১০. সর্প কেল্লার খুনী

সুলতান আইয়ুবী আপন কামরায় তাঁর উপদেষ্টা ও সামরিক অফিসারদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। গোয়েন্দারা যে সব নতুন সংবাদ সংগ্রহ করেছে সে সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। কি করে তার মোকাবেলা করা হবে তার প্ল্যান ও পরিকল্পপনা নিয়ে বিবেচনা, পুনঃবিবেচনা করা হচ্ছিল। ঠিক এই সময় পাহারার দায়িত্ব পড়লো এই রক্ষীর।

সর্প কেল্লার দরবেশের কাছ থেকে নতুন স্বপ্ন ও ন্তুন জগত দেখে এসেছে সে। সেই স্বপ্নে সে বিভোর।

অনেকক্ষণ পর।

উপদেষ্টা ও সামরিক অফিসারগণ কামরা থেকে বের হয়ে চলে গেলেন যার যার কাজে। সুলতান আইয়ুবী তখনো একাকী বসেছিলেন কামরায়। সিদ্ধান্তগুলো ঠিক হলো কিনা মনে মনে খতিয়ে দেখছিলেন তিনি। এমন সময় রক্ষী পা টিপে টিপে চুপিসারে প্রবেশ করলো কামরায়। সুলতান তখনো তন্ময় হয়ে ডুবেছিলেন আপন ভাবনায়।

সে সুলতানের একদম কাছাকাছি চলে এলো। সুলতানের কি মনে হলো, তিনি চট করে চাইলেন পিছন ফিরে। রক্ষী তলোয়ার উচিয়ে বলে উঠলো, ‘তুমি আমার দাদার খুনী! আমার বাবার খুনী!’

সুলতান আইয়ুবী অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলেন তাকে। সে বলতে লাগলো, ‘তাকে তুমি মুক্ত করে দাও, ওই রাজকন্যা আমার।’

এই বলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়লো সুলতানের উপর।

সুলতান আইয়ুবী নিরস্ত্র, তিনি তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে সরে পড়লেন একদিকে। রক্ষীর তলোয়ার সুলতানের কাঠের চেয়ারে সেধিয়ে গেলো।

রক্ষী সেনা তলোয়ারটি মুক্ত করার জন্য টানাটানি করতে লাগলো। সুলতান দ্রুত এগিয়ে তার তলোয়ার পা দিয়ে চেপে ধরলেন।

ক্ষিপ্ত সিপাই এবার খঞ্জর বের করে আক্রমণ চালালো তার উপর। সুলতান ধরে ফেললেন তার হাত। সে হাত মুক্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু আইয়ুবীর মতো বীর যোদ্ধা ও দক্ষ সেনাপতির হাত থেকে মুক্ত হওয়া এতো সহজ ছিলো না।

সুলতান আইয়ুবী তার আঘাত ঠেকিয়ে অন্য গার্ডদের ডাক দিলেন। কামরায় ছুটে এলো গার্ডরা। সুলতান আইয়ুবী তাদের বললেন, ‘খবরদার! ওর ওপর কেউ আঘাত করবে না। ওকে শুধু জীবিত বন্দী করো!’

রক্ষী তখনো সমানে চিৎকার করে বলছিল, ‘তুমি আমার দাদার খুনী! আমার বাবার খুনী! আমার রাজ্য ও সিংহাসন জবর দখল করে রেখেছো! আমার স্বপ্নের রানীকে বন্দী করে রেখেছো!’

গার্ডরা তাকে ধরে ফেললো এবং তার কাছ থেকে খঞ্জর ও তলোয়ার কেড়ে নিলো।

‘সাবাস রক্ষী! তুমি বেঁচে থাকো!’ সুলতান আইয়ুবী রাগ না করে বরং তাকে ধন্যবাদ দিলেন। বললেন, ‘মুসলিম সেনাবাহিনীতে তোমার মত এমন তেজস্বী যোদ্ধারই প্রয়োজন!’

কমান্ডার ও অন্যান্য বডিগার্ডরা সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতে লাগলো! ঘটনা কি? যে রক্ষি সুলতানকে খুন করার জন্য আঘাত করলো তাকে সুলতান ধন্যবাদ দিচ্ছেন কিসের জন্য?

আইয়ুবী কমান্ডারকে বললেন, ‘জলদি করে ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এসো আর হাসান বিন আবদুল্লাহকে এখুনই আমার সাথে দেখা করতে বলো।’

চারজন বডিগার্ড সিপাইকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলো। সে তখনো চিৎকার দিচ্ছিল, ‘এই লোক আমার ভালোবাসার খুনী! আমার ভাগ্যের খুনী!’

একজন বডিগার্ড তার মুখ বন্ধ করার জন্য মুখে হাত চাপা দিতে গেল, কিন্তু সুলতান আইয়ুবি তাকে নিষেধ করে বললেন, ‘ওকে বলতে দাও। হাত সরাও, দেখি ও কি বলে।’

রক্ষীকে বললেন, ‘বলো তো তুমি কেন আমাকে হত্যা করতে চাও?’

‘তুমি তাকে মুক্ত করে দাও!’ রক্ষী চিৎকার করে বললো, ‘তুমি তাকে খাঁচায় বন্দী করে রেখেছ। আমার ভালোবাসাকে বন্দী করে রেখেছ। তুমু আমার দাদাকে খুন করেছ, আমার বাবাকে খুন করেছ, আমার রাজ্য ও সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করেছ আমাকে। হুজুর বলেছে, ‘আমি তোমাকে হত্যা করতে না পারলে তুমিই আমকে খুন করবে।’

সুলতান আইয়ুবী তাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। বডিগার্ডরা সুলতানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো আদেশের অপেক্ষায়। তাদের চোখগুলো বলছিল, ‘একে কয়েদখানায় পাঠানোর নির্দেশ দিন। তার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য, সে আপনাকে খুন করতে চেয়েছিল। যদি আপনি সতর্ক না থাকতেন তবে মৃত্যু অবধারিত ছিল আপনার। আল্লাহর হাজার শোকর, আপনি সময় মত টের পেয়েছিলেন।’

কিন্তু আইয়ুবী তাকে কয়েদখানায় পাঠানোর আদেশ দিলেন না। রক্ষী উন্মাদের মত বকেই যাচ্ছিল।

ইতোমধ্যে ডাক্তার এসে গেলেন। তার একটু পরেই এলেন হাসান বিন আবদুল্লাহ। ভিতরের অবস্থা দেখে ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে গেল।

‘ওকে নিয়ে যাও, সম্ভবত, এই সিপাই পাগল হয়ে গেছে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন।

‘ও চারদিন ছুটি কাটিয়ে আজই মাত্র ডিউটিতে জয়েন্ট করেছে।’ বডিগার্ডদের কমান্ডার বললো, ‘যখন ডিউটিতে এসেছে তখন থেকেই ও নিরব ছিল। কারো সাথে কোন কথা বলেনি।’

তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তারও তার সাথে গেলেন।

সুলতান আইয়ুবী হাসান বিন আবদুল্লাহকে বললেন, ‘চারদিন ছুটির পর আজ এসেই হঠাত ও আমাকে হত্যার জন্য আক্রমণ করার বিষয়টি রহস্যজনক।’

হাসান বিন আবদুল্লাহর মনে প্রথমেই যে সন্দেহ দানা বাঁধলো তিনি তা সুলতানকে জানালেন। বললেন, ‘ সে ফেদাইন গুপ্তঘাতক হতে পারে।’

সুলতান বললেন, ‘এই সিপাহী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। হঠাত করে কেন এমনটি ঘটলো ভালো করে তদন্ত করো। গত চারদিন ও কোথায় ছিল, কি করেছে এ সম্পর্কে ভালো করে তদন্ত করলেই আশা করি তার আসল পরিচয় বেরিয়ে যাবে।’

কিছুক্ষণ পর।

ডাক্তার ফিরে এলেন সুলতান আইয়ুবীর কাছে। বললেন, ‘এ সৈনিককে গত কয়েকদিন ধরে পর্যায়ক্রমে নেশার মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল। তার উপর সম্মোহন বিদ্যে প্রয়োগ করা হয়েছে। সে যা বকরেছে সবই তার ঘোরের মধ্যে করেছে। কে বা কারা তাকে সম্মোহন করেছে তা উদ্ধার করে দরকার।’

ডাক্তার আরো বললেন, ‘ডাক্তারী মতে এটা কোন আশ্চর্য ব্যাপার নয়। এর মূলে হাসান বিন সাবাহর ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। আপনি হয়তো জানেন, তারা এক প্রকার শরবত তৈরি করে, যে সেই শরবত পান করবে তার চোখের সসামনে ভেসে উঠবো ভিন্নতর এক জগত। তখন তার কানে যে কথা বলা হবে, বাস্তবে সে তাই দেখতে পাবে। এর নাম কল্প বাস্তবতা। ইচ্ছে করলেই তাকে নিয়ে যাওয়া যাবে সুন্দর ও স্বপ্নময় ভুবনে, আবার পরক্ষণেই ভয়ার্ত ও বিভীষিকার রাজ্যে ছুড়ে ফেলা যাবে তাকে। তার উপর এ পদ্ধতিই প্রয়োগ করা হয়েছে।’

হাসান বিন আবদুল্লাহর এ শরবতের কথা জানতেন সুলতান। সাবাহ সম্মোহন শাস্ত্রের অভাবিত উন্নতি সাধন করেছে। তৈরি করেছে বিস্ময়কর এক নতুন ভূবন। যে এই ভুবনে একবার প্রবেশ করে সে আর সেখান থেকে কিছুতেই বের হতে চায় না। তাকে মাটি আর পাথর খেতে দিয়ে যদি বলে হয়, ঘিয়ে পাকানো এক সুস্বাদু খাবার, সে তাই অনুভব করবে। কাঁটার ওপর দিয়ে হাটার সময় যদি বলে হয়, সে মখমলের গালিচার ওপর হাঁটছে, তাও বিশ্বাস করবে সে।

ডাক্তার আর বললেন, ‘হাসান বিন সাবাহ মারা গেলেও তার শরবত ও সম্মোহন বিদ্যে মারা যায় নি, শিশ্যরা এখনো তার চর্চা অব্যাহত রেখেছে। সাধারণতঃ ফেদাইন গুপ্তঘাতকরাই এর চর্চাকারী। স্পর্শকাতর জায়গায় তারা নিজেরা না গিয়ে টোপ হিসাবে ব্যবহার করে সম্পূর্ণ নতুন লোক। তাকে প্রস্তুত করে করে এ শরবত ও সুন্দরী মেয়ে ব্যবহার করে।। এ সৈনিক তেমনি চক্রান্তের শিকার। আপনাকে খুন করার জন্য প্রস্তুত করেই একে আপনার কাছে পাঠিয়েছে।’

ডাক্তার শরবতের প্রভাব থেকে সৈনিকটিকে মুক্ত করার জন্য ঔষধ দিলেন। ঔষধ খেয়ে সিপাহীটি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। হাসান বিন আবদুল্লাহ রোগীর অবস্থা ও এর কারণ সম্পর্কে ডাক্তারের মতামত জেনে বুঝতে পারলেন, তিনি যা সন্দেহ করেছিলেন ঘটনা প্রায় তাই। এটা ফেদাইনদেরই কাজ।

গত চারদিন এ সৈনিক ছুটিতে ছিলো। কিন্তু এ ছুটি সে কোথায় কাটিয়েছে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল, কেউ এ সম্পর্কে কিছুই বলতে পারছে না। বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।

শহরে সর্প কেল্লা সম্পর্কে নানা গুজব আবার ছড়িয়ে পড়েছিল। এ গুজবের কিছু কিছু কথা হাসান বিন আবদুল্লাহর কানে পৌছে ছিলো।

লোকেরা বলাবলি করছিল, কেল্লার মধ্যে একজন বুজুর্গ এসে আস্তানা গেড়েছেন। তিনি গায়েবের অবস্থা বলতে পারেন। মানুষের মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে পারেন।

এতোদিন হাসান বিন আবদুল্লাহ এদিকে মনোযোগ দেয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করেন নি। কারণ, এমন বুজুর্গ ও পীরের আমদানি রফতানি তো চলেই আসছে। পাগল জাতীয় লোককে লোকেরা আল্লাহ মনোনিত করে। তার কাছে মনের আশা পূরণের দাবী জানায়। কিন্তু এ ঘটনার পর এ ব্যাপারে মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন তিনি।

হাসান বিন আবদুল্লাহর এক গোয়েন্দা জানালো, সে একজন কালো দাড়িওয়ালা লোককে কেল্লার মধ্যে দু’বার যেতে দেখেছে।

কেল্লার আশেপাশের লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেলো, কালো দাড়িওয়ালা, সাদা পোশাকের এক লোককে অনেকেই কেল্লার মধ্যে যাতায়াত করতে দেখেছে।

এসব তথ্য পাওয়ার পর হাসান বিন আবদুল্লাহ সূর্য ডোবার একট আগে সৈন্যদের একটি দল নিয়ে হঠাত করেই সেখানে হানা দিলেন।

তখনো সন্ধ্যা হয় নি, কিন্তু কেল্লার ভিতরে চাপ চাপ অন্ধকার। মশাল তাদের সঙ্গেই ছিল, মশাল জ্বেলে নিল তারা।

কেল্লার ভিতরে আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ পথ। কোথাও কোথাও দেয়াল ধ্বসে পড়েছে। ইটের স্তুপ জমা হয়ে আছে রাস্তায়। তবে তার মধ্যেও কোন কোন কামরা দেখা গেল এখনো অক্ষত আছে।

সৈন্যরা চাআরদিকে ছড়িয়ে পড়লো। হঠাত একদিক থেকে ভেসে এলো কারো চিৎকার ধ্বনি। কয়েকজন সিপাই দৌড়ে গেল সেদিকে। দেখলো দু’জন সৈন্য আহত হয়ে ছটফট করছে। তাদের বুকে বিদ্গে আছে বিষাক্ত তীর।

ওরা ওখানে পৌছতেই আবারও কোত্থেকে তিন চারটা তীর ছুটে এলো। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়লো আরো কয়েকজন।বাকীরা ভয়ে পিছু সরে এলো।

তাদের ধারণা ছিল, এখানে কোন মানুষ থাকতে পারে না। এখানে কেবল জীন-ভূতের কারবার। ফলে কেউ কেউ খুব ঘাবড়ে গেল। ভয়ের ছাপ ফুটে উঠলো তাদের চেহারায়। কিন্তু যারা বাসববাদী তারা তাদের ভুল বুঝতে পারল।

হাসান বিন আবদুল্লাহ দুঃসাহসী ও বাস্তববাদী লোক ছিল। সে সৈন্যদের সাহস জোগানোর জন্য বললো, ‘এ তীর মানুষের নিক্ষিপ্ত।’

তিনি অবরোধের চিন্তা ত্যাগ করে সৈন্যদের একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। সৈন্যরা বিভিন্ন দিক থেকে সমবেত হওয়া শুরু করলে দেখা গেল অদৃশ্য থেকে একটি দুটি তীর ছুটে আসছে। এসব তীর আরো কয়েকজন সৈন্যকে আহত করে ফেললো।

কে বা কারা এই তীর ছুঁড়ছে, কোত্থেকে ছুঁড়ছে তার কোন হদিস খুজে পেল না ওরা।কেল্লার ভিতর কোন মানুষই নজরে পড়লো না ওদের।

হাসান বিন আবদুল্লাহ সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিয়ে দু’জনকে ডেকে বললো, ‘চুপিসারে বেড়িয়ে যাও এখান থেকে। শহর আরো সৈন্য নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।’

রাত গভীর হয়ে এলো। সৈন্য নিয়ে ফিরে এলো পাঠানো দুজন। ঘিরে ফেলা হলো সমগ্র কেল্লা। অসংখ্য মশাল জ্বলে উঠলো।

বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে দলে দলে কেল্লায় প্রবেশ করতে লাগলো ওরা। এক দল যেতে যেতে সেই কামরার কাছে পৌছে গেল, যেখানে দরবেশের সাথে দেখা করতো ঐ রক্ষী সেনা।

এমন ভয়াবহ ধবংসাবশেষের মধ্যে এমন সাজানো গোছানো কামরা ও তার জৌলুসময় আসবাবপত্র দেখে কমান্ডারের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।

হাসান বিন আবদুল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে জানানো হলো এ কামরার কথা। সে ভেতরে প্রবেশ করে যেসব জিনিস দেখলোতাতে সুলতানকে হত্যা প্রচেষ্টারগোপন রহস্য পরিস্কার হয়ে গেল তার কাছে।

ইতোমধ্যে কয়েকজন সৈন্য সেই কালো দাড়িওয়ালা হুজুরকে কোথা থেকে ধরে নিয়ে এলো। সঙ্গে সেই সুন্দরী মেয়েকেও। তল্লাশী চালিয়ে জঞ্জালের আড়াল থেকে উদ্ধার করা হলো আরো ছয়জনকে। তাদের কাছে ছিলো তীর ধনুক।

সংসারত্যাগী কোন কোন দরবেশের কাছে সুন্দরী মেয়ে, তির ধনুক ও অস্ত্রশস্ত্র থাকার কথা নয়। ফলে সহজেই দরবেশের ধোকা ধরা পড়ে গেল। তার সমস্ত সরঞ্জাম ও বন্দীদের নিয়ে ফিরে চললেন হাসান বিন আবদুল্লাহ।

সেখান থেকে পাওয়া শরাবের পাত্রগুলো রাতেই ডাক্তারকে পৌছে দেয়া হলো পরীক্ষার জন্য। তিনি পাত্রের গন্ধ শুকেই বলে দিলেন, ‘এর মধ্যে হাসান বিন সাব্বাহর বানানো সেই শরবত ছিল।’

হাসান বিন আবদুল্লাহ মুখোশধারী সেই দরবেশ, যুবতী ও অন্যান্য কয়েদীদের জেলে পাঠিয়ে রিপোর্ট করার জন্য চললেন সুলতান আইয়ুবীর কাছে।

সকালে সূর্য উঠার আগেই মেয়েটি শাস্তির ভয়ে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য উপহার দিল হাসান বিন আবদুল্লাহকে। স্বীকার করলো, তারা সবাই ফেদাইন গুপ্তঘাতক দলের সদস্য। সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করার জন্য পাঠানো হয়েছে তাদের। তারা সবাই এই শপথ করে মিশনে শরীক হয়েছে যে, হয় তারা সুলতানকে হত্যা করে ঘরে ফিরবে নতুবা মৃত্যুকে কবুল করে নিবে। সুলতান আইয়ুবী বেঁচে থাকতে কারো ঘরে ফেরার অনুমতি নেই। কেউ এ শপথ ভঙ্গ করলে তাকে খুন করার জন্য কোন বিচারের সম্মুখীন করা হবে না তাকে।

মেয়েটি বললো, ‘ঐ যুবককে সংগ্রহ করেছিল কালো দাড়িওয়ালা ব্যক্তি। তখন সে দরবেশের বেশে ছিল। তার কথা মতই যুবক সর্প কেল্লায় যায়। সেখানে তাকে নেশা পান করানোর দায়িত্ব ছিল আমার উপর আর তাকে সম্মোহন করার দায়িত্ব ছিল দরবেশেরধারীর।

সম্মোহনের মাধ্যমে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলা হয় যুবককে। সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করার মানসিক প্রস্তুতি তৈরী হওয়ার পরই ওকে ফেরত পাঠানো হয়

আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, সুলতান আইয়ুবিকে সে সহজেই খুন করতে পারবে। সেই খুশিতেই আমরা শান্ত মনে কেল্লায় বসে ছিল।’

হাসানের প্রশ্নের জবাবে মায়েটি আরো জানালো, ‘তার সাফল্যের সংবাদ নেয়ার জন্য বাইরে আমাদের লোক ছিল। সুলতান খুন হওয়ার সাথে সাথেই সে খবর আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব ছিল তাদের ওপর। কিন্তু তারা ফিরে যাওয়ার আগেই সন্ধ্যার সময়হঠাত সৈন্যদল কেল্লায় ঢুকে পড়ায় আমরা বিপাকে পড়ে যাই। সৈন্যদের খুন করে বা ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়ার জন্যই তাদের ওপর তীর ছোঁড়া হয়েছিল।’

কালো দাড়িওয়ায়ালা ছিল কঠিন প্রানের লোক। সে মেয়েটির সাথে তার সম্পর্ক অস্বীকার করলো। প্রত্যেকেই এ জন্য নতুন নতুন গল্প শোনাল জেরাকারীদের।

কিন্তু হাসান বিন আবদুল্লাহ যখন বন্দীদের কাছ থেকে তথ্য আদায় করার গোপন কক্ষে নিয়ে গেল তাদের, তখন প্রত্যেকে একের পর এক তাদের সব অপরাধ স্বীকার করে নিল।

কালো দাড়িওয়ালাকে যখন তাদের সামনে দাড় করানো হলো, তখন তার আর অস্বীকার করার কোন সুযোগই থাকলো না। সে সাথীদের করুণ অবস্থা দেখে কেঁপে উঠল।

তাকে বলা হলো, ‘যদি তুমি এখনো সবিস্তারে সব কথা খুলে বলো এবং নিজের অপরাধ স্বীকার করো তবে তোমার ওপর কোন নির্যাতন করা হবে না। আর যদি অস্বীকার করো তবে বন্দীদের কাছ থেকে কথা আদায় করার জন্য যে সব শাস্তি আজ পর্যন্ত উদ্ভাবিত হয়েছে একে একে তার সবই তমার ওপর প্রয়োগ করা হবে। তুমি বাঁচতেও পারবে না, মরতেও পারবে না। আমি এক থেকে দশ পর্যন্ত গুণবো, এর মধ্যে মুখ না খুললে তোমার সাথে আর ঠোটের ভাষায় কথা বলে হবে না।’

হাসান বিন আবদুল্লাহ গুণা শুরু করলো, ‘এক,দুই,তিন…’

লোকটি তাকালো তার সঙ্গীদের দিকে। তাদের করুণ ও ভয়ার্ত চেহারা দিকে শেষ বারের মত তাকিয়ে দশ বলার আগেই সে চিৎকার করে উঠলো, ‘বলবো, আমি সব বলব।’

সে স্বীকার করলো, সে ফেদাইন খুনী চক্রের লোক। ফেদাইন নেতা শেখ মান্নানের সে বিশেষ প্রিয়ভাজন ও পরীক্ষিত খুনী। কিন্তু সে নিজ হাতে খুন করে না,সম্মোহনের মাধ্যমে সে নতুন নতুন খুনী তৈরি করে এবং তাদের দিয়ে কাংখিত খুনের ঘটনা ঘটায়।

হাসান বিন সাবাহর আবিষ্কৃত এই অভিনব খুনের পদ্ধতি অতীতে বহুবার ফলপ্রসু ভূমিকা রেখেছে। অসাধারণ বুদ্ধি ও কুটচালে সিদ্ধহস্ত ছিল সে। কিন্তু সে তার মেধা ও জ্ঞানকে ব্যবহার করতো শয়তানী কাজে।

সুলতান আইয়ুবীকে হত্যার জন্য রক্ষী সেনাকে উস্কে দেয়ার এ কৌশল তারই আবিষ্কৃত। এ পদ্ধতি কতটা কার্যকর ছিল তা সুলতানের প্রতি নিবেদিত প্রাণ এক রক্ষীর সুলতানকে হত্যার প্রচেষ্টা থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায়।

মানুষের মন নিয়ে সে প্রচুর গবেষণা করেছে। মানুষ কেবল নিজের মনই নিয়ন্ত্রণ করে না, অন্যের মন নিয়ন্ত্রণেও আশ্চর্য দক্ষতা দেখাতে পারে, এটাই ছিল তার দাবী। সে দাবীর প্রমাণ স্বরুপই সে আবিষ্কার করে অভিনব পদ্ধতি। সে পদ্ধতি প্রয়োগ করে এক সামান্য সিপাইকে ফেদাইনরা দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল সুলতান আইয়ুবীর মত জাদরেল সেনানায়কের বিরুদ্ধে।

কালো দাড়িওয়ালা বললো, ‘আইয়ুবীকে হত্যার উদ্দেশ্যে চারবার আমাদের আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত আমরা এ পদ্ধতি ব্যবহারে বাধ্য হই। আগের চারটি আক্রমণই ব্যর্থ হওয়ায় আমরা স্পষ্ট বুঝেছিলাম, সোজা পথে সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করা সম্ভব নয়। তাই দলের ছয়জন দক্ষ ও সাহসী সঙ্গী ও একটি মেয়েকে নিয়ে দামেশকে চলে আসি। আস্তানা গাড়ি সর্প কেল্লায়।

রাতের বেলা আমরা এই সর্প কেল্লায় প্রবেশ করি। সমস্ত আসবাবপত্র নিয়ে আসি রাতের আঁধারে। আমার লোকেরাই শহরে গুজব ছড়িয়ে দেয়, কেল্লায় এক দরবেশ এসেছেন, যার হাতে অদৃশ্য শক্তি আছে। যিনি মানুষের ভূত ভবিষ্যত সবই বলে দিতে পারেন।

এই গুজবের উদ্দেশ্য ছিলো, লোকজন যেন কেল্লার মধ্যেয়াসে। কেউ এলেই তার সামনে নিজেকে দরবেশ হিসেবে পরিচয় দিয়ে যেন ওদের ভক্তি শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে পারি।

তারপর সুযোগ বুঝে এক বা একাধিক লোককে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে সুলতান আইয়ুবীকে হত্যার জন্য পাঠিয়ে দেবো। কিন্তু এ আশা সফল হলো না, লোকেরা কেল্লার কাছে কেউ এলো না। কেল্লা সম্পর্কে জনমনে যে ভীতি ছিল, বিশেষ করে হাজার বছর বয়সী দুই সাপের যে কাহিনী প্রচলিত ছিল, সেই ভয় কাটিয়ে কেউ এলো না কেল্লায়।

তখনি আমার মাথায় এলো, সুলতান আইয়ুবীর কোন সৈন্যকে কৌশলে ব্যবহার করার চিন্তা। আমি তখন সুলতান আইয়ুবীর রক্ষি দলের খোজ-খবর নিতে থাকি। তারা কোথায় থাকে, কিভাবে তাদের ডিউটি বদল হয়, এসব জানার পর ঐ বডিগার্ডকে হাতের কাছে পেয়ে যাই।

অবশ্য, সুলতান আইয়ুবীর অফিস বা মহল কোথাও যাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। ঐ বডিগার্ডকে পেয়ে সেখানে যাওয়ার আর প্রয়োজনও বোধ করিনি। কারণ তাকে দিয়েই সুলতান পর্যন্ত আমি বিনা বাঁধায় পৌছে যেতে পারবো।

একদিন পথে তার সাথে দেখা হওয়ার পর এমন সব কথা বললাম, যে কথায় যত বড় দৃঢ় চিত্তের লোকই হোক না কেন, প্রভাবিত না হয়ে পারে না। কাউকে প্রভাবিত করার জন্য যে ভাষা, ভঙ্গি ও অভিনয় দরকার সবই আমার জানা ছিল। আমি সহজেই যুবককে জালে আটকে ফেললাম এবং রাতে তাকে কেল্লার মধ্যে আসতে বললাম।

কেল্লায় এমন ব্যবস্থা রাখা ছিল, যেখানে পাথরকেও মোম বানানো যায়। বিশেষ করে সুন্দরী নারীর ছলাকলা যাদুর চেয়েও বেশী প্রভাব বিস্তার করে কোন যুবকের মনে। এই অস্ত্রও প্রয়োগ করা হয় তার ওপর। এক মেয়ের রেশমী কোমল চুলের বাঁধনে আটকা পড়ে যুবক।

তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় স্বপ্নময় রহস্যের জগতে। তার মাথায় এই বিশ্বাস বদ্ধমূল করা হয় যে, সে শাহী পরিবারের সন্তান। আর তার পরিবার ও বংশ শাহ সোলায়মানের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। তাকে এক সুন্দর রহস্যময় রুপকথার গল্প শোনানো হয়।

মেয়েটির পান করানো শরবতের নেশার ঘোরে তার ওপর চালানো হয় সম্মোহন, আইয়ুবীকে খুন করার জন্য উন্মাদ হয়ে যায় সে।

চারদিন ও চাররাতের নেশা ও সম্মোহনের পর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবিকে খুন করার জন্য তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ডিউটিতে।

রক্ষী সেনা বেহুশ অবস্থায় পড়েছিল। তার দেহ মন থেকে নেশার ঘোর তখনো কাটে নি। সে কল্পনার জগতেই ভেসে বেড়াচ্ছিল।

ডাক্তার তাকে সজ্ঞানে আনবার সবরকম প্রচেষ্টা চালাতে লাগলেন। দুদিন পর সিপাহী চোখ খুললো। সে এমনভাবে ঘুম থেকে উঠলো যেন সে স্বপ্ন দেখছিল।

সে আশেপাশের লোকজনকে বিস্মিত হয়ে দেখতে লাগলো। ডাক্তার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এতোক্ষণ কোথায় ছিলে?’

সে বললো, ‘শুয়ে ছিলাম।’

অনেক্ষণ পর সে যখন স্বাভাবিক অবস্থায় আসলো তখন তাকে তার স্বপ্নময় জগতের কথা জিজ্ঞেস করা হলো। সে কিছুই বলতে পারলো না। সে শুধু বললো, ‘কালো দাড়িওয়ালা এক লোক আমাকে কেল্লার মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল।’ সেখানকার কিছু কথাও সে বললো, কিন্তু তার সবটা খেয়ালে আসছিল না।

তাকে যখন বলা হলো, ‘তুমি সুলতান আইয়ুবীকে আক্রমণ করেছিলে কেন’ তখন সে বিস্মিত ও লজ্জিত হয়ে বললো, ‘যাহ, আমার সাথে এমন ঠাট্টা করবেন না।’

তাকে এ কথা বিশ্বাস করানোর জন্য সুলতান আইয়ুবীর কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। সে ফৌজি কায়দায় সুলতানকে সালাম করলো। সুলতান আইয়ুবী স্নেহময় স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি এখন কেমন আছো?’

সে সুলতানের ব্যবহার এবং সঙ্গীদের কান্ডকারখানা দেখে যারপর নাই বিস্মিত হয়ে বললো, ‘এই, এসব কি হচ্ছে!’

যখন তাকে সব ঘটনা খুলে বলে হলো তখন সে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা! বলুন, এসব কথা সত্যি নয়! আমি সুলতান আইয়ুবীর ওপর আক্রমণ করতে পারি না। বিশ্বাস করুন, কিছুতেই না।’

সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এই সিপাহী নিরপরাধ, তাকে কখনো কেউ এ নিয়ে কিছু বলবে না। আমি যেন শুনতে না পাই, এ নিয়ী তোমরা তাকে কখনো লজ্জায় ফেলেছো।’

হত্যার এই পদ্ধতি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সামরিক অফিসারদের বেশ ভাবিয়ে তুললো। সুলতান আইয়ুবীর জন্য জীবন উৎসর্গকারী এক দেহরক্ষীর মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে নেশা ও সম্মোহনের মাধ্যমে সুলতানের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য প্রস্তুত করার ভয়ানক খেলা যারা খেলতে পারে, তারা কত ভয়ংকর, নিষ্ঠুর ও বেপরয়া বুঝতে কষ্ট হয় না কারো। আল্লাহর রহমত আছে বলেই সুলতান অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন। তাদের পরবর্তী কোনদিক থেকে আসবে তাই নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই অফিসারদের।

এই ঘটনার কয়েকদিন পর।

সুলতান আইয়ুবী দামেশকের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা ও সামরিক অফিসারদের এক সম্মেলন ডাকেন।

এরা সবাই ক্ষিপ্ত ছিল খলিফা আস সালেহ ও তার আমীর উজিরদের ওপর। কারণ তারাই সুলতান আইয়ুবীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। ফেদাইন গ্রুপকে তারাই ভাড়া করেছিল গুপ্তহত্যার জন্য।

সকলেই ভেবেছিলেন, সুলতান এ ব্যাপারেই সম্মেলন ডেকেছেন। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী সে বিষয়ে কোন আলোচনাই করলেন না। যেন তার এ ব্যাপারে কোন চিন্তাই নেই।

তখন পর্যন্ত গোয়েন্দা বিভাগ শত্রুদের তৎপরতার যে সব সংবাদ দিচ্ছিল তিনি সে সম্পর্কে সম্মেলনে তার প্ল্যান পরিকল্পনার বিষয় সকলকে জ্ঞাত করালেন। তার পরিকল্পনা ও তৎপরতার মধ্যে কোন উত্তেজনার আভাসও ছিল না।

যখন তিনি ভাষণ শেষ করলেন তখন সকলেই উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘আপনার ওপর যে হত্যা প্রচেষ্টা হলো, এ ব্যাপারে আপনি কি পদক্ষেপের কথা চিন্তা করছেন তা তো কিছুই বললেন? এর দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিতে চাই।’

সুলতান আইয়ুবী হাসিমুখে বললেন, ‘রাগ, উত্তেজনা ও আবেগের বশবর্তী হয়ে কখনো কোন কিছু করবেন না। শত্রুরা আপনাদেরকে উত্তেজিত করার জন্য এমন কিছু করতে বাধ্য করবে চায়, যাতে জ্ঞান বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে রাগ ও আবেগের বশে চলতে গিয়ে আপনারা ভুল করে বসেন।

আমার সমস্ত পরিকল্পনা ও তৎপরতা ওদের অশুভ তৎপরতা মোকাবেলার লক্ষ্যে। কোন ব্যক্তিগত প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপার এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় স্বার্থ থেকে আমার দৃষ্টিকে অন্য দিকে ফেরাতে চাই না।

ওদের সাথে আমাদের সংঘাত জাতীয় স্বার্থের কারণে। আমার জীবন, আমার সত্ত্বা এবং তোমাদের প্রত্যেকের জীবন ও সত্ত্বা, সবকিছুই ইসলাম ও মুসলিম জাতিসত্ত্বা রক্ষার জন্য। এর জন্য আমরা সকলেই জীবন কোরবানী করার শপথ নিয়েছি। যুদ্ধের ময়দানে মারা যাই বা শত্রুর ষড়যন্ত্রের মৃত্যুবরণ করি, দুই অবস্থায়ই আমাদের মৃত্যু হবে শাহাদাতের।

শাসক ও মুজাহিদ বাহিনীর মধ্যে পার্থক্য এই যে, শাসকগোষ্ঠী শুধু তার সরকার রক্ষা ও তার ব্যক্তিগত স্বার্থ সংরক্ষণের কথা চিন্তা করে। আর মুজাহিদ তার দেশ ও জাতির জন্য জীবন কোরবান করে।

আস সালেহ ও তার আমীর উজিররা তাদের বাদশাহী ও ক্ষমতা রক্ষা করতে চায়। এই নিয়ম আল্লাহর বিধানের পরিপন্থি, অতএব তারা পরাজিত হতে বাধ্য। কোন ছোটখাট বিষয় নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে সময় ও শক্তি অপচয় করার সুযোগ নেই আমাদের। তাদের সার্বিক ও চুরান্ত পরাজয়ই আমাদের সকল তৎপরতার লক্ষ্য।’

সুলতান আইয়ুবী তাঁর গোয়েন্দাবাহিনীর শাখা প্রধান হাসান বিন আবদুল্লাহকে বললেন, ‘এমন বেওয়ারিশ পুরাতন দালান কোঠার ধবংসাবশেষ যেখানে আছে, যার কোন প্রয়োজন নেই, সেগুলো মাটির সাথে মিশিয়ে দাও।’

তিনি আরও নির্দেশ দিলেন, ‘মসজিদে এমন খুৎবা প্রদান করা হবে, যার বিষয় হবে আল্লাহ তায়ালা ইহকাল ও পরকালের মালিক। আর অদৃশ্যের খবর একমাত্র তিনি ছাড়া কেউ জানেন না। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মাঝখানে কোন দালালের সুপারিশের প্রয়োজন নেই।

আল্লাহ সকল বান্দার আবেদনই শোনেন। এমনকি বান্দারা যা প্রকাশ না করে গোপন রাখে, আল্লাহ তাও জানতে পারেন। তাই কোন লোকের সামনে নত হওয়া, তাকে সিজদাহ করা শুধু নাজায়েজই নয়, সম্পূর্ণ হারাম ও গুনাহের কাজ।

মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে,মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে উদ্ধার করা, ব্যক্তিপুজা থেকে মানুষকে রিক্ষা করা।

আমার এ কথার মানে এ নয় যে, তোমরা ধর্মীয় নেতাদের শ্রদ্ধা করবে না, আলেম ওলামাদের ভক্তি করবে না। মুরব্বীদের অবশ্যই শ্রদ্ধা করবে, আলেম ও নেতৃবৃন্দকে শ্রদ্ধা করবে, তবে তা সর্বাবস্থায় শরীয়তের সীমার মধ্য থেকে হতে হবে।’

তিনি আরো বললেন, ‘তোমরা সৈন্যদের এই উপদেশই দাও, যেভাবে তারা যুদ্ধের ময়দানে নিজেদের দেহ শত্রুর অস্ত্রের আঘাত থেকে বাঁচায়, প্রতিরোধ করে, তেমনিভাবে নিজের অন্তর এবং বিবেককেও শত্রুদের অপপ্রচার ও মতবাদ থেকে রক্ষা করো। এ আঘাত তলোয়ারের আঘাত নয়, কথার আঘাত। শরীরের আঘাত মিলিয়ে যায়, আহত শরীর নিয়েও যুদ্ধ করা যায়, কিন্তু মন ও চিন্তায় যদি আঘাত লাগে, তবে শরীর অকেজ হয়ে যায়।

তমরা নেশার প্রভাব দেখতে পেয়েছ, কেমনভাবে আমার দেহরক্ষীই আমার ওপরব আক্রমণ করেছিল। কিন্তু যখন নেশার ঘোর কেটে গেল তখন সে নিজেও বিশ্বাস করতে পারলো না, সত্যি সে আমকে আঘাত করেছে।

মন এমনি এক জিনিস, একে পবিত্র না রাখলে কোন কিছুই আর পবিত্র থাকে না। যখন শত্রুর কথার তীর তোমার মনকে তার মশীভূত করে নেবে তখন তোমার মূল সম্পদ ঈমানের ঘরই ফাঁকা হয়ে যাবে।

এ জন্যই সশস্ত্র লড়াইয়ের চাইতে সাংস্কৃতিক লড়াই অধিক গুরুত্বপুরন। সশস্ত্র লড়াইয়ের সৈনিক হিসাবে তোমাদের এ কথা সর্বক্ষণ মনে রাখতে হবে, অস্ত্র লড়াই করে না, লড়াই করে জিন্দাদীল মুজাহিদ, অস্ত্র তার হাতিয়ার। যদি তমার মধ্যে লড়াই করার সদিচ্ছা ও আগ্রহ শেষ হয়ে যায়, তবে অস্ত্রের মজুদ কোনদিন তোমাকে বিজয় এনে দেবে না। ঈমানকে সর্বক্ষণ সতেজ ও সজীব রাখার জন্য সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।

প্রতিপক্ষ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালায় মেয়েদের দিয়ে। তোমরা জেনেছো, এই নেশা ওরা প্রয়োগ করেছিল একটি সুন্দরী মেয়ের সাহায্যে। এই মেয়েদেরকেও ওরা নেশার সামগ্রী বানিয়ে নিয়েছে। এরা ওই মেয়েদের নিয়ে নেশায় নেশায় নেশাময় ভুবন তৈরির চেষ্টা করবে, আর তোমাদের কাজ হবে এই নেশার জগত থেকে মুক্ত থাকা, জাতিকে এই নেশার জগত থেকে সরিয়ে আনা।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 4 | 5 | 6 | 7 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top