৪. ভয়ংকর ষড়যন্ত্র

 ‘মুসলমানদের সাথে এখানে যা করা হচ্ছে সালাহউদ্দীন আয়ুবী নিয়মিত তার খবর পাচ্ছেন।’ হরমুন বলল, ‘আপনারা তাকে ক্রাকে তাড়াতাড়ি আক্রমণ করতে বাধ্য করছেন। আপনারা ভুলে যাচ্ছেন আমাদের সেনাবাহিনী এ মুহূর্তে কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার উপযুক্ত নেই।’

 ‘তবে কি এখানকার মুসলমানদেরকে মাথায় তুলে নাচব! বুঝতে পারছি না বন্দীদেরকে হত্যা না করে কেন আমরা লালন পালন করছি।’ জবাব দিলেন গে অব লুজিনাম।

 ‘কারণ মুসলমান বন্দীদের হত্যা করলে আয়ুবী আমাদের বন্দীদের হত্যা করবে। আমাদের কাছে রয়েছে ওদের তিনশ লোক, ওদের কাছে রয়েছে আমাদের তেরশ বন্দী।’

 ‘একজন মুসলমান সৈন্য হত্যার বিনিময়ে আমরা চারজন খ্রিস্টান সৈন্য হারাতে পারি না’, বললেন শাহ অগাস্টাস।

 ‘আয়ুবী আমাদের যে সব সৈন্যদের বন্দী করেছে ওরা ভীরু, কাপুরুষ। যুদ্ধ করার পরিবর্তে স্বেচ্ছায় বন্দীত্ব গ্রহণ করেছে। ওদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। আমাদের হাতে মরার চাইতে বরং মুসলমানদের হাতে মরাই ভাল। নিশ্চিন্তে মুসলিম বন্দীদের হত্যা করার পক্ষপাতি আমি।’ একজন সেনা কমান্ডার দাঁড়িয়ে বলল।

 ‘স্থানীয় মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করে, বন্দীদের হত্যা করে আমরা কি আয়ুবীকে পরাজিত করতে পারব? এখন আমাদের সামনে সমস্যা হল আয়ুবী আক্রমণ করলে কিভাবে বাধা দেব, কিভাবে সুবাক দুর্গ পুনরুদ্ধার করব। আপনার কথামত ক্রাকের সব মুসলমানদের মেরে ফেললাম। তারপর কি হবে? শত্রু কি নিশ্চিহ্ন হবে? তারচে আয়ুবীর মত আমরাও আমাদের সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করছি না কেন?’ বলল একজন।

 ‘মিশরে আমাদের গোয়েন্দারা কি কাজ করছে অনুগ্রহ করে হরমুন কি বলবেন?’ বলল আরেক সেনা কমান্ডার।

 ‘হ্যাঁ, আমাদের গোয়েন্দারা আশানুরূপ কাজ করছে। সালাহউদ্দীন সুবাক কেল্লায়। তার অনুপস্থিতিতে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কায়রোর উপ-রাষ্ট্রপতি মুসলেহ উদ্দীন ফাতেমীদের সাথে হাত মিলিয়েছে। মুসলেহ উদ্দিন আয়ুবীর বিশ্বস্ত। এখন আমাদের হাতে ফাতেমীরা গোপনে একজনকে খলিফা নির্বাচন করে বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের সেনা অফিসাররা সুদানী বাহিনী তৈরী করছে। কায়রোতে আয়ুবীর ফৌজের দু’জন উপ-সেনাপ্রধান আমাদের লোক। সুদানীরা আক্রমণ করলেই ফাতেমীরা বিদ্রোহ করবে।’

 ‘ভুলে যাচ্ছ কেন, মিসরের সংবাদ পেলে আয়ুবী ক্রাক দুর্গ আক্রমণ মুলতবী রেখে ছুটে যাবে।’ বললেন রিমান্ড, ‘এখানেই রাখতে হবে তাকে। এমনভাবে বিরক্ত করতে হবে যেন তার সৈন্যরা মিসর যাবার পথ না পায়।’

 হরমুন বললেন, ‘আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, মিসরে তার যে ক’জন সৈন্য রয়েছে ওরা কিছু করতে পারবে না। ওদের বুঝানো হয়েছে যে, সুলতান তোমাদেরকে গনিমতের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করেছেন। হাজার হাজার সুন্দরী যুবতী ধরা পড়েছে, ওদেরকে সৈন্যদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। এসব গুজব ছড়ানোর দায়িত্ব পালন করছে প্রশাসনের লোকেরা। আমি দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলতে পারি, গোটা সেনাবাহিনী সুদানীদের পক্ষ অবলম্বন করবে। এ বিদ্রোহ দমন করার জন্য আয়ুবীকে এখানকার ফৌজ নিয়ে যেতে হবে। ততোক্ষণে কায়রো হবে ফাতেমী খেলাফতের পদানত। আমরা আয়ুবীকে আক্রমণ করব না। কায়রোতে স্থান না পেয়ে বিশাল মরুতে ঘুরে ঘুরে একদিন …

 ‘কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে, খলিফার গদিও কিন্তু টিকে থাকেনি।’

 হরমুন বলল, ‘তার কারণ, ইসলামী সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করার পরিবর্তে ব্যক্তি স্বার্থের দিকে নিবদ্ধ হল সকলের দৃষ্টি। ফলে, একে একে ছুটে যেতে থাকল বিজিত এলাকাগুলো। তারই ফলশ্রুতিতে আমরা এখন আরবে অবস্থান করছি।

 প্রথম দিককার জেনারেলগণ ইসলামী রাজ্যের সীমানা যদ্দুর বিস্তৃত করেছিল, সালাহউদ্দীন আয়ুবী সে পর্যন্ত যেতে চাইছেন। তার সবচে বড় গুণ হচ্ছে, তিনি খেলাফত বা প্রশাসনের তোয়াক্কা করেন না। তার চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মিসরের খেলাফত। তিনি তাকে পদচ্যুত করেছেন। সাহস, দূরদর্শিতা এবং সামরিক শক্তি নিজের হাতে থাকার কারণেই তিনি এমনটি করতে পেরেছেন।’

 মজলিশে পিন পতন নিরবতা নেমে এল। হরমুনই নিরবতা ভাঙল আবার, ‘বেসমারিক নেতৃত্বের লক্ষ্য ক্ষমতার মসনদ। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তারা অর্থ, নারী এবং মদে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সুলতান তাদের এ দুর্বলতা বুঝতে পেরেছেন। আমরা কেবল উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তাদেরকেই হাত করছি। প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আমাদের দ্বিতীয় টার্গেট। সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে হলে তাদেরকে জনগণের কাছে হেয় করতে হবে। আমি এ কাজটিই করছি। এ ব্যাপারে আপনারা হয়ত আমার সাথে একমত হবেন না, তবুও আমি বলব, মুসলমানদের হাতেই নিঃশেষ হয়ে যাবে সে।

 মুসলমানদের মানসিকতা আপনারা এখনও বুঝেননি, এ জন্যেই আমার কিছু কিছু পদক্ষেপ ও পরামর্শকে আপনারা ভাল চোখে দেখেন না। প্রশিক্ষণের সময় যদি মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া যায় যে, তোমরা দেশ ও জাতির অতন্দ্র প্রহরী, সিংহাসন উপহার দিলেও ওরা সৈন্য হয়ে থাকতেই পছন্দ করবে। কিন্তু যদি ওদের ভেতর আত্মপূজা, নারী লিপ্সা এবং মদে অভ্যস্ত করে দেয়া যায় তবে আপন ধর্ম ছেড়ে দিতেও ওরা কণ্ঠিত হবে না। আমাদের পক্ষাবলম্বনকারী প্রশাসনের লোকেরা দ্বিতীয় দায়িত্বটিই পালন করছে।’

 ‘তবে প্রশাসনের লোকদের মত সেনা ফৌজকে অত সহজে গাদ্দার বানানো যায় না। প্রশাসনের প্রতিটি লোকই রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সৈন্যরা সবাই তেমনটি দেখে না।’ হরমুনের কথার মাঝখানে বললেন অগাস্টাস।

 ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, তবে এটাও ঠিক, তাদের নবীর পরে খেলাফতের জন্য মুসলমানরাই পরস্পর যুদ্ধ করেছিল।’

 ‘কিন্তু জেনারেলগণ ঈমানদারীর সাথে দায়িত্ব পালন করে, এমনকি অন্য দেশ দখল করে খেলাফতের অন্তর্ভূক্ত করেছে।’

 ‘হ্যাঁ, মজাটা এখানেই। জেনারেলরা ঈমানদারীর প্রমাণ দিলেও খলিফারা তার কোন মূল্য দেয়নি, এমনকি খলিফারা তাদের সাথে ভাল ব্যবহার পর্যন্ত করেনি। ফলে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের মধ্যে বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হয়েছে।’

সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে যুদ্ধের ময়দানে হারানো সম্ভব নয়। কারণ, তাঁর প্রতিটি সৈন্য তাঁর মতই জানবাজ। যুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা এতটাই অবগত যে, মৃত্যু তাদের কোন ভীতির সৃষ্টি করে না।

 আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, তিনি শুধু যুদ্ধ পরিচালনা করেন না, নিজেও লড়াই করেন। তাকে কোন খলিফা বা বেসামরিক নেতৃত্ব থেকে নির্দেশ নিতে হয় না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি একজন পাকা মুসলমান। তাঁর কথা হচ্ছে, আমি সরাসরি খোদা এবং কোরআনের হুকুম পালন করি। আমাদের বাগদাদের গোয়েন্দারা বলেছে, নুরুদ্দীন জংগী যেসব পরামর্শ পাঠিয়েছেন আয়ুবী তা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। প্রথমতঃ একজন বড় মুফতি ফতোয়া দিয়েছেন খেলাফতের কেন্দ্র থাকবে বাগদাদ। বিভিন্ন দেশের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে খলিফা সেনা প্রধানের সাথে পরামর্শ করবেন। দ্বিতীয়তঃ সামরিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে খলিফা কোন হস্তক্ষেপ করবেন না। তৃতীয়তঃ খোৎবায় খলিফার নাম উচ্চারণ করা হবে না। আয়ুবী আরো নির্দেশ দিয়েছে যে, খলিফা বা তার মনোনীত কোন ব্যক্তি বা কোন কেল্লাদার বাইরে বের হলে জনগণ ফুলের তোড়া নিয়ে আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে না। খলিফার সম্মানে কোন শ্লোগান দেয়া যাবে না।

 সালাহউদ্দীন আয়ুবীর বড় সাফল্য হল, তিনি শিয়া-সুন্নীর মতভেদ দূর করে দিয়েছেন। এখন শিয়াদের অনেকেই সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে আসীন। শিয়া আলেমদের তিনি বুঝিয়েছেন, ইসলামে নেই এমন কোন কাজ যেন তারা না করেন। এতে আমাদের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন দল উপদল থাকলে আমাদের সুবিধা। এখন আমরা প্রশাসনের মধ্যে সালাহউদ্দীন এবং সেনাবাহিনীর বিরোধী মনোভাব তৈরী করছি।’

 ‘এ মনোভাব স্থায়ী করতে হবে।’ মুখ খুললেন ফিলিপ অগাস্টাস। ‘শুধু সালাহউদ্দীনই আমাদের শত্রু নয়, আমাদের যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে। আমাদের চেষ্টা হবে আয়ুবীর মৃত্যু হলে এ জাতি যেন অন্য কোন আয়ুবীর জন্ম দিতে না পারে। ওদের আকিদা বিশ্বাসে কুসংস্কার ঢুকিয়ে দাও। প্রতিটি লোকের চিন্তায় থাকবে রাজা হওয়ার স্বপ্ন। ওদেরকে বিলাসিতার গহীনে ডুবিয়ে দাও। দেখবে একজন অন্য জনের মাথা কাটছে। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, একদিন এরা ক্রুশের গোলামে পরিণত হবে। ওদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ওদের ধর্ম খ্রিস্টবাদের রঙে রঙ্গীন হবে। ক্ষমতার লোভে একজন আরেকজনকে অন্যজনকে হত্যা করবে। সাহায্য চাইবে আমাদের কাছে। তখন হয়ত আমরা কেউ বেঁচে থাকব না। আমাদের আত্মা ওদের এ পরিণতি দেখে খুশী হবে। ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ইহুদীরা নিজের যুবতী মেয়েদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দিচ্ছে। এদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার কর। ইহুদীরা জেরুজালেম এবং ফিলিস্তিনকে নিজের মনে করে, এজন্য ওরা আমাদের দুশমন। কিন্তু সে কথা বলার সময় এটা নয়। ওদের বল, জেরুজালেম তোমাদের। শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিন তোমাদেরকেই দেব। তোমরা এখন আমাদের সহযোগিতা কর। তবে ইহুদীরা অত্যন্ত সতর্ক। আমাদের মানসিকতা বুঝতে পারলেই মুসলমানদের সাথে যোগ দেবে। সতর্কতার সাথে ফিলিস্তিনিদের লোভ দেখিয়ে ওদের সম্পদ এবং যুবতীদের ব্যবহার কর। বিজয় আমাদের হবেই।

J J J J

 সুবাক এবং ক্রাক দুর্গ থেকে অনেক দূরে এক বিস্তীর্ণ মরু। চারপাশে উঁচু নীচু এবং পাথুরে পাহাড়। কাকর আর বালুকাময় ভূমিতে মাঝে মাঝে খানাখন্দ। একদিকে খ্রিস্টান শাসকগণ মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য বিপজ্জনক পরিকল্পনা তৈরী করছিল, অন্যদিকে দেড় মাইল দীর্ঘ এবং দেড় মাইল প্রশস্ত এ পাহাড় ঘেরা স্থানে চলছিল আয়ুবীর যুদ্ধের মহড়া, নতুন রিক্রুট করা মুসলিম সৈন্যদের প্রশিক্ষণ।

 পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে সুলতান মহড়া দেখছিলেন। সাথে দু’জন সহকারী। প্রশিক্ষণরত সৈনিকগণ ঘোড়াসহ লাফিয়ে খানাখন্দ পার হচ্ছিল। প্রতিপক্ষের প্রচন্ড আক্রমণ ঠেকিয়ে করছিলো পাল্টা আক্রমণ।

 ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন সুলতান’, বললেন একজন সহকারী, ‘কিছুদিনের মধ্যেই এরা অভিজ্ঞ সৈনিকে পরিণত হবে। তীর-তরবারী, নেজা-বল্লম, সবকিছুতেই হয়ে উঠবে পারদর্শী।’

 নতুন রিক্রুটদের মধ্যে সুবাকের লোক যেমন ছিল, গোয়েন্দাদের সহযোগিতায় ক্রাক থেকেও যুবকরা এসে শামিল হয়েছিল এতে। ক্রাকে এদের ওপর চলছিল অবর্ণনীয় নির্যাতন।

 নতুনদের আগ্রহ উদ্দীপনায় সুলতান প্রীত হলেন। সহকারীদের বললেন, ‘সুবাক এবং ক্রাক থেকে আরও নতুন নতুন যুবকদের ভর্তি করে ওদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কর।’

 ‘অস্ত্রের ব্যবহার জানলেই অভিজ্ঞ সৈনিক হওয়া যায় না। একজন অভিজ্ঞ সৈনিকের গুণ হচ্ছে বুদ্ধি এবং দূরদর্শিতা। যারা এলোপাথাড়ি দুশমনকে আক্রমণ করে, এমন সৈনিক আমার প্রয়োজন নেই। আমার সৈন্যরা জানবে কে তার শত্রু, যুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে থাকবে পরিচ্ছন্ন ধারণা। বিশ্বাস থাকবে তারা আল্লাহর সৈনিক, আল্লাহর পথে লড়াই করছে। এদের মধ্যে দেখছি প্রচন্ড আবেগ রয়েছে। কিন্তু যদি উদ্দেশ্য এবং নিজের অবস্থান জানা না থাকে অল্প ক’দিনের মধ্যেই এ আবেগ নিঃশেষ হয়ে যাবে। ওদের বুঝিয়ে বল আমরা কেন ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করতে চাই। গাদ্দারীর পরিণাম ওদের বল। ওদের বল, কেবল মাত্র রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে নয় বরং দ্বীন এবং ঈমানের জন্য তোমরা যুদ্ধ করছ। সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ হলে ওদের জন্য আত্মিক ও মানসিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা কর।’

 ‘মহামান্য সুলতান’, একজন সহকারী বললেন, ‘প্রতি সন্ধ্যায় ওদের জন্য দ্বীনী আলোচনার ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা একদল পশু সৈনিক তৈরী করতে চাই না।’

 ‘আমাদের যে সব মেয়েদেরকে ওরা অপহরণ করছে, যেসব যুবতীদের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে তাদের কথা এদের খুলে বল। খ্রিস্টানরা পবিত্র কোরআন পদদলিত করছে, মসজিদ হয়েছে ওদেরই গোশালা। ওদের বল, নারীর সম্ভ্রম, পবিত্র কোরআন এবং মসজিদের সম্মান রক্ষা করা মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব। যেদিন তোমরা এ দায়িত্ব ভুলে যাবে সেদিন এ পৃথিবী তোমাদের জন্য হবে জাহান্নাম। পরকালের শাস্তি তো মৃত্যুর পরে।

 ট্রেনিং চলছিল পর্বতবেষ্টিত বিশাল এলাকা জুড়ে। এরপরও সুলতান পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন। যে কোন সময় খ্রিস্টান ফৌজ আক্রমণ করতে পারে। চার পাঁচজনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল পাহারায় নিয়োজিত ছিল। সুলতান যে পাহাড়ে দাঁড়িয়েছিলেন তার বিপরীত দিকের টিলার উঠে এল এদের একটা দল। তাদের দিকে সুলতানের পিঠ।

 দলের একজন বলল, ‘মাত্র আড়াইশ গজ দূরে সে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে মারার জন্য একটা তীরই যথেষ্ট। কি বল?’

 ‘হ্যাঁ’, বলল দ্বিতীয়জন, ‘কিন্তু এরপর পালিয়ে যাবো কোথায়?’

 ‘তাও ঠিক। ওরা আমাদের মেরে ফেললে তো কোন কথা ছিল না, কিন্তু তা করবে না। এমন শাস্তি দেবে, আমরা আমাদের সংগীদের নাম বলতে বাধ্য হব।’

 ‘এ কাজ তার দেহরক্ষীরাই করবে।’ তৃতীয়জন বলল, ‘সালাহউদ্দিনকে হত্যা করা এত সহজ হলে এতদিন তার বেঁচে থাকার কথা নয়।’

 ‘এ কাজ এখনই হওয়া উচিৎ। ফাতেমীরা বলছে আমরা শুধু ওদের কাছ থেকে অর্থ নিচ্ছি, কাজের কাজ কিছুই করছি না।’

 ‘ভেবো না, খুব শীঘ্রই ওর মৃত্যু হবে। শুনেছি ঘাতক দলের সদস্যরা খুব সাহসী। সুলতানের দেহরক্ষীদের মধ্যে ওদের তিনজন সদস্য রয়েছে। সম্ভবত ওরা ভয় পাচ্ছে, নয়তো একটা লোককে মারতে এতদিন লাগবে কেন?’

 কথা বলতে বলতে ওরা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। এরা ছিল খ্রিস্টানদের নিয়োজিত ভাড়াটে খুনী।

 ∞ ∞ ∞ ∞ ∞

 ক্রাকে খ্রিস্টান সম্রাটদের মিটিং শেষ হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, আর অপেক্ষা নয়- আয়ুবী আক্রমণ করার পূর্বেই তাকে আক্রমণ করতে হবে। শুরু হল সৈন্য সেটিং-এর পালা। ফ্রান্সের বাহিনী আয়ুবীকে পথেই বাধা দেবে। রিমান্ডের ফৌজ আক্রমণ করবে মুসলিম বাহিনীর পেছন থেকে। ক্রাকের দুর্গ রক্ষা করবে জার্মান বাহিনী। তাদের সাথে থাকবে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের কয়েক প্লাটুন সৈন্য।

 আয়ুবীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আক্রমণ করে পালিয়ে আসার পরিকল্পনার বিরোধিতা করল গোয়েন্দা বিভাগ। তাদের যুক্তি হল, সুলতান আয়ুবী তার বাহিনী তিন ভাগে ভাগ করেছেন। একভাগ যুদ্ধের জন্য তৈরী হয়ে আছে। তার সৈন্যরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে সমগ্র মরুভূমিতে ছড়িয়ে আছে। গাছের একটা পাতা নড়লেও আয়ুবীর কানে সে সংবাদ পৌঁছে যায়।

 সুলতানের এ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার কথা শুনে এই পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়া হল।

 খ্রিস্টানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল আয়ুবীর চেয়ে চারগুণ বেশী। এর বেশীরভাগ বর্মধারী এবং অশ্বারোহী। ওদের স্বাভাবিক আক্রমণ ঠেকানো মুসলিম বাহিনীর জন্য ছিল অসম্ভব। কিন্তু সুবাকের যুদ্ধ ওদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। আতংক ছড়াচ্ছিল পরাজিত সৈন্যরা। সুবাক ছিল ওদের কাছে লৌহ দুর্গ। সুলতানের বাহিনীকে পথে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য ওরা বিশাল এক বাহিনী পাঠিয়েছিল। দুর্গে বসে ছিল নেতৃবৃন্দ। সুলতান মুখোমুখি সংঘর্ষে না গিয়ে ওদেরকে মরুর বালুর সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। মুসলিম বাহিনীর নিক্ষিপ্ত গোলার আগুন দেখে আতংকিত হয়েছিল ঘোড়া এবং উঠগুলো। দীর্ঘদিন পর্যন্ত একটু আগুন দেখলেই ওগুলি ভড়কে যেত। সুলতানের প্রচন্ড আক্রমণে লৌহ দুর্গের প্রতিরোধ বুহ্য ভেংগে পড়ল। কাঁপন ধরল খ্রিস্টানদের বুকে।

 বিভিন্ন সম্রাটদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল সম্মিলিত বাহিনী। নিজেদের ভেতর ছিল চরম বিরোধ। সবাই চাইছিল নিজ নিজ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে। সম্প্রসারিত করতে চাইছিল স্বীয় রাজ্যের সীমানা। শুধু মুসলমানদেরকে নিঃশেষ করার জন্যই ওরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু হৃদয়ে লালিত বিরোধের কারণে সঠিক কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না ওরা।

 খ্রিস্টানরা ছিল ষড়যন্ত্রে পারদর্শী। কোন মুসলিম এলাকা দখল করলে ওখানে চালাত হত্যাযজ্ঞ। লুণ্ঠন করত মুসলিম নারীদের সম্ভ্রম। অপরদিকে মুসলমানরা কোন এলাকা দখল করলে দূরদর্শিতা, বুদ্ধিমত্তা এবং ভালবাসা দিয়ে শত্রুকে আপন করে নিতেন আয়ুবী। মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে ছিল আত্মত্যাগের সুষমা। দশজন সৈনিকের কমান্ডো বাহিনী এক হাজার খ্রিস্টান সৈন্যকে পর্যুদস্ত করে দিত। জীবন বিলিয়ে দেয়াকে এরা সাধারণ ব্যাপার মনে করত। সুলতানের নিপুন পরিচালনায় অল্প সংখ্যক সৈন্য বিশাল বাহিনীর বুহ্য ভেংগে দিত। ক্রাকেও তিনি এ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। খ্রিস্টান বাহিনীর মনোবল ভেংগে পড়েছিল। সৈন্যদের শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা দেখে যুদ্ধের পরিকল্পনা আপাততঃ স্থগিত করা হল। মিসরে অভুত্থান ঘটাতে হবে। মিসর আক্রমণ করার জন্য সুদানীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সিদ্ধান্ত হল, যুদ্বাস্ত্রসহ এর সমস্ত ব্যয় খ্রিস্টান শাসকগণ বহন করবেন। মিসরের উপ-রাষ্ট্রপ্রধান খ্রিস্টান শিবিরে নিয়মিত সংবাদ পাঠাচ্ছিলেন। আশাব্যঞ্জক সে সব সংবাদ।

 মিসরের অর্থ সচিব নিহত হয়েছেন এবং মুসলিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এ খবর তখনও পৌঁছেনি খ্রিস্টানদের কাছে। ক্রাকে এ সংবাদ দেয়া জরুরী। সংবাদ পৌঁছাতে পনর দিনের প্রয়োজন। চারদিকে সুলতানের ফৌজ ছড়িয়ে আছে বলে অনেকটা পথ ঘুরে ক্রাক যেতে হয় বলে খ্রিস্টান গুপ্তচররা চিন্তিত।

 যেদিন সাবেরা অপহৃত হয় সেদিন ক্রাক পৌঁছল খবরবহনকারী। দূত বলল, ‘বিদ্রোহের জন্য সব তৈরী, কিন্তু সুদানীরা এখনও আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়নি। তাদের ঘোড়ার অভাব রয়েছে, তবে উট আছে অনেক। এ মুহূর্তে শ’পাঁচেক ঘোড়া পাঠানো দরকার।’

 ‘এখনি পাঁচশ ঘোড়া নিয়ে সাতজন খ্রিস্টান অফিসার রওয়ানা হয়ে যাও।’ নির্দেশ দিলেন ফ্রান্সের সেনা কমান্ডার। ‘সময় সুযোগ বুঝে তোমরা সুদানীদের দিয়ে মিসর আক্রমণ করাবে।’

 খ্রিস্টানদের রয়েছে অসংখ্য ঘোড়া। এরপরও তিন দিনের মধ্যেই সাধারণ খ্রিস্টানগণ পাঁচশত ঘোড়া কমান্ডারের কাছে হাজির করল। রওয়ানা হল ঘোড়ার বহর। পথ দেখাচ্ছিল এক গোয়েন্দা। সুদানী এ গোয়েন্দাটি তিন বছর থেকে এ কাজে রয়েছে। সাথে ছিল আটজন খ্রিস্টান সেনা অফিসার। তাদের বলা হয়েছিল আয়ুবীকে এখান থেকে আর মিসরে যেতে দেয়া হবে না।

 সুলতান শুনেছেন মিসরের পরিস্থিতি ভাল নয়। মিসর যে এখন জীবন্ত অগ্নিগিরী তা তিনি জানতেন না। আলী তাকে বলেছিলেন, ‘মিসরে আমাদের গোয়েন্দাদের যে নেটওয়ার্ক রয়েছে তাতে যে কোন সংবাদ আমরা পেয়ে যাব। অর্থসচিব এবং উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের পরিণতির কথাও তাদের জানা ছিল না। সুলতানের কাছে সংবাদ পাঠানোর জন্য কেউ কেউ পুলিশ প্রধানকে পরামর্শ দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আগে সাক্ষী প্রমাণ যোগাড় করে নেই। সুলতানকে জানাব তারপর।’

 J J J J J

 রাতে সাবেরাকে ভিন্ন একটা তাবুতে রাখা হল। তখনো সূর্য উঠেনি। তিনজন অপহরণকারী এবং সাবেরাকে কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হল। সাথে আটজন সশস্ত্র সৈন্য। দলটি যখন কায়রো পৌঁছলো সূর্য ডুবে গেছে। ওরা সরাসরি পুলিশ প্রধানের অফিসে গেল। গিয়াস বিলকিস মামলার তদন্ত নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সন্ধ্যার পর শাস্তি সেলে ঢুকেছেন। মুসলেহ উদ্দীনের বাড়ীতে তল্লাশী নেয়া হয়েছিলো। ফিরিংগী মেয়েটাকে পাওয়া গেছে। ও নিজের পরিচয় দিল উজবেক মুসলমান হিসেবে। পুলিশ প্রধানকেও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করল উল্টাপাল্টা কথা বলে। চেষ্টা করল যৌবনের মায়াজালে আটকে দিতে।

 গিয়াস বিলকিস যুবতীকে শাস্তি সেলের কয়েকটা কক্ষ দেখালেন। বিবর্ণ হয়ে গেল মেয়েটার মুখ। পুলিশ প্রধানের উদ্দেশ্য সফল হল, সব স্বীকার করল ও। বলল, ‘ আমার নাম মাথা। জাতিতে খ্রিস্টান। এসেছি জেরুজালেম থেকে।’

 মেয়েটা পুলিশ প্রধানকে অর্থ এবং যৌবনের লোভ দেখাল। বলল, ‘মানুষ তো সুখের জন্যই এত কষ্ট করে। আপনি আমাকে মুক্তি দিলে সুখ ও সম্পদে আপনাকে ভরে দেব।’

 মুসলেহ উদ্দীনের বাড়ী থেকে যেসব সম্পদ আটক করা হয়েছে এতেই তিনি হতবাক হয়ে গেছেন। তিনি অনুমান করতে পেরেছেন উপ-রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও মুসলেহ উদ্দীন কেন খ্রিস্টানদের ফাঁদে পা দিয়েছেন। অর্থ ছাড়াও যুবতীর মাতাল করা রূপ আর ভাষার যাদু থেকে বেঁচে থাকার জন্য পাথর হৃদয় মানুষের প্রয়োজন।

 পুলিশ প্রধান ভাবনার অতলে ডুবে গেলেন। উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে রূপের জ্বলন্ত আগুন আর সম্পদের পাহাড় নিয়ে মেয়েটা জেরুজালেম থেকে। এসেছে একজন মুসলিমের কাছে খ্রিস্টানের উপঢৌকন হিসাবে। ফলে তিনি বুঝলেন, ষড়যন্ত্রের মূল অনেক গভীরে।

 মেয়েটার দিকে তাকালেন পুলিশ প্রধান। ‘বল মেয়ে, এ দেশে কি জন্য এসেছ? কে তোমায় পাঠিয়েছে?’

 যুবতীর ঠোঁটে মৃদু হাসির ঝিলিক। বলল, ‘যা বলছি তার বেশী আর কিছু বলার নেই। আর কিছু বললে ক্রুশের সাথে প্রতারণা করা হবে। ক্রুশ হাতে নিয়ে শপথ করেছি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রয়োজনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করব, তবুও গোপন তথ্য প্রকাশ করব না। এখন আমাকে যা ইচ্ছে করতে পারেন। একটা কথাও আর বলব না। আর যদি জেরুজালেম বা ক্রাক পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন, এ দেহ ছাড়াও পাবেন অঢেল সম্পদ। মুসলেহ উদ্দীন তো আপনার হাতে বন্দী, ওকে জিজ্ঞেস করুন, সে আপনার স্বজাতি, কিছু বললেও পারে।’

 গিয়াস মারথাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, মুসলেহ উদ্দীনের কক্ষে চলে এলেন। তার শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। হাতের কব্জিতে রশি বেঁধে ছাদের আংটার সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ‘মুসলেহ, বন্ধু! যা জিজ্ঞেস করি জবাব দাও। তোমার স্ত্রী কোথায়? কারা তাকে অপহরণ করেছে? তোমার বান্ধবী মারথা সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে। এবার তোমাকেও বলতে হবে। আমি দেখতে চাই দু’জনের এক কথা বলছ কিনা। তুমি কতটুকু মিথ্যে বলতে পার সেটাও বুঝা যাবে তোমার কথা থেকে।’

 ‘আমার হাত খুলে দে বদমাশ।’ ক্রোধে দাঁত পিষে বলল মুসলেহ উদ্দীন। ‘সুলতান আসুক, তোকেও এভাবে ঝুলাবো।’

 প্রহরী এসে পুলিশ প্রধানের কানে কানে কি যেন বলল। বিস্ফারিত চোখে সেন্ট্রির দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। ছুটে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। মুসলেহ উদ্দীনের স্ত্রী এবং তিনজন অপহরণকারী বসে আছে। অপহরণ থেকে শুরু করে এদের গ্রেপ্তার হওয়ার সমস্ত ঘটনা খুলে বলল সাবেরা। পুলিশ প্রধান চারজনকে নিয়ে চললেন আন্ডার গ্রাউন্ড শাস্তি সেলে। মুসলেহ উদ্দীনের কক্ষের তালা খুলে চারজনকে তার সামনে দাঁড় করানো হল। এদের দেখেই চোখ বন্ধ করে ফেলল সে।

 ‘এই তিন জনের মধ্যে হত্যাকারী কে?’ প্রশ্ন করলেন পুলিশ প্রধান।

 মুসলাহ উদ্দীন নিরব। আবার প্রশ্ন করলেন। কিন্তু কথা বলল না উপ-রাষ্ট্রপ্রধান। গিয়াস বিলকিস একজন লোককে চোখের ইশারায় ডাকলেন। লোকটি ভেতরে এসে মুসলেহ উদ্দীনের কোমর জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ল। ছিড়ে যাচ্ছে মুসলেহ উদ্দীনের হাতের কব্জি। চিৎকার দিয়ে বলল, ‘মাঝেরটা।’

 তিনজনকে সরিয়ে নেয়া হল। গিয়াস বিলকিস ওদের বললেন, ‘সমস্ত ঘটনা খুলে বল। তা নয়তো এখান থেকে জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না।’

 নিজেদের মধ্যে কি কথা হল ওদের। এরপর বলল, ‘আমরা রাজি।’

 ওদেরকে আলাদা আলাদা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল। সাবেরাকে নেয়া হল ওপরে।

 পূর্বের বলা কথাই আবার বলল সাবেরা। বলল, ‘আমার মা সুদানী, পিতা মিসরী। থাকতাম সুদানে। বছর তিনেক আগে আব্বার সাথে মিসরে এলাম। এক অনুষ্ঠানে মুসলেহ উদ্দীন আমায় দেখলেন। আব্বার কাছে লোক পাঠালেন। আব্বার সাথে তার কত টাকার চুক্তি হয়েছিল জানি না। আমাকে মুসলেহ উদ্দীনের বাড়ী রেখে আব্বা চলে গেলেন। যাওয়ার সময় হাতে ছিল এক থলি আশরাফি।

 পরদিন মুসলেহ উদ্দীন একজন আলেম এবং ক’জন লোক ডেকে আমাকে বিয়ে করল। এখন আমি তার স্ত্রী। ও আমায় ভীষণ ভালবাসত। আব্বার স্নেহ আমি পাইনি বলে আমি ছিলাম ভালবাসার কাঙ্গাল। মনে হল বিক্রি করার জন্যই আব্বা আমায় মিসরে নিয়ে এসেছিলেন। মুসলেহ উদ্দীন এতটা নীচ কখনও ভাবিনি। ও কখনও মদ পান করেনি। বাইরে কি করত আমি জানতাম না, জানার চেষ্টাও করিনি।

 সালাহউদ্দীন আয়ুবী সুবাক চলে যাবার পর মুসলেহ উদ্দীন কেমন যেন হয়ে গেল। অনেক রাত করে বাসায় ফিরত। আমার আব্বা মদ্যপ ছিলেন। আমি মদের গন্ধের সাথে পরিচিত। দেখতাম মুসলেহ উদ্দীনের মুখ থেকে মদের গন্ধ আসছে। ভালবাসার খাতিরে আমি চোখ বুজে এ সব সহ্য করতাম। তাকে কিছুই বলতাম না।

 ক’দিন পর বাসায় অপরিচিত লোকের আনাগোনা শুরু হল। এক রাতে আমাকে দুই থলি আশরাফি এবং দুটি স্বর্ণের টুকরা দেখাল। অন্য এক রাতে মদে মাতাল হয়ে বাড়ী ফিরল। আমার কাছে এসে বলল, ‘তুমি কি মিসরের উত্তরে রোম উপসাগরের এলাকা, নাকি সুদান সীমান্তের এলাকা পছন্দ করবে? তুমি যে এলাকা চাইবে, সেখানকার রাণী হবে তুমি, আমি হব সম্রাট।’

 আমি অতশত বুঝি না, চুপ করে রইলাম। ভাবলাম অত্যধিক মদ পান করে আমার স্বামীর মাথা বিগড়ে গেছে।

 একরাতে তিনি একজন সুন্দরী ফিরিংগী যুবতীকে বাড়ী নিয়ে এলেন। সাথে আরো অপরিচিত দু’জন লোক ছিল। মেয়েটাকে থাকতে দেয়া হল তার শোবার ঘরে। আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়নি ওদের। মেয়েটা আমার সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওকে আমি ঘৃণা করতাম। এ মেয়েটা আমার স্বামীকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে আমার কাছ থেকে। এ হল খিজরুল হায়াতের হত্যার আগের ঘটনা। ৪৭/৪৯

@ @ @ @ @

 অপহরণকারীরা পুলিশ প্রধানকে প্রথমে ভুল তথ্য দিচ্ছিল, কিন্তু সত্য বলতে ওদের বাধ্য করা হল। ওদের বর্ণনা অনুযায়ী ওরা তিনজনই ঘাতক দলের সদস্য। খ্রিস্টানরা মুসলেহ উদ্দীনের সাথে এদের পরিচয় করে দিয়েছিল। তাদেরকে দিয়েছিল প্রচুর অর্থ এবং সুন্দরী তরুণী। ওরা কথা দিয়েছে, আয়ুবী কে পরাজিত করতে পারলে মিসর সীমান্তে তাকে একটা এলাকার স্বাধীন সম্রাট করে দেয়া হবে।

 মুসলেহ উদ্দীন প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের লোকদের হাত করতে লাগলেন। খিজরুল হায়াত তার ফাঁদে পা দেননি। অর্থ বিভাগ কব্জা করতে হলে হয় তাকে বশ করতে হবে, নয়তো সরিয়ে দিতে হবে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা ছিল সুলতানের প্রতি অনুগত। তাদের ট্রান্সফার করে নিজের লোক বসাতে হলেও খিজরুল হায়াতকে সরিয়ে দেয়া প্রয়োজন। মুসলেহ উদ্দীন তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন। দায়িত্ব দিলেন ঘাতক দলের সদস্যদের। খ্রিস্টানদের কাছ থেকে ওরা নিয়মিত বখরা পেত। কাজ শেষ হওয়ার পর দেননি বলে ওরা ক্ষ্যাপে গেল। গোপন তথ্য জানিয়ে দিল তার স্ত্রীকে।

 মুসলেহ উদ্দীন এখনও ঝুলে আছে। জবানবন্দী নেয়ার জন্য হাত খুলে দেয়া হল তার। ততোক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে মুসলেহ উদ্দীন। জ্ঞান ফিরল অনেক পরে। কিন্তু প্রমাদ বকতে লাগল। চোখ বড় বড় করে তাকাতে লাগল সবার দিকে। মেয়েটার কক্ষে গিয়ে দেখা গেল মুখ থুবরে পড়ে আছে। ডাক্তার এসে নাড়ী পরীক্ষা করে বললেন, ‘বিষ খেয়ে মারা গেছে, তবে বেশীক্ষণ হয়নি। লাশের পাশে একটা প্যাকেটে বিষের চিহ্ন পাওয়া গেল।

 রাতে বিলকিসের কাছে এলেন জয়নুদ্দীন আলী বিন নাজা আল ওয়ারেজ। তিনি মিসরের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্ব বিষয়ে তার হিল অগাধ পান্ডিত্য। পীর না হলেও প্রশাসনের পদস্ত কর্মকর্তারা তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। পুলিশ প্রধানকে বললেন, ‘শুনেছি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের দু’একজন ধরা পড়েছে। আপনাকে আরও কিছু তথ্য দিতে চাই। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ক’জন লোক আমায় বলেছে সুলতানের অনুপস্থিতিতে শত্রুরা ফায়দা লুটছে। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কাজ করছে যেন ধরা না পড়ে। গোয়েন্দা উপ-প্রধান হামাসকে কিছু না বলেই আমি গোপনে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছিলাম। আমার জলসায় ফৌজ অফিসার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছাড়াও বিভিন্ন পেশার লোকজন এসে থাকেন। আমার নিজস্ব এবং বিশ্বস্ত লোকদেরকেও তথ্য সংগহের কাজে লাগিয়াছি। যদ্দুর বুঝতে পেরেছি, মিসরের বিরুদ্ধে বিরাট এক ষড়যন্ত্র চলছে। আপনি ক’জনকে গ্রেপ্তার করার পর গা ঢাকা দিয়েছে বাকীরা।’

 জয়নুদ্দীন পুলিশ প্রধানের কাছে সমস্ত গোপন তথ্য প্রমাণাদি পেশ করলেন। গিয়াস বিলকিস ডেকে পাঠালেন হামাস বিন আবদুল্লাকে। এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল এখনি সুলতানকে সংবাদ দেয়া উচিৎ। দূত হিসেবে জয়নুদ্দীনকে নির্বাচন করা হল। পরের দিন বারজন রক্ষী সেনা নিয়ে সুবাকের পথ ধরলেন জয়নুদ্দীন।

 { { { { { { { { { { { { { { { { {

 তৃতীয় সন্ধ্যায় জয়নুদ্দীন সুবাক পৌঁছেলেন। সুলতান হতবাক হয়ে গেলেন তাঁকে দেখে। খুশীও হলেন। জড়িয়ে ধরলেন পরস্পরকে। জয়নুদ্দীন বললেন, ‘আমি কোন ভাল সংবাদ আনিনি। অর্থ সচিব নিহত। হত্যাকারী ভারপ্রাপ্ত উপ-রাষ্ট্রপ্রধান মুসলেহ উদ্দীন এখন জেলে। মাথা খারাপ হয়ে গেছে তার।’

 বিবর্ণ হয়ে গেল সুলতানের চেহারা। জয়নুদ্দীন তাঁকে সব ঘটনা খুলে বললেন। বললেন, ‘মিসরের সেনাবাহিনীতে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সুবাকের মুসলিম ফৌজকে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং প্রচুর গনিমতের মাল দেয়া হচ্ছে। আপনি খ্রিস্টান ও ইহুদী যুবতীদেরকে ফৌজের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। ওদেরকে আতংকিত করার জন্য বলা হচ্ছে, বিশাল এক সুদানী বাহিনী খুব শীঘ্রই মিসর আক্রমণ করবে। মিসরের স্বল্প সংখ্যক সৈন্য ওদের বাধা দিতে পারবে না। নিহত হবে প্রতিটি সৈন্য। সুলতান আয়ুবীও তাই চাইছেন। আরো বলা হয়েছে, সুলতান গুরুতর আহত হয়ে পড়ে আছেন। বাঁচার কোন আশা নেই। সুবাকের সেনা অফিসাররা ইচ্ছে মত উপভোগ করছে। আপনি গুরুতর আহত একথা এখন সবাই বিশ্বাস করছে। এ জন্যই মুসলেহ উদ্দীন দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে খ্রিস্টানদের সহযোগিতা করে যাচ্ছিল।’

 সাথে সাথে নুরুদ্দীন জংগীকে সব জানিয়ে চিঠি লিখলেন সুলতান। তার কাছে সামরিক সাহায্য চাইলেন। লিখলেন, ‘এখানে থাকলে মিসর হাতছাড়া হয়ে যায়। চলে গেলে পরাজয়ে বদলে যায় সুবাকের বিজয়। কোন কিছুর বিনিময়ে এ এলাকা ফিরিয়ে দিতে চাই না। সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না এখানে থাকব না মিসর ফিরে যাব।’

 একজন দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ারকে ডেকে বললেন, ‘রাতদিন ঘোড়া ছুটাবে। থামাবে না কোথাও। ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে পড়লে সামনে যাকে পাবে তার অশ্ব বদলে নেবে। দিতে না চাইলে হত্যা করবে। শত্রুর হাতে পড়লে পালানোর চেষ্টা করবে, না পারলে চিঠি মুখে পুরে গিলে ফেলবে। কোন অবস্থাতেই যেন চিঠি দুশমনের হাতে না পারে।’

 দূত রওয়ানা হয়ে গেল। দ্বিতীয় চিঠি লিখলেন ভাই তকিউদ্দীনের কাছে। ‘তোমার কাছে যা আছে এবং যে ক’জন যুদ্ধ করতে পারে তাদের নিয়ে চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে ঘোড়া ছুটাও। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কোথাও থেমো না। তোমার সাথে কোথায় দেখা হবে অথবা আদৌ দেখা হবে কিনা জানিনা। যদি তোমার আমার সাক্ষাৎ না হয়, যদি আমি মারা যাই তুমি অনতিবিলম্বে মিসরের দায়িত্বভার গ্রহণ করো। মিসর বাগদাদ খেলাফতের অধীন। যাত্রার পূর্বে আব্বাজানকে কদমবুসি করে বলবে, তোমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে। এরপর আম্মাজানের কবরে গিয়ে ফাতেহা পড়ো। আল্লাহ্‌ তোমার সঙ্গী। আমি যেখানে থাকব সেখানে ইসলামের পতাকা নত হতে দেবো না। তুমিও মিসরে ইসলামের পতাকাকে উড্ডীন রেখো।’ আরেক জন দূত ডেকে তাকেও পূর্বের মত নির্দেশ দিলেন। রওয়ানা হয়ে গেল ২য় দূতও।

 নুরুদ্দীন জাংগীর পায়ের কাছে গিয়ে আছড়ে পড়ল দূত। তার বা হাত তরবারীর আঘাতে ছিন্নভিন্ন। পিঠে বিঁধে আছে একটা তীর। ‘পথে দুশমনের হাতে পরেছিলাম। কিন্তু চিঠি নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছি।’ যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বলল দূত। আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু কিছুই আর বলতে পারল না, তার কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল চির দিনের জন্য।

 চিঠি তুলে নিলেন জাংগী। চিঠি পড়ে অনতিবিলম্বে সুবাকের কাছে পৌঁছল নুরুদ্দীন জাংগীর বিশাল বাহিনী। সুবাকবাসীরা দেখল এক ধুলিঝড় এগিয়ে আসছে। সকলের মনে শংকিত প্রশ্ন, ‘কারা এরা?’

 খ্রিস্টানদের আক্রমণ ভেবে তৈরি হয়ে গেল মুসলিম ফৌজ। হঠাৎ ধূলিঝড়ের আড়াল থেকে উঁকি দিল কালিমা খচিত পতাকা। ভেসে এল সৈনিকদের তাকবীর ধ্বনি। তাই শুনে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে তাদেরকে স্বাগত জানাল সুবাকের সৈন্যরা। মুসলিম ফৌজকে অভ্যর্থনা জানাতে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এলেন সেনা কর্মকর্তাবৃন্দ।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top