৮. ফেরাউনের গুপ্তধন


সেখানকার অবস্থা জানার জন্য এবং শক্ৰদের পরিকল্পনা ও পরবর্তী পদক্ষেপের আগাম সংবাদ জানার জন্য সুলতান আইয়ুবী তিনজন ঝানু গোয়েন্দা প্রেরণ করে ছিলেন। তাদের কাজ ছিল আক্রার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য সংগ্রহ করে নূরুদ্দিন জঙ্গী ও সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌছানো। এদের কমান্ডার ছিল ইমরান নামে এক নিভীক ও বুদ্ধিমান গোয়েন্দা। এই গোয়েন্দাকে আলী বিন সুফিয়ানই বাছাই করে পাঠিয়েছিল।
এই তিনজন খুব সতর্কতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে আক্রাতে পৌছল। সুলতান আইয়ুবী সুবাক দূর্গ ও শহর জয় করায় সেখানকার অসংখ্য খৃস্টান ও ইহুদী আক্রাতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। মুসলমানরা ক্রাকের ওপর আক্রমণ চালিয়ে এই দূর্গ ও শহর যখন জয় করে নিল, তখন সেখান থেকেও ইহুদী খৃস্টানরা বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে গেল। এই দুটি বিজিত শহর ও দূর্গের আশপাশের এলাকা থেকেই ইহুদী ও খৃস্টানরা পালিয়ে গিয়েছিল।
সৈন্যদের মধ্যেও সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগের লোক ছিল। আলী বিন সুফিয়ানের নির্দেশে তাদের মধ্য থেকে কিছু গোয়েন্দা খৃস্টানদের ছদ্মবেশ নিয়ে খৃস্টান এলাকায় চলে গেল। এর মধ্যে তিনজনকে দায়িত্ব দেয়া হল, তারা যেন আক্রা থেকে শক্ৰদের যুদ্ধ প্ৰস্তৃতির সংবাদ সংগ্রহ করে কায়রোতে পাঠায়।
তাদের বলা হলো, খৃস্টান ও ক্রুসেডদের সকল গতিবিধির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখবে এবং প্রয়ােজনীয় তথ্য জরুরীভাবে পাঠানাের ব্যবস্থা করবে। অমুসলিম নিয়ন্ত্রিত ওসব অঞ্চলে মুসলিম শক্তি ও সৈন্যরা এগিয়ে গেলে সেখানকার জনগণের মধ্যে তার কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে এবং ওই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায় এসব ব্যাপারেও তাদের রিপোর্ট করতে বলা হল।
গোয়েন্দা তিনজন বাস্তুহারা খৃস্টানদের ছদ্মবেশে আক্রাতে প্রবেশ করলো। সে সময় প্রতিদিনই বাস্তুহারা খৃস্টান ও ইহুদীরা লাইন ধরে আক্রাতে প্ৰবেশ করছিল।
তাদের চেহারায় ছিল নিরাশা ও হতাশার ছাপ। এসব উদ্বাস্তু আশ্রয় প্রাথীদের নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য ছিল না। আয় উপার্জনের ব্যবস্থা ছিল না। দু’বেলা ঠিকমত খাবারও কোন সংস্থান ছিল না।
ইমরান ও তার দুই সখী খৃষ্টান সেজে সেখানে আশ্রয় প্রাথী হলো। তিনজনই খুব চালাক, সতর্ক ও শিক্ষিত ছিল।
ইমরান সোজা বড় পাদ্রীর কাছে চলে গেল। সে তার বাড়ি এমন এলাকায় বললো, যে এলাকা মুসলমানদের অধিকারে চলে গেছে। নিজেকে সে বিপন্ন ও অসহায় বলে প্ৰকাশ করলো। খৃষ্ট ধর্মের একনিষ্ঠ ভক্ত ও পাগল হিসাবে জাহির করলো নিজেকে।
সে পাদ্রীর সামনে কেঁদে কেঁদে বললো, তার বিবি বাচ্চারা সবাই মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছে। তার এখন আর কোন-পিছু টান নেই। বিবি বাচ্চার জন্য পেরেশানী নেই। সে বলল, বাকি জীবন গির্জার সেবায় কাটিয়ে মরতে চাই।”
তোমার নাম কি?” পাদ্রী প্রশ্ন করল।
সে তার নাম বললো, জন গিন্থার।
গিজায় থাকতে হলে যিশুর পুত্র হয়ে থাকতে হবে। দুনিয়ার প্রতি কোন টান থাকলে তো চলবে না।”
“আমি তো চিরকালই দেওয়ানা হয়ে জীবন কাটিয়েছি। দুনিয়ার প্রতি আমার কোন লোভ কোন কালেই ছিল না। বিবি বাচ্চাদের খোঁজ খবরও নিতাম না। সব সময়। এ জন্য আমার বিবি ও শিশুরা কাদাকাটি করত, আর অভিযোগ করে বলতো, আমি নাকি কোন কাজকর্ম করি না। শুধু আত্মার শান্তির জন্য ছুটে বেড়াই।
একবার এ জন্য আমি খুব বিপদে পড়েছিলাম। আমাদের এলাকায় এক মৌলভী সাহেব ছিলেন। আমার দেওয়ানা হালত দেখে বললেন, “জন, খোদা তো মসজিদে থাকে, তুমি কোথায় তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে?” তার কথাবার্তা শুনে খোদাকে পাওয়ার জন্য আমি তো প্ৰায় ইসলাম গ্রহণই করে ফেলেছিলাম।”
ইমরান পাদ্রী সাহেবকে আরো বললে, “আমার বিশ্বাস আমার স্ত্রী ও সন্তানরা মুসলমানদের হাতে নিহত হওয়ায়, খোদা তাদেরকে তার শান্তির আশ্রয়ে নিয়ে নিয়েছেন। কারন আমি এমন অপদার্থ স্বামী ও বাবা ছিলাম, তাদের কোন রুটি রুজির ব্যবস্থা করতে পারতাম না। খোদাই আমার পরিবারের দেখাশোনা করতেন। আমার সন্তানরা মাকে ছাড়া থাকতে পারতো না। আমি তাদের সম্পর্কে গাফেল ছিলাম বলে ওদের মা-ই ছিল ওদের একমাত্র আশ্রয়।
জন গিন্থার কেদে কেটে পাদ্রীকে বলল, মুসলমানরা আমার বিবি ও সন্তানদের হত্যা না করলে আমি হয়তো ইসলাম কবুল করেই ফেলতাম। তারা কেবল তাদেরই হত্যা করেনি আমার উপরেও অনেক অত্যাচার করেছে। এখন আমি জানি, এই খুনীদের অন্তরে খোদা থাকতে পারে না। মুসলমানদের অন্তরে খোদা নেই, আছে অন্য কোথাও, আছে এই গির্জায়।’
ইমরান সহসা পাদ্রীর কাধে হাত দিয়ে তাকে ঝাকুনী দিয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘পবিত্র বাবা! আমাকে বলো, আমি তো পাগল হয়ে যাইনি? বলাে, আমি এখন সত্যকে চিনেছি, ঠিক বুঝেছি, বলো, নাহলে আমি আমার জীবন নিজের হাতেই শেষ করে দেবো। আমি পরকালে খোদাকে বলবো, তুমি পথপ্রদর্শক ছিলে না, শুধু ধর্মের নামে ঢং করেছো, লোকদের ধোকা দিয়েছো!”
তার মানসিক অবস্থা দেখে ক্রুসেডের মহান রক্ষক চমকে উঠলেন। তিনি ইমরানের মাথায় হাত রেখে বললেন, “হে আমার বিপন্ন সন্তান! খোদা তোমার বুকের মধ্যেই আছেন। তিনি তোমাকে খোদার বেটার পুজারীদের মধ্যেই রাখবেন। তুমি খৃষ্টান, জন গিন্থর, তুমি এই ধর্মেই, এই সুরতেই খোদাকে পাবে। তুমি যাও, প্রতিদিন সকালে আমার সাথে দেখা করবে। আমি তোমাকে তোমার অন্তরের খোদার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।”
“আমি আর কোথাও যাব না মুকাদাস বাপ!” ইমরান বললো, “আমার কোন বাড়ী নেই। দুনিয়াতে আমার কেউ নেই। আপনি আমাকে আপনার কাছে রাখুন!! আমি আপনার ও খোদার বেটার এই গির্জার এমন খেদমত করবো, যেমন আর কেউ করেনি।’
ইমরান ও তার সাথীরা খৃষ্টান ও ক্রুসেডদের গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য আলী বিন সুফিয়ানের কাছ থেকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়েই এই দুরূহ অভিযানে বেরিয়েছিল। সে জন্য খৃষ্টান ধর্ম সম্পর্কেও তাদেরকে পরিপূর্ণ শিক্ষা ও জ্ঞান দান করা হয়েছিল। গির্জার আদব, উপাসনার পদ্ধতি এসবের শুধু প্রশিক্ষণই দেয়া হয়নি বরং বারবার অভিনয় এবং রিহার্সালও দেয়া হয়েছিল।
ইমরান এমন নিপূণভাবে সেই শিক্ষা কাজে লাগােল যে, প্রধান পাদ্রী ও তার সাগরেদ দল তার আদবের পরাকাষ্ঠা দেখে তাকে আনন্দের সাথেই গির্জার মধ্যে থাকার অনুমতি দিয়ে দিল।
ইমরান পদ্রীর খেদমতে নিজেকে এমনভাবে নিবেদন করলো যে, কয়েক দিনের মধ্যেই পাস্ত্রী তাকে খাস চাকর বানিয়ে নিল। তার বুদ্ধি ও সরলতা পাদ্রীর মন জয় করে নিয়েছিল।
পাদ্রী মনে মনে স্বীকার করল, এই ছেলে অসাধারণ বুদ্ধিমান এবং তার ওপর ধর্মের ভূত ভালভাবেই চেপে বসেছে। অতএব তাকে সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে।
পাদ্রী সাহেব তাকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য তার প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিজেই নিয়ে নিলেন।
ইমরানের এক সাখী এক খৃস্টান বণিকের কাছে গিয়ে।

নিজেকে ক্রাক থেকে পালিয়ে আসা খৃস্টান বলে পরিচয় দিল। সেখানে তার সমস্ত পরিবার মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছে। সে তার বেদনা ভরা কাহিনী এমন করুণ ভাবে বর্ণনা করলে যে, খৃষ্টান বণিক সদয় হয়ে তাকে তার কর্মচারী বানিয়ে নিলো।
সে ছিল সুদানী মুসলমান, নাম রহিম হাংগুরা। ইমরানের মতই সেও ছিল বুদ্ধিমান, সাহসী ও সুশ্ৰী যুবক। সে এ বণিকের এখানে চাকরী নিল, কারণ সে দেখেছে, এখানে ক্রুসেডদের সৈন্য ও অফিসাররা নিয়মিত আসা যাওয়া করে। এই বণিক সৈন্যদের খাদ্যশস্যও সরবরাহ করে।
কিছুদিন পর বণিক তার কাজে ও বিশ্বস্ততায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে গৃহ কাজেও লাগাতে শুরু করলো।
রহিম বণিকের কাছে তার নাম বলল, ইলিমোর। সে বণিকের পরিবারের সবার সাথেই অত্যন্ত ভাল ও মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলল। অচিরেই সবাই তার ব্যাপারে খুবই সহানুভূতিশীল হয়ে উঠল।
সে বণিকের স্ত্রী, কন্যা ও ছেলেদের কাছে এমন করুণ ভঙ্গিতে তার ধ্বংসের কাহিনী বর্ণনা করতো, যা শুনে ওদের চোখে অশ্রু এসে যেতো !
রহিম তাদের বলেছে, “আমার বাড়ীও এই বাড়ীর মতই ছিল। এমনি সাজানো গোছানো বাড়ী। এরকমই জৌলুসময় ছিল বাড়ীর আসবাবপত্র। আমার উন্নত জাতের দামী ঘোড়াও ছিল।
বণিকের মেয়ে আলিসাকে রহিম একদিন বলল, “তোমার মত দেখতে আমার এক বােন ছিল, তোমাকে দেখলেই আমার তার কথা মনে পড়ে যায়। ,
সে আক্ষেপ করে আরো ৰলল, “একদিন আমার বাড়ীর চাকর তার ফাইফরমাশ খাটতো আমাদের কাজকর্ম করত। আর আজ কপাল দােষে আমি তোমাদের বাড়িতে কাজ করে খাই। অথচ এমনও দিন ছিল, ক্ষুধার্তা লোকদের আমি বিনা কাজেই খাবার দিতাম।’
বণিকের যুবতী মেয়ে এই সুশ্রী যুবকের প্রতি বেশ আকৃষ্ট হয়ে পড়লো। সে তার বোনের সম্পর্কে নানা রকম প্রশ্ন করতো।
রহিম বলতাে, ‘সে প্রায় তোমার মতই দেখতে ছিল। যদি সে মরে যেত তবে কোন দুঃখ ছিল না আমার। আমার আসসোস মুসলমানরা তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আমি জানি না, এখন তার কি অবস্থা! হয়ত তুমি বুঝতে পারবে।’
তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা কর নি?
কেমন করে করবাে? তেমন কোন সুযোগ তো ছিলনা! তবে তার পর থেকে প্রতিদিনই তাকে উদ্ধারের কথা মনে হয়েছে আমার। আজও আমি চিন্তা করি, তাকে মুসলমানের হাত থেকে কেমন করে উদ্ধার করা যায়।”
‘সত্যি খুবই দু:খজনক।” সমবেদনা ঝরে পড়ে আলিসার কণ্ঠ থেকে।
‘মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি পাগল হয়ে যাবো। ইচ্ছে করে আবার সেখানে ছুটে যাই, যেখানে আমি আমার প্রাণপ্রিয় বোনকে ফেলে এসেছি। বোনকে হয়তো আর পাব না, কিন্তু তার জন্য মরতে তো পারব। তার কথা মনে হলে আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।”
তার এ ধরনের কথা ও তার বেতাল অবস্থা দেখে মা ও বেটি তাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। এমন মায়াময় যুবকের চেহারায় সে কি বেদনার ছাপ! যৌবন বয়সেই এত বড় আঘাত পেয়ে দিন দিন সে আরো মনমরা হয়ে যাচ্ছে। তার চেহারা বলছে, যদি তার দুঃখ লাঘব না হয়, তবে সে পাগল হয়ে যাবে বা আত্মহত্যা করবে।
আলিসা বণিকের অবিবাহিত যুবতী মেয়ে। সে এই যুবকের ব্যথা বেদনা অন্তর দিয়ে অনুভব করে। এমন কি যখন রহিম যখন বাইরে যায় তখন আলিসাও কোন বাহানা করে বাইরে চলে যায়। সে রহিমকে রাস্তায় পাকড়াও করে বলে, “বাবাকে বলে তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ী চলে এসো।
সে রহিমের সাথে কথা বলে আবেগমথিত স্বরে। ভাবে, যদি এতে তার দুঃখ কিছুটা হালকা হয়।
মা বণিককে বলে, “এই ছেলেটির দিকে একটু খেয়াল রেখো।’
রহিমের শরীর স্বাস্থ্য ও চেহারায় একটা আভিজাত্য ছিল। দেখলেই বুঝা যায়, কোন উচ্চ বংশের সচ্ছল পরিবারের ছেলে সে।
রহিম অনেক কসরত করে এমন চালচলন আয়ত্ব করেছিল। সবাইকে আকৃষ্ট করতে পারে এমন আদব কায়দা ও ভদ্রতা শেখা তার প্রশিক্ষণেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার কষ্ট করে শেখা বিদ্যা আজ কাজে লাগল। তার অভিনয় ও ভাষার মাধুর্যে সহজেই মুগ্ধ হয়ে যেত যে কোন লোক।
তিন চার দিন পর। সেদিন সে বণিকের পাশে বসেছিল। এমন সময় তার আরেক সঙ্গী গোয়েন্দা রেজাউল জাউওয়াকে দেখলো দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রহিম তার কাছে গেল এবং তার সাথে চলতে চলতে অনেক কথা হলো।
সে তাকে জিজ্ঞেস করলে, “তুমি কি করো’।
“এখনও কোন ঠিকান্ত হয়ে উঠেনি, বলল রেজাউল।
রেজাউল একজন অশ্ব বিশেষজ্ঞ ছিল। সে ঘোড়া পালন ও পরিচর্যায় যেমন পারদর্শী ছিল তেমনি চৌকস অশ্বারোহী হিসাবেও তার খ্যাতি ছিল পরিচিত মহলে।
রহিম তাকে বণিকের কাছে নিয়ে এলো ! সে তার নাম বলল ফ্রান্সিস। বণিককে সে জানাল, ‘এই খৃস্টান যুবক ক্রাকে সব কিছু হারিয়ে এখন বিপন্ন, সর্বহারা। একেও কোথাও একটা চাকরী দিয়ে দেন।”
“কিন্তু ওকে কি কাজে লাগাবো?” বলল বণিক।
রহিম বললো, “সে ঘোড়া লালন পালনের কাজ ভাল জানে। ” কোথাও ঘোড়ার রাখাল হিসাবে কাজ জুটিয়ে দিতে পারলে হয়।”
বণিক বললে, “ঠিক আছে, আমার কাছে বড় বড় ফৌজি অফিসাররা আসে, দেখি তাদের ওখানে তাকে ঢুকিয়ে দিতে পারি কিনা !’
দুতিন দিন পর।
বণিকের মধ্যস্থতায় রেজাউল ফৌজি আস্তাবলে চাকুরী পেয়ে গেল। এখানে বিশেষ করে ফৌজি অফিসারদের ঘোড়াগুলোই থাকে।
বণিকের কাছে সবসময় সামরিক অফিসাররা কেন আসা যাওয়া করত। অল্প সময়ের মধ্যেই এর কারণ আবিষ্কার করে ফেলল রহিম।
সে জানতে পারলো, এই বণিক একজন ঝানু ব্যবসায়ী। সাধারণ, সওদাপাতি ছাড়াও তার কিছু গোপন ব্যবসা আছে। এই বণিক গোপনে এসব সামরিক অফিসারদের মদ ও মেয়ে সাপ্লাই করে। এ কারণে সব বড় বড় সামরিক অফিসাররা ছিল তার হাতের মুঠোয়।
রহিম বণিককে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করতো। কথায় কথায় সে তাদের অভিশাপ দিত এবং আশা প্ৰকাশ করতো, একদিন ক্রুসেড বাহিনী সমস্ত আরব ও মিশরের উপরে আধিপত্য বিস্তার করবে।
তার কথায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার চরম ঘূণা ও ক্ষোভ থাকতো। ক্রুসেড বাহিনী যেন একজন মুসলমানকেও খাঁচিয়ে না রাখে সে জন্য সুযোগ পেলেই অফিসারদের কাছে আবেদন করত।
কখনও কখনও সে এত বেশী অস্থির ও উত্তেজিত হয়ে উঠতো যা বলার মত নয়। সে লাগামহীনভাবে বিড়বিড় করে বলতো, আমি আক্রার মুসলমানদের রক্ত পান করব।
বণিক তাকে সান্তুনা দিয়ে বলতো, তুমি শান্ত হও। ক্রুসেড বাহিনী তোমার আশা পূরণ করে দেবে।’
সে ক্রুসেড বাহিনীর সেইসব সামরিক অফিসারদের গালমন্দ করত, যারা আক্রায় আরাম আয়েশে বসে আছে।
সে মুসলমানদের হত্যা করার পরিকল্পনা করতো এবং পরিকল্পনা ও নকশা তৈয়ারী করত, যা দেখে বণিক চমৎকৃত হয়ে যেতো।
বণিক সামরিক বাহিনীর অনেক গোপন তথ্য জানতো। মাঝে মাঝে রহিমের উদ্ভট ও নিত্যনতুন যুদ্ধ পরিকল্পনা দেখে তা সংশোধন করে দিত। তার পরিকল্পনায় কোথায় কি ভুলত্রুটি আছে ধরিয়ে দিত।
এই সব কথার ফাঁকে এমন অনেক সামরিক গোপন বিষয়ও বেরিয়ে আসতো, যে বিষয়গুলো সামরিক অফিসার ছাড়া অন্য কারো জানার কথা নয়।
দিন দিন আলিসা তার প্রতি বুকে পড়ে। রহিম শুরু থেকেই তাকে তার দায়িত্ব পালনের অন্যতম হাতিয়ার ধরে রেখেছিল। ”
কিন্তু আলিসার হৃদয় উজাড় করা প্রেম রহিমের অন্তরেও ভালবাসার সৃষ্টি করে। রহিম সিদ্ধান্ত নেয়, দায়িত্ব পালন করে। দেশে ফেরার সময় সে আলিসাকেও তার সঙ্গে কায়রো নিয়ে যাবে। তাকে মুসলমান বানিয়ে তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে।
কিন্তু তাদের কারো জানা ছিল না ক্রুসেড বাহিনীর একজন বর অফিসার তাদের প্রতি কড়া দৃষ্টি রেখে চলেছে।
রেজাউল জাওয়াও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা ছিল। আস্তাবলে এক বড় অফিসারের ঘোড়া প্রতিপালনের দায়িত্ব পেল সে। সেই অফিসার অনুভব করলো, রেজাউল কোন সাধারণ সহিস বা রাখাল নয়, বরং ছেলেটি তার চেয়ে অনেক বেশী বুদ্ধিমান।
যখন অফিসার আস্তাবলে আসে সে তখন তাকে জিজ্ঞেস করে সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে কখন আপনারা পরাজিত করবেন?” .
আবার হয়তো কখনো জিজ্ঞেস করে, সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের মধ্যে, এমন কি গুণ আছে যা ক্রুসেড বাহিনীর নেই?
কেন ক্রুসেড বাহিনী মুসলমানদের শেষ করতে পারছে না?”
একদিন সে অফিসারকে এমন কিছু কথা বলে, যাতে অফিসার নিঃসন্দেহ হয়ে যায়, এ লোক একজন সমর বিশারদ না হলেও কোন মতেই তাকে একজন সহিস বলা যায় না। সহিসের মুখ থেকে এমন কথা বের হতে পারে না।
সেই অফিসার তাকে বললো, “তুমি কে? তোমার পেশা তো সহিস হতে পারে না।”
আপনাকে কে বলেছি, আমার পেশা সহিস?” রেজাউল বললে, “আমি ক্রাকে ঘোড়ার মালিক ছিলাম। আমি যদিও সৈন্য বিভাগে ছিলাম না, তবে আমার দুই ঘোড়া যুদ্ধে গিয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আমি ঘোড়ার মালিক এখন আস্তাবলের সহিস।
এতে আমার কোন দুঃখ নেই। যে আমার এই দুৰ্গতির জন্য দায়ী আপনি যদি সেই সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত করতে পারেন তবে আমার আর কোন আফসোস থাকবে না। বাকি জীবন আপনার জুতা পালিশ করে কাটিয়ে দেব।”
“সুলতান আইয়ুবীর ভাগ্যে পরাজয় লিখা হয়ে গেছে ফ্রান্সিস!’ অফিসার রেজাউলকে বললো। ” “কিন্তু কেমন করে?” রেজাউল বললো, “যদি আপনারা ক্রাক ও সুবাকের উপর আক্রমণ চালিয়ে মুসলমানদের অবরোধ করে তাদের পরাজিত করার কথা ভেবে থাকেন তবে ভুল করবেন। মুসলমানরা আমাদের অবরোধ করে যেভাবে জয়ী হয়েছে সেরূপ করে আপনারা যুদ্ধে জয় লাভ করতে পারবেন না।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও নূরুদ্দিন জঙ্গী যুদ্ধের উস্তাদ! তারা আমাদের সৈন্যদেরকে কেল্লা থেকে অনেক দূরেই বাধা দেয়ার ব্যবস্থা করবে।
যদি এমন কোন আক্রমণ করা যায়, যা সুলতান আইয়ুবীর ধারণা ও কল্পনার বাইরে, তবেই সাফল্যের আশা করা যায়। তখন দেখা যাবে, আইয়ুবী ও জঙ্গী কেল্লাতেই বসে আছে আর আপনারা মিশরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে বসে আছেন।”
তাই হবে!’ অফিসার একটু অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বললো, ‘সমুদ্রে কোন দূর্গ থাকে না, মিশরের সমুদ্র তীরেও কোন দূর্গ নেই। অতএব আইয়ুবী জানার আগেই আমরা মিশরের উপরে খৃস্টীয় শাসন কায়েম করবো।
এভাবেই তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়! তারপর রেজাউল ঐ অফিসারের কাছ থেকে গোপনে ও কৌশলে আরও অনেক তথ্য আদায় করে নেয়।
শক্ররা তাদের যুদ্ধের গােপনীয়তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলে বেড়ায় না। সতর্ক ও বুদ্ধিমান গোয়েন্দারা ইশারা ইঙ্গিত থেকেই অনেক বিষয় বুঝে নেয়। নিজের বুদ্ধি বিবেক কাজে লাগিয়ে এমন সব গোপন তথ্য উদ্ধার করে, যুদ্ধের ময়দানে যার মূল্য অনেক।
রহিম ও রেজাউল প্রতি রোববার সকালেই গির্জায় যেতো। এবং ইমরানের সাথে সাক্ষাৎ করতো। ওখানেই তারা ইমরানের কাছে তাদের গত সপ্তাহের কাজের রিপোর্ট দিত।
রহিম ইমরানকে বললো, বণিকের মেয়ে আলিসা আমাকে প্ৰচণ্ড ভালবেসে ফেলেছে।” ইমরান বললো, “তার ভালবাসায় আঘাত দেবে না। আবার এ ভালবাসার খবর পরিবারে জানাজানি হযে গেলে কি প্ৰতিক্রিয়া হবে তা না বুঝে এ প্রেমের কথা প্রকাশও হতে দেবে না। দিলে তোমাকে ওরা ওদের বাড়ী থেকে বের করে দিতে পারে।
রহিম প্ৰেম করো আর যা-ই করো, সব সময় মনে রেখো তুমি একজন গোয়েন্দা অসাবধানে তুমি আবার তার ভালবাসায় তলিয়ে যেও না।”
কিন্তু রহিম আলিসার যৌবন ও সৌন্দর্য্যে প্রায় তলিয়েই যাচ্ছে। আলিসা তাকে এ কথাও বলে দিয়েছে, তাদের বিয়ে শুধু তখনই সম্ভব, যদি সে বাড়ী ও আক্রা শহর থেকে পালিয়ে অন্য কোথাও যেতে পারে। কেননা তার বাবা কোন এক সামরিক অফিসারের সাথে সম্পর্ক করার তালে আছে।
এ অবস্থার কথা অবশ্য রহিম ইমরানকে জানায়নি।
অল্প দিনেই ইমরান পাদ্রী সাহেবের একান্ত আপন ও ঘনিষ্ঠজন হয়ে উঠল। সে এমন নৈকট্য লাভ করল যে, সে পাদ্রীর একজন গোপন পরামর্শদাতা হয়ে গেল।
পাদ্রীকে সে যে সব প্রশ্ন করতো, তার মধ্যে বুদ্ধিমত্তার ছাপ থাকতো। পাদ্রী সাহেব তার জানার আগ্রহ দেখে অবাক হয়ে যেতেন। পাদ্রী অবসর সময়েও তাকে ধমীয় পাঠ দান করতেন।
তিনি ইমরানের মনে এই কথা বদ্ধমূল করতে চেষ্টা করতেন যে, খৃষ্টীয় মতবাদের দায়িত্ব হলো পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্ৰান্ত পর্যন্ত ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা। এ উদ্দেশ্য নিয়েই ক্রুসেড যুদ্ধ শুরু করা হয়েছে। আর এ জন্য যে উপকরণ প্রয়োজন তাই ব্যবহার করা হবে।
প্ৰয়োজনে মুসলমানদেরকে হত্যা করা হবে। তাদেরকে যে কোন পদ্ধতি প্রয়োগ করে তাদের খৃস্টীয় ধর্মে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
যদি তারা খৃস্টধর্ম গ্ৰহণ না করে তবে তাদেরকে ইসলামের আদর্শ থেকে সরাতে হবে। মুসলমানদেরকে পাপের সাগরে ডুবিয়ে দিতে পারলেও এ উদ্দেশ্য সফল হয়।
এর জন্য প্রথম কাজ হলো নিজেদের নারীদেরকে এ পথে এগিয়ে দেয়া !” এই নারীরা মুসলিম নারী সমাজকে পথে নামাবে। যুবতী নারীদের লেলিয়ে দিতে হবে মুসলমান যুবক, শাসক, সমাজপতি এবং রাজনৈতিক নেতাদের পিছনে।
এই নারীরা তাদের সকল মহৎ কার্যকলাপ ও শুভ উদ্যোগ বানচাল এবং ধ্বংস করে দেবে।
পাদ্রী ইমরানকে জানাল ইহুদিরাও মুসলমানদের শত্রু। তারাও তাদের নারী সমাজকে এ কাজে লাগিয়ে দিয়েছে।
মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য ইহুদি নারীদের এ কাজে সহযোগিতা করতে হবে। মুসলমানদের মুসলিম জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ভুলিয়ে দিতে হবে। দৈহিকভাবে সম্ভব না হলে এভাবেই মুসলমানদেরকে মানসিকভাবে দুনিয়া থেকে উচ্ছেদ করতে হবে।
এজন্যে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়, তাই করতে হবে। এ পদ্ধতি খারাপ, নাজায়েজ, উৎপীড়নমূলক, লজ্জাজনক এ ধরনের কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না।
ইমরান পাদ্রীর কাছে এসব কথা শুনত এবং আর এমন ভাব দেখাত যে এতে সে খুবই খুশি। সুযোগ পেলেই সে এ কাজে ঝাপিয়ে পড়তে প্রস্তুত।

পাদ্রীর কাছে সামরিক অফিসার, সরকারী অফিসার সহ সব শ্রেনীর লোকেরাই আসত।
সে সময় ক্রুসেডদের বড় দুর্দিন। তারা একের পর এক দুটি যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেছে।
সেখান থেকে পালাতে হয়েছে খৃস্টানদের। সে জন্য আক্রা শহর ও দূর্গের প্রতিটি লোকের মুখে এক কথাই গুঞ্জরিত হতাে, কবে প্রতিশোধ নেয়া হবে। আক্রমণ করা হবে দুৰ্বত্ত মুসলমানদের।”
পাদ্রীর মহফিলে এ ছাড়া অন্য কোন আলোচনাই ছিলো না। ইমরান সেখান থেকে মূল্যবান তথ্য সংগ্ৰহ করতে লাগলো। সে এটাও জানতে পারুল, মুসলমানদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত উদ্যোগে খৃস্টানরা সক্রিয় হলেও আসলে খৃস্টান সরকারগুলোর মধ্যে কোন ঐক্য নেই।
তাদের বহু সম্রাট ও বহু রাষ্ট্র। সকলেই এক ধর্মের অনুসারী বলে সবাই ক্রুশ চিহ্নের উপরে হাত রেখে শপথ করেছে। ইসলামকে ধ্বংস ও নির্মূল করার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের মধ্যে রয়েছে বিশাল ফাটল।
তাদের মধ্যে এমন দেশও ছিল, যারা গোপনে মুসলমানদের গ সাথে শান্তিচুক্তি করতো আর প্রকাশ্যে খৃষ্টান ভাইদের সাথে কাধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতো।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল স্যার জেমিনুয়েল। সে একটি যুদ্ধের ময়দানে সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর সাথে আপোষ। চুক্তি করে যুদ্ধবন্দী বিনিময় করে নেয়।
এরপর স্যার জেমিনুয়েল অন্যান্য খৃষ্টান সরকারকেও এ জন্য গোপনে উস্কানী দিতে থাকে এই আশায় যে, এতে সফল হলে খৃস্টানরা তাকে এককভাবে আপোষকামী বলে অভিযুক্ত করতে পারবে না।
অন্যদিকে সকলের সাথে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ চালানাের প্রচেষ্টার সাথেও সে সম্পৃক্ত রইল। এ আক্রমণকে দুটি অংশে ভাগ করা হলো। একটি আক্রমণ হবে নূরুদ্দিন জঙ্গীর ওপর, দ্বিতীয়টি মিশরের ওপর।
এ সময় নূরুদ্দিন জঙ্গী ক্রাক শহরেই অবস্থান করছিলেন।
পাদ্রী খৃস্টান শাসকদের ফাটলের খবর সবই জানতেন। এ কারণে তিনি খুবই পেরেশানীর মধ্যে ছিলেন।
ইমরান তাদেরকে এ কথা বলতে পারেনি, যে জাতি তার আপন কন্যাদেরকেও নিজ স্বাৰ্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করতে আপত্তি করে না, সে জাতি একে অপরকে ধোঁকা দিতে আপত্তি করবে কেন?
যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত হয়ে যারা ধোঁকা প্রতারণার মাধ্যমে। বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন দেখে, তারা তাদের ভাইদের সাথে ধোঁকা ও প্রতারণার খেলা না খেললে এ খেলায় তারা পারদর্শী হবে কিভাবে?
ইমরান মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, সে সুলতান আইয়ুবীকে জানাবে, যদি মুসলমানদের মধ্যে” গাদ্দার না থাকতো, তবে মুসলমানরা খৃস্টানদের পরাজিত করে এতদিনে ইউরোপও জয় করে ফেলতে পারতো। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ও দুশমন হচ্ছে গাদ্দার।
আক্রার পাদ্রী ও খৃস্টান রাজন্যবর্গ এই দুর্বলতায় খুবই সন্তুষ্ট ও তৃপ্তিবােধ করছে। ইমরান জানতে পেরেছে, ক্রুসেডাররা মুসলমানদের মাঝে পাপাচার আরও বেশী করে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আপ্ৰাণ চেষ্টা করছে। তাদের এ মিশন দ্রুত এগিয়ে চলছে।
তারা মুসলমানদের ছোট ছোট রাজ্যগুলোর শাসকদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে। এই মুসলিম রাজ্যগুলোর শাসকরা গোপনে খৃস্টানদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এদেরকে খৃস্টানরা নির্বিবাদে ইউরোপের মদ, অর্থ ও যুবতী সুন্দরী নারী সরবরাহ করে চলেছে।
ইমরান ও রেজাউল সদা সতর্ক থেকে তাদের গুরু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু রহিম দিন দিন দায়িত্ব থেকে গাফেল হয়ে যাচ্ছে। সে এখন সারাদিন চেষ্টা করে, কি করে সব সময় বণিকের বাড়ীর কাজে ব্যস্ত থাকা যায়। আলিসার ভালবাসা তাকে অন্ধ করতে শুরু করেছে। কয়েকদিন পর আলিসা তাকে বললে, “বাবা এমন এক সামরিক অফিসারের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে, যার বয়স তার দ্বিগুণ হবে।’
আলিসা রহিমকে আরও বলল, যত বড় অফিসারই হোক, আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।
আলিসা তার মাকে বুঝিয়েছে, সে ঐ অফিসারের সাথে বিয়েতে রাজী নয়। কিন্তু তার বাবা সে কথা মানছে না ; কারণ সে এই অফিসারকে দিয়ে প্রচুর অর্থকড়ি রোজগার করছে। এখন তার কন্যাকে তার হাতে তুলে না দিয়ে তার উপায় নেই। একদিন আলিসা তার গলায় পর ক্রুশটি রহিমের হাতে রেখে সেখানে তার হাত চেপে ধর্মে বলল, রহিম, কসম এই ক্রুশের, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।”
রহিমও তার হাতের ওপর হাত রেখে কসম খেয়ে বলল, ‘আলিসা, আমিও তোমাকে বাঁচবো না।”
একদিন পাদ্রীর কাছে চার পাঁচজন সামরিক অফিসার এলো এবং তার খাস কামরায় গিয়ে বসলো। ইমরান তাদের চেহারা দেখেই বুঝতে পারলো, কোন গুরুত্বপূর্ণ গোপন বিষয়
আলোচনার জন্য এসেছে তারা। তারা কামরায় প্রবেশের কিছুক্ষণ পর ইমরানও পাদ্রীর কামরায় প্রবেশ করল। এক ফৌজি অফিসার কথা বলছিল, ইমরানকে কামরায় ঢুকতে দেখেই মাঝপথে কথা থামিয়ে চুপ হয়ে গেল!
পাদ্রী বললেন, “জন গিন্থার! তুমি কিছুক্ষণ বাইরেই থাকো! আমরা কিছু জরুরী কথা বলছি।”
ইমরান পাশের কামরায় চলে গেলে অফিসার আবার তার কথা শুরু করল। পাশের কামরায় গিয়ে ইমরান দরোজার সাথে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
তারা কথা বলছিল নিচু স্বরে, তবুও কিছু দরকারী কথা ইমরান বুঝতে পারলো। আর যেটুকু বুঝলো তাতেই তার দফা রফা হওয়ার অবস্থা হলো। ফৌজি অফিসাররা চলে যেতেই ইমরানও সেখান থেকে সরে গেল যাতে পাদ্রীর সন্দেহ না হয়।
সে শুধু কামরার বাইরেই এলো না, গির্জারও বাইরে চলে এল। তার মনে হলো, এখনি তার এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত এবং কোথাও না থেমে সোজা কায়রো গিয়ে পৌঁছা দরকার। সুলতান আইয়ুবীকে এ সংবাদ জানানো দরকার যে, আপনার ওপর কঠিন আঘাত আসছে। যাতে তিনি এ আক্রমণ প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নিতে পারেন।
তার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা শুরু হলো এবং অস্থিরতা নিয়েই সে পূনরায় গীর্জায় ফিরে এল।
পাদ্রী তাকে দেখে ডেকে এমন এক কাজে লাগিয়ে দিল যে, সে আর তখন পালাতে পারলো না। তা ছাড়া তার মনে পড়ল, যাওয়ার আগে রহিম এবং রেজাউলের রিপাের্টও জেনে যাওয়া দরকার। সে ধারণা করল, এ সংবাদ তাদের কানেও নিশ্চয়ই এসেছে। যদি তাদের কাছে এ খবরের সত্যতা যাচাই হয়ে যায় তবে আর এখানে কারোরই থাকার দরকার নেই। তাহলে তিনজনই একসাথে আক্রা থেকে বের হয়ে যেতে পারে।
পরক্ষণেই তার মনে হলো, এক সাথে রওনা দিতে গেলে দু’একদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে। কিন্তু অপেক্ষা করা কি ঠিক হবে? এসব নানা চিন্তা তাকে অস্থির করে তুলল।
পরের দিনই সে রেজাউলের সাথে দেখা করল। রেজাউল তখন আস্তাবলেই ছিল।
নতুন কোন খবর পেয়েছিস?” তাকে জিজ্ঞেস করলো ইমরান।
রেজা বললো, “এখানে অসাধারণ তৎপরতা চলছে। যতদূর বুঝতে পারছি, ক্রুসেডাররা এবার স্থলপথে আক্রমণ চালাবে না। মনে হয়, তারা সমুদ্র পথেই আক্রমণ করবে। কিন্তু এর বেশী আর কিছু জানতে পারিনি।’
ইমরান যতটা জানতে পেরেছিল তার কিছু বললো তাকে। বললো, খৃস্টানরা ফয়সালামূলক যুদ্ধ করার জন্যই এ আক্রমণ চালাবে।” সে রেজাউলকে এই আক্রমণের বিস্তারিত তথ্য সংগ্ৰহ করার জন্য বলল। ইমরান শুধু তার জানা কথাগুলোর সত্যতার “প্ৰমাণ পেতে চায়। নতুবা বিস্তারিত সে মোটামুটি জেনেই গেছে।
সে রেজাউলকে বললো, দু’এক দিনের মধ্যেই এখান থেকে পালাতে হবে। যে দায়িত্ব দিয়ে আমাদের এখানে পাঠানাে হয়েছিল বলতে গেলে তা পূর্ণ হয়েছে। এখন ফিরে যাওয়ার জন্য আমাদের তিনটি ঘোড়া বা উটের প্রয়োজন।”
‘কোথাও থেকে চুরি করা ছাড়া সে প্রয়ােজন পূরণের কোন ৷ উপায় তো দেখছি না। বলল রেজাউল। ”
ইমরান রহিমের সাথেও দেখা করতে চাইলো। তাকেও সতর্ক করে পালানোর কথা বলতে হবে। কিন্তু রাত হয়ে গিয়েছিল বলে সে তার ঠিকানায় যাওয়া ঠিক মনে করল না। কারণ বণিকের বাড়ির ঠিকানায় অন্য কারো যাওয়া উচিত নয়।

সে রহিমের কাছে গেলেও তার দেখা পেত না। কারণ রহিম তখন তার নির্দিষ্ট ঠিকানায় ছিল না। এমনকি সে আক্রা শহরেও ছিল না। যখন ইমরান তার দায়িত্ব পালনে পেরেশান, সে সময় রহিম পেরেশান আলিসাকে নিয়ে।
এক অবাঞ্ছিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিল রহিম। খৃস্টানদের এক ভোজ সভায় মেহমানদের জন্য একটি নাচের আসরের আয়োজন করা হয়েছিল ! এ আসরে শরিক ছিল আলিসাও। আলিসার বাগদত্তা তাকে তার সাথে নাচের জন্য বলল। কিন্তু আলিসা তার সাথে নাচতে অস্বীকার করে বসলো এবং তার চেয়ে অল্প বয়স্ক এক যুবকের সাথে নাচতে শুরু করলো। এ নিয়ে সেই অফিসার তার বাবার কাছে অভিযোগ করলো। তাঁর বাবাও সে মহফিলে ছিল।
সেখানে সমানে মদের বােতল খালি হচ্ছিল। আলিসার বাবা মেয়েকে গিয়ে সতর্ক করল। বললো, ‘কেন তুমি তোমার হবু স্বামীর সাথে নাচছে না, কেন তাকে অপমান করছো?”
আলিসা এ কথার কোন জবাব না দিয়ে রাগ করে সেখান থেকে বাড়ী চলে গেল। আসার আগে তার হবু স্বামীকে আসর থেকে সরিয়ে এনে বলল, “খবরদার বুড়ো, আমাকে বিয়ে করার আশা ছেড়ে দে, কোন বুড়োভামকে আমি বিয়ে করবাে না। আরেকবার আমার দিকে চোখ তুলে তাকালে তোর চােখ আমি তুলে ফেলবো।”
এ কথা বলে সে আর সেখানে দাঁড়ায়নি, হতভম্ব অফিসারের নাকের ডগার ওপর দিয়ে সোজা হেঁটে বাড়ি চলে এসেছিল।
এ অপমান সইতে পারলেন না অফিসার। তিনি আলিসার বাবাকে খুঁজে বের করে তাকে নিয়ে তাদের বাড়ীতে এলেন। বয়স হওয়ার কারণে অফিসার রাগকে চরমে পৌঁছতে দেননি, বরং মনে মনে কিছুটা মজাও পাচ্ছিলেন! ভাবছিলেন, মেয়ে মানুষ একটু তেজী না হলে জমে না।
বাড়ী গিয়ে বণিক মেয়েকে খুঁজতে গেল তার কামরায়, কিন্তু দেখলে সেখানে সে নেই। খুঁজতে খুঁজতে তাকে গিয়ে পাওয়া গেল রহিমের কামরায়। পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে, গভীর রাতে হবু স্বামী ও পিতার সামনে অলিসা ধরা পড়ল রহিমের ঘরে। ক্ষিপ্ত বাপ পারলে মেযেকে চুল ধরে টেনে নিয়ে আসে এমন অবস্থা। কর্কশ কণ্ঠে সে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো, “এখানে কি করছিস?”
মেয়েও তেজের সাথেই উত্তর দিল, “আমার যেখানে মন চায় যাবাে, যার কাছে ইচ্ছা বসবাে। আমাকে নিয়ে কারো মাথাব্যথার দরকার নেই।’
এ রকম জবাব সেই সামরিক অফিসারটির পছন্দ হলো না। তার মনে সন্দেহ জাগল ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। আলিসার বাবাকে সে বলল, “ওর সাথে রাগারাগি করার দরকার নেই। মেয়েকে নিয়ে ঘরে চলে যান।”
রহিমের ঘর থেকে ওরা বেরিয়ে যেতেই সেই অফিসার রহিমকে জিজ্ঞেস করলে, “এই মেয়েটি এত রাতে এখানে এসেছিল কেন?”
রহিম উত্তরে বলল, “সে কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? যে এসেছিল তাকে জিজ্ঞেস করুন?”
“ও কি আজই প্রথম এখানে এসেছে, নাকি আগেও আসতো?”
‘তার জায়গায় সে যতবার খুশি আসবে যাবে, সে জন্য কি যার তার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে?”
লোকটি ছিল সামরিক বিভাগের বড় অফিসার। এতক্ষণ সে যে ধৈর্য ধরে রেখেছিল একজন চাকরের এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে তা আর ধরে রাখতে পারলো না। রহিমকে ধমক দিয়ে বলল, “খবরদার বেতমিজ, সওদাগরের সম্মানে এখনো তোর লাশ পড়েনি, নইলে এতক্ষণে তুই লাশ হয়ে যেতি। কাল ভোরেই তুই এখান থেকে চলে যাবি, নইলে আর কোনদিন জীবিত যাওয়ার সুযোগ পাবি না।”
রহিমের শরীরেও ছিল যৌবনের রক্ত ও ভালবাসার উন্মাদনা। সেও অফিসারের মুখের ওপর জওয়াব দিল, “আমি এখানে থাকবো কি থাকবো না তা নির্ধারণ করবে। আমার মুনীব। আমার ব্যাপারে অন্য কারো নাক গলানো আমি পছন্দ করি না।”
এ উত্তপ্ত কথাবার্তা হয়তো আরো চলতো, কিন্তু বণিক এসে দু’জনের মধ্যে মিটমাট করে দিল। যাওয়ার আগে অফিসার আলিসার বাবাকে বলে গেল, “এই লোক যেন আগামী কালের পর আর এখানে না থাকে ৷”
পরের দিন আলিসার বাবা এসে রহিমকে বলল, বাবা, এ ঘটনার পর আর তোমাকে চাকুরীতে রাখা সম্ভব নয়। কারণ সৈন্য বিভাগের এত বড় অফিসারকে অসন্তুষ্ট করলে কেবল যে আমার কারবার নষ্ট হবে তা নয়, প্রাণ নিয়ে বাঁচাও দায় হয়ে যাবে। ”
সে রহিমকে উপদেশ দিল, “তুমি আজই এখান থেকে চলে যাও। কারণ সামরিক অফিসার তোমাকে তার কথামত খুন না করলেও বিনা অপরাধেই কয়েকখানায় পাঠিয়ে দিতে পারে।’ ‘
রহিম অতীতের সব কথা ভুলে গিয়েছিল। ভয়ংকর বর্তমান মুছে দিয়েছিল তার সব স্মৃতি। ভুলে গিয়েছিল, সে এখানে কোন দায়িত্ব নিয়ে কেন এসেছিল। সে আলিসাকে তার জীবনের সাথে জড়িয়ে ফেলেছিল। আলিসার বাগদত্তার ধমকের উচিত জওয়াব দেওয়ার জন্য তার যুবক রক্ত টগবগ করে উঠল। বণিকের দোকান থেকে বেরিয়ে এল রহিম।
প্রথমে রহিম বণিকের বাড়িতে গেল। আলিসার সঙ্গে দেখা করে বললো, “তোমার বাবা আমাকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করেছে।”
আলিসা বলল, “আমি তোমাকে বরখাস্ত করিনি। আমার হৃদয়ে তুমি ছিলে, আছো এবং থাকবে। আমি বুঝতে পারছি এখানে আমাদের থােক, ঠিক হবে না। আমরা দূরে কোথাও পালিয়ে যাবো।”
কিন্তু কখন, কিভাবে?
তুমি আজি সন্ধ্যার সময় এখানে চলে এসো। সে সময় আব্বা বাড়ীতে থাকেন না। লোকজনও সান্ধ্য ব্যস্ততায় থাকে। আজই সন্ধ্যার অন্ধকারে পালিয়ে যাবাে আমরা
“কিন্তু তোমার আব্বা বরখাস্ত করার পর এখানে আমাদের দু’জনের এক সাথে পথচলা নিরাপদ নয়।’
তাহলে তোমাকে আমি শহরের বাইরে একটি ঠিকানা দিচ্ছি, সময় মতো। ওখানে চলে যেও। আমি আমার বাবার ঘোড়া নিয়ে যথাসময়ে চলে আসবো।”
রাতে যখন ইমরান রেজাউলের কাছে বসেছিল। আর গোপন তথ্য নিয়ে আলোচনা করছিল, রহিম তখন গোপনে শহর থেকে বেরিয়ে আলিসার দেয়া ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছিল। যখন ওরা কি করে জীবনের ঝুকি এড়িয়ে তিনজনে একত্রে এখান থেকে পালানাে যায় সে চিন্তা করছিল, রহিম তখন আলিসাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য শহরের বাইরে তার বলে দেয়া একটি নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করছিল।
আলিসা বলেছিল, সে তার বাবার ঘোড়া নিয়ে আসবে। আর তারা একই ঘোড়ার পিঠে দু’জন একত্রে পালাবে। রহিম অধৈৰ্য ভাবে আলিসার জন্য অপেক্ষা করছিল, আর ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। সে ভেবে পাচ্ছিল না, আলিসা তার বাবার ঘোড়া কেমন করে চুরি করবে।

আলিসা সময়মতই তার বাবার ঘোড়ার পিঠে জিন বেধে তার উপর লাফিয়ে উঠল এবং দ্রুত বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে।
রহিম যখন তাকে দেখলো, তখনো তার বিশ্বাস হচ্ছিল না, আলিসা এসে গেছে।
আলিসা ঘোড়া নিয়ে রহিমের কাছে পৌঁছলো এবং বলল, রহিম, তাড়াতাড়ি উঠে এসো।”
আলিসার আহবানে রহিম তার পিছনে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলো। কিছু দূর তারা ধীর গতিতে অগ্রসর হলো। শহর ও শহরতলী অতিক্রম করে ঘোড়া থামাল আলিসা। বলল, “এবার ঘোড়ার বাগ তুমি হাতে নাও।”
রহিম আলিসার হাত থেকে ঘোড়ার বাগ হাতে নি। ঐ এবং তীব্ৰ গতিতে ঘোড়া ছুটলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আক্রা থেকে অনেক দূরে চলে গেল।
অনেক রাত। তারা এমন এক স্থানে এসে পৌছল যেখানে পানি আছে। ঘোড়াকে পানি পান করানো এবং একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য ঘোড়া থামালো রহিম। কারণ সে জানতো, এর পর বহুদূর পর্যন্ত আর পানি পাওয়া যাবে না। তাছাড়া তার এতদূর চলে এসেছে যে, তার মনে হলো, এখন আর ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই।
আলিসা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসায় তার খোজে লোক বেরুবে এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সে যে পালিয়েছে এ কথা জানতে সময় লাগবে তাদের। তার ওপর পালিয়ে সে কোন দিকে এবং কার সাথে গেছে কারো জানা নেই। রাতের অন্ধকারে তারা যে এদিকেই এসেছে এ খবরও জানা থাকার কথা নয় অনুসন্ধানী দলের। এ সব বিবেচনা করেই সে আলিসাকে বললো, ‘আজ রাতের মত এসো আমরা এখানেই বিশ্রাম নেই। সকালে অন্ধকার থাকতেই আবার রওনা হয়ে যাবো।’
‘তুমি বায়তুল মুকাদাসের রাস্তা চেনো?” আলিসা রহিমকে প্রশ্ন করলো।
তারা আক্রা থেকে বের হওয়ার সময় কোথায় যাবে তার কোন সিদ্ধান্তই নেয়নি। তাদের তখন উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ‘ যে কান মূল্যে নিরাপদে শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়া।
অলিসা বায়তুল মুকাদাসের নাম করলে রহিম বললো, ‘বায়তুল মূকাদাসে কেন? আমি তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে তোমার পিছু ধাওয়া করার কারো সাহসই হবে না।’
‘কোথায় নিয়ে যাবে?” আলিসা জিজ্ঞেস করলো।
মিশরের দিকে!’ রহিম উত্তর করলো।
“মিশর?’ আলিসা বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, “সে তো মুসলমানদের দেশ, তারা তো আমাদের জীবিত রাখবে না।’
মুসলমানরা খুবই সদয় জাতি। তুমি গেলেই দেখতে পাবে।”
না! আলিসা চমকে উঠে বলল, মুসলমানদের আমি ভীষণ ভয় করি। শিশুকাল থেকেই শুনে আসছি মুসলমানরা জঘন্য জাতি। আমাদের মায়েরা শিশুদের ঘুম পাড়ানোর সময় ভয় দেখায়, ঘুমোও বাবু ঘুমোও। সাবধান, গোল করো না, ” ওই যে মুসলমানরা আসছে। টের পেলে ওরা আমাদের জবাই করে ফেলবে।’ না, রহিম, আমি মিশর যাবো না। মুসলমানদের আমি দারুণভাবে ভয় এবং ঘৃণা করি।
আসলেই সে খুব ভয় পাচ্ছিল। ভয়ে সে রহিমকে জড়িয়ে ধরল, যেন মুসলমানরা তাকে জবাই করার জন্য এসে গেছে।
বায়তুল মুকাদ্দাস নিয়ে চলো। সেখানে সম্মানিত পাদ্রীকে সাক্ষী রেখে আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হব।
আলিসা রহিমের বুকে মুখ ঘষছিল, মাথা তুলে বলল, “বায়তুল মুকাদাস কোন দিকে? আমার দিক সব উলটাপালট হয়ে গেছে। তুমি বায়তুল মুকাদাস যাচ্ছে তো?”
‘আমি মিশরের দিকে যাচ্ছি। রহিম আবারো আগের কথাই বললো। ”।
‘না, তুমি মিশর যাবে না।’ আলিসা জিদ ধরলো এবং কাদতে লাগলো।
‘কেন, তুমি মুসলমানদের খুব বেশী ভয় করো, তাদের ঘৃণা করো?”
“হ্যা, খুব বেশী ঘূণা করি।”
আর আমার সঙ্গে তোমার ভালবাসা?
‘ওকথা বলছে কেন?
তুমি জানো তোমাকে আমি আমার জীবনের চেয়েও বেশী ভালবাসি!”
“যদি আমি বলি, আমি মুসলমান! তখন তুমি কি করবো?”
‘তখন আমি হাসবাে!” আলিসা বললে, “তোমার রসিকতা আমার বডড ভাল লাগে।”
‘আমি হাসি ঠাট্টা করছি না। আলিসা।” রহিম শান্ত স্বরে ধীরে সুস্থে বললো, ‘আমি আসলেই একজন মুসলমান! তুমি আমার কঠিন ত্যাগের কথা চিন্তা করো, তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি কি না করেছি! শুধু তোমায় ভালবাসাই আমাকে এ ত্যাগ আজো দিয়ে যাচ্ছি।”
’কেমন কুরবানী?’ আলিসা বললো, “তুমি তো আগে থেকেই গৃহহীন, ভাগ্য বিড়ম্বিত এক যুবক। আমাকে নিয়ে সংসার গড়ে তুলতে গিয়ে নতুন করে তুমি আবার কি ত্যাগ করলে?”
‘না, তা নয়। আলিসা!’ রহিম বললে, “আমি এখন গৃহহীন হয়েছি, তুমি বাড়ী থেকে পালিয়েছ, আমার সাথে বিয়ে করে নতুন ঘর সংসার করবে। কিন্তু আমার তো কোন ঠিকানা হবে না। আমি আমার কঠিন দায়িত্ব থেকে আজ পলাতক। আমি আমার সৈন্য বিভাগ থেকেও বিচ্ছিন্ন। আমি মিশরের গোয়েন্দা বিভাগের একজন অফিসার। আক্রা শহরে গোয়েন্দাগিরী করতে এসে তোমার ভালবাসায় অন্ধ হয়ে আমি আমার দায়িত্বকে কুরবানী দিয়েছি, আমার কর্তব্য কোরবানী করেছি। আমার চাকরী, পদোন্নতি, উন্নতি, অগ্ৰগতি সব কোরবানী করেছি।’
“তুমি আমাকে বডড ভয় দেখােচ্ছ!” আলিসা হেসে বললো, রাখো এসব হেয়ালীপনা। এখন ঘুমিয়ে যাও, আমি তোমাকে জাগিয়ে দিব।’
‘আমি তোমাকে ভয় দেখাচ্ছি না। আলিসা !” রহিম বললো, আমার নাম রহিম হাংগুর, আইলিমুর নয়। আমি তোমাকে ধোকার মধ্যে রাখতে চাই না। আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, তোমাকে আমি যেখানেই রাখি, সুখে শান্তিতে রাখবাে।
না, কিন্তু তোমাকে কোন কষ্ট করতে দেবো না। তোমাত্র জীবন আমি সুখ শান্তিতে ভরে দেবো ॥
“আমাকে কি ইসলাম গ্ৰহণ করতে হবে?’ আলিসা জিজ্ঞেস করলো।
‘তাতে কি তোমার কোন আপত্তি আছে?’ রহিম বললো, যদি তোমার আপত্তি থাকে। তবে এমন কথা আমার মুখ থেকে কোনদিন তুমি শুনতে পাবে না। আলিসা, এখন এসব কথা থাক, আর সময় নষ্ট না করে শুয়ে পড়ো। আমাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। কথা বলার সময় অনেক পাবো আমরা।”
রহিম নিজে শুয়ে পড়লে আলিসাও শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর আলিসা রহিমের নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেল। কিন্তু তার মোটেই ঘুম আসছিল না, নানা রকম দুশ্চিন্তা তখন কিলবিল করছিল তার মাথায়।
রহিমের ঘুম ভাঙ্গলো। চারদিক তখন ফর্সা হয়ে গেছে। সে আতংকে উঠে বসলো। তার এত বেশী ঘুমানো উচিত হয়নি। সে, চোখ মেলে এদিক-ওদিক তাকালো। সেখানে ঘোড়াও নেই, আলিসাও নেই। সে আবারও এদিক-ওদিক দেখলো। শেষে এক টিলার ওপর দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালো। মরুভূমির শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই তার চােখে পড়লো না। সে কয়েকবার আলিসা আলিসা বলে ডাকল, কোনই সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। সে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল।
কি ঘটতে পারে ধারনা করতে গিয়ে সে কোন কুল কিনারা পেল না। একবার মনে হলো, কোন লোক কি তাদের পিছু ধাওয়া করে এসেছিল? সে আলিসাকে ঘুমন্ত অবস্থায় উঠিয়ে নিয়ে গেছে? কিন্তু তাই বা কি করে হয়! তাহলে তো রমিহকে জীবিত রাখার কথা নয়! নিশ্চয়ই তাকে হত্যা করতো বা নারী অপহরণকারী হিসেবে তাকেও ধরে নিয়ে যেতো।
সে খুবই অবাক হলো, লোকেরা আলিসাকে এমন চুপিসারে কেমন করে উঠিয়ে গেল যে, সে একটুও-টের পেল না ! হঠাৎ আরেকটি চিন্তা মাথায় ঢুকতেই সে একটু ভয় পেয়ে গেল। আলিসা নিজেই পালিয়ে যায়নি তো! সে মুসলমান, এ কথা শোনার পর আলিসার পক্ষে পালিয়ে যাওয়া কি খুবই অসম্ভব কোন ব্যাপার!
আলিসা যেখানেই যাক বা তাকে কেউ উঠিয়েই নিয়ে যাক, রহিম এই ভেবে অস্থির হয়ে উঠলো যে, সে এখন কোথায় যাবে? আক্রা ফিরে যাওয়া ভীষণ বিপজ্জনক। কায়রো ফিরে যাওয়া আরো বিপজ্জনক। কারণ সে তার ফরজ দায়িত্ব পালন করেনি। তাছাড়া কমান্ডার ইমারনকেও সে কিছু বলে আসেনি। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সে সিদ্ধান্ত নিল, সে আক্রাও নয় কায়রোও নয়, সোজা ক্রাকে চলে যাবে। সেখানে গিয়ে বলবে, তাকে মুসলমান ও গোয়েন্দা বলে চিনে ফেলেছিল বলে কাউকে কিছু না বলেই সে পালিয়ে এসেছে। অবস্থা এমনই প্রতিকূল হয়ে উঠেছিল যে, রেজাউল বা ইমরান কাউকে সে কোন সংবাদও দিতে পারেনি। তার নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়ে গিয়েছিল।
অনেক ভেবে দেখল, এটাই সবচে ভালো কৈফিয়ত। কারণ কেউ এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করবে না, কেউ বলবে না, তোমার কথার যথার্থতা প্ৰমাণ করো, সাক্ষী পেশ করো।
রহিম পানি পান করে পায়ে হেটেই ক্রাকের দিকে যাত্রা করলো। আলিসার অনুপস্থিতিতে সে খুবই মর্মাহত ও বেদনাবোধ করছিল। তার আফসোস হচ্ছিল এই ভেবে, জীবনে আলিসার কোন খবর কি আর পাবো না। এই বিশাল মরুভূমিতে সে কেমন করে কোথায় হারিয়ে গেল!’
‘ সে অতি কষ্টে পায়ে হেঁটে মাইল তিনেক পথ মাত্র অতিক্রম করেছে। হঠাৎ ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পেল পেছনে। শব্দের উৎস লক্ষ্য করে সে পেছনে তাকিয়ে দেখল, ধুলি ঝড় তুলেই তার দিকে ছুটে আসছে ঘোড়া।
সে এদিক-ওদিক দেখলাে, কোথাও লুকানাের জায়গা নেই। সেজানতো না, এই আরোহী করা। আরোহীদের নিয়ে চিন্তার চেয়ে তার নিজেকে নিয়েই বেশী চিন্তা হলো। কি পরিচয় দেবে সে তার নিজের এই মরুভূমিতে বাহনহীন অবস্থায় সে কি করছে? সে কি খৃস্টান, না মুসলিম? খৃস্টান হলে সে ক্রাকের দিকে যাচ্ছে কেন? মুসলিম হলে খৃষ্টান অধূষিত মরু অঞ্চলে কি করছে সে?
সে ঘোড়ার রাস্তা থেকে একটু সরে গিয়ে হাঁটতে লাগলো। ঘোড়া নিকটবতী হলো। এবার সে ওদের চিনতে পারলো, ওরা আক্রার ক্রুসেড বাহিনীর সদস্য।
অশ্বারোহী বাহিনী মুহুর্তে তাকে ঘিরে ফেলল। সে নিরস্ত্ৰ, অসহায়। পালানোর কোন সুযোগই পেল না সে। আরোহীদের দিকে তাকালো সে। তাদের মধ্যে একজনকে সে চিনতে পারলো। এই সে সামরিক অফিসার, আলিসা যার বাগদত্তা। সে রহিমকে বললো, আমারও ধারণা ছিল যে, তুমি খৃস্টান নও।
তাকে ধরে ফেলা হলো। সে কোন রকম বাঁধাই দিল না তাদের। তারা তার হাত পিঠের দিকে শক্ত করে বেঁধে এক আরোহীর পেছনে ঘোড়ার পিঠে তুলে দিল। ঘোড়া আক্রার দিকে চললো !
ঘটনাটি সেই সময়ের, যখন ইমরান রহিমের সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখলে সে সেখানে নেই। বণিকের চাকর ইমরানকে বলল তাকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
ইমরান খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। রহিম গেল কোথায়? কোন সমস্যা দেখা দিলে প্রথমে তো রহিমের তার কাছেই আসার কথা! কিন্তু সে কেন তার কাছে এলো না?
এসব চিন্তা করতে করতে গির্জায় ফিরে এলো। এক অজানা আশংকায় দুরু দুরু করতে লাগল তার বুক।

(সমাপ্ত)

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top