৪. ভয়ংকর ষড়যন্ত্র

 ডাক্তারের হাত-পা এবং চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হল। চোখ রগড়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলেন তিনি।

 ‘এদিক-ওদিক তাকিয়ো না। সোজা সামনে চল।’ পিঠে খঞ্জর ঠেকিয়ে বলল একজন অপহরণকারী।

 হাঁটা দিলেন ডাক্তার। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আকিলকে ছায়ায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। পাশে বসে আছে শারজা। কাঁদছে। ডাক্তারকে দেখেই ও বলল, ‘দোহাই ডাক্তার, আমার ভাইকে বাঁচান।’

 বসে রোগীর নার্ভ দেখলেন ডাক্তার। এদিক-ওদিক তাকাতে নিষেধ করা হয়েছে। এখনও পিঠে খঞ্জর ঠেকিয়ে রেখেছে লোকটা। আকিলের শিরা থেকে হাত সরিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চকিতে পেছনে ফিরলেন। মুখোশ পরা চারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। একজনের হাতে খঞ্জর।

 ক্রুদ্ধ স্বরে ডাক্তার বললেন, ‘গযব পড়ুক তোমাদের ওপর। বাঁচানোর পরিবর্তে লোকটাকে তোমরা মেরে ফেলেছ। তোমরা সবাই এর হত্যাকারী। আমি ওকে বিছানা থেকে নামতে দেইনি। তোমরা সারা রাত ঘোড়ার পিঠে রেখেছ ওকে। ক্ষতস্থান ফেটে দেহের সব রক্ত ঝরে ও মারা গেছে।

 লাশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল শারজা। অনেক কাঁদল মেয়েটা। ওকে সরিয়ে লাশ ঘোড়ার পিঠে চাপানো হল। পাহাড়ের ঢাল থেকে সরে এসে পথে নামল কাফেলা। ডাক্তারের চোখ এবং হাত-পা বেঁধে দেয়া হল। এখনও শারজার বিলাপ শোনা যাচ্ছে। ডাক্তার তার পেছনে বসা আরোহীকে বলল, ‘লোকটা সুস্থ হয়ে যেত। তোমরা মেরে ফেললে। সুলতান ওকে কোন শাস্তিই দিতেন না।

 আমরা ওকে বাঁচানোর জন্য আসিনি। ওকে নয়, ওর ভেতরের গোপন তথ্য অপহরণ করেছি। সে মরে গেছে এ জন্য আমাদের কোন দুঃখ নেই। আমরা খুশী। কারণ, তোমরা এবং তোমাদের সুলতান কোন গোপন তথ্য জানতে পারল না ওর কাছ থেকে।

 তোমরা আমাকে কোন অপরাধের শাস্তি দিচ্ছ?’

 আমরা তোমাকে নবীদের মত সম্মানে রাখব। মরুর সামান্য বাতাসও তোমাকে স্পর্শ করবে না। পথে রোগীর কোন সমস্যা হলে তুমি চিকিৎসা করবে, এ জন্যই তোমায় এনেছি। তখন ভাবিনি, তোমার কাছে ওষুধ বা যন্ত্রপাতি কিছুই নেই, কি দিয়ে চিকিৎসা করবে?’

 মেয়েটাকে আনার প্রয়োজন ছিলো, তোমাকে ছেড়ে ওকে নিয়ে এলে তোমাদের গোটা সেনাবাহিনী আমাদের ধাওয়া করতো। আমাদের যাত্রা নিরাপদ করার জন্যই তোমাকে আনতে হয়েছে। তা ছাড়া আমাদের একজন ভাল ডাক্তারও দরকার। এখন থেকে তুমি আমাদের সাথে থাকবে।

 ‘দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এমন কোন লোকের চিকিৎসা আমি করব না। তোমরা খ্রিস্টান এবং সুদানীদের বন্ধু। ফাতেমীদের সাহায্যকারী। তোমরা ওদের হাতের পুতুল। ওদের নির্দেশে তোমরা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছো/

 ‘তবে তো তোমাকে মরতে হবে।’

 ‘তাই আমার জন্য ভাল।’

 ‘তোমার সাথে এমন ব্যবহার করব যা ভাল না। তখন আমাদের প্রতিটি নির্দেশ পালন করতে তুমি বাধ্য হবে। তবে আমার মনে হয়, তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার কোন প্রয়জনই পড়বে না। তুমি সুলতান আয়ুবী র রাজত্ব দেখেছ, আমাদেরটা দেখলে বলবে এখান থেকে যাব না। এ তো এক স্বর্গ। আমাদের প্রস্তাব না মানলে নরকের ছবিটাও এক নজর দেখিয়ে দেব।

 ঘোড়া ছুটছে। চোখ বাঁধা থাকায় ডাক্তার কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কল্পনায় নিজের ভবিষ্যৎ দেখার চেষ্টা করছেন শুধু। শারজার কথা বার বার মনে পড়ছে। কিন্তু হতাশ হচ্ছেন এই ভেবে যে, মেয়েটা হয়ত ওদের দলেরই সদস্য। ও তাকে কোন সাহায্য করবে না।

 ² ² ² ² ²

 সীমান্তে প্রহরাবত মুসলিম সৈনিকদের ভয়ে অপহরণকারীদেরকে অনেক পথ ঘুরে যেতে হচ্ছে। দিনভর একটানা চলেছে সন্ধ্যার পরও থামেনি। মাঝরাতে কাফেলা একটা উপত্যকায় এসে থামল। অন্ধকার রাত। ডাক্তারকে ঘোড়া থেকে নামিয়ে চোখ এবং হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল। সামনে দিল খাবার এবং পানীয়। পথশ্রমে ক্লান্ত সবাই। ঘোড়াগুলোর জিন খুলে পানি খাওয়ানো হল। ঘাস পাতা দিয়ে বেঁধে রাখা হল একটু দূরে।

 খাওয়ার পর হাত-পা বেঁধে ডাক্তারকে ওরা শুয়ে পড়তে বলল। ওরাও শুয়ে পড়ল। গতরাতে কেউ ঘুমুতে পারেনি, শোয়ার সাথে সাথে ঘুম নেমে এল সবার চোখে।

 কিছুক্ষণ পর ডাক্তারের চোখ খুলে গেল। ভাবলেন হত্যা করার জন্য সম্ভবত তাকে জাগানো হচ্ছে। মরার জন্য ডাক্তার তৈরী। কে যেন পায়ের বাঁধন খুলছে। পায়ের কাছ থেকে ছায়ামূর্তি হাতের কাছে চলে এসেছে। ধীরে ধীরে হাতের বাঁধনও খুলে ফেলল। এরপর ডাক্তারের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘দুটো ঘোড়ার পিঠে জিন চাপিয়েছি।’ শারজার কণ্ঠ। ‘নীরবে আমার সাথে আসুন। ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে। এখুনি পালাতে হবে। ওরা অজ্ঞানের মত ঘুমুচ্ছে। সহজে জাগবে না।’

 নিঃশব্দে শারজাকে অনুসরণ করলেন ডাক্তার। নরম বালিতে হাঁটার শব্দ হচ্ছে না। সামনে দুটো ঘোড়া প্রস্তুত। দু’জন দুটোর পিঠে উঠে বসল।

 ‘ঘোড়া ভাল চালাতে না পারলেও ভয় নেই’, শারজা বলল, ‘পড়বেন না। লাগাম ঢিলা করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিন। ডানে বায়ে ঘুরাতে পারবেন তো?’

 ‘কোন কথা না বলে ঘোড়া ছুটালেন ডাক্তার। শারজা বলল, ‘আমার পেছনে আসুন, আমি পথ চিনি। সাবধান, অন্ধকারে যেন বিচ্ছিন্ন হবেন না।’

 অশ্বের ক্ষুরের শব্দে জেগে উঠল অপহরণকারী দল। কারা যাচ্ছে প্রথম দিকে বুঝতে পারল না ওরা। শারজার পালানোর প্রশ্নই ওঠে না। ডাক্তারের হাত পা বাঁধা। তাহলে কে যাচ্ছে? চিন্তা-ভাবনা করে কিছু সময় নষ্ট হল ওদের। ঘোড়ার কাছে ছুটে গেল ওরা। দুটো ঘোড়া নেই। খোজাখুজি করে বুঝল, ডাক্তারও নেই, শারজাও নেই।

 ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাল ওরা। দ্রুতগামী দুই ঘোড়সওয়ার তখন অনেক দূর চলে গেছে। তবুও ওরা বারবার পেছন ফিরে চাইছিল।

 অনেকক্ষণ শারজাকে বলল, ‘এখানে কোথাও সীমান্ত ফাঁড়ি রয়েছে। কোথায় জানি না।’ জানে না শারজাও। ফাঁড়ির রক্ষীদের দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য অনেক পথ ঘুরে ওরা এগিয়েছে। শারজা বলল, ‘সোজা পথে আমাদের গ্রাম এত দূরে নয়। আপনি নিশ্চিত থাকুন আমরা কায়রোর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি।’

 দুপুরে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর তকিদ্দীনের কাছে পৌঁছলেন আলী বিন সুফিয়ান। তাকে সব কথা খুলে বললেন। গভর্নর বললেন, ‘চারজন অপরিচিত লোককে বন্দীর সাথে দেখা করতে দেয়া এবং সন্দেহভাজন মেয়েটাকে তার কাছে থাকতে দেয়াটা ছিল মারাত্মক ভুল। আপনার মত অভিজ্ঞ ব্যক্তি এ ভুল করার পরও আমি ততটা আশ্চর্য হইনি, যতটা আশ্চর্য হয়েছি ওদের দুঃসাহস এবং দক্ষতা দেখে।

 ‘আপনি ঠিকই বলেছেন’, আলী বললেন, ‘সেন্ট্রিকে হত্যা করে বন্দীকে অপহরণ করা নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক কাজ।

 ‘আমার ধারণা ডাক্তার এবং যুবতী মেয়েটা এ অপহরণকে সহজ করে দিয়েছে। সুলতান আমাদের এ দুর্বলতা নিয়েই উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, নারী এবং ক্ষমতার লোভ এ জাতিকে ধ্বংস করবে। আমি ডাক্তারকে একজন ভাল মানুষ মনে করতাম। অথচ অবাক লাগছে, একটা সাধারণ মেয়ে তাকে অন্ধ করে ফেলল!’

 ‘বন্দীর গ্রামের ঠিকানা সংগ্রহ করে আমি এক প্লাটুন সৈন্য পাঠিয়ে দিয়েছি।’

 ‘দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের যে পর্বত ঘেরা পড়োবাড়ীর কথা বন্দী বলেছে সে ব্যাপারে কি চিন্তা করেছেন?’

 ‘মনে হয় বন্দী মিথ্যা বলেছে। জীবন বাঁচানোর জন্যই একটা মিথ্যে গল্প ফেঁদেছিল ও, এরপরও খোজ-খবর নেয়ার জন্য ওখানে গোয়েন্দা দল পাঠাব।’

 প্রহরী ভেতরে এসে বলল, ‘ডাক্তার একজন তরুণীকে নিয়ে এইমাত্র এখানে এসে পৌঁছেছেন, উনি আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন।

 এ সংবাদ শুনে থ’হয়ে গেলেন দু’জনই। একজন আরেকজনের দিকে চাইতে লাগলেন। কারও মুখে কথা সরছে না।

 ‘অন্য কেউ হবে হয়ত’ বলে বেরিয়ে গেলেন আলী। পেছনে গেলেন গভর্নর। ডাক্তার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল সাথে বন্দীর বোন শারজা। ধূলোমলিন বিধ্বস্ত চেহারা ওদের, ঘোড়াগুলো হাপাচ্ছে।

 ‘বন্দীকে কোথায় রেখে এসেছ?’ আলীর কণ্ঠে ঝাঝ। হাত দিয়ে ইশারা করে ডাক্তার বুঝালেন, তারা ভীষণ ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত।

 ভেতরে নিয়ে তাদেরকে পানি এবং খাবার দেয়া হল। খাওয়া শেষে ডাক্তার সব ঘটনা খুলে বললেন।

 ‘আহত বন্দী আমাদের সাথে রয়েছে জানতাম না। পরদিন ঘোড়া থেকে পড়ে লোকটা যখন মারা গেল তখনই শুধু জেনেছি বন্দীকেও অপহরণ করা হয়েছে।

 এরপর শারজার জবানবন্দী নেয়া হল। তার কথা শুনে আলী বুঝলেন, যতটা চতুর মনে করা হয়েছিল ও ততটা নয়। গ্রামের একজন সাধারণ মেয়ে হলেও সাহস আছে।

 শারজা বলল, ‘ভায়ের আশ্রয়ে এতদিন আমি বেঁচে ছিলাম তার জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হতাম না। ডাক্তার নিষ্পাপ, আন্তরিকতা ও দরদ নিয়েই তিনি ভায়ের চিকিৎসা করেছেন। তার পবিত্র ব্যবহারে আমি মোহিত হয়েছি। ভেবেছি লোকটা মানুষ নয়, ফেরেস্তা। আমার সাথে যে চারদিন লোক এসেছিল। ওদের সাথে আমার আত্মীয়তার কোন সম্পর্ক নেই। যারা সুলতানকে হত্যা করতে চায় এরা তাদের দলের লোক।

 আপনার লোকেরা যখন আমাদের গ্রামে গিয়েছিল তখন এ চারজন গ্রামে ছিল। ভায়ের বন্দী হওয়ার কথা শুনে ওরা সাথে এসেছে। ভাইয়া ওদের অনেক গোপন কথা জানতেন। ওদের আশংকা ছিল ভাইয়া না আবার সব প্রকাশ করে দেয়। ভাইয়া কোথায় এবং কি কাজে গিয়ে আহত হয়েছেন তাও তারা জানত। তাই সুযোগ পেলে ভাইয়াকে অপহরণ করার টার্গেট ছিল তাদের।

 আমারও ইচ্ছা ছিল ভাইয়াকে ওরা অপহরণ করুক। দুটো কারণে আমি ভাইয়ার কাছে থাকতে চেয়েছি। প্রথমতঃ তার সেবা করা। দ্বিতীয়তঃ সুযোগ পেলে তাকে অপহরণ করতে সাহায্য করা।

 আমার সাথে আসা সে চারজন লোক গ্রামে ফিরে যায়নি। কায়রোতে আত্মগোপন করেছি ওরা। আমার ইঙ্গিত পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। জিন্তু ডাক্তার আমার চিন্তা বদলে দিলেন। তিনি বলেছেন, ভাইয়াকে কোন শাস্তি দেয়া হবে না। সুলতান আয়ুবী সম্পর্কে আমাদের এতদিন যা বলা হয়েছিল। ডাক্তার সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বললেন। আমরা সুলতানকে হত্যা করা বৈধ মনে করতাম, কিন্তু ডাক্তার বললেন, তিনি ইসলামের জন্য যুদ্ধ করছেন। ডাক্তারের উন্নত নৈতিক চরিত্র সুলতান এবং ইসলাম সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে দিল। অধিকাংশ সময় তার কাছে গিয়ে এসব কথা শোনার জন্য বসে থাকতাম।

 একদিন ডাক্তারের বাসায় যাচ্ছি। পথে সেই চারজনের সাথে দেখা হল। ওরা ভাইয়াকে অপহরণ করার কথা বলল। আমি বললাম, ‘আমার ইচ্ছে পরিবর্তন করেছি। ভাইয়া এখানেই থাকবেন।’

 ওরা বলল, ‘শহরে এসে আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।’

 ওদের সহযোগিতা না করলে ওরা আমাকে হত্যা করে ভাইয়াকে নিয়ে যাবে বলে হুমকি দিল।

 আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। বললাম, ‘অপহরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের কোন সাহায্য করবো না।’ ওদের একজন বলল, ‘ডাক্তারের বাসায় তোমার আসা-যাওয়া দেখে ভেবেছিলাম তুমি তাকে ফাঁসিয়েছ। এখন দেখছি নিজেই তার জালে ফেঁসে গেছ।

 আমি ওদের ধমক দিয়ে বললাম, ‘এসব কথা আবার বললে পরিণতি ভাল হবে না। ডাক্তারের সাথে আমার খারাপ কোন সম্পর্ক নেই।’ ওরা এতটা দুঃসাহসী হয়ে এ কাজ করবে ভাবিনি, এ জন্য ডাক্তারকেও বলিনি কিছু।

 রাতে ডাক্তারের বাসা থেকে বাসা থেকে ফেরার সময় ওদের হাতে ধরা পড়লাম। একটা ঘোড়ার পিঠে আমার ভাইকেও দেখলাম। ভাইয়া মুক্ত হয়েছেন দেখে খুশীও হলাম। পালানোর জন্য প্রস্তুত হলাম। ডাক্তারকে অপহরণ করুক আমি চাইনি। আমার বাঁধা উপেক্ষা করে ওরা তার হাত-পা বেঁধে ঘোড়ায় তুলে নিল।

 ভাইয়াকে কিভাবে অপহরণ করেছে জানতে চাইলাম। ওরা বলল, ‘আমাদের দু’জন গিয়ে সেন্ট্রির কাছে একটা ঠিকানা জিজ্ঞেস করল। সেন্ট্রি তাদেরকে ঠিকানা বুঝাতে লাগল। এ সু্যোগে দু’জন ঢুকে গেল ভেতরে বাইরের দু’জনও সেন্ট্রিকে নিয়ে ভেতরে গেল। ভাইয়া তাদেরকে দেখে উঠে বসলেন।

 ভাইয়ার বিছানায় সেন্ট্রিকে শুইয়ে দেয়া হল। খঞ্জর দিয়ে বুকে দুটো আঘাত করে বেরিয়ে এল ওরা। ওরা ধারণা করেছিল, আমি ডাক্তারের বাসায় রয়েছি। ওদের ভয় ছিল, আমি অপহরণে বাঁধা দেব। এজন্য দু’জন লুকিয়ে রইল ডাক্তারের বাসায় যাওয়ার পথে। ডাক্তার যখন আমায় এগিয়ে দিতে আসছিলেন তখনই ওরা আমাদেরকে ধরে ফেলল। আর সাথে সাথেই সবাইকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল।

 YYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYYY

 দু’জনের জবানবন্দীর ওপর নির্ভর করেলেন না গোয়েন্দা প্রধান। এদের ফিরে আসাও ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে।

 দু’জনকে আলাদা কক্ষে নিয়ে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। আলী বাধ্য হলেন ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করতে।

 মেয়েটার প্রসঙ্গে ডাক্তার বললেন, ‘এর সাথে আবেগ জড়িত। ও দেখতে অবিকল আমার মৃত বোনের মত। এ জন্য ওকে আন্তরিকতা দেখিয়েছি, নিয়ে গিয়েছি আমার বাসায়। বন্দীর ঘরেও ওর কাছে বেশী সময় কাটাতাম। আমার ভেতর কোন পাপ বোধ ছিল না, এ কারণে ও বেশী প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল। বিশ্বাস করেছে আমাকে। জানতে চেয়েছিল অনেক কিছু। ও মুসলমান এবং গ্রামের এক সহজ সরল মেয়ে। সুলতান সম্পর্কে ওর ভেতর কাজ করছিল বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া। গ্রামে যা শুনেছে তাই বিশ্বাস করেছে। আমি ইসলাম, সুলতান এবং মিসর সম্পর্কে ওর খারাপ ধারণা দূর করেছি। তার কথা শুনে বুঝতে পেরেছি, তাদের এলাকায় ইসলাম এবং সুলতানের বিরুদ্ধে প্রাকাশ্য ষড়যন্ত্রে চলছে।

 শারজার নিয়মিত জবানবন্দী গ্রুহণ না করে আলী তাকে কিছু প্রশ্ন করলেন, ওর জবাবেও পড়োবাড়ীর প্রসঙ্গ এসেছে। শারজা নিজেও পড়োবাড়ীর রহস্যময় পীরের ভক্ত।

 ও বলল, ‘ভাইয়া সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। বাড়ীতে আমি থাকতাম একা। গ্রামের লোকেরা আমাকে ওখানে চলে যেতে বলেছে পবিত্র বাবা নাকি সুন্দরী যুবতী কুমারীদের পছন্দ করেন। আমাদের গ্রামের ক’জন সুন্দরী যুবতী রহস্য ঘেরা বাড়িতে গিয়ে ফিরে আসেনি। এক ছুটিতে ভাইয়া বাড়ী গেলেন। আমি পড়োবাড়ীতে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। তিনি নিষেধ করলেন।

 পড়োবাড়ী সম্পর্কে শারজা পরিষ্কার করে কিছুই বলতে না পারলেও ওখানে কি হচ্ছে বুঝা যায়। ডাক্তারের প্রসংগ তোলা হলে ও বলল, ‘অপহরণকারীরা তাকে বন্দী করে রাখলেও আমি তাকে মুক্ত করে দিতাম। আমি বাঁচব কি মরব এ তোয়াক্কা করতাম না।

 ভাইয়ার মৃত্যুর পর গ্রামে যাবার আর কোন আকর্ষণ আমার নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম পথেই ডাক্তারকে মুক্ত করব। ভেবেছিলাম অপহরণকারীরা আপন। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন, ওরা পাপী এবং অপ্রাধী। নিজের দেশের বিরুদ্ধে ওরা ষড়যন্ত্র করছে। পরে বুঝেছি, ভাইয়ার জন্য ওদের কোন আন্তরিকতা নেই। ভাইয়া তাদের গোপন তথ্য জানতেন বলেই তাকে ওরা মেরে ফেলেছে।

 ‘এখন কি করবে?’ প্রশ্ন করলেন আলী। ‘নিজের ব্যাপারে কি ভেবেছ?’

 ‘আমি সারা জীবন ডাক্তারের পায়ের ওপর পরে থাকব। তিনি আগুনে ঝাপ দিতে বললে তাও দেব। আমার চোখে ছিল পাপের পর্দা। ডাক্তার তা সরিয়ে দিয়েছেন। আপনারা যদি রহস্যঘেরা বাড়ীতে যেতে চান, আমি নিয়ে যাব। আমাদের এলাকায় যারা সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে আমি সবাইকে চিনি। ওদের গ্রেফতার করতে চাইলে আমি সহযোগিতা করব। এ জন্য মরতে হলেও পিছপা হব না। ওরা দেশ ও জাতির শত্রু এ কথা ডাক্তার আমাকে ভালভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন।

 আলীর পরামর্শে পদস্থ সেনা অফিসার এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মিটিং ডাকা হল। আলোচনা হল পরিস্থিতি নিয়ে।

 অধিকাংশ সদস্যের অভিমত হল, তকীউদ্দীন যেহেতু মিসরে নতুন, কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে চিন্তা ভাবনা করা উচিৎ। এক বিশাল এলাকা জুড়ে যেহেতু ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত হয়েছে, এত লোকের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ হবে না। মনে হচ্ছে রহস্যময় বাড়ী ঘিরা নতুন মতাদর্শের জন্ম নিয়েছে। মতাদর্শের অনুসারীরা এর বিরুদ্ধে কোন সেনা অভিযান সহ্য করবে না। ওরা দ্বীনের সত্যিকার কথা তুলে ধরে আবেগকে আহত করা যাবে না।

 কেউ পরামর্শ দিলেন, ‘ঘটনা সুলতানকে অবহিত করে তার নির্দেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ।’

 ‘এর অর্থ হচ্ছে আপনারা মানুষকে ভয় পাচ্ছেন।’ মুখ খুললেন ভারপ্রাপ্ত গভর্নর। যে আল্লাহ্‌ এবং রাসুলের দ্বীনকে বিকৃত করা হচ্ছে সে ব্যাপারে আপনাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। মিসরে কি হচ্ছে সব সুলতানকে জানিয়ে তাকে বিব্রত করা ঠিক হবে না। সুলতান এক শক্তিমান শত্রুর মোকাবেলা করছেন তা আপনাদের অজানা নয়। তাকে কি বুঝাতে চাইছেন আমরা দু’চার হাজার শত্রুর ভয়ে আতংকিত! আমি সরাসরি এবং কঠোর পদক্ষেপ নিতে চাই।

 ‘অপরাধ নেবেন না মাননীয় আমীর!’ বললেন একজন সেনাপতি। ‘আমাদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের অভিযোগ হচ্ছে আমরা তরবারীর জোরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা এ অপবাদ মুছে ফেলতে চাই। আমরা ওখানে যাব প্রেম এবং ভালবাসার বাণী নিয়ে।’

১৩০/১৩২

‘তাহলে কোমরে তরবারী ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন?’ গভর্নরের কণ্ঠে তিরস্কার। ‘এত টাকা খরচ করে কেন সেনাবাহিনী লালন পালন করা হচ্ছে? সেনাবাহিনীকে ছুটি দিয়ে একদল ধরমপ্রচারক তৈরী করি। ওরা গ্রামে গ্রামে, দেশে দেশে ঘুরে ধর্ম প্রচার করবে। অস্ত্রভান্ডার নীল দরিয়ায় ফেলে দিয়ে বলুন সবাই দরবেশ হয়ে যাই।’

 গভর্নরের কণ্ঠে উথলে উঠল এক রাশ আবেগ। ‘রাসূল (সা.) এর বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের তরবারী উন্মুক্ত হলে ইসলামের তরবারী কোষমুক্ত থাকবে না। একবার যদি ইসলামের তলোয়ার কোষমুক্ত হয় তবে নবীর (সা.) সামনে মাথানত করতে অস্বীকারকারী প্রতিটি বেঈমানের শিরোচ্ছেদ করা হবে। কালিমার বিরুদ্ধাচারণকারী প্রতিটি জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলা হবে।

 ইসলামের তরবারীর জোরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ অভিযোগকারীদের কাছে আমরা ক্ষমা চাইতে যাব না। কেন সংকীর্ণ হয়ে এসেছে মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা? স্বয়ং মুসলমানই কেন ইসলামের শত্রুতে পরিণত হচ্ছে! কারণ, খ্রিস্টান যুবতীদের রূপ, মদ, সম্পদ, আর ক্ষমতার মোহ মুসলমানদের তরবারী ভোতা করে দিয়েছে। যুদ্ধ আমাদের ইতিহাস।

 যেহেতু যুদ্ধের ময়দানে ওরা আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না তাই বিভিন্ন অভিযোগ দিয়ে ওরা আমাদের ইতিহাসের ঐতিহ্যকে নিঃশেষ করে দিতে চাইছে। ওদের পদাতিক এবং নৌ-অভিযান ব্যর্থ। আমাদেরকে নিঃশেষ করার জন্য ওরা বিছিয়েছে ষড়যন্ত্রের জাল। নারী, মদ আর সম্পদের মাধ্যমে দ্বীনের সামনে দাঁড় করিয়েছে বাধার প্রাচীর।

 আমাদের চরিত্র, আমাদের নৈতিকতা আর আমাদের ঈমানী চেতনা ধ্বংস করার জন্য সামনে এগিয়ে দিচ্ছে রূপসীদের রাঙ্গা ঠোঁটের মৃদু হাসি। আপনারা এদের বিরূদ্ধে তরবারী কোষমুক্ত করতে নিষেধ করছেন!

 শুনুন আমার বন্ধুরা! ভালবাসার অভিনয় করে শত্রু আপনাদের হাত থেকে তরবারী ছিনিয়ে নিতে চাইছে। আঘাত করতে চাইছে আপনাদের পিঠে। ‘কেউ তোমার এক গালে চড় মারলে অন্য গাল পেতে দাও’, ওদের এ শ্লোগান একটা প্রতারণা। ক্রাকের মুসলমান কি অবস্থায় আছে আপনারা জানেন না? ওদের তৈরী বেগার ক্যাম্প সুবাকে দেখেননি?’ ওখানে লুণ্ঠিত হয়েছে মুসলিম নারীদের সম্ভ্রম। অধিকৃত ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মুসলমান নারীরা হারাচ্ছে ইজ্জত। প্রচন্ড আতংকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে ওরা।

 খ্রিস্টানরামুসলমানদের কাফেলা থেকে যুবতী এবং সুন্দরী মেয়ে ও শিশুদের অপহরণ করে নেয়ে যাচ্ছে। আসব জনোয়ারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে আপনারা নিষেধ করছেন? বলছেন এ অন্যায়! এ অন্যায় করতে আমি লজ্জিত হব না। নিরস্ত্র মুসলিম রক্তে রংগীন হচ্ছে খ্রিস্টানদের তরবারী। ওদের অপরাধ, ওরা আল্লাহ্‌ এবং রাসূলকে বিশ্বাস করে, ভালবাসে। ওরা ক্রুশ পুজা এবং শিরক করে না। যেখানে আল্লাহর বাণী কায়েম হবে শুধু সেখানেই তোমাদের তরবারী কোষবদ্ধ হবে। ১৩২/১৩৪

‘ওদের আবেগকে আহত করা যাবে না’ আমি এ কথায় বিশ্বাসী নই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাসক আর অযোগ্য আমীর ওমরাহর দল আকর্ষণীয় কথা বলে মানুষকে প্রলুব্ধ করে। মানুষের মিথ্যে আকীদা বিশ্বাস ওদের পূঁজি। জনগণকে কুসংস্কারের সাগরে ডুবিয়ে নিজের লালসা এবং ভোগ বিলাসে মত্ত থাকলে চলবে না। সত্যের পথে চলতে গিয়ে কারও কারও কষ্ট হবে। এ ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে।

 কয়েকজনের সন্তুষ্টির জন্য জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে পারি না। কিছু মানুষের আবেগ আহত হবে বলে দেশের এক বিশাল এলাকা ষড়যন্ত্রকারী গাদ্দারের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না। আপনারা দেখেছেন ওখানকার মানুষ সহজ সরল এবং অশিক্ষিত। গোত্রপতিরা ধর্মের ইজারাদার হয়ে বসে আছে। শত্রুর পক্ষ হয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।

 সভার সদস্যগণ কল্পনাও করতে পারেনি গভর্নর এমন কঠিন পদক্ষেপ নিবেন। তিনি যে সব যুক্তি পেশ করেছেন তা খন্ডন করার ক্ষমতা কারও ছিল না। অন্য কোন পরিকল্পনা পেশ করার সাহস পায়নি কেউ।

 গভর্নর বললেন, ‘বর্তমানে মিসরে অবস্থানগত সেনাবাহিনীর ময়দানের বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। এদের মধ্য থেকে পাঁচশত ঘোড় সওয়ার, দু’শ উস্ট্রারোহী এবং পাঁচশত পদাতিক সৈন্য আজ সন্ধ্যার মধ্যে রওয়ানা করবে। এরা রহস্য ঘেরা বাড়ী থেকে এদ্দুর দূরে থাকবে, যেন, প্রয়োজনে আক্রমণ করতে পারে।

 দামেশক থেকে যে দু’শ সওয়ার এসেছে তারা পার্বত্য এলাকায় গিয়ে পড়োবাড়ী অবরোধ করবে। বাড়ীর ভেতরে চলবে কমান্ডো অভিযান। ওরা তৈরী করে একদল চাটুকার। চাটুকারের দল ঘুরে ঘুরে প্রচার করে, ওলি যা বলেছেন তা আল্লাহর কথা। আমির ওমরা বা রাজার কথা না মানলে পাপ হবে।

 এ ভাবেই মানুষ লম্পট পাপীদের গোলামীর শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে। সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে দুটো শ্রেণীতে। একদল শাসক, আর একদল শাসিত। একদল অত্যাচারী, অন্যদল অত্যাচারিত। তখন জনগণ হয় ক্ষমতাসীনদের বলির পাঠা।

 আমরা দেখছি শত্রু আমাদের মুলে আক্রমণ করছে। আমাদের ভাইদেরকে নিয়ে যাচ্ছে কুফরীর গহীন অন্ধকারে। এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে এর অর্থ হবে আমরা বেঈমানদের সহযোগিতা করছি। আমার ভাই সুলতান আয়ুবী বলেছেন, গাদ্দারী এবং গাদ্দারীতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি।

 আমি দেখতে পাচ্ছি, সমাজে শাসক এবং শাসিত এ দুটো শ্রেনী সৃষ্টি হয়েছে। শাসক মদের পিয়ালায় ডুবিয়ে দেবে দেশের সম্পদ। অনাহারে অর্ধাহারে মারা পড়বে জনগণ। ভাইজানের কথাই ঠিক। তিনি বলেছেন, স্বীয় জাতি এবং ধর্মের ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিৎ আমাদের। জাতির চিন্তা চেতনা এবং কর্মধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, আগামী প্রজন্ম আমাদের কবরের কাছে জবাব চাইবে। জাতি এবং ধর্মের জন্য কল্যাণকর কোন কাজ থেকে আমাদেরকে দূরে থাকলে চলবে না। সভা শেষ হল। সবাই যুদ্ধ যাত্রার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

 ü ü ü ü ü ü ü ü ü ü

 দলে উপদলে বিভক্ত করে সুলতান সেনাবাহিনীকে সমগ্র মরু এলাকায় ছড়িয়ে দিলেন। দখল করে নিলেন পানি এবং মরুদ্যান। শত্রু যেন এসব এলাকায় আসতে না পারে এ জন্য পাহারা দেয়ার জন্য স্থাপন করলেন মেনজানিক কামান। প্রস্তুত রইল তীরন্দাজ। পর্বত চূড়ায় বাংকার তৈরী করা হল।

 মুসলিম ফৌজকে নির্দেশ দেয়া হল, শত্রু মুখোমুখি আক্রমণ করলে চার দিকে ছড়িয়ে যাবে। ওরাও তখন ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হবে। সুলতান এমন ভাবে সৈন্যদের সংগঠিত করলেন এমন ভাবে সৈন্যদের সংগঠিত করলেন, কোনটা সামনের দিক আর কোনটা পেছনের বুঝার কোন উপায় রইল না।

 সেনাবাহিনীর এক অংশ রিজার্ভ রাখা হল প্রয়োজনে কাজে লাগানোর জন্য। প্রস্তুত রইল কমান্ডো বাহিনী। সুলতান খ্রিস্টানদের তৎপরতার বিস্তারিত খবর পাচ্ছিলেন। ওদের প্রথম পরিকল্পনা ছিল সুবাক দুর্গ পুনরুদ্ধার করা। সুবাক অবরুদ্ধ হলে সুলতানের ক্ষুদ্র বাহিনীকে মরুভুনিতেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যাবে।

 ভেতরের সাহায্য থেকে সৈন্যবাহিনী সরিয়ে আনলেন। বাহ্যত সুবাক এখন অরক্ষিত। খ্রিস্টান গুপ্তচর ছুটল ক্রাকে। বলল, ‘সুবাক এখন অরক্ষিত। নিরদ্ধিধায় আক্রমণ করা যায়। বিনা বাধায় সুবাক দুর্গ দখল যাবে।’

 সাথে সাথে মুখোমুখি আক্রমণকারী বাহিনীকে দিক পরিবর্তনের নির্দেশ দেয়া হল। নতুন নির্দেশ পেয়ে খ্রিস্টানদের বিশাল বাহিনী এগিয়ে চলল সুবাকের দিকে। পেছনে রসদের বহর। রসদ বোঝাই হাজার হাজার গাড়ী পেছনে আসছে। বিস্তীর্ণ এলাকার কোথাও একজন মুসলিম সৈন্যও দেখা যায়নি। নির্ভয়ে এগিয়ে চলল রসদবাহী কাফেলা।

 খ্রিস্টান সম্রাটদের খুশীর আন্ত নেই। সুবাক দুর্গ তাদের হাতের মুঠোয়। রাত নেমেছে। কেউ ঘুমিয়েছে, কেউ আবার আনন্দ উৎসব করছে। অকস্মাৎ দৃষ্টি ছুটে গেল ফৌজের পেছনে। মাইল পাঁচেক দূরের আকাশ রংগীন হয়ে উঠছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আগুনের শিখা লকলকিয়ে উঠছে আকাশের দিকে। একদল দ্রুতগামী সওয়ার পাঠিয়ে দেয়া হল। ওরা যখন সেখানে পৌঁছল তখন সব শেষ। ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সে আগুনের দিকে। ওদের চোখের সামনে পুড়ছে ওদের রসদ সামান। লাগামহীন ঘোড়াগুলো দিক-বিদিক ছুটাছুটি করছে। আগুনে পুড়ে গেছে পশুর খাবার, শুকনো ঘাস আর খড়ের স্তুপ।

 সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সেনাপতিরা ছুটে গেলেন সেখানে। তাদের বিষণ্ণ চোখে অবাক দৃষ্টি। কিছু নেই। এক মাসের রসদ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ওরা বুঝতে পারল এবারও ওরা সুলতান আয়ুবী র ফাঁদে পা দিয়েছে। ‘রসদ’ ছাড়া দুর্গ অবরোধ করা যাবে না। এখন সুবাক যাওয়ার পথও নিরাপদ নয়।’ সেনাপতি সিদ্ধান্ত দিলেন, ‘অভিযান মুলতবী করা হল।’

 গুপ্তচরের দ্বিতীয় সংবাদে আরও হতাশ হয়ে পড়ল খ্রিস্টান বাহিনী, ‘গত রাতে খ্রিস্টানদের দ্বিতীয় বাহিনীর রসদও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’

 খ্রিস্টান সম্রাট এবং সেনাপতিরা বৈঠকে মিলিত হলেন। পরিকল্পনা রদবদল করতে হবে। কি আশ্চর্য! মুসলিম বাহিনীর ‘টিকি’টি পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। গোয়েন্দারাও বলতে পারল না কোথায় জমায়েত হয়েছে মুসলিম বাহিনী। বিশাল মরুভূমির কোথাও নেই ওরা।

 খ্রিস্টানদের দুই বিশাল বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করে দিলেন সুলতান। কমান্ডারদের ডেকে বললেন, ‘খ্রিস্টান ফৌজ যুদ্ধ মুলতবী করলেও আমাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। ওরা দুই বাহিনীর মুখোমুখি লড়াইকে যুদ্ধ বলে। আমি তা করব না। ওরা পিছিয়ে যাচ্ছে। ওদের নিশ্চিন্তে যেতে দেব না। কমান্ডো আক্রমণে ওদের ব্যস্ত রাখবে। পেছনে বা ডানে বায়ে ঝটিয়ে আক্রমণ করে পালিয়ে রণক্ষেত্রে। সেখানের ধূলিকণাও তোমাদের সহযোগিতা করবে।

 সুলতান এক জায়গায় বসে থাকতেন না। আজ এখানে তো ওখানে। ঘুরে বেড়াচ্ছেন সমগ্র মরু এলাকা। খ্রিস্টান গোয়েন্দারাও জানে না সুলতান কোথায় আছেন। পরবর্তী বিপর্যয়ের ভয়ে তটস্থ রইল খ্রিস্টান ফৌজ।

 * * * * * *

 137/139

মিসরের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের পার্বত্য এলাকা। এখানকার রহস্য বাড়ীতে আকাশ থেকে নেমে আসলো হযরত ঈসা (আঃ)। ফেরাউনদের ভাংগা বাড়ী থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন এক ধর্ম বিশ্বাস। এ অঞ্চলের অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ নতুন এ ধর্ম মত গ্রহণ করছে।

 বৃহস্পতিবারের এক মনোরম সন্ধ্যায় বাড়ীর প্রবেশ পথে দর্শনার্থীর প্রচন্ড ভীড়। সারিবদ্ধভাবে ভেতরে ঢুকছে সবাই। ভেতরের প্রশস্ত কক্ষে গুঞ্জরিত হচ্ছে অদৃশ্য কণ্ঠ। পাশের দেয়ালে ভাসছে পাপীর শাস্তির দৃশ্য। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মত আজও মানুষ আগ্রহ নিয়ে সে দৃশ্য দেখছে।

 হঠাৎ কণ্ঠ থেমে গেল। যে পবিত্র বাবাকে পাপী চক্ষু দেখতে পায় না তার কণ্ঠের পরিবর্তে ভেসে এল নতুন কণ্ঠ, ‘পথভ্রষ্ট মানুষ! আজ রাতে বাড়ী ফিরে যেতনা। যে রহস্য উন্মোচনের জন্য তোমরা উদ্বিগ্ন, কাল সকালে তা দেখতে পাবে। যে বাবার দর্শক লাভের জন্য তোমরা ব্যাকুল, ভোরেই তার দেখা পাবে। এখনই এ পড়োবাড়ীর বাইরে চলে যাও। হযরত ঈসা আসছেন। বাইরে গিয়ে সবাই শুয়ে পড়।’

 কক্ষের দেয়ালে ভেসে উঠা তারকারাজী ম্লান হয়ে এসেছে। যুবতীরা হেঁটে বেড়াচ্ছে। সৈন্যদের পোশাক পরা কিছু লোক ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওদের। চিৎকার ভেসে আসছে। থেমে গেছে মেঘের গর্জন। পবিত্র স্থানে এসব কি ঘটছে! ভয়ার্ত মানুষ কক্ষ থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল।

 কি ঘটছে দর্শনার্থীদের কেউ বুঝতে পারল না। সংগী হচ্ছে কমান্ড সদস্যরা। কেউ কেউ ঢুকছে মশাল নিয়ে। ভেতরে মশাল নেয়ার নিয়ম নেই। আশ্চর্য হল দর্শনার্থী, বুঝতে পারছে না কেন মশাল নেয়া হচ্ছে। প্রায় পঞ্চাশটি মশাল এবং একশজন গলি পথে এগিয়ে গেল ওরা। এ পথে বাইরের কারও চলাচল নিষিদ্ধ। এরা সবাই সশস্ত্র। কারও কাছে খঞ্জর, তারবারী আবার কারও হাতে রয়েছে তীর ধনুক। লোকজনের বেরোবার পথেও ঢুকে পড়েছে কমান্ডো সৈন্য। ছড়িয়ে প্রতিটি অন্ধকার গলিতে।

 দামেশকের দু’শ অশ্বারোহী ঘিরে ফেলল বাড়ীর চারদিক। ওরা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা দর্শনার্থীদের একত্রিত করছিল। বাড়ীর ভেতরটা অন্দ্রনালীর মত পেছানো। আঁকা-বাঁকা পথ পেরিয়ে কমান্ডো দল প্রশস্ত কক্ষে। চাঁদ অনেক উঁচু। কক্ষে অনেক নারী-পুরুষ। কারো কারো চেহারা নেকড়ের মত।

 মিসরের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর তকিউদ্দীন এবং আলী বিন সুফিয়ানের পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যার পর সেনা সদস্যের একটি দল পার্বত্য এলাকায় পৌঁছল। পথ দেখাচ্ছিল শারজা। পাঁচশ ঘোড় সওয়ার, দু’শ উস্ট্রারোহী এবং পাঁচশ পদাতিক সৈন্যের বহর লুকিয়ে রইল খানিক দূরে। পড়োবাড়ী আক্রান্ত হলে সুদানীরা আক্রমণ করতে পারে।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 4 | 5 | 6 | 7 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top