১. গাজী সালাহউদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযান

রোম উপসাগরের পাড়ে নির্দিষ্ট স্থানের আশপাশে আইয়ুবী নিজের সৈন্যদের লুকিয়ে রাখলেন। আক্রমণের এখনো কয়েকদিন বাকী। পত্রের নির্দেশ মত খৃস্টান হামলার পূর্বেই নির্দিষ্ট দিনে সুদানী ফৌজ বিদ্রোহ ঘোষণা করল। শক্তি প্রয়োগ না করে ডিপ্লোমেসী এবং সুন্দর ব্যবহার দিয়ে আইয়ুবী এ বিদ্রোহ দমন করলেন। সেনাপতির অনুপস্থিতি ছিল ওদের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।

সুদানী ফৌজ বিদ্রোহ করার দু’দিন পর নির্দিষ্ট তারিখে দেখা গেল খৃস্টানদের নৌবহর এগিয়ে আসছে। এর মধ্যে ফ্রান্স, গ্রীস, রোম এবং সিসিলির যুদ্ধ জাহাজ ছিল ১৫০টি। এসব জাহাজের মধ্যে ১২টি ছিল খুবই বিশাল। এসব জাহাজ মিসরে অবতরণকারী সৈন্য বহন করছিল।

খৃস্টানদের এ বাহীনিতে কেবল কমাণ্ডারই ছিল এক লাখ। রসদ এবং অস্ত্র বোঝাই নৌকার সংখ্যা ছিল অগণিত। জাহাজগুলি এগিয়ে আসছিল দুই সারিতে। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী নিজে মিসর বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে গেলেন এর মোকাবেলা করতে।

জাহাজ উপকূলের কাছে আসার অপেক্ষায় রইলেন তিনি। সবচে বড় জাহাজটি কিনারে এল। হঠাৎ জাহাজ লক্ষ্য করে অগ্নি গোলা নিক্ষিপ্ত হতে লাগল। কামানের গোলায় আগুন ধরে গেল পালে। আড়াল থেকে বেরিয়ে এল মুসলমানদের যুদ্ধ জাহাজ। ওদের জাহাজগুলো ছিল কাঠের তৈরী। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল সাগর বক্ষে। মনে হচ্ছিল আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিচ্ছিল সমগ্র রোম উপসাগর।

খৃস্টান জাহাজগুলো পালাতে গিয়ে পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে আগুন আরো ছড়িয়ে পরল। সৈন্যদের অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরে। যারা সাঁতরে তীরে উঠার চেষ্টা করছিল আইয়ুবীর তীরন্দাজদের নিশানা হল ওরা।

ওদিকে নুরুদ্দীন জংগী ফ্রাঙ্ক সম্রাটের রাজধানী আক্রমণ করলেন। মিসরের দিকে এগিয়ে আসা স্থলবাহিনী এ সংবাদ পেয়ে স্বদেশের দিকে ফিরে চাইল। কিন্তু সালাহউদ্দীন আউয়ুবীর সাড়াশী আক্রমণের ফলে রোম উপসাগরে সলীল সমাধি হল ওদের। এ যুদ্ধে সম্মিলিত খৃস্টান নৌশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল। আগুনে পুড়ে এবং সাগরে ডুবে নিহত হল অসংখ্য নৌ সেনা।

কমাণ্ডার এসমার্ক আত্মসমর্পণ করে সন্ধির প্রস্তাব করল। প্রচুর অর্থের বিনিময়ে তাকে মুক্তি দেয়া হর। গ্রীস এবং সিসিলির কিছু যুদ্ধ জাহাজ বেঁচে গিয়েছিল। আইয়ুবী তাদের ফিরে যাবার অনুমতি দিলেন। কিন্তু হঠাৎ সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে সব কটি জাহাজ নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেল। ১১৬৯ সনের ১৯শে ডিসেম্বর কর প্রদানের শর্তে খৃস্টানরা সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করল। বলতে গেলে এ বিজয়ের মূল কৃতিত্ব ছিল গোয়েন্দা সংস্থার।

এ ছিল দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী ক্রুসেডের প্রথম লড়াই। ইতিহাসের পাতায় খৃষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে সংঘটিত অসংখ্য লোমহর্ষক ক্রুসেডের যে কাহিনী ছড়িয়ে আছে তা আরো চমকপ্রদ, আরো ঘটনাবহুল।

ঐতিহাসিকরা বলেন, এতো কেবল মাত্র শুরু। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ক্রমেই প্রবেশ করলেন জীবনের বিপজ্জনক সব অধ্যায়ে। যে সব অধ্যায় অতিক্রম করে তিনি হয়েছিলেন গাজী সালাহউদ্দীন। তার সে বিপদজনক জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সংঘর্ষ এবং রহস্য ও রোমাঞ্চের ভয়াবহ সব জটিল ও কুটিল অধ্যায়।

খৃস্টানদের সম্মিলিত নৌশক্তি বিধ্বস্ত হয়েছে সাতদিন আগে। উপকূল ছেড়ে জাননি সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। এখনো সাগর বক্ষে ঢেউয়ের দোলায় দুলছিল দু’একটি পালছেড়া জাহাজ, মাল্লাহীন নৌকা। জ্বলন্ত জাহাজ থেকে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচতে চেয়েছে অনেক সৈন্য। ঢেউয়ের তালে ভেসে বেড়ানো জাহাজ এবং নৌকা তল্লাশীর জন্য সালাহউদ্দীন আইয়ুবী লোক লাগিয়ে দিলেন। অক্ষত নৌকা এবং জাহাজ তীরে নিয়ে আসছিল ওরা। অকেজো জাহাজ থেকে মালপত্র বের করা হচ্ছিল। বেশীর ভাগই অস্ত্র এবং খাদ্য সামগ্রী।

ঢেউয়ের আঘাতে বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ছিল অর্ধদগ্ধ অথবা মাছে খাওয়া লাশ। জাহাজের ভাঙা কাঠ আঁকড়ে সাগরে ভাসছিল কিছু জীবন্ত মানুষ। ঢেউ ওদের তীরে ঠেলে দিচ্ছিল। সমগ্র বেলাভূমিতে পাহারা দিচ্ছিল মুসলিম ফৌজ। আহত খৃস্টান সৈন্যদের কুড়িয়ে এনে চিকিৎসা করা হচ্ছিল তাদের। ঘোড়ায় চড়ে উপকূল ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন সুলতান আইয়ুবী।

ঘুরতে ঘুরতে ছাউনি থেকে দু’মাইল দুরে চলে এলেন তিনি। সামনে পার্বত্য এলাকা। পাহাড়ের একদিকে সাগর, অন্যদিকে খেজুর, নানা রকম গাছগাছালি এবং লতাগুল্ম ঘেরা প্রান্তর। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সাথে তিনজন সেনাপতি ও চারজন দেহরক্ষী।

ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন তিনি। ঘোড়ার বাগ রক্ষীদের হাতে দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। সেনাপতি তিনজনও ঘোড়া থেকে নেমে তার সঙ্গ নিল। এদেরই একজন বন্ধু বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ। যুদ্ধের একিদন আগে মাত্র তিনি এখানে এসেছেন।

শীত মওশুমের শান্ত সাগর। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এলেন তিনি। রক্ষীদের দৃষ্টির আড়ালে। সামনে পেছনে ছোট ছোট টিলা আর বালিয়াড়ি। বাঁয়ে পাহাড়। ডানে বেলাভূমির দিগন্ত বিস্তৃত বালুকারাশি। চার পাঁচ হাত উঁচু এক বালিয়াড়িতে উঠে দাঁড়ালেন আইয়ুবী। দৃষ্টি ছুঁড়লেন রোম উপসাগরের নীল জলরাশিতে। মনে হল সাগরের সব নীল জমা হয়েছে তার চোখে। বিজয়ের আনন্দে চেহারা উদ্ভাসিত। নাক কুঞ্চিত করে বললেন, ‘ভীষণ দুর্গন্ধ।’

সৈকতে আছড়ে পড়ল সব ক’টি চোখ। আকাশে ওড়াওড়ি করছে কতগুলো শকুন। ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেল ওরা। সুলতান বললনে, ‘ওখানে মড়া আছে।’

ঢিবি থেকে নেমে চারজনই সেদিকে এগিয়ে গেলেন। পনের বিশগজ দূরে এক ঝাঁক শকুন লাশের মাংস খাচ্ছে। একটা শকুন এক মড়ার মথার খুলি নিয়ে আকাশে উড়ল। কিন্তু পাঞ্চা থেকে ছুটে গেল মুণ্ডটা। পড়ল এসে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সামনে। তিনি মাথাটার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে রইলেন। মাথাটার খোলা চোখ আইয়ুবীর দিকে তাকিয়ে আছে যেন।

সালারদের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তিনি বললেন, ‘এ মাথাটা মুসলমানদের মাথা থেকে অনেক ভাল। এ মস্তিষ্কের জোরেই ওরা নারী আর মদে মাতাল করে দিচ্ছে সমগ্র মুসলিম খেলাফত।’

‘ওরা ইঁদুরের মত মুসলিম বিশ্বকে কুরে কুরে খাচ্ছে সুলতান।’ বললেন এক সেনাপতি।

আরেকজন বললেন, ‘আমাদের সম্রাটগণ ওদের নিয়মিত কর দিয়ে যাচ্ছে।’

শাদ্দাদ বললেন, ‘ফিলিস্তিন ওদের দখলে সুলতান। আমরা কি কোনদিন তা পুনরুদ্ধার করতে পারব না?’

‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা শাদ্দাদ।’

‘আল্লাহর রহমত থেকে না হলেও আমরা আমাদের ভাইদের দিক থেকে নিরাশ হয়ে পড়েছি।’

‘তুমি ঠিকই বলেছ। বাইরের আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। একবারও কি ভেবেছ, কি করে খৃস্টানদের এতবড় নৌশক্তি আমরা নিঃশেষ করে দিলাম? খোলা ময়দানে নয়, শুধু কমাণ্ডো হামলার মাধ্যমে। ওদের ফৌজ সমগ্র মিসর ধ্বস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বন্ধুরা, ভেতরের  আক্রমণ এত সহজে ঠেকানো সম্ভব হত না। ভাই আক্রমণ করলে ভাববে, সত্যিই কি ভাই আক্রমণ করেছে! যখন তার বিরুদ্ধে তরবারী তুলবে, দুশমন এ সুযোগ নেবে, নিঃশেষ করবে দু’জনকেই।’

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এগিয়ে চললেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। কিছু দূর এগিয়ে কি দেখে থমকে দাঁড়ালেন। নুয়ে মাটি থেকে জিনিসটা তুলে দেখালেন সবাইকে।

একটা ক্রুশ, তাগায় বাঁধা।

ছড়িয়ে থাকা লাশগুলোর দিকে তাকালেন আবার। আগেই সেই খুলিটা নিয়ে ঝগড়া করছে তিনটে শকুন।

দ্রুত মাথাটার কাছে গেলেন তিনি। ক্রুশটা সেই মাথার ওপর রেখে ফিরে এলেন সংগীদের কাছে। বললেন, ‘আমি এক বন্দী খৃস্টান অফিসারের সাথে কথা বলেছি। ও বলেছে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবার সময় সকলকেই ক্রুশের ওপর হাত রেখে শপথ করতে হয়। জীবন বাজি রেখে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শপথ নেয়ার পর সব সৈনিকের গলায় একটি করে ক্রুশ ঝুলিয়ে দেয়া হয়। জানিনা কুড়িয়ে পাওয়া এ ক্রুশটি কার? ক্রুশের জন্যই এরা জীবন দিয়েছে। খুলিটার ওপর ক্রুশটা রাখলাম, একজন সৈনিকের শপথের অমর্যাদা যেন না হয়।’

‘সুলতান’, শাদ্দান বললেন, ‘জেরুজালেমে খৃস্টানরা মুসলমানদের কি মর্যাদা দিচ্ছে আপনি জানেন? ওখান থেকে স্ত্রী পরিজন নিয়ে পালিে যাচ্ছে মুসলমানরা। লুন্ঠিত হচ্ছে আমাদের মেয়েদের ইজ্জত। এখনো আমাদের বন্দীদের ওরা ছেড়ে দেয়নি। মুসলমানরা ওখানে পশুর মত জীবন যাপন করছে। আমরা কি এর প্রতিশোধ নেব না?’

‘প্রতিশোধ নয় শাদ্দাদ, আমরা ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করতে চাই। কিন্তু আমাদের শাসকরাই এ পথের বড় বাঁধা। ওরা ক্রুশ স্পর্শ করে মুসলিম বিশ্বকে নিঃশেষ করার শপথ নিয়েছে, আমিও আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে বুকে হাত দিয়ে শপথ করে বলছি, অবশ্যই ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করব। কিন্তু বন্ধুরা, আমাদের ভবিষ্যত ইতিহাস আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে।

এক সময় ওরা শাসক ছিল, আমরা ছিলাম যোদ্ধা। এখন মুসলমান শাসক হচ্ছে ওরা দখল করে নিচ্ছে যুদ্ধের ময়দান। আমার মনে হয় মুসলমানরা শাসক হলেও নেতৃত্ব থাকবে খ্রীষ্টানদের হাতে। শাসক হতে পেরই ওরা সন্তুষ্ট থাকবে। আমি ফিলিস্তিন জয় করব কিন্তু ওরা তা রক্ষা করতে পারবে না। খৃস্টানদের মস্তিষ্ক অত্যন্ত উর্বর। পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজ কারা লালন করছে? আমাদের খেলাফতের পোশাকে লুকিয়ে আছে নাজির মত কালকেউটে। এরা দেশের জন্য বিপজ্জনক। আমিই প্রথম গভর্ণর যে এ সত্যটা বুঝতে পেরেছি। নাজির চিঠি আমাদের হাতে না এলে এতক্ষণে আমাদের রক্ত মিশে যেত মরুর বালুকারাশির সাথে, নয়তো হতাম ওদের হাতে বন্দী।’

আইয়ুবী আবেগাপ্লুত কণ্ঠে কথা বলে যাচ্ছেন, আকস্মাৎ পেছন থেকে শনশন শব্দে ছুলে এল একটা তীর। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর দু’পায়ের ফাঁকে বালিতে গেঁথে গেল তীরটা। আতংকিত দৃষ্টিতে পিছনে ফিরে পাহাড়ের দিকে তাকালেন সবাই। আরও তীর আসতে পারে ভেবে দৌড়ে এক পাহাড়ের আড়ালে দাঁড়ালেন।

শীষ দিলেন শাদ্দাদ। নীচে থেকে ছুটে এল রক্ষীর।

‘ঘোড়াগুলো এখানে রেখে তোমরা পাহাড়ের ওপাশে চলে যাও।’ রক্ষীদের বললেন সুলতান, ‘ওদিক থেকেই তীর এসেছে। কাউকে দেখলে গ্রেফতার করবে।’

যেদিক থেকে তীরটা ছোটে এসেছিল সাবধানে সেদিকে এগোতে শুরু করল রক্ষীরা। সেনাপতিরা দ্রুত পাহাড়ে উঠতে লাগলেন। ওদের নিষেধ উপেক্ষা করে তাদের সাথে এগিয়ে চললেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী নিজেও।

পাহাড়ে উঠে দাঁড়ালেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত পর্বতমালা। কোনটা উঁচু, কোনটা নীচু। সালারদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলেন চারদিক। জনমানুষের চিহ্নও নেই। রক্ষীরা ঘোড়া ছুটিয়ে বিভিন্ন পাহাড় খুঁজে দেখল। কেউ নেই। যেন হাওয়া থেকে ছুটে এসছে তীরট।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ফিরে এলেন তীরের কাছে। হাত লাগতেই পড়ে গেল ওটা। তীরটা হাতে নিলেন সুলতান। বললেন, ‘অনেক দূর থেকে এসেছে, এ জন্য হালকা ভাবে বিঁধেছে। তবে তীলটা গুপ্তঘাতকদের নয়, খৃষ্টানদের।’

‘সুলতানের জীবন বিপন্ন।’ বললেন এক সেনাপতি।

হেসে উঠলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী, ‘এবং সব সময় ঝুঁকিপূর্ণই থাকবে।’ বললেন তিনি। ‘খৃস্টানদের যেসব নৌকা মাঝা মাল্লা ছাড়া ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে, আমি তা দেখতে বেরিয়েছি। কিন্তু বন্ধুরা ওদের সব তীরই মাল্লাহীন নয়। ওরা আবার আসবে, আসবে ঝড়ের গতিতে। আঘাত করতে মাটির নীচ থেকে, পিছন থেকে। যুদ্ধের স্বাভাবিক নিয়মে ওদের সাথে মোকাবিলা করা যাবে না। আমি যুদ্ধ পলিসিতে এক নতুন পদ্ধতি সংযোজন করব। এ পলিসি সম্পূর্ণ আনকোরা নতুন। গেরিলা অপারেশনে আনব নতুন মাত্রা। কমাণ্ডো এবং গোয়েন্দাদেরই থাকবে এতে প্রধান ভূমিকা।

তীরটা হাতে নিয়েই ঘোড়ায় চাপলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। এগিয়ে গেলেন শিবিরের দিকে। ডানে, বাঁয়ে এবং পেছন থেকে সালাহউদ্দীন আইয়ূবীকে অনুসরণ করে এগিয়ে চললেন সেনাপতি তিনজন।

বলতে গেলে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। কিন্তু তিনি ছিলেন এ ব্যাপারে নিরুদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠাহীন। যেন কিছুই হয়নি।

তাঁবুতে ফিরে সালারদে নিয়ে বসলেন। তাদের সামনে তুলে ধরলেন গেরিলা আক্রমণ এবং কমাণ্ডো হামলার বিভিন্ন দিক। বললেন, ‘আমি আলী বিন সুফিয়ানকে শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী গঠন করার নির্দেশ দিয়েছি। তোমরা সেনাবাহিনী থেকে স্বাস্থ্যবান এবং মেধাবী যুবকদের বাছাই কর। ওরা হবে দুরদর্শী, বুদ্ধিমান। ওদের থাকবে উটের মত দীর্ঘ সময় ক্ষুধাতৃষ্ণা সহ্য করার ক্ষমতা। গতি হবে চিতাবাঘের মত ক্ষিপ্র। ঈগলের মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং খরগোশ ও হরিণের মত দ্রুতগামী হবে ওরা। এদের থাকবে সশস্ত্র শত্রুর সাথে খালি হাতে লড়াই করার ক্ষমতা, নেশা ও পরনারীর প্রতি আসক্ত হবার লোভ থেকে মুক্ত।

খৃষ্টানরা আমাদের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে চায়। সুন্দরী মেয়েদের ব্যবহার করছে গোয়েন্দা কাজে। ওরা নিঃশেষ করে দিতে চাইছে আমাদের ঈমানী আবেগ। আমি দেখছি মুসলমানরা নারীদের ব্যাপারে অত্যন্ত দুর্বল। আমি গোয়েন্দাগিরি বা অন্য কোন কাজে কোন মেয়ে ব্যবহারের পক্ষপাতি নই। আমরা নারীর ইজ্জত আব্রুর রক্ষক। নারীর ইজ্জতকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা আমাদের কাজ নয়। আলী গোয়োন্দা কাজে কয়েকটি মেয়েকে ব্যবহার করছে। ওরা না মুসলিম না খৃষ্টান। কিন্তু কোন ধর্মাধর্ম নয়, আমি নারীকে নারী হিসেবেই সম্মান করি।’

তাবুতে ঢুকল রক্ষী দলের কমাণ্ডার। বলল, ‘রক্ষীরা কয়েকজন মেয়ে ও পুরুষকে ধরে এনেছে।’

বেরিয়ে এলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। তার পিছু নিলেন তিন সেনাপতি। বারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচজন পুরুষ, সাতজন মেয়ে। মালপত্র দেখে মনে হচ্ছে ব্যবসায়ী। মেয়েগুলো অপূর্ব সুন্দরী। রক্ষীরা বলল, ‘তীর নিক্ষেপকারীকে খুঁজতে গিয়ে এদের পাওয়া গেছে। তিনটি উটসহ একটি তাবুতে অপেক্ষা করছিল ওরা।

‘এদের কি তল্লাশী নেয়া হয়েছে?’ এক সেনাপতি প্রশ্ন করলেন।

‘জ্বী, ওদের দেহ এবং মালপত্র তল্লাশী নেয়া হয়েছে। খঞ্জর ছাড়া কোন অস্ত্র পাওয়া যায়নি।’

‘আমরা মরক্কোর ব্যবসায়ী।’ ওদের একজন বলল, ‘যাব ইস্কান্দারিয়া পর্যন্ত। দু’দিন আগেআমরা যখন দশ ক্রোশ পেছনে তখন এ মেয়েগুলো আমাদের কাছে আসে। ভেজা কাপড়, বিধ্বস্ত চেহারা। বলল, বাড়ী সিসিলি। এদিকে আসার পথে এক খৃস্টান কমাণ্ডোর ওদেরকে উপকুল থেকে ধরে নিয়ে আসে। ওরা আমাদের সাহায্য চাইল। অসহায় মেয়েগুলোর জন্য মায়া হল আমাদের। সেই থেকে ওরা আমাদের সঙ্গে।’

‘এদের সম্পর্কে আর কি জান তুমি?’

‘এরা বলেছে, এরা গরীব ঘরের সন্তান। জাহাজে এনে অফিসাররা এদের সতিত্ব নষ্ট করেছে। যুদ্ধের সময় গোলার আঘাতে হঠাৎ ওদের জাহাজে আগুণ ধরে গেলে সবাই সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। সাঁতার জানেনা বলে এদেরকে একটা ছোট্ট নৌকায় তুলে দিল সৈন্যরা। এরা নৌকা বাইতে জানে না। ঢেউয়ের ধাক্কায় একসময় নৌকা কিনার স্পর্শ করল। আমরা তখন উপকূল থেকে সামান্য দূরে বিশ্রাম করছিলাম। তখনই ওরা আমাদের কাছে আসে।’

‘তারপর?’

‘প্রথমে ভেবে পেলাম না কি করব, ওদের সাথে নেয়া ঠিক হবে কিনা। পরে অসহায় ভেবে আশ্রয় দিলাম, সাথে নিয়েই এগিয়ে চললাম। পেছনের তাঁবুতে আপনার লোকেরা আমাদের তল্লাশী নিতে লাগল। কারণ জিজ্ঞেস করায় বলল, মিসরের গভর্ণর সুলতান আইয়ুবীর নির্দেশ। আমরা অনুনয় বিনয় করে বললাম, আমাদেরকে সুলতানের কাছে পৌছে দাও।’

‘কেন তোমরা সুলতানের কাছে আসতে চাইলে?’

‘এ মেয়েগুলোকে আশ্রয় দেয়ার জন্য সুলতানকে অনুরোধ করব। আমরা ব্যবসায়ী, কোথা থেকে কোথায় যাই তার তো ঠিক নেই। এদের আমরা কতক্ষণ বয়ে বেড়াবো?’

মেয়েদেরকে জিজ্ঞেস করা হল। ওরা কথা বলল, সিসিলির ভাষায়, দু’তিনজন এক সংগে। আতংকিত চোখ।

সুলতান ব্যবসায়ীদের দিকে চাইলেন।

‘তোমরা কি এদের ভাষা বোঝ?’

একজন এগিয়ে এল। ‘জ্বী, কেবলমাত্র আমিই বুঝি। ওদের আশ্রয় দেয়ার জন্য মহানুভব সুলতানকে অনুরোধ করছে ওরা। ওরা বলছে, ব্যবসায়ীদের সাথে ওরা যাবে না। চারদিকে যুদ্ধ চলছে। ভয় আছে চোর ডাকাতের। ওরা আরো বলছে, খৃস্টান সৈন্যদের ওরা ভীষণ ভয় পায়। অপহরণের সময় ওরা সবাই কুমারী ছিল। জাহাজে ওদের সতীত্ব হরণ করা হয়েছে।’

অন্য একটা মেয়ে কিছু বলল, দোভাষী বলল, ‘মেয়েটি বলছে, আমাদেরকে মুসলমানদের রাজার কাছে নিয়ে চল। হয়ত তিনি আমাদেরকে আশ্রহ দেবেন।’

অপর একটি মেয়ে কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘আমাদেরকে খৃস্টান সৈন্যদের কাছে ফিরিয়ে দিও না। আমরা মুসলমান হয়ে যাব।’ বলল আরেক মেয়ে।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা মুসলমান হয়ে যাব। কোন মুসলমান দয়া করে আমাদের বিয়ে করলে আমরা আর দেশেও ফিরে যাব না, আমরা এখানেই থেকে যাব।’ বলল আরেক মেয়ে।

তার কথা শুনে চোখে মুখে আতংক নিয়ে দু’তিনটি মেয়ে মুখ লুকানোর চেষ্টা করছিল, যেন ওরা লজ্জায় মরে যাচ্ছে।

সুলতান বললেন, ‘এদেরকে খৃস্টান সৈন্যদের কাছে তুলে দেয়া হবে না। মুসলমান হওয়ার জন্যও ওদের বাধ্য করবে না কেউ। ওরা যদি আমাকে বিশ্বাস করে মুসলিম মেয়েদের মতই ওদের আশ্রয় দেব। জেরুজালেমের খৃষ্টান ফাদার বা পাদ্রীর কাছে পাঠিয়ে দেব রাজধানীতে গিয়ে। অথবা খৃস্টানদের সাথে বন্দী বিনিময়ের সময় ওদেরকে স্বদেশ পাঠিয়ে দেয়া হবে। ওদের প্রয়োজন এবং মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখা হবে। কিন্তু কেউ বিয়ে করলে মুসলমান হবে এ প্রস্তাব গ্রহণ করা যাবেনা। এমনকি কোন মুসলমানের সাথে ওরা মিশতেও পারবে না।’

ব্যবসায়ী সুলতানের কথা মেয়েদের বুঝিয়ে বলল। স্বস্থির ভাব ফুটে উঠল ওদের চেহারায়। সুলতানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ফিরে গেল ব্যবসায়ীরা।

মেয়েদের জন্য আলাদা তাবু টানাতে বললেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। প্রয়োজনীয় প্রহরা এবং তাবুর স্থান নির্দেশ করতে না করতেই রক্ষীরা দু’জন আহত বন্দীকে নিয়ে এল। জীর্ণ বিধ্বস্ত চেহারা। রক্ত ও পানিতে ভেজা পোশাক। লাশের মত ফ্যাকাশে।

জানা গেল মাইল দেড়েক দূরে এক নৌকায় ছিল বাইশ জন লোক। এ দু’জন কোনভাবে বেঁচে গেছে, বাকী সবাই মারা পড়েছে। কিনারে এসে নৌকা ডুবে গেলে অনেক কষ্টে সাঁতরে তীরে উঠেছে ওরা।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সামনে ধপাস করে মাটিতে বরে পড়ল ওরা। ব্যাথায় কোঁকাচ্ছে।

ওদের একজনকে সধারণ সৈনিক বলে মনে হল না। কাপড়ে রক্তের দাগ নেই, তবে কাতরাচ্ছে অন্যদের চেয়ে বেশী। মাঝে মাঝে মেয়েদের দিকে মুখ বিকৃত করে তাকাচ্ছে।
একে একে সবার ওপর দৃষ্টি বুলালেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। শেষ বন্দীর দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। সেনাপতিদের দিকে ফিরিয়ে আনলেন দৃষ্টি।

‘আলী এখনও এল না! বললেন আইয়ুবী, ‘এ পর্যন্ত যতজন ধরা পড়েছে তাদের এখনি জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার।’

শেষ বন্দীর দিকে তাকালেন আবার। বললেন, ‘মনে হয় কমাণ্ডার। আলী এলে ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলবে। সম্ভবত ভেতরে হাড়গোড় ভেঙেছে।’

রক্ষীদের দিকে ফিরে বললেন, ‘এদেরকে এখনি আহত বন্দী শিবিরে পৌঁছে দাও। চিকিৎসা এবং খাওয়া দাওয়ার দিকে খেয়াল রেখো।’

বন্দীদের পৌঁছে দেওয়া হল আহত শিবিরে। মেয়েরা তাকিয়ে রইল ওদের গমন পথের দিকে।

সেনা ছাউনি থেকে একটু দূরে মেয়েদের জন্য তাবু তৈরী হচ্ছিল। তার একটু দূরেই আহত বন্দীদের তাঁবু। মেয়েরা তাদের জন্য যে তাবু বানানো হচ্ছিল তার পাশে গিয়ে বসল। তাকিয়ে রইল আহত বন্দীদের তাবুর দিকে। নির্ণিমেষ নয়নে ওরা দেখছিল নতুন বন্দীকে।

তাঁবু তৈরী হল। ওরা চলে গেল যে যার তাঁবুতে। বাইরে সশস্ত্র পাহারা। খাওয়া দাওয়ার পর তাবু থেকে বেরিয়ে এল একটি মেয়ে। তাকাতে লাগল অন্য তাবুর দিকে। ভয়শূণ্য স্বাভাবিক দৃষ্টি। সেন্ট্রি তাকাল ওর দিকে। সেন্ট্রির চোখে চোখ রেখে মিষ্টি করে হাসল মেয়েটা। ইশারায় বুঝাল ওই তাঁবুতে যেতে চায়।

মাথা নেড়ে নিষেধ করল প্রহরী। দূরে কোথাও যাওয়া নিষেধ। দু’টো তাবুর মাঝে গাছগাছালি, বাঁয়ে ঝোপ ঝাড় ভরা উঁচু বালিয়াড়ি ও ছোট ছোট পাহাড়।

সূর্য ডুবে গেছে। বোরকা পরা রাত নেমেছে আঁধার হয়ে। তাবুর ভেতরে কোলাহলের কণ্ঠ আঁকড়ে ধরেছে ক্লান্তি ও ঘুম। মরুভূমির বাতাসে রাতের স্তব্ধতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আহতদের করুণ কাৎরানি অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হচ্ছে। বাতাসে ভর করে ভেসে আসছে রোম উপসাগরের আন্দোলিত জলরাশি ও ঢেউয়ের মৃদুমন্দ ধ্বনি। প্রহরী এবং আহতরা ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে গেছে।
সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর তাবুতে আলো জ্বলছে। রক্ষীরা টহল দিচ্ছে তাবুর বাইরে। তাবুর ভেতর সেনাপতি তিনজনকে নিয়ে  বসে আছেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। চেহারায় উদ্বেগ।

‘আলী এখনও এর না! আইয়ুবীর কণ্ঠে স্পষ্ট উদ্বেগ। ‘ওখানে বিদ্রোহের সম্ভাবনা ছিল বলে আলীকে রেখে এসেছিলাম। তার খোঁজ নিতে যাকে পাঠিয়েছিলাম, সেও তো এখনও ফিরে এল না!’

‘কোন সমস্যা হলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই সংবাদ পেতাম। হয়ত ওখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক।’ বলল এক সেনাপতি।

‘আমরা তো তাই কামনা করি। কিন্তু পঞ্চাশ হাজার বিদ্রোহী সৈন্যকে সামলানো সহজ ব্যাপার নয়। ওখানে আমাদের মাত্র দেড় হাজার ঘোড়সওয়ার এবং দু’হাজার সাতশো পদাতিক সৈন্য রয়েছে। এদের তুলনায় সুদানী ফৌজ কেবল সংখ্যায়ই বিপুল নয়, অভিজ্ঞতা এবং সমরাস্ত্রেও ওরাই শক্তিশালী।

‘নাজি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের দমন করার পর ওখানে প্রকাশ্যে কেউ বিদ্রোহ করবে বলে মনে হয়না। নেতৃত্ব ছাড়া বিদ্রোহ সম্ভব নয়।’ বলল অন্য এক সেনাপতি।

‘তবুও আমাদের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ পরিস্থিতিতে কি করা যায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার।

ছাউনিতে নিশুতি রাতের ভুতুরে নীরবতা। কিন্তু মেয়ে সাতটির চোখে ঘুম নেই। পর্দা তুলে তাবুর ভেতরে উঁকি দিল প্রহরী। প্রহরীর পদশব্দে ঘুমের ভান করে পড়ে রইল মেয়েগুলো। তাবুর ভেতর প্রদীপের আলো। গুণে দেখল প্রহরী, সাতজন। পর্দা ছেড়ে সরে এল সে।

প্রকৃতির সবকিছু নিরব, নিস্তব্ধ। সবকিচু সুস্থ স্বাভাবিক। একটানা একঘেয়ে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে প্রহরী।

একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য তাবুর একপাশে হেলান দিয়ে বসল প্রহরী। তাবু ঘেঁষে শুয়েছিল যে মেয়েটা সে তার পাশের জনের কানে কানে বলল, ‘বসে পড়েছে।’ এক কান দু’কানকরে সাতজনের কাছেই পৌঁছল খবরটা। দরজার কাছে শুয়েছিল যে মেয়েটা সে এবার উঠে বসল। নিজের বিছানায় কম্বল ভাঁজ করে বিছিয়ে তার ওপর চাদর ছড়িয়ে দিল। এরপর সস্তর্পণে বেরিয়ে এল তাবু থেকে।

প্রহরী জানত এ তাবুতে কয়েকজন অসহায় মেয়ে আছে মাত্র। যাদেরকে সাগর থেকে কুড়িয়ে এনে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এদের কাছ থেকে কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই ভেবে বসে বসে ঝিমুতে লাগল সে।

বিপরীত দিক দিয়ে মেয়েটা বেরিয়ে এল তাবুর বাইরে। সতর্ক পায়ে এগিয়ে গেল টিলার দিকে। টিলার কাছে পৌঁছে আহত বন্দীদের তাঁবুর দিকে হাঁটা দিল। গাছের ফাঁকে ফাঁকে এগিয়ে যাচ্ছিল ও। প্রহরীটি এখন বেশ দূরে। ওকে আর দেখে ফেলার ভয় নেই।

তাবুর কাছাকাছি পৌঁছে একটা ঝোপের আড়ালে বসে এদিক ওদিক ভাল করে তাকিয়ে দেখল। গভীর সাবধানী দৃষ্টি। দেখল এখানকার প্রহরী তাখনো টহল দিচ্ছে। কালো একটা সচল ছায়া চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে তাবুর চারদিক। সে সচল ছায়ার ওপর আটকে রইল মেয়েটার চোখ।

এখন ও দু’সেন্ট্রির মাঝখানে মাটিতে শুয়ে আছে। প্রহরীটি হাঁটতে হাঁটতে সরে গেল তাবুর ওপাশে।

ও হামাগুড়ি দিয়ে পৌছুল তাবুর কাছে। অন্ধকাররে পর্দা একটু ফাঁক করে ঢুকে গেল তাবুর ভেতর।

ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। যন্ত্রণায় আহতদের অনেকেই ঘুমোতে পারছে না। ব্যথায় কাৎরাচ্ছে কেউ কেউ।

পর্দা ফাঁক করে কেউ একজন ভেতরে প্রবেশ করছে দেখে পাশের জন ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘কে?’

‘রবিন কোথায়! ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে ফিসফিসিয়ে বলল মেয়েটা।

‘এদিক থেকে তৃতীয়।’

মেয়েটা হাতড়ে হাতড়ে তৃতীয় ব্যক্তির পা স্পর্শ করল।

‘কে?’ বলল সে।

‘আমি মুবি।’

উঠে বসল রবিন। হাত বাড়িয়ে মুবিকে বিছানায় টেনে নিল। শুইয়ে দিল নিজের পাশে। ওর গায়ে চাদর তুলে দিতে দিতে বলল, ‘আমার সাথে লেগে থাক। প্রহরী এসে যেতে পারে।’

রবিন মুবিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ঘরে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি আশ্চর্য হচ্ছি মুবি, কিভাবে আমাদের দেখা হল! এতে বুঝা যায়, পবিত্র যিশু আমাদের সাফল্য চাইছেন। আমরা পরাজিত হয়েছি একথা ঠিক নয়।’

‘তুমি কি আহত, হাড়গোড় ভাঙ্গেনি তো!’

‘ধুর, আমার কিছু হয়নি। একটা আঁচর পর্যন্ত লাগেনি কোথাও।’

এখানে এসেছ কেন?’

‘সুদানী সেনাবাহিনীর কাছে যাব। চারদিকে মুসলিম ফৌজ। অনেক চেষ্টা করেছি, যেতে পারিনি। দেখলাম ওরা আহত বন্দীদের চিকিৎসা দিচ্ছে। আহত হওয়ার ভান করে ওদের দলে ভিড়ে গেলাম।’

‘এখন কি করবে?’

‘সুযোগ পেলেই পালিয়ে যাবো। কিন্তু এ মুহূর্তে তা সম্ভব হচ্ছে না। আইয়ুবী বড় বজ্জাত আদমী, চারদিকে ওর চোখ কান খোল।’

‘ভালই গ্যাড়াকলে আটকেছ দেখছি।’

‘টিটকারী মারবে না।’ হঠাৎ খেপে গেল রবিন, ক্রোধের সাথে বলল, ‘বলতো আইয়ুবী এখনও বেঁচে আছেন কেন? তীর কি শেষ হয়ে গিয়েছিল, না ওই বদমাশটা ভয় পেয়েছে? আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, তোমরা সাতজন একত্রে ধরা পড়লে কিভাবে? ওই পাঁচটা পাঠা কি মরে গেছে, না পালিয়েছে?’

‘ওরা সবাই বেঁচে আছে রবিন। তুমি তো বললে যিশু আমাদের বিজয় চাইছেন, আমি বলছি, ঈশ্বর আমাদের কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন। আইয়ুবী বেঁচে আছে, কারণ তীল তার গায়ে লাগেনি। তীর বিঁধেছে তার দু’পায়ের ফাঁকে, মাটিতে।’

‘কোন মেয়ে তীর ছুড়েছিল?’ রবিনের কণ্ঠে ঝাঁঝ। ‘ক্রিস্টোফার কোথায় ছিল?’

‘ও-ই তীল ছুড়েছে। কিন্তু- – – – ‘

‘ক্রিস্টোফারের তীর লাগেনি!’ রবিনের কণ্ঠে বিস্ময়। ‘লক্ষ্য ভেদের জন্য সম্রাট অগাষ্টাস নিজের তরবারি দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করছেন। এখানে এসে ছ’ফুট দীর্ঘ আর তিন ফিট চওড়া সালাহউদ্দীনের গায়ে ও তীর লাগাতে পারল না। তীর ছোড়ার সময় ভয়ে হারামিটার হাত কাঁপছিল নাকি?’

‘দুরত্ব ছিল বেশী। ক্রিস্টোফার বলেছে, তীর ছোঁড়ার সময় বাম চোখে একটা মাছি এসে বসায় লক্ষ্য স্থির থাকেনি।’

‘তারপর কি হল?’

‘যা হবার তাই। সালাহ্উদ্দীনের সাথে ছিল তিনজন সেনাপতি এবং চারজন দেহরক্ষী। ওরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ভাগ্য ভাল, পাহাড়ী এলাকা বলে বেঁচে গেছি। তীর বালির নীচে লুকিয়ে ফেলেছিলাম। সেপাইরা এলে ক্রিস্টোফার বলল, আমরা পাঁচজন মরক্কোর ব্যবসায়ী। এ মেয়েদেকে সাগর থেকে উদ্ধার করেছি। আমাদের মালপত্র তল্লাশী নেয়া হল। ব্যবসায়িক সামানাদি ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না। আমাদেরকে আইয়ুবীর সামনে নেয়া হল। বোঝালাম আমরা সিসিলি ভাষা ছাড়া কিছুই জানি না। দোভাষীর কাজ করল ক্রিস্টোফার।’

মুবি পুরো ঘটনা শোনাল রবিনকে। ব্যবসায়ীরূপী পাঁচ ব্যক্তি এবং এই সাতটি মেয়ে ছিল খৃস্টানদের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুপ্তচর। গোয়েন্দা কাজ ছাড়াও মেয়েদের দায়িত্ব ছিল মুসলিম সেনাপতি, কমাণ্ডার এবং দায়িত্বপূর্ণ লোকদের ফাঁসানো। রবিন এ গ্রুপের কমাণ্ডার।

‘তুমি আইয়ুবীকে রূপের জালে জড়াতে পারো না মুবি?’

‘কেবল তো প্রথম রাত। আমাদেরকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। বুঝতে হবে কোন পথে এগোনো যায়। আমাদের ব্যাপারে সে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে তা যদি তার মনের কথা হয়, তবে বুঝতে হবে, সে মানুষ নয়, পাথর। সে জানে আমরা অসহায়। চাইলেই সে আমাদের পেতে পারে, অথচ একজনকেও সে তার তাবুতে ডাকেনি।’

‘তাকে হত্যা করাও সহজ নয়। সব সময় সে থাকে সেনাপতি আর রক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে। মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে সশস্ত্র প্রহরী।’

‘শুনেছি ওই পাজিটা নাকি মদও স্পর্শ করে না।’

‘তোমাদের সঙ্গী পাঁচজন এখন কোথায়?’

‘ওরা কাছেই আছে। ওদের নিয়ে তুমি ভোবোনা, এরা এখানেই থাকবে।’

‘মুবি, পরাজয় আমাকে পাগল করে দিয়েছে। এর জন্য আমিই দায়ী। সকল সৈনিকই ক্রুশ হাতে নিয়ে শপথ করে। কিন্তু আমার আর তাদের শপথে আসমান জমিন ফারাক। পেছন থেকে আক্রমণ করে আমরা অর্ধেক বিজয় ছিনিয়ে আনি। কিন্তু আমরা কেউ আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি।’

গলায় ঝুলানো ক্রুশ হাতে নিয়ে রবিন বলল, ‘এ ক্রুশ আমার কাছে জবাব চাইছে। একে আমি বুক থেকে সরাতে পারিনা।’

নিজের ক্রুশ ছেড়ে রবিন মুবির জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল। ওর বুকের সাথে সেটে থাকা ক্রুশ বের করে বলল, ‘তুমি তোমার পিতা মাতাকে ধোকা দিতে পার, কিন্তু এ পবিত্র ক্রুশের সাথে প্রতারণা করতে পার না। ঈশ্বর তোমায় ক্লিওপেট্রারচে বেশী রূপ দিয়েছেন। তোমার দেহের মাদকতা, রূপের জৌলুস পাহাড় কেটে তোমার জন্য পথ খুলে দেবে। আমাদের এ অযাচিত সাক্ষাতে মনে হচ্ছে, আমরা পরাজয়ের গ্লানি থেকে বাঁচতে পারবো। আমরা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারলে আমরাই বিজয়ী হব। রোম উপসাগরের ওপারে আমাদের ফৌজ জমা হচ্ছে। যারা মরেছে, মরেছে। বেঁচে আছে যারা তাদের বিশ্বাস, প্রতারণার শিকার হয়ে আমরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি ঠিক, কিন্তু এ আমাদের চুড়ান্ত কোন পরাজয় নয়। নিজের তাবুতে ফিরে যাও। অন্য মেয়েদের বলো, তাবুতে পড়ে ঘুমানো এদের কাজ নয়। বার বার আইয়ুবীর সাথে দেখা করবে। সাক্ষাৎ করবে সেনাপতিদের সাথে। প্রেমের অভিনয় করবে। লোভ দেখাবে দেহের। যৌবনের আগুণ দিয়ে জ্বালিয়ে দেবে ওদের ঈমানের আগুন। আর একবার যদি এতে সফল হতে পার সবকিছু আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে।’

‘সবার আগে আসল ঘটনা জানতে হবে, জানতে হবে কেন এমনটি ঘটল। সুদানীরা কি আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে?’

‘নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছি না। যুদ্ধের আগে আমাদের গোয়েন্দাদের রিপোর্ট ছিল সালাহউদ্দীন আইয়ুবী মিসরের গভর্ণর এবং ফৌজের সর্বাধিনায়ক হয়ে এসেছেন। নতুন ফৌজ গঠন করছেন মিসরীদের দিয়ে। নাজির পঞ্চাশ হাজার সৈন্য সে সাথে যোগ দেয়নি। নাজি আমাদের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠায়। নাজির সে চিঠি আমি নিজে দেখেছি। তার লেখা আমি চিনি, ওটা যে তারই চিঠি ছিল এ ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু কি করে এমনটি ঘটল কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এটা যদি প্রতারণা হয় তবে বলল, ইতিহাসের সবচে জঘন্য প্রতারণা করা হয়েছে আমাদের সাথে।’

‘রবিন, অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে লাভ নেই। সবার আগে আমাদের জানতে হবে এসব কি করে হল? কে করল?’

‘মুবি, মনে করোনা এ রহস্য না জেনেই আমি এখান থেকে যাব। সম্রাট অগাষ্টাস গর্ব করে বলেছিলেন, মুসলমানদের ভেতরের খবর সংগ্রহ করে ওদের নিশ্চিহ্ন করে দেব। ভেবে দেখ মুবি, সম্রাটের হৃদয়ে এখন কি ঝড় বইছে। আমরা যা করেছি তাতে মৃত্যুদণ্ডই আমাদের প্রাপ্য। আমাদের কারণেই ক্রুশের এ বিপর্যয়। আমি ক্রুশের অভিশাপকে ভয় পাচ্ছি।’

‘আমি সব জানি রবিন। আবেগের কথা নয়, এখন কাজের কথা বল। আমাদের এখন কি করতে হবে, কোন পথে এগুবো আমরা তাই বল শুনি।’

পরাজয়ের গ্লানি রবিনের স্নায়ূগুলো বিকল করে দিয়েছিল। মুবির মত সুন্দরী যুবতী তার বুকের সাথে লেপ্টে আছে। তার রেশম কোমল চুল রবিনের গালের অর্ধেকটা ঢেকে রেখেছে। কিন্তু তার অনুভূতি যেন ভোতা হয়ে গেছে।

মুবির চুলে বিলি কেটে রবিন বলল, ‘তোমার এ মায়াময় চুলের শৃংখলে আইয়ুীকে বাঁধতে পার না! মুবি, আমি জানি তুমি একটু চেষ্টা করলেই তোমার ধ্যানভাংগা রূপ আইয়ুবীকে তোমার দাসে পরিণত করবে। তোমার প্রথম কাজ হল, ক্রিস্টোফারকে বলবে ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশেই সে যেন নাজির কাছে পৌঁছে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে। নাজি যদি আইয়ুবীর সাথে মিশে গিয়ে থাকে, আমাদের যুদ্ধের পলিসি পাল্টাতে হবে। আমি বুঝতে পারছি, সংখ্যায় কম হলেও মুসলমানদের সহজে পরাজিত করা যাবে না। আগে ওদের জোশ ও ইসলামী জযবা ধ্বংস করতে হবে। বিজয়ের জন্য এটাই প্রথম শর্ত। আর এ জন্যই আমরা তোমাদের মত রূপসী তরুণীদের দিয়ে আরবের হারেমগুলো ভরিয়ে রেখেছি। তোমরা এতে সফল না হলে আমাদের সাফল্যের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।’

আবার কথা বাড়াচ্ছো? আমরা নিজের ঘরে নয়, শত্রুর তাবুতে বসে কথা বলছি। চারপাশে কড়া প্রহরা। ওদিকে রাতও শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মিশন ধ্বংস হয়ে গেছে। এ পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করতে হবে। এ জন্য এখান থেকেই শুরু করতে হবে কাজ।’

‘হ্যাঁ, সে কাজের কথাই বলছি, সবার আগে আমাদের দরকার নাজির খবর।’

‘সংবাদ সংগ্রহ করে তোমাকে কোথায় পাব?’

‘আমি এখান থেকে পালিয়ে যাব। তাঁর আগে আইয়ুবীর ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও তার সৈন্য সংখ্যা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেব।’

‘আমারও মনে হয় সমগ্র মুসলি বিশ্বে একটা লোকই ক্রুশের জন্য বিপজ্জনক।’

‘তাই, আর এ জন্যই আইয়ুবীকে হত্যা করা জরুরী। আর ও বেঁচে থাকলে থাকবে আমাদের বন্দীশালায়।’

‘কিন্তু কিভাবে?’

‘শোন, প্রথমেই তাবুতে গিয়ে ওদের বলবে, যে করেই হোক আলী বিন  সুফিয়ানকে ফাঁসাতে হবে। আলী এবং আইয়ুবীর মাঝে তুলে দিতে হবে ঘৃণার দেয়াল। এরপর যাবে ক্রিস্টোফারের কাছে। বলবে, লক্ষ্য ভেদ না করে যে পাপ করেছ, দায়িত্ব পালন করে এবার তা মোচন করার চেষ্টা কর।’

‘ঠিক আছে রবিন। দোয়া করো যিশু যেন আমার সহায় হন।’

রবিন মুবির চুলে চুমো খেয়ে বলল, ‘ক্রুশের জন্য তোমাকে তোমার ইজ্জত বিলিয়ে দিতে হবে। তবে মনে রেখ, যিশুর কাছে তুমি থাকবে মা মেরীর মতই পবিত্র কুমারী। ইসলামের মূল উপড়ে ফেলে আমরা জেরুজালেম দখল করেছি, এবার মিসরও আমাদের হবে।’

রবিনের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল মুবি। তাবুর পর্দা ইষৎ ফাঁক করে তাকাল বাইরে। কোথাও কেউ নেই।

নিঃশব্দে বেরিয়ে এল মুবি। তাবুর সাথে সেঁটে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি বুলাল চারদিকে। দূর থেকে কারো গুনগুন শব্দ ভেসে আসছে। সম্ভবতঃ প্রহরী।

হাঁটা দিল মুবি। গাছের আড়ালে আড়ালে গা বাঁচিয়ে পৌঁছল টিলার কাছে। টিলা পার হয়ে চলতে লাগল নিজের তাবুর দিকে। তাবুর কাছাকাছি চলে এসেছে মুবি, দু’জন লোকের অনুচ্চ কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এল। থমকে দাঁড়াল মুবি, উৎকর্ণ হয়ে তাকাল সামনে। শব্দ আসছে তাবুর দিক থেকে।

ও তাবুতে নেই হয়ত ওরা জেনে গেছে, এ জন্য ডেকে এনেছে কমাণ্ডার বা অন্য কাউকে। ধরা পড়লে চলবে না।

ব্যাবসায়ীদের সংগীদের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ও। এতে অন্য মেয়েগুলো বিপদে পড়তে পারে ভেবে দাঁড়াল আবার।

কয়েক পা এগিয়ে গেল লোক দুটোর কথা শোনার জন্য। কিন্তু ও কাছে পৌঁছার আগেই কথা থামিয়ে দিয়েছে ওরা। এখন কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

একপা দু’পা করে হাঁটছে ও, হঠাৎ বায়ে শব্দ হল। চমকে সেদিকে তাকাল মুবি। গাছের একটা ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

ও টিলার কাছে ফিরে এল। উঠে দাঁড়াল টিলার ওপর। সাগর পাড়ের জোৎস্না ধোয়া রাত। এখন ওকে দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে।

ডিউটি পরিবর্তনের সময় হয়ে এসেছে। প্রহরীদের অবস্থা দেখার জন্য বেরিয়ে গেলেন কমাণ্ডার। টিলার ওপর একটা ছায়া দেখতে পেলেন। দাঁড়িয়ে পড়লেন কমাণ্ডার।

ছায়াটা তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। দু’হাত সামনে আসা চুল ঠিক করল। দেহের গঠনে মেয়ে মনে হচ্ছে। কমাণ্ডার অপেক্ষা করছেন।

জ্বীন ভূত হলে অদুশ্য হয়ে যাবে, কিন্তু ছায়াটা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগর। কমাণ্ডার বুঝে ফেললেন, এ জ্বীন নয়, মানুষ। সুলতান আইয়ুবীর সতর্কবাণী তার মনে পড়ল। তাদের বলা হয়েছে খৃস্টানরা গুপ্তচর হিসেবে মেয়েদের ব্যবহার করছে। কখনও বেদুঈন আবার কখনও ভিক্ষুক সেজে ওরা আসবে। নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে আশ্রয় চাইবে। আরও তাকে বলা হয়েছে, সুলতান সন্দেহভাজন সাতজন মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছেন। অপেক্ষা করছেন গোয়েন্দা প্রধান আলীর জন্য। তিনি এলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে।

প্রহরীদের ডিউটি পরিবর্তনের সময় কমাণ্ডার ফখরুল মিসরি তাবুর পর্দা তুলে দেখলেন সাতটা মেয়েই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কম্বল সরালে দেখা যেত সপ্তম মেয়েটা বিছানায় নেই। টিলার ওপরই যে ওই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে কমাণ্ডার তা বুঝতে পারেনি।

মেয়েটা হাঁটা শুরু করতেই কমাণ্ডার টিলার দিকে এগিয়ে গেল। বলল, ‘কে তুমি, নীচে নেমে এস।’

চঞ্চল হরিণীর মত মেয়েটা দ্রুত টিলার অন্যদিকে নেমে গেল।

কমাণ্ডার একলাফে টিলার ওপর উঠে এল। রাতের নীরবতা ভেঙ্গে তীব্রগতিতে ছুটছে মেয়েটা। তাকে ধরার জন্য তার পিছনে ছুটল কমাণ্ডার।

দু’জনের মাঝে বেশ খানিকটা দুরুত্ব। দু’জনেই ছুটছে তীব্র গতিতে। কিন্তু ফখরুল একজন সৈনিক, ছুটছে চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতা নিয়ে। অসমতল মাটি, শুকনো ঝোপঝাড় আর গাছগাছালি মাড়িয়ে নিশুতি রাতে মরুদ্যানের বুকে ছুটছে দু’জন। দূরত্ব কমে আসছে দু’জনের মাঝে। সামনে খণ্ড খণ্ড অনেকগুলো এলোপাথারি ঝোপঝাড়।

মুবি মেয়ে হলেও একজন গোয়োন্দা। শত্রুর চোখে ধুলো দেয়ার হাজারো কায়দা কানুন শিখেছে দীর্ঘদিনের অনুশীলনে। তার সে ট্রেনিং কাজে লাগানোর সময় এসেছে। দ্রুত ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করল মুবি। কমাণ্ডার কিছুদূর এগিয়ে দেখল সামনে কেউ নেই। মেয়েটার পায়ের শব্দও শোনা যাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল সে। গতি কমিয়ে অনির্দিষ্টভাবে এগিয়ে গেল সামনে।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top