২৮. রক্তস্রোত

এরপর আর বক্তব্য রাখার সুযোগ পেতেন না সম্মানিত আলেমবৃন্দ। হাজারো যোদ্ধার গগনবিদারী তাকবীর ধ্বনির আড়ালে হারিয়ে যেতো তাদের তাতানো কণ্ঠগুলো।

সুলতান আইয়ুবী তার বাহিনী একত্রিত করে তাদের সুশৃঙ্খলভাবে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দিচ্ছিলেন। গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুসারে নতুন করে সাজাচ্ছিলেন সেনাবাহিনী। এভাবেই বায়তুল মোকাদ্দাস আক্রমণ ও অবরোধের প্ল্যান চূড়ান্ত করছিলেন তিনি।

আলফারেসের জাহাজে মেয়েরা বেশ আনন্দেই দিন কাটাচ্ছিল। হাসি তামাশার ফুলঝুরি ছড়াচ্ছিল তারা আলফারেসের কেবিনে। সাগরের নিরানন্দ জীবনে তারা নিয়ে এলো জীবনের স্পন্দন। কিন্তু যখনই তারা আলাদা হতো, এক ধরনের ধাঁধাঁর মধ্যে পড়ে যেতো তারা।

আলফারেস মিলাতে পারতেন না মেয়েদের কথা ও কাজ। মেয়েরা তাকে বলেছে, তারা যাযাবর কন্যা। যুদ্ধের কবলে পড়ে তাদের গোত্রের সবাই ধ্বংস হয়ে গেছে। তারা অতি কষ্টে পালিয়ে সমুদ্র তীরে পৌঁছতে পেরেছিল।

কিন্তু আপনজনদের জন্য তাদের কখনো আনমনা হতে দেখেনি আলফারেস। তাছাড়া মেয়েদের স্বভাব এবং চালচলনও যাযাবরদের মতো নয়। যাযাবর মেয়েরা যতই সুশ্রী হোক তাদের চালচলন ও কথাবার্তায় গ্রাম্যতা না থেকেই পারে না। অথচ এরা শহুরে মেয়েদের মতোই সভ্য। শহুরে নাগরিকদের নির্লজ্জতা আর যাযাবরদের অসভ্যতা এক রকম হওয়ার কথা নয়। অথচ এদের জীবন প্রণালী নাগরিকদের মতোই কেতাদুরস্ত।

মেয়েদের কাছে আলফারেসও এক অদ্ভূত মানুষ। মেয়েরা এমনটি আশা করেনি। তারা ভেবেছিল, অন্যান্য পুরুষের মতো সেও হবে নারীলোভী, মাতাল ও কামুক। যেমনটি তারা জীবনভর দেখেছে। কিন্তু আলফারেসের আচরণে সে সবের কোন বালাই ছিল না। ওদের সাথে তিনি মিশতেন, হাসিঠাট্টা করতেন, কিন্তু সবই ছিল নির্দোষ রসিকতা। তার মধ্যে কামনা বাসনার ইঙ্গিতও কখনো লক্ষ্য করেনি ওরা। এতে তারা দারুনভাবে নিরাশ হয়েছিল।

কিন্তু ওরা তার অন্য এক দুর্বলতা ধরতে পেরে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। দায়িত্বের ব্যাপারে তিনি যেমন কঠিন ও নীতিনিষ্ঠ তেমনি অবসর ও বিনোদনের সময় শিশুর মত সরল ও আমোদপ্রিয় হয়ে যেতেন আলফারেস। তিনি মেয়েদের সাথে নিছক বন্ধুর মতো খেলা করতেন। তাদের রূপের প্রশংসা করতেন। তাদের দুষ্টুমীতে মজা পেতেন। তাদের নিয়ে মজার মজার গল্প করতেন। আবার দেখা যেতো, একাকী হলে এই মেয়েদের নিয়েই তিনি ভাবনার অতল তলে হারিয়ে যেতেন।

একদিন আলফারেস তার কামরায় শুয়ে আছেন। পাশের কামরাটি তিনি মেয়েদের থাকার জন্য বরাদ্দ দিয়েছিলেন। এক মেয়ে তার কামরায় এসে দরজা লাগিয়ে দিল। সে আলফারেসের বিছানায় উঠে বসে তাকে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করলো। মেয়েটা আসলে দেখতে চাচ্ছিল, তার মধ্যে আদৌ কামনার আগুন আছে কি না।

আলফারেস তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বললো, ‘আমি তোমাদের দু’জনকে যখন প্রথম উপকূলে দেখলাম তখন বলেছিলাম, আমি তোমাদের জাহাজে আশ্রয় দিতে পারি। তোমরা বলেছিলে, আমাদের সাথে কোন প্রতারণা হবে না তো? আমি সেদিন বলেছিলাম, আমি তোমাদের দু’জনকে মিশরে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো। আমি সেই কথাতেই স্থির থাকতে চাই। বিয়ের আগে এমন কোন অশোভন কাজ করবো না, যাতে তোমাদের সন্দেহ জাগে, সাময়িক আনন্দ উপভোগের জন্যই আমি তোমাদেরকে কাছে এনে রেখেছি। তেমনটি করলে তোমরা হয়তো ভাববে, আমি তোমাদের অসহায়ত্ব ও দুর্বলতার সুযোগ নিতে চাচ্ছি।

আমার সংকল্প তুমি জানো। এবার তুমি চিন্তা করে দেখো, তোমরা আমার কাছে যে ওয়াদা করেছিলে তা ঠিক রাখবে কিনা? মিশরে যাওয়ার আগেই এ ব্যাপারে তোমাদের মন স্থির করা দরকার। যদি আমার কাছে থাকতে চাও, আমাকে আমার সংকল্পে অটুট পাবে। আর যদি আমার কাছে থাকার ব্যাপারে তোমাদের মন সায় না দেয় তবে নিঃসঙ্কোচে তা আমার কাছে খুলে বলতে পারো। আমি কথা দিচ্ছি, তোমাদেরকে পরিপূর্ণ সম্মান ও মর্যাদার সাথে যেখানে যেতে চাও সেখানে পাঠিয়ে দেবো।’

মেয়েটি অধীর হয়ে তার দুই কোমল বাহু দিয়ে আলফারেসের গলা জড়িয়ে রেখেছিল। আলফারেসের কথা শুনে বললো, ‘আমরা দু’জনের কেউ তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। তোমাকে আমরা এক অনন্য পুরুষ হিসেবে পেয়েছি। কোন পুরুষের মধ্যে এমন সততা ও পবিত্রতা থাকতে পারে তোমাকে না দেখলে আমরা বিশ্বাসই করতাম না। আমরা মনে করতাম পুরুষ মানেই পশু, সাক্ষাত শয়তানের চেলা। তুমি আমাদের সে বিশ্বাস গুড়িয়ে দিয়েছো। তোমার মাঝে যে মহত্ব ও মনুষত্ব আছে কোন দেবতার মধ্যেও তা খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা দুষ্কর।’

মেয়েটির ভালবাসার অভিনয়ে মোমের মতো গলে গেলেন আলফারেস। নারীর ছলনা কি জিনিষ জানা ছিল না তার। তিনি মেয়েটির প্রতিটি কথা বিশ্বাস করলেন এবং নিজেকে সঁপে দিলেন মেয়েটির ভালবাসার রঙিন জালে। মেয়েটি যখন বিদায় নিল তখন সে কল্পনার ফানুস উড়িয়ে হারিয়ে গেল প্রেমের রঙিন ভুবনে।

মানুষের এ এক সহজাত দুর্বলতা যে, যে মানুষকে নির্মম অত্যাচার করে বশ করা যায় না, কঠিন শীলা যার হৃদয়ের অর্গল খুলতে পারে না, কামানের গোলা যেখানে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়, হৃদয়ের সামান্য উষ্ণতার টোকা পড়লে সে হৃদয়ের বদ্ধ কপাট খুলে যায় নিমিষে। তখন সে আকাশে উড়ে বেড়াতে পারে, সমুদ্র পাড়ি দিতে পারে, মরুভূমিকে বানিয়ে দিতে পারে পুষ্পিত বাগান। মানুষের চরিত্র ও স্বভাবের এ এক ভয়ংকর দুর্বলতা। দীর্ঘদিন সাগরে অতিবাহিত করা ও ছোট খাটো যুদ্ধের সম্মুখীন হওয়ায় আলফারেসের দেহমনে যে বিষাদময়তা জমা হয়েছিল একটি অচেনা মেয়ের সামান্য দুটি কথায় তা দূর হয়ে গেল। সেই শূন্যতা ও অবসাদ পরিণত হলো শান্তি ও আনন্দে।

এতে তার দায়িত্ববোধ ও সচেতনতা আরো তীব্র হলো। কাজে কর্মে এলো নব উদ্যম। ছয়টি জাহাজের কমান্ড নিয়ে শত্রুর অপেক্ষায় তিনি প্রহর গুনতে লাগলেন গভীর সমুদ্রে।

ফিলিস্তিনে তখন বিজয়ের পতাকা উড়য়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। একের পর এক শহর ও কেল্লা দখল করে বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। উপকূলের অধিকাংশ এলাকা দখল করে এসে আসকালান শহরে অবস্থান নিলেন। তারপর এখানে বসে বায়তুল মোকাদ্দাস অধিকার করার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করতে লাগলেন।

সমুদ্র পথে খৃস্টানদের সমরসম্ভার, সাহায্য ও খাদ্যশস্য আসার পথ আগলে বসেছিলেন আলফারেস। সাগর পথে ক্রুসেড যোদ্ধাদের জন্য যেন কোন সাহায্য আসতে না পারে তার জন্য তিনি তার বহরকে সদা জাগ্রত অবস্থায় প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি দিনের আরাম ও রাতের ঘুমকে হারাম করে দিয়েছিলেন। খৃস্টান গোয়েন্দা সেই দুই মেয়ে ভেতরে ভেতরে গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে দেখছিল আলফারেসের তৎপরতা। তারা সুযোগের সন্ধানে ছিল। ফেরিওয়ালাবেশী কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ হওয়ার পর থেকে অপেক্ষা করছিল তার ইশারার।

আলফারেস একদিন ওই মেয়েদের বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে যাযাবরের কোন লক্ষণ নেই। নাগরিক কায়দা কানুন তোমরা এমন চমৎকারভাবে রপ্ত করেছো যে, আমি তোমাদের আচরণ দেখে বিস্মিত হয়ে গেছি। এমন শালীন ও ভদ্র আচরণ তোমরা কেমন করে কোত্থেকে শিখলে?’

‘বাহ, আমরা বড় বড় খৃস্টান পরিবারে চাকরী করতাম না?’ এক মেয়ে বললো, ‘এসব তো তারাই আমাদের শিখিয়েছে। নইলে সম্মানিত মেহমানদের আমরা কিভাবে আপ্যায়ন করতাম?’

অন্য মেয়ে বললো, ‘আপনি যদি কোন সাধারণ লোক হতেন তবে আমরা আপনার সাথে ঠিক যাযাবরের মতোই আচরণ করতাম। কিন্তু আমরা জানি, আপনি তা পছন্দ করবেন না। আমাদের ভাগ্য ভাল যে, আমরা বড় বড় খৃস্টান পরিবারে চাকরী পেয়েছিলাম। নইলে আপনার মতো নৌবাহিনীর এত বড় কমান্ডারের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় তাইতো আমরা জানতাম না। আমরা কি আপনার সাথে গ্রাম্য আচরণ করতে পারি? আপনি কি আমাদের আচরণ ও ব্যবহারে সন্তুষ্ট নন?’

‘আরে তোমরা এমন উত্তেজিত হয়ে উঠলে কেন? আমি কি বলেছি, তোমাদের আচরণ আমার পছন্দ নয়? আমি তো তোমাদের প্রশংসা করছিলাম তোমাদের শিষ্টাচার ও ভদ্রতা দেখে।’ বললেন আলফারেস।

অন্যান্য পাঁচ জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং সৈন্যদের কাছেও আলফারেসের জাহাজে দুটি মেয়ে আনার খবর রটে গিয়েছিল। তারা এ সংবাদ শুনে মনে মনে হাসলো। কেউ কেউ কৌতুক বোধ করলো।

সৈন্যরা এ নিয়ে রসালো গল্প করতে মজা পেলেও কমান্ডাররা এ ঘটনায় বেশ চিন্তিত হলো। তারা বলাবলি করতে লাগলো, ‘এটা তিনি ঠিক করেননি। জাহাজে স্ত্রী রাখাটা সংগত হলেও কোন অচেনা মেয়েকে জাহাজে রাখা ঠিক নয়। এতে বিপদের আশংকা আছে।’

আলফারেসের যারা ঘনিষ্ট তাদের কেউ কেউ বিষয়টি আলফারেসের কানেও তুললো। কিন্তু আলফারেস তাদের কথা হেসেই উড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘তোমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। এরা তেমন মেয়েই নয়।’

আলফারেসের চরিত্র সম্পর্কে জানতো কমান্ডাররা। তারা দীর্ঘদিন ধরে তাকে সৎ, দায়িত্বশীল ও চরিত্রবান লোক হিসাবে দেখে এসেছে। তিনি দায়িত্বের ব্যাপারে কোন অবহেলা কখনো সহ্য করতেন না।

বায়তুল মোকাদ্দাসের ভেতরের অবস্থা ছিল তখন চরম অশান্ত ও উত্তপ্ত। সেখানে তখনো মুসলমানদের উপর উৎপীড়ন ও নির্যাতন চলছিল। ফিলিস্তিনের অন্য কোন এলাকা দেখে সেই অত্যাচারের নমুনা বুঝার উপায় ছিল না। এই অত্যাচার উৎপীড়নের ইতিহাস অতি পুরাতন।

১০৯৯ খৃষ্টাব্দে খৃষ্টানরা যখন বায়তুল মোকাদ্দাস অধিকার করে, তখন থেকেই শুরু হয় এ অত্যাচার। খৃষ্টানদের এ বিজয় লাভ সম্ভব হয়েছিল মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও গাদ্দারীর কারণে। মুনাফেকরাই খৃষ্টানদেরকে জেরুজালেম আসার পথ করে দিয়েছিল।

ইতিহাসে খৃস্টানরা এর চেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শহরও দখল করেছিল। কিন্তু বায়তুল মোকাদ্দাস তাদের কাছে যে গুরুত্ব লাভ করেছিল সেই গুরুত্ব আর কোন শহরই পায়নি। জেরুজালেম দখলের পর তাদের মনে হলো, তারা অর্ধেক দুনিয়াই দখল করে ফেলেছে। ইউরোপ তথা সমস্ত খৃস্টান জগৎ বায়তুল মোকাদ্দাসকে তাদের সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক বানিয়ে নিয়েছিল।

জেরুজালেমের এই গুরুত্বের কারণ, বায়তুল মোকাদ্দাসকে খৃস্টানরা তাদের পবিত্র স্থান মনে করতো। তাদের বিশ্বাস ছিল, হযরত ঈসা (আ.) এ অঞ্চলেই ক্রুশ বিদ্ধ হয়েছিলেন। তাছাড়া, মসজিদুল আকসা মুসলমানদের প্রথম কেবলা। রাসুলুল্লাহ (সা.) এখান থেকেই মেরাজে গিয়েছিলেন। এ কারণে মুসলমানরাও বায়তুল মোকাদ্দাসকে পরম পবিত্র স্থান মনে করতো। তাই কাবা ঘরের মতো বায়তুল মোকাদ্দাসও মুসলমানদের প্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করতো।

খৃস্টানরা বায়তুল মোকাদ্দাস দখল করে মুসলমানদের নৈতিক মনোবল গুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। এ ক্ষেত্রে তারা বেশ সফলও হয়েছিল। তারা চাচ্ছিল, মুসলমানদের আকিদা ও বিশ্বাসের কেন্দ্রস্থলগুলো ধুলিস্মাৎ করে তারা মুসলমানদের মনোবল ভেঙ্গে দেবে। আমাদের ঈমানী দৃঢ়তা নষ্ট করার জন্য তারা চাচ্ছিল এমন একটা ধুম্রজাল সৃষ্টি করতে যাতে ইসলামের মতবাদ ভুল প্রমাণিত হয়। তাহলেই তারা ইসলামকে বাতিল মতবাদ হিসাবে ঘোষণা করতে পারে।

তৎকালীন খৃস্টান গোয়েন্দা প্রধান হরমন মিথ্যা বলেনি, ‘ক্রুসেড যুদ্ধ মুসলমান সুলতান ও খৃস্টান সম্রাটদের যুদ্ধ নয়। এটা গীর্জা ও মসজিদের যুদ্ধ। কোরআন ও ক্রুশের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ততোদিন চলবে যতোদিন এ দু’য়ের একটি নিশ্চিহ্ন না হবে।’

এ জন্যই খৃস্টানরা মুসলমানদেরকে যুদ্ধে পরাজিত ও পদানত করার জন্য যে কোন পদক্ষেপ নিতে কুণ্ঠিত হতো না। মুসলমানদের নিঃশেষ করার জন্য ধোঁকা, প্রতারণা, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, গুপ্ত হত্যা সবকিছুকেই বৈধ এবং অসীম পূণ্যময় কাজ বলে মনে করতো খৃস্টানরা।

খৃস্টান পাদ্রী সৈন্যদের যুদ্ধের উস্কানি দিতে গিয়ে মুসলমানকে হত্যা করাকে অসীম সওয়াবের কাজ বলে প্রচার করতেন। ইউরোপের বড় কোন পাদ্রীকে দেয়া হতো বিশপের মর্যাদা। আক্রার পাদ্রী ছিলেন তখনকার বিশপ। হাতিনের রণাঙ্গনে এই পাদ্রী স্বয়ং মহান ক্রুশ নিয়ে উপস্থিত ছিলেন খৃস্টানদের মনোবল অটুট রাখার জন্য। খৃস্টানরা বিশ্বাস করতো, এই ক্রুশেই বিদ্ধ হয়েছিলেন হযরত ঈসা (আ.)।

এভাবেই খৃস্টান ধর্মীয় নেতারা ইসলামের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তাই এ যুদ্ধ রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ না হয়ে ধর্মীয় যুদ্ধের রূপ নিয়েছিল। খৃস্টান গোয়েন্দা প্রধান হরমন এ জন্যই বলতেন, ‘এটি দুই বিশ্বাস ও মতবাদের যুদ্ধ।’

পাদ্রীরা ক্রুসেড যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য খৃস্টান সম্রাটদের কাছ থেকে ওয়াদা নিয়েছিলেন। পাদ্রীদের ইচ্ছার কারণে সম্রাটরা ক্রুশ ছুঁয়ে শপথ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। শুধু সম্রাটরা নয়, ক্রুসেড যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল নাইট এবং সৈন্যদেরও ক্রুশ ছুঁয়ে শপথ করতে হতো। এভাবেই খৃস্টান পাদ্রীরা বিশ্বব্যাপী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছিল।

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এই প্লাবনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। পতনোন্মুখ জাতিকে দিয়েছিলেন বিজয়ের সুসংবাদ। খৃস্টানদের বিভিন্ন ঘাঁটি ও কেল্লা দখল করে তিনি এসে দাঁড়িয়েছিলেন বায়তুল মোকাদ্দাসের সন্নিকটে।

খৃস্টান এবং মুসলমান উভয় জাতিই ধর্মীয় উন্মাদনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই যুদ্ধে। এ যুদ্ধ উভয় জাতির মধ্যে এমন উন্মাদনা সৃষ্টি করলো যে, খৃস্টান মেয়েরা তাদের গহনা, সোনাদানা, নগদ অর্থ সবই গীর্জার পাদ্রীর কাছে তুলে দিচ্ছিল যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য। একই অবস্থা ছিল মুসলমানদের মধ্যেও।

মুসলমান নারীরা উদ্গ্রীব ছিল যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য আর খৃস্টান যুবতীরা জাতির স্বার্থে নিজের সতীত্ব ও মানসম্ভ্রম সবই বিকিয়ে দেয়ার জন্য ছিল প্রস্তুত।

খৃস্টান ধর্ম নেতারা ক্রুসেড যুদ্ধে নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দেয়াকে কেবল বৈধ নয়, খৃস্টানদের জন্য তা অপরিহার্য করে দিয়েছিল। মুসলমানদের পরাজিত করার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি তারা চালিয়ে যাচ্ছিল গুপ্তহত্যা ও ষড়যন্ত্র। মেয়েদেরকে লেলিয়ে দিত মুসলমানদের চরিত্র হননের জন্য। তাদের বলা হতো, তোমাদের সম্ভ্রম ও সতীত্বের বিনিময়ে তোমরা লাভ করবে অনন্ত সুখের স্বর্গ।

এই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই খৃস্টানরা তাদের সুন্দরী মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মুসলমান নেতা, আমীর ও সেনাপতিদের কাছে পাঠিয়ে দিত। তারা মুসলমান আমীর ও শাসকদের অন্দর মহলে প্রবেশ করে সেখানে ধ্বংসের যে বীজ বপন করতো সেই বীজ মুসলমানদের ঘরে ঘরে তৈরী করতো গাদ্দার।

এই ছলনার জালে জড়িয়ে মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। খৃস্টান নারীদের খপ্পরে পড়ে ভুলে যেতো নিজের বিশ্বাস ও আকিদার কথা। তাদের মধ্যে জন্ম নিত রাজ্য ও ক্ষমতার মোহ। তারা নিজের ঈমান বিকিয়ে দিয়ে শত্রুর গোলামে পরিণত হয়ে যেতো।

খৃস্টানদের এই মধুর ছোবল থেকে তারাই বাঁচতে পারতো যারা সচেতন। এ সব লোকের ঈমান হতো সাচ্চা ও দৃঢ়। কেবল এই সচেতন লোকদের আত্মাগুলোই ঈমানের আলোয় আলোকিত থাকতো।

এ ধরনের একদল ঈমানদারই বায়তুল মোকাদ্দাস উদ্ধারের শপথ নিয়েছিল। তারা বায়তুল মোকাদ্দাসের জন্য জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিতেও কুণ্ঠিত ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, একজন বিশ্বাসঘাতকই সমস্ত জাতিকে ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত করার জন্য যথেষ্ট। যদি নিজের আস্তিনের ভেতর বিশ্বাসঘাতক লুকিয়ে থাকে তবে শত্রুর চেয়ে শতগুণ শক্তিশালী হওয়ার পরও তাকে পরাজয় বরণ করতে হয়। কারণ শত্রুর কেনা গোলাম রাতের অন্ধকারে ঘরের দরজা খুলে দেয় দুশমনের জন্য।

এমনি একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৫ জুলাই ১০৯৯ খৃস্টাব্দে। খৃস্টানরা সেদিন বায়তুল মোকাদ্দাসের উপর আধিপত্য লাভ করার জন্য এগিয়ে আসছিল। সে সময় কতিপয় মুসলমান আমীর ও শাসক খৃস্টানদের সাহায্য না করলে খৃস্টানদের পক্ষে জেরুজালেম দখল করা কোনদিনই সম্ভব হতো না। সেই বেদনাঘন কলংকময় ইতিহাস বড়ই তিক্ত ও দুঃসহ। যখন ক্রুসেড বাহিনী বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন যদি শাহজার আমীর খৃস্টানদের রাস্তা না দেখাতো এবং তাদের খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করে সাহায্য না করতো তবে জেরুজালেমের ইতিহাস হতো ভিন্ন রকমের।

হিম্মাত এবং ত্রিপোলীর মুসলমান আমীররাও শাহজার আমীরের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল। তারাও সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল খৃস্টানদের প্রতি। খৃস্টানরা তাদের জন্য মেলে ধরেছিল উপঢৌকনের ডালি। সেই উপহার পেয়েই গাদ্দাররা মুসলমানদের প্রথম কেবলা ধ্বংসের পথ সুগম করেছিল।

ক্রুসেড বাহিনীর অগ্রাভিযানের পথে ছোট ছোট যে সব মুসলিম রাষ্ট্র পড়েছিল তারা তাদের নিরাপত্তার দোহায় দিয়ে খৃস্টানদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল তাদের এগিয়ে চলার পথ। খৃস্টানদের দেয়া উপহার সামগ্রী গ্রহণ করে মেনে নিয়েছিল তাদের সব দাবী, পূরণ করেছিল তাদের সব প্রয়োজন।

শুধু ব্যতিক্রম ছিলেন ইরকার আমীর। তিনি একজন মর্দে মোমিন ও মুজাহিদ ছিলেন। ক্রুসেড বাহিনীর তুলনায় তার শক্তি ছিল নিতান্ত নগণ্য। কিন্তু তিনি ক্রুসেড জেনারেলের দেয়া সুন্দর উপহার গ্রহণ করেননি। তিনি তাদের দাবী পূরণ করতে অস্বীকার করে ক্রুসেড বাহিনীর সাথে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন। ক্রুসেড বাহিনী তার শহর অবরোধ করলো। কিন্তু তিনি প্রাণপণে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে দিলে খৃস্টান বাহিনী তার সাহস ও বীরত্ব দেখে বিস্মিত হয়।

১০৯৯ খৃস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারী থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত পুরো এক মাস অবরোধ করেও তারা ইরকার আমীরের মাথা নোয়াতে পারেনি। অবশেষে ক্রুসেড বাহিনী বহু জান মালের ক্ষতি স্বীকার করে ইরকার অবরোধ উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়। ইরকার আমীর খৃস্টানদেরকে তার ভূমি ব্যবহার করতে না দেয়ায় খৃস্টানরা রাস্তা পরিবর্তন করে ঘুর পথে বায়তুল মোকাদ্দাসে অভিযান চালাতে বাধ্য হয়েছিল বলেই তাদের টার্গেটকৃত নির্ধারিত সময়ে তারা জেরুজালেম যেতে পারেনি।

নির্বোধ মুসলমান আমীররা যদি সেদিন ইরকার আমীরের মতো খৃস্টানদের সামনে বাঁধার প্রাচীর তুলে দিত তবে একের পর এক বাঁধা মাড়িয়ে অগণিত জানমালের ক্ষতি স্বীকার করে ক্রুসেড বাহিনীর পক্ষে বায়তুল মোকাদ্দাসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছা কিছুতেই সম্ভব হতো না। এভাবে বায়তুল মোকাদ্দাস পৌঁছতে গেলে কম করেও তাদের দুই আড়াই বছর সময় লেগে যেতো। ততোদিনে বায়তুল মোকাদ্দাস জয় করার মনোবল ও স্বপ্নসাধ নিঃশেষ হয়ে যেতো ক্রুসেড বাহিনীর।

ইতিহাস কোনদিনই সেই সব শাসককে ক্ষমা করবে না, যারা ক্রুসেড বাহিনীকে বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত পথ দেখিয়েছিল। যারা তাদের অর্থ ও খাদ্য সাহায্য দিয়ে তাদের মনোবলকে অটুট রেখেছিল। কতিপয় মুসলিম আমীরের গাদ্দারীর শাস্তি ভোগ করতে হলো সমগ্র জাতিকে। প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে মুসলমানদের উপর চেপে রইলো পরাধীনতার কঠিন শৃংখল।

এই অভিশাপ থেকে জাতিকে বাঁচানোর কঠোর সংকল্প নিয়েই ছুটে এসেছেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। পথের সমস্ত বাঁধা মাড়িয়ে এসে পৌঁছেছেন জেরুজালেমের সন্নিকটে।

বায়তুল মোকাদ্দাস যখন খৃস্টানরা দখল করে তখন সেখানে বহু দেশের তীর্থ যাত্রীও ছিল। তারা সবাই ক্রুসেড বাহিনীর নির্মম ধ্বংস যজ্ঞের শিকার হয়েছিল।

১০৯৯ সালের ৭ জুন ক্রুসেড বাহিনী বায়তুল মোকাদ্দাস অবরোধ করে। তখন মিসরের গভর্ণর ইফতেখারউদ্দৌলা বায়তুল মোকাদ্দাসের শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। সামান্য গভর্ণর হয়েও শেষ শক্তি দিয়ে লড়াই করেন তিনি।

অসাধারণ সামরিক কৌশল প্রয়োগ করেন খৃস্টানদের কবল থেকে পবিত্র ভূমি রক্ষা করার জন্য। সামান্য সৈন্য নিয়ে বিশাল বাহিনীর স্রোত মাসাধিক কাল আটকে রাখেন শহরের বাইরে। অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন করে তিনি সৈন্য নিয়ে শহরের বাইরে চলে আসতেন। কচুকাটা করতেন আগ্রাসী বাহিনীকে। বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে তিনি প্রমাণ করছিলেন মুসলমান জান দিতে জানে কিন্তু মান দিতে জানে না।

কিন্তু ক্রুসেড বাহিনীর বেপরোয়া সয়লাব ও উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের মুখে গুটিকয় মুজাহিদ আর কতোক্ষণ টিকে থাকবে? ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই মুজাহিদদের লাশের ওপর দিয়ে শহরে প্রবেশ করলো ক্রুসেড বাহিনী।

এ বিজয়ের আনন্দে সমস্ত ইউরোপীয় দেশগুলো এবং বিশ্বের সর্বত্র খৃস্টান দেশগুলোতে শুরু হয়ে গেলো বিজয়ের উৎসব। কিন্তু সর্বাধিক ভয়াবহ ও নির্মম উৎসব পালিত হলো বায়তুল মোকাদ্দাসে। বিজয়ী ক্রুসেড বাহিনী মুসলমানদের গৃহে হায়েনার মত প্রবেশ করলো। বেপরোয়া লুটপাট করলো প্রতিটি মুসলিম ঘরে। কোন ঘরে কোন পুরুষ মানুষ, হোক সে বৃদ্ধ বা দুগ্ধ পোষ্য শিশু, কাউকে জীবিত রাখলো না।

জীবিত ছিল শুধু যুবতী মেয়েরা, যারা হয়েছিল পশুদের লালসার খোরাক। রাস্তায় পলায়নরত মুসলমান শিশু, নারী, পুরুষ যাকেই পেল, তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করলো। খৃস্টানরা কোলের শিশুকে বর্শার আগায় বিদ্ধ করে উপরে তুলে চিৎকার দিত আর হো হো করে হাসতো জল্লাদের মতো। প্রকাশ্য রাস্তায় হাজারো চোখের সামনে মেয়েদের সতীত্ব নাশ করে ফেটে পড়তো অট্টহাসিতে। তারপর সেই মেয়েকে হত্যা করে তার কাটা মাথা বর্শার আগায় বিদ্ধ করে শুরু করতো জংলী নৃত্য। মানুষ হত্যা করা তাদের কাছে ছিল সবচে আকর্ষনীয় ও প্রিয় খেলা।

মুসলমানদের আশ্রয়ের কোন স্থান ছিল না। এমন কোন নিরাপদ জায়গা ছিল না যেখানে তারা একটুখানি আশ্রয় পেতে পারে।

একদল নারী ও শিশুসহ কিছু সংখ্যক মুসলমান ভেবেছিল আল্লাহর ঘর মসজিদে নিশ্চয়ই হামলা করবে না খৃস্টানরা। মসজিদকে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে তারা মসজিদুল আকসায় গিয়ে আশ্রয় নিল। খৃস্টান সৈন্যরা যখন দেখলো শিশু ও নারীসহ সব ধরনের মানুষই জমায়েত হয়েছে সেখানে, ওরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। মসজিদের চত্বর ভরে গিয়েছিল একদল ভয়ার্ত, অসহায় ও দিশেহারা মানুষে। সেখানে মানুষের দাঁড়ানোরও আর জায়গা ছিল না।

যারা মসজিদুল আকসার চত্বরে জায়গা পায়নি তারা ছুটলো বাবে দাউদ ও অন্যান্য মসজিদে। এভাবে জেরুজালেমের প্রতিটি মসজিদে আশ্রয় নিল হাজার হাজার মুসলমান। যারা মসজিদুল আকসায় ঠাঁই পেয়েছিল তাদের মনে বেঁচে যাওয়ার একটা আশা এ জন্যই বাসা বেঁধেছিল যে, এ মসজিদকে সকল ধর্মের লোকই পবিত্র স্থান মনে করে। এমতাবস্থায় এ পবিত্র ঘরে নরহত্যার দুঃসাহস করবে না কোন হামলাকারী।

ইউরোপের ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, জেরুজালেম দখলের সময় ভীতসন্ত্রস্ত মুসলমানরা বিভিন্ন মসজিদ ও উপাসনালয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। এই শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা ছিল সত্তর হাজারের অধিক।

খৃস্টানরা মসজিদুল আকসাকে তাদেরও ইবাদতখানা এবং পবিত্র স্থান মনে করতো। কিন্তু বিজয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা খৃস্টানদের মনে তখন স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধির লেশমাত্র ছিল না। তারা তখন হয়ে উঠেছিল পশুর অধিক পশু। তারা মনে করলো, পবিত্র ঘরে শত্রু নিধন করতে পারলে অধিক পূণ্য লাভ করা যাবে। তাই তারা কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে, হিংস্র দস্যুর মত ঝাঁপিয়ে পড়লো বায়তুল মোকাদ্দাসে আশ্রয়প্রার্থী হাজার হাজার নিরীহ মুসলমানদের ওপর।

একটি বাচ্চা শিশুও তাদের এই বর্বরতার হাত থেকে রক্ষা পেলো না। মসজিদুল আকসা, বাবে দাউদ ও শহরের অন্যান্য মসজিদগুলো লাশে ঠাসাঠাসি হয়ে গেল। মসজিদ থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়ে এসে গড়িয়ে পড়তে লাগলো রাস্তায়। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, ‘রাস্তায় এতো রক্ত জমা হলো যে খৃস্টান অশ্বারোহীদের ঘোড়াগুলোর পা সেই রক্তে ডুবে যেতো।’

মসজিদের ভেতর থেকে মুসলিম মেয়েদের জোরপূর্বক টেনে বের করে তাদের উলঙ্গ করে হাকিয়ে নেয়া হতো।

যেখানে সেখানে যখন তখন ঘটতো তাদের সম্ভ্রম ও সতীত্ব হরণের ঘটনা। নির্যাতীত মেয়েরা অজ্ঞান হয়ে গেলে তাদের মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফিরিয়ে আনতো তাদের। তারপর আবার চলতো তাদের ওপর পাশবিক নিপীড়ন।

পুরুষদের হত্যা করে ফেলায় শহরে শ্রমিক সংকট দেখা দিল। তখন এই মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দিল অমানুষিক কঠোর পরিশ্রমের কাজ। এই সব মেয়েদের দিয়ে তারা পরিশ্রমের কাজ করিয়ে নিলেও সেই অনুপাতে খাবার দিত খুবই কম। এই মেয়েদের তারা লাগালো মসজিদ ভাঙ্গার কাজে।

যে মেয়ে কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়তো তাকে নির্দয়ভাবে প্রহার করতো। যখন বুঝতো এই মেয়েকে দিয়ে আর কোন কাজ করানো যাবে না তখন তাকে জবাই করে তার গোশত তুলে দিত বাবুর্চির হাতে। বাবুর্চি গরু ছাগলের গোশতের মতোই সেই গোশত রান্না করে খৃস্টান অফিসার ও সৈন্যদের খেতে দিত।

মানুষের গোশত খাওয়ার এই রেওয়াজ প্রথমে জেরুজালেমেই চালু হয়। এক হিংস্র খৃস্টান যুদ্ধবন্দী এক মুসলমানকে জবাই করে তার শরীরের গোশত বাবুর্চির হাতে দিয়ে বললো, ‘রান্না করে দাও, আজ এই দিয়েই ভুঁড়িভোজ করবো।’

রান্নার পর সেই গোশত খেয়ে সে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সঙ্গীদের বললো, ‘খেয়ে দেখো কেমন স্বাদ।’ তারপর থেকেই সেখানে মুসলমানদের মাংস খাওয়ার প্রথা চালু হয়ে গেল। যখনই কোন উৎসব ও ভোজসভার আয়োজন হতো তখনই মোটা তাজা মুসলমান ধরে জবাই করে তার মাংস রান্না করে খাওয়ানো হতো। ইউরোপের খৃস্টান ঐতিহাসিকরাও মানুষ খাওয়ার এই অমানবিক প্রথার কথা তাদের লেখায় উল্লেখ করেছেন।

মুসলিম শূন্য মসজিদগুলোকে তারা বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করতে শুরু করলো। অপূর্ব কারুকার্যখচিত কিছু মসজিদ তারা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিল। কিছু মসজিদকে বানিয়ে নিল পতিতালয়। কিছু মসজিদকে বানালো খৃস্টান সৈনিকদের ঘোড়ার আস্তাবল।

মসজিদুল আকসায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সুলতান ও সরকার প্রধান এবং অভিজাত দর্শনার্থীরা সোনা রূপার ঝাড়বাতি ও সৌন্দর্যবর্ধক নানা জিনিষ দান করেছিলেন। খৃস্টানরা সেই সব মূল্যবান উপহার সবই লুট করে নিল। তারপর তারা মসজিদের মেহরাবের ওপর স্থাপন করলো তাদের পবিত্র ক্রুশ, মা মেরীর ছবি ও হযরত ঈসা (আ.)-এর মুর্তি।

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী শৈশবেই বায়তুল মোকাদ্দাসের অবমাননা ও সেখানকার মুসলমানদের ওপর যে নির্মম হত্যাকান্ড এবং বর্বরতা চালানো হয় সেই কাহিনী তার পিতা নাজমুদ্দিন আইয়ুবীর কাছ থেকে শুনিয়েছিলেন। তার পিতা এ কাহিনী শুনিয়েছিলেন তার দাদার কাছ থেকে।

এ নির্মম কাহিনীর প্রভাব সুলতান আইয়ুবীর শিরায় শিরায় মিশে গিয়েছিল। শৈশবেই তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সময় হলে তিনি বায়তুল মোকাদ্দাস মুক্ত করবেন।

আসকালান থেকে সৈন্য চালানোর আগে তিনি আরেকবার স্মরণ করলেন সেই প্রতিজ্ঞার কথা। ভাবলেন, আজ আর স্বপ্ন নয়, জীবনের শ্রেষ্ঠ স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে তিনি এসে পৌঁছেছেন। আর মাত্র চল্লিশ মাইল দূরে তাঁর স্বপ্নের শহর জেরুজালেম। যে শহরে আছে রাসূলের স্মৃতি বিজড়িত মসজিদ বায়তুল মোকাদ্দাস। সেই মসজিদুল আকসায় দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ার জন্য তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

পরবর্তী বই ক্রুসেড-২৯

যাযাবর কন্যা

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 5 | 6 | 7 | 8 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top