১. গাজী সালাহউদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযান

গাছের আড়ালে লুকিয়ে কমাণ্ডারকে এগিয়ে যেতে দেখল মুবি। কমাণ্ডার এগিয়ে যেতেই ও আবার ছুটতে লাগল। হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ শুনে কমাণ্ডারও ছুটল পেছন ফিরে। আবার কোন শব্দ নেই। অনুমান করে ছুটছে কমাণ্ডার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পেছন থেকে আবার ভেসে এল পদশব্দ। ঘুরে দৌড় লাগাল কমাণ্ডার। থেমে গেল পদশব্দ লুকোচুরি খেলার ট্রেনিং ভালই কাজে লাগাচ্ছে মুবি। ‘

এভাবে চলল কিছুক্ষণ। মেয়েটা যেন তার সাথে কানামাছি খেলছে। হারিয়ে যাচ্ছে, আবার দৌঁড়াচ্ছে। ক্রোধে ফুঁসতে লাগল কমাণ্ডার।

ঝোপ ঝাড় আর গাছের ফাঁকে ফাঁকে এভাবে লুকোচুরি খেলতে খেলতে মাইল দুয়েক দূরে চলে এসেছে ওরা। সামনে দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের তাবু।

মেয়েটা তাবুর কাছে পৌঁছে চিৎকার করে ডাকতে লাগল ওদের। আলো জ্বেলে তাবু থেকে বরিয়ে এল ব্যবসায়ীরা।

তরবারী হাতে কমাণ্ডারও পৌছে গেল ওখানে। ব্যবসায়ীদেরকে মুসলমান মনে হচ্ছে। মেয়েটা তাদের একজনের পা জড়িয়ে ধরে আছে। আতংকে বিবর্ণ চেহারা, হাফাচ্ছে।

‘এ মেয়েটাকে আমার হাতে তুলে দাও।’ নির্দেশের ভংগীতে বলল কমাণ্ডার।

‘ও একা নয়,’ বলল এক ব্যবসায়ী, ‘আমরা সাতজনকেই তোমাদের সুলতানের কাছে দিয়ে এসেছি, একেও নিয়ে যেতে পার।’

‘না।’ আরও জোরে লোকটার পা আকড়ে ধরল মুবি। বলল ‘আমি ওর সাথে যাব না। মুসলমানরা খ্রীস্টানের চাইতেও জানোয়ার। ওদের সুলতান একটা ষাঁড়, একটা পশু। সে আমার হাড়গোড় পর্যন্ত ভেঙে দিয়েছে। আমি কোন রকমে পালিয়ে এসেছি।

‘কোন সুলতান?’ কমাণ্ডারের হতবাক কণ্ঠ।

‘যাকে তোমরা সালাহউদ্দীন আইয়ুবী বল।’

‘মেয়েটা মিথ্যে বলছে। কে ও? তোমাদের সাথে এর সম্পর্ক কি?’

‘ভেতরে এস বন্ধু। বাইরে ঠাণ্ডা, তারাবারী খাপে ঢুকাও। কোন ভয় নেই, আমরা ব্যবসায়ী। মেয়েটা কি বলতে চায় শোনই না। আমরা তোমাদের সুলতানকে ভাল মানুষ ভেবেছিলাম। কিস্তু সুন্দরী যুবতীদের দেখে তিনিও ঈমান আমান খুইয়ে বসেছেন!

অন্য ছ’টি মেয়ের কি অবস্থা করেছে কে জানে!’

‘অন্য সেনাপতি এবং কমাণ্ডাররা এদের শেষ করে দিয়েছে।’ মুবি বলল, ‘এদেরকে সন্ধ্যার সময় নিয়ে গেছে, দিয়ে গেছে খানিক আগে। এখন ওরা তাবুতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।’

কমাণ্ডার তরবারী কোষবদ্ধ করে তাবুতে প্রবেশ করল। কফি তৈরী করতে লাগল এক ব্যবসায়ী। কমাণ্ডারের অলক্ষ্যে কি যেন মেশাল তাতে। অন্য একজন জানতে চাইল তার পদমর্যাদা।

আলাপচারিতায় ব্যবসায়ীরা বুঝল লোকটা সেনাবাহিনীর উঁচু পর্যায়ের কেউ নয়, একজন সাধারণ গ্রুপ লিডার মাত্র। তবে লোকটা মেধাবী এবং সাহসী।

ওরা মেয়েদের ব্যাপারে সুলতানকে বলা গল্পটাই কমাণ্ডারকে পুনরায় শোনাল। জানাল এদের ব্যাপারে সুলতানের সিদ্ধান্ত। যোগ্য বর পেলে এরা মুসলামন হবে, দেশে ফিরবে না কখনো, তাও কমাণ্ডারকে বলা হল।

অন্য একজন বলল, ‘এ মেয়েটার সাথে তোমাদের প্রিয় সুলতান কি কাণ্ড ঘটিয়েছে তাতো ওর মুখেই শুনলে।’

কমাণ্ডার মেয়েটার দিকে তাকাল।

মুবি বলতে লাগল, ‘একজন দেবদুতের আশ্রয় পেয়েছি মনে করে আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না। সুর্য ডোবার সাথে সাথে সুলতানের নাম করে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। অন্যদের তুলনায় আমি একটু বেশী সুন্দরী। বুঝতে পারিনি তোমাদের আইয়ুবী আমাকে খারাপ উদ্দেশ্যে ডাকছে। আমি গেলাম। সুলতান মদের সোরাহী খুলে বসল। গ্লাস ভরে রাখল আমার সামনে। আমি খৃস্টান, মদপানে অভ্যস্ত।

আইয়ুবী আমাকে ভোগ করতে চাইল। পুরুষ নতুন নয় আমার জন্য। আমি যাকে দেবদূত মনে করি এ অপবিত্র দেহ থেকে তাকে দূরে রাখতে চাইলাম। কিন্তু সে জাহাজের খৃস্টানদের চাইতেও নিকৃষ্ট। দেহের প্রতিটি জোড়া ব্যথা করছে। হাড়গুলো মনে হয় ভেংগেই ফেলেছে।’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সে।

একটু পর আবার শুরু করল, ‘ঈশ্বর আমায় রক্ষা করেছেন। নিষ্কৃতি দিয়েছেন দেবদুতরূপী পশুর হাত থেকে। সুলতান আমাকে বলেছে, অন্যান্য কমাণ্ডাররা বাকী মেয়েদের নিয়ে আনন্দ করছে। আমি সুলতানের পা ধরে মিনতি করলাম বিয়ে করার জন্য। সুলতান বলল, ‘বিয়ে ছাড়াই তুমি আমার হারেমে থাকবে।’

অত্যাধিক মদপান করায় সুলতান বেহুশ হয়ে পড়ল। এ সুযোগে আমি পালিয়ে এসেছি। বিশ্বাস না হলে তার দেহরক্ষীদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পার।’

মুবির কথার মাঝেই কফি পরিবেশন করা হল। কফির মধ্যে হাশিশ মেশানো ছিল জানতো না কমাণ্ডার। কফি পান করল কমাণ্ডার, হাশিশের ক্রিয়া শরু হল  মগজে। মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে অট্টহাসি দিয়ে বলল, ‘আমাদের জন্য নির্দেশ, মদ এবং নারী থেকে দূরে থাক। নিজে মেয়ে মানুষ নিয়ে ফুর্তি করছে আর মদ পান করছে, হা, হা, হা। ‘

হাশিশের প্রভাবে ও বুঝতেই পারল না মেয়েটা নির্জলা মিথ্যে বলেছে তার সাথে। কল্পনায় এখন সে নিজেই সম্রাট। মুবির চেহারায় মশালের আলো। চুলে কাল আর সোনালী রঙের মিশেল। যৌবন উপচে পড়ছে অপরূপা অঙ্গ থেকে। চোখে নেশা ধরানো দীপ্তি। কমাণ্ডারের মনে হল, পৃথীবির সবচে রূপবতী নারীটি বসে আছে তার সামনে।

সে চঞ্চল হয়ে বলল, ‘তুমি চাইলে আমি তোমাকে আশ্রয় দিতে পারি।’

‘না?’ ভয়ে পেছনে সরে গেল মুবি। ‘তুমিও আমার সাথে সুলতানের মতই আচরণ করবে। তোমার তাবুতে নিয়ে গেলে আবার আমি আইয়ুবীর হাতে গিয়ে পড়ব।

‘ইজ্জত রক্ষার জন্য ওদেরকে তোমাদের হাতে দেয়া ভুল হয়ে গেছে। ভাবছি অন্য মেয়েদেরকেও কালই গিয়ে ফেরত নিয়ে আসব। বলল এক ব্যবসায়ী।

মুবির দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়েছিল ফখরুল মিসরী। তার দেহলতা ও শরীরের প্রতিটি অঙ্গ থেকে উপচে পড়ছে যৌবন। এমন অপরূপা অঙ্গশোভার অধিকারী সুন্দরী নারী সে জীবনেও দেখেনি।

ব্যবসায়ীর কথা পিঠে কেউ কোন কথা বলল না। তাবুতে নেমে এল নীরবতা। চুপচাপ কেটে গেল কিছু সময়।

নীরবতা ভাঙল ক্রিস্টোফার। বলল, ‘তুমি আরবী না মিসরী?’

‘মিসরী। আমি সাধারণ একজন সৈনিক হিসাবে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলাম। যুদ্ধে বীবরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় আমাকে কমাণ্ডার পদে প্রমোশন দেয়া হয়েছে।

‘সুদানী ফৌজকে দেখছি না, ওরা কি এ যুদ্ধে অংশ নেয়নি?’

‘সুদানী ফৌজকে দেখছি না, ওরা কি এ যুদ্ধে অংশ নেয়নি?’

‘সুদানী কোন ফৌজ এখানে আসেনি, এ যুদ্ধে অংশ নেয়নি ওরা।

‘কি ব্যাপার, যুদ্ধে ওরা অংশ নিল না কেন?’

‘মনে হয় সুদানীরা সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে গ্রহণ করেননি।’ জবাব দিল আরেক ব্যবসায়ী।

‘হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। সুদানীরা সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে গ্রহণ করেনি। তাদের কমাণ্ডার সুলতানকে মিসর ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। কারণ তিনি মিসরের নন, বিদেশী। এ জন্য আইয়ুবী মিসরীয়দের দিয়ে নতুন ফৌজ গঠন করেছেন। ওরাই এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে।

গল্প জমে উঠেছে। যেন খোশগল্প করছে সবাই এভাবেই একজন জানতে চাইল, ‘যুদ্ধে তো তোমরা জিতেছ, গনিমতের মাল কি কি পেলে?’

‘গনিমতের মাল কি আর গরীবের ভাগ্যে জোটে!’ টিপ্পনি কাটল অন্যজন।

‘গনিমতের মালের খবর জানিনা, এখনো ভাগবণ্টন হয়নি বোধ হয়।’ বলল কমাণ্ডার।

‘তা জানবে কেমন করে? তোমাদের সুলতান তোমাদেরকে মদ ও নারী থেকে দূরে থাকতে উপদেশ দেন, অথচ নিজে ভোগ বিলাসে মত্ত থাকেন। যুদ্ধলব্ধ সম্পদের খবর তোমরা যারা যুদ্ধ করেছ তারা জাননা, অথচ ব্যবসায়ী হিসাবে আমরা জানি, খৃস্টান জাহাজ থেকে অঢেল সম্পদ পাওয়া গেছে। অসংখ্য উট বোঝাই করে এসব মাল কায়রো পাঠানো হয়েছে রাতের অন্ধকারে। কায়রো থেকে সে সব চলে যাবে দামেশক এবং বাগদাদ। সুদানী ফৌজকে সুলতান দাসে পরিণত করতে চাইছেন। আরবের সৈন্য এসে গেলে তোমরাও হবে তাদের মতই গোলাম।’

মুবির চোখ ধাঁধানো রূপ আর হাশিশের প্রবাবে ফখরুলের হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছিল ওদর প্রতিটি শব্দ। অযাচিত ভাবেই পরিস্থিতি মুবির পক্ষে চলে গেছে। তাকে ধরতে এসে নিজেই ফেঁসে গেছে কমাণ্ডার।

আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানত না কমাণ্ডা। মুবি নিজের ভাষায় সব ঘটনা বলতে লাগল সংগীদের। ওদের শোনাল রবিনের নির্দেশ। বলল, ‘পরাজয়ের কারণ বের করতে হবে। যেতে হবে নাজির কাছে।’

মেয়েটা কি বলছে জানতে চাইল ফখরুল। ক্রিস্টোফার বলল, ‘ও বলছিল, তুমি আইয়ুবীর সৈন্য না হলে ও তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হতো। এ জন্য ও মুসলমান হতেও প্রস্তুত। কিন্তু এখন সে কোন মুসলমানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

কমাণ্ডার কি ভেবে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। মুবির হাত ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করে বলল, ‘খোদার শপথ তোমার জন্য আমি সিংহাসন ত্যাগ করি এই যদি হয় তোমার ইচ্ছে, এই রইল তরবারী! এখন থেকে তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা।’

কমাণ্ডার খাপ সহ তার তরবারী রেখে দিল মুবির পায়ের কাছে। ‘এখন আমি আইয়ুবীর সৈনিক নই, কমাণ্ডারও নই।’

মুবি হাত ধরে টেনে ওকে পাশে বসাল। নিজেও ঘনিষ্ট হয়ে বলল তার পাশে। বলল, ‘তুমি যদি সত্যি আমাকে চাও তোমার জন্য আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করবো। তবে আমাকে পেতে হলে তোমাকে একটা শর্ত পালন করতে হবে, যে পাষণ্ড পশু আমার ওপর আজ এ বর্বর আচরণ করেছে, তার প্রতিশোধ নিতে হবে তোমাকে।’

‘খোদার কসম, সুলতান আমার হাত থেকে কিছুতেই রক্ষা পাবে না। একে আমি খুন করবো।’

মুবি ব্যবসায়ীদের দিকে তাকাল। ক্রিস্টোফার বলল, ‘এক আইয়ুবী মরলে বা বাঁচলে কিছু যায় আসে না। যে আসবে সেও এমন হবে। আজ হোক, কাল হোক মিসরীরা ওদের দাসই হবে। তুমি বরং নাজির কাছে যাও। মুবি থাকবে তোমার সংগে। তোমরা দু’জন সালাহউদ্দীনের আসল রূপ তার কাছে প্রকাশ করে তার সাহায্য চাইতে পার। এ ছাড়া  এর বদলা নেয়ার কোন রাস্তা দেখি না আমি।’

নাজি এবং তার সংগীদের যে গোপনে হত্যা করা হয়েছিল এ কথা জানতো না এরা। মুবি চাচ্ছিল দ্রুত নাজির কাছে পৌঁছতে, কিন্তু এক যুবতীর পক্ষে একা মিসর পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব ছিল না। অপ্রত্যাশিত ভাবে ফখরুলকে পাওয়ায় তার বরং সুবিধাই হল। ওরা সিদ্ধান্ত নিল, মিসর যাওয়ার পথে ওকেই ব্যবহার করা হবে।

খৃষ্টান গোয়োন্দা দলে প্রধান রবিন রয়েছে আহতদের তাবুতে। ব্যবসায়ীরাও সিদ্ধান্ত নিল এখানেই থাকবে। আইয়ুবীকে ছোঁড়া তীর একবার ফসকে গেছে, আবার চেষ্টা করবে ওরা।

মুবির রূপের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে ফখরুল। হাশিশ তাকে বিবেকশূন্য করে দিয়েছে। ফখরুল আর নিজের তাবুতে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

মুবিকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ার জন্য তাকে পরামর্শ দিল ক্রিস্টোফার। ব্যবসায়ীরা একটা উট দিল তাকে। উটের সাথে দেয়া হল পানির মশক ও প্রয়োজনীয় খাবার। হাশিশ মেশানো খাবারের থলিটা ধরিয়ে দিল মুবির হাতে। ফখরুল পরল ঢাউস জুব্বা ও ব্যবসায়ীদের মত টুপি। উটের পিঠে চাপল মুবি ও কমাণ্ডার।

উট চলতে শুরু করেছে, আশপাশের কোন খেয়াল নেই কমাণ্ডারের। সমস্ত অতীত তার হারিয়ে গেছে। হৃদয়ের কার্নিশে এখন শুধু ঝুলে আছে বিশ্বের সেরা এক সুন্দরীর ছবি। সুলতানকে বাদ দিয়ে যে রূপসী তাকে পছন্দ করেছে। কি সৌভাগ্য তার, মুবিকে বাহুবেষ্টন করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল ও।

‘খৃস্টান কমাণ্ডার আর তোমাদের সুলতানের মত পশুর আচরণতো করবে না?’ কপট কটাক্ষ হেনে বলল মুবি।

‘মুবি, আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি সে কথা কি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।’

‘না ফখরুল, এ তো আমি রহস্য করে বলেছি। তোমার ভালবাসার ওপর আমার আস্থা না থাকলে কি তোমার সাথে এভাবে একাকী বেরিয়ে পড়তাম? এ দেহ-মন আমি তোমাকেই সঁপেছি। এখন থেকে আমি শুধুই তোমার। আমাকে নিয়ে তোমার যা ইচ্ছে করতে পার। তবে আইয়ুবীর পশুত্ব ভুলতে পারছি না বলেই ওভাবে বলেছি তোমায়। ধৈর্যহীনদের আমি ঘৃণা করি, যেমন ঘৃণা করি তোমাদের সুলতানকে।’

‘তার মানে তুমি আমাকে ধৈর্যহীন বলতে চাইছো? দেখ মুবি, তুমি চাইলে আমি উট থেকে নেমে যাব।’ মুবিকে বাহুবন্ধন থেকে ছেড়ে দিল ফখরুল।

‘ছি! কি বলছো তুমি? তোমাকে আমার ভাল লেগেছে বলেই তো তোমার জন্য আমার ধর্ম পর্যন্ত ত্যাগ করেছি। ইচ্ছে করলে আমি ব্যবসায়ীদের কাছেও তো থাকতে পারতাম।

মুবির আগেবপূর্ণ কথায় আরো দুর্বল হয়ে পড়ল কমাণ্ডার। গল্পে গল্পে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে ওরা।

সাধারণভাবে চললে ওদের পাঁচদিনের পথ অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু ফখরুল এক পালিয়ে আসা সৈনিক। মুবিও পালিয়ে এসেছে মুসলিম তাবু থেকে। তাই সাধারণ পথ ছেড়ে দুর্গম পথে এগিয়ে চলল ওরা।

গভীর হয়ে এল রাত। ঘুমে ভারী হয়ে এল মুবির চোখ। ফখরুলের বুকে মাথা রেখে ও ঘুমিয়ে পড়ল। আকাশের অগণিত তারার রাথে জেগে রইল এক পলাতক সৈনিক। উট এগিয়ে চলছে মিসরের দিকে।

সবেমাত্র ফজরের নামাজ শেষ করেছেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী, প্রহরী তাবুতে প্রবেশ করে জানাল, ‘আলী বিন সুফিয়ান এসেছেন।’

তাবু থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলেন সালাহউদ্দীন। আলীর সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও দিকের কি খবর?’

‘এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক। তবে ওদের উৎকণ্ঠা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের গোয়েন্দারা বলেছে, নেতৃত্ব দেয়ার মত কোন কমাণ্ডার এগিয়ে এলে ওরা বিদ্রোহ করবে।’

কথা বলতে বলতে দু’জন তাবুতে প্রবেশ করলেন। ‘নাজি এবং তার সংগীদের আমরা শেষ করেছি, কিন্তু সুদানীদের ভেতর মিসরীয়দের বিরুদ্ধে যে বিষ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তার প্রভাব এখনও কমেনি। সেনাপতির অন্তর্ধান তাদের উৎকণ্ঠার বড় কারণ। আমাদের গোয়োন্দারা প্রচার করেছে যে, নাজি যুদ্ধের ময়দানে। আমার মনে হয় ওরা একথা বিশ্বাস করছে না।’

‘ওরা বিদ্রোহ করলে আমাদের ওখানকার ফৌজ কি অভিজ্ঞ পঞ্চাশ হাজার ফৌজের মোকাবিলা করতে পারবে?’

‘আমি তার ব্যবস্থা করে এসেছি। সব জানিয়ে দু’জন ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে দিয়েছি নুরুদ্দীন জংগীর কাছে। বিদ্রোহ দমন করার জন্য কিছু সাহায্য পাঠাতে অনুরোধ করেছি তাকে।’

‘ওদিক থেকে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা কম। গত পরশু দূত মারফত জেনেছি, জংগী সম্রাট ফ্রাংকুর এলাকা আক্রমণ করেছেন। খৃস্টানদের বিশাল এক বাহিনী মিসরের দিকে আসছিল। আক্রান্ত হয়ে পিছনে সরে গেছে ওরা। জংগী কিছু এলাকাও দখল করেছেন। কিন্তু একটা সংবাদে আমি দারুণ উদ্বিগ্ন।’

‘ওরা আবার হামলা করেছে?’

‘ওদের আক্রমণে আমি ভীত নই। আমার উদ্বেগের কারণ হল, শত্রুকে যারা বাঁধা দেবে তারা মদের পিয়ালায় আকণ্ঠ ডুবে আছে। ইসলামের রক্ষকরা হারেমে বন্দী। যুবতী নারীর মোহনীয় চুল ওদের পায়ে শৃংখল পরিয়ে রেখেছে।

হায়, আমার চাচা শেরে কোহ আজ যদি বেঁচে থাকতেন! তিনিই আমাকে যুদ্ধের ময়দানে এনেছিলেন। সামান্য সৈন্য নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শত্রুর ওপর। কিন্তু মুসলিম নামধারী বেঈমানের দল শত্রুর সাথে মিশে গিয়েছিল। তার সামনে তৈরী করেছিল দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর। তবু চাচা সাহস হারাননি। তুমিতো তার সব ইতিহাস জান।’

‘আমার সব কিছু মনে আছে সুলতান। সে সব যুদ্ধ এবং রক্তঝরার পর আশা করেছিলাম মিসর এবার সোজা পথে আসবে। কিন্তু এক গাদ্দারের মৃত্যু হলে এগিয়ে আসে অন্য গাদ্দার। আসলে গাদ্দার দুর্বল খেলাফতের সৃষ্টি, ফাতেমী খেলাফত হারেমের বিলাসে হারিয়ে না গেলে খৃস্টানদের সাথে আপনার যুদ্ধ এখানে নয়, ইউরোপে হত। আমাদের বন্ধুরাই আমাদেরকে বাইরে যেতে দিচ্ছে না। শাসক যখন ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে প্রজারা তখন সিংহাসের স্বপ্ন দেখে, সাহায্য চায় শত্রুর কাছে। ক্ষমতার লোভে তাদের স্ত্রী কন্যার ইজ্জত আব্রুর কথাও ভুলিয়ে দেয়।’

‘এদের আমি ভীষণ ভয় করি আলী। ইসলাম নিশ্চিহ্ন হলে এসব নামধারী মুসলমানের হাতেই হবে। আমাদের ইতিহাস এখন বিশ্বাসঘাতকের ইতিহাস, ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। আমার মন বলছে, এমন এক সময় আসবে যখন মানুষ নামে থাকবে মুসলমান, কিন্তু চিন্তা করবে শত্রুর মস্তিষ্ক দিয়ে। মসজিদের চেয়ে পতিতালয় বেশী থাকবে, অথবা ওদের ঘরগুলোই হয়ে উঠবে একেকটা পতিতালয়।

অমুসলিমরা মুসলমানকে সে পথেই নিয়ে এসেছে। মিসরে দেখা যাচ্ছে ঝড়ের পূর্বভাস। তোমার সংস্থাকে আরও শক্তিশালী কর, শত্রুর এলাকায় গিয়ে কমাণ্ডা হামলা এবং সংবাদ সংগ্রহের জন্য সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং বুদ্ধিমান যুবকদের বাছাই কর। গুপ্তচর বৃত্তির ময়দানে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হও আলী।’

‘আপনি দোয়া করুন, নতুন করে যে সব যুকব ভর্তি হচ্ছে তাদের মধ্যে আমি প্রাণের স্পন্দন দেখতে পাচ্ছি। তাদের নিষ্ঠা ও আগ্রহ আমাকে আশাবাদী করে তুলছে। এখানকার খবর কি?’

বেলাভূমিতে কুড়িয়ে পাওয়া বন্দীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তুমি ওদের সাথে একাবর দেখা করো।

প্রহরীকে ডাকলেন আইয়ুবী। বললেন, ‘আমাদের নাস্তা দাও।’

নাস্তা নিয়ে এল প্রহরী। খেতে খেতে কথা বলছিলেন আইয়ুবী, ‘গতকাল আরো কিছু আহত খৃষ্টান সৈনিককে এখানে আনা হয়েছে। এদের একজনকে আমার সন্দেহ হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে সাধারণ সৈনিক নয়। এছাড়া ঘটনাচক্রে একদল মেয়েকেও এখানে আশ্রয় দিতে হয়েছে। ওদের নিয়ে এসেছে পাঁচজন ব্যবসায়ী। এদের সাথেও একটু দেখা করো।

‘মেয়েরা এখানে কিভাবে এল?’

মেয়েদের ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা যা বলেছিল সুলতান আলীকে তা শোনালেন। বললেন, ‘আসলে ওদের আশ্রয় দিয়ে আমার আওতায় নিয়ে এলাম। ওরা গরবী, দীর্ঘদিন জাহাজে ছিল। কিন্তু দেখে তা মনে হয়না। ওদের আলাদা তাবুতে রাখা হয়েছে। তুমি নাস্তা সেরে আগে ওদের সাথেই দেখা করো।

এরপর মৃদু হেসে বললেন, ‘কাল উপকূলে হাঁটছিলাম। হঠাৎ কোত্থেকে একটা তীর এসে দু’পায়ের ফাঁকে বালিতে গেঁথে গেল। রক্ষীরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে, কোন তীরন্দাজ পায়নি। ওরা ওই এলাকা থেকে পাঁচজন ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে এসেছিল। ওরাই মেয়েগুলোকে এখানে রেখে গেছে।’

ওদের চলে যেতে দেয়া হয়েছে শুনে অবাক বিস্ময়ে সুলতানের দিকে তাকিয়ে রইলেন আলী।

‘আপনি তাদের যেতে দিলেন! রক্ষীরা ওদের মালপত্তর তল্লাশী নিয়েছে? সন্দেহ করা যায় এমন কিছু পাওয়া যায়নি ওদের কাছে?’

গভীর মনোযোগ দিয়ে তীরটা দেখলেন আলী। বললেন, ‘এক গোয়োন্দার দৃষ্টি আর সুলতানের দৃষ্টিতে অনেক পার্থক্য। সবার আগে ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করার চেষ্টা করব।’

তাবু থেকে বেরিয়ে এলেন আলী বিন সুফিয়ান। একজন প্রহরী সালাম দিয়ে বলল, ‘আপনার সাথে একজন কমাণ্ডার কথা বলতে চাচ্ছেন।’

‘কি ব্যাপার?’

কমাণ্ডার এগিয়ে এসে বলল, ‘কালকে সাতজন মেয়ের মধ্যে একজন পালিয়ে গেছে। এ ছাড়া কাল রাতের ডিউটি কমাণ্ডার ফখরুল মিসরীকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রহরী বলছে, ডিউটি বদলের সময় তিনি তা চেক করতে বেরিয়ে ছিলেন। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। সুলতানকে এ খবরটি দেয়া জরুরী।’

গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন আলী বিন সুফিয়ান। কমাণ্ডার তার কাছে এসে অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘একটা খৃস্টান মেয়ে চলে যাওয়ার ঘটনা কি খুব গুরত্বপূর্ণ?’

খানিকটা ভেবে নিয়ে আলী বললেন, ‘শোন, সুলতানকে এখন কিছু বলার দরকার নেই। ফখরুল যখন টহল দিতে বেরিয়েছিলেন তখনকার সব প্রহরীদের ডেকে নিয়ে এস। কাল যেসব রক্ষী সুলতানের সাথে সাগর পারে গিয়েছিলেন তাদেরও ডাকবে।’

খবর পেয়ে চারজন প্রহরী এসে হাজির হল। আলী বললেন, ‘কাল যেখানে ব্যবসায়ী এবং মেয়েদের পেয়েছ সেখানে যাও। ব্যবসায়ীরা না গিয়ে থাকলে আমার না আসা পর্যন্ত যেতে দেবে না। না পেলে জলদি ফিরে এস।’

রক্ষীরা চলে গেল। মেয়েদের তাবুর কাছে পৌঁছলেন আলী। তাবুর বাইরে বসে আছে মেয়েরা। পাশে দাঁড়িয়ে আছে পাহারাদার। আলী মেয়েদের মুখোমুখি হয়ে আরবীতে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা এখানে ছ’জন কেন, আরেকজন কোথায়?’

ওরা পরস্পরের দিকে চাইতে লাগল। আলীর দিকে তাকিয়ে মাথা এপাশ ওপাশ করে বোঝালো তারা আরবী জানেনা।

‘তোমরা সবাই আমার ভাষা বোঝ।’

ওরা হতবাক দৃষ্টিতে আলীর দিকে তাকিয়ে রইল। ওদের সহজ সরল চেহারা দেখে দ্বিধায় পড়লেন গোয়েন্দা প্রধান। এরপর মেয়েদের পেছেনে গিয়ে আরবী ভাষায় বললে, ‘এদের উলংগ করে বারজন কাফ্রী সেপাই ডেকে নিয়ে এস।’

ওরা সবাই এক সঙ্গে পেছনে ফিরল। আতংকিত কণ্ঠে দু’তিনজন একসঙ্গে বলে উঠল, ‘মেয়েদের সাথে তোমরা এমন ব্যবহার করতে পারনা। আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি।’

হেসে ফেললেন আলী বিন সুফিয়ান। ‘তোমাদের সাথে খুব ভাল ব্যবহার করব। এক ধমকেই আরবী বলতে শুরু করেছ। এবার ধমক ছাড়াই বল সপ্তম মেয়েটা কোথায়?’

ওরা অজ্ঞতা প্রকাশ করলে আলী বললেন, ‘এ প্রশ্নের জবাব অবশ্যই তোমরা দেবে। একটু আগেও তোমরা বলেছ আরবী জানোনা, এখনতো দিব্বি আরবীতে কথা বলতে পারছ। ঠিক আছে, প্রশ্নের জবাব কি করে পাওয়া যায় আমি দেখছি। সেন্ট্রি, ওদের তাবুর ভিতরে নিয়ে যাও।

রাতের প্রহরী এল। ওদের অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন গোয়েন্দা প্রধান। মেয়েদের তাবুর প্রহরী বলল, ‘আমাকে দাঁড় করিয়ে তিনি বন্দীদের তাবুর দিকে গেলেন। কিছুক্ষণ পর একটা শব্দ শুনলাম, ‘কে তুমি, নেমে এস।’ মনে হল টিলার ওপর একটা ছায়াও দেখেছি। তবে খুবই অস্পষ্ট।

টিলার কাছে গেলেন গোয়েন্দা প্রধান। বালিতে পায়ের ছাপ সুস্পষ্ট। একটা সৈনিক বুটের ছাপ, অন্যটা মেয়েলী জুতো। মেয়েলী জুতার চিহ্ন ধরে আহত বন্দীদের তাবু পর্যন্ত চলে এলেন আলী। তাবুর পর্দা তুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। শুয়ে আছে পাঁচজন, একজন বসা। আলীকে দেখেই সে শুয়ে কাৎরাতে লাগল। আলী তার কাঁধ খামচে ধরে বাইরে নিয়ে এলেন।

‘রাতে একটা মেয়ে তোমার কাছে এসেছিল কেন?’

রবিন হাবার মত তাকিয়ে রইল। যেন এসব কথা সেকিছুই বুঝতে পারছে না। আলী তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমি তোমার ভাষা বুঝি। কিন্তু তোমাকে আমার ভাষাতেই কথা বলতে হবে।

রবিন তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ‘ওকে এখানে বসিয়ে রাখ।’ প্রহরীকে বলে আবার তাবুর ভেতরে ঢুকলেন আলী। বন্দীদের বললেন, ‘কাল রাতে মেয়েটা কতক্ষণ এখানে ছিল? নিজেদের যন্ত্রণার মধ্যে ফেলো না, জলদি জবাব দাও ও কার কাছে এসেছিল?

সাগরের উত্তাল তরঙ্গের সাথে লড়াই করে ওরা বেঁচে আছে। দেখেছে মৃত্যুর বিভীর্ষিকা। অথচ গোয়েন্দা প্রধানের একা কড়া ধমক খেতেই একজন বলে উঠল, ‘ও এসেছিল রবিনের কাছে। শুয়েছিল কি বসেছিল অন্ধকারে দেখা যায়নি। কি বলেছে তাও শুনিনি। মেয়েটা যে কে তাও জানিনা। রবিনের পদমর্যাদা সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ, আমরা শুধু তার নাম শুনেছি। এখানে আসরা আগমুহূর্ত পর্যন্ত সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল ও। আমরা সাবই সাধারণ সৈনিক। আমাদের ওপর রহম করুন।’

ওদের ওপর করা দৃষ্টি রাখতে বললেন প্রহরীদের। ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছলেন তিনি। রক্ষীরা ওদের তাবুর সানে বসিয়ে রেখেছে। রক্ষীরা বলল, ‘কাল দু’টো উট দেখেছি, আজ একটা নেই।’

গোয়েন্দা প্রধানের জন্য এটা একটা মূল্যবান সংবাদ। ওদর জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু সন্তোষজনক জবাব দিতে পারল না ওরা। উটের পায়ের চিহ্ন পাওয়া গেল। আলী বললেন, ‘তোমরা সাধারণ চুরির অপরাধে অপরাধী নও। তোমরা একটা দেশ এবং একটা জাতির জন্য বিপজ্জনক। ক্ষমা তোমাদের করা যায় না। তোমরা কি ব্যবসায়ী?’

‘হ্যাঁ।’ সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল। ‘আমরা ব্যবসায়ী, আমরা নিরপরাধ।’

সবাই হাতের উল্টাো পিঠ দেখাও।’

হাত উল্টে এগিয়ে ধরল ওরা। বাঁ হাতের তর্জনী এবং মধ্যমার মাঝখানটা দেখলেন আলী। একজনের হাতের কব্জি ধরে বললেন, ‘তীর কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?’

ওরা না জানার ভান করল। সুলতানের এক দেহরক্ষীকে ডাকলেন আলী। উল্টো করলেন তার হাত। বললেন, ‘এ লোকটি আমাদের তীরন্দাজ। ওর দু আঙ্গুলের ফাঁকে তীরের ঘর্ষণের চিহ্ন রয়েছে। ধনুকে তীর জুড়ে নিক্ষেপের সময় তর্জনী এবং মধ্যমার ফাঁক দিয়ে তীর ছুটে যায়। তীরন্দাজ ছাড়া অন্য কারো এ চিহ্ন থাকেনা। পাঁচজনের মধ্যে কেবল তোমার আঙ্গুলে এই চিহ্ন রয়েছে। এবার বল তীর কোথায়?’

পাঁচজনই নীরব। ওদের একজনকে ধরে রক্ষীকে বললনে, ‘একে ওই গাছের সাথে বেঁধে দাও।’

তারপর অন্য এক রক্ষীকে ডেকে কানে কানে কিছু বললেন। রক্ষী লোকটাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল। বিঁধল ডান চোখে। তড়াপাতে লাগল লোকটা।

‘ক্রুশের জন্য এভাবে আর কে জীবন দিতে পার? একে দেখ, তড়পাচ্ছে। রক্ত ঝরছে চোখ থেকে। কথা দিচ্ছি, তোমাদের সসম্মানে সাগরের ওপারে পাঠিয়ে দেব।  বল দ্বিতীয় উট কে নিয়ে গেছে? কোথায় গেছে?

তোমাদের এক কমাণ্ডার আমাদের একটি উট ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।

‘সাথে একটি মেয়েও।’ আলীর কণ্ঠে বিদ্রুপ।

শেষতক স্বীকার করল ওরা। শোনাল সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী সম্পর্কে মেয়েটার বলা মিথ্যা কাহিনী। কিন্তু তাবু থেকে পালিয়ে আসাটা চেপে গের।

আলীর ঠোটে শ্লেষের হাসি।

‘আশ্চর্য! একজন মাত্র লোক তোমাদের মত পাঁচজন সৈনিকের কাছ থেকে একটা উট এবং একটা মেয়ে ছিনিয়ে নিয়ে গেল?

তীর ধনুক বের করা হল বালির নীচ থেকে। তড়পাতে তড়পাতে মরে গেল তীর খাওয়া লোকটা।

দশজন অশ্বারোহী ডেকে দ্রুত উটের পায়ের চিহ্ন ধরে এগিয়ে যেতে বললেন গোয়েেন্দা প্রধান। ওদের যাবার পনের ঘন্টা পর তাদের পিছু ধাওয়া করে ছুটল আলীর বাহিনী।

খাওয়া এবং বিশ্রাম ছাড়া উট একনাগাড়ে ছ’সাত ঘন্টা চলতে পারে। ধরা পড়ার ভয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল ফখরুল। মরুর জাহাস উটও তার সহযোগিতা করছিল।

পথে দুজায়গায় উট বসার চিহ্ন পাওয়া গেল। পাশে খেজুরের বীচি, ফলের খোসা। আরো কিছুটা এগিয়ে আলী খাবার রাখার দু’টো থলে কুড়িয়ে পেলেন। একটা খালি, অন্যটাতে তখনও বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্য অবশিষ্ট ছিল। খাবারগুলো নাকের কাছে নিতেই পরিচিত একটা গন্ধ নাকে লাগর। আলী বললেন, ‘এ খাবারে হাশিশ মেশানো।’

থলে দু’টো নিয়ে আবার চলতে লাগল কাফেলা। বিচক্ষণ আরী সময় নষ্ট না করে কাফেলাকে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে চললেন।

ফখরুল মিসরী এবং মুবি ধরা পড়লেও কিছু যায় আসে না। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সুদানী সেনাবাহিনীকে নতুন করে প্ররোচিত করার কিছু ছিল না। মুবির প্ররোচনা ছাড়াই আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ ভরা ছিল ওদের হৃদয়গুলো। এ বিষ ওদের পান করিয়েছিল নাজি। ফাতেমী খেলাফতের সেনাপতিরা ছিল নামে মাত্র জেনারেল। ওরা ছিল অকর্মণ্য ও বিলাসপ্রিয়। আইয়ুবীকে অথর্ব প্রমাণ করতে চাইছিল ওরাও।

মুসলিম শাসকরা খৃস্টান এবং ইহুদী যুবতীল রূপের হারেমে বন্দী। উপদেষ্টাদের বেশীরভাগ ইহুদী বা খৃস্টান। ভোগ আর সুরার অন্ধাকারে হারিয়ে গিয়েছিল ওদের বিবেক।

ওদেরকে হারেমের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করবেন আইয়ুবী, জাগিয়ে তুলবেন জাতির বিবেক, জেগে উঠবে মানবতা, এ অসহ্য। শেরে কোহ-এর শাসন থেকে ওরা বুঝেছিল, সালাহউদ্দীন আইয়ুবী তাদেরকে ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করবেন। তাই তার সব পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে চাচ্ছিল ওরা। এ জন্য সাহায্যের আশায় হাত বাড়াল খৃস্টানদের কাছে। ওরা ময়দান উর্বর করছির খৃস্টান গোয়োন্দাদের জন্য।

নুরুদ্দীন জংগী না হলে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ইতিহাস হয়ত অন্যভাবে লেখা হত। বিশ্বের মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যেতনা এতগুলো মুসলিম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব।

আলীর চিঠি পেলেন নুরুদ্দীন জংগী। ঘ্ড়োসওয়ার এবং পদাতিক মিলে দু’হাজার সৈন্য পাঠালেন আইয়ূবীর সাহায্য।

নাজির মৃত্যু সংবাদ পৌছে গেল সুদানী সেনা শিবিরে। সুলতান যুদ্ধের ময়দানে, মিসরে রয়েছে অল্প ক’জন সৈন্য, আক্রমণের সুবর্ন সুযোগ। মিসরের সেনা ছাউনিতে হঠাৎ আক্রমণ করা হবে এ সিদ্ধান্ত নিল ওরা।

মিসরে পৌঁছল আলীর ক্ষুদ্র কাফেলা। মুবি এবং ফখরুলকে পাওয়া যায়নি। সুদানী হেড কোয়ার্টারে নিয়োজিত গোয়োন্দাদের ডেকে পাঠালেন তিনি এক গোপন আস্তানায়। ওদের একজন বলল, ‘গতরাতে একটা উট এসেছে। আরোহী একজন পুরুষ ও এক যুবতী।’

‘কোথায় উঠেছে ওরা?’

ওরা কোথায় উঠেছে গোয়োন্দা তার বিশদ বর্ণনা দিল। সুদানীরা মুসলিম ফৌজেরই অংশ, ইচ্ছে করলে আলী যে কারো বাসায় তল্লাশী নিতে পারেন। এতে আগুণে ঘি ঢালা হবে। আরও ক্ষেপে যাবে সুদানী ফৌজ। মুবিকে গ্রেফতার করা তার আসল উদ্দেশ্য নয়, তার উদ্দেশ্য ওদের পরিকল্পনা জানা। নতুন নির্দেশ দিয়ে গোয়োন্দাদের ফেরত পাঠালেন তিনি।

চারদিন পর্যন্ত রাজধানীর বাইরে ঘোরাঘুরি করলেন আলী। পঞ্চম রতে খোলা আকাশের নীচে বসে আছেন তিনি। বিশ্রাম করছেন আর ফাঁকে ফাঁকে শুনছেন গুপ্তচরদের রিপোর্ট।

এক গোয়োন্দা একটা লোককে ধরে নিয়ে এল। পা কাঁপছিল লোকটির, পড়ে যাচ্ছিল বারবার। গোয়োন্দা বলল, ‘ওর নাম নাকি ফখরুল মিসরী, জড়ানো কণ্ঠে ও শুধু বলছে আমাকে আমার সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছে দাঁও।’

ফখরুল গোয়োন্দা প্রধানের সামনে বসল।

‘একটা মেয়ে নিয়ে যে পালিয়ৈ এসেছে তুমি কি সেই কমাণ্ডার?’

‘আমিই সুলতানের রক্ষী বাহিনীর সেই পলাতক আসামী। মৃত্যুদণ্ডই আমার প্রাপ্য। তবে আমাকে মারার আগে আমার কথা শোন, নয়ত তোমরা সবাই মরবে।

আলী বুঝলেন, কমাণ্ডারের এখনও নেশা কাটেনি। তাকে অফিসে নিয়ে গেলেন। পথে পাওয়া খাবারে থলে দেখিয়ে বললেন, ‘এটা কি তোমার? এখান থেকে কে খেয়েছে?’

‘হ্যাঁ, ও আমাকে এ থেকে খাইয়েছে।’

আলী থলে খুললেন। গুড়ের মত একটা টুকরা বেরিয়ে এল। এক ঝটকায় টুকরাটা হাতে তুলে নিল ফখরুল। মুখে দেওয়ার আগেই আলী তার হাত ধরে ফেললেন।

‘দোহাই আপনার, ছেড়ে দিন। এর ভেতর আমার জীবন, আমার আত্মা।’

‘আগে সব কথা খুলে বল। এরপর এর সবই তোমার।

কমাণ্ডারকে এন্টি ড্রাগ খাওয়ানো হল। কিছুটা প্রকৃতিস্থ হলে গোটা কাহিনী বলল সে।

‘ব্যবসায়ীরা আমাকে কফি পান করাল। মনে হল অন্য পৃথিবীতে পৌঁছে গেছি আমি। মেয়েটা আমাকে ভালবাসার কথা বলল, লোভ দেখাল বিয়ের। আমরা দু’জন উটে সওয়ার হলাম।

পথে ধরা পড়ার ভয়ে বিশ্রাম করেছি কম। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করত। আমার পাশবিক সত্তা জেগে উঠলে বলত, এখন নয়, বিয়ের পর ওসব হবে। উটের সাথে খাদ্যের দুটো ব্যাগ, একটা থেকে ও খেত, আমাকে দিত অন্যটা থেকে। পথে থলে দু’টো কোথাও পড়ে গেল। খোঁজ করার জন্য পীড়াপীড়ি করল ও, আমি রাজি হইনি। বলেছি সময় নষ্ট হলে ধরা পড়ে যাব। খাবারের অভাব হলো, কিন্তু বসতি থেকে দূরে থাকতে চাইত ও।

চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় আমরা এক সুদানী কমাণ্ডারের কাছে পৌঁছলাম। আমার মাথায় অসংখ্য কীটের দংশন। কেন জানিনা, ধীরে ধীরে প্রকৃতিস্থ হলাম। মেয়েটা আমার সামনেই কমাণ্ডারকে সব কথা বলল। প্ররোচিত করতে লাগল বিদ্রোহ করার জন্য। বলল, আলী এবং আইয়ূবীর মাঝে ভুল বুঝাবুঝীর সৃষ্টি করতে হবে। তাদের দীর্ঘ আলোচনায় বিদ্রোহের কথাই প্রাধান্য পেয়েছে। তথোক্ষণে আমি পুরোপুরি সুস্থ।

আবার মাথার যন্ত্রণা, আবার সুস্থ, এভাবে চলতে লাগল। মেয়েটা কমাণ্ডারকে বলল, আইয়ুবী নেই, এখনি বিদ্রোহ করার উপযুক্ত সময়। ও আরও বলল, কিছু দিনের মধ্যেই খৃস্টান সৈন্যরা আবার আক্রমণ করবে। তখন আইয়ুবীকে এখানকার ফৌজও ডেকে নিতে হবে। কমাণ্ডার তার কথায় সম্মত হয়ে বলল, ছ’ সাত দিনের মধ্যেই তারা বিদ্রোহ করবে।

মাঝ রাতে আমাকে অন্য এক কামরায় পাঠিয়ে দেয়া হল। দু’কক্ষের মাঝে ছোট একটি দরজা। দরজাটি ওপাশ থেকে বন্ধ।

কমাণ্ডার এবং মেয়েটা হাসির শব্দ ভেসে আসছিল ও পাশ থেকে। আমার ঘুম আসছিল না। উঠে দরজায় কান লাগিয়ে উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। মেয়েটা বলল, ‘ওকে হাশিশ খাইয়ে এদ্দুর এনেছি। একা এতদূর আসা সম্ভব ছিল না বলে পথে ছিলাম ওর প্রেমিকা। পথে হাশিশের পুটলিটা পড়ে গেছে। সকালে এক পুরিয়া না পেলে বিরক্ত করবে।

এরপর বুঝলাম, মদপানের সাথে সাথে ওরা পাপের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। অনেক পরে কমাণ্ডারের কণ্ঠ ভেসে এল, ‘ওর এখন আমাদের প্রয়োজন নেই। জেলে পাঠিয়ে দেব, না হয় মেরে ফেলব।’

‘বরং তাকে মেরেই ফেল।’ মেয়েটার কণ্ঠ, ‘থাকলে ঝামেলা করতে পারে।’

পালানোর চিন্তা করলাম, রাতের শেষ প্রহরে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। ভোরের আলো ফোটার আগেই অনেক দূর চলে এলাম। এবার দু’দিক থেকে ধাওয়াকারীদের ভয়, খৃস্টান বা সুদানীরা পেলে হত্যা করবে, আমাদের ফৌজের কাছেও আমি অপরাধী। তাই দিনে লুকিয়ে থাকতাম কোন পড়োবাড়ীতে। দেহ এবং মস্তিষ্ক দুটোই দুর্বল।

পথ চলতাম রাতে। কখনো ইচ্ছে হতো, ফিরে গিয়ে খৃস্টান মেয়েটাকে হত্যা করি। আবার ভাবতাম, সুলতানের পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইব। কিন্তু কিছুই সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারছিলাম না। এভাবে হাঁটছি, এ লোকটার সাথে দেখা। ও আমাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে।

সুদানীরা আক্রমণ করবে এখন এ আর আশংকা নয়, বাস্তব। সুলতানকে সংবাদ দিতে হবে, নষ্ট করার মত সময় নেই। কি করে দ্রুত সুলতানকে সংবাদ দিতে হবে, নষ্ট করার মত সময় নেই। কি করে দ্রুত সুলতানকে খবর দেয়া যায় ভাবতে লাগলেন আলী। একজন অফিসার এসে বলল, ‘সুলতান আপনাকে স্মরণ করেছেন।’

‘সুলতান!’ আলীর অবাক কণ্ঠ, ‘তিনি তো যুদ্ধের ময়দানে! এলেন কখন?’

সাথে সাথে সুলতানের সাথে দেখা করলেন তিনি। সুলতান বললেন, ‘সংবাদ পেলাম যুদ্ধের ময়দানে এবং এদিকে ওদের অনেক গুপ্তচর ছড়িয়ে পড়েছে। ওখানে আমার কাজ নেই। এ দিক নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি, তাই চলে এলাম।’

সব ঘটনা খুলে বললেন আলী। ‘সুলতান, আপনি বললে জংগীর ফৌজ আসা পর্যন্ত বিদ্রোহ মুলতবী করার চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমাদের সৈন্য কম, ওদের আক্রমণ ঠেকাতে পারব না।’ সুলতান পায়চারি করতে লাগলেন। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন তিনি। আলী অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন সুলতানে দিকে কক্ষে নীরবতা।

হঠাৎ পায়চারী থামিয়ে সুলতান বললেন, ‘হ্যাঁ! আলী, এবার তোমার ভাষা ব্যবহার কর। আক্রমণের বিপক্ষে নয়, পক্ষে। ওরা আক্রমণ করবে রাতে, যখন ঘুমিয়ে থাকবে আমাদের ফৌজ।’

আলীর চোখে অবাক বিস্ময়। সুলতান মুখ খুললেন, ‘সব কমাণ্ডারদের ডেকে নিয়ে এস। মনে রেখ আমি এখনো যুদ্ধের ময়দানে। আমি এসেছি কেউ যেন জানতে না পারে।

তিন রাত পর। গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে সমগ্র কায়রো। একদিন পূর্বে ফৌজকে শহরের বাইরে যেতে দেখা গেছে। বলা হয়েছে সামরিক মহড়ায় অংশ নিতে যাচ্ছে ওরা। নীলনদের পাড়ে বালিয়াড়ি আর টিলা।

টিলা এবং নদীর মাঝখানে ছাউনি ফেলল ওরা। পদাতিক এবং অশ্বারোহী সৈন্য। মাঝরাতে অশ্বক্ষুরের শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠল কায়রোবাসী। শহরের বাইরে যেন রোজ কিয়ামত। ওরা মনে করল সামরিক মহড়া।

শব্দগুলো এগিয়ে আসছে। বাড়ীর ছাদে উঠে এল উৎসুক জনতা। দিগন্তের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। দেখা গেল নীলের শান্ত বুক থেকে উঠে আসছে অগ্নিগোলক। ছাউনি লক্ষ্য করে রাতের বুক চিরে এগিয়ে আসছে তীব্র গতিতে।

শহরময় ছড়িয়ে পড়ল অশ্বক্ষুর ধ্বনি। মানুষ জানল না সুদানী ফৌজের বেশীরভাগ জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হচ্ছে। সুলতান আইয়ুবীর কৌশল আবারো অভ্রান্ত প্রমাণিত হল। নীল আর পাহাড়ের মাঝের বালিয়াড়িতে তাবু ফেলল তার ক্ষুদ্র বাহিনী।

সুদানী ফৌজ দু’ভাগে ভাগ হল। মধ্যরাতে একভাগ মার্চ করল রোম উপসাগরের দিকে। সেখানে পরাজিত হয়েছে খৃস্টান বাহিনী। অন্যভাগ নীলের পাড়ের ছাউনিতে আক্রমণ করল। সুর্যোদয়ের পূবেই রাজধানী দখল করবে ওরা। দ্রুততার সাথে সুদানী বাহিনী সুলতানের ফৌজের ছাউনি দখল করল।

আচম্বিত তাবুতে নিক্ষিপ্ত হতে লাগল আগুণের গোলা। নীল থেকেও ছুটে আসছিল অগ্নিগোলক। তাবুতে আগুন ধরে গেল। অবাক হয়ৈ ওরা দেখল, আইয়ুবীর একজন সৈন্যও নেই তাবুতে।

রাতের প্রথম প্রহরেই সৈন্যদের সরিয়ে নিয়েছিলেন আইয়ুবী পাহাড়ে এবং নদীতে। ওদর দিলেন বহনযোগ্য কামান মিনজানিক। তাবুগুলো ভরে দিলেন তেলে ভেজা খড় এবং শুকনো ঘাস দিয়ে। সুদানী সৈন্যরা তাবুর কাছে এল। পাহাড় এবং নদী থেকে নিক্ষীপ্ত তোপের আঘাতে আগুন ধরে গের শুনকো খড়ে। সুদানী ঘোড়সওয়াররা পদাতিকদের পিষে ফেলতে লাগর। চারদিকে আগুনের লেলিহান শীখা। বেরোতে গিয়ে জীবন্ত পুড়ে মরল অনেক সৈন্য। বেরিয়ে এলে পড়ত মুসলিম বাহিনীর তীরের আওতায়।

সুদানী ফৌজের অন্য দল এগিয়ে যাচ্ছিল রোম উপসাগরের দিকে। তাদের ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন সুলতান আইয়ুবী। পাহাড়ের ফাঁকে লুকিয়েছিল কমাণ্ডো বাহিনী। সুদানী ফৌজের পেছনে থেকে আক্রমণ করত ওরা। সৈন্যরা কিছু বোঝার আগেই পালিয়ে যেত। প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করে আবার এগিয়ে চলত সুদানী বাহিনী। আবার পেছন থেকে আচমকা আক্রমণ।

অন্ধকার রাত। এ অন্ধকারে কমাণ্ডোদের ধাওয়া করা অসম্ভব। ভোর পর্যন্ত তিনাবর আক্রান্ত হল ওরা। ভয় পেয়ে থেমে গেল ফৌজ। সামনে এগিয়ে যাবার সাহস হারিয়ে ফেলেছে ওরা।

দিনের বেলা কমাণ্ডাররা তাদের বোঝাল। সাহস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল সৈন্যদের। রাতে আবার আক্রমণ হল। অদৃশ্য শত্রুর তীরের আঘাতে মারা পড়ল অসংখ্য সৈন্য। হঠাৎ মাল বোঝাই উটগুলো দিকবিদিক ছুটতে লাগল। মাঝ পথে আগুন জ্বলছে। মাত্র দু’রাতের কমাণ্ডো আক্রমণে সুদানী বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল। সৈন্যদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ৈ দিল আলীর গোয়োন্দারা। আরব থেকে বিশাল বাহিনী আসার সংবাদে ভয় পেয়ে গেল ওরা। যে যেদিকে পারল পালিয়ে গেল।

নিঃশেষ হয়ে গেল সুদানী বাহিনী।

ওদিকে জংগীর পাঠানো ফৌজ কায়রো এসে পৌঁছল। ইচ্ছে করলে সুলতান আইয়ুবী সুদানীদের নির্বিচারে হত্যা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেন। সুদানী কমাণ্ডাররা বুঝেছিল তারা অপরাধী, নিঃশেষ হয়ে গেছে ওদের সামরিক শক্তি। ওরা যে অপরধ করেছে তাতে একমাত্র মৃত্যুদণ্ডই ওদর প্রাপ্য।

কিন্তু সুলতান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। সৈন্যদেরকে সরকারী জমি দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হল। এরপর ঘোষণা করা হল মিসরের সেনাবাহিনীতে ভর্তিচ্ছুদের স্বাগত জানানো হবে।

জংগীর পাঠানো সৈন্য, মিসরের ফৌজ এবং সুদানী বাহিনীর নতুন লোকদের নিয়ে সুলতান আইয়ুবী এক সুশৃখল এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুললনে।

আলী বিন সুফিয়ান তৈরী করলেন দুঃসাহসী কমাণ্ডো এবং গেরিলা বাহিনী।

খৃস্টানরাও অপরূপা সুন্দরী তরুণী এবং গুপ্তচরদেরকে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দিল। দু’পক্ষেরই সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন প্রায়।

সুলতান এসব সুন্দরী তরুনীদের বিষাক্ত ছোবল কিভাবে মোকাবেলা করবেন আর খৃস্টানরাই বা কিভাবে মোকাবেলা করবে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সুশৃঙ্খল বাহিনীর উভয় পক্ষ তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইল।

কিন্তু এ পায়তারা শেষ হতে বেশী দিন সময় লাগল না। অল্পদিনের মধ্যেই ভয়ংকর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল ওরা।

রোমের এক উপশহর। জরুরী সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন খৃস্টান নেতৃবৃন্দ। এর মধ্যে রয়েছেন সম্রাট অগাস্টাস, সম্রাট রিমাণ্ড, এলমার্ক, সপ্তম লুইয়ের ভাই রবার্ট।

এদের মধ্যে সবচে’ ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছিল এমলার্ককে। খৃস্টানদের সম্মিলিত নৌবাহিনীর প্রধান তিনি। সুলতান সালাহউদ্দীনের হাতে পর্যুদস্ত হয়ে মেজাজ বিগড়ে গেছে তারা। বিজয় দূরে থাক, উপকূলের কাছেও ঘেঁষতে পারেনি সে। যারাই মিসর উপকূলে পা রাখার দুঃসাহস দেখিয়েছে, তারা হয়েছে বন্দী, নয়তো নিহত।

সুলতান আইয়ূবীর গোলন্দাজদের তোপের আঘাতে পুড়ে গেছে জাহাজের পাল এবং মাস্তুল। ভাগ্য ভাল যে সিপাইরা তার জাহাজের আগুন নিভাতে সক্ষম হয়েছিল।

পাল ছেঁড়া জাহাজ ঢেউয়ের দোলায় এগিয়ে গিয়ে পড়ল সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে। অনেক জাহাজ এবং নৌকা ঝড়ে ডুবে গেল। তার জাহাজের মাঝি মাল্লা সাহসিকতার সাথে ঝড়ের মোকাবিলা করল। একদিন পৌঁছল সমুদ্র উপকূলে। তীরে নেমেই মাঝি মাল্লাদের পুরস্কৃত করল এমলার্ক।

খৃস্টান নেতারা তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সম্মেলনের উদ্দেশ্য পরাজয়ের কারণ নিয়ে পর্যালোচনা করা। কেউ কি তাদের সাথে প্রতারণা করেছে? কে সে, নাজি?

তার চিঠি পেয়েই নৌসেনা পাঠানো হয়েছিল। নাজির চিঠি তাদের কাছে নতুন নয়। আগের লেখাগুলোর সাথে এ লেখার হুবুহ মিল আছে।

ওরা আবার চিঠি খুলে বসল। কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। কায়রো থেকে গোয়েন্দারা কোন সংবাদ দেয়নি। নাজি কথায় তাও ওরা জানেনা।

রাগে কাঁপছিল এমলার্ক। আইয়ুবীকে হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে নিয়ে আসবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল সে। তার দর্প চুর্ণ হয়ে গেছে। এমলার্ক পরাজিত, ক্লান্ত।

কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলো না ওরা। সম্মেলন পরদিনের জন্য মুলতবী ঘোষণা করা হল।

রাতে মদের আসর চলছে। এক অপরিচিত মুখ ভেতরে এল। শুধু রিমাণ্ড চেনে তাকে। বিশ্বস্ত গোয়োন্দা। আক্রমণের দিন সন্ধ্যায় তাকে মিসরের উপকূলে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। তার চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে খৃস্টানদের নৌবহর।

রিমাণ্ড গোয়োন্দার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দির। ভিড় জমে উঠল তার চারপাশে। গোয়েন্দা বলল, ‘আহত হওয়ার ভান করে রবিন আইয়ুবীর ছাউনিতে পৌঁছে গেছে। রবিনের সহযোগী পাঁচজন ছিল। ব্যবসায়ীর পোশাকে। তাদের একজন ক্রিস্টোফার। সে তীর ছুঁড়েছিল আইয়ুবীকে লক্ষ্য করে। লাগেনি।

ধরা পড়েছে পাঁচজনই। সাথে সাতটা মেয়ে। ওরা চমৎকার গল্প ফেঁদেছিল। আইয়ুবী মেয়েগুলোকে রেখে ছেড়ে দিয়েছিল বাকী পাঁচজনকে। কিন্তু এদের গোয়োন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান এসে সবাইকে গ্রেফতার করল। কথা আদায় করতে গিয়ে অত্যাচার করে মেরে ফেলল একজনকে। অপরাধ স্বীকার করল অন্যরা।

আমি নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়েছিলাম। সুলতান আমাকে আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব দিলেন। শুনেছি সুদানীদের বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে। বড় বড় অফিসারদের গ্রেফতার করা হয়েছে। রবিনসহ এগারজন বন্দী করা হয়েছে। সুবিনা আর তালাশকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ছাউনিতে আইয়ুবীও নেই, নেই আলী বিন সুফিয়ানও। অনেক টাকার বিনিময়ে একটা নৌকা জোগাড় করে আমি পালিয়ে এসেছি।

রবিন এবং অন্যদের উদ্ধার না করলে মারা পড়বে। ছেলেদের না হলেও মেয়েগুলোকে মুক্ত করা জরুরী। ওরা শুধু সুন্দরী ও যুবতীই নয়, মুসলমান আমীর ওমরাদের ফাঁসানোর জন্য ওদেরকে দীর্ঘদিন ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। এরকম সাতটা চৌকস মেয়ে তৈরী করতে অনেক সময় ও কাঠখড় পোড়াতে হবে আমাদের। মুসলমানরা তাদের কি অবস্থা করেছে কল্পনাও করতে পারবেন না।’

‘এ ধরনের সেক্রিফাইস তো আমাদের করতেই হবে।’ সম্রাট অগাস্টাস বললেন, ‘মেয়েদের মেরে ফেলা হবে এ নিশ্চয়তা তোমাকে কে দিল?’

রিমাণ্ড বলল, ‘কিন্তু তাই বলে মুসলমানরা ওদের সাথে পশুর মত আচরণ করবে আর আমরা চুপ করে বসে থাকব, তা হয়না। আমি ওদের মুক্ত করার চেষ্টা করব।’

রবার্ট বলল, ‘ভাল ব্যবহার করে মুসলমানরা ওদেরকে আমাদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করতে পারে। ওদের মুক্ত করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা অর্ধেক সম্পদ এর জন্য ব্যয় করতে প্রস্তুত।’

‘ওরা মেয়ে বলেই এত দামী তা নয়।’ গোয়েন্দাটি বলল, ‘ওরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তাছাড়া এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এমন মেয়ে ক’টাই বা পাওয়া যায়? আপনাদের যুবতী মেয়েরা কি এমনিভাবে শত্রুর হাতে নিজেকে তুলে দিতে পারবে? পারবে কি শত্রুর ভোগের সামগ্রী হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে? মৃদু হাসির যাদু দিয়ে পারবে বড় বড় দুশমনকে পদানত করতে?

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top