২৭. ছোট বেগম

সেনাপতি এক হাতে পিছন থেকে তার গলা পেঁচিয়ে ধরে অন্য হাতে তার পেটে ও বুকে ভীষণ জোরে ঘুষি চালালেন।

হাবিবুল কুদ্দসের বেদম মারের চোটে লোকটি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রায় মরতে বসেছিল, কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত ঘুষি বন্ধ করে তার নুয়ে পড়া মাথাটি উঁচু করে ধরলেন এবং হাতের চাপ ছেড়ে দিলেন। লোকটি ভুস করে দম ছাড়লো।

হাবিবুল কুদ্দুস আবার তার গলা টিপে ধরে তাকে টেনে নিয়ে এক ঘন ঝোঁপের মধ্যে ফেলে দিলেন এবং দ্রুত সেখান থেকে পালালেন।

পাহাড়ের পাশ দিয়ে একটি সরু রাস্তা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। চারদিকে চোখ ‍বুলাতে গিয়ে আগেই রাস্তাটি দেখেছিলেন তিনি। পেছনে মহলের ধ্বংসাবশেষের দিকে না গিয়ে তিনি সেই রাস্তা দিয়ে ছুটলেন। কিছু দূর গিয়ে পাহাড়ের বাঁক ঘুরেই থমকে দাড়াঁলেন তিনি। সেখানে এক লোক বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

লোকটি হাবিবুল কুদ্দুসকে দেখলো। তার মধ্যে বিস্ময় বা ভয় কোনটাই নেই। যন্ত্রচালিতের মত সে শুধু একটি কথাই বললো, ‘ফিরে যান।’

হাবিবুল কুদ্দুস ছিলেন নিরস্ত্র। এর হুকুম অমান্য করলে লোকটি যে তাকে শিকারী পশুর মতই বর্শাবিদ্ধ করে মহলে ফিরিয়ে নেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় খালি হাতে তার সাথে লাগতে যাওয়া নিরর্থক ভেবে তিনি মাথা নত করে পিছনে ফিরলেন।

তিনি মাএ কয়েক পা এগিয়েছেন এই সময় খৃষ্টান প্রহরী তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালো এবং হেসে বললো, ‘আমি আপনাকে জ্ঞানী মনে করেছিলাম।’ খৃষ্টান প্রহরী তাকে আরো বললো, ’আপনি এ ধ্বংসাবশেষ থেকে বের হতে পারবেন না। আহাম্মকি না করে গোসল করে নিন। আসুন আমার সঙ্গে।’

তিনি সেই ঝর্ণার পানিতে গোসল করে কাপড় পাল্টে চলে এলেন। খৃষ্টান প্রহরী তাঁকে মহল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। পথে তিনি খৃষ্টানটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওই মেয়েগুলো তোমাদের সাথেই আছে?’

’এমন জনশূন্য বিরান স্থানে কিছু আলো তো সঙ্গে রাখাই দরকার।’ খৃষ্টানটি বললো, ‘আপনার কি তিনটি স্ত্রী নেই? বাড়ীতে যার এক সাথে তিন স্ত্রী দরকার হয় এমন জনশূন্য বিরান প্রান্তরে তার কি কোন মেয়ে মানুষের দরকার হতে পারে না?

আপনার যুদি প্রয়োজন না থাকে ভাল কথা, কিন্তু ‍যদি আপনি এই নির্জন স্থানে একাকীত্বের কষ্ট পান তবে এই মেয়েদের যাকে খুশী ডাক দেবেন, আপনার কষ্ট তারা দূর করে দেবে।’

মহলে প্রবেশ করলে এক মেয়ে নাস্তা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তার কামরায় এলো। হাবিবুল কুদ্দুস এ মেয়েটিকে আগেও দেখেছেন। মেয়েটি তার সামনে নাস্তা রেখে নিজেও তার পাশে বসে গেল। কামরায় খৃষ্টান নেতা ছিল, সে বাইরে চলে গেল। মেয়েটি তার পাতে খাবার তুলে ‍দিতে লাগলো এবং তার সাথে আপনজনের মত গল্প জুড়ে দিল। মেয়েটির কথার যাদু ও অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন হাবিবুল কুদ্দুস। খাওয়া শেষ হওয়ার পরও গল্প চলতে লাগলো তাদের।

অনেকক্ষন পর খৃষ্টান নেতা ফিরে এলে মেয়েটি সেখান থেকে উঠে চলে গেল। হাবিবুল কুদ্দুস অনুভব করলেন, মেয়েটি চলে যাওয়ায় তার বেশ খারাপ লাগছে।

’আপনি স্বাধীন মিশরের প্রধান সেনাপতি হবেন।’ খৃষ্টান তাঁকে বললো, ‘আপনার বাহিনীতে যে তিন হাজার পদাতিক সৈন্য, দুই হাজার অশ্বারোহী ও দুই হাজার তীরন্দাজ আছে তারা আপনার একান্ত অনুগত ও ভক্ত। আপনি তাদের সাহায্যে মিশরের শাসন ক্ষমতা দখল করতে পারবেন।’

’সালাউদ্দিন আইয়ুবী আক্রমন চালালে আমি কি এই বাহিনী দিয়ে মিশরকে তাঁর আক্রমন থেকে বাঁচাতে পারবো?’

’সুদানী মুসলমান, যারা এক সময় মিশরের সেনাবাহিনীতে ছিল, তারা আমাদের সাথে থাকবে।’ খৃষ্টানটি বললো, ‘সালাউদ্দিন আইয়ুবীর সৈন্যদের মধ্যেও যারা মিশরের অধিবাসী, তাদের কাছে আমি এ খবর পৌছে দেবো। তাদের জানাবো, এটা গৃহযুদ্ধ নয়, বরং এটা মিশরকে স্বাধীন করার এক চূড়ান্ত প্রচেষ্টা।’ খৃষ্টান লোকটি আরো বললো, ‘আপনি আপনার বাহিনী ‍দিয়ে বিদ্রোহ করাবেন। আপনাকে সামরিক সাহায্য দেয়ার ব্যবস্থা আমি করবো।’

কিভাবে এই বিদ্রোহ তিনি সংগঠিত করবেন তার একটি নীলনকশা হাবিবুল কুদ্দুসের সামনে তুলে ধরলো খৃষ্টান নেতা। বিস্তারিত আলোচনার পর জিজ্ঞেস করলো, ‘এবার বলুন, এ পরিকল্পনা আপনার কেমন লাগছে?’

হাবিবুল কুদ্দুস বিষয়টিকে আর হালকাভাবে নিতে পারলেন না। তিনি এটুকু বুঝলেন, খৃষ্টানরা আটঁঘাট বেঁধেই এ কাজে নেমেছে। অতএব এ পরিকল্পনা তারা বাস্তবায়ন করবেই।

তিনি খৃষ্টান নেতার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। খৃষ্টানটি আবার বললো, ‘কি ভাবছেন?’

’ভাবছি, তুমি যে পরিকল্পনা দিলে তা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?’

খৃষ্টানটি বুঝে নিল টোপ গিলতে শুরু করেছেন হাবিবুল কুদ্দুস। অনেকক্ষন পর হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘যদি আমি কায়রো ফিরে যেতে না পারি তবে আমার বাহিনীকে কেমন করে বিদ্রোহে রাজি করাবো?’

’আপনাকে ফিরে যেতে হতে না।’ খৃষ্টানটি বললো, ‘আপনি এখান থেকেই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে পারবেন। আপনার খুব বিশ্বাসভাজন কাউকে আপনি চিঠির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠাবেন। সে চিঠি পৌঁছানো এবং তার মাধ্যমে কাজ উদ্ধার করার ব্যবস্থা আমিই করতে পারবো।’

’কিন্তু আমি যদি তাতে রাজি না হই?’

’অমন কথা বলবেন না।’ খৃষ্টানটি বললো, ‘আপনি আমার এক প্রাণপ্রিয় সাথীকে হত্যা করেছেন। সেই অপরাধে আমি আপনাকে হত্যা করতে পারতাম। কিন্তু মিশরের স্বার্থে আমি আমার সব রাগ ও ক্ষোভ দমন করে নিয়েছি। দয়া করে আপনি আমাকে আবার উওেজিত করে তুলবেন না।’

লোকটি বললো, ‘আপনি যদি আমার কথা না মানেন তবে আমাকে আপনার ও আপনার পরিবারের সাথে হিংস্র আচরণ করতে হবে।’

’তবে তো আমাকে এখানে দীর্ঘ দিন থাকতে হবে।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন।

’কিছু সময় তো লাগবেই।’ খৃষ্টানটি উওর দিল, ‘এখানে আপনার কষ্ট হয় এমন কিছু ঘটতে দেবো না আমি। আপনার যখন যা প্রয়োজন হয় বলবেন, আপনার সব প্রয়োজন আমি পূরণ করে দেবো।’

’তবে আমার একটা প্রয়োজন আপাতত মিটিয়ে দাও।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘তুমি আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য দুটি মেয়েকে নিয়োজিত করেছো। কিন্তু আমি পাপ থেকে বাঁচতে চাই। এমনও হতে পারে, এই সুন্দরীদের মোহে পড়ে আমি আমার দায়িত্ব ভুলে যেতে পারি। তার চেয়ে একটি ব্যবস্থা করো, আমার ছোট বিবি জোহরাকে এখানে এনে দাও। তাতে লাভ হবে এই যে, তাকে দিয়েই আমি সংবাদ আদান প্রদানও করতে পারবো।’

’তাহলে যে তাকেও ছিনতাই করতে হবে।’ খৃষ্টান লোকটি বললো, ‘যদি তাকে আমি বলি যে, আপনি তাকে ডাকছেন, সে তো আমার কথা বিশ্বাস করবে না। বরং আমাকে ধরিয়ে দেবে। তার বদলে আমি আপনাকে যে জিনিষ দিচ্ছি তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন। সংবাদ বা যোগাযোগের জন্য অন্য কোন বিশ্বস্ত লোকের নাম ঠিকানা বলুন।’

তারচে তুমি আমাকে বিশ্বাস করে নাও।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ‘তুমি আমাকে কায়রো পৌছে দাও। আমি তোমার কাছে ওয়াদা করছি, এক মাসের মধ্যেই আমি সেখানে বিদ্রোহ ঘটাবো।’

’এটা অসম্ভব! এ হতে পারে না।’ খৃষ্টানটি উওেজিত কন্ঠে বললো, ‘সম্মানিত সেনাপতি! আমি যা করছি সেটা মিশরের ভালোর জন্যই করছি। আর এর মধ্যে আপনারও কল্যাণ নিহিত আছে। আমি অথবা আমার সংগঠন কোন ব্যক্তিই মিশরের শাসক হতে পারবো না। আপনি বুঝতে চেষ্টা করুন, মিশর স্বাধীন হলে তার দায়িত্ব ও শাসনভার আপনাকেই গ্রহন করতে হবে।’

’আমি তোমার কথা ভাল করেই বুঝতে পেরেছি।’ হাবিবুল কুদ্দুস বললেন, ’আর এখন আমি চিন্তা ভাবনা করেই কথা বলছি। আমার ছোট বিবি জোহরার কাছে সংবাদ পৌছে দাও। তাকে বলো, আমি তাকে আমার কাছে আসতে বলেছি। সে যে কাজ করতে পারবে তা আর কেউ পারবে না। কারন তার বাপ আমার বাহিনীতে আছে। তার আসার পর দেখবো, এই পরিকল্পনা কিভাবে সফল করা যায়।’

এক বুড়ি ভিখারিনী একদিন জোহরাকে পথে থামিয়ে দিল। বুড়ি দু’তিন দিন ধরেই লক্ষ্য করছে, জোহরা হাবিবুল কুদ্দুসের বাড়ী থেকে দুপুরে তার মা বাবার বাড়ী চলে যায় আর সন্ধ্যায় ফিরে আসে।

সেদিন জোহরা বাপের বাড়ী যাওয়ার জন্য পথে বেড়িয়েছে। এক ভিখারিনী তার পথ আগলে হাত প্রশস্ত করে বললো, ‘সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুস আপনাকে ডেকেছেন। এই চিঠি তার নিজের হাতের লেখা। নিশ্চয়ই তার হাতের লেখা আপনি চিনতে পারছেন?’

জোহরা কাগজটি হাতে নিয়ে তাঁর কাছে লেখা হাবিবুল কুদ্দুসের চিঠিটি পড়লো। এ চিঠি যে তার স্বামীরই হাতের লেখা তাতে কোন সন্দেহ নেই।

চিঠি পড়া শেষ হতেই ভিখারিনী তার চোখে চোখ রেখে বললো, ’তিনি যেখানেই যান না কেন, স্বেচ্ছায় একাকীই গেছেন। এতবড় ক্ষমতাবান লোককে কেউ ধরে নিয়ে যেতে পারে না।

তিনি শুধু আপনাকেই চান। তিনি বলেছেন, ‘জোহরাকে ছাড়া এ চিঠি আর কারো হাতে দেবে না। আর তাকে বলবে, সে যেন তোমার সাথে আমার কাছে চলে আসে। তিনি এ চিঠির প্রসঙ্গ কাউকে বলতে নিষেধ করেছেন।

এও বলেছেন, ‘জোহরাকে বলবে, সে যেন তোমাকে বিশ্বাস করে। সে যদি এ চিঠি বিশ্বাস না করে তোমাকে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বা থানায় সংবাদ পাঠায় তবে আমি ও জোহরা দু’জনেই মারা পড়বো।’ আমার কথা বিশ্বাস করুন, হাবিবুল কুদ্দুসের কাছে আপনার যাওয়া দরকার।’

’আমি তোমার কথা কেমন করে বিশ্বাস করি?’ জোহরা ভীত-চকিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘বলো, এমন কথা আমি কেমন করে বিশ্বাস করি?’

’আমি ভিক্ষুক নই।’ ভিখারিনী বললো, ‘এটা আমার ছদ্মবেশ। আমিও আপনার মত ধনীর দুলালী। আমাদের উদ্দেশ্য সৎ ও পবিএ। বিশ্বাস না করলে কি ক্ষতি হবে সে কথা আপনার স্বামীই বলে দিয়েছেন। আপনি কি জানেন না, তিনি আপনাকে কতটা ভালবাসেন? এই হাতের লেখা কি তার নয়? তাহলে কেন অযথা সন্দেহ পোষণ করে নিজের ও স্বামীর বিপদ ডেকে আনবেন?’

’কিন্তু তিনি নিরুদ্দেশ হতে গেলেন কেন? আমি তো এর কিছুই বুঝতে পারছি না।’

তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছেন এক মহৎ ও বিরাট উদ্দেশ্য নিয়ে। সব কথা আমিও জানি না, আর যা জানি তাও আপনাকে বলতে পারবো না। কারন সে তথ্য প্রকাশ করার অনুমতি তিনি আমাকে দেননি। তিনি শুধু বলেছেন, দেশ আজ এক মহা ষড়যন্ত্রে পড়েছে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্যই তাকে নিরুদ্দেশ হতে হয়েছে।’

মেয়েটি তাকে আরও অনেক কথাই বললো। জোহরা তার কথায় এটুকু বুঝলো যে, ঘটনা যাই হোক, তার স্বামী এখনো জীবিত আছেন। তিনি যে কারণেই নিরুদ্দেশ হোন না কেন, তার জীবন ও দেশের স্বাধীনতা আজ হুমকির সম্মুখীন। ফলে সে মেয়েটির প্রস্তাবে রাজী হল। ওকে বললো, ‘তুমি সন্ধার সময় অমুক জায়গায় অপেক্ষা করো, আমি চলে আসবো।’

জোহরা ওকে বিদায় ‍দিয়ে বাপের বাড়ী চলে গেল। সারাদিন সে চিন্তা করলো। শেষে সন্ধার একটু আগে প্রতিদিনের মতই বাড়ী ফেরার নাম করে রাস্তায় নামলো। কিন্তু আজ তার গতি বাড়ীর দিকে ছিল না, ছিল সেই দিকে, যেখানে দুপুরের দেখা মেয়েটিকে থাকতে বলেছিল।

কিন্তু ওখানে পৌঁছে সে দুপুরের ভিখারিনীর কোন হদিস পেলো না। সে মহা দুর্ভাবনায় পড়ে গেল। চিন্তা করতে লাগলো, কাউকে কিছু না জানিয়ে তার এভাবে চলে আসাটা কি ঠিক হচ্ছে?

কিন্তু যেখানে স্বামীর জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন, সেখানে যদি তাকে জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয় তাতে পিছপা হতে পারে না জোহরা। কারন তার পিতা ও স্বামী উভয়েই তাকে মুজাহিদ হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে। সামনে যাই ঘটুক না কেন, তা মেনে নেয়ার জন্য সে নিজের মনকে বুঝাতে লাগলো।

সূর্য যখন ঠিক ডুবতে বসেছে তখন সেখানে এক বোরকাওয়ালী যুবতী এলো। এই মেয়েই দুপুরে বুড়ি সেজেছিল। মেয়েটি তাকে বললো, ’চলুন।’

জোহরা তাকে অনুসরণ করলো। তারা শহর ছেড়ে গ্রামে নেমে এলো। ততোক্ষণে রাতের আধাঁর গিলে ফেলেছে সেই গ্রামের বাড়িঘর ও বৃক্ষরাজি। রাস্তার পাশে এক বৃক্ষের আড়ালে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল দু’জন লোক।

একটু পর সেই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গেল ওরা। মেয়েটি গাছের কাছে পৌছতেই বিড়ালের ডাক ডাকলো দুই বার। এটা ছিল এক গোপন সংকেত। সংকেত পেয়ে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলো সেই দুই লোক।

মেয়েটি তখন আর ভিখারিনীর ছদ্মবেশে ছিল না। সে এখন এক সুন্দরী যুবতী নারী। সে জোহরাকে বললো, ‘আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ওদের সাথে চলে যাও, মনে কোন ভয় রাখবে না।’

জোহরাকে একটি অশ্বের পিঠে আরোহন করানো হলো। লোক দু’জনও দুই ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে বসলো। তারপর অন্ধকারের মধ্যেই অপরিচিত দুই লোকের সাথে অজানার উদ্দেশ্যে যাএা করলো জোহরা।

জোহরা এমন এক সফরে যাএা করলো যে পথের মঞ্জিল তার জানা নেই। মেয়েটি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। জোহরাদের ঘোড়ার পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলে ‍সে একাকী শহরের পথে ফিরে চললো।

অনেক রাত পর্যন্ত পখ চললো ওরা। জোহরা পথঘাট কিছুই চেনে না। রাত বলে সে আশেপাশে কিছু দেখতেও পাচ্ছে না। কোথায় যাচ্ছে, কতদূর যেতে হবে কিছুই জানা নেই তার। তবু তার চলার বিরাম নেই।

রাত তখন অর্ধেকেরও বেশী পার হয়ে গেছে। এক পাহাড়ের কোলে থামলো ওরা। একজন আরেকজনকে বললো, ‘ওর চোখ বাঁধা প্রয়োজন।’

এই মধ্য রাতে অন্ধকার পথে যেখানে জোহরা কোন দিকে যাচ্ছে তাই জানে না, সেখানে হঠাৎ করে তার চোখ বাঁধার কি দরকার পড়লো বুঝতে পারলো না জোহরা। কিন্তু সে একা এবং অসহায়। তাদের বাঁধা দেয়ার কোন ক্ষমতাই নেই জোহরার। তাই সে কোন বাঁধা দিল না। ওরা তার চোখে কালো কাপড়ের পট্টি বেঁধে দিল।

জোহরা যেদিন বাড়ী থেকে পালালো তার দুই দিন পর ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেল। সবাই জানলো, সেনাপতি হাবিবুল কুদ্দুসের ছোট বিবিও নিখোঁজ হয়েছে।

গোয়েন্দারা সন্দেহ করলো, তাকেও ছিনতাই করা হয়েছে। কিন্তু সন্দেহ থেকে তো কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যায় না। তাই আসলে কি ঘটেছে বলতে পারলো না কেউ।

লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো, ‘তিনি হয়তো খৃষ্টান বা সুদানীদের সাথে মিলিত হয়েছেন। তার স্ত্রী জোহরাও হয়তো তাঁর কাছেই চলে গেছে।’

কিন্তু আলী বিন সুফিয়ান ভাবছিলেন অন্য কথা। একজন সেনাপতির অন্তর্ধানের পর তার পরিবারের প্রতি গোয়েন্দাদের যে নজরদারী ছিল তার ফাঁক গলে কেমন করে তার স্ত্রী হারিয়ে যেতে পারে? সে পালিয়ে যাক বা অপহৃত হোক, গোয়েন্দদের সে ফাঁকি দিতে পেরেছে, এতে তো কোন সন্দেহ নেই?

কায়রোতে যখন এ নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলছিল ততোক্ষণে জোহরা হাবিবুল কুদ্দুসের কাছে পৌছে গেছে। তার চোখের পট্টি যখন খোলা হলো তখন সে দেখতে পেলো তার স্বামী হাবিবুল কুদ্দুস তার সামনে দাড়িয়ে আছে।

সেদিন সারা রাত এবং পরের দিনও অর্ধদিবস তাদের রাস্তায় কাটাতে হয়েছে। রাস্তায় শুধু আহারাদির সময় তার চোখ খুলে দেয়া হতো। তার সঙ্গে আসা দু’জন পুরো পথে তার সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করেনি, অপ্রয়োজনীয় কথাও বলেনি। বরং তাকে আরো শান্তনা দিয়ে বলেছে, ‘আপনি ভয় পাবেন না। আপনার হেফাজতের জিম্মা আমাদের।’

হাবিবুল কুদ্দুসকে দেখতে পেয়ে তার দেহে প্রাণ ফিরে এলো। খৃষ্টান লোকটিও হাবিবুল কুদ্দুসের পাশেই দাড়িয়ে ছিল। তাই নিজের আবেগকে সংযত করে সে কোন মতে বললো, ‘আপনি কেমন আছেন?’

হাবিবুল কুদ্দুস হেসে জোহরার একটি হাত ধরে বললেন, ‘এরা আমার বন্ধু! এখানে তুমি নিজেকে বন্দী মনে করবে না। তুমি খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছো। এখন খাওয়া দাওয়া করো। রাতে আরাম করে একটা ঘুম দাও, দেখবে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। কাল সকালে তোমাকে আমি বলবো, কেন তোমাকে এখানে ডেকে এনেছি।’

’কোন বিপদ!’ জোহরার শঙ্কিত প্রশ্ন।

’আরে না। তুমি সব সময় বলতে, তুমি পুরুষের মত খোলা ময়দানে যুদ্ধ করতে চাও। আমার এই বন্ধুরা তোমাকে সে রকম একটা সুবর্ণ ‍সুযোগ ‍দিতে চাচ্ছে। সবই জানতে পারবে। এত উতলা হওয়ার কিছু নেই। যাও, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও।’

মেয়ে দুটি তাকে পথ দেখিয়ে খাওয়ার রুমে নিয়ে গেল।

জোহরা বধু হলেও এখনও পূর্ণ যুবতী। তার রূপ ও সৌন্দর্য তে রয়েছে বিশেষ আকর্ষণ। একহারা দেহের গড়ন। স্বভাবে বন্য হরিণীর চঞ্চলতা ও ক্ষিপ্রতা সহজেই অন্যের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। সন্ধ্যার একটু আগে হাবিবুল কুদ্দুসের কামড়ায় এলো সেই মেয়েরা, যাদেরকে হাবিবুল কুদ্দুস জলাশয়ে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় গোসল করতে দেখেছিলেন। তারা তাঁর কামরায় এসে নির্বিবাদে জোহরাকে বান্ধবীর মত টেনে বাইরে নিয়ে গেল।

এই বিরান ধ্বংশপ্রাপ্ত মহলটা ছিল দেখতে ভয়ংকর স্থান। কিন্তু মেয়ে দুটো এখানেই থাকতো। তারা যে কেবল কামরা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতো তাই নয়, পুরুষদের মনোরঞ্জনের ‍দিকেও খেয়াল রাখতো তারা।

জোহরা যে কামরায় ছিল সেখানে ধ্বংসাবশেষের কোন চিহ্নই ছিল না। উচ্চবিওের বিলাসী সামগ্রী দিয়ে ঘরটা রুচিস্নিগ্ধভাবে এ মেয়েরাই সাজিয়ে দিয়েছিল।

জোহরাকে কামরা থেকে বের করে নেয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই সে ওদের সাথে একেবারে মিশে গেল। তাদের মধ্য থেকে এক মেয়ে জোহরাকে বললো, ‘তোমার মত এমন ফুলের কলিকে তোমার মা বাবা কেমন করে এই বুড়ো লোকের হাতে তুলে ‍দিল। তারা কি খুবই নিষ্ঠুর? নাকি তিনি তোমাকে খরিদ করে এনেছেন?’

’হ্যা’ জোহরা রাগান্বিত কন্ঠে বললো, ‘তিনি আমাকে খরিদ করেছেন। সেনাপতি মানুষ তো, ক্ষমতা ও সম্পদের অভাব নেই। সেই ক্ষমতাবলে আমাকে তার হেরেমে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আমার তো আর সেই শক্তি নেই যে, পালিয়ে যাবো।’

’যদি কোথাও আশ্রয় পাও তবে পালিয়ে যাবে?’ প্রশ্ন করলো মেয়েটি।

’যদি সে আশ্রয় বর্তমান জীবনের চেয়ে উন্নত হয় তবে পালাবো না কেন, অবশ্যই পালিয়ে যাবো।’ জোহরা বললো, ’তিনি আমাকে এখানে কেন ডেকেছেন? তিনি কি আমাকে এখানে বিক্রি করে দেবেন? তোমরা কারা? তোমরা এখানে কেন? তোমাদেরও কি কেউ এখানে বিক্রি করে ‍দিয়ে গেছে?’

’হ্যা, আমাদেরকেও এখানে বিক্রি করা হয়েছে। তবে তাতে আমরা অখুশি নই। বরং এতে আমাদের জীবন ধন্য হয়ে গেছে। যদি তুমি চাও তোমাকেও আমাদের সাথে নিতে পারি। আমরা এখানে রাজকুমারীর মত আছি। এত সুখে আছি যা জীবনে কোনদিন কল্পনাও করিনি।’

ওরা হাঁটতে হাঁটতে ঝর্ণার কাছে চলে এসেছিল। এক মেয়ে তাকে বললো, ‘আমরা কারা সে পরিচয় তুমি অবশ্যই পাবে। তবে তার আগে দেখতে হবে তুমি আমাদের সাথে থাকার যোগ্য কিনা?’

তোমাদের সাথে থাকতে গেলে কি যোগ্যতার দরকার?’

’তুমি আমাদের সাথে ওই ঝর্ণার পাশে গিয়ে কাপড় চোপর খুলে রেখে এ জলাশয়ে গোসল করতে পারবে?’

’ওই পশুটার কাছ থেকে যদি আমাকে মুক্ত করতে পারো তবে তোমরা যা বলবে তাই করতে পারবো।’ জোহরা বললো।

এ সময় এক লোক সেখানে হাজির হয়ে জোহরাকে বললো, কামরায় বিকালের নাস্তা দেয়া হয়েছে। সেনাপতি আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।’

জোহরা চলে গেল স্বামীর কাছে। হাবিবুল কুদ্দুসের সাথে যে খৃষ্টান কথা বলছিল সে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। হাটঁতে হাটঁতে সে চলে এলো মেয়েদের কাছে।

মেয়েরা তাকে দেখে খুশীতে হাততালি দিল। উচ্ছল আনন্দে কলকলিয়ে বললো, ‘কেল্লা ফতে সরদার। এ মেয়েটা আমাদের ভালই কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছে। সে তার বুড়ো স্বামীকে ভীষণ ঘৃণা করে।

তুমি আদেশ ‍দিলে তাকে আমরা আমাদের মত করে গড়ে তুলতে পারি। তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো মেয়েটি অসম্ভব রূপসী। তার মধ্যে চঞ্চলতা ও দুষ্টুমী ভাবও আছে। তাকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ‍দিতে পারলে তীরের মতই লক্ষ্য ভেদ করতে পারবে সে।’

’কিন্তু হাবিবুল কুদ্দুস তো বলেছে, এই স্ত্রীর উপর তার পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস আছে এবং এ মেয়ে তার যোগাযোগ রক্ষার কাজ ঠিক মতই করতে পারবে।’ খৃষ্টানটি বললো, ‘কিন্তু যদি তোমাদের কথা সত্যি হয় ধোঁকা দিতে পারে এবং আমাদের সবাইকে ধরিয়ে দিতে পারে।’

’তার ঘৃণার কারণটা তুমি বুঝবে না। ‍এটা তার বয়সের দোষ। একজন যুবতী মেয়ে কখনোই একজন বুড়োকে ভালবাসতে পারে না। সেনাপতির বউ বলে প্রকাশ্যে গর্ব করলেও অন্তরের দহন তাতে চাপা পড়ে না। হাবিবুল কুদ্দুসের চাইতেও সহজে আমরা এই মেয়েকে আমাদের দলে টেনে নিতে পারবো।’

’এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই। খাচায় বন্দী পাখি এক সময় পোষ মানবেই, ও নিয়ে আমি ভাবি না। আমাদের টার্গেট মেয়েটা নয়, হাবিবুল কুদ্দুস। আসল সুখবরটা তাহলে আমার কাছ থেকে শোন।

এ লোক আমাদের জালে পড়ে গেছে। সে আমাকে মিশরী এবং দেশপ্রেমিক মুসলমান বলে বিশ্বাস করেছে। সে আমাদের পরিকল্পনা মত কাজ করতেও রাজী হয়েছে।’

’আর মেয়েটির ব্যাপারে তোমার কি ফয়সালা?’

’যদি মেয়েটি হাবিবুল কুদ্দুসকে ধোঁকা ‍দিতে রাজি থাকে তবে তাকে আমি অন্যভাবে কাজে লাগাবো। আগে মেয়েটিকে যাচাই করে দেখি। তুমি রাতে কিছুক্ষনের জন্য তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। তারপর মেয়েটিকে আমার কামরায় রেখে কোন বাহানায় বাইরে চলে যাবে।’

বৈকালিক নাস্তা শেষ হওয়ার পর মেয়েরা গিয়ে পুনরায় তাকে নিয়ে এলো। তারা হাসতে খেলতে ও গল্প গুজব করতে লাগলো জোহরাকে সঙ্গে নিয়ে। জোহরাকে তারা আগের চেয়ে খোলামেলা বেপর্দা করে ফেললো। রাতে খাওয়ার পর আবার তারা গল্পগুজবে মেতে উঠলো। মেয়েরা তাকে নিয়ে এলো নিজেদের কামরায়। এক মেয়ে গিয়ে খৃষ্টান লোকটিকে খবর ‍দিল, ‘মেয়েটাকে আমাদের কামরায় নিয়ে এসেছি। আপনি ওখানেই তার সাথে দেখা করুন।’

খৃষ্টান লোকটি সেখানে গেল। সে জোহরার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। মেয়েরা এক ফাঁকে তাদের একা রেখে বাইরে চলে গেল।

খৃষ্টান লোকটি তার সঙ্গে গল্প করছিল আর তাকে গভীরভাবে লক্ষ্য করছিল। এক সময় সে তার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো এবং তার বাহু ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করলো।

জোহরা তার বাহু থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বললো, ‘আমি এত সাধারণ ও সস্তা মেয়ে নই যে, সামান্য ইশারাতেই আপনার কোলে গিয়ে পড়বো।’

খৃষ্টান লোকটি জোহরার এমন স্পষ্ট কথায় বেজার না হয়ে বরং বেশ খুশিই হলো। বুঝলো, মেয়েটির মধ্যে ব্যক্তিত্ব আছে। এমন মেয়েই দরকার যে সহজে কারো হাতের খেলনা হয় না। লোকটি জোহরার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তার সাহস ও বুদ্ধিমওা দেখে চমৎকৃত হলো। গোয়েন্দাগীরিতে এমন মেয়েদেরই প্রয়োজন। সে মেয়েদের সাথে একমত হলো, এমন মেয়েকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিলে সে তীরের মতই নিশানা ভেদ করতে সমর্থ হবে।

লোকটি আলাপ করে বুঝলো, স্বামীর প্রতি এ মেয়ের যথার্থই ঘৃণা আছে। তবে নিরূপায় বলেই সে মুখ ফুটে বা আচরণের মাধ্যমে তার অবজ্ঞার কথা প্রকাশ করে না। আর তাই হাবিবুল কুদ্দুস মনে করেন, এ মেয়ে তার জন্য পাগলপারা।

লোকটি জোহরাকে বললো, ‘তুমি তোমার মনের ভাব এখনি ওর কাছে প্রকাশ করতে যেও না। আমি ওর থেকে তোমাকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করবো। তোমাকে এমন জীবন দান করবো যাতে তুমি রাজকুমারীর মত জীবন যাপন করতে পারো। তুমি এখানেই বসো, আমি তোমার বান্ধবীদের তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

সে কামরা থেকে বের হয়ে গেল। মেয়েদের কাছে গিয়ে বললো, ‘তোমরা ঠিকই বলেছো। মেয়েটি আসলেই চালাক চতুর ও কাজের মেয়ে। তাকে তোমরা পাশে পাশে রেখে গড়ে তোলার চেষ্টা করো।’

সে আরো বললো, ‘হাবিবুল কুদ্দুস তাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। এই মেয়েকে ‍দিয়েই আমি হাবিবুল কুদ্দুসকে বশে রাখবো এবং আমার কাজ আদায় করে নিবো।

মেয়েটিকে তোমরা বুঝাও, সে যেন হাবিবুল কুদ্দুসকে উন্মাদিনীর মত ভালবাসার অভিনয় করে যায়। তাহলে তিনি তাঁর বিশ্বাসী কমান্ডারদের সাথে এই মেয়ের মাধ্যমেই যোগাযোগ করিয়ে দেবেন আমাদের।

তোমাদের কাজ হলো এই মেয়েকে জালে আটকে রাখা। তাকে জীবনের এমন রঙিন স্বপ্ন দেখাবে যাতে সে মনে মনে রাজকুমারী বনে যায়। আর কিভাবে তাকে এ কাজের জন্য প্রস্তুত করতে হবে তা তো তোমাদের ভালো করেই জানা আছে।’

জোহরা অন্তর থেকেই স্বামীকে ভালবাসতো। এখানে এসে তার সে ভালবাসা বহুগুন বেড়ে গেল। খৃষ্টান মেয়েরা ভাবলো, জোহরা তাদের নির্দেশে হাবিবুল কুদ্দুসের সাথে প্রেমের অভিনয় ভালই করছে।

জোহরা সুযোগ পেলেই মেয়েদেরকে বুঝাতে চাইতো, এই বুড়ো স্বামীকে সে কোন কালেই ভালবাসেনি। তাদের অনুরোধে ভালবাসার অভিনয় করলেও এখন সে তার স্বামীকে আগের চাইতেও বেশী ঘৃণা করে।

মেয়েরা তাকে তাদের কাছে রাখে। একান্ত অন্তরঙ্গ বান্ধবীর মতই তাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যায়। তাকে নিয়ে ঝর্ণার জলাশয়ে সাতাঁর কাটে মনের আনন্দে।

প্রথম দিকে গোসলের সময় বিবস্ত্র হতে ইতস্তত করতো জোহরা। মেয়েরা তাকে বুঝালো, ’এতে কোন অপরাধ নেই। জীবনকে উপভোগ করতে শেখো। এমন লাজুক হয়ে থাকলে তুমিতো ভীতুর ডিম হয়ে যাবে। আর যারা ভীতু তারা জীবনে কিছুই অর্জন করতে পারে না।’

খুব দ্রুত জোহরা সাহসী হয়ে উঠলো। সে ওদের মত বিবস্ত্র হয়ে পানিতে ঝাঁপ দিতে শিখলো। ওদের মত স্বল্প বসনে পুরুষদের সাথে মেলামেশা করতে শিখলো। শেষে এ সব বিষয় তার দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেলো।

রাতটি সে স্বামী হাবিবুল কুদ্দুসের সাথেই কাটায়। কিন্তু দিনের অধিকাংশ সময় তার কাটে মেয়ে দুটির সাথে। মাঝে মাঝে খৃষ্টান লোকটির সঙ্গেও বন্ধুর মত গল্প করে।

জোহরা চার পাঁচ দিনের মধ্যেই মেয়ে দুটির মত অসভ্য হয়ে গেল। তার দুষ্টামী ও নির্লজ্জতা দেখে মেয়েরা এবার তার সামনে মেলে ধরতে শুরু করলো তাদের রহস্যময় জীবনের কথা।

ইতিমধ্যে খৃষ্টান লোকটি হাবিবুল কুদ্দুসের সাথে বসে বিদ্রোহের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেললো। হাবিবুল কুদ্দুসও এ পরিকল্পনা গ্রহণে তাকে অনেক তথ্য দিয়ে সাহায্য করলো। যে সব তথ্য জানা না থাকলে তাদের পরিকল্পনা সফল হতো না বলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো খৃষ্টান লোকটি।

হাবিবুল কুদ্দুসের প্রতি এখন এ লোকের পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস জন্মে গেল। হাবিবুল কুদ্দুস মিশরের সেনাদলের কয়েকজন বড় বড় সামরিক অফিসারের নাম বললো যারা সালাউদ্দিন আইয়ুবীর সেনাদলে থাকলেও তারা মূলত আইয়ুবী বিরোধী। তারা মনে করতো, আইয়ুবীর মতই একটি বিশাল বাহিনী পরিচালনা করার মত ক্ষমতা ও দক্ষতা তাদের আছে, কিন্তু আইয়ুবীর বর্তমানে তাদের সে দক্ষতা প্রদর্শনের কোন সুযোগ নেই।

খৃষ্টান লোকটি হাবিবুল কুদ্দুসকে সব সময় বলতে লাগলো, ’একজন দেশপ্রেমিক মিশরীয় মুসলমান বলেই আইয়ুবীর বিরুদ্ধে আমার অবস্থান। আইয়ুবীর মতাদর্শের সাথে আমার কোন সংঘাত নেই। মিশরকে স্বাধীন করতে পারলে আমাদের জাতীয় ঐক্যের ভিত হবে ইসলাম। তখন যদি আইয়ুবী চান, আমরা স্বাধীন দেশের সেনা পাঠিয়ে তাকে ফিলিস্তিন উদ্ধারেও সহায়তা করতে পারি।’

সে যে একজন খৃষ্টান ষড়যন্ত্রকারী সে কথা সে বেমালুম চেপে গেল। কারন সে ভেবে দেখলো, হাবিবুল কুদ্দুসকে এ পথেই ব্যবহার করা অধিক সহজ।

জোহরা ততদিনে মেয়েদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে। বলতে গেলে এখন সে তাদেরই একজন হয়ে উঠেছে। তার কথাবার্তা বা চলন বলন দেখে ওদের থেকে আলাদা করা অসম্ভব। সে যে কোন ভদ্র ঘরের সন্তান এবং একজন সেনাপতির বেগম এ কথা তাকে দেখে বুঝার কোন উপায় নেই। অথচ হাবিবুল কুদ্দুস তাকেই তার সবচেয়ে অনুগত ও বিশ্বস্ত বেগম মনে করতেন।

জোহরা তখনো জানতো না এই বিজন পাহাড় ও ধ্বংসাবশেষটি কোথায় অবস্থিত। একদিন সে কথায় কথায় মেয়েদের জিজ্ঞেস করলো, ‘এই বিরান ধ্বংসস্তুপ ও পাহাড় ঘেরা ক্ষুদ্র পরিবেশ ছাড়া কি আর কোন দুনিয়া নেই? খোলামেলা প্রান্তর, মরুদ্যান বা কোন শহর?’

মেয়েরা বললো, ‘থাকবে না কেন? দাড়াও, কাল তোমাকে এক সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাব।’

পরদিন সত্যি সত্যি তারা তাকে ওই এলাকা থেকে দূরে এক জায়গায় নিয়ে গেল। পাহাড়ের সংকীর্ণ রাস্তা অতিক্রম করে এক ঝিলের পাশ দিয়ে যখন তারা আরও সামনে এগিয়ে গেল তখন তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো নীলনদের উওাল ঢেউ।

নীলনদ থেকে একটি নালা ভেতরের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, এতোক্ষন তারা সেই নালার পাশ দিয়েই হেটে এসেছে। নীলনদের পানি সেই নালা দিয়ে পাহাড়ে প্রবেশ করেছে। আবার পাহাড়ী ঝর্ণার পানিও সেই নালা দিয়েই নীলনদে এসে পড়েছে। জোহরা দেখতে পেল নালার মুখে একটি নৌকা বাঁধা। নৌকার পাটাতনে পড়ে আছে দুটো বৈঠা। নদী ও নালার সঙ্গমস্থলটা অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top