২৭. ছোট বেগম

আপনারা থাকবেন না, কিন্তু আপনাদের শপথের বাণী যুগ যুগ ধরে এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রেরণা জোগাবে সত্য পথের সৈনিকদের। আমাদের কথা, আমাদের প্রতিজ্ঞা ইতিহাসের অংশ হয়ে পৌঁছে যাবে আমাদের শেষ বংশধর পর্যন্ত।

একটি কথা মনে রাখবেন, এ দুনিয়ায় আমরা আমাদের কর্ম রেখে যাবো, কিন্তু সঙ্গে নিয়ে যাবো আমাদের কর্মফল। দুনিয়ার প্রতিটি কর্মের ফলই সঙ্গী হবে আমাদের এবং আমরা সেই কর্মফল নিয়েই আল্লাহর দরবারে হাজির হবো।

এখন আপনাদেরকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যে সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য বয়ে নিয়ে আনবে কল্যাণ। যে সিদ্ধান্ত ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আমাদের মুখ করবে উজ্জল। যে সিদ্ধান্ত আল্লাহর দরবারে লজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে আমাদের।

বিজয়ের নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। কারণ বিজয় দেয়ার মালিক একমাএ আল্লাহ রব্বুল আলামীন। কিন্তু আমরা যে নিশ্চয়তা দিতে পারি তা হচ্ছে, আমরা প্রাণপণে যুদ্ধ করবো। আমরা মরবো কিন্তু পিছু হটবো না। আমরা আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবো পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সাথে। আমরা শপথের মর্যাদা রক্ষা করবো।

লাশের পাহাড় আর রক্তের নদী সাঁতরে আমরা এগিয়ে যাবো আমাদের মঞ্জিলের দিকে। কোন ভয়-ভীতি, লোভ, দুনিয়ার টান, কিছুই আমাদের অগ্রযাএার গতি রোধ করতে পারবে না।’

সুলতান আইয়ুবী একে একে তাকালেন তার উপদেষ্টা ও সেনাপতিদের দিকে। দেখলেন সবার চোখে মুখে শপথের দৃঢ়তা। প্রতিটি চোখে খেলা করছে অনড় ও অনমনীয় আপোষহীনতার ছাপ।

তার মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হলো। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের বিজয়ের ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা দিতে পারবো না। কিন্তু তাই বলে আমাদের মধ্যে যেন কারো এ ভয় না হয় যে, খৃষ্টান বাহিনী আমাদের ‍দ্বিগুন এবং আমরা বহু দূর থেকে যুদ্ধ করতে এসেছি।’

তিনি একটু দম নিলেন। তারপর সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে ‍দিতে চাই, আমরা এখন সংখ্যায় ততো নগন্য নই। বরং এর চেয়েও কম সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিশাল শএু বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে আমরা বিজয় লাভ করেছি।

যুদ্ধ শুধু সংখ্যা দিয়ে হয় না, বুদ্ধি, কৌশল ও প্রেরণা দিয়ে যুদ্ধ করতে হয়। যদি ঈমান মজবুত হয় তবে তার বাহু, তলোয়ার আর মনও দৃঢ় হয়ে যায়। আমাদের মাঝে ঈমানের দুর্বলতা নেই। অতএব বলা যায়, আমাদের কিছুই অভাব নেই।’ সুলতান থামলেন।

’আমাদের মধ্যে এমন একজনও নেই, যে শএুর সাথে নিজের শক্তির তুলনা করে।’ কমান্ডো বাহিনীর সেনাপতি ছালেম মিশরী দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমাদের শুধু জানা প্রয়োজন, আমরা কোন দিক দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাসে গিয়ে পৌছবো আর আমাদের গতি কেমন হবে?’

’তবে আমি চলার পথে প্রতি কদমে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরী মনে করি। আমাদের অহংকারী হওয়া যেমন মানায় না, তেমনি স্বপ্নবিলাসী হওয়াও কোন সৈনিকের কাজ নয়।’ বললেল সুলতান।

সালেম মিশরী বললো, আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হবে বাস্তবতার নিরিখে। আর আপনি যেমন বললেন, ঈমান, সাহস, বুদ্ধি ও কৌশল হবে আমাদের অস্ত্র।’

’আমি আপনাদেরকে একথাই বলতে চেয়েছি।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি যুদ্ধের প্ল্যান পরিকল্পনা আপনাদের পরামর্শক্রমেই তৈরী করেছি। আমি গত কয়েক রাত চিন্তা ভাবনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি, আমাদের প্রথম লক্ষ্য হবে হ’তিন। ‍যুদ্ধের কৌশলগত ক্ষেএ হিসাবে আপনারা হ’তিনের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত আছেন। সেখানে আমরা তেমন স্থান পেয়ে যাবো যেখানে আমরা খৃষ্টানদেরকে ময়দানে পেতে চাই।

আমরা এবার কোন নীতিতে যুদ্ধ চালাবো সে কথা আমি আপনাদের আগেই জানিয়েছি। আমি আবারো বলছি, যুদ্ধের জন্য আপনারা সেই স্থান নির্বাচন করবেন, যেখানে ময়দানে আপনাদের প্রাধান্য বজায় থাকবে।

ময়দান নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখার পূর্ব শর্ত হচ্ছে অনুকূল স্থানে শএুকে টেনে আনা, যাতে ময়দান আপনাদের উপকারে আসে ও শএু বিপাকে পড়ে যায়। এমন ময়দানে একমাএ হা’তিনেই পাওয়া সম্ভব।

যুদ্ধ জয়ের শর্ত হচ্ছে, গোপনীয়তার সাথে দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপে ময়দানে পৌছা এবং শএুকে সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা।’

তিনি সেনাপতিদের হা’তিনের ম্যাপ দেখিয়ে বললেন, ‘হা’তিন এলাকায় উচ্চ ভূমিও আছে, পানিও আছে। আপনারা এই দুটো জয় করতে যুদ্ধ অর্ধেক জয় হয়ে যাবে।

কিন্তু এমন ময়দানে শএুকে নিয়ে আসা সহজ নয়। আমাদের পরিকল্পনার প্রত্যেকটা অংশ কার্যকরী হতে হবে। নয়তো একটা অংশের জন্য সমস্ত পরিকল্পনাই ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হতে পারে।

আমরা এই মাসের মাঝামাঝি দামেশক থেকে যাএা করতে পারি। আমি হলব ও মিশরে কাসেদ পাঠিয়ে বলেছি তারা যেন প্রস্তুত থাকে। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা যেন দ্রুত গতিতে এসে আমাদের সাথে রাস্তায় মিলিত হয়।

তারপর আমাদের সমস্ত সৈন্য এক জায়গায় একত্রিত করে বাইরে থেকে আসা সৈন্য ও আমাদের নিয়মিত সৈন্যদের মিশিয়ে দিয়ে নতুন করে সাজাতে হবে। নতুন সৈন্য বিন্যাস ও প্ল্যান সেনাপতি ও কমান্ডারদের বুঝিয়ে তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হবে।

আমাদের অগ্রাভিযানের ধরন ও পথ হবে ভিন্ন। এ মুহূর্তে গোপনীতার দিকে আমাদের সবচেয়ে বেশী সতর্ক থাকবো। সেনাপতি ও কমান্ডাররা ছাড়া আর কেউই কিছু জানতে পারবে না। আমাদের গোয়েন্দারা শএু এলাকায় থেকে প্রতিনিয়ত তাদের গতিবিধি জানিয়ে যাচ্ছে। আমরা দুশমন গোয়েন্দাদের এমন সুযোগ দিতে চাই না।

এখন প্রয়োজন দুশমন গোয়েন্দাদের অন্ধ ও বধির করে দেয়া। বিভিন্ন পথে সৈন্য চালনা করে আমরা তাদের বিভ্রান্ত করে দিব যাতে তাদের পাঠানো সংবাদগুলো পরস্পর বিরোধী হয়।

হাসান বিন আবদু্ল্লাহ এ ব্যাপারে কাজ করছে। আমি এ ব্যাপারে তাকে কিছু নির্দেশ আগেই দিয়ে রেখেছি। আমি আপনাদের একটি ব্যাপার জানিয়ে রাখছি, সৈন্যদলের একটি অংশ আমার সাথে ক্রাকে পৌছবে। আমার গতি সম্পূর্ণ গোপন থাকবে। চার বছর আগের প্রতিজ্ঞা পূরণের সময় হয়েছে এখন।

সুলতান আইয়ুবীর প্রতিজ্ঞাটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। চার বছর আগের ঘটনা তিনি সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন। তখন খৃষ্টান সরকার মুসলমানদের হজ্জের কাফেলায় হামলা চালিয়ে পুরুষদের হত্যা ও মহিলাদের ইজ্জত লুট করতো। আর বাচ্চা মেয়ে শিশুকে নিয়ে এনে গোয়েন্দা ট্রেনিং দিয়ে পাঠিয়ে দিত মুসলমানদের চরিএ হননের জন্য। ছেলে শিশুকে হত্যা করতো যাতে মুজাহিদের সংখ্যা বাড়তে না পারে।

হজ্জ মৌসুমে ক্রাকের খৃষ্টান সম্রাট আরনাতের নির্দেশে খৃষ্টান সৈন্যরা হাজীদের লুট করার জন্যে ওত পেতে বসে থাকতো। এ জন্য সম্রাট আরনাত গর্ব করে বেড়াত। নিরস্ত্র হাজীদের লুট ও খুন করার সংবাদে তার বুক আনন্দে ও গর্বে ভরে উঠতো। এই ডাকাতি করাটাই তার কাছে যুদ্ধ জয়ের সমান বলে পরিগণিত হতো।

১১৮৩ সালের হজ্জ মৌসুমে হেজাজ থেকে মিশরের পথে অগ্রসর একটি হজ্জ কাফেলা লুট করলো আরনাতের সেনাবাহিনী। এই কাফেলায় ছিল সুলতান আইয়ুবীর এক কন্যা।

এই খবর যখন সুলতানের কানে পৌছলো, সুলতান আইয়ুবী চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘হায়! এ কাফেলায় যে আমার মেয়ে ছিল।’ সুলতান তখুনি এর প্রতিশোধের কসম খেয়ে বললেন, ’আরনাতের এই অমানবিক ও পাশবিক অত্যাচারের মাধ্যমে সে শুধু আমার মেয়েকেই অপবিএ করেনি, পুরো মুসলিম নারী সমাজকে কলঙ্কিত করেছে। আমি কসম খেয়ে বলছি, আমি তাকে ক্ষমা করবো না, আমি নিজ হাতে তাকে হত্যা করবো।’

উপস্থিত সবারই চোখ পানিতে ভরে গেল। তাদের মনে পড়ে গেল চার বছর আগের সেই দুঃসহ স্মৃতি। তারা সবাই সুলতানের মনোবেদনা অনুভব করে নিজেরাও কাতর হয়ে পড়লো। সুলতানকে তারা এমন ভঙ্গিতে আর কখনো কথা বলতে দেখেনি।

মাথা নিচু করা লোকগুলো এক সময় চোখ তুলে তাকাল সুলতানের দিকে। দেখলো রাগে, ক্ষোভে, কষ্টে সুলতানের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে। সেখানে খেলা করছে শপথের দৃঢ়তা ও তীব্র উওেজনা।

পরিস্থিতি যাই হোক, সুলতান উওেজিত ও ক্ষিপ্ত হওয়া পছন্দ করতেন না। কিন্তু আজ তার ক্ষিপ্ত ও এই উওেজিত চেহারা দেখে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে। সবাই বুঝে নিল, যে আজকের এই প্রতিজ্ঞা থেকে সুলতানকে কেউ ফেরাতে পারবে না।

সকল খৃষ্টান সম্রাটই ইসলাম বিরোধী ও মুসলমানদের শএু। তবে সম্রাট আরনাতের সাথে আর কারো তুলনা চলে না। সে রাসুল (সাঃ) কে অবমাননা করতো। বন্দী মুসলমানদের নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে রাসুল (সাঃ) কে অপবাদ দিত ও গালমন্দ করতো। বন্দীদের বলত, এখন ডাকো তোমার আল্লাহকে। ডাকো তোমার রসুল কে। পড় তোমার আল্লাহর বানী। দেখি কেমন করে তুমি ছাড়া পাও। হা হা হা।’

এভাবে বন্দী ‍মুসলমানদের তিরষ্কার করতো এবং উচ্চস্বরে হাসতো। তার এ আচরণ সম্পর্কে সবাই জানতো, আইয়ুবীও জানতেন।

আজ চার বছর পর যখন তাঁর মনে হলো চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে, তখনি তার মনে পড়ে গেল অতীতের সেই বেদনাদায়ক স্মৃতি। তিনি কমান্ডার ও সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই হতভাগা আরনাতের সাথে বোঝাপড়ার সময় হয়েছে। আমি নিজে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে চাই। বন্ধুরা তোমরা দোয়া কর যাতে আল্লাহ আমাকে সেই সুযোগ ও সাহস দান করেন, যাতে আমি আমার প্রিয়তম রাসুলের অবমাননাকারীর অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারি।’

আমি আশা করি, তিন মাসের মধ্যেই আমি তোমাদের সাথে মিলিত হতে পারি। তিন মাস পর নতুন ঋতু শুরু হবে। তার আগেই আমি হাতিন এলাকায় পৌছে যাবো।

তোমরা জানো যে আগামী ঋতুতে প্রচন্ড গরম থাকবে। মরুভূমি তখন ফুটতে থাকবে জলন্ত অঙ্গারের মত। আমি খৃষ্টানদের তখন যুদ্ধে নামাবো। প্রচন্ড গরমে তাদের লৌহবস্ত্রগুলো আগুনের মত গরম হয়ে তাদের সিদ্ধ করে ফেলবে। আমরা আঘাত হানার আগেই খৃষ্টানরা নিজের দেহে জড়ানো অগ্নিকুন্ডে ভস্মীভূত হয়ে যাবে।’

ঐতিহাসিকগণ ও ইউরোপের যুদ্ধ অভিজ্ঞ সমালোচকগণ সুলতান আইয়ুবীর এই পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘তিনি যুদ্ধের জন্য যে ঋতু বেছে নিয়েছিলেন সেটা ছিল জুন মাস। এ সময় মরুভুমি জ্বলন্ত কয়লার মত গরম থাকে।

গ্রীষ্মের এ প্রচন্ড দাবদাহ খৃষ্টান সৈনিকদের জন্য ছিল মৃত্যুর ফাঁদের মত। লোহার শিরস্ত্রান ও পোষাক তাদের নিরাপদ না করে বরং তন্দুরের মত ভাজা ভাজা করছিল।

খৃষ্টান নাইটরা আপাদমস্তক লৌহবর্ম ও মোটা চামড়ার পোষাক পরতো। তাই তীর ও তলোয়ারের আঘাত তাদের সহজে ক্ষতি করতে পারতো না। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী তাদের এ লোহার বর্ম ও পোষাককে তাদের জন্য বড় বিপদ ও ক্ষতির কারন বানিয়ে দিলেন।

একে তো তিনি কমান্ডো ধরনের যুদ্ধ করতেন। সামান্য সৈন্য দিয়ে পাশ থেকে বিদ্যুত বেগে আক্রমণ চালিয়ে প্রতিপক্ষের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে সরে পড়তেন। এই ধরনের আক্রমণ চালানোর জন্য দরকার ক্ষীপ্ত গতির সৈনিক। কিন্তু লোহার পোষাক পড়ে খৃষ্টান সৈন্যদের পক্ষে দ্রুত গতিতে চলা সম্ভব ছিল না। আইয়ুবী এই সুযোগটাই নিতেন। তার সৈন্যরা ক্ষীপ্ত গতিতে আক্রমণ চালাতো এবং দ্রুত গতিতে সরে পড়তো।

জুনের খরতাপে রোদ্দুর যখন মাথার উপর থাকে মরুভুমি তখন আগুনের কুন্ড হয়ে যায়। লোহার পোষাক তপ্ত তাওয়ার মত জ্বলতে থাকে। পিপাসায় কন্ঠ ও শরীর শুকিয়ে যায়।

মরুভুমির ঝলসানো তাপ মুসলিম সৈন্যদেরও অসুবিধার সৃষ্টি করতো। কিন্তু তাদের পোষাক হালকা পাতলা হওয়ায় তাদের অবস্থা থাকতো তুলনামূলকভাবে ভালো।

যুদ্ধের আগেই সুলতান আইয়ুবী পানি নিজের দখলে নিয়ে নিতেন। আর তিনি তার সৈন্যদের এমন কঠিন প্রশিক্ষণ দিতেন যাতে যুদ্ধের সময় কেউ ক্ষুধা তৃষ্মায় কাতর না হয়। তিনি সৈন্যদের বলতেন, ‘বদরের যুদ্ধ হয়েছিল রমজান মাসে। ক্ষুধা-তৃষ্না জয় করে জেহাদের প্রেরণা আমাদের সেখান থেকে নিতে হবে।

শারিরীক ট্রেনিং ছাড়াও তিনি মানসিক ও আধ্যাত্নিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতেন। তিনি বলতেন, ‘মানসিক শক্তি শারিরীক শক্তির চেয়ে যুদ্ধ ক্ষে্ত্রে অনেক বেশী উপকারী। যেই সেনাপতি তার সৈন্যদের এই শক্তিতে বলীয়ান করতে পারে তারা যুদ্ধ বিজয়ী হয়।

তিনি সৈন্যদের বলতেন, ‘তোমরা আল্লাহর সৈনিক। ইসলামের সতন্ত্র প্রহরী। কারো চাকর নও যে তোমাদের ত্যাগ বিফলে যাবে। আল্লাহই তোমাদের এই বিরল সম্মানের অধিকারী করেছেন, আর মৃত্যুর পর তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। গনীমত জিহাদের আসল পুরস্কার নয়, আসল পুরস্কার আল্লাহর হাতে।

সৈন্যদেরকে জাতীয় দায়িত্বের কথা ও বিশ্বের নির্যাতিত মুসলমানদের কথা শুনানো হতো। বলা হতো, ’তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে মজলুমের পাশে দাড়ানো। তোমাদের মা, বোন যাদেরকে খৃষ্টানরা ধরে নিয়ে গেছে তাদের আহাজারিতে আল্লাহর আরশ কেপে উঠছে।

তোমরা জানো খৃষ্টান শাসিত অঞ্চলে মুসলমানদের পশুর মত জীবন যাপন করতে হয়। তাদের অশ্রু মোছানোর দায়িত্ব তোমাদের। পৃথিবীর যেখানেই অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, সেখানেই তোমরা জালিমের মুলোচ্ছেদ করবে। এখন হোক সে জালিম খৃষ্টান, ইহুদী অথবা নামধারী মুসলমান। যদি কোন মুসলমান মানবতার বিরুদ্ধে যায়, সে মুসলমান নামের কলঙ্ক, সে রাসুলের সুন্নাতের বিরোধী, আল্লাহর নাফরমান।’

তিনি বলতেন, যারা শহীদদের ভুলে যায়, নির্যাতিত মানুষের কথা ভুলে যায়, তারা বিজাতির গোলাম হয়। যে জাতি গাদ্দারদের মাথায় তুলে নাচে তাদের অন্ধকার রজনী কোনদিন ভোরের আলো দেখেনা। আর গাদ্দাররা মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস খুজে পায়। বিবেক বর্জিত পথে ঠেলে দেয় মানুষকে।

বিপদ দেখলে পিছিয়ে পড়া বা আবেগের বশবর্তী হয়ে আগুনে ঝাপ দিলে সে মুমিন মুজাহিদ নয়। মুমীনের সিদ্ধান্ত হবে দায়িত্বপূর্ণ, আচরণ হবে সহানুভূতিপূর্ন আর শপথ হবে আপোষহীন।’

এমন সব আলোচনা সেনাপতি ও কমান্ডারদের মুখে সবসময় উচ্চারিত হতো বলে সৈনিকরা ব্যাপক প্রভাবিত হতো। সুলতান নিজেও সৈনিকদের মধ্যে ঘোরাফিরা করতেন এবং আলোচনায় মিলিত হতেন। উপদেশ ও নির্দেশও দিতেন।

তিনি বলতেন, ‘সৈন্যদের ওপর জাতি যে দায়িত্ব দিয়েছে, সৈনিকরা তা ঠিকমতো পালন না করলে তাদের ভাগ্যে দুনিয়ায় জোটে ভীষন লাঞ্ছনা আর পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি।

সামনে বিশাল এক ক্রুশ নিয়ে দাড়িয়ে আছে আক্রার সবচেয়ে বড় পাদ্রী। খৃষ্টানদের বিশ্বাস, হযরত ঈসা (আঃ) কে এই ক্রুশেই বিদ্ধ করা হয়েছিল এবং এখনো এখানে তার রক্ত লেগে আছে। এই ক্রুশ ও এর রক্ষাকারী পাদ্রী খৃষ্টান জগতে মহা সম্মানিত। সে সম্রাটের চেয়েও বেশী অধিকার ও গুরুত্ব লাভ করে। সম্রাটরা সবাই তার তাবেদার।

তিনি বিশ্বব্যাপী মুসলিম হত্যার সবচেয়ে বড় ভূমিকা গ্রহনকারী। তার নির্দেশে সম্রাটরা ও গোয়েন্দারা তাদের কার্য পরিচালনা করেন। প্রকাশ্যে তিনি মানবতার কথা বলেন, কিন্তু তলে তলে তিনি মানুষ মারার পরিকল্পনা ও নির্দেশ সরবরাহ করেন খৃষ্টান গোয়েন্দা বাহিনীকে। গোয়েন্দা বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে তার ট্রেনিং শেষে কাজে যাওয়ার আগে এই ক্রুশ ছুয়ে ও এই মহান পাদ্রীর দোআ নিয়ে যেতে হয়। বিদায়ের আগে তাদের গলায় ঝুলিয়ে দিত একটি ছোট ক্রুশ।

নাসিবা নামক স্থানে খৃষ্টান সৈন্য, তাদের সম্রাটগণ ও তাদের মহান সেই পাদ্রী উপস্থিত হলো। সম্রাটদের মধ্যে সম্রাট গে অব লুজিয়ার, ত্রিপলীর সম্রাট রিমান্ড, গ্রান্ড মাস্টার গ্রাড, সম্রাট আরনাত আরো অনেক নামী দামী সম্রাট এখানে একত্রিত হয়েছেন।

ত্রিপলী থেকে আনা মোটা সিল্কের কাপড়ের সামিয়ানা দিয়ে রংমহলের বাহিরের ও আলোকসজ্জা দিয়ে ভিতরের অন্দরমহল সাজানো হয়েছে সম্রাটদের জন্য। চাকর ও সেবাদাসীতে ভর্তি রংমহল যেন ঝাড়বাতির আলোয় রাজমহল থেকে আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে।

সম্রাটদের তাবুর পাশেই নাইট ও নাইটদের তাবুর পাশে বিপুল সৈন্যের তাবুর সারি। সামিয়ানার নিচে সম্রাটরা সুন্দরী যুবতীদের পরিবেশন করা মদ পান করছে ও নারীদের উপভোগ করছে। এই নারীরা ভাইকে ভাইয়ের শত্রু ও বাবাকে ছেলের শত্রু বানাতে খুবই পারঙ্গম।

এক সামিয়ানার নিচে মহলের মত সাজানো হয়েছে বিশাল কামরা যেখানে সেই মহান পাদ্রী তার বিশাল ক্রুশসহ অবস্থান করছেন। তার সামনে সম্রাটগণ ও সেনাবাহিনীর জেনারেলগন।

এই ঐতিহাসিক মহাসম্মেলন এর মাধ্যমে ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করতে যাচ্ছে খৃষ্টান সম্রাটগন। তারা এক নতুন অভিযান শুরু করবেন এখান থেকে যার নাম ’কিলিং ইসলাম’।

’হে মহান ক্রুশের রক্ষকগন।’ পাদ্রী বলা শুরু করলেন, ‘এই মহান ক্রুশ আপনাদের পূর্বের শপথের কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য আক্রা থেকে আজ এখানে আনা হয়েছে। সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে তোমাদের চেতনাকে পূনঃজাগ্রত করাই এটার আসল উদ্দেশ্য। তোমাদের মনে রাখতে হবে, তোমরা তোমাদের অঙ্গিকার রাখতে পারনি, পারনি আইয়ুবীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে। বরং এখন সে আগের থেকে অনেক শক্তিশালী।

এখন তোমাদের ওয়াদা রক্ষা করার একটাই উপায়। তা হলো এক চূড়ান্ত যুদ্ধের মাধ্যমে আইয়ুবীকে শেষ করে ইসলামের পতন ঘটানো আর সারা জাহানে ক্রুশের রাজ্য তৈরী করা। আমি তোমাদের ধর্মীয় নেতা। তাই আমি তোমাদের ক্রুশের কথা বলি। কিন্তু ময়দানে লড়াইয়ের দায়িত্ব তোমাদের। তোমরা সবাই তোমাদের সারা জীবন এই কাজেই ব্যয় করেছো। তাই এই যুদ্ধ তোমাদেরই করতে হবে।

ইসলামকে মুছে ফেলতে চাইলে শুধু বায়তুল মোকাদ্দাস নয়, আমাদের মক্কা ও মদীনা জয় করতে হবে। মক্কা ও মদীনাকে খৃষ্টের ধর্মীয় স্থান বানাতে হবে। তোমাদের মনে আছে তোমরা একবার মদীনা থেকে মাএ তিন মাইলের মত দূরে ছিলে। কিন্তু তারপরও তা দখল করতে পারনি মুসলমানদের উন্মাদনার কারনে। সুতরাং তা দখল করতে চাইলে আমাদেরও সেরকম উন্মাদনা চাই।

সালাউদ্দিন আইয়ুবী আটঘাঁট বেঁধে এবার জেরুজালেমের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। তার হাত থেকে জেরুজালেম রক্ষা করতে হলে তোমাদের দৃষ্টি দিতে হবে মক্কা ও মদীনার দিকে। মনে রেখ, আমাদের যুদ্ধ ইসলামের সাথে, আইয়ুবীর সাথে নয়। এটা ধর্মযুদ্ধ। আমরা না পারলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তা চালিয়ে যাবে।

মনে রেখো, শেষ পর্যন্ত একটা ধর্মই থাকবে। তা হলো খৃষ্টধর্ম। ইসলাম বিলুপ্তির দিনটি বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরনীয় দিন হবে আর খৃষ্টধর্মকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মত কোন শক্তি থাকবে না।

পাদ্রী একটু থামলেন। আবার শুরু করলেন, ‘আপনারা জানেন মুসলমানদের থামানোর জন্য আমরা অন্য উপায় অবলম্বন করেছিলাম। তবে তাতে কিছুটা লাভ হলেও আসল উদ্দেশ্য এর কিছুই পূরণ হয়নি। বিনিময়ে আমরা আমাদের কত মেয়ে, কত সম্পদ, কত সেনা নষ্ট করেছি। হয়তো আইয়ুবীর কিছু দক্ষ সৈনিকের প্রাণ নিতে পেরেছি আর মুসলমানদের মধ্যে সম্পদের মোহ তৈরী করতে পেরেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

’সম্মানিত পিতা’! এক সম্রাট বললো, ‘আপনি এটাকে বিফল বলতে পারেন না। এর কারনে আমরা সাত আট বছর তার আক্রমণ থেকে নিরাপদ ছিলাম। এই সময় আমরা আমাদের সামরিক শক্তিকে অনেক মজবুত ও সুসংহত করেছি। জেরুজালেমের প্রতিরক্ষা সুদৃঢ় করেছি। অর্থনৈতিক অবরোধ করে তাদের কোমর ভেঙ্গে দিয়েছি। সামগ্রিকভাবে মুসলমানরা গৃহযুদ্ধের ফলে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটা কি আমাদের সফলতা নয়?’

’তোমরা মুসলমান মারতে চাও কারন এতে ইসলাম বিপন্ন হবে। কিন্তু তা তো হয়নি। বরং ইসলামী সব নেতারা এখন একত্রিত হয়েছে। ইসলামও আগের থেকে শক্তিশালী হয়েছে।

আমাদের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করা হয়েছে। তার সাথে গাদ্দারদের শেষ করা হয়েছে। মুসলমানদেরকে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের গৃহযুদ্ধ আমাদের ষড়যন্ত্রের ফল। ফলে মুসলিমরা বিশেষ করে যুবকদের মধ্যে আগের থেকে বেশি সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

যুদ্ধে জিততে হলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না। নয়তো তোমরাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তোমাদের মত সালাউদ্দিন আইয়ুবীও তার আগের অবস্থা থেকে এখন যথেষ্ঠ শক্তিশালী। এখন হলব ও মুশেলের বাহিনীও তার সাথে হাত মিলিয়েছে। আমাদের আগের বন্ধুরাও যারা আগে তার শত্রু ছিল, তারাও এখন তার সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে।

আমরা যাদেরকে কিনেছিলাম তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আর অন্যদের তিনি দুর্বল ও অসহায় করে দিয়েছেন। সুতরাং তারা কেউ এখন কোন কাজে আসবেনা। এখন আর কোন মুসলমান শাসক নেই যে তাকে পিছন থেকে আক্রমণ করবে। আমাদের মদ ও হাশিশ ব্যবহারও কার্যকারিতা লাভ করেনি। এখন তার বিরদ্ধে আমাদের সম্মিলিত আক্রমণ ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

এক জেনারেল বললো, ‘আপনার পরামর্শ অত্যন্ত মূল্যবান। তবে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে মনে করি তাকেই আগে আক্রমন করতে দেওয়া উচিত। এর কারন হলো,

প্রথমত আমাদের সৈন্যদের বেশী দূরে নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। তাতে খাদ্যসামগ্রী ও প্রয়োজনীয় রসদের যথেষ্ঠ নিরাপওা থাকবে। সৈন্যরা তাদের পরিচিত জায়গায় পূর্ণ শক্তি নিয়ে লড়াই করতে পারবে।

অপর কারনটি হলো, আইয়ুবীর যুদ্ধ স্টাইলটা অনেক ছড়ানো ছিটানো সৈন্যদের নিয়ে গঠিত। এখন মুসলিম এলাকায় আমাদের বন্ধু নেই। তাই তাকেই আমাদের অনুকূল জায়গায় এনে বেকায়দায় ফেলে দিলেই সে শেষ। তবে আমাদের অনেক ভাবনা ও চিন্তা করতে হবে এই ব্যাপারে।’

পাদ্রী বললেন, আইয়ুবীর বিরুদ্ধে এখন ভাবনা চিন্তার সময় নেই। গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুযায়ী সে জেরুজালেমের দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে ফেলছেন। তাই আমাদেরও সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে যে, আমরা কি তাকে তার পথে রাখবো, নাকি মক্কা মদীনা আক্রমণ করে তার পথ থেকে সরিয়ে দিব।’

’আমরা তাকে জেরুজালেমেই ফাদে ফেলতে পারি এবং গতবার তাই হয়েছিল। তবে গতবারের মত তাকে ছেড়ে না দিয়ে তাকে ওখানেই পিষে মারতে হবে।’

’তাহলে তার পথ তোমাদের চিনে রাখতে হবে। আর তার মত আমাদেরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে এখন তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হবে।’

এবার পাদ্রী উপস্থিত সকল সম্রাট, জেনারেল ও নাইটদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ’এই পবিএ ক্রুশ এখানে আনা হয়েছে তোমাদের সকলের একসাথে শপথ গ্রহনের জন্য। তোমরা এটা ছুয়ে ওয়াদা করবে সব দলাদলি বাদ দিয়ে তোমরা নিজেরা কাধে কাধ মিলিয়ে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইসলামের নাম নিশানা মুছে ফেলবে। এই শপথ হবে শুধুমাএ পবিএ ক্রুশ ও মহান যিশুর নামে। তোমরা কি আমার এই প্রস্তাব মেনে নিতে প্রস্তুত?’

সবাই উঠে দাড়ালো এবং বিনীত কন্ঠে বললো, ‘আপনার প্রস্তাব আমাদের জন্য আদেশ, আর সেই আদেশ মানা আমাদের জন্য শিরোধার্য।’

পাদ্রী তাদেরকে শপথের আহবান করলে তার ডাকে সারা দিয়ে সবাই সেই পবিএ ‍ক্রশের সামনে এসে তা ছুয়ে পাদ্রীর সাথে জোরে জোরে শপথ বাক্য পাঠ করলো।

সম্রাট আরনাতের তাবু থেকে এক অপূর্ব রূপসী লম্বা একহারা গড়ন বিশিষ্ট যুবতী বেরিয়ে এলো। মেয়েটি দেখতে আরবীয় মেয়েদের মতো। তাকে সম্রাট নিজে এখানে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। তাকে সম্রাট ডাকতো প্রিন্সেস লিলি বলে আর তাকে দেখাতো রাজকুমারীর মতো।

সে বের হওয়া মাএই তার চাকরাণী ছুটে এলো। চাকরাণীকে সে বললো তার নাস্তা ও পালকি গাড়ী তৈরী করতে। সে এই এলাকাটা একটু ঘুরে দেখতে চায়।

এই সাত সকালে অন্যান্য সকল সম্রাটের মত সম্রাট আরনাতও গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। পাদ্রীও তার প্রাতকালীন উপাসনা সেরে শুয়ে পড়েছেন।

প্রিন্সেস লিলিরও কোন কাজ নেই। কিন্তু সকালে ঘুরে বেড়ানো তার এক প্রিয় অভ্যাস। নাস্তা আনতে আনতে সে তার পোষাক পাল্টে নিল। নাস্তা এলে দ্রুত নাস্তাও খেয়ে নিল।

ইতিমধ্যে দুই ঘোড়ার টানা পালকি গাড়ী নিয়ে প্রস্তুত সহিস। সে সহিসকে বললো, এলাকাটা সে ঘুরে দেখতে চায়। সহিস এলাকাটা ভালো করে না চিনলে সে যেন একজন গাইড নিয়ে নেয়।

সহিস বললো, এই এলাকাটা তার আগে থেকেই ভালো করে জানা আছে। এখানে এর আগেও অনেকবার সে সম্রাটকে নিয়ে এসেছে। সে আরো বললো, ‘আপনি শিকার করতে চাইলে তীর ধনুক নিই। এখানে অনেক খরগোশ ও পাখী আছে। ওগুলো আপনি শিকার করতে পারেন।’

প্রিন্সেস লিলি হেসে বললো, ‘তুমি কি আমাকে শিকারী ভাবো? হরিণ পাওয়া যায় এখানে? তোমার ইচ্ছা হলে তীর ধনুক নিতে পারো।

সহিস বললো, ‘হরিন মাঝে মাঝেই দেখা যায় এবং সংখ্যায় খুবই কম। খরগোশ প্রচুর। আমি এক্ষুনি তীর ধনুক নিয়ে আসছি।’

’আমিতো তীরন্দাজ নই, দেখবে সব তীর শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু একটিও কারো গায়ে লাগেনি।’

’তাতে কোন সমস্যা নেই। আপনি তো আর যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছেন না। তীর মিছ হলেও শিকারের আনন্দে ভাটা পড়েনা।’ বলেই সে দৌড়ে গিয়ে তীর ধনুক নিয়ে এল।

প্রিন্সেস লিলিকে নিয়ে পালকির গাড়ী অনেক দূরে চলে গেল। অঞ্চলটিতে সবুজের সমারোহ আর আছে উচু নিচু পাহাড়।

এখন বসন্তকাল। প্রকৃতিতে নবদিগন্তের সূচনা ঘটছে চারিদিকে। গাড়ী চলছিল ধীরে ধীরে। রাস্তার পাশে এক বড় গাছের নিচে গাড়ির চালক সায়বল লিলির নির্দেশে গাড়ী থামালো।

সায়বল জাতিতে খৃষ্টান ও আক্রার অধিবাসী। বয়স ত্রিশ। সুদর্শন ও সুঠামদেহের কারনে সম্রাট তাকে এ চাকরি দিয়েছে। লিলিরও এ যুবককে ভালো লাগে তার সপ্রতিভ, ভদ্র ও কর্মঠ গুনের কারনে। লিলি আরনাতের কাছে আসার এক বছর পর সায়বল এখানে এসেছে।

লিলি গাছের নিচে বসে সায়বল কে বললো পানি দিতে। ‍লিলি জিজ্ঞেস করলো, ‘সীমান্ত আর কত দূর?’

সায়বল বললো, ‘সামনে সাত-আট মাইল পরে এক হ্রদ, নাম গেলিলি সাগর। তারপরে তিববিয়া গ্রাম। এরপরেই মুসলমানদের এলাকা।

’তারমানে সীমান্ত খুব কাছেই। আমরা কি হ্রদ পর্যন্ত যেতে পারবো?’

’আমরা এ গাড়ীতে করে ক্রাক থেকে এসেছি, আর হ্রদ তো এখানেই। আমরা অনায়াসে পৌছে যাবো।’

’তুমি হ্রদের রাস্তা ঠিক চিনো তো? রাস্তা কি ভালো? গাড়ী কি যেতে পারবে? তুমি আগে কখনো গিয়েছো?’ শিশুর মত প্রশ্ন লিলির।

সায়বল তাকে একটা ম্যাপ একে বুঝাতে থাকে হ্রদের রাস্তা। লিলির সব প্রশ্নের উওর দেয় একে একে। সব প্রশ্ন শেষে লিলি তাকে তীর ধনুক বের করতে বলে শিকার করার জন্য।

সায়বল তাকে তীর দিলে সে তা ধনুকে সংযোজন করে একটি পাখীর দিকে তাক করে। তীরটি ছুড়লে তা অনেক দূর দিয়ে যায় আর পাখিটিও চলে যায় সেখান থেকে।

সায়বল তাকে তীর চালনার কৌশল শিখিয়ে দেয়। সে উদাহরন সরূপ কিছু তীর এদিক ওদিক চালিয়ে দেখালো।

লিলি বললো, ‘আর একটু সামনে যাও। দেখি হরিণ পাওয়া যায় কিনা?’

সায়বল আরো দু-আড়াই মাইল এগিয়ে এক স্থানে গাড়ী থামালো। লিলির দিকে তীর ধনুক এগিয়ে দিয়ে সে লিলির জন্য একটা হরিণ খুজতে লাগল।

লিলির দিকে ছিল তার পিঠ। লিলি সায়বলের পিঠকে নিশানা করে তীর ছুড়লে তা সায়বলের পিঠের উপর দিয়ে গিয়ে এক গাছে বিদ্ধ হয়।

সায়বল চমকে উঠে লিলির দিকে তাকিয়ে দেখে লিলির চেহারায় অনমনীয় প্রতিজ্ঞার ছাপ। তবুও সে হেসে বললো, ’আপনি আমার উপর তীর চালানো শিখছেন?’

এমন অবস্থায় ‍লিলি আরেকটি তীর কোষ থেকে বের করে তা ধনুকে সংযোজন করে সায়বলকে স্থির হয়ে দাড়াতে বললো।

সায়বল বুঝতে পারলো ব্যাপারটি কি ঘটতে যাচ্ছে। সে লিলির দিকে ছুটলো তাকে ধরতে। লিলিও তীর ধনুক ফেলে একদিকে ছুটলো। সায়বল দ্রুত দৌড়ে লিলিকে ধরে ফেললো এবং তার কাছ থেকে তীর কোষটি ছিনিয়ে নিল।

সে ‍লিলিকে বললো, ‘আমি সম্রাটের অন্যান্য চাকরদের মত নই যে আমাকে সম্রাট খুব উৎপীড়ন করে। তুমি কি আমার উপরেই তীরের নিশানা করবে? এই কি আমার বিশ্বস্ততা ও তাবেদারীর ফল?’

লিলির ঠোঁট কাপতে লাগল। কোন উওর না দিয়ে সে কাদতে লাগল।

সায়বল তীর ধনুক ফেলে ধীরে ধীরে লিলির কাছে গিয়ে সসম্মানে প্রশ্ন করলো, ‘আপনি কেন আমার উপর তীর চালালেন? কেনই বা আপনার চোখে পানি?’

লিলি বললো, ‘কারন তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। আমার অসহায়ত্ব সবসময়েই আমার সাথী।’

’শাহজাদী আমি আপনার জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারি। এখন বলুন আপনার কি সাহায্য দরকার?’

’তোমাকে ধনী বানিয়ে দিব। যদি আমাকে চাও তবে তাও পাবে। তুমি আমাকে মুসলমানদের এলাকায় পৌছে দাও। এই গাড়ী ও ঘোড়া তোমারই থাকবে। আর পুরস্কার পাবে আলাদাভাবে।’

’আপনার উপর মনেহয় জ্বিন ভূতের আছর পড়েছে। চলুন ফিরে যাই।’ সায়বল বললো।

’না, যদি তুমি আমার কথা না মানো তাহলে সম্রাটকে বলে তোমাকে ফাঁসাবো।’ লিলি বললো।

’ভালোই হলো আপনি আমাকে আগে বলে দিয়েছেন। তাহলে এখন আর আমি ফিরে যাবো না। আপনাকে কোন শহরের পতিতালয়ে বিক্রি করে দিবো। আমিও আর সম্রাটের কাছে যাবো না, আপনিও যেতে পারবেন না। এখন বলুন আপনি কেন মুসলমানদের এলাকায় যেতে চান?’

তখন লিলির মনে হলো, সে এক ফাদে আটকা পড়েছে। সে বসে ফুপিয়ে কাদতে লাগল। সায়বল কিছু না বলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল।

এই মেয়েটাকে তার কাছে এখন অপরিচিত মনে হলো যদিও তিন বছর ধরে মেয়েটাকে তার খুব পরিচিত বলে মনে হতো। আর এই মেয়েটা অন্য দশটা খৃষ্টান মেয়ের মত নয়। তাকে আরবীয় মেয়ে বলে মনে হয়। সে জানতো খৃষ্টানরা মুসলমান মেয়েদের ‍লুট করে। এই মেয়েটাও হয়তো সে রকমই কোন কাফেলা থেকে লুট কৃত।

সে মেয়েটার পাশে বসে মোলায়েম কন্ঠে বললো, ‘তুমি মুসলমান হলে বল। তোমাকে কি কোন কাফেলা থেকে ছিনাতাই করে আনা হয়েছে?’

’হ্যা, আমি তোমাকে সব বলে দিই আর তুমি সম্রাটের কাছে গিয়ে সব ফাস করে দাও আর বলো যে আমি মুসলিম গোযেন্দা। তুমি তোমার এই পবিএ ক্রুশে হাত রেখে বলো যে, তুমি আমাকে ধোকা দিবে না। সম্রাটকে সব বলে দেবে না। তাহলে আমি তোমাকে সব খুলে বলব।’ লিলি বললো।

সায়বল বুঝলো মেয়েটা কি বলতে চায়। সে তার ক্রুশের মালা ছিড়ে ফেলে বললো কোন মুসলমান ক্রুশের উপর হাত রেখে শপথ করতে পারে না।

লিলি বিশ্বাস করতে পারলো না এই ঘটনা। কোন খৃষ্টান সে যতই বেদ্বীনই হোক না কেন, সে ক্রুশের এমন অবমাননা সহ্য করতে পারবেনা। লিলি সায়বলের ‍মুখের দিকে তাকালো যাতে পরিস্থিতিটা কিছুটা হলেও বুঝা যায়। সায়বলের নিশ্চিত বিশ্বাস জম্মে গিয়েছিল যে, মেয়েটা মুসলমান। কোন বিপদে হয়ত খৃষ্টানদের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়েছে।

’আমি আমার গোপন কথা তোমার কাছে প্রকাশ করে দিয়েছি। এখন তুমি বল তুমি কি করে খৃষ্টানদের খপ্পড়ে পড়লে?’ সায়বল বললো।

’আমি এক হজ্জ কাফেলার সাথে হজ্জ শেষে আমার মা বাবার সঙ্গে মিশরে ফিরছিলাম। ক্রাকের সম্রাট আরনাত সেই হজ্জ কাফেলা লুট করে কাফেলার লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করলো। এটা ছিল আজ থেকে চার বছর আগের ঘটনা। সেই সময় আমার বয়স ষোল কি সতের। আমি জানি না আমার মা-বাবা বেঁচে আছেন কিনা? এত লোক মারা পড়লো, কিন্তু আমাকে কেউ মারলো না। এই দুর্ভাগ্য ছাড়াও আরো দুর্ভাগ্য আমার সঙ্গি ছিল। আর তা হলো আমার সৌন্দর্য। আমার রূপের কারনে সম্রাট আমাকে বাছাই করলেন।

আমি এত সুন্দরী না হলে হয়ত অন্য কারো হাতে পড়তাম আর পালাবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সম্রাটের নিরাপওা ভেদ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আজ চার বছর পর এই একবার চেষ্টা করলাম, তাও তোমার হাতে পড়লাম। জানি না কি হবে। তবে জীবনের প্রতি আমার মায়া নেই। এর চেয়ে মরন ভালো।’

সায়বল বললো, ‘আমি তো তোমাকে কয়েক বছর এর মধ্যে কখনো বিমর্ষ দেখিনি।’

লিলি বললো, ‘তোমার চাকরী পেতে পেতে ততোদিনে আমার চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল।

আমি সম্রাটের পা ধরে কত কান্নাকাটি করেছি। কিন্তু তিনি বলেছেন, ‘আমি রাজ সিংহাসন ছাড়তে পারি, কিন্তু তোমাকে ছাড়বো না। তোমাকে আমি রাজরানীর মতোই রাখবো।’ সে তার কথা রেখেছে। আমাকে রাজরানীর মতই রেখেছে। কিন্তু সে আমাকে বিয়ে করেনি, আমাকে ধর্ম ত্যাগ করতেও বলেনি। আমাকে শুধু তার আনন্দের সাথী করে রেখেছে।

সে আমার এতই ভক্ত হয়ে গেল যে তার মহলের অন্যান্য সুন্দরী মেয়েদের সাথে আমার শত্রুতা হওয়ার পরও তারা আমার কিছুই করতে পারলো না। সবশেষে আমি আমার এই অবস্থাকে আমি মেনে নিলাম। এছাড়া আমার আর করার কিছুই ছিল না।

তুমি কি এসব কথা সম্রাটকে জানিয়ে দেবে? সম্রাটকে বললে আমাকে কি শাস্তি দিবে?’

সায়বল বললো, ‘আমি তো খৃষ্টান না। মুসলমান, তাই বলবো না। সিরিয়া আমার দেশ ও আমার নাম বাকার বিন মুহাম্মদ।’

’তুমি কি সালাউদ্দিনের গোয়েন্দা? যাদের ব্যাপারে আরনাত আমাকে বলতো যে খৃষ্টানদের মতো মুসলমানরাও শত্রু দেশে গোয়েন্দাগিরী করে। আর আমার মুসলমান নাম ছিল কুলসুম।’ লিলি বললো।

’আমি একজন মুসলমান, আমি তোমাকে ধোকা দিবো না। আমি গোয়েন্দা কি না তা জেনে তোমার কাজ নেই। আমি শুধু জানতে চাই, তুমি কি শুধুই পালাতে চাও নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্যও আছে?’

’বিরাট উদ্দেশ্য আছে। তুমি কি জানো আক্রার পাদ্রী কেন সমস্ত বড় বড় খৃষ্টান সম্রাটদের এখানে একত্রিত করেছেন? রাতে আরনাত আমাকে বললো, আমি অনেক বড় দেশের রানী হবো। সালাউদ্দিন নাকি তাদের ফাদে পড়তে যাচ্ছে।’

আমি খুশির ভান করে প্রশ্ন করলাম, ’কিভাবে?’ সে বললো, ‘আমরা এবার নিজেদের সব বিভেদ ভুলে সবাই একসাথে ক্রুশ ছুয়ে সালাউদ্দিনের সাথে যু্দ্ধ করার পণ করেছি। আর এবার আমরা সালাউদ্দিনকে আগে আক্রমণ করার সুযোগ দিবো। ফলে তার নিজস্ব এলাকা সে ছেড়ে আসবে আর তার রসদপত্র পৌছানোর পথ দীর্ঘ হয়ে যাবে। আর এই সুযোগে কোন এক জায়গায় আক্রমণ করে তার রসদপত্রের যোগান বন্ধ করে দেওয়া হবে।

যদি সুলতান আইয়ুবী নিজের থেকে দীর্ঘদিন ধরেও আক্রমণ না করেন, তবে সবাই একসাথে আক্রমণ করে তার সাঙ্গলীলা ভঙ্গ করা হবে। আর নয়তো তারা একযোগে মক্কা ও মদীনা অভিমুখে অভিযান করে শহর দুটো দখল করে নিবে। তাদের ধারনা, এতে সারা দুনিয়া থেকে ইসলামের নাম নিশানা মুছে যাবে।’

’তোমার মনে হঠাৎ এটা মনে হলো কেন যে এটা সুলতান আইয়ুবীকে জানাতে হবে। যদি বলি তুমি আরনাতের আদেশেই এটা সুলতান আইয়ূবীকে দিতে যাচ্ছো তাহলে কি উওর দিবে?’ বাকার বিন মুহাম্মদ বললো।

’তোমাকে এখন এতই বোকা মনে হচ্ছে যে এতক্ষন যে মনে হচ্ছিল তুমি একজন মুসলমান গোয়েন্দা, সেই বিশ্বাসের অপমান করতে হচ্ছে। যদি আইয়ুবীকে বিভ্রান্ত করাই আরনাতের উদ্দেশ্য হতো তাহলে নিশ্চই অন্য উপায় অবলম্বন করতেন। আর যদি আমাকেই বেছে নিতেন, তবে তিনি নিজেই আমাকে গাড়ীতে করে মুসলিম এলাকায় পৌছে দিতেন।

শোন বাকার, আমি তোমাকে প্রথম তীর মেরেছিলাম আমার ইচ্ছাতেই। আর এই ইচ্ছাটা হঠাৎ করেই আমার মাথায় এসেছিল। আমি তো নিখাদ ভ্রমনই করতাম, তুমিইতো আমাকে শিকারের জন্য তীর ধনুক এনে দিলে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম বর্ডারের দূরত্ব। কারন এটাই আপাতত আমার জানা দরকার ছিল।

তুমি যখন বললে কয়েক মাইল পরেই বর্ডার, তখন আমার মনে পালাবার চিন্তা আসলো। প্রথমে মনে করেছিলাম, লোভ দেখাবো তোমাকে। পরে যখন তোমার বিশস্ততার কথা মাথায় আসলো তখন ভাবলাম তুমি আমাকে সাহায্য করবে না। উল্টো আমাকে মুসলিম গোয়েন্দা বলে সম্রাটের কাছে ধরিয়ে দেবে এবং অনেক পুরস্কার জিতবে। ঠিক তখনি আমার মাথায় তোমাকে খুন করার কথা ধরা দিল।

তুমি তখন গাছের সাথে আমার দিকে পিঠ দিয়ে দাড়িয়ে আছ, আমি ভাবলাম এটাই তো মহাসুযোগ। তোমাকে মেরে তোমার দেখানো পথে পালিয়ে যাবো। আমার প্রথম তীর লক্ষভ্রষ্ট হলো আমার আবেগের কারনে। জীবনে এই প্রথম নিজ হাতে কোন মানুষ মারতে যাচ্ছিলাম। এরপর যখন তুমি টের পেয়ে গেলে তখনো আমার হুশ হলো না যে, তোমাকে বলি, ভুলক্রমে ছুটে গেছে। তাহলে তুমি সহজেই বিশ্বাস করতে। কারন তুমি জানো যে আমি তীর চালাতে জানি না।

এই রকম ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তা হলো না। উল্টো নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনলাম।’

বাকার বললো, ‘তোমার কি এর আগে কখনো পালানোর চিন্তা মাথায় এসেছিল?’

কুলসুম বললো, ‘প্রথম দিকে সারাক্ষনই আমার মাথায় তাই ঘুরপাক খেতো। কিভাবে এখান থেকে পালানো যায়। কিন্তু শত চেষ্টা করেও কোন বুদ্ধি বের করতে পারিনি।

একবার একটা সম্ভাবনা তৈরী হয়েছিল যখন সুলতান আইয়ুবী ক্রাক অবরোধ করেছিলেন। তখন তিনি গোলা নিক্ষেপ করে শহরের বিশেষ ক্ষতি সাধন করেছিলেন। আমি মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম যে, যদি আমাদের বাহিনী শহরে প্রবেশ করে তবে আরনাতকে নিজ হাতে হত্যা করে আমাদের কাফেলা লুট করার প্রতিশোধ নিবো।

কিন্তু আরনাত সুলতান আইয়ুবীর সাথে সন্ধি করায় আমার ইচ্ছা দমে গেল। সে আমাকে বললো, ‘আইয়বীকে বোকা বানিয়েছি। আমি তাকে ওয়াদা দিয়েছি যে আমি আর হজ্জ কাফেলা লুট করবো না। আর আগামীতে তার সাথেও আর কোন যুদ্ধ করবো না।’

তখন আমার মনে খুব দুঃখ হলো যে, আমাকে উদ্ধার না করে সুলতান আইয়ুবীর ফিরে যাওয়া উচিত হয়নি।’

’সুলতান আইয়ুবীর আরো বড় লক্ষ্য আছে। তিনি আমাদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাসকে দুশমনের হাত থেকে উদ্ধার করতে চান। ‍যদি সুলতান আইয়ুবী প্রত্যেকটি মুসলমান মেয়েকে উদ্ধার করতে চান, তবে তিনি তার লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে চলে যাবেন। দ্বীন ও স্বদেশ যখন বিপদগ্রস্থ হয় তখন জাতির সন্তানদের বিভিন্নভাবে কোরবানী দিতে হয়। মুজাহিদরা কোরবানী দিচ্ছে একভাবে, আর তুমি কোরবানী দিচ্ছ আরেকভাবে।’ বাকার বললো।

’আমি মুসলমানের মেয়ে হওয়ায় আরনাতের এক বিশ্রি অভ্যাস সহ্য করতে পারছি না। সে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর শানে খুবই বেয়াদবী করে। সে একথাও বলে, সুলতান আইয়ুবী প্রথম কেবলা উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে আর আমরা চেষ্টা করছি কাবা শরীফ ধ্বংস করে সেখানে গির্জা বানাতে।’ কুলসুম বললো।

ক্রুসেডারদের এমন সংকল্পের কথা ইউরোপের ঐতিহাসিকরাও উল্লেখ করেছেন। ক্রুসেড বাহিনী সম্মিলিত শক্তি নিয়ে কাবা শরীফ ও রাসুলের রওজা মোবারক ধ্বংশ করারও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আল্লাহর নিজস্ব মদদে মক্কা ও মদীনার মুসলমানরা তাদের রুখে দেয় রাসুলের রওজা মোবারক হেফাজত করে।

ক্রকের যে অবরোধ সুলতান আইয়ুবী করেছিলেন এবং এক মাস পরে তা উঠিয়ে নিয়েছিলেন সেটাও এক ঐতিহাসিক ঘটনা। অবরোধ উঠিয়ে নেওয়ার কারণ এ নয় যে, আরনাত যুদ্ধ না করার ও হাজীদের কাফেলা লুট না করার অঙ্গিকার করেছিলো। সুলতান আইয়ুবী ভালো করেই জানতেন খৃষ্টানরা ওয়াদা ভঙ্গে ওস্তাদ। অবরোধ উঠানোর আসল কারন ছিল বায়তুল মোকাদ্দাস উদ্ধারের প্রস্তুতিতে ভীষন ব্যস্ততা।

আরনাত সে চুক্তি করার দুই বছর পর হাজীদের আর একটি কাফেলা লুট করেছিল। তার চুক্তির মেয়াদ ছিল ১১৮৮ সাল পর্যন্ত।

সুলতান আইয়ুবী ১১৮৭ সালে হাতিন এলাকার দিকে অভিযান চালান। তিনি এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই দামেশক থেকে বের হন, তিনি নিজ হাতে আরনাতকে হত্যা করবেন।

অপরদিকে খৃষ্টানরা তাকে শেষ করার জন্য আক্রার পাদ্রীর আহবানে নসিবায় মিলিত হয়ে শপথ গ্রহন করল। একটি রক্তাক্ত ও চূড়ান্ত সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত উভয়েই। সুলতান আইয়ুবী সব জেনেও হাতিনের দিকে তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে চললেন।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top