাদের যে গোয়েন্দা সেখানে কাজ করছে তাদের সহযোগিতা করবে। আর যদি তাদের পিছনে কোন গোয়েন্দা লেগে যায় তবে আগেই তাদেরকে সতর্ক করে করে দূরে কোথাও সরিয়ে দেবে।’

সে বলেই যাচ্ছিল, আর দু’জনে নিরবে শুনছিল তার কথা।

‘কিন্তু আমরা যে আমাদের ওয়াদায় ঠিক থাকবো, তার গ্যারান্টি কি? আমাদের আপন ভুবনে একবার ফিরে যেতে পারলে আমরা তো আপনাকে পিঠও দেখাতে পারি?’ বললো খলিল।

উইগুসার একটু হাসলো। বললো, ‘সে ভয় আমার নেই। তোমরা আমার শর্ত মেনে নেয়ার সাথে সাথেই আমার দলের একজন হয়ে যাবে, তাই নয় কি? আমার দলে যোগ দেয়ার পর তোমাদের প্রথম এ্যাসাইনমেন্ট হবে, এখানে আইয়ুবীর যত গোয়েন্দা আছে তাদেরকে ধরিয়ে দেয়া। তোমরা এ কাজ বিশ্বস্ততার সাথে করতে পারলে যে সাফল্য আসবে আমাদের তাকে আমি ছোট করে দেখি না।

আর তারপর! তারপর তোমরা যেখানে যেতে চাও আমি বিনা দ্বিধায় পাঠিয়ে দেবো। কারণ আমি জানি, এরপর আইয়ুবীর কাছে তোমরা যতই সাফাই গাও, কেউ তোমাদের বিশ্বাস করবে না। দলে ফিরিয়ে নেয়া তো দূরের কথা, কোর্ট মার্শাল হবে তোমাদের। প্রাণের মায়ায় আমার ছায়াতলে থাকা ছাড়া তোমাদের কোন গতি থাকবে মা।’

‘তোমার এই শর্ত গুলোর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই এবং এসব শোনারও আমার কোন আগ্রহ নেই। আর গোয়েন্দাদের ব্যাপার! আমার জানাও নেই, এখানে আইয়ুবীর কোন গোয়েন্দা আছে কি না?’

‘মনে হয় এটাও তোমার জানা নেই, আমার শর্ত অমান্য করলে তার পরিণতি কি হবে? তোমার এই নধরকান্তি দেহটার কি অবস্থা হবে?’ উইগুসার বললো, ‘যদি তুমি মনে করে থাকো, তোমাকে হত্যা করা হবে, তবে তোমার সে আশা পূরণ হবে না। আমি তোমাকে এমন তন্দুরে নিক্ষেপ করবো, যেখান থেকে তুমি মুক্তিও পাবে না, নিঃশেষও হতে পারবে না।’

সে হেসে বললো, ‘তুমি কি আমাকে বুঝাতে পারবে যে, তুমি মানুষ নও? অথবা তোমার বুদ্ধি এতই বেশী যে, তুমি আমাকে ধোকা দিতে পারবে? যদি তোমার তেমন জ্ঞানই থাকতো তবে তুমি ওই অচেনা মেয়ের হাতে বোকা সেজে যেতে না। তার যৌবন ও সৌন্দর্যের জালে আটকা যেতে না।’

‘শোন আমার খৃস্টান বন্ধু!’ খলিল কর্কশ ভাষায় কথা বলে উঠলো, ‘আমরা দু’জন গোয়েন্দা সত্য কিন্তু আমি ও আমার বন্ধু মেয়েদের যৌবন জালে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম এ কথা মিথ্যা। মেয়েদের ব্যাপারে আমি পাষাণ! কিন্তু আমার দুর্বলতা ছিল অন্য জায়গায়।’

‘সেটা কি রকম বন্ধু!’ রহস্য-তরল কন্ঠে বললো উইগুসার।

‘অনেক দিন আগে, পনেরো ষোল বৎসরের একটি মেয়ে আমার সামনে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। আমি তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি! এক লোকের তলোয়ার কেড়ে নিয়ে একজনকে আহতও করেছিলাম।

তারা ছিল তিন জন আর আমি একা। তারা আমাকে ফেলে দিয়েছিল। যদি আমি বেহুশ না হতাম তবে সে মেয়েটাকে বাঁচাতে পারতাম। তারা তাকে মিয়ে গেল, আর আমাকে লোকেরা অজ্ঞান অবস্থায় বাড়ি নিয়ে গেল। সেই মেয়ের কারণেই কোন নারী নির্যাতিতা বললে আমার আর হুঁশ থাকে না, তাকে মুক্ত করে দেয়ার জন্য জীবন বাজি রাখতে পারি আমি।’

‘তোমার বাড়ি কোথায়?’

‘মনে করো দামেশকে!’ খলিল উত্তর দিল, ‘আমি এখন আর কোন কথা গোপন করবো না। দামেশকের কাছে একটি গ্রাম, আমি সেই গ্রামের বাসিন্দা, আর আমার বন্ধু বাগদাদী! আমি এ কথা তোমার ভয়ে বলছি না, আর তুমি আমাকে এতো সহজে ধরতেও পারবে না। শক্তি থাকে তো আমার হাত থেকে বর্শাটা কেড়ে নাও দেখি? যে তন্দুরের কথা তুমি বলছো, সেখানে আমি নই, দরকার হলে আমার লাশ যাবে।’

উইগুসারের মুখে বিদ্রুপের হাসি ছড়িয়ে পড়ল। খৃস্টান মেয়েটি হেসে বললো, ‘ওকে সজ্ঞানে শান্তিতে মরতে হবে।’

নর্তকী গভীর দৃষ্টিতে খলিলের দিকে তাকিয়েছিল। তার মন হারিয়ে গিয়েছিল দামেশকের এক গ্রামে। বললো, ‘আর মেয়েটির কি হলো?’

‘আমি তো বলেছি, সে মেয়েটাকে আমি বাঁচাতে পারিনি।’ খলিল বললো, ‘কিন্তু সে মেয়ের স্মৃতি আমার অন্তরে গেঁথে আছে।’

সে উইগুসারের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘সে রাতে যখন আমরা দু’জন তোমাদের কাফেলার সাথে ছিলাম, তোমাদের দু’জন মেয়ে এসে বললো, তাদেরকে বিক্রির জন্য ধরে নিয়ে যাচ্ছো। তখন আমার চোখের সামনে সেই মেয়ের স্মৃতি ভেসে উঠলো, যাকে আমি বাঁচাতে পারিনি। আমরা এই মেয়ে দু’টির মুখে সেই মেয়েটিরই চেহারা দেখলাম। যদি আমার মনে সেই মেয়েটির স্মৃতি জেগে না উঠতো, তবে মেয়ে দু’টি আমাদের বোকা বানাতে পারতো না।’

নর্তকীর সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো, সে পিছনে সরে গিয়ে পালংকের ওপর বসে পড়লো। তার চেহারার রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

‘এখন আর আমাকে মৃত্যুও বোকা বানাতে পারবে না।’ খলিল বললো, ‘তোমার কোন লোভনীয় শর্তই আমাকাএ বিভ্রান্ত করতে পারবে না।’

ওদিকে ভোজসভার হলঘরে উইগুসারের জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল। নতুন নর্তকীর নাচ দেখারও অপেক্ষা ছিল তাদের। কিন্তু কেউই লক্ষ্য করলো না, হল ঘরের দরজারদুই প্রহরী ডিউটিতে নেই।

খলিল ও তার সঙ্গীর সাথে তখনও তাদের বর্শা ও তলোয়ার বহাল তবিয়তেই ছিল। উইগুসার যখন দেখলো, তার লোভনীয় শর্ত প্রত্যাখ্যান করে তারা তাদের ঈমানী দায়িত্বের ওপরই অটল, তখন সে তাদের অস্ত্রশস্ত্র জমা দিতে বললো। দু’জনই অস্ত্র সমর্পণ করতে অস্বীকার করলো।

উইগুসার তখন শক্তি প্রয়োগে অস্ত্র কেড়ে নেয়ার জন্য বাইরে তার বডিগার্ডদের ডাকতে দরজার দিকে অগ্রসর হলো। খলিল দ্রুত দরজা বন্ধ করে পথ আগলে দাঁড়ালো এবং বর্শার ধারালো ডগা উইগুসারের বুকে ঠেকিয়ে বললো, ‘যেখানে আছো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো!’

সে বর্শার ধারালো ফলা বুক থেকে সরিয়ে তার গলার শাহরগের ওপর চেপে ধরলো।

খলিলের সাথী বর্শার ফলা খৃস্টান মেয়েটার ঘাড়ে ঠেকালো। উইগুসার ও মেয়েটা সরতে সরতে দেয়ালের সাথে গিয়ে ঠেকলো।

খলিল ও তার সাথী দু’জনকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে নর্তকীকে বললো, ‘তুমিও এসে এদের সাথে দাঁড়িয়ে যাও। খবরদার, চিৎকার করবে না,চিতকার করলে তোমার মরণ কেউ ঠেকাতে পারবে না।’

‘যদি তুমি খলিল হও তবে আমি হুমায়রা।’ নর্তকী বললো, ‘আমি তোমাকে প্রথম দিনই চিনেছিলাম। আর তুমি চিনতে চেষ্টা করছিলে।’

একটু আগেই খলিল তার না ছাড়া সব কিছু বলে দিয়েছিল। হুমায়রা এখানে আসা অবধি খলিলকেই কেবল দেখছিল। তার মন বলছিল এ খলিল। আবার সন্দেহ এসে তার বিশ্বাস গুড়িয়ে দিত, মানুষের মত মানুষও তো হয়!’

‘তুমি কি গোয়েন্দা?’ খলিল বললো।

‘না, আমি শুধু নর্তকী!’ হুমায়রা বললো, ‘আমার উপরে কোন সন্দেহ করবে না। আমি তোমারই ছিলাম, তোমারই আছি। এখান থেকে বেরুতে পারলে তোমার সাথেই যাবো, আর মরতে হলেও তোমার সাথেই মরবো।’

আস সালেহ ভোজ সভায় উপস্থিত হলেন। তার সমস্ত আমীর, উজির ও অন্যান্য মেহমানরাও উপস্থিত। খৃস্টান সামরিক অফিসার, যারা তার উপদেষ্টা হয়ে কাজ করছিল, তাদের ভঙ্গি ছিল বাদশাহর মত। মেহমানদের মধ্যে রিমান্ডের সামরিক প্রতিনিধিও ছিল। সে এবং অন্যান্য সবাই উইগুসারের জন্য অপেক্ষা করছিল। তার সম্মানে এ সভা, অথচ সে-ই এখনো আসেনি!

খৃস্টান মেয়েরা হলরুমে কলরব করছিল। এখানে সবাই হাজির, শুধু একজন বাদে। নর্তকীরাও সবাই এসে গিয়েছিল, শুধু নতুন নর্তকী অনুপস্থিত।

আস সালেহ আসার পর সবারই অস্থিরতা বেড়ে গেল। একজন এক চাকরকে ডেকে বললো, ‘উইগুসার ও মেয়েদের খবর দাও। বলবে, সবাই এসে গেছে, আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে সকলে।’

‘এদেরকে এখানেই বেঁধে চলে যাওয়া যাক।’ খলিলের সাথী বললো।

‘তুমি কি সাপকে জীবিত রাখতে চাও? জানো না, কাল সাপকে কখনো বাঁচিয়ে রাখতে নেই?’ খলিল এ কথা বলেই বর্শার ফলা উইগুসারের গলায় পূর্ণ শক্তিতে চেপে ধরলো। মুহূর্তে উইগুসারের গলায় বর্শার ফলা আমূল বিঁধে গেল। শেষ নিঃশ্বাসের ঘড়ঘড়ানি শোনা গেল সেখান থেকে।

তার সঙ্গী আর অপেক্ষা করলো না, তাকে অনুসরণ করে খৃস্টান মেয়েটার গলায় চেপে ধরলো তার বর্শা। শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল তারও।

দু’জনেই বর্শা বের করে নিল। উইগুসার ও মেয়েটার দেহ মাটিতী পড়ে ছটফট করতে লাগলো। খলিল ও তার সাথী দু’জনের বুকের উপ ভারী জিনিস চাপিয়ে দিল।

দু’জনেরই ছটফটানি বন্ধ হয়ে গেলে নিথর লাশ দুটো পালংকের নিচে সরিয়ে দিল ওরা।

কামরাটি ছিল উইগুসারের। দেয়ালে তার সামরিক পোশাক, মুখঢাকা হেলমেট।

হুমায়রা রাতের নাচের পোশাক বদলে দ্রুত সেই পোশাক ও হেলমেট পড়ে নিল। তার সারা শরীর পুরুষের পোশাকের নিচে ঢাকা পরে গেল। জুতাও পাল্টে নিল হুমায়রা। এখন আর কেউ চিনতে পারবে না, এমনকি যে মেয়ে মানুষ তাও বুঝতে পারবে না কেউ।

খলিল দরজা খুলে দেখলো বাইরে চাকর-বাকররা ঘোরাফেরা করছে। ওদিকে আমল দেয়ার সুযোগ নেই ওদের, তিনজনই বাইরে বেড়িয়ে এলো। বেরিয়ে এসেই বাইরে থেকে দরজা টেনে একদিকে হাটা ধরলো ওরা।

শীঘ্রই তারা অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে সরে পড়লো ওখান থেকে। কাছেই একটি ছোট গিরিপথ ছিল, গিরিপথ ধরে ওরা শাহী মহলের এলাকার বাইরে চলে এল।

খলিল ও তার সাথীর জানা ছিল, এখন তাদের কোথায় যেতে হবে। তাদের কমান্ডার একজন বড় আলেম, সেখানে তাদের থাকার গোপন ব্যবস্থাও আছে।

সে সময় শহর থেকে বের হওয়া বড় বিপদের ব্যাপার ছিল। নির্দিষ্ট ফটক দিয়ে বের হতে হতো সবাইকে। ফটকে থাকতো পাহারা। রাত একটু বেশী হলেই বন্ধ হয়ে যেতো ফটক। এখন ফটক পার হওয়া যাবে না, সে চেষ্টাও করলো না তারা। শহরের যে এলাকায় তাদের কমান্ডার থাকেন সে আলেমের বাড়ির দিকেই দ্রুত হেঁটে চললো ওরা।

তাদের ভয়, খুনের সন্ধান পাওয়ার সাথে সাথে শহরে হুলস্থল পড়ে যাবে। ফটক বন্ধ করে তল্লাশী চালানো হবে শহরে। তার আগেই লুকাতে হবে তাদের।

খুনের ব্যাপার জানাজানি হতে দেরী লাগলো না। চাকর এসে উইগুসারকে কোথাও না পেয়ে তার কামরার দরজা খুললো। পালংকের নিচ থেকে রক্তের ধারা এসে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছিল। দরজা খুলেই আতকে উঠলো চাকর।

ভয়ে চিৎকার জুড়ে দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলো অন্যান্য চাকররা। রক্ত দেখে চিৎকার চেঁচামেচি ও হৈ চৈ শুরু করে দিল সবাই। সেখানে একটি নয়, দু’টি লাশ পড়েছিল। দু’জনেরই আঘাত একই রকম।

প্রহরীদের মাঝে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। তারা ভেবে পেলো না, সকলের উপস্থিতিতে একই সময় কে বা কারা এই জোড়া খুন করতে পারে।?

সব প্রহরীদের ডাকলো কমান্ডার, দেখা গেল তাদের মধ্যে দু’জন প্রহরী অনুপস্থিত।

এ প্রাসাদ ছিল সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া কারো প্রবেশ করার সাধ্য ছিল না এখানে। কেবল সম্ভ্রান্ত ও সম্মানী লোকরাই এখানে আসতে পারতো। তাদেরও চেকিং করে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হতো।

বডিগার্ড দু’জন কমান্ডারের জন্য বিপদ ডেকে আনল। এই খুন কোন পেশাদার খুনির দ্বারাই সম্ভব। সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী বা ফেদাইন খুনীচক্র ছাড়া এ কাজ কারো দ্বারা সম্ভব নয়।

কেউ একজন বললো, ‘কারো কাছ থেকে টাকা খেয়ে এ কাজ কোন ভাড়াটে খুনীও করতে পারে।’

কমান্ডার বললো, ‘হলঘরের দু’জন প্রহরীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এ খুন দু’টো যে ওদেরই কাজ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সম্ভবত তারা সুলতান আইয়ুবীর লোক ছিল। তা না হলে তারা সুলতানের লোকদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে এ কাজ করেছে। উইগুসার যেহেতু খৃস্টান গোয়েন্দা অফিসার, তার খুন হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক কারণ ছাড়া অন্য কিছুই থাকতে পারে না।’

গভীর রাত পর্যন্ত যখন খলিল ও তার সাথীর কোন খোঁজ শাহী চত্বরে পাওয়া গেল না, তখন শহরে তাদের তল্লাশী শুরু হয়ে গেল। অনেক পরে জানাজানি হলো, নতুন নর্তকীও তাদের সাথে উধাও হয়ে গেছে।। তাদের গ্রেফতার করার জন্য সারা শহরে ব্যাপক তল্লাশী অভিযান শুরু হয়ে গেলো।

খলিল ও তার সঙ্গী হুমায়রাকে নিয়ে জায়গামত পৌঁছে গিয়েছিল। তারা তাদের কমান্ডারকে যখন সমস্ত ঘটনা খুলে বললো তখন তিনি জলদি তাদের গোপন স্থানে লুকিয়ে ফেললেন। বললেন, ‘বাইরের অবস্থা আগে শান্ত হোক। তারপর তোমাদের কি করতে হবে জানাবো।’

এই কমান্ডার খুবই মশহুর আলেম হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। যদিও এটা তার ছদ্মবেশ, তবুও অভিনয় দক্ষতায় তিনি অসম্ভব কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। তার কাছে দু’জন শাগরেদ থাকতো, তারাও গোয়েন্দা। হলব থেকে দামেশকে তারাই সংবাদ আদান প্রদান করতো।

তিনি শাগরেদ দু’জনকে ডেকে বললেন, ‘বাইরে কি হচ্ছে খোঁজ খবর নাও। উপযুক্ত সময় ও পরিবেশ তৈরী হলেই ওদের দামেশক পাঠিয়ে দিতে হবে।’

হুমায়রা কমান্ডারের সামনেই খলিলকে তার বিপদের কাহিনী শোনালো। শোনালো এ সাত আট বছর সে কোথায় ছিল, কি করেছে সব কথা। বললো, ‘তুমি যখন বাবা ও লোক দ’জনের কাছ থেকে আমাকে রক্ষা করার জন্য লড়াই করছিলে, তখন বাবা পিছন থেকে কোদালের গোড়ালী দিয়ে তোমার মাথায় আঘাত করে। এতে তুমি অজ্ঞান হয়ে যাও।

তখন তিন জনে ধরে আমাকে বাড়ি নিয়ে যায় এবং একজন কাজী ডেকে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই আমার বিয়ে পড়িয়ে দেয়। বিয়ে পড়ানো শেষ হলে লোক দু’টি আমাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে বাড়ি থেকে।

এক রাত ওরা দামেশক কাটায়। পরদিন আমাকে এমন এক এলাকায় নিয়ে যায়, যেখানে শুধু খৃস্টানদের বসবাস ছিল। ওরা আমাকে নাচের ট্রেনিং দিতে শুরু করে।

প্রথম প্রথম আমি তাতে আপত্তি জানাই এবং বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তাতে আমার উপর এমন উৎপীড়ন নেমে আসে যে, মাঝে মধ্যে আমি অজ্ঞান হয়ে যেতাম। কিন্তু ওরা আমাকে উন্নত মানের খাবার দিত, সুস্বাদু শরবত পান করাতো। সেই শরবতে নেশা জাতীয় কিছু থাকতো, যার প্রভাবে আমার মনের জোর কমে যেত এবং আমি আবার নাচতে শুরু করতাম।

এই নেশার প্রভাব ও নির্যাতনই আমাকে নাচিয়ে বানিয়ে দিল। অনেক উঁচু স্তরের লোকেরা আমাকে এমন সব মূল্যবান উপহার দিত যে, সেগুলো দেখে আমি ‘থ’ বনে যেতাম।

ওরা আমাকে জেরুজালেম নিয়ে গেল। সেখানে দু’জন লোক আমার মালিককে বললো, ‘যত টাকা লাগে নাও, মেয়েটাকে আমাদের হাতে দিয়ে দাও।’

তিনি এতে সম্মত হলেন না, তাদেরকে স্পষ্ট বলে দিলেন, ‘এ মেয়েকে গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করাবো আমি।’ ফলে তিনি তার কাছ থেকে কোন অর্থ নিলেন না।

একবার এক লোক আমাকে হাইজ্যাক করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেও ব্যর্থ হয়ে যায়। ফলে ওদের হাতেই থেকে যাই আমি। এখানে কোন আমীরের আদেশে আমাকে ডেকে আনা হয়েছে।’

সে খলিলকে আরো জানালো, ‘প্রথম যেদিন তোমাকে দেখেছি সেদিনই মন বলছিল, এ লোক খলিল। কিন্তু মনের ভেতর প্রশ্ন জাগলো, এখানে খলিল আসবে কোত্থেকে? ফলে মনের মধ্যে সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছিল, খলিলের চেহারায় এ আবার অন্য কোন লোক নয়তো! তাই তোমাকে গভীরভাবে লক্ষ্য করতে লাগলাম। আমার ভাগ্য ভাল, উইগুসারের কল্যাণে তোমাদের ব্যাপারে আমার সব সন্দেহ সংশয়ের অবসান ঘটলো।

কমান্ডারকে সে বললো, ‘আমি এক জঘন্য জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। আমার মনের সব আবেগ ও ভালবাসা মরে গিয়েছিল। এক পাথরের মূর্তির মত আমি নিজেকে এদিক-ওদিক প্রদর্শনী করে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু যখন খলিলকে দেখলাম, তখন আমার মনে আবার সেই কৈশোরের আবেগ জেগে উঠলো। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, এই সে খলিল। কিন্তু তার চেহারা আমার মনে সেই সময়ে স্মৃতি জাগিয়ে দিল, যখন তার সঙ্গে আমার গভীর ভালবাসা ও প্রণয় ছিল।

আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, তাকে জিজ্ঞেস করবো, তুমি কি খলিল? যদি সে নিজেকে খলিল বলে স্বীকার করে তবে তাকে বলবো, চলো আমরা কোথাও পালিয়ে যাই।, প্রয়োজনে মরুভূমির যাযাবরদের মত জীবন-যাপন করি।

খলিলকে আমি পেয়ে গেলাম এবং তার সঙ্গে আমি পালিয়েও এলাম। এখন হলব থেকে পালাতে পারলে আমি বাঁচি।’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 5 | 6 | 7 | 8 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top