৩০. মহাসময়

জিয়ান বললো, ‘যদি আক্রা দখল করতেই কয়েক বছর লেগে যায় তবে কি আপনি আপনার জীবদ্দশায় জেরুজালেমের মুক্তি দেখে যেতে পারবেন?’

আমাদের গোয়েন্দারা বলেছে, আক্রা শহরে মাত্র দশ হাজার সৈন্য আছে ওদের। এ কথা মুসলমান যুদ্ধবন্দীরাও স্বীকার করেছে। কিন্তু আমাদের সৈন্য সংখ্যা এখনও পাঁচ লাখের বেশী আছে।

অবরোধ ১১৮৯ সালের আগষ্ট মাসের ১৩ তারিখে শুরু হয়েছে, এখন ১১৯১ সালের আগষ্ট মাস। এর মধ্যে পার হয়ে গেছে দুইটি বছর। ভাইয়া! এই দুই বছরেও যখন তোমরা ছয় লাখ সৈন্য নিয়ে মাত্র দশ হাজার অবরুদ্ধ সৈন্যকে পরাজিত করতে পারোনি তখন তোমরা তাদের আদৌ পরাজিত করতে পারবে কি না এ প্রশ্ন কি এসে যায় না?

তোমরা দুই বছরে আক্রার দুর্গ প্রাচীরের সামান্য ক্ষতিসাধন ও মেঞ্জানিক দিয়ে শহরের কিছু অংশে আগুন লাগানো ছাড়া আর কোন সফলতা লাভ করতে পারোনি। আমার তো মনে হচ্ছে, তোমরা এ শহরের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারবে না।

স¤্রাট রিচার্ড রাণীকে বললেন, ‘তুমি একটু তাবুতে যাও।’ বিরাঙ্গারিয়া সেখান থেকে চলে গেলেন।

রাণী চলে যাওয়ার পর রিচার্ড তার বোন জিয়ানকে বললেন, ‘মহান ক্রুশ ও পবিত্র জেরুজালেমের শপথ, এর সম্মানের জন্য আমি আমার জীবন বিলিয়ে দিতেও প্রস্তুত। আমি মনে করি প্রতিটি খৃষ্টানেরই এমন মনোভাব থাকা দরকার। জিয়ান, আজ থেকে তুমি ভুলে যাও তুমি আমার বোন। তুমি মনে করো, তুমি এই ক্রুশের এক কন্যা। তুমি জানো, আমাদের পবিত্র ক্রুশটি এখন মুসলমানদের হাতে।

আর তুমি এটাও জানো, পবিত্র জেরুজালেম, যেটা আমাদের পয়গম্বরের তীর্থ স্থান, সেটাও এখন মুসলমানদের অধিকারে। তুমি জানো, আক্রা দখল করা আমাদের মূল টার্গেট নয়। আমাদের মূল টার্গেট এখন ইসলাম তথা মুসলিম জাতিকে দুনিয়া থেকে নির্মূল করা।

জিয়ান! তুমি নিজেই দেখতে পাচ্ছো, মুসলমানরা কি মরণপণ যুদ্ধ করছে। এরা মৃত্যুকে ভয় পায় না। এই যে অল্প ক’জন মুসলমান, এরাও জয়লাভের আশা নিয়েই যুদ্ধ করছে।

আমি এখানে এই প্রথমবার এসেছি এবং তাদের যুদ্ধ করা দেখতে পাচ্ছি। তাদের আবেগ ও প্রেরণার এই উন্মাদনার কথা গল্পে শুনেছি, এখন তা স্বচক্ষে দেখতে পেলাম।

তবে আমি শুনেছি, মুসলমানদের শুধু মেয়েরাই কব্জা করতে পারে। মুসলমানদের মধ্যে যে গৃহযুদ্ধ হয়েছিল, তার পিছনে আমাদের মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার লোভ, সম্পদের মোহ, মদ ও নারীর নেশা মুসলমানদের মধ্যে আমাদের মেয়েরাই চালু করেছে।

‘কিন্তু তারা সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীকে কব্জা করতে পারলো না কেন? প্রশ্ন করলো জিয়ান।

‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী এক ঈমানদার সাচ্চা মুসলমান। যতোক্ষণ মুসলমানরা তাদের ঈমানকে মজবুত রাখতে পারে ততোক্ষণ তাদের কিছুতেই কাবু করা যায় না। সে ঈমানদার বলেই তাকে আমরা তার লক্ষ্য বিচ্যুত করতে পারিনি।

তিনি তার মুসলমান ভাই, যাদের আমরা নানাভাবে লোভ দেখিয়ে হাত করেছিলাম, তলোয়ারের জোরে তিনি তাদেরকে নিজের অধীন করে নিয়েছেন। তিনি তাদের প্রাণে আবার ইসলামী প্রেরণা ও জোশ জাগিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন।’

জিয়ান বললো, ‘আমিও সেই সব মেয়েদের ত্যাগের কথা শুনেছি। তারা মুসলমান শাসনকর্তা ও পদস্থ রাজকর্মচারীদের বশ করে ইসলামের বহু ক্ষতি সাধন করতে সমর্থ হয়েছে। তারা সেখানে গোয়েন্দাগিরী ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকেও পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। যদি তারা সফল হতো তবে আমাদের আজ নতুন করে লড়াইতে নামতে হতো না।’

‘আমি একে ব্যর্থও বলতে পারি না।’ স¤্রাট রিচার্ড বললেন, ‘যদি মুসলমানদের জাতীয় চেতনাকে ধ্বংস করার কাজে আমরা মেয়েদের ব্যবহার না করতাম তবে মুসলমানরা বহু আগেই শুধু ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম নয় বরং অর্ধ ইউরোপ অধিকার করে ফেলতো।

আমরা নারীর রূপের মোহ ও আকর্ষণে অধিকাংশ মুসলিম আমীর, উজির ও সেনাপতিদের ফেলতে পেরেছিলাম বলেই তারা স¤্রাট হওয়ার লোভে নিজেদের জাতীয ঐক্য ধ্বংস করে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল।

জিয়ান, একবার ভেবে দেখো, তারা নিজেদের সামরিক শক্তি নিজেদের ওপর ব্যবহার না করে যদি আমাদের ওপর করতো তাহলে কি অবস্থা হতো আমাদের?

তাদের নিঃশেষ হওয়া শক্তির সাথেই আমরা পেরে উঠছি না, যদি সমগ্র জাতিকে এক করে তারা আমাদের বিরুদ্ধে একবার দাঁড়াতে পারতো তবে যিশুর সন্তানরা মাথা গোঁজার মত একটু ঠাঁইও পেতো না দুনিয়ার কোথাও। তাই আমাদের মেয়েদের সাধনা ব্যর্থ হয়েছে এমন কতা তুমি বলতে পারো না।’

‘আপনি এসব কথা আমাকে কেন শোনাচ্ছেন?’ জিয়ান বললো, ‘আপনারন কথায় নিরাশার ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে, আমি কি আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারি?’

‘আমি তো তোমাকে শুরুতেই বলেছি, তুমি যে আমার বোন সে কথা ভুলে যাও। তুমি এখন ক্রুশের কন্যা। এই ক্রুসেড যুদ্ধে তোমাকেও গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে হবে এবং আমার বিশ্বাস তুমি তা পারবে।

তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো, আমরা মুসলামনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও তাদের সাথে আপসের আলোচনাও চলছে। আমরা একে অপরের সাথে দুত বিনিময় করে চলেছ্ িআমার সাথে দেখা করার জন্য সুলতান আইয়ুবীর ভাই তকিউদ্দিন এসেছিলেন। আমি তাঁকে আমাদের শর্তগুলো মেনে নিতে বলেছি।

কিন্তু  তিনি তা মানতে প্রস্তুত নন। আমি তাকে বললাম, ‘তোমরা জেরুজালেম ও মহান ক্রুশটি আমাদের দিয়ে দাও, আর যে সব এলাকা খৃষ্টান শাসন ছিল সে এলাকা ছেড়ে চলে যাও, আমরা ফিরে যাবো। আমরা কোন মুসলমান দেশ দখল করতে এখানে আসিনি। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী এর একটি শর্তও মানতে রাজী হচ্ছেন না।’

‘আপনি নিজেই সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাঙ্গে দেখা করছেন না কেন?’

‘তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান না।’ স¤্রাট রিচার্ড বললেন,‘তিনি এখন অসুস্থ! মনে হয় তার ভাই তকিউদ্দিনই সালাহউদ্দিনের নামে সব কাজকর্ম চালিয়ে নিচ্ছে। আমি তার মধ্যে একটি দুর্বলতা দেখেছি। সে সুন্দর ও সুপুরুষ। তাকে আমার মনে হয়েছে প্রফুল্ল মনের এক সজীব মানুষ। আমি এই লোকটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চাই। কিন্তু এ কাজ তো তোমার, আমি কেমন করে সেটার সমাধা করবো?’

‘আপনি কি সেই ছলনার কাজ আামাকে দিয়ে করাতে চাচ্ছেন যে কাজ আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার ট্রেনিংপ্রাপ্ত মেয়েরা করতো?’

‘হ্যাঁ!’ রিচার্ড বললেন, ‘তাকে তুমি জয় করো, ভালবাসার অভিনয়ে বন্দী করো তাকে। বলো, তাকে তুমি বিয়ে করতে চাও। আমি তোমাদের সব রকম সাহায্য ও মধ্যস্থতা করবো। আমি তখন সালাউদ্দিনকে বলবো, ‘আপনি সাগর উপকূলের রাজ্যগুলো আপনার ভাই ও আমার বোনকে ছেড়ে দিন। আমি উভয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করে দেবো।’

তুমি তকিউদ্দিনকে বুঝাও, সে যেন ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। যদি তাতে রাজি না হয় তাতেও আপত্তি নেই। তাকে বলো, সে তোমাকে গ্রহণ করলে চিরদিনের মত খৃষ্টান ও মুসলামনদের দ্বন্ধের অবসান হয়ে যাবে। সে উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলোর বাদশাহ হলে কোন খুষ্টান স¤্রাট আর তা দখল করতে আসবে না। আমি আশা করি তুমি তাকে সুলহতান সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারবে।’

জিয়ান কিছুক্ষণ নিরব থাকলো। স¤্রাট রিচার্ড গভীর প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। স¤্রাট রিচার্ড গভীর প্রত্যাশা নিয়ে তাকিযে রইলেন তার দিকে। জিয়ান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মুখ না তুলেই বললো,‘আচ্ছা, আমি চেষ্টা করে দেখবো।’

‘মুসলমানদের এমনি ছলনা দিয়েই মারতে হয়।’ রিচার্ড বললেন, ‘আমি যুদ্ধক্ষেত্রে এদের পরাজিত করতে প্রাণপণ চেষ্টা করবো। কিন্তু সে চেষ্টা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। হয়তো সে সময় পর্যন্ত আমি বেচেঁই থাকবো না। আমাকে শিঘ্রই ইংল্যান্ড ফিরে যেতে হবে। সেখানকার অবস্থাও বেশী ভাল নয়। বিরোধী চক্র আমার অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করছে।’

যে কবুতারটি রিচার্ডের মাথার উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল সেটি সুলতান সালাহউদ্দিনের তাবুর ওপর গিয়ে বসলো। এক রক্ষী দৌড়ে গিয়ে কবুতরের পায়ে বাধাঁ চিঠি খুলে সুলতানের তাবুর মধ্যে নিযে গেল।

সুলতান আইয়ুবী তখন অসুস্থতার কারণে খুবই দুর্বল অনুভব করছিলেন। চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন তিনি। চিঠি এসেছে শুনেই তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠে বসলেন। চিঠিটি রক্ষীর হাত থেকে নিযে পড়তে শুরু করলেন তিনি।

আক্রা শহরের সৈন্যদের সাথে সুলতানের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এই পত্রবাহক কবুতর। চিঠি পাঠিয়েছেন আক্রা শহরের দু’জন সেনাপতি আল মাশতুত ও বাহাউদ্দিন কারাকুশ। এই দু’জনই অসাধারণ সাহসী ও বিচক্ষণ সেনাপতি ছিলেন।

তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন অবরোধে থেকে তাদের অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে উঠেছে। শহর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। শত্রু সেনারা কান পেতে আছে কখন আক্রার সেনাদল অস্ত্র সমর্পন করবে এই ঘোষনা শোনার জন্য। তবে তারা জানিয়ে দিয়েছে মুসলামান সৈন্যরা কোনদিন অস্ত্র সমর্পনের ট্রেনিংই পায়নি।

এই চিঠিতে মাশতুত ও কারাকুশ সুলতান আইয়ুবীকে আবারও জানিযেছেন, যা তারা ইতিপূর্বে বহুবার সুলতানকে জানিয়েছেন,‘আপনি এমন আশা করবেন না যে, আমরা জীবিত অবস্থায় আত্মমর্পন করবো।’

তারা লিখেছে, ‘আপনি আপনার সঙ্গের সৈন্যদের বলবেন, তারা যেন খৃষ্টান বাহিনীর পশ্চাৎ দিক থেকে প্রবল আক্রমণ চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সব সময় তাদের সন্ত্রস্ত করে রাখে। সৈন্যদের আরো বলবেন, আমরা শাহাদাতের পেয়ালা পান করার জন্য উন্মুাখ হয়ে আছি, তারাও ইচ্ছা করলে আমাদের সঙ্গী হতে পারে।

খৃষ্টানদের আক্রমণে আক্রা শহর অর্ধেকটা পুড়ে গেছে। আমাদের দশ হাজার সৈন্যের অর্ধেক এরই মধ্যে শাহাদাতের পেয়ালা পান করে চরে গেছে আল্লাহর দরবারে। অবশিষ্ট পাঁচ হাজার মুজাহিদ পরিপূর্ণ আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও ভয়শূন্য হৃদয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের নিঃশেষ করার আগে কোন বেদ্বীন ও কাফের এ শহরে ঢুকতে পারবে না।

আপনি শহরবাসীর চেতনা ও আবেগের কথা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন। তারা দিনে এক বেলা আহার করে আর দুই বেলার আহার সৈন্যদের জন্য পাঠিয়ে দেয়। আমাদের মেয়েরাও আমাদের সহযোগিতা করতে সর্বোতভাবে। তারা প্রত্যেকেই ঘরের পামের ফাঁকা জায়গায় সবজির চাষ করছে যেন আমাদের দান করতে পারে। পুরুষের মত মেয়েরাও এখন এক বেলা খাবার গ্রহন করছে।’

চিঠিতে প্রাচীরের অবস্থাও লিখেছেন তারা। লিখেছেন, ‘খৃষ্টান সৈন্যরা মেঞ্জানিক দিযে ক্রমাগত পাথর নিক্ষেপ করে শহরের প্রাচীরের কয়েক স্থান ভেঙ্গে ফেলেছে। তবে প্রাচীরের উপরের অংশ ইনষ্ট হয়েছে তাতে, নিচের অংশ এখনো অটুট আছে। গম্বুজ ধ্বসে পড়েছে।

শত্রুরা শহরের বাইরের খন্দকের কয়েকটি স্থান তাদের সৈন্যদের লাশ দিয়ে ভরাট করে ফেলেছে। এই ভরাট করার কাজে তারা মৃত সৈন্য এবঙ মৃত ঘোড়া ব্যবহার করেছে। তার ওপর মাটি দিয়ে তারা চলাচলের মত রাস্তা বানিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সে পথে যখনই শত্রু সৈন্য প্রাচীরের কাছে আসতে চেষ্টা করেছে, আমরা তাদের পরপারে পাঠিয়ে দিয়েছি।

যুদ্ধের ব্যাপারে এখন আমাদের আরও নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা দরকার। আপনি যখন ঢোলের শব্দ শুনবেন তখন শত্রুর ওপর পিছন থেকে প্রবল বেগে আক্রমণ করবেন। আমরা তখনই ঢোল বাজাতে আরম্ভ করবো যখন ক্রুসেড বাহিনী প্রাচীরের উপর আক্রমণ চালাবে।

অথবা আমরা শত্রুর ওপর আক্রমণ করার আগেও ঢোল বাজাতে পারি যাতে তখন আপনারাও তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। যতোক্ষণ তাদের অস্তিত্ব থাকে বা আমরা নিঃশেষ হয়ে না যাই।

আমরা আরো চিন্তা করছি, রাতে গোপনে শহর থেকে বের হয়ে আমরা তাদের জাহাজে চড়াও হবো এবং পেট্রোল ঢেলে তাতে আগুন ধরিয়ে দেবো। আপনি আমাদের এ পরিকল্পনা অনুমোদন করলে জানাবেন।’

সুলতান আইয়ুবী দুর্বল শরীর ও জ্বরের বেগ নিয়েই উঠে দাঁড়ালেন। তিনি কাতেবকে ডেকে চিঠির উত্তর লিখতে বসলেন, কাতিব সঙ্গে সঙ্গে তা লিখে নিচ্ছিল।

চিঠি লেখা শেষ হলে তিনি কাতেবকে বললেন, ‘পুনশ্চ দিয়ে আরো লিখ, ‘তোমাদের জন্য সামান্য সংখ্যক জানবাজ কমান্ডো সৈন্য পাঠালাম। কোন খাদ্য সামগ্রী তাদের দেইনি নিতে অসুবিধা হবে বলে।

তারা রাতে সাগর পথে শহরের উপকূলে পৌছবে। না, কোন জাহাজে চড়ে যাবে না ওরা, ওরা যাবে সাঁতরে। তোমরা ওদের শহরে ঢুকার পথ করে দেবে।

আল্লাহর প্রিয় বান্দারা! এখন তোমাদের একমাত্র আল্লাহই সহায়। ইসলামের উপর এখন কঠিন সমস্যা চেপে আছে। এটা আমারই দোষ। আমিই ক্রুসেড বাহিনী আক্রাতে ডেকে এনেছিলাম বায়তুল মোকাদ্দাসকে বাঁচানোর জন্য।

আমার ইচ্ছে ছিল, শত্রুদের আমরা এখানেই ব্যস্ত রাখবো যাতে ধীরে ধীরে তাদের শক্তি ও সাহস কমতে থাকে। শত্রুদের সমস্ত শক্তি এখানে শেষ করে দিতে পারলে তারা আর বায়তুল মোকাদ্দাসে অভিযান চালাতে পারবে না।

অতএব তোমরা মনে রাখবে, তোমরা আক্রা শহর বাঁচানোর জন্য লাড়াই করছো না, বরং তোমরা জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করছো মসজিদুল আকসা ও বায়তুল মোকাদ্দাস রক্ষার জন্য।’ এই চিঠি কবুতরের মাধমে পাঠিয়ে দিতে সুলতান আইয়ুবী তার সেনাপতিদের ডাকলেন।

তিনি তাদের বললেন, ‘এখন প্রত্যেক কমান্ডার ও সেনাপতির কাছে গিয়ে নির্দেশ দেয়ার শক্তি ও সময় আমার নেই। আমার শরীরে যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে তা আমি জিহাদে সর্বোত্তম পন্থায় ব্যয় করতে চাই। তোমরা তোমাদের সৈন্যদের বলো, তারা যেন আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল ও তার মাধ্যমে আমরা যে দ্বীন পেয়েছি সেই দ্বীনের জন্য স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে যুদ্ধ শুরু করে।

আমি যদি তাদের নির্দেশ দিতে নাও পারি, জিহাদের জন্য আল্লাহ কোরআনের যে নির্দেশ দিয়েছেন সেই নির্দেশের কথা স্বরণ করে ওরা যেন যুদ্ধ চালিয়ে যায় । একথা যেন কেউ চিন্তা না করে, তারা সুলতান আইয়ুবীর আদেমে ও তার জন্য লড়ছে।

তোমাদের এ কথা আমি এ জন্যই বললাম, এমন সময়ও আসতে পারে, যখন সৈন্যদের নির্দেশ দেয়ার জন্য তোমরা আর বেচে থাকবে না। আমি জানি, আমার মতোই তোমরাও তোমাদের জীবন আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দিয়েছো। এই জীবনের মূল্য আল্লাহ কি দেবেন তা তিনিই ভাল জানেন। এ নিয়ে কোন চিন্তা করার সময় এখন আমাদের হাতে নেই।’

সুলতান আইয়ুবীর এ ভাষণ ছিল যেমন আবেগদীপ্ত তেমনি উদ্দীপনাময়। তাঁর আবেগ এমন  অবস্থায় ছিল, মা তার শিশুকে হারিয়ে ফেললে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় অনেকটা সে রকম।

সুলতান আইয়ুবীর উপদেষ্টা কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন,‘এ সময় আমি সুলতান আইয়ুবীকে অনেকবার বলেছি, সুলতান, তোমার শরীর ও স্বাস্থ্যের দিকে একটু নজর দাও। তুমি তোমার দেহটাকে এবাবে ধ্বংস করে দিতে পারো ন্ াআল্লাহ কে স্বরণ করো, জয় পরাজয় তো তাঁরই হাতে।’

সুলতানের চোখে তখন অশ্রু বযে যেতো। তিনি আবেগ কম্পিত কন্ঠে বলতেন, ‘বাহাউদ্দিন! আমি বায়তুল মোকাদ্দাস ও মসজিদুল আকসা খৃষ্টানদের দ্বারা কলংকিত হতে দেবো না আমি সে পবিত্র স্থান অপবিত্র হতে দেবো না, যেখান থেকে আমাদের প্রিয় নবী আল্লাহর দরবারে গিয়েছিলেন।

যে মসজিদে হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজ পড়েছিলেন আমরা বেঁচে থাকতে সেই ঘর আবার নাপাক করবে নাসারারা? না বাহাউদ্দিন, তা হতে পারে না। আমি মরে গেলেও বায়তুল মোকাদ্দাস খৃষ্টানদের হাতে তুলে দেবো না।’

কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ আরও বলেছেন,‘এক রাতে তিনি এতই অস্থির ছিলেন যে, সে রাতে আমি তার কাছেই থাকতে বাধ্য হই। তার চোখে কোন ঘুম ছিল না। আমি কোরআনের কয়েকটি সূরা পাঠ করলাম। তাকে বললাম, ‘সালাহউদ্দিন, এগুলো তুমিও পড়তে থাকো।’

তিনি চোখ বন্ধ করে নিলেন। আমি দেখলাম, তাঁর ঠোঁট নড়ছে। তিনি আয়াতগুলো পাঠ করতে করতে শুয়ে পড়লেন। শুযে তিনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন,‘ইয়াকুবের কোন সংবাদ এলো না? সে কি শহরে প্রবেশ করতে পারবে?

এবাবে আল্লাহর কালাম পড়তে পড়তে এক সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। কিন্তু ঘুমানোর কয়েক মিনিট পর ছটফট করতে করতে আবার তিনি জেগে উঠলেন। আবার ঘুমালেন। আবার জেগে উঠলেন।

সুলতান আইয়ুবীর তাবু থেকে আক্রার প্রাচীর স্পস্ট দেখা যাচ্ছিল। শহরের বাইরে ক্রুসেড বাহিনীর সমাবেশকে মনে হচ্ছিল মৃত পোকা-মাকড়ের ওপর এক দঙ্গল ডাসা পিঁপড়াড়ে বসে আছে। পোকাটাকে ঢেকে ফেলেছে পিঁপড়ের ঝাঁক। রাতের আক্রার প্রাচীরের উপর মশালের চলাফেরা লক্ষ্য করছিল আইয়ুবীর সঙ্গের সৈন্যরা। দেখছিল কিভাবে খৃষ্টানদের নিক্ষেপ করা আগুনের গোলাগুলো প্রাচীরের উপর দিয়ে ভেতরে গিয়ে পড়ছে। প্রাচীর থেকেও গোলা ছুটে আসছে বাইরে খৃষ্টান বাহিনীর ওপর। সুলতান আইয়ুবী তার কমান্ডোরেদ বললেন, ‘যাও, আক্রমণ চালাও।’

কমান্ডো বাহিনী ছুটে গেল শত্রুর দিকে। তীব্র আঘাত হানলো খৃষ্টান বাহিনীর ওপর। আক্রার মাটিতে লটিয়ে পড়লো রক্তাক্ত লামের স্তুপ। আহতদের চিৎকার ভারী হয়ে উঠছিল রাতের আকাশ।

ঘুমের মধ্যে সুলতান আইয়ুবী বার বার ইয়াকুব, ইয়াকুব বলে নৌবাহিনীর এক ক্যাপ্টেনকে ডাকছিলেন।

ইয়াকুব নৌবাহিনীর এক সাহসী ক্যাপ্টেন। তার নেতৃত্বেই আক্রা শহরে একদল কমান্ডোকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সমুদ্র উপকূল ঘেরাও করে রেখেছিল খৃষ্টান বাহিনী। সেই বাহিনীর চোখ এড়িয়ে তাদের পৌঁছতে হবে শহরে।

শহরের তিন দিকই ছিল সমুদ্রবেষ্টিত। বিশাল সমুদ্র উপকূল জুড়ে নোঙর করা ছিল ক্রুসেড বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলো। এদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিযে শহরে অস্ত্র ও খাদ্য সামগ্রী পাঠানো ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। সুলতান আইয়ুবী ক্যাপ্টেন ইয়াকুবকে বললেন,‘শহরে খাদ্য ও অস্ত্র পাঠানো দরকার।’

ইয়াকুব বললো,‘আপনি অনুমতি দিলে এ দায়িত্ব আমি নিতে পারি।’ এভাবে ক্যাপ্টেন ইয়াকুব নিজেই এক কঠিন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়।

ক্যাপ্টেন ইয়াকুব ছিলেন হলবের অধিবাসী। চাকরী জীবনের শুরুতে যোগ দিয়েছিলেন সুলতান আইয়ুবীর স্থল বাহিনীতে। সেখান থেকে তাকে নেয়া হয় কমান্ডো দলে। কমান্ডো ট্রেনিং শেষে তাকে নৌবাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়।

তার সৈন্য সংখ্যা ছিল ছয়শো পঁচিশ। ওখান তেকে চারশো সৈন্য তিনি রাতের আঁধারে আক্রায় পাঠিয়ে দিলেন। অবশিষ্ট দুইশো পঁচিম জন সৈন্য নিয়ে ইয়াকুব বৈরুত চলে গেলেন। সেখান থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্য বোঝাই করলেন।

জাহাজে খাদ্য সামগ্রী ও অস্ত্র বোঝাই করে তিনি আবার আক্রার পথ ধরলেন্ তিনি জাহাজে প্রচুর খাদ্য সামগ্রী তুলেছিলেন যা দিয়ে আক্রাবাসী দীর্ঘ দিন খেয়ে পরে যুদ্ধ করতে পারবে।

ইয়াকুব তার সৈন্যদের বললেন,‘আমাদের জান চলে যেতে পারে কিন্তু এ রসদপত্র আক্রা পৌঁছাতেই হবে। ক্রুসেড বাহিনী আমাদের উপকূলে ভিড়তে দেবে না।

উপকূলের কয়েক  মাইর দূরে জাহাজ নোঙর করা হবে। সেখান থেকে রাতের আঁধারে নৌকা নিয়ে তোমরা চলে যাবে। আক্রা পৌঁছতে পারলে মাল খালাস করে আবার ফিরে আসবে। এবাবেই সব মাল আামদের খালাস করতে হবে।’

১১৯১ সালের ৮ই জুন্ ইয়াকুবের জাহাজ আক্রা থেকে তখনো কয়েক মাইল দূর্ েক্রুসেড বাহিনীর চল্লিশটি যুদ্ধ জাহাজ ইয়াকুবের জাহাজকে ঘিরে ফেললো।

ইয়াকুব জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বললেন,‘জাহাজ আক্রার দিকে চলতে থাকবে। ওরা বাঁধা দিলে যুদ্ধ হবে। কিন্তু জাহাজের গতি কমাবে ন্

াক্রুসেড বাহিনী তাদের থামতে বললো। কিন্তু জাহাজ তো থামলোই না, উপরন্তু ইয়াকুবের সৈন্যরা ক্রুসেড বাহিনীর দিকে তা করে কামানের গোলা ছুঁড়তে লাগলো।

চল্লিশটি জাহাজ একযোগে আক্রমণ করলো তাদের। তারা প্রাণপণে যুদ্ধ করলো। যুদ্ধ চলছিল, জাহাজও আক্রার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।

ইয়াকুবের জানবাজ সৈন্যরা ক্রুসেড নৌবহরের প্রচুর ক্ষতিসাধন করলো। চারটি জাহাজ ডুবে গেল ক্রুসেড বাহিনীর। ইয়াকুবের জাহাজ তখনো ছুটছে উপকূলের দিকে। কিন্তু তার গতি পড়ে গেছে। খৃষ্টানদের গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেচে জাহাজের পাল।

ফরাসী ঐতিহাসিক ডিভেনসুফ লিখেছেন, ‘তারা যখন যুদ্ধ করছিল তখন মনে হচ্ছিল, তারা কেউ মানুষ নয়। ভূতের মতো তারা লড়ছে এবং অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে।’

কিন্তু তারা ঘেরাও থেকে বের হতে পারলো না। ইয়াকুবের অর্ধেক সেনা তীর ও গোলার আঘাতে মারা গেলো। আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় লড়তে লাগলো বাকী সৈন্যরা।

ইয়াকুব যখন দেখলো, জাহাজের পাল ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়ায় জাহাজের গতি থেমে গেছে এবং খৃষ্টান নৌবাহিনীর সৈন্যরা তীর খেয়েও ছুটে আসছে জাহাজের দিকে তখন তার বুঝতে বাকী থাকলো না, অচিরেই খৃষ্টান সৈন্যরা জাহাজে উঠে আসবে এবং দখল করে নেবে জাহাজ। তখন ইয়াকুব তার জানবাজদের ডেকে বললো,‘আল্লাহর কসম! আমরা সম্মানের সাথে মরবো। শত্রুরা এ জাহাজ দখল করতে ছুটে আসছে। কিন্তু এর খাদ্য সামগ্রী ও অস্ত্রসস্ত্র আমরা শত্রুদের হাতে তুলে দিতে পারি না। তোমরা হাতিয়ার ফেলে হাতে কুড়াল তুলে নাও। জাহাজে কুড়াল মেরে ডুবিয়ে দাও এ জাহাজ। জাহাজের মধ্যে পানি ঢুকলে সহজেই এটা ডুবে যাবে। জাহাজের মধ্যে পানি ঢুকলে সহজেই এটা ডুবে যাবে। তখন আর ক্রুসেড বাহিনী আমাদের মাল সামান হস্তগত করতে পারবে না।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা যায়, যে সব সৈন্যরা জীবিত ছিল তারা পাটাতনের নিচে গিয়ে জাহাজ ভাঙ্গা শুরু করলো। জাহাজের তল ছিদ্র হলে সাগরের পানি জাহাজে প্রেবেশ করতে শুরু করে। কোন সৈন্যই জাহাজ থেকে বেরিযে সাঁতরে বাঁচার চেষ্টা করেনি, সকলেই জাহাজের সাথে সমুদ্র তলে ডুবে গেল।

সুলতান আইয়ুবী যখন এই মর্মান্তিক ঘটনা শুনলেন তখন তিনি তাবু থেকে বের হলেন। তার ঘোড়া সর্বদা প্রস্তুত থাকে। তিনি লাফিয়ে ঘোড়ায় চড়ে হুকুম দিলেন,‘জলদি দফ ও নাকাড়া বাজাও।

সঙ্গে সঙ্গে দফ ও নাকাড়া বেজে উঠলো। এটা আক্রমণের সংকেত। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সৈন্যরা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে মাঠে এসে সমবেত হলো। সুলতান আইয়ুবী সমবেত সৈন্যদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘মুজাহিদ ভাইসব! আজ শত্রুদের ব্যুহ ভেদ করে আক্রান্ত প্রাচীরের কাছে পৌছাতে হবে তোমাদের।’

প্রথমেই ঘোড়া ছুটালেন তিনি। তার পিছনে ছুটলো অশ্বারোহী বাহিনী। তাদের পিছনে তীরন্দাজ ও পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা ছুটলো লড়াকুর বেশে। তীব্র বেগে তারা যখন ছুটে গেল বিশাল ক্রুসেড বাহিনীর কাছে, ওরা ভযে প্রতমে পিছিয়ে গেল কয়েক কদম।

কিন্তু ততোক্ষণে মুজাহিদ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের ওপর। বাধ্য হয়ে রুখে দাঁড়াতে হলো ওদের।

দৃশ্যতঃ এ আক্রমণ দেখে মনে হচ্ছিল, মুজাহিদরা এলোপাথাড়ি আঘাত হানছে। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী এবাবেই আঘাত হানার জন্য গত দুই দিন তার সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তারা পরিকল্পিতভাবেই ক্রুসেড বাহিনীর ওপর এলোপাথাড়ি আঘাত হেনে যাচ্ছিল।

মুসলমানদের এমন ক্ষিপ্ত আক্রমণ দেখে ক্রুসেড বাহিনীর কমান্ডার তার তীরন্দাজদের হুকুম দিল, ‘দূর থেকে ওদের নিশানা করো। ওদের সামনে পড়ে আমাদের সৈন্যরা কচু কাটা হয়ে যাচ্ছে।’

ক্রুসেড তীরন্দাজরা ধুনকে তীর জুড়লো। নিশানা করলো ক্ষিপ্ত মুসলিম সৈন্যদের। প্রাথমিক ধাক্কর হতবিহবলতা কাটিয়ে উঠে তাদের পদাতিক বাহিনীও প্রাচীরের মত দাঁিড়য়ে গেল। তারও একটু পর প্রস্তুত হয়ে ময়দানে এলো ক্রুসেড বাহিনীর অশ্বারোহীদল।

তীরন্দাজ বাহিনী তীর বর্ষণ করছিল। কিন্তু তাতে মোটেই ভড়কালো না মুসলিম বাহিন্ ীতারা তাদের গতি অব্যাহত রেখেই সামনে এগিয়ে গেল।

এ আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সুলতান আইয়ুবী নিজে। তাকে বেষ্টন করে এগিয়ে যাচ্ছিল মামলুক সেনাদল। তারা এগুচ্ছিল বিদ্যুৎ গতিতে। ক্রুসেড তীরন্দাজরা নিশানা ঠিক করার সুযোগ পাচ্ছিল না। তারা এলোপাথাড়ি তীর ছুঁড়তে আরম্ভ করলো।

ময়দানে ক্রুসেডদের সংখ্যা ছিল বেশুমার। হামলাকারী সৈন্যদের দেখে মনে হচ্ছিল, মুসলিম বাহিনী আত্মাহুতি দিতে যাচ্ছে। অশ্বারোহীরা ছুটছিল এঁকেবেঁকে, যাতে তীরন্দাজদের তীর তাদের গায়ে না লাগে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই যুদ্ধ এক সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করলো। খৃষ্টান বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে লাগলো মুজাহিদদের বেপরোয়া আঘাতে। তারা এমনভাবে ময়াদানে ছড়িয়ে পড়লো যে, তাদের দেখাই যাচ্ছিল না। ময়দানে শুধু খৃষ্টা বাহিনীই দেখা যাচ্ছিল। এমন বেপরোয়া আক্রমণে যেন কেয়ামত নেমে এলো। ক্রুসেড বাহিনী প্রবল শক্তিতে মুসলমানদের আঘাত প্রতিহত করতে লাগলো।

এ যুদ্ধ তখনই শেষ হলো যখন সন্ধ্যার আঁধারে ছেয়ে গেল পৃথিবী। খৃষ্টানদের বহু সৈন্য হতাহত হলো। ময়দানে পড়ে রইলো অসংখ্য লাশ ও আহত সৈনিক।

কিন্তু এত কিছুর পরও মুসলিম বাহিনী কাঙ্খিত সফলতা লাভ করতে পারলো না। যে প্ল্যানে সুলতান আইয়ুবী আক্রমণ চালিয়েছিলেন সে পরিকল্পনা সফল হলো না তার তিনি আক্রার প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেন ন্

াএমন আক্রমণ এটাই প্রথম ও শেষ নয়। আক্রার অবরোধের দু’বছর কেটে গেল। এই দু’বছরের মধ্যে সুলতান আইয়ুবী পিছন তেকে এমন আকস্মিক ও বেপরোয়া আক্রমণ বহুবার চালিয়েছেন। প্রত্যেক আক্রমণেই জানবাজ সৈন্যরা বীরত্বের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

ইতিমধ্যে সুরতান আইয়ুবীর সাহায্য এসে গেলো মিশর থেক্ েহলব এবং হারানের আমীরদের দেয়া সৈন্য ও রসদ সাহায্যও পাওয়া গেল সামান্য পরিমাণে। ছুটতে যাওয়া সৈন্যরাও নিজ নিজ ক্যাম্পে গিয়ে কাজে যোগ দিল। তাদের একটা অংশও শামিল হলো সুলতানের সাথে। যুদ্ধও চলতে লাগলো তীব্র থেকে তীব্রতর।

বিশাল বাহিনী আর প্রচুর লড়াইয়ের পরও ক্রুসেড বাহিনী আক্রা শহরে প্রবেশ করতে পারলো না। অবরোধ করতে এসে তারা নিজেরাই এখন অবরোদের মধ্যে পড়ে গেল্

এভাবে দীর্ঘ দিন কেটে গেলে খৃষ্টান সৈন্যদের অন্তরে ভয় ঢুকে গেল। কারণ প্রতিদিনই তাদের সংখ্যা অল্প অল্প করে কমছিল। তাদের মনে হলো, এভাবে চলতে থাকলে তারা কেউ জীবিত দেশে ফিরে যেতে পারবে না। তার আগেই কোন একদিন সেও ময়দানে লাশ হযে পড়ে থাকবে। তখন তার সাথীরা সেই লাশ কোন খন্দকে ফেলে দিযে ভরাট করবে খন্দক। তারপর সেখানে মাটি ফেলে তার ওপর দিয়ে তারা তৈরী করে নেবে তাদের চলাচলের পথ।

ক্রুসেড বাহিনীর সংখ্যা যেমন ছিল অপরিমেয়, তেমনি তাদের লাশের সংখ্যাও ছিল অগুনতি। এত বেশী লাশের সংখ্যা দেখে সাহসী খৃষ্টান সৈন্যদের মনোবল ক্রমেই আরো কমতে লাগলো। একদিন দেখা গেল, তাদের সাহস কমতে কমতে নিঃশেষ হয়ে এসেছে। এমনকি স¤্রাট রিচার্ডের মনেও আতংক দেখা দিল।

মুসরিম সৈন্যদের মনোবল প্রবল বাঁধার মুখেও শুরুতে যেমন ছিল তেমনি অটুট রইলো। কারণ তাদের মনে একই সাথে দু’টো প্রাপ্তির স্বপ্ন দানা বেধেছিল, এর যে কোন একটি পেলেই তারা খুশী। আর সে স্বপ্ন দুটো ছিল, বিজয় অথবা শাহাদাত।

এ সময় স¤্রাট রিচার্ড সুলতান আইয়ুবীর কাছে সন্ধির দুত বিনিময় মুরু করেন্ রিচার্ডের দুত আসতো সুলতান তকিউদ্দিনের কাছে। তকিউদ্দিন সন্ধির শর্তাবলী ও প্রস্তাব সুলতান আইয়ুবীর কাছে পৌছে দিতেন।

রিচার্ডের দাবী ছিল দুটো, বায়তুল মোকাদ্দাস, যাকে তারা জেরুজালেম বলে সেটা তাদের কাছে হস্তান্তর করা আর হাতিনের যুদ্ধের ময়দান থেকে পাওয়া পবিত্র ক্রুশটি তাদেরকে ফেরত দান। প্রথম দিকে দাবী ছিল তিনটি। অপর দাবীটি ছিল, এ যাবত সুলতান আইয়ুবী খৃষ্টানদের কাছ থেকে যে সব এলাকা দখল করেছেন তা ফেরত দেয়া। এখন এ দাবীটি তিনি ছাড় দিতে সম্মত হয়েছেন।

সুলতান আইয়ুবী জেরুজালেমের নাম শুনলেই উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। কিন্তু তবুও তিনি সন্ধির ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যেতে তকিউদ্দিনকে পরামর্শ দেন। তাকে বলেন, ‘তুমি স¤্রাট রিচার্ডের সাথে কথা চালিযে যাও।’

প্রায় সব ঐতিহাসিক একমত যে, স¤্রাট রিচার্ড ও তকিউদ্দিন এই আলোচনা চালাতে গিয়ে একে অন্যের বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। তকিউদ্দিন যখন স¤্রাট রিচার্ডের কাছে যেতেন তকন তার বোন জিয়ানও তাদের কাছে থাকতো। এতো বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও তকিউদ্দিন স¤্রাট রিচার্ডের শর্ত মেনে নিতে পারছিলেন না। এই মেলামেশা ও দেখা সাক্ষাতের মধ্যেও আক্রার যুদ্ধ সমান তালেই চলছিল। রক্তারক্তি আরও তীব্রতর হচ্ছিল । আক্রার অবরুদ্ধবাসীদের অবস্থা আরও করুণ ও শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। ইউরোপীয় স¤্রাটদের মধ্যে ফ্রান্সের স¤্রাট অগাষ্টাস ও ইংল্যান্ডের স¤্রাট রিচার্ড এরা দু’জনই ক্রুসেড যুদ্ধের নেতৃত্ব দান করছিলেন।

‘ভাইজান!’ জিয়ান তার ভাই রিচার্ডকে বললো, ‘আমি কিন্তু সফলাতা লাভ করতে যাচ্ছি। সুরতান তকিউদ্দিন আমার ভালবাসা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমি তার মধ্যে সেই দুর্বলতা দেখতে পাচ্ছি না, যে দুর্বলতার কথা আপনি মুসলমান আমীল ও নেতাদের সম্পর্কে বলে থাকেন। সে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে কিন্তু তার ধর্ম ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। সে বরং আমাকেই আমার ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বলেছে।’

‘আমার মনে হচ্ছে তুমি তোমার রূপের যাদুতে তাকে বশ করতে পারোনি, যেমনটি পারে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েরা।’

রিচার্ড বললেন,‘তকিউদ্দিন এখনো ঈমানের বলে যথেষ্ট বলিয়ান। আমি নিজেই তার সাক্ষী। আমি তাকে বলে দিয়েছি, ‘তুমি যদি জিয়ানকে বিয়ে করতে চাও তবে তোমাকে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আর তোমার ভাইয়ের কাছে দাবী জানাতে হবে, তারা যেন উপকূলীয় রাজ্যগুলো তোমাকে দিয়ে দেয়্ ওখানে কেবল তোমাদের দু’জনের শাসন চলবে।’

রিচার্ড বললেন,‘সে তার উত্তরে বললো কি জানো? সে বললো, ‘সে কথা তোমার বোনকেই জিজ্ঞেস করো। আমি তাকে ততটুকু ভালবাসি সে যতখানি আমাকে ভালবাসে, তার বেশিও নয় কমও নয়।’

আমি তাকে বলেছি, ‘তার সাথে মেলামেশা ও ভালবাসাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তোমাদের ভালবাসা যদি তোমাদের মনকে এক সূত্রে বাঁধতে না পারে তবে সেখানে আমি বিয়েতে রাজি হই কি করে? আগে তোমরা এ ব্যাপারে একমত হও।’

রিচার্ড তার বোনকে বললো, ‘জিয়ান! শিকার জালে আটকা পড়েছে। কিন্তু এই কৃতিত্ব তুমি তখনই দাবী করতে পারবে, যখন জাল গুটিয়ে তাকে উপরে তুলতে পারবে। তবে জাল গুটানোর সময় তুমি আয়নায় তোমার চেহারা দেখে নিও।’

‘সে কথা আমার স্মরণ আছে, ভাইজান। ’ জিয়ান প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,‘ভাইজান! একটা খারাপ খবর আছে। আমার দুটি দাসীর কোন খোঁজ পাচ্ছি না। রাতে তারা আমার কাছেই ছিল, কিন্তু ভোর থেকে তাদের দেখা যাচ্ছে ন্’া

স¤্রাট রিচার্ড চিন্তিত মনে বললেন,‘এটা তো খুব চিন্তার কথা! তারা কি মুসলমান?’ তিনি চেহারায় দুশ্চিন্তা ধরে রেখেই বললেন,‘মুসলামন না হলে ওরা পালাবে কেন? আর যদি মুসলামন হযে থাকে তবে তো তারা পালাবেই । আমরা যেভাবে মার খাচ্ছি তাতে ওদের পালিয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

‘হ্যা, তারা সিসিলির মুসলিম মেয়ে।’ জিয়ান বললো, ‘তবে তারা বিয়ের পর তেকেই আমার সাথে ছিল। বিয়ের পর সিসিলির শ্বশুর বাড়ীতে গিয়েই আমি ওনাদের পেয়েছিলাম।’

‘মুসলামানের জন্ম যেকানেই হোক না কেন তাদের ঈমান, আবেগ ও চেতনা একই থাকে।’ রিচার্ড বললেন, ‘সে জন্যই আমরা এ জাতিটাকে এত বেশী ভয় করি। বলতে পারো, এ জন্যই তাদের পিছনে আমরা লেগে আছি যেন তারা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে। ওরা এখানে এসে দেখতে পেলো, আমরা তাদের জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। ফলে সুযোগ মতো তারা তাদের জাতির কাছে চলে গেছে।

স¤্রাট রিচার্ড সঠিক কথাই বলেছিলেন। ভাই-বোন যখন খৃষ্টান শিবিরে বসে এসব আলাপ করছিল সে সময় এই দুই মেয়ে বসা ছিল সুলতান আইয়ুবীর সামনে। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদেরকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে নিযে যাওয়া হলো।

তারা সুলতানের সাথে দেখা করতে চাচ্ছিল। তারা বলছিল, ‘আমাদের কিছু কথা আছে যা শুধু সুলতান আইয়ুবীর কাছেই আমরা বলতে চাই।’

তাদেরকে সুলতান আইয়ুবীর সামনে হাজির করলে তারা সুলতান আইয়ুবীকে জালালো, ‘আমরা সিসিলিতে জন্মগ্রহণ করেছি এবং সেখানেই প্রতিপালিত হয়েছি। শৈশবেই আমরা রাজবাড়ীর কাজে নিযুক্ত হই।

রাজবাড়ীতেই আমারেদ কৈশোর ও প্রথম যৌবনের দিনগুলো পার হয়ে যায়্ রাজকুমারী জিয়ান রাণী হয়ে আমাদের স¤্রাটের কাছে এলে আমাদের চেহারা-সুরত ও শারীরিক গঠন দেখে আমাদের দু’জনকে রাণী জিয়ানের সেবিকা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

সিসিলিতে সে সময় মুসলামনদের সংখ্যা প্রায় খৃষ্টানদের কাছাকাছি ছিল। এই কারণে সেখানে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি যথেষ্ট সজীব ছিল। আমরা মেয়ে হলেও ধর্মের প্রতি ছিল আমাদের আন্তরিক টান ও ভক্তি।

মেয়েরা সুলতান কে জানালো, ‘জিয়ান বিধাব হয়ে গেলেন তখন স¤্রাট রিচার্ড তার বোনকে নিজের কাছে নিয়ে এলেন। জিয়ানের দাসী হিসাবে আমরাও চলে এলাম তার সাথে।

এখানে এসে দেখতে পেলাম, আমাদের প্রভুরা আমাদের ধর্ম ও জাতির বিরুদ্ধে  কেবল যুদ্ধ করছে না বরং ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে মিটিয়ে দেয়ার জন্য নানারকম ষড়যন্ত্র করছে।

এতে আমাদের মন খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। আমরা তখন তাদের কাছ থেকে পালিযে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।

মাননীয সুলতান! আপনিই বলুন, আমরা কি মুসলমান নই? আমাদের দেহে কি মুসলিম পিতার রক্ত বইছে না? তাহলে কি করে আমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছে তাদের সাথে থাকতে পারি?

কাফেরদের বিরুদ্ধে এই জিহাদে আমরা শরীক হতে চাই। আপনি আমাদের মনোবাসনা পূর্ণ করুন এবং আমাদেরদ ময়দানেদ যাওয়ার অনুমতি দিন।’

একহারা চমৎকার স্বাস্থের অধিকারী এই মেয়ে দুটি শুধু শারীরিক গঠনেই আকর্ষণীয় ছিল না, কথাবর্তায়ও যথেষ্ট চটপটে এবং বুদ্ধিমতি হনে হলো। সুলতান তাদের কাছে জানােত চাইলেন, ‘তোমরা ষড়যন্ত্রের কথা বললে, কি ধরনের ষড়যন্ত্রের খবর জানো তোমরা?’

তারা বললো, ‘রাজকুমারী জিয়ান স¤্রাট রিচার্ডের নব বধূকে বলছিল, ‘সুলতান  সালাহউদ্দিনের ভাই তকিউদ্দিনকে জালে আটকে ফেলেছে।

‘ওকে জালে আটকেছিস, নাকি নিজে তার জালে ধরা দিয়েছিস?’

‘ওই একই কথা।’ সে বললো, ‘তকিউদ্দিনের অন্তরে আমার জন্য যেমন ভালবাসা সৃষ্টি হয়েছে তেমনি তাকেও আমি ভালবেসে ফেলেছি।

‘তাহলেই মরেছিস। ওরকম শত্রুকে কেউ ভালবাসা দেয়? তোকে তো ভালবাসতে বলা হয়নি, ভালবাসার অভিনয় করতে বলা হয়েছিল।’

‘তাই তো করছি। তকিউদ্দিনকে বলেছি, ‘তুমি তোমার ধর্ম বদলে আমাদের ধর্ম গ্রহণ করো তাহলেই আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে।’ জিয়ান বললো, ‘তারপরে সুলাতান আইয়ুবীকে হত্যা করা ও জেরুজালেম পুনর্দখল করা কোন কঠিন কাজ হবে না।’

এই মেয়েরা সুলাতানকে জানালো, তকিউদ্দিন ও জিয়ান এরা পরস্পর কখন কোথায় সাক্ষাত করে। তারা বললো, ‘এই সংবাদ আপনাকে জানানোর জন্যই আমরা পালিয়ে এসেছি।’ সুলতান আইয়ুবী মেয়ে দুটিকে সসম্মানে দামেশকে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন।

সুলতান আইয়ুবী এই মেয়েদের রিপোর্টকে সত্য বলেই বিশ্বাস করলেন। কিন্তু তিনি ভেবে পেলেন না, তার সহোদর ভাই কি করে তাকে ধোঁকা দিতে পারে?

তিনি তার প্রতিটি সেনাপতিকেই বিশ্বাস করতেন এবং তাদের উপর নির্ভর করতেন। কিন্তু যখন তার ভাই তকিউদ্দিন ও দুই ছেলে আফজাল ও মালেক আল জাহের তার পাশে এসে দাঁড়ালো তখন তার পেরেশানী আরো অনেক কমে গেল।

ইদানিং ক্রুসেড বাহিনীর পিছন থেকে যে আক্রমণ চালানো হয় তার নেতৃত্বে তিনি এদেরকেই পাঠিয়ে দেন। শরীর অসুস্থ থাকে বলে কদাচিৎ তিনি নিজে ময়দানে যান।

তকিউদ্দিনকে তিনি খৃষ্টান স¤্রাটদের সাথে আপোষ আলোচনার কাজে লাগাচ্ছিলেন। বিশেষ করে স¤্রাট রিচার্ডের সাথে আলোচনা চলছিল তারই মাধ্যমে। কারণ রিচার্ড তার সাথে আলোচনা করতেই বেশী পছন্দ করেন।

আক্রার যুদ্ধ শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছে ছিল। মুসলমানদের কঠিন অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল দিন দিন। কারণ বিভিন্ন মুসলিম অঞ্চল থেকে সাহায্য আসতে শুরু করেছে।

মুজাহিদরা তাদের অভিযান ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর করছে। খৃষ্টান সৈন্যদের মনোবল ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। তকিউদ্দিনের আপোস আলোচনাও চলছে নিয়মিত। ইদানিং তিনি এই আলোচনার কাজে এতই ব্যস্ত থাকেন যে, সুলতান তাকে কমই কাছে পাচ্ছেন। সুলতান জানতে পেরেছেন, ময়দানে যাওয়ার সময়ও তার খুব একটা হয়ে উঠে না।

সুরতানে শরীর খারাপ। ইদানিং যুদ্ধ চালাচ্ছে তার সেনাপতি ও ছেলেরা। তিনি শুধু সংবাদ পান, আজ অমুক দিক দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে তার া দুশমনের প্রচুর ক্ষতি সাধন করেছে। পরে তারা অমুক দিক দিয়ে আক্রমণ করেছে।

সুলতান আইয়ুবীর ছেলেরা এখন ভালই কাজ দেখাচ্ছে। তারা পুরোপুরি যোদ্ধা হয়ে উঠেছে। ময়দান এবং সেনা ক্যাম্পেই এখন কেটে যায় তাদের বেশীর ভাগ সময়। বাপের সাথে দেখা করারও সময় পায় না তারা।

আক্রার প্রাচীর এক স্থানে ক্রমাগত পাথর বর্ষণে ধ্বসে গিয়েছিল। খৃষ্টান বাহিনী সে পথে শহরে প্রবেশ করার জন্য অনেকবারই চেষ্টা করেছে। কিন্তু যতবারই তারা ওই পথে শহরে ঢুকতে চেয়েছে ততোবারই মুসলিম সৈন্যদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে সরে আসতে হয়েছে তাদের।

আক্রাবাসী প্রাণপণ শক্তি দিয়ে এমনি এক অভিযান রুখে দাঁড়িয়েছিল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল, দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে। উভয় পক্ষই মরিয়া হয়ে লড়ছে। ফলে হতাহত ও লাশের স্তুপ বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।

সেই মুহূর্তে এক সেনাপতি পত্রবাহক কবুতরের পায়ে একটি চিঠি বেঁধে তাকে আকাশে উড়িয়ে দিল।

চিঠিতে সে লিখলো,‘আগামীকাল সকাল পর্যন্ত যদি আমাদের কাছে কোন সাহায্য না পৌঁছে আর আপনি বাইরে থেকে অবরোধ ভঙ্গ করতে না পারেন তবে শহরের পতন ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

কারণ শহরের শিশুরা ক্ষুধার জ্বালায় চিৎকার করছে। শহর পুড়ে ধ্বংস হচ্ছে। সৈন্য সংখ্যা আর সামান্যই রয়েছে। যারা বেঁচে আছে তাদেরও অনেকে আহত। বাকীরা দীর্ঘ একটানা যুদ্ধে ক্লান্ত। লাশের মতোই এখন অসাড় হয়ে গেছে তাদের দেহগুলো।

সুলতান আইয়ুবী চিঠি পড়ে কেঁদে ফেললেন। তিনি তার সমস্ত বাহিনীকে একত্রিত করলেন। সমস্ত শক্তি একত্রি করে তিনি দু’রাকাত নফল নামাজ পড়লেন।

সৈন্যদের বললেন, ‘মুজাহিদ ভাইয়েরা আমর! অনেক দিন হয়ে গেল আমরা এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়ে আছি। শহরের ভেতর যে সব ভাইয়েরা ছিল তাদের অনেকেই আল্লাহর দরবারে চলে গেছে। বাকীরা জীবিত থেকেও মৃতের মতোই। ওখানে আমাদের শিশুরা খেতে না পেয়ে মারা যাচ্ছে। যে কোন সময় শহরের পতন হতে পারে।

এ অবস্থা আর চরতে দেয়া যায় না। ছয় লাখ খৃষ্টান এসেছিল আমাদের দশ হাজার সৈন্য শেষ করতে। আমরা ওদের অর্ধেক সৈন্য খতম করে দিয়েছি।

এ রকম অসম যুদ্ধের নজির পৃথিবীতে এক বদর যুদ্ধ ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাবে না। সেদিন আল্লাহর সাহায্যে আল্লাহর সৈনিকরাই বিজয়ী হয়েছিল। আজো আল্লাহর সাহায্য আছে বলেই আমরা এখনো শত্রুর তিন লাখ সৈন্যকে খতম করার পরও টিকে আছি বহাল তবিয়তে। আমরা আল্রাহর আরো সাহায্য চাই এবং বিজয় চাই।

এসো আজ আমারা শপথ করি, বিজয় না নিয়ে আমরা কেউ আর ময়দান থেকে ফিরে আসবো না। হয় আমরা জয়ী হবো নইলে শাহাদাতের পেয়ালা পান করে চলে যাবো মালিকের দরবারে।

তাকে বলবো,‘তোমার প্রিয় বান্দাদের রক্ষা করার জন্য দুনিয়াতে কেবল তোমাকেই রেখে এসেছি। আমারা তোমার হুকুম অমান্য করিনি। বীর খ্যাতি লাভের জন্য নয়, স¤্রাজ্য বিস্তারের জন্য নয়, আমাদের সব প্রচেষ্টা ছিল তোমাকেই খুশী করারজন্য। আমরা তোমার প্রতিশ্রুত জান্নাতের আকাঙ্খা নিয়ে তোমার শাহী দরবারে হাজির হয়েছি। হে রাব্বুল আলামীন, তুমি আমাদের কবুল করো।’

তিনি বললেন, ‘এখন আমরা সবাই দু’রাকাত নফল নামাজ পড়বো। নামাজ পড়ে আমরা কেউ ক্যাম্পে ফিরে যাবো না, অজু অবস্থায় সবাই আল্লাহর সেই হুকুম বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে যাবো, যেখানে তিনি মুমীনদের সম্বোধন করে বলেছেন, ‘‘তোমরা হয় মারো অথবা মরো।’’ আমারা আমাদের মালিকের এই হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। আমরা মারবো অথবা মরবো। তৃতীয় কোন পথ খোলা নেই আমাদের জন্য।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top