১. গাজী সালাহউদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযান

জাদুল আসাদির তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। শিরস্ত্রাণ খোলেননি। তাঁবুর বাইরে সশস্ত্র দেহরক্ষীরা পাহারা দিচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য রক্ষীবাহিনীর কমাণ্ডার একটু অন্যদিকে গেলেন। একজন গার্ড পর্দা
ঈষৎ ফাঁক করে উঁকি দিল তাবুর ভেতর। দু’চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন সুলতান। গার্ড বাইরে দাঁড়ানোর চারজন সঙ্গীর দিকে তাকার। চোখ বন্ধ করে খুলল একবার। সে চারজন দেহরক্ষী অন্যদের সাথে গল্প জুড়ে দিল।

তাঁবুতে ঢুকল প্রথম রক্ষী। খঞ্জর হাতে নিল। বিড়ালের মত নিঃশব্দে এগিয়ে গেল ঘুমন্ত সুলতানের দিকে। খঞ্জর বাগিয়ে ধরে হাত উপরে তুলল। আইয়ুবীর বুক লক্ষ্য করে যখন নেমে আসছীল হাত, ঠিক সে মুহূর্তে পাশ ফিরলেন তিনি। রক্ষীর আঘতা গিয়ে পড়ল সালাহউদ্দীন আইয়ুরীর শিরস্ত্রাণে।

বিদ্যুৎ গতিতে দাঁড়িয়ে গেলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। নিমিষেই ঘনটা আঁচ করে নিলেন। নিজের বাছাই করা দেহরক্ষী আক্রমণ করছে দেখেও হতবাক হলেন না।

রক্ষী শিরস্ত্রাণের পাশ কেটে মাটিতে গেঁছে যাওয়া খঞ্জর টেনে তুলছিল। পলকে পূর্ণ শক্তিতে রক্ষীর মুখে ঘুসি মারলেন সালাহউদ্দীন। মট করে হাড় ভাংগার শব্দ হল। বিকট শব্দ করে চিৎ হয়ে পরে গেল রক্ষী।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রক্ষীর হাত থেকে ছিটকে পড়া খঞ্জর নিজের হাতে তুলে নিলেন। চিৎকার শুনে বাইরে থেকে ছুটে এল দু’জন রক্ষী।

‘ওকে বেঁছে ফেল।’ নির্দেশ দিলেন সুলতান।

কিন্তু ওরা সুলতানের আদেশ  অমান্য করে উল্টো আইয়ুবীকেই আক্রমণ করে বসল। একা খঞ্জর দিয়ে দুই রক্ষীর তলোয়ারের মোকাবেলা করতে লাগলেন আইয়ুবী। তাবুর ভেতর শুরু হলো আসম এক লোমহর্ষক লড়াই।

দু’এক মিনিটের মধ্যেই অন্য গার্ডরাও ভেতরে প্রবেশ করল। অবাক বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত তারা তাকিয়ে রইল আউয়ুবী ও রক্ষীদের অসম লড়াইয়ের দিকে। সম্বিত ফিরে এলে একজন এগিয়ে এসে আঘাত করল রক্ষীদের। দেখাদেখি অন্য রক্ষীরাও ঝাঁপিয়ে পড়র। এবার রক্ষীরা দুই দল হয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করল। আপন পর পার্থক্য করতে না পেরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী।

সংঘর্ষ থেমে গেল। দু’জন নিহত হল এই সংঘর্ষে। আহত হল কয়েকজন, পালিয়ে গেল একজন। তদন্ত শেষে দেখা গেল দেহরক্ষীদের সাতজন ছিল ঘাতক দলের সদস্য। গুমাস্তিগীন নামে খলিফা সালেহের এক কেল্লাধিপতি আইয়ুবীকে হত্যার জন্য এদের নিয়োগ করেছিল।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে হত্যা করার এ ধরনের কয়েকটি প্রচেষ্টা পরপর ব্যর্থ হল। এ হত্যা পরিকল্পনার হোতা ছিল সাইফুদ্দীন। সাইফুদ্দীন ছিল সালাহউদ্দীনের চাচাতো ভাই খলিফা আস সালেহের একজন আমীর। যে সময়ের কথা বলছি, তখন মুসলিম বিশ্বের প্রধান হলেও কার্যত ইসলামী দুনিয়া ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত। বিভিন্ন প্রদেশের গভর্ণরগণ সুলতান উপাধি ধারণ করে বলতে গেলে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতো। এ ঘনটার পর একদিন ভোরে সাইফুনদ্দীনকে লক্ষ্য করে একটি চিঠি পাঠালেন সালাহউদ্দীন আইয়ুরী। তাতে তিনি লিখলেন, “খাঁচায় বন্দী পাখীল মাঝে তুমি চিত্তপ্রসাদ খোঁজ, নারী আর মদের মাঝে খোঁজ জীবনের মানে, কিন্তু জাননা সৈনিকের জীবন মানেই এক বিপজ্জনক খেলা।’

চিঠিটি লিখেছিলেন তিনি ১১৭৫ সালের এপ্রিল মাসে। খলিফা সালেহ এবং সাইফুদ্দীন খৃস্টানদের সহযোগিতায় আইয়ুরীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলো। পরাজিত হয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেল সাইফুদ্দীন। তার তাঁবুতে পাওয়া গেল আগণিত সম্পদ। পাওয়া গেল খাঁচায় বন্ধী রঙবেরঙের পাখী, এক ঝাঁক সুন্দরী তরুণী, নর্তকী, গয়িকা। বিভিন্ন প্রকার বাদ্যযন্ত্র আর পিপা ভর্তি মদ।

সালাহউদ্দীন খাঁচায় দুয়ার খুলে দিলেন, পাখীরা উড়ে গেল উন্মুক্ত আকাশে। নর্তকী, গায়িকা আর তরুণীদের মুক্ত করে দিলেন। চিঠি লিখলেন আমীর সাইফুদ্দীনের কাছে, ‘তোমরা বেঈমানী করে খৃস্টানদের সহযোগিতায় আমাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছ। একবারও কি ভেবেছ, তোমাদের এ ষড়যন্ত্র ইসলামী বিশ্বের মানচিত্র মুছে দিতে পারে? যদি আমাকেই ঈর্ষা কর, যদি আমিই তোমাদের শত্রু হয়ে থাকি, মেরে ফেল আমায়। দু’বার সে চেষ্টাও করেছ। সফল হওনি, আবার না হয় চেষ্টা করে দেখ। এবার সফল হলে হতেও পার।

যদি নিশ্চয়তা দিতে পারো, আমাকে হত্যা করলে ইসলাম আরো গৌরবোজ্জ্বল হবে, তবে আমার মাথা কেটে তোমাদের পায়ের কাছে রেখে দিতে বলব। মনে রোখো, অমুসলিম কখনো মুসলমানের বন্ধু হতে পারেনা। ইতিহাস এর সাক্ষী। ফ্রান্স সম্রাট এবং রিমাণ্ডের মত খৃস্টানকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সহযোগিতা করছ বলে তোমরা ওদের বন্ধু। ওরা সফল হলে ওদের প্রথম শিকার হবে তোমরাই। এরপর পৃথিবীর বুক থেকে ইসলামের নামও মুছে যাবে।

তোমরা যোদ্ধা জাতির সন্তান। সৈন্য হওয়া তোমাদের জাতীয় পেশা। প্রতিটি মুসলমানই আল্লাহর সৈনিক। তার জন্য শর্ত কেবল ঈমান ও সৎ কাজ। খাঁচায় বন্দী পাখীর মাঝে তুমি চিত্তপ্রসাদ খোঁজ, নারী আর মদের মাঝে খোঁজ জীবনের মানে, কিন্তু জাননা সৈনিকের জীবন মানেই এক বিপজ্জনক খেলা। অনুরোধ করি, আমার সাথে সহযোগিতা কর। জিহাদে শরীক হও,  না হলে কমপক্ষে বিরোধিতা করো না। আমি তোমাদের কোন শাস্তি দেবনা। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।’

            -সালাহউদ্দীন আইয়ুরী।

এ সব যুদ্ধের ফলে অজস্র যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর হাতে এসেছিল। বন্দীর সংখ্যা ছিল অগণিত। তিনি যুদ্ধলব্ধ সম্পদকে তিন ভাগে ভাগ করলেন। এক ভাগ যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে তাদের মুক্ত করে দিলেন। এক ভাগ দিলেন সৈন্য এবং গরীবদের। তৃতীয় ভাগ পাঠিয়ে দিলেন নিজমুল মুলক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেই তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন। নিজের জন্য এবং জেনারেলদের জন্য কিছুই রাখেননি। বন্দীদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। কিছু অমুসলিমও ছিল, আইয়ুবীর মহানুভবতায় ওরা তার আনুগত্য গ্রহণ করে সোবাহিনীতে ভর্তি হয়ে গেল।

ইবনে সাবার ফেদাই গ্রুপ দু’বার সালাহউদ্দীনকে হত্যা করার জন্য আক্রমণ করেছিল। ফেদাইদেরকে ঐতিহাসিকগণ  ঘাতক দল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দু’দু’বারই তিনি অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। তৃতীয় আক্রমণ হল খৃস্টান এবং সাইফুদ্দীনের সম্মিলিত শক্তিকে পরাজিত করার পর। সাইফুদ্দীন পালিয়ে গুপ্তঘাতক দলের সাহায্য কামনা করল।

সালাহউদ্দীনের প্রায় একশো বছর আগে হাসান ইবনে সাবা ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন উপদলের জন্ম দিয়েছিল। নিজেদের পরিচয় দিত মুসলমান হিসেবে। কিছু অলৌকিক কাজ দেখিয়ে মানুষকে অনুসারী বানাতো। সুন্দরী তরুণী, মদ, হিপটোনিজম এবং চাটুকারিতা ছিল ওদের পুঁজি। বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য ছিল বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ঘাতক দল। ওরা মানুষকে হত্যা করত গোপনে।

এরা ছিল সতর্ক, বুদ্ধিদীপ্ত এবং দুঃসাহসী। এরা পোশাক আশাক এবং ভাষা পরিবর্তন করে বড় বড় জেনারেলের দেহরক্ষীর চাকরী নিত। সময় সুযোগ বুঝে এমন ভাবে সারত হত্যার কাজ, নিহত ব্যক্তির হত্যাকারীকে কোনভাবেই খুঁজে পাওয়া যেতনা। ধীরে ধীরে ইবনে সাবার দল ঘাতকদল হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠল। রাজনৈতিক হত্যাকানণ্ডে ওরা ছিল পারদর্শী, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হত্যার কাজে ব্যবহার করত বিষ। সুন্দরী যুবতীরা মদের সাথে এ বিষ মিশিয়ে দিত।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে রূপসী নারী দিয়ে বা মদ খাওয়ে হত্যা করা সম্ভব ছিল না। তিনি এ দুটো থেকেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতেন সতর্কভাবে। ফলে আকস্মিক আক্রমণ ছাড়া তাকে হত্যা করার অন্য কোন পথ ছিল না। কিন্তু বিশ্বস্ত ও নিবেদিত প্রাণ দেহরক্ষীদের উপস্থিতিতে তাও ছিল অসম্ভব। সালাহউদ্দীন ভেবেছিলেন পরাজয়ের পর সালেহ এবং সাইফুদ্দীন আর মাথা তুলে দাঁড়াবে না। সম্মিলিত বাহিনীল অহমিকা চুর্ণ হবার পর আইয়ুবীর সাথে টক্কর দেওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে সংশোধন হয়ে যাবে। কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল ওরা।

বিজয়ের পর সালাহউদ্দীন আইয়ুবী তার অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখলেন। দখল করলেন গাজাসহ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।

সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী- দুঃসাহসী এক যোদ্ধা, অসাধারণ এক সেনাপতি। ইসলামের শত্রুরা আজো তাকে সম্বোধন করে ‘গ্রেট সালাদীন’ বলে, মুসলমনরা স্মরণ করে জাতীয় বীর হিসাবে।

মুসলিম মিল্লাতের ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে লেখা রয়েছে তার নাম। খৃস্টান জগৎ তার সাহস, বুদ্ধিমত্তা আর রণকৌশলৈর কথা কোনদিন ভুলতে পারবেনা। ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে আছে তার জয় পরাজয়ের বিস্ময়কর কাহিনী। কিন্তু ক্রুশের ধ্বজাধারীরা মদ আর রূপের মায়াজালে যে ষড়যন্ত্রের বিস্তার ঘটিয়েছিল, নিজেদের সে সব অপকর্মের চমকপ্রদ কাহিনী ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিতে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি।

১১৬৯ সালের ২৩ মার্চ। মিসরের গভর্ণর এবং সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে এলেন সালাহউদ্দীন। তিনি ছিলেন রাজ পরিবারের সন্তান। অল্প বয়সেই যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মনে করতেন শাসক রাজা নয়, শাসক হলো ইসলামের রক্ষক। বুদ্ধি হওয়ার পর তিনি দেখেছিলেন মুসলিম শাসকদের অনৈক্য। বিলাসপ্রিয় শাসকবর্গ সুন্দরী রমণী আর মদে আকণ্ঠ ডুবেছিল। গাদ্দারী, বিলাসিতা আর অবিশ্বাসের কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল মুসলিম মিল্লাতের ভবিষ্যত।

রাষ্ট্রের কর্ণধারদের হারেমের শোভা বর্ধন করছিল ইহুদী আর খৃস্টান যুবতীরা। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব সুন্দরী রমনীদের রূপের আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছিল মানুষের ইসলামী জোশ আর স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বার আবেগ অনুভূতি।

এ সুযোগে খৃস্টান শাসকগণ একের পর এক ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলো দখল করে নিচ্ছিল। মুসলিম শাসকবর্গ প্রজার রক্ত শুষে খৃষ্টানদেরকে বাৎসরিক কর প্রদান করত। ওদের সেনা শক্তির ভয়ে সর্বক্ষণ তটস্ত হয়ে থাকত। খৃস্টানরা মুসলমানদেরকে ভোগবিলাসের হারেমে বন্দী রেখে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব দখলের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলছিল।

সালাহউদ্দীন শিক্ষা লাভ করেছিলেন নিজাম-উল-মুলক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে শিক্ষার্থীদেরকে খালেছ ইসলামী আদর্শে গড়ে তোলার ব্যবস্থা ছিল। আর সে জন্যই ঘাতকদলের প্রথম শিকার ছিলেন নিজাম-উল-মুলক। রোমানদের রাজ্যবিস্তারে তিনি ছিলেন বড় বাঁধা। এ বাঁধা দূর করার জন্য তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

সালাহউদ্দীন এখানেই সেনা প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। প্রশাসনিক কাজে তাকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছিলেন নুরুদ্দীন জংগী। মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার সকল গুণাবলী এখানেই অর্জন করেছিলেন তিনি। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী গোয়েন্দা বৃত্তি, কমাণ্ডো অভিযান এবং গেরিলা অপারেশনকে সবচে’ বেশী গুরুত্ব দিতেন। তিনি দেখেছিলেন গুপ্তচর বৃত্তিতে খৃস্টান জগৎ অনেক অগ্রসর। মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা আর সাংস্কৃতিক অংগন ছিল ওদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। সালাহউদ্দীন অত্যান্ত ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে এর মোকাবিলা করেছিলেন।

তিনি মিসরের গভর্ণর ও সেনাবাহিনী প্রধন হয়ে এলে শুরু হল ষড়যন্ত্র। বড় বড় জেনারেলরা এ পদের জন্য ছিল লালায়িত। তারা যখন দেখল তাদের আশায় গুড়ে বালি, তখনা ক্ষুব্ধ জেনারেলগণ ষড়যন্ত্র শুরু করল তার বিরুদ্ধে।

ওদের ধারনায় সালাহউদ্দীন একজন বাকলমাত্র। এ পদের যোগ্যতা তার মধ্যে নেই। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে জেনারেলদের সে ধারণা ভেঙে গেল। সালাহউদ্দীন কঠোর নিয়ম শৃংখলা মেনে চলতেন। সৈন্যদের জন্য ভোগবিলাস এবং মদ নিষিদ্ধ করলেন। মনোনিবেশ করলেন ওদের শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে। ফলে অল্প দিনেই সেনাবাহিনী সুশৃংখল ও সুসংগঠিত হয়ে উঠল। অল্পবয়স্ক অর্বাচীন বালক বলে তাকে যারা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখছিল, টনক নড়ে উঠল তাদের।

সালাহউদ্দীন খৃষ্টান শক্তির মোকাবিলার জন্য একটি শক্তিশালী সেনা বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। মুক্ত ফিলিস্তিনে শ্বাসন নেয়ার দুর্মর আকাঙ্খা নিয়ে সেনাবাহিনীকে সে ভাবে গড়ে তুলতে লাগলেন তিনি। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘যে খোদা আমাকে মিসরের গভর্নর করেছেন, অবশ্যই তিনি ফিলিস্তিনও মুক্ত করবেন।’ তার এ ঘোষণার জন্য কেবল খৃস্টানই নয়, খৃস্টানপন্থী মুসলমান আমীর ওমরারাও তার শত্রু হয়ে দাঁড়াল। বাইরের শত্রুর চাইতে ঘরের শত্রুরা হয়ে উঠল তার জন্য অধিকতর বিপজ্জনক।

নতুন গভর্নরের অভ্যর্থনার আয়োজন করা হল। আয়োজন করলেন জেনারেল নাজি। পঞ্চাশ হাজর ফৌজের অধিনায়ক তিনি। অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী ছাড়াও বেসামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত। মুচকি হেসে একে একে সকলের সাথে করমর্দন করলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। কণ্ঠে স্নেহ-ভালবাসার উষ্ণ পরশ। কোন কোন অফিসারের ঠোঁটে কুটিল হাসি। দৃষ্টিতে ঘৃণা আর উপহাস। ওদের ধারনা, নুরুদ্দীন জংগীর সাথে সুসম্পর্ক এবং রাজপরিবারেির সন্তান বলেই সারাহউদ্দীন গভর্নর হতে পেরেছেন। এক প্রবীণ অফিসার আরেকজনের কানে কানে বলল, ‘এখনো শিশু, আমরা পেলে পুষে নেব।’

অনুষ্ঠানে তাকে শিশুই মনে হচ্ছিল। জেনারেল নাজির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন আইয়ুবী। কপাল কুঞ্চিত হল ঈষৎ। করমর্দনের জন্য হাত প্রসারিত করলেন। নাজি তোষামুদে দরবারীদের মত সালাহউদ্দীনকে কুর্নিশ করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমো খেয়ে বললেন, ‘আপনার জীবন রক্ষার্থে আমার দেহের শেষ রক্তবিন্দুটুকুও বিলিয়ে দেব। আপনি আমাদের কাছে মাননীয় জংগীর আমানত।’

‘ইসলামের চাইতে আমার জীবনের দাম বেশী নয় সম্মানিত জেনারেল।’ আইয়ুবী বললেন, ‘প্রতিটি ফোঁটা রক্ত সংরক্ষণ করে রাখুন। খৃষ্টান ষড়যন্ত্রের ঘনঘটা মুসলিম বিশ্বের আকাশে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।’

জবাবে মৃদু হাসলেন নাজি। যেন তাকে রূপ কথার গল্প শোননো হচ্ছে। নাজি ছিল ফাতমী খেলাফতের সিপাহসালার। পঞ্চাশ হাজার ফৌজের অধিনায়ক। সৈন্যদের সবাই ছিল সুদানের অধিবাসী। তার বাহিনী ছিল আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত। বলতে গেলে এরা ছিল নাজির ব্যক্তিগত সৈন্য। নাজি ছিল মুকিটহীন সম্রাট।

তখন মুসলিম দেশগুলোর কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না। একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতো। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছিল খৃস্টান জগৎ। মিসর এবং আশপাশের শাসকদের জন্য নাজি ছিল এক ত্রাস। তার মস্তিষ্ক ছিল ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রভূমি। ভেড়া দেখলে নেকড়ের যেমন দাঁত বেরিয়ে আসে, সালাহউদ্দীনকে দেখে নাজিরও তেমনি দাঁত বেরিয়ে এসেছিল। আইয়ুবী তার এ ক্রুর হাসির মর্ম না বুঝলেও এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, এ শক্তিধর জেনারেলকে তার প্রয়োজন।

‘হুজুর অনেক দূর থেকে এসেছেন। খানিক বিশ্রাম করে নিন।’ নাজি বলল।

‘যে কঠিন দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে, আমি তার যোগ্য নই। এ দায়িত্বভার আমার বিশ্রাম এবং নিদ্রা কেড়ে নিয়েছে। প্রথমে অফিসে গেলেই কি ভাল হয় না?’

‘হুজুর কি আগে খেয়ে নেবেন?’ বলল একজন অফিসার।

একটু ভেবে ওদের সাথে হাঁটা দিলেন আইয়ুবী। দু’সারিতে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র গার্ডবাহিনী। ওদের হাতের অস্ত্র এবং পেশীবহুল বলিষ্ঠ দেহ দেখে তার চেহারায় হেসে উঠল আনন্দের দ্যুতি। দরজার কাছে পৌঁছতেই চেহারায় এ আলো হঠাৎ নিভে গেল। তার বদলে হতাশার আঁধার এসে গ্রাস করল তাকে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চারজন রূপসী তরুণী। তাদের পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আছে রেশম কোমল চুল। পরনে পাতলা পোশাক। হাতে ফুলের ঝুড়ি। সালাহউদ্দীনের পথে ওরা ফুল ছুঁড়তে লাগল। সাথে সাথে বেজে উঠল দফ ও রবাবের সুর ঝংকার।

থমকে দাঁড়ালেন আইয়ুবী। ডানে বাঁয়ে নাজি এবং তার সহকারীরা। ভারতীয় রাজরাজড়াদের মত ওরা নুয়ে তাকে সামনে চলার জন্য অনুরোধ করল।

‘সালাহউদ্দীন ফুল মাড়ানোর জন্য আসেনি।’ গমগম করে উঠল আইয়ুবীর কণ্ঠ। ঠোঁটে শ্লেষের হাসি। যে হাসি দেখতে ওরা অভ্যস্ত নয়। ‘হুজুর চাইলে আমরা আকাশের তারা এনে দিতে পারি’ নাজি বলল।

‘আমাকে খুশী করতে হলে একটা জিনিসই আমার পথে ছড়ানো যেতে পারে।’

খৃস্টানদের লাশ।’ মৃদু হেসে বললেন সালাহউদ্দীন।

ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল অফিসারের।

মুহূর্তে বদলে গেল সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর চেহারা। দু চোক থেকে ঠিকরে বেরোতে লাগল আগুনের হলকা। বললেন, মুসলমানদের জীবন ফুলশয্ডা নয়। আপনারা কি জানেন না খৃস্টানরা মুসলিম বিশ্বকে ইঁদুরের মত কেটে টুকরো টুকরো করে চলছে?’

তার গম্ভীর কণ্ঠের ধ্বনি বদলে দিল ঘরের পরিবেশ। প্রতিটি শব্দ থেকে বিস্ফোরিত হচ্ছিল প্রচণ্ড ক্রোধ। ‘আমাদের মেয়েদের উলংগ করে ওদের ইজ্জত পদদলিত করেছি বলেই আজ আমরা ফুল মাড়াতে পারছি। শুনুন, আমার দৃষ্টি আটকে আছে ফিসিস্তিনে। আপনারা কি আমার পথে ফুল বিছিয়ে মিশর থেকে ইসলামকে বিদায় করতে চাইছেন?’

তিনি চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমার পথ থেকে ফুল সরিয়ে নাও। এ ফুলে পা পড়লে আমার হৃদয় কাঁটার ঝাঁঝরা হয়ে যাবে। সরিয়ে দাও মেয়েদের। আমি চাইনা ওদের সোনালী চুলে জড়িয়ে গিয়ে আমার তরবারী গতি হারিয়ে ফেলুক।

‘হুজুরের ইজ্জত সম্মান. . . . .।’

আমাকে আর কখনো হুজুর বলবে না।’ ঝাঁঝের সাথে বললেন তিনি। মনে হল শব্দের তীব্র আঘাতে ওদের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে দেয়া হয়েছে। ‘তোমরা যার কালেমা পড়েছ হুজুরতো তিনি। আমি তাঁর দাসানুদাস মাত্র। সে হুজুরের জন্য আমার জীবন নিঃশেষে বিলিয়ে দিতে চাই। তার পয়গাম আমার বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছি। খৃস্টান জগৎ ওই পয়গাম ছিনিয়ে নিয়ে রোম উপসাগরে ডুবিয়ে দিতে চাইছে। ডুবিয়ে দিতে চাইছে মদের দরিয়ায়। আমি বাদশা হয়ে এখানে আসিনি।’ নাজির চোখের ইশারায় মেয়েরা ফুল কুড়িয়ে দরজা থেকে সরে গেল। দ্রুতপায়ে ভেতরে ঢুকলেন সালাহউদ্দীন। প্রশস্ত কক্ষ। ফুল দিয়ে সাজানো বিশাল টেবিল। টেবিলে নানা রকম সুস্বাদু খাবার। ‘

খাবারে দৃষ্টি বুলিয়ে তিনি তাকালেন সহকারী সালারের দিকে।

‘মিসরের সব মানুষ কি এমন খাবার খেতে পারে?’

‘না হুজুর’। সহকারীর জবাব, ‘গরীবরা তো এসব খাবার স্বপ্নেও দেখেনা।’

‘তোমরা কোন্ সমাজের লোক? যারা এমন খাবার স্বপ্নেও দেখেনা ওরা কি তোমাদের চেয়ে ভিন্ন জাতি?’

সকলেই নির্বাক।

‘এখানে যত চাকর-বাকর এবং ডিউটিরত সেপাই রয়েছে সবাইকে ডেকে নিয়ে এসো। এ খাবার ওরা খাবে।’

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী একটা রুটির সাথে ক’টুকরা তরকারী তুলে তড়িঘড়ি খাওয়া শেষ করলেন। এরপর নাজিকে সাথে নিয়ে হাঁটা দিলেন গভর্নর হাউসের দিকে।

দু’ঘন্টা পর। গভর্নর হাউস থেকে বেরিয়ে এল নাজি। দ্রুত এগিয়ে গেল ঘোড়ার দিকে। এক লাফে ঘোড়ায় চড়ে দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল।

রাত নেমেছে। নাজি খাস কামরায় কয়েকজন বিশ্বস্ত বন্ধুকে নিয়ে মদের আসর বসিয়েছে। নাজি বলল, ‘যৌবনের তেজ কয়েক দিনের মধ্যেই ঠাণ্ডা করে দেব। কমবখ্ত বলল কি জান? বলল, কাবার প্রভুর শপথ! মুসলিম বিশ্ব থেকে খৃস্টানদের বিতাড়িত করে তবে আমি বিশ্রাম নেব।’

‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী? হুহ্!’ সহকারী সালারের কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর। ‘ইসলামী রাষ্ট্রের দম ফুরিয়ে গেছে সে এ খবরও জানেনা। এখনতো সুদানীরা দেশ চালাবে।’

অন্য এক কমাণ্ডার প্রশ্ন করল, ‘পঞ্চাশ হাজার ফৌজের সবাই সুদানী একথা তাকে বলেননি। বলেননি যে ওরা আপনার নির্দেশে খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না?’

‘তোমার কি মাথা খারাপ এডরোস? আমি বরং তাকে নিশ্চয়তা দিয়েছি। বলেছি আপনারা ইশারা পেলৈ আমসরা সৈন্যরা খৃষ্টানদের ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। কিন্তু. . .’

থেমে গেল নাজি।

‘কিন্তু কি?’

‘মিসরের লোকদেরকে ফৌজে ভর্তি করার জন্য সে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে। কারণ ফৌজ এক এলাকার থাকা নাকি উচিৎ নয়। সে মিসরের লোকদেরকে আমার সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে।’

‘আপনি কি বললেন?’

‘বলেছি আপনার নির্দেশ পালন করা হবে। কিন্তু আমি তা করব না।’

‘তার মনমানসিকতা কেমন বুঝলেন?’

‘একরোখা জেদী।’

‘আপনার বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতার সামনে সে এখনো শিশু। নতুন গভর্ন হয়ে এলো তো! কদিন পরই পদের নেশায় পেয়ে বসবে।’

‘আমি তার এ নেশা দূর করবো না। নেশায় নেশায় তাকে নিঃশেষ করব।’

ওরা অনেকক্ষণ ধরে আইয়ুবীকে নিয়ে কথা বলল। নতুন গভর্নর এই মুকুটহীন সম্রাটের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে কি পদক্ষেপ নেয় হবে তাও আলোচিত হল।

অন্যদিকে আইয়ুবী তার সহকারীদের বলছিলেন, ‘আমি এখানে রাজা হয়ে আসিনি। কাউকে রাজত্ব করতেও দেবো না।’ তিনি আরো বললেন, ‘আমাদের সামরিক শক্তির প্রয়োজন। এখানকার সেনাবাহিনীর গঠন পদ্ধতি আমার পছন্দ নয়। পঞ্চাশ হাজর ফৌজের সবাই সুদানী। অথচ সব এলাকার লোকেরই সৈন্য হবার অধিকার আছে। এভাবে ওদের জীবনের মানও উন্নত হতে পারে। সব এলাকা থেকে সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তি করার জন্য আমি নাজিকে বলে দিয়েছি।

‘নাজি কি আপনার নির্দেশ পালন করবে?’ একজন সহকারী প্রশ্ন করল।

‘কেন, সে কি আমার হুকুম অমান্য করবে নাকি?’

‘করতেও পারে। ফৌজের সর্বময় কর্তা তিনি। তিনি কারো নির্দেশ পালন করেন না, বরং অন্যকে তার নির্দেশ পালনে বাধ্য করেন।’

এ কথায় সালাহউদ্দীন একটু নীরব রইলেন। তবে তার চেহারায় কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি কি ভাবছেন তা বুঝে উঠার আগেই আলী বিন সুফিয়ানকে রেখে অন্যদের বিদায় জানালেন তিনি।

আলী মধ্য বয়সী এক চৌকস গোয়েন্দা লিডার। কুশলী, সাহসী এবং অসম্ভব বাকপটু। গুপ্তচর বৃত্তির জন্য সে বিশ্বস্তক ও নিবেদিতপ্রাণ কিছু লোককে ট্রেনিং দিয়ে পারদর্শী করে তুলেছে। তাদের নিয়ে গড়ে তুলেছে নিজস্ব গোয়েন্দা দল। আকাশ থেকে তারকা ছিনিয়ে আনতে বললেও যারা পিছপা হবে না। চিন্তা চেতনার দিক থেকে সে ছিল আইয়ুবীর সমমনা। সালাউদ্দীন তাকে বাগদাদ থেকে সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন।

‘শুনলাম তো। চিনতে ভুল না করলে বলব, লোকটি ধুরন্ধর ও বড় ধরনের ক্রিমিনাল। তার ব্যাপারে আগে থেকেও আমি কিছুটা জানি। জনগণের টাকায় লালিত সেনাবাহিনী এখন তার নিজস্ব ফৌজ। তার ষড়যন্ত্রের ফলে প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে। ‘সব এলাকার লোকই সেনাবাহিনীতে ভর্তি করার প্রয়োজন’ আপনার এ সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী এবং সঠিক হয়েছে। আমার তো আশংকা হচ্ছে সুদানী সৈন্যরা প্রয়োজনের সময় আপনার হুকুম অমান্য করে তারই অনুগত্য করবে। বলা যায়না, ফৌজের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি পরিবর্তন করে নাজিকে আনপার অপসারণও করতে হতে পারে।

‘না, নাজির মত প্রভাবশালী ব্যক্তিকে এখনই বিরূপ করতে চাই না। এ মুহূর্তে তাকে অপসারণ করা ঠিক হবে না। নিজেদের রক্ত ঝরানোর জন্য আমি অস্ত্র হাতে নেইনি, আমাদের তরবারী শত্রুর জন্য। আমি আগে ভালবাসা দিয়ে তাকে পরিবর্তন করতে চেষ্টা করব। তুমি বর্তমান সেনাবাহিনী আমাদের কদ্দুর কাজে আসবে তা-ই বোঝার চেষ্টা কর।’

‘আপনার ভালবাসা তাকে শুধরাতে পারবে বলৈ মনে হয় না’।

সালাহউদ্দীন যা ভেবেছিলেন নাজি ততোটা সহজ ছিল না। ভালবাসা শব্দটি তার অভিধানে ছিল না। তার সব প্রীতি এবং মমতা ছিল ক্ষমতার সাথে। ক্ষমতার প্রশ্নে সে ছিল অত্যন্ত কঠোর। মানুষ হিসাবে ছিল অসম্ভব ধূর্ত। ষড়যন্ত্র ছিল তার হাতিয়ার। কাউকে ফাঁসাতে চাইলে তার সাথে মোমের মত কোমল ব্যবহার করত। আইয়ুবীর সাথ তার ব্যবহার ছিল অনুগত দাসানুদাসের মত। তার সামনে সে কখনো বসত না। আইয়ুবীর প্রতিটি কথায় জি-হুজুরীর ভূমিকা পালন করত।

নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে সে মিসরের সকল অঞ্চল থেকেই সেনা ভর্তি শুরু করে দিয়েছিল। সময় এগিয়ে যাচ্ছে। আইয়ুবীও তাকে একটু একটু পসন্দ করা শুরু করেছেন। নাজি তাকে আশ্বাস দিয়েছিল, সেনাবাহিনী আপনার নির্দেশের অপেক্ষায়। ফৌজের পক্ষ থেকে নতুন গভর্নরকে ‘গার্ড অব অনার’ দেয়ার প্রস্তাবও দিল সে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে তিনি তার এ আমন্ত্রণ মুলতবী রাখলেন।

রাত নেমেছে। নিজের কক্ষে দু’জন কমাণ্ডার নিয়ে মদ পান করছিল নাজি। মৃদু লয়ে বাজছে সংগীতের সুর মুর্ছনা। তালে তালে নাচছে দু’জন নর্তকী। পায়ে নুপুর নেই। বে আব্রু দেহের ভাঁজে ভাঁজে মাদকতা। প্রহরী ভেতরে এসে নাজির কানে কানে কি যেন বলল।

মদির আবেশে মত্ত নাজির আনন্দে বিঘ্ন ঘটাবার সাহস কারো ছিল না। কিন্তু এ আসর থেকে তাকে কোন্ সময় তুলে নেয়া যায়’ প্রহরী তা জানত।

উঠে দাঁড়ালেন নাজি। প্রহরী তাকে একটি কক্ষে নিয়ে গেল। সুদানী পোশাক পরে একজন লোক বসে আছে। সাথে এক যুবতী।

নাজিকে দেখে দু’জন উঠে দাঁড়াল। যুবতীর রূপ মাধুর্য দেখে নাজি খানিক হতভম্বের মত তাকিয়ে রইল। সে নারী শিকারী। শুধু ভোগের জন্যই নয়, বড় বড় অফিসারদের ব্লাকমেল অথবা তাদেরকে হাতে রাখরা জন্যও সুন্দরী যুবতীদের ব্যবহার করত নাজি। কসাই যেমন পশু দেখলে গোশত পরিমাণ করতে পারে, সেও প্রথম দেখাতেই বুঝত কাকে দিয়ে কোন কাজ করানো যাবে। নারী ব্যবসায়ীরা প্রায়শই তার কাছে মেয়ে নিয়ে আসত।

বিক্রেতা যুবতীর ব্যাপারে বলল, ‘দারুণ স্মার্ট। নাচতে পারে, গাইতে পারে, মুখের মধুতে পাথরও গলিয়ে দিতে পারে।’

নাজি ওর ইন্টারভিউ নিয়ে চমৎকৃত হল। ভাবল, একটু তৈরী করে নিলে যে কোন কাজেই ব্যবহার  করা যাবে।

দাম দস্তুর শেষে টাকা নিয়ে চলে গেল লোকটি। নাজি ওকে নিয়ে চলে এল জলসা ঘরে। নাচতে বলল তরুলীকে। দেহের বাড়তি কাপড় ফেলে দিয়ে দু’পাক ঘুরতেই হা হয়ে গেল তিন দর্শক। ফ্যাকাশে হয়ে গেল আগের দু’নর্তকীর চেহারা। নতুন মেয়েটার সামনে ওরা এখন মূল্যহীন বাসি ফুল।

আসর ভেঙে দিল নাজি। নতুন মেয়েটাকে রেখে সকলকে বিদায় করে দিল।

‘নাম কি সুন্দরী?’

‘আমার নাম জুলি’।

‘তোমাকে যে দিয়ৈ গেল সে বলেছে, তুমি নাকি পাথর গলাতে পার। আমি তোমার সে যোদ্যতা যাচাই করতে চাই। ‘

‘কে সে পাথর?’

‘মিসরের নতুন গভর্নর। যিনি একই সাথে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কও।’

‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী?’

‘হ্যাঁ, যদি তাকে বশে আনতে পার তবে তার ওজন সমান সোনা তোমার পুরস্কার।’

‘তিনি কি মদ পান করেন?’

‘না, মুসলমান শূকরকে যেমন ঘৃণা করে, সে দম, নারী, নাচ, গান এবং ভোগবিলামকে তেমনি ঘৃণা করে।’

‘শুনেছি আপনার কাছে এমন সব যুবতী রয়েছে যাদের দেহের যাদু নীল নদের স্রোতকেও রুদ্ধ করে দিতে পারে। ওরা কি ব্যর্থ?’

‘এখনো পরীক্ষা করে দেখিনি। আমার বিশ্বাস তুমি এ কাজ করতে পারবে। সালাহউদ্দীনের বিশ্বাস এবং চরিত্র সম্পর্কে আমি তোমাকে বিস্তারিত বলবো।’

‘তাকেকি বিষ খাওয়াতে হবে?’

‘এখন নয়। তার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। আমি চাই সে তোমার মত রূপসীর আঁচলে বাঁধা পড়ুক। এরপর তাকে আমার পাশে বসিয়ে মদ খাওয়াব। মারতে চাইলে তোমার প্রয়োজন নেই, ঘাতক দলকে দিয়ে সহজেই তা করানো যায়।’

‘তার মানে আপনি দুশমনি নয় বন্ধুত্ব চাইছেন?’

জুকির বুদ্ধিমত্তায় নাজি কতক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

‘হ্যাঁ জুকি।’

ওর রেশম কোমল চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল নাজি, ‘আমি তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। এমন বন্ধুত্ব, যেন সে আমার কথায় উঠে এবং বসে। এর পর কি করতে হবে তা আমি জানি।’ থামল নাজি।

একটু ভেবে নিয়ে আবার বলল, ‘একটা কথা তোমাকে বলা প্রয়োজন। সালাহউদ্দীনের হাতেও একটা চাল আছে। তোমার রূপ যৌবনের ওপর তার চাল বিজয়ী হলে তুমি বাঁচতে পারবে না। সালাহউদ্দীনও তোমায় বাঁচাতে পারবে না। তোমার জীবন আমার হাতে। এ জন্যই তোমার সাথে এত খোলামেলা কথা বলছি। নইলে আমার মত জেনারেল তোমার মত এক গনিকার সনাথে এভাবে আলাপ করত না।’

‘অনাগত ভবিষ্যত বলে দেবে কে ধোঁকা দেয়। এবার বলুন তার কাছে আমি পৌঁছব কিভাবে?’

‘আমি তার সম্মানে এক সংবর্ধনার আয়োজন করতে যাচ্ছি। রাতে তার শয়ন কক্ষে তোমায় ঢুকিয়ে দেব।’

‘ঠিক আছে, এর পরের কাজ হবে আমার।

সে রাতের পর আরও ক’টা রাত চলে গেছে। প্রশাসনিক কাজ এবং নতুন সৈন্য ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আইয়ুবী নাজির নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি। এর মধ্যেই নাজি সম্পর্কে আলী বিন সুফিয়ানের আরো রিপোর্ট পাওয়া গেল। আলীর সে রিপোর্ট পেয়ে সালাহউদ্দীন চিন্তিত হয়ে উঠলেন।

‘আলী! এর অর্থ হল সে খৃষ্টানদের চাইতেও বিপদজনক।’

‘লোকটা মিসরের পোশাকের ভেতর লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত সাপ। প্রশাসনের অনেক বড় বড় লোক তার হাতে। সেনাবাহিনীও আমাদের নয় বরং অন্যের অনুগত। এ ব্যপারে কি করা যায় কিছু ভেবেছেন?’

‘শুধু ভাবিনি, কাজও শুরু করে দিয়েছি। সুদানী সৈন্যদেরকে নতুন সৈন্যদের সাথে একীভূত করে দেব। এখন এরা না হবে সুদানের, না মিসরের। এপর নাজিকে সোজা পথে নিয়ে আসা যাবে।’

‘আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, সে খৃষ্টানদের সাথে নিজের ভবিষ্যত জুড়ে দিয়েছে। মুসলিম বিশ্বকে এক কেন্দ্রের আওতায় এনে আপনি মুসলিমদের শক্তি বৃদ্ধি করতে চাইছেন। কিন্তু নাজি আপনার ও ইচ্ছেকে পাগলামী মনে করে।’

‘তুমি কি করছ?’

‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তার চারপাশে আমি গুপ্তচরের প্রাচীর তৈরী করে দিয়েছি। মনে করুণ সে এখন গোয়োন্দাদের দুর্গে বন্দী। আমি সব বিষয়েই আপনাকে অবহিত করব।’

আলীর ওপর ছিল সালাহউদ্দীনের পূর্ণ আস্থা। তাই তার গোপন তৎপরতা সম্পর্কে কিছুই তাকে জিজ্ঞেস করলেন না।

‘শুনলাম নাজি আপনাকে সম্বর্ধনা দিতে চাইছে। যেতে চাইলে আমি যখন বলব তখন যাবেন।’

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী কতক্ষণ ঘরময় পায়চারী করলেন। হঠাৎ কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এর ব্যথাভরা ‘আহ’ শব্দ। দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। তাকালেন আলী বিন সুফিয়ানের দিকে।

‘আলী, জীবন মৃত্যু তো আল্লাহর হাতে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে বেঁচে থাকার চাইতে জন্মের সাথে সাথেই কি মরে যাওয়া ভাল নয়? কখনো ভাবি, যাদের মাঝে জাতীয় চেতনাবোধ নেই, নেই কোন মহৎ ভাবনা সম্ভবতঃ পৃথিবীতে তারাই সুখী। ওরা নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকে, মরেও যায় তেমনি।

‘না, সম্মানিত আমীর! ওরা সবচে বেমী হতভাগা।’

‘হ্যাঁ আলী। আমি যখন ওদেরকে ভাগ্যবান মনে করি কে যেন আমার কানের কাছে এসে তোমার কথাটাই উচ্চারণ করে যায়। মনে রেখো আলী, ইতিহাসের বর্তমান ধারা পরিবর্তন করতে না পারলে মুসলিম বিশ্ব হারিয়ে যাবে উপত্যকা আর মরুভূমির সীমাহীন বিস্তারে। খেলাফত এখন তিন ভাগে বিভক্ত। আমীর ওমরার দল স্বেচ্ছাচারী, খৃস্টান ষড়যন্ত্রের আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে ওরা। আমার আশংকা হচ্ছে, মুসলমানরা বেঁচে থাকলেও থাকবে খৃষ্টানদের গোলামীর শৃংখলিত। শুধু বেঁচে থেকেই সন্তুষ্ট থাকবে ওরা। জাতিসত্ত্বা বলে কিছুই থাকবে না, যেন সে শুধু এক মৃতের কফিন। দেখছো না, অর্ধশতাব্দীর মধ্যেই আমাদের মানচিত্র কতো সংকীর্ণ হয়ে এসেছে!’

মাথা নুইয়ে আবার তিনি পায়চারী করতে লাগলেন। কুঞ্চিত কপালে চিন্তার ভাজ। এক সময় মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে গমগম কণ্ঠে বললেন, ‘আলী, নিজের ভেতর থেকে ধ্বংস শুরু হলে তা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের খেলাফত এবং আমীরগণ বর্তমান অবস্থায় থাকলে খৃষ্টানদের আক্রমণ করার প্রয়োজনই পড়বে না। যে আগুণ আমাদের ঈমান, আমাদের কর্ম আর জাতিসত্ত্বাকে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে খৃস্টানরা তাতে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে মাত্র। ওদের ষড়যন্ত্র আমাদেরকে একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে বাধ্য করছে। হয়তো আমার ইচ্ছে অপূর্ণই থেকে যাবে। আমি পরাজিত হতে পারি, তবুও জাতির কাছে আমি কিছু কথা রখে যেতে চাই। আমি চিৎকার করে বলতে চাই, অমুসলিমকে কখনো বিশ্বাস করো না। যুদ্ধ করতে করতে জীবন দেবে, তবু দুশমনের পাতা ফাঁদে পা দেবে না।’

‘মনে হচ্ছে আপনি হতাশ হয়ে গেছেন?’

‘না আলী, নিরাশ হইনি, একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। আলী, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কাছে আমাদের নির্দেশ পৌঁছে দাও। সেনা ভর্তি আরো তীব্রতর কর। যুদ্ধে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সবসময় প্রাধান্য দেবে। সৈন্য ভর্তির বাধ্যতামূলক শর্ত হল ইসলামী আমল আখলাক। শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার দিকে বিশেষ নজর দেবে। ওদেরকে স্পেশাল গেরিলা ট্রেনিং দেবে। শত্রুর এলাকায় গিয়ে কাজ করতে হবে ওদের। ওরা হবে সুইসাইড স্কোয়ার্ড। গেরিলাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কর। ওদের থাকতে হবে উটের মত দীর্ঘসময় ক্ষুঁৎ পিপাসা সহ্য করার শক্তি। দৃষ্টি হবে ঈগলের মত, মরু শিয়ালের মত হবে সতর্ক। চিতাবাঘের মত ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে শত্রুর ওপর। শক্তি সাহস আর বুদ্ধিমত্তায় হবে অনন্য। মদ হাসিস বা এ জাতীয় মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে ওদের। ওদেরকে মোকাবেলা করতে হবে সেই সব নারীদের যৌবনের পশরা সাজিয়ে, চোখে মদির নেশা জাগিয়ে যারা আসবে ওদের ছোবল হানতে। এ ব্যাপারগুলো এদের এমন ট্রেনিং দেবে, যেনো নৃত্যরত পরী এলেও ওরা থাকতে পারে বরফশীতল।

ভর্তি আরো তীব্রতর করো আলী। মনে রেখো, আমি আবেগতাড়িত হয়ে কাজ করতে পসন্দ করিনা। সংখ্যায় যত নগন্যই হোক, আমি যোদ্ধা চাই। সেই সব যোদ্ধা, যাদের ভেতরে থাকবে ইসলামী ঐতিহ্য ও চেতনাবোধ। কেন যুদ্ধ করছি এ প্রশ্ন কখনো কারো মনে উদয় হবে না। শুরুতকেই সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার উদ্দেশ্য কি তা ওদের ভাল করে বুঝিয়ে দাও। এ দুর্দিনে জাতি তাদের কাছে কতটুকু ত্যাগ ও কোরবানী দাবী করে এ কথা প্রত্যেকটি সৈনিকের অন্তরে এমন ভাবে গেঁথে দাও, যাতে এটাকে কেউ কেবল চাকরী মনে না করে।’

নাজি তার ক্ষমতা ও প্রাধান্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে একটি দুঃসাহসিক গোয়েন্দা সংস্থা গড়ে তুলেছিল। ওরা নাজিকে বলল, ‘আলী বিন সুফিয়ান সালাহউদ্দীন আউয়ুবীর বিশেষ উপদেষ্টা এবং গুপ্তচর বৃত্তিতে আরব শ্রেষ্ঠ। আপনার অস্তিত্বের জন্য সে এক মারাত্মক হুমকী স্বরূপ।’

নাজি আলীর পেছনে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছিল। তাদের রিপোর্টের পর সে আলীকে হত্যা করারও পরিকল্পনা করল। সালাহউদ্দীনকে ফাঁসানোর জন্য জুকিকে তৈরী করেছিল নাজি, কিন্তু সে জানতেও পারেনি, নিজেই সে জুকির ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। শুধু অসাধারণ রূপের জৌলুষেই নয়- জুকির মধুমাখা কণ্ঠে ছিল যাদুর ছোঁয়া। ওকে নিজের পাশে বসিয়ে কথা বলত নাজি।

এখন আর পুরনো নর্তকীদের ডাক পড়েনা। ঈর্ষার আগুণে পুড়ে মরতে লাগল ওরা। এ ঈর্ষার আগুন ওদের এতটাই ক্ষিপ্ত করলো যে, পুরনো নর্তকী দু’জন জুকীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করল। কিন্তু কার্যত এ ছিল অসম্ভব। ওর কক্ষের সামনে সারাক্ষণ দু’জন প্রহরী দাঁড়িয়ে থাকত। অন্যদিকে অনুমতি ছাড়া নর্তকীরা বাইরে যেতে পারত না। অনেক ভেবেচিন্তে ওরা হারেমের এক চাকরাণীকে হাত করে নিল।

গভর্ণরের পুরনো বডিগার্ড বদলে দিলেন আলী। সেখানে নিয়োগ করলেন দুঃসাহসী এবং আত্মত্যাগী নতুন সৈন্য। ওদের প্রত্যেকেই ছিল একেকজন আদর্শ সৈনিক। নাজি এ পরিবর্তন মেনে নিতে না পারলেও আইয়ুবীর সামনে তা প্রকাশ করল না। সম্বর্ধনায় হাজির হওয়ার জন্য সে আবার আইয়ুবীকে অনুরোধ করল। আইয়ুবী বললেন, ‘কবে আপনার দাওয়াতে যেতে পারব দু’ একদিনের মধ্যেই আপনাকে তা জানাবো।

নাজি চলে গেলে তিনি এ ব্যপারে আলীর পরামর্শ চাইলেন। আলী বললেন, ‘যে কোন সময় আপনি নাজির নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারেন।

পরদিন সালাহউদ্দীন নাজিকে জানালেন, তিনি এখন তার দাওয়াত কবুল করতে প্রস্তুত। নাজি তিন দিন সময় নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করার অনুমতি প্রার্থনা করলে আইয়ুবী সানন্দে তাতে সম্মতি দিলেন।

অনুমতি পেয়ে নাজি আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করল। অনুষ্ঠানটি হবে শহর থেকে দূরে। মশাল জ্বেলে আলোর ব্যবস্থা করা হবে। ব্যবস্থা থাকবে নাচগানের। ঘোড়সওয়াররা তাদের নৈপুণ্য দেখাবে। মশালের আলোয় অনুষ্ঠিত হবে কুস্তি, নেজাবাজি এৰং তলোয়ারের খেলা। রাতে ওখানেই সবার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তৈরী করা হয়েছে আলীশান তাঁবু। পুরো অনুষ্ঠানমালা জানানো হল সালাহউদ্দীনকে। তিনি মনযোগ দিয়ে বিস্তারিত কর্মসূচী শুনলেন কিন্তু নাচগান সম্পর্কে কিছুই বললেন না। এতে নাজি উৎফুল্ল হল। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘সেনাবাহিনীর বেশীর ভাগ ফৌজ দুর্বল মুসলিম। ওরা কখনো সখনো মদপান করে, তবে অভ্যস্ত নয়। আপনাকে সম্বর্ধনা জানানোর এ আনন্দঘন অনুষ্ঠানে ওরা সামান্য পদ পানের অনুমতি চাইছে।’

‘এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। আপনি আমাকে দাওয়াত করেছেন, আমি সে দাওয়াত কবুল করেছি। ওখানে আপনি কি করবেন তা আপনিই ভাল বুঝবেন। আপনি ওদের কমাণ্ডার। ইচ্ছে হয় অনুমতি দেবেন, না হয় দেবেন না, আমি এ ব্যাপারে আপনাকে কোন নির্দেশ দেব না।’

‘মিসরেবর আমীরের জয় হোক।’ আনন্দে গদগদ হয়ে মোসাহেবী কণ্ঠে বলল নাজি। ‘যে কাজ আপনি অপছন্দ করেন আমি তার অনুমতি দেয়ার কে? নেহায়েত আপনাকে উপলক্ষ করে ওরা একটু আনন্দ করতে চাইছে, নইলে এ প্রস্তাব আমি কিছুতেই উঠাবার দুঃসাহস করতাম না।’

সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। শুনল সালাহউদ্দীনের কর্মচারীরাও। আইয়ুবী নাচগান এবং মদের অনুষ্ঠানে যাবেন শুনে ওরা হতভম্ব হয়ে গেল। চাইতে লাগল একে অপরের দিকে। কেউ বলল, ‘নাজি মিথ্যে বলে সকলকে চমৎকৃত করতে চাইছে।’ কারো ধারণা, ‘নাজি সালাহউদ্দীনকেও হাত করে নিয়েছে।’

এ সংবাদে সবচে বেশী খুশী হল নাজির লোকেরা। দায়িত্বগ্রহণ করার পরপরই সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ভোগবিলাস এবং নাচগান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সেনাবাহিনীর জন্য কঠোর নিয়ম পালন বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এ নিয়ম ভাঙার দুঃসাহস কারো ছিল না।

সালাহউদ্দীন আজ নাচগান এবং মদের অনুমতি দিয়েছেন, কাল নিজিেই এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন, এই ভেবে নাজি মহা খুশী।

কেবলমাত্র আলী বিন সুফিয়ান জাতেন এর গূঢ় রহস্য। এছাড়া আর কেউ জানতো না, কেন নাজিকে অনুষ্ঠানে নাচগান আর মদ পরিবেশনের অনুমতি দেয়া হয়েছে।

রাত নেমেছে। থোকা থোকা জোসনা ঝরে পড়ছে মরুর বালুকারাশির ওপর। হাজার হাজার মশালের আলোয় দিনের মত উজ্জ্বল মনে হচ্ছে সমগ্র এলাকা।

প্রশস্ত ময়দানের একপাশে ফৌজ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। বিপরীত দিকে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বসার স্থান। যেন কোন সম্রাটের মসনদ। মসনদের ডানে বায়ে চেয়ার সাজানো। একটু দূরে অতিথিদের তাঁবু। আরেকটু সরে গিয়ে বিশাল এক তাবু তৈরী হয়েছে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর অবকাশ যাপনের জন্য।

সূর্য ডোবার পূর্বেই আলী বিন সুফিয়ান ওখানে পৌঁছে তাঁবুর চারপাশে কড়া পাহারা বসালেন। অন্যদিকে নাজি শেষ বারের মত জুকিকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছিল। নজরকাড়া রূপ লাবণ্যে জুকিকে মনে হচ্ছিল স্বর্গের অপ্সরা। তার দেহ থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল হালকা সুবাস। সে সুবাসে পরিবেশ হয়ে উঠছিল অপূর্ব মোহনীয় ও মাদকতাময়। তার নিরাভরণ কাঁধে সোনালী চুলের বাহার। শরীরে পোষাকের স্বচ্ছ প্রলেপ। সে প্রলেপের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছিল এক অনুপম শিল্প সুষমা। সে সুষমায় ছিল মাখন কোমল এক মোমের পুতুলের জীবন্ত সজীবতা। ঠোঁটে তার অনির্বচনীয় মুচকি হাসি।

গভীর চোখে জুকির দিকে খানিক তাকিয়ে রইল নাজি। বলল, ‘তোমার এ মাতাল করা রূপযৌবনও হয়ত তাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। তখন চালাবে ভাষার যাদু। এতদিনের ট্রেনিং ভুলে যেয়ো না। দেখো আবার তা বাঁদী না হয়ে যাও। মনে রেখ, তুমি হবে অচিন নগরের সেই ফোটা ফুল, যা ধরতে গেলে ধরা যায় না, আবার সেখান থেকে চোখও ফেরানো যায না। জুকি, তুমি সেই আলো, যার হাত থেকে কোন পতঙ্গের নিস্তার নেই। তুমি সেই মায়াবিনী, রক্ত মাংসের কোন মানুষের সাধ্য নেই তার আকর্ষণকে উপেক্ষা করে। মনে রেখ, সালাহউদ্দীনও মানুষ। ওকে তুমি তোমার পায়ের কাছে বসতে বাধ্য করবে। ক্লিওপেট্রা তার রূপ যৌবন দিয়ে লৌহমানবকে গলিয়ে মরুর বালির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। সে তোমার চে’ বেশী সুন্দরী ছিল না। আমি তোমায় যা শিখিয়েছি তা ক্লিওপেট্রারই পদ্ধতি। নারীর এ চাল কখনো ব্যর্থ হয় না।’

মৃদু মৃদু হাসছিল জুকি। মনোযোগ দিয়ে শুনছিল নাজির কথা। মিসরের বালুকারাশি থখেকে জন্ম নিয়েছিল ক্লিওপেট্রার মত রূপসী নাগিণী। ইতিহাস আরো একবার সে অতীতে ফিরে যাচ্ছিল।

সূর্য ডোবার সাথে সাথে জ্বলে উঠল হাজার হাজার মশাল। দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। দফ বাজিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করা হল। ‘মিসরের আমীর সালাহউদ্দীন জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে মরুর নিস্তরঙ্গ প্রকৃতি মুখরিত হয়ে উঠল। নাজি এগিয়ে এসে বলল, ‘আত্মত্যাগী ও ইসলামের রক্ষক সেনাবাহিনী আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। খোশ আমদেদ মহান নেতা, ওদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। এই সে সেনাবাহিনী, আপনার ইশারায় যারা জীবন নবিলিয়ে দিতে প্রস্তুত।’ তোষামুদে শব্দগুলো নাজির কণ্ঠে প্রণচঞ্চল হয়ে উঠল। মসনদে বসলেন সালাহউদ্দীন ভেসে এল অশ্বক্ষুরধ্বনি। আলোর নিশানায় চলে এল ঘোড়াগুলো। দু’দিক থেকে আসছে চারটি করে ঘোড়া। আরোহীরা নিরস্ত্র। ছুটে আসছে মুখোমুখি। যে কোন মুহূর্তে সংঘর্ষ হতে পারে। আরোক াছে এগিয়ে আসতেই সওয়াররা স্যাডলৈ পা রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক হাতে তুলে নিল বলগ। অন্য হাত আড়াআড়ািভাবে প্রসারিত করে একে অন্যকে পেরিয়ে গেল। যাবার সময় অপর আরোহীকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করল ওরা। একজন প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য সওয়ারকে জাপটে ধরে ছুে গেল সামনে। দু’দল হারিয়ে গেল দিগন্তের বিস্তৃত মরুতে। সংঘর্ষের স্থানে মাটিতে ডিগবাজি খাচ্ছিল দু’জন সওয়ার।

এভাবে পরপর আটটি দল তাদের নৈপূণ্য দেখাল। এরপর এল উষ্ট্রারোহী বাহিনী। তাদের খেলা শেষ হতেই শুরু হল নেজাবাজি ও অসি চালনা। ওদের সাহস ও নৈপূণ্যে অভিভূত হলেন সালাউদ্দীন। এমন দুঃসাহসী সৈন্যই তো তার প্রয়োজন। তিনি আলী বিন সুফিয়ানের কানে কানে বললেন, ‘ইসালামি জোশ সৃষ্টি করতে পারলে এ ফৌজ দিয়েই সমস্ত খৃষ্টান শক্তিকে পরাভূত করা যায়।

আলী পূর্বের পরামর্শ পুনরাবৃত্তি করে বলল, ‘নাজিকে সরিয়ে দিন, দেখবেন এদের মধ্যে এমনিতেই ইসলামী জযবা ও আবেগ সৃষ্টি হয়ে যাবে।’

কিন্তু সালাইউদ্দীন আইয়ুবী একজন অভিজ্ঞ জেনারেলকে না সরিয়ে তাকে সংশোধন করতে চাইছিলেন। তিনি সেবানবাহিনীর অবস্থা দেখার জন্য যোগ দিয়েছিলেন সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে। নাজি যখন নাচগান এবং মদপানের প্রস্তাব করেছিল, নিরাশ হয়ৈ গিয়েছিলেন তিনি। এরা ভোগবিলাসে কদ্দুর ডুবে আছে তা দেখতে নাচগানের অনুমতি দিয়েছিলেন।

সাহসিকতা, ঘোড়া সওয়ারী, অসি চালনা এবং মল্ল যুদ্ধে সেনা সদস্যরা উতরে গিয়েছিল। কিন্তু খাবার সময় ওরা উচ্ছৃংখল হয়ে পড়ল। বিশাল এলাকা জুড়ে খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। একপাশে সেনা সদস্যদের জন্য, অন্যপাশ বিশেষ অতিথিদের। হরেক রকম খাবারের মনমাতানো গন্ধে মরুভূমির রাতের বাতাস ম-ম করছিল। সেপাইদের সামনে ছিল মদের মশক। খাওয়া শেষ হতেই ওরা মদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন সালাহউদ্দীন। কি ভাবছেন চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছিল না।

নাজিকে প্রশ্ন করলেন, ‘এদের কিভাবে নির্বাচিত করলেন? এরা কি ফৌজের নিকৃষ্টতম সিপাই?’

‘না, আমীর।’ মিনমিনে কণ্ঠে বলল নাজি, ‘এরা সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠ সৈনিক। যুদ্ধের ময়দানে এদের বীরত্ব দেখলে আপনি হতবাক হয়ে যাবেন। ওরা একটু বাড়াবাড়ি হয়ত করছে, কিন্তু আপনার ইশারায় জীবন দিতে প্রস্তুত। আনন্দে উল্লাস করার জন্য মাঝে মাঝে ওদেরকে মুক্তভাবে ছেড়ে দেই। মৃত্যুর পূর্বে পৃথিবীটাকে খানিক ভোগ করে নিক।’

আইয়ুবী এ যুক্তির কোন জবাব দিলেন না। নাজি অন্য অতিথিদের দিকে ফিরতেই তিনি আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, ‘ যা দেখার আমি দেখেছি, এরা মদ আর উচ্ছৃংখলতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তুমি বলেছিলে এদের ভেতর কোন আবেগ নেই, আমি দেখছি কোন কর্মও নেই। এরা যুদ্ধের ময়দান থেকে জীবন নিয়ে পালাবে। লুট করবে পতিত সম্পদ। বিজিত এলাকার মেয়েদর সাথে পশুর মত ব্যবহার করবে।’

‘এর ওষুধ হল, আলী বললেন, ‘আপনি বিভিন্ন এলাকার লোক দিয়ে যে ফৌজ তৈরী করেছেন, এদেরকে ওদের সাথে একীভূত করে দিন। ভাল সিপাইদের সাথে মিশলে এদের স্বভাব ভালও হয়ে যেতে পারে।’

মৃদু হেসে সালাহউদ্দীন বললেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি আমার মনের কথা জানতে পেরেছ। একক্ষণ আমিও তাই চিন্তা ভাবছিলাম। আর কারো কাছে একথা প্রকাশ করো না।’

আলী কিছু বলতে যাচ্ছিল, সামনে কয়েকটি মশাল জ্বলে উঠল, বেজে উঠল সানাই আর সারিন্দার সুমধুর সুর। সমাবেশে নেমে এল অখণ্ড নীরবতা। একদিকে দেখা দিল নর্তকীর দল। পরনে ঝলমলে নাচের পোশাক। আধখোলা দেহ, নগ্ন কাঁধে ছড়ানো চুল।

হু হু করে বয়ে যাচ্ছে মরুভূমির উচ্ছল রাতের বাতাস। সে বাতাসে ওদের চুল উড়ছে, পতাকার মত পতপত ঢেউ খেলছে জরীন পোশাক। মনে হচ্ছে বাতাসে ভর করে উড়ে আসছে এক ঝাঁক সোনালী পায়রা। প্রসারিত দুই বাহু মেলে দেয়া দুই উড়ন্ত ডানা। সেই ডানায় বাঁধা রেশমী রুমাল। সেই রুমালে আঁকা বিচিত্র বর্ণালী রঙ। সেই রঙের ভেতর একেকটি মুখ ফুটে আছে রক্ত পদ্মের মত। কোমল, পেলব। মসৃন উন্মুক্ত বাহুলতায় অপার্থিব জ্যোতির পরাগ। পা নড়ছে না ওদের, কিন্তু বাদ্যের তালে তালে ছন্দোবদ্ধভাবে সামনে এগিয়ে আসছে।

দ্বিতীয়ার চাঁদের মত সালাহউদ্দীনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল যুবতীরা। মাথা নোয়াল কুর্ণিশ করার জন্য। সোনালী চুল পিছলে সামনে চলে এল।

দেখা গেল দূরে দৈত্যের মত এক হাবশী দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসছে। পরনে চিতাবাঘের চামড়ার তৈরী পোশাক। হাতে বিশাল একা ডালা, ডালা ভর্তি অর্ধফোটা ফুল।

তরুণীদের সামনে এসে ওটা নামিয়ে রাখল সে। বেড়ে গেল বাদ্যের আওয়াজ। বন্য মোষের মত গজরাতে গজরাতে আবার ফিরে গেল কাফ্রী।

নড়ে উঠল দ্বিতীয়ার চাঁদ। চাঁদের খোলস ভেঙ্গে বেরিয়ে এল অনিন্দ্য এক চাঁদবদনী। মনে হল ধূসর মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদ। যেন এ যুবতী এ গ্রহের কেউ নয়। ঠোঁটে তার মৃদু হাসির ঝিলিক। হাসি তো নয়, যেনো অনবদ্য এক খাপখোলা তলোয়ার।

অবাক বিস্ময়ে মোহগ্রস্থের মত তাকিয়ে রইল দর্শকবৃন্দ। দৃষ্টি তাদের পলকহীন। স্মিত হেসে সালাহউদ্দীনের দিকে তাকালেন আলী বিন সুফিয়ান, আইয়ুবীর ঠোঁটেও মুচকি হাসি।

‘ও এতটা সুন্দরী, ধারণা করিনি।’ আলীর কানে কানে বললেন তিনি।

‘মিসরের আমীরের জয় হোক,’ বলতে বলতে এগিয়ে এল নাজি। ‘ওর নাম জোকি।’ বলল সে, ‘আপনার জন্য ইস্কান্দারিয়া থেকে আনিয়েছি। ও নর্তকী বা দেহপশারিণী নয়। কখনো সখনো শখের বশে নাচে বটে, তবে কোন জলসায় যায়না। ওর পিতা আমার পরিচিত, বড় ব্যবসায়ী। এ মেয়েটা আপনার খুব ভক্ত। আপনাকে ও প্রাণ দিয়ে ভালবাসে না বলে বরং নবীর মত সম্মান করে বলাই ভাল। ঘটনাচক্রে হঠাৎ ওর বাবার সাথে দেখা। একটা কাজে ওদিকে গিয়েছিলাম। মেয়েটা বলল, ‘শুনেছি সালাহউদ্দীন আইয়ুবী মিসরের গভর্নর হয়ে এসেছেন? মেহেরবানী করে আমাকে তার সাথে দেখা করিয়ে দেবেন? তাকে দেয়ার মত আমরা জীবনে আর নাচ ছাড়া কিছুই নেই। মাননীয় গভর্নর, এ মেয়েটাকে আপনার সামনে হাজির করার জন্যই নাচগানের অনুমতি চেয়েছিলাম।’

‘আপনি কি ওকে বলেননি, মেয়েদের অর্ধনগ্ন দেহ বা নাচগান আমি পছন্দ করি না। আপনি যাদের পোশাক পরা বলছেন ওরাতো সবাই উলংগ।’

‘মহামান্য আমীর’, ফ্যসফ্যসে গলায় বলল নাজি, ‘আপনি নাচ গান পছন্দ করে না একথা আমি ওকে বলেছি। ও বলল, আমার নাচ তিনি পছন্দ করবেন। কারণ, আমার নৃত্যে পাপের আহ্বান নেই। দেহ নয়, আমীরকে আমি শালীনভাবে নৃত্যের শৈল্পিক কলাকৌশল দেখাব। আমি পুরুষ হলে তার নিরাপত্তার জন্য জীবন বিলিয়ে দিতাম।’

‘আপনি কি বলতে চাইছেন?’

‘ওকে কাছে ডেকে একটু ধন্যবাদ জানালে ও খুব খুশী হবে।’

‘আপনি চাইছেন আমি তাকে ডেকে বলি যে, হাজার হাজার মানুষের সামনে তোমার নগ্ন দেহটাকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছ, পুরুষের ঘুমন্ত পশু সত্ত্বাকে উসকে দিতে তোমার জুড়ি নেই, এ জন্য তোমাকে ধন্যবাদ!’

‘ছি! ছি! তা কেন করবেন মাননীয় আমীর। আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম, এখানে এলে ওকে আপনার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেব। মেয়েটা অনেক আশা নিয়ে এসেছে। দেখুন ওর নৃত্যে পাপের আহবান নেই, আছে নীরব আত্মসমর্পণ। দেখুন না কেমন করে ও আপনার দিকে তাকিয়ে আছে! ও তার নৃত্যের কলাকৌশল, ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং মাদকতাময় দৃষ্টি দিয়ে আপনার উপাসনা করছে। কয়েক মুহূ্র্তের জন্য ওকে আপনার তাঁবুতে আসার অনুমতি দিন। আগামী দিন যারা হবে ইসলামের রক্ষক, ও হবে সে বীরপ্রসু মায়েদের একজন। নিজের সন্তানদের কাছে গর্ব করে বলতে পারবে যে, আমি সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সাথে একান্তে কথা বলেছি।’

‘ঠিক আছে ওকে আমার তাঁবুতে পাঠিয়ে দেবেন।’

অপূর্ব দেহবল্লরীতে কম্পন তুলে নাচছে জুকি। মদির কটাক্ষ হেনে তাকাচ্ছে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর দিকে। ঠোঁটে মধুমাখা মিষ্টি হাসির ঝিলিক। অন্য মেয়েরা প্রজাপতির মত তিরতির করে উড়ে বেড়াচ্ছে। মশালের ক্ষীণ আলোয় মনে হচ্ছে বরফগলা ঝরনার স্বচ্ছ পানিতে ফুলপরীরা দল বেঁধে সাঁতার কাটছে।

নিশ্চুপ বসে ছিলেন আইয়ুবী। নাজির সৈন্যরা মদে মাতাল। মরুভূমির সেই খোলা প্রান্তরে নিশুতি রাতের প্রকৃতিতে ভেসে বেড়াচ্ছে এক অপার্থিব সুর শিহরণ। ছন্দের তালে তালে বেজে চলছে নুপুরের নিক্কন ধ্বনি।

নিজের সাফল্যে নাজি ভীষণ খুশী। নাচ চলছে, ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে রাত।

মাঝরাতে তাঁবুতে প্রবেশ করলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। মেঝেতে দামী কার্পেট। দরজায় ঝুলানো রেশমী পর্দা। পালংকে চিতাবাঘের চামড়ার তৈরী আচ্ছাদন। কক্ষে মরু জ্যোস্নার মত ঝাড় বাতির হালকা নীলাভ আলোর ফুলঝুরি, বাতাসে মোহনীয় আতরের সুবাস।

নাজি তাবুতে ঢুকে বলল, ‘ওকে কিছু সময়ের জন্য পাঠিয়ে দেব মহামান্য আমীর? আমি প্রতিশ্রুতি ভাঙতে ভয় পাই।’

‘হ্যাঁ, পাঠিয়ে দাও।’

ধূর্ত শিয়ালের মত লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেল নাজি। খানিক পর দেহরক্ষীরা দেখল এক নর্তকী সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর তাবুর দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই তরুণীকে চিনতে পারল ওরা, এখনো নাচের ফিনফিনে পোশাক পড়ে আছে। রক্ষীরা ওর পথ আটকে দাঁড়াল। ও বলল, ‘মহামান্য গভর্ণর আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন।’

কমাণ্ডার বলল, ‘যেসব আমীর বাজে মেয়েদের সাথে রাত কাটায় সালাহউদ্দীন আইয়ুবী তাদের মত নয়।’

‘তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখ না, না ডাকলে কোন সাহসে আমি এখানে আসব?’

‘কার মাধ্যমে তোমায় ডেকে পাঠিয়েছেন?’

‘সেনাপতি নাজি আমাকে বললেন, গভর্ণর তোমায় ডাকছেন। আপনারা বললে আমি ফিরে যাচ্ছি, কিন্তু এর সব দায় দায়িত্ব আপনাদের।’

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী এক নর্তকীকে শোবার ঘরে ডাকবেন, রক্ষীদের কাছে তা অবিশ্বাস্য মনে হল। তারা জানত, তিনি কেমন প্রকৃতির মানুষ। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, নাচগানের সাথে যারা সম্পর্ক রাখবে তাদের একশত বেত্রাঘাত করা হবে। সমস্যায় পড়ল রক্ষী কমাণ্ডার। তবু ভয়ে ভয়ে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর তাবুতে প্রবেশ করে কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘বাইরে এক নর্তকী দাঁড়িয়ে আছে, আপনি নাকি তাকে ডেকেছেন।’

‘হ্যাঁ, ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’

কমাণ্ডার বেরিয়ে গেল। তাঁবুতে প্রবেশ করল জুকি। রক্ষীদের ধারণা ছিল, গভর্ণর তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাঁবু থেকে বের করে দেবেন। আইয়ুবীর বজ্র হুংকার শোনার জন্য ওরা কান পেতে রইল। কিন্তু এমন কিছুই ঘটল না।

রাত এগিয়ে যাচ্ছে। তাঁবুর ভেতর শোনা যাচ্ছে অনুচ্ছ কণ্ঠের আওয়াজ। কমাণ্ডার সীমাহীন উদ্বেগ নিয়ে বাইরে পায়চারী করতে লাগল। এক রক্ষী বলল, ‘বাজে মেয়েদের সাথে সম্পর্ক রাখা নিষেধ শুধু আমাদের জন্য।’

‘হ্যাঁ, অন্যজন বলল, ‘অধীনস্ত আর প্রজাদের জন্যই শুধু আইনের কড়াকড়ি। গভর্ণরকে তো আর বেত মারা যাবে না!’

‘রাজা বাদশাদের কাজই এমন।’ কমাণ্ডাররের কণ্ঠে ঝাঝ। ‘হয়ত তিনি মদও পান করেন, উপরের গাম্ভীর্য কেবল আমাদের প্রভাবিত করার জন্য।’

একটি মাত্র ঘটনায় সালাহউদ্দীন আইয়ুবী সম্পর্কে ওদের এতদিনকার সকল ধারণা নিঃশেষ হয়ে গেল। ওদের  চোখের সামনে ভেসে উঠল এক বিলাসপ্রিয় চরিত্রহীন রাজকুমারের ছবি।

নাজির খুশীর অন্ত নেই। সালাহউদ্দীন টোপ গিলেছে। তাকে সন্তুষ্ট করার অস্থিরতায় আজ সে মদ পর্যন্ত স্পর্শ করেনি। হৃদয়ভরা আনন্দ নিয়ে এডরোসসহ তাবুতে ঝিমুচ্ছিল সে।

এডরোস বলল, ‘ও অনেক্ষণ হয় গেছে। সম্ভবত আমাদের নিক্ষিপ্ত তীর সালাহউদ্দীনের হৃৎপিণ্ডে বিঁধে গেছে।’

‘আমার নিক্ষিপ্ত তীর কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।’ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল নাজি।

‘তীরের নিশানা ভুল হলে এতোক্ষণে ও ফিরে আসত। তুমি ঠিকই বলছ, জুকী মানুষরূপী এক যাদুকন্যা। নয়তো সালাহউদ্দীনের মত পাথর গলাতে পারত না।’

‘আমি যে ট্রেনিং তাকে দিয়েছি, ঘাতকদল তা কল্পনাও করতে পারবে না। সালাহউদ্দীনকে এখন শুধু মদ খাওয়ানোটা বাকী।’

বাইরে কারো পদশব্দে নাজি তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তাবুর পর্দা তুলে তাকাল বাইরে। না, জুকি নয়, একজন সৈনিক যাচ্ছে। নাজি দৃষ্টি ছু্ঁড়ল আইয়ুবীর তাবুর দিকে। বাইরে রক্ষীরা টহল দিচ্ছে। ফিরে এসে এডরোসকে বলল, ‘এবার আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি আমার জুকি পাথর ভেঙেছে।’

রাতের শেষ প্রহর। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর তাবু থেকে বেরিয়ে এল জুকি। নাজির তাবুর দিকে না গিয়ে হাঁটা দিল অন্য দিকে। পথে আপাদমস্তক ঢাকা একজন লোক দাঁড়িয়ে। লোকটি জুকিকে ইশারায় কাছে ডাকল, এগিয়ে গেল জুকি। লোকটি তাকে অন্য এক তাবুতে নিয়ে গেল। অনেকক্ষণ পর নাজির তাবুর দিকে হাঁটা দিল ও।

নাজির চোখে ঘুম নেই, ও একবার তাঁবুর ভেতরে ঢুকছিল, আবার বেরিয়ে আসছিল অস্থিরভাবে। কখনো হৃদয়ে তোলপাড় করা আনন্দ নিয়ে তাকাচ্ছিল আইয়ুবীর তাবুর দিকে। আকাশের উদার বিস্তার থেকে সালাহউদ্দীনকে তার পায়ের কাছে নামিয়ে এনেছে জুকি।

 ‘এডরোস, রাত তো শেষ হয়ে এলো, এখনো যে ও ফিরল না!’

‘ও আর কখনো ফিরে আসবে না। গভর্ণর তাকে সাথে নিয়ে যাবে। কোন রাজপুত্রও এমন হিরের টুকরো ফেলে দিতে পারে না, এদিকটা ভেবেছ কখনো?’

‘না তো! এদিকটা চিন্তাও করিনি।’

‘গভর্ণর তাকে বিয়েও তো করে নিতে পারেন! তাহলে মেয়েটা আমাদের কোন কাজেই আসবে না।’

‘ও যথেষ্ট সতর্ক।’

তবুও এক নর্তকীকে কদ্দুর বিশ্বাস করা যায়। নিজে অভিজ্ঞ পেশাদার নাচিয়ে। মা-ও বাঈজী ছিল। অবশ্যই সে আমাদের ধোঁকা দিতে পারে। ‘

গভীর চিন্তায় ডুবে গেল ওরা।

তাবুতে ঢুকলো জুকি। হেসে বলল, ‘এবার আমাকে আমার দেহের ওজন পরিমাণ স্বর্ণ দিন। ‘

‘কি হয়েছে আগে বলবে তো!’ নাজির কণ্ঠে অস্থিরতা।

‘আপনি যা চাইছিলেন তাই। আপনাকে কে বলল সালাহউদ্দীন পাথর, খোদার ভয়ে ভীত এক অনড় মুমীন।’ মাটিতে পা ঠুকে বলল জুকি, ‘সে মরুভূমির বালুর চাইতেও বেশী অসহায়, সামান্য বাতাসই তাকে উড়িয়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট।’

‘তোমার রূপের জৌলুস আর কণ্ঠের মধু তাকে উতলা করে দিয়েছে।’ এডরোস বলল, ‘নয়তো হারামিটা একটা দুর্গম পাথুরে পর্বত।’

‘পাথুরে পর্বত ছিল, এখন বালিয়াড়িও নয়।’

‘আমার ব্যাপারে কোন কথা হয়েছে?’ নাজির প্রশ্ন।

‘হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করল নাজি লোকটা কেমন? আমি বলেছি, মিসরে আপনার বিশ্বস্ত এবং অনুগত কেউ থাকলে একমাত্র নাজিই রয়েছে।’

‘আমার সাথে পরিচয় কিভাবে জানতে চায়নি?’

‘চেয়েছে, বলেছি তিনি আমার পিতার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমাদের বাড়ী গিয়ে আব্বাকে বললেন, আমি সালাহউদ্দীনের নফর। তিনি যদি আমায় সাগরে ঝাঁপ দিতে বলেন, তাও আমি দিব।’

‘বাহাব, বেশ বলেছ।’

‘আমার কথা শুনে তিনি বললেন, তুমি তো ভদ্রঘরের এক সম্ভ্রমশীলা তরুণী। আমি তাকে বললাম, অন্যের কাছে আমি যাই হই, আপনার কাছে আমি নগন্য এক দাসীমাত্র। আপনার ইশারাই আমার জন্য নির্দেশ।’

‘তারপর?’

‘আমার এ কথায় প্রভাবিত হয়ে তিনি বললেন, তুমি খুব ভাল মেয়ে। আরে অত দূরে কেন, আরেকটু কাছে এসে বসো। আমি খুব লজ্জিতভাবে জড়তা ও দ্বিধার ভাব নিয়ে তার পাশে গিয়ে বসলাম। আগে তিনি পাথর থাকলেও আমার দেহের স্পর্শে বলা যায় মোমের মত গলে গেছেন। বিদায়ের সময় আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন, জীবনে এই প্রথম পাপ করেছি। আমি বললম, আপনি কোন পাপ করেননি, প্রতারণা বা জোরাজুরিও করেননি। অন্যান্য শাসকদের মত জোর করেও ধরে আনেননি। আমি স্বেচ্ছায় এসেছি, আপনার অনুমতি পেলে আবারও আসব, বারবার আসব।’

নিজের নগ্ন দেহের মত অনেক মিথ্যা অবলীলায় বলে গেল জুকি। আনন্দের আতিশয্যে জুকিকে জড়িয়ে ধরল নাজি। এডরোস দু’জনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাবু থেকে বেরিয়ে গেল।

রহস্য ঘেরা মরুরাতের জঠর থেকে জন্ম নিল একটি প্রভাত, তবে অন্য প্রভাতের চেয়ে ভিন্ন। এ ভোরের আলো মরুরাতের আঁধার বুকে এমন এক নিগূঢ় তথ্য লুকিয়ে রাখল, যার মূল্য সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সমান। গতরাতে ঘটে যাওয়া রহস্যের দুটি দিক ছিল। একটি জানত নাজি এবং এডরোস। দ্বিতীয়টি আইয়ুবীর দেহরক্ষীরা। আর দু’টি দিকই জানতেন আলী বিন সুফিয়ান, আইয়ুবী এবং জুকি।

সালাহউদ্দীন এবং তার সঙ্গীদের অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে বিদায় দিয়েছিলেন নাজি। দুই সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল সুদানী ফৌজ। ‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী জিন্দাবাদ’ এর ধনিতে প্রকম্পিত হল আকাশ বাতাস। কিন্তু আইয়ুবী মৃদু হাসি বা হাত নেড়ে এ অভিবাদনের কোন জবাব দিলেন না।

নাজির সাতে হাত মিলিয়ে দ্রুত ঘোড়ায় চেপে বসলেন তিনি। তাকে অনুসরণ করল অন্য সংগীরা। অফিসে গিয়ে আলী এবং একজন সহকারীকে নিয়ে কক্ষের দরজা বন্ধ কর দিলেন তিনি। দিন কাটলালেন রুদ্ধদ্বার কক্ষে।

সুর্য ডুবে গেল। রাতের অন্ধকার গ্রাস করল পৃথিবী। কিন্তু তিনি রুদ্ধদ্বার কক্ষের দরজা খুললেন না। কক্ষে খাবার বা পানি দেয়ারও সুযোগ দিলেন না কাউকে। অনেক রাতে তিনজন কক্ষ থেকে বেরিয়ে নিজ নিজ ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন।

আলী বিন সুফিয়ান একা হতেই কমাণ্ডার তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

‘জনাব’ অভিমান ভরা কমাণ্ডারের কণ্ঠ, ‘নির্দেশ পালন করা এবং মুখ বন্ধ রাখা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু আমার সিপাইদের মধ্যে অসন্তুষ্টি আর নৈরাশ্য ছড়িয়ে পড়েছে। আমরাও একই অবস্থা।’

‘কেন, কি হয়েছে?’

‘রক্ষীরা বলছে, সুদানী বাহিনীর জন্য মদ বৈধ হলে আমরা কি অপরাধ করেছি? আমার অনুযোগকে অপরাধ মনে করলে যে কোন শাস্তি মাথাপেতে গ্রহণ করব। গভর্ণকে আমরা একজন সৎ চরিত্রবান এবং খোদাভীরু লোক বলে জানি, হাসিমুখে জীবন বিলিয়ে দিতে পারি তার সামান্য ইশারায়।’

‘কিন্তু গত রাতে তার তাবুতে এক নর্তকী প্রবেশ করেছিল, এইতো!’ কমাণ্ডারের মুখের কথা টেনে নিলেন গোয়োন্দা প্রধান। ‘না, তুমি কোন অপরাধ করনি। রাজা করুক আর প্রজা করুক, পাপ সে পাপই। আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, গভর্ণরের সাথে গোপন সাক্ষাতের মধ্যে পাপের কোন সম্পর্ক ছিল না। তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছে এ মুহূর্তে বলা যাবে না। কয়েকটা দিন যাক, সব নিজেরাই বুঝতে পারবে।’

কমাণ্ডারের কাঁধে হাত রেখে তিনি আবার বললেন, ‘আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন আমের বিন সালেহ, তুমি অভিজ্ঞ সৈনিক। ভাল করেই জান ফৌজ এবং ফৌজি কর্মকর্তাদের এমন কিছু গোপন ব্যাপার থাকে যার গোপনীয়তা রক্ষা করা সকলের কর্তব্য। নর্তকী আইয়ুবীর তাবুতে গিয়েছিল তাও এক গোপন ব্যাপার। কাউকে সন্দেহের মধ্যে রেখো না, কারো সামনে ভুলেও প্রকাশ করোনা সে রাতে কি ঘটেছিল।’

আলীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কমাণ্ডার অবহিত ছিল। সে নিশ্চিত হয়ে গেল। সন্দেহের অবসান ঘটল সেপাইদেরও।

দুপুরের খানা খাচ্ছিলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী, তাকে নাজির আগমনের সংবাদ দেয়া হর। খাওয়া শেষে তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন। নাজির চেহারায় শংকা এবং ক্রোধের অভিব্যক্তি। কম্পিত কণ্ঠে সে বলল, ‘মহামান্য আমীর! পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজকে সদ্য প্রস্তুতকৃত ফৌজের সাথে একীভূত করার নির্দেশ কি আপনি দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, অনেক চিন্তা ভাবনার পর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আরো সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মিসরের সেনাবাহিনীতে শতকরা ১০ জন থাকবে সুদানী সৈন্য। আপনাকে হেডকোয়ার্টারে বদলী করা হয়েছে, এখন থেকে আপনি আর সুদানী বাহিনীর প্রধান নন।’

‘মহামান্য আমীর, এ আমার কোন অপরাধের শাস্তি?’

‘সেনাবাহিনীর সামগ্রিক স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সৈনিক জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে হেডকোয়ার্টার আপনার সেবা নিতে চাচ্ছে, এ-তো আপনার জন্য খুশির খবর। কেবল একটা বাহিনী নয়, আপনি কি চাননা আপনার অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হোক আমাদের সকল সৈনিক?’

‘আমীর, আমার আশংকা হচ্ছে, সম্ভবতঃ আমার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র চলছে। আপনার মহান ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে একটু যাচাই বাছাই করবেন। আমার মনে হয় কেন্দ্রে আমার কোন শত্রু রয়েছে।’

‘দেখুন, সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনের ভুল বুঝাবুঝি দূর করার জন্যই এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। অফিসার হোক কি সাধারণ সিপাই, এখন থেকে সকলের জন্য মদ নিষিদ্ধ। কোন অনুষ্ঠানে নাচগান চলবে না।’

‘কিন্তু মাননীয় আমীর! আমিতো হুজুরের অনুমতি নিয়েই সবকিছু করেছিলাম।’

‘আপনি যাদেরকে মুসলিম মিল্লাতের সেনাবাহিনী বলছেন, তাদের আসল চরিত্র দেখার জন্য নাচ গানের অনুমতি আমি দিয়েছিলাম। পঞ্চাশ হাজার সৈনিককে তো চাকুরীচ্যুত করতে পারছি না, এ জন্য মিসরের ফৌজের সাথে একীভূত করে ওদের সংশোধন করতে চাচ্ছি। মনে রাখবেন, আমরা কেউ সুদানী, মিসরী বা সিরীয় নই। আমরা সবাই মুসলমান। আমাদের ধর্ম এক, পতাকাও এক।’

‘আমার অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কি একবারও ভেবেছেন?’

‘দেখুন, এ সিদ্ধান্ত আপনার মনপুত না হলে আপনি সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দিতে পারেন। আপনার ওপর আমি কোন কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না।’

‘মহামান্য আমীর, এ অন্যায়, এ জুলুম!’

‘কোনটা অন্যায় আর জুলুম তা বুঝার সাধ্যি কি আপনার আছে? নিজের অতীত একটু নিজেই তলিয়ে দেখুন গিয়ে, আমার মুখে শোনার প্রয়োজন হবে না।’

‘মহামান্য আমীর, এ সিদ্ধান্ত আরেকবার একটু বিবেচনার জন্য অনুরোধ করছি।’

‘অনেক ভেবেচিন্তেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ফিরে গিয়ে সব কিছু প্রস্তুত করুন। কোনরকম হটকারিতার আশ্রয় নেবেন না। মনে রাখবেন, আমার সহকারীর কাছে সাত দিনের মধ্যে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হবে।’

নাজি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার মুখ খোলার আগেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী।

জুকি গভর্ণরের তাবুতে রাত কাটিয়েছে, নাজির গোপন হারেমেও এ সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল। ও এসেছে এই সেদিন, অথচ নাজি প্রথম দিন থেকেই অন্য সবার চাইতে ওকে বেশী ভালবাসে। এক মুহূর্তের জন্যও অন্য নর্তকীদের কক্ষে তাকে যেতে দেয়া হয়নি। জুকির জন্য ছিল আলাদা কক্ষ। নর্তকীরা প্রতিহিংসার আগুণে পুড়তে লাগল। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে ফাঁসানোর জন্য জুকিকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে ওরা তা জানত না। ওদের ধারণা, জুকি নাজিকে এককভাবে দখল করে নিয়েছে। নর্তকী দু’জনের প্রতিহিংসা চরমে পৌঁছলে ওরা জুকিকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

গভর্ণরের তাবুতে জুকির রাত কাটানোর সংবাদে ওরা আরো পাগল হয়ে উঠল। কিভাবে তাকে হত্যা করা যায় ভাবতে গিয়ে ওদের মাথায় দুটি চিন্তা আসে। এক, তাকে বিষ প্রয়োগ করা যায়। দ্বিতীয়তঃ ভারাটে খুনী দিয়েও খুন করানো যায়। কিন্তু বাস্তবে দুটোর একটাও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ জুকির খাওয়া দাওয়ার সবকিছু ছিল ওদের থেকে আলাদা, অন্যদিকে প্রহরী ছাড়া সে তার রুম থেকে বেরই হতো না।

ওরা হারেমের এক চতুর বাদীকে হাত করল। জুকিকে শেষ করতে পারলে প্রচুর ধন সম্পদ দেয়ার লোভ দেখাল তাকে। চাকরাণীটা ছিল লোভী এবং জঘন্য প্রকৃতির। হেরেমের অসংখ্য অপকর্মের হোতা ছিল সে।

প্রস্তাব শুনে সে বলল, ‘মুনীবের কক্ষে গিয়ে ওকে বিষ খাওয়ানো সম্ভব নয়। সুযোগমত খঞ্জর ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে এ জন্য কিছু সময়ের প্রয়োজন।’

‘কতদিন সময় প্রয়োজন তোমার?’

‘জুকির তৎপরতার ওপর নজর রাখতে হবে। হয়ত শীঘ্রই সুযোগ এসে যাবে।’

‘কিন্তু তারাতারি যদি সুযোগ না আসে?’

‘তাহলে ঘাতক দলের সহযোগীতা নিতে হবে। তবে ওরা এজন্য অনেক টাকা দাবি করবে।’

‘যত টাকা লাগে দেব, তবু আমারা চাই কাজটা তুমি তাড়াতাড়ি শেষ কর।’ বলল নর্তকীরা।

ক্রোধে উন্মুক্ত প্রায় নাজি কামরায় পায়চারী করছিল। জুকি তাকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করেছে। নাজির রাগ কমেনি।

‘আমাকে তার কাছে যেতে দিন।’ এ নিয়ে চতুর্থবারের মত বলল জুকি, ‘আমি তাকে সোজা পথে নিয়ে আসবো।’

‘কোন লাভ নেই।’ বেটা কমবখত হুকুম দিয়ে ফেলেছে, বাস্তাবয়নও শুরু হয়ে গেছে। আমার আর কিছুই রইল না। তোমার যাদু ওকে ধরেনি। আমার বিরুদ্ধে কারা ষড়যন্ত্র করছে জানি। ওরা আমার উন্নতি সইতে পারছে না। আমিই হতাম গভর্ণর। একজন সাধারণ সেনাপতি হয়েই সব শাসকদের শাসন করেছি আমি। আর এখন আমি একজন সামান্য কমাণ্ডারও নই।

নাজি প্রহরীকে ডেকে বললো, ‘জলদি এডরোসকে আসতে বলো।’

এডরোস এলে দু’জনে নতুন নির্দেশ নামার ব্যাপারে আলাপ করল। এডরোসের কাছে এ খবর নতুন না হলেও সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে এ ব্যাপারে এডরোস কোন পরামর্শ দিতে পারলো না।

নাজি বলল, ‘কি করবো আমি ভেবে রেখেছি।’

‘কি ভেবেছেন?’

‘বিদ্রোহ করব।’

হতভম্বের মত তাকিয়ে রইল এডরোস

‘কি ব্যাপার, হতবাক হয়ে গেছ মনে হচ্ছে? বলতো পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজ আমাদের পক্ষে থাকবে, না সালাহউদ্দীনের পক্ষে? আমি ওদের বিদ্রোহের জন্য উস্কানি দিয়ে বলব, মিসর তোমাদের কিন্তু তোমরা এখন হবে ওদের দাস দাসী।’

দীর্ঘশ্বাস টেনে এডরোস বলল, ‘এ নিয়ে এখনো ভাবিনি। চোখের পলকেই তো বিদ্রোহ ঘটানো যায়। কিন্তু মিসের নতুন ফৌজ আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং যথেষ্ট শক্তিশালী। ইচ্ছে করলেই ওরা বিদ্রোহ দমন করতে পারবে। সরকারের সাথে সংঘর্ষে যাবার আগে সবদিক ভেবে দেখা উচিৎ।

‘ভাবাভাবির কাজ শেষ। আমি খৃস্টান সম্রাটদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকবো। দূত তৈরী কর, অনেক দূর যেতে হবে ওদের। এবার মন দিয়ে আমার পরিকল্পনার কথা শোন। জুকি তুমি নিজের ঘরে যাও।

জুকি ফিরে গেল নিজের কক্ষে। সারারাত দু’জন দরজা বন্ধ করে বিদ্রোহের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করল।

দুই ফৌজ একীভূত করার জন্য আইয়ুবী সাতদিন সময় দিয়েছিলেন। কাগজপত্র তৈরী হতে লাগল। পূর্ণ সহযোগীতা করছিল নাজি। চারদিন পার হয়ে গেছে, এর মধ্যে গভর্ণরের সাথে আরো একবার দেখা করেছিল নাজি, কিন্তু কোন অনুযোগ করেনি। কাজের বিস্তারিত রিপোর্ট দিয়ে আইয়ুবীকে আশ্বস্ত করেছিল। গভর্ণরের সহকারীও তাকে আশাব্যঞ্জক সংবাদ দিচ্ছিল, কিন্তু আলী বিন সুফিয়ানের দেয়া তথ্য ছিল উদ্বেগজনক।

গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হল, ‘সুদানী সৈন্যদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে। গুজব ছড়ানো হচ্ছে মিসরের সেনাবাহীনীর সাথে একত্রিত করে সুদানী সৈন্যদেরকে তাদের দাস দাসীতে রূপান্তরিত করা হবে। যুদ্ধলব্ধ সম্পদে সুদানীদের কোন অংশ থাকবে না। বিশেষ করে কাউকে মদ পানের অনুমতি দেয়া হবে না।’

রিপোর্ট শুনে সালাহউদ্দীন আইয়ুবী বললেন, ‘অনেক দিনের বদ অভ্যাস, আমার এসন নীতি ওদের পছন্দ না হওয়ারই কথা। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নতুন পরিবেশে এলে কিছুদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ওই মেয়েটার সাথে আর দেখা হয়েছে আলী?’

‘না, দেখা করা সম্ভব হচ্ছে না। আমার পাঠানো লোকটাকে নাজি আটকে রেখেছে।

দিন পেরিয়ে কালো নেকাব পরে প্রকৃতিতে নেমে এসেছে রাত। এডরোসের সাথে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বসেছিল নাজি। জুকি তার নিজস্ব কামরায়। ঘোড়ার পায়ের শব্দ কানে এল ওর। পর্দা তুলে বাইরে তাকাল জুকি।

দু’জন ঘোড়সওয়ার। পোশাক আশাকে ব্যবসায়ী মনে হচ্ছে।

ঘোড়া থেকে নেমে নাজির কক্ষের দিকে হাঁটা দিল ওরা। ওদের চলাচল জুকির কাছে ব্যবসায়ীর মত মনে হল না। ততোক্ষণে এডরোস বেরিয়ে এসেছে। থমকে দাঁড়াল আরোহী দু’জন। সামরিক কায়দায় স্যালুট করল। এডরোস ওদের পোশাক দেখে বলল, ‘প্রমাণ দাও।’

ওরা পোশাকের নীচে লুকানো অস্ত্র বের করল। ছোট তলোয়ার ওবং খঞ্জর।

ওদের ভেতরে নিয়ে গেল এডরোস। প্রহরী দাঁড়িয়ে রইল একপাশে।

গভীর চিন্তায় ডুবে গেল জুকি। কক্ষ থেকে বেরিয়ে নাজির কক্ষের দিকে হাঁটা দিল ও। পথরোধ করে দাঁড়িয়ে প্রহরী। বলল, ‘কারো ভেতরে যাবার অনুমতি নেই।’

সে বুঝে নিল কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। দু’তিন রাত আগের কথা মনে পড়ল তার। নাজি এডরোসকে বলেছিল, ‘আমি খৃস্টান শাসকদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকবো। তুমি দু’জন দূত তৈরী কর। ওদেরকে অনেক দূর যেতে হবে।’ এর পর জুকিকে বিদেয় করে বিদ্রোহের ব্যাপরের আলাপ করেছিল ওরা।

নিঃশব্দে নিজের কক্ষে ফিরে এল ও। নাজির খাস কামরার সাথে সংযুক্ত জুকির কক্ষের কপাট আঁটা। ও চুপিসারে দরজায় কান লাগিয়ে দাঁড়াল। ওপাশের কক্ষে অস্ফুট শব্দ। কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না।

একটু পর ভেসে এল নাজির কণ্ঠ, ‘পরিষ্কার জনবসতি থেকে দূরে থাকবে। ধরা পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে এ চিঠি নষ্ট করে ফেলবে। পথে কেউ বাঁধা সৃষ্টি করলে হত্যা করবে নির্দয়ভাবে। চার দিনে সফর তিন দিনে অতিক্রম করতে হবে। মনে রেখো, তোমাদের রোখ থাকবে উত্তর পূর্ব দিকে।’

নাজির কক্ষ থেকে সেই দুই ব্যক্তি বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এল জুকিও। এদের বিদায় দিতে নাজি এবং এডরোস আগেই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। লোক দু’টো ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল। জুকির দিকে চোখ পড়তেই নাজি বলল, ‘আমি বাইরে যাচ্ছি, তুমি গিয়ে বিশ্রাম করো। একা একা ভাল না লাগলে হারেমে ঘুরাফিরা করতে পার।’

‘ঠিক আছে।’ জুকি বলল।

ও এখানে আসার পর থেকে একবারের জন্যও বেরোতে পারেনি।

নাজি এবং এডরোস চলে যেতেই ও নিজের কক্ষে ফিরে গাউন পরল। কোমরে একটা খঞ্জর গুঁজে হাঁটা দিল হারেমের দিকে। হারেমের মেয়েরা অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকাতে লাগল। এখানে ওর এই প্রথম আসা। সবাই আন্তরিকতার সাথে স্বাগতঃ জানাল ওকে। সেই দুই নর্তকী অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। কথা বলল হেসে হেসে। ‘

একটু পর বেরিয়ে এল জুকি। হারেম আর নাজির বসত বাড়ির মাঝখানটা নির্জন এবং এবড়ো থেবড়ো। নাজির বাড়ীল দিকে না গিয়ে ও অন্যদিকে চলে গেল।

এদিকে ছিল একটা পায়ে চলার পথ। সে পথ ধরে হাঁটতে লাগর জুকি। ওর পনর বিশ কদম পেছনে এক ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি তার চেহারা আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢেকে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছিল তার পিছু পিছু।

কিন্তু সতর্ক জুকি টের পেয়ে গের। সে তার চলার গতি বাড়িয়ে দিল, বেড়ে গেল ছায়ামূর্তির গতিও। সামনে ঘন ঝোপঝাড়। জুকি ঝোপের আড়ালে ঢুকে গেল, পেছনে ঢুকল ছায়ামূর্তি।

সেখান থেকে শ’তিনেক গজ দূরে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বাসগৃহ। আশপাশে সেনা অফিসারদের বাস ভবন।

জুকি ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আইয়ুবীর বাড়ীর দিকে হাঁটতে লাগল। বায়ে উদয় হল ছায়ামূর্তী। ঝকঝকে জোৎস্নায়ও তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না। বিড়ালের মত নিঃশব্দে এগোচ্ছিল সে।

ছায়ামূর্তির হাত উপরে উঠল, বিদ্যুৎ গতিতে একটা খঞ্জর নেমে এল জুকির বাম কাঁধ এবং ঘাড়ের মধ্যখানে।

আঘাত খেয়ে জুকিও কোমর থেকে খঞ্জর বের করল। ছায়ামূর্তি আরেকটা আঘাত করল ওকে। পাশ কটে নিজেকে বাঁচিয়ে ডান হাতের খঞ্জর ছায়ামূর্তীর বুকে আমূল বসিয়ে দিল জুকি।

ভেসে এল এক মরণ চিৎকার। চিৎকারটা নারী কণ্ঠের। জুকি এবার আঘাত করল ছায়ামূর্তীর পেটে। মাটিতে পড়ে গেল সে। আক্রমণকারীর দিকে না তাকিয়েই দৌড়াতে লাগল জুকি। রক্ত ঝরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ও।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বাড়ীর অর্ধেক পথ এখনো বাকী, মাথা ঘুরতে লাগল ওর। গতি শ্লথ হয়ে এল। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে শরীর। সে এখন টলছে, পা পড়ছে এলোমেলো। ভয় হল, সে আর আইয়ুবীর বাড়ি পৌঁছতে পারবে না।

এবার ও চিৎকার করতে লাগল। ‘আলী, আলী, আইয়ুবী।’

রক্তে ভিজে গেছে ওর পোশাক। পা টেনে টেনে এগিয়ে চলছে ও। অনেক কাছে চলে এলেও মনে হচ্ছে আইয়ুবীর বাড়ী পর্যন্ত ও আসলেই পৌঁছতে পারবে না।

ও আলী এবং সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে ডেকেই যাচ্ছিল। ওর ডাকা ডাকির শব্দ কানে যেতেই ছুটে এল এক পাহারাদার। টলতে টলতে জুকি তার গায়ের উপরই হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

পাহারাদারকে বলল, ‘আমাকে এক্ষুণি গভর্ণরের কাছে পৌছে দাও। জলদি। তাড়াতাড়ি কর।’

শোবার ঘরে বসে আলীর নিক থেকে রিপোর্ট নিচ্ছিলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। পাশে দু’জন পদস্থ কর্মকর্তা। আলীর রিপোর্ট অনুযায়ী সুদানী বাহিনীতে বিদ্রোহের সম্ভাবনা রয়েছে। এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা চলছিল।

আতংকিত প্রহরী ভেতরে প্রবেশ করল। কক্ষের চোখগুলো এক সংগে ঘুরে গেল তার দিকে। প্রহরী বলল, ‘পাহারাদার একজন আহত মেয়ে নিয়ে বাঁইরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা গভর্ণরের সাথেদেখা করতে চাইছে।

তীরের মত কামরা থেকে বেরিয়ে গেল আলী। পেছনে সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। জুকিকে ভেতরে নিয়ে আসা হল। একজনকে পাঠিয়ে দেয়া হল ডাক্তারের জন্য। আইয়ুবী নিজের পালংকে শুইয়ে দিলেন ওকে। রক্তে ভিজে গেল বিছানার চাদর। ‘কাউকে ডাকতে হবে না।’ ক্ষীণ কণ্ঠে বলল জুকি, ‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি।’

‘জুকি, তোমাকে কে আহত করেছে?’ আলী প্রশ্ন করলেন।

‘আগে জরুরী কথা শুনুন। এখনি উত্তর-পূর্ব দিকে লোক পাঠিয়ে দিন। দেখতে পাবেন দু’জন অশ্বারোহী দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। দু’জনের পরনেই বাদামী পোশাক। দেখতে ব্যবসায়ী মনে হবে। একজনের ঘোড়া ধুসর অন্যেররটা কালো। খৃস্টান সম্রাট ফ্রাঙ্কের কাছে নাজির লেখা চিঠি আছে ওদের কাছে। নাজি সুদানী বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহ করবে। আমি আর কিছুই জানি না। আপনাদের দেশ ভয়ংকর সকটের মুখে। অশ্বারোহী দু’জনকে পথেই ধরে ফেলতে হবে। ওরা সব কিছু জানে।’ বলতে বলতে থেমে গেল জুকি। জ্ঞান হারিয়েছে ও।

দু’জন ডাক্তার দ্রুত ঘরে ঢুকলেন। রক্তক্ষরণ বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলেন ওরা। ওষুধ খাওয়ানোর কয়েক মিনিট পর জ্ঞান ফিরে এল ওর।

জ্ঞান ফিরতেই জুকি নাজির সথে এডরোসের কথাবার্তা থেকে শুরু করে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করল। এরপর বলল, ‘আততায়ীকে আমি চিনিনা, আঘাত পেয়ে পাল্টা আঘাত করেছিলাম। তার চিৎকার শুনে মনে হয়েছে মহিলা। তবে এন পর্যন্ত বেঁচে নেই হয়ত।

সাথে সাথে আক্রমণ স্থলে লোক পাঠিয়ে দেওয়া হল। জুকির রক্তক্ষরণ বন্ধ হল না। ও সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর হাতে চুমো খেয়ে বলল, ‘আল্লাহ আপনকে এবং আপনার দেশকে অবশ্যই নিরাপদে রাখবেন। আপনি পরাজিত হতে পারেন না। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ঈমান কত দৃঢ় আমারচে বেশী কেউ জানে না।’

এরপর আলী বিন সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তো দায়িত্ব পালনে অবহেলা করিনি। যে জিম্মা আমাকে দিয়েছিলেন আমি তা পূর্ণভাবে পালন করেছি।’

‘তুমি অনেক বেশী পালন করেছ জুকি।’ আলী বললেন, ‘নাজি এতটা বিপজ্জনক আমি কল্পনাও করিনি, যার জন্য তোমায় জীবন দিতে হল। আমি শুধু তথ্য সংগ্রহের জন্য তোমাকে ওখানে পাঠিয়েছিলাম।’

‘হায়! আমি যদি মুসলমান হতাম।’ বেদনা ঝরে পড়ল জুকির কণ্ঠ থেকে। সাথে সাথে বেরিয়ে এল অশ্রু বন্যা।

‘আমাকে যে বিনিময় দেয়ার কথা ছির তা আমার অন্ধ পিতা আর চির রোগা মাকে পাঠিয়ে দেবেন। তাদের অপারগতাই বার বছর বয়সে আমাকে নর্তকী হতে বাধ্য করেছিল।

বাক রুদ্ধ হয়ে এল জুকির। হঠাৎ মাথা একদিকে ঢলে পড়ল। অর্ধনিমলিত চোখ আর ঈষৎ ফাঁক করা ঠোঁট দেখে মনে হচ্ছিল ও মৃদু হাসছে। ডাক্তার ওর নাড়িতে হাত রাখলেন। করুণ চোখে চাইলেন আইয়ুবীর দিকে।

‘ও যেই ধর্মেরই হোক, সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হবে ওকে।’ বললেন আইয়ুবী। ‘ইচ্ছে করলে আমাদের ধোঁকাও দিতে পারতো। কিন্তু তার পরিবর্তে ও ইসলামের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছে।’

প্রহরী এসে বলল, ‘একজন মহিলার লাশ নিয়ে আসা হয়েছে।’ সবাই দেখলো মধ্যবয়সী এক অপরিচিতা মহিলা। আক্রান্ত স্থানে দু’টো খঞ্জর পাওয়া গেল। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, মহিলা ছিল নাজির হারেমের চাকরাণী, যার জন্য কেউ তাকে চিনতে পারেনি।

অত্যন্ত গোপনে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জুকিকে সমাহিত করা হল। মাটি খুড়ে পুঁতে রাখা হল মহিলার লাশ।

রাতেই সালাহউদ্দীন আইয়ুবী পত্রবাহী অশ্বরোহীদের ধরে আনার জন্য আটজন দুঃসাহসী ঘোড়সওয়ার প্রেরণ করলেন। জুকির নির্দেশিত পথ ধরে ধাওয়া করে ছুটল ওরা। মরুভূমির ধুলো উড়িয়ে দ্রুত এগিয়ে চলল আলী বিন সুফিয়ানের নেতৃত্বে।

জুকি ছিল মরোক্কোর এক নর্তকী। তার ধর্ম সম্পর্কে কেউ জানতে পারেনি। নাজি শত্রুর বিরুদ্ধে সুন্দরী যুবতী এবং হাসিস ব্যবহার করে একথা জানত আলী। তাই সে এক বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে মরক্কো থেকে জুকিকে আনিয়েছিল। এরপর নারী ব্যবসায়ী ছদ্মবেশে নিজেই ওকে নাজির কাছে বিক্রি করেছিল। মেয়েটার মধ্যে ছিল যাদুর চমক। নাজি ওকে সালাহউদ্দীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেল। নাজির গোপন বৈঠকে হাজির থাকত জুকি। সম্বর্ধনার রাতে ওকে আইয়ুবীর তাবুতে পাঠিয়ে নাজি ভীষণ খুশী হয়েছিল। এতদিনে পাথর গলানো যাবে, মেয়েটা তাকে মদ খাওয়াবে, এরপর তাকে নিজের ইচ্ছেমত গড়ে নিতে কতক্ষণ- এই ছিল নাজির ভাবনা। কিন্তু নাজি জানত না জুকি আইয়ুবীর চর। সে রাতে ও সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর তাঁবুতে তার ওপর অর্পিত কাজের রিপোর্ট দিয়েছিল। তাবু থেকে বেরিয়ে দেখা করেছিল আলীর সাথে। আলী ওকে পরবর্তি নির্দেশ দিয়েছিল। এরপর নাজির বাড়ী থেকে আর বের হওয়ার সুযোগ পায়নি ও। সুযোগ যখন পেল, ঘাতকের খঞ্জর কেড়ে নিল ওর প্রাণ।

জুকির মৃত্যুর পর প্রতিশ্রুত পারিশ্রমিক, নাজির কাছ থেকে নেয়া বিক্রয়লব্ধ অর্থ এবং আইয়ুবীর দেয়া উপহার সামগ্রী মরক্কোয় পাঠিয়ে দেওয়া হল বাপ-মার কাছে।

মৃত্যুর আতংক জড়ানো বিষন্ন রাতের আঁধার কেটে গেছে। গা জ্বলা তীব্রতা নিয়ে উঁকি দিয়েছে মরু সূর্য। আলী বিন সুফিয়ান তখন জনবসতি থেকে অনেক দূরে। সাথে আটজন সশস্ত্র অশ্বারোহী। যাচ্ছিল উত্তরপূর্ব দিকে। সম্রাট ফ্রাঙ্কোর রাজধানীর পথ আলীর চেনা। ক্লান্ত হলেও আরবী ঘোড়াগুলো এখনো সপ্রতিভ। দূরদিগন্তে দৃষ্টি ছুঁড়লেন আলী। খর্জ্জুরবীথির পাশ ঘেঁষে এগিয়ে যাচ্ছে দু’জন অশ্বারোহী।

পথ পরিবর্তন করে পাহাড়ের আড়াল নিয়ে এগুতে লাগলেন তিনি। আলী ছিলেন মরুভেদী। পথ হারানোর সম্ভাবনা ছিল না। সওয়ার দু’জন এখনো মাইল চারেক দূরে, গতি বাড়িয়ে দিলেন আলী।

অবসন্ন হয়ে পড়েছে ঘোড়া। খর্জুর বীথির কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সওয়ার দু’জন আরো মাইল দুয়েক এগিয়ে গেছে। চলছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। ওদের ঘোড়াও সম্ভবতঃ ক্লান্ত। ঘোড়া থেকে নেমে পাহাড়ের আড়ালে চলে গেল লোক দুটো। আলী আবার পথ পরিবর্তন করলেন। দু’দলের মধ্যে দূরত্ব কমে এল। এখন মাত্র কয়েকশ গজের ব্যবধান।

লোক দুটো অশ্ব ক্ষুরের শব্দে বেরিয়ে এর। আলীদের দেখে দ্রুত ঘোড়ায় চড়ে পালাতে লাগল ওরা। সামনে বালিয়াড়ি। ভয় পেয়ে ওরা একবার ডানে একবার বায়ে যাচ্ছিল। একজন তীরন্দাজ চলতি ঘোড়া থেকে তীর ছুঁড়ল। একজনের ঘোড়ার পায়ে বিঁধতেই লাফিয়ে উঠল ঘোড়াটা। টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ল আরোহী। আলী ওদের ঘিরে ফেললেন। দু’জনকেই বেঁধে ফেলা হল।

আলীর প্রশ্নের জবাবে ওরা নিজেদের ব্যবসায়ী পরিচয় দিল। তল্লাশীর পর পাওয়া গেল নাজির লেখা চিঠি। আলী খানিক বিশ্রাম করে বন্দীদের নিয়ে রাজধানীর পথ ধরলেন।

চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। দিন শেষে রাত এল। গভীর হয়ে এল রাতও। অনেক রাতে বিছানায় পিঠ লাগালেন আইয়ুবী। ভোর রাতে দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দে জেগে উঠলেন তিনি। তড়িঘড়ি দরজা খুলে দেখলেন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আলী। পেছনে আটজন সওয়ার এবং দু’জন বন্দী। আইয়ুবী সকলকে ভেতরে ডেকে নিলেন। নাজির চিঠি এগিয়ে দিল আলী।

চিঠি খুললেন আইয়ুবী। কয়েক লাইন পড়তেই ক্রোধে বিবর্ণ হয়ে গেল তার চেহারা। পলকে আনন্দ ঝলকে উঠল চোখে মুখে। নাজি তার দীর্ঘ চিঠিতে খ্রিষ্টান সম্রাট ফ্রাংককে আক্রমণের জন্য দিনক্ষণ ঠিক করে দিয়েছে। লিখেছে, রোম উপসাগর উপকূলে নৌবহর থেকে খৃস্টান সৈন্যরা নেমেই মিসর আক্রমণ করবে। এদিকে বিদ্রোহ করবে পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজ। সালাহউদ্দীনের নতুন সৈন্যরা এক সঙ্গে দুই ফৌজ মোকাবিলা করতে পারবে না। এর বিনিময়ে নাজি সমগ্র মিসর অথবা মিসরের একাংশ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছে।

‘জেলে পাঠিয়ে দেয়া হল বন্দী দু’জনকে। নাজি এবং তার সঙ্গীদের নিজস্ব বাসগৃহে নজরবন্দী করা হল। নাজির হারেমের মেয়েদেরকে ছেড়ে দেয়া হল। বাজেয়াপ্ত করা হল নাজির ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এ সব কিছুই করা হল অত্যন্ত গোপনে ও সতর্কতার সাথে। নাজি লিখিত চিঠি দু’জন দূত মারফত শুধু আক্রমণের তারিখ পরিবর্তন করে ফ্রাঙ্কোর কাছে পাঠিয়ে দিলেন আইয়ুবী। দুই সেনাবাহিনীর একত্রীকরণ সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেয়া হল।

দূত ফিরে এল আট দিন পর। নাজিকে জবাব লিখেছেন ফ্রাঙ্ক। সালাহউদ্দীন যেন আক্রমণ প্রতিহত করতে না পরে এজন্য আক্রমণের দুদিন আগেই বিদ্রোহ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ সংবাদ গোপন রাখার স্বার্থে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর অনুমতি নিয়ে আলী দু’জন দূতকে সসম্মানে গৃহবন্দী করে রাখলেন।

 

রোম উপসাগরের পাড়ে নির্দিষ্ট স্থানের আশপাশে আইয়ুবী নিজের সৈন্যদের লুকিয়ে রাখলেন। আক্রমণের এখনো কয়েকদিন বাকী। পত্রের নির্দেশ মত খৃস্টান হামলার পূর্বেই নির্দিষ্ট দিনে সুদানী ফৌজ বিদ্রোহ ঘোষণা করল। শক্তি প্রয়োগ না করে ডিপ্লোমেসী এবং সুন্দর ব্যবহার দিয়ে আইয়ুবী এ বিদ্রোহ দমন করলেন। সেনাপতির অনুপস্থিতি ছিল ওদের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।

সুদানী ফৌজ বিদ্রোহ করার দু’দিন পর নির্দিষ্ট তারিখে দেখা গেল খৃস্টানদের নৌবহর এগিয়ে আসছে। এর মধ্যে ফ্রান্স, গ্রীস, রোম এবং সিসিলির যুদ্ধ জাহাজ ছিল ১৫০টি। এসব জাহাজের মধ্যে ১২টি ছিল খুবই বিশাল। এসব জাহাজ মিসরে অবতরণকারী সৈন্য বহন করছিল।

খৃস্টানদের এ বাহীনিতে কেবল কমাণ্ডারই ছিল এক লাখ। রসদ এবং অস্ত্র বোঝাই নৌকার সংখ্যা ছিল অগণিত। জাহাজগুলি এগিয়ে আসছিল দুই সারিতে। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী নিজে মিসর বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে গেলেন এর মোকাবেলা করতে।

জাহাজ উপকূলের কাছে আসার অপেক্ষায় রইলেন তিনি। সবচে বড় জাহাজটি কিনারে এল। হঠাৎ জাহাজ লক্ষ্য করে অগ্নি গোলা নিক্ষিপ্ত হতে লাগল। কামানের গোলায় আগুন ধরে গেল পালে। আড়াল থেকে বেরিয়ে এল মুসলমানদের যুদ্ধ জাহাজ। ওদের জাহাজগুলো ছিল কাঠের তৈরী। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল সাগর বক্ষে। মনে হচ্ছিল আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিচ্ছিল সমগ্র রোম উপসাগর।

খৃস্টান জাহাজগুলো পালাতে গিয়ে পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে আগুন আরো ছড়িয়ে পরল। সৈন্যদের অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরে। যারা সাঁতরে তীরে উঠার চেষ্টা করছিল আইয়ুবীর তীরন্দাজদের নিশানা হল ওরা।

ওদিকে নুরুদ্দীন জংগী ফ্রাঙ্ক সম্রাটের রাজধানী আক্রমণ করলেন। মিসরের দিকে এগিয়ে আসা স্থলবাহিনী এ সংবাদ পেয়ে স্বদেশের দিকে ফিরে চাইল। কিন্তু সালাহউদ্দীন আউয়ুবীর সাড়াশী আক্রমণের ফলে রোম উপসাগরে সলীল সমাধি হল ওদের। এ যুদ্ধে সম্মিলিত খৃস্টান নৌশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল। আগুনে পুড়ে এবং সাগরে ডুবে নিহত হল অসংখ্য নৌ সেনা।

কমাণ্ডার এসমার্ক আত্মসমর্পণ করে সন্ধির প্রস্তাব করল। প্রচুর অর্থের বিনিময়ে তাকে মুক্তি দেয়া হর। গ্রীস এবং সিসিলির কিছু যুদ্ধ জাহাজ বেঁচে গিয়েছিল। আইয়ুবী তাদের ফিরে যাবার অনুমতি দিলেন। কিন্তু হঠাৎ সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে সব কটি জাহাজ নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেল। ১১৬৯ সনের ১৯শে ডিসেম্বর কর প্রদানের শর্তে খৃস্টানরা সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করল। বলতে গেলে এ বিজয়ের মূল কৃতিত্ব ছিল গোয়েন্দা সংস্থার।

এ ছিল দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী ক্রুসেডের প্রথম লড়াই। ইতিহাসের পাতায় খৃষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে সংঘটিত অসংখ্য লোমহর্ষক ক্রুসেডের যে কাহিনী ছড়িয়ে আছে তা আরো চমকপ্রদ, আরো ঘটনাবহুল।

ঐতিহাসিকরা বলেন, এতো কেবল মাত্র শুরু। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ক্রমেই প্রবেশ করলেন জীবনের বিপজ্জনক সব অধ্যায়ে। যে সব অধ্যায় অতিক্রম করে তিনি হয়েছিলেন গাজী সালাহউদ্দীন। তার সে বিপদজনক জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সংঘর্ষ এবং রহস্য ও রোমাঞ্চের ভয়াবহ সব জটিল ও কুটিল অধ্যায়।

খৃস্টানদের সম্মিলিত নৌশক্তি বিধ্বস্ত হয়েছে সাতদিন আগে। উপকূল ছেড়ে জাননি সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। এখনো সাগর বক্ষে ঢেউয়ের দোলায় দুলছিল দু’একটি পালছেড়া জাহাজ, মাল্লাহীন নৌকা। জ্বলন্ত জাহাজ থেকে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচতে চেয়েছে অনেক সৈন্য। ঢেউয়ের তালে ভেসে বেড়ানো জাহাজ এবং নৌকা তল্লাশীর জন্য সালাহউদ্দীন আইয়ুবী লোক লাগিয়ে দিলেন। অক্ষত নৌকা এবং জাহাজ তীরে নিয়ে আসছিল ওরা। অকেজো জাহাজ থেকে মালপত্র বের করা হচ্ছিল। বেশীর ভাগই অস্ত্র এবং খাদ্য সামগ্রী।

ঢেউয়ের আঘাতে বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ছিল অর্ধদগ্ধ অথবা মাছে খাওয়া লাশ। জাহাজের ভাঙা কাঠ আঁকড়ে সাগরে ভাসছিল কিছু জীবন্ত মানুষ। ঢেউ ওদের তীরে ঠেলে দিচ্ছিল। সমগ্র বেলাভূমিতে পাহারা দিচ্ছিল মুসলিম ফৌজ। আহত খৃস্টান সৈন্যদের কুড়িয়ে এনে চিকিৎসা করা হচ্ছিল তাদের। ঘোড়ায় চড়ে উপকূল ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন সুলতান আইয়ুবী।

ঘুরতে ঘুরতে ছাউনি থেকে দু’মাইল দুরে চলে এলেন তিনি। সামনে পার্বত্য এলাকা। পাহাড়ের একদিকে সাগর, অন্যদিকে খেজুর, নানা রকম গাছগাছালি এবং লতাগুল্ম ঘেরা প্রান্তর। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সাথে তিনজন সেনাপতি ও চারজন দেহরক্ষী।

ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন তিনি। ঘোড়ার বাগ রক্ষীদের হাতে দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। সেনাপতি তিনজনও ঘোড়া থেকে নেমে তার সঙ্গ নিল। এদেরই একজন বন্ধু বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ। যুদ্ধের একিদন আগে মাত্র তিনি এখানে এসেছেন।

শীত মওশুমের শান্ত সাগর। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এলেন তিনি। রক্ষীদের দৃষ্টির আড়ালে। সামনে পেছনে ছোট ছোট টিলা আর বালিয়াড়ি। বাঁয়ে পাহাড়। ডানে বেলাভূমির দিগন্ত বিস্তৃত বালুকারাশি। চার পাঁচ হাত উঁচু এক বালিয়াড়িতে উঠে দাঁড়ালেন আইয়ুবী। দৃষ্টি ছুঁড়লেন রোম উপসাগরের নীল জলরাশিতে। মনে হল সাগরের সব নীল জমা হয়েছে তার চোখে। বিজয়ের আনন্দে চেহারা উদ্ভাসিত। নাক কুঞ্চিত করে বললেন, ‘ভীষণ দুর্গন্ধ।’

সৈকতে আছড়ে পড়ল সব ক’টি চোখ। আকাশে ওড়াওড়ি করছে কতগুলো শকুন। ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেল ওরা। সুলতান বললনে, ‘ওখানে মড়া আছে।’

ঢিবি থেকে নেমে চারজনই সেদিকে এগিয়ে গেলেন। পনের বিশগজ দূরে এক ঝাঁক শকুন লাশের মাংস খাচ্ছে। একটা শকুন এক মড়ার মথার খুলি নিয়ে আকাশে উড়ল। কিন্তু পাঞ্চা থেকে ছুটে গেল মুণ্ডটা। পড়ল এসে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সামনে। তিনি মাথাটার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে রইলেন। মাথাটার খোলা চোখ আইয়ুবীর দিকে তাকিয়ে আছে যেন।

সালারদের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তিনি বললেন, ‘এ মাথাটা মুসলমানদের মাথা থেকে অনেক ভাল। এ মস্তিষ্কের জোরেই ওরা নারী আর মদে মাতাল করে দিচ্ছে সমগ্র মুসলিম খেলাফত।’

‘ওরা ইঁদুরের মত মুসলিম বিশ্বকে কুরে কুরে খাচ্ছে সুলতান।’ বললেন এক সেনাপতি।

আরেকজন বললেন, ‘আমাদের সম্রাটগণ ওদের নিয়মিত কর দিয়ে যাচ্ছে।’

শাদ্দাদ বললেন, ‘ফিলিস্তিন ওদের দখলে সুলতান। আমরা কি কোনদিন তা পুনরুদ্ধার করতে পারব না?’

‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা শাদ্দাদ।’

‘আল্লাহর রহমত থেকে না হলেও আমরা আমাদের ভাইদের দিক থেকে নিরাশ হয়ে পড়েছি।’

‘তুমি ঠিকই বলেছ। বাইরের আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। একবারও কি ভেবেছ, কি করে খৃস্টানদের এতবড় নৌশক্তি আমরা নিঃশেষ করে দিলাম? খোলা ময়দানে নয়, শুধু কমাণ্ডো হামলার মাধ্যমে। ওদের ফৌজ সমগ্র মিসর ধ্বস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বন্ধুরা, ভেতরের  আক্রমণ এত সহজে ঠেকানো সম্ভব হত না। ভাই আক্রমণ করলে ভাববে, সত্যিই কি ভাই আক্রমণ করেছে! যখন তার বিরুদ্ধে তরবারী তুলবে, দুশমন এ সুযোগ নেবে, নিঃশেষ করবে দু’জনকেই।’

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এগিয়ে চললেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। কিছু দূর এগিয়ে কি দেখে থমকে দাঁড়ালেন। নুয়ে মাটি থেকে জিনিসটা তুলে দেখালেন সবাইকে।

একটা ক্রুশ, তাগায় বাঁধা।

ছড়িয়ে থাকা লাশগুলোর দিকে তাকালেন আবার। আগেই সেই খুলিটা নিয়ে ঝগড়া করছে তিনটে শকুন।

দ্রুত মাথাটার কাছে গেলেন তিনি। ক্রুশটা সেই মাথার ওপর রেখে ফিরে এলেন সংগীদের কাছে। বললেন, ‘আমি এক বন্দী খৃস্টান অফিসারের সাথে কথা বলেছি। ও বলেছে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবার সময় সকলকেই ক্রুশের ওপর হাত রেখে শপথ করতে হয়। জীবন বাজি রেখে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শপথ নেয়ার পর সব সৈনিকের গলায় একটি করে ক্রুশ ঝুলিয়ে দেয়া হয়। জানিনা কুড়িয়ে পাওয়া এ ক্রুশটি কার? ক্রুশের জন্যই এরা জীবন দিয়েছে। খুলিটার ওপর ক্রুশটা রাখলাম, একজন সৈনিকের শপথের অমর্যাদা যেন না হয়।’

‘সুলতান’, শাদ্দান বললেন, ‘জেরুজালেমে খৃস্টানরা মুসলমানদের কি মর্যাদা দিচ্ছে আপনি জানেন? ওখান থেকে স্ত্রী পরিজন নিয়ে পালিে যাচ্ছে মুসলমানরা। লুন্ঠিত হচ্ছে আমাদের মেয়েদের ইজ্জত। এখনো আমাদের বন্দীদের ওরা ছেড়ে দেয়নি। মুসলমানরা ওখানে পশুর মত জীবন যাপন করছে। আমরা কি এর প্রতিশোধ নেব না?’

‘প্রতিশোধ নয় শাদ্দাদ, আমরা ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করতে চাই। কিন্তু আমাদের শাসকরাই এ পথের বড় বাঁধা। ওরা ক্রুশ স্পর্শ করে মুসলিম বিশ্বকে নিঃশেষ করার শপথ নিয়েছে, আমিও আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে বুকে হাত দিয়ে শপথ করে বলছি, অবশ্যই ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করব। কিন্তু বন্ধুরা, আমাদের ভবিষ্যত ইতিহাস আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে।

এক সময় ওরা শাসক ছিল, আমরা ছিলাম যোদ্ধা। এখন মুসলমান শাসক হচ্ছে ওরা দখল করে নিচ্ছে যুদ্ধের ময়দান। আমার মনে হয় মুসলমানরা শাসক হলেও নেতৃত্ব থাকবে খ্রীষ্টানদের হাতে। শাসক হতে পেরই ওরা সন্তুষ্ট থাকবে। আমি ফিলিস্তিন জয় করব কিন্তু ওরা তা রক্ষা করতে পারবে না। খৃস্টানদের মস্তিষ্ক অত্যন্ত উর্বর। পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজ কারা লালন করছে? আমাদের খেলাফতের পোশাকে লুকিয়ে আছে নাজির মত কালকেউটে। এরা দেশের জন্য বিপজ্জনক। আমিই প্রথম গভর্ণর যে এ সত্যটা বুঝতে পেরেছি। নাজির চিঠি আমাদের হাতে না এলে এতক্ষণে আমাদের রক্ত মিশে যেত মরুর বালুকারাশির সাথে, নয়তো হতাম ওদের হাতে বন্দী।’

আইয়ুবী আবেগাপ্লুত কণ্ঠে কথা বলে যাচ্ছেন, আকস্মাৎ পেছন থেকে শনশন শব্দে ছুলে এল একটা তীর। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর দু’পায়ের ফাঁকে বালিতে গেঁথে গেল তীরটা। আতংকিত দৃষ্টিতে পিছনে ফিরে পাহাড়ের দিকে তাকালেন সবাই। আরও তীর আসতে পারে ভেবে দৌড়ে এক পাহাড়ের আড়ালে দাঁড়ালেন।

শীষ দিলেন শাদ্দাদ। নীচে থেকে ছুটে এল রক্ষীর।

‘ঘোড়াগুলো এখানে রেখে তোমরা পাহাড়ের ওপাশে চলে যাও।’ রক্ষীদের বললেন সুলতান, ‘ওদিক থেকেই তীর এসেছে। কাউকে দেখলে গ্রেফতার করবে।’

যেদিক থেকে তীরটা ছোটে এসেছিল সাবধানে সেদিকে এগোতে শুরু করল রক্ষীরা। সেনাপতিরা দ্রুত পাহাড়ে উঠতে লাগলেন। ওদের নিষেধ উপেক্ষা করে তাদের সাথে এগিয়ে চললেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী নিজেও।

পাহাড়ে উঠে দাঁড়ালেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত পর্বতমালা। কোনটা উঁচু, কোনটা নীচু। সালারদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলেন চারদিক। জনমানুষের চিহ্নও নেই। রক্ষীরা ঘোড়া ছুটিয়ে বিভিন্ন পাহাড় খুঁজে দেখল। কেউ নেই। যেন হাওয়া থেকে ছুটে এসছে তীরট।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ফিরে এলেন তীরের কাছে। হাত লাগতেই পড়ে গেল ওটা। তীরটা হাতে নিলেন সুলতান। বললেন, ‘অনেক দূর থেকে এসেছে, এ জন্য হালকা ভাবে বিঁধেছে। তবে তীলটা গুপ্তঘাতকদের নয়, খৃষ্টানদের।’

‘সুলতানের জীবন বিপন্ন।’ বললেন এক সেনাপতি।

হেসে উঠলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী, ‘এবং সব সময় ঝুঁকিপূর্ণই থাকবে।’ বললেন তিনি। ‘খৃস্টানদের যেসব নৌকা মাঝা মাল্লা ছাড়া ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে, আমি তা দেখতে বেরিয়েছি। কিন্তু বন্ধুরা ওদের সব তীরই মাল্লাহীন নয়। ওরা আবার আসবে, আসবে ঝড়ের গতিতে। আঘাত করতে মাটির নীচ থেকে, পিছন থেকে। যুদ্ধের স্বাভাবিক নিয়মে ওদের সাথে মোকাবিলা করা যাবে না। আমি যুদ্ধ পলিসিতে এক নতুন পদ্ধতি সংযোজন করব। এ পলিসি সম্পূর্ণ আনকোরা নতুন। গেরিলা অপারেশনে আনব নতুন মাত্রা। কমাণ্ডো এবং গোয়েন্দাদেরই থাকবে এতে প্রধান ভূমিকা।

তীরটা হাতে নিয়েই ঘোড়ায় চাপলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। এগিয়ে গেলেন শিবিরের দিকে। ডানে, বাঁয়ে এবং পেছন থেকে সালাহউদ্দীন আইয়ূবীকে অনুসরণ করে এগিয়ে চললেন সেনাপতি তিনজন।

বলতে গেলে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। কিন্তু তিনি ছিলেন এ ব্যাপারে নিরুদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠাহীন। যেন কিছুই হয়নি।

তাঁবুতে ফিরে সালারদে নিয়ে বসলেন। তাদের সামনে তুলে ধরলেন গেরিলা আক্রমণ এবং কমাণ্ডো হামলার বিভিন্ন দিক। বললেন, ‘আমি আলী বিন সুফিয়ানকে শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী গঠন করার নির্দেশ দিয়েছি। তোমরা সেনাবাহিনী থেকে স্বাস্থ্যবান এবং মেধাবী যুবকদের বাছাই কর। ওরা হবে দুরদর্শী, বুদ্ধিমান। ওদের থাকবে উটের মত দীর্ঘ সময় ক্ষুধাতৃষ্ণা সহ্য করার ক্ষমতা। গতি হবে চিতাবাঘের মত ক্ষিপ্র। ঈগলের মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং খরগোশ ও হরিণের মত দ্রুতগামী হবে ওরা। এদের থাকবে সশস্ত্র শত্রুর সাথে খালি হাতে লড়াই করার ক্ষমতা, নেশা ও পরনারীর প্রতি আসক্ত হবার লোভ থেকে মুক্ত।

খৃষ্টানরা আমাদের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে চায়। সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহার করছে গোয়েন্দা কাজে। ওরা নিঃশেষ করে দিতে চাইছে আমাদের ঈমানী আবেগ। আমি দেখছি মুসলমানরা নারীদের ব্যাপারে অত্যন্ত দুর্বল। আমি গোয়েন্দাগিরি বা অন্য কোন কাজে কোন মেয়ে ব্যবহারের পক্ষপাতি নই। আমরা নারীর ইজ্জত আব্রুর রক্ষক। নারীর ইজ্জতকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা আমাদের কাজ নয়। আলী গোয়োন্দা কাজে কয়েকটি মেয়েকে ব্যবহার করছে। ওরা না মুসলিম না খৃষ্টান। কিন্তু কোন ধর্মাধর্ম নয়, আমি নারীকে নারী হিসেবেই সম্মান করি।’

তাবুতে ঢুকল রক্ষী দলের কমাণ্ডার। বলল, ‘রক্ষীরা কয়েকজন মেয়ে ও পুরুষকে ধরে এনেছে।’

বেরিয়ে এলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। তার পিছু নিলেন তিন সেনাপতি। বারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচজন পুরুষ, সাতজন মেয়ে। মালপত্র দেখে মনে হচ্ছে ব্যবসায়ী। মেয়েগুলো অপূর্ব সুন্দরী। রক্ষীরা বলল, ‘তীর নিক্ষেপকারীকে খুঁজতে গিয়ে এদের পাওয়া গেছে। তিনটি উটসহ একটি তাবুতে অপেক্ষা করছিল ওরা।

‘এদের কি তল্লাশী নেয়া হয়েছে?’ এক সেনাপতি প্রশ্ন করলেন।

‘জ্বী, ওদের দেহ এবং মালপত্র তল্লাশী নেয়া হয়েছে। খঞ্জর ছাড়া কোন অস্ত্র পাওয়া যায়নি।’

‘আমরা মরক্কোর ব্যবসায়ী।’ ওদের একজন বলল, ‘যাব ইস্কান্দারিয়া পর্যন্ত। দু’দিন আগেআমরা যখন দশ ক্রোশ পেছনে তখন এ মেয়েগুলো আমাদের কাছে আসে। ভেজা কাপড়, বিধ্বস্ত চেহারা। বলল, বাড়ী সিসিলি। এদিকে আসার পথে এক খৃস্টান কমাণ্ডোর ওদেরকে উপকুল থেকে ধরে নিয়ে আসে। ওরা আমাদের সাহায্য চাইল। অসহায় মেয়েগুলোর জন্য মায়া হল আমাদের। সেই থেকে ওরা আমাদের সঙ্গে।’

‘এদের সম্পর্কে আর কি জান তুমি?’

‘এরা বলেছে, এরা গরীব ঘরের সন্তান। জাহাজে এনে অফিসাররা এদের সতিত্ব নষ্ট করেছে। যুদ্ধের সময় গোলার আঘাতে হঠাৎ ওদের জাহাজে আগুণ ধরে গেলে সবাই সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। সাঁতার জানেনা বলে এদেরকে একটা ছোট্ট নৌকায় তুলে দিল সৈন্যরা। এরা নৌকা বাইতে জানে না। ঢেউয়ের ধাক্কায় একসময় নৌকা কিনার স্পর্শ করল। আমরা তখন উপকূল থেকে সামান্য দূরে বিশ্রাম করছিলাম। তখনই ওরা আমাদের কাছে আসে।’

‘তারপর?’

‘প্রথমে ভেবে পেলাম না কি করব, ওদের সাথে নেয়া ঠিক হবে কিনা। পরে অসহায় ভেবে আশ্রয় দিলাম, সাথে নিয়েই এগিয়ে চললাম। পেছনের তাঁবুতে আপনার লোকেরা আমাদের তল্লাশী নিতে লাগল। কারণ জিজ্ঞেস করায় বলল, মিসরের গভর্ণর সুলতান আইয়ুবীর নির্দেশ। আমরা অনুনয় বিনয় করে বললাম, আমাদেরকে সুলতানের কাছে পৌছে দাও।’

‘কেন তোমরা সুলতানের কাছে আসতে চাইলে?’

‘এ মেয়েগুলোকে আশ্রয় দেয়ার জন্য সুলতানকে অনুরোধ করব। আমরা ব্যবসায়ী, কোথা থেকে কোথায় যাই তার তো ঠিক নেই। এদের আমরা কতক্ষণ বয়ে বেড়াবো?’

মেয়েদেরকে জিজ্ঞেস করা হল। ওরা কথা বলল, সিসিলির ভাষায়, দু’তিনজন এক সংগে। আতংকিত চোখ।

সুলতান ব্যবসায়ীদের দিকে চাইলেন।

‘তোমরা কি এদের ভাষা বোঝ?’

একজন এগিয়ে এল। ‘জ্বী, কেবলমাত্র আমিই বুঝি। ওদের আশ্রয় দেয়ার জন্য মহানুভব সুলতানকে অনুরোধ করছে ওরা। ওরা বলছে, ব্যবসায়ীদের সাথে ওরা যাবে না। চারদিকে যুদ্ধ চলছে। ভয় আছে চোর ডাকাতের। ওরা আরো বলছে, খৃস্টান সৈন্যদের ওরা ভীষণ ভয় পায়। অপহরণের সময় ওরা সবাই কুমারী ছিল। জাহাজে ওদের সতীত্ব হরণ করা হয়েছে।’

অন্য একটা মেয়ে কিছু বলল, দোভাষী বলল, ‘মেয়েটি বলছে, আমাদেরকে মুসলমানদের রাজার কাছে নিয়ে চল। হয়ত তিনি আমাদেরকে আশ্রহ দেবেন।’

অপর একটি মেয়ে কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘আমাদেরকে খৃস্টান সৈন্যদের কাছে ফিরিয়ে দিও না। আমরা মুসলমান হয়ে যাব।’ বলল আরেক মেয়ে।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা মুসলমান হয়ে যাব। কোন মুসলমান দয়া করে আমাদের বিয়ে করলে আমরা আর দেশেও ফিরে যাব না, আমরা এখানেই থেকে যাব।’ বলল আরেক মেয়ে।

তার কথা শুনে চোখে মুখে আতংক নিয়ে দু’তিনটি মেয়ে মুখ লুকানোর চেষ্টা করছিল, যেন ওরা লজ্জায় মরে যাচ্ছে।

সুলতান বললেন, ‘এদেরকে খৃস্টান সৈন্যদের কাছে তুলে দেয়া হবে না। মুসলমান হওয়ার জন্যও ওদের বাধ্য করবে না কেউ। ওরা যদি আমাকে বিশ্বাস করে মুসলিম মেয়েদের মতই ওদের আশ্রয় দেব। জেরুজালেমের খৃষ্টান ফাদার বা পাদ্রীর কাছে পাঠিয়ে দেব রাজধানীতে গিয়ে। অথবা খৃস্টানদের সাথে বন্দী বিনিময়ের সময় ওদেরকে স্বদেশ পাঠিয়ে দেয়া হবে। ওদের প্রয়োজন এবং মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখা হবে। কিন্তু কেউ বিয়ে করলে মুসলমান হবে এ প্রস্তাব গ্রহণ করা যাবেনা। এমনকি কোন মুসলমানের সাথে ওরা মিশতেও পারবে না।’

ব্যবসায়ী সুলতানের কথা মেয়েদের বুঝিয়ে বলল। স্বস্থির ভাব ফুটে উঠল ওদের চেহারায়। সুলতানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ফিরে গেল ব্যবসায়ীরা।

মেয়েদের জন্য আলাদা তাবু টানাতে বললেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। প্রয়োজনীয় প্রহরা এবং তাবুর স্থান নির্দেশ করতে না করতেই রক্ষীরা দু’জন আহত বন্দীকে নিয়ে এল। জীর্ণ বিধ্বস্ত চেহারা। রক্ত ও পানিতে ভেজা পোশাক। লাশের মত ফ্যাকাশে।

জানা গেল মাইল দেড়েক দূরে এক নৌকায় ছিল বাইশ জন লোক। এ দু’জন কোনভাবে বেঁচে গেছে, বাকী সবাই মারা পড়েছে। কিনারে এসে নৌকা ডুবে গেলে অনেক কষ্টে সাঁতরে তীরে উঠেছে ওরা।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সামনে ধপাস করে মাটিতে বরে পড়ল ওরা। ব্যাথায় কোঁকাচ্ছে।

ওদের একজনকে সধারণ সৈনিক বলে মনে হল না। কাপড়ে রক্তের দাগ নেই, তবে কাতরাচ্ছে অন্যদের চেয়ে বেশী। মাঝে মাঝে মেয়েদের দিকে মুখ বিকৃত করে তাকাচ্ছে।
একে একে সবার ওপর দৃষ্টি বুলালেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। শেষ বন্দীর দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। সেনাপতিদের দিকে ফিরিয়ে আনলেন দৃষ্টি।

‘আলী এখনও এল না! বললেন আইয়ুবী, ‘এ পর্যন্ত যতজন ধরা পড়েছে তাদের এখনি জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার।’

শেষ বন্দীর দিকে তাকালেন আবার। বললেন, ‘মনে হয় কমাণ্ডার। আলী এলে ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলবে। সম্ভবত ভেতরে হাড়গোড় ভেঙেছে।’

রক্ষীদের দিকে ফিরে বললেন, ‘এদেরকে এখনি আহত বন্দী শিবিরে পৌঁছে দাও। চিকিৎসা এবং খাওয়া দাওয়ার দিকে খেয়াল রেখো।’

বন্দীদের পৌঁছে দেওয়া হল আহত শিবিরে। মেয়েরা তাকিয়ে রইল ওদের গমন পথের দিকে।

সেনা ছাউনি থেকে একটু দূরে মেয়েদের জন্য তাবু তৈরী হচ্ছিল। তার একটু দূরেই আহত বন্দীদের তাঁবু। মেয়েরা তাদের জন্য যে তাবু বানানো হচ্ছিল তার পাশে গিয়ে বসল। তাকিয়ে রইল আহত বন্দীদের তাবুর দিকে। নির্ণিমেষ নয়নে ওরা দেখছিল নতুন বন্দীকে।

তাঁবু তৈরী হল। ওরা চলে গেল যে যার তাঁবুতে। বাইরে সশস্ত্র পাহারা। খাওয়া দাওয়ার পর তাবু থেকে বেরিয়ে এল একটি মেয়ে। তাকাতে লাগল অন্য তাবুর দিকে। ভয়শূণ্য স্বাভাবিক দৃষ্টি। সেন্ট্রি তাকাল ওর দিকে। সেন্ট্রির চোখে চোখ রেখে মিষ্টি করে হাসল মেয়েটা। ইশারায় বুঝাল ওই তাঁবুতে যেতে চায়।

মাথা নেড়ে নিষেধ করল প্রহরী। দূরে কোথাও যাওয়া নিষেধ। দু’টো তাবুর মাঝে গাছগাছালি, বাঁয়ে ঝোপ ঝাড় ভরা উঁচু বালিয়াড়ি ও ছোট ছোট পাহাড়।

সূর্য ডুবে গেছে। বোরকা পরা রাত নেমেছে আঁধার হয়ে। তাবুর ভেতরে কোলাহলের কণ্ঠ আঁকড়ে ধরেছে ক্লান্তি ও ঘুম। মরুভূমির বাতাসে রাতের স্তব্ধতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আহতদের করুণ কাৎরানি অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হচ্ছে। বাতাসে ভর করে ভেসে আসছে রোম উপসাগরের আন্দোলিত জলরাশি ও ঢেউয়ের মৃদুমন্দ ধ্বনি। প্রহরী এবং আহতরা ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে গেছে।
সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর তাবুতে আলো জ্বলছে। রক্ষীরা টহল দিচ্ছে তাবুর বাইরে। তাবুর ভেতর সেনাপতি তিনজনকে নিয়ে  বসে আছেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। চেহারায় উদ্বেগ।

‘আলী এখনও এর না! আইয়ুবীর কণ্ঠে স্পষ্ট উদ্বেগ। ‘ওখানে বিদ্রোহের সম্ভাবনা ছিল বলে আলীকে রেখে এসেছিলাম। তার খোঁজ নিতে যাকে পাঠিয়েছিলাম, সেও তো এখনও ফিরে এল না!’

‘কোন সমস্যা হলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই সংবাদ পেতাম। হয়ত ওখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক।’ বলল এক সেনাপতি।

‘আমরা তো তাই কামনা করি। কিন্তু পঞ্চাশ হাজার বিদ্রোহী সৈন্যকে সামলানো সহজ ব্যাপার নয়। ওখানে আমাদের মাত্র দেড় হাজার ঘোড়সওয়ার এবং দু’হাজার সাতশো পদাতিক সৈন্য রয়েছে। এদের তুলনায় সুদানী ফৌজ কেবল সংখ্যায়ই বিপুল নয়, অভিজ্ঞতা এবং সমরাস্ত্রেও ওরাই শক্তিশালী।

‘নাজি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের দমন করার পর ওখানে প্রকাশ্যে কেউ বিদ্রোহ করবে বলে মনে হয়না। নেতৃত্ব ছাড়া বিদ্রোহ সম্ভব নয়।’ বলল অন্য এক সেনাপতি।

‘তবুও আমাদের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ পরিস্থিতিতে কি করা যায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার।

ছাউনিতে নিশুতি রাতের ভুতুরে নীরবতা। কিন্তু মেয়ে সাতটির চোখে ঘুম নেই। পর্দা তুলে তাবুর ভেতরে উঁকি দিল প্রহরী। প্রহরীর পদশব্দে ঘুমের ভান করে পড়ে রইল মেয়েগুলো। তাবুর ভেতর প্রদীপের আলো। গুণে দেখল প্রহরী, সাতজন। পর্দা ছেড়ে সরে এল সে।

প্রকৃতির সবকিছু নিরব, নিস্তব্ধ। সবকিচু সুস্থ স্বাভাবিক। একটানা একঘেয়ে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে প্রহরী।

একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য তাবুর একপাশে হেলান দিয়ে বসল প্রহরী। তাবু ঘেঁষে শুয়েছিল যে মেয়েটা সে তার পাশের জনের কানে কানে বলল, ‘বসে পড়েছে।’ এক কান দু’কানকরে সাতজনের কাছেই পৌঁছল খবরটা। দরজার কাছে শুয়েছিল যে মেয়েটা সে এবার উঠে বসল। নিজের বিছানায় কম্বল ভাঁজ করে বিছিয়ে তার ওপর চাদর ছড়িয়ে দিল। এরপর সস্তর্পণে বেরিয়ে এল তাবু থেকে।

প্রহরী জানত এ তাবুতে কয়েকজন অসহায় মেয়ে আছে মাত্র। যাদেরকে সাগর থেকে কুড়িয়ে এনে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এদের কাছ থেকে কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই ভেবে বসে বসে ঝিমুতে লাগল সে।

বিপরীত দিক দিয়ে মেয়েটা বেরিয়ে এল তাবুর বাইরে। সতর্ক পায়ে এগিয়ে গেল টিলার দিকে। টিলার কাছে পৌঁছে আহত বন্দীদের তাঁবুর দিকে হাঁটা দিল। গাছের ফাঁকে ফাঁকে এগিয়ে যাচ্ছিল ও। প্রহরীটি এখন বেশ দূরে। ওকে আর দেখে ফেলার ভয় নেই।

তাবুর কাছাকাছি পৌঁছে একটা ঝোপের আড়ালে বসে এদিক ওদিক ভাল করে তাকিয়ে দেখল। গভীর সাবধানী দৃষ্টি। দেখল এখানকার প্রহরী তাখনো টহল দিচ্ছে। কালো একটা সচল ছায়া চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে তাবুর চারদিক। সে সচল ছায়ার ওপর আটকে রইল মেয়েটার চোখ।

এখন ও দু’সেন্ট্রির মাঝখানে মাটিতে শুয়ে আছে। প্রহরীটি হাঁটতে হাঁটতে সরে গেল তাবুর ওপাশে।

ও হামাগুড়ি দিয়ে পৌছুল তাবুর কাছে। অন্ধকাররে পর্দা একটু ফাঁক করে ঢুকে গেল তাবুর ভেতর।

ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। যন্ত্রণায় আহতদের অনেকেই ঘুমোতে পারছে না। ব্যথায় কাৎরাচ্ছে কেউ কেউ।

পর্দা ফাঁক করে কেউ একজন ভেতরে প্রবেশ করছে দেখে পাশের জন ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘কে?’

‘রবিন কোথায়! ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে ফিসফিসিয়ে বলল মেয়েটা।

‘এদিক থেকে তৃতীয়।’

মেয়েটা হাতড়ে হাতড়ে তৃতীয় ব্যক্তির পা স্পর্শ করল।

‘কে?’ বলল সে।

‘আমি মুবি।’

উঠে বসল রবিন। হাত বাড়িয়ে মুবিকে বিছানায় টেনে নিল। শুইয়ে দিল নিজের পাশে। ওর গায়ে চাদর তুলে দিতে দিতে বলল, ‘আমার সাথে লেগে থাক। প্রহরী এসে যেতে পারে।’

রবিন মুবিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ঘরে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি আশ্চর্য হচ্ছি মুবি, কিভাবে আমাদের দেখা হল! এতে বুঝা যায়, পবিত্র যিশু আমাদের সাফল্য চাইছেন। আমরা পরাজিত হয়েছি একথা ঠিক নয়।’

‘তুমি কি আহত, হাড়গোড় ভাঙ্গেনি তো!’

‘ধুর, আমার কিছু হয়নি। একটা আঁচর পর্যন্ত লাগেনি কোথাও।’

এখানে এসেছ কেন?’

‘সুদানী সেনাবাহিনীর কাছে যাব। চারদিকে মুসলিম ফৌজ। অনেক চেষ্টা করেছি, যেতে পারিনি। দেখলাম ওরা আহত বন্দীদের চিকিৎসা দিচ্ছে। আহত হওয়ার ভান করে ওদের দলে ভিড়ে গেলাম।’

‘এখন কি করবে?’

‘সুযোগ পেলেই পালিয়ে যাবো। কিন্তু এ মুহূর্তে তা সম্ভব হচ্ছে না। আইয়ুবী বড় বজ্জাত আদমী, চারদিকে ওর চোখ কান খোল।’

‘ভালই গ্যাড়াকলে আটকেছ দেখছি।’

‘টিটকারী মারবে না।’ হঠাৎ খেপে গেল রবিন, ক্রোধের সাথে বলল, ‘বলতো আইয়ুবী এখনও বেঁচে আছেন কেন? তীর কি শেষ হয়ে গিয়েছিল, না ওই বদমাশটা ভয় পেয়েছে? আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, তোমরা সাতজন একত্রে ধরা পড়লে কিভাবে? ওই পাঁচটা পাঠা কি মরে গেছে, না পালিয়েছে?’

‘ওরা সবাই বেঁচে আছে রবিন। তুমি তো বললে যিশু আমাদের বিজয় চাইছেন, আমি বলছি, ঈশ্বর আমাদের কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন। আইয়ুবী বেঁচে আছে, কারণ তীল তার গায়ে লাগেনি। তীর বিঁধেছে তার দু’পায়ের ফাঁকে, মাটিতে।’

‘কোন মেয়ে তীর ছুড়েছিল?’ রবিনের কণ্ঠে ঝাঁঝ। ‘ক্রিস্টোফার কোথায় ছিল?’

‘ও-ই তীল ছুড়েছে। কিন্তু- – – – ‘

‘ক্রিস্টোফারের তীর লাগেনি!’ রবিনের কণ্ঠে বিস্ময়। ‘লক্ষ্য ভেদের জন্য সম্রাট অগাষ্টাস নিজের তরবারি দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করছেন। এখানে এসে ছ’ফুট দীর্ঘ আর তিন ফিট চওড়া সালাহউদ্দীনের গায়ে ও তীর লাগাতে পারল না। তীর ছোড়ার সময় ভয়ে হারামিটার হাত কাঁপছিল নাকি?’

‘দুরত্ব ছিল বেশী। ক্রিস্টোফার বলেছে, তীর ছোঁড়ার সময় বাম চোখে একটা মাছি এসে বসায় লক্ষ্য স্থির থাকেনি।’

‘তারপর কি হল?’

‘যা হবার তাই। সালাহ্উদ্দীনের সাথে ছিল তিনজন সেনাপতি এবং চারজন দেহরক্ষী। ওরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ভাগ্য ভাল, পাহাড়ী এলাকা বলে বেঁচে গেছি। তীর বালির নীচে লুকিয়ে ফেলেছিলাম। সেপাইরা এলে ক্রিস্টোফার বলল, আমরা পাঁচজন মরক্কোর ব্যবসায়ী। এ মেয়েদেকে সাগর থেকে উদ্ধার করেছি। আমাদের মালপত্র তল্লাশী নেয়া হল। ব্যবসায়িক সামানাদি ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না। আমাদেরকে আইয়ুবীর সামনে নেয়া হল। বোঝালাম আমরা সিসিলি ভাষা ছাড়া কিছুই জানি না। দোভাষীর কাজ করল ক্রিস্টোফার।’

মুবি পুরো ঘটনা শোনাল রবিনকে। ব্যবসায়ীরূপী পাঁচ ব্যক্তি এবং এই সাতটি মেয়ে ছিল খৃস্টানদের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুপ্তচর। গোয়েন্দা কাজ ছাড়াও মেয়েদের দায়িত্ব ছিল মুসলিম সেনাপতি, কমাণ্ডার এবং দায়িত্বপূর্ণ লোকদের ফাঁসানো। রবিন এ গ্রুপের কমাণ্ডার।

‘তুমি আইয়ুবীকে রূপের জালে জড়াতে পারো না মুবি?’

‘কেবল তো প্রথম রাত। আমাদেরকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। বুঝতে হবে কোন পথে এগোনো যায়। আমাদের ব্যাপারে সে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে তা যদি তার মনের কথা হয়, তবে বুঝতে হবে, সে মানুষ নয়, পাথর। সে জানে আমরা অসহায়। চাইলেই সে আমাদের পেতে পারে, অথচ একজনকেও সে তার তাবুতে ডাকেনি।’

‘তাকে হত্যা করাও সহজ নয়। সব সময় সে থাকে সেনাপতি আর রক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে। মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে সশস্ত্র প্রহরী।’

‘শুনেছি ওই পাজিটা নাকি মদও স্পর্শ করে না।’

‘তোমাদের সঙ্গী পাঁচজন এখন কোথায়?’

‘ওরা কাছেই আছে। ওদের নিয়ে তুমি ভোবোনা, এরা এখানেই থাকবে।’

‘মুবি, পরাজয় আমাকে পাগল করে দিয়েছে। এর জন্য আমিই দায়ী। সকল সৈনিকই ক্রুশ হাতে নিয়ে শপথ করে। কিন্তু আমার আর তাদের শপথে আসমান জমিন ফারাক। পেছন থেকে আক্রমণ করে আমরা অর্ধেক বিজয় ছিনিয়ে আনি। কিন্তু আমরা কেউ আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি।’

গলায় ঝুলানো ক্রুশ হাতে নিয়ে রবিন বলল, ‘এ ক্রুশ আমার কাছে জবাব চাইছে। একে আমি বুক থেকে সরাতে পারিনা।’

নিজের ক্রুশ ছেড়ে রবিন মুবির জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল। ওর বুকের সাথে সেটে থাকা ক্রুশ বের করে বলল, ‘তুমি তোমার পিতা মাতাকে ধোকা দিতে পার, কিন্তু এ পবিত্র ক্রুশের সাথে প্রতারণা করতে পার না। ঈশ্বর তোমায় ক্লিওপেট্রারচে বেশী রূপ দিয়েছেন। তোমার দেহের মাদকতা, রূপের জৌলুস পাহাড় কেটে তোমার জন্য পথ খুলে দেবে। আমাদের এ অযাচিত সাক্ষাতে মনে হচ্ছে, আমরা পরাজয়ের গ্লানি থেকে বাঁচতে পারবো। আমরা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারলে আমরাই বিজয়ী হব। রোম উপসাগরের ওপারে আমাদের ফৌজ জমা হচ্ছে। যারা মরেছে, মরেছে। বেঁচে আছে যারা তাদের বিশ্বাস, প্রতারণার শিকার হয়ে আমরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি ঠিক, কিন্তু এ আমাদের চুড়ান্ত কোন পরাজয় নয়। নিজের তাবুতে ফিরে যাও। অন্য মেয়েদের বলো, তাবুতে পড়ে ঘুমানো এদের কাজ নয়। বার বার আইয়ুবীর সাথে দেখা করবে। সাক্ষাৎ করবে সেনাপতিদের সাথে। প্রেমের অভিনয় করবে। লোভ দেখাবে দেহের। যৌবনের আগুণ দিয়ে জ্বালিয়ে দেবে ওদের ঈমানের আগুন। আর একবার যদি এতে সফল হতে পার সবকিছু আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে।’

‘সবার আগে আসল ঘটনা জানতে হবে, জানতে হবে কেন এমনটি ঘটল। সুদানীরা কি আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে?’

‘নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছি না। যুদ্ধের আগে আমাদের গোয়েন্দাদের রিপোর্ট ছিল সালাহউদ্দীন আইয়ুবী মিসরের গভর্ণর এবং ফৌজের সর্বাধিনায়ক হয়ে এসেছেন। নতুন ফৌজ গঠন করছেন মিসরীদের দিয়ে। নাজির পঞ্চাশ হাজার সৈন্য সে সাথে যোগ দেয়নি। নাজি আমাদের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠায়। নাজির সে চিঠি আমি নিজে দেখেছি। তার লেখা আমি চিনি, ওটা যে তারই চিঠি ছিল এ ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু কি করে এমনটি ঘটল কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এটা যদি প্রতারণা হয় তবে বলল, ইতিহাসের সবচে জঘন্য প্রতারণা করা হয়েছে আমাদের সাথে।’

‘রবিন, অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে লাভ নেই। সবার আগে আমাদের জানতে হবে এসব কি করে হল? কে করল?’

‘মুবি, মনে করোনা এ রহস্য না জেনেই আমি এখান থেকে যাব। সম্রাট অগাষ্টাস গর্ব করে বলেছিলেন, মুসলমানদের ভেতরের খবর সংগ্রহ করে ওদের নিশ্চিহ্ন করে দেব। ভেবে দেখ মুবি, সম্রাটের হৃদয়ে এখন কি ঝড় বইছে। আমরা যা করেছি তাতে মৃত্যুদণ্ডই আমাদের প্রাপ্য। আমাদের কারণেই ক্রুশের এ বিপর্যয়। আমি ক্রুশের অভিশাপকে ভয় পাচ্ছি।’

‘আমি সব জানি রবিন। আবেগের কথা নয়, এখন কাজের কথা বল। আমাদের এখন কি করতে হবে, কোন পথে এগুবো আমরা তাই বল শুনি।’

পরাজয়ের গ্লানি রবিনের স্নায়ূগুলো বিকল করে দিয়েছিল। মুবির মত সুন্দরী যুবতী তার বুকের সাথে লেপ্টে আছে। তার রেশম কোমল চুল রবিনের গালের অর্ধেকটা ঢেকে রেখেছে। কিন্তু তার অনুভূতি যেন ভোতা হয়ে গেছে।

মুবির চুলে বিলি কেটে রবিন বলল, ‘তোমার এ মায়াময় চুলের শৃংখলে আইয়ুীকে বাঁধতে পার না! মুবি, আমি জানি তুমি একটু চেষ্টা করলেই তোমার ধ্যানভাংগা রূপ আইয়ুবীকে তোমার দাসে পরিণত করবে। তোমার প্রথম কাজ হল, ক্রিস্টোফারকে বলবে ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশেই সে যেন নাজির কাছে পৌঁছে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে। নাজি যদি আইয়ুবীর সাথে মিশে গিয়ে থাকে, আমাদের যুদ্ধের পলিসি পাল্টাতে হবে। আমি বুঝতে পারছি, সংখ্যায় কম হলেও মুসলমানদের সহজে পরাজিত করা যাবে না। আগে ওদের জোশ ও ইসলামী জযবা ধ্বংস করতে হবে। বিজয়ের জন্য এটাই প্রথম শর্ত। আর এ জন্যই আমরা তোমাদের মত রূপসী তরুণীদের দিয়ে আরবের হারেমগুলো ভরিয়ে রেখেছি। তোমরা এতে সফল না হলে আমাদের সাফল্যের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।’

আবার কথা বাড়াচ্ছো? আমরা নিজের ঘরে নয়, শত্রুর তাবুতে বসে কথা বলছি। চারপাশে কড়া প্রহরা। ওদিকে রাতও শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মিশন ধ্বংস হয়ে গেছে। এ পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করতে হবে। এ জন্য এখান থেকেই শুরু করতে হবে কাজ।’

‘হ্যাঁ, সে কাজের কথাই বলছি, সবার আগে আমাদের দরকার নাজির খবর।’

‘সংবাদ সংগ্রহ করে তোমাকে কোথায় পাব?’

‘আমি এখান থেকে পালিয়ে যাব। তাঁর আগে আইয়ুবীর ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও তার সৈন্য সংখ্যা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেব।’

‘আমারও মনে হয় সমগ্র মুসলি বিশ্বে একটা লোকই ক্রুশের জন্য বিপজ্জনক।’

‘তাই, আর এ জন্যই আইয়ুবীকে হত্যা করা জরুরী। আর ও বেঁচে থাকলে থাকবে আমাদের বন্দীশালায়।’

‘কিন্তু কিভাবে?’

‘শোন, প্রথমেই তাবুতে গিয়ে ওদের বলবে, যে করেই হোক আলী বিন  সুফিয়ানকে ফাঁসাতে হবে। আলী এবং আইয়ুবীর মাঝে তুলে দিতে হবে ঘৃণার দেয়াল। এরপর যাবে ক্রিস্টোফারের কাছে। বলবে, লক্ষ্য ভেদ না করে যে পাপ করেছ, দায়িত্ব পালন করে এবার তা মোচন করার চেষ্টা কর।’

‘ঠিক আছে রবিন। দোয়া করো যিশু যেন আমার সহায় হন।’

রবিন মুবির চুলে চুমো খেয়ে বলল, ‘ক্রুশের জন্য তোমাকে তোমার ইজ্জত বিলিয়ে দিতে হবে। তবে মনে রেখ, যিশুর কাছে তুমি থাকবে মা মেরীর মতই পবিত্র কুমারী। ইসলামের মূল উপড়ে ফেলে আমরা জেরুজালেম দখল করেছি, এবার মিসরও আমাদের হবে।’

রবিনের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল মুবি। তাবুর পর্দা ইষৎ ফাঁক করে তাকাল বাইরে। কোথাও কেউ নেই।

নিঃশব্দে বেরিয়ে এল মুবি। তাবুর সাথে সেঁটে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি বুলাল চারদিকে। দূর থেকে কারো গুনগুন শব্দ ভেসে আসছে। সম্ভবতঃ প্রহরী।

হাঁটা দিল মুবি। গাছের আড়ালে আড়ালে গা বাঁচিয়ে পৌঁছল টিলার কাছে। টিলা পার হয়ে চলতে লাগল নিজের তাবুর দিকে। তাবুর কাছাকাছি চলে এসেছে মুবি, দু’জন লোকের অনুচ্চ কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এল। থমকে দাঁড়াল মুবি, উৎকর্ণ হয়ে তাকাল সামনে। শব্দ আসছে তাবুর দিক থেকে।

ও তাবুতে নেই হয়ত ওরা জেনে গেছে, এ জন্য ডেকে এনেছে কমাণ্ডার বা অন্য কাউকে। ধরা পড়লে চলবে না।

ব্যাবসায়ীদের সংগীদের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ও। এতে অন্য মেয়েগুলো বিপদে পড়তে পারে ভেবে দাঁড়াল আবার।

কয়েক পা এগিয়ে গেল লোক দুটোর কথা শোনার জন্য। কিন্তু ও কাছে পৌঁছার আগেই কথা থামিয়ে দিয়েছে ওরা। এখন কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

একপা দু’পা করে হাঁটছে ও, হঠাৎ বায়ে শব্দ হল। চমকে সেদিকে তাকাল মুবি। গাছের একটা ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

ও টিলার কাছে ফিরে এল। উঠে দাঁড়াল টিলার ওপর। সাগর পাড়ের জোৎস্না ধোয়া রাত। এখন ওকে দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে।

ডিউটি পরিবর্তনের সময় হয়ে এসেছে। প্রহরীদের অবস্থা দেখার জন্য বেরিয়ে গেলেন কমাণ্ডার। টিলার ওপর একটা ছায়া দেখতে পেলেন। দাঁড়িয়ে পড়লেন কমাণ্ডার।

ছায়াটা তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। দু’হাত সামনে আসা চুল ঠিক করল। দেহের গঠনে মেয়ে মনে হচ্ছে। কমাণ্ডার অপেক্ষা করছেন।

জ্বীন ভূত হলে অদুশ্য হয়ে যাবে, কিন্তু ছায়াটা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগর। কমাণ্ডার বুঝে ফেললেন, এ জ্বীন নয়, মানুষ। সুলতান আইয়ুবীর সতর্কবাণী তার মনে পড়ল। তাদের বলা হয়েছে খৃস্টানরা গুপ্তচর হিসেবে মেয়েদের ব্যবহার করছে। কখনও বেদুঈন আবার কখনও ভিক্ষুক সেজে ওরা আসবে। নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে আশ্রয় চাইবে। আরও তাকে বলা হয়েছে, সুলতান সন্দেহভাজন সাতজন মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছেন। অপেক্ষা করছেন গোয়েন্দা প্রধান আলীর জন্য। তিনি এলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে।

প্রহরীদের ডিউটি পরিবর্তনের সময় কমাণ্ডার ফখরুল মিসরি তাবুর পর্দা তুলে দেখলেন সাতটা মেয়েই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কম্বল সরালে দেখা যেত সপ্তম মেয়েটা বিছানায় নেই। টিলার ওপরই যে ওই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে কমাণ্ডার তা বুঝতে পারেনি।

মেয়েটা হাঁটা শুরু করতেই কমাণ্ডার টিলার দিকে এগিয়ে গেল। বলল, ‘কে তুমি, নীচে নেমে এস।’

চঞ্চল হরিণীর মত মেয়েটা দ্রুত টিলার অন্যদিকে নেমে গেল।

কমাণ্ডার একলাফে টিলার ওপর উঠে এল। রাতের নীরবতা ভেঙ্গে তীব্রগতিতে ছুটছে মেয়েটা। তাকে ধরার জন্য তার পিছনে ছুটল কমাণ্ডার।

দু’জনের মাঝে বেশ খানিকটা দুরুত্ব। দু’জনেই ছুটছে তীব্র গতিতে। কিন্তু ফখরুল একজন সৈনিক, ছুটছে চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতা নিয়ে। অসমতল মাটি, শুকনো ঝোপঝাড় আর গাছগাছালি মাড়িয়ে নিশুতি রাতে মরুদ্যানের বুকে ছুটছে দু’জন। দূরত্ব কমে আসছে দু’জনের মাঝে। সামনে খণ্ড খণ্ড অনেকগুলো এলোপাথারি ঝোপঝাড়।

মুবি মেয়ে হলেও একজন গোয়োন্দা। শত্রুর চোখে ধুলো দেয়ার হাজারো কায়দা কানুন শিখেছে দীর্ঘদিনের অনুশীলনে। তার সে ট্রেনিং কাজে লাগানোর সময় এসেছে। দ্রুত ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করল মুবি। কমাণ্ডার কিছুদূর এগিয়ে দেখল সামনে কেউ নেই। মেয়েটার পায়ের শব্দও শোনা যাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল সে। গতি কমিয়ে অনির্দিষ্টভাবে এগিয়ে গেল সামনে।

গাছের আড়ালে লুকিয়ে কমাণ্ডারকে এগিয়ে যেতে দেখল মুবি। কমাণ্ডার এগিয়ে যেতেই ও আবার ছুটতে লাগল। হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ শুনে কমাণ্ডারও ছুটল পেছন ফিরে। আবার কোন শব্দ নেই। অনুমান করে ছুটছে কমাণ্ডার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পেছন থেকে আবার ভেসে এল পদশব্দ। ঘুরে দৌড় লাগাল কমাণ্ডার। থেমে গেল পদশব্দ লুকোচুরি খেলার ট্রেনিং ভালই কাজে লাগাচ্ছে মুবি। ‘

এভাবে চলল কিছুক্ষণ। মেয়েটা যেন তার সাথে কানামাছি খেলছে। হারিয়ে যাচ্ছে, আবার দৌঁড়াচ্ছে। ক্রোধে ফুঁসতে লাগল কমাণ্ডার।

ঝোপ ঝাড় আর গাছের ফাঁকে ফাঁকে এভাবে লুকোচুরি খেলতে খেলতে মাইল দুয়েক দূরে চলে এসেছে ওরা। সামনে দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের তাবু।

মেয়েটা তাবুর কাছে পৌঁছে চিৎকার করে ডাকতে লাগল ওদের। আলো জ্বেলে তাবু থেকে বরিয়ে এল ব্যবসায়ীরা।

তরবারী হাতে কমাণ্ডারও পৌছে গেল ওখানে। ব্যবসায়ীদেরকে মুসলমান মনে হচ্ছে। মেয়েটা তাদের একজনের পা জড়িয়ে ধরে আছে। আতংকে বিবর্ণ চেহারা, হাফাচ্ছে।

‘এ মেয়েটাকে আমার হাতে তুলে দাও।’ নির্দেশের ভংগীতে বলল কমাণ্ডার।

‘ও একা নয়,’ বলল এক ব্যবসায়ী, ‘আমরা সাতজনকেই তোমাদের সুলতানের কাছে দিয়ে এসেছি, একেও নিয়ে যেতে পার।’

‘না।’ আরও জোরে লোকটার পা আকড়ে ধরল মুবি। বলল ‘আমি ওর সাথে যাব না। মুসলমানরা খ্রীস্টানের চাইতেও জানোয়ার। ওদের সুলতান একটা ষাঁড়, একটা পশু। সে আমার হাড়গোড় পর্যন্ত ভেঙে দিয়েছে। আমি কোন রকমে পালিয়ে এসেছি।

‘কোন সুলতান?’ কমাণ্ডারের হতবাক কণ্ঠ।

‘যাকে তোমরা সালাহউদ্দীন আইয়ুবী বল।’

‘মেয়েটা মিথ্যে বলছে। কে ও? তোমাদের সাথে এর সম্পর্ক কি?’

‘ভেতরে এস বন্ধু। বাইরে ঠাণ্ডা, তারাবারী খাপে ঢুকাও। কোন ভয় নেই, আমরা ব্যবসায়ী। মেয়েটা কি বলতে চায় শোনই না। আমরা তোমাদের সুলতানকে ভাল মানুষ ভেবেছিলাম। কিস্তু সুন্দরী যুবতীদের দেখে তিনিও ঈমান আমান খুইয়ে বসেছেন!

অন্য ছ’টি মেয়ের কি অবস্থা করেছে কে জানে!’

‘অন্য সেনাপতি এবং কমাণ্ডাররা এদের শেষ করে দিয়েছে।’ মুবি বলল, ‘এদেরকে সন্ধ্যার সময় নিয়ে গেছে, দিয়ে গেছে খানিক আগে। এখন ওরা তাবুতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।’

কমাণ্ডার তরবারী কোষবদ্ধ করে তাবুতে প্রবেশ করল। কফি তৈরী করতে লাগল এক ব্যবসায়ী। কমাণ্ডারের অলক্ষ্যে কি যেন মেশাল তাতে। অন্য একজন জানতে চাইল তার পদমর্যাদা।

আলাপচারিতায় ব্যবসায়ীরা বুঝল লোকটা সেনাবাহিনীর উঁচু পর্যায়ের কেউ নয়, একজন সাধারণ গ্রুপ লিডার মাত্র। তবে লোকটা মেধাবী এবং সাহসী।

ওরা মেয়েদের ব্যাপারে সুলতানকে বলা গল্পটাই কমাণ্ডারকে পুনরায় শোনাল। জানাল এদের ব্যাপারে সুলতানের সিদ্ধান্ত। যোগ্য বর পেলে এরা মুসলামন হবে, দেশে ফিরবে না কখনো, তাও কমাণ্ডারকে বলা হল।

অন্য একজন বলল, ‘এ মেয়েটার সাথে তোমাদের প্রিয় সুলতান কি কাণ্ড ঘটিয়েছে তাতো ওর মুখেই শুনলে।’

কমাণ্ডার মেয়েটার দিকে তাকাল।

মুবি বলতে লাগল, ‘একজন দেবদুতের আশ্রয় পেয়েছি মনে করে আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না। সুর্য ডোবার সাথে সাথে সুলতানের নাম করে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। অন্যদের তুলনায় আমি একটু বেশী সুন্দরী। বুঝতে পারিনি তোমাদের আইয়ুবী আমাকে খারাপ উদ্দেশ্যে ডাকছে। আমি গেলাম। সুলতান মদের সোরাহী খুলে বসল। গ্লাস ভরে রাখল আমার সামনে। আমি খৃস্টান, মদপানে অভ্যস্ত।

আইয়ুবী আমাকে ভোগ করতে চাইল। পুরুষ নতুন নয় আমার জন্য। আমি যাকে দেবদূত মনে করি এ অপবিত্র দেহ থেকে তাকে দূরে রাখতে চাইলাম। কিন্তু সে জাহাজের খৃস্টানদের চাইতেও নিকৃষ্ট। দেহের প্রতিটি জোড়া ব্যথা করছে। হাড়গুলো মনে হয় ভেংগেই ফেলেছে।’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সে।

একটু পর আবার শুরু করল, ‘ঈশ্বর আমায় রক্ষা করেছেন। নিষ্কৃতি দিয়েছেন দেবদুতরূপী পশুর হাত থেকে। সুলতান আমাকে বলেছে, অন্যান্য কমাণ্ডাররা বাকী মেয়েদের নিয়ে আনন্দ করছে। আমি সুলতানের পা ধরে মিনতি করলাম বিয়ে করার জন্য। সুলতান বলল, ‘বিয়ে ছাড়াই তুমি আমার হারেমে থাকবে।’

অত্যাধিক মদপান করায় সুলতান বেহুশ হয়ে পড়ল। এ সুযোগে আমি পালিয়ে এসেছি। বিশ্বাস না হলে তার দেহরক্ষীদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পার।’

মুবির কথার মাঝেই কফি পরিবেশন করা হল। কফির মধ্যে হাশিশ মেশানো ছিল জানতো না কমাণ্ডার। কফি পান করল কমাণ্ডার, হাশিশের ক্রিয়া শরু হল  মগজে। মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে অট্টহাসি দিয়ে বলল, ‘আমাদের জন্য নির্দেশ, মদ এবং নারী থেকে দূরে থাক। নিজে মেয়ে মানুষ নিয়ে ফুর্তি করছে আর মদ পান করছে, হা, হা, হা। ‘

হাশিশের প্রভাবে ও বুঝতেই পারল না মেয়েটা নির্জলা মিথ্যে বলেছে তার সাথে। কল্পনায় এখন সে নিজেই সম্রাট। মুবির চেহারায় মশালের আলো। চুলে কাল আর সোনালী রঙের মিশেল। যৌবন উপচে পড়ছে অপরূপা অঙ্গ থেকে। চোখে নেশা ধরানো দীপ্তি। কমাণ্ডারের মনে হল, পৃথীবির সবচে রূপবতী নারীটি বসে আছে তার সামনে।

সে চঞ্চল হয়ে বলল, ‘তুমি চাইলে আমি তোমাকে আশ্রয় দিতে পারি।’

‘না?’ ভয়ে পেছনে সরে গেল মুবি। ‘তুমিও আমার সাথে সুলতানের মতই আচরণ করবে। তোমার তাবুতে নিয়ে গেলে আবার আমি আইয়ুবীর হাতে গিয়ে পড়ব।

‘ইজ্জত রক্ষার জন্য ওদেরকে তোমাদের হাতে দেয়া ভুল হয়ে গেছে। ভাবছি অন্য মেয়েদেরকেও কালই গিয়ে ফেরত নিয়ে আসব। বলল এক ব্যবসায়ী।

মুবির দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়েছিল ফখরুল মিসরী। তার দেহলতা ও শরীরের প্রতিটি অঙ্গ থেকে উপচে পড়ছে যৌবন। এমন অপরূপা অঙ্গশোভার অধিকারী সুন্দরী নারী সে জীবনেও দেখেনি।

ব্যবসায়ীর কথা পিঠে কেউ কোন কথা বলল না। তাবুতে নেমে এল নীরবতা। চুপচাপ কেটে গেল কিছু সময়।

নীরবতা ভাঙল ক্রিস্টোফার। বলল, ‘তুমি আরবী না মিসরী?’

‘মিসরী। আমি সাধারণ একজন সৈনিক হিসাবে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলাম। যুদ্ধে বীবরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় আমাকে কমাণ্ডার পদে প্রমোশন দেয়া হয়েছে।

‘সুদানী ফৌজকে দেখছি না, ওরা কি এ যুদ্ধে অংশ নেয়নি?’

‘সুদানী ফৌজকে দেখছি না, ওরা কি এ যুদ্ধে অংশ নেয়নি?’

‘সুদানী কোন ফৌজ এখানে আসেনি, এ যুদ্ধে অংশ নেয়নি ওরা।

‘কি ব্যাপার, যুদ্ধে ওরা অংশ নিল না কেন?’

‘মনে হয় সুদানীরা সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে গ্রহণ করেননি।’ জবাব দিল আরেক ব্যবসায়ী।

‘হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। সুদানীরা সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে গ্রহণ করেনি। তাদের কমাণ্ডার সুলতানকে মিসর ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। কারণ তিনি মিসরের নন, বিদেশী। এ জন্য আইয়ুবী মিসরীয়দের দিয়ে নতুন ফৌজ গঠন করেছেন। ওরাই এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে।

গল্প জমে উঠেছে। যেন খোশগল্প করছে সবাই এভাবেই একজন জানতে চাইল, ‘যুদ্ধে তো তোমরা জিতেছ, গনিমতের মাল কি কি পেলে?’

‘গনিমতের মাল কি আর গরীবের ভাগ্যে জোটে!’ টিপ্পনি কাটল অন্যজন।

‘গনিমতের মালের খবর জানিনা, এখনো ভাগবণ্টন হয়নি বোধ হয়।’ বলল কমাণ্ডার।

‘তা জানবে কেমন করে? তোমাদের সুলতান তোমাদেরকে মদ ও নারী থেকে দূরে থাকতে উপদেশ দেন, অথচ নিজে ভোগ বিলাসে মত্ত থাকেন। যুদ্ধলব্ধ সম্পদের খবর তোমরা যারা যুদ্ধ করেছ তারা জাননা, অথচ ব্যবসায়ী হিসাবে আমরা জানি, খৃস্টান জাহাজ থেকে অঢেল সম্পদ পাওয়া গেছে। অসংখ্য উট বোঝাই করে এসব মাল কায়রো পাঠানো হয়েছে রাতের অন্ধকারে। কায়রো থেকে সে সব চলে যাবে দামেশক এবং বাগদাদ। সুদানী ফৌজকে সুলতান দাসে পরিণত করতে চাইছেন। আরবের সৈন্য এসে গেলে তোমরাও হবে তাদের মতই গোলাম।’

মুবির চোখ ধাঁধানো রূপ আর হাশিশের প্রবাবে ফখরুলের হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছিল ওদর প্রতিটি শব্দ। অযাচিত ভাবেই পরিস্থিতি মুবির পক্ষে চলে গেছে। তাকে ধরতে এসে নিজেই ফেঁসে গেছে কমাণ্ডার।

আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানত না কমাণ্ডা। মুবি নিজের ভাষায় সব ঘটনা বলতে লাগল সংগীদের। ওদের শোনাল রবিনের নির্দেশ। বলল, ‘পরাজয়ের কারণ বের করতে হবে। যেতে হবে নাজির কাছে।’

মেয়েটা কি বলছে জানতে চাইল ফখরুল। ক্রিস্টোফার বলল, ‘ও বলছিল, তুমি আইয়ুবীর সৈন্য না হলে ও তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হতো। এ জন্য ও মুসলমান হতেও প্রস্তুত। কিন্তু এখন সে কোন মুসলমানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

কমাণ্ডার কি ভেবে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। মুবির হাত ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করে বলল, ‘খোদার শপথ তোমার জন্য আমি সিংহাসন ত্যাগ করি এই যদি হয় তোমার ইচ্ছে, এই রইল তরবারী! এখন থেকে তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা।’

কমাণ্ডার খাপ সহ তার তরবারী রেখে দিল মুবির পায়ের কাছে। ‘এখন আমি আইয়ুবীর সৈনিক নই, কমাণ্ডারও নই।’

মুবি হাত ধরে টেনে ওকে পাশে বসাল। নিজেও ঘনিষ্ট হয়ে বলল তার পাশে। বলল, ‘তুমি যদি সত্যি আমাকে চাও তোমার জন্য আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করবো। তবে আমাকে পেতে হলে তোমাকে একটা শর্ত পালন করতে হবে, যে পাষণ্ড পশু আমার ওপর আজ এ বর্বর আচরণ করেছে, তার প্রতিশোধ নিতে হবে তোমাকে।’

‘খোদার কসম, সুলতান আমার হাত থেকে কিছুতেই রক্ষা পাবে না। একে আমি খুন করবো।’

মুবি ব্যবসায়ীদের দিকে তাকাল। ক্রিস্টোফার বলল, ‘এক আইয়ুবী মরলে বা বাঁচলে কিছু যায় আসে না। যে আসবে সেও এমন হবে। আজ হোক, কাল হোক মিসরীরা ওদের দাসই হবে। তুমি বরং নাজির কাছে যাও। মুবি থাকবে তোমার সংগে। তোমরা দু’জন সালাহউদ্দীনের আসল রূপ তার কাছে প্রকাশ করে তার সাহায্য চাইতে পার। এ ছাড়া  এর বদলা নেয়ার কোন রাস্তা দেখি না আমি।’

নাজি এবং তার সংগীদের যে গোপনে হত্যা করা হয়েছিল এ কথা জানতো না এরা। মুবি চাচ্ছিল দ্রুত নাজির কাছে পৌঁছতে, কিন্তু এক যুবতীর পক্ষে একা মিসর পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব ছিল না। অপ্রত্যাশিত ভাবে ফখরুলকে পাওয়ায় তার বরং সুবিধাই হল। ওরা সিদ্ধান্ত নিল, মিসর যাওয়ার পথে ওকেই ব্যবহার করা হবে।

খৃষ্টান গোয়োন্দা দলে প্রধান রবিন রয়েছে আহতদের তাবুতে। ব্যবসায়ীরাও সিদ্ধান্ত নিল এখানেই থাকবে। আইয়ুবীকে ছোঁড়া তীর একবার ফসকে গেছে, আবার চেষ্টা করবে ওরা।

মুবির রূপের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে ফখরুল। হাশিশ তাকে বিবেকশূন্য করে দিয়েছে। ফখরুল আর নিজের তাবুতে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

মুবিকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ার জন্য তাকে পরামর্শ দিল ক্রিস্টোফার। ব্যবসায়ীরা একটা উট দিল তাকে। উটের সাথে দেয়া হল পানির মশক ও প্রয়োজনীয় খাবার। হাশিশ মেশানো খাবারের থলিটা ধরিয়ে দিল মুবির হাতে। ফখরুল পরল ঢাউস জুব্বা ও ব্যবসায়ীদের মত টুপি। উটের পিঠে চাপল মুবি ও কমাণ্ডার।

উট চলতে শুরু করেছে, আশপাশের কোন খেয়াল নেই কমাণ্ডারের। সমস্ত অতীত তার হারিয়ে গেছে। হৃদয়ের কার্নিশে এখন শুধু ঝুলে আছে বিশ্বের সেরা এক সুন্দরীর ছবি। সুলতানকে বাদ দিয়ে যে রূপসী তাকে পছন্দ করেছে। কি সৌভাগ্য তার, মুবিকে বাহুবেষ্টন করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল ও।

‘খৃস্টান কমাণ্ডার আর তোমাদের সুলতানের মত পশুর আচরণতো করবে না?’ কপট কটাক্ষ হেনে বলল মুবি।

‘মুবি, আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি সে কথা কি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।’

‘না ফখরুল, এ তো আমি রহস্য করে বলেছি। তোমার ভালবাসার ওপর আমার আস্থা না থাকলে কি তোমার সাথে এভাবে একাকী বেরিয়ে পড়তাম? এ দেহ-মন আমি তোমাকেই সঁপেছি। এখন থেকে আমি শুধুই তোমার। আমাকে নিয়ে তোমার যা ইচ্ছে করতে পার। তবে আইয়ুবীর পশুত্ব ভুলতে পারছি না বলেই ওভাবে বলেছি তোমায়। ধৈর্যহীনদের আমি ঘৃণা করি, যেমন ঘৃণা করি তোমাদের সুলতানকে।’

‘তার মানে তুমি আমাকে ধৈর্যহীন বলতে চাইছো? দেখ মুবি, তুমি চাইলে আমি উট থেকে নেমে যাব।’ মুবিকে বাহুবন্ধন থেকে ছেড়ে দিল ফখরুল।

‘ছি! কি বলছো তুমি? তোমাকে আমার ভাল লেগেছে বলেই তো তোমার জন্য আমার ধর্ম পর্যন্ত ত্যাগ করেছি। ইচ্ছে করলে আমি ব্যবসায়ীদের কাছেও তো থাকতে পারতাম।

মুবির আগেবপূর্ণ কথায় আরো দুর্বল হয়ে পড়ল কমাণ্ডার। গল্পে গল্পে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে ওরা।

সাধারণভাবে চললে ওদের পাঁচদিনের পথ অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু ফখরুল এক পালিয়ে আসা সৈনিক। মুবিও পালিয়ে এসেছে মুসলিম তাবু থেকে। তাই সাধারণ পথ ছেড়ে দুর্গম পথে এগিয়ে চলল ওরা।

গভীর হয়ে এল রাত। ঘুমে ভারী হয়ে এল মুবির চোখ। ফখরুলের বুকে মাথা রেখে ও ঘুমিয়ে পড়ল। আকাশের অগণিত তারার রাথে জেগে রইল এক পলাতক সৈনিক। উট এগিয়ে চলছে মিসরের দিকে।

সবেমাত্র ফজরের নামাজ শেষ করেছেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী, প্রহরী তাবুতে প্রবেশ করে জানাল, ‘আলী বিন সুফিয়ান এসেছেন।’

তাবু থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলেন সালাহউদ্দীন। আলীর সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও দিকের কি খবর?’

‘এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক। তবে ওদের উৎকণ্ঠা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের গোয়েন্দারা বলেছে, নেতৃত্ব দেয়ার মত কোন কমাণ্ডার এগিয়ে এলে ওরা বিদ্রোহ করবে।’

কথা বলতে বলতে দু’জন তাবুতে প্রবেশ করলেন। ‘নাজি এবং তার সংগীদের আমরা শেষ করেছি, কিন্তু সুদানীদের ভেতর মিসরীয়দের বিরুদ্ধে যে বিষ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তার প্রভাব এখনও কমেনি। সেনাপতির অন্তর্ধান তাদের উৎকণ্ঠার বড় কারণ। আমাদের গোয়োন্দারা প্রচার করেছে যে, নাজি যুদ্ধের ময়দানে। আমার মনে হয় ওরা একথা বিশ্বাস করছে না।’

‘ওরা বিদ্রোহ করলে আমাদের ওখানকার ফৌজ কি অভিজ্ঞ পঞ্চাশ হাজার ফৌজের মোকাবিলা করতে পারবে?’

‘আমি তার ব্যবস্থা করে এসেছি। সব জানিয়ে দু’জন ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে দিয়েছি নুরুদ্দীন জংগীর কাছে। বিদ্রোহ দমন করার জন্য কিছু সাহায্য পাঠাতে অনুরোধ করেছি তাকে।’

‘ওদিক থেকে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা কম। গত পরশু দূত মারফত জেনেছি, জংগী সম্রাট ফ্রাংকুর এলাকা আক্রমণ করেছেন। খৃস্টানদের বিশাল এক বাহিনী মিসরের দিকে আসছিল। আক্রান্ত হয়ে পিছনে সরে গেছে ওরা। জংগী কিছু এলাকাও দখল করেছেন। কিন্তু একটা সংবাদে আমি দারুণ উদ্বিগ্ন।’

‘ওরা আবার হামলা করেছে?’

‘ওদের আক্রমণে আমি ভীত নই। আমার উদ্বেগের কারণ হল, শত্রুকে যারা বাঁধা দেবে তারা মদের পিয়ালায় আকণ্ঠ ডুবে আছে। ইসলামের রক্ষকরা হারেমে বন্দী। যুবতী নারীর মোহনীয় চুল ওদের পায়ে শৃংখল পরিয়ে রেখেছে।

হায়, আমার চাচা শেরে কোহ আজ যদি বেঁচে থাকতেন! তিনিই আমাকে যুদ্ধের ময়দানে এনেছিলেন। সামান্য সৈন্য নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শত্রুর ওপর। কিন্তু মুসলিম নামধারী বেঈমানের দল শত্রুর সাথে মিশে গিয়েছিল। তার সামনে তৈরী করেছিল দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর। তবু চাচা সাহস হারাননি। তুমিতো তার সব ইতিহাস জান।’

‘আমার সব কিছু মনে আছে সুলতান। সে সব যুদ্ধ এবং রক্তঝরার পর আশা করেছিলাম মিসর এবার সোজা পথে আসবে। কিন্তু এক গাদ্দারের মৃত্যু হলে এগিয়ে আসে অন্য গাদ্দার। আসলে গাদ্দার দুর্বল খেলাফতের সৃষ্টি, ফাতেমী খেলাফত হারেমের বিলাসে হারিয়ে না গেলে খৃস্টানদের সাথে আপনার যুদ্ধ এখানে নয়, ইউরোপে হত। আমাদের বন্ধুরাই আমাদেরকে বাইরে যেতে দিচ্ছে না। শাসক যখন ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে প্রজারা তখন সিংহাসের স্বপ্ন দেখে, সাহায্য চায় শত্রুর কাছে। ক্ষমতার লোভে তাদের স্ত্রী কন্যার ইজ্জত আব্রুর কথাও ভুলিয়ে দেয়।’

‘এদের আমি ভীষণ ভয় করি আলী। ইসলাম নিশ্চিহ্ন হলে এসব নামধারী মুসলমানের হাতেই হবে। আমাদের ইতিহাস এখন বিশ্বাসঘাতকের ইতিহাস, ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। আমার মন বলছে, এমন এক সময় আসবে যখন মানুষ নামে থাকবে মুসলমান, কিন্তু চিন্তা করবে শত্রুর মস্তিষ্ক দিয়ে। মসজিদের চেয়ে পতিতালয় বেশী থাকবে, অথবা ওদের ঘরগুলোই হয়ে উঠবে একেকটা পতিতালয়।

অমুসলিমরা মুসলমানকে সে পথেই নিয়ে এসেছে। মিসরে দেখা যাচ্ছে ঝড়ের পূর্বভাস। তোমার সংস্থাকে আরও শক্তিশালী কর, শত্রুর এলাকায় গিয়ে কমাণ্ডা হামলা এবং সংবাদ সংগ্রহের জন্য সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং বুদ্ধিমান যুবকদের বাছাই কর। গুপ্তচর বৃত্তির ময়দানে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হও আলী।’

‘আপনি দোয়া করুন, নতুন করে যে সব যুকব ভর্তি হচ্ছে তাদের মধ্যে আমি প্রাণের স্পন্দন দেখতে পাচ্ছি। তাদের নিষ্ঠা ও আগ্রহ আমাকে আশাবাদী করে তুলছে। এখানকার খবর কি?’

বেলাভূমিতে কুড়িয়ে পাওয়া বন্দীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তুমি ওদের সাথে একাবর দেখা করো।

প্রহরীকে ডাকলেন আইয়ুবী। বললেন, ‘আমাদের নাস্তা দাও।’

নাস্তা নিয়ে এল প্রহরী। খেতে খেতে কথা বলছিলেন আইয়ুবী, ‘গতকাল আরো কিছু আহত খৃষ্টান সৈনিককে এখানে আনা হয়েছে। এদের একজনকে আমার সন্দেহ হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে সাধারণ সৈনিক নয়। এছাড়া ঘটনাচক্রে একদল মেয়েকেও এখানে আশ্রয় দিতে হয়েছে। ওদের নিয়ে এসেছে পাঁচজন ব্যবসায়ী। এদের সাথেও একটু দেখা করো।

‘মেয়েরা এখানে কিভাবে এল?’

মেয়েদের ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা যা বলেছিল সুলতান আলীকে তা শোনালেন। বললেন, ‘আসলে ওদের আশ্রয় দিয়ে আমার আওতায় নিয়ে এলাম। ওরা গরবী, দীর্ঘদিন জাহাজে ছিল। কিন্তু দেখে তা মনে হয়না। ওদের আলাদা তাবুতে রাখা হয়েছে। তুমি নাস্তা সেরে আগে ওদের সাথেই দেখা করো।

এরপর মৃদু হেসে বললেন, ‘কাল উপকূলে হাঁটছিলাম। হঠাৎ কোত্থেকে একটা তীর এসে দু’পায়ের ফাঁকে বালিতে গেঁথে গেল। রক্ষীরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে, কোন তীরন্দাজ পায়নি। ওরা ওই এলাকা থেকে পাঁচজন ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে এসেছিল। ওরাই মেয়েগুলোকে এখানে রেখে গেছে।’

ওদের চলে যেতে দেয়া হয়েছে শুনে অবাক বিস্ময়ে সুলতানের দিকে তাকিয়ে রইলেন আলী।

‘আপনি তাদের যেতে দিলেন! রক্ষীরা ওদের মালপত্তর তল্লাশী নিয়েছে? সন্দেহ করা যায় এমন কিছু পাওয়া যায়নি ওদের কাছে?’

গভীর মনোযোগ দিয়ে তীরটা দেখলেন আলী। বললেন, ‘এক গোয়োন্দার দৃষ্টি আর সুলতানের দৃষ্টিতে অনেক পার্থক্য। সবার আগে ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করার চেষ্টা করব।’

তাবু থেকে বেরিয়ে এলেন আলী বিন সুফিয়ান। একজন প্রহরী সালাম দিয়ে বলল, ‘আপনার সাথে একজন কমাণ্ডার কথা বলতে চাচ্ছেন।’

‘কি ব্যাপার?’

কমাণ্ডার এগিয়ে এসে বলল, ‘কালকে সাতজন মেয়ের মধ্যে একজন পালিয়ে গেছে। এ ছাড়া কাল রাতের ডিউটি কমাণ্ডার ফখরুল মিসরীকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রহরী বলছে, ডিউটি বদলের সময় তিনি তা চেক করতে বেরিয়ে ছিলেন। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। সুলতানকে এ খবরটি দেয়া জরুরী।’

গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন আলী বিন সুফিয়ান। কমাণ্ডার তার কাছে এসে অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘একটা খৃস্টান মেয়ে চলে যাওয়ার ঘটনা কি খুব গুরত্বপূর্ণ?’

খানিকটা ভেবে নিয়ে আলী বললেন, ‘শোন, সুলতানকে এখন কিছু বলার দরকার নেই। ফখরুল যখন টহল দিতে বেরিয়েছিলেন তখনকার সব প্রহরীদের ডেকে নিয়ে এস। কাল যেসব রক্ষী সুলতানের সাথে সাগর পারে গিয়েছিলেন তাদেরও ডাকবে।’

খবর পেয়ে চারজন প্রহরী এসে হাজির হল। আলী বললেন, ‘কাল যেখানে ব্যবসায়ী এবং মেয়েদের পেয়েছ সেখানে যাও। ব্যবসায়ীরা না গিয়ে থাকলে আমার না আসা পর্যন্ত যেতে দেবে না। না পেলে জলদি ফিরে এস।’

রক্ষীরা চলে গেল। মেয়েদের তাবুর কাছে পৌঁছলেন আলী। তাবুর বাইরে বসে আছে মেয়েরা। পাশে দাঁড়িয়ে আছে পাহারাদার। আলী মেয়েদের মুখোমুখি হয়ে আরবীতে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা এখানে ছ’জন কেন, আরেকজন কোথায়?’

ওরা পরস্পরের দিকে চাইতে লাগল। আলীর দিকে তাকিয়ে মাথা এপাশ ওপাশ করে বোঝালো তারা আরবী জানেনা।

‘তোমরা সবাই আমার ভাষা বোঝ।’

ওরা হতবাক দৃষ্টিতে আলীর দিকে তাকিয়ে রইল। ওদের সহজ সরল চেহারা দেখে দ্বিধায় পড়লেন গোয়েন্দা প্রধান। এরপর মেয়েদের পেছেনে গিয়ে আরবী ভাষায় বললে, ‘এদের উলংগ করে বারজন কাফ্রী সেপাই ডেকে নিয়ে এস।’

ওরা সবাই এক সঙ্গে পেছনে ফিরল। আতংকিত কণ্ঠে দু’তিনজন একসঙ্গে বলে উঠল, ‘মেয়েদের সাথে তোমরা এমন ব্যবহার করতে পারনা। আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি।’

হেসে ফেললেন আলী বিন সুফিয়ান। ‘তোমাদের সাথে খুব ভাল ব্যবহার করব। এক ধমকেই আরবী বলতে শুরু করেছ। এবার ধমক ছাড়াই বল সপ্তম মেয়েটা কোথায়?’

ওরা অজ্ঞতা প্রকাশ করলে আলী বললেন, ‘এ প্রশ্নের জবাব অবশ্যই তোমরা দেবে। একটু আগেও তোমরা বলেছ আরবী জানোনা, এখনতো দিব্বি আরবীতে কথা বলতে পারছ। ঠিক আছে, প্রশ্নের জবাব কি করে পাওয়া যায় আমি দেখছি। সেন্ট্রি, ওদের তাবুর ভিতরে নিয়ে যাও।

রাতের প্রহরী এল। ওদের অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন গোয়েন্দা প্রধান। মেয়েদের তাবুর প্রহরী বলল, ‘আমাকে দাঁড় করিয়ে তিনি বন্দীদের তাবুর দিকে গেলেন। কিছুক্ষণ পর একটা শব্দ শুনলাম, ‘কে তুমি, নেমে এস।’ মনে হল টিলার ওপর একটা ছায়াও দেখেছি। তবে খুবই অস্পষ্ট।

টিলার কাছে গেলেন গোয়েন্দা প্রধান। বালিতে পায়ের ছাপ সুস্পষ্ট। একটা সৈনিক বুটের ছাপ, অন্যটা মেয়েলী জুতো। মেয়েলী জুতার চিহ্ন ধরে আহত বন্দীদের তাবু পর্যন্ত চলে এলেন আলী। তাবুর পর্দা তুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। শুয়ে আছে পাঁচজন, একজন বসা। আলীকে দেখেই সে শুয়ে কাৎরাতে লাগল। আলী তার কাঁধ খামচে ধরে বাইরে নিয়ে এলেন।

‘রাতে একটা মেয়ে তোমার কাছে এসেছিল কেন?’

রবিন হাবার মত তাকিয়ে রইল। যেন এসব কথা সেকিছুই বুঝতে পারছে না। আলী তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমি তোমার ভাষা বুঝি। কিন্তু তোমাকে আমার ভাষাতেই কথা বলতে হবে।

রবিন তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ‘ওকে এখানে বসিয়ে রাখ।’ প্রহরীকে বলে আবার তাবুর ভেতরে ঢুকলেন আলী। বন্দীদের বললেন, ‘কাল রাতে মেয়েটা কতক্ষণ এখানে ছিল? নিজেদের যন্ত্রণার মধ্যে ফেলো না, জলদি জবাব দাও ও কার কাছে এসেছিল?

সাগরের উত্তাল তরঙ্গের সাথে লড়াই করে ওরা বেঁচে আছে। দেখেছে মৃত্যুর বিভীর্ষিকা। অথচ গোয়েন্দা প্রধানের একা কড়া ধমক খেতেই একজন বলে উঠল, ‘ও এসেছিল রবিনের কাছে। শুয়েছিল কি বসেছিল অন্ধকারে দেখা যায়নি। কি বলেছে তাও শুনিনি। মেয়েটা যে কে তাও জানিনা। রবিনের পদমর্যাদা সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ, আমরা শুধু তার নাম শুনেছি। এখানে আসরা আগমুহূর্ত পর্যন্ত সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল ও। আমরা সাবই সাধারণ সৈনিক। আমাদের ওপর রহম করুন।’

ওদের ওপর করা দৃষ্টি রাখতে বললেন প্রহরীদের। ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছলেন তিনি। রক্ষীরা ওদের তাবুর সানে বসিয়ে রেখেছে। রক্ষীরা বলল, ‘কাল দু’টো উট দেখেছি, আজ একটা নেই।’

গোয়েন্দা প্রধানের জন্য এটা একটা মূল্যবান সংবাদ। ওদর জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু সন্তোষজনক জবাব দিতে পারল না ওরা। উটের পায়ের চিহ্ন পাওয়া গেল। আলী বললেন, ‘তোমরা সাধারণ চুরির অপরাধে অপরাধী নও। তোমরা একটা দেশ এবং একটা জাতির জন্য বিপজ্জনক। ক্ষমা তোমাদের করা যায় না। তোমরা কি ব্যবসায়ী?’

‘হ্যাঁ।’ সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল। ‘আমরা ব্যবসায়ী, আমরা নিরপরাধ।’

সবাই হাতের উল্টাো পিঠ দেখাও।’

হাত উল্টে এগিয়ে ধরল ওরা। বাঁ হাতের তর্জনী এবং মধ্যমার মাঝখানটা দেখলেন আলী। একজনের হাতের কব্জি ধরে বললেন, ‘তীর কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?’

ওরা না জানার ভান করল। সুলতানের এক দেহরক্ষীকে ডাকলেন আলী। উল্টো করলেন তার হাত। বললেন, ‘এ লোকটি আমাদের তীরন্দাজ। ওর দু আঙ্গুলের ফাঁকে তীরের ঘর্ষণের চিহ্ন রয়েছে। ধনুকে তীর জুড়ে নিক্ষেপের সময় তর্জনী এবং মধ্যমার ফাঁক দিয়ে তীর ছুটে যায়। তীরন্দাজ ছাড়া অন্য কারো এ চিহ্ন থাকেনা। পাঁচজনের মধ্যে কেবল তোমার আঙ্গুলে এই চিহ্ন রয়েছে। এবার বল তীর কোথায়?’

পাঁচজনই নীরব। ওদের একজনকে ধরে রক্ষীকে বললনে, ‘একে ওই গাছের সাথে বেঁধে দাও।’

তারপর অন্য এক রক্ষীকে ডেকে কানে কানে কিছু বললেন। রক্ষী লোকটাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল। বিঁধল ডান চোখে। তড়াপাতে লাগল লোকটা।

‘ক্রুশের জন্য এভাবে আর কে জীবন দিতে পার? একে দেখ, তড়পাচ্ছে। রক্ত ঝরছে চোখ থেকে। কথা দিচ্ছি, তোমাদের সসম্মানে সাগরের ওপারে পাঠিয়ে দেব।  বল দ্বিতীয় উট কে নিয়ে গেছে? কোথায় গেছে?

তোমাদের এক কমাণ্ডার আমাদের একটি উট ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।

‘সাথে একটি মেয়েও।’ আলীর কণ্ঠে বিদ্রুপ।

শেষতক স্বীকার করল ওরা। শোনাল সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী সম্পর্কে মেয়েটার বলা মিথ্যা কাহিনী। কিন্তু তাবু থেকে পালিয়ে আসাটা চেপে গের।

আলীর ঠোটে শ্লেষের হাসি।

‘আশ্চর্য! একজন মাত্র লোক তোমাদের মত পাঁচজন সৈনিকের কাছ থেকে একটা উট এবং একটা মেয়ে ছিনিয়ে নিয়ে গেল?

তীর ধনুক বের করা হল বালির নীচ থেকে। তড়পাতে তড়পাতে মরে গেল তীর খাওয়া লোকটা।

দশজন অশ্বারোহী ডেকে দ্রুত উটের পায়ের চিহ্ন ধরে এগিয়ে যেতে বললেন গোয়েেন্দা প্রধান। ওদের যাবার পনের ঘন্টা পর তাদের পিছু ধাওয়া করে ছুটল আলীর বাহিনী।

খাওয়া এবং বিশ্রাম ছাড়া উট একনাগাড়ে ছ’সাত ঘন্টা চলতে পারে। ধরা পড়ার ভয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল ফখরুল। মরুর জাহাস উটও তার সহযোগিতা করছিল।

পথে দুজায়গায় উট বসার চিহ্ন পাওয়া গেল। পাশে খেজুরের বীচি, ফলের খোসা। আরো কিছুটা এগিয়ে আলী খাবার রাখার দু’টো থলে কুড়িয়ে পেলেন। একটা খালি, অন্যটাতে তখনও বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্য অবশিষ্ট ছিল। খাবারগুলো নাকের কাছে নিতেই পরিচিত একটা গন্ধ নাকে লাগর। আলী বললেন, ‘এ খাবারে হাশিশ মেশানো।’

থলে দু’টো নিয়ে আবার চলতে লাগল কাফেলা। বিচক্ষণ আরী সময় নষ্ট না করে কাফেলাকে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে চললেন।

ফখরুল মিসরী এবং মুবি ধরা পড়লেও কিছু যায় আসে না। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সুদানী সেনাবাহিনীকে নতুন করে প্ররোচিত করার কিছু ছিল না। মুবির প্ররোচনা ছাড়াই আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ ভরা ছিল ওদের হৃদয়গুলো। এ বিষ ওদের পান করিয়েছিল নাজি। ফাতেমী খেলাফতের সেনাপতিরা ছিল নামে মাত্র জেনারেল। ওরা ছিল অকর্মণ্য ও বিলাসপ্রিয়। আইয়ুবীকে অথর্ব প্রমাণ করতে চাইছিল ওরাও।

মুসলিম শাসকরা খৃস্টান এবং ইহুদী যুবতীল রূপের হারেমে বন্দী। উপদেষ্টাদের বেশীরভাগ ইহুদী বা খৃস্টান। ভোগ আর সুরার অন্ধাকারে হারিয়ে গিয়েছিল ওদের বিবেক।

ওদেরকে হারেমের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করবেন আইয়ুবী, জাগিয়ে তুলবেন জাতির বিবেক, জেগে উঠবে মানবতা, এ অসহ্য। শেরে কোহ-এর শাসন থেকে ওরা বুঝেছিল, সালাহউদ্দীন আইয়ুবী তাদেরকে ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করবেন। তাই তার সব পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে চাচ্ছিল ওরা। এ জন্য সাহায্যের আশায় হাত বাড়াল খৃস্টানদের কাছে। ওরা ময়দান উর্বর করছির খৃস্টান গোয়োন্দাদের জন্য।

নুরুদ্দীন জংগী না হলে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ইতিহাস হয়ত অন্যভাবে লেখা হত। বিশ্বের মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যেতনা এতগুলো মুসলিম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব।

আলীর চিঠি পেলেন নুরুদ্দীন জংগী। ঘ্ড়োসওয়ার এবং পদাতিক মিলে দু’হাজার সৈন্য পাঠালেন আইয়ূবীর সাহায্য।

নাজির মৃত্যু সংবাদ পৌছে গেল সুদানী সেনা শিবিরে। সুলতান যুদ্ধের ময়দানে, মিসরে রয়েছে অল্প ক’জন সৈন্য, আক্রমণের সুবর্ন সুযোগ। মিসরের সেনা ছাউনিতে হঠাৎ আক্রমণ করা হবে এ সিদ্ধান্ত নিল ওরা।

মিসরে পৌঁছল আলীর ক্ষুদ্র কাফেলা। মুবি এবং ফখরুলকে পাওয়া যায়নি। সুদানী হেড কোয়ার্টারে নিয়োজিত গোয়োন্দাদের ডেকে পাঠালেন তিনি এক গোপন আস্তানায়। ওদের একজন বলল, ‘গতরাতে একটা উট এসেছে। আরোহী একজন পুরুষ ও এক যুবতী।’

‘কোথায় উঠেছে ওরা?’

ওরা কোথায় উঠেছে গোয়োন্দা তার বিশদ বর্ণনা দিল। সুদানীরা মুসলিম ফৌজেরই অংশ, ইচ্ছে করলে আলী যে কারো বাসায় তল্লাশী নিতে পারেন। এতে আগুণে ঘি ঢালা হবে। আরও ক্ষেপে যাবে সুদানী ফৌজ। মুবিকে গ্রেফতার করা তার আসল উদ্দেশ্য নয়, তার উদ্দেশ্য ওদের পরিকল্পনা জানা। নতুন নির্দেশ দিয়ে গোয়োন্দাদের ফেরত পাঠালেন তিনি।

চারদিন পর্যন্ত রাজধানীর বাইরে ঘোরাঘুরি করলেন আলী। পঞ্চম রতে খোলা আকাশের নীচে বসে আছেন তিনি। বিশ্রাম করছেন আর ফাঁকে ফাঁকে শুনছেন গুপ্তচরদের রিপোর্ট।

এক গোয়োন্দা একটা লোককে ধরে নিয়ে এল। পা কাঁপছিল লোকটির, পড়ে যাচ্ছিল বারবার। গোয়োন্দা বলল, ‘ওর নাম নাকি ফখরুল মিসরী, জড়ানো কণ্ঠে ও শুধু বলছে আমাকে আমার সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছে দাঁও।’

ফখরুল গোয়োন্দা প্রধানের সামনে বসল।

‘একটা মেয়ে নিয়ে যে পালিয়ৈ এসেছে তুমি কি সেই কমাণ্ডার?’

‘আমিই সুলতানের রক্ষী বাহিনীর সেই পলাতক আসামী। মৃত্যুদণ্ডই আমার প্রাপ্য। তবে আমাকে মারার আগে আমার কথা শোন, নয়ত তোমরা সবাই মরবে।

আলী বুঝলেন, কমাণ্ডারের এখনও নেশা কাটেনি। তাকে অফিসে নিয়ে গেলেন। পথে পাওয়া খাবারে থলে দেখিয়ে বললেন, ‘এটা কি তোমার? এখান থেকে কে খেয়েছে?’

‘হ্যাঁ, ও আমাকে এ থেকে খাইয়েছে।’

আলী থলে খুললেন। গুড়ের মত একটা টুকরা বেরিয়ে এল। এক ঝটকায় টুকরাটা হাতে তুলে নিল ফখরুল। মুখে দেওয়ার আগেই আলী তার হাত ধরে ফেললেন।

‘দোহাই আপনার, ছেড়ে দিন। এর ভেতর আমার জীবন, আমার আত্মা।’

‘আগে সব কথা খুলে বল। এরপর এর সবই তোমার।

কমাণ্ডারকে এন্টি ড্রাগ খাওয়ানো হল। কিছুটা প্রকৃতিস্থ হলে গোটা কাহিনী বলল সে।

‘ব্যবসায়ীরা আমাকে কফি পান করাল। মনে হল অন্য পৃথিবীতে পৌঁছে গেছি আমি। মেয়েটা আমাকে ভালবাসার কথা বলল, লোভ দেখাল বিয়ের। আমরা দু’জন উটে সওয়ার হলাম।

পথে ধরা পড়ার ভয়ে বিশ্রাম করেছি কম। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করত। আমার পাশবিক সত্তা জেগে উঠলে বলত, এখন নয়, বিয়ের পর ওসব হবে। উটের সাথে খাদ্যের দুটো ব্যাগ, একটা থেকে ও খেত, আমাকে দিত অন্যটা থেকে। পথে থলে দু’টো কোথাও পড়ে গেল। খোঁজ করার জন্য পীড়াপীড়ি করল ও, আমি রাজি হইনি। বলেছি সময় নষ্ট হলে ধরা পড়ে যাব। খাবারের অভাব হলো, কিন্তু বসতি থেকে দূরে থাকতে চাইত ও।

চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় আমরা এক সুদানী কমাণ্ডারের কাছে পৌঁছলাম। আমার মাথায় অসংখ্য কীটের দংশন। কেন জানিনা, ধীরে ধীরে প্রকৃতিস্থ হলাম। মেয়েটা আমার সামনেই কমাণ্ডারকে সব কথা বলল। প্ররোচিত করতে লাগল বিদ্রোহ করার জন্য। বলল, আলী এবং আইয়ূবীর মাঝে ভুল বুঝাবুঝীর সৃষ্টি করতে হবে। তাদের দীর্ঘ আলোচনায় বিদ্রোহের কথাই প্রাধান্য পেয়েছে। তথোক্ষণে আমি পুরোপুরি সুস্থ।

আবার মাথার যন্ত্রণা, আবার সুস্থ, এভাবে চলতে লাগল। মেয়েটা কমাণ্ডারকে বলল, আইয়ুবী নেই, এখনি বিদ্রোহ করার উপযুক্ত সময়। ও আরও বলল, কিছু দিনের মধ্যেই খৃস্টান সৈন্যরা আবার আক্রমণ করবে। তখন আইয়ুবীকে এখানকার ফৌজও ডেকে নিতে হবে। কমাণ্ডার তার কথায় সম্মত হয়ে বলল, ছ’ সাত দিনের মধ্যেই তারা বিদ্রোহ করবে।

মাঝ রাতে আমাকে অন্য এক কামরায় পাঠিয়ে দেয়া হল। দু’কক্ষের মাঝে ছোট একটি দরজা। দরজাটি ওপাশ থেকে বন্ধ।

কমাণ্ডার এবং মেয়েটা হাসির শব্দ ভেসে আসছিল ও পাশ থেকে। আমার ঘুম আসছিল না। উঠে দরজায় কান লাগিয়ে উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। মেয়েটা বলল, ‘ওকে হাশিশ খাইয়ে এদ্দুর এনেছি। একা এতদূর আসা সম্ভব ছিল না বলে পথে ছিলাম ওর প্রেমিকা। পথে হাশিশের পুটলিটা পড়ে গেছে। সকালে এক পুরিয়া না পেলে বিরক্ত করবে।

এরপর বুঝলাম, মদপানের সাথে সাথে ওরা পাপের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। অনেক পরে কমাণ্ডারের কণ্ঠ ভেসে এল, ‘ওর এখন আমাদের প্রয়োজন নেই। জেলে পাঠিয়ে দেব, না হয় মেরে ফেলব।’

‘বরং তাকে মেরেই ফেল।’ মেয়েটার কণ্ঠ, ‘থাকলে ঝামেলা করতে পারে।’

পালানোর চিন্তা করলাম, রাতের শেষ প্রহরে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। ভোরের আলো ফোটার আগেই অনেক দূর চলে এলাম। এবার দু’দিক থেকে ধাওয়াকারীদের ভয়, খৃস্টান বা সুদানীরা পেলে হত্যা করবে, আমাদের ফৌজের কাছেও আমি অপরাধী। তাই দিনে লুকিয়ে থাকতাম কোন পড়োবাড়ীতে। দেহ এবং মস্তিষ্ক দুটোই দুর্বল।

পথ চলতাম রাতে। কখনো ইচ্ছে হতো, ফিরে গিয়ে খৃস্টান মেয়েটাকে হত্যা করি। আবার ভাবতাম, সুলতানের পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইব। কিন্তু কিছুই সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারছিলাম না। এভাবে হাঁটছি, এ লোকটার সাথে দেখা। ও আমাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে।

সুদানীরা আক্রমণ করবে এখন এ আর আশংকা নয়, বাস্তব। সুলতানকে সংবাদ দিতে হবে, নষ্ট করার মত সময় নেই। কি করে দ্রুত সুলতানকে সংবাদ দিতে হবে, নষ্ট করার মত সময় নেই। কি করে দ্রুত সুলতানকে খবর দেয়া যায় ভাবতে লাগলেন আলী। একজন অফিসার এসে বলল, ‘সুলতান আপনাকে স্মরণ করেছেন।’

‘সুলতান!’ আলীর অবাক কণ্ঠ, ‘তিনি তো যুদ্ধের ময়দানে! এলেন কখন?’

সাথে সাথে সুলতানের সাথে দেখা করলেন তিনি। সুলতান বললেন, ‘সংবাদ পেলাম যুদ্ধের ময়দানে এবং এদিকে ওদের অনেক গুপ্তচর ছড়িয়ে পড়েছে। ওখানে আমার কাজ নেই। এ দিক নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি, তাই চলে এলাম।’

সব ঘটনা খুলে বললেন আলী। ‘সুলতান, আপনি বললে জংগীর ফৌজ আসা পর্যন্ত বিদ্রোহ মুলতবী করার চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমাদের সৈন্য কম, ওদের আক্রমণ ঠেকাতে পারব না।’ সুলতান পায়চারি করতে লাগলেন। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন তিনি। আলী অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন সুলতানে দিকে কক্ষে নীরবতা।

হঠাৎ পায়চারী থামিয়ে সুলতান বললেন, ‘হ্যাঁ! আলী, এবার তোমার ভাষা ব্যবহার কর। আক্রমণের বিপক্ষে নয়, পক্ষে। ওরা আক্রমণ করবে রাতে, যখন ঘুমিয়ে থাকবে আমাদের ফৌজ।’

আলীর চোখে অবাক বিস্ময়। সুলতান মুখ খুললেন, ‘সব কমাণ্ডারদের ডেকে নিয়ে এস। মনে রেখ আমি এখনো যুদ্ধের ময়দানে। আমি এসেছি কেউ যেন জানতে না পারে।

তিন রাত পর। গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে সমগ্র কায়রো। একদিন পূর্বে ফৌজকে শহরের বাইরে যেতে দেখা গেছে। বলা হয়েছে সামরিক মহড়ায় অংশ নিতে যাচ্ছে ওরা। নীলনদের পাড়ে বালিয়াড়ি আর টিলা।

টিলা এবং নদীর মাঝখানে ছাউনি ফেলল ওরা। পদাতিক এবং অশ্বারোহী সৈন্য। মাঝরাতে অশ্বক্ষুরের শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠল কায়রোবাসী। শহরের বাইরে যেন রোজ কিয়ামত। ওরা মনে করল সামরিক মহড়া।

শব্দগুলো এগিয়ে আসছে। বাড়ীর ছাদে উঠে এল উৎসুক জনতা। দিগন্তের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। দেখা গেল নীলের শান্ত বুক থেকে উঠে আসছে অগ্নিগোলক। ছাউনি লক্ষ্য করে রাতের বুক চিরে এগিয়ে আসছে তীব্র গতিতে।

শহরময় ছড়িয়ে পড়ল অশ্বক্ষুর ধ্বনি। মানুষ জানল না সুদানী ফৌজের বেশীরভাগ জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হচ্ছে। সুলতান আইয়ুবীর কৌশল আবারো অভ্রান্ত প্রমাণিত হল। নীল আর পাহাড়ের মাঝের বালিয়াড়িতে তাবু ফেলল তার ক্ষুদ্র বাহিনী।

সুদানী ফৌজ দু’ভাগে ভাগ হল। মধ্যরাতে একভাগ মার্চ করল রোম উপসাগরের দিকে। সেখানে পরাজিত হয়েছে খৃস্টান বাহিনী। অন্যভাগ নীলের পাড়ের ছাউনিতে আক্রমণ করল। সুর্যোদয়ের পূবেই রাজধানী দখল করবে ওরা। দ্রুততার সাথে সুদানী বাহিনী সুলতানের ফৌজের ছাউনি দখল করল।

আচম্বিত তাবুতে নিক্ষিপ্ত হতে লাগল আগুণের গোলা। নীল থেকেও ছুটে আসছিল অগ্নিগোলক। তাবুতে আগুন ধরে গেল। অবাক হয়ৈ ওরা দেখল, আইয়ুবীর একজন সৈন্যও নেই তাবুতে।

রাতের প্রথম প্রহরেই সৈন্যদের সরিয়ে নিয়েছিলেন আইয়ুবী পাহাড়ে এবং নদীতে। ওদর দিলেন বহনযোগ্য কামান মিনজানিক। তাবুগুলো ভরে দিলেন তেলে ভেজা খড় এবং শুকনো ঘাস দিয়ে। সুদানী সৈন্যরা তাবুর কাছে এল। পাহাড় এবং নদী থেকে নিক্ষীপ্ত তোপের আঘাতে আগুন ধরে গের শুনকো খড়ে। সুদানী ঘোড়সওয়াররা পদাতিকদের পিষে ফেলতে লাগর। চারদিকে আগুনের লেলিহান শীখা। বেরোতে গিয়ে জীবন্ত পুড়ে মরল অনেক সৈন্য। বেরিয়ে এলে পড়ত মুসলিম বাহিনীর তীরের আওতায়।

সুদানী ফৌজের অন্য দল এগিয়ে যাচ্ছিল রোম উপসাগরের দিকে। তাদের ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন সুলতান আইয়ুবী। পাহাড়ের ফাঁকে লুকিয়েছিল কমাণ্ডো বাহিনী। সুদানী ফৌজের পেছনে থেকে আক্রমণ করত ওরা। সৈন্যরা কিছু বোঝার আগেই পালিয়ে যেত। প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করে আবার এগিয়ে চলত সুদানী বাহিনী। আবার পেছন থেকে আচমকা আক্রমণ।

অন্ধকার রাত। এ অন্ধকারে কমাণ্ডোদের ধাওয়া করা অসম্ভব। ভোর পর্যন্ত তিনাবর আক্রান্ত হল ওরা। ভয় পেয়ে থেমে গেল ফৌজ। সামনে এগিয়ে যাবার সাহস হারিয়ে ফেলেছে ওরা।

দিনের বেলা কমাণ্ডাররা তাদের বোঝাল। সাহস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল সৈন্যদের। রাতে আবার আক্রমণ হল। অদৃশ্য শত্রুর তীরের আঘাতে মারা পড়ল অসংখ্য সৈন্য। হঠাৎ মাল বোঝাই উটগুলো দিকবিদিক ছুটতে লাগল। মাঝ পথে আগুন জ্বলছে। মাত্র দু’রাতের কমাণ্ডো আক্রমণে সুদানী বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল। সৈন্যদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ৈ দিল আলীর গোয়োন্দারা। আরব থেকে বিশাল বাহিনী আসার সংবাদে ভয় পেয়ে গেল ওরা। যে যেদিকে পারল পালিয়ে গেল।

নিঃশেষ হয়ে গেল সুদানী বাহিনী।

ওদিকে জংগীর পাঠানো ফৌজ কায়রো এসে পৌঁছল। ইচ্ছে করলে সুলতান আইয়ুবী সুদানীদের নির্বিচারে হত্যা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেন। সুদানী কমাণ্ডাররা বুঝেছিল তারা অপরাধী, নিঃশেষ হয়ে গেছে ওদের সামরিক শক্তি। ওরা যে অপরধ করেছে তাতে একমাত্র মৃত্যুদণ্ডই ওদর প্রাপ্য।

কিন্তু সুলতান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। সৈন্যদেরকে সরকারী জমি দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হল। এরপর ঘোষণা করা হল মিসরের সেনাবাহিনীতে ভর্তিচ্ছুদের স্বাগত জানানো হবে।

জংগীর পাঠানো সৈন্য, মিসরের ফৌজ এবং সুদানী বাহিনীর নতুন লোকদের নিয়ে সুলতান আইয়ুবী এক সুশৃখল এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুললনে।

আলী বিন সুফিয়ান তৈরী করলেন দুঃসাহসী কমাণ্ডো এবং গেরিলা বাহিনী।

খৃস্টানরাও অপরূপা সুন্দরী তরুণী এবং গুপ্তচরদেরকে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দিল। দু’পক্ষেরই সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন প্রায়।

সুলতান এসব সুন্দরী তরুনীদের বিষাক্ত ছোবল কিভাবে মোকাবেলা করবেন আর খৃস্টানরাই বা কিভাবে মোকাবেলা করবে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সুশৃঙ্খল বাহিনীর উভয় পক্ষ তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইল।

কিন্তু এ পায়তারা শেষ হতে বেশী দিন সময় লাগল না। অল্পদিনের মধ্যেই ভয়ংকর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল ওরা।

রোমের এক উপশহর। জরুরী সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন খৃস্টান নেতৃবৃন্দ। এর মধ্যে রয়েছেন সম্রাট অগাস্টাস, সম্রাট রিমাণ্ড, এলমার্ক, সপ্তম লুইয়ের ভাই রবার্ট।

এদের মধ্যে সবচে’ ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছিল এমলার্ককে। খৃস্টানদের সম্মিলিত নৌবাহিনীর প্রধান তিনি। সুলতান সালাহউদ্দীনের হাতে পর্যুদস্ত হয়ে মেজাজ বিগড়ে গেছে তারা। বিজয় দূরে থাক, উপকূলের কাছেও ঘেঁষতে পারেনি সে। যারাই মিসর উপকূলে পা রাখার দুঃসাহস দেখিয়েছে, তারা হয়েছে বন্দী, নয়তো নিহত।

সুলতান আইয়ূবীর গোলন্দাজদের তোপের আঘাতে পুড়ে গেছে জাহাজের পাল এবং মাস্তুল। ভাগ্য ভাল যে সিপাইরা তার জাহাজের আগুন নিভাতে সক্ষম হয়েছিল।

পাল ছেঁড়া জাহাজ ঢেউয়ের দোলায় এগিয়ে গিয়ে পড়ল সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে। অনেক জাহাজ এবং নৌকা ঝড়ে ডুবে গেল। তার জাহাজের মাঝি মাল্লা সাহসিকতার সাথে ঝড়ের মোকাবিলা করল। একদিন পৌঁছল সমুদ্র উপকূলে। তীরে নেমেই মাঝি মাল্লাদের পুরস্কৃত করল এমলার্ক।

খৃস্টান নেতারা তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সম্মেলনের উদ্দেশ্য পরাজয়ের কারণ নিয়ে পর্যালোচনা করা। কেউ কি তাদের সাথে প্রতারণা করেছে? কে সে, নাজি?

তার চিঠি পেয়েই নৌসেনা পাঠানো হয়েছিল। নাজির চিঠি তাদের কাছে নতুন নয়। আগের লেখাগুলোর সাথে এ লেখার হুবুহ মিল আছে।

ওরা আবার চিঠি খুলে বসল। কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। কায়রো থেকে গোয়েন্দারা কোন সংবাদ দেয়নি। নাজি কথায় তাও ওরা জানেনা।

রাগে কাঁপছিল এমলার্ক। আইয়ুবীকে হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে নিয়ে আসবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল সে। তার দর্প চুর্ণ হয়ে গেছে। এমলার্ক পরাজিত, ক্লান্ত।

কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলো না ওরা। সম্মেলন পরদিনের জন্য মুলতবী ঘোষণা করা হল।

রাতে মদের আসর চলছে। এক অপরিচিত মুখ ভেতরে এল। শুধু রিমাণ্ড চেনে তাকে। বিশ্বস্ত গোয়োন্দা। আক্রমণের দিন সন্ধ্যায় তাকে মিসরের উপকূলে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। তার চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে খৃস্টানদের নৌবহর।

রিমাণ্ড গোয়োন্দার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দির। ভিড় জমে উঠল তার চারপাশে। গোয়েন্দা বলল, ‘আহত হওয়ার ভান করে রবিন আইয়ুবীর ছাউনিতে পৌঁছে গেছে। রবিনের সহযোগী পাঁচজন ছিল। ব্যবসায়ীর পোশাকে। তাদের একজন ক্রিস্টোফার। সে তীর ছুঁড়েছিল আইয়ুবীকে লক্ষ্য করে। লাগেনি।

ধরা পড়েছে পাঁচজনই। সাথে সাতটা মেয়ে। ওরা চমৎকার গল্প ফেঁদেছিল। আইয়ুবী মেয়েগুলোকে রেখে ছেড়ে দিয়েছিল বাকী পাঁচজনকে। কিন্তু এদের গোয়োন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান এসে সবাইকে গ্রেফতার করল। কথা আদায় করতে গিয়ে অত্যাচার করে মেরে ফেলল একজনকে। অপরাধ স্বীকার করল অন্যরা।

আমি নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়েছিলাম। সুলতান আমাকে আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব দিলেন। শুনেছি সুদানীদের বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে। বড় বড় অফিসারদের গ্রেফতার করা হয়েছে। রবিনসহ এগারজন বন্দী করা হয়েছে। সুবিনা আর তালাশকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ছাউনিতে আইয়ুবীও নেই, নেই আলী বিন সুফিয়ানও। অনেক টাকার বিনিময়ে একটা নৌকা জোগাড় করে আমি পালিয়ে এসেছি।

রবিন এবং অন্যদের উদ্ধার না করলে মারা পড়বে। ছেলেদের না হলেও মেয়েগুলোকে মুক্ত করা জরুরী। ওরা শুধু সুন্দরী ও যুবতীই নয়, মুসলমান আমীর ওমরাদের ফাঁসানোর জন্য ওদেরকে দীর্ঘদিন ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। এরকম সাতটা চৌকস মেয়ে তৈরী করতে অনেক সময় ও কাঠখড় পোড়াতে হবে আমাদের। মুসলমানরা তাদের কি অবস্থা করেছে কল্পনাও করতে পারবেন না।’

‘এ ধরনের সেক্রিফাইস তো আমাদের করতেই হবে।’ সম্রাট অগাস্টাস বললেন, ‘মেয়েদের মেরে ফেলা হবে এ নিশ্চয়তা তোমাকে কে দিল?’

রিমাণ্ড বলল, ‘কিন্তু তাই বলে মুসলমানরা ওদের সাথে পশুর মত আচরণ করবে আর আমরা চুপ করে বসে থাকব, তা হয়না। আমি ওদের মুক্ত করার চেষ্টা করব।’

রবার্ট বলল, ‘ভাল ব্যবহার করে মুসলমানরা ওদেরকে আমাদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করতে পারে। ওদের মুক্ত করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা অর্ধেক সম্পদ এর জন্য ব্যয় করতে প্রস্তুত।’

‘ওরা মেয়ে বলেই এত দামী তা নয়।’ গোয়েন্দাটি বলল, ‘ওরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তাছাড়া এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এমন মেয়ে ক’টাই বা পাওয়া যায়? আপনাদের যুবতী মেয়েরা কি এমনিভাবে শত্রুর হাতে নিজেকে তুলে দিতে পারবে? পারবে কি শত্রুর ভোগের সামগ্রী হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে? মৃদু হাসির যাদু দিয়ে পারবে বড় বড় দুশমনকে পদানত করতে?

‘যদি শত্রুরা ওদের পরিচয় জানতে পারে তবে ওদের মৃত্যু অনিবার্য।’

‘হ্যাঁ, প্রচুর টাকার বিনিময়ে আমরা ওদের নিয়েছি। ট্রেনিং দিয়েছি, বিভিন্ন ভাষা শিখিয়েছি। এমন অভিজ্ঞ মেয়েগুলোকে হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না।’

সম্রাট অগাষ্টাস প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা কি মনে কর ওদের বের করে আনা যাবে?’

‘জ্বী। শুধু ক’জন সাহসী লোক প্রয়োজন। হয়ত দু’একদিনের মধ্যে ওরা ওদেরকে কায়রো নিয়ে যাবে। তখন উদ্ধার করতে ঝামেলা হবে। সময় নষ্ট না করলে ক্যাম্পেই ওদের পাব। আমাকে কয়েকজন সাহসী এবং ত্যাগী লোক দিন, আমি ওদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে আসব।’ বলল গোয়োন্দা।

‘অবশ্যই মেয়েদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে।’ ক্রোধ কম্পিত কণ্ঠে বলল এমলার্ক। পরাজয়ের অপমান তার চোখে মুখে। কখনো টেবিলে ঘুষী মেরে, কখনো নিজের উরু চাপড়ে কথা বলছিল সে।

‘আমি মেয়েদের ফিরিয়ে আনবো, হত্যা করব আইয়ুবীকে। রূপসী যুবতীদের দিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ছিন্নভিন্ন করে দেব।’

‘এমলার্ক!’ রিমাণ্ড বললেন, ‘আমি তোমার আবেগকে শ্রদ্ধা করি। ট্রেনিংপ্রাপ্ত মেয়েদরও সহজে হাতছাড়া করতে পারি না। তুমি তো জানোই আমাদের মেয়েরা সিরিয়ায় হারেমগুলো জমিয়ে রেখেছে। আমীর ওমরারা এখন ওদের হাতের পুতুল। নারী এবং সুরার গুণে মুসলিম বিশ্ব এখন তিনভাগে বিভক্ত। ঐক্য ভেংগে গেছে ওদের। শুধু দুটো লোক আমাদের জন্য বিপজ্জনক। একজন নুরুদ্দীন জংগী। অন্যজন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। এদের একজন বেঁচে থাকলেও ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা সহজ হবে না। আইয়ুবী সুদানী বিদ্রোহ দমন করেছে, তার মানে লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত। আমরা তার ওপর লক্ষ্য রাখছি।’

‘নিয়মিত যুদ্ধের পরিবর্তে গেরিলা যুদ্ধে তাকে হারাতে হবে। মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করতে হলে ট্রেনিংপ্রাপ্তা মেয়েদেরকে আমাদের প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন।’

রবার্ট বলল, ‘হ্যাঁ, অভিজ্ঞতা আমাদের তাই বলে। মুসলমানরা নারীদেহের গন্ধ পেলে সব কিছু ভুলে যায়। এ যুদ্ধে ওদের হারাবার সহজ পথ হল ওদর হাতেই ওদেরকে মারতে হবে। বিনোদনের বিভিন্ন পথ উন্মুক্ত করে দাও, ওরা দ্বীন ঈমান ভুলে যাবে। শুধু যুবতী দেহের রূপ ও সৌন্দর্যের বিনিময়ে আরবের অনেক আমীর বাদশা এখন আমাদের হাতের পুতুল।’

মুসলমানদের দুর্বলতাগুলো নিয়ে এদের মধ্যে অনেকক্ষণ কথা হল। সিন্ধান্ত হল, মেয়েদের মুক্ত করা হবে। দুঃসাহসী ক’জন কমাণ্ডো পাঠানো হবে এ অভিযানে।

একটু পর পাঁচজন কমাণ্ডারকে ডেকে আনা হল। ওরা এলে বিস্তারিত পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেয়া হল ওদের।

একজন বলল, ‘আমরা আগে থেকেই দুঃসাহসী কমাণ্ডো ফোর্স তৈরী করে রেখেছি।’

‘কিন্তু এদের বিশ্বস্ত হতে হবে।’ অগাস্টাস বললেস, ‘ওরা কাজ করবে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে। কিছু না করেও এসে বলবে অনেক কিছু করেছি।’

‘শুনে আশ্চর্য হবে, ওদের অনককে আমরা কারাগার থেকে সংগ্রহ করেছি। ওরা ছিল চোর, ডাকাত এবং খুনী। কেউ কেউ যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী। স্বতস্ফর্তভাবেই ওরা আমাদের বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। মেয়েদের উদ্ধার করার জন্য আমি এমন তিনজন লোক দিতে পারব, কুখ্যাত খুনী হিসাবে যাদের ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল।

সকাল পর্যন্ত বিশজনের এক বাহিনী তৈরি করা হল। তাদের একজন মেগনামা মারইউস। সে ছিল রোমের জেলে। ডাক্তাররূপী এক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান করা হল তাকে।

এদের প্রথম কাজ মেয়েদের মুক্ত করা। রবিন এবং তার সংগীদের মুক্ত করতে না পারলে ঝুঁকি নেয়ার দরকার নেই। দ্বিতীয় কাজ হল সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে হত্যা করা।

প্রয়োজনীয় অস্ত্রসহ সেদিনই তাদেরকে নৌকায় তুলে দেয়া হল।

সুদানীরা ব্যর্থ হয়েছে, দমন করা হয়েছে ওদের সেনা বিদ্রোহ। অনেক অফিসার ওদের নিহত হয়েছে। সুলতান আইয়ূবীর অফিসের সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিল অনেকে। পরাজিত ও বিধ্বস্ত চেহারা। অস্ত্র সমর্পণ করে ওরা আনুগত্য মেনে নিয়েছে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর।

আইয়ুবী নিজের কমাণ্ডারদের বিভিন্ন নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সাথে গোয়োন্দা প্রধান। এ বিজয়ে তার ভূমিকা অসামান্য। বলতে গেলে গোয়োন্দা যুদ্ধেই ওদের পরাজিত করা হয়েছে।

হঠাৎ আলীর দিকে তাকালেন সুলতান। বললেন, ‘আলী! ব্যস্তার কারণে সাতটি মেয়ে এবং তার সংগীদের নিয়ে কিছু ভাবতে পারিনি। ওরা ওখনও সাগর পারের ছাউনিতে। যত শীঘ্র সম্ভব ওদের এখানে নিয়ে এস।’

‘এখনি লোক পাঠিয়ে ওদের আনানোর ব্যবস্থা করছি। সুলতান! সম্ভবতঃ সপ্তম মেয়েটার কথা আপনি ভুলে গেছেন। ও এসেছিল সুদানী কমাণ্ডার বালিয়ানের কাছে। বালিয়ান বন্দী হয়নি, নিহত ও আহতদের মধ্যেও নেই। মেয়েটা সম্ভবতঃ বালিয়ানের সাথে পালিয়ে গেছে।’

‘আমার মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ। শোন, এখানে এখন তুমি না হলেও চলবে। বালিয়ান হয়ত রোম উপসাগরের দিকেই পালিয়েছে। খৃস্টান ছাড়া কে আর ওদের আশ্রয় দেবে? যেখানেই পাও, ওকে এনে জেলে পুরে দাও। আর গোয়োন্দাদের একটা দল সাগরের ওপারে পাঠানোের ব্যবস্থা কর।’

‘নিজের দেশেই গোয়েন্দাদের ছড়িয়ে দেয়া বেশী জরুরী।’ নুরুদ্দীন জংগীর পাঠানো সেনা কমাণ্ডার বলল, ‘খৃস্টানদের চাইতে মুসলমান আমীর ওমরারা আমাদের জন্য বেশী ক্ষতিকর। গোয়েন্দাদেরকে ওদের হারেমে ঢুকিয়ে দিতে পারলে অনেক ষড়যন্ত্রই প্রকাশ হয়ে পড়বে। সুলতান জংগী সব সময় উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকেন, বাইরের হামলা ঠেকাবেন, না ঘরের শত্রু প্রতিরোধ করবেন।’

কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন সুলতান আইয়ুবী। বললেন, ‘যাদের হাতে অস্ত্র আছে তারা যদি বিশ্বস্ত এবং দৃঢ় ঈমানের অধিকারী হয় তবে ভেতরের ষড়যন্ত্র এবং বাইরের আক্রমণ আমাদের কিছুই করতে পারবে না। একটা কথা মনে রেখো, মুসলিম বিশ্বের কোন সীমানা নেই। যখনি ইসলামকে সীমার সংকীর্ণতায় আবদ্ধ করা হয়েছে তখনি বিপর্যয় এসেছে। দৃষ্টিকে প্রসারিত করে তোমার দৃষ্টি নিয়ে যাও রোম উপরাগরের উপারে, দেখবে বিশাল জলরাশিও তোমার পথ রুখতে পারবে না। ঘরের যে আগুনকে ভয় পাচ্ছ তা এক ফুঁতে নিভে যাবে, সেখানে জ্বলবে দ্বীন এবং ঈমানের আলো।’

‘আমরা বেঈমানদের মোকাবেলা করার কথা বলছি সুলতান! আমরা নিরাশ হইনি।’ বলল কমাণ্ডার।

‘বন্ধুরা, তোমরা দুটো শব্দ থেকে দূরে থেকো ‘নৈরাশ্য’ এবং ‘মানসিক বিলাস’। মানুষ প্রথমে  নিরাশ হয়, এরপর মানসিক বিলাসিতার মধ্যে দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ায়।

আলী বিন সুফিয়ান বেরিয়ে গেলেন। একজন দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে দিলেন সাগরপারের ছাউনিতে। তাকে বললনে, ‘রবিন এবং মেয়েগুলোকে ঘোড়া বা উটে করে সেনা প্রহরায় রাজধানীতে নিয়ে এসো।’

ওদের পাঠিয়ে দিয়ে দু’জন সেপাই সাথে নিয়ে তিনি নিজে বেরোলেন বলিয়ানের খোঁজে। হেড কোয়ার্টারের বাইরে দাঁড়ানো সুদানী কমাণ্ডাররা বলিয়ান সম্পর্কে কিছু তথ্য দিল। ওরা বলল, ‘বালিয়ানকে যুদ্ধের ময়দানে দেখা যায়নি। উপসাগরের ছাউনিতেও যায়নি সে।’

আলী পৌঁছলেন তার বাড়ীতে। দু’জন বৃদ্ধা চাকরানী ছাড়া কেউ নেই। ওরা বলল, ‘এখানে পাঁচজন যুবতী মেয়ে ছিল। কারো রূপ একটু ম্লান হলেই তাকে সরিয়ে দিত বালীয়ান। নিয়ে আসত তরতাজা উচ্ছল যুবতী। বিদ্রোহের আগে একটা ফিরিঙ্গী মেয়ে এসেছিল। ভীষণ সুন্দরী এবং সতর্ক। আমাদের মালিক ছিল তার হাতের পুতুল। বিদ্রোহের পর সুদানীরা যেদিন আত্মসমর্পন করল সে রাতে তিনি সাতজন ঘোড়সওয়ারসহ মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে যান। উনি চলে যাবার পর হারেমের অন্যান্য মেয়েরা হাতের কাছে যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে ভেগেছে।’

আলী ফিরে আসার জন্য ঘুরলেন, এক দ্রুতগামী সওয়ার তার সামনে এসে লাফিয়ে পড়ল ঘোড়া থেকে। সওয়ারের নাম ফখরুল মিসরী।

হাঁফাতে হাঁফাতে সে বলল, ‘আমি আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছি। বালিয়ান এবং সে মেযেটাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। ওরা কোন দিকে গেছে আমি জানি। ওদের পিছু নিয়েছিলাম আমি। কিন্তু ওদের সাথে সাতজন সশস্ত্র প্রহরী থাকায় আমি ফিরে এসেছি। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। ওদের দু’জনকে নিজের হাতে হত্যা করতে না পারলে আমি শান্তি পাব না। আমি একা, খোদার দিকে চেয়ে আমার সাথে কয়েকজন সিপাই দিন।’

‘ওরা কোথায়?

‘ওরা রোম উপসাগরের দিকে যাচ্ছে। তবে ওরা পথ চলছে খুব সাবধানে। সাধারণতঃ তারা বড় রাস্তা এড়িয়ে পার্শ্ববর্তী সরু রাস্তা মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

ফখরুল মিসরী দ্রুত নুয়ে আলীর পায়ে হাত রেখে অনুনয় করে বলল, ‘আমি ওদের পিছু নেব, হত্যা করব ওদের। দয়া করে আমার সাথে মাত্র চারজন সেপাই দিন।’

আলী তাকে শান্ত করলেন। ‘চারজন নয় বিশ জন সওয়ার দেব। ওরা এত শীঘ্র সাগর পারে পৌঁছতে পারবে না। আমরা ওদের পিছু নিচ্ছি, তুমিও থাকবে আমাদের সাথে।

ওদের খোঁজ পেয়ে আলী এবার নিশ্চিন্ত মনে ওদের পিছু নিলেন।

অনেক পথ অতিক্রম করেছে বালিয়ান এবং মুবি। সাধারণ রাস্তা ছেড়ে এগিয়ে চলেছে ওরা। এসব পথঘাট বালিয়ানের চেনা থাকায় পথ চলতে ওদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন তা জানত না বালিয়ান। ভয়ে পালাচ্ছে সে, মুবির মত সুন্দরী যুবতীকে হাতছাড়া করার ইচ্ছে নেই তার। ওর ধারণা ছিল, মিশর এবং সুদানেই রয়েছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সুন্দরীরা। কিন্তু ইটালীর এ যুবতীর রূপ তাকে অন্ধ করে দিয়েছে। তার জন্য উচ্চপদ, ধর্ম এবং দেশ ছাড়তেও কুণ্ঠিত হয়নি সে।

ও জানত না, মুবি তার কাছ থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। সে যে উদ্দেশ্যে দ্বিগুণ বয়েসী এ লোকের কাছে নিজরের হৃদয়, নিজের ইজ্জত বিকিয়ে দিয়েছে তা বরবাদ হয়ে গেছে।

মুবির মত যুবতীর ভালবাসা পেয়ে বালিয়ান ছিল তৃপ্ত। কিন্তু এখন মুবি তাকে ঘৃণা করছে। একজন নারীর পক্ষে একা পথ চলা সম্ভব নয় বলেই বাধ্য হয়ে তার সাথে যাচ্ছে সে। রবিনকে খুঁজে বের করাই এখন তার প্রধান কাজ। ওকে না পেলে সে ফিরে যাবে সাগরের ওপারে।

অনিচ্ছাসত্বেও তাকে বালিয়ানের ভোগের সামগ্রী হতে হচ্ছে। ও কয়েকবারই বলেছে, ‘বিশ্রাম কম করে তাড়াতাড়ি এগিয়ে চল।’ কিন্তু বালিয়ান একটু ভাল জায়গা পেলেই থেমে যেত।

একরাতে বালিয়ানকে মদ ঢেলে দিচ্ছে মুবি। ইচ্ছে করেই বেশী খাওয়ালো। নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল বালিয়ান। প্রহরীরাও শুয়ে আছে।

ধীরপায়ে এক প্রহরীর কাছে গেল ও। যুবক বয়স। সাহসী। বালিয়ানের বিশ্বস্ত। আলতো স্পর্শে তাকে জাগাল মুবি। নিয়ে গেল খানিক দূরে। বলল, ‘তুমিতো জান আমি কে? কেন এসেছি।’

যুবক কোন কথা না বলে মাথা নাড়ল।

‘তোমাদের জন্য সাহায্যের আশ্বাস নিয়ে এসেছিলাম। চেয়েছিলাম সালাহউদ্দীনকে সরিয়ে তোমাদেরকে ক্ষমতায় বসাব। কিন্তু তোমাদের এ কমাণ্ডার অপদার্থ। বিদ্রোহের পরিকল্পনা করবে তা নয়, প্রতিরতে মাতাল হয়ে আামাকে ভোগ করা শুরু করল। আমি হলাম তা হারেমের বন্দিনী।’

সামান্য বিরতি নিয়ে মুবি আবার বলতে শুরু করল, ‘কোন চিন্তা ভাবনা না করেই ফৌজকে দু’ভাগে ভাগ করল ও। আক্রমণ করল বুদ্ধিহীনের মত। যার ফলে তোমাদের এক বিশাল বাহিনী শেষ হয়ে গেল। তোমাদের পরাজয়ের জন্য এ লোকটা সম্পূর্ণরূপে দায়ী। এখনও সে আমাকে ভোগ করে চলছে। আমাকে বলছে দেশে নিয়ে আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু ওকে আমি ঘৃণা করি।

বিয়ে করতে হলে কাকে করব সে সিদ্ধান্ত আমার। তোমাকে আমি ভালবাসি। তুমি যুবক, সাহসী এবং বুদ্ধিমান। প্রথম দেখার দিন থেকেই তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। এ বুড়ো হাবড়াটার হাত থেকে আমাকে উদ্ধার কর। তোমাকে আমি সাগরের ওপারে নিয়ে যাব। সেনাবাহিনীর বড় পদ এবং ধন সম্পদ থাকবে তোমার পদতলে। কিন্তু একে শেষ না করলে তা সম্ভব নয়। ও ঘুমিয়ে আছে। ওকে হত্যা করে চল আমরা দু’জনে পালিয়ে যাই।’

সৈনিকটার গলা জড়িয়ে ধরল মুবি। মুবির মাতাল করা রূপ তাকে পাগল করে তুলল। কিছুক্ষণ জড়িয়ে রেখে তাকে ছেড়ে সরে বসল ও। যুবক এগোল তার দিকে। আচমকা একটা বশা এসে বিঁধল যুবকের পিঠে। ‘আঃ!’  শব্দ করে লুটিয়ে পড়ল সে। বর্শা টেনে তুলল একজন। বলল, ‘নেমকহারামের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’

আতংকিত চিৎকার বেরিয়ে এল মুবির কণ্ঠ থেকে। দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমরা লোকটাকে মেরে ফেললে!’

পেছন থেকে কেউ তার বাহু খামছে ধরল। ঝাকুনি দিয়ে টেনে নিয়ে চলল বালিয়ানের কাছে।

‘আমরা এ ব্যক্তির পালিত বন্ধু। তার সাথেই আমাদের জীবন মরণ। আমাদের কাউকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপাতে পারবে না। নিমকহারাম তার শাস্তি পেয়েছে।’

‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ ভেবেছ একবারও?’

‘সাগরে ডুবতে যাচ্ছি। তোমার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। বালিয়ান যেখানে যাবে, আমরাও সেখানে যাব।’

বালিয়ান তখনো মাতাল হয়ে পড়ে আছে। ওরা দু’জন শুয়ে পড়ল আবার। পরদিন বালিয়ানকে সব ঘটনা খুলে বলা হল। মুবি বলল, ‘লোকটা আমাকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।’

রক্ষীদের ধন্যবাদ জানাল বালিয়ান। আবার পথ চলতে শুরু করল ওরা। মুবি আবারও দ্রুত চলার জন্য তাগাদা দিতে লাগল। বলল, ‘যতশ্রীঘ্র সম্ভব এগিয়ে যাওয়া উচিৎ।’

বালিয়ান চলল তার নিজস্ব গতিতে। মুবির রূপ যৌবন তাকে বিবেকশূন্য করে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু পরিস্থিতি সম্পর্কেও সে ছিল সজাগ। চারদিক দেখেশুনে সাবধানে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল তার। মুবি বুঝেছে, বালিয়ানের হাত থেকে মুক্ত হওয়া এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। প্রয়োজনে এরা বন্ধুকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হয় না।

বিদ্রোহ পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সুলতান আইয়ুবী আলী বিন সুফিয়ানকে নিজের কাছে রাখা জরুরী মনে করলেন। এ খবর পেয়ে আলী বিন সুফিয়ান ওদের পিছু নেয়া বাদ দিয়ে ছুটে এলেন আইয়ুবীর কাছে। এসেই তিনি এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, ওদের পিছু নেয়ার আর সুযোগ করে উঠতে পারলেন না।

রবিন ও মেয়েদেরকে পনেরজন সেন্ট্রির পাহারায় কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বন্দীরা চলছে উটের পিঠে প্রহরীরা ঘোড়সওয়ার। স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলেছে ওরা। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে। নির্ভয়ে চলছে কাফেলা। কোন দিক থেকে শত্রুর আক্রমণের ভয় নেই। কয়েদীরা নিরস্ত্র, সাথে ছ’টা মেয়ে। ওরা পালিয়ে যাবে সে আশঙ্কাও নেই। কিন্তু প্রহরীরা জানেনা এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়োন্দা। মেয়েরাও অবলা নয়, ওদেরও সামরিক প্রশিক্ষণ রয়েছে। ওদের রূপ যৌবন, মাদকতাময় দেহ এবং যে কাউকে প্রেমের ফাঁদে জড়ানোর মত অস্ত্র রয়েছে ওদের কাছে। ওদের কমাণ্ডার মিসরী।

একটা মেয়ে তার দিকে বার বার  তাকাচ্ছে। চোখে চোখ পড়লেই হাসছে মিষ্টি করে। হৃদয় গলানো হাসি।
কমাণ্ডারের মনে তোলপাড় শুরু হল। বিশ্রামের সময় খাবার দেয়া হল। মেয়েটা খাবার ছুঁলনা। কমাণ্ডারকে জানানো হল এ কথা। কমাণ্ডার মেয়েটাকে ডেকে না খাওয়ার কারণ জানতে চাইল। মেয়েটা কিছুই বলল না, কেবল মায়াময় চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

কমাণ্ডার বললেন, ‘কি ব্যাপার, তুমি খাচ্ছো না কেন?’

মেয়েটা কাঁদকে কাঁদতে বলল, ‘আমার খালী মায়ের কথা মনে পড়ে।’

মায়ের কথা শুনে কমাণ্ডারের মনটা কেমন নরম হয়ে গেল। অনেক বুঝীয়ে শুনিয়ে খেতে পাঠাল তাকে। যাবার সময় মেয়েটা বলল, ‘কেবল আপনাকে খুশি করার জন্যই আমি এখন খাব, নইলে খাওয়ার প্রতি আমার কোন রুচি নেই।’

‘কিন্তু না খেলে যেে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে।’

তীর্যক কটাক্ষ হেনে মেয়েটা বলল, ‘আমি অসুস্থ হলে আপনার কি? আমি কি আপনার ইয়ে. . .’ বলেই লজ্জায় আরক্তিম হয়ে ওখান থেকে সরে পড়ল। মেয়েটার এই কটাক্ষ গেঁথে রইল ওর মনে।

নিশুতি রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে। আলগোছে উঠল কমাণ্ডার। মেয়েটার কাছে গিয়ে আলতো করে টোকা দিল তার গায়ে। চোখ মেলে ওকে দেখেই হাসল মেয়েটা। ওরা সরে এল নিরিবিলি জায়গায়।

মেয়েটা বলর, ‘আমি এক অসহায় তরুণী। ভঅগ্য খারাপ বলে আজ এই করুণ পরিণতি। খৃস্টান সৈন্যরা আমাকে অপহরণ করে নিয়ে তুলেছে জাহাজে। অন্য মেয়েদের সাথে জাহাজেই পরিচয় হয় আমার। তাদেরকেও অপহরণ করা হয়েছে। হঠাৎ জাহাজে আগুন লাগর। আমাদের তুলে দেয়অ হল একটা নৌকায়। নৌকা তীরে ভিড়ল। গোয়েন্দা ভেবে আমাদেরকে বন্দী করল সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সৈন্যরা।

কমাণ্ডার জানত না সুলতানকেও এ কল্পকাহিনীই শুনিয়েছে ওরা।

কমাণ্ডারকে শুধু বলা হয়েছে, ‘এরা অত্যন্ত বিপজ্জনক বন্দী। কায়রোর গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ওদের হস্তান্তর করতে হবে।’

কমাণ্ডার তাকে তার অপারগাতর কথা জানিয়ে বরর, ‘এ ব্যাপারে আমি তোমাদের কোন সাহায্য করতে পারছি না।’

মেয়েটা মাত্র তুনীর মাত্র একটা তীর ছুঁড়েছে। এখনো অনেক তীর বাকী। বলল, ‘আমি তোমার কাছে কোন সাহায্য চাইনা। তুমি সাহায্য করতে চাইলেও আমি বাঁধা দেব। জানিনা তোমাকে কেন এত ভাল লাগে। আমার জন্য তুমি কোন বিপদে পড়বে, তা আমি হতে দেবনা। আমার সমব্যাথী কেউ নেই। মেয়েরা আমার আপন কেউ নয়, পুরুষদের চিনিনা। মনে হল তোমার মনটা বড় ভাল এজন্য তোমার কাছে আমার দুঃখের কথা বলে মনটা হালকা করছি।’ যুবতি কমাণ্ডারে আরো কাছে সরে এল।

কাজ হল এতে। যুবতীর কাঁধে হাত রেখে সহানুভূতির সুরে বলল কমাণ্ডার, ‘তোমাদের জন্য আমার কষ্ট হয়। কিন্তু এ অবস্থায় তোমার জন্য আমি কিউবা করতে পারি।

আরেকটা তীর ছুঁড়ল ও। বলল, তোমাদের সুলতানকে আমার এ দুঃখের কাহিনী শুনিয়েছীলাম। ভেবেছিলাম তিনি দয়া করে আমাদের দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তিনি আমাকে তার তাবুতে ডেকে নিলেন। মদে মাতাল হয়ে সারারাত আমার দেহ নিয়ে খেলা করলেন। ও আস্ত একটা জানোয়ার। মদ খেলে সে আর মানুষ থাকে না। আমার হাড়গোড় সব ভেঙে দিয়েছে।’

কমাণ্ডারের রক্তে আগুন লাগল, জেগে উঠল তার পশু শক্তি। মিসরীয় পৌরুষ নিয়ে সমবেদনার সুরে তার গাযে, মুখে হাত বুলাতে বুলাতে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘আমাদের বলা হয়েছে আইয়ুবী একজন খাঁটি মুমিন। একজন ফেরেস্তা। মদ এবং নারীকে তিনি ঘৃণা করেন। অথচ. . . .’

মেয়েটা তার দেহের ভার কমাণ্ডারের বুকে ছেড়ে দিতে দিতে বলল, ‘আমাকে তো এখন তার কাছেই নিয়ে যাচ্ছ। বিশ্বাস না হলে রাতে দেখো আমি কোথায় থাকি? আমাকে সুলতান জেলে দেবে না, রাখবে তার নিজস্ব হারেমে। ভয়ে এখনি আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।’

এ ধরনের কথায় সুলতানের ওপর কমাণ্ডারের মন বিষিয়ে উঠছিল। কমাণ্ডার জানতো না, যুবতী গোয়োন্দারা এ হাতিয়ার দিয়েই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে। মেয়েটার প্রেমে হাবুডুব খেতে লাগর সে।

‘যদি তুমি আমাকে এ অপমানকর জীবন থেকে মুক্তি দাও, আমি চির জীবনের জন্য তোমার হয়ে যাব। আমার পিতা বিত্তশালী। আমাকে এ অপমানকর জীবন থেকে উদ্ধার করেছ জানতে পালে তিনি তোমাকে আনন্দের সাথেই গ্রহণ করবেন। চলো আমরা সাগরের ওপারে পালিয়ে যাই।’

‘কিন্তু. . . . . .’

‘শোন, কোন কিন্তু নয়। দেশে গিয়ে আমি তোমাকে বিয়ে করব। বাবা তোমায় বাড়ী দেবেন, সম্পদ দেবেন। তুমি নিশ্চিন্তে ব্যবসা করে হেসেখেলে জীবনটা পার করতে পারবে।’

কমাণ্ডার বলল, ‘কিন্তু আমি আমার ধর্মত্যাগ করতে পারব না।’

মেয়েটা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, ‘আমি আমার ধর্ম ছেড়ে দেব।’

এরপর ওরা বিয়ের পরিকল্পনা করতে লাগল। মেয়েটা বলল, ‘আমি তোমাকে বাধ্য করছিনা, ভাল করে ভেবে দেখো কি করবে। আমি শুধু একটা কথা জানতে চাই, আমি তোমাকে যেমন ভালবাসি, তুমিও তেমনটি বাস কিনা। যদি তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও, তবে কায়রো যেতে দেরী করো। একবার কায়রো গেলে তুমি আমার গন্ধও পাবে না।’

মেয়েটা সফর দীর্ঘায়িত করতে চাইছিল, কারণ পলানোর পরিকল্পনা করছিল রবিন। তিনদিনের সফল শেষ হয়ে গেলে তা সম্ভব নয়। ঘুমন্ত প্রহরীদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের হত্যা না করলে পালানো যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সময়ের। ওরা নিশ্চিন্ত না হলে ও সুযোগ পাওয়া যাবে না।

এ জন্য মেয়েটাকে কমাণ্ডারের পেছনে লাগিয়ৈচে ওরা। প্রথম সাক্ষাতেই মেয়েটা সফল। যৌবন পুষ্ট দেহটা কমাণ্ডারকে উজাড় করে দিয়েছে সে। কমাণ্ডার উচ্চপদস্থ কোন অফিসার নয়। এমন সুন্দরী যুবতী সে কখনও দেখেনি। কল্পনা দেবী তার হাতের মুঠোয়। ভুলে গেল সে কর্তব্য এবং ধর্ম।

সকালে কমাণ্ডার ঘোষণা করল, ‘পশুগুলো ক্লান্ত, আজ সফর করব না।’

ঘোষণা শুনে সবাই খুশী। ময়দানের কঠিন নিয়ম কানুনে ওরা হাঁফিয়ে উঠেছিল। কায়রো পৌঁছরর কোন তাড়া ওদের নেই।

বিশ্রাম আর গল্পগুজবে কেটে গেল দিন। কমাণ্ডারের সময় কাটল মেয়েটার কাছে।

রাত নালম। ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। মেয়েটাকে নিয়ে দূরে সরে এল কমাণ্ডার। সুখের অতলে হারিয়ে গেল দু’জনে।

ভোরে কাফেলা রওনা হল। পথ পরিবর্তন করল কমাণ্ডার। বলল, ‘এদিকে যাত্রা বিরতির জন্য সুন্দর জায়গা পাওয়া যাবে। খাওয়ার জন্য পাশের গ্রাম থেকে ডিম এবং মুরগীও আনতে পারবো।

কমাণ্ডার তাদের বিনোদনের সুযোগ দিচ্ছে ভেবে প্রহরীরা ভীষণ খুশী। কিন্তু দু’জন প্রহরী কমাণ্ডারের এসব কাজে খুশী হতে পারেনি। ওরা তাকে বলল, ‘আমরা বিপজ্জনক বন্দীদের নিয়ে যাচ্ছি। ওদের সবাই গুপ্তচর। যতশীঘ্র সম্ভব ওদেরকে সংস্থার হাতে পৌঁছে দেয়া উচিৎ। অকারণে সফর দীর্ঘ করা ঠিক হবে না।’

‘তাড়াতাড়ি পৌঁছব কি দেরীতে পৌঁছব সে দায়িত্ব আমার। এ ব্যাপারে তোমাদের না ভাবলেও চলবে। জবাবদিহী করতে হলে আমি করব।’

ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল প্রহরী দু’জন। তারপরও দু’জন আড়ালে আবডালে শলাপরামর্শ করতে লাগল।

দুপুর। দূর আকাশে একঝাঁক শুকুন উড়ছে। হয়ত লাশ আছে আশপাশে। এলাকাটা বালিয়াড়ি হলেও ছোট ভোট টিলায় মরুবৃক্ষ আছে।

কাফেলা একটা টিলায় পৌঁছল। চড়াই পেরিয়ে বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠে শুকুনের ভিড়। ওরা তাকিে দেলল প্রান্তর জুড়ে অসংখ্য লাশ। সুলতান আইয়ুবীল কমাণ্ডো বাহিনীল আক্রমণে নিহত সুদানী ফৌজ। সুদানীরা লাশ তুলে নিতে পারেনি, পালিয়ে গেছে জীবন নিয়ে। লাশের পাশে পড়ে আছে অস্ত্র। ঢাল, তলোয়ার, নেযা, বল্লম।

ময়দানের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে চলল ওরা। পড়ে থাকা অস্ত্রের দিকে জুলজুল চোখে তাকাল রবিন। কথা বলল সংগীদের সাথে।

ডান দিকে সবুজের সমারোহ। সুপেয় ঝরণা। চোখের ইশারায় কমাণ্ডারকে ডাকল মেয়েটা। এগিয়ে এল মিসরী। মেয়েটা বলল, ‘চমৎকার জায়গা, চলোনা বিশ্রাম করি।’

কাফেলাকে থামতে হুকুম দিল কমাণ্ডার। ঝরণার পাশে থামল ওরা। আরোহীরা  নেমে পড়ল উট এবং ঘোড়া থেকে। পশুগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে। রাতে থাকার জন্য তাবু খাটানো হল দুই টিলার ফাঁকে সবুজ ঘাসে ভরা প্রশস্ত মাঠে।

মরুভূমিতে নেমে এসেছে অন্ধকার রাত। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু কমাণ্ডারের চোখে ঘুম নেই। কখন মেয়েটার কাছে পৌঁছবে এ ভাবনায় অস্থির সে।

জেগে আছে মেয়েটাও। ‘আজ কমাণ্ডারকে মাতাল করতে হবে’ মনে মনে বলল ও।

নীরব রাতে প্রহরীদের নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। মিসরী উঠল। পা টিপে টিপে পৌঁছল মেয়েটার কাছে। টিলা ওপাশে চলে গেল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল অন্য টিলায়। গাছের ছায়ায় গাঢ় অন্ধকার। ওরা একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসল।

ছাউনিতে কমাণ্ডার নেই। প্রহরীরা সবাই ঘুমিয়ে আছে। কোন সেন্ট্রি নেই। এ অপূর্ব সুযোগকে কাজে লাগালো রবিন। নিঃশব্দে সংগীদের জাগাল। হামাগুড়ি দিয়ে দূরে সরে গেল একে একে সবাই।

টিলার আড়াল হয়ে দৌড়াতে লাগল ওরা। পৌঁছল লাশের কাছে। তীর ধনু এবং বর্শা নিয়ে ফিরে এল। ঘুমন্ত প্রহরীদের পাশে এসে দাঁড়াল রবিন। বর্শা তুলল মারার জন্য, অন্য চারজনও তৈরী। ঘুমের মধ্যে একসঙ্গে পাঁচজনকে শেষ করতে পারছে এ আনন্দে উদ্ভাসিত ওদের চেহারা।

নিহতদের চিৎকার সঙ্গীদের কানে পৌছার আগেই বাকীদেরও নিরস্ত্র অবস্থায়ই হত্যা করতে হবে। রবিন পেছনের দিকে তাকাল একবার। দেখল একটু দূরে ঘুমিয়ে আছে উট চালক তিনজন। কমাণ্ডারকে নিয়ে মেয়েটা সরে গেছে দূরে।

রবিন একজন সৈনিকের বুক লক্ষ্য করে বর্শা নামিয়ে আনতে শুরু করেছে, হঠাৎ একটা তীর এসে তার বুকে বিঁধে গেল। অন্য একটা তীর লাগল তার সংগীর গায়ে। ওরা কিছু বুঝে উঠার আগেই আরও দুটো তীর ওদের দুই সঙ্গীর বুকে এসে বিঁধল।

এগিয়ে এল তীর নিক্ষেপকারী সৈনিক দু’জন। কমাণ্ডারের সাথে এদেরই কথা কাটাকাটি হয়েছিল দিনের বেলা।

শুয়েছিল ওরাও। বন্দীরা ওদের পাশ দিয়ে যাবার সময় চোখ খুলে গেল একজনের। তাকিয়ে দেখল বন্দীরা পালিয়ে যাচ্ছে। ওরা একটু দূরে যেতেই পাশের জনকে জাগাল সে। ফিসফিস করে বলল, ‘ওরা পালাচ্ছে।’

‘কারা?’

‘বন্দীরা।’

‘কউ? কোন দিকে গেছে?’ দ্রুত উঠে বসল সে। প্রথম সৈনিকটি হাত ইশারায় বন্দীদের গমনপথের দিকটা দেখাল ওকে। প্রথম সৈনিকটি উঠে দাঁড়াল।  বলল, ‘চল, ওদের পিছু নিতে হবে।’

সাবধানে বন্দীদের অনুসরণ করে এগিয়ে চলল দু’জন। দেখল বন্দীরা অস্ত্র কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসছে।

টিলার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল দু’জন। বন্দীরা ঘুমন্ত প্রহরীদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হতেই এরা তীর ছুঁড়ল। ওরা পড়ে যেতেই কমাণ্ডারকে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসল সৈনিক দু’জন।

তাদের ডাক চিৎকারে জেগে উঠল মেয়েগুলো। সাথে সাথে প্রহরীরাও। মেয়েগুলো লাশের দিকে তাকাল ভয়-বিস্ফারিত নয়নে। প্রত্যেকর বুকে একটা করে তীর বিঁধে আছে।

এদের পরিকল্পনা মেয়েরা জানত। হতাশা ফুটে উঠল ওদের চেহারায়। এদিক ওদিক তাকাল ওরা। দেখল মিসরী কমাণ্ডার ও একটা মেয়ে সেখানে নেই।

যখন বন্দীদের বুকে তীর বিঁধেছে ঠিক সে মুহূর্তে পাশের টিলায় একটা খঞ্জর কমাণ্ডারের পিঠে আমূল প্রবেশ করল। টিলার উপর পড়ে রইল তার লাশ।

মেয়েটাকে নিয়ে টিলার ওপর বসেছিল কমাণ্ডার। ওরা জানতোনা তার খানিক দূরে বালিয়ানের তাঁবু। ঘোড়াগুলো একটু দূরে। মুবিকে নিয়ে এদিকে এসেছিল বালিয়ান, রক্ষীদের চোখের আড়ালে। হাতে মদের বোতল, চাদর বিছিয়ে বসল মুবিকে নিয়ে।

রাতের নীরবতা ভেঙে ভেসে এল অস্ফুট শব্দ। চমকে উঠল ওরা। উৎকর্ণ হয়ে রইল। সতর্ক পা ফেলে দু’জনে এগিয়ে গেল শব্দ লক্ষ্য করে। দেখল, গাছের নীচে দু’টো ছায়ার অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যাচ্ছে।

মুবি আরও এগিয়ে গিয়ে ওদের কথা শুনতে লাগল। মেয়েটার কথা শুনে সে স্পষ্ট বুঝতে পারল যে, এ তার সঙ্গিনীদের একজন।

কমাণ্ডারের তৎপরতা স্পষ্ট। বদামায়েশী করার জন্য অসহায় মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে।

পিছিয়ে এল সে। বালিয়ানকে বলল, ‘লোকটা মিসরী। আমার সঙ্গীনী একটা মেয়েকে ভোগ করার জন্য নিয়ে এসেছে। একে রক্ষা কর। মিসরী তোমায় শত্রু, মেয়েটা বন্ধু। ও আমারচে বেশী সুন্দরী। ওকে এনে তোমার হারেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধী কর।’

বালিয়ান মদ পান করছিল, মুবির কথায় উঠে দাঁড়াল। খাপ থেকে খঞ্জর বের করে শিকারী বেড়ালের মত পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল। কমাণ্ডার কিছু বুঝে উঠার আগেই তার পিঠে আমূল বসিয়ে দিল খঞ্জর। টেনে নিয়ে আবার আঘাত করল।

আকস্মিক এ আক্রমণে ভয় পেয়ে মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। ওকে দূর থেকে ডাকল মুবি। ও ছুটে গিয়ে মুবিকে জড়িয়ে ধরল।

‘অন্যরা কোথায়?’ মুবির প্রশ্ন।

সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে বলল মেয়েটা। বলল, ‘ওরা এখন পনরজন সৈনিকের পাহারায় রয়েছে।’

বালিয়ান দৌড়ে গিয়ে সংগীদের ডেকে নিয়ে এল। সাথে অস্ত্র। কমাণ্ডারকে ডাকতে ডাকতে এদিকে এগুচ্ছিল এক প্রহরী। বালিয়ানের এক সংগী তীর মেরে তাকে হত্যা করল। মেয়েটা ওদের নিয়ে এগিয়ে চলল ক্যাম্পাসের দিকে।

টিলার নীচে আলো জ্বলছে। বালিয়ান টিলার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখল মাটিতে গাঁথা লাঠির মাথায় দুটো মশাল। প্রহরীরা লাশগুলো ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েগুলো জড়ো হয়ে আছে পাশে। তা দেখে মুবি এবং মেয়েটা কাঁদকে লাগল।

বালিয়ান সঙ্গীদের বলল, ‘তীর ছোঁড়।’

একসঙ্গে দু’টো তীর নিক্ষিপ্ত হল। লুটিয়ে পড়ল দু’জন প্রহরী। ওরা তখনও বুঝে উঠতে পারছে না কি ঘটছে, আরো দু’টা তীরে পড়ে গেল আরো দু’জন সৈনিক। একজনের দেহে বিঁধল তিনটে তীর।

উট চালকরা অন্ধাকারে লুকিয়ে পড়ল। মুবি মেয়েদের কাছে ছুটে এল। হঠাৎ ওদের কানে ভেসে এল অশ্বক্ষুরের শব্দ।

‘এখানে আর দেরী করা যাবে না।’ বালিয়ান বলল, ‘ওদের একজন পালিয়ে যাচ্ছে কায়রোর দিকে। এখুনি আমাদের পালানো উচিত।’

প্রহরীদের ঘোড়াগুলো নিয়ে নিজের ক্যাম্পের দিকে চলল বালিয়ান। তার একটা ঘোড়া নেই। আহত মিসরী সিপাইটি এদের ঘোড়া নিয়েই পালিয়েছে। নিজের ঘোড়া পর্যন্ত যেতে পারেনি সে।

চৌদ্দটি ঘোড়ার পিঠে জিন চাপানো হল। মালামাল চাপাল দুটার পিঠে। রওনা হল কাফেলা।

মেয়েরা মুবিকে সব ঘটনা খুলে বলল। কিন্তু রবিনদের মৃত্যুর রহস্য বলতে পারল না। মুবি বলল, ‘আইয়ুবীর ক্যাম্পে রবিনের সাক্ষাৎ যেমন অযাচিত ভাবে পেয়েছিলাম, তোমাদেরও পেলাম তেমনি আকস্মিকভাবে। এতে বলব না, পবিত্র যীশু আমাদের সফল করবেন। যে কাজেই আমরা হাত দিয়েছি, ব্যর্থ হয়েছি। রোম উপসাগরের পাড়ে আমাদের সৈন্যরা পরাজিত হয়েছে। মিসরে পরাজিত হয়েছে আমাদের বন্ধু সুদানী ফৌজ। রবিনের মত লোক নিহত হল। জানিনা কি হবে আমাদের পরিণতি। মনে হয় যীশু আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট।’

‘আমি বেঁচে থাকতে তোমাদের গায়ে কেউ হাত তুলতে পারবে না।’ বালিয়ান বলল, ‘আমার সিংহদের কাজ কি দেখনি?’

রোম উপসাগরের তীরে এসে লাগল একটি নৌকা। নেমে এল তিনজন লোক, পায়ে পায়ে এগিয়ে চলর মুসলিম সেনা ক্যাম্পের দিকে। কথা বলছে ইটালীর ভাষায়।

ক্যাম্পে পৌঁছল ওরা। ওদের কথা শুনে ইটালীর খৃস্টান বন্দীদের ডেকে আনা হল। ওরা বলল, ‘এরা ইটালী থেকে এসেছে হরিয়ে যাওয়া বোনের খোঁজ। সেনাপতির সাথে দেখা করতে চাইছে।’

ক্যাম্পের অধিনায়ক বাহাউদ্দিন শাদ্দাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হল ওদের।

তিনজনের একজন আধ বয়েসী, দু’জন যুবক। দোভাষী বলল, ‘ওদের যুবতী বোনকে খৃস্টান সৈন্যরা তুলে নিয়ে এসেছে। এরা শুনেছে ওদের বোনেরা এখন আইয়ুবীর ক্যাম্পে আছে। বোনদের খোঁজে সাগর পাড়ি দিয়ে এদ্দুর এসেছে এরা।’

তাদের বলা হল মেয়েরা এসেছে তিনজন নয় সাতজন। সাবাই গুপ্তচর। তিনজনই বলল, ‘আমরা গরীব। গুপ্তচরীর সাথে আমাদের বোনদের কোন সম্পর্ক নেই। সাতজনকে আমরা জানিনা। আমাদের বোনদের খোঁজে আমরা এসেছি।

শাদ্দাদ বললেন, ‘যে সাতজন আমাদের কাছে এসেছে, তার মধ্য থেকে পালিয়ে গেছে একজন। বাকী ছ’জনকে আজই কায়রো পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমরা বরং ওখানে যাও। আমাদের সুলতান ভাল মানুষ।

‘বিশ্বাস করুন, আমাদের বোনেরা গোয়েন্দা নয়। আপনারা যাদের পেয়েছেন তারা গোয়োন্দা হলে ওরা আমাদে বোন নয়। আমাদের হতভাগী বোনেরা তাহলে হয়ত সাগরে ডুবে মরেছে। না হয় খৃস্টানদের কাছেই আছে।’

শাদ্দাদের মনটা ছিল নরম। তিনজন গ্রাম্য লোকের দুঃখে তিনিও ব্যথিত হলেন। খাতির যত্ন করে বিদায় করলেন ওদের। চলে গেল ওরা। কোথায় গেল কেউ জানল না।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা নিরাপদ এলাকায় পৌঁছল। এক পাহাড়ের কোলে আঠারজন কমাণ্ডো ওদর জন্য অপেক্ষা করছিল।

তিনজনের মধ্যে বয়সী লোকটি সেগনামা মারইউস। এসেছে মেয়েদের মুক্ত করতে এবং সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করতে। সাগর থেকে পাহাড়ের ভেতর দিকে চলে গেছে এক সংকীর্ণ চ্যানেল। পাড়ে নেমে ওখানে নৌকা লুকিয়ে রেখেছিল ওরা।

ওরা কায়রো যাবে, কিন্তু কোন বাহন নেই। ক্যাম্পের ঘোড়া চুরি করাও সহজ নয়। সুর্য ওঠার এখনও অনেক দেরী, ওরা হাঁটা ধরল। পথে কোন সওয়ারী পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে। বন্দীদের পথেই ধরতে হবে, তা না হলে কায়রো গিয়ে ওদের মুক্ত করা কঠিন হবে।

মৃত্যু হাতে নিয়েই ওরা অভিযানে এসেছে। সফল হলে পুরস্কার পাবে। তা দিয়ে জীবন ভর বসে বসে খেতে পারবে। তিরিশ বছর মেয়াদের জেল খাটছিল মেগনামা মারইউস। ডাকাতির আসামী। আরো একটা কেস ছিল খুনের। ওটার রায় বেরোলে তার ফাঁসি হয়ে যেতো।

তার সাথের দু’জনের শাস্তি ছিল চব্বিশ বছরে। কারাগারের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য ওরা মৃত্যু কামনা করত। এদের শাস্তি মওকুফ করে এ অভিযানে পাঠানো হয়েছে।

এক পাদ্রীর হাতে শপথ করেছে ওরা। পাদ্রী বলেছেন, যত মুসলমান হত্যা করবে, ঈশ্বর তার দশগুণ পাপ মোচন করবেন। সালাহউদ্দীনকে হত্যা করলে ক্ষমা করা হবে সারা জীবনের পাপ। পরকালে পবিত্র যীশুর সাথে একসঙ্গে স্বর্গে থাকবে।

জেল থেকে মুক্তি আর স্বর্গপ্রাপ্তি ও পুরস্কারের লোভে ওরা এসেছে এ দলে। ওদের ভেতর ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা।
জীবন বাজি রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা। হয়ত আইয়ুবীকে হত্যা করবে, নয়তো জীবন বিলিয়ে দেবে। বাকী আঠারজন পরাজিত বাহিনীর সেনা সদস্য। ওদের হৃদয়ে জ্বলছিল প্রতিশোদের আগুন। প্রজ্বলিত আবেগ নিয়ে ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল কায়রোর দিকে।

দ্বিপ্রহর। সুলতান আইয়ুবীর হেডকোয়ার্টারের সামনে এসে থামল এক ঘোড়সওয়ার। ঘোড়ার গা ঘামে জবজবে। ক্লান্তিতে আরোহীর মুখে কথা সরছেনা। নেমে পড়ল আরোহী। কেঁপে উঠল ঘোড়ার শরীর। মাটিতে পড়ে মরে গেল ঘোড়াটা, টানা দেড় দিন একনাগাড়ে দৌড়িয়েছে। এর মধ্যে পেটে দানাপানি পড়েনি, বিশ্রামও জুটেনি কপালে।

সুলতান আইয়ুবীর রক্ষীরা সওয়ারকে ঘিরে ধরল। পানি পান করাল। কথা বলার উপযুক্ত হতেই বলল, ‘কোন সালার অথবা কমাণ্ডারের সাথে দেখা করব।’

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী নিজে বেরিয়ে এলেন। আগন্তুক দাঁড়িয়ে সালাম করে বলর, ‘আমি একটা দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি।’

সুলতান তাকে ভেতরে নিয়ে বললেন, ‘এবার বল।’

‘বন্দী মেয়েরা পালিয়ে গেছে। আমােদরও সবাই নিহত। আমি আহত, তবে কোনরকমে আমি বেঁচে গেছি। ওদের পুরুষ বন্দীদের আমরা হত্যা করেছি। আক্রমণকারী কে জানিনা। আমরা ছিলাম মশালের আলোয়। আক্রমণকারী অন্ধকার থেকে তীর ছুড়েছে।’

সুলতান একজন কমাণ্ডার এবং গোয়োন্দা অফিসারকে ডেকে আনালেন। বললেন, ‘ও কি বলছে শোন।’

সিপাইটি ঘটনা শোনাল। বলল, ‘বন্দী মেয়ের সাথে কমাণ্ডারের সম্পর্কের কথা।’

আইয়ুবী বললেন, ‘তার মানে মিসরেও তাদের কমাণ্ডো বাহিনী রয়েছে।’

‘হতে পারে।’ আলী বললেন, ‘আবার মরু ডাকাত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এমন সুন্দরী যুবতীতো ওদের জন্য মহা মূল্যবান।’

‘ওর কথা মন দিয়ে শোননি তুমি। বন্দীরা লাশের অস্ত্র তুলে এনে আক্রমণ করেছিল ঘুমন্ত প্রহরীদের। আমাদের যে দু’জন প্রহরী এটা দেখেছেন তারা তীর মেরে ওদের হত্যা করার পরপরই আক্রান্ত হয়েছে আমাদের প্রহরীরা। এতে মনে হয় কমাণ্ডো বাহিনী ওদের অনুসরণ করছিল।’

মহামান্য সুলতান, এ মুহূর্তে ওদের ধাওয়া করার জন্য বিশটি ঘোড়া এবং এই সৈনিককে প্রয়োজন। আক্রমণ কে করেছে পরে দেখা যাবে।’ বলল এক কমাণ্ডার।

‘আমার একজন সহকারীকে সাথে পাঠাব।’ আলী বললেন, ‘একে খাবার দাও। খাওয়ার পর ও বিশ্রাম করবে। প্রয়োজনে বিশের অধিক ঘোড়া নিতে পার।’

আগন্তুক বলল, ‘আমি যেখান থেকে ঘোড়া নিয়েছি ওখানে ঘোড়াটা বাঁধা ছিল, কিন্তু কোন লোক ছিল না। সম্ভবতঃ ওরাই আক্রমণকারী। ওখানে আমি আটটি ঘোড়া দেখেছি। নিশ্চয়ই ওরা আটজন ছিল।’

‘কমাণ্ডো বাহিনীতে বেশী লোক থাকেনা। ইনশাআল্লা আমরা ওদের গ্রেফতার করতে পারব।’ কমাণ্ডার বলল।’

‘মনে রেখো ওরা কমাণ্ডো বাহিনী।’ সুলতান বললেন, ‘মেয়েগুলো গোয়েন্দা। ওদের একজন সৈন্য অথবা একটা মেয়েকে ধরতে পারলে মনে করবে দু’শ শত্রু সৈন্য পাকড়াও করেছ। এক নারী কারো তেমন ক্ষতি করতে পারেনা। কিন্তু এক গুপ্তচর মেয়ে একটা দেশ এবং জাতি ধ্বংস করে দিতে পারে। ওরা অত্যন্ত বিপজ্জনক। একবার মিসরে ঢুকে গেলে গোটা সেবানাহিনী অকর্মণ্য হয়ে পড়বে।

সুলতান আরো বললেন, ‘একজন পুরুষ বা মেয়ে গেয়েন্দাকে ধরার জন্য আমি একশত সিপাই কোরবানী দিতে প্রস্তুত। কমাণ্ডোরা ধরা না পড়লে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যে কোন মূল্যেই হোক মেয়েগুলোকে গ্রেপ্তার করতে হবে। জীবিত ধরতে না পারলে তীর মেরে শেষ কর দিও।’

এক ঘন্টা পর বিশজন দুঃসাহসী সৈনিক রওয়ানা হল। পথ দেখাচ্ছিল পালিয়ে আসা প্রহরী। কমাণ্ডার আলী বিন সুফিয়ানের সহকারী জাহেদীন। বিশজনের একজন ছিল ফখরুল মিসরী। আলী জানতো না ওরা মুবি এবং বালিয়ানকেই ধাওয়া করতে যাচ্ছে।

কাফেলার একুশতম ব্যক্তি কমাণ্ডার যাচ্ছেন মেয়েদের পাকড়াও করতে। ওদিকে খৃস্টান কাফেলার একুশতম ব্যক্তিও কমাণ্ডার। তার উদ্দেশ্য মেয়েদেরকে মুক্ত করা। এরা যাচ্ছিল পায়ে হেঁটে। যাদের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে তারা, তাদের কারো জানা ছিল না, দু’দলের কে কোথায় আছে।

এখনো সূর্য ডুবেনি। অনেকদূর এগিয়ে এসেছে খৃস্টান কাফেলা। সামনে চড়াই। উপরে উঠল ওরা। দূরে প্রশস্ত মাঠ, মাঠ পেরিয়ে মরুদ্যান। খেজুর গাছ ছাড়াও বিভিন্ন বৃক্ষে ঘেরা। অনেকগুলো উট দেখা যাচ্ছে। ওদের পিঠ থেকে মাল নামানো হচ্ছে। ঘোড়া রয়েছে বারচৌদ্দটি।

পরস্পরের দিকে তালাক ওরা। যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। এখন ওদের ঘোড়ার ভীষণ প্রয়োজন।

কমাণ্ডার কাফেলা থামাল। বলল, ‘আমরা ক্রুশে হাত রেখে সত্যিকার শপথ নিয়েছিলাম। দেখলে তো ক্রুশের মহিমা। ঈশ্বর আকাশ থেকে এ সওয়ার পাঠিয়েছেন। ঈশ্বরপুত্র তোমাদের সাহায্যের জন্য নেমে এসেছেন আকাশ থেকে।

ক্লান্তির চিহ্ন মুছে গেল ওদের চেহারা থেকে। এখনো চিন্তা করছে না এগুলো হাত করবে কিভাবে?

শ’খানেক উট সেবানাহিনীল জন্য রেশন নিয়ে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে শত্রুর ভয় নেই, এজন্য পাহারা তেমন জোরালো নয়। দশজন ঘোড়সওয়ার পাঠানো হয়েছে। উট চালকরা নিরস্ত্র।

ডাকাতরা ছোটখাট কাফেলা লুট করলেও সামরিক কনভয় আক্রমণ করেনা কখনো। আগেও এভাবে সামরিক ঘাঁটির জন্য রসদ পাঠানো হয়েছে। নির্ভয়ে চলছে রসদবাহী কাফেলা। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে।

খৃস্টান কমাণ্ডার অভিযাত্রীদের নিয়ে গেল পাহাড়ের আড়ালে। বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত ওরা। আবেগ এবং সাহসেরও অভাব নেই। গভীর রাতে দু’জন গিয়ে দেখে এল। ঘুমিয়ে আছে রসদবাহী কাফেলা। সশস্ত্র মাত্র দশজন।

ভের হওয়ার সামান্য আগে রওনা দিল ওরা। সাবধানে এগিয়ে গেল। ঘুমন্ত দশজন প্রহরীকে হত্যা করল। কোচম্যানরা বুঝতেই পারলনা কি হচ্ছে। চিৎকার দিল কেউ, সে চিৎকার থেমে গেল তরবারীর আঘাতে।

ভয় পাইয়ৈ দেয়ার জন্য খৃস্টানরাও চিৎকার করতে লাগর। জেগে উঠল সব কোচওয়ান। শুরু হল হত্যাজজ্ঞ। কমাণ্ডার গলা চড়িয়ে বলল, ‘এগুলো মুসলিম বাহিনীর রেশন। নিশ্চিহ্ন করে দাও। মেরে ফেল উটগুলি। উটচালকদের হত্যা কর।’

খৃষ্টানরা নির্বিচারে তরবারী চালাতে লাগল। বারোটা ঘোড়া দখল করল কমাণ্ডার। ভোরের আলো ফুটল। উট এবং মানুষের লাশে ভরে গেছে মাঠ। কেউ কেউ তড়পাচ্ছে এখনো। পালিয়ে গেছে কেউ। প্রতিরোধ করার মত কেউ নেই।

ঘোড়া নিয়ে সরে পড়ল খৃস্টান অভিযাত্রীরা। ওদের বাহনের প্রয়োজন মিটেছে। এখন ওরা ছুটে চলছে পরবর্তী শিকারের উদ্দেশ্যে।

বালিয়ানের সমগ্র সত্ত্বায় জড়িয়ে আছে মুবি। মদ বিকল করে রেখেছে স্নায়ুগুলো। এখন তার কাছে  সাত সাতটা রূপসী যুবতী। ভুলে গেছে বিপদের কথা।

মুবি বার বার বলছে, ‘কোথাও বিশ্রাম নেয়া ঠিক নয়। তাড়াতাড়ি সাগর তীরে পৌঁছার চেষ্টা কর। আমাদের পেছনে শত্রু ধেয়ে আসছে।’

কিন্তু কে শোনে কার কথা। নিঃশঙ্কচিত্ত মহারাজা সে। হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে মুবির কথা।

মেয়েদের মুক্ত করার পরের রাতে এক জাগয়ায় বিশ্রাম করছিল ওরা। বালিয়ান মুবিকে বলল, ‘তোমরা সাত যুবতী। আমরা সাতজন পুরুষ। দেখেছো আমার বন্ধুরা কত বিশ্বাসী। আজ ওদের পুরষ্কার দিব। আজ আমার ছয় বন্ধুর সাথে থাকবে তোমার ছয় বান্ধবী। তুমি থাকবে আমার সাথে। আজ আমরা আনন্দ করব।’

‘অসম্ভব!’ ক্রোধকম্পিত কণ্ঠে বলল মুবি, ‘আমরা বাজারের মেয়ে নই। ওরা তোমার কোনা বাদী নয় যে, যা ইচ্ছে তা করবে। বাধ্য হয়ে আমি তোমাকে দেহ দিয়েছি। এরা কারো ভোগর সামগ্রী হবে না।’

‘আনন্দ তুমি একাই লুটবে তা তো হয়না সুন্দরী। তোমার বান্ধবীদেরও কিছু ভাগ দাও।’ বালিয়ানের কণ্ঠে তরল রসিকতা।

‘বালিয়ান, তুমি ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ।’ রাগে ফেটে পড়ছে মুবি।

‘তোমরা কতটুকু ভদ্র তা জানা আছে আমার। আমাদের জন্য তো মরা দেহের উপঢৌকন নিয়ে এসেছ। এরা কতজনের শয্যা-সংগী হয়েছে তার হিসেব দিতে পারো? তোমরা কেউ মেরী নও, এ কথা কে না জানে।’

‘কর্তব্য পালন করতে গিয়ে আমরা দেহের উপঢৌকন পেশ করেছি, ভোগের সামগ্রী হওয়ার জন্য পুরুষদের সংগ দেইনি। আমাদের জাতি, ধর্ম আমাদের ওপর এক গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছে। সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা দেহ, যৌবন, রূপলাবণ্য এবং সতীত্বকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি। আমরা দেহ দিয়েছি আমাদের ওপর অর্পিত কর্তব্য ও দায়িত্বের অংশ হিসেবে, ভোগের জন্য নয়। এখন তুমি যা বলছ তা ভোগ বিলাস ছাড়া কিছুই নয়। যেদিন আমরা ভোগ বিলাসে জড়িয়ে পড়ব সেদিন থেকে শুরু হবে খৃস্টানদের পতন। ক্রুশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

‘মুবি, আমার বন্ধুরা জীবন পণ করে ক্রুশের জন্য লড়ছে। ওদের উজ্জীবিত করা তোমাদের দায়িত্ব।’

‘ট্রেনিং দেয়ার সময় আমাদের বলা হয়েছে, এক মুসলিম নেতাকে করায়ত্ত করার জন্য দশ জনের শয্যাসংগী হওয়া শুধু বৈধ নয় বরং পুণ্যের কাজ। মুসলমান ধর্মীয় গুরুকে দেহ দান করাকে আমরা সেরা পূণ্য মনে করি।’

‘তাহলে তুমি খৃস্টানদের  স্বার্থে আমাকে ব্যবহার করছ?’

‘কেন, এখনো সন্দেহ আছে?’

‘কিন্তু আমি তো খৃস্টান নই।’

‘তা নও। কিন্তু খৃস্টানদের সাথে তোমাদের বন্ধুত্বকে কি অস্বীকার করবে? বলতো খৃস্টানদের সাথে তোমাদের এ বন্ধুত্ব কেন?’

‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য, খৃস্টানদের রক্ষার জন্য নয়। আমি মুসলমান কিন্তু প্রথমে একজন সুদানী।’

‘আর আমি সর্বপ্রথম একজন খৃস্টান। এর পর যে দেশের জন্ম নিয়েছি সে দেশের সন্তান।’

বালিয়ানের হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে মুবি বলল, ‘শোন, ইসলাম কোন ধর্ম নয়, এজন্য তুমি দেশকে প্রাধান্য দিচ্ছ। আমার সাথে চল সাগরের ওপারে। দেখবে আমাদের মহান ধর্ম। তখন নিজের ধর্মকে ভুলে যাবে।

‘যে ধর্ম নিজের মেয়েদের অন্যের শয্যাসংগী হওয়াকে পূণ্যের কাজ মনে করে, সে ধর্মকে শত ধিক।’ আচম্বিত জেগে উঠল বালিয়ানের ঈমানী চেতনা। ‘তুমি নিজের সতীত্ব হারাওনি- আমার ইজ্জত লুণ্ঠন করেছ। আমি নই, তুমিই আমায় ভোগ করেছ।’

‘এক মুসলমানের ঈমান ক্রয় করার জন্য সতীত্ব এমন বড় কিছু নয়। আমি তোমার ইজ্জত লুণ্ঠন করিনি, তোমার ঈমান কিনে নিয়েছি। তোমাকে এ অবস্থায় পথে ছেড়ে যাব না। নিয়ে যাব ঝলমলে আলোর কাছে। তোমার ভবিষ্যত এবং পরকাল হিরার মত উজ্জল হয়ে উঠবে।’

‘আমি তোমার সে আলোর কাছে যাব না।’

‘দেখো বালিয়ান, পুরুষ যোদ্ধা। ওরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না। তুমি আমার পণ্য গ্রহণ করেছ। আমি তোমার ঈমান সুরার পাত্রে ডুবিয়ে দিয়েছি। তোমার ঈমান ক্রয়ের জন্য আমি দিয়েছি চড়া মুল্য। তোমার বাঁদী হয়ে, রক্ষিতা হয়ে থেকেছি আমি। হয় আমার সতীত্ব ফিরিয়ে দাও, নয় তোমার ঈমান দাও। তুমি এ ক্রম-বিক্রয় থেকে মুখ ফেরাতে পার না। প্রতারণা করতে পার না এক দুর্বল মেয়ের সাথে।’

‘যে আলো সাগরে ওপারে দেখাতে চাইছ তা এখানেই দেখিয়েছ। আমি দেখতে পাচ্ছি হিরকের মত জ্বলজ্বল করছে আমার ভবিষ্যত।’

মুবি কিছু বলতে যাচ্ছিল, গর্জে উঠল বালিয়ান, ‘খামোশ বদমাশ মেয়ে! সালাহউদ্দীন আইয়ুবী আমার দুশমন হতে পারে কিন্তু আমি রাসূলের দুশমন নই। যে নবীর জন্য আমি সমগ্র মিসর এবং সুদান বিলিয়ে দিতে পারি সে পবিত্র নামের স্বার্থে আমি আইয়ুবীর কাছেও অস্ত্র সমর্পণ করতে প্রস্তুত।’

‘কতবার বলেছি, মদ কম খাও। অত্যাধিক মদপান, রাত জাগা এবং প্রতিদিন আমার সাথে এইসব করে তোমার মাথাটাই বিগড়ে গেছে। আমি যে তোমার স্ত্রী তাও ভুলে গেছো?’

‘আমি এক বেশ্যার স্বামী নই।’

মদের বোতল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল বালিয়ান। বন্ধুদের ডাকতেই ওরা ছুঁটে এল।

‘এ মেয়েরা এখন তোমাদের বন্দী। ওদের কায়রো ফিরিয়ে নিয়ে চল।’

‘কায়রো?’ একজনের হতচকিত প্রশ্ন, ‘আপনি কায়রো ফিরে যেতে চাইছেন?’

‘হ্যাঁ, কায়রো। হতবাক হচ্ছ কেন? এ মরুভূমিতে আর কতকাল ঘুরে মরব? যাও, জলদি ঘোড়া তৈরী কর, আর প্রতিটি ঘোড়ার পিঠে একটি করে মেয়ে বেঁধে দাও।’

বালিয়ানের তাঁবু থেকে আধমাইল দূরে থাকতেই থেমে গেল খৃষ্টান কমাণ্ডার। বিশ্রাম নেয়ার চমৎকার এলাকা। আশপাশে আরো কেউ তাবুঁ ফেলেছে কিনা খোঁজ নেয়ার জন্য রাতে তিনজন উষ্ট্রারোহীকে পাঠিয়ে দিল। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ হয়, উট চলে নিঃশব্দে। তিন আরোহী ছড়িয়ে গেল তিনদিকে।

বালিয়ান যখন মুবির সাথে কথা বলছিল, একটা উট এসে দাঁড়িয়েছিল পেছনে। বালিয়াড়ির আড়ালে। দূর থেকে মশালের আলো দেখে এগিয়ে এসেছিল আরোহী। উটের পিঠে বসে সে মেয়েদের দেখতে পাচ্ছিল। গল্প করছে বালিয়ানের সাথে। দূরে কটা ঘোড়া বাঁধা।

উষ্ট্রারোহী ফিরে এল সংগীদের কাছে। বলল, ‘শিকার তোমাদের পাশেই রয়েছে।’

সময় নষ্ট করল না কমাণ্ডার। হেঁটে রওনা হল। ওরা যখন পৌঁছল বালিয়ান তখন মেয়েদের বেঁধে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছে।

সংগীরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তার দিকে। নেতার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তর্ক জুড়ে দিল ওরা। সময় নষ্ট হতে লাগল। বালিয়ান অনেক কষ্টে বোঝাল যে, কায়রো গেলেই ওদের ভাল হবে।

বিস্ফারিত চোখে বালিয়ানে দিকে তাকাচ্ছিল মেয়েরা। ঘোড়ার পিঠে জিন চড়িয়ে ওরা মেয়েদের ধরে ফেলল।

আচমকা আক্রমণ হল। সুলতান আইয়ুবীর ফৌজ ভেবে বালিয়ান চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আমরা অস্ত্র সমর্পণ করব। মেয়েদের কায়রো নিয়ে যাব।’

একটা খঞ্জর এসে বুকে বিঁধল তার। নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল বালিয়ান চিরদিনের জন্য। তার সংগীরা এত লোকের মোকাবেলা করতে পারল না। নিহত হল সবাই। মুক্ত হল মেয়েরা। কমাণ্ডারকে চিনতে পেরে খুশীতে উদ্বেলিত হয়ে উঠল মুবি। রাতে কাফেলার চারপাশে দাঁড় করানো হল সশস্ত্র সেন্ট্রি।

সুলতান আইয়ুবীর পাঠানো সওয়াররা এখান থেকে অনেক দূরে। রাতেও পথ চলছিল ওরা। সময় নষ্ট করতে চাইল না কেউ। সাথে পথ প্রদর্শক। পথ ভোলেনি সে।

কাফেলাকে সে আক্রমণের স্থানে নিয়ে গেল। মশাল জ্বেলে দেখাল শৃগাল শকুনের আঁধ খাওয়া রবিন এবং অন্যদের লাশ।

সওয়ারীদের দেখে শেয়াল পালিয়ে গেল। রক্ষীদের লাশ একত্রিত করে দ্রুত দাফন সারল কমাণ্ডার। এরপর ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন ধরে এগিয়ে চলল। রাতে ট্র্যাক পেতে কষ্ট হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে ছাউনি ফেলা হল ওখানে।

খৃস্টানদের সবাই জেগে আছে। ওরা আনন্দিত। ভোরেই বেলাভূমির পথ ধরার সিদ্ধান্ত নিল খৃস্টান কমাণ্ডার। মেগনামা মারইউস বলল, ‘এখনো উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বেঁচে আছে সালাহউদ্দীন।’

কমাণ্ডার বলল, ‘মেয়েদের অনুসরণ করে কায়রো পৌঁছতে পারলে তা সম্ভব হত।’

‘কায়রো অনেক দূর। এজন্য এ পরিকল্পনা বাতিল।’

‘মৃত্যু ছাড়া এ পরিকল্পনা কেউ বাতিল করতে পারবে না।’ মেগনামার ঝাঝালো কণ্ঠ। ‘আমরা ক্রুশ ছুঁয়ে তাকে হত্যা করার জন্য শপথ করেছি। কেউ না গেলে আমি একা যাব। শুধু একটা মেয়ে এবং একজন সংগী প্রয়োজন।’

‘কি করতে হবে সে সিদ্ধান্ত আমি দেব।’কমাণ্ডার বলল, ‘তোমাদের কর্তব্য হল আমার নির্দেশ পালন করা।’

‘আমি কারও হুকুম পালন করতে বাধ্য নই। আমরা সবাই ঈশ্বরের আজ্ঞাবহ।’

কমাণ্ডার তাকে ধমকাতে লাগল। মেগনামা মারইউস তরবারী কোষমুক্ত করে কমাণ্ডারের মাথার ওপর তুলতেই অন্যরা মাঝখানে এসে দাঁড়াল।

‘আমি পাপী, অভিশপ্ত। পাপ এবং অবিচারের মাঝে ধুঁকে ধুঁকে মরছিলাম। তোরা কি জান আমার ত্রিশ বছরের শাস্তি কেন হয়েছিল?

পাঁচ বছর পূর্বে আমর এক যুবতী বোনকে অপহরণ করা হয়েছিল। ষোড়শী। আমি দরীদ্র। পিতা নেই, মা অন্ধ। সন্তানরা অবুঝ শিশু। গতর খেটে জীবিকা নির্বাহ করি। গির্জায় যীশুর মূর্তির কাছে অনেক দিন প্রশ্ন করেছিলাম, কেন আমি গরীব? কোন পাপ তো আমি করেনি! আন্তরিকতার সাথে পরিশ্রম করেও কেন ভূখা থাকি। আমার মা কেন অন্ধ? যীশু কোন জবাব দেননি। বোন অপহরণ হবার পর গির্জায় গিয়েছিলাম। মা মেরিকে প্রশ্ন করেছি, আমার বোনের ওপর তুমি এত ক্রুদ্ধ কেন! ও তো নিষ্পাপ। ওকে রূপ দিয়ে ঈশ্বরই জুলুম করেছেন। যীশুর মত মেরিও কোন জবাব দেয়নি।

একদিন এক আমীরের চাকর বলল, ‘তোমার বোন এক আমীরের ঘরে। আমীরটা বদমাশ। সুন্দরী মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। কয়েকদিন আমোদ স্ফুর্তি করে। স্বাদ ফুরিয়ে গেলে গায়েব করে দেয়।

তার উঠাবসা রাজা বাদশার সাথে। মানুষ তাকে সমীহ করে, আইন তার হাতে বন্দী। আমি তার কাছে আমার বোনকে ফেরৎ চাইলাম। গলা ধাক্কা দিয়ে মহল থেকে বের করে দিল আমাকে। আবার গির্জায় গেলাম। যীশু এবং মেরীর মূর্তির সামনে কাঁদলাম। ঈশ্বরকে ডাকলাম। কেউ সাড়া দিল না। আমি গির্জায় একা ছিলাম। পাদ্রী এল, বের করে দিল ঘাড় ধাক্কা দিয়ে। বলল, ‘এখান থেকে মূর্তি চুরি হয়েছে। ভাগ, নইলে পুলিশের হাতে তুলে দেব।’

আমি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘এটা কি ঈশ্বরের ঘর নয়?’

সে বলল, ‘আমার কাছে না বলে ঈশ্বরের ঘরে আসার সাহস তোকে কে দিয়েছে? পাপের স্খলন চাইলে আমার কাছে আয়। পাপের বর্ণনা দে। আমি ঈশ্বরকে বললে তিনি তোকে ক্ষমা করে দেবেন। তুই সরাসরি ঈশ্বরে সাথে কোন কথা বলতে পারিস না। ভাগ এখান থেকে।’ বন্ধুরা! এরপর খোদার ঘর থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হল।

তার বলার ভংগীতে  মরু রাতের নিথর প্রকৃতি বিষন্নতায় ছেয়ে যাচ্ছিল। মেয়েদের চোখ ফেটে বেরিয়ে আসছিল অশ্রু। প্রতিটি যাত্রী মোহাবিষ্টের মত শুনছিল তার বেদনার্ত করুণ বর্ণনা।

ও বলছিল, ‘আমি পাদ্রীকে অবিশ্বাস করলাম। সন্দেহ জাগল যীশু, মরিয়ম এবং অদৃশ্য ঈশ্বরের প্রতি। বাড়ী ফিরে এলাম। আমার অন্ধ মায়ের প্রশ্ন, ‘আমার মেয়ে আসে নি বাবা?’

স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় আমার বোন?’

যীশু মেরীর নির্বাক ছবির মত দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। কিন্তু আমার ভেতর তৈরী হচ্ছিল এক ঝড়। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। সারাদিন ঘুরলাম উদ্দেশ্যহীন ভাবে। সন্ধ্যায় একটা খঞ্জর নিয়ে সাগর পাড় ধরে হাঁটতে লাগলাম। রাতের আঁধারে ছেয়ে গেল প্রকৃতি। অপেক্ষা করলাম। আরো গভীর হল রাত। যে বাড়িতে আমার বোন, সেদিকে চললাম। চলে এলাম মহলের পেছনে। সাধাসিধে মানুষ হলেও একটা বুদ্ধি এল। পেছনের দরজা দিয়ে ভতরে ঢুকে পড়লাম। একটা কক্ষে হৈ-হুল্লোড় চলছিল। সম্ভবত সুরার আসর। আমি অন্য একটি কক্ষে ঢুকলাম। একটা চাকর আমাকে বাঁধা দিল। খঞ্জর তার বুকে ঠেকিয়ে বোনের নাম বলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সে কোথায়?’

সে আমাকে সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিয়ে গেল। একটা কক্ষ দেখিয়ে বলল, ‘এখানে।’

আমি দ্রুত রুমে প্রবেশ করলাম। শিকল টানার শব্দে চকিতে পিছনে ফিরে দেখলাম দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কক্ষ শূণ্য। কেউ নেই।

খানিক পর দরজা খুলল। এক সংগে অনেকে ভেতরে ঢুকল। ওদের কাছে তরবারী এবং লাঠি। আমি কক্ষের জিনিসপত্র তছনছ করতে লাগলাম, অনেক ভাঙলাম।

ওরা আমাকে ধরে পিটাতে লাগল। এক সময় আমি অজ্ঞান হয়ে গোলাম। জ্ঞান ফিরতে দেখি আমার হাত পা শক্ত করে বাঁধা। আমার বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগ আনা হল। সাথে রাজার দরবারীর বাড়ীর আসবাবপত্র নষ্ট করা এবং হত্যার উদ্দেশ্যে তিনজকে আহত করা।

কেউ আমার কথা শুনল না। ত্রিশ বছরের শাস্তি দিয়ে কারাগারের জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হল। পাঁচ বছর শেষ হয়েছে। আমি এখন মানুষের মধ্যে নেই। তোমরা ‘কারা নির্যাতন’ দেখনি। দিনে জানোয়ারের মত খাটাতে হয়, রাতে কুকুরের মত গলায় শিকল পরিয়ে এক কক্ষে আটকে রাখা হয়। জানিনা আমার অন্ধ মা বেঁচে আছে কিনা। স্ত্রী সন্তান কোথায় তাও জানা নেই। আমি এক বিপজ্জনক ডাকাত। এ জন্য কাউকে আমার সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি।

সব সময় ভাবতাম ঈশ্বর সত্য না আমি সত্য। শুনেছি খোদা নিষ্পাপদের শাস্তি দেন না। তিনি আমায় কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন? কি অপরাধ করেছিল আমার অবোধ শিশুরা?

পাঁচ বছর মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগেছি। কিছুদিন পূর্বে কারাগারে এলেন দু’জন ফৌজি অফিসার। বিশেষ কাজের জন্য লোক খুঁজছেন। আমি রাজা বাদশার ব্যক্তিগত যুদ্ধে নিজকে জড়াতে চাইনি। রাজার প্রতি আমার আকর্ণষ নেই। কিন্তু যখন শুনলাম ক’জন মেয়েকে মুসলমানদের বন্দীখানা থেকে মুক্ত করতে হবে, বোনের কথা মনে পড়ল আমার।

আমাদের বলা হল মুসলামনরা ঘৃণ্য জাতি। সিদ্ধান্ত নিলাম মেয়েদের মুক্ত করব। তাহলে ঈশ্বর যদি সত্য হন আমার বোনকে জালেম খ্রীষ্টানের কব্জা থেকে মুক্তি দিবেন।

ফৌজি অফিসার পুরস্কারের বিনিময়ে একজন মুসলমান রাজাকে হত্যা করার কথা বলল। আমি রাজি হলাম। বলল, ‘টাকার পরিমাণ এমন হতে হবে যাতে আমার পরিবারকে ভাবতে না হয়।’

ওরা কথা দিল। বলল, ‘তুমি সাগরের ওপারে নিহত হলে সরকার তোমার পরিবারের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেবেন।’

এরপর মারইউস দু’জন লোককে দেখিয়ে বলল, ‘এরাও আমার সাথে কারাগারে ছিল। এ দলে শরীক হতে রাজি হল ওরাও। অনেক প্রশ্ন করা হল আমাদের। জবাবে আশ্বস্ত করলাম। বললাম, আপন ধর্ম এবং জাতির সাথে প্রতারণা করব না। আসলে পরিবারের ভরণ পোষণের জন্যই আমার জীবন আমি বিক্রি করে দিয়েছি।

কারাগার থেকে বের করে এক পাদ্রীর কাছে নেয়া হল। তিনি বললনে, ‘একজন মুসলমানকে হত্যা করলে জীবনের সব পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে। মেয়েদেরকে মুক্ত করতে পারলে স্বর্গ নিশ্চিত।’

পাদ্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খোদা কোথায় থাকেন?’

তার জবাব আমার মনঃপুত হয়নি। ক্রুশে হাত রেখে শপথ নেয়ার পর ছাড়া পেলাম। বাড়ী গেলাম। ওরা আমার পরিবারকে প্রচুর অর্থ সম্পদ দিল। আমি চিন্তামুক্ত হলাম। বন্ধুরা; আমার শপথ পূর্ণ করতে দাও। দেখতে চাই খোদা কোথায় আছেন? একজন মুসলামন বাদশাকে হত্যা করলে কি আমি খোদাকে দেখতে পাব?’

‘তুমি একটা পাগল।’ কমাণ্ডার বলল, ‘এতক্ষণ যা বলেছ তা নিরেট পাগলের প্রলাপ।’

‘ও অনেক মূল্যবান কথা বলেছে।’ একজন বলল, ‘আমি তার সাথে থাকবো।’

‘আমার একটা মেয়ে প্রয়োজন।’ মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বরল মারইউস। ‘ওর জীবন এবং ইজ্জত রক্ষার দায়িত্ব আমার। মেয়ে ছাড়া আইয়ুবী পর্যন্ত পৌঁছা যাবে না। আসার সময় থেকে তার সাথে একা দেখঅ করার কথা ভাবছি।’

মুবি দাঁড়াল। মারইউসের পাশে গিয়ে বলল, ‘আমি ওর সঙ্গে যাব।’

‘তোমাকে অনেক কষ্টে মুক্ত করেছি।’ কমাণ্ডার বলর, ‘এমন বিপজ্জনক অভিযানে যাবার অনুমতি আমি তোমাকে দেব না।’

‘আমি সতীত্ব হারিয়েছি। এর প্রতিশোধ আমি নেব। আইয়ুবীর শোবার ঘরে ঢোকা আমার জন্য সহজ। মুসলামন যত ক্ষমতাবানই হোক, সুন্দরী নারী দেখলে ওদের মাথা ঘুরে যায়। ও কল্পনাও করতে পারবে না, আমি হব তার জীবনের শেষ নারী।’

অনেক তর্কবিতর্কের পর মারইউস একজন সংগী এবং মুবিকে নিয়ে যাবার জন্য তৈরী হল। সবাই প্রার্থনা করল তাদের সাফল্যের জন্য।

রওয়ানা হল তিনজনের কাফেলা। সাথে দুটো উট। একটাতে মুবি, অন্যটাতে দু’জন পুরুষ।

ওদের কাছে ছিল মিসরের দিরহাম এবং স্বর্ণমূদ্রা। পরণে জুব্বা। মারইউসের দীর্ঘ গাড়ি। অত্যাধিক পরিশ্রমে শরীরের রং কিছুটা কালো। দেখলে ইটালীর লোক মনে হয়না, ইইরোপীয় বলে সান্দেহ করবে যে কেউ। কিন্তু সমস্যা ছিল একটি, আরবী জানত না মারইউস। মুবি এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি মিসরে ভাষায় পারদর্শী।

রাতে রওয়ানা হল ওরা। মুবির পরিচিত পথ। ওড়নায় মুখ ঢেকে রেখেছে ও।

ভোরে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই পাওয়া গেল ট্র্যাক। ঘোড়ার পায়ের পরিচিত চিহ্ন। অনেকগুলো ঘোড়া গেছে এ পথে।

খৃস্টানদের কাফেলা দ্রুত চলছিল। মাঝ রাত পর্যন্ত থামেনি খৃস্টানরা। সামান্য বিশ্রাম নিয়ে ভোর রাতে আবার যাত্রা শুরু করেছে।

মারইউস ঘোড়া নেয়নি। উট দীর্ঘপথের ক্লান্তি সইতে পারে। না খেয়ে থাকতে পারে অনেকক্ষণ।

ট্র্যাক না পাওয়ায় রাতে পথ চলতে পারেনি মুসলমানরা। দিনের বেলা তই যতদূর সম্ভব দ্রুত ছুটছিল। সূর্য ডোবার এখনও সামান্য বাকী, সামনে দেখা গেল লাশের সারি।

বালিয়ানকে চিনতে পারল আলী বিন সুফিয়ানের সহকারী। পাহাড়ী জন্তু তার সংগীদের লাশের বেশীর ভাগ গোশত খেয়ে ফেললেও তার চেহারা ছিল অক্ষত। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল ওরা। বুঝতে পারছিল না কি হয়েছে। রক্ত বলছে বেশী দিন আগে নিহত হয়নি। বিদ্রোহের দিন মৃত্যু হলে রক্তের দাগ থাকত না।

ট্রাক ধরে আবার এগিয়ে চলল কাফেলা। আধমাইল পর উটের পায়ের চিহ্নও দেখা গেল। সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলল ওরা।

সামনে উঁচুনীচু টিলা। এঁকে বেঁকে চলে গেছে পাহাড়ী পথ। অন্য কোন রাস্তা নেই। এ পথেই গেছে খৃষ্টান কাফেলা।

পাহাড় শ্রেণী পেরিয়ে এল ধাওয়াকারীরা। সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে বাধ্য হয়ে ওদের থামতে হল।

ভোরেই রওয়ানা হল আবার। খানিক চলার পর সাগরের নির্মল বাতারের স্পর্শ পেল ওরা দেহে। বুঝল, সাগরের কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। কিন্তু খৃস্টানদের দেখা যাচ্ছে না এখনো।

এক জায়গায় দেখা গেল খাবারের উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে। রাতে এখানে কেউ বিশ্রাম করেছে।

ট্র্যাক ধরে আবার ঘোড়া ছুটল। সূর্য মাথার ওপর থেকে সামান্য নুয়ে পড়েছে। ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দেয় হল খানিক। রওয়ানা হল আবার। সাগরের বাতাস জোরালো হচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে কাফেলা। চোখের সামনে ভেসে উঠল সাগর পাড়ের টিলা আর বালিয়াড়ি।

ট্র্যাক দেখে মনে হচ্ছে অনেকগুলো ঘোড়া এগিয়ে গেছে। টিলার প্রায় কাছে এসে পড়েছে ওরা। টিলার ওপর দু’জন লোক। এদিকেই তাকিয়ে আছে। ওদের দেখে দ্রুত বেলাভূমিতে নেমে গেল লোক দু’টি।

ঘোড়ার গতি আরও তীব্র হল। থামতে হল পাহাড়ের কাছে এসে। ওপাশে যাওয়ার কয়েকটি পথ। একজনকে পাঠানো হল পথ দেখার জন্য।

পাহাড়ের ওপর উঠে এর লোকটি। শুয়ে সামনে তাকাল। পেছনের সরে এসে সংগীদের ইশারা করল। ঘোড়া থেকে নেমে উপড়ে উঠে এল সবাই।

কমাণ্ডার সবার সামনে। বেলাভূমির দিকে তাকিয়ে একজনর দেখেই দ্রুত সরে এল সংগীদের কাছে। হুকুম দিল দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার।

ওপাশ থেকে ভেসে আসছিল ঘোড়ার হ্রোষা ধ্বনি। এখানেই সাগর থেকে একটা খাল ভেতরে ঢুকেছে। খৃষ্টানরা লুকিয়ে রাখা নৌকায় উঠছিল। অনেক বড়ো নৌকা। মেয়েরা উঠে পড়েছে। উঠছে বাকীরাও। ঘোড়াগুলো ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

হঠাৎ তীর বৃষ্টি শুরু হল। কমাণ্ডার সকলকে হত্যা না করে জীবন্ত ধরতে চাচ্ছিল। লাফিয়ে যারা নৌকায় চড়তে পেরেছিল তারা দাড় টানতে শুরু করল। যারা উঠতে পারল না তারা তীরের আঘাতে নিহত হল।

চওড়া খাল বেয়ে নৌকা চলছে। কমাণ্ডার ওদের ভয় দেখাল, কিন্তু নৌকা থামল না। তীর বৃষ্টি হল একবার, দু’বার, তিনবার। নৌকা লাশে ভরে গেল। ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকা কিনারে এসে ঠেকল। ধরে ফেলল সওয়াররা। কেউ বেঁচে নেই। কারো গায়ে দু’টো তীরও লেগেছে।

নৌকা বেঁধে কাফেলা এগিয়ে চলল ছাউনির দিকে। সাগর পারের সেনা ছাউনি এখান থেকে বেশী দূরে নয়।

মিসরের এক সরাইখানায় অবস্থান করছিল মেগনামা মারইউস। সরাইখানায় দু’টো ভাগ। একভাগ সাধারণ পথচারীদের জন্য। অন্যভাগে থাকেন বড় লোক এবং আমীর ওমরার দল। ব্যবসায়ীরাও এ ভাগেই থাকেন। এখানে মদ এবং নর্তকীর ব্যবস্থা আছে। মারইউস এখানে এসে উঠল।

মুবি এখন তার স্ত্রী। সংগীটি বিশ্বস্ত চাকর। মুবির অনবদ্য রূপ সরাইখানায় মারইউসের মর্যাদা বাড়িয়ে দিল। এমন সুন্দরী স্ত্রী যার ঘরে সে নিশ্চয় অনেক বড়লোক। সরাইখানার লোকেরা তার বিশেষ যত্ন নিতে লাগল।

নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিল মুবি। ওদের কাছ থেকে সুলতান আইয়ুবীর অফিস এবং বাড়ীর ঠিকানা জেনে নিল। সুদানীরা পরাজিত এবং সুলতান তাদের ক্ষমা করেছেন এ খবরও পেল সে। আরও শুনল সুদানী কমাণ্ডারদের হারেম এবং যুবতী শূন্য। সুলতান আইয়ুবী তাদের মধ্যে কৃষি জমি বিতরণ করছেন।

মিসরের ভাষা জানে না মারইউস। শাসকদের কাছে পৌঁছার ট্রেনিংও পায়নি সে। মানসিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত। এসেছে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে হত্যা করার বিপজ্জনক মিশন নিয়ে। তার চারপাশে থাকে সশস্ত্র প্রহরা। পাহারার দেয়াল ভেদ করে তার কাছে পৌছা সহজ নয়। কমাণ্ডার তাকে পাগল বলেছেন। বস্তুত সে পাগলই। পৃথিবীর তাবৎ নামী লোকদের হত্যাকারীদের সবাই ছিল আধ পাগল, নয়তো ছিল মানসিকভাবে বিকৃত।

মারইউসও এদেরই একজন। তার কাছে আছে একটা শক্তিশালী অস্ত্র- মুবি। আরবী ভাষা, সভ্যতা সংস্কৃতির ওপর তাকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল। ও জানত মুসলমানদের মনমানসিকতা, অভ্যাস ও চালচলন। গুপ্তচরবৃত্তি এবং অভিনয়ে পারদর্শী মুবি পুরুষ নাচাত চোখের ইশারায়। প্রয়োজনে বিবস্ত দেহ তুলে ধরত পুরুষের কাছে।

সরাইখানার বন্ধ কক্ষে কেটে গেল তিনদিন। ভেতরে তিনজন। মুবি, মারইউস এবং সংগীটি। কেউ জানেনা কি করছে ওরা। দু’টো ঘোড়া এবং কিছু কাপড় কিনেছিল সরাইখানার লোকদের মাধ্যমে। চার দিন পর বেরিয়ে এল মারইউস। সুন্দর করে আঁচড়ানো দাঁড়ি। সুদানীদের মত গাঢ় বাদামী গায়ের রং। পরনে সাধারণ জুব্বা, মাথায় পাগড়ি।

মুবির দেহ কাল বোরকায় ঢাকা। চোখ, কপাল এবং নাক উন্মুক্ত। ঠোঁটের ওপর থেকে ফিনফিনে নেকাব ঝুলানো। তার চোখ ধাঁধানো রূপে চোখ আটকে যায়। সংগীটির নগন্য পোশাক। চাকরদের মত। বাইরে এসে একটা ঘোড়ায় চাপল মারইউস, অন্যটায় মুবি। চাকরের মত তাদের পেছনে চলল সংগীটি।

জংগীর পাঠানো সৈন্যদের সাথে নিয়ে জেরুজালেম আক্রমণ করবে সালাহউদ্দীন, তার আগেই কাজ শেষ করতে চায় ওরা।
অভিযানের পূর্বে সুদানীদের জমি দিয়ে পূনর্বাসন করতে চাইছেন সুলতান। কাজে জড়িয়ে গেলে বিদ্রোহ করার সুযোগ পাবে না ওরা।

সেনাবাহীনির সংস্কার এবং পূনর্বাসনের কাজ ততোটা সহজ নয়। প্রশাসন এবং ফৌজে সুলতানের বিরোধী লোক ছিল। সুদানীরা আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুযায়ী এখনও তাদের ভেতরে প্রতিশোধের আগুণ জ্বলছে।

প্রশাসন এবং ফোজের কিছু লোক সুদানীদের পরাজয়ের চেয়ে খৃস্টানদের পাজয়ে কষ্ট পেয়েছে বেশী। ওরা ভেবেছিল সালাহউদ্দীন আইয়ুবী নিহত হবে। সৌভাগ্যোের দুয়ার খুলে যবাে ওদের জন্য।

এরা বিশ্বাসঘাতক জেনেও সুলতান এদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেননি। কখনো প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেননি। ভাল ব্যবহার করেছেন ওদের সাথে। প্রায়ই বলতেন, ‘কাউকে নিজের ঈমান বিক্রি করতে দেখলে বাঁধা দিও। তাকে বলো সে মুসলমান। তার সাথে মুসলমান বন্ধুর মত ব্যবহার করো।

কিন্তু আলীর গোয়োন্দারা নিয়মিত ওদের তৎপরতার সংবাদ পৌঁছে দিত সুলতানের কাছে।

রসদবাহী কাফেলা লুণ্ঠিত হয়েছে, প্রহরীদের হত্যা করে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বন্দীদের। এতে বোঝা যায়, সমগ্র মিসরে ওদের কমাণ্ডো বাহিনী ছড়িয়ে আছে। তাদের আশ্রয় দিচ্ছে বিশ্বাসঘাতকরা।

গোয়োন্দা বিভাগকে আরও সম্প্রসারিত এবং শক্তিশালী করার নির্দেশ দিলেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী।

মুসলিম বিশ্বকে শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তিনি। অথচ তার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে ঝড়ো হাওয়ার তাণ্ডব। এজন্য তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন। কি করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন তিনি? মুসলমানের তলোয়ারই স্বজাতির কণ্ঠে ধরা। দিন দিন বিশ্বাসঘাতকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে ছড়ানো ষড়যন্ত্রের জালে ফেঁসে যাচ্ছে ওরা। টাকা এবং নারী সব তছনছ করে দিচ্ছে।

তিনি জানতেন তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এ জন্য কখনও তাকে উৎকণ্ঠিত দেখা যায়নি। তিনি বলতেন, ‘আমার জীবন আল্লার হাতে। এ ভূখণ্ডে আমার প্রোজন না হলে তিনি তুলে নেবেন।’

এজন্য নিজকে রক্ষার জন্য তিনি চিন্তিত হননি কখনও। প্রশাসন তাঁর চারপাশে গুপ্তচর ছড়িয়ে রেখেছিল। আলী ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক, আইয়ুবীকে তিনি তার মুর্শিদ মনে করতেন।

একদিন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী অফিসার এবং কমাণ্ডারদের বিভান্ন কাজের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। হেড কোয়ার্টারের গোটে দু’টো ঘোড়া এসে থামল। আরোহীদের একজন মধ্য বয়সী পুরুষ, অন্যজন যুবতী।

ভেতরে ঢুকতে বাঁধা দিল সেন্ট্রিরা। ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল আরোহী দু’জন। যুবতী এগিয়ে এসে কমাণ্ডারকে বলল, ‘আমার পিতা। সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’

কমাণ্ডার পুরুষ আরোহীকে সুলতানের সাথে দেখা করার কারণ জিজ্ঞেস করল। না শোনার ভান করল সে।

যুবতী বলল, ‘বাবা বধীর। কানেও শোনেন না।’

‘কি জন্য দেখা করতে চাচ্ছেন?’

‘সে কথা আমরা সুলতানকে বলব।’

বাইরে পায়চারী করছিলেন আলী বিন সুফিয়ান। এগিয়ে এলেন তিনি। সালাম দিলেন। জবাব দিল যুবতী।

কমাণ্ডার বলল, ‘এরা সুলতানের সাথে দেখা করতে চাইছেন।’

আলী পুরুষটিকে সাক্ষাতের কারণ জিজ্ঞেস করলনে। যুবতী বলল, ‘আমার পিতা বধির। কানেও শোনেন না।’

‘সুলতান ভীষণ ব্যস্ত। আপনাদের সাক্ষাতের উদ্দেশ্য পুরণ হতে পারে। ছোট খাট অভিযোগগুলো সুলতানের কাছে বলার দরকার কি? এজন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে।’

‘এক নির্যাতিতা মুসলিম মেয়ের ফরিয়াদ শোনার সময় কি সুলতানের হবে না? আমার যা বলার তাকেই বলব।’

‘আমাকে বলুন। আমিই আপনাদের ফরিয়াদ সুলতানের কাছে পৌঁছে দেব। প্রয়োজন মনে করলে তিনি আপনাদের ডেকে পাঠাবেন।’

আলী ওদের নিজের কক্ষে নিয়ে গেলেন।

যুবতী বলতে লাগল, ‘উত্তর সীমান্তে আমাদের বাস। বছর দু’য়েক আগে সুদানী ফৌজ সে এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল, অন্য মেয়েদের সাথে আমিও সৈন্যদের দেখার জন্য বেরিয়ে এলাম। এক কমাণ্ডার ঘোড়া ঘুরিয়ে আমার কাছে এল। নাম এবং পরিচয় জানতে চাইল। নাম বললাম। ও আব্বাকে ডেকে আনল। আড়ালে নিয়ে কি যেন জিজ্ঞেস করল। কেউ একজন বলল সে কথা বলতে পারেনা। কমাণ্ডার ফিরে গেল।

সন্ধ্যার পর চারজন সিপাই এসে আমায় জোর করে ধরে নিয়ে গেল। কমাণ্ডারের নাম বালিয়ান। আমি তার হারেমে অন্তরীণ হলাম। ওখানে আরও চারটি মেয়ে ছিল। কামাণ্ডারকে বললাম আমাকে বিয়ে কর। কিন্তু বিয়ে ছাড়াই সে আমায় ভোগ করতে লাগল।

দু’বছর ছিলাম তার কাছে। সুদানীরা বিদ্রোহ করে পরাজিত হল। পালিয়ে গেল বালিয়ান। জানিনা মারা গেছে না বন্দী হয়েছে।

আপনার সৈন্যরা তার বাড়ীতে গিয়ে আমাদের মুক্ত করে দিল। আমি বাড়ী গেলাম। বাবা আমায় বিয়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু কেউ আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলনা। বলল, ‘আমি হারেমের বেশ্যা।’

ওখানে আমার থাকাটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল। আমরা একটা সরাইখানায় উঠেছি। শুনেছি সুলতান সুদানীদের জমি এবং বাড়ী দিচ্ছেন। বালিয়ানের রক্ষিতা বা স্ত্রী মনে করতে তিনি যদি আমাকে কিছু জমি দেন তাহলে ওখান থেকে চলে আসব। তা না  হল হয় আত্মহত্যা করব নয়তো হবো বারবনিতা।’

‘সুলতানের সাথে দেখা করা ছাড়াই যদি জমি পেয়ে যান তবে কি তাঁর সাথে সাক্ষাতের প্রয়োজন আছে?’

‘হ্যাঁ, আমার শ্রদ্ধা এবং আবেগ তাকে জানানো দরকার। আমি শুধু তাকে বলব, আপনার দেশে নারীরা পুরুষের ভোগের সামগ্রী। আমীর ওমরা এবং বিত্তশালীদের মধ্যে বিয়ের প্রথা ভেঙে গেছে। মেয়েদের ইজ্জত রক্ষা করুন। ওদের সম্মান ওদের ফিরিয়ে দিন। সুলতানকে একথা বলতে পারলে হয়ত আমি মনে শান্তি পাব।’

পুরুষ সংগীটি নির্বাক বসেছিল।

‘আপনারা অপেক্ষা করুন। মিটিং শেষ হলে আপনাদের ডেকে পাঠাব।’ বেরিয়ে গেলেন আলী।

সরাইখানায় গিয়ে ওদের কক্ষ তল্লাশী নিলেন তিনি। লোকদের জিজ্ঞেস করে জানলেন ওরা স্বামী-স্ত্রী। ওরা কি কি কিনেছে তাও তাকে বলা হল। আলী নিশ্চিত হলেন, এরা খৃস্টানদের গুপ্তচর।

ফিরে এসে চাকরটাকে বন্দী করে জেরা শুরু করলেন। জেরার জবাবে সে বলল, ‘মেয়েটা মুবি। পুরুষ সংগীটির নাম মেগনামা মারইউস।’

আলী ফিরে এলেন মুবিদের কাছে। বললেন, ‘আরেকটু বসুন, আমি সুলতানের অনুমতি নিতে যাচ্ছি।’

সুলতানের কক্ষে আলীর অনেক সময় কাটল। তিনি বিস্তারিত জানালেন সুলতানকে। ফিরে এসে যুবতীকে বললেন, ‘সুলতান অনুমতি দিয়েছেন। আপনার পিতাকে নিয়ে আসুন।

আলী ওদেরকে সুলতানের কক্ষ দেখিয়ে দিলেন।

‘ধন্যবাদ’ বলে ওরা প্রবেশ করল ভেতরে। ঢোকার আগে চারদিক নজর বুলিয়ে বাইরেটা দেখে নিল ভাল করে।

ওরা ভেতরে ঢুকলে সুলতান ওদের বসালেন। হাসিমুখে বললেন, ‘বলুন, আপনাদের জন্য কি করতে পারি।’

কক্ষে সুলতান একা। যুবতীকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার পিতা কি জন্ম থেকেই বধির?’

সুলতান বসেননি, কক্ষে পায়চারি করতে করতে বললেন, তোমাদের অভিযোগ আমি শুনেছি। আমি তোমাদের ব্যাথায় সমান ভাবে ব্যথিত। তোমাদেরকে জমি এবং বাড়ী দেয়া হবে। শুনলাম তুমি নাকি আরো কিছু বলতে চাইছ।’

‘দীর্ঘজীবী হোন সুলতান! নিশ্চয়ই শুনেছেন কেউ আমাকে বিয়ে করতে চাইছে না। আমাকে বলছে হারেমের বেশ্যা। বাবাকে বলছে মেয়ে বিক্রেতা! জমি এবং বাড়ী তো দেবেন। কিন্তু শূণ্য বাড়ী দিয়ে আমি কি করবো? আমার কি এমন লোকের প্রয়োজন নয়, যে আমার ইজ্জতের হেফাজত করবে?

একটু থেমে লজ্জাজড়িত কণ্ঠে যুবতী আবার বলল, ‘মহামান্য সুলতান! জানি, আমি আপনার উপযুক্ত নই। এ প্রস্তাব করার দুঃসাহসও আমার নেই যে আপনি আমায় বিয়ে করুন। আমার রূপ যৌবনই আমার শত্রু। এ রূপ নিয়ে কোথাও একাকী জীবন কাটানো আমার জন্য নিরাপদ নয়। আপনার হারেমের বাদী হতে পারলেও আমার জীবনকে ধন্য মনে করতাম।’

মেয়েটি পুরুষ সংগীর কাঁধে একহাত এবং নিজের বুকে এক হাত রেখে সুলতানের দিকে ইশারা করল। পুরুষটি হাত জোড় করে সুলতানের সামনে এগিয়ে এল। সে বোঝাতে চাইছে, ‘সুলতান! আমার এ মেয়েটাকে গ্রহণ করুন।’

‘আমার কোন হারেম নেই। দেশের সব হারেম, পতিতাপল্লী এবং মদপান আমি বন্ধ করে দিয়েছি।’

কথা বলতে বলতে তিনি পকেট থেকে একটা মুদ্রা বের করে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। ‘আমি নারীর ইজ্জতের রক্ষক হতে চাই।’

পায়চারী করতে করতে তিনি ওদের পেছনে চলে এলেন। মুদ্রা হাত থেকে ছেড়ে দিলেন। ঝন করে শব্দ হল। পুরুষটি চমকে পেছনে তাকাল।

সুলতান দ্রুত খাপ থেকে খঞ্জর টেনে পুরুষটির ঘাড়ে ঠেকিয়ে যুবতীকে বললেন, ‘ও আমার ভাষা বোঝে না। ওকে অস্ত্র ফেলে দিতে বল। দেরী হলে তোমার দু’জনই মারা পড়বে।’

ফ্যাকাসে হয়ে গেল যুবতীর চেহারা। বলল, ‘বাবাকে ভয় দেখিয়ে আমায় হাতে নিতে চাইছেন? আমি তো স্বেচ্ছায় নিজকে আপনার কাছে সমর্পণ করতে চাইছি।’

‘যখন তুমি সাগর পারের ছাউনিতে এসেছিলে তখন আরবী জানতে না। এত শীঘ্র এ ভাষা শিখে ফেললে? ওকে অস্ত্র ফেলে দিতে বল।’

যুবতী নিজের ভাষায় পুরুষ সংগীকে অস্ত্র ফেলে দিতে বলল। জুব্বার ভেতর থেকে খঞ্জর বের করে সুলতানের হাতে তুলে দিল লোকটি। ওটা হাতে নিয়ে সুলতান পুরুষটির ঘাড় থেকে খঞ্জর সরিয়ে বললেন, ‘অন্য মেয়েরা কোথায়?’

‘আপনি ভুল করছেন সুলতান।’ কাঁপা কণ্ঠে বলল যুবতী, ‘আমার সাথে আর কোন মেয়ে নেই। আপনি কাদের কথা বলছেন?’

‘আমি অন্ধ নই মেয়ে। একবার যাকে দেখি, কখনও তার চেহারা ভুলি না। যদিও অর্ধেক চেহারা ঢেকে রেখেছ নেকাবে, তবু তোমাকে চিনতে আমার মোটও ভুল হয়নি। যে কাজের জন্য এসেছ তোমরা তুমি তার যোগ্য নও। সরাইখানায় ছিলে স্বামী-স্ত্রী, এখানে পিতা-কন্যা। গোয়েন্দাদের এত আনাড়ি হলে চলে না। তোমাদের চাকরও ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে গেছে।’

মারইউস আইয়ুবীর কথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। সুলতান কি বলছে বুঝার জন্য সে মুবির দিকে তাকিয়ে রইল। সুলতান বললেন, ‘ওকে বল, আমার জীবন খৃস্টানদের ঈশ্বরের হাতে নয়, আমার খোদার হাতে।

মুবি ইটালীর ভাষায় তাকে সুলতানের কথাটা বুঝিয়ে দিল। জবাবে সে কি বলর সুলতান তা বুঝতে পারলেন না। মুবি বলল, ‘সুলতান! ও বলছে আপনার খোদা কি অন্য কেউ, মুসলমান কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে?’

সুলতান বললেন, ‘ওকে বল মুসলামনা এক সত্য খোদাকে বিশ্বাস করে, তিনি সত্যবাদীকে ভালবাসেন। তোমরা আমাকে হত্যা করার জন্য এসেছ এ কথা আমাকে কে বলল? আমার খোদা। তোমাদের খোদা সত্য হলে এতক্ষণে তোমাদের খঞ্জর আমার বুক এফোঁড় ওফোড় করে দিত। আমার খোদা তোমাদের খঞ্জর আমার হাতে তুলে দিয়েছেন।

একটা তরবারী এবং কিছু জিনিস বের করে সুলতান বললেন, ‘এগুলো তোমাদের, সাগরের ওপার থেকে নিয়ে এসেছ। অথচ তোমারা এখানে আসার পূর্বেই এগুলো আমার হাতে এসে গেছে।’

দোভাষীর কাজ করছিল মেয়েটা। সে সুলতানের কথা মারউইসকে বুঝিয়ে দিল। আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মারইউস। বিস্ময় বিস্ফারিত চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে বলতে লাগল, ‘লোকটাকে সত্য মনে হয়। এসেছি তাকে হত্যা করতে, এখন আমার জীবন তার হাতে। মুবি, তার বুকের ভেতরে এক খোদাকে আমায় দেখাতে বল। আমি তাকে হত্যা করতে এসেছি, এ সংবাদ যে তাকে দিয়েছে সে খোদাকে আমি দেখতে চাই।’

দীর্ঘ আলাপ করার সময় সুলতানের ছিল না। দি’জনকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তাঁর মনে হর লোকটা পাগল না হলেও মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত। তিনি বন্ধুর মতো কথা বলতে লাগলেন। কি হচ্ছে দেখার জন্য ভেতরে ঢুকলেন আলী। সুলতান মৃদু হেসে বললেন, ‘কোন সমস্যা নেই আলী। খঞ্জর নিয়ে নিয়েছি।’

আলী বেরিয়ে গেল। মারইউস বলল, ‘সুলতান! আমাকে হত্যা করার পূর্বে আপনাকে আমার জীবন কাহিনী শোনাতে চাই।’

অনুমতি পেয়ে সে তার কাহিনী সুলতানকে শোনাল। খৃস্টান কাফেলার সামনে যা বলেছিল হুবহু তাই। যীশু এবং মেরির মূর্তি কথা বলেনি, গির্জায় যেতে পাদ্রীর অনুমতি প্রয়োজন, এতে তার মন ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। সে বলল, ‘মৃত্যুর পূর্বে খোদাকে এক নজর দেখতে চাই সুলতান। আমার ঈশ্বর আমার শিশুদের অনাহারে মেরেছে। আমার মাকে অন্ধ করেছে। একমাত্র যুবতী বোনকে তুলে দিয়েছে মদ্যপ জানোয়াের হাতে। বিনা অপরাধে আমাকে দিয়েছে ত্রিশ বছরের কারাদণ্ড। আমার ফাঁসির জন্য আমার নামে মিথ্যা খুনের দোষ চাপানোর সুযোগ দিয়েছে আমার শত্রুকে। মৃত্যুর মুখোমুখি করে ওখান থেকে বের করে এনেছে আপনাকে হতা করার জন্য। সুলতান, এখন আপনার হাতে আমার জীবন। আমাকে সত্য খোদা দেখান। তার কাছে আমার নালিশ জানাবো, ন্যায় বিচার চাইব আমি তার কাছে।’

‘তোমার জীবন আমার হাতে নয়, আমার খোদার হাতে। এতক্ষণে তুমি থাকতে জল্লাদের কাছে। আমি তোায় সে কহ্য খোদাকে দেখাব যিনি তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন।

অভিভুত হয়ে সুলতানের কথা শুনছিল মারইউস। তিনি বললনে, ‘আমার খোদাকে গ্রহণ করতে হয় খাঁটি মনে। অন্তর পরিচ্ছন্ন না হলে তিনি তার ফরিয়াদ শোনবেন কেন? তুমি ন্যায়বিচার চাইলে আগে নিজের অন্তর পরিষ্কার কর।’

সুলতান খঞ্জর ছুঁড়ে দিলেন তার দিকে। তার সামনে গিয়ে পেছনে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মুবি! ওকে বল, আমার জীবন তার হাতে তুলে দিলাম। এ খঞ্জর আমার পিঠে বিদ্ধ করুক।’

খঞ্জর হাতে তুলে নিল মেগনামা মারইউস। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখল। তাকাল সুলতানের পিঠের দিকে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর চলে এল সুলতানের সামনে। খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সুলতানকে। চোখে চোখ রাখল। কেঁপে গেল তার হাত। সত্য খোদাকে দেখছে ও।

হাটু গেড়ে সুলতানের পায়ের কাছে খঞ্জর রাখল মারইউস। চুমো খেল সুলাতানের হাতে। তার চোখ ফেটে বেরিয়ে এল অশ্রুর বন্যা। মুবির দিকে তাকিে বলল, ‘এই কি খোদা! নাকি খোদাকে এ বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছেন। তার খোদাকে দেখাতে বল।’

সুলতান দুবাহু ধরে তাকে তুললেন, জড়িয়ে ধরলেন বুকের সাথে। নিজের হাতে মুছে দিলেন তার অশ্রু।

মেগনামা মারইউস। এক পথহারা পথিক। মুসলামনদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তার হৃদয়ে। পরিস্থিতি তাকে তার স্বাভাবিক জীবন থেকে সরিয়ে এনে তাকে করে তুলেছিল প্রতিশোধ পরায়ন ও বিকারগ্রস্থ। তার পাগলাটে স্বভাব বা আবেগ বিপজ্জনক অভিযানে নিয়ে এসেছিল তাকে।

সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর চোখে ও নিরপরাধ। কিন্তু ছাড়তেও পারছিলেন না। কারণ তার সাথে আছে ট্রেনিংপ্রাপ্ত বিপজ্জনক ফেরারী গুপ্তচর মুবি। খৃষ্টানদের সংবাদ সুজদানীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে সে। উস্কানি দিয়েছে বিদ্রোহের জন্য। ও দেশ এবং জাতির শত্রু। আইন তাকে ক্ষমা করতে পারে না।

তাদের দু’জনকেই আলীর হাতে তুলে দেয়া হল। জবানবন্দিতে অপরাধ স্বীকার করল ওরা। স্বীকার করল রসদবাহী কাফেলা লুণ্ঠন করার কথা। প্রহরীদের হত্যা করে মেয়েদের ছাড়িয়ে নেয়ার কথাও বলল।

জিজ্ঞাসাবাদ চলল তিন দিন। এর মধ্যে মারইউসের চিন্তাধারা অনেকটা পরিচ্ছন্ন হয়েছে। আলাদা আলাদা ভাবে চলছে ওদের জিজ্ঞাসাবাদ। একবার ও জিজ্ঞেস করল, ‘মেয়েটা কোথায়?’ ওকে মুসলমান করে সুলতান কি তাকে হারেমে অন্তর্ভূক্ত করেছেন?’

‘আজ সন্ধ্যায় এর জবাব পাবে।’

সন্ধ্যায় এর জবাব পাবে।’

সন্ধ্যায় মারইউসকে এক দেয়াল ঘেরা চত্বরে নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে চাদরে ঢাকা দুটো তক্তপোষ। একদিক থেকে চাদর তুলে ফেলা হল। আতংকে বিবর্ণ হয়ে গেল মারইউসের চেহারা। একটা মুবির অন্যটায় তার সংগী। মৃত। ওদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী বললেন, ‘এদের ক্ষমা করা যায় না। মুসলিম মিল্লাতের কত ক্ষতি করেছে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।’

‘সুলতান, আমায় কেন ক্ষমা করলেন?’

‘কারণ, তুমি এসেছিলে আমাকে হত্যা করতে। ওরা এসেছে আমার জাতিসত্ত্বাকে ধ্বংস করতে। তোমার সংগী বুঝে সুঝে এ দলের সংগী হয়েছে। হত্যা করেছে অনেক লোক। তুমি শুধু আমাকে মেরেই খোদাকে দেখতে চেয়েছ। ফলে তোমায় আমি ক্ষমা করতে পারলেও ওদের ক্ষমা করার সাধ্য আমার নেই।

কিছুদিন পর। মেগনামা মারইউস এখন সাইফুল্লাহ। তাকে সুলতানের দেহরক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত করা হল। ইতিহাসে তার নাম না থাকলেও বাহাউদ্দীন শাদ্দাদের ডায়েরীতে সাইফুল্লার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। আরবী ভাষায় লিখিত এ ডায়েরী আজও অক্ষত আছে।

সাইফুল্লাহ সুলতানকে ভালবাসত প্রাণের চে’ বেশী। সুলতানের মৃত্যুর পরও সতের বছর বেঁচেছিল সাইফুল্লাহ। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর মৃত্যুর পর সে ছিল সুলতানের কবরের খাদেম।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কবর ছেড়ে সে যায়নি কোথাও। মরার আগে ওসিয়ত করে গিয়েছিল, মৃত্যুর পর যেন সুলতানের কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হয়। সে কবরস্তান আজ কালের প্রবাহে হারিয়ে গেছে, কিন্তু হারিয়ে যায়নি সুলতানের জন্য তার ভালবাসার কাহিনী।

পরবর্তী কাহিনীর জন্য পড়ুন

সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর কমাণ্ডো অভিযান

পেজঃ ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | | Multi-Page

Top