৪. ভয়ংকর ষড়যন্ত্র

 ছোট ভাই এবং কর্মকর্তাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে সুলতান রণক্ষেত্রে রওয়ানা হয়ে গেলেন। সঙ্গে চব্বিশজন দেহরক্ষী। খ্রিস্টান গোয়েন্দারা এ খবর জানত। চাতুর্যের সাথে ঘাতক দলের চারজন সদস্য দেহরক্ষী পদে চাকুরী নিয়েছিল। সুলতানকে হত্যা করাই ছিল তাদের কিন্তু সুযোগ হচ্ছে না। কারণ, চারজনের ডিউটি একত্রে পড়েনি। তাছাড়া সব সময় কমপক্ষে বিশজন পাহারায় থাকত। রক্ষীদের কমান্ডার ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক এবং বুদ্ধিমান। রক্ষী দলে ঘাপটি মেরে আছে ঘাতকদের চারজন সদস্য জানতেন না তিনি। সুলতান সফরে, সুতরাং তিনি আরও বেশী সতর্ক। সঙ্গে আরও বেশী রক্ষী নিতে চেয়েছিলেন কমান্ডার। সুলতানের আপত্তির জন্য রক্ষীদের সংখ্যা বাড়ানো যায়নি।

 কায়রো থেকে সুলতানের যাত্রা শুরু হয়েছিল বিকেলে। সফর চলল মাঝ রাত পর্যন্ত। এরপর বিশ্রাম। ভোর রাতে আবার যাত্রা শুরু হল। দুপুরের মরু রোদে ক্লান্ত হয়ে পড়ল ঘোড়াগুলো। পানি, ছায়াদার বৃক্ষ এবং টিলা দেখে থামল কাফেলা। তাবু টানানো হল সুলতানের জন্য। রক্ষীদের দু’জন তাবুর সামনে, দু’জন পেছনে। অন্যরা ধারে কাছে ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। কয়েকজন ঘোড়াকে পানি খাওয়াতে ব্যস্ত। আলী বিন সুফিয়ান এবং সুলতানের অন্য সংগীরা তাবু টানাননি। একটা টিলার পাশে গাছের ছায়ায় সবাই শুয়ে পড়েছেন। ঝোপ ঝাপের কারণে সুলতানের তাবু ছিল দৃষ্টির আড়ালে। উত্তাপ ছড়াচ্ছে মরু সূর্য। যে যেখানে পারছে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে।

 এই প্রথম একসঙ্গে সুলতানের তাবুর প্রহরায় এসেছে ঘাতক দলের দু’জন সদস্য। বাকী রক্ষীরা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। সহিসরাও উট এবং ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়াচ্ছে। ঘাতক দলের অন্য দু’সদস্য বাকী রক্ষীদের সাথে। প্রহরারত দু’সৈন্যকের একজন তাঁবুর পর্দা ঈষৎ ফাঁক করল। চকিতে ফিরে তাকাল দ্বিতীয় প্রহরীর দিকে। সুলতান ঘুমিয়ে আছেন। পিঠ তাঁবুর দরজার দিকে।

 প্রহরী হাতের বর্শা তাঁবুর বাইরে রেখে আলতো পায়ে ভেতরে প্রবেশ করল। খাপে ভরা তরবারী, খজ্জরও হাতে নেয়নি। এ প্রহরী অন্যদের চাইতে শক্তিমান, বয়সে যুবক। শরীরে অসুরের শক্তি। সতর্ক পায়ে সে এগিয়ে গেল ঘুমন্ত সুলতানের কাছে।

 আচমকা দু’হাতে চেপে ধরল সুলতানের ঘাড়। সুলতান ঘুমাননি, জেগেই ছিলেন তিনি। পাশ ফিরার সময় টের পেলেন দু’টো লৌহ কঠিন হাত গলায় চেপে বসছে।

 আর কয়েক মুহূর্ত মাত্র। এরপর চিরদিনের জন্য নিভে যাবে তার জীবনের আলো। উপুড় হয়ে পড়ে আছেন তিনি। ঘাতক সুলতানের পিঠ হাটু দিয়ে চেপে ধরে ঘাড় থেকে একটা হাত সরিয়ে নিল। আরেক হাতে চেপে রাখল সুলতানের ঘাড়। কোমরের বেল্ট থেকে একটা কাগজের প্যাকেট বের করল। প্যাকেটের মুখ খুলে ভেতরের পাউডার ঢেলে দিতে চাইল সুলতানের মুখে।

 লোকটার গায়ে অসুরের শক্তি। অসহায়ের মত পড়ে আছেন সুলতান। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঘাতকের হাতে প্যাকেট দেখে তিনি বুঝতে পেরেছেন লোকটা তাকে বিষ খাওয়াতে চাইছে। মুখবন্ধ করে ফেললেন তিনি।

 বিষ খাওয়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠল প্রহরী, এ ফাঁকে কোমর থেকে খঞ্জর খুলে নিলেন সুলতান। ঢুকিয়ে দিলেন লোকটার পাঁজরে। বের করে আবার আঘাত করলেন। ষাঁড়ের মত শক্তিশালী প্রহরী এতেও কাবু হল না।

 সুলতান খঞ্জর বের না করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে লোকটার অন্ত্রনালী কেটে ফেললেন। ঢিলে হয়ে গেল আক্রমণকারীর হাত। পড়ে গেল হাত থেকে কাগজের প্যাকেট। ধাক্কা দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়ালেন সুলতান। লোকটা পড়ে গেল নিচে। ক্ষতস্থানে হাত চেপে পড়ে আছে, উঠার সাধ্য নেই।

 পতনের শব্দে দ্বিতীয় প্রহরী তাঁবুর ভেতর উঁকি দিয়ে দেখল। সঙ্গীর অবস্থা দেখে তরবারী নিয়ে ছুটে এল। আঘাত করল সুলতানকে লক্ষ্য করে। চকিতে জায়গা বদল করে আঘাত ঠেকালেন সুলতান। সুলতান যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন তার পাশের খুটিতে আটকে গেলো তরবারী।

 এ সুযোগে সুলতান প্রহরীকে খঞ্জর দিয়ে আঘাত করলেন। দেহ বাঁকিয়ে আঘাত এড়াল প্রহরী। সুলতান উচ্চস্বরে কমান্ডারকে ডাকলেন। দ্বিতীয় আঘাত করল প্রহরী। সরে আক্রমণকারীর পাশে চলে এলেন তিনি। আঘাত করলেন পাঁজরে। আমূল ঢুকে গেল খঞ্জর। সুলতানের ডাক শুনে আরও দু’জন প্রহরী ছুটে এল। ঝাঁপিয়ে পড়ল সুলতানের ওপর।

 সুলতান সাহস হারালেন না। তিনজনের বিরুদ্ধে একা লড়ে যেতে লাগলেন।

 কয়েকজন প্রহরী নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন কমান্ডার। ঢুকেই আক্রমণকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

 একপাশে সরে দাঁড়ালেন সুলতান। মনে পড়ল, এর আগেও তিনি এমনি এক পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। দাঁড়িয়ে দু’জন প্রহরীর যুদ্ধ দেখতে লাগলেন সুলতান। শোরগোল শুনে আলী এবং তার সংগীরাও এলেন। পরিস্থিতি দেখে বিবর্ণ হয়ে গেল আলীর চেহারা। রক্তাক্ত হয়ে চারজন প্রহরী মাটিতে পড়ে আছে। মারা গেছে দু’জন। তৃতীয় জন জ্ঞান হারিয়েছে। পাজর থেকে পেট পর্যন্ত ফাঁড়া। বুকে গভীর ক্ষত।

 চতুর্থ জনের আঘাত লেগেছে পেটে এবং উরুতে। হাত জোড় করে সে জীবন ভিক্ষা চাইছে। ‘আমি বেঁচে থাকতে চাই। আমার বোনের জন্য আমায় বেঁচে থাকতে দিন। ক্ষমা করুন আমায়।’

 সুলতান ইঙ্গিতে প্রহরীদের থামিয়ে দিলেন।

 ‘ওকে মেরো না, দ্রুত ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা কর।’

 একটু পর তৃতীয় প্রহরীরও জ্ঞান ফিরে এল। এক দেহরক্ষী এগিয়ে ওর বুকে খঞ্জর বসিয়ে দিল।

 ব্যক্তিগত চিকিৎসককে ডাকলেন সুলতান। বললেন, ‘যে কোন মূল্যে ওকে বাঁচাতে হবে। চিকিৎসার কোন ত্রুটি যেন না হয়।’

 সুলতান সম্পূর্ণ সুস্থ। একটা আঁচড়ও লাগেনি তাঁর গাঁয়ে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি আশ্চর্য হইনি। এমনটি হওয়ারই কথা।’

 আলীর অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। কপালে চিন্তার বলিরেখা। চেহারা বিবর্ণ। সুলতানের দেহরক্ষী নির্বাচন করার দায়িত্ব তাঁর। দলের অন্যান্য সদস্যরা বিশ্বস্ত কিনা এখনই দেখা উচিৎ।

 সুলতানের বিছানা থেকে ঘাতকের হাত থেকে পড়ে যাওয়া কাগজের প্যাকেট তুলে নিলেন ডাক্তার। পরীক্ষা করে বললেন, ‘ভয়ংকর বিষ। এর সামান্য পাউডার কাউকে খাওয়াতে পারলে মৃত্যু অনিবার্য। নিশ্চিন্তে মারা যায় লোকটি।’ ডাক্তারের নির্দেশে বিছানা বাইরে নিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে আনা হল।

 আহত প্রহরীকে তুলে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিলেন সুলতান। পেটের চাইতে তাঁর উরুর ক্ষতটা বেশী মারাত্মক।

 প্রহরী হাত জোড় করে সুলতানের কাছে জীবন ভিক্ষা চাইতে লাগল।

 সুলতানের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা নেই। সে একজন ভাড়াটিয়া খুনী।

 ক্ষতস্থানের ব্যথার চাইতে সে বেশী কাঁদছিল অবিবাহিত বোনের জন্য। বোনের নাম নিচ্ছিল বারবার।

 ‘মহামান্য সুলতান’, বলল সে, ‘আমি একজন মুসলমান। ক্ষমা করুন আমায়। আমার জন্য না হলেও আপনার একজন মুসলিম বোনের জন্য আমায় মার্জনা করুন।’

 ‘জীবন এবং মৃত্যু আল্লাহর হাতে,’ দৃঢ় অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন সুলতান, ‘কে মারে কে বাঁচায় দেখলে তো? কিন্তু আমার বন্ধু! এ মুহূর্তে আমার হাতে তোমার জীবন তুমি দেখতে পাচ্ছ, কিন্তু সেদিকে না তাকিয়ে নিজের পাপের দিকে তাকাও। দেখ কত অসহায় তুমি।

 তোমার মৃত সংগীদের সাথে মরুভূমিতে ফেলে দেব, মারব না তোমায়। শিয়াল-শকুন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে তোমার মাংস। তোমার জ্ঞান থাকবে, কিন্তু পালাতে পারবে না, এক সময় মরে যাবে। এভাবেই পাবে তোমার পাপের শাস্তি। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল প্রহরী। আঁকড়ে ধরতে চাইল সুলতানের হাত।

 ‘কে তুমি?’ প্রশ্ন করলেন সুলতান, ‘কোথেকে এসেছে? আমার সাথে তোমার কিসের শত্রুতা?’

 ‘আমি ফাতেমীদের লোক। আমরা চারজনই ঘাতক দলের সদস্য। তিন বছর পূর্বে আপনার সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছিলাম। কিভাবে আপনার দেহরক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায় আমাদেরকে বলে দেয়া হয়েছিল।’

 প্রহরীর মুখ থেকে বেরিয়ে এল অনেক মুল্যবান তথ্য। একদিকে ডাক্তার ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করছেন, অন্যদিকে লোকটি বলে যাচ্ছে। ফাতেমী খেলাফতের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত আয়ুবী র বিরুদ্ধে কি কি ষড়যন্ত্র করেছে, কি চুক্তি হয়েছে খ্রিস্টান এবং ঘাতক দলের সাথে সব কথাই সে বলল।

 ডাক্তার ব্যান্ডেজ শেষ করেছেন।

 লাশগুলো বাইরে ফেলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন সুলতান। আলীকে বললেন, আহত প্রহরীকে এখান থেকেই কায়রো নিয়ে যেতে। বললেন, ‘প্রহরী ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত যে সব লোকের নাম করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নাও।’

 সাথে সাথে আহত প্রহরীকে নিয়ে উটে চাপলেন আলী। ছুটলেন কায়রোর দিকে।

·          * * * * * *

মিসরের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত এলাকা। এরপরই সুদানের বর্ডার। এখানে রয়েছে পুরনো পড়োবাড়ী। শত শত বছরের অব্যবহৃত বাড়ীগুলো ভয়ংকর এবং দুর্গম। হয়ত ফেরাউনদের সময় এ এলাকা ছিল সবুজ শ্যামল। ছিল পানির ঝর্ণা। শুকনো ঝিল আর পানি শূন্য নদী তার সাক্ষ্য বহন করছে। এখানে ছিল পাথুরে পর্বত আর বালিয়াড়ি। পর্বতগুলো দেখতে ছিল বিশাল অট্টালিকার মত। থামের মত পর্বতশৃঙ্গ। কোথাও দেয়ালের মত। সমতল ভূমিতে বালি আর বালি।

 এলাকার বাইরে কোথাও কোথাও পানি। গাছ-গাছালিও রয়েছে। অধিবাসীদের পেশা কৃষি। চল্লিশ মাইল লম্বা এবং বার মাইল চওড়া অঞ্চল জুড়ে জনবসতি। জনসংখ্যার বেশীর ভাগ মুসলমান। অন্য ধর্মেরও কিছু লোক রয়েছে। সবাই কুসংস্কারে বিশ্বাসী। ফারাওদের এসব অট্টালিকাকে মানুষ ভয় পেত। লোকজন ভুলেও মাড়াত না এসব এলাকা। তাদের বিশ্বাস, এখানে থাকে ফেরাউনদের অতৃপ্ত আত্মা।

 দিনের বেলা পশুর রূপ ধরে ওরা ঘুরে বেড়ায়। ওদের কখনও দেখা যায় উস্ট্রারোহী সৈনিকের বেশে, আবার কখনও সুন্দরী যুবতীর রূপে। কখনও শোনা যায় ভয়ংকর শব্দ।

 বছর খানেক থেকে এসব পড়োবাড়ী মানুষকে আকর্ষণ করতে শুরু করেছে। মুসলিম সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তির জন্য আয়ুবী র লোকজন যখন ওখানে গিয়েছিল, এলাকার লোকজন তাদেরকে পড়োবাড়ী সম্পর্কে ভয়ংকর গল্প শুনিয়েছিল। ওরা ওখানে যেতে নিষেধ করেছে তাদের।

 প্রথমবার অনেকেই ভর্তি হয়েছে সেনাবাহিনীতে। পরের বার চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। সীমান্ত প্রহরীরাও ভয়ে ও পথ মাড়ায় না। ওরা কোন মানুষকে পড়োবাড়ীতে যেতে দেখেনি। ইদানীং ওখানে লোকজনের যাতায়াত শুরু হয়েছে। ওখান থেকে যখন ফিরে আসে, ওদের চোখে মুখে থাকে তৃপ্তি। দেখতে দেখতে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে ওখানে মেলা বসতে শুরু করেছে। ঘটছে আশ্চর্য সব ঘটনা। সেদিন পাঁচজন সীমান্ত রক্ষী টহল দিতে দিতে পড়োবাড়ীর কাছে গেল, কিন্তু তারপর কি যে হলো, ওদের আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

 *****

 সমগ্র মিসরে ছড়িয়ে ছিল সুলতান আয়ুবী র গোয়েন্দা বাহিনী। রহস্যঘেরা পড়োবাড়ী সম্পর্কে ওরা কেন্দ্রে রিপোর্ট পাঠাল। রিপোর্টে বলা হল, ‘এ অঞ্চলের মানুষের চিন্তাধারা বলে যাচ্ছে। মুসলিম সেনাবাহিনীকে ওরা ঘৃণার চোখে দেখে। সুলতান আয়ুবী র নামও ওরা শুনতে চায় না।’

 এ রিপোর্ট পাঠানোর পর দু’জন গোয়েন্দা কর্মী নিহত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, গোপনে হত্যা করা হয়েছে ওদের। ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের লোকজন ভয়ংকর পড়োবাড়ীতে যাওয়া আসা শুরু করল। অথচ ক’দিন আগেও ওই স্থানের নাম শুনলে ভয়ে আঁতকে উঠত সবাই।

 শুরুটা ছিল, একদিন গাঁয়ে এল একজন অপরিচিত উস্ট্রারোহী। লোকটি মিসরীয় মুসলমান। উটের মত তার চেহারাও নাদুশ নুদুশ। গাঁয়ের লোকদের একত্রিত করে সে বলল, ‘আমি অর্থ কষ্টে ছিলাম। দিনে একবেলার আহার জোটাতে পারতাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম ডাকাতি করব। বাড়ী থেকে বের হলাম একদিন। বাহন নেই। পায়দল হাঁটতে লাগলাম।

 এ এলাকায় জনবসতি নেই। ভাবলাম ডাকাতি করে এখানে নিরাপদে লুকিয়ে থাকতে পারব, ধরা পড়ার ভয় থাকবে না। অনেকদিন ঘোরাঘুরি করলাম। কিন্তু কোন শিকার পেলাম না।

 হাঁটতে হাঁটতে পড়োবাড়ী এলাকায় একটা পাহাড়ের কাছে পড়ে গেলাম। দেহে শক্তি নেই। অনেক কষ্টে দু’হাত ওপরে তুলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলাম। কানে ভেসে এলো এক গুরুগম্ভীর শব্দ, ‘তুমি ভাগ্যবান, এখনও কোন পাপ করোনি, পাপের ইচ্ছে করেছ মাত্র। ডাকাতি করে এখানে এলে এতক্ষণে দেহের পরিবর্তে হাড়ের ছাউনি পড়ে থাকত। পাহাড়ী জন্তু জানোয়ার তোমার গোশত ছিঁড়ে খুঁড়ে খেত।’

 সে বলল, ‘শব্দ শুনে আমি আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। মনে হল কে যেন আমাকে টেনে তুলছে। চোখ খুলে দেখলাম এক আজব দৃশ্য। সেখানে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। দেখলাম দুধ সাদা শুভ্র শুশ্রুমন্ডিত বৃদ্ধকে। বৃদ্ধের দুচোখ থেকে আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। তাহলে এ বৃদ্ধের কণ্ঠই শুনেছি আমি?’

 ভয়ে কাঁপতে লাগলাম আমি। বৃদ্ধ দু’হাত বাড়িয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘কোন ভয় নেই পথিক। যারা এখানে আসতে ভয় পায় ওরা হতভাগা। শয়তান ওদেরকে এখানে আসতে দেয় না। যাও, গাঁয়ের লোকদের গিয়ে বল ফারাওদের খোদা এখন আর নেই। এ এলাকা এখন মুসার খোদার রাজত্ব। হযরত ঈসা (আ.) আকাশ থেকে এখানেই অবতরণ করবেন। এ বিরাণ ভূমি থেকেই প্রজ্জ্বলিত হবে ইসলামের আলো। জ্যোতিতে জ্যোতিমান হবে সমগ্র পৃথিবী।যাও বতস, গাঁয়ের লোকদের আমার কথা বলবে। এখানে নিয়ে এস ওদের।’

 আমি হাঁটতে পারছিলাম না। দেহ শক্তিহীন, দুর্বল। বৃদ্ধ আবার বললেন, ‘যাও গুণে গুণে পঞ্চাশ পা উত্তর দিকে এগুবে। খবরদার, একবারও পেছনে তাকাবে না। লোকদের কাছে আমার এ কথাগুলো পৌঁছে দাও। নয়তো তোমার ভীষণ ক্ষতি হবে। সামনে দেখবে একটা উট বসে আছে। তার সাথে রয়েছে ঘাস-পাতা, তোমার খাবার এবং পানি। উটের সাথে আর যা পাবে সব তোমার।’

 এ কথা শুনে আমি হাঁটতে লাগলাম। কোন দুর্বলতা নেই। বৃদ্ধকে ফেরাউনের আত্মা ভেবে প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম, এ জন্য পেছনে তাকাইনি, যেন পালাতে পারলে বাঁচি।

 গুণে গুণে পঞ্চাশ পা এগোলাম। এখানে এসে পথ খানিকটা বেঁকে গেছে। সামনে দেখলাম একটা উট। এগিয়ে গিয়ে উটের সাথে বাঁধা পুটুলী থেকে খাবার বের করে নিলাম। তৃপ্তির সাথে খেয়ে পানি পান করলাম। দেহে এল অবর্ণনীয় শক্তি।’

 একটি থলির মুখ খুলল অপরিচিত লোকটি। লোকদের দেখিয়ে বলল, ‘এই দেখুন স্বর্ণ মুদ্রা, এটিও উটের সাথে বাঁধা ছিল। তাই উটে চাপে আপনাদের কাছে এলাম বৃদ্ধের বাণী শোনানোর জন্য।’

 কথা শেষ করে অপরিচিত লোকটি ফিরে গেল। লোকটির বাচনভংগী গাঁয়ের মানুষকে ভয়ংকর স্থানে উদ্বুদ্ধ করল। মুরুব্বীরা বললেন, ‘লোকটি অপরিচিত। আমরা কেউ কখনও তাকে দেখিনি। লোকটি নিজেই ফারাওদের আত্মা কিনা কে জানে!’

 নিসিদ্ধ জিনিষের প্রতি মানুষের সহজাত আকর্ষণের ফলে যুবকরা সে ভয়ংকর স্থানে যেতে তৈরী হল। ওরা দেখতে চায় পড়োবাড়ীর গোপন রহস্য। স্বর্ণ মুদ্রার হাতছানি এড়াতে পারল না গাঁয়ের লোকজনও।

 Ø Ø Ø Ø Ø Ø Ø Ú Ú Ú

চল্লিশ মাইল দীর্ঘ এলাকায় এ অপরিচিত লোকটির সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। কেউবা সিদ্ধান্ত নিল যাবার জন্য, কিন্তু মন থেকে ভয় দূর করতে পারছিল না। কিছু লোক পার্বত্য এলাকার কাছাকাছি গিয়ে ফিরে এসেছে।

 ক’দিন পর দু’জন যুবক উস্ট্রারোহী সমগ্র এলাকা ঘোরাঘুরি করল। আগের লোকটির মত গল্প বললেও এদের বলার ধরন ছিল ভিন্ন। ওরা ঘোড়ায় চেপে অনেক দূরে যাচ্ছিল। সাথে ছিল অতিরিক্ত দুটো ঘোড়া। ওতে মূল্যবান মালপত্রে বোঝাই। ওরা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য নিয়ে যাচ্ছিল সুদান।

 পথে ডাকাত দল ওদের সব কিছু কেড়ে নিয়ে ওদের তাড়িয়ে দিয়েছে। যুবক দু’জন হাঁটতে হাঁটতে পার্বত্য এলাকায় এসে ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে পরল। চলার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল ওদের। ক্লান্ত দেহ নিয়ে মাটিতে বসে পড়ল।

 ওরা দেখল শুভ্র পোশাক পরা একজন বৃদ্ধ ধীরপায়ে ওদের কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘শয়তান তোমাদের সম্পদ লুট করেছে। তোমরা খুব ভাল। পঞ্চাশ কদম এগিয়ে দুটি উট দেখতে পাবে। উটের সাথে যা থাকবে সব তোমাদের। সোনা গয়না দেখে পরস্পর মারামারি করো না। তাহলে দু’জনই চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে যাবে। গ্রামে গিয়ে লোকদের বলো পার্বত্য এলাকাকে যেন ভয় না পায়। এখানে ভয়ের কিছু নেই।

 সাহস করে লোকজন পার্বত্য এলাকায় যাতায়াত শুরু করল। দেখা গেল অনেকেই পার্বত্য এলাকায় যাতায়াত শুরু করল। দেখা গেল অনেকেই ভয়ংকর পড়োবাড়ীতে আসা যাওয়া করছে। ওরা বলল, ‘ভেতরে একজন দরবেশ রয়েছেন। তিনি গায়েব জানেন। আকাশের খবর বলতে পারেন।’

 কেউ কেউ বলল, ‘তিনি ইমাম মেহদী।’ কেউ বলল, ‘তিনি মুসা (আ.)।’ আবার অনেকের ধারণা তিনিই হযরত ইসা (আ.)। তিনি যেই হোন একজন দরবেশ। পাপীদের সাথে দেখা দেন না, কেবলমাত্র মন পবিত্র করে গেলেই তাকে দেখা যায়। দু’একজন বলেই ফেলল, ‘তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারেন।’

 এসব রহস্যময় গল্প মানুষকে পড়োবাড়ীর দিকে টানতে লাগল। ভয়ংকর স্থানে শুরু হল মানুষের আনাগোনা। ভেতরে গুহার মত কক্ষে ঢোকার আঁকাবাঁকা পথ। একটা বিশাল কক্ষের ছাদ অনেক উঁচু। ছাদে মাকড়সার জাল। কিন্তু ফুলের সুবাসে ম,ম করছে। কোথাও নীচের দিকে নেমে গেছে সিঁড়ি। পাতালপুরীতে গিয়ে শেষ হয়েছে শেষ ধাপ।

 এসব প্রাসাদ ছিল ফারাওদের। ওরা নিজেরা খোদার আসনে বসেছিল। ওদেরকে সবাই দেখতে পেত না। মানুষকে এ প্রাসাদে একত্রিত করে শুধু কণ্ঠ শোনানো হতো। বড় কক্ষে মিশে ছিল এক সুড়ং মুখ। সুড়ংয়ের অপর প্রান্ত থেকে কথা বলা হত। কে কথা বলছে লোকেরা তা দেখত না, শুধু কণ্ঠ শোনা যেত।

 এ শব্দটি খোদার কণ্ঠ ভেবে তৃপ্তি পেত মানুষ। বড় কক্ষে ছিল পর্যাপ্ত আলো। কোন প্রদীপ ছিল না। এ জন্য আয়না ব্যবহার করা হত। আলোর প্রতিবিম্ব কক্ষে এসে পড়ত। খোদাই নুরের এ কারিশমা দেখে হতবাক হয়ে যেত মানুষ।

 শত শত বছরের সেই পুরনো পদ্ধতি ফিরে এল আবার। মানুষ সুড়ংয়ের শব্দকে খোদার শব্দ মনে করে মোহিত হল। দূর হয়ে গেল পড়োবাড়ীর ভয়। অনেক পথ ঘুরে বিভিন্ন কক্ষ পেরিয়ে যেতে হত বড় কক্ষে। সবগুলো কক্ষে ছিল কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা। ইথারে ভেসে বেড়াত একটি কণ্ঠ। ‘আমি তোমাদেরকে আঁধার থেকে আলোতে নিয়ে এসেছি। মরে গেছে ফেরাউনের আত্মা। খোদার নূর দেখ। এ হল কোহে নূরের জ্যোতি। মুসা এ জ্যোতিই দেখেছিলেন। ঈসা (আ.) কে এ নূর জ্যোতিষ্মান করবে। আল্লাহ্‌কে ভয় কর। মুখে কালিমা পড়।’

 হতবাক হয়ে লোকজন পরস্পরের দিকে চাইত। গুণ গুণ করে কালিমা পড়ত সবাই।

 ইথারের শব্দে মুসা, ইসা এবং কালিমার কথা না থাকলে মানুষ হয়ত বিশ্বাস করত না। এরা সবাই মুসলমান। ধর্মের নামে ওরা সব কথাই বিশ্বাস করছে। ইথারে গুঞ্জরিত হল দ্বিতীয় কণ্ঠ, ‘আমাদের নবী (সা.)অন্ধকার হেরা গুহায় আল্লাহ্‌কে দেখেছিলেন। তোমরাও অন্ধকার কক্ষে আল্লাহ্‌কে দেখতে পাবে।

 ভক্তির আবেশে মাথা নোয়াল সবাই। যিনি পথিকদের উট, খাবার এবং স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছেন এরা তার কাছে যেতে চাইছে। যিনি মৃত্যুকে জীবন দিতে পারেন, এরা তাকে দেখতে চায়।

 মানুষের আগ্রহ এবং সেই সাথে উৎকণ্ঠা বেড়ে যাচ্ছিল। ওরা যখন বাড়ী ফিরল, মহিলারা বলল, ‘একজন অপরিচিত লোক এসে দরবেশের অলৌকিক কাজের বর্ণনা দিয়েছে। ওরা নাকি দরবেশকে দেখেছে।’

 বড় মসজিদের ইমামের কাছে গিয়ে লোকজন দরবেশ সম্পর্কে প্রশ্ন করল। ইমাম সাহেব বললেন, ‘তিনি একজন পবিত্র মানুষ। হযরত ঈসার বাণী নিয়ে এসেছেন। ঈসার বাণী হল ভালবাসা আর সম্প্রীতির শিক্ষা। তিনি যুদ্ধ বিগ্রহ করতে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, কাউকে আহত করোনা বরং আহত ব্যক্তির চিকিৎসা কর। তোমরা এ নিয়ম মেনে চললে দরবেশ বাবা অবশ্যই তোমাদের সাথে দেখা দেবেন।’ ইমাম সাহেবের মুখে শোনার পর দরবেশ সম্পর্কে মানুষের মনে আর কোন সন্দেহ রইল না। দলে দলে লোক পড়োবাড়ীতে যেতে লাগল। দরবেশ ঘোষণা করল, ‘শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার রাতে লোকজন এখানে আসতে পারবে।’

 সে অনুযায়ী প্রতি বৃহস্পতিবার বাবার সাথে দেখা করার দিন ধার্য করা হল। পুরুষের সাথে মেয়েরাও ওখানে যেতে লাগল। এখন কেউ ইচ্ছে মত পড়োবাড়ীতে যেতে পারে না। দূর-দূরান্ত থেকে উট, ঘোড়া আর খচ্চরে চেপে আসতে লাগল। রহস্য ঘেরা পড়োবাড়ীর বাইরে বৃহস্পতিবার আসার অপেক্ষায় বসে থাকে দর্শনার্থী।

ভেতরের চিত্রও বদলে গেল। আলো আঁধারীতে পাপী আর পূণ্যবানের ছবি দেখানো হল। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখতো পাপীর ছবি শূন্যে ভাসছে, শাস্তি পাচ্ছে।

 সূর্য ডোবার সাথে সাথেই খুলে যেত রহস্যে ভরা সুড়ং মুখ। সুড়ংটি মুলতঃ প্রাসাদের ভেতরকার প্যাসেজ। দু’পাশের দেয়ালে ছোট ছোট খুপড়ি। সুড়ং পথ দশজন পরে পরে ডানে বায়ে মোড় নিয়েছে। সুড়ং মুখে দাঁড়িয়ে থাকে দু’জন লোক। পাশে খেজুরের স্তূপ। মনে হত দর্শকদের দেয়া খেজুরের তোহফা এখানে জমা করা হচ্ছে। খেজুরের পাশে পানির মশক। সুড়ং পথে যেতে চাইলে দর্শনার্থীদেরকে দুটো খেজুর এবং কয়েক ঢোক পানি দেয়া হয়।

 অন্ধকার সুড়ং পেরিয়ে এরা পৌঁছত আলো ঝলমলে বিশাল কক্ষে। ওখানে ভেসে আসত গায়েবী আওয়াজঃ ‘ কালিমা পড়, আল্লাহ্‌কে স্মরণ কর। হযরত মুসা এসেছেন। ঈসা (আ.) আসবেন। মন থেকে পাপ এবং শত্রুতা মুছে ফেল। যুদ্ধ বিগ্রহের কথা ভুলে যাও। বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে যাদের দিয়ে সুদ্ধ করানো হয়েছিল তাদের পরিণতি দেখে নাও।

 দর্শনার্থীদেরকে একদিকে মুখ করে দাঁড় করানো হত। শব্দ শেষ হলেই ছুটে আসত চোখ ধাঁধানো তীব্র আলো। একটু পর সে আলো কমে আসত ধীরে ধীরে। তারপর আবার তীব্র আলোতে ভরে যেত ঘর।

 এভাবে কয়েকবার আলোতে খেলা চলার পর সামনের দেয়ালে ভেসে উঠত অসংখ্য ছবি। ধ্বনিত হত গায়েবী আওয়াজঃ ‘এরাও তোমাদের মতই যুবক এবং সুন্দর ছিল। খোদার বিধান মানেনি। কোমরে তরবারী ঝুলিয়ে ঘোড়ায় চেপে খোদার সৃষ্ট মানুষ হত্যা করেছে। ওদের ধোকা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছিল তোমরা যুদ্ধ করে শহীদ হলে স্বর্গ পাবে। ওদের পরিণতি দেখো। খোদা ওদেরকে শয়তানের রূপ দিয়েছেন।’

 এর সাথে শোনা যেত মেঘের গর্জন আর বজ্রের চমক। শোনা যেত বিভিন্ন পশুর শব্দ। চোখ ধাঁধানো আলোয় দর্শকরা চোখ পিটপিট করে তাকাতো দেয়ালের দিকে। ভঙ্কর দাতালো পশুর দল একদিক থেকে অন্য দিকে যাচ্ছে। শুধু মুখটা মানুষের মত, বাকী সব ভয়ঙ্কর হায়নার মত।

 একটু পর দেখা গেল, ওরা দু’বাহুতে জড়িয়ে রেখেছে দুই উলংগ সুন্দরী যুবতী। ছাড়া পাওয়ার জন্য তড়পাচ্ছে যুবতীরা। বজ্রের শব্দ ছাপিয়ে গম্ভীর কণ্ঠ ধ্বনিত হল, ‘এদের ছিল রূপের অহংকার। খোদার দেয়া সৌন্দর্য সুষমাকে এরা অপবিত্র করেছে।’

 এরপর দেয়ালে ভেসে বেড়াত সুন্দর যুবক আর রূপসী রমণীর দল। প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশী। গায়েবী শব্দ তুলে ধরত এদের পরিচয়। এসব যুবক যুবতী যুদ্ধ বিগ্রহে যায়নি। মানুষকে শুনিয়েছে প্রেম ও ভালবাসার বাণী। কেউ কারো মনে আঘাত দেয়নি। ওরা সন্তুষ্ট করেছে মানুষকে, আল্লাহও ওদের প্রতি সন্তুষ্ট তাই।

 এরপর ওদের নিয়ে যাওয়া হত অন্য একটি কক্ষে। ওখানে ছিল মৃত মানুষের হাড়গোড়। সুন্দরী যুবতীরা এদিক ওদিক হাঁটছে। ঠোঁটে মিষ্টি হাসির ঝিলিক।

 একটু পর ভেসে আসত গায়েবী শব্দঃ ‘হযরত ঈসা আসছেন। যুদ্ধ বিগ্রহ এবং ঘৃণা বিদ্বেষ মন থেকে মুছে ফেল। খলিফা আল আযেদ পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন।

 দৃষ্টিকাড়া রূপসীদের দিকে তাকিয়ে থাকতো দর্শকরা। কিন্তু ওদের বের করে দেয়া হত অন্য পথে। দর্শকদের মনে হত এইমাত্র ওরা স্বপ্ন দেখে জেগে অনভূতিতে ভরা। ওরা আবার ফিরে যেতে চাইত সে স্বপ্নের জগতে। কিন্তু ওদের আর সুড়ং মুখে যেতে দেয়া হতো না।

 লোকজন ওখান থেকে বেরিয়ে বাড়ী ফিরে যেতো না কেউ। রাত কাটাতো প্রাসাদের বাইরে পর্বতে, উপত্যকায়। দু’তিন জন বসে ফিস ফিস করে কথা বলত। আল্লাহর বাণী নিয়ে যিনি এসেছেন গায়েবী শব্দ তার। তিনি বললেন, হযরত ঈসা আসছেন। খলিফা আল আযেদ আবার পৃথিবীতে এসেছেন।

 আল আযেদের মৃত্যুর পর ফাতেমীরা খ্রিস্টান এবং ঘাতক দলের সাথে মিশে সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। মিসর আক্রমণ করার জন্য সুদানে তৈরী হচ্ছিল শক্তিশালী বাহিনী। দিন দিন পড়োবাড়ীড় অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে লাগল। সমগ্র দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে রটে গেল ঈসা (আ.) আসছেন। তিনি আল আযেদকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এরা শপথ নিয়েছে আয়ুবী র সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবে না। যুদ্ধ বিগ্রহ করা মহাপাপ। সালাহউদ্দীন একজন পাপী সম্রাট। সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধির জন্যে তিনি যুবকদের স্বর্গের লোভ দেখিয়ে ফৌজে ভর্তি করছেন।

 পড়োবাড়ী এখন এ অঞ্চলের লোকদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। অনেকে পার্বত্য এলাকায় স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করেছে। দরবেশকে একনজর দেখার জন্য এরা বাড়ী ঘর ছেড়ে অপেক্ষার প্রহর গোণে দিনের পর দিন। কখন আসবে সেই শুভ লগ্ন, কথন বাবা দেখা দেবেন। জীবন থেকে মুছে যাবে অভাব, আশান্তি আর মলিনতা।

–   – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – – –

 আহত বন্দীকে নিয়ে কায়রো পৌঁছলেন আলী বিন সুফিয়ান। বন্দীর নাম আকিল। আলাদা বাড়ীতে রেখে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হল। বাড়ীর সামনে সেন্ট্রি দাঁড় করিয়ে দিলেন আলী।আকিল তখনও সুস্থ হয়নি, সে-ই পড়োবাড়ীর ঠিকানা দিয়েছিল। সিদ্ধান্ত হল, আকিল সুস্থ হলে গোয়েন্দা দল তাকে নিয়ে পার্বত্য এলাকায় যাবে। উদ্ধার করবে পড়োবাড়ীর রহস্য। আলী কায়রো এসে সহকারী গোয়েন্দা প্রধান হাসান এবং পুলিশ প্রধানকে বললেন ওই এলাকায় যেন কোন লোক পাঠানো না হয়। ওখানকার লোকজনের ভেতর সেনাবাহিনী বিরোধী আবেগ সৃষ্টি করা হয়েছে। আলীর ধারণা ওখান থেকে রহস্যময় ষড়যন্ত্র বের করা যাবে।

 আকিলের ধারণা সে মরে যাবে। বিলাপ করছিল সে। নিজের গ্রামের নাম নিয়ে বলছিল, ‘আমার বোনকে এলে দাও। আমি এ জীবনে ওকে আর কোনদিন দেখতে পাব না।’

 তার এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিলেন আলী বিন সুফিয়ান। তিনি বন্দীর কাছ থেকে সব গোপন কথা বের করার চেষ্টা করছিলেন। লোকটি বোনের জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল। একে একে সবকিছুই বলে দিল আলীর কাছে। গোয়েন্দা প্রধান বুঝলেন ওর কাছে আর কোন তথ্য নেই। দু’জন দূতকে ডাকলেন আলী। আকিলের গাঁয়ের ঠিকানা, বোনের নাম ধাম দিয়ে বললেন, ‘ওর বোনকে সাথে নিয়ে আসবে। মিসরের দক্ষিণ পশ্চিমে ওর বাড়ী।’

 দূত দু’জন সাথে সাথে ঘোড়ায় চেপে বসল।

 সুবাক দুর্গে পৌঁছে গেছেন সুলতান আয়ুবী। তাকে হত্যা করার জন্য এত বড় একটা আক্রমণ হল চেহারায় উদ্বেগের চিহ্ন মাত্র নেই। রক্ষীদের কমান্ডার এবং কর্মকর্তাদের নির্ঘুম রাত কাটে। ভয়ে তটস্থ থাকে সবাই। এই বুঝি সুলতান তাদেরকে ডেকে বলবেন, কেন এমনটি হল? শাস্তি না দিলেও অন্যত্র বদলি করে দিবেন। কিন্তু সুলতান নির্বিকার। এ প্রসংগের ধারে কাছেও গেলেন না। কেন্দ্রীয় সেনা নেতৃবৃন্দকে ডেকে বললেন, ‘আপনারা দেখেছেন আমার জীবনের কোন ভরসা নেই। আমার যুদ্ধের চাল আপনাদের গভীরভাবে বুঝে নিতে হবে। শত্রুরা আরেকটা রণক্ষেত্র তৈরী করেছে। ওদের গুপ্তচরদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন। আমাদের গোয়েন্দাদের কেউ কি ফিরে এসেছে?’

 ‘মহামান্য আমীর। দু’জন গোয়েন্দা কর্মী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে এসেছেন।’ একজন সেনা অফিসার বললেন।

 সুলতান তাদের ডেকে পাঠালেন। খ্রিস্টানদের সমস্ত পরিকল্পনা সুলতানকে অবহিত করা হল। নূরুদ্দীন জংগীর পাঠানো ফৌজের সালার এবং মিসর থেকে আসা ফৌজের সালারকে আসতে বলে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।

 চারদিন পর আকিলের বোনকে নিয়ে দূত কায়রো ফিরে এল। সাথে চারজন লোক। ওরা বন্দীর চাচা এবং চাচাত ভাই। বোনটি মনকাড়া সুন্দরী। তার চোখে মুখে উদ্বেগের চিহ্ন। সেই আকিলের একমাত্র বোন। বাবা মা নেই ওদের।

 বন্দীর সাথে দেখা করতে চাইল ওরা। আলীর অনুমতি প্রয়োজন। বোনকে অনুমতি দিলেন গোয়েন্দা প্রধান। সংগীরা অনেক অনুরোধ করল। বলল, ‘আমরা তার সাথে কথা বলব না। এক নজর দেখেই চলে আসব।’

 অনুমতি মিলল। কিন্তু সঙ্গে রইলেন আলী। পাঁচজনকেই বন্দীর কাছে নেয়া হল। আকিলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটা। ভায়ের চোখে মুখে চুমো খেয়ে কাঁদতে লাগল।

 ‘এদের সাথে হাত মেলাও।’ চাচা এবং চাচাত ভাইকে দেখিয়ে বললেন আলী।

 করমর্দনের পর ওদের বের করে দেয়া হল। আলী বললেন, ‘এর সাথে আর কখনও দেখা করতে পারবে না, এবার তোমরা বাড়ী যেতে পার।’

 গাঁয়ের পথ ধরল ওরা। মেয়েটা আলীর পায়ের কাছে বসে পড়ল।

 ‘আমার ভায়ের সেবা-শুশ্রূষা করার সু্যোগ দিন।’ অনুরোধ ঝরে পড়ল যুবতীর কণ্ঠ থেকে।

 বোনের এ আবেগ ফেলতে পারলেন না আলী। একজন মহিলাকে ডেকে বললেন, ‘ওর দেহ তল্লাসী কর।’

 দেহ তল্লাশী করা হল। এরপর মেয়েটাকে বন্দীর কাছে রেখে সবাই ফিরে গেলেন। কক্ষে ভাই-বোন ছাড়া কেউ নেই। কি হয়েছে জানতে চাইলে ভাই সব ঘটনা খুলে বলল।

 ‘এখন ওরা আপনার সাথে কেমন ব্যবহার করবে?’

 ‘সুলতানের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করেছি, এ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। অনুগ্রহ করে মৃত্যুদণ্ড না দিলেও আজীবন কারাদন্ড ভোগ করতে হবে।

 ‘তবে কি আপনাকে আর কোন দিন দেখতে পাব না?’

 ‘না শারজা।’ বেদনা মাথা কণ্ঠে বলল আকিল। ‘কারাগারে আমি মরবও না আবার বাঁচবও না। কারাগার অত্যন্ত ভয়ংকর স্থান।’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top