৩০. মহাসময়

সুলতান আইয়ুবী তার মজলিশে শুরাকে আরো বললেন, ‘আমরা যদি শত্রুদের আক্রাতে এনে জড়ো করতে সক্ষম হই তবে শত্রুরা আক্রার দেয়ালের সাথে মাথা কুটে মরবে, অন্যদিকে নজর দেয়ারই সময় পাবে না।’

উপদেষ্টা পরিষদ তার এ প্রস্তাব সানন্দে অনুমোদন করলো। সুলতান বিশ্বাস করতেন, মসজিদুল আকসা ও ফিলিস্তিনকে কেবল মুসলমানদের অশ্রুই বাঁচাতে পারে। মুমীনের অন্তর নিঙড়ানো অশ্রু আল্লাহ  কখনো বৃথা যেতে দেন না। তাবে সে অশ্রু হতে হবে নিখাঁদ ও নির্ভেজাল। আর মুমীনকে সে অশ্রুর দাবী পূরণ করতে হবে।

মসজিদুল আকসায় অশ্রু বিসর্জন দিযে আসার পর তার অন্তরে প্রশান্তি নেমে এসেছিল। তিনি মনে করেন, আল্লাহর করণীয় আল্লাহ করবেন। আমাদের কাজ হচ্ছে আমাদের বুদ্ধি-বিবেক, সামর্ত ও চেষ্টাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।

তা মনে পড়ে গেল সেই মেয়েটির কথা, যে মেয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, আমি দেখলাম, শত্রুর জাহাজগুলো তোমার অশ্রুজলের সাগরে ডুবে যাচ্চে। বায়তুল মোকাদ্দাসের প্রাচীরের কাছেও তোমার দুশমনরা কেউ আসতে পারবে না।’

সুলতান ভাবছিলেন, সত্যি কি এমনটি ঘটতে পারে না! আমার প্রার্থনায় তো কোন খাঁদ ছিল না। তাহলে আল্লাহ কেন আমাদের বিজয় দেবেন না?

আল্লাহর প্রতি এমন নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার পরও সুলতান আইয়ুবীর মত খোদাভীরু লোক স¤্রাট রিচার্ডের সামুদ্রিক নৌবহরের আগমনের খবরে বিচলিত হয়ে পড়লেন।

তিনি ভেবে পেলেন না, এতো বড় বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা তিনি কিভাবে করবেন? নিজের অক্ষমতা টের পেয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে তিনি বিষয়টি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলেন। বললেন,‘আয় আল্লাহ, আমার যতটুকু সাধ্য ছিল আমি করেছি। আরো যদি কিছু করার থাকে সে বুদ্ধি তুমি আমার মাথায় ঢুকিযে দাও।’

স¤্রাট রিচার্ড ইংল্যান্ড থেকে যাত্রা করে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করার কয়েকদিন পরের ঘটনা। এক রাতে এক ভয়াবহ তুফান তার নৌবহরকে ঘিরে ফেললো। ঝড়ে তার সমস্ত জাহাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, তার নৌবহরে ছোট বড় পাঁচশ বিশটি জাহাজ ছিল।

তার মধ্যে অনেক গুলো ছিল বড় বড় যুদ্ধজাহাজ। এসব জাহাজ সৈন্য, ঘোড়া, অস্ত্র, রসদপত্র ও অন্যান্য মালপত্রে বোঝাই ছিল।

ঝড় এত প্রচন্ড ছিল যে, স¤্রাট রিচার্ডের জীবনও বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এই তুফানের মধ্যে পড়ে জাহাজগুলো এলোমেলো হয়ে গেলো। ঝড় শেষ হওয়ার পরও কয়েকদিন লেগে গেল সেগুলো একত্র করতে।

অনেক অন্বেষণের পর জাহাজগুলো একত্রিত করে দেখা গেল পঁচিশটি বড় জাহাজের কোন হদিস নেই। ধারণা করা হলো, সেগুলোর সবই সমুদ্রে ডুবে গেছে।

এর মধ্যে ছিল দু’টি বিশালাকায় নামকরা জাহাজ। তাতে এত বিপুল পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম ছিল, যা হারিয়ে স¤্রাট নিজেই দিশেহারা হয়ে গেলেন। কারণ এতে ছিল তার আগুনতি ধন সম্পদ, অর্থ কড়ি ও প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র। এই ঝড় তার সবকিছুই ভূমধ্যসাগরে তলিয়ে দিল। এতে যে কেবল মূলবান সম্পদ ছিল তাই নয়, স¤্রাটের বাগদত্তা স্ত্রী এবং তার এক বোনও ছিল সেই জাহাজে। ফলে জাহাজ দুটো হারিয়ে স¤্রাট রিচার্ড অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন তো হলেনই সেই সাথে স্বজনও হারালেন। আর এই ক্ষতি তাকে প্রচন্ড রকম বিমর্ষ করে তুললো।

এই ব্যথাতুর মন নিয়েই স¤্রাট রিচার্ড তার বহর নিয়ে সাইপ্রাস দ্বীপে এসে পৌঁছলেন এবং জাহাজগুলোকে এখানে নোঙর করার হুকুম দিলেন। এখানে এসে তিনি জানতে পারলেন, ঝড়ের কবলে পড়ে তার নৌবহরের যে জাহাজগুলো হারিয় গিয়েছিল তার তিন চারটি সাইপ্রাসের কূলে চলে আসতে পেরেছিল এবং সেগুলো এখনো এখানেই নোঙর করা আছে। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, যে জাহাজে তার যুবতী বোন জিয়ান ও বাগদত্তা রানী বিরাঙ্গারিয়া ছিল সে জাহাজটিও রক্ষা পেয়েছে এবং তারাও বেঁচে আছে।

এদের দু’জনের ব্যাপারেই তিনি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন, তারা ঝড়ের কবলে পড়ে মারা গেছে। তাদের বেঁচে থাকার খবরে তিনি পঁচিশটি বড় বড় জাহাজ হারানোর বেদনা ভূলে গেলেন। তার মুখে অনেক দিন পর আবার হাসি দেখা গেল। কিন্তু তখনো তিনি জানতেন না, তার জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ানক এক দুঃসংবাদ। যখন জানতে পারলেন তখন তার সেই হাসি আবার বিষাদে রূপ নিল এবং তিনি প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হযে উঠলেন।

তিনি জানতে পারলেন, তার রাণী ও বোনকে বহনকারী জাহাজসহ চারটি জাহাজই নিরাপদে কূলে এসে ভিড়তে পেরেছিল। কিন্তু তখনই দেখা দিল নতুন সমস্যা।

সাইপ্রাসের স¤্রাট আইজাক কূলে ভিড়া জাহাজের সমস্ত মালপত্র উঠিয়ে নিলেন এবং জাহাজের সকল যাত্রীকে ধরে নিয়ে বন্দী করলেন। এই বন্দীদের মধ্যে ছিলেন রিচার্ডের রাণী ও বোন।

আইয়ুবীকে শায়েস্তা করতে এসে পথে অন্য কারো পেছনে শক্তি ক্ষয় করতে প্রস্তুত ছিলেন না স¤্রাট রিচার্ড। কিন্তু বাধ্য হয়ে রিচার্ডকে আইজারে বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হলো।যুদ্ধে আইজাক পরাজিত ও বন্দী হলেন। বন্দী আইজাককে এনে রাখা হলো এক তাবুতে।

গভীর রাত। আইজাক বন্দী হয়ে আছেন তার নিজের দেশে। তাবুতে শুয়েও তার ঘুম এলো না। তিনি অপমান ও মর্ম যাতনায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলেন। তখনই তার মনে হলো, আমি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি না কেন? এটা আমার নিজের দেশ। এর পথঘাট সবই আমার চেনা। দেশের মানুষ আমার প্রজা। একবার এই তাবু থেকে পালাতে পারলে রিচার্ডের সৈন্যদের সাধ্য হবে না আমাকে ধরার। আমাকে আশ্রয় দেবে এ দেশের প্রতিটি নাগরিক। তা হলে আর বসে আছি কেন? তাবুর পাহারাদার দু’জন ঘুম তাড়াবার জন্য তাবুর এক পাশে বসে গল্প করছিল। যেদিকে কোন পাহারা ছিল না স¤্রাট আইজাক সেদিকের তাবুর নিচ দিয়ে গড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তারপর খুব সন্তর্পনে একটু একটু করে সরে যেতে লাগলেন তাবুর কাছ থেকে। এক সময় রিচার্ডের সৈন্যদের দৃষ্টির বাইরে চলে এলেন তিনি, পালিয়ে গিযে আশ্রয় নিলেন এক দ্বীপে।

রাণী এবং রাকুমারীকে বন্দী করায় এমনিতেই স¤্রাট রিচার্ড আইজাকের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। আইজাকের পলায়ন তার আত্মসম্মানে ঘা দিল, তিনি আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন।

তিনি তার বিশাল বাহিনীকে দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দিলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন, আইজাককে পাকড়াও না করে এক পাও তিনি সামনে এগুবেন না আর।

রিচার্ডের বাহিনী আইজাকের খোঁজে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। ছুটে গেল দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে। দিন পেরিয়ে যেতে লাগলো। আইজাকের কোন সন্ধান পাচ্ছেন না স¤্রাট রিচার্ড।

সপ্তাহ পার হয়ে গেল। পার হলো দশদিন। দুই সপ্তাহ অতিক্রম করার পরও তার কোন খোঁজ না পেয়ে স¤্রাট রিচার্ড চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ভাবলেন, আমি কি ক্ষোভের বশে এখানে সময় নষ্ট করছি? তিনি সৈন্যদের বললেন, ‘তোমাদের আর পাঁচ দিন সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে আইজাককে আমার সামনে হাজির করতে না পারলে তোমাদের ভাগ্যে কি ঘটবে আমি বলতে পারি না।’

আজ স¤্রাট রিচার্ডের বেঁধে দেয়া সময়ের শেষ দিন। সৈনিকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। ব্যর্ততার অপমান ও ক্ষোভে কালো হয়ে গেল স¤্রাটের চেহারা। তিনি নিজের তাবুর মধ্যে গিয়ে সেই যে ঢুকলেন আর বের হলেন না।

রিচার্ডের সৈন্যরা সাগর তীরের প্রতিটি গ্রাম ও দ্বীপ তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। কিন্তু ব্যর্থতা ছাড়া কিছুই পেলো না তারা। তবু হাল ছাড়লো না, একবারদ যেখানে খুঁজে গিয়েছিল সেখানেই আবার নতুন করে খুঁজতে লাগলো।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। একদল সৈনিক এক দ্বীপে তাকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে আসছিল, তাদের সামনে পড়ে দেল একদল জেলে। এই জেলেদের একজনের ওপর আটকে গেল এক সৈনিকের চোখ। লোকটি জেলেদের বেশে থাকলেও অন্যদের  থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। জেলেদের পোশাক পাল্টে এ লোককে ভদ্রলোকদের পোশাক পরিয়ে দিলে সে কোন অভিজাত বংশের সর্দার হতে পারবে।

জেলেদের দলটিকে আটকালো সৈন্যরা। জানতে চাইলো তারা এদিকে স¤্রাট আইজাককে দেখেছে কি না? তারা অস্বীকার করলো। কিন্তু সন্দেহ গেলো না সেই সৈনিকের। সে ওই লোককে বন্দী করে নিয়ে এলো স¤্রাট রিচার্ডের সামনে। পাহারাদাররা তাকে দেখেই আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললো, ‘ইনিই তো স¤্রাট আইজাক।’

স¤্রাট রিচার্ড যখন ফিলিস্তিনের উপকূলে এসে পৌঁছলেন ততোক্ষণে ক্রুসেডদের সম্মিলিত বাহিনী আক্রা শহর অবরোধ করে নিয়েছে। এই অবরোধকারী বাহিনীর প্রথমেই ছিলেন গে অব লুজিয়ানের সেনাদল, যাকে রাণী সাবিলা সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে আর কখনো যুদ্ধ করবে না এই শর্তে মুক্ত করে নিয়েছিলেন।

এরপর তাদের সাথে এসে যুক্ত হলেন ফ্রান্সের স¤্রাট ফিলিপস অগাষ্টাস ও তার বাহিনী। এই দুই শক্তি মিলে আক্রার অবরোধকে দৃঢ়তর করে তুলল। এ সময় শহরের  মধ্যে মুসলমান সৈন্যের সংখ্যা ছিলষ মাত্র দশ হাজার আর তাদের কাছে এক বছর চলার মতো খাদ্যশস্য মজুত ছিল।

এই সর্বাত্মক অবরোধের সূচনা ঘটে ১১৮৯ সালের ১৩ আগষ্ট। আক্রা ছিল খুবই সমৃদ্ধ শহর। রাজা বাদশাহদের থাকার মতো আলীশান মহলগুলো ছিল সাগর তীরে। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এ শহরকে আকর্ষণীয় পর্যটক কেন্দ্রে পরিণত করে নিযেছিল। এ শহরের তিন দিকেই ছিল খোলা সমুদ্র, মাত্র একদিকে ছিল শহরের শক্ত প্রতিরক্ষা প্রাচীর।

বলতে গেলে সমুদ্রের বিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের সবটাই ঘেরাও করে নিয়েছিল খৃষ্টান বাহিনীর নৌবহর। স্থলবাহিনী খৃষ্টান সদস্যরা আস্তানা গেড়েছিল শহর রক্ষা প্রাচীরের বাইরে, নিরাপদ দূরত্বে। এভাবে জল ও স্থল পথের সমস্ত রাস্তা ক্রুসেড বাহিনী বন্ধ করে দিয়ে ভাবলো, এবার সিংহকে খাঁচায় আটকানো গেছে।

সুলতান আইয়ুবী তার তৎপরতার দ্বারা প্রমাণ করছিলেন, তিনি শহরেই আছেন, কিন্তু মূলত তিনি শহরে ছিলেন না। ক্রুসেড বাহিনী সুলতান আইয়ুবীকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলতে পেরেছে ভেবে খুবই আনন্দিত ছিল। শিকারী যেমন হিং¯্র প্রাণীকে খাঁচায় আটকাতে পারলে নিরাপদ বোধ করে তেমনি নিশ্চিন্ততা নিয়ে তারা চারদিক থেকে শহর ঘেরাও করে বসে ছিল। আজই সুলতানকে হাতের মুঠোয় পেতে হবে এমন কোন তাড়াহুড়ো ছিল না তাদের মধ্যে। তারা ভাবছিল, কিছুদিন যাক খাদ্য ও রসদের ঘাটতি দেখা দিক মুসলিম শিবিরে। না খেতে পেরে শুকিযে মরুক। তারপর এক সময় তারা আত্মসমর্পন করবেই

এ ধরনের ভাবনার কারণেই তারা শহর আক্রমণ করার কোন গরজ অনুভব করলো না। বরং তারা মনে করলো, শহরের দিকে চোখ রেখে অলসভাবে সময় পার করে দিতে পারলেই একদিন বিজয় এসে চুমু খাবে তাদের পায়ে।

সুলতান আইয়ুবী তখন শহরের বাইরে এক নিরাপদ ও গোপন জায়গায় বসে লক্ষ্য করছিলেন শত্রুদের গতিবিধি। তিনি তার কর্ম তৎপরতার দ্বারা শত্রু বাহিনীকে আক্রার দিকে টেনে আনতে পেরেছেন, এটাকে তার প্রথম বিজয় বলে গণ্য করলেন। এবার তিনি তার আসল খেলা শুরু করলেন।

ক্রুসেড বাহিনী যখন অবরোধকে গুছিয়ে নিয়ে সুস্থির হয়ে বসলো তখন তিতিন তার কমান্ডো বাহিনীকে বললেন, ‘হ্যা, এবার তোমরা কাজে নামতে পারো।’

একদিন রাত। অবরোধকারী সৈন্যরা রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ মধ্য রাতে হৈ চৈ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল তাদের। ওরা তাকিয়ে দেখলো শহরের ফটক তেমনি বন্ধ আছে। সৈন্য নড়াচরার কোন লক্ষণ নেই শহরের ভেতর। স্থলভাগের অবরোধকারীদের পেছন দিকের কিছু তাবু জ্বলছে। ওইসব তাবুতে তাদের খাদ্যসামগ্রী ও সরঞ্জামাদি রাখা ছিল। আশে পাশে তারা কোন মুসলমান সৈন্যও দেখতে পেলো না।

তবে গে অব লজিয়ান ও স¤্রাট অগাষ্টাসের বুঝতে বাকী রইলো না, সুরতান আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী তাদের পেছন থেকে আক্রমন করেছিল। তাদের টার্গেট ছিল রসদবান্ডার, তাই তারা সৈন্যবাহিনীর ওপর আঘাত হানেনি।

পরদিন তারা পাহারা আরো জোরদার করলো। বিশেষ করে পেছন দিকের সুরক্ষার দিকে মনযোগ দিল বেশী।

সেই রাতেই  আবার হামলা হলো। তবে এবার হামলা আরো জোরালো। হামলা হলো এক পাশে এবং ঝড়ের বেগে এসে ঝড়ের বেগে হারিযে গেল কমান্ডো বাহিনী। তছনছ করে দিয়ে গেল অনেক তাবু।

পরের রাত। ক্রুসেড বাহিনীর পাহারাদাররা দুই ভাগ হয়ে এক ভাগ তাকিয়েছিল শহরের দিকে অন্য ভাগ তাদের পেছনটা দেখছিল। হঠাৎ মাঝরাতে ক্যাম্পের ডান পাশে তারা দেখতে পেলো মুহূর্তে কতগুলো মশার জ্বলে উঠেছে এবং বাঁধা দেয়ার আগেই তারা অতর্কিত ঢকে পড়েছে ক্যাম্পের ভের্ত আজও তারা ঝড়ের বেগে একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

তবে যাওয়ার আগে অনেক কয়টা তাবুতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেলো। সামনে যাকে পেলো হত্যা করে গেল। ক্যাম্পের আগুনে ছুটাছুটি করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মরলো কয়েকজন। আহহ হলো বেশ কিছু সৈন্য।

ওরা বুঝলো, সুলতান আইয়ুবী ভেতরে থাকলেও তার কিছু কমান্ডো সৈন্য বাইরে রযে গেছে। হয়তো তারা শহরে প্রবেশ করতে চায়। শহরে ঢুকার রাস্তা বের করার জন্যই বার বার হামলা করছে।

স¤্রাট অগাষ্টাস বললেন,‘গে অব লুজিয়ান, ওদের শহরে ঢুকার মতো একটা রাস্তা বের করে দাও, দেখে কমান্ডো আক্রমণ বন্ধ হয়ে গেছে।

পরের রাতে তারা শহরের ফটক বরাবর অংশটা এমনভাবে হালকা করে দিল, যাতে সুলতানের দলছুট কমান্ডোরা শহরের ফটক পর্যন্ত অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে। কিন্তু তারা তখনও বুঝতে পারেনি, সুলতান আইয়ুবী শহরের ভেতরে নয়, বাইরে আছেন।

খৃষ্টানদের এ পরিকল্পনা সফল হলো না, কেউ ঢুকলো না শহরে। ঢুকার কথাও নয়। এভাবেই প্রতি রাতে, কখনো দু’একদিন বিরতি দিয়ে অবরোধকারী বাহিনীর ওপর মুসলমানদের আক্রমণ চলতেই থাকলো। তখন ওরা বুঝলো, সুলতান আসলে শহরের ভেতরে নেই তিনি বাইরেই আছেন এবং এসব হামলা তিনিই পরিচালনা করছেন।

এ কয়দিনের হামলায় ক্রুসেড বাহিনীর বেশ ক্ষতি হয়ে গেল। তারাও প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিল এবং প্রতিরোধ করতে শুরুও করলো। এতো মুসলামনদেরও কয়েজন কমান্ডো শহীদ হয়ে গেলেন।

সুলতান আইয়ুবীর সবচে বড় অসুবিধা ছিল, তাঁর সৈন্য সংখ্যা নিতান্তই কম। তারপরও আল্লাহর ওপর ভরসা করে তিনি মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

তিনি মনে মনে আশা করলেন, অবরোধ দীর্ঘদিন ধরে চললে ক্রুসেডদের শক্তি ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাবে। তিনি কমান্ডো আাক্রমণের মাধ্যমে যতটা না তাদের ক্ষতি করছিলেন তারচে বড় টার্গেট ছিল তার, দুশমনের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া। তিনি একটু একটু করে তাদের শক্তি নিঃশেষ করতে চাচ্ছিলেন। এতে করে খৃষ্টান সৈন্যদের মনে ভীতিটা একটা রোগের মতোই ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।

সুলতান আইয়ুবী হিসাব করে দেখলেন, আঘাত হানার জন্য আর অপেক্ষা করলে ক্রুসেড বাহিনী নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের উদ্যোগ নিতে পারে।

১১৮৯ সালের ৪ অক্টোবর। দিন গিয়ে রাত এলো। সুলতান আইয়ুবী তার সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ক্রুসেড বাহিনীর উপর প্রবল আক্রমণ চালালেন। ক্রুসেড বাহিনীও সতর্ক এবং প্রস্তুত ছিল। শুরু হলো এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এক রাতেই নিহত হলো ক্রুসেড বাহিনীর নয় হাজার সৈন্য।

কিন্তু তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ছয় লক্ষ। মাত্র নয় হাজার সৈন্য শেষ হওয়ায় তাদের তেমন কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হলো না। আক্রা শহর তাদের দখলে আসবে এ ব্যাপারেও কোন সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হলো না তাদের মধ্যে। বরং তাড়াতাড়ি যুদ্ধ লেগে যাওয়ায় খুশীই হলো তারা। এভাবে লাড়াই শুরু না হলে মোকাবেলা হতো কি করে? আর মোকাবেলা না হলে কি করে এর পরিসমাপ্তি ঘটবে?

ক্রুসেড বাহিনী বীর বিক্রমে আইয়ুবীর জানবাজদের হামলা প্রতিহত করে চললো। কিন্তু সাহস করে তারা কেল্লা বা শহর আক্রমণ করতে গেলো না। কারণ তারা যতোবারই শহরের প্রাচীরের দিকে এগুতে চেষ্টা করেছে ততোবারই মেনজানিকের অগ্নিগোলা ও তীরের বৃষ্টি তাদের ছেকে ধরেছে। বিজয় যেখানে নিশ্চিত সেখানে ধৈর্যহারা হয়ে অযথা নিজেদের আরো কিছু সৈন্য ক্ষয় করার কোন মানে হয় না। এই ব্যাপারে স¤্রাট অগাষ্টাস ও গে অব লজিয়ান দু’জনই একমত।

রাত শেষে ভোর হলো। ক্রুসেড বাহিনী ময়দানে দিকে তাকিয়ে দেখলো তাদের হাজার হাজার সৈন্য পড়ে আছে ময়দানে কিন্তু আইয়ুবীর বাহিনীর কোন ছায়াও নেই আশেপাশে।

স¤্রাট অগাষ্টাস বললেন,‘না, এভাবে মার খাওয়ার কোন মানে হয় না। শহর আক্রমণ করতে হবে। শহরের পতন না হওয়া পর্যন্ত এই লুকোচুরি খেলা থামাবে না আইয়ুবী।’

‘তাহলে আর দেরী করে লাভ কি? আসুন এখনই হামলা করে বসি। এতগুলো সৈন্য এক সাথে এগিয়ে গেলে শহরের পতন ঘটাতে আমাদের এক ঘন্টার বেশী লাগবে না।’ বললেন গে অব লুজিয়ান।

ক্রুসেড বাহিনী তাদের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে হামলা করলো শহরের ওপর। কিন্তু তারপরও তাদের সৈন্যরা প্রাচীরে কাছে ভিড়তে পারলো না। কারণ মুসলমান সৈন্যরা তাদের উপর মুষলধারে তীর বর্ষন করতে লাগলো।

এই তীরে জাল ভেদ করে জীবন নিয়ে শহরের পাঁচিলে কাছে পৌঁছা  সম্ভব নয় কোন মানুষের পক্সে। এই ছাড়া মুসলমান সৈন্যরা পেট্রোল ভর্তি হাড়ি নিক্ষেপ করলো খৃষ্টানদের দিকে, যার লেলিহান শিখা টপকে প্রাচীরের কাছে পৌঁছা সম্ভব ছিলনা তাদের পক্ষে।

ফলে ছয় লাখ সৈন্যের যে বিশাল বাহিনী পঙ্গপালের মত ছুটছিল শহরের দিকে তারা  আরো কয়েক হাজার সাথীকে ময়দানে ফেলে রেখে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলো। স¤্রাট অগাস্টাস ও গে অব লুজিয়ান উর্ধতন সামরিক কর্মকার্তাদের নিযে বৈঠকে বসলেন।

স¤্রাট অগাষ্টাস বললেন, ‘আইয়ুবীকে আর ছাড় দেয়ার কোন উপায় নেই। সে আমাদের বহু সৈন্যকে মৃত্যুর হাতে তুলে দিয়েছে। সুযোগ দিলে সে এভাবে একটু একটু করে আমাদের খেয়ে ফেলবে। অতএব হশরে আমাদের ঢুকতেই হবে। কিভাবে শহরে প্রবেশ করা যায় সে বুদ্ধি বের করো।’

অনেক গবেষণার পর এক অফিসার একটি বুদ্ধি আবিষ্কার করলো। সে তার চিন্তা পেশ করলো বৈঠকে। সবাই একমত হলো তার প্রস্তাবে। শুরু হলো সে প্রস্তাব বাস্তবায়নের মহা তোড়জোড়।

ক্রুসেড বাহিনী প্রাচীর টপকানোর যে নতুন উপায় উদ্ভাবন করেছে তা সফল করার জন্য তারা কয়েক দিনের পরিশ্রমে একটি বড় গম্বুজওয়ালা কাঠের ঘর তৈরী করলো। এই ঘরের নিছে অনেকগুলো কাঠের চাকা লাগানো হলো। সে ঘরটি এত বড়ছিল যে তাকে কয়েকশ সৈন্য এক সাথে থাকতে পারে। ঘরের গম্বুজটি অনেক উঁচু। ওখান থেকে সহজেই প্রাচীরের ওপর লাফিয়ে নামা যাবে। একদিন ভোরে একদল খৃষ্টান সৈন্য ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। তারা ঘরে ঢুকতেই অন্য আরেকদল সৈনিক ঘরটি শহরের পাঁচিলের দিকে ঠেলতে শুরু করলো। শহরের প্রতিরক্ষ বাহিনী অবাক হয়ে দেখলো এই অদ্ভুত কান্ড তারা ঘরের দিকে তাক করে তীর ছুড়তে শুরু করলো।

তীর সব কাঠে বিদ্ধ হচ্ছিল, সে জন্য সৈনিকদের তাতে কোন ক্ষতি হলো না। তখন সেই ঘর তাক করে মুসলমানরা মেঞ্জানিক কামান দাগতে শুরু করলো। ঘরটি প্রাচীরের আরো কাছে চলে এলো। এ সময় এক মুসলিম সেনা কমান্ডার বললো, ‘না, এবাবে হবে না।’ এই কমান্ডার ঘরের দিকে পেট্রোল হাড়ি নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিল।

সে দেয়ালের কাছাকাছি চলে আসা ঘরটির দিকে তাক করে মেনজানিক দিয়ে পেট্রোল হাড়ি ছুঁড়ে মারলো। হাড়িটি ঘরের গাযে লেগে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। পেট্রোল ছড়িযে পড়লো ঘরের কাঠের দেয়ালে। ঘরের ভেতর থেকে কয়েকশো সৈন্য তীর ছুঁড়তে লাগলো পাঁচিলের দিকে। সেই তীরের জবাবে তীর ছুঁড়ছিল মুজাহিদরাও। সেই কমান্ডার এক মুজাহিদকে বললো,‘অগ্নিতীর ছুঁড়ে মারো ।’

এক মুজাহিদ দ্রুত ঘরের দিকে অগ্নিতীর ছুঁড়ে মারলো। জ্বলন্ত তীরটি কাঠের ঘরের দেয়াল স্পর্শ করতেই সেখানে দপ করে জ্বলে উঠলো আগুন। মুহূর্তে সে আগুন ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। একে তো কাঠের ঘর তার ওপর সেই কাঠ পেট্রোল ভেজা। ফলে দেখতে দেখতে ঘরটি হারিয়ে গের বিশাল অগ্নিকুন্ডের ভেতর। কয়েক মিনিটের মধ্যে সমস্ত সৈন্যসহ ঘরটি পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

খৃষ্টানদের এ অভিযান পুরোপুরি ব্যর্থ হলে তারা শহরে প্রবেশের নতুন উপায় সন্ধান করতে লাগলো। শহর প্রাচীরের বাইরে একটি বড় পরিখা ছিল। এই খন্দক পার হওয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়াল খৃষ্টানদের জন্য। তারা সে খন্দকটি মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলার উদ্যোগ নিল।

শত শত ক্রুসেড সৈন্য লেগে গেল মাটি ভরাটের কাজে। শহরের প্রতিরক্ষা বাহিনীর তীর সে পর্যন্ত পৌঁছাতো না। মুজাহিদ বাহিনীর এক কমান্ডার বললো,‘যারা আগে শহীদ হতে চাও তারা আমর সাথে এসো।

সে একদল মুজাহিদ নিয়ে ফটক পার হয়ে চলে এলো শহরের বাইরে। এসেই এ দুঃসাহসী সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়লো ক্রুসেড বাহিনীর উপর। তাদের তীব্র আক্রমণে শত শত খৃষ্টান সৈন্য তীরবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়তে লাগলো সেই খন্দকের ভেতরেই।

খৃষ্টান সেনারাও মরিয়া হয়ে উঠলো। তারাও পাল্টা তীর ছুঁড়তে শুরু করলো। কিন্তু মুসলিম সৈন্যরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার শপথ নিয়েই ছুটে গিয়েছিল শহরের বাইরে। ফলে সেখানে তীব্র লড়াই শুরু হয়ে গেল।

দেখা গেল সেই খন্দকটি এবার মাটির পরিবর্তে খৃষ্টানদের মৃত লাশে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। খৃষ্টানরা সেই লাশ সরানো বা দাফনের সুযোগ পেলো না। তারা খন্দকের ভেতর কয়েক হাজার লাশ রেখে পিছু হটতে বাধ্য হলো। সুলতান আইয়ুবীর জানবাজ কমান্ডো বাহিনী তাদের ধাওয়া করে এগিয়ে গেল খন্দক পর্যন্ত। কিন্তু এত কিছুর পরু খৃষ্টানদের অবরোধ দুর্বল না হয়ে বরং আরো দৃঢ় হলো। সামান্য মুসলিম সৈন্যের এই প্রতিরোধ তাদের ক্ষিপ্ত করে তুললো।

শহরবাসী সৈন্যদের সাথে সুলতান আইয়ুবীর যোগাযোগ চলছিল পত্রবাহী কবুতরের মাধ্যমে। অপর এক যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এক লোক, যার নাম ছিল ইশা আল উমওয়াম। সে চিঠি কোমরে চামড়ার ওয়াটারপ্রুফ বেল্টে ঢুকিয়ে সমুদ্র সাঁতরে শহরে প্রবেশ করতো। রাতের অন্ধকারে সে শহরে আসতো, অন্ধকারেই আবার বিদায় হয়ে যেতো। কখনো প্রয়োজন হলে থেকে যেতো শহরেই।

শত্রুদের জাহাজগুলো ঘিরে রেখেছিল আক্রা শহর। তাকে শত্রুদের নোঙ্গর করা জাহাজের গা ঘেঁষে চলাচল করতে হতো। এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে চিঠি আদন প্রাদান করতো।

সে শহরে নিরাপদে পৌঁছতে পারলে আকাশে কবুতর উড়িয়ে দিত। পায়রাটি উড়ে মুসলমানদের শিবিরে চলে এলে তারা বুঝতে পারতো, ইশা নিরাপদেই শহরে পৌঁছেছে। তারাও তখন তার কবুতর উড়িয়ে ফেরত পাঠাতো।

একদিন রাতে সে এমনি সাঁতার কেটে আক্রা শহরে যাওয়ার জন্য রওনা হলো। ওখানে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাকে দেয়া হলো এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা ও একটি চিঠি। সে স্বর্ণমুদ্রা ও চিঠিটি কোমরে বেঁধে সমুদ্রে নেমে পড়লো।

সে স্বর্ণমুদ্রা ও চিটি নিযে রওনা হয়ে যাওয়ার পর সুলতান আইয়ুবী তার পাঠানো কবুতরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু কোন কবুতর তার কাছে থেকে ফেরত এলো না। সুলতান চিন্তিত হলেন। পরের দিনও কোন কবুতর ফেরত না এলে তিনি মনে করলেন, সে ধরা পড়েছে।

কয়েকদিন পর শহরে সংবাদ পৌঁছলো, ইশার লাশ আক্রা শহরের উপর্কলে ভাসছে। সোনার মোহরগুলো তখনো তার দেহের সাথে বাঁধা। লাশের অবস্থা খুবই খারাপ। ঘটনা হচ্ছে, সে সোনার ভারে সাঁতার দিতে না পারায় ডুবে গিয়েছিল।

আক্রার শাসনকর্তা মীর কারাকোশ ও সেনাপতি আলী ইবনে আহমদ মাশতুত দু’জনই ছিলেন জিন্দাদীল মুজাহিদ। তারা বরাবর সুলতানকে এই খবর পাঠাতে লাগলেন,‘সুলতান, আপনি নিশ্চিত থাকুন, পরিস্থিতি যত নির্মম ও কঠিনই হোক না কেন, কোন অবস্থাতেই আমরা অস্ত্রসমর্পন করবো না। তবে শহরের এই সামান্য সৈন্য দিয়ে অবরোধকারীদের হটিয়ে দেয়া হয়তো আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আপনি বাইরে থেকে খৃষ্টানদের উপর প্রবল চাপ বজায় রাখলে তারা শহরে আক্রমণ করার ফুসরত পাবে না। নইলে তারা শহরে আক্রমণ করে বসতে পারে। খৃষ্টানরা প্রবল ¯্রােতের মতো শহরে ঢুকতে শুরু করলে সামান্য ক’জন মুজাহিদের পক্ষে এখানে টিকে থাকই কঠিন হবে।’ তারা আরো লিখলেন,‘অবরোধ দীর্ঘায়িত হরে শহরে খাদ্য ও অস্ত্রসস্ত্র পাঠাতে হবে। সৈন্য সাহায্য পাঠানো সম্ভব হলে শহরের ভেতর থেকেও অবরোধকারীদের ওপর হামলা করা সম্ভব।’

সুলতান আইয়ুবী বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট ভাবলেন। কিন্তু শহরে সাহায্য পাঠানো এক জটিল সমস্যা। চারদিকে ঘেরাও করে রেখেছে খৃষ্টানরা। এ অবস্থায় ইচ্ছে করলেও তিনি যখন তখন সাহায্য পাঠাতে পারছেন না। এমন কোন ফুটো নেই, যে ফুটো দিয়ে তিনি সৈন্য বা খাদ্য সাহায্য ভেতরে পাঠাবেন।

ইশা আল উমওয়ামের শাহাদাতের পর সুলতান আইয়ুবী আরো একবার স্থলভাগের অবরোধকারীদের ওপর চড়াও হলেন। তবে এবার কেবল আঘাত হেনে শত্রুদের বিপুল ক্ষতি সাধনই তার লক্ষ্য ছিল না বরং অবরোধের জাবাবে পাল্টা অবরোধ করে বসলেন তিনি।

খৃষ্টানদের সামনে শহর এবং শহরে অবস্থানকারী সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা আর পেছনে স্বয়ং সুলতান আইয়ুবী এবং তার ক্ষদ্র বাহিনী।

দু’পাশের শত্রুবেষ্টিত হলেও খৃষ্টানদের দুর্ভাবনার তেমন কিছুই ছিল না। কারণ তখনো ওরা ভাবছিল, সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী এতই নগন্র যে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

খৃষ্টানদের বিশাল বাহিনীর তুলনায় মুসলমানদের বাহিনী হাতির কাছে মশার সমান। কিন্তু দুর্ভাবনার কারণ একটাই, আইয়ুবীর বাহিনী বসে থাকে না এবং ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিও নেয় না। বরং তারা পরিকল্পিতখভাবে একটু একটু করে খৃষ্টান বাহিনীকে খেয়ে ফেলতে চেষ্টা করছে।

সুলতান আইয়ুবীর অবরোধের পর দু’পক্ষেই আবার তুমুল সংঘর্ষ হয়। ব্যাপক ক্ষতি হয় উভয় পক্ষে। তারপর সংঘর্ষের প্রচন্ডতা কমে এলে দুই বাহিনী আবার যার যার অবস্থানে দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

এ সময় সুরতান আইয়ুবীর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ে। তার শরীর জ্বরে পড়ে যাচ্ছিল। অসুখের কারণ, অত্যধিক রাত্রি জাগরণ ও শরীরের উপর বেশী অত্যাচার। তৃতীয কারণ ছিল মানসিক। চারদিক শুধু লাশ আর লাশ। দু’পক্ষেরই সৈনিকদের মৃত লাশ স্তুপ হয়ে পড়ে আছে ময়দানে। পচাঁ ও গলিত লাশের দুর্গন্ধ এত বেশী যে, সেখানে নিঃস্বাস নেয়াই দুঃসাধ্য হয়ে উঠলো।

এ সব কারণে সুলতান আইয়ুবীর শরীর বেশ খারাপ হয়ে গেল। তিন চার দিন তিনি শয্যা থেকে উঠতেই পারলেন না। তিনি শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন, হায়! আক্রা শহরে কি হাত ছাড়া হয়ে যাবে?

সুলতান আইয়ুবী তার তাবুতে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন। তার মুষ্ঠিমেয় কমান্ডো সৈন্য তখনো আক্রার কাছে বিশাল ক্রুসেড বাহিনীর উপরে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। এখন কোন পক্ষই আর দয়ামায়ার ধার কাছ দিয়ে যাচ্ছে না। যে যেখানে যেভাবে পারছে শত্রু নিধন করে যাচ্ছে।

সুলতান আইয়ুবী দশ হাজার সৈন্য শহরে রেখে বাইরে থেকে এতদিন ধরে লড়াই করে যাচ্ছেন তার হাতে গড়া কমান্ডো বাহিনী নিয়ে। তাদের সংখ্যাও ছিল প্রায় সৈন্যদের সমানই।

এদের অনেকেই এর মধ্যে শহীদ হয়ে গেছে। অল্প যে ক’জন বেঁচে আছে তারা ভাসছে রক্তের ওপর। সম্ভবত ফিলিস্তিনের ইতিহাস সবচাইতে রক্তাক্ত সময় পার করছিল সেই দিনগুলোতে।

যুদ্ধ চলছিল প্রতিদিন। কোন পক্ষেই অবরোধ সরানোর কোন লক্ষণ দেখা গেলনা। খৃষ্টানরা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী তাদের সংখ্যাধিক্যের জন্য, মুসলমানরাও আশাবাদী, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সহায় থাকবেন।

সুলতান আইয়ুবী শহরের সৈন্যদের কথা ভাবলেন। আসার সময় তিনি সেখানে যে দশ হাজার সৈন্য রেখে এসেছিলেন যুদ্ধে তাদের অনেকেই শহীদ হয়ে গেছে। তবে বাকীরা এখনো লড়ছে ঈমানের জোরে। এই ঈমানী শক্তির কোন তুলনা নেই। তাদের অর্ধেক সাথী আল্লাহর দরবারে রওনা হয়ে যাওয়ার পরও তাদের সাহস ও তৎপরাতায় কোন ভাটা পড়েনি। অপর পক্ষে এ লড়াই শুরু হওয়ার সময় অবরোধকারী ক্রুসেড বাহিনী ছয় লাখ সৈন্য নিয়ে ময়দানে নেমেছিল। এর মধ্যে তাদের এক লাখের মতো সৈন্য মারা গেছে। তার পরও তাদের সৈন্য এখনো বেঁচে আছে পাঁ লাখের মতো।

সুলতান পাঁচ হাজার মুজাহিদের হাতে এক লাখ খৃষ্টান সৈন্য নিহত হওয়ার পরও খুশী হতে পারলেন না। তিনি হিসাব করে দেখলেন, এই হারে চলতে থাকলে ভেতরের দশ ও বাইরের দশ মোট বিশ জাজার সৈন্যের হাতে মারা যাবে চার লাখ। কিন্তু তখনো খৃষ্টানদের হাতে থেকে যাবে দুই লাখ সৈন্য। তাই তিনি যুদ্ধের ধারা পাল্টাবার প্রয়োজন অনুভব করতে লাগলেন। সুলতান আইয়ুবী ক্রুসেড বাহিনীর পশ্চাতে অর্থাৎ শহরের বাইরে ছিলেন বলে এতদিন যুদ্ধ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। তাঁর কাছে যে দশ হাজার কমান্ডো ছিল তাদের অধিকাংশই ছিল মামলুক বংশের। এদের উপর সুলতানের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল অপরিসীম।

তারা তাঁর বিশ্বাসের অমর্যাদা করেনি। ক্রুসেড বাহিনীর উপর উপর্যুপরি প্রচন্ড আক্রমণ চালিয় বিপুল ক্ষতি সাধন করেছে তাদের। কিন্তু বিশাল বাহিনীকে এই ক্ষুদ্র বাহিনী দিয়ে এখনো অপসারণ করা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। সুলতান গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন।

একে তো তাদের সৈন্য সংখ্যা বহুগুণ বেশী, তার ওপর তারা আইয়ুবীর অশ্বারোহী বাহিনী যাতে অতর্কিত আক্রমণ চালাতে না পারে সে জন্য পথে নানা জায়গায় বড় বড় গর্ত করে রেখেছে। এই সব খন্দক সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যদের জন্য বিরাট অসুবিধা ও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল। কারণ অশ্বারোহীরা দ্রুত আক্রমণ চালাতে গেলেই তাদের ঘোড়া আরোহীসহ গর্তে পড়ে যায়।

খন্দক ছিল আক্রা শহরের বাইরেও। ক্রুসেড বাহিনী সেই খন্দক পার হয়ে শহরে প্রবেশ করতে পারছিল না। ওদিকে ময়দানে লাশের স্তুপ। সেই লাশের দুর্গন্ধে তাদের অবস্থাও কাহিল। কমান্ডাররা সৈন্যদের বললো, ‘এই লাশগুলো তুলে নিয়ে খন্দকে ফেলে দাও’।

বিরাট রণাঙ্গন থেকে লাশগুলো কুড়িয়ে এনে সৈন্যরা সেই লাশ খন্দকে ফেলতে লাগলো। প্রশস্ত খন্দক ক্রুসেড বাহিনীর মৃত সৈন্য ও ঘোড়ার লাশে ভরাট হতে লাগলো।

লাশের গন্ধে ছুটে এলো শত শত শকুন। তারা খন্দকে বসেই সে সব লাশ খেতে লাগলো। এই শকুনের ঝাঁকের মধ্যেও প্রায় প্রতিদিনই একটা পায়রা আক্রা থেকে উড়ে সুলতান আইয়ুবীর ক্যাম্পে যায় আবার সেখান থেকে উড়ে আক্রাতে চলে আসে।

একদিন ইংল্যান্ডের স¤্রাট রিচার্ড তার তাবুর বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সঙ্গে তার বোন জিয়ান ও বগদত্তা রাণী বিরাঙ্গারিয়া।

তিনি লক্ষ্য করলেন, একটি পায়রা একা একা উড়ে যাচ্ছে তাদের মাথার ওপর দিয়ে। তিনি জিয়ানকে বললেন, ‘পায়রাটাকে লক্ষ্য করো।’

জিয়ান বললো, ‘পায়রাটাকে আমি আগেও দেখেছি। সব সময় একাই উড়ে। কখনো ওর সাথে কোন সঙ্গী দেখিনি।’

রিচার্ড তার বোনকে বললেন, ‘এরপর যখনই পাখীটাকে দেখতে পাবে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাজপাখী লেলিয়ে দেবে ওর পিছনে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এই কবুতর আমাদের পরাজয়ের কারণ হতে পারে।’

স¤্রাট রিচার্ডের বংস হয়েছে। তিনি তার যুবতী বোনকে সঙ্গে রেখেছেন তাকে রাজকার্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে তুলতে। তার ইচ্ছা, বায়তুল মোকাদ্দাস জয় হয়ে গেলে দেশে ফিরেই তিনি তার বোনের বিয়ের দিকে মন দেবেন।

এই বোনটির জন্য তার বড়ই মায়া হয়। কিছু দিন আগে বোন জিয়ানকে তিনি সিসিলের স¤্রাটের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কপাল মন্দ বোনের, বিয়ের পরপরই স¤্রাট মারা যান। বোন জিয়ান যৌবন কালেই বিধাব হয়ে ফিরে আসে ভাইয়ের কাছে।

সে এতোই সুন্দরী ছিল যে, হাজার নারীর মাধ্যেও তার রূপ ঝলমল করতো। মনে হতো, রাজকুমারী এখানে একজনই আছে, আর সেই রাজকুমারীর নাম জিয়ান।

জিয়ান স¤্রাটের কথা শুনে হেসে দিল। জিয়ানের হাসি শুনে স¤্রাট রিচার্ড তাকালেন তার দিকে, বললেন, ‘হাসছো কেন?’

জিয়ান তাকে উল্টো প্রশ্ন করলো, ‘ভাইয়া! এই কবুতরটি মারা গেলে সেই সাথে আইয়ুবীও কি মারা যাবেন?’

‘এই কবুতরটি পত্রবাহক, পোষা পায়রা, জিয়ান!’ রিচার্ড বললেন, ‘এই পাখীর এক পাযে একটি চিঠি বাঁধা আছে। আক্রা শহর থেকে চিঠিটা পাঠানো হচ্ছে সুলতান আইয়ুবীর কাছে। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আবার চিঠি লিখে কবুতরটির পায়ে বেঁধে আকাশে উড়িয়ে দেবেন। এভাবেই সুলতানের সব খবর আক্রাবাসী এ চিঠির মাধ্যমে পেয়ে যায়।

আক্রাবাসীদের মনে সাহস ও প্রেরণা জোগায় এ কবুতর। নইলে অবরুদ্ধ কয়েকটি লোক আমাদের বিশাল বাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে এভাবে টিকে থাকতে পারতো না।’

‘এত বিশাল বাহিনী থাকার পরও আপনারা শহরটি গুড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন?’

‘কারণ আমারা ওদের সাথে পারছি না। তুমি দেখতে পাচ্ছো, আমাদের পাথর বর্ষণের ফলে ওদের প্রাচীরের উপরের দিকের কয়েক স্থান ধ্বসে গেছে। কিন্তু তারা অস্ত্র সমর্পন করছে না। এই সাহসের পিছনে আছে সামান্য এই কবুতর। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কবুতরটি যদি সুলতানের সাথে তাদের যোগাযোগ না রাখতো তবে অনেক আগেই তারা আত্মসমর্পন করে ফেলতো।’

‘আপনার আসল লক্ষ্য তো জেরুজালেম, যা এখনও বহু দূরে। আপনারা জেরুজালেম না গিয়ে এখানে বাসে আছেন কেন?’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top