২৮. রক্তস্রোত

আলফারেস ছিলেন সুঠাম ও সুন্দর চেহারার অধিকারী এক সেনা কমান্ডার। তারপরও তার চেহারায় খেলা করতো মায়াময় এক কমনীয়তা। চেহারা দেখে বুঝার উপায় ছিল না, এ লোক এমন দুর্দান্ত ও দুঃসাহসী। অসাধারণ বীর যোদ্ধা হিসাবে নৌবাহিনীতে তার খ্যাতি ছিল। কিন্তু লোকজন তাকে বেশী পছন্দ করতো তার অমায়িক হাসি ও কৌতুকপ্রিয়তার জন্য। তার মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকতো। নারীরা যে সব পুরুষ একবার দেখলে তার চেহারা আর ভুলতে পারে না, আলফারেস ছিলেন তেমনি রমনী মোহন, প্রাণবন্ত ও উচ্ছ্বল। তার এই সদা প্রফুল্ল আনন সহজেই মেয়েদের নজর কেড়ে নিল।

মেয়েরা আলফারেসকে বললো, ‘আমরা অসহায়। আপনি কি আমাদের একটু আশ্রয় দেবেন? দরকার হলে আমরা আপনার ওখানে দাসীগিরী করবো।’

তার বয়সী লোকেরা তখন একই সময় দু’তিনটি করে স্ত্রী রাখতো। আভিজাত্য প্রকাশের এটাও একটা পদ্ধতি ছিল। কিন্তু সামরিক বাহিনীর ট্রেনিংয়ের ব্যস্ততা, যুদ্ধের কারণে মাসের পর মাস সাগরে থাকার ফলে অনেকদিন তার স্থলে যাওয়ারই সুযোগ হয়ে উঠেনি। ফলে তখনো আলফারেস বিয়ে করার অবসর করতে পারেননি। আলফারেস ভাবলেন, জাহাজের যারা বড় অফিসার তারা স্ত্রী ও দাসীদের সাথে রাখার জন্য কেবিন পায়। বিয়ে করলে আমিও মাঝে মধ্যে স্ত্রীকে এনে সঙ্গে রাখার সুযোগ পেতাম, কিন্তু আমি তো এখনো বিয়েই করিনি।

মেয়ে দুটির রূপ ও যৌবন দেখে আলফারেস খুবই চমৎকৃত হলেন। গত তিন মাস ধরে তিনি একটানা সমুদ্রে কাটাচ্ছেন। সমুদ্রের একঘেয়ে জীবনে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। মাটিতে পা দিতে পারায় যখন তার মনটা ভাল হয়ে উঠেছে, তখনই তিনি দেখতে পান মেয়েদের।

আলফারেস মেয়ে দুটিকে বললেন, ‘আমার তো মাটির সাথেই সম্পর্ক নেই। নিজেই মাসের পর মাস পড়ে থাকি জাহাজে। তোমরা কি আমার সাথে জাহাজে থাকতে পারবে? যদি তোমরা জাহাজে থাকতে সম্মত হও তবে জাহাজের কোন কামরা তোমাদের জন্য ছেড়ে দেয়া যেতে পারে।’

‘আমরা অসহায় ও দুর্বল মেয়ে মানুষ। আপনি আমাদের আশ্রয় দিলে আমরা আপনার ওপর চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবো। কিন্তু আপনি আমাদের সঙ্গে কোন রকম ধোঁকা ও প্রতারণা করবেন না তো? আমাদের তো বিক্রি করে দেবেন না আবার?’

‘আরে না, তোমরা তো আমার ক্রীতদাসী নও।’ আলফারেস বললেন, ‘তোমরা রাজি থাকলে তোমাদের দু’জনকে আমি মিশর নিয়ে যাবো এবং দু’জনকেই বিয়ে করে নেবো।’

মেয়েরা একে অন্যের দিকে তাকালো। চোখে চোখে কথা বললো। শেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে আলফারেসকে বললো, ‘আমরা রাজি।’

আলফারেস তার নৌকার মাল্লাদের ডেকে বললেন, ‘এদের জাহাজে নিয়ে যাও। আমার ক্যাবিনে ওদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে ফিরে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকো’ এই বলে আলফারেস মেয়েদেরকে নৌকায় উঠিয়ে দিয়ে আনন্দ মনে গুন গুন করতে করতে সুলতান আইয়ুবীর সাথে দেখা করার জন্য এগিয়ে চললেন।

‘আলফারেস!’ সুলতান আইয়ুবী তাকে বললেন, ‘আমি তোমার সম্পর্কে জানি। সামুদ্রিক যুদ্ধে তোমার দক্ষতা ও সাফল্যের একাধিক কাহিনীও শুনেছি। কিন্তু বর্তমান অবস্থা অন্য রকম। আগে তুমি ছোটখাট যুদ্ধ করেছো। এখন বিরাট আকারের যুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে।

আমি বায়তুল মোকাদ্দাস জয় করতে এসেছি। কিন্তু তার আগে আমি বড় বড় সামুদ্রিক বন্দরগুলো আমাদের অধিকারে আছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাই। বিশেষ করে উত্তর দক্ষিণ উপকূলের এলাকাগুলো আমার জন্য বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের গোয়েন্দা বাহিনী তোমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে। এ জন্য তোমার দু’চারটি নৌকা সবসময় কূলে থাকতে হবে। আমি স্থলপথে যেদিকেই যাবো তোমাদের সংবাদ জানাবো। তোমাদের রণতরী সাগরে টহল দিয়ে বেড়াবে। তোমার জাহাজের বহরে অস্ত্র ও খাদ্য শস্যের কোন ঘাটতি নেই তো?’

‘আমরা সব দিক থেকেই প্রস্তুত হয়েই এসেছি সুলতান।’ আলফারেস উত্তর দিলেন।

‘বিরাট আকারের যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘খৃস্টানরা হাতিন রণাঙ্গনে যে পরাজয় বরণ করেছে তা কোন তুচ্ছ ব্যাপার নয়। তারা যেভাবে কাপুরুষের মত পালিয়েছে তাতে অপমানের এক বিশাল বোঝা চেপে আছে সমগ্র খৃস্টান জগতের ঘাড়ে। তাদের চারজন সম্রাট এখনো আমার কাছে বন্দী আছে। একজনকে হত্যা করতে আমি বাধ্য হয়েছি। সম্রাট রিমান্ড মারা গেছেন। তাদের সবচে বাহাদুর ও যোগ্য শাসক সম্রাট বিলডনও মারা গেছেন। ফলে এবার তারা আরো শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে আসবে আমার সাথে মোকাবেলা করার জন্য।

কায়রো থেকে আলী বিন সুফিয়ান সংবাদ পাঠিয়েছেন, ইংল্যান্ড থেকে সম্রাট রিচার্ড ও জার্মানীর সম্রাট ফ্রেডারিক এই অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ফিলিস্তিন অভিমুখে রওনা হয়ে গেছেন। তারা আসছেন ফিলিস্তিনের মাটিতে ক্রুসেড শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য। আমরা লড়ছি এই দখলদার বাহিনীকে ফিলিস্তিনের মাটি থেকে উৎখাত করে মসজিদুল আকসা মুক্ত করার জন্য। তাদের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সাথে বিশাল নৌবাহিনীও সঙ্গে নিয়ে আসবেন। আর আমি জানি, তাদের রণতরী ও নৌবাহিনী পৃথিবীর সেরা বাহিনী বলে খ্যাত। এই বিশাল বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে না পারলে আমরা আমাদের এই বিজয় ধরে রাখতে পারবো না।’

‘আপনি কি মনে করেন ওদের সাথে আমাদের এবারের মূল লড়াইটা সমুদ্রেই হবে?’ আলফারেস প্রশ্ন করলেন।

‘তারা এলে তবে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারবো, তাদের সাথে আমার মূল লড়াইটা কোথায় হবে? আমি কি স্থলপথে ওদের জন্য অপেক্ষা করবো নাকি সমুদ্রপথেই তাদেরকে বাঁধা দিয়ে তাদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে পারবো? ইংল্যান্ডের নৌবাহিনী সম্পর্কে শুনেছি, তাদের নৌবহর বিরাট এবং শক্তিশালী। মনে হচ্ছে তারা সঙ্গে বারুদ নিয়ে আসবে। বারুদ কামানের নলের মধ্যে ভর্তি করবে যাতে আগুন দিলে বারুদ নলের মধ্য দিয়ে উড়ে এসে জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেয়।’

‘আমাদেরও এমন কামান লাভ করার চেষ্টা করা উচিত।’

‘ভেবো না, আমরা নিজেরাই ওরকম কামান তৈরী করে নিতে সক্ষম হবো ইনশাআল্লাহ। তোমরা উপকূলের কাছাকাছি কোন শত্রু জাহাজকে ভিড়তে দিও না। ছয়টি জাহাজের যে বহর তোমার কমান্ডে আছে তাকে সংহত রেখে গভীর সাগর পর্যন্ত তুমি টহল দিয়ে বেড়াবে। শত্রু বহরের সন্ধান পেলে তাদের ওপর অতর্কিতে চড়াও হবে। সঙ্গে সঙ্গে সেই খবর যেন আমার কাছে পৌঁছে যায় সেদিকে খেয়াল রাখবে। এ্যাডমিরাল আল মুহসিনকেও প্রস্তুত অবস্থায় উন্মুক্ত সাগরেই অবস্থান করতে বলবে।’

সুলতান আইয়ুবী প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘যাও, সব সময় হুশিয়ার থাকবে এবং বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। আর মনে রাখবে, আল্লাহই হচ্ছেন আমাদের প্রকৃত মোহাফেজ। তাই সব সময় আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে থাকবে। কখনো এমন কিছু করবে না, যাতে আল্লাহ নারাজ হতে পারেন।’

সুলতানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আলফারেস আর দেরী করলেন না, সঙ্গে সঙ্গে উপকূলের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। নৌকা নির্দিষ্ট স্থানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। তিনি উপকূলে পৌঁছেই মাল্লাদের বললেন, ‘জাহাজে চলো।’

নৌকায় কেবলই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল সুলতানের আদেশ নিষেধ ও পরামর্শগুলো। সুলতানের নির্দেশগুলো যেন তাকে তাড়িয়ে ফিরছে। তিনি জাহাজে পৌঁছেই অন্য জাহাজের ক্যাপ্টেনদের ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তাদের বুঝিয়ে বললেন সুলতানের বর্তমান পরিকল্পনা।

তিনি উপস্থিত ক্যাপ্টেনদের কাছে সুলতানের নির্দেশ ও উপদেশ পৌঁছে দিয়ে বললেন, ‘এবার যার যার জাহাজে ফিরে যাও। কঠিন অবস্থা সামনে, তাই সবাইকে সচেতন ও সক্রিয় করে তোল। বিপর্যয় আসার আগেই যারা সতর্ক হতে পারে তারা অনেক বিপদ সহজে মোকাবেলা করতে পারে। কোন রকম অবহেলা ও অলসতাকে মোটেই প্রশ্রয় দেবে না।’

ক্যাপ্টেনরা বিদায় নিয়ে নিজ নিজ জাহাজে ফিরে গেলেন। এতোক্ষণ মেয়েদের কথা আলফারেসের মনেই ছিল না। ক্যাপ্টেনরা বিদায় হতেই তার মনে পড়ে গেল দুটি অসহায় মেয়েকে তিনি জাহাজে পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি নিজের ক্যাবিনের দিকে হাঁটা দিলেন।

ক্যাবিনে দুই মেয়ে এতোক্ষণ তার অপেক্ষাতেই বসেছিল। তারা তাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো এবং আনন্দিত গলায় বললো, ‘আপনি এসেছেন?’

‘হ্যাঁ, তোমরা ভাল আছো? খাওয়া দাওয়া করেছো?’

তারা সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে সহজভাবেই জিজ্ঞেস করলো, ‘এই গভীর সাগরে আপনারা কি করছেন? এই অন্তহীন জলরাশি, সাগরের ঢেউ কি যে ভাল লাগছে!’

আলফারেসের দীর্ঘদিনের নিরানন্দ জগত যেন হঠাৎ করেই উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। মেয়েদের চোখের তারায় আনন্দ চিকচিক করছিল, আলফারেসের স্বভাবসুলভ হাসি খুশির সাথে মিশে গেল সেই আনন্দ। পুরুষ পটানোয় পারদর্শী দুই মেয়ের সাথে রং তামাশায় মেতে উঠলেন আলফারেস।

২০ জুলাই ১১৮৭। সুলতান আইয়ুবী আক্রা থেকে বের হলেন। সুলতানের কমাণ্ডো বাহিনী তাঁর জন্য আগে থেকেই রাস্তা পরিষ্কার করে রেখেছিল। তিনি কোন রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সামনে এগিয়ে গেলেন।

উপকূল এলাকার একাধিক কেল্লা ও বসতি হস্তগত করে তিনি পৌঁছলেন বৈরুতের উপকণ্ঠে। ৩০ জুলাই তিনি বৈরুত অবরোধ করলেন।

খৃস্টানরা এই গুরুত্বপূর্ণ শহর বাঁচাতে প্রাণপণ লড়াই করলো। কিন্তু সুলতান আইয়ুবীর জানবাজদের সামনে টিকতে পারলো না তারা। অসাধারণ ক্ষিপ্রতার সাথে তিনি বৈরুত দখল করে নিলেন। দেখলেন, বৈরুতের মুসলমানদের অবস্থাও আক্রার মুসলমানদের মতোই অবর্ণনীয় ও দুর্বিসহ। সীমাহীন নির্যাতনের ছাপ লেগে আছে তাদের চেহারায়। অনেক বস্তি ও ঘরদোর বিধ্বস্ত। মসজিদগুলো বিরাণ। সেগুলোর কোন কোনটি খৃস্টানরা তাদের ঘোড়ার আস্তাবল বানিয়ে নিয়েছে।

২৯ জুলাই বৈরুত শহর পরিপূর্ণভাবে নিজের অধীনে নিয়ে আসার পর তিনি পার্শ্ববর্তী প্রসিদ্ধ উপকূলীয় শহর টায়েরের দিকে যাত্রা করলেন। গোয়েন্দাদের কাছ থেকে খবর পেলেন, খৃস্টানরা এ শহরটির পতন রোধ করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।

তারা  তাদের অনেক সৈন্য শহরের বাইরে চারদিকে ছড়িয়ে রেখেছে। এদিক ওদিক থেকে পালিয়ে আসা খৃস্টান সৈন্যরাও সেখানে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। তারা নতুন করে সমবেত হচ্ছে সেখানকার বাহিনীতে। বিভিন্ন উপকূল থেকে সরে এসে খৃস্টান সৈন্যরা জমা হচ্ছে আইয়ুবীর সম্ভাব্য হামলা মোকাবেলা করার জন্য।

এ খবর পেয়ে সুলতান আইয়ুবী টায়েরে আক্রমণের পরিকল্পনা ত্যাগ করলেন। তিনি টায়েরে নতুন করে শক্তি ক্ষয় না করে বায়তুল মোকাদ্দাস আক্রমণের জন্য সৈন্য বাহিনী দৃঢ় করতে লাগলেন।

আলফারেসের যুদ্ধজাহাজগুলো তখনো সাগরে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। মেয়েরা জাহাজেই স্বচ্ছন্দে অবস্থান করছে। তারা এরই মধ্যে আলফারেসের হৃদয়-মন জয় করে নিয়েছে। স্ফুর্তিবাজ লোক হওয়ার পরও আলফারেস ছিলেন যথেষ্ট দায়িত্ব সচেতন ব্যক্তি। তিনি তার দায়িত্বে বিন্দুমাত্র ত্রুটি বা শৈথিল্য প্রদর্শন করেননি। প্রতিটি জাহাজের সাথে সংযোগ রক্ষা করে তিনি সমুদ্রে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন।

যখন কোন জাহাজ উপকূলের কাছে যেতো তখন আশপাশের ছোট ছোট নৌকা এসে ভীড়তো জাহাজের পাশে। এসব নৌকায় করে গরীব ফেরিওয়ালারা ফল, ডিম, মাখন ইত্যাদি নিয়ে বিক্রি করতো জাহাজীদের কাছে। নৌ সেনারা রশির সিঁড়ি ফেলে তাদের কাউকে কাউকে উঠিয়ে নিত জাহাজে। প্রয়জনীয় জিনিষপত্র কেনাকাটা করে আবার তাদের নামিয়ে দিত। এই ফেরিওয়ালাদের মধ্যেই থাকতো খৃস্টান ও মুসলিম গোয়েন্দারা। জাহাজের ক্যাপ্টেন এটা ওটা কেনার উসিলায় গোয়েন্দাদের কখনো কখনো তুলে নিতেন উপরে। খবরাখবর জেনে নিয়ে আবার তাদের নিচে নামিয়ে দিতেন।

একদিন আলফারেস জাহাজ নিয়ে কূলে গেলেন। গোয়েন্দাদের কাছ থেকে সর্বশেষ সংবাদ নেয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। তিনি ফেরিওয়ালাবেশী মুসলিম গোয়েন্দাকে উপরে তুলে নিলেন।

মেয়ে দু’জন জাহাজের কার্নিস ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। ছোট ছোট তিন চারটি নৌকা এসে ভিড়লো জাহাজের সাথে। নৌকাগুলোতে ফল, ডিম, মাখন ও নানান খাদ্য দ্রব্য। নৌকার ফেরিওয়ালারা জাহাজের লোকদের অনুরোধ করছিল কিছু কেনার জন্য। হাকডাক করে বলছিল তাদের কাছে কি কি আছে।

এক নৌকায় মধ্য বয়সী এক লোক ছেঁড়া কাপড় পরে নৌকার হাল ধরে বসেছিল। লোকটাকে খুবই নিরীহ ও গরীব বলে মনে হচ্ছিল। মেয়েরা কার্নিশে দাঁড়িয়েই দেখলো নৌকাটি তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে লোকটি হাক ছাড়লো, ‘কিছু কিনবেন নাকি শাহজাদীরা? আমি খুবই গরীব। দয়া করে আমার কাছ থেকে কিছু কিনুন।’

মেয়েরা লোকটির দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিল, হঠাৎ তাদের মনে হলো লোকটি তাদের দিকে চোখ টিপে কিছু ইঙ্গিত করছে। মেয়েরা আশ্চর্য হয়ে একে অন্যের দিকে তাকালো। তারপর আবার যখন ওরা তার দিকে ফিরলো, সেই লোক বুকের উপর আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় ক্রুশ চিহ্ন আঁকলো। এক মেয়ে তার দুই হাতের তর্জনীর আঙ্গুল আড়াআড়ি ভাবে রেখে ক্রুশ চিহ্ন এঁকে এর জবাব দিল। মেয়েরা ওর ইঙ্গিত ধরতে পেরেছে দেখে লোকটির ঠোঁটে ফুটে উঠলো বিজয়ের হাসি। মেয়েরা রশির মই নামিয়ে লোকটিকে জাহাজে উঠে আসতে বললো।

মাল্লারা জানতো, এই মেয়েরা জাহাজের ক্যাপ্টেনের আশ্রিতা। মাল্লারা মেয়েদের হুকুম পেয়ে জলদি রশির সিঁড়ি ফেলে দিল। লোকটি তার ঝুড়িতে বিভিন্ন খাবার জিনিষ নিয়ে জাহাজে উঠে এলো। মেয়েরা তাকে একদিকে সরিয়ে নিয়ে তার জিনিষ দেখতে লাগলো। মেয়েরা বিরক্ত হতে পারে ভেবে জাহাজের পুরুষ সৈনিক বা মাল্লাদের কেউ ওদের কাছে যাওয়ার কথা ভাবলো না।

‘তোমরা এখানে কেমন করে পৌঁছলে?’ লোকটি নিচু স্বরে তাদের জিজ্ঞেস করলো।

‘সে এক দৈব ঘটনা।’ এক মেয়ে বললো, ‘সম্রাট হরমন ধরা পড়েছেন। আমাদের কয়েকজন মারা গেছে মুসলমানদের হাতে। আমরা পালিয়ে সমুদ্র পাড়ে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলাম। তারপর এই জাহাজের ক্যাপ্টেনের সাথে জাহাজে এসে উঠেছি।’

‘আরো খুলে বলো। এই জাহাজের ক্যাপ্টেনের সাথে তোমাদের কি করে পরিচয় হলো?’

মেয়েটি সমস্ত ঘটনা লোকটিকে খুলে বললো। ক্যাপ্টেন আলফারেস সম্পর্কে বললো, ‘আমরা তার কাছে নিজেদের অসহায় যাযাবর কন্যা বলে পরিচয় দিয়েছি। তিনি আমাদের বিশ্বাস করে সঙ্গে নিয়ে এসে আশ্রয় দিয়েছেন।’

‘কোন চিন্তা করেছো, এখন কি করবে?’ লোকটি জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় যাবে?’

‘জীবন বাঁচানোর দরকার ছিল, আগে তার ব্যবস্থা করেছি।’ মেয়েটি বললো, ‘এখন ক্যাপ্টেন আলফারেসের রগ পর্যন্ত আমরা নিয়ন্ত্রণ করছি। আর তুমি যদি মনে করো এখানে থেকেই কিছু করতে পারবো তবে সে ভাবেও আমাদের কাজে লাগাতে পারো।’

এই লোকটি ছিল খৃস্টানদের গোয়েন্দা। সে মেয়েদেরকে আগে থেকেই চিনতো, মেয়েরাও চিনতো তাকে। মেয়েদের দেখেই সে তাদের চিনে ফেলেছিল, কিন্তু ছদ্মবেশে থাকায় মেয়েরা প্রথমে তাকে চিনতে পারেনি। জাহাজে উঠে আসার পর তার কণ্ঠ শুনে চিনতে পারে এ লোক তাদেরই এক গোয়েন্দা কমান্ডার।

সে লোক মেয়েদের বললো, ‘উপকূলে নেমে পালানোর চেষ্টা করো না। তাতে কঠিন বিপদের সম্মুখীন হবে। বৈরুত পর্যন্ত মুসলমানদের অধিকারে চলে গেছে। আমাদের খৃস্টান বাহিনী সবখানেই পিছু হটছে। এখন উপকূলে নামলে মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করা হবে। শুধুমাত্র টায়ের শহর অবশিষ্ট আছে যেখানে এখনো তোমাদের আশ্রয় মিলতে পারে।’

‘তাহলে এখন তুমি আমাদের কি করতে বলো।’ জানতে চাইলো এক মেয়ে।

‘এখন এই জাহাজেই থাকো। আমি তোমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবো। আমাদের জন্য পরিস্থিতি এখন খুবই সংকটজনক। সবখানেই মুসলিম বাহিনী অস্ত্র হাতে ঘুরছে। অতএব যা করার খুব সাবধানে করতে হবে।’

‘তুমি এখানে কি করছো?’

‘আমি ক্রুশের ওপর হাত রেখে যে শপথ করেছিলাম তাই পালন করছি।’ সে উত্তরে বললো, ‘এই জাহাজগুলোর গতিবিধি লক্ষ্য করছি। এগুলো ধ্বংস করার একটা ব্যবস্থা আমি অবশ্যই করবো।’

‘আমাদের জাহাজ কোথায় আছে?’

‘টায়েরের কাছে।’ সে বলল, ‘এ জাহাজ যদি সেদিকে যায়, তবে আমি আগেই সংবাদ জানিয়ে দেবো। তোমরা দৈবক্রমে শত্রুর জাহাজে আশ্রয় পাওয়ায় ভালই হয়েছে। এখন আমি নতুন করে পরিকল্পনা করতে পারবো। তোমরাও আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারবে। আর যদি তোমাদের এই জাহাজ থেকে বের করে টায়েরে পৌঁছানো দরকার হয় আমি তারও ব্যবস্থা করবো।

অনেকক্ষণ হয়ে গেল, এবার আমার কেটে পড়া দরকার। সব সময় দেখা করা সম্ভব নাও হতে পারে। ইশারায় সব কিছু বুঝে নিতে চেষ্টা করবে। আমি এই জাহাজগুলোর সাথে ছায়ার মত লেগে আছি। এ জাহাজগুলো উপকূলের কোথাও না কোথাও নোঙ্গর করবেই। তখন আমি এই বেশেই তোমাদের সাথে দেখা করবো।’

সে ওদের কিছু সংকেত বুঝিয়ে দিল। মেয়েরা তার ঝুড়ি থেকে কিছু জিনিষ কিনে বিদায় করে দিল তাকে। লোকটি রশির সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল তার ছোট ডিঙ্গিতে।

১১৮৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর। সুলতান আইয়ুবী উপকূলীয় শহর আসকালান অবরোধ করলেন। এখানেও খৃস্টানরা প্রতিরোধ গড়ে তুলল। সুলতান আইয়ুবী মেনজানিক কামান দিয়ে ভারী পাথর নিক্ষেপ করা শুরু করলেন শহরের ওপর। এই মেনজানিক ব্যবহারে এবার একটা বাড়তি সুবিধা পাচ্ছিলেন সুলতান। এতদিন মেনজানিকগুলো বহন করা ছিল খুবই সমস্যাবহুল। এবার প্রতিটি মেনজানিকের নিচে চাকা লাগানো ছিল। ফলে এখানে ওখানে সরিয়ে সুবিধামত তিনি মেনজানিকগুলো ব্যবহার করতে পারছিলেন।

রাতে মেনজানিকের ছত্রছায়ায় দেয়াল ভাঙ্গার জন্য বিশেষভাবে তৈরী বাহিনীকে পাঠিয়ে দেয়া হলো প্রাচীরের কাছে। সারা রাত সুড়ং তৈরীর বাহিনী প্রাচীর খোদাই করে প্রাচীরের ভেতর বড় রকমের সুড়ং তৈরী করে ফেললো। পাশেই এক উঁচু স্থান থেকে শহরের মধ্যে মেনজানিক দিয়ে অব্যাহতভাবে পাথর ও অগ্নি নিক্ষেপ চলছিল। পর দিন ভোরে দেয়ালে ফাটল দেখেই শহরবাসী গেট খুলে দিয়ে আত্মসমর্পন করলো।

এই শহরটা ১১৫৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ফ্রাংকস বাহিনী অধিকার করে নিয়েছিল। পূর্ণ চৌত্রিশ বছর পর শহরটি আবার দখল মুক্ত হলো।

আসকালান থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসের দুরত্ব মাত্র চল্লিশ মাইল। শহরটি ছিল আসকালান থেকে সোজা পূর্ব দিকে। বায়তুল মোকাদ্দাসের নিকটতম শহর হিসাবে কৌশলগত দিক থেকে আসকালান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীর জন্য এই দুরত্ব অতিক্রম করা ছিল মাত্র দু’দিনের ব্যাপার।

সুলতান আইয়ুবী আসকালানের প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকে তাকিয়েছিলেন। মরুভূমির বিশাল শূন্যতা অতিক্রম করে তাঁর অন্তর দৃষ্টি চলে গিয়েছিল জেরুজালেম। তিনি যেন এখানে দাঁড়িয়েও দেখতে পাচ্ছেন বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদের সুউচ্চ মিনার চূড়া।

সুলতান আইয়ুবী তাঁর কমাণ্ডো বাহিনীকে এগিয়ে যাওয়ার হুকুম দিলেন। বললেন, ‘আসকালান থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত এই চল্লিশ মাইল পথকে চারটি ভাগে ভাগ করে নাও। একেক ভাগের নিয়ন্ত্রণ নাও একেক গ্রুপ। পথে যে সব সেনা ছাউনি ও খৃস্টানদের ফাঁড়ি পাবে সেগুলো ধ্বংস করে দেবে। তোমাদের অগ্রযাত্রা দেখেছে এমন কাউকে তোমাদের অতিক্রম করে সামনে যেতে দেবে না। সে লোক বেসামরিক ব্যক্তি হলেও। আমাদের মূল বাহিনীর পথ নিষ্কণ্টক রাখা তোমাদের দায়িত্ব। জেরুজালেম পর্যন্ত পথের প্রতিটি মঞ্জিলের অগ্রযাত্রার খবর আমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে।’

আসকালান দখল হওয়ার পর আসকালান থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত যত খৃস্টান গ্রাম ও বস্তি ছিল সেখানকার নারী, পুরুষ ও শিশুরা দলে দলে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটলো জেরুজালেম। আইয়ুবী ভীতি গ্রাস করে নিয়েছিল সমগ্র জনপদ। খৃস্টানরা বেশী শঙ্কিত ছিল নিজেদের অপকর্মের কারণে। কারণ এতদিন মুসলমানদের ওপর তারা যে নির্মম অত্যাচার কেরেছে স্বাভাবিকভাবেই তারা আশঙ্কা করছিল, এবার মুসলমানরা তার প্রতিশোধ নেবে। এই প্রতিশোধের হাত থেকে বাঁচার জন্যই তারা দলে দলে ছুটছিল জেরুজালেম।

সুলতান আইয়ুবী বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানরত তাঁর সমগ্র বাহিনীকে আসকালান ঘাঁটিতে সমবেত হওয়ার আদেশ দিলেন। শুরু হলো বায়তুল মোকাদ্দাস উদ্ধারের চূড়ান্ত আক্রমণ করার প্রস্তুতি।

সুলতান আইয়ুবীর এই বিজয় ও অগ্রাভিযানের খবর দামেশক, বাগদাদ, হলব, মুশেল ও কায়রোসহ সমস্ত আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা সর্বশেষ সংবাদ পেলো, সুলতান আইয়ুবী এখন আসকালানে আছেন। শিগ্রই তিনি জেরুজালেম আক্রমণ করবেন।

ইতিহাসবিদ কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ লিখেছেন, ‘মনে করা হচ্ছিল, ক্রমাগত যুদ্ধের ফলে আইয়ুবীর সৈন্যরা ক্লান্ত ও নির্জীব অবস্থায় এসে আসকালান পৌঁছবে। তাদের বাহুগুলো থাকবে অবসাদগ্রস্ত আর চেহারায় থাকবে সাময়িক বিশ্রামের করুণ আকুতি।

কিন্তু সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা যখন আসকালান এসে জমায়েত হতে শুরু করলো তখন দেখা গেলো, ক্রমাগত সাফল্যে তাদের চেহারাগুলোতে বিশ্বাসের দৃঢ়তা আরো মজবুত হয়েছে। এই সব সৈনিকেরা যেখানেই গেছে সেখানেই দেখেছে সাধারণ মুসলমানদের ওপর খৃস্টানদের বর্বর নির্যতনের চাক্ষুস দৃশ্য। ফলে তাদের মনে এর ভয়াবহ ছাপ পড়েছে। এই নির্যতনের মূল উপড়ে ফেলার জন্য মনে মনে তারা নতুন করে শপথ নিয়েছে। শপথের দৃঢ়তায় শানিত হয়েছে তাদের চেতনার রঙ। এসব দৃশ্য তারা যত দেখেছে ততোই অন্তরে জ্বলে উঠেছে প্রতিশোধের আগুন। আসকালানে আসা প্রতিটি সৈনিকের চোখে মুখে তাই খেলা করছিল টগবগে উদ্যম। তারা বায়তুল মোকাদ্দাসে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ছিল অধীর ও অস্থির। এই আবেগই ছিল জেরুজালেম উদ্ধারে সুলতান আইয়ুবীর প্রধান অস্ত্র।

আসকালানে থাকা অবস্থায় আরেকটি ঘটনায় সুলতান আইয়ুবীর মনোবল আরো বেড়ে যায়। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে দামেশক, বাগদাদ ও অন্যান্য শহর থেকে সেই সময়কার শ্রেষ্ঠ আলেম ওলামারা দল বেঁধে দূর দূরান্তের পথ অতিক্রম করে সুলতানের সাথে দেখা করে সুলতানের সাথে জেরুজালেম প্রবেশ করার আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকেন।

আলেম সমাজের এই আগ্রহ ও দোয়াকে তিনি খুবই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করলেন। তাঁরা সৈন্যদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাছে বায়তুল মোকাদ্দাস প্রবেশের গুরুত্ব ও তার পবিত্রতা বর্ণনা করে ভাষণ দিলেন। বুজুর্গানে দ্বীনের ভাষণ শুনে সেনা বাহিনীর সদস্যদের জযবা ও আকাংখ্যার আগুন আরও তীব্রতর হয়ে উঠলো।

সুলতান আইয়ুবী আলেম সমাজ, সুফি দরবেশ ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে খুবই সম্মান করতেন। তাদের সাথে পেয়ে তিনি দ্বিগুণ উৎসাহ বোধ করেন। তিনিও তাঁর ক্লান্তি ভুলে গভীর আবেগে বললেন, ‘আপনারা দোয়া করুন। ইনশাল্লাহ দুনিয়ার কোন শক্তিই এবার আমাদের পথ আটকাতে পারবে না।’

এ সময় আরো একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো। সুলতান আইয়ুবী আসকালানে আলেমদের সাথে আলাপ করছিলেন, এ সময় তাকে খবর দেয়া হলো, ‘হলব থেকে এক মেহমান এসেছেন।’

সুলতান আইয়ুবী তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য বললে খবরদাতা সুলতানের কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে কিছু বললো। সাথে সাথে সুলতান উঠে দাঁড়ালেন এবং বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি ঠিক বলছো?’

‘হ্যাঁ সুলতান।’

সুলতান আইয়ুবী মেহমানদের রেখে একাই বাইরে এলেন। বাইরের দৃশ্য দেখে তিনি নিজের চোখকেই যেনো বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এই মেহমান ছিলেন মরহুম নুরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুন, যিনি পরবর্তীতে ইয়াজউদ্দিনের বিবি হয়েছিলেন।

রাজিয়া খাতুন তখনো অশ্বপৃষ্ঠে বসা। সুলতানকে দেখেই তিনি অশ্বপৃষ্ঠ থেকে লাফিয়ে নামলেন। সুলতানও ছুটে গেলেন তার কাছে। আবেগে অনেকক্ষণ দু’জনের কেউ কথা বলতে পারলেন না।

কিছুক্ষণ পর। তারা সবেমাত্র কুশল বিনিময় শেষ করেছেন। একটি উটের কাফেলা এসে তাদের কাছাকাছি থামলো। উটের ওপর দু’শর অধিক আরোহী, সবাই মেয়ে।

‘এসব কি?’ সুলতান আইয়ুবী রাজিয়া খাতুনকে জিজ্ঞেস করলেন।

‘আহত সৈন্যদের সেবা করার জন্য আমি ওদের নিয়ে এসেছি।’ রাজিয়া খাতুন উত্তর দিলেন, ‘আমি ওদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ওরা শুধু নার্স নয়, যুদ্ধ বিদ্যায়ও সমান পারদর্শী। আপনি ওদের তীরন্দাজীতে যেমন পটু পাবেন তেমনি তলোয়ার চালনায়ও ওরা দক্ষ।’ রাজিয়া খাতুন একটু দম নিয়ে বললেন, ‘ভাই, আমি জানি তুমি যুদ্ধের ময়দানে মেয়েদের আনা পছন্দ করো না। কিন্তু আমার এই মেয়েদের আবেগকে তুমি বাঁধা দিও না। তুমি জানো না, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এসব মেয়েরা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য আবেগে ফেটে পড়ছে। ওরা রণক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।’

হতবিহবল সুলতান নির্বাক দাঁড়িয়েছিলেন। সুলতান কিছুই বলছেন না দেখে তিনি আরেকটু সাহসী হলেন। বললেন, ‘যদি তুমি আমাকে অনুমতি দাও তবে আরও এক হাজার যোদ্ধা মেয়ে আমি এখনি যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাতে পারবো। পুরুষ সৈন্যদের মতোই ওরা সমান দক্ষতা নিয়ে যুদ্ধ করবে। ওদের লড়াই দেখে ওরা পুরুষ না মেয়ে সে পার্থক্য তুমিও করতে পারবে না।

পুরুষ আর মেয়ে বলো, ওরা তো একই মায়ের দুধ পান করেছে, ওদের চেতনাও অভিন্ন। যে মায়েরা তার ছেলেকে যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়ে বিজয়ের খবর শুনতে চায়, সন্তান ফেরত চায় না, ওরাও সেই মায়ের সন্তান। আজ আর নারী পুরুষ নেই, সবার মুখে এক কথা, যুদ্ধক্ষেত্রের খবর কি? বলো, ভাই সালাহউদ্দিন, আমি কি ওই মেয়েদের লড়াই করার জন্য পাঠাবো?’

‘আমি এদেরকে আহত সৈন্যদের সেবার জন্য রেখে দেবো।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘তবে আমি কোন মেয়েকে যুদ্ধের ময়দানে পাঠাবো না।’

‘সুলতান!’ রাজিয়া খাতুন আইয়ুবীকে বললেন, ‘এই উটের পিঠে তোমার জন্য এক দামী উপহার নিয়ে এসেছি। এমন দামী উপহার…।’ এটুকু বলেই রাজিয়া খাতুন ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন।

সুলতান বিচলিত হয়ে বললেন, ‘কি এনেছেন? কি আছে উটের পিঠে?’

রাজিয়া খাতুন চোখ মুছে বললেন, ‘হয়তো তোমার মনে আছে, আমার মরহুম স্বামী একটি মিম্বর তৈরী করে রেখেছিলেন, তিনি যখন বায়তুল মোকাদ্দাস শত্রু মুক্ত করবেন তখন তা মসজিদুল আকসায় স্থাপন করবেন। তার ইচ্ছে ছিল, এই মিম্বরে দাঁড়িয়ে তিনি সমবেত মুসল্লিদের সামনে খোৎবা দেবেন। মিম্বরটি খুবই সুন্দর। এটি এতোদিন দামেশকে রাখা ছিল। আমি সেখান থেকে এটা তোমার জন্য নিয়ে এসেছি। আমি জানি, আল্লাহ তোমাকে অবশ্যই বিজয় দান করবেন। ভাই সালাহউদ্দিন, আমার ইচ্ছা, এই মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে তুমি মসজিদুল আকসায় খোৎবা দাও। আমার নেকবখত স্বামীর আশা তুমি পূরণ করো।’

এ কথা শোনার পর সুলতান আইয়ুবী তার নিজের অশ্রুও আর সম্বরণ করতে পারলেন না। তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এই বলে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি এই মহিয়সী নারীর আশা পূরণ করো। সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর স্বপ্ন পূরণ করো। এই মিম্বর মসজিদুল আকসায় স্থাপন করার তৌফিক দাও আমাকে।’

শাহজাদীর মতো এক যুবতী কন্যা উটের পিঠ থেকে নেমে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। হেসে সুলতান আইয়ুবীকে সালাম দিয়ে বললো, ‘আমাকে চিনতে পেরেছেন?’

রাজিয়া খাতুন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সালাহউদ্দিন, এ আমার মেয়ে শাহজাদী শামসুন্নেসা!’

সুলতান আইয়ুবীর চোখ আবারও বাষ্পরুদ্ধ হয়ে উঠলো। তিনি বললেন, ‘এই মেয়েকে আমি দেখেছিলাম যখন সে খুব ছোট, একেবারে অবুঝ বালিকা।’

‘এই মেয়েই মেয়েদের কমান্ড করবে।’ রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘এখন আমাকে বিদায় দাও, আমাকে জলদি ফিরে যেতে হবে।’

সেই সম্মানিত আলেম, যারা সুলতান আইয়ুবীর নিকটে এসেছিলেন, তাঁরা সবাই দোয়া করছিলেন মুজাহিদদের বিজয়ের জন্য। মাঝে মাঝে সৈন্যদের কাছে গিয়ে তাদের সামনে তুলে ধরছিলেন জিহাদের গুরুত্ব। সৈন্যরা তাদের এই বয়ান শুনে আরো উজ্জীবিত হয়ে উঠছিল।

তারা আসকালানের বিভিন্ন সামরিক ক্যাম্পে গিয়ে বক্তৃতা করতেন। বলতেন, ‘হে আল্লাহর সিপাহীগণ! কাফেররা তোমাদের প্রথম কেবলা নব্বই বছর ধরে অধিকার করে রেখেছে। আল্লাহ সেই মসজিদ দুশমনের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য তোমাদের বাছাই করেছেন। ভেবে দেখো, এটা তোমাদের জন্য কত বড় সৌভাগ্য!

কোরআনের নির্দেশ যদি তোমরা পড়ে থাকো তবে মসজিদুল আকসা কাফেরদের কবল থেকে মুক্ত না করে তোমাদের বিশ্রাম করার কোন সুযোগ নেই। এই সে মসজিদুল আকসা, যেখান থেকে আমাদের প্রিয় নবী মে’রাজে গিয়েছিলেন। এখন সে মসজিদ কাফেরদের গির্জায় পরিণত হয়ে গেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পবিত্র আত্মা আমাদের উপর অভিশাপ দিচ্ছে। এমন অবস্থায় আমাদের পানাহার, বিশ্রাম এমনকি বিবির সংস্পর্শও নিষেধ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা নব্বই বছর শুধু ঘুমিয়েই কাটিয়েছি। আমরা দায়িত্বের কথা ভুলে ভোগ বিলাসে সময় নষ্ট করেছি।

হে, আল্লাহর সৈনিকেরা! আমাদের শাসক শ্রেণী ইহুদী ও খৃস্টানদের পাতানো জালে আটকে নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ করে নিজেরাই ধ্বংস হয়েছে। অথচ আমরা তাদের ক্ষমতায় বসিয়েছিলাম এই আশায় যে, তারা আমাদের জানমালের নিরাপত্তা দান করবে। আমরা ভেবেছিলাম, তারা আমাদের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখবে এবং আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া ভূমি পূনরুদ্ধার করবে। তারা আমাদের প্রথম কেবলা পবিত্র মসজিদ বায়তুল মোকাদ্দাস মুক্ত করবে।

মুজাহিদ ভাইয়েরা! যেখানে আমাদের প্রিয় নবীর পবিত্র পদচিহ্ন পড়েছিল, যে পবিত্র মসজিদে তাঁর কপাল সিজদায় লুটিয়ে পড়েছিল, সেখানে নাপাক পা নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে ইহুদী ও খৃস্টানরা। হযরত ইবরাহিম (আ.), হযরত সুলায়মান (আ.), হযরত উমর (রা.) এমনি কত শত নবী, সাহাবীর পবিত্র স্পর্শে যে মাটি ধন্য হয়েছিল, সেখানে এখন বিচরণ করছে কাফের নাসারারা। দীর্ঘ নব্বই বছর ধরে সেখানে সিজদা দেয়ার সুযোগ বঞ্চিত মুসলমানরা।

এর কারণ আর কিছুই নয়, কারণ আমরা নিজেরা। আমরা ছিলাম গাফেল। আমরা ছিলাম চেতনাহীন। তাই আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে রক্তের বন্যা। আমরা ইজ্জত দিয়েছি, ক্ষতবিক্ষত হয়েছি। এই কঠিন অভিশাপ থেকে বাঁচতে হলে কঠিন শপথ নিয়েই ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে তোমাদের। আমাদের মা-বোনরা তোমাদের জন্য দোয়া করছে। তাদের চোখের পানি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আজ সমগ্র জাতি তাকিয়ে আছে তোমাদের দিকে। তোমাদের ওপর কঠিন দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে তারা আশা করছে, তোমরা তাদের জীবনে নিয়ে আসবে নয়া প্রভাত। তাদের হতাশ জীবনে আশার আলো জ্বালবে তোমাদের কুওত ও হিম্মত।

হে মানবতার রক্ষক সিংহ শার্দুলেরা! তোমরা যখন জেরুজালেম পৌঁছবে তখন তোমরা নিজের চোখেই দেখতে পাবে, মসজিদুল আকসার ভেতর ক্রুশ চিহ্ন ও মূর্তির ছড়াছড়ি। কোন কোন মসজিদকে দেখতে পাবে খৃস্টানদের ঘোড়ার আস্তাবল।

এই শহর দখল করার সময় খৃস্টানরা মুসলমানদের এমনভাবে হত্যা করেছিল যে, মুসলমানদের রক্তে শহরের অলিগলি রাজপথ ভেসে গিয়েছিল। যারা বেঁচে ছিল, আজ নব্বই বছর যাবত সেই সব মুসলমানরা সেখানে বন্দী জীবন যাপন করছে। তোমাদের বোনেরা সেখানে কাফেরদের দাসী বাদী হয়ে জীবন কাটাচ্ছে।

হে রাসূলের প্রেমিকেরা! হে আমার মুজাহিদ ভাইয়েরা! আল্লাহ তোমাদের এমন সুযোগ দান করেছেন যে সুযোগ বিগত নব্বই বছর এ জাতির সন্তানরা পায়নি। তাই বলছি, হিম্মতে বুক বাঁধো। বায়তুল মোকাদ্দাস মুক্ত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ো দুর্বার বেগে। ইনশাআল্লাহ, ব্যর্থতা এবার তোমাদেরকে স্পর্শও করতে পারবে না।

মনে রেখো, আল্লাহর পথে বেরিয়ে পড়া মুসাফিরের জীবনে ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। তোমরা বিজয়ী হলে হবে গাজী। আর যদি তোমাদের ভাগ্যে শাহাদাত লেখা থাকে তবে মনে রেখো, তোমাদের জীবন ষোলকলায় পূর্ণ হলো। আল্লাহ নিজে বলেছেন, ‘আর যারা আমার পথে নিহত হয় তোমরা তাদের মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত। যদিও তোমরা তা বুঝতে পারো না।’ এই সব শহীদের আত্মাগুলো চলে যায় জান্নাতের বাগানে।

তোমরা শুনে বিস্মিত হবে, বায়তুল মোকাদ্দাস দখল করার সময়ই যে মুসলমানদের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে এমন নয়। আফসোস! হযরত ঈসা (আ.) মানব জাতিকে প্রেম ও ভালবাসার শিক্ষা দান করেছিলেন। আজ তার অনুসারী বলে দাবীদার ক্রুশের পুজারীরা এমন পশুত্ব ও বর্বরতা চালাচ্ছে, যার কোন তুলনা হয় না।

এই বর্বরতা তারা দেখাচ্ছে যুগের পর যুগ। যখনি কোথাও তারা বিজয় লাভে সমর্থ হয় তখনি জেরুজালেমের নিরীহ মুসলমানদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন জুলুম। বিজয়ী খৃস্টানরা জেরুজালেমে আয়োজন করে আনন্দ উৎসব। সেই উৎসবে আমাদের যুবতী মেয়েদেরকে তারা উলঙ্গ হয়ে নাচতে বাধ্য করে।

এখানেই শেষ নয়। তাদের মর্মান্তিক ও অমানবিক আচরণের কথা শুনলেও গা শিউরে উঠে। উৎসবের সবচে প্রিয় অনুষ্ঠান তাদের মানুষের গোশত খাওয়া। উৎসব উপলক্ষে তারা কয়েকজন মোটা তাজা মুসলমানকে ধরে আনে। তারপর তাকে জবাই করে তার গোশত রান্না করা হয়। এই গোশতের স্বাদের নাকি কোন তুলনা হয় না।

প্রিয় বন্ধুরা! সভ্যতা ও মানবতার এ অপমান আমরা আর কতকাল সইবো? আর কত নিরীহ মুসলমানকে তাদের পাশবিক লালসার শিকার হতে দেবো আমরা? মনে রেখো, ইহুদী ও খৃস্টানরা সাপের মতোই কোমল আর হিংস্র। বিষদাঁত না ভাঙ্গা পর্যন্ত তারা এভাবেই আমাদের শিরায় শিরায় ছোবল হানতে থাকবে।

জানি না তোমাদের শুনতে কেমন লাগবে। তবে শুনে রাখো, মরহুম সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রাজিয়া খাতুন দামেশক থেকে একটি সুদৃশ্য মিম্বর নিয়ে এসেছেন মসজিদুল আকসায় স্থাপনের জন্য। এই মিম্বরটি মরহুম জঙ্গী মরার আগে এ মসজিদে স্থাপন করার জন্যই তৈরী করেছিলেন।

সেই মহিয়সী মহিলা সঙ্গে করে দুশো মেয়ে যোদ্ধা নিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এখানে এসেছেন। তিনি সুলতান আইয়ুবীর কাছে আরো এক হাজার মেয়ে যোদ্ধা ময়দানে হাজির করার অনুমতি চেয়েছেন। যদি প্রয়োজন হয় আরো হাজার হাজার নারীকে তিনি যুদ্ধের মাঠে নিয়ে আসতে পারবেন বলে জানিয়েছেন সুলতানকে।

তার স্পষ্ট বক্তব্য, মসজিদুল আকসা মুক্ত না করা পর্যন্ত এই সব নারীরা ঘরে ফিরবে না। তারা আইয়ুবীকে বলেছে, ‘যে মায়ের দুধ পান করে আপনার সৈন্যরা ময়দানে এসেছে সেই একই মায়ের দুধ পান করেছি আমরাও। বহু যুদ্ধ করে হয়তো পুরুষদের বাহুগুলো শিথিল হয়ে যেতে পারে, আপনি আমাদের সুযোগ দিয়ে দেখুন, আমাদের একটি বাহুও শিথিল পাবেন না।’

এই নারী বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গীর আদরের কন্যা শামসুন্নেসা। আমি তোমাদের কাছে জানতে চাই, তারা যে বলেছে, যুদ্ধ করে করে তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছো, এটাই ঠিক, নাকি এখনো লড়াই করার হিম্মত রাখো তোমরা? তোমরা কি শাহজাদী শামসুন্নেসাকে ময়দানে পাঠিয়ে বিশ্রাম নিতে চাও, নাকি বায়তুল মোকাদ্দাস মুক্ত করে সেই মসজিদে শোকরানা নামাজ পড়ার আমন্ত্রণ জানাতে চাও শামসুন্নেসাকে?’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 5 | 6 | 7 | 8 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top