৬. আবারো সংঘাত

 রাস্তা দিয়ে যাযাবর পোষাকে দুইটি মেয়ে ও একজন মধ্যবয়সী লোককে যেতে দেখলেন ওরা। ওরাও দেখল তাদের। কি মনে করে মেয়ে দুজন ও লোকটি আতাউল হাশেমের কাছে এগিয়ে এলো। মেয়ে দুটি সুদানী মনে হলেও তাদের পরণে ছিল বিচিত্র পোশাক। তাদের চেহারায় ধুলাবালি লেগেছিল। মুখ ছিল মলিন ও উদাস। তাদের খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। মধ্য বয়সী লোকটির পিছনে মেয়ে দু’টি এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল, যেন পর-পুরুষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে বলে তারা লজ্জায় মরে যাচ্ছে।

 লোকটি কিছু মিশরীয় কিছু সুদানী ভাষায় জগাখিচুড়ি পাকিয়ে কথা বললো। জানালো, তারা মুসলমান। মেয়ে দুটি তার কন্যা। পথে ডাকাতের কবলে পড়ে সবকিছু খোয়া গেছে তাদের। এখন ক্ষুধা তৃষ্ণায় তারা এতটাই কাহিল যা বলার মত নয়। লোকটি বললো, ‘বাপ হয়ে সন্তানের কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। জীবনে কোনদিন কারো কাছে হাত পাততে হবে এ কথা কখনো কল্পনাও করিনি। আমি আমার জন্য কিছুই চাই না, শুধু এই কচি মেয়ে দুটোকে যদি কিছু খেতে দেন তবে সারা জীবন আপনার জন্য দোয়া করবো।’

 আতাউল হাশেম সুদানী ভাষা জানতেন। কারণ তিনি কমান্ডো দলের লিডার। সুদানী অঞ্চলে কমান্ডারের দায়িত্ব সফলভাবে পালনের জন্য তাকে সুদানী ভাষা শিখতে হয়েছিল। তার কাছে খাবারের কোন অভাব ছিল না। এরই মধ্যে মিশর থেকে দু’তিনবার রসদ আমদানী হয়েছে। তিনি তার অংশের সৈন্যদের রেশন এ আস্তানায়ই মজুদ রেখেছিলেন।

 আতাউল হাশেম ওদের তিনজনকেই আস্তানার ভেতর নিয়ে গেলেন এবং খেতে দিলেন। খাওয়া শেষ হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কোত্থেকে এসেছেন?’

 লোকটি একটি গ্রামের নাম উল্লেখ করে বললো, ‘গ্রামটির এখন খুবই দুরাবস্থা। কখনও সুদানীরা এসে চড়াও হয়, কখনও মুসলমানরা। উভয় পক্ষেরই ঘরের খাবার জিনিসের ওপর প্রচণ্ড লোভ।’

 লোকটি আরো বলল, ‘একে তো যুদ্ধাবস্থা, হুটহাট সেনাবাহিনী চড়াও হয় গ্রামে। ঘরে যুবতী মেয়ে, কখন কি অঘটন ঘটে যায় এই ভয়ে সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হতো। মেয়েদের লুকিয়ে রাখতে রাখতে শেষে বিরক্তি ধরে গেল। অবশেষে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কন্যা দুটিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। বাপের কাছে মেয়েদের মানসম্ভ্রমই বড় কথা।’

 ‘তা, এখন কোথায় যাবেন আপনারা?’

 ‘ভেবেছিলাম মিশরে চলে যাবো। সুদানে মুসলমানদের জা-মাল, ইজ্জত-আব্রু মোটেই নিরাপদ নয়। কিন্তু যুদ্ধের যা অবস্থা, এখন তো দেখছি পথ চলাও নিরাপদ নয়।’

 ‘জ্বি, আপনি ঠিকই বলেছেন। যুদ্ধের সময় বাড়ি বা পথ কোন জায়গাই নিরাপদ থাকে না।’

 ‘বাবা, তুমি আমার ছেলের মত। মা মরা মেয়ে দুটোকে নিয়ে আমি যে কি পেরেশানীর মধ্যে আছি সে কথা তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না। তুমি একজন মুজাহিদ, মুসলমানের জা-নাল, ইজ্জত-আব্রু রক্ষক। আমরা তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তুমি কি আমাদের মিশর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার কোন ব্যবস্থা করতে পারবে?’

 ‘দেখুন, এখন আমরা যুদ্ধের ময়দানে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তো আমাদের পক্ষে দেশে ফেরা সম্ভব নয়। তবে কয়েকদিন পরপর আমাদের কাছে রসদ আসে। আপনারা চাইলে তাদের সাথে আপনাদেরকে পাঠিয়ে দিতে পারি।’

 লোকটির চোখ আশায় চকচক করে উঠল। যেন ডুবন্ত তীর তীরের নাগাল পেল। চোখে-মুখে সীমাহীন প্রত্যাশা নিয়ে জানতে চাইল, ‘সত্যি পারবে বাবা! যাক, আল্লাহর হাজার শোকর। তিনি আমাদেরকে এই মুসীবত থেকে বাঁচানোর জন্য তোমাকে উসিলা হিসেবে পাঠিয়েছেন। তা বাবা, ওরা আবার কবে নাগাদ আসবে?’

 ‘এসে যাবে কয়েক দিনের মধ্যে।’ আতাউল হাশেমের নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর।

 ‘কিন্তু বাবা, এ কয়দিন আমরা কোথায় থাকবো? হায় আল্লাহ, দুটি তরতাজা যুবতী নিয়ে এখন আমি কোথায় যাই!’

 ‘আপনি অস্থির হবেন না। যতদিন ওরা না আসবে ততদিন আপনাদের জিম্মাদার আমি। আপনারা আমাদের সাথেই থাকবেন।’ আতাউল হাশেম বললেন।

 লোকটি বলল, ‘বুঝতে পারছি, যুদ্ধের মধ্যে আমি তোমাকে বেশ বিপদের মধ্যেই ফেলে দিলাম। তারচে এক কাজ করি, ডাকাতের পাল্লায় পড়ে সবকিছু তো আমি খুইয়ে ফেলেছি। আমি না হয় বাড়ি গিয়ে কিছু হাত খরচ নিয়ে আসি। মিশর গিয়ে কিছু করতে হলেও তো টাকা পয়সা দরকার। ওরা থাক তোমার হেফাজতে, আমি দু’তিন দিনের মধ্যেই ফিরে আসবো।’

 মেয়েরা কেঁদে উঠল, ‘না বাবা, আমাদের একা ফেল তুমি যেও না।’

 ‘ধূর পাগলী! একা কোথায়? উনি আছেন না! এরা মুজাহিদ, তোদের ভাই। ভাইয়ের কাছে বোনের থাকতে সংকোচ কিসের? আর আমি তো দু’তিন দিনের মধ্যেই ফিরে আসছি।’

 ‘হ্যাঁ বোন, এখানে ইনশাআল্লাহ তোমাদের কোন বিপদ হবে না।’

 লোকটি বলল, ‘ঠিক আছে, পথে নামার আগে তাহলে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিএ, তোমরা কথা বলো।’ লোকটি বিদায় নিয়ে ওখান থেকে চলে এল।

 মেয়ে দুটি ভয়ে ভয়ে চাইল আতাউল হাশেমের দিকে। একজন বললো, ‘ভাই, আমি কিন্তু আমাদের বলেছেন এখানে আমাদের কোন বিপদ নেই, কিন্তু আপনরাই তো মহাবিপদে জড়িয়ে আছেন।’

 ‘সৈনিকের কাছে যুদ্ধ কোন বিপদ নয়, এটা তার স্বাভাবিক কাজ। যুদ্ধ দেখে ভয় পেলে কি মুজাহিদ হওয়া যায়?’

 ‘কিন্তু আমার মনে হয় আপনাদের এই জীবন বড় ভয়ংকর। সারাক্ষণ হয় ভাবেন কখন কাকে কিভাবে মারবেন, নইলে ভাবেন কখন কে মেরে বসে। কি, ঠিক বলিনি আমি?’

 ‘কি যে বলো! মৃত্যু নিয়ে আমরা মোটেও ভাবি না। মানুষ তো জন্মগ্রহণই করে মরার জন্য। মানব জীবনে মৃত্যুর চাইতে সহজ সত্য আর কি আছে! মরণ অবধারিত, আমরা চাই সে মরণ সুন্দর ও মহান করতে। জেহাদের ময়দানে গাজী হতে পারা গৌরবের আর মৃত্যুবরণ করা সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাই ও নিয়ে আমাদের কোন দুশ্চিন্তা নেই।’

 একটি মেয়ে শিশুর মত সরল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, ‘তাহলে আপনারা কি ভাবেন? বাড়ির কথা, স্ত্রি-সন্তানদের কথা?’

 ‘না, সব সময় তাও ভাবি না। যখন সময় পাই তখন আমরা মনে মনে কি করে দুশমনের মোকাবেলা করবো, কি করে বিজয় ছিনিয়ে আনবো এইসব ভাবি।’

 ‘তার মানে বাড়ির কথা, আপনজনদের কথা আপনাদের মনে পড়ে না?’

 ‘তা মনে পড়ে বৈকি!’ আতাউল হাশেম বললেন, ‘কিন্তু আমি আমার ফরজ দায়িত্বের কথা কখনো ভুলে যাই না।’

 কথা বলতে বলতে পরিবেশ কেমন সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠল। মেয়েদের মধ্যে যে সংকোচ ও জড়তা ছিল আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল সে সব। মনে হলো পেটে দানাপানি পড়ায় তাদের শরীরেও ফিরে এসেছে নতুন শক্তি, নতুন প্রাণ। সৈনিক জীবনের অজানা কথা আজানার কৌতূহল যেন তাদের চলচঞ্চল ও চপল করে তুলল। কথার পিঠে কথা জুড়ে দিল ওরা, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করল। একজন থামলে অন্যজন মুখ খোলে। এ ভাবেই এগিয়ে চলল তাদের আলাপচারিতা।

 তাদের উচ্ছল কৌতূহল আর প্রশ্নের পর প্রশ্নে আতাউল হাশেম তার নিজের ও সঙ্গীদের জীবনের অনেক করুণ কথা তুলে ধরল তাদের কাছে। স্মৃতির পাতা হাতড়ে সে সব কথা তুলে আনতে গিয়ে কখন যে হারিয়ে গেল অতীতের বুকে, ভেসে গেল আবেগের বন্যায়, আতাউল হাশেম তা টেরি পেল না।

 মেয়েরা ভাবল, এটাই সময়, এ আবেগের স্রোতে ফেলেই তাকে নিয়ে যেতে হবে অজানা বন্দরে। তাই তারা আসল জায়গায় ঘা দিল, বললো, ‘আপনারা দেশ ছেড়ে এত দূর এসে কেন নিজের জীবন নষ্ট করছেন?’

 ‘কি বললে! জীবন নষ্ট করছি?’ বিস্মিত আতাউল হাশেম।

 ‘তা নয়তো কি! জেনে শুনে মৃত্যুর কোলে ঝাঁপ দেয়ার বোকামী কেন করছেন আপনারা আমার বুঝে আসে না।’

 হঠাৎ ঘোর কেটে গেল আতাউল হাশেমের। রাগে জ্বলে উঠল সর্ব অঙ্গ। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ডাকলেন সাথীদের। বললেন, ‘এই মেয়ে দুটো এবং এদের নিয়ে আসা লোকটির পা রশি দিয়ে বেঁধে আমার ঘোড়ার পিছনে বেঁধে দাও।’

 সঙ্গীরা সাথে সাহতে হুকুম তামিল করল। তাদের মাটিতে ফেলে দিয়ে পা শক্ত করে বেঁধে ঘোড়া নিয়ে এলো। রশির এক প্রান্ত ঘোড়ার জ্বিনের সাথে শক্ত করে বাঁধতেই আতাউল হাশেম এক সৈন্যকে বললেন, ‘ঘোড়ায় আরোহন করো।’

 সে সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ায় আরোহন করলো।

 আতাউল হাশেম মেয়ে দু’টিকে দাঁড় করালনে। দুই তীরন্দাজকে বললেন, ‘আমার ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র মেয়ে দুটির চোখের মাঝে একটি করে তীর বিদ্ধ করবে আর ঘোড়ার আরোহী সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া ছুটিয়ে দিবে।’

 ঘোড়ায় বাঁধা লোকটির ব্যাপারে তিনি কিছু বললেন না। লোকটি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে ছিল। সে তখন ভাবছিলো, ঘোড়া যখন দৌড়াবে তখন মেয়েদের সামনে কি কেয়ামতই না নেমে আসবে!

 তীরন্দাজরা তাদের ধনুক তীর জুড়ল, আরোহীরা লাগাম টেনে ধরলো।

 আতাউল হাশেম সুদানী মেয়ে দুটি ও লোকটিকে বললেন, ‘আমি তোমাদের তিনজনকে মাত্র একবারই বলবো, তোমাদের আসল পরিচয় দাও। যে উদ্দেশ্যে এসেছো পরিষ্কার করে বলো, নতুবা তোমাদের শেষ পরিণামের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও।’

 সবাই নীরব হয়ে গেল। মেয়েরা তাদের সঙ্গী লোকটিকে দেখলো। সেও নীরব। তারা চোখে চোখে কিছু একটা পরামর্শ করে নিল। সুদানী লোকটি মনে মনে বললো, ‘এ বেটা তো বড় হুশিয়ার। মেয়েরা কি শেষ পর্যন্ত এর সামনে টিকতে পারবে?’

 আতাউল হাশেম লোকটির পাশে বসে পড়ে বললেন, ‘যদি তুমি সত্য কথা বলো তবে তোমার বাঁধন খুলে দেয়া হবে।’

 লোকটি চুপ করে থাকলো। আতাউল হাশেম একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। লোকটি তবু চুপ। এবার ক্ষেপে গেলেন আতাউল হাশেম। বললেন, ‘শেষ বারের মত বলছি, তুমি কি মুখ খুলবে?’

 মুখ খুলল লোকটি। এতক্ষণের গোবেচারা ভাবটি উধাও হয়ে গেছে তার চেহারা থেকে। সেখানে ক্ষোভ ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ।

 ‘তুমি কি মানুষ না পাথর! তোমার কাছে আমি এমন মেয়ে নিয়ে এলাম, যাদের দেখলে ঋষির ধ্যান ভেঙে যায় আত তুমি তাদেরকে তীরের নিশানা বানাচ্ছো? আমার পরামর্শ শোন, তাদেরকে তোমার কাছে রেখে দাও আর সৈন্যদল নিয়ে এখান থেকে চলে যাও। যদি এ প্রস্তাব তোমার মনপূত না হয় তাহলে বলো, আমাদের মুক্তির বিনিময়ে তুমি কি চাও? যদি সোনা চাও তাহলে বলো তার ওজন কত, আর যদি অন্য কিছু চাও তাহলে তাও বলো। সন্ধ্যার আগেই তোমার সব দাবী পূরণ করা হবে।’

 আতাউল হাশেম উঠে দাঁড়ালেন। ঘোড় সওয়ারকে বললেন, ‘ঘোড়া নিয়ে দুলকি চালে পনেরো বিশ কদম এগিয়ে যাও।’

 ঘোড়া কয়েক কদম এগুতেই লোকটি ছটফট করে উঠলো। পনেরো বিশ কদম যাওয়ার পর আতাউল হাশেম বললেন, ‘থামো।’

 ঘোড়া থামালো সহিস। আতাউল হাশেম এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘এখনও সঠিক কথা বলো।’

 অবশেষে সব স্বীকার করলো সে। বলল, সে সুদানী গোয়েন্দা সদস্য। খৃস্টানরা তাকে ট্রেনিং দিয়েছে। মেয়ে দুটি জন্মগতভাবে মিশরী। তাদেরকেও খৃস্টানরা সব ধরনের অপকর্ম ও ধ্বংসাত্মক কাজের ট্রেনিং দিয়েই এখানে পাঠিয়েছে।

 আতাউল হাশেম তার বাঁধন খুলে দেয়ার হুকুম দিলেন। বাঁধন মুক্ত হওয়ার পর তাকে নিজের পাশে বসিয়ে নরম সুরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। বললেন, ‘আমি তোমার কোন ক্ষতি করতে চাই না। তুমি যে জবানবন্দী দিয়েছো তোমাকে যে কোন কঠিন শাস্তি দেয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। এখন সব কথা খোলাখুলি ও সত্য বললে তুমি আমার দয়ার আশা করতে পারো। মনে রেখো, সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার মত ট্রেনিং আমারও আছে।’

 ‘জনাব, সুদানে ছড়িয়ে পড়া মুসলিম বাহিনীর কম্যান্ডারদের বশীভূত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাকে।’ লোকটি বললো, ‘এই কাজে চোখ ধাঁধানো সুন্দরী নারী এবং যত খুশি সোনা রূপা ব্যয় করার অনুমতি আছে আমার। এসব নারী ও অর্থ দিয়ে আমাদের প্রথম চেষ্টা তাহকবে আপনাদেরকে আমাদের দলে ভেড়ানো। এতে ব্যর্থ হলে আমাদের ওপর নির্দেশ আপনাদের বন্দী করার। আর যদি তাও সম্ভব না হয় তাহলে আপনাদের হত্যা এবং শেষ করে দেয়ার হুকুম আছে আমাদের ওপর।’

 ‘যারা নিয়মিত যুদ্ধ করছে তাদের পিছনে না লেগে তুমি আমার কাছে এলে কেন?’

 ‘তাদের কাছে অন্যেরা যাবে। আমাকে বলা হয়েছে, আতাউল হাশেম মুজাহিদদের রসদপত্র আসার রাস্তা এমনভাবে পাহারা দিচ্ছে, যার কারণে আমাদের কমান্ডোরা একাধিকবার রসদের ওপর হামলা চালিয়েও কোন সুবিধা করতে পারেনি। এই লোকটির কারণে আমাদের লোকেরা রসদপত্র তো সংগ্রহ করতে পারলোই না, উল্টো আমাদের বহু মূল্যবান প্রাণের ক্ষতিও হয়েছে। তাই তোমার কাজ হচ্ছে, কমান্ডার আতাউল হাশেমের কাছে মেয়ে দুটিকে পৌঁছে দেয়া। তারা ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে আমাদের দলে ভেড়াতে চেষ্টা করবে। কিন্তু তার ঈমান যদি খুব মজবুত হয় তাহলে এতে সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সে ক্ষেত্রে তাকে বন্দী করার সুযোগ বের করে দেয়া তোমার দায়িত্ব। তাকে এমন ফাঁদে ফেলবে যেন সে নিরূপায় হয়ে বন্দী হয় অথবা নিহত হয়। যদি এটাও বিপদজনক মনে করো তবে তোমরা তিনজনে মিলে তাকে যে করেই হোক হত্যা করবে।’

 লোকটা খুবই আশ্চর্য হলো এই ভেবে যেম আতাউল হাশেম এমন অসামান্য সুন্দরী দুই যুবতীর প্রতি কোনই আগ্রহ প্রকাশ করলো না। আতাউল হাশেম অন্তরঙ্গভাবে তার সাথে কথা বলছে দেখে সে তাকে জিজ্ঞেসই করে বসলো, কেন এমন সুন্দরী মেয়ে ও স্বর্ণ রৌপ্যের প্রস্তাব তিনি হেলায় ঠেলে দিলেন।

 আতাউল হাশেম হেসে বললেন, ‘তার কারণ আমি দুর্বল ঈমানাদার নই।’

 আতাউল হাশেম এবার মেয়ে দু’টির কাছে গেলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘ও যা বলেছে সে ব্যাপারে তোমাদের কোন বক্তব্য আছে?’

 মেয়েরা না সূচক মাথা নাড়ল।

 একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি সবই শুনেছেন। এখন আমাদের সঙ্গে কেম ব্যবহার করবেন?’

 আতাউল হাশেম বললেন, ‘আগামীকাল সকালে তোমাদের হেডকোয়ার্টারে তকিউদ্দিনের কাছে পাঠিয়ে দেবো। তোমাদের ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেয়ার তিনিই নিবনে।’

 তিনি সুদানী লোকটি ও মেয়ে দু’জনকে সঙ্গীদের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘এদেরকে পৃথক পৃথক স্থানে রাখবে।’

 তাদের তল্লাশী নেয়া হলো। প্রত্যেকের কাছে পাওয়া গেল একটি করে ছুরি। আর লোকটির কাছে অতিরিক্ত পাওয়া গেল এক পুটলি নেশার দ্রব্য, হাশিস।

 সূর্য তখন ডুবে যাচ্ছে। একটি টহল দল ফিরে এসে রিপোর্ট করলো তার কাছে। সন্ধ্যা হলো। মাগরিবের নামাজ পড়ে তিনি তার বাহিনীর সদস্যদের বললেন, ‘রাতের ডিউটির জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আমার সাথে দেখা করবে। আমি তোমাদের বলে দেব কে কোথায় ডিউটিতে যাবে।’

 সৈন্যরা চলে গেল। একটু পরই ফিরে এলো সামরিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে। তিনি সৈন্যদের বিভিন্ন দলকে দূর দূরান্ত পর্যন্ত পাঠিয়ে দিলেন। প্রত্যেককে বলে দিলেন, ‘সুদানীরা গোয়েন্দা ও চর ছড়িয়ে দিয়েছে ব্যাপকভাবে। তিনজন ধরা পড়েছে। ওরা মারাত্মক ধ্বংসাত্মক কাজে নিয়োজিত। ফলে চোখ কান খোলা রাখবে। সাবধান থাকবে এদের ব্যাপারে। আর অস্বাভাবিক কোন কিছু চোখে পড়লেই খবর পাঠাবে আমার কাছে।’

 আস্তানায় পাহারায় নিয়োজিতদের ডেকে বললেন, ‘এমনও হতে পারে, এদের সাথী ও দলের লোকেরা এদের আটকে পড়ার খবর পেয়ে যেতে পারে। তাহলে এদের ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করবে ওরা, হামলা করতে পারে আস্তানায়। পাহারা জোরদার রাখবে। বিশ্রামরত রিজার্ভ সৈন্যদেরও শোয়ার সতর্ক করে দেবে যেন সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে শোয়।’

 সবার দায়-দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে রাতের খাবার সেরে শুয়ে পড়লেন তিনি। আস্তানার ভেতরে না শুয়ে টিলার চূড়ায় উঠে গেলেন। জায়গাটা উঁচু নিচু। শোয়ার আগে লোকটি ও মেয়ে দুটির কি ব্যবস্থা করেছে দেখে নিলেন। এরপর তিনি টিলার ওপরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

 সেখান থেকে তিনি আস্তানার সৈন্যদের আর দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি চোখ বন্ধ করলেন। ঘুম আসছিল না সে চোখে। কিছুক্ষণ ওভাবে শুয়ে থাকার পর আবার চোখ মেললেন তিনি। মেয়ে দু’টির কথা ভাবছিলেন। আহা! কি কমনীয় চেহারা মেয়ে দু’টির! কি নিষ্পাপ মাসুম কচি মেয়ে! অথচ তাদের দিয়ে কেমন জঘন্য ও ভয়াবহ কাজ করানো হচ্ছে। যদি এরা কোন মুসলমান ঘরের মেয়ে হতো তবে কোন সম্মানী ঘরের বউ হয়ে সসম্মানে থাকতো।

 স্ত্রীর কথা স্মরণ হলো তার। যখন সে তার ঘরে বউ হয়ে এসেছিল তখন সে তাদের মতই নব যৌবনা ও আকর্ষণীয়া ছিল। তিনি স্ত্রীর সাথে প্রথম জীবনের সেই রোমান্টিক স্মৃতিতে বিভোর। হয়ে গেলেন। এই বিরাণ মরুভূমিতে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি হারিয়ে গেলেন সেইসিব দিনগুলিতে। চারদিকে এত যুদ্ধ, এ মৃত্যু, অস্ত্রের ঝনঝনানি, তলোয়ারের চমক কছুই এখন আর তাকে স্পর্শ করছে না। যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যরা কখনো কখনো এমনিভাবে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায়, মনোহর স্মৃতির মাঝে ভুলিয়ে রাখে মনকে।

 চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। মরুভূমির মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে কোমল জোসনা। এটাই মরুভূমির বৈশিষ্ট্য। দিনের বেলা এখানে যেমন থাকে সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপ তেমনি তাদের চাঁদনী থাকে স্বচ্ছ ও শীতল। এই শীতলতা যেন তার হৃদয় ও মন থেকে মৃত্যুর বিভীষিকা শুষে নিয়েছে। আতাউল হাশেম উঠে বসলেন। তাকিয়ে রইলেন দূর দিগন্তে। তারপর উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন আস্তানার দিকে। ঘুরে ঘুরে দেখছেন সবকিছু। দেখলেন পাহারাদাররা টহল দিচ্ছে নিয়মমাফিক। সৈন্যরা শুয়ে আছে নিজ নিজ বিছানায়। তিনজন সৈন্যের সাথে শুয়ে আছে সুদানী লোকটি। মেয়েরা শুয়ে আছে ওদের বিছানায়।

 আতাউল হাশেম একজন মেয়ের পাশে দাঁড়ালেন। নিজের পা দিয়ে চাপ দিলেন মেয়েটির পায়ে। মেয়েটির চোখ খুলে গেল। আতাউল হাশেমকে চিনতে পেরে উঠে বসলো সে। আতাউল হাশেম তাকে উঠে দাঁড়াতে ও তার সাথে যেতে ইঙ্গিত করলেন। মেয়েতি আনন্দ চিত্তে উঠে দাঁড়ালো। তার আরো আনন্দ হলো এই ভেবে যে, যৌবনা নারীর যাদুর প্রভাব শেষে এই পাথরের মত কঠিন প্রাণ কমান্ডারের মনেও ঢেউ তুলতে পেরেছে!

 আতাউল হাশেম হাঁটা দিলেন। মেয়েটি তার পিছু পিছু পা চালালো। সৈন্যরা বেহুশের মত ঘুমিয়ে আছে। তারা কেউ জানতে বা বুঝতেও পারল না, তাদেরই মাঝ থেকে কোন এক ব্যক্তি একটি মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আতাউল হাশেম সৈন্যদের দিকে তাকালেন। তাদের জন্য তাঁর একটু করুণা হলো। কারণ তিনি তো এক অবিশ্বাস্য ধরনের নফসের যুদ্ধে নেমেছেন। এ যুদ্ধেও গাজী হতে চান তিনি।

 টিলার ওপরে তিনি যেখানে শুয়েছিলেন মেয়েটিকে তিনি ওখানে নিয়ে গেলেন। শীতল বাতাস বইছে সেখানে। মাথার ওপর তারা ভরা আকাশ। সেদিকে তাকাল মেয়েটি। মাথা থেকে ওড়না লুটিয়ে পড়ল কাঁধে। বাতাসে এলোমেলো হয়ে গেলো চুলগুলি। চাঁদের আলোতে সে চুল সোনার আশের মত চমকাচ্ছিল। তিনি অনেকক্ষণ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

 মেয়েটি আতাউল হাশেমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি খুবই অবাক হচ্ছি, আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেন? আমাকে তো আপনার জন্যই এখানে আনা হয়েছে। আপনার যে কোন সাধ পূরণ করার জন্য আমি প্রস্তুত এ কথা কি আপনি বুঝতে পারছেন না?’

 তিনি এ কথার কোন জবাব দিলেন না। শুধু নীরবে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। যেন তিনি এক নীরব পাথর হয়ে গেছেন।

 মেয়েটি তার একটি হাত ধরল। বললো, ‘আমি জানি আপনি আমাকে কেন ডেকে এনেছেন ও কি চিন্তা করছেন।’

 ‘আমি চিন্তা করছি তোমার বাবা আমার মতই একজন পুরুষ মানুষ।’ আতাউল হাশেম তার থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলেন। বললেন, ‘আমিও বাপ। এই দুই বাপের মধ্যে কত আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এক বাপ কত নির্লজ্জ। আরেক বাপ সন্তানের নিরাপত্তা ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্যই তাদের ছেড়ে এই যুদ্ধের ময়দানে পড়ে আছে।’

 ‘আমার কোন বাবা নেই।’ মেয়েটি বললো, ‘তাকে কোনদিন দেখেছি বলেও মনে পড়ে না।’

 ‘তিনি কি মারা গেছেন?’

 ‘সে কথাও জানি না!’

 ‘আর তোমার মা?’

 ‘কোন কিছুই মনে নেই আমার।’ মেয়েটি বললো, ‘আমার এ কথাও মনে নেই যে, আমি বাড়িতে জন্মেছি না কোন যাযাবরের ঝুঁপড়িতে বা তাবুতে। কিন্তু পানি এ সময় বেরসিকের মত এ কথা বলছেন কেন?’

 ‘আমি আমার সৈনিক জীবনের রসেই ডুবে থাকতে পছন্দ করি।’ আতাউল হাশেম বললেন, ‘আমি চাচ্ছিলাম তোমাকে তোমার জীবনের অতীতের স্মৃতিময় জগতে ফিরিয়ে নিতে। যেখানে কে মা-বাপের স্নেহ আদরের জন্য কাঙাল থাকে।’

 ‘আমি তো নিজেই এক সৌন্দর্যময় স্মৃতি।’ মেয়েটি বললো, ‘যার সাথে আমি জীবনের সামান্য সময় কাটিয়ে দেই, সে সারা জীবন আমাকে স্মরণ করে। আমি অন্যের স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকি, আমার নিজের কোন স্মৃতি নেই।’

 ‘তুমি নিজেকে সৌন্দর্যের স্মৃতি না বলে বলো পঙ্কিলতার স্মৃতি।’ আতাউল হাশেম বললেন, ‘তোমার শরীরে লেগে আছে অসংখ্য পাপিষ্ঠের পাপের কলঙ্ক। তুমি ভাবছো ওদের মনে তোমার স্মৃতি টিকে থাকবে। ভুল, ভুল তোমার ধারনা। তোমার মত মেয়েদের কোন পুরুষ স্মরণে রাখে না। ওসব মেয়ে শিকারীরা আজ এখানে কাল ওখানে শিকার করে বেড়ায়। দ্বিতীয় শিকার পেলে প্রথমটার কথা ওরা বেমালুম ভুলে যায় চিরদিনের মত।

 তোমার এউ রূপ যৌবন কচু পাতার পানির মত। কচুপাতা যেমন পানি ধরে রাখতে পারে না, এ দেহও পারে না যৌবন ধরে রাখতে। শৈশব ও কৈশোরে এ যৌবনের কোন ধারনা ছিল না তোমার। দুদিন পর যখন চেহারায় বয়সের ছাপ পড়বে তখন যৌবনের এ কয়েকটা দিন কেবল স্মৃতি হয়েই থাকবে। চেহারায় জৌলুশ নিয়ে অহংকার করো না। আমি এই মুহূর্তেই তোমার চেহারা চিরদিনের জন্য বিকৃত করে দিতে পারি। কিন্তু আমি তা করবো না। এই মরুময় পরিবেশ, মদ আর ব্যভিচার তোমাকে কয়েক বছরের মধ্যে নিঃশেষ করে দেবে। তখন তোমার অবস্থা হবে ঝরা ফুলের মত। মানুষের পায়ের তলায় পিষে গেলেও যে ফুলের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। আজ যারা তোমার রূপের মোহে ছুটে আসে তোমার কাছে, সেদিন তোমাকে রাস্তায় দেখে তোমার কাতর আবেদন শুনে এইসব সুদানী ও খৃস্টানরা ভিক্ষা দিতেও এগিয়ে আসবে না তোমার কাছে। তুমি যখন শহরের কোন ফুটপাতে পড়ে থাকবে, ওরা তখন ফুটপাত দিয়ে যাওয়ার সময় ঘৃণায় নাকে রুমাল চেপে ধরবে।’

 আতাউল হাশেমের বলার মধ্যে ঘৃণা নয় এমন এক দরদমাখা ভাব ছিল যা মেয়েটিকে অস্থির করে তুলল। তার মনে হলো তার বুকের মধ্যে সাইমুম ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে ঝড়ে যৌবনের দুরন্তপনা উধাও হয়ে গেল। একজন মুসলমান একটু পিতৃস্নেহের। কেঁপে উঠল মেয়েটির শরীর। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে আতাউল হাশেমের পায়ের কাছে বসে পড়ল।

 ‘আমার এক মেয়ে আছে, তোমার চেয়ে দু’তিন বছরের ছোট হবে সে। তার বিয়ে হবে এক সম্মানী ঘরের যুবকের সাথে। যে ছেলে আমার মতই কোমরে তলোয়ার ঝুলিয়ে ভাল জাতের ঘোড়ার চেপে ছুটে যাবে যুদ্ধের মাঠে। আমার মেয়ে জায়নামাজে বসে তার জন্য দোয়া করবে আর জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকবে পথের দিকে, কখন ফিরে আসবে তার স্বপ্নের শাহজাদা, এই আশায়। সে তার স্বামীর কাছে হবে স্বপ্নের রাণী। সে তার ভালবাসা দিয়ে জয় করে নেবে শ্বশুর-শ্বাশুরি, দেবর-ননদ সকলের ভালবাসা। পড়শি মহিলারা আমার মেয়েকে এক নজর দেখতে চাইবে তার গুণের কথা শুনে। আমি এই জন্য গর্ববোধ করব যে, আমার মেয়ে ও তার স্বামী পরষ্পর প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। সে এক এমন প্রীতি যা সারা জীবনেও শেষ হবার নয়। বুড়ী হয়ে গেলেও তাদের ভালবাসা ও সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকবে। দিন যত যাবে তার সম্মান বাড়বে বৈ করবে না। তোমাকে দেখার জন্য কি কেউ আগ্রহ প্রকাশ করবে? তুমি তো তারই মত এক মেয়ে। তোমাকে দুদিন না দেখলে কেউ কি তেমন অস্থিরতা বোধ করবে? করবে না। কারণ তুমি এক বেপর্দা নারী, মরুভূমির মতই খোলামেলা উন্মুক্ত প্রান্তর। যেখানে কোন রহস্য নেই, পরিচর্যার মত উদ্যান নেই, আবিষ্কারের মত আকর্ষণ নেই। ফলে তোমার কোন সম্মান নেই। কারো কাছে জমা নেই তোমার জন্য একটু স্নেহ বা প্রেম। কেউ নেই যে তোমাকে ভালবাসার যোগ্য মনে করবে।’

 ‘আপনি আমার সাথে এমন সব কথা বলছেন কেন?’ মেয়েটি এমন কাতর স্বরে জিজ্ঞেস করলো যেন সে স্বরটি তার নয়।

 ‘আমি তোমাকে বলতে চাই, তোমার মত মেয়ের পবিত্র হওয়াই উচিত!’ আতাউল হাশেম উত্তরে বললেন, ‘মুসলমানরা নারী জাতিকে আল্লাহর রহমত মনে করে। প্রেম প্রীতি আর ভালবাসার যে পবিত্র বন্ধনে আমাদের পরিবার গঠিত তুমি যদি তার সন্ধান পেতে তবেই তুমি বুঝতে পারতে, সতীত্ব ও ধর্মের অনুপম মাহাত্ম। শান্তি ও সুখের কি অপূর্ব নেয়ামতে ধন্য আমাদের জীবন সে কথা তুমি বুঝতে পারবে না। কারণ তুমি সে ভালবাসার সুবাস কোনদিন পাওনি। যে ভালবাসা অন্তরের অন্তস্থলে শান্তির বাগান রচলা করে। দুর্ভাগ্য তোমাদের, তোমরা পুরুষের লোভ-লালসা দেখেছ কিন্তু ভালবাসা দেখোনি।’

 মেয়েটির মনে হচ্ছিল, স্নিগ্ধ শীতল নিস্তব্ধ রাতের উন্মুক্ত পটভূমিকায় টিলার ওপর যেন কোন অদৃশ্যলোক থেকে ভেসে আসছে অপার্থিব শব্দমালা। আতাউল হাশেম একটা উপলক্ষ মাত্র।

 মেয়েটি অবাক বিস্ময় নিয়ে আতাউল হাশেমের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখতে আর দশজন পুরুষের মতই একজন পুরুষ বৈ তো নয়! কিন্তু অন্যেরা তার রূপ দেখে যেমন পতঙ্গবৎ ঝাপিয়ে পড়ে, তাঁর মধ্যে তাঁর সামান্যতম আগ্রহও নেই। আতাউল হাশেম কোন নিশ্চল পাথর নয়। তাঁর শরীরেও রক্ত মাংশ আছে, আবেগ উত্তেজনা আছে, কিন্তু তাকে সংযত সংহত করার কি অসামান্য শক্তি রাখে এই লোক!

 মেয়েটি অস্থির হয়ে বললো, ‘আপনার কথার মধ্যে এমন নেশা ধরানো মাদকতা রয়েছে যে, এমন আমি শরাবে বা হাশিসেও পেয়েছি। আমি আপনার সব কথা বুঝতে পারিনি, তবে সব কথাই আমার অন্তরে খোদাই হয়ে গেছে।’

 মেয়েটি ছিল বুদ্ধিমতি। কারণ হাবাগোবা লোকদের গোয়েন্দা বিভাগে নেয়া যায় না। পুরুষদেরকে আঙ্গুলের ওপরে নাচানোর ট্রেনিং তাকে শিশুকাল থেকেই দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে সব ট্রেনিং আজ আর কোন কাজেই এলো না, বরং এই পুরুষটি সাপের বিষ দাঁত ভাঙার মত তার এতদিনের গর্ব ও অহংকার যেন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।

 এরপর আতাউল হাশেমের সাথে তার আরো অনেক কথাই হলো। ইসলামের অনুপম সৌন্দর্যের অনেক কিছুই সে জানতে পারল এ আলোচনা থেকে। পেশাদার সুন্দরীর পরিবর্তে মমতাময়ী এক নারীর মহিমা ফুটে উঠল তার কথাবার্তা ও আচরণে। এক সময় সে প্রশ্ন করলো, ‘আমাকে আপনারা কেমন শাস্তি দেবেন?’

 ‘আমি তোমাকে কোন শাস্তিই দিবো না।’ আতাউল হাশেম বললেন, ‘কাল সকালে তোমাদেরকে আমি প্রধান সেনাপতির কাছে পাঠিয়ে দেবো।’

 ‘তিনি আমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবেন?’

 ‘যা আমাদের আইনে লেখা আছে তাই।’

 ‘আপনি কি আমাকে ঘৃণা করছেন?’

 ‘না।’

 ‘আমি শুনেছি, মুসলমানরা একের অধিক স্ত্রী রাখতে পারে।’ মেয়েটি বললো, ‘যদি আপনি আমাকে আপনার স্ত্রী বানিয়ে নেন তবে আমি আপনার ধর্ম গ্রহন করবো। সারা জীবন আপনার খেদমতে নিয়োজিত থাকবো।’

 ‘আমি তোমাকে স্ত্রী নয়, কন্যার মর্যাদা দিতে পারি।’ আতাউল হাশেম বললেন, ‘কারণ তুমি আমার কন্যার বয়সী।’

 

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top