৩. সুবাক দুর্গে আক্রমণ

* * *

বেগার ক্যাম্পে মরার মত ঘুমিয়ে আছে বন্দীরা। প্রহরীও ঘুমিয়ে আছে।

এখান থেকে কেউ কখনও পালায়নি। পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? বন্দীদের কোন রেজিষ্টার নেই বলে দু’একজন পালালেও কেউ জানতে পারেনা।

রাতের প্রথম প্রহর শেষ হয়েছে। পুরনো ছেড়া এক তাবু থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক। হামাগুড়ি দিয়ে তাবুর আড়ালে চলে গেল। এখন প্রহরী সজাগ থাকলেও তাকে আর দেখতে পাবে না।

ক্যামন্পের গেট পেরিয়ে এগিয়ে চলল লোকটি।

ঘুটঘুটে অন্ধকার। সামনে খেজুর বাগানের নীচে আঁধার আরো ঘন। কিছুই দেখা যায় না। ও খেজুর বাগানের দিকে পা চালাল।

ওখানে আপাদমস্তক মোটা কাপড় শরীরে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি।

তাবু থেকে বর হওয়া লোকটা বাগানে ঢুকতেই সন্তর্পনে এগিয়ে এল ছায়ামূর্তি। কাছে এসে বলল, ‘দ্রুত হাঁটতে পারবে হাদিদ?’

‘চেষ্টা করব।’

সিনথিয়া হাদিদের হাত চেপে ধরে বলল, ‘তাহলে চর।  সাবধানে হাঁটতে হবে, নাইটগার্ডের চোখে পড়লে বিপদ হবে।’

ক্যাম্প পেছনে ফেলে অনেক দুরে চলে এল ওরা, সামনে বিপশাল অনাবাদী ভূমি।

হাদিদ দ্রুত হাঁটতে পারছেনা। সিনথিয়া ওকে সাহায্য কারছে হাঁটতে।

চলতে চলতে গোয়েন্দা প্রধান এবং অফিসাররা কি কি বলেছে একে একে সব বলল সিনথিয়া। হাদিদের সকল সন্দেহ দূর হয়ে গেল।

সামনে শহর। শহরে প্রবেশ করেই একটা গলিতে ঢুকল ওরা। কিছুদূর এগিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে ডাক্তারের বাড়ীল সামনে এসে দাঁড়াল।

হাদিদকে অন্ধকারে দাঁড় করিয়ে রেখে এগিয়ে গেল সিনথিয়া। দরজার কড়া নাড়ল তিন চারবার।

বেতরে কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিলেন ডাক্তার। দরজা খুলতেই সিনথিয়া দ্রুত হাদিদকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

হাদিদের ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, ‘সুস্থ হতে কমপক্ষে দিন বিশেষ লাগবে।’

সমস্যায় পড়ল সিনথিয়া। হাদিদকে এতদিন কোথায় লুকিয়ে রাখবে? বেগার ক্যাম্পে নেয়া যাবেনা। সিদ্ধান্ত নেয়ার শক্তি লোপ পেল ওর।

ততোক্ষণে ডাক্তার হাদিদের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন। বললেন, ‘ওকে ভাল খাবার দিতে হবে।’

সিনথিয়া ডাক্তারকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, ‘ও তো গরীব, ও এত ভাল খাবার পাবে কই? আর ওর এমন কেউ নেই যে ওকে দেখাশোনা করবে। আমার বাড়িতেও ওকে নিতে পারছিনা।

এক কাজ করুন, ওকে বরং এখানেই রাখুন। তাতে বারবার ওকে আনা নেয়ার ঝামেলাও কমবে, আর ঠিকমত দেখাশোনা করারও সুবিধা হবে। আমার কাছে বিনিময় এবং পারিশ্রমিক যা চাইবেন দেব।’

ডাক্তার অস্বাভাবিক পারিশ্রমিক দাবী করল। শুনে চোখ কপালে তুলল সিনথিয়া। বলল, ‘ও মাই গড, বলেন কি আপনি?

ডাক্তার বলল, ‘আমাকে দিয়ে একটা বিপজ্জনক কাজ করাচ্ছেন। আমি জানি একে বেগার ক্যাম্প থেকে আনা হয়েছে। ও একজন মিসরীয় সৈনিক। আপনার সাথে ওর সম্পর্ক কি, পারিশ্রমিক বেশী হলে ও গোপন তথ্য আমার ঘরের বাইরে যাবে না।’

‘আমি রাজি। তবে এ গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে পড়লে আপনিও বাঁচতে পারবেন না। ওর পরিচয় যখন পেয়ছেন তখন আশা করি আমার পরিচয়ও আপনার জানা আছে।’

ডাক্তার হাদিদকে অন্য এক কক্ষে নিয়ে গেল। বলল, সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তুমি এখানেই থাকবে।’

দুধ এবং ফল এনে দিল ভেতর থেকে। দরজা বন্ধ করে ফিরে গেল সিনথিয়ার কাছে।

পরদিন সিনথিয়া এবং তার বান্ধবী হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পের কাছে গেল। দেখল ঘুরে ফিরে। কথা বরল প্রহরীর সাথে। কথায় কথায় জেনে নিল হাদিদ যে পালিয়েছে কেউ টের পায়নি।

দিন গিয়ে রাত এল। সিনথিয়ার মত পারিাশ্রমিক পেয়ে ডাক্তার মহাখুশী। মন দিয়ে হাদিদের চিকিৎসা করছে, প্রয়োজনীয় খাবরর দিচ্ছে। নিজেই সেবা শুশ্রুষা করছে।

প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ডাক্তারখানায় আসতো সিনথিয়া। হাদিদের সাথে কথা বলত। সময় কাটাতো ডাক্তারের ঘরে।

এভাবে বিশদিন কেটে গের। হাদিদ এখন সুস্থ।

সিনথিয়। ডাক্তারকে বলল, ‘কাল রাতে ওকে নিয়ে যাব।’

সিনথিয়ার প্রতি দুর্বল ছিল একজন চুনিয়র অফিসার। ওকে ব্যবহার করল সিনথিয়া। অফিসারকে ভঅবাসার কথঅ বলল, মদ খাওয়াল তাকে।

অতিরিক্ত মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গের অফিসার। তার দেহ থেকে সামরিক উর্দি খুলে নিয়ে হাদিদকে পরাল সে পোশাক।

শহরের চারপাশে ছিল মাটির উঁটু দেয়াল। ফটক খোলা হত দিনে। রাতে থাকত বন্ধ।

আয়ুবীল আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সৈন্যরা ছিল বেজায় তৎপর। ওরা ফটক দিয়ে যাওয়া আসা করছিল হরদম।

সূর্য এখনো ডুবেনি। দুর্গের মূল ফটকের দিকে যাচ্ছিল একজন অশ্বারোহী। পরনে খ্রীষ্টান সেনাবাহিনীর উর্দি। কোমরে ঝুলানো খ্রীষ্টান সৈন্যদের তারবারী। চজুলছে মুসলমানদের মত বাঁকা করে নয়, সোজা।

খোলা ফটক। উটের বহর যুদ্ধের রসদ নিয়ে বাইরে যাচ্ছে।

অশ্বারোহী পৌঁছল ফটকে। এ সময় খ্রীষ্টানদের গোয়োন্দা প্রধান ভেতরে ঢুকছীলেন, তাকালেন অশ্বারোহীর দিকে। মৃদু হাসলেন তিনি। অফিসার জবাবে হাসল না, বরং তাকে অগ্রহা্য করেই যেন ফটক পেরোল।

হরমুনের কি মনে হল, ঘোড়ার বলগা টেনে ধরলেন তিনি। কয়েক কদম এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ঘোড়া। তিনি ঘোড়ার মুখ ঘুরালেন।

সিনথিয়া দাড়িয়ে আছে শ’তিনেক গজ দূরৈ। হরমুনকে দেখে আড়ালে সরে গেল সে।

ফটকের দিকে ঘোড়া ছুটালেন গোয়েন্দা প্রধান। একটা সন্দেহ দূর করতে চাইছেন। বাইরে এসে দৃষ্টি ছুড়লেন। অশ্বারোহী অনেক দূর চলে গেছে। তাকিয়ৈ রইলেন তিনি, ঘোড়সওয়ার হারিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে।

সিনথিয়ার সহযোগিতায় হাদিদ পালিয়ে গেছে এ কথঅ আর জানা হল না হরমুনের। কিন্তু সন্দেহটা মনের ভেতর খচখচ করতে লাগল।

ঘোড়া ঘুরিয়ে গোয়েন্দা প্রদান ছুটলেন মুসলিম ক্যাম্পের দিকে। হাদিদের হুলীয়া বর্ণনা করে কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমন কেউ আছে তোমার এখানে?’

কমান্ডার খোঁজ নিল। দেখা গেল এমন কোন লোক নেই এখানে। হরমুনের সন্দেহ দাঢ় হল। ফটকে যাকে দেখেছেন সে হাদিদ কিনা আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি সিনথিয়ার কক্ষে গেলেন।

দু’হাতে মাথা চেপে ধরে কাঁদছে মেয়েটা।

‘তুমিই কি ওকে পালাতে সাহায্য করেছ? গর্জে উঠল হরমুন।

সিনথিয়া ধীরে ধীরে মাথা তুলল।

‘মিথ্যে বরো না, আমি তদন্ত করে সব প্রমাণ করব।’

‘আপনার তদন্তের প্রয়োজন নেই। আমার মিথ্যে বলারও কিছু নেই। আমার জীবনটাই রাজকীয় মিথ্যা, আমি হচ্ছি চোখ ধাঁধাঁনো প্রতারণা। আমার আত্মার মুক্তির জন্য সত্য কথা বলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে আমার কোন আপত্তি নেই।’

টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়াল সিনথিয়া। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল তার। পাশের টেবিলে শূন্য গ্লাসে কয়েক ফোটা পানি।

কাঁপা হাতে গ্লাস তুলে হরমুনের দাকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি আমাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছি। গ্লাসের অবশিষ্ট ক’ফোটা পানি এর সাক্ষী। আমি জাতির সাথে বেঈমানী করেছি বা বন্দী শত্রুকে পালাতে সাহায্য করেছি বলে এ শাস্তি নেইনি। বরং এ অপবিত্র দেহ দিয়ে এমন মানুষের সাথে প্রতারণা করেছি যারপ প্রতারণা বা ধোকা বুঝে না।

আমাদের তো কোন সম্ভ্রম নেই। কিন্তু ওরা চারজন আমাদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য দশ বারোজন দস্যুর মোকাবিলা করেছে। দ্বিধঅহীন চিত্তে বরণ করে নিয়েছে আপন মৃত্যু। অথচ আমাদেরকে ডাকাতের হাতে তুলে দিলে ওরা কোন ক্ষতিরই সম্মুখীন হতোনা।

এরপর এক ব্যক্তি নিজে আহত হয়ে আমাকে দস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করেছে। সে জানত, আমি তার শত্রু, তবু আমার জন্য সে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিল। অথচ আমার প্রতি  তার কোন লোভ ছিলনা।

তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝেছি সত্য মিথ্যার ফারাক। ঘৃণা এবং ভঅলবাসার পার্থক্য। আমি সত্য প্রকাশ করে মরতে পারছি, এ জন্য আমি আনন্দিত। এ মৃত্যু প্রশান্তির, এ মৃত্যু গৌরবের।’

ও পড়ে যাচ্ছিল, গ্লাস সহ ওকে ধরে পেলল হরমুন। ঝটকা মেরে হরমুনের হাত থেকে মুক্ত হযৈ সরে গেল ও।

অস্ফুট স্বরে বরল, ‘আমার দেহ স্পর্শ করোনা। এ দেহ এখন তোমাদের কোন কাজে আসবে না। তোমাদের প্রয়োজন এক অপবিত্র দেহ। এ বিষে আমার দেহ পবিত্র হয়ে গেছে।

ওকে আমি পালাতে সাহায্য করেছী। বিশ দিনব লুকিয়ে রেখৈ চিকিৎসা করেয়েছি। অস্ত্র ও উর্দি চুরু রকে ওকে দিয়েছী। আমার নিজের ঘোড়া দিয়েছি ওকে। ওর সাথে আমি যেতে পারছি না, ওকে ছাড়া থাকতেও পারছী না- এ জন্য বিষ খেয়েছি।’

বিছানায় পড়ে গেল ও। হরমুনের কানে বাজতে লাগল ওর অন্তিম শব্দগুলো।

সত্য বলার পর মৃত্যু কত প্রশান্তির হয় তাই তাকিয়ে দেখছিল হরমুন। চির শান্তির কোলে ঘুমিয়ে পড়ল সিনথিয়া, সেদিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল হরমুন।

সিনথিয়ার শেষকৃত্যের পর েকজন অফিসার বরল, ‘ওর কোন আত্মীয় স্বজন থাকলে মৃত্যু সংবাদ পৌঁছে দেয়া উচিত।’

‘আমরাই ওর আত্মীয়।’ জবাবে বলল হরমুন। ‘ওর বয়স যখন এগার, এক কাফেলা থেকে ্কোে অপহরণ করা হয়েছিল।’

সুলতানের সেনাবাহিনী মিসর ছেড়েছে তিনদিন আগে। পথে বাধা দেয়ার জন্য খ্রীষ্টানদের পাঠিয়ে দেয়অ হয়েছে। সুবাকের বেশীর ভাগ সৈন্য পাঠানো হয়েছে ক্রাকে। নুরুদ্দীন জংগীকে ঠেকানোের জন্য কিছু গেছে সিরিয়ার দিকে। সুসজ্জিত খ্রীষ্টান বাহিনী আয়ুবীকে বাধা দেয়ার জন্য এখন পুরোপুরি প্রস্তুত।

সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবী নিজের বাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করলেন। খানিকটা দুরুত্ব বজায় রেখে ওদের এগিয়ে চলতে নির্দেশ দিলেন। তিন দলে কমান্ডারদেরকে ডেকে পাঠালেন নিজের তাবুতে।

সবাই তাবুতে একত্রিত হর। সুলতান বললেন, ‘এবার গোপন তথ্য প্রকাশ করার সময় এসেছে। আমি বলেছিলাম ক্রাক আক্রমণ করব। কিন্তু তোমাদেরকে অন্য পথে নিয়ে এসেছি। এতে তোমরা নিশ্চয় আশ্চর্য হচ্ছ। আসলে আমি ক্রাকে আক্রমণ করব না। আমাদের লক্ষ্য হল সুবাক।

খ্রীষ্টান গোয়েন্দাদেরকে পাশের কামরায় রেখে যুদ্ধের পরিকর্পনা নিয়ে কথা বলেছিলাম, মৃত্যু দণ্ড না দিয়ে ওদের মুক্তি দিয়েছিলাম, ওদেরকে সুবাক পৌঁছে দেয়ার জন্য দেহরক্ষী দিয়েছিলাম- এর সবকিছইতেই তোমরা আশ্চর্য হয়েছ।

এবার শোন এর হাকীকত। ওদের সাথে যে চারজন রক্ষী দিয়েছিলাম ওদের একজন কাল রাতে সুবাক থেকে ফিরে এসেছে। ডিউক গিয়ে আমাদের কাছ থেকে শোনা যুদ্ধৈর সব পরিকল্পনা ওদের কাছে ফাঁস করে দিয়েছে। আমি জানতাম এমনটি হবে।

আমি যেভাবে চেয়েছিলাম ঠিক সেভাবেই ওরা সৈন্যদের ছড়িয়ৈ দিয়েছে। এখন আমাদের ফৌজের বায়ের অংশ থেকে চার মাইল দূরে রয়েছে খ্রীষ্টানদের বিশাল বাহিনী।

বাম অংশের কমান্ডারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি দু’মাইল সোজাসুজি এগিয়ে যাবে। এরপর বায়ে  মোড় নেবে। চার মাইল এগিয়ে আবার বায়ৈ মোড় নেবে। দেখবে শত্রু সৈন্য বিশ্রাম নিচ্ছে। তীব্য গতিতে কমান্ডো হামলা করবে ওদের ওপর। পথের সবকিছু তছনছ করে আগের জায়গায় ফিরে আসবে।

দ্বিতীয় দর সন্ধ্যার পর আট মাইল সোজা এগিয়ে বায়ের মোড় নেবে। ওদের রসদ এবং খাদ্য সামগ্রী পাবে ওখানে। তোমরা তখন থাকবে শত্রুর পেছন দিকে। দিনে দুশমনের বাম অংশের পিছনে ধাওয়া করবে, কিন্তু সামনা সামনি যুদ্ধ করবে না।

ওরা মোকাবেলা করতে শুরু করলে পিছনে হটবে। আস্তে আস্তে অনেক দূরে পেছনে চলৈ আসবে। যেখানে এসে দেখবে দুটো পাহাড় এক জায়গায় মিলেছে, পাহাড়ের সেই সন্ধিস্থলে নিয়ে আসবে শত্রু সেনাদের। তারপর পাথরকুচির ফাঁক গলে সরে যাবে আরো পেছনে।

মূল আক্রমণ করবে রাতে। খ্রীষ্টান সেনাবাহিনী এগিয়ে এলে মাঝের অংশ পেছন থেকে ওদেরকে আক্রমণ করবে। আমি এক অংশ নিয়ে রাতেই রওয়ানা করব। কাল দুপুর নাগাদ সুবাক অবরোধ করব। বাকী দু’ভাগ মরুভূমির বিশাল এলাকায় ওদের ব্যস্ত রাখবে।

ওদের কাছে যেন রসদ পৌঁছতে না পারে। পানির সবগুলৌ ণর্ষা দখল করে নেবে। আক্রমণ করবে একপাশ থেকে। যুদ্ধ করার জন্য কোথাও দাঁড়াবে না। সুইসাইড স্কোয়াড প্রতি রাতেই ওদের রসদ, পশু এবং খাদ্য বহরের উপর অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করবে।’

সুবাক অবরোধ করলেন সুলতান আয়ুবী, ওখানকার বেশীর ভাগ খ্রীষ্টান ফৌজকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল ক্রাকের পথে।

মরুভূমিতে মুসরিম সেনাবাহিনী ওদের এখান থেকে ওখানে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।

রসদ নেই, পানি নেই। মুসলমানরা সামনাসামনি যুদ্ধ করছে না। সুবাক রক্ষার জন্য এগিয়ে যাবে, মুসলিম বাহিনী সে সুযোগও দিচ্ছে না। বরতে গেলে খ্রীষ্টান বাহিনীর এখন ত্রিশংকু অবস্থা।

সুবাক কেল্লার অল্প সংখ্যক খ্রীষ্টান সৈন্য পাঁচিলে উঠে তীর নিক্ষেপ করছিল সর্বশক্তি দিয়ে। িন্তু স্রোতের মত টুটে পড়ল মুসলিম ফৌজ।

একবা রএদিক থেকে আবার ওদিক থেকে অব্যাহত হামলা চালাতে থাকল। দেড় মাস অবরোধের পর দেয়ার ভেংগে শহরে প্রবেশ করলেন সুলতান আয়ুবী।

পাহাড় ও মরুভূমিতে ধাওয়া খাওয়া বিচ্ছিন্ন খ্রীষ্টান বাহিনী ধীরে ধীরে সমবেত হল ক্রাক-এর দূর্গে। কখন সুলতান ক্রাক আক্রমণ করবেন সে অপেক্ষায় বসে রইল ওরা।

রক্তের বাঁধন

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়। সুবাক দুর্গ আয়ুবীর পদানত হয়েছিল ডিসেম্বরে। শহর এখনও অশান্ত। কিছু কিছু খ্রীষ্টান পরিবার এখনও পালানোর চেষ্টা করছে।

এতদিন মুসলমানরা ওদের জন্য শান্তিতে থাকতে পারেনি। শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল অনেক পরিবার। সুবাকের মাটি লাল হয়ে উঠেছিল মুসলমানদের রক্তে। শঅসকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় লুন্ঠিত হয়েছিল তাদের ঘরবাড়ি।

মুসলমানরা সুবাক দখল করে নিয়েছে। অত্যাচারিত মুসলমানদের প্রতিশোধের ভয়ে পালাচ্ছে এখন খ্রীষ্টানরা।

সুলতান ঘোষণা করলেন, ‘কোন খ্রীষ্টান পরিবারকে পালাতে হবে না। নিশ্চিন্তে ওরা নিজেদের বাড়ীতে থাকতে পারবে। ওদেরকে কেউ উত্যক্ত করবে না।’

তিনি পলায়নপর খ্রীষ্টানদের বাধা দেয়ার জন্য মুসলিম সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ পেয়ে সৈন্যরা তৎপর হয়ে উঠল।

ওরা কাউকে পালিয়ৈ যেতে দিচ্ছে না। যারা পালিয়ে গেছৈ তাদের খুঁজে আনছে মরুভূমি আর উপত্যকা থেকে। ওদের ছেড়ে যাওয়অ বাড়ী ঘর ওদের বুঝিয়ে দিয়ে বলছে, ‘তোমাদের কোন ভয় নেই। মুসলমানরা তোমাদের ওপর কোন প্রতিশোধ নেবেনা। তোমরা নিশ্চিন্ত, স্বাধীন।’

খ্রীষ্টানরা তবুও ভয় পাচ্ছিল। মুসলমানদেরকে ওরা শান্তিতে থাকতে দেয়নি। প্রায় দু’হাজার মুসলমান এখনও বেগার ক্যাম্পে মানবেতর কাল কাটাচ্ছে।

সুবাক দখল করে সুলতান আয়ুবী প্রথমেই গিয়েছিলেন বেগার ক্যাম্পে। দু’হাজার বন্দী যেন  মৃত লাশ। ওদের পশুর মত খাটানো হয়েছে। শহরের নোংরা আবর্জনা বহন করেছে ওরা। অনেকে এসেছে যৌবনে। এখন বৃদ্ধ। ভুলে গেছে ওরাো স্বাধীন  মানুষ ছিল এককালে।

খ্রীষ্টানদের সাথে প্রথম যুদ্ধে যেসব মুসলমান বন্দী হয়েছে তাদেরকে যেমন এখানে রাখা হয়েছে তেমনি শহর থেকে জোর করে ধরে আনা বন্দীদেরও এখানেই রাখা হয়েছে।

তবে কাফেলা থেকে অপহরণ করে আনা বন্দীর সংখ্যাই এখানে বেশী। এদোে কেউ ছিল ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, কেউ সুন্দরী যুবতী কন্যার পিতা। খ্রীষ্টানরা ওদের ধন সম্পদ কেড়ে নিয়েছে এবং যুবতী মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। এদের একমাত্র পরাধ ছিল ওরা মুসলমান।

খ্রীষ্টানদের ভয়ে শহরের মুসলমানরা সব সময় তটস্ত হয়ে থাকত। ওরা নামাজ পড়ত গোপনে, কোরান তেলাওয়াত করত অনুচ্চ স্বরে। মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে যেতে দিতনা। সুন্দরী মেয়ে ওদে রচোখে পড়লে রক্ষে নেই। যে কোন বাহানায় তুলে নিয়ে যাবে।

সম্ভ্রান্ত মুসলমানকেও একজন সাধারণ খ্রীষ্টানকে ঝুঁকে কুর্ণিশ করতে হত। এসব অত্যঅচারের কথা মনে ছিল বলেই এখন প্রতিশোধের আশঙ্কায় খ্রীষ্টানরা সপরিবারে পালিয়ে যাচ্ছিল।

বেগার ক্যাম্পের দু’হাজার জীবন্ত লাশের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলৈন সুলতান। তার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু অশ্রু। এক সময় আবেগ ভরা কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘ওদের মুক্ত করার বিনিময়ে আমি সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ছেড়ে দিতে পারি।’

তিনি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিলৈন, ‘এরা এখানেই থাকবে। তোমরা এদের থাকা খাওয়া এবং সুচিকিৎসার ব্যবস্থা কর। এরা আগে সুস্থ হোক, তার পর সিদ্ধান্ত নেব এদের কি করা যায়।’

সুলতানের যুদ্ধপলিসির কাছে খ্রীষ্টানরা হেরে গেছে। বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে মুসলমানদের কমান্ডো হামলা ওদের অতিষ্ঠ করে তুলছিল। বিপদে পড়ে পেছনে সরে যাচ্ছিল ওরা।

সুলতান আশংকা করছিলৈন ক্রাক দুর্গ থেকে খ্রীষ্টান সেনাবাহিনী ওদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে। ওদের বাধঅ দেয়অর জন্য সুলতানের কাছে পর্যাপ্ত সৈন্য ছিল না। ও মুহূর্তে মিসর থেকেও সৈন্য আনা সম্ভব নয়। ফাতেমী খেলাফতের পতনের পর মিসর হয়ে পড়েছিল ষড়যন্ত্রের লীলাভূমি। গাদ্দাররা যে কোন সময় প্রশাসনের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।

এ পর্যন্ত গাদ্দারী আর ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তিনি যাদের মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই মুসলমান এ জন্য সুলতানের হৃদয় ছিল বেদনা ভারে জর্জরিত।

সুবাক কেল্লার পশ্চিম প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুলতান আয়ুবী, সাথে সামরিক বেসামরিক উপদেষ্টাবৃন্দ।

শহরের মুসলিম অধিবাসীরা খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসছিল। অন্যদিকে ছিল শহীদদের বহনকারী উটের সারি। সুলতান গভীল চিন্তায় ডুবেছিলেন।

আনন্দ মিছিল থেকে ভেসে আসছিল শানাইয়ের সুর ঝংকার। উল্লসিত জনতা পাচিলের পাশে এসে থামল। সেদিকে তাকিয়ে রইলেন আয়ুবী।

তার নির্বাক ঠোঁটে কোন হাসি নেই। তিনি দেখছিলেন মুসলমানদের উচ্ছসিত আনন্দ। ওরা নাচছে পাগলের মত। মিছিল থেকে কেউ কেউ চিৎকার দিয়ে বলছে, ‘নাজমুদ্দীনের ছেলে সালাহউদ্দীন আয়ুবী সুবাকে তোমাকে স্বাগতম। তুমি এক মুক্তিদূত। তুমি সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান।’

মিছিল থেকে শ্লোগান উঠল, ‘কুর্দির কৃতি সন্তান আয়ুবী আমরা তোমায় সিজদা করি।’

জেগে উঠল আয়ুবীর ঈমানী চেতনা। দরাজ কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আমায় গুনাহগার করো না বন্ধুরা। আমি আল্লাহর এক নগন্য গোলাম মাত্র। আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সিজদা করা বৈধ নয়।’

কিন্তু তার কথায় কেউ কান দিল বলে মনে হলোনা। তারা আগের মতই লাফাচ্ছে, শ্লোগান দিচ্ছে।

একজন সেনা অফিসারকে ডেকে তিনি বললেন, ‘ওদের এসব বলতে নিষেধ কর। বলবে, এসব শ্লোগানে সুলতান রাগ করেন।’

সেনা অফিসার হাঁটা দিতেই আবার তাকে ডেকে বললেন, ‘শোন, ওদের ধমকের সুরে নয়, শান্তভাবে বলবে। ওরা যেন মনে ব্যাথা না পায়। ওদের নাচতে দাও, গাইতে দাও। ওরা জুলুমের জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়েছে সে জন্য আমিও খুশী। আমার জীবন এই মজলুম মানুষগুলোর জন্যই। কিন্তু আমার নামে শ্লোগান দেয়ার দরকার নেই। বিশেষ করে আমাকে সিজদা করার  মত নাজায়েয কথা যেন কেউ না বলে।’

তিনি আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল তার কণ্ঠ। তিনি আর কিছুই বলতে পারলেন না। আবেগে চোখে এসে জমা হল অশ্রুরাশি। উদগত অশ্রু আড়াল করার জন্য তিনি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

একটু পর সবার দিকে নজর বুলিয়ে বললেন, ‘আমরা এখন ফিলিস্তিনের আঙ্গিনায় পা রেখেছি। মঞ্জিল এখনও অনেক দূরে। এ মরুভূমি রোম উপসাগর ঘুরে সেখান থেকে পশ্চিমে মোড় নিয়েছে, আমাদের যেতে হবে সেখান পর্যন্ত। শত্রুদের ক্রুশ ডুবিয়ে দিতে হবে রোম উপসাগরের অথৈ জলে।’

সুলতান শহর-প্রধানকে বললেন, ‘প্রতিটি অলীগলিতে ঘোষণা করে দাও, ‘কোন অমুসলমানের প্রাণ-ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার দরকার হবে না। কেউ তাদের উত্যক্ত করবে না। যদি কোন নাগরিক কাউকে বিরক্ত করে সরাসরি দূর্গের ফটকে এসে অভিযোগ করবে। প্রশাসন প্রতিটি নাগরিকের সমস্যা দূর করার চেষ্টা করবে।

আমি আবারও বলছি, আমরা কাউকে কষ্ট দিতে আসিনি। আসিনি কারও বিপদের কারণ হতে। আমরা এসেছি স্নেহ ও ভালবাসার বারতা নিয়ে। ইসলামী সরকারের বিরুদ্ধে কোন তৎপরতার বিচার ইসলামী আইনেই করা হবে। এ আইন মসুলিম অমুসলিম সকলের জন্য সমান।

শহরে যদি খ্রীষ্টানদের কোন গুপ্তচর লুকিয়ে থেকে থাকে আশ্রয়দাতা সহ তাকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার জন্য আমি জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’

উপদেষ্টাদের নিয়ৈ পাঁচিল থেকে নেমে এলেন সুলতান। প্রথমেই গোয়োন্দাদের সদর দপ্তরে তল্লাশী নেয়া হল। কোন কাগজপত্র পাওয়া গেল না। খ্রীষ্টানদের গোয়েন্দা প্রধান হরমুন এবং তার সংগীরা পালিয়ে গেছে।

আটজন তরুণী গোয়েন্দা পালাতে পারেনি। তাদেরকে আলী বিন সুফিয়ানের হাতে তুলে দেয়া হল। জবানবন্দীতে ওরা বলল, ‘মেয়েদের সবাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে পালিয়েছে। কোন পুরুষ ওদের সহযোগিতা করেনি।’ ওরা আরও জানাল, ‘লুজিনা (এটা সিনথিয়া হবার কথা? লুজিনা লিখা কেন?) নামে আমাদের এক সঙ্গিনী ছিল। একজন মুসলমান সৈন্যকে পালাতে সাহায্য করে সে নিজে আত্মহত্যা করেছে।

আলী ওদের নিরাপত স্থানে আটকে রাখলেন।

নিরাপত্তা এবং শান্তি সৃষ্টির জন্য সুলতানের নির্দেশে তৎপর ছিল সুবাকের প্রশাসন।

ক্রাকের খ্রীষ্টান শিবিরে চলছিল সুবাক আক্রমণের পরিকল্পনা ।কিন্তু আয়ুবীলর পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে তা নিশ্চিত না হয়ৈ চটজলদি কিছু করে বসার বোকামী করতে আর রাজী নয়, তাই ওদের তৈরী হতে হচ্ছিল।

বিশেষ করে সুবাকের বিপর্যয় তাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। যেকানে গোয়োন্দাদের কাছ থেকে তারা নিশ্চিত রিপোর্ঠ পেয়েছিল সুলতান আয়ুবী ক্রাক আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কায়রোরহ অন্যঅন্য এলাকার গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকেও একই রকম তথ্যাই পাওয়া যাচ্ছিল, তারা এ খবরও পেয়েছিল যে আয়ুবীর নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনী ক্রাকের দিকে যাত্রা করেছে এবং তারা দ্রুত এগিয়ে আসছে। ফলে আয়ুবীর উদ্দেশ্য ছিল তাদের কাছে স্পষ্ট। এজন্য পথেই মুসলিম বাহিনীকে বাধা দেয়ার সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করা হয়েছিল। কিন্তু এসবই যে ছিল সুলতানের সাজানো খেলা, বিস্ময়কর যুদ্ধ চাল তা কে জানত।

শেষ মুহূর্তে দেখা গেল সুলতান ক্রাকে আক্রমণ না করে সুবাকে হামলা করলেন। মুসলিম বাহিনীর অগ্রাভিযান রোধ করার জন্য যাদের পাঠানো হয়েছিল পথে ওঁৎ পেতে থাকা সেই সব খ্রীষ্টান সৈন্যরা অযাচিত কমান্ডো হামলার শিকার হল। অথচ যুদ্ধৈর সমুদয় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল গোয়েন্দাদের নিশ্চিত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই।

ক্রাকের খ্রীষ্টান শিবিরে কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়েছে। কয়ৈকজন সম্রাট এবং সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এতে শরীক হয়েছেন। অপরাধীর বেশে এসেচেন গোয়োন্দা প্রধান হরমুন। আলেমরূপী গোয়েন্দা ডিউককে আনা হয়েচে হাতে হাতকড়া পরিয়ে। তার ভুল তথ্যৈর কারণে খ্রিষ্ঠান সৈন্যরা পরাজিত হয়েছে, হাতছাড়া হয়েছে সুবাকের মত গুরুত্বপূর্ণ দূর্গ।

এ তথ্য কিভাবে পেয়েচে ডিউক আবার কনফারেন্সে তা শুনালো। সব শেষে বললো, ‘আমার দেয়া তথ্যে সন্দেহ হলে আপনারা সে অনুযায়ী কাজ করলেন কেন? গোয়েন্দা সংস্থা এ নিয়ে কেন যাচাই বাছাই করেনি?’

হরমুনকে প্রশ্ন করা হল, ‘গোয়েন্দা বৃত্তিতে অভিজ্ঞ হওয়ার পরও কিভাবে আপনি এ ভুল করলেন?’

হরমুন বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমার অনেক কিছু বলার আছে। অবশ্যই আমি গুপ্তচর বৃত্তি এবং গোয়োন্দা কাজে অভিজ্ঞ। এরপরও কোন কোন ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা এবং পরিশ্রমকে ওভারলুক করা হয়েছে।

আমাদের পরাজয় আমার একার ভুলে হয়েছে এ কথা বলার কোন অবকাশ নেই। সত্য প্রকাশের খাতিরে আমাকে কিছু তিক্ত কথা বলতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত।

আমি সেই সব সেনাপতি ও শাসকদের হুকুমের সামনে অসহায় ছিলাম যারা আমার পরামর্শের তোয়অক্কা না করে আমার যোগ্যতাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। এখানে তিনজন সম্রাট এবং সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ রয়েছেন। কেন আমরা পরাজিত, সুবাক হাত ছাড়া হল কেন, এক বিশাল এলাকা কেন আমাদেরকে হারাতে হল, এক্ষেত্রে আমাদের ভুগুলি কি ছিল তা কনফারেন্সে তুলে ধরা আমার কর্তব্য বলে মনে করছি।

যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে বিনয়ের সাথে বলতে চাই আমরা সবাই ক্রশ হাতে নিয়ে শপথ করেছিলাম। শপথ করেছিলাম ক্রুশের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেব। ব্যক্তিগত মর্যাদা নয় ক্রুশের মর্যাদা বৃদ্ধিই আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু আমরা অনেকেই আমাদের শপথের মর্যাদা রক্ষা করতে পারিনি।’

কোনার্ড, গে অব লুজিনাম এবং শাহ অগাষ্টাস-এর মত আত্মম্ভর সম্রাটগণও হরমুনের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে বলার সাহস পেতেন না। গোয়েন্দা জগতে তার ছিল একচ্ছত্র ক্ষমতা। যে কোন শাসককেই তিনি গুপ্তভাবে হত্যা করতে পারতেন।

কনফারেন্সের পিনপতন নিরবতার মাঝে হরমুন প্রশ্ন করলেন, ‘বুঝতে পারছি না শত্রুর গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য মেয়েদের ব্যবহার করা হচ্ছে কেন?’

‘কারণ নারী হচ্ছে মানুষের সবচে বড় দুর্বলতা।’ কোনার্ড বললেন। ‘মানুষের চরিত্র নষ্ট করার জন্য নারীল বিকল্প নেঈ। তোক সে রক্ত মাংসের মানুষ বা সাহিত্যৈর মোড়কে নারীর শারীরিক বর্ণনা। তুমি কি অস্বীকার করতে পার হরমুন, নারীদের দিয়েই আমরা আরবের অনেক আমীল ওমরাকে আমাদের গোলামে পরিণত করেছি?’

‘না অস্বীকার করিনা। কিন্তু এখন মুসলিম শাসন আমীর ওমরাতের হাতে নয়, সেনাবাহিনীল হাতে। মিসরের শাসক একজন গভর্ণর হয়েও খলীফাকে বরখাস্ত করেছেন। সুরুদ্দীন জংগী একজন সেনাপতি এবং মন্ত্রী। তিনিও কেন্দ্রীয় নির্দেশের তোয়াক্কা করেন না।

এ জন্যক ‘জন আমীল ওমরাকে হাত করলে বড়জোর ক’জন গাদ্দার বৃদ্ধি পাবে। ওরা দেশৈর এক ইঞ্চি মাটিও আপনাদের দিতে পারবে না।

এখন সেনাবাহিনীর হাতেই সর্বময় ক্ষমতা। আয়ুবী এবং জংগী সৈন্যদেরকে এমন ট্রেনিং দিচ্ছে নারীদের দিয়ে আপনারা ্দের নৈতিক স্খলন ঘটাতে পারছেন না এবং পারেননি। ইসলাম মদ হামা করেছে। ফলে সৈন্যদের জন্য মত কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। তাই কেউ বিবেকশূন্য হয়না। আয়ুবী মদে অভ্যস্ত হলে বিজী হয়ে নয় সুবাক আসত বন্দী হয়ে।’

‘হরমুন,’ বিরক্তি প্রকাশ করল এক সেনাপতি, ‘তোমার কথা মেয়েদের মধ্যেই সীমাবন্ধ রাখ। মুসলমানের প্রশংসা শোনার জন্য আমরা এখানে আসিনি।’

‘আমি বলতে চাই, গুপ্তচর বৃত্তিতে মেয়েদের ব্যবহার করে আমরা ব্যার্থ হয়েছি। গত দু’বছরে মিসর পাঠিয়ে আমরা অনেক মূল্যবান মেয়ে হারিয়েছি। মনে রাখতে হবে মেয়েরা সাধারণভাবেই আবেগ্রবণ। যত ট্রেনিং-ই দেয়া হোক ওরা পুরুষের মত কঠিন হতে পারে না।

আমরা ওদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার কির। কখনও অবস্থা পাল্টে যায। যুবতীদেরকে ভোগ না করে বরং নিরাপদ আশ্রয় দান করে মুসলমানরা। এর ফলে মেয়েদের ভেতর প্রচন্ড আবেগ জন্ম নেয়। ওদের চারিত্রিক দৃঢ়তায় অভিভুত হয়ে অনেকেই তাদের ভক্ত হয়ে যায়।

কিছুদিন পূর্বে সালাহউদ্দীনের এক কমান্ডার আমাদের একটা মেয়েকে দস্যুর কবল থেকে মুক্ত করে নিজে আহত হযৈ পড়ে। মেয়েটা কমান্ডারকে সুবাক নিয়ে এসেছীল। আমরা তাকে মুসলমানদের ক্যাম্পে স্থানান্তর করেছীলাম। মেয়েটা আমাদের এক অফিসারের উর্দি পরিয়ে তাকে দুর্গ থেকে পালাতে সাহায্য করেছে। হোষ্টেলে ফিরে নিজে বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে। মৃত্যুর সময় আমি ওর পাশে ছিলাম। আমাদের শাস্তির ভযৈ ও আত্মহত্যা করেনি। প্রতারণার জালে আটকে গিয়ে নিজের দেহ ব্যবহার করেছে, এ অনুভূতি ওকে বিষপানে বাধ্য করেছে।

এ প্রসঙ্গে আমি আরও দু’একটা উপমা দিচ্ছি। আমাদের বেশীল ভাগ গোয়েন্দা মেয়েকে শৈশবে কোন মুসলিম কাফেলা বা মুসলমানদের বাড়ী থেকে অপহরণ করে এসেছি। পরে ওদেরকে আমাদের ধর্মের রঙে রাঙিয়ৈ ট্রেনিং দিয়েছি। যৌবনে এসে মেয়েরা ভুলে গেছে তাদের অতীত, তাদের মৌলিক অস্তিত্ব। ওরা জানেনা ওরা মুসলিম ঘরের সন্তান। আমরা ওদের নাম, ধর্ম এবং কর্ম বদলে দিয়েছী, কিনতউ ওদের রক্ত পরিবর্তন করতে পারিনি।

আমি মানুষের সাইকোলজি বুঝি। মুসলমানের মানসিকতা অন্য সব ধর্মের অনুসারীদের মানসিকতারচে ভিন্ন। এসব মেয়েরা কোন মুসলমানের হাতে পড়লে অস্তিত্বে নতুন অনুভূতি জন্ম নেয়,। সে তখন ভাবে আমার দেঞেও বইছে মুসলিম পিতার রক্ত। মুসলিম রক্ত থেকে ইসলামকে কোন ভাবেই আলাদা করা যায় না।’

‘তুমি কোন মেয়েকে গেয়েন্দা কাজে পাঠাতে চাইছ না’ এক সেনাপতি প্রশ্ন করল।

‘না, কারণ সে সব মেয়ের দেহে মুসলিম রক্ত বইছে। আমার সংস্থা থেকে মেয়েদের বাদ দিলেই বরং ক্রুশের জন্য ভাল হবে। আপনারা মুসলমান আমীল ওমরাদের হারেমে মেেদের পাঠিয়ে সহজেই ওদের মিকার করতে পারছেন। কারণ ওরা যুদ্ধৈর ময়দান দেখেনি। আমাদে রতারবাীল সাথে ওদের তরবারী সংঘর্ষ হয়নি। শুধু সৈন্যরাই আমাদের চেনে। সেনাবাহিনীই কেবল দুশমন এবং বন্ধুর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। এজন্য ওরা আমাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দেয় না।’

সম্রাট অগাষ্টাস ছিলেন জটিল ও কুটিল মনের অধিকারী। মুসলমানদের বিরোধিতায় অন্যদের তুলনায় একধাপ এগয়ে ছিলেন তিনি। বললেন, ‘তোমার দৃষ।টি সীমাবদ্ধ হরমুন। তুমি দেখছ নুরুদ্দীন জংগী এবং সালাহউদ্দীন আয়ুবীকে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ইসলাম। আমরা এ ধর্মটাকে নিশ্চিহ্ন রকে দিতে চাই। এ জন্য প্রয়োজন ওদের নৈতিকস্খলন।

ওদের চিন্তা চেতনায় সন্দেহ সৃষ্টি করতে হবে। মুসলমানদেরকে এক আকর্ষণীয় সংস্কৃতির জালে আটকে ফেল। আমরা বেঁচে থাকতেই এ উদ্দেশ্য পুরণ হতে হবে এমন কোন কথা নেই। পরবর্তী প্রজন্মের হাতে দিয়ে যাব আমাদের দায়িত্ব। এরপর এমন একক সময় আসবে যখন ইসলামের নাম নিশানাও থাকবে না। থাকলেও সে ধর্ম থেকে জন্ম নেবে না কোন নুরুদ্দীন বা আয়ুবী।

আমি দৃঢ়তার সথে বলছি, ধর্শ হবে মুসলমানদের নিজস্ব, কিন্তু তা রদেহে থাকবে আমাদের সভ্যতা এবং সংস্কৃতির পোশাক। আমাদের চিন্তা চেতনায় রঙ্গীন হবে ওই ধর্ম।

হুরমুন, আজ থেকে শত বর্শষ পরে দেক। জয় পরাজয় ক্ষণস্থায়ী। আবার আমরা সুবাক জয় করব। মিসরে ষঙযন্তের জাল বিছিয়ে দাও। ফাতেমী, সুদানী এবং কাফ্রীদের সাহায্য কর। ব্যবহার কর গুপ্ত ঘাতকদের। জিজীয় আমরাই হত। ওদের সভ্যতা সংস্কৃতি, ওদের চিন্তা চেতনা এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্ব হবে আমাদের।

কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করল একজন খ্রীষ্টান অফিসা। লুলোমলিন চেহারা। আয়ুবীকে পথে বাধা দেয়ার জন্য পাঠানো একটা দলের কমান্ডার। এরা মুসলীম কমান্ডো বাহিনীল চাপে ক্রাকের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছিল।

উদ্বিগ্ন কণ্ঠে কমান্ডার বলল, ‘আমাদের সৈন্যদের অবস্তঅ ভাল নয়। এ পরিস্থিতিতে আমি একটা প্রস্তাব পেশ করতে চাই।’

‘কি তোমার প্রস্তাব?’ কোনার্ড বললেন।

‘ক্রাকে অবস্থানকারী সৈন্যদের সাথে আরও কিছু যোগ করে এ মুহূর্তে সুবাক আক্রমণ করা উচিৎ। এতে মুসলমানরা সামনা সামনি যুদ্ধ করতে বাধ্য হবে। কেন্দ্রের নির্দেশৈ আমাদের ফৌজ ক্রাকের দিকে পিছিয়ে আসছে। মুসলমানদের কমান্ডো বাহিনী ্রাতে আচম্বিত আক্রমণ করে পালিয়ৈ যায়। তীরন্দাজ গ্রুপ হঠাৎ করেই তীর বর্ষন শুরু করে। ওদের টার্গেট আমাদে ঘোড়া এবং উট। আহত পশুগুলো বেসামাল হয়ে দিকবিদিক ছুটতে থাকে। আমরা জওয়াবী হামলা করতে যাব ততোক্ষণে ওরা হাওয়া হয়ে গেছে। ওরা সামনা সামনি যুদ্ধ করছে না। ওদের মনমত স্থানে এনে ওরা আমাদের অনেক সৈন্য হত্যা করেছে। সাহস হারিয়ে ফেলছে আমাদের সৈন্যরা। এভাবে আর কদিন চলবে? এজন্য আমার পরামর্শ হচ্ছে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে আমরা ওদেরকে মুখোমুখী যুদ্ধ করতে বাধ্য করব।’

এ বিষয়ের ওপর আলোচনা শুরু হল।

এ মুহূর্তে আক্রমণ করার জন্য ওদের সামনে বড় সমস্যা হল লড়াকু সৈনিকদের বেশীল ভাগই বিস্তৃত মরুতে ছড়িয়ৈ ছিটিয়ৈ আছে। ভীষণ বিপদে আছে ওরা। মুসলিম ফৌজ দিনে লুকিয়ে থৈকে রাতে গেরিলা আক্রমণ করছিল। সুবাকে রউত্তরপূর্ব সীমান্তে পাঠানো খ্রীষ্টান ফৌজের কোন কাজ ছিল না। নুরুদ্দীন জংগীর আক্রমণের বয়ে ওদের আনাও যাচ্ছিল না।

অন্যদিকে নগন্য সংখ্যাক সৈন্য নিয়ে সুবাকে অবস্থঅন করছিলেন সুলতান আয়ুবী। তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন। খ্রীষ্টানদের পাল্টা আক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তার ছিল না। কিন্তু বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে তিনি খ্রীষ্টানদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন। যার ফলে খ্রীষ্টান বাহিনী প্রতি -আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। খ্রীষ্টানদের পরিকল্পনা জানার জন্য ক্রাকে অনেক গুপ্তচর পাঠিয়েছিলেন সুলতান আয়ুবী। খ্রীষ্টানদের ছদ্মবেশে ওরা ক্রাকে প্রবেশ করেছিল। গোয়েন্দাদের ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সমগ্র মরুভূমিতে। ওরা সুলতানকে নিয়মিত যুদ্ধের সংবাদ সরবরাহ করছির। সুবাকের আশপাশের এলাকা থেকে নতুন সৈন্য ভর্তি শুরু করে দুর্গেই ওদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হল। ওদের দেয়া হল খ্রীষ্টান বাহিনীর ফেলে যাওয়া উট, ঘোড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র।

মরুভূমিতে যুদ্ধরত সৈন্যদের তিনি নির্দেশ পাঠালেন, পশুগুলো না মেরে যেন দুর্গে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

‘ক্রাকের কনফারেন্সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মেয়েদের ব্যবহার না করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হল। ছেড়ে দেয়া হল আলেম গোয়েন্দাকে। তাকে বলা হল, মুসলমানদের সংস্কৃতি এবং চিন্তা-চেতনা পরিবর্তন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে।

হরমুনকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘সুবাকে এখন কতজন গোয়েন্দা রয়েছে?’

জবাবে হরমুন বলল, ‘কয়েকজন মেয়ে এবং পুরুষ মুসলমানদের হাতে ধরা পড়েছে। পুরুষদের বেশীল ভাগই সুবাক রয়ে গেছে। কয়েকজন গেয়োন্দা পালিয়ে এসেছে। গুটি কতক মেয়ের সন্ধান পাওয়া যায়নি। মুসলমানদের ছদ্মবেশে কাজ করার জন্য আমি পুরুষ গোয়েন্দাদের খবর পাঠিয়েছি।’

কোনার্ড বললেন, ‘বন্দী মেয়েদের হায়ত মুক্ত  করা যাবে না। খ্রীষ্টানদের ঘরে যে সব মেয়ে আত্মগোপন করে আছে তাদেরকে বের করে আনা উচিৎ।’

সিন্ধান্ত হল সুলতান আয়ুবীর কমান্ডো বািনীর মত বিভীন্ন ভাষায় পারদর্শী আত্মত্যাগী একটা গ্রুপ তৈরী করে সুবাক পাঠাতে হবে। ওরা বলবে ক্রাকের খ্রীষ্টান নির্যাতনের কারণে ওরা পালিয়ৈ এসেছে। ওদের কাজ হবে গোয়েন্দা মেয়েদর খুঁজে আমাদে কাছে পৌঁছে দেয়া। সাজাপ্রাপ্ত সে সব বন্দীদেরকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছিল ওদেরকে ও গ্রুপের সদস্য করবে। যারা সুবাক ছিল প্রাধান্য দেবে তাদের।

সুলতান আয়ুবীর ফৌজ বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ৈ মরুভূমি ছড়িযে গিয়েছিল। কেউবা পথ ভুলে পাহাড়ের ফাঁকে ক্ষুৎপিপাসায় মৃত্যু বরণ করছির। খ্রীষ্টান বাহিনী ইচছে করলৈই প্রতি-আক্রমণ করে সুবাক ফিরিয়ে নিতে পারত। কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যাপারে মনযোগ দিতে গিয়ে এ দিকে তারা দৃষ্টি দিতে পারেনি।

আয়ুবীকে দুর্বল করার জন্য নুরুদ্দীন জংগীর সাথে আয়ুবীল সম্পর্ক নষ।ট করার প্রয়োজন ছিল। এ জন্য গোয়েন্দারা ছিল তৎপর। নুরুদ্দীন জংগীকে বুঝানো হল আয়ুবী কোন খেলাফতের তোয়াক্কা করে না। নিজেই স্বাধীন সুলতান হওয়ার জন্য রাজ্য বিস্তারে মন দিয়েছে।

এ সংবাদ আয়ুবীল পিতা নজমুদ্দীন এর কানে গেল। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে তিনি সুবাক পৌঁছলেন এর সত্যতা যাচাই করার জন্য। পিতাকে সুবাকে দেখে আশ্চর্য হলেন সুলতান। ভাবলেন সুবাক বিজয় করায় তিনি ধন্যবাদ দিতে এসেছেন। মোসাফেহা করে তার হাতে চুমো খেলেন।

মুখ খুললেন নজমুদ্দীন আয়ুব। ‘আমার  মত এক অখ্যাত ব্যক্তির সন্তানকে মিসরের গভর্নর করে জংগী কি ভুল করেছেন? নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আমার ছেলে জংগীর শত্রু হয়ে গেছে, এ কথাও আমায় শুনতে হল। যাও, গিয়ে নুরুদ্দীন জংগীর কাছে ক্ষমা চাও।’

সুলতান পিতাকে বুঝালেন। বললেন, ‘আমি মাননীয় জংগীর কাছে সাহাডৌের জন্য আবেদন করতে চেয়েছি।’

তিনি নুরুদ্দীন জংগীল কাছে চিঠি লিখে ইসা আল হুকারীর হাতে দিয়ে পিতার সাথে রওয়ানা করিয়ে দিলেন। সাতে সুবাকের কিছু উপহার সামগ্রী। তিনি লিখলেন, ‘সবচে মূল্যবান সুবাক দর্গ আপনার পদতলে নিবেদন করছী। ইনশাল্লাহ ক’দিন পর ক্রাকের দুর্গও আপনার খেদমতে পেশ করব। খ্রীষ্টানদের ষড়যন্ত্রের সাথে কিছু মুসলিম আমীর ওমরাও জড়িত। বিধর্মীদের চাইতে ওরই ইসলামের বড় ক্ষতি করছে।

ইসলামের জন্য লড়াই করছে সেনাবাহিনী। মরুর বালুকারাশি শুষে নিচ্ছে ওদের তাজা রক্ত। মরুর নেকড়ে আর শকুনের আহার হচ্ছে ওদের লাশ। আপনর আত্মীয় স্বজন ছেড়ে মরুর বিশাল বিস্তারে শত্রুর পেছনে ঘুরে মরছে ওরা। ওরা ইসলামের মর্যাদা য্দদুর বুঝতে পারে অন্য কেউ তা পারে না।

অসামরিক আমীল ওমরারা যুদ্ধের ময়দান থেকে অনেক দূরে নিরাপদে অবস্থান করে। ইসলামের জন্য, দেশের জন্য ওদের রক্ত ঝরে না। ওরা হারেমের আনন্দে ডুবে থাকে সর্বক্ষণ। ইসলামের দুশমনের সাথে হাত মিলিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে।

আমি যখন ফিলিস্তিনের আঙ্গিনায় পা রেখেছি ফিলিস্তিন শত্রু মুক্ত না করে ফিরব না ইনশাল্লাহ। এসময় বেসামরিক প্রশাসনের দিকে কঠোর দৃষ্টি রাখা আবশ্যক।

প্রতিটি মসজিদে ঘোষণা করে দিতে হবে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বাগদাদ খেলাফতের অধীন। খেলাফতের আনুগত্য প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ। কিন্তু জুম্মার খোৎবায় খলিফার নাম নেয়া যাবে না। শিয়া সুন্নীর বিভেদ উসকে দেয়া হচ্ছে। এ দিক সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।’

নুরুদ্দীন জংগী সুলতান আয়ুবীর চিঠি পেয়ৈ অত্যন্ত প্রীত হলেন।

খ্রীষ্টানদের কেন্দ্রীয় সামরিক কমান্ড মরুভূমিতে ছড়িয়ৈ থাকা সৈন্যদের কাছে সংবাদ পাঠাল মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ না করে ধীরে ধীরে ক্রাকে ফিরে আসতে। এরপর চল্লিশ সদস্যের কমান্ডো বাহিনী তৈরী করা হর। ওরা মুসলমানদের ছদ্মবেশে সুবাক প্রবেশ করবে এবং মেয়েদের মুক্ত করার চেষ্টা করবে।

আয়ুবী মিসরে নেই। তার অনুপস্থিতিতে মিরে গোয়েন্দা তৎপরতা আরও বৃদ্ধি করার জন্য হরমুনকে নির্দেশ দেয়া হর। গোয়েন্দারা সুদানী এবং ফাতেম ীদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে মিসরে আক্রমণ করার জন্য সবরকম সাহায্য করবে।

সুবাক এবং ক্রাকের মধ্যবর্তী অশ্চলের সবটাই মরুভূমি ছিল না। কোথাও বালিয়াড়ি, কোথাওত পাথুরে পর্বত আবার কোথাও পাহাড় শ্রেণী।

পথ ভুলে কেউ পাহাড়ের ফাঁকে ঢুকে পড়লে আর বেরোবার রাস্তা খুঁজে পেতনা। মরতে হত ওখানেঈ। এভাবে দু’ বাহিনীর সৈন্যরাই মারা যাচ্ছিল। সুবাক থেকে পালিয়ে আসা লোকজনও মরছিল এসব পাহাড়ে।

আকাশে উড়ছিল শকুনের ঝাঁক। পার্বত্য শ্রগাল আর নেকড়েরা ছিড়ে খাচ্ছিল নিহতদের লাশ। শরুভূমির কোথাও ছিল খর্জুর বীথি এবং পানির ঝর্ণা। ক্লান্ত শ্রান্ত সৈনিক গভীর তৃষ্ণায় ছুটে আসত সেসব পানির উৎসের কাছে।

আরমান হাশেমী মুসলিম বাহিনীর একজন প্লাটুন কমান্ডার। নিজকে পরিচয় দিত সিরীয় হিসেবে। তার হৃদয়ে ছিল খ্রীষ্টানদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা। এ ঘৃণার সাথে ছিল প্রচণ্ড প্রতিশোধ স্পৃহা।

সবাই জানত আরমান এতিম। তার আপন বরতে কেউ নেই। কিন্তু আরমানের ধারণা, সে পিতৃহীন নয়। পিতা তার সামনে মরেননি।

ও বাড়ী ছেড়েছে চৌদ্দ বছর বয়সে। থাকত সুবাক।

তার স্পষ্ট মনে আছে তখন খ্রীষ্টান সৈন্যরা সুবাক দখল করে মুসলিম নিধনে মেতে উঠেছে। খ্রীষ্টানদের নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেই বড় হয়েছে সে। দেখেছে নিরপরাধ মুসলিম বন্দীদের। নিহত হতে দেখেছে অসহায় মানুষ।

দেখেছে মুসলমানদের সুন্দরী মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। যুবকদের পাঠঅচ্ছে বেগার ক্যাম্পে।

সুবাকের মুসলমানদের বলত, ‘খ্রীষ্টান সৈন্যরা কোথাও পরাজিত হলে আমাদের ওপর তার প্রতিশোধ নেয়া শুরু করে।’

আরমানের পরিবারও নিরাপদ ছিলনা। সাত আট বছর বয়সী এক বোনের কথা ও মনে আছে। ভীষণ সুন্দরী ছিল। মনে হত পুতুল। পিতা এবং বড় একজন ভাই ছিল।

ছোট বোন একদিন খেলতে বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। একজন মুসলমান প্রতিবেশী বলেছীল ওকে খ্রীষ্টান সৈন্যরা তুলে নিয়ে গেছে।

আরমানের পিতা শহর প্রধানের কাছে অভিযোগ পেশ করলেন। তিনি মুসলমান শুনে জ্বলে উঠল শহর প্রধান। শাসক জাতির বিরুদ্ধে এত বড় অপবাদ।

তার পিতা বাড়ী ফিরে এলেন। বড় ছেলেকে নিয়ে মহল্লার সবাইকে জানালেন। এক রাতে তাদের বাড়ী আক্রান্ত হল। বড় ভাই এবং তা নিহত হল আরমানের চোখের সামনে।

আরমান পালিয়ে একজন মুসলিম প্রতিবেশীল ঘরে আশ্রয় নিল। তার আর ঘলে ফেরা হয়নি। তাকেও মেরে ফেলতে পারে ভেবে কয়েকদিন ওখানেই লুকিয়ে রইল।

কয়েকদিন পর প্রতিবেশী আরমানকে আর একজন মুসলমানের হাতে তুলে দিল। লোকটি গোপনে তাকে ঞর থেকে বের করে এক কাফেলায় সংগী করে দিল।

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কাফেলা ফৌঁছল সিরিয়া। আরমান একজন আমীরের বাড়ীতে চাকরি পেয়ে গেল।

বেঁচে থাকার তাগিতে আরমান আমীরের বাড়িতে চাকরী করছৈ। ধীরে ধীরে বয়স বাড়র। তার হৃদয়ে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। এ চাকরীর চাইতে সেনাবাহিনী তার ভাল লাগত।

আমীরের চাকরী ছেড়ে ও একজন সেনা কমান্ডারের বাড়ীতে কাজ নিল। কমান্ডারকে শুনাল তার অতীত কাহিনী। আবেদন জানাল সেনা ফৌজে ভর্তি হওয়ার জন্য।

ষোল বছর বয়সে কমান্ডার আরমানকে সেনাবাহিনঢীতে ভর্তি করে দিলেন। তিন চারটে যুদ্ধে শরীক হল ও। সুলতান আয়ুবীর অনুরোধে নুরুদ্দীন জংগী যে ফৌজ মিসর পাঠিয়েছিলেন ও ছিল তাদের সংগে।

ও এখন আটাশ বছরের টগবগে তরুন। মিসরে কাটল দু’বছর। আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেছেন।

সুবাক দুর্গ আক্রমণকারী বাহিনীল সাথৈ ওকেও নেয়অ হর। হৃদয়ৈ ওর ভড় বইছীর। কিছুদিন পরই যুদ্ধ হবে খ্রীষ্টান বাহিনীর সাথে।

আরমানের কমান্ডো বাহিনী প্রতিপক্ষের ওপর শিকারী বাজের মত ঝাপিয়ে পড়ত। মুখে মুখে ছড়িয়ৈ গেল তার নাম। অম্বারোহী যোদ্ধঅদের সাথে নিয়ৈ মরুময় ঘুরে বেড়াত আরমান। খ্রীষ্টান সৈন্য দেখলেই চিতাবাঘের মত ঝঅপিয়ে পড়ত।

হৃদয়ৈর আগুন এতে নিভত না। একমাস পর তার গ্রুপের চারজন মাত্র বেঁচে রইল। বাকীরা শহীদ হল যুদ্ধ করে।

একরাতে সে জঞ্চাশ জনের একটা দলকে আক্রমণ করল। দিন ভর লুকিয়ে অনুসরণ করেছিল ওদের। আক্রমণ করেনি। দিনের বেলা পঞ্চাশ জনকে আক্রমণ করা চারজনের পক্ষে সম্ভব নয়।

খ্রীষ্টান সেনা দলটি অনেক দূরে এগিয়ে গেল। রতে থামল ওরা। ছাউনি ফেলল বিশ্রামের জন্য। কজন সান্ত্রীকে পাহারায় রেখে গুশিয়ে পড়ল।

মাঝ রাতে ছাউনির মাঝ বরাবর ঘোড়া ছুটাল আরমান। ডানে বায়ে তরবারীল আঘাত করে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ৈ গেল। ঘোড়ার পায়ের চাপে থেতলে গেল ক’জন খ্রীষ্টান সৈন্যৈর দেহ। সান্ত্রীরা তীল ছুড়ল। অন্ধকারে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হল তীর।

সামনে গিয়ৈ সংগীদের থামাল আরমান। ধীরে ধীরে পিছিয়ে এল। একবারও ভাবল না শত্রু এতক্ষণে সতর্ক হয়ে গেছে।

ছাউনির াকছে গিয়ৈ আবার ঘোড়া ছুটাল ওরা। সৈন্যদের দলে পিষে বেরিয়ে গেল সামনে।

ওরা এখন তিনজন। দু’জন শহীদ হয়েছে খ্রীষ্টানদের তীরের আঘাতে। আরমানের রক্তে আগুন ধরে গেল। সংগীদের বলল, ‘এবার প্রতিশোধ নেব।’

এ ছিল এক ভয়ংকর দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। দু’জন সংগীকে নিয়ে আরমান আবার ফিরে এল ছাউনির কাছে।

ততক্ষণে জেগে উঠেছে ছাউনির সবাই। ঘোড়াগুলো ক্লান্ত। ঘোড়া ছুটাল ওরা। খ্রীষ্টান সৈন্যরা হামলে পড়ল তাদের ওপর। নিমিষে তার সংগী দু’জন শহীদ হয়ে গেল।

এখন বেঁচে আছে শুধু আরমান। তাকে ধাওয়া করছে দু’জন খ্রীষ্টান সৈন্য। পেছন থেকে ভেসে এল খ্রীষ্টানদের সতর্কবানী, ‘থামো! পালাতে পারবে না, তুমি এখন একা।’

ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দিল ও।

তারবারী দিয়ে আক্রমণ করল দুই ধাওয়াকারী। বর্শা দিয়ে একাই দু’জনের মোকাবিলা করল আরমান।

দীর্ঘ সময় ধরে চলল মুখোমুখী যুদ্ধ। কাফেলা থৈকে অনেক দূরে চলে এসেছে ওরা।

শেষ পর্যন্ত আরমান বিজয়ী হল। নিহত হল দু’জন খ্রীষ্টান সৈন্য।

সুবাক পাঠানোর জন্য ওদের ঘোড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র তুলৈ নিল ওল। বুঝতে পারছে না কোথায় এসেছে। ঘোড়াটা ক্লান্ত। বিশ্রাম প্রয়োজন। আরো কিছু দূর এগিয়ে এক পাহাড়ের কোলে থামল আরমান্

খ্রীষ্টান সৈন্যরা যে কোন সময় আক্রমণ করতে পারে ভেবে রাতভর জেগে রইল।

আকাশের নক্ষত্র দেখে সুবাক এবং ক্রাক কোন দিকে নির্ধারণ করল ও। কোন দিকে গেলৈ মুসলিম সৈন্যদের পাওয়অ যাবে তাও বুঝল আরমান।

ভোরের আলো ফুটতেই বেরিয়ৈ পড়ল ও। মরুভূমিতেই ও বড় হয়েছে, সুতরাং পথ হারাবার ভয় নেঈ। ও এক অভিজ্ঞ কমান্ডো সদস্য। দূল থেকেই বিপদের গন্ধ পায়।

অনেক দূরে খ্রীষ্টান সৈন্রেদর কয়েকটা দলকে যেতে দেখল ও। অতিরিক্ত ঘোড়া দুটো সাথে না থাকলে একাই আক্রমণ করে বসত ওদের।

খ্রীষ্টান সৈন্যদের দৃষ্টি বাঁচিয়ে এগিয়ে চরল আরমান। পথের বিভিন্ন ষাত্নে পড়ে আছে উট ঘোড়া এবং খ্রীষ্টান সৈন্যদের মৃত লাশ। শিয়াল শকুন খাবলে নিচ্ছে লাশের মাংস।

ও পথ চলছে, মাথার উপর উঠে এসেছে সূর্য। সামনে পাহাড় শ্রেণী। এখানে পথ এঁকে বেঁকে চলে গেছে।

পাহাড়ের ফাঁকে খ্রীষ্টান সৈন্যদের লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ৈ দেয়া যায় না। ওরা রাতে বিশ্রামের জন্য এখানে থামতে পারে।

সূর্য ডোবার পূর্বেই পার্বত্য এলাকা পেরিয়ে যেতে চাইছে ও। চোখ-কান সতর্ক। কোন টিলা থেকে যে কোন সময় ছুটে আসতে পারে শত্রুর নিক্ষিপ্ত তীর।

পাহাড়ের কোল ঘেষে এগিয়ে যাচ্ছে আরমান্ সামনের পথ পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ঘুরে গেছে। এলাকাটা ভয়াবহ দুর্গম।

আচম্বিত ভেসে এল ছুটন্ত পায়ের শব্দ। কেউ পাশের টিলার আড়ালে লুকিয়েছে কিনা না দেখরা জন্য দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে ও টিলার ওপাশে পৌঁছল। সামনে বেরোবার পথ নেই। স্থানটি এক বিশাল গর্তের মত।

আরমানের বিশ কদম দূরে লম্বা জুব্বা পরে এক ব্যক্তি উপরে উঠার চেষ্টা করছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। লোকটির মাথাও ঢাকা। ওখানে আর কেউ নেই।

আরমান ওকে ডাক। কিন্তু লোকটি পাহাড়ে উঠার চেষ্টা থামাল না। এগিয়ৈ গেল আরমান ।

লোকটি দ্রুত উটরে উঠার চেষ্টা করল। কিন্তু তার ক্লান্ত হাত ফসকে এসে পড়ল আরমানের ঘোড়ার কাছে।

মুখের কাপড় সরে গেল লোকটার। আরমানের হতবাক দৃষ্টি অপলক তাকিয়ে রাইল সে চেহারার দিকে।

এ-তো এক সুন্দরী যুবতী। এমন অপরূপা নারী ও জীবনে দেখেনি।

আরমান ঘোড়া থেকে নামল।

মেয়েটি উঠে বসল। ভীত হরিণীর মত কাঁপছে সে।

‘কে তুমি?’ আরমান প্রশ্ন করল।

জবাবে পানি চাইল ও। আরমান ঘোড়ার সাথে বাধা মশক থেকে পানি এনে দিল। মেয়েটি ঢক ঢক করে পানি পান করল।

ক্লান্তি বা ভয়ে বন্ধ হয়ে আসছিল মেয়েটির চোখের পাতা।

চোখ বন্ধ করে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটি।

আরমান এগিয়ে ওর চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিল। জ্ঞান ফিরল ওর। আরমান থলে থেকে কিছু খাবার এনে তুলে দিল মেয়েটির হাতে। খাওয়া শেষে কিছুটি স্বাভাবিক হল মেয়েটা।

আরমান বলল, ‘আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কি তোমার পরিচয়। তুমি কোত্থেকে এসেছ?’

‘সুবাক থেকে আমার পরিবারের সাথে এসেছি।’ মেয়েটির দুর্বল কণ্ঠ। ‘মুসলীম সৈন্যদের আক্রমণে পরিবারের সবাই মারা গেছে। বেঁচে আছি আমি একা।’

আরমান বরল, ‘তুমি ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করছো কেন? তুমি যা বললে এর সবচাই মিথ্যে। আমাকে তোমার আসল পরিচয় দিচ্ছ না কেন?’

‘মিথ্যে হলে হলো।’ একই সাথে আতংক ও ঝাঁঝ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল মেয়েটি। তারপর সুর সামান্য নরম করে বরল, ‘আমি তোমার করুণা ভিক্ষা করছি। অনুগ্রহ করে আমাকে ক্রাক পর্যন্ত পৌঁছে দাও।’

‘সুনাক পর্যন্ত। আমি তোমায় সুবাক পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারি, ক্রাক নয়। দেখতেই পাচ্ছ আমি মুসলমান। তোমাকে ক্রাক পৌঁছাতে গিয়ে পথে খ্রীষ্টান সৈন্যদের হাতে মরার কোন ইচছে নেই আমার।’

‘তাহলে আমাকে একটা ঘোড়া দাও।’

‘তোমায় ঘোড়াও দিতে পারছি না, এখানেও একা ছেড়ে যেতে পারছি না। তোমায় সুবাক পৃযন্ত পৌছে দেয়া আমার দায়িত্ব।’

‘কমান্ডারের হাতে তুলৈ দেব।’

‘আমি যুবতী বলেি কি আমাকে সুবাক নিতে চাচ্ছ?’

‘ভয় নেই, তুমি যে আশংকা করছ তেমন ব্যবহার কেউ তোমার সাথে করবে না।’

মেয়েটা ক্রাক যাবার জন্য জিদ করছির। আরমান বলল, ‘পথে কারো হাতে পড়লে কিঅবস্থঅ হবে বুঝতে পারছ?’

‘সুবাক গেলে অবস্থঅ তারচে ভাল হবে এর নিশ্চয়তা কি?’

‘নিশ্চয়তা হচ্ছে আমাদের সুলতানের নির্দেশ। আমাদের নির্দেশ দেয়অ হয়েছে সুবাক থেকে কোন খ্রীষ্টান পরিবার যেন পালিয়ে যেতে না পারে। কাউকে পালিয়ে যেতে দেখলৈ ফেরত পাঠাতে বরা হয়েছে। সুলতান সবার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন বলেছেন। তাছাড়া তুমি একা ক্রাক পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে না।’

তরুণী ভেবেছিল মুসরিম যুবকটি হয়ত তার সম্ভ্রম নষ্ট করবে। সে সিদ্ধান্ত নিল দেঞৈর লোভ দেখিয়ে এর কাছ থেকে একটা ঘোড়া বাগাতে হবে। কথার মোড় ঘুরিয়ে দিল ও।

‘আমি ভীসণ ক্লান্ত। আপনি চাইলে আমরা রাতটা এখানে কাটিয়ে সকালে সুবাকের পথ ধরতে পারি। কিন্তু এখন আমার পক্ষে সফর করা কঠিন।’

আরমাননিজেও ক্লান্ত। ঘোড়াগুলোর ওপর অনেক ধকল গেছে। মেয়েটাকেও ক্লান্ত দেখঅচ্ছে। ওখানেই রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত নিল আরমান।

এর আগে মেয়েটা তাকে ভাল ভাবে দেখেনি। ওর কাছে মুসলিম সৈন্য মানেই এক হিংস্র পশু। তার কাছে অনুসম্পা আশা করা যায়না। কিন্তু আরমান এখানেই রাত কাটাতে রাজি হওয়ায় ও বুঝল ওকে হয়তো বাগানো যাবে।

মেয়েটি এবার গভীর চোখে আরমানের দিকে তাকাল।

আরমানও তাকালম েয়েটির দিকে। ভাবল চারদিকে যুদ্ধের দামামা বাজছে, এর মাঝে অনিন্দ্য এক সুন্দরীর একা থাকা কত বিপদজনক। এমনওহ তে পারে এ মেয়েটার জন্য।ি কমান্ডাররা পরস্পর ঝগড়া করে নিহত হয়েছে। ওর য়ে গেছে একা। সেও তো একজন মানুষ।

ও তরুনীল চোখে চোখ রাখর। মেয়েটা তার দিকে চেয়ে আছে। দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চাইল আরমান। কিন্তু টওর মায়াভরা চোখ দুটো যেন আরমানের দৃষ।টি আটকে ফেলেছে। দেহে খেলে গেল অপরিচিত শিহরণ। চোখ সরিয়ে নিল ও।

পরক্ষণেই আবার দৃষ্টি স্থির হল যুবতীর চোখে। হৃদয়ে উৎকণ্ঠিত তোলপাড়। মেয়েটার ঠোঁটে ফুটে উঠল একটুকরো মিষ্টি হাসি।

‘সম্ভবত তুমি এখনও কুমারী।’ অনুচ্চ কণ্ঠে বলল আরমান।

‘হ্যাঁ।’ মেয়েটি চটপট জবাব দিল। ‘পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। তুমি আমাকে ক্রাক পৌঁছে দিলে আমি তোমায় বিয়ে করব।’

আরমান সচকিত হয়ে বরল, ‘এরপর বলবে তোমার ধর্ম ত্যাগ কর, যা আামর দ্বারা সম্ভবন য়। কেন, সুবাক গিয়ে মুসলমান হয়ে আমায় বিয়ে করতে পার না?’

‘আমাকে অবশ্যই ক্রাক যেতে হবে। আমার সাথে চল, তোমার পৃথিবী বদলে যাবে।’

মেয়েটা আরমানকে দেহের লোভ দেখাল। কিন্তু আরমানের ভাবনাগুলো ও বুঝতে পারছিল না।

ও চোখ তুলে তাকাত মেয়েটার দিকে। ওর চেহারা, রেশন কোমল চুল, ওর দুটো মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত অনেক্ষণ। এরপর মাথা নুয়ে হারয়ে যেত ভাবনার গভীরে।

যুবতীর কোন কথাই ওর কানে যাচ্ছিল না। জোৎস্নাহীন মেঘলা রাতের আঁধারে ছেয়ে গেল ওর চেহারা।

উঠাে দাঁড়াল ও। ঘোড়ার পালানে বাধা থলে থেকে খাবার বের করে এনে মেয়েটাক দিল। নিজেও কিছু খেল।

ক্লান্তিতে ভেংগে আসছিল ওদের দেহ। পাথরে মাথা রেখে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল দু’জনই।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top