৭. দূর্গ পতন


বেঈমানরা কাফেরের চেয়েও ভয়ংকর । আমরা ওদের গাদারীর পাওনা কড়ায় গণ্ডায় আদায় করবো।’ অন্য এক উত্তেজিত সৈন্য বললো, “এ কথা কি সত্য নয় সালারে আযম! কায়রোতে বিশ্বাসঘাতকরা বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করছে?’,
হ্যা, এ কথায় কিছু সত্যতা আছে ঠিক, তবে অতিরঞ্জনও আছে। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি অপরাধীদের রেহাই দেবো না, শাস্তি ওদের পেতেই হবে।’
‘আপনি পুরো বাহিনীকে কেমন করে শাস্তি দেবেন। এক সমস্ত ঘটনা আমাদের বলেছেন। আমাদের সঙ্গীরা সুবাকে শহীদ হয়েছে, ক্রাকে শহীদ হয়েছে। এ দুই শহরে আমাদের মা বোনদের সতীত্ব ও সন্ত্রম নষ্ট হয়েছে। ক্রাকে এখনও অগ্নিগোলায় জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে। আমাদের প্রথম কেবলারওপর এখনও কাফেরদের পতাকা উড়ছে। আর আমাদের সৈন্যরা কায়রোতে শান্তিতে বসে বিলাসিতা ও ষড়যন্ত্র করছে? জেহাদী কাফেলার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চাইছে? যারা শহীদের রক্তের দাম দিতে জানে না, মা বোনদের ইজ্জত রক্ষা করতে জানে না, তাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’
আমরা জানতে পেরেছি তারা ইসলামের শত্রুদের বন্ধু হয়ে গেছে। আমরা যতক্ষণ এই গাদারদের নিজ হাতে হত্যা না করবো ততক্ষণ শহীদ ভাইদের আত্মা আমাদের ক্ষমা করবে না। এই আহতদের দেখুন, যাদেরকে আমরা সঙ্গে নিয়ে এসেছি, এদের কারো পা নেই, কারো হাত নেই। তার সার্থীরা শক্রদের বন্ধু হয়ে জাতির ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে, এটা দেখার জন্যই কি তারা পঙ্গু অবস্থায় অসহায়ের মত বেঁচে থাকবে?’
তার কথার প্রতিধ্বনি করে সৈন্যরা শোরগোল শুরু করে দিল, “আমরা তাদের নিজ হাতে শাস্তি দেবো ।
এ শোরগোল শুনে আশপাশ থেকে আরো সৈন্য সেখানে এসে জমা হতে লাগলো। তারা সবাই সুলতান আইয়ুবীর লাগলো। সুলতান গভীর মমতা নিয়ে সৈন্যদের এ আবেগ ও প্রেরণা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করলেন ।
তিনি সৈনিকদের এই আবেগ ঠাণ্ডা করতে বা তাদের মনে ব্যথা দিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি বললেন, “অবশ্যই আমরা তাদের শাস্তি দেবো, তবে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে নয়। আপনারা সবাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। শাস্তি দেয়ার নাম করে আমরা কোন আহাম্মকী করতে চাই না। আমাদের উপদেষ্টারা আছেন, সালার এবং কমাণ্ডাররা আছেন, তাদের নিয়ে বসে আমি দেখছি এ ব্যাপারে কি পদক্ষেপ নেয়া যায়।’
তিনি নিজের তাবুতে ফিরে গেলেন এবং উপদেষ্টা ও কমাণ্ডারদের ডাকলেন। সবাই একত্রিত হলে তিনি বললেন, শিক্রর চাল এখন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে । ওরা চায় আমরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে ধ্বংস হয়ে যাই। কিন্তু সে সুযোগ আমি শক্রদের দেবো না। পরবতী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এই উত্তেজিত সৈন্যরা এখানেই বিশ্রাম কবরে। গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে হবে আমাদের । আমি আজ রাতে কায়রো যাবো। কেউ যেন না জানে আমি এখানেই নেই। সৈন্যদের উত্তেজনায় আপনারা শরীক হবেন না। আবার এমন কিছু করবেন না বা বলবেন না, যাতে তাদের আবেগে আঘাত লাগে |
তিনি বিশেষভাবে বললেন, কায়রোয় আমাদের যে সব সৈন্য বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করছে তারা আমার দৃষ্টিতে নিরপরাধ। ওদেরকে আমাদের সরকারী কিছু অফিসার ও পদস্থ কর্মকর্তারা উত্তেজিত করেছে। এই কর্মকর্তাদের নির্দেশে ও ছত্রছায়ায় কায়রোসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে যৌনতা, নেশা ও বিলাস সামগ্ৰী ছড়ানো হয়েছে। এই চরিত্র বিধ্বংসী তৎপরতা সমাজে এতটা ব্যাপকভাবে জেকে বসেছে এ জন্য যে, আমাদের প্রশাসন দুষ্কৃতকারীদের গতিরোধ করার পরিবর্তে তাদের সহযোগিতা করেছে। আর এটা ওরা করেছে দুশমনের বেতন খেয়ে । যখন কোন জাতির প্রশাসন, সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সচিবরা শক্রদের হাতের পুতুল হয়, তখন সে জাতির সর্বনাশ এভাবেই ঘটে।
আমাদের সৈন্যদের একটি অংশ সুদানের উষর মরুভূমিতে যুদ্ধ করছে, প্রাণ দিচ্ছে। অথচ আমাদের প্রশাসন তাদের রসদপত্র, খাদ্য ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে ক্ষুধা ও পিপাসায় সৈন্যদের প্রাণ দিতে বাধ্য করছে।
এদের এ অপকর্মের ফলেই তকিউদিনের সৈন্যরা আজ দুর্দশায় পড়েছে। অস্ত্রসমপণ না করে বাঁচার আর কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না সে। ওরা কেবল তকিউদ্দিনের বাহিনীকে সেনাবাহিনীর মর্যাদা ও সম্মান হেয় করার জন্যও উঠে পড়ে লেগেছে। তকিউদ্দিন পরাজিত হয়ে ফিরে এলে বা বন্দী হলে ওরা বলবে, দেখো পরাজিত সৈন্যরা ফিরে এসেছে। জাতির সম্মান ও ইজ্জত রক্ষার কোন যোগ্যতাই এদের নেই।
এসব গাদ্দাররা মিশরের গদিতে বসার স্বপ্ন দেখছে। এ জন্যই তারা সেনাবাহিনীকে জাতির কাছে ছোট ও ঘৃণিত করতে চায়। তারা যখন জাতির ঘাড়ে সওয়ার হবে তখন যেন সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করার মনোবল হারিয়ে ফেলে এ জন্যই তারা এ চক্রান্ত করছে। এ অৰস্থায় চুপচাপ বসে থাকার কোন অবকাশ নেই আমাদের ।
যদি ওরা দ্বীনের জন্য এ চেষ্টা করতো তবে আমি সে বাহিনীতে সাধারণ সৈনিক হয়ে লড়াই করতাম। কিন্তু ওরা নিজের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্য। এ জন্য দুশমনের সাথে হাত মিলাতেও তাদের আপত্তি নেই। ওদের একমাত্র । লক্ষ্য ছলে বলে কৌশলে নিজের ক্ষমতা লাভ | দ্বীন ও ঈমানের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমি চাই জাতিকে সেইখানে নিয়ে যেতে, যেখানে সে দ্বীনের শক্রদের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে বীরের মত বুক ফুলিয়ে চলতে পারে। কুচক্রীদের ঘৃণ্য দৃষ্টি বর্তমান ও ব্যক্তি স্বার্থের দিকে, আমাদের দৃষ্টি জাতির ভবিষ্যত কল্যাণের দিকে।
তিনি একটু থামলেন। এরপর রক্ষী প্রধানকে বললেন, আমার ঘোড়া প্রস্তুত করতে বলো।
এরপর তিনি উপস্থিত উপদেষ্টা ও সালারদের দিকে ফিরে বললেন, “আমি কায়রো যাবো। ওখান থেকে আমি তোমাদের জানাবো তোমরা কখন এখান থেকে রওনা হবে।’
তিনি কয়েকজন কমাণ্ডো লিডারকে তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার জন্য দ্রুত প্রস্তুত হয়ে আসতে বললেন।
তারা উঠে দাঁড়ালে তিনি বললেন খবরদার আমার অনুপস্থিতির খবর যেন সৈনিকরা না জানে। আমার তাবু গুটাবে না, এ অবস্থায় রেখে দেবে। যাতে তাদের সন্দেহ না হয়, আমি এখানে নেই।’
কমাণ্ডো লিডাররা বেরিয়ে গেল। তিনি উপদেষ্টাদের দিকে ফিরে বললেন, আমি আপনাদের স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, যে সব সৈন্য বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আমি তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবো না। আপনারাও কেউ তাদের বিরুদ্ধে কোন কটুক্তি করবেন না। কেউ যেন ওই সৈনিক ভাইদের ঘৃণার পাত্ৰ মনে না করে সে চেষ্টা করুন।
আমি এ্যাকশন নেবো তাদের ওপর, যারা সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত ও বিভ্রান্ত করেছে এবং জাতিকে বিপথগামী করার জন্য নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আমি জানি, কায়রোর যে সৈন্যদের নামে আজ অভিযোগ উঠেছে তারা ষড়যন্ত্রের শিকার। এরাই যখন শক্রর সামনে যাবে এবং শক্রর তীর আল্লাহর সৈনিক। বিদ্রোহের পোঁকা তখন তাদের মাথা থেকে পালিয়ে যাবে। আপনারা আপনার সন্তানকে এইসব করছে। দেখবেন, তাদের মন স্বাভাবিকভাবেই জুয়ার দিক থেকে জিহাদের দিকে ফিরে আসবে।
আমি আপনাদের স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, ইসলাম ও ইসলামী সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ও সম্মান কেবলমাত্র এইসব থেকে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। তাদের চতুর্মুখী চক্রান্ত বলছে, ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদদের বিরুদ্ধে তারা একটার পর একটা ষড়যন্ত্র করে যাবে। তাদের সকল তৎপরতার উদ্দেশ্য, দুনিয়ার বুক থেকে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা। আমরা এই অপতৎপরতা বরদাশত করতে পারি না।
মনে রাখবেন, মুজাহিদদের মর্যাদা যখন মুসলমানদের কাছে হেয় বা খাটো হয়ে য়ায় তখন মুসলমানদের জাতীয় মর্যাদা এবং সম্মানও বিশ্ব দরবারে ভূলুষ্ঠিত হয়ে যায়। কোন থাকতে পারে না। আমাদের আজকের ভুল, ইসলামকে আগামী কাল অন্ধকারে নিমজ্জিত করবে। আমাদের আজকের সঠিক পদক্ষেপ, আগামী প্রজনের জন্য বয়ে আনবে সাফল্যের স্বর্ণতোরণ। আমাদের আজকের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা, আগামী প্রজন্মকে নিয়ে যাবে ক্ষতি ও ধ্বংসের অতল গহবরে ।
মাননীয় আমীর! একজন উপদেষ্টা বললেন, “আমাদের ভাইয়েরা গাদারীতে নাম লিখিয়ে আগামী প্রজন্মের নিশ্চিত বরবাদী ও ধ্বংসের কাজ তো সম্পন্ন করেই ফেলেছে। তারা এখন ক্রমাগত গোলাম ও দাসে পরিণত হতে থাকবে। স্বাধীনতা কাকে বলে, জাতীয় সম্মান কি জিনিস। এসব কোন অনুভূতিই তাদের থাকবে না। আমাদের কাছে কি এর কোন চিকিৎসা আছে?”
‘এর চিকিৎসা হচ্ছে জাতির বিবেককে জাগ্রত করা!’ প্রজা নয়, জাতির প্রতিটি নাগরিক তার নিজ নিজ অবস্থানে একজন দায়িত্বশীল। তারা যদি বাদশাহর মত স্বাধীন ও সচেতন হয়, তবে জাতির অস্তিত্ব তারাই রক্ষা করবে। এ জন্য কোন ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করবেন না ।
আমাদের নেতাদের মধ্যে বাদশাহ হওয়ার প্রতিযোগিতা ও উন্মাদনা শুরু হয়েছে। এ জন্য তারা জাতির প্রতিটি নাগরিককে প্রজা বানিয়ে নিজেদের বাদশাহী ও ক্ষমতা প্রদর্শন করতে চায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষ পশু নয় যে আমরা তাদের জানোয়ারের মত হাকিয়ে বেড়াবো। মানুষের মধ্যে বিবেক-বুদ্ধি আছে, আত্মসম্মানবোধ আছে এবং জাতীয় মর্যাদার অনুভূতি আছে। জাতির এই গুণগুলো বিকশিত থাকলে জাতি নিজেই চিন্তা করে নেয়, কিসে তার ভাল আর কিসে মন্দ। যদি জাতি মনে করে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর সুরক্ষিত রেখে রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটাতে পারবেন, তাহলে জাতির যে কেউ আমার পথ আগলে যেন উচ্চারণ করে, সালাহউদ্দিন, তুমি এখন মসনদ খালি করো, আমরা তোমার চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পেয়েছি। জাতির মধ্যে এ চিন্তা চেতনা ও সাহসের বিস্তার ঘটুক, যাতে কেউ ফেরাউনের মত দাম্ভিক হতে না , পারে । শাসকের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তার শিরচ্ছেদ করার দুঃসাহস যেন জন্ম নিতে না পারে কোন শাসকের মনে।
রক্ষী ভেতরে প্রবেশ করলো। সালাম দিয়ে বললো, আমীর, আপনার ঘোড়া প্রস্তুত।”
ততোক্ষণে সঙ্গে যাবার জন্য যাদের নাম বলেছিলেন, তারাও তৈরী হয়ে চলে এল । সুলতান আইয়ুবী তাদের মধ্য থেকে বারোজনকে সাথে নিলেন। অন্যদের বললেন, “তোমরা এ তাবুর চারপাশে পাহারা দিতে থাকবে। কেউ যেন জানতে না পারে, আমি এখানে নেই।’
তিনি বারজন কমান্ডোকে বললেন, মাইলখানেক পূবে যে ছোট্ট পাহাড় দেখা যাচ্ছে তার ওপাশে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করো। প্রত্যেকে আলাদা আলাদাভাবে যাবে। তোমাদের গতি দেখে কেউ যেন বুঝতে না পারে তোমরা সফরে যাচ্ছো। যাৰে গোপনে এবং একেকজন একেক দিক দিয়ে যাবে।
সফরসঙ্গী বেড়িয়ে গেলে তিনি দ্রুত তৈরী হয়ে বাইরে এলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ায় চেপে রওনা হয়ে গেলেন নির্দিষ্ট স্থানে ।
০০০
সন্ধ্যায় সাদিয়া ইমামের জন্য খাবার নিয়ে এসে মাহমুদকে দেখে থতমত খেয়ে গেল এবং হেসে দিল ।
মাহমুদ বলল তুমি আমার জন্য খাবার আনবে না?
সাদিয়া এর কোন জবাব না দিয়ে ইমামের খাবার রেখে দৌড়ে বাড়ি চলে গেল। কিছুক্ষণ পর রুটি ও বকরির দুধ নিয়ে ফিরে এলো সে ।
সাদিয়া চলে যেতেই ইমাম সাহেব বললেন, “এ মেয়েটি গ্রামের সবচে সুন্দরী মেয়ে। বয়স কম, কিন্তু মেয়েটি বেশ বুদ্ধিমতি। আফসোস! মেয়েটি শীগগীরই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
‘বিক্রি হয়ে যাচ্ছে?’ অবাক হয়ে মাহমুদ প্রশ্ন করল, “মানে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে?”
না, বিয়ে নয়, বিক্রি। ইমাম সাহেব বললেন, ‘তুমি তো জানো এ ধরনের গরীব লোকের সুন্দরী মেয়েরা বিয়ের নামে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু সাদিয়ার ব্যাপারটা আরো ব্যতিক্রম । বলতে গেলে সে সরাসরিই বিক্রি হচ্ছে। যে তাকে খরিদ করতে চায় সে সন্দেহভাজনদের একজন। লোকটি এখানকার বাসিন্দা নয়, মনে হয় যারা আমাকে হুমকি দিয়েছিল সে তাদেরই কেউ ।
মাহমুদ কেমন একটু বিমর্ষ হয়ে গেল, কিন্তু কিছু বলল না ।
ইমাম সাহেবই মুখ খোললেন আবার, এই মেয়েকে তারা ট্রেনিং দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে, এ কিন্তু সে একটি মুসলিম পরিবারের কন্যা। তার ইজ্জত ও সম্মানের হেফাযত করা ইসলামের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। আমি মেয়েটিকে কিছুতেই বিক্রি হতে দেবো না। সাদিয়ার বাবা আমার ভক্ত। কিন্তু সে গরীব ও অসহায়। মেয়েকে বাঁচানোর কোন সামর্থ্য তার নেই। কিন্তু আমরা আছি। সাদিয়ার মান সম্মান ও সতীত্ব রক্ষার দায়িত্ব এখন আমাদের। এটা আমাদের ঈমানী ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সুতরাং কঠিন হলেও এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কোন সুযোগ নেই আমাদের।”
প্রকাশ্যে ছাত্র ও তালবে এলেম হলেও আসলে ইমাম সাহেবের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও গার্ড হযে গেল মাহমুদ। এখন নিয়মিত সাদিয়ার সাথে তার একাধিকবার দেখা হয়। দিন যতই যেতে লাগলো, মাহমুদের সঙ্গে সাদিয়ার ঘনিষ্ঠতাও বাড়তে লাগলো। বুদ্ধিমতি সাদিয়া দেশ গ্রামে কখন কি ঘটে সব খোঁজ খবর রাখতো। সাদিয়ার কাছ থেকেই কথায় কথায় মাহমুদ জেনে নিত আশপাশের সব গ্রামের সংবাদাদি। জেনে নিত স্থানীয় জনমত।

এর মধ্যে একদিন একটি ঘটনা ঘটল । সাদিয়া প্রতিদিন চারণভূমিতে বকরী ও উট চরাতে যায়। মাহমুদও সময় পেলেই ছুটে যায় সেখানে। একদিন মাহমুদ সাদিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, যে লোকটা তোমাকে খরিদ করতে চায়, সে কে?”
এ কথায় সাদিয়ার চেহারা বিমর্ষ হয়ে গেল। বললো, ‘আমি চিনি না, কোনদিন তাকে দেখিনি। কোথায় বাড়ি, কি করে কিছুই আমার জানা নেই। যেদিন আমাকে দেখতে এসেছিল সেদিন এক পলকের জন্য একটু দেখেছি, এর বেশি আর কিছু জানি না।’
তাহলে সেই অচেনা লোকটি তোমাকে এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে দেখেও গেছে!
সাদিয়ার মনটা আরো বিমর্ষ হয়ে গেল। মনে পড়ল লোকটা তাকে এমন ভাবে দেখেছে, যেন সে হাট থেকে গরু ছাগল কিনতে এসেছে।
সাদিয়া জানতো, তার যা রূপ যৌবন তাতে সে কোন লোকের স্ত্রী হতে পারবে না। তার আগেই আরবের কোন ধনী বণিক, কোন আমীর বা উজিরের দালাল ছুটে আসবে তাকে কিনে নিতে । গরীবের ঘরের রূপসীদের না পেলে এসব নবাবজাদাদের অন্দর মহলের শোভা বর্ধন হয় না, আভিজাত্য রক্ষা হয় না। তাই টাকার বাণ্ডিল নিয়ে দালালরা ঘুরে বেড়ায় গ্রামে গ্রামে। কোন ঘরে রূপসী সুন্দরীদের দেখলেই শুরু করে দরদাম। এভাবেই একদিন গ্রামের কুঁড়েঘর থেকে ওরা ঠাই পায় শাহী প্রাসাদে । শোকেসে সাজানো তৈজসপত্রের মতই যুগ যুগ ধরে ।
ওরা বন্দী থাকে সুরম্য অট্টালিকায়। সেখানে ওদের কোন ঘর সংসার হয় না, ছেলে সন্তান থাকে না। কেবল দিনে দিনে বয়স বাড়ে, একদিন বুড়ী হয়, তারপর কোন রকম পিছুটান না । রেখেই একদিন টুপ করে মরে যায়। তাদের জন্য এ পৃথিবীতে কান্নারও কেউ থাকে না, প্রার্থনা করারও কেউ না।
যৌবনের কয়েকটা দিন ওরা বেশ সমাদরে থাকে। নাচ গান শিখিয়ে আনন্দ স্ফূর্তির সামগ্ৰী বানিয়ে ওদের পরিবেশন করা হয় মেহমানদের সামনে। মেহমানরা তাদের গান শুনে, নাচ দেখে হাততালি দেয়, এটুকুই তাদের জীবন।
সাদিয়া তাদের গ্রামের এমন অনেক হতভাগ্য মেয়ের জীবন কাহিনী শুনেছে। জানে, তাকে নিয়েও হয়তো একদিন কাহিনী হবে, কিন্তু সমাজ ও সংসারে জায়গা হবে না তার। এ নিয়ে খুব ভাবতো সে। কারণ, গ্রামের সহজ সরল মেয়ে হয়েও সে ছিল খুব বুদ্ধিমতি। তাই সে তার জীবনের ভালমন্দ নিয়ে ভাবতো।
মাহমুদকে দেখার পর তার অন্তরে যে নতুন আবেগ এসে ভর করলো, সে আবেগ তার চিন্তাধারায় এনে দিল নতুন গতি । সে অনুভব করলো, সে যেমন মাহমুদকে ভালবাসে, মাহমুদও তেমনি ভালবাসে তাকে । তার মনে হলো, জীবন মানুষের একটাই, বন্দী পাখির মত ছটফট করে এ জীবনে বেঁচে থাকার সার্থকতা কি! তারচে জীবনকে ভালবেসে যে কটা দিন বাঁচা যায়, সে বাঁচায় আনন্দ আছে, সুখ আছে, সার্থকতা আছে।
না, সে আর বিক্রি হবে না। যদি মাহমুদ রাজি হয় তবে তাকে নিয়ে সে জীবনটাকে সুন্দর ও আনন্দময় করে তুলবে।
হোক সে জীবন সংক্ষিপ্ত। মানুষ আর কদিন বাঁচে। মহাকালের স্রোতধারায় মানুষের জীবন একটি বুদবুদ বৈ তো নয়! তার বুদবুদটুকু না হয় আরেকটু ছোট হলো!
কিন্তু এসব কি ভাবছে সে! তার বিক্রির কথা তো পাকাপাকি হয়ে গেছে। এখন যে কোন দিন খরিদার এসে টাকা দিয়ে নিয়ে যাবে তাকে ।
সে ব্যাকুল নয়নে মাহমুদের দিকে তাকালো। বললো, মাহমুদ, তুমি এ প্রসঙ্গ এখন কেন তুললে! কেন মনে করিয়ে দিলে আমি মানুষ নই, ধনীদের শখের সামগ্ৰী? কেন তুমি এভাবে আমার কষ্টের কথা আমাকে মনে করিয়ে দিলে? তার কণ্ঠে কান্নার মিহিদানা।
তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছো, এ কথা যতবার মনে হয় ততবার নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে। ভাবি, একজন মুসলমান হিসাবে আমার কি কিছুই করার নেই? আল্লাহর বিধানে এভাবে নারীদের ক্রয়-বিক্রয় করার কোন সুযোগ নেই। বিক্রি তো দূরের কথা, এমনকি মাতার। অথচ যারা কিনছে, যারা বিক্রি করছে এবং আমরা যারা এ অন্যায় দেখছি ও শুনছি, আমরা সবাই নিজেদের মুসলমান বলে দাবী করি।
‘আমার আব্বা একজন অসহায় ও গরীব মানুষ । সামাজিক কারণেই এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া আব্বার পক্ষে সম্ভব নয়। আর আমাকে বিয়ে করার জন্য এখনো কেউ প্রস্তাবও দেয়নি, ফলে আব্বা নিরূপায়।”
কেউ যদি বিয়ে করতেচায় তাতে তোমার আব্বা রাজি হবেন?
কেন হবেন না? আব্বা তো ইচ্ছে করে বা টাকার লোভে এ প্রস্তাব কবুল করেননি, করেছেন দায়ে ঠেকে, সামাজিক চাপের মুখে ।
আমার কাছে কিছু টাকা থাকলে তোমার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতাম। কিন্তু তাকে খুশি করার মত কিছুই যে নেই আমার কাছে! আমার কাছে যা আছে তাতে তোমার বাবার মন ভরবে না।
আমার বাবার মন কিসে ভরবে আর কিসে ভরবে না প্রস্তাব পাঠানোর আগেই কিভাবে ফয়সালা করলে! তুমি যা দিতে পারো তা আমাকে বলো, আমি বাবাকে রাজি করানোর দায়িত্ব নিচ্ছি।’ বলল সাদিয়া।
‘আমার কাছে তো এখন দেয়ার মত একমাত্র মন ছাড়া আর কিছুই নেই সাদিয়া’, মাহমিদ বলল, ‘জানি না আমার মনের মূল্য বোঝ কি না?’
যদি তোমার মনে আমার জন্য ভালবাসা থাকে তবে তা আমার জন্য অনেক বেশি পাওনা। সাদিয়া বললো, তুমি ঠিকই বলেছো, আমার বাবার কাছে এ মূল্য গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু আমি তোমাকে এ কথাও বলবো, আমার বাবা আমাকে বেঁচতে চান না। তার দুর্বলতা, তিনি গরীব ও সংসারের একমাত্র পুরুষ। আমার কোন ভাই নেই। সে লোক বাবাকে হুমকি দিয়েছে, যদি বাবা স্বেচ্ছায় আমাকে বিক্রি না করে তবে আমাকে ওরা কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে বাবা আমাকেও হারাবে, টাকাও হারাবে। বাবা লোকটাকে পছন্দ করে না, কিন্তু নিরূপায় হয়ে রাজি হয়েছে।
‘তোমার বাবার লোকটাকে পছন্দ না করার কারণ? মাহমুদ জিজ্ঞেস করলো, ‘এ গ্রামে তো মেয়েদের বিক্রি করা নতুন কিছু নয়?”
বাবা বলেছেন ‘লোকটা মুসলমান নয়’ সাদিয়া বলল, আর আমিও বাবাকে বলে দিয়েছি, ‘আমি কোন অমুসলিমের সাথে যাবো না।’
একটু চুপ করে থেকে সাদিয়া আবার মুখ খুললো । অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো, মাহমুদ, তুমি কি সত্যি আমাকে ভালবাসো। বলো, তুমি যদি চাও আমি তোমার সাথে পালিয়ে যেতে প্রস্তুত আছি।
‘তুমি জানো আমি তোমাকে সত্যি ভালবাসি। হ্যা! আমিও প্রস্তুত!’ মাহমুদ আবেগে বললো।
তবে চলো আজ রাতেই আমরা এ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাই।’ সাদিয়াও উৎসাহের সাথে বললো।
না! আজ রাতে নয়!’ মাহমুদের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, আমি আমার দায়িত্ব পূর্ণ না করে যেতে পারবো না।’
‘কোন দায়িত্বের কথা বলছো?” সাদিয়া প্রশ্ন করলো।
মাহমুদ বিন আহমদ চমকে উঠলো। সাদিয়াকে সে দায়িত্বের কথা বলা যায় না। সে তার মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া কথাকে গোপন করতে চেষ্টা করলো। সাদিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল আমি ইমাম সাহেবের কাছে তালিম নিতে এসেছি। সে শিক্ষা শেষ না করে আমি কোথাও যেতে পারব না।’
জানিনা ততোদিনে আমার পরিণতি কোথায় গিয়ে পৌছবে।’ সাদিয়া আক্ষেপের সুরে বললো।
একটি মেয়ের জন্য মাহমুদ দায়িত্বের ব্যাপারে উদাসীন হতে রাজী নয়। তা ছাড়া মেয়েটি শক্রদের গোয়েন্দা দলের । কেউ নয় এ নিশ্চয়তা কে দেবে! এখনো তার ব্যাপারে আরো খোঁজখবর নেয়া দরকার আছে বলে মনে হলো তার। সাদিয়াকে তার ভাল লাগে ঠিকই, কিন্তু এসব ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে হুট করে কিছু করে ফেলা সে ঠিক মনে করলো না। বললো, সাদিয়া, অস্থির হয়ো না, আল্লাহ আছেন, আমাদের ভাল-মন্দ তিনিই দেখবেন। সবুর করো, আমি তো তোমার কাছেই আছি। তেমন কিছু হলে তখন দেখা যাবে।’
গভীর রাত। মরুভুমির অন্ধকার ভেদ করে প্রাণপণে ছুটে যাচ্ছে চৌদ্দটা ঘোড়া ! সালাহউদ্দিন আইয়ুবী অন্ধকার কেটে যাওয়ার আগেই কায়রো পৌছতে চাচ্ছিলেন। সুলতানের সাথে এ সফরে ছিলেন তার নিত্য সহচর এবং প্রতিটি বিজয়ের গর্বিত অংশীদার আলী বিন সুফিয়ান। আর ছিলেন শত প্রতিকুলতা, সংকট ও সংঘাতে পরীক্ষিত কয়েকজন বিচক্ষণ জানবাজ সহযোদ্ধা।
রাতের আঁধার কেটে যখন তারা তীব্র বেগে ছুটে চলেছেন কায়রোর দিকে, তখন তার সৈন্যরা নিশ্চিন্তে তাবুতে গভীরে নিদ্রায় বিভোর। জাগ্রত প্রহরীরাও জানতে পারেনি সালারে আযম কখন চলে গেছে তাবুর বাইরে।
কায়রোর সেনাবাহিনী এবং অধিবাসীরা জানে সুলতান আইয়ুবী কায়রো থেকে অনেক দূরে ক্রাকের দূর্ভেদ্য দুর্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কল্পনাও করেনি, সুলতান আইয়ুবী তার বাহিনী নিয়ে কায়রোর এত কাছে অবস্থান করছেন। রাতের শেষ প্রহরে যখন সুলতান আইয়ুবী কায়রো প্রবেশ করেন তখনো ঘুম ভাঙেনি শহরবাসীর।
শহরে প্রবেশ করতে কেউ তাদের বাঁধা দেয়নি, কারণ সেখানে কোন প্রহরীই ছিল না।
সুলতান আইয়ুবী সাথীদের বললেন, শহরের নিরাপত্তা ভার যাদের কাঁধে, তারা কেউ পাহারায় নেই, এটা কি বিদ্রোহ নয়? সৈন্যরা আরামে ঘুমাচ্ছে, তারা নির্ভয় ও দায়িত্বহীন। যে দেশের সৈন্যরা দুটি রণাঙ্গণে প্রাণপণ যুদ্ধে লিপ্ত, সে দেশের সৈনিকদের এ নির্লিপ্ততা ও দায়িত্বহীনতাই এক ধরনের বিদ্রোহ।”
কায়রোতে তার নির্দিষ্ট স্থানে পৌছলেন সুলতান। সারা রাতের পথশ্রমে ক্লান্ত তিনি, কিন্তু এক মুহূর্তও বিশ্রামের সুযোগ নিলেন না, সঙ্গে সঙ্গে মিশরের প্রতিরক্ষা প্রধানকে ডেকে পাঠালেন। প্রতিরক্ষা প্রধান সুলতান আইয়ুবীকে ভয়ে থতমত খেয়ে গেল ।
তিনি কায়রোর প্রতিরক্ষা,প্রধানকে নিয়ে বসলেন। বিশদ রিপোর্ট পেশ করতে। প্রতিরক্ষা প্রধানের বক্তব্য শেষ অবস্থা জানতে চাইলেন। প্রতিরক্ষা প্রধান সন্দেহভাজনদের একটি তালিকা সুলতানের হাতে তুলে দিলেন। ।
সবকিছু শোনার পর সুলতান আদেশ দেয়া আরম্ভ করলেন। বললেন, ‘যে সকল সামরিক অফিসার সন্দেহভাজন তাদেরকে কেন্দ্রীয় কমাণ্ডে নিয়ে যাও। এই মুহুর্তে সেনা ছাউনিতে যত সৈন্য আছে সবাইকে সূর্য উঠার আগেই যুদ্ধ যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে বলো। সৈন্যদের বলবে, আমি কায়রোতে এসেছি ওদের নিয়ে যেতে এবং এখুনি তাদেরকে আমার সাথে ময়দানে রওনা হতে হবে।’
তিনি প্রতিরক্ষা প্রধানকে আরও কিছু জরুরী নির্দেশ দিয়ে বিদায় করলেন। ফিরলেন আলী বিন সুফিয়ানের দিকে। আলী বললেন, সুলতান, আমার জন্য আপনার নির্দেশ কি? সুলতান তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে বিদায় করলেন ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনা ব্যারাকে হুলস্থল পড়ে গেল। ঘুম থেকে তুলে সৈন্যদের জানানো হলো সুলতানের আগমন বার্তা ও নির্দেশ। সন্দেহভাজন অফিসারদেরকে সুলতান আইয়ুবীর হেডকোয়ার্টারে পাঠানো হলো। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা ভাবাচেকা খেয়ে গেল। যেই তারা শুনল, সুলতান আইয়ুবী এসে গেছেন, অমনি তাদের বুক ধরফড় শুরু হলো।
তারা সুলতানের ঘোড়া চিনতে পারল এবং এখন তাদের করনীয় কি এ কথা ভাবার আগেই তাদের বলা হলো হেডকোয়ার্টারে সুলতানের কাছে রিপোর্ট করতে। তালিকাভুক্ত হলো, সুলতান গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছেন। আপনাদের তিনি জরুরীভাবে তলব করেছেন। আপনারা বসুন, কাজ শেষ হলেই তিনি আপনাদের সাথে দেখা করবেন।
উপস্থিত অফিসারদের কেউ এখনো সুলতান আইয়ুবীকে চোখে দেখেনি। সুলতান আইয়ুবীও এখনি অফিসারদের সঙ্গে দেখা দিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি তাদেরকে এখানে ডেকে এনেছেন, যাতে সেনাবাহিনী যাত্রা করার আগ পর্যন্ত সৈন্যদের সাথে তাদের দেখা না হয় এবং কোন অফিসারের মনে কোন দুরভিসন্ধি থাকলেও তা বাস্তবায়নের সুযোগ না পায়।
তখনও ভোরের আলো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। সৈন্যদেরকে লাইন করে দাড় করিয়ে দেয়া হলো। প্রথমে পদাতিক বাহিনী, তারপরে অশ্বারোহী বাহিনী এবং তারও পিছে খাদ্য ও রসদ বহণকারী উটের কাফেলা।
সুলতান আইয়ুবী তার সেনাদের বিশেষভাবে ট্রেনিং দিয়েছিলেন। সেই ট্রেনিং অনুযায়ী জরুরী অভিযানের আহবান এলে সৈন্যরা এক ঘণ্টার মধ্যেই রসদ সামানসহ যাত্রা শুরু করে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যেতে পারত।
সুলতান আইয়ুবী তার ঘোড়ার ওপর সওয়ার হলেন, তার সঙ্গে মিশরের প্রতিরক্ষা প্রধান। সুলতান আইয়ুবী সৈন্যদের এক একটি সারির সামনে দিয়ে যেতে লাগলেন এবং তাদের দেখতে লাগলেন। তার মুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। তিনি সৈন্যদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগলেন, ‘সাবাস! সাবাস নওজোয়ান! হে আল্লাহর সেনাদল, তোমদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক ।
সুলতান সালাহউদিনের নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব ছিল । তার প্রভাব অনুভব করতো প্রতিটি সৈনিক। তাদের সঙ্গে সহাস্য বদনে কথা বলছেন তাদের আমীর ও সর্বাধিনায়ক, এ আনন্দের তৃপ্তির প্রভা ছড়িয়ে আছে প্রতিটি সৈনিকের চেহারায়। তাদের নিতে এসেছেন তাদের শ্রদ্ধেয় আমীর, এ কথা ভেবে গর্বে ফুলে উঠছিল তাদের বুক ।
পর্যবেক্ষণ শেষ করে সুলতান আইয়ুবী সৈনিকদের সামনে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। সে ভাষণে যুদ্ধের জন্য উদ্বেলিত হয়ে উঠল প্রতিটি হৃদয় ।
সৈনিকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, হে আল্লাহর সৈনিকেরা! আল্লাহর নামে জীবন বিলিয়ে দেয়ার জন্য হে পাগলপারা মুজাহেদিন! ইসলামের সুনাম তোমাদের অন্ত্রকে ডাকছে। সুবাকের ময়দানে তোমরা কাফেরের সুদৃঢ় দুর্গ বালির পাহাড়ের মত ধ্বসিয়ে দিয়েছো । তোমরা ক্রুসেডারদের মরুভূমিতে কবর দিয়ে নিজেদের জন্য জান্নাতুল ফেরদৌসে ক্রয় করে নিয়েছো। তোমাদের প্রিয় বন্ধুরা তোমাদের সামনে শহীদ হয়েছে। তোমরা নিজ হাতে তাদের দাফন করেছ।
সেইসব কমাণ্ডো সৈন্যদের কথা স্মরণ করো, যারা অবলীলায় শক্রর বেষ্টনী ভেদ করে ঢুকে গেছে তাদের মধ্যে এবং শাহাদাতের পেয়ালা পান করে চলে গেছে আল্লাহর দরবারে । জানাজার নামাজ পড়ার জন্যও তাদের খুঁজে পাওনি তোমরা । তাদের লাশ তোমরা দেখতে পাওনি । তোমরা একটু চিন্তা করো, সে লাশের সাথে কেমন ব্যবহার করেছিল দুশমন?
শহীদের এতিম শিশুদের কথা চিন্তা করো। তাদের বিধবা স্ত্রীদের কথা স্মরণ করো। স্মরণ করো সেই জিন্দাদিল তাদের দুনিয়াবী সব সাধ-আহলাদ, ধন-সম্পদ এবং এমনকি নিজের প্রাণটুকু।
আজ শহীদদের আত্মা তোমাদের ডাকছে যুদ্ধের ময়দানে। তোমাদের বীরত্বগাথা তোমাদের আহবান জানাচ্ছে আবার ময়দানে ঝাপিয়ে পড়তে। শক্ররা ক্রাক দুর্গের সুদৃঢ় পাঁচিলের ওপর থেকে আগুন ছুড়ে ভষ্মিভূত করেছে তোমাদের ভাইদের । তোমরা যদি সে দৃশ্য দেখতে তবে তোমরা মাথা ঠুকেই ভেঙে ফেলতে ক্রাকের দুর্ভেদ্য দুর্গ প্রাচীর।
‘হে ইসলামের নিশান বরদার! ক্রাক দুর্গের মধ্যে তোমাদের বোন ও কন্যাদের সতীত্ব নষ্ট করছে দুশমন। তোমাদের বৃদ্ধ পিতাদের থেকে পশুর মত শ্রম আদায় করা হচ্ছে। যুবকদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। মাকে তার শিশু সন্তানদের থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। ।
একদিন আমরা পাথরের দুর্গ ভেঙ্গেছি, আজ মাটির কেল্লা আমাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রাকের কেল্লার দেয়াল ভাঙতে ব্যর্থ হয়ে আমি এসেছি তোমাদের কাছে।’
সুলতানের কণ্ঠে উপচে পড়া আবেগের জোয়ার। তিনি দুই হাত উর্ধে তুলে আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি, এই অপরাধে তোমরা আমার বুক তীর মেরে ঝাঝরা করে দিতে পারো, আমি কোন আপত্তি করবো না। কিন্তু আমার প্রাণ নেয়ার আগে আমি শুধু শুনতে চাই, তোমরা ক্রাকের দুর্গে ইসলামের বিজয় নিশান উড়িয়েছো । তোমাদের সতীত্ব নষ্ট হওয়া ময়ে ও বোনদের কান্না থেমে গেছে। তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে সান্তুনা দিচ্ছো তোমরা।”
শুনছিলো সেই জ্বালাময়ী ভাষণ। তাদের শিরায় শিরায় যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, কেবল আরোহীরা নয়, আবেগ ও উন্মাদনায় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে তাদের ঘোড়াগুলোও।
আরোহীরা সকলেই চুপচাপ। কিন্তু ঘোড়ার হেষা ও চঞ্চলতা বাড়ছিল। আরোহীরা জোরে লাগাম টেনে ধরে তাদের অস্থিরতা রোধ করছিল। জবান বন্ধ থাকলেও আরোহীদের চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছিল আবেগের রক্তিম আভা । সুলতান আইয়ুবীর প্রতিটি বাক্য যেন তীরের মত তাদের অন্তরে বিদ্ধ হচ্ছিল। জেহাদী জযবার বন্যা ধুয়ে মুছে ছাপ করে দিচ্ছিল তাদের মনে জমে থাকা বিদ্রোহের আগুন। সুলতান আইয়ুবীর উদ্দেশ্য সফল হচ্ছিল।
মুসলিম সাম্রাজ্যের ইজ্জত ও আবরু রক্ষীরা! তোমরা কাফেরদের মনে আতংকের ভয়ানক ঝড় সৃষ্টি করো বলে ওরা তোমাদের তলোয়ারের ধার ভোতা করতে চায়। এ জন্য তারা মদ, হাশিশ ও তাদের সুন্দরী মেয়েদের লেলিয়ে দিয়েছে তোমাদের পেছনে । তোমরা বুঝতে পারোনি, ক্রুসেডরা তাদের এক মেয়ের রূপের আগুন দিয়ে হাজার হাজার মুজাহিদের ঈমানী চেতনা পুড়ে ছারখার করে দিচ্ছে। ওরা শত মেয়েকে বেহায়া বানিয়ে দিচ্ছে। আজ সময় এসেছে আমাদের মা বোন কন্যাদের সন্ত্রম রক্ষা করার। তোমরা দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যাও, তোমাদের মাতা ভগ্নি কন্যাদের মান সম্মান ইজ্জত রক্ষা করে প্রমাণ করো তোমরা মুসলিম।
তোমরা ক্রাকের রণাঙ্গণে রওনা হতে যাচ্ছে । ওখানে গেলে তোমরা দেখতে পাবে দুর্গের চারপাশে কুরআনের ছেড়া পাতা উড়ে বেড়াচ্ছে। সেখানকার মসজিদগুলো খৃস্টানরা বাথরুমে পরিণত করেছে। যে ক্রুসেডাররা তোমাদের ভয়ে সুবাক থেকে পালিয়েছিল, তারা আজ ক্রাকে বসে গলা ফাটিয়ে হাসছে। যে ঈমানের বলে সুবাক তোমরা দখল করেছিলে, সেই ঈমান ও জযবা নিয়ে এগিয়ে যাও, ক্রাকও তোমাদেরই হবে।’
সুলতান আইয়ুবী সেনাবাহিনীর ওপর এই দোষারোপ করলেন না, তারা বিভ্রান্ত হয়ে গেছে এবং তারা বিদ্রোহী বা গাদার । তিনি কারো ওপর কোন সন্দেহ করলেন না, ইশারা ইঙ্গিতেও কটাক্ষ করলেন না কাউকে । তার পরিবর্তে সৈন্যদের মনে জাগিয়ে দিলেন জেহাদী জযবা ও বাতিলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দুরন্ত সাহস।
ভোরের উত্তাপ তখনো তীব্র আকার ধারণ করেনি, কিন্তু সৈন্যদের আবেগ উত্তপ্ত হয়ে উঠল আইয়ুবীর বক্তৃতায়। অভিভূত হয়ে সৈন্যরা লক্ষ্য করলো সমস্ত সেনাদল একটি জ্বলন্ত মশালে পরিণত হয়েছে।
সুলতান আইয়ুবী এরপর কমাণ্ডারদের নিয়ে বসলেন। ‘এখান থেকে সোজা ক্রাকের পথ ধরবে না। প্রথমে সুদানের পথে কিছু দূর এগিয়ে যাবে। মরুভূমিতে নেমে যখন বুঝবে কোন অনুসরণকারী পিছু নেয়নি, তখন বাহিনীর মুখ ঘুরিয়ে দেবে ক্রাকের দিকে।’
তিনি তাদেরকে কায়রো থেকে ক্রাকের দিকে যাওয়ার এমন এক রাস্তা বাতলে দিলেন, যাতে ক্রাকের রণাঙ্গণ থেকে আসা সৈন্যদের সামনে তাদের পড়তে না হয়। ক্রাক থেকে আসা বাহিনীর যে সব অফিসারকে তিনি সঙ্গে এনেছিলেন । তাদেরকে তিনি এই বাহিনীর সঙ্গে পাঠালেন। যাত্রার পূর্বে এইসব কমাণ্ডারকে আরো কিছু গোপন নির্দেশ দিলেন।
সৈন্যরা ক্রাকের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। কায়রোর আকাশ বাতাস ধ্বনিত করে আওয়াজ উঠলো, ‘আল্লাহু আকবার’। সুলতান আইয়ুবী প্রশান্ত চেহারায় খেলা করতে লাগলো কৃতজ্ঞতা ও সহমর্মিতার আবেগ ।
যখন সৈন্যরা তার চোখের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন তিনি এক কাসেদকে দিয়ে কায়রোর অদূরে ক্রাক রণাঙ্গণ থেকে আগত সেনা ক্যাম্পে চিঠি পাঠালেন । কাসেদ দ্রুত রওনা হয়ে গেল ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। চিঠিতে বলা হলো, ‘পয়গাম পাওয়া মাত্র সেনাবাহিনী নিয়ে দ্রুত কায়রো চলে এসো।”
কায়রো থেকে ক্যাম্পের দূরত্ব ছিল মাত্র আট দশ মাইল । অল্প সময়ের মধ্যেই কাসেদ ওখানে পৌছে গেল। চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেনাবাহিনী রওনা হলো কায়রোর উদ্দেশ্যে। সূর্যোদয়ের ঘন্টা দুই পরে সৈন্যদের প্রথম দলটি কায়রো এসে পৌছল এরপর একে একে সব দলই কায়রো সেনানিবাসে প্রবেশ করল।
এ সৈন্যদের সেই সব সিটে থাকার ব্যবস্থা হলো, যেগুলো আজ সকালে ক্রাক অভিমুখে রওনা হয়ে যাওয়া সৈন্যরা খালি করে দিয়ে গেছে। আগত সৈন্যরা খুব উত্তেজিত ছিল। আলী বিন সুফিয়ান তাদেরকে শান্ত করার ব্যবস্থা করলেন। তিনি তাদের জানালেন রণাঙ্গণে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’
তারা যখন শুনল, একটু আগে বিদ্রোহের অপরাধে যাদের খুন করার জন্য তারা পাগলপারা ছিল, বিদ্রোহের পরিবর্তে সেই সব সৈনিকরা জেহাদের ময়দানে রওনা হয়ে গেছে তখন তারা তাদের ভুল বুঝতে পারল এবং সুলতান আইয়ুবীর বিচক্ষণতায় অভিভূত হয়ে গেল।
আলীর সহযোগিতায় এভাবেই সুলতান আইয়ুবী সুকৌশলে মিশরে সেনা বিদ্রোহের পথ বন্ধ করলেন এবং সেনা বিদ্রোহের কারণে মিশরে গৃহযুদ্ধের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তা নিঃশেষ করে দিলেন।
কিন্তু সুলতানের কাছে সমস্যার কোন অভাব ছিল না। একটি সমস্যা থেকে তিনি মুক্তি পেলেন ঠিকই, কিন্তু আরো অসংখ্য সমস্যার পাহাড় তাঁর মাথায় বোঝা হয়ে রইল। তিনি উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারদের ডেকে সেনাবাহিনীকে নতুন করে বিন্যাস করতে বললেন ।
এরপর ডাকলেন প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানকে । তার কাছে তিনি জানতে চাইলেন, সীমান্ত রক্ষীরা কোথায় কি পরিমাণ আছে?
প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রধান সুলতানের কাছে সীমান্ত এলাকার বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করল। সুলতান বললেন, বিভিন্ন জায়গায় আরো সৈন্য পাঠাও। তিনি কোথায় কত সৈন্য পাঠাতে হবে সব বুঝিয়ে দিলেন তাকে ।

সুলতানকে বলা হয়েছিল, সীমান্ত রক্ষীরা দেশের সম্পদ আইয়ুবী আলী বিন সুফিয়ানের কাছ থেকে সীমান্তের দুনীতিপরায়ণ কমাণ্ডারদের তালিকা নিলেন এবং তাদেরকে সীমান্ত এলাকা থেকে প্রত্যাহার করে কায়রো আসার পরিবর্তে ক্রাকের যুদ্ধ সেক্টরে যোগ দেয়ার হুকুম দিলেন।
সেনা বিদ্রোহ দমন এবং গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা নাকচ করার পরও সুলতান আইয়ুবীর সামনে কয়েকটি গুরুতর সমস্যা রয়েই গেল। যেমন, ক্রাক থেকে ফিরে এলেও ক্রাক জয়ের চিন্তা তাঁর মাথায় রয়েই গেল। ওদিকে সুদানের রণাঙ্গণে ভাই তকিউদ্দিন যে গ্যাঁড়াকলে আটকে পড়েছে তাকে উদ্ধার করার কঠিন দায়িত্বও তাকেই পালন করতে হবে। গোয়েন্দা প্রধানের রিপোর্ট অনুযায়ী মিশরের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে এ মুহুর্তে তাকে আরো কয়েকটি কাজ করতে হবে ।
প্রথমত, কায়রোয় খৃস্টানরা যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু করেছে এবং যে আগ্রাসনের ফলে মুসলিম তরুণ ও যুব সমাজে ইতিমধ্যেই ব্যাপক ধ্বস নেমে এসেছে তার সয়লাব রোধ করা ।
দ্বিতীয়ত সীমান্তের সেনা বিভাগে যে ফুটাে সৃষ্টি হয়েছে সে ফুটো বন্ধ করে সীমান্তের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করা।
তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে ভয়ংকর ও জটিল সমস্যা হচ্ছে সীমান্তবতী অঞ্চলসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামগুলোতে যে ধর্মীয় ফেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার মোকাবেলা করা। কাজ অনেক, কিন্তু সময় কম।
আইয়ুবী অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করলেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করলেন । বিশেষ করে মিশরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তিনি যে যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন তা দেখে তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব এবং একান্ত বিশ্বস্ত ভক্ত অনুরক্তরাও চমকে উঠল।
গত রাতে ক্রাকের রণাঙ্গন থেকে আসা বাহিনীকে কায়রো থেকে আট দশ মাইল দূরে অবস্থানের নির্দেশ দিয়ে ফিরে এসেই সুলতান আইয়ুবী গোয়েন্দা বাহিনী প্রধান আলী বিন সুফিয়ান এবং পুলিশ বাহিনী প্রধান গিয়াস কামালের দেয়া রিপোর্ট নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকেছিলেন এবং দরজা বন্ধ করে গভীর মনোনিবেশ সহকারে তা পাঠ করেছিলেন । এইসব রিপোটে ইতিমধ্যে সীমান্তের কোন কোন সেনা অফিসার ও কমাণ্ডার খৃস্টানদের খপ্পরে পড়ে গেছে তার বিস্তারিত তালিকা ছিল ।
আরেকটি তালিকায় ছিল প্রশাসনের সেই সব উচ্চ পদস্থ অফিসার ও কর্মকর্তাদের নাম ঠিকানা, যারা খৃষ্টানদের বন্ধুত্ব কবুল করে নিয়েছিল এবং খৃষ্টানদের অর্থ, নারী ও মদের প্রভাবে নৈতিক অধপতনের শিকার হয়েছিল। এই তালিকায় এমন সব ব্যক্তিদের নামও ছিল, যারা রাষ্ট্রের মজলিশে শুরা এবং প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি ।
সারারাত ধরে খুটিয়ে খুটিয়ে তিনি প্রতিটি নাম পরীক্ষা করলেন। ভোরে কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই মিশরের বাহিনীকে ক্রাকে পাঠিয়ে দিয়ে এবং অন্য দলকে সীমান্তে প্রেরণ করে অতর্কিত অপারেশন চালিয়ে গ্রেফতার করলেন রাষ্ট্রের ও প্রশাসনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে । তাদের মধ্যে দুই তিনজন কেন্দ্রীয় মজলিশে সুরার সদস্য এবং উচ্চ পর্যায়ের সচিবও ছিলেন।
তাদের বাড়ী থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ, স্বর্ণ, মনিমুক্তা ও মূল্যবান বিদেশী সামগ্ৰী উদ্ধার হলো। প্রত্যেকের বাড়িতে পাওয়া গেল ইহুদী এবং খৃষ্টান মেয়ে। তাদেরও থেকেও অনুরূপ মালপত্র, মেয়ে এবং চাকর-চাকরানী বেশে লুকিয়ে থাকা সুদানী, ইহুদী এবং খৃষ্টান গোয়েন্দাদের উদ্ধার করা হয় ।
গ্রেফতারকৃতদের কোন রকম জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই কারাগারে প্রেরণ করা হলো । সুলতান আইয়ুবী কারারক্ষীকে আদেশ দিলেন, ‘এরা কেউ রাজবন্দীর মর্যাদা পাবে না। এরা সবাই রাষ্ট্রীয় ক্রিমিনাল, কারাগারে ক্রিমিনালদের সাথে যে ব্যবহার করা হয় এদের সাথেও সেই ব্যবহারই করবে।’
এই গ্রেফতারীর ফলে কেন্দ্রীয় কমাণ্ড কাউন্সিল ও মজলিশে শূরার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য হয়ে গেল। এইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে মিল্লাতে ইসলামিয়ার সেবা করে যাচ্ছিলেন। সমাজে তারা আইয়ুবীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হিসাবে পরিচিত এবং সম্মানিত ছিলেন। বিভিন্ন পদে কেউ কেউ এমনও ছিলেন যাদের কোন বিকল্প নেই বলে মনে করা হতো। কিন্তু গোয়েন্দা বিভাগের সুস্পষ্ট অভিযোগের ফলে এইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গ্রেফতারের ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত ও দ্বিধাৰিত হলেন না।
এই গ্রেফতারী তৎপরতা শেষ করতে মাত্র ঘন্টা দুই সময় নিলেন তিনি। দুপুরের আগেই সমুদয় কাজ শেষ করে Tতিনি যখন খেতে এলেন তখন কোন কোন উপদেষ্টা উদ্বেগাকুল কণ্ঠে বললেন, ‘সুলতান! যে ভয়ংকর পদক্ষেপ আপনি নিলেন এর পরিণতি কি হবে তাই ভাবছি আমরা । আমাদের এখন যে কোন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’
সুলতান উপস্থিত উপদেষ্টাদের দিকে তাকালেন । বললেন, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতীক্ষা ও বুদ্ধি পরামর্শ নিয়ে ইসলামী সাম্রাজ্যের এই ভিত গড়ে তুলেছিলাম, দীর্ঘদিনের সেইসব পরীক্ষিত বন্ধু ও সার্থীদের নিজ হাতে প্রেফতার করে কারাগারে পাঠাতে আমার চেয়ে আর কারো বেশি কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন যেখানে ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থের, সেখানে ব্যক্তিগত অনুভূতির কোন মূল্য নেই। এর পরিণতি ভয়ংকর হতে পারে বলে আপনারা যে আশংকা করছেন আমি সে আশংকা উড়িয়ে দেই না। কিন্তু আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ব্যক্তি যত গুরুত্বপূর্ণই হোক, সে যখন মূল স্রোতধারা থেকে ছিটকে পড়ে তখন সেখানে আর কোন স্রোত থাকে না । ডোবার পানির মতই তখন তা বন্ধা ও দূষিত হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে তার স্থলে নতুন করে যিনি দায়িত্বে আসেন, যদি তার যোগ্যতা আগের ব্যক্তির তুলনায় কিছু কমও হয়, কিন্তু তার মধ্যে থাকে ঈমানের মজবুতি, দায়িত্বে আন্তরিক ও নিবেদিতপ্রাণ, তবে আল্লাহর রহমত তার সেই ঘাটতি পূরণ করে দেয়। কোন গাড়ি তার লাইনে ঠিক ভাবে চলতে থাকলে কেবল ড্রাইভার বদলের কারণে তার চলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই।’
এরপর সুলতান আইয়ুবী আক্রমণ চালালেন সেই নাজুক অঙ্গনে, যেখানে আক্রমণ চালাতে পৃথিবীর সকল কালের সকল শাসক অসংখ্যবার চিন্তা ভাবনা করে নেন। সবকিছু জেনেশুনেও যেখানে আঘাত হানতে সাহস পান না অনেক শাসকই। ধর্মের নামে নানা কুসংস্কার তারা মুখ বুজে সয়ে নিতে কিছুতেই রাজি হন না।
সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর চরিত্রে কোন অস্পষ্টটা ও আপোষকামীতা ছিল না। ফলে ইসলামের নামে মুসলিম সমাজে যে ধর্মীয় ফেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল সেখানে দ্বিধাহীন চিত্তে আঘাত হানলেন তিনি।
সুলতান আইয়ুবীর উপদেষ্টারা অত্যন্ত খালেছ দীলে সুলতানকে এ পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘ধর্ম একটি নাজুক ও সেনসেটিভ ব্যাপার। আপনি কোন মসজিদের ইমামের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে তার মুসল্লিরা ক্ষেপে যাবে আপনার বিরুদ্ধে। কোন খানকা বা পীরের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে ক্ষেপে যাবে তার ভক্ত ও মুরীদরা। ধর্মীয় ব্যাপারে সরাসরি পদক্ষেপ নেয়ার মধ্যে প্রচণ্ড ঝুঁকি আছে।’
সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘এদের সংখ্যা কত যারা ধর্মের প্রাণ বলে গণ্য? জনগণ কেন তাদের মুরীদ হয় এ কথা কখনো ভেবে দেখেছেন? তারা মানুষকে ইসলামের দিকে যত না আহবান করে তার চেয়ে বেশি প্রচেষ্টা চালায় তাকে মুরীদ বানাতে। আমি জানি, এই জাতীয় ইমাম ও পীরেরা তাদের শ্ৰেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে গিয়ে লোকদেরকে ধর্মের মূল বিষয় থেকে দূরে রাখে।
মুসলিম জাতির মূল শিক্ষাকেন্দ্র হলো মসজিদ। মসজিদের চার দেয়ালের মাঝে বসে যাই শোনানো হোক, তাই মানুষের অন্তরে বসে যায়। এটা হয় মসজিদের পবিত্রতার গুণে। আল্লাহর ঘরকে যা্রা আল্লাহর শ্ৰেষ্ঠত্ব ঘোষণার কাজে ব্যবহার না করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষনার কাজে ব্যবহার করবে তাদের হাতে আমি জাতিকে তুলে দিতে পারি না। মসজিদের ইমাম হবেন তিনি, যিনি ইসলামের সঠিক শিক্ষা জনগণের সামনে তুলে ধরবেন। কিন্তু জনগণের মধ্যে ভুল আকীদা বিশ্বাস তুলে ধরা ব্যক্তি যত সম্মানিতই হোক, যত বড় পীর, বুজুর্গ ও মুর্শিদ হিসাবে পরিচিতি লাভ করুক, ইসলামের স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে।’
তিনি আরো বললেন, যদি আজ মসজিদে সঠিক দ্বীনী চেতনা সম্পন্ন আলেম ও ইমাম না রাখি, তবে কিছুকাল পরে লোকেরা ইমাম ও পীরদেরই পূজা শুরু করে দেবে। একদিন এই মূৰ্খ আলেম ও আমলবিহীন ইমামরাই ইসলামের ধ্বংসের কারণ হয়ে যাবে।’
সুলতান আইয়ুবী প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম জয়নুদ্দিন আলী বিন আল ওয়ায়েজকে তাঁর নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ করলেন । এই মশহুর আলেম তাঁর ছাত্রদের দিয়ে একটি নিজস্ব গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে বিশেষভাবে ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতেন। তাঁর ছাত্ররা বড় বড় মাদ্রাসায় শিক্ষক হতেন, নামকরা মসজিদের ইমাম হতেন এবং নিয়মিত তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখতেন।
তার গোয়েন্দা বিভাগ একবার খৃস্টানদের একটি বড় চক্রান্ত উদ্ঘাটন করে প্রশাসনকে সতর্ক করেছিল। প্রশাসন তদন্ত করে দেখল, ঘটনা সত্য। সাথে সাথে এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা হলো। ফলে মুসলমানরা ভয়াবহ এক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেলো।
তিনি ধর্মের নামে সারা দেশে যে সব নিত্য নতুন ফেতনা তৈরী হতো তার খোঁজ রাখতেন এবং নিজের সামর্থ অনুযায়ী তার মোকাবেলা করার চেষ্টা করতেন।
তিনি সুলতান আইয়ুবীকে বললেন, যদি এখনই আপনি ধর্মের সর্বনাশকারী এইসব ফেতনার কবল থেকে ইসলামকে মুক্ত না করেন তবে ভবিষ্যতে আপনাকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। তখন আল্লাহর কালামের পরিবর্তে এই সব তথাকথিত ধর্মীয় নেতাদের আদেশকেই জনগণ ইসলামী আইন বলে ধরে নেবে। খৃষ্টানরা এরই মধ্যে মুসলমানদের মনে সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা ও ব্যক্তিপূজাকে ইসলামের অঙ্গ বানিয়ে ফেলেছে। ফেতনাবাজরা কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে, কেউ জেনে, কেউ না জেনে খৃস্টানদের পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। অতএব, এদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা বা দেরী করার কোন অবকাশ নেই।’
আইয়ুবী এক জরুরী ফরমান জারী করলেন। এ ফরমানে জয়নুদ্দিন আলী বিন আল ওয়ায়েজের নেতৃত্বে দেশের হাক্কানী আলেমদের সমন্বয়ে ইমাম নিয়োগ বোর্ড গঠন করা হলো। দেশের সমস্ত মসজিদের ইমামদের ইসলামী জ্ঞান সম্পর্কে এ বোর্ড পরীক্ষা গ্রহণ করবে। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের আমল আখলাক ও নিজ পরিবারে কি ধরনের ধর্মীয় অবস্থা বিরাজ করছে বোর্ড তা তদন্ত করে দেখবে। তদন্ত কমিটির রিপোটের ভিত্তিতে এবং সুপারিশক্রমে সারাদেশের সকল মসজিদের ইমাম নতুন করে নিযুক্ত হবে।”
আল্লামা জয়েনউদ্দিন নতুন ইমাম নিযুক্তির ব্যাপারে নিম্নোক্ত শর্ত আরোপ করলেন। যিনি ইমাম হবেন:
১. তিনি অবশ্যই ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী হবেন।
২. তিনি প্রয়োজনীয় সামরিক জ্ঞান ও ট্রেনিং প্রাপ্ত হবেন।
৩. তাঁর আমল স্বচ্ছ, পরিষ্কার ও অনুকরণীয় হতে হবে।
৪. তাঁর পরিবারে ইসলামী আমল আখলাক থাকতে হবে।
৫. তিনি কখনোই খৃস্টানদের মত ‘ধর্ম ও জীবন আলাদা তার মুসল্লিদের এ শিক্ষা দেবেন না। বরং ইসলাম যে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা এ সত্য তুলে ধরবেন।
৬. প্রতিটি মুমীনের অন্তরে শাহাদাতের তামান্না ও জেহাদী জযবা সৃষ্টির ব্যাপারে সর্বদা সজাগ থাকবেন ।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top