২৯. রিচার্ডের নৌবহর


‘এখনতো আমাকে আপনার কাছেই থাকতে হবে’ গোয়েন্দা বললো, ‘আল ফারেস যেন জানতে না পারে আমি এখানে গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছি। আপনি তো চিঠি পড়েই সবই বুঝেছেন। মেয়েদের নিয়ে আপনার আর চিন্তা করতে হবে না। আমি নিজেই যাচাই করে দেখবো, ওরা কেমন মেয়ে, কি তাদের মতিগতি।
‘ওদের ব্যাপারে অবশ্য সবচে ভাল বলতে পারবেন আল ফারেস। কারণ মেয়েরা সারাক্ষনই তার কাছেই থাকে। তবে ওদের আচরণ সন্দেহজনক হলে তিনি নিশ্চয়ই তাদের এতটা প্রশ্রয় দিতেন না’।
‘ঠিক আছে, ওটা আমি দেখবো। মেয়েদের কোন গোপন তথ্য সংগ্রহ করার প্রয়োজন হবে না যদি আমি জানতে পারি, আল ফারেস এদের ফাঁদে পড়ে তার দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য দেখাচ্ছে আর অধিকাংশ সময় মেয়েদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এমনটি দেখলে আমি মেয়েদের কিছুতেই এখানে থাকতে দেবো না’।
গোয়েন্দা কমান্ডার তাকে আরো বললো, ‘আল ফারেস জানে না, আমি এখানে গোয়েন্দাগিরী করছি। এটা তার জানার কথাও নয়। কারণ আপনি ছাড়া আর কেউ জানে না আমি এখানে কোন উদ্দেশ্যে এসেছি। আমি আপনাকে আবারও বলছি, আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল ফারেসকে আপনি কিছুই বলবেন না’।
এটা যুদ্ধ জাহাজ হলেও এখানে কেবল নৌবাহিনীর অফিসার ও সৈন্যরা আছে এমন নয়। জাহাজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা এবং রান্নাবান্না ও খাবার পরিবেশন করার লোকজনও এ জাহাজে আছে। এছাড়াও আছে আরো কিছু কাজের লোক। এখানে নিজের আসল পরিচয় গোপন রেখে দু’ একজন লোক থাকা অসম্ভব ছিল না।
আল ফারেস এই বহরের কমান্ডার থাকায় তারচে নিন্ম পদে চাকরী করে এমন কারো সাধ্য নেই তার কাজে নজরদারী করে। চাকর বাকর ও সৈন্যদের কারো পক্ষে তার কাজকে ভিন্ন চোখে দেখার ও বলার কোন সুযোগ ছিল না।
তারা জাহাজে অচেনা এক লোককে দেখতে পালো ঠিকই কিন্তু এ লোক কোত্থেকে কেন এলো তা কেউ জিজ্ঞেস করতে এলো না। একমাত্র রউফ কুর্দি জানতো এ লোক কে? কিন্তু সে মোটেই পছন্দ করতে পারছিল না স্বাধীনভাবে জাহাজের সর্বত্র এই গোয়েন্দা কমান্ডারের ঘুরাফেরা ও নজরদারী।
হাসান বিন আব্দুল্লাহর পাঠানো গোয়েন্দা প্রথম দিন মেয়ে দুটিকে দেখেই রউফ কুর্দিকে বললো, ‘এরা মোটেই বেদুইন মেয়ে নয় বা কোন বাস্তুহারা বিপন্ন মেয়েও নয়। এদের দেখেই আমার গভীর সন্দেহ হচ্ছে’।
‘এতদিন ধরে এরা আমাদের সাথে আছে। কই, এদের কাউকে তো কোন সন্দেহজনক কাজ করতে দেখলাম না’! রউফ কুর্দি বললো, ‘ওদের ব্যাপারে আমার মনে এখনো কোন সন্দেহ নেই’।
‘আমি যে বিষয় লক্ষ্য করি সে সব বিষয়ে আপনাদের কোন ধারনাই নেই’। গোয়েন্দা বললো, ‘শীত প্রধান দেশের যাযাবর মেয়েদের রং এমন হয় কিন্তু তাদের চোখের রং এমন হয় না। তাদের মধ্যে এমন শহুরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ভাবও দেখা যায় না।
দেখুন, আমরা এখন ভয়ংকর যুদ্ধে জড়িয়ে আছি। এ অবস্থায় আমাদের যুদ্ধ জাহাজে কোন অপরিচিত মেয়ে রাখা সম্ভব নয়। আমি এ মেয়েদের এখানে থাকতে দিতে পারি না’।
‘আরও কয়দিন দেখো’। রউফ কুর্দি বললো, ‘এমনও তো হতে পারে, মেয়ে দুটি আসলেই বিপদ্গ্রস্ত কিন্তু তুমি ওদের এখান থেকে সরিয়ে আবার বিপদের মাঝে ফেলে দিচ্ছো?’
‘আচ্ছা! আপনি যখন বলছেন আর কিছুদিন না হয় দেখি’।
সুলতান আইয়ুবী তাঁর সেনাপতিদের ঠিক কথাই বলেছিলেন। বায়তুল মোকাদ্দাসে যে খৃষ্টান জেনারেলরা আছে তারা ভাল করেই জানতো, মুসলিম বাহিনী বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এদিকে যখন সুলতান আইয়ুবী তাঁর সেনাপতিদের শেষ নির্দেশ দান করছিলেন সে সময় বায়তুল মোকাদ্দাসে ক্রুসেড বাহিনীর হাইকমান্ড তার জেনারেলদের প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন।
‘আমরা সালাউদ্দিন কে রাস্তায় বাঁধা দেবো না’। তাদের হাইকমান্ড বলছিলেন, ‘নিঃসন্দেহে তার সৈন্য সংখ্যা আমাদের তুলনায় অনেক কম, কিন্তু তাদের খাদ্য ও অস্ত্রের কোন ঘাটতি নেই। তাদের সাপ্লাই ব্যবস্থা দৃঢ় ও নির্ভরযোগ্য।
তাদেরকে বায়তুল মোকাদ্দাস অবরোধ করতে দাও। আমাদের কাছে দীর্ঘদিনের খাদ্য মজুদ আছে। অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং যুদ্ধের সাজ সরঞ্জামও আছে যথেষ্ট পরিমাণে। যদি তাদের অবরোধ দীর্ঘ হয় ও আমাদের রসদ কমে যায় তাতেও ভীত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের নাইট বাহিনী তাদের রসদ পাওয়ার পথও বাঁধাগ্রস্ত করে ফেলবে। তখন মুসলমানরা ক্ষুধা ও পিপাসায় মরতে থাকবে। আর আমরা কম আহার করে খাদ্যের মজুদ দীর্ঘদিন ধরে রাখবো।
এই যুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাহিনী হচ্ছে নাইটদের বাহিনী। তাদের এক অংশ ইতিমধ্যেই বাইরে গিয়ে অবস্থান নিয়েছে। আরেক অংশ শহরে থাকলেও তারা কমান্ডো স্টাইলে যুদ্ধ করবে’।
তিনি উপস্থিত কমান্ডারদের সাহস ও প্রেরণা সৃষ্টির জন্য বললেন, ‘তারা আইয়ুবীর নিয়মিত বাহিনীর ওপর অতর্কিত আঘাত করে আবার ফিরে আসবে। আমি আপনাদের সকলকে বলতে চাই, অতীতের সকল অবরোধের মতই মুসলমানদের এ অবরোধও বিফল হবে’।
‘আপনি সৈন্যদের অবস্থা সামনে রেখে কথা বলছেন না’। এক জেনারেল বললো, ‘শহরের বাইরে যে রণ ক্ষেত্রটি হাতিন থেকে আস কালান পর্যন্ত বিস্তৃত, এখন সেখানে আমাদের যুদ্ধ করার শক্তি শিথিল হয়ে গেছে। বরং বলা ভুল হবে না যে, আমাদের সৈন্যদের উপর সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বাহিনীর বিভীষিকা বিরাজ করছে। শহরে স্থায়ী সৈন্যরা আগে কখনও ময়দানে যুদ্ধ করেনি। প্রতিরক্ষার ট্রেনিং থাকলেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ওদের নিয়ে ময়দানে যাওয়া যাবে না। অতীতের অভিজ্ঞতার কারণে মুসলমানরা এবার তাদের সরবরাহ লাইন অটুট রেখেই সামনে এগুচ্ছে। সে জন্যই পথের প্রতিটি ফাঁড়ি তারা দখল করে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে সামনে পা বাড়াচ্ছে। আপনি এসব বিষয় বিবেচনায় আনছেন না’।
‘আমরা সে সমস্যার সমাধানও খুঁজে পেয়েছি’। কমান্ডার-ইন-চীফ বললেন, ‘আমাদের সম্মানিত পাদ্রী সৈন্যদের মাঝে ঘোরাফেরা করছেন। তিনি বাইবেলের উদ্ধৃতি দিয়ে তাদের দায়িত্ব সচেতন করার চেষ্টা করছেন।
তিনি তাদের বুঝাচ্ছেন, মুসলিম বাহিনীকে কেন পরাস্ত করা প্রয়োজন। তিনি সবার সামনে এটা যে ধর্মযুদ্ধ তা বলিষ্ঠতার সাথে তুলে ধরছেন। যদি জেনারেলরা ধর্মীয় আবেগ নিয়ে যুদ্ধ করে তবে সৈন্যরাও ধর্মীয় উদ্দীপনা ও আবেগ নিয়েই যুদ্ধ করবে’।
তিনি জেনারেলদের আবেগ আরো উস্কে দেয়ার জন্য বললেন, ‘যদি আমরা বায়তুল মোকাদ্দাস রক্ষার এ যুদ্ধে হেরে যাই তবে মনে রেখো, ভূমধ্যসাগরও আমাদের আশ্রয় দেবে না’।
‘সালাউদ্দিন আইয়ুবী কেন এত বিজয় লাভ করছে? তার সৈন্য বল, অস্ত্র বল সবই আমাদের চেয়ে কম। তাহলে এই শক্তি সে পাচ্ছে কথায়?’ প্রশ্ন করে এক সেনাপতি।
‘তাদের মুলশক্তি হচ্ছে তাদের ঈমান’। কমান্ডার-ইন-চীফ বললেন, ‘তারা একনিষ্ঠ ধার্মিক। মুসলমানরা বিশ্বাস করে ধর্মযুদ্ধে মারা গেলে তারা শহীদ হয়। আর শহীদরা সবাই স্বর্গে যাবে। স্বর্গে যাওয়ার আশায় মৃত্যুভয়কে তারা সহজেই জয় করে নেয়।
তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হচ্ছে, আমরা আমাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলকে পাদ্রীদের হাতে তুলে দিয়েছি। কিন্তু তারা তাদের ধর্মগ্রন্থ কোরআনকে সর্ব সাধারনের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এই কোরআন পড়েই তাদের মধ্যে শহীদ হওয়ার দুর্বার আকাংখা তৈরি হয়ে যায়’।
‘তাহলে এই কোরআনকে তাদের হাত থেকে সরিয়ে সেই হাতে আমরা অন্য কিছু তুলে দেয়ার চেষ্টা করছি না কেন?’ বললো এক কমান্ডার।
‘কে বললো করছি না? আমরা তো অনেক কাল ধরেই সে চেষ্টা করে আসছি।আর আমাদের চেষ্টা একেবারে ব্যর্থও হয়নি।
আমরা কোরআনকে ওদের হাত থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য তাকে অতি মুল্যবান বস্তু বলে বুঝাবার চেষ্টা করেছি। যারা তাদের মধ্যে বেশী ধর্মভীরু তারা এই পবিত্র জিনিস রেশমী গেলাফে মুড়িয়ে ভক্তিভরে তাকে তুলে রাখে।
আর যারা এখনো ধর্মের ব্যাপারে ততোটা সচেতন নয় তাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করছি, এই পবিত্রগ্রন্থ পাপী হাতে ধরা ঠিক নয়। তাতে তোমাদের পাপ আরো বাড়বে’।
আমরা তাদের আরো বলেছি, ‘জীবনে উন্নতি করতে হলে ধর্ম আর জীবনকে আলাদা করে নাও। তাহলে তোমরা নির্বিচারে আয়-রোজগার করতে পারবে এবং জীবনকে উপভোগ করতে পারবে’।
এভাবে আমরা তাদের বিভ্রান্ত করেই তো দীর্ঘকাল পারস্পরিক যুদ্ধেবিগ্রহে লিপ্ত করে দিয়েছিলাম ওদের। তারা গৃহযুদ্ধ করে যে পরিমাণ ধ্বংস হয়েছে লড়াই করে ততোটা ক্ষতি আমরা কোনদিনই করতে পারতাম না।
কোরআন থেকে দূরে সরাতে পেরেছিলাম বলেই তো আমরা ওদের মনে লোভ জাগাতে পেরেছিলাম ক্ষমতার লোভ, সম্পদের লোভ। কোরআন থেকে দূরে সরাতে পেরেছিলাম বলেই তো আমরা মুসলমানদের মধ্য থেকে এত অধিক সংখ্যক গাদ্দার জোগাড় করতে পেরেছিলাম।
কিন্তু আইয়ুবী ও তার বাহিনীকে আমরা কোরআন থেকে সরাতে পারিনি। পারিনি বলেই তাদের ঈমানী চেতনা নষ্ট হয়নি। সুলতান আইয়ুবী খুবই হুশিয়ার এক সমরবিদ। তিনি গৃহযুদ্ধরত মুসলমানদের কৌশলে আবার এক করে নিয়েছেন। তার সফলতার পেছনে তার সমরকৌশলই কাজ করেছে’।
‘আমাদের ব্যর্থতার কারণগুলো খুঁজে বের করা দরকার’। বললেন এক জেনারেল। তিনি বললেন, ‘আমরা যে শাসকদের তার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিলাম এখন তারা ফিরে দাঁড়িয়েছে। তারা আইয়ুবীর অনুগত হয়ে যাওয়ার ফলে তাদেরকে আমরা যে অস্ত্র দিয়েছিলাম সে অস্ত্র এখন আইয়ুবীর বাহিনীর হাতে চলে গেছে। আইয়ুবী এখন আমাদের অস্ত্র দিয়েই আমাদের মারছে।
আমরা যেসব সুন্দরী মেয়েদের পাঠিয়ে ছিলাম তাদেরলে দুর্বল ও কাবু করার জন্য, বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের সে মেয়েরা ব্যর্থ হয়েছে। এতদিন আমরা একটি ভুল ধারনার মধ্যে ছিলাম। আমাদের আশা ছিল, মেয়েদের দিয়েই আমরা বিরাট রকম সফলতা আদায় করতে পারবো। কিন্তু আমাদের সে আশা সালাউদ্দিন আইয়ুবী ব্যর্থ করে দিয়েছে’।
‘আমাদের কোন ত্যাগ বৃথা যায়নি’। মহান বেত্রিক যিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন, বললেন, ‘আপনার এ চিন্তা সম্পূর্ণ ভুল যে, ধর্ম যুদ্ধ শুধু সৈন্যরাই করে থাকে। আমাদের ধর্মের উন্নতি ও সমৃদ্ধি এবং শত্রু ধর্মের অধঃপতন ও দুর্গতি যদিও অস্ত্রের সাহায্য হয়েছে, কিন্তু তাদের মগজ ধোলাই ও ভুল পথে পরিচালনার কৃতিত্ব আমাদের বুদ্ধিজীবিদের।
তারা মুসলমানদের আত্মাকে কলুষিত করার এমন সব পদ্ধতি বের ও প্রয়োগ করেছে, যে প্রক্রিয়ার সাফল্যের কারণেই আইয়ুবী এতদিন সামনে বাড়তে পারেনি। ফলে আপনি বলতে পারেন না, আমাদের ত্যাগ ব্যর্থ হয়েছে’।
অন্য এক সেনাপতি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমরা আমাদের সেই সব মেয়েদের শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানাই, যারা তাদের রুপের জালে আমাদের বড় বড় দুশমন শাসকদের ঘায়েল করে আমাদেরকে অনিবার্য যুদ্ধের হুমকি থেকে রক্ষা করছিল। তারা নিজেদের সুখ ও আরাম বিসর্জন দিয়ে ধর্মের জন্য যে মহান ত্যাগ স্বীকার করেছে, তার জন্য আমি তাদের কুর্নিশ করি। ধর্মের জন্য তারা মুসলমানদের মহলে ও রাজ দরবারে লাঞ্চনা ও অপমান সহ্য করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়।
মুসলমানদের মধ্যে তারাই গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করেছিল। মুসলিম শাসকদের ঈমান ক্রয়ের কৃতিত্বও তাদেরই। তারা একই শাসকের অধীন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টিতেও কৃতিত্ব দেখিয়েছে। অতএব তাদের ব্যাপারে আমাদের সমীহ করে কথা বলা উচিত’।
কমান্ডার-ইন-চীফ তার কথার সূত্র ধরে বললেন, ‘ক্রুসেড বাহিনীর জেনারেলগণ! আমার বন্ধু ঠিকই বলেছে, শত্রুকে কাবু করার উত্তম পথ হলো, তাদের নেতাদের মধ্যে বিলাসিতা ও যৌন উন্মাদনা সৃষ্টি করে দেয়া। তাদের শাসক গোষ্ঠীর অন্তরে ক্ষমতা, সিংহাসন এবং ঐশ্বর্যের লালসা সৃষ্টি করে দাও।
মনে রেখো, মুসলিম জাতি ততোদিন বিশ্বনন্দিত থাকবে যতোদিন তাদের বীর সিপাহীরা ধর্মীয় উন্মাদনা নিয়ে মাঠে নামবে। তাদের মধ্যে ধর্মের চেতনা চির জাগ্রত ও অক্ষয় থাকলে শুধুমাত্র সংখ্যার জোরে আমরা ওদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারবো না।
তাদের মতো আমরা যেমন কমান্ডো বাহিনী গঠন করেছিল তেমনি তাদের মতো ধর্মীয় চেতনাও আমাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাদের সম্মানিত পাদ্রীরা সে চেষ্টা করছেন। আমাদের নাইটরা তাদের কাছে দীক্ষা নিচ্ছেন। বিজয়ের জন্য এই মূলমন্ত্রেই সমগ্র খৃষ্টান জাতি এবং বিশেষ করে সৈন্যদের আজ জাগিয়ে তুলতে হবে।
তোমরা জানো, ইসলাম আজ ইউরোপেও প্রবেশ করেছে। ভারত এবং চীনেও ইসলাম প্রসারিত হয়েছে। চীনের নৌবাহিনী প্রধান একজন মুসলমান। সেখানকার বিভিন্ন জেনারেলরাও মুসলমান। ভারত মহাসগরের পূর্ব দিকে যাও, সেখানে দেখতে পাবে বড় বড় দ্বীপের শাসক গোষ্ঠী আরবীয় মুসলমান। তোমরা ইসলামের এই গতি শুধু অস্ত্র দিয়ে রুখতে পারবে না। এর গতিকে রুখতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে কৌশল অবলম্বন করতে হবে’।
‘কি হবে আমাদের সে কৌশল?’ প্রশ্ন করলো এক কমান্ডার।
‘সবার আগে বায়তুল মোকাদ্দাসের কর্তৃত্ব আমাদের হাতে অটুট রাখতে হবে। এরপর আইয়ুবী ফিরে গেলে আমাদের প্রথম কাজ হবে তাদের পবিত্র ভূমি মক্কা ও মদীনা আক্রমণ করা’।
সেই সাথে আবার নতুন করে উদ্যোগ নিতে হবে মুসলমান আমীর ও সুলতানদেরকে যে কোন মুল্যে আমাদের দিকে ফিরিয়ে আনা। এ জন্য তাদেরকে পর্যাপ্ত সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দান করতে হবে।
এই সুযোগে আবার তাদের অন্দর মহলে আমাদের প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত সুন্দরী মেয়েদের প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। মুসলমানদের নফসকে জাগ্রত করতে না পারলে তাদের ধর্মীয় আবেগ কখনোই দমানো সম্ভব হবে না। এ কাজ আমরা আগেও করেছি, আবার নব উদ্যমে তা শুরু করতে হবে।
আমি ইহুদীদের কুর্নিশ করি, কারণ আমরা এ নিয়ম ইহুদীদের কাছ থেকেই শিক্ষা লাভ করেছি। তারা মুসলমানদের বিপথগামী করার নানা পথ আবিষ্কার করেছে।
যৌনতা বিস্তারের কর্মসূচী যেখানে কাজ করবে না, সেখানে ধর্মীয় কুসংস্কার ঢোকানোর পথ ব্যবহার করতে হবে। এসব কাজে ইহুদীরা খুবই পারদর্শী। তাদের সাথে আমাদের চুক্তি হয়েছে, মুসলমানদের ঈমানী চেতনা বিনষ্টের জন্য তারা চিরকাল কাজ করবে। এসব বিষয়ে তারা সুক্ষ কর্মতৎপরতা চালাবে, যা আমাদের চিরকাল সাহায্য করবে।
আমি আপনাদের আশ্বাস দিচ্ছি, সেই সময় আমাদের সামনে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে, যখন বায়তুল মোকাদ্দাস আমাদের চিরস্থায়ী নিয়ন্ত্রন ও অধিকারে এসে যাবে। আর বায়তুল মোকাদ্দাস আমাদের অধিকারে থাকলে আশেপাশের অঞ্চলগুলো নিয়ন্ত্রন করা আমাদের জন্য তেমন কঠিন হবে না। জেরুজালেম ও তার আশেপাশের অঞ্চলকে মুসলমান মুক্ত করা প্রয়োজন ছিল আমাদের। বিনা যুদ্ধে মুসলমানদের হত্যা করলে বিশ্ববাসী আমাদের খারাপ ভাবতে পারতো।
সুলতান আইয়ুবীর এ আক্রমনের ফলে আমাদের জন্য মুসলমান হত্যা করার একটা অজুহাত সৃষ্টি হয়ে গেলো। এ সুযোগ আমরা কাজে লাগাবো এবং জেরুজালেম ও তার আশেপাশের সমস্ত অঞ্চলের মুসলমানদের কচুকাটা করে প্রতিশোধ নেবো আইয়ুবীর এ ঔদ্ধত্যের।
ইহুদী বুদ্ধিজীবিরা আমাদের পরামর্শ দিয়েছে, মুসলমান রাজ্যগুলো খণ্ড খণ্ড করে ওদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করে দাও। যদি শত্রু বানাতে না পারো তবে অন্তত ওদের ঐক্য নষ্ট করে দাও। এ জন্য তাদের মধ্যে সৃষ্টি করো আঞ্চলিক জাতীয়তাবোধ।
ইসলামী জাতীয়তার বদলে ওদের মধ্যে সৃষ্টি করো ভৌগলিক জাতীয়তাবোধ। তারা মুসলমান নয়, নিজেদের পরিচয় দেবে আরবী, মিশরী, কুর্দি, ইরাকী বলে। তারপর এই জাতীয় পরিচয়কে বলিষ্ঠ করার জন্য তাদের সাহায্য করো অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে।
যখন দেখবে তাদের মধ্য কেউ মাথাচাড়া দিয়ে উঠার মতো শক্তিশালী হয়ে গেছে তখন এতদিনের দেয়া সাহায্য সুদে-আসলে আদায় করা শুরু করবে। দেখবে উঁচু মাথা দু’দিনেই নিচু হয়ে গেছে।
আমি মনে করি, ইহুদী বিশেষজ্ঞরা ঠিকই বলেছেন। মুসলমান জাতির প্রত্যেকেই নিজেকে শাসক মনে করে। কিন্তু তারা জানে না, তাদের প্রভুত্ব আমাদের হাতে।
আমরা হয়তো আমাদের কাজে সামান্য ঢিলেমি করেছিলাম, এই সুযোগে ধুরন্ধর আইয়ুবী তার স্বজাতির ভাইদেরকে তার দলে টেনে নিয়ে আমাদের ওপর আঘাত হানতে এসেছে। কিন্তু বার বার তাকে আমরা এমন সুযোগ দিতে পারি না।
আমাদের এই কর্মসূচী সফল করার জন্য আমাদের এমন সুক্ষ পথ অবলম্বন করতে হবে যাতে ওরা আমদের ষড়যন্ত্র ধরতে না পারে। এ কাজে বিশেষজ্ঞের ভূমিকা পালন করবে আমাদের ধর্মীয় নেতারা।
তারা প্রেম ও মানবতার বাণী নিয়ে ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। অহিংসার পথে তারা মানুষকে ডাকবে। ওদের অনুসরণ করে অর্থনৈতিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যাবে আমাদের পরবর্তী বাহিনী। লোকজন যখন আমাদের পাদ্রী ও সাহায্যদাতাদের ওপর খুশী হয়ে তাদের সাহায্য নিয়ে ঢেকুর তুলতে যাবে তখন যাবো আমরা।
আমরা সৈন্য বা সামরিক বিভাগের লোক। আমরা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের কাজ করবো। কিন্তু এসব করতে হলে সবার আগে যা করতে হবে তা হচ্ছে, আইয়ুবীকে নাস্তানাবুদ করে ফেরত পাঠানো বা তাকে নিঃশেষ করে দেয়া। আসুন আমরা আমাদের সবচে বড় শত্রু, যে শত্রু এখন আমাদের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে এগিয়ে আসছে, তাকে প্রতিহত ও পরাজিত করি’।

সেদিন রোববার। সকাল বেলা। ১১৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২০ তারিখ। সুলতান আইয়ুবী অবিশ্বাস্য গতিতে বায়তুল মোকাদ্দাসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছলেন।
ক্রুসেড বাহিনী সুলতান আইয়ুবীর আগমনের জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু তারা আশা করেনি, তিনি এমন ঝড়ের বেগে এসে পড়বেন। কারণ রাস্তায় ক্রুসেডদের বড় বড় কেল্লা রয়েছে। রয়েছে অনেক ফাঁড়ি। তাকে ওদের সাথে মোকাবেলা করে এগুতে হবে। তারা মনে করছিল, কোন কেল্লা বা ফাঁড়িতে তিনি পৌঁছলে ওরা সামরথ অনুযায়ী বাঁধা দেবে।
তারা ওর পথরোধ করতে না পারলেও তার গতিকে বাঁধাগ্রস্ত করতে পারবে এবং সঙ্গে সঙ্গে তার আগমনের খবর জেরুজালেম পৌঁছে দেবে। কিন্তু তিনি সে সব উপেক্ষা করে এবং পথের অপেক্ষমান সৈন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে কেমন করে এত দ্রুত জেরুজালেমের উপকণ্ঠে এসে পৌঁছলেন?
সুলতান আইয়ুবী যখন জেরুজালেমের ফটকের সামনে পৌঁছলেন তখন রাত। তিনি তাঁর অভিযানের সংবাদ নিয়ে কাউকে আগে আসতে দেননি। কমান্ডো বাহিনীর মাধ্যমে এ ব্যাপারটি তিনি নিশ্চিত করেছিলেন।
শহরের কাছে এসেই তিনি নিশ্চিত হলেন, তাঁর অভিযানের খবর এখনো জেরুজালেম পৌঁছেনি। কারণ সুলতান আইয়ুবীর প্রথম সৈন্যদলটি শহরের কাছে পৌঁছে দেখতে পেলো, প্রাচীরের উপরে দু’চার জন সৈন্য ভয় ভীতিহীন নিশ্চিন্ত মনে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। শহরের দরজা বন্ধ। ভেতরে গির্জার ঘণ্টাধ্বনির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
সহসা শহর প্রাচীরের বাইরে বিউগল ও কড়া নাকারা বেজে উঠলো। খৃষ্টান জেনারেলরা চমকে উঠে সৈন্যদের প্রাচীরের ওপর উঠে যাওয়ার হুকুম দিল। চারদিকের প্রাচীরের উপর ছুটে গেল খৃষ্টান সৈন্যরা।
একটু পর। আইয়ুবী দেখতে পেলেন ফাঁকা প্রাচীর মুহূর্তে ভরে গেল মানুষের মাথায়। সে মাথাগুলোতে শোভা পাচ্ছে লোহার হেলমেট। তাদের হাতে তীর ধনুক। এসব মাথার সংখ্যা ক্রমেই আরও বাড়তে লাগলো। শেষে এমন দেখা গেল যে, প্রাচীরের উপর মানুষের আরেকটি প্রাচীর দাঁড়িয়ে গেছে।
শহরের পশ্চিম দিকে কিছুটা পাহাড়ী অঞ্চল ছিল। সুলতান আইয়ুবী সেদিকে তাঁর বাহিনীর একটি গ্রুপকে ক্যাম্প করে বসিয়ে দিলেন। তিনি নিজে অশ্বারোহণ করে শহরের আশেপাশে তাঁর সৈন্য সমাবেশ দেখতে লাগলেন।
তিনি শহরে চার পাশ দিয়ে ঘুরছিলেন আর দেখছিলেন শহরের প্রাচীর কোন স্থানে দুর্বল। শহরের দেয়াল ফুটো করে সুরং পথ নির্মাণের জন্য একটি যুতসই জায়গা বাছাই করার ওপর নির্ভর করছে দেয়াল ভাঙ্গা বাহিনীর সাফল্য।
সুলতান আইয়ুবী প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য এক আত্মঘাতি দুর্ধর্ষ দল গড়ে তুলেছিলেন, যাদের কৃতিত্বের বহু কাহিনী আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল খৃষ্টান সৈন্যদের কাছে। মুসলিম সৈন্যরা শহরের চারদিক অবরোধ করেছিল কিন্তু কোন দিক দিয়েই হামলা করেনি।
মুসলমানদের একটি বড় দল ছিল শহরের পশ্চিমে, তখনো তারা ছিল খৃষ্টানদের দৃষ্টির আড়ালে। এদিকে শহরের প্রাচীর সংলগ্ন দুটি দৃঢ় গম্বুজ আছে। একটা দাউদের গম্বুজ ও অপরটি ট্যাংকার গম্বুজ নামে খ্যাত। এই গম্বুজের মধ্যে দূরে তীর নিক্ষেপকারী কামান ও মেঞ্জানিক পাতা।
সুলতান আইয়ুবী শহরের আশে পাশে দেয়াল নীরিক্ষন করে ফিরছেন। পশ্চিম দিকের বাহিনী প্রধান আগুন ও ভারী পাথর নিক্ষেপকারী মেঞ্জানিক স্থাপন করতে শুরু করলো।
ক্রুসেড বাহিনী বীরত্ব প্রদর্শন করে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনুযায়ী নাইটদের বেরোবার জন্য শহরের একটি গেট খুলে দিল। সেই গেট দিয়ে লৌহ পোশাকধারী নাইট সেনারা অশ্ব পৃষ্ঠে আরোহন করে হাতে বর্শা নিয়ে দ্রুত বেগে অশ্ব ছুটিয়ে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে তারা মুজাহিদ বাহিনীর উপর তীব্র আক্রমণ চালালো। নাইট বাহিনী বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই তাদের গেট বন্ধ হয়ে গেল।
প্রশস্ত ময়দানে ছুটছে নাইটরা। লৌহ পোশাকের জন্য তাদের গায়ে তীর বিদ্ধ হচ্ছে না। তারা এমন তীব্র ও অপ্রত্যাশিত গতিতে এগিয়ে এলো যে, কতক মুজাহিদ নাইটদের বর্শার খোঁচায় আহত ও শহীদ হয়ে গেলো।
কিছু সংখ্যক পিষ্ট হলো নাইটদের অশ্ব পদতলে। তারা যেমন ক্ষিপ্র গতিতে এসেছিল তেমনি ক্ষিপ্র গতিতে ধুলির ঝড় তুলে আবার ফিরে গেল দরোজার কাছে।
মুসলিম বাহিনীর সৈন্যরা আহতদের তুলে আনতে ছুটলো। তখন পিছনে কয়েকজন মেয়ের চিৎকার শোনা গেল, ‘তোমরা সরে যাও, এ কাজ আমাদের।
সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো মেয়ে দৌড়ে এলো। তারা কাঠের খাটে করে আহতদের উঠিয়ে নিল। মেয়েরা কাঁধে বয়ে আনা পানির মশক থেকে আহতদের পানি পান করালো।
তখনো ক্রুসেড বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তীর ছুটে আসছিল তাদের দিকে। এতে দু’ তিনজন মেয়ে পড়ে গেল।
মুসলমান তীরন্দাজরা সেখানে উপস্থিত হয়ে ঢাল দিয়ে তীর প্রতিরোধ করতে লাগলো। তারা প্রাচীর ও গম্বুজ থেকে আসা তীরের পাল্টা জওয়াব দিল দূর পাল্লার তীর নিক্ষেপ করে।
দূর পাল্লার তীর নিক্ষেপ শুরু হলে শত্রুদের তীর নিক্ষেপ বন্ধ হয়ে গেল। এই সুযোগে মেয়েরা আহতদের উঠিয়ে গাছের আড়ালে নিয়ে গেল।
আবার হামলা করলো নাইটরা। মুসলিম সৈন্যরা এবার প্রতিহত করলো তাদের আক্রমণ। উভয় পক্ষে আহত নিহত হচ্ছিল। তুমুল যুদ্ধ উপেক্ষা করে আহত মুজাহিদদের সঙ্গে সঙ্গে তুলে আনছিল মেয়েরা। তাদের তুলে দেয়া হচ্ছিল চিকিৎসকদের হাতে। সেখানে তাদের দ্রুত সেবা ও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। আহত রুগীরা সামান্য সুস্থ্য হয়েই উঠে বসতো। সঙ্গে সঙ্গে তারা দাঁড়িয়ে বলতো, ‘এই ক্ষত আমাদের যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে পারবে না। ছাড়ো, আমাদের ময়দানে যেতে দাও’।
তারা আবেগে উদ্বেলিত হয়ে বলতো, ‘আমরা বায়তুল মোকাদ্দাসে প্রবেশ করে তবে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করবো’।
যখন আহত সৈন্যরা দেখলো, তিন চারটি মেয়ে তীর বিদ্ধ হয়েছে তখন তারা এমন উত্তেজিত হয়ে উঠলো যে, তাদের ক্ষতে ব্যান্ডেজ করাই মুশকিল হয়ে গেল। মেয়েদের এমন দশা দেখে তাদের আবেগ উন্মাদনা আয়ত্বের বাইরে চলে গেল।
মেঞ্জানিক বাহিনী দ্রুত মেঞ্জানিক স্থাপনের কাজ করছিল। তীরন্দাজ বাহিনী তাদের যুদ্ধের গতি তীব্রতর করলো। মেঞ্জানিক স্থাপন করা হয়ে গেলে শুরু হলো মেঞ্জানিক দিয়ে ভারী পাথর ও অগ্নি বোমা নিক্ষেপ।
তারা গোলা ও পাথর দিয়ে আঘাত হানলো প্রাচীরের ওপর। গেট আরেকবার খোলা হলো। নতুন আরেকদল নাইট ঘোড়া নিয়ে বাতাসের বেগে ছুটলো। মুসলিম সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের উপর।
একদল অশ্বারোহী ছুটে গেল তাদের পেছনে। মুহূর্তে তারা অশ্বারোহী বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেল। ক্রুসেড বাহিনীর ফেরার পথ রুদ্ধ করে দিল তারা
মুসলিম সেনারা নাইটদের অশ্বগুলোকে বর্শা ও তলোয়ার দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করতে লাগলো।নাইটরা তাদের লৌহ বর্মের কারণে সুরক্ষিত ছিল।
ঘোড়া আহত হয়ে পড়ে যেতে লাগলো ময়দানে। ঘোড়ার সাথে নাইটরাও পড়ে যেতে লাগলো। মাটিতে পড়া নাইটদের হত্যা করা তেমন কঠিন হলো না মুজাহিদদের পক্ষে।
নাইটরা সবাই ছিল অশ্বারোহী। সে জন্য সবাইকে ভুপাতিত করা সম্ভব হলো না। বরং তারাও কয়েকজন মুসলমান সৈন্যকে ভুপাতিত করে চলে গেল।
তারা ফিরে যেতে চাইলে মুসলমান অশ্বারহীরা তাদের বাঁধা দিতে লাগলো। কেউ কেউ সেই বাঁধা অতিক্রম করে পালিয়ে যেতে পারলেও অনেকেই ধরাশায়ী হলো।
পালিয়ে যাওয়া অশ্বারোহীরা গেটের কাছে পৌঁছতেই সঙ্গে সঙ্গে গেট খুলে গেল। ওরা পেছন দিকে না তাকিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে।
এই ধারা চলতেই থাকলো। দাউদ গম্বুজের সামনেও শুরু হয়ে গেল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সে যুদ্ধে উভয় পক্ষ সমান বীরত্ব, ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতা প্রদর্শন করতে লাগলো। যুদ্ধের প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছিল, উভয় দলই যুদ্ধের চূড়ান্ত পরীক্ষার সম্মুখীন। আজই তারা এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি চায়।
ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায়, পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাসে উভয় পক্ষ ধর্মীয় উন্মাদনা নিয়ে যুদ্ধ করছিল। যে সব খৃষ্টান সেনা আহত হতো, তারা শহর প্রাচীরের বাইরেই পড়ে থাকতো। এই হতভাগাদের উঠিয়ে নেয়ার কেউ ছিল না।
রাত শেষ হলো এভাবেই। সেপ্টেম্বরের অসহ্য গরমের আগাম বার্তা নিয়ে রক্তচক্ষু মেলে উদিত হলো রাঙ্গা সূর্য। যুদ্ধ চলতে লাগলো বিরতিহীনভাবে।
দুপুর। প্রচণ্ড রোদ জ্বালিয়ে মারছিল সৈন্যদের। লৌহ পোশাক ধারী খৃষ্টান নাইটরা জ্বলেপুড়ে মরছিল সে রোদে। সে তুলনায় মুসলিম বাহিনীর অবস্থা ছিল অনেক ভাল। আহত মুজাহিদদেরকে মেয়েরা উঠিয়ে নিয়ে সেবা শুশ্রূষা করছিল। তাদের পানি পান করানো আর ব্যান্ডেজ বাঁধার কাজ করছিল একাগ্রতার সাথে।
পাহাড়ের পাশের ঝর্ণা থেকে মশক ভরে পানি আনছিল কেউ কেউ। দুপুরের উত্তপ্ত সূর্য মাথায় নিয়ে পানি আনতে গিয়ে তাদের আধমরা অবস্থা হয়ে গেল। সুলতান আইয়ুবী এ যুদ্ধ দেখছিলেন আর আবেগে ফেটে পড়ছিলেন।
পাহাড় থেকে ভারী পাথর বহন করে আনার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছিল খচ্চরের গাড়ী। এই পাথর ব্যবহৃত হচ্ছিল মেঞ্জানিক কামানে।
বিরতিহীন এই যুদ্ধে আরো প্রচণ্ড রূপ নিল দুপুরের পর। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত যেন কোন দলই থামতে রাজি নয়। প্রাচীরের ওপর থেকে খৃষ্টানরা ছুঁড়ছিল দুরপাল্লার কামানের গোলা। মুসলমানরা ছুঁড়ছিল মেঞ্জানিক।
চারদিকে আহতদের চিৎকার, চেঁচামেচি। তীরের শন শন আওয়াজ। এই হট্টগোলের মধ্যেই রাগী সূর্য তার রক্তচক্ষু নিয়ে চলে গেল পশ্চিমের আকাশে।
রাত নামলো। পাথর নিক্ষেপ তখনো চলছিল অব্যাহত গতিতে। মুজাহিদদের পাথর ও অগ্নিগোলা প্রাচীরের ওপর গিয়ে পড়ছিল। কখনো কখনো প্রাচীর পার হয়ে শহরের ভেতরও গিয়ে পড়তো।
অন্যদিকে প্রাচীর এবং গম্বুজ থেকেও গোলা ও পাথর বর্ষণ করছিল খৃষ্টানরা। তাদের এক জ্বলন্ত অগ্নিবান গিয়ে পড়লো মুসলিম বাহিনীর এক মেঞ্জানিকের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে তাতে আগুন ধরে গেল। পাশাপাশি আরো দু’তিনটি মেঞ্জানিকে ছড়িয়ে পড়লো সে আগুন। মেঞ্জানিকের সাথে পুড়ে গেল তাতে কর্মরত সৈন্যরাও।
অন্য মেঞ্জানিকগুলো থেকে পাথর নিক্ষেপ চলতেই থাকলো। প্রাচীর এবং গম্বুজ থেকেও গোলা ও পাথর বর্ষণ চলতে থাকলো সমান তালে। তীরও বর্ষিত হচ্ছিল দু’পক্ষ থেকে। রাতের প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হলো। প্রাচীরের বিভিন্ন দিক থেকেও পাথর ও অগ্নিবোমা নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল মুজাহিদ বাহিনীর ওপর।
বাইরে কোথাও কোথাও উঁচু টিলা ছিল। সে সব টিলার ওপর সরিয়ে নেয়া হলো বেশ কয়েকটি মেঞ্জানিক। ওখান থেকে যখন পাথর ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ শুরু হলো তখন দেখা গেল, সে সব গোলা প্রাচীর পার হয়ে শহরের ভেতরে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। মুজাহিদরা এবার পাথর বাদ দিয়ে সলতে ওয়ালা জ্বলন্ত তীর নিক্ষেপ শুরু করলো শহরের বিভিন্ন স্থানে। সঙ্গে সঙ্গে সে সব জায়গায় আগুন ধরে গেল। ধোঁয়া ও আগুনের শিখা বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top