২৮. রক্তস্রোত

হযরত ঈসা (আ.) প্রেম ও ভালবাসার বাণীই প্রচার করেছিলেন। শুধু হযরত ঈসা (আ.)ই নন, সকল নবী রাসূলই মানুষকে মানবতা ও মহত্বের শিক্ষা দিয়েছেন। তারা মানুষকে সভ্যতার বিকাশ ও নিরাপত্তা রক্ষার উপায় শিখিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রুশের পূজারী ধর্মরক্ষকদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ এতটাই প্রবল যে, তারা তাদের নবীর কথাও ভুলে গেছে।

তারা বলে, ‘দুনিয়াতে মাত্র একটি ধর্মই টিকে থাকবে। হয় ইসলাম, নয়তো খৃস্টধর্ম। অতএব মুসলমানদের ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ নেই। তাদের প্রতি অনুকম্পা দেখানো মানে নিজের গলায় ছুরি চালানো। তাই ইসলামকে কবর দিতেই হবে। এখানে ভক্তি বা বিদ্বেষের কিছু নেই।’ অতএব খৃস্টানরা যা করছে সব বুঝেশুনেই করছে। এ জন্যই খৃস্টানদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ ও অন্তর্কলহ থাকলেও যখন দুনিয়াব্যাপী মুসলিম নিধনের প্রশ্ন আসে তখন তারা এক হয়ে যায়।’

‘সুলতান, মুসলমানদের মধ্যে সচেতনতার অভাব বলেই খৃস্টানরা এমনটি করতে পারছে। যদি এই ঘুমন্ত জাতি একবার জেগে উঠে মাথা ঝাড়া দেয় তাহলে কোন অস্ত্রই তাদের ঈমানের সামনে টিকতে পারবে না।’

‘খুবই খাঁটি কথা বলেছো। আমরা দুনিয়ার মিথ্যা আড়ম্বর ও লোভ মন থেকে দূর করতে না পারলে খৃস্টানরা আমাদের এই পাপে ডুবিয়েই ইসলামের সমাধি রচনা করবে।’

খৃস্টান সেনাপতি ও কমান্ডাররা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সুলতান আইয়ুবী সেনাপ্তিকে নিয়ে সেখানে গেলেন। তাদের বললেন, ‘তোমরা বিনা অপরাধে অসংখ্য মুসলিম নরনারীকে হত্যা করেছো। বেগার ক্যাম্পে এনে বিনা পারিশ্রমিকে মুসলমানদের দিয়ে অমানুষিক কাজ করিয়ে শেষে কাজের অনুপযুক্ত হলে তাদের হত্যা করেছো। এবার বলো এর কি শাস্তি তোমারা চাও?’

খৃস্টান সেনাপতি ও কমান্ডাররা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ সুলতানের অভিযোগ অস্বীকার করতে এগিয়ে এলো না। সুলতান গর্জন করে বললেন, ‘এই সব পাপিষ্ঠদের সমুদ্র পাড়ে নিয়ে যাও। সেখানে ওদের হত্যা করে লাশগুলো সমুদ্রে ভাসিয়ে দেবে। আর সাধারণ সৈন্যদের যারা অপরাধ স্বীকার করবে তাদের দামেশকে পাঠিয়ে দাও। অবশিষ্টদের শেষ করে দাও। সাবধান, কোন নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর হস্তক্ষেপ করবে না। তাদের মধ্যে স্বেচ্ছায় যারা শহর ছেড়ে চলে যেতে যায় তাদের কোন বাঁধা দিওনা। যারা এখানে থাকতে চায় তাদের সসম্মানে থাকতে দিবে।’

৮ জুলাই ১১৮৭ সাল। আক্রার ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব কায়েম হলো মুসলমানদের। রাতে সুলতান আইয়ুবী সবেমাত্র খাওয়া দাওয়া শেষ করেছেন, এক রক্ষী এসে সংবাদ দিল, ‘একজন গুরুত্বপূর্ণ বন্দী আনা হয়েছে।’

‘সে কে?’

‘বন্দির নাম হরমন।’

‘কোন হরমন?’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘খৃষ্টানদের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান? যেমন আমাদের আলী বিন সুফিয়ান?’

‘জ্বী, সম্ভবত তিনিই।’

‘ঠিক আছে, তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’

ঘটনা প্রবাহে সম্রাট হরমনের নাম আমরা অনেক বার শুনেছি। এ লোক ষড়যন্ত্র ও কূটনীতিতে খুবই পারদর্শী ছিল। যেসব ইহুদী ও খৃস্টান মেয়েরা মুসলমান এলাকায় গোয়েন্দাগিরী করতে আসতো তাদেরকে ভাল মতো ট্রেনিং দিতেন এই হরমন। তিনি একদল খৃস্টান মেয়েকে ট্রেনিং দেয়ার জন্য আক্রায় অবস্থান করছিলেন। কিন্তু আক্রার পতনের পর শহর ছেড়ে পালাবার সময় সবাই দলসহ ধরা পড়ে যায়।

তিনি এবং তার সঙ্গের মেয়েরা গোপনে শহর থেকে পালাচ্ছিল। দলটিকে দেখে সুলতান আইয়ুবীর এক গোয়েন্দার সন্দেহ হয়। সে তাদের পিছু নেয়। ফটকে পৌঁছলে রক্ষীদের জানায় সে তার সন্দেহের কথা। এক গোয়েন্দা কমান্ডার এগিয়ে যায় দলটির দিকে। হরমন তখন ছদ্মবেশে ছিল। তারপরও তাকে দেখেই চিনতে পারে সেই কমান্ডার।

হরমন তখন গ্রাম্য কৃষকের ছদ্মবেশে ছিল। মেয়েরাও কৃষক কন্যার মতোই পোষাকে পরে ফিরে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আনাজ-তরকারী বিক্রি করতে এসে তারা শহরে আটকা পড়ে যায়। এখন সুযোগ পেয়ে তারা ফিরে যাচ্ছে আপন গাঁয়ে।

গোয়েন্দা কমান্ডার বললো, ‘তুমি খুব দামী উপহার জোগাড় করেছ। এসো, এক্ষুণি ওদের পাকড়াও করতে হবে।’

কমান্ডার কয়েকজন রক্ষী সৈন্যের সহযোগিতা নিয়ে হরমন ও তার সঙ্গীদের কাফেলাটিকে ঘিরে ফেললো। সম্রাট হরমনের সঙ্গে মেয়েদের দলটিই শুধু ছিল না, সঙ্গে সোনাদানাও ছিল প্রচুর। হরমন কমান্ডারের সামনে সোনার পুটলি মেলে ধরে কমান্ডার ও সৈন্যদের লক্ষ্য করে বললো, ‘তোমরা এই সোনা ভাগ করে নাও এবং যে মেয়েকে তোমাদের পছন্দ হয় নিয়ে যাও, আমাকে এবং বাকী মেয়েদের ছেড়ে দাও।’

‘আমাদের যে সব কটা মেয়েই পছন্দ!’ কমান্ডার বললো, ‘আমরা সব কটা মেয়েকেই নেবো, সমস্ত সোনাদানাও নেবো, সঙ্গে আপনাকেও সাথে নিয়ে যাবো।’

‘ঠিক আছে, তোমরা সব কটা মেয়েকেই নাও, সোনাদানাও নিয়ে যাও, শুধু আমাকে ছেড়ে দাও।’

‘তা কি করে হয়? আমার যে আপনাকেই সবচে বেশী পছন্দ হয়।’ কমান্ডার রহস্যময় কণ্ঠে বললো হরমনকে।

কমান্ডার হরমনসহ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সুলতান আইয়ুবীর দরবারে হাজির হলো। সমস্ত সোনাদানা ও মেয়েদেরকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিল কমান্ডার।

সম্মিলিত খৃস্টান গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান সম্রাট হরমন সুলতান আইয়ুবীর কাছে ছিলেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কয়েদী। তাকে সুলতান আইয়ুবীর কামরায় হাজির করা হলে সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘হরমন, আমি জানি তুমি ভাল আরবী বলতে পারো!’ তাই আমি চাই তুমি এখন আরবী ভাষাতেই কথা বলো। আমি তোমার গুণ, দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করি। তোমার সম্মান আমি যতটুকু বুঝতে পারি অন্য কেউ তা পারবে না। তোমার মর্যাদার কথা বিবেচনা করে আমি তোমার সাথে এমন কিছু কথা বলতে চাই, যা অন্য কারো সাথে বলা আমি সমীচিন মনে করি না।’

‘যদি দয়া করে আমার সঙ্গে কথা না বলে আমাকে হত্যা করার হুকুম দেন তাতেই আমি খুশী হবো।’ সম্রাট হরমন বললেন, ‘আমি জানি, শেষ পর্যন্ত আমাকেও আক্রার জেনারেল ও কমান্ডারদের মত নিহত হতে হবে। সুতরাং আর কথা বলার প্রয়োজন কি?’

‘হরমন! তোমাকে হত্যা করা হবে না!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি যাকে হত্যা করতে চাই, তার শুধু মুখের দিকে তাকাই, তার সঙ্গে কখনও কথা বলি না’

হরমন বিস্মিত ও অভিভূত হলেন। তার চোখে মুখে আনন্দের আভা ফুটে উঠলো। তিনি আরবের প্রথা সম্পর্কে ভালমতই জানতেন। কোন শত্রুকে সরবত পরিবেশন করলে বুঝতে হবে, সরবত প্রদানকারী তার মন থেকে শত্রুতা মুছে ফেলেছে এবং শত্রুর প্রাণ ভিক্ষা দিয়েছে।

প্রহরী তার সামনে সরবতের গ্লাস রাখলে তিনি পলকের জন্য সুলতানের দিকে তাকালেন এবং বুঝে নিলেন সুলতান আইয়ুবী তার সাথে কোন রকম ঠাট্টা ইয়ার্কি করছেন না, সত্যি সত্যি তিনি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তিনি গ্লাসটি উঠিয়ে নিলেন এবং আনন্দিত চিত্তেই সরবত পান করলেন।

সরবত পান শেষ হলে তিনি গ্লাসটি নামিয়ে রেখে বললেন, ‘আমি জানি, আপনি আমাকে কি বলতে চাচ্ছেন। আপনি জানতে চাচ্ছেন, কোন কোন স্থানে আমাদের কত সৈন্য আপনার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।’ হরমন বললেন, ‘আর আপনি এ বিষয়ও জানতে চাইবেন, তাদের মধ্যে যুদ্ধ করার যোগ্যতা ও আগ্রহ কেমন? হয়তো যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম এবং অস্ত্র সম্পর্কেও আপনার প্রশ্ন থাকতে পারে।’

‘না, আমি এসবের কিছুই জানতে চাই না।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘বরং তুমি আমাকেই জিজ্ঞেস করো তোমাদের কোন কোন এলাকায় কত সৈন্য আছে। কারণ আমাদের গোয়েন্দারা তোমাদের প্রাণ কেন্দ্রে মিশে আছে। তোমাদের কত সৈন্য কোথায় আছে, তোমাদের অস্ত্রসম্ভার কেমন আছে সবই আমার জানা। সৈন্য সংখ্যা নিয়ে আমি কখনো দুশ্চিন্তায় ভুগি না। হাতিনে তোমাদের সৈন্য কম ছিল না। কম সৈন্য ছিল আমাদের, এখনতো আরও কমে গেছে। কিন্তু তাই বলে পবিত্র ভূমি থেকে আমাকে বের করে দেবে এমনটি কখনোই ঘটবে না। তুমি বরং এ সংবাদ শুনতে পারো, সালাউদ্দিন আইয়ুবী নিহত হয়েছে, কিন্তু পিছু হটেনি।’

‘যদি আপনার সমস্ত কমান্ডার এই কমান্ডারের মত চরিত্রবান হয়, যে কমান্ডার আমাদের এখানে ধরে এনেছে, তবে আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি, যত বড় শক্তিই থাকুক আপনাকে এখান থেকে কেউ সরাতে পারবে না।’ হরমন বললেন, ‘আমি তাদের সামনে যে মেয়েদের ধরেছিলাম, সেই মেয়েদের দিয়েই আমি পাষাণ হৃদয় সেনাপতি ও কেল্লাদারদেরকে মোমের মত গলিয়ে খৃস্টানদের অনুগত বানিয়েছিলাম। আর সোনা এমনই জিনিস যে জিনিস শুধু চোখই না, মানুষের বিবেকও অন্ধ করে দেয়। আমি সোনাকে শয়তানের পুঁজি মনে করি। কিন্তু আপনার কমান্ডার সোনার প্রতি দৃষ্টিই দিল না।

আমি মানুষের প্রকৃতিগত দুর্বলতা খুব ভাল বুঝি। আমি জানি, আনন্দ ও বিলাসিতা মানুষের বিবেক খেয়ে ফেলে, মুমীনের ঈমান ধ্বংস করে দেয়। আমি আপনার বিরুদ্ধে এ অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ করেছি। যদি এই দুর্বলতা কখনও কোন সেনাপতির মনে সৃষ্টি হয়ে যায় বা সৃষ্টি করে দেয়া যায় তখন তার ভাগ্যে পরাজয় ছাড়া আর কিছু লেখা হয় না। আমি আপনাদের এখানে বহু গাদ্দার সৃষ্টি করেছিলাম। তাদের মনে শাসন ক্ষমতার নেশা সৃষ্টি করেছিলাম, যে দুর্বলতা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।’

‘আমার সৈন্যদের কৃতিত্ব সম্পর্কে তোমার কি মতামত?’ সুলতান আইয়ুবী তাকে জিজ্ঞেস করলেন।

‘আপনার সৈন্যদের কৃতিত্ব এটাই, আমরা তাদের যেমন বানাতে চেষ্টা করেছিলাম, তারা তা হয়নি। যদি হতো তবে আজ আপনার সৈন্যবাহিনী এখানে থাকতো না।’ হরমন বললেন, ‘আর যদি আপনি চরিত্রহীন অকর্মন্য শাসক, আমীর, উজির ও সেনাপতিদের শেষ না করতেন তবে তারা এতদিনে আমাদের কারাগারে বন্দী থাকতো। আমি আপনার প্রশংসা করি এ জন্য যে, আপনি সম্রাট বা বাদশাহদের মতো রাজ্য শাসনের ইচ্ছা করেননি কখনো। যদি আপনি নিজেকে বাদশাহ ভাবতেন তাহলেও আপনি আজ এখানে থাকতে পারতেন না।’

‘হরমন!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি তোমার জীবন রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। তুমি এটাও উপলব্ধি করতে পারছো, তোমার প্রতি আমি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে দিয়েছি। এখন তুমি আমাকে বলো, আমি কেমন করে আমার সৈন্যদের মনোবল ও কৃতিত্বকে আরও দৃঢ় ও উচ্চ করতে পারি। আমার মৃত্যুর পরও কি করে এই কৃতিত্ব টিকে থাকতে পারে?’

‘সম্মানিত সুলতান!’ হরমন বললেন, ‘আমি আপনার দুরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার প্রশংসা করি। গোয়েন্দাগিরীর ক্ষেত্রে আপনার গোয়েন্দারা যে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে সে জন্য আমি আপনাকে উস্তাদ মানি। আপনি বরাবর সঠিক স্থানেই আঘাত হানেন। আপনার গোয়েন্দা সংস্থার ট্রেনিং ও নিয়ম শৃঙ্খলা অতিশয় উন্নত। আপনার সৌভাগ্য যে, আপনি আলী বিন সুফিয়ান ও হাসান বিন আবদুল্লাহর মতো হুশিয়ার গোয়েন্দা অফিসার পেয়েছেন এবং গিয়াস বিলকিসের মতো পুলিশ অফিসার পেয়েছেন। যতোদিন আপনার পাশে এমন দক্ষ গোয়েন্দা ও পুলিশ প্রধান থাকবে ততোদিন ব্যর্থতার গ্লানি আপনাকে স্পর্শ করবে না।

কিন্তু তবুও আমি আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ সফলতা শুধু আপনার জীবদ্বশাতেই থাকবে। আমি আপনার জাতির মাঝে যে বিষ ছড়িয়েছি তা ব্যর্থ হওয়ার নয়। আপনি একজন ঈমানদার লোক, সে জন্য আপনি বেদ্বীন ও বেঈমানদের দাবিয়ে রাখতে পেরেছেন। আপনাদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ কে বাঁধিয়েছিল? আমি বাঁধিয়েছিলাম। আমি আপনার জাতির শাসকদের মধ্যে ক্ষমতা, ধনসম্পদ, আনন্দ ও নারীর নেশা ভরে দিয়েছি। আপনার ঈমানের চাবুক সাময়িকভাবে তাদের নেশা দূর করে দিয়েছে ঠিক, কিন্তু যেদিন আপনি থাকবেন না সেদিন আপনার জাতিকে চাবুক মারারও কেউ থাকবে না। তখন আপনার উত্তরসূরীরা আবার সেই নেশাই বিভোর হয়ে যাবে। কারণ আমি না থাকলেও আমার উত্তরসূরীরা আপনার জাতির মধ্যে এ নেশা জাগাতেই থাকবে।

সম্মানিত সুলতান! এই যুদ্ধ, যা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি, সেটি আমার ও আপনার অথবা আমাদের সম্রাট ও আপনার যুদ্ধ নয়। এটা গীর্জা ও মসজিদের যুদ্ধ- যা আমাদের মৃত্যুর পরও চালু থাকবে। প্রয়োজন না পড়লে আমরা সমরক্ষেত্রে যুদ্ধ করবো না। হয়তো এমন সময় আসবে, যখন আমরা আপনাদের কোন দেশ দখলও করতে যাবো না। আমরা মুসলমানদের মন- মগজ, আদর্শ ও চরিত্র দখল করবো। আমরা মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করবো।

আমাদের এই মেয়েরা আর আমাদের স্বর্ণ, ধনসম্পদ ও আমাদের কৃষ্টি-সভ্যতার আকর্ষণ, যেটাকে আপনি মোহ ও নির্লজ্জতা বলে থাকেন, এই মোহ ও অশ্লীলতাই ইসলামের প্রাচীরকে ধ্বংস করে দেবে। আপনি লিখে নিতে পারেন, আমি বলছি, সেদিন বেশী দূরে নয় যেদিন মুসলমানরা তাদের কৃষ্টি ও সভ্যতাকে ঘৃণা করতে শিখবে। তারা খৃস্টান সভ্যতাকে ভালবাসতে থাকবে, হয়তো  সে সময়টা আপনি দেখতে পাবেন না, আমিও দেখে যেতে পারবো না। আমাদের আত্মা ও উত্তরসূরীরা তা অবশ্যই দেখবে।’

সুলতান আইয়ুবী জার্মান বংশোদ্ভূত সম্রাট এবং সম্মিলিত খৃস্টান গোয়েন্দা বাহিনী প্রধান হরমনের কথা গভীর মনোযোগের সাথে শুনছিলেন। হরমন বললেন, ‘আমরা পারস্য, আফগানিস্তান ও ভারতবর্ষ কেন দখল করতে যাইনি? আমরা আমাদের আক্রমণের লক্ষ্য কেন আরবের ওপর স্থির করেছি? এটা এ কারণে যে, সমস্ত মুসলমানরাই এদিকে মুখ করে ইবাদত বন্দেগী করে। আরবেই অবস্থিত মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র কাবাঘর। আমরা মুসলমানদের এই কেন্দ্রের প্রতি ঝোঁক ও আগ্রহ শেষ করে দিতে চাই।

আপনাদের বিশ্বাস, আপনাদের প্রিয় রাসুল (সা.) মসজিদুল আকসা থেকে সাত আকাশে ভ্রমণ করেছিলেন। আমরা সেই মসজিদের মধ্যে মহান ক্রুশ রেখে দিয়েছি। আমরা সেখানকার অধিবাসীদের বলছি, মুসলমানদের বিশ্বাস ভুল। তাদের রাসুল (সা.) কখনও মসজিদুল আকসায় আসেননি এবং এখান থেকে মেরাজেও যাননি। যদি মুসলমানদের দাবী সত্য হতো তবে মসজিদুল আকসা তাদের দখলেই থাকতো। মসজিদুল আকসার কর্তৃত্ব খৃস্টানদের হাতে তুলে দেয়ার মানে হচ্ছে, আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলাম নয় বরং বাইবেলই আল্লাহর মনোনীত কিতাব আর খৃস্টান ধর্মই আল্লাহর মনোনীত ধর্ম।’

‘হরমন!’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি তোমাদের প্রচেষ্টা ও সংকল্পকে প্রশংসা করি। আপন ধর্মের প্রতি প্রত্যেকের এমন আনুগত্যই করা উচিত যেমন তুমি করছো। সেই জাতিই বেঁচে থাকে, যে জাতি তার ধর্ম ও সামাজিক মূল্যবোধকে সম্মান দেয়। তারা তাদের মনের চারদিকে ধর্মের শিক্ষা দিয়ে এমন বুহ্য রচনা করে নেয়, অন্য কোন ধর্ম, মতবাদ বা দর্শন তার কোন ক্ষতি সাধন করতে পারে না।

আমি জানি, ইহুদীরা আমাদের এখানে সুগভীর ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। তারা মূলতঃ তোমাদের সহযোগীতা করছে। আমি এখন বায়তুল মোকাদ্দাস যাচ্ছি শুধু এই কারণে যে, এর সাথে আমাদের ধর্মীয় আবেগ জড়িয়ে আছে। আমাদের প্রিয় নবী (সা.)কে আল্লাহতায়ালা এখান থেকেই মেরাজে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি এখন এটাকে খৃস্টান আধিপত্য থেকে মুক্ত করে প্রমাণ করবো, তোমার ধারণা ভুল। আল্লাহর একমাত্র মনোনীত জীবন বিধান ইসলাম ছাড়া আর কিছু নয়।’

‘তারপরে আপনি কি করবেন?’ হরমন বললেন, ‘তারপরে আপনি এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেবেন। মসজিদুল আকসা আবার আমাদের অধিকারে চলে আসবে। আমাদের ইবাদতের স্থান হবে। আমি যে ভবিষ্যতবাণী করছি তা আপনার জাতির স্বভাব চরিত্র দেখে বলছি। আমরা আপনার জাতিকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দেবো। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে খন্ডরাজ্যে পরিণত করবো। তারপর তারা যেন একে অপরের শত্রু হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় তার ব্যবস্থা করবো। তখন আর ফিলিস্তিন উদ্ধারের কোন প্রশ্নই উঠবে না।

 ইহুদীরা তাদের ছেলে মেয়েদের মধ্যে যৌন আনন্দ বাঁধাহীন করে দিয়েছে। আমরাও তাদের কাছ থেকে এই শিক্ষা ভালমতোই রপ্ত করে নিয়েছি। এই শিক্ষা আপনার জাতির মধ্যেও সংক্রামিত হতে শুরু করেছিল। কিন্তু আপনি তাদের সামনে এমন প্রাচীর তুলে দিলেন যে, তারা আর এ পথে এগুতে পারলো না। কিন্তু আপনি এ কথা অবশ্যই স্বীকার করবেন, একদিন আপনাকে মরতে হবে। আর কোন জাতির মধ্যে প্রতিদিন নুরুদ্দিন জঙ্গী ও সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর জন্ম হয় না।’

সুলতান আইয়ুবী স্মিত হেসে হরমনের সাথে করমর্দন করে বললেন, ‘তোমার কথা খুবই মূল্যবান। আমি তোমাকে দামেশকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, সেখানে তুমি রাজবন্দী হিসেবে সসম্মানে থাকবে।’

‘আর এই মেয়েরা যারা আমার সাথে আছে?’

সুলতান আইয়ুবী একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। একটু পরে বললেন, ‘মেয়েদের যুদ্ধবন্দী হিসাবে রাখার কোন ব্যবস্থা আমাদের এখানে নেই। ওরা গোয়েন্দা, তাই ওদের ছেড়েও দেয়া যায় না। ওদের হত্যা করে সমুদ্রে ফেলে দেয়াই উত্তম হবে।’

‘সম্মানিত সুলতান! এরা খুব সুন্দরী এবং চৌকস মেয়ে।’ হরমন বললেন, ‘যদি আপনি এদের এক নজর দেখেন তবে তাদেরকে আপনি হত্যা করতে পারবেন না। এমনকি এদেরকে কারাগারে পাঠাতেও আপনার বিবেক সায় দেবে না। আপনার ধর্মে দাসীকে বিয়ে করার বিধান আছে। আপনি এদেরকে দাসী হিসাবে আপনার হেরেমখানায় রেখে দিন, তাতে ওদের অন্তত প্রাণটা তো রক্ষা পাবে!’

‘আমাদের ধর্মে এমন বিলাসিতার কোন স্থান নেই।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি আমার ঘরে কেন, কোন মুসলমানের ঘরেই কোন কাল সাপ পুষতে দিতে পারি না।’

‘কিন্তু এদের ব্যাপারে কি আর কোন চিন্তা করা যায় না?’ অনুনয় ভরা দৃষ্টি নিয়ে হরমন বললেন, ‘এদের শিশুকাল থেকে পেলেপুষে আমি বড় করেছি। আমার মতো পাপীকেও যদি আপনি ক্ষমা করতে পারেন, ওরা তো আমার শিশুর তুল্য, ওদের প্রাণ রক্ষা পায় এমন কোন ব্যবস্থা কি আপনি করতে পারেন না?’

‘ঠিক আছে, এতো করে যখন বলছো, আমি ওয়াদা করছি, ওদের আমি হত্যা করবো না।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘কিন্তু ওদেরকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। আমি তোমার ওকালতির প্রশংসা করছি, ওদের প্রতি তোমার মায়া ও স্নেহ দেখে। কিন্তু তোমার চালাকি আমি ঠিকই ধরতে পেরেছি। তুমি এই সুন্দর নাগিনীগুলোকে আমার জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাও। কিন্তু আমি তোমার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে দিতে পারি না। ওদেরকে বলো, ওরা আক্রা ছেড়ে চলে যাবে। আর কোনদিন কোন মুসলিম এলাকায় প্রবেশ করবে না। যদি কোন মুসলিম এলাকায় ওদের কাউকে চোখে পড়ে তবে অবশ্যই তাকে হত্যা করা হবে।’

সুলতান আইয়ুবী কয়েক দিনেই আক্রাতে তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠা করে প্রশাসনিক কাজকর্ম শুরু করেন। মসজিদগুলো আবার সাফসুতরো ও পরিষ্কার করে জীবন্ত করে তোলেন। যে সব গনিমতের মাল পাওয়া গিয়েছিল তার অধিকাংশ নিজ সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করে দেন। কিছু দান করেন সেখানে অবস্থানরত গরীব মুসলমানদের মধ্যে। কিন্তু এসব করতে গিয়ে মুহূর্তের জন্যও তিনি ফিলিস্তিনের কথা ভুলে যাননি। তাঁর মাথায় কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছিল ফিলিস্তিন জয়ের স্বপ্ন।

তিনি তাঁর কামরায় বসে আছেন। তার আঙ্গুল খেলা করছে মানচিত্রের ওপর। সেই নকশার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেল তার আঙুল যেখানে লেবানন ও ইসরাইলের মানচিত্র অংকিত। তাঁর চিন্তা ভাবনা আচ্ছন্ন করে আছে বায়তুল মোকাদ্দাস। তিনি তাঁর সৈন্য বাহিনী সাজাচ্ছিলেন সেই মানচিত্রের ওপর। কমান্ডো বাহিনী কোথায় অবস্থান করবে, কোন পথে এগুবে পদাতিক বাহিনী, অশ্বারোহী ও তীরন্দাজরা কোথায় থাকবে এসব ঠিক করছিলেন তিনি। গভীর মনোযোগের সাথে তাকিয়েছিলেন মানচিত্রের ওপর।

‘সম্মানিত সুলতান।’ কামরায় প্রবেশ করে মৃদুকণ্ঠে সুলতান আইয়ুবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন গোয়েন্দা প্রধান হাসান বিন আবদুল্লাহ।

‘হাসান!’ নকশা থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই সুলতান বললেন, ‘আমাদের এখন তেমন সময় সুযোগ নেই যে, সব কথা নিয়ম কানুন রক্ষা করে বলবো। এমন সময় আমি তখন পাবো যখন আমি বিজয়ীর বেশে বায়তুল মোকাদ্দাসে প্রবেশ করবো। কি জন্য এসেছো বলো।’

‘ত্রিপোলী থেকে সংবাদ এসেছে, সম্রাট রিমান্ড মারা গেছেন।’

‘তিনি কি আহত ছিলেন?’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 4 | 5 | 6 | 7 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top