২১. ধাপ্পাবাজ

লোকটিকে রুখে দাঁড়াতে দেখে নিজের কোমরবন্দ থেকে সোয়া গজ লম্বা তলোয়ারটা টেনে বের করে নিলেন। তলোয়ারটা তার জোব্বার মধ্যে লুকানো ছিল। চোখের পলকে তলোয়ার বের করে বললেন, ‘তোমার দাড়িটা ফেলে দাও।’ আলী বিন সুফিয়ান তার চোয়ালের পাশে তলোয়ারের মাথা ঠিকিয়ে বললেন, ‘আর আমার আগে আগে চলতে থাকো।

সাদা দাড়িওয়ালার চক্ষু স্থির হয়ে গেল।আলী বিন সুফিয়ান তলোয়ারের মাথা তার দাড়ির পাশে ঠেকিয়ে একটু টান দিতেই তার দাড়ি মুখ থেকে খসে পড়ল। নিজের পরিচয় লুকানোর চেষ্টা বৃথা দেখে লোকটি মাথা নত করলো।

আলী বিন সুফিয়ান তাঁর মুখে বিস্ময় ও বিষন্নতা দেখে বললেন, ‘আমার দু’জনেই একে অপরকে ভালমত চিনি। ভনিতা না করে চলো এখন যাওয়া যাক।’

লোকটি শহরের খুব প্রভাবশালী ও উচ্চতর প্রশাসনিক অফিসার ছিল না বটে কিন্তু সে একেবারে অপরিচিত বা নিম্ম শ্রেণীরও কেউ ছিল না। সে মিশরেরই নাগরিক এবং মিশর সরকারের এক মধ্যমগোছের অফিসার ছিল।

তার সম্পর্কে আলী বিন সুফিয়ানের কাছে এ খবর আগেই পৌঁছে ছিল যে, তার গতিবিধি সন্দেহজনক। সম্ভবত সে দুশমনের গোপন চর। কিন্তু প্রমান না থাকায় এতদিন তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যায়নি।

সে খেলাফতের রাজধানী কায়রোতে দীর্ঘদিন যাবত সরকারী কর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত আছে। সুলতান আইয়ুবী ক্ষমতায় আরোহণের সাত আট বছর আগেই সে চাকরীতে যোগদান করে। খলিফা আল আজিদ যখন ফেদাইন দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্রুসেট ও সুদানীদের সঙ্গে জোট গঠন করেছিল তখনই মূলত এ লোক তাদের সঙ্গে হাত মিলায়। এরপর থেকে এতটা বৎসর প্রশাসনের ভিতর ঘাপটি মেরে পড়ে থেকে সে দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে অপতৎপরতায় লিপ্ত ছিল।

সুলতান আইয়ুবী নিরুদ্দিন জঙ্গীর সাথে পরামর্শ করে খেলাফতের অনেক দুশমনকে অপরাসণ করেছিলেন। কিন্তু আব্বাসীয় খেলাফতের অনুসারী এই ধুরন্ধর ব্যক্তিটি নিজের পরিচয় গোপন করে কিভাবে এতদিন টিকেছিল, ভেবে অবাক হলেন আলী বিন সুফিয়ান। আরো অবাক হলে, এতকাল পরও লোকটি গোপন ষড়যন্ত ও চক্রান্তে লিপ্ত আছে দেখে।

রমলার পরাজয় এইসব দেশদ্রোহীদের জন্য এক সোনালী সুযোগ বয়ে নিয়ে এলো। সুলতান আইয়ুবী ও তার বাহিনীকে পাপিষ্ঠ, বিলাসপরায়ণ ও লুটেরা প্রমাণ করতে পারলে দীর্ঘদিন তারা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না ভেবে  আব্বাসীয় খেলাফতের পরাজিত বাহিনী গোপন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল। লোকটি ছিল সেই গোপন তৎপরতার ধুসন্ধর নায়ক।

আলী বিন সুফিয়ান লোকটাকে বন্দী করে সেই গোপন কারাগারে নিক্ষেপ করলেন, যেখানে রাষ্ট্রদ্রোহীদের জন্য বরাদ্দা থাকে সুকঠিন শাস্তি।

আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা রাতের আঁধারে গ্রামের বাইরে হুজুরের বলা সেই মসজিদের সামনে ঠিক সময়েই গিয়ে উপস্থিত হলো। গত রাতের সেই সৈনিক সেখানে তার জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। সে ওখানে পৌঁছতেই সৈনিকটি তার কাছে এসে আগ্রহ ভরে বলল, ‘এসে গেছো তাহলে? তোমার জন্য অনেক্ষণ ধরে বসে আছি। চলো, এখানে আর দেরী করার দরকার নেই।’

আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা গত রাতে দেখা সৈনিকটির নির্দেশ মত চলতে শুরু করলো। গ্রামে এসে সদর দরজা দিয়ে না ঢুকে ওরা পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করল।

বাড়ীতে ঢুকে লোকটি গতকাল তাকে যে কামরায় নিয়ে গিয়েছিল সেখানে না নিয়ে অন্য এক কামরার দিকে পা বাড়াল। আনিস বলল, ‘ওদিকে কোথায়, হুজুর এ কামরায় বসে না।?’

লোকটি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘আস্তে! তোমাকে ঠিক জায়গাতেই নিয়ে যাচ্ছি। ভয় নেই, এখানে আমারা হুজুরের নির্দেশ ছাড়া কিছুই করি না। সে গত রাতের কামরায় যাওয়ার পরিবর্তে লোকটির সাথে অন্য আরেক কামরায় গিয়ে প্রবেশ করলো। এ কামরায় সে অলৌকিক ক্ষমতাধর হুজুরকে কোথাও দেখতে পেল না।

সে কামরার চারদিকে চোখ বুলাল। কামরায় কোন আসবাবপত্র নেই। না কোন চেয়ার-টেবিল, না কোন খাট। এমনকি কামরায় কোন চাটাই বা চাদরও নেই।

গোয়েন্দার সব কটা ইন্দ্রিয় ততক্ষণে সজাগ হয়ে উঠেছে।

চট করে সে চাইল দরজার দিকে। ততক্ষণে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। সে তাকিয়ে দেখলো, তাকে নিয়ে আসা সৈনিকটি কামরার বাইরে চলে গেছে। ঘুরে দ্রুত দু’পা এগিয়ে দরজায় হাত লাগলো, দেখলো দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।

সে বুঝতে পারলো, তার অভিনয় সব বৃথা গেছে, তাকে তারা চিনে ফেলেছে। মুহূর্তে শত্রুর হাতে ধরা পড়ার চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। বুঝতে পারলো, এখণ পালাবার আর কোন সম্ভাবনা নেই। সে সেই ঘরে বসে কি করা যায় একা একা চিন্তা করতে লাগলো।

রাত গভীর থেকে গভীরতর হলো। অন্ধকার কামরার মেঝেতে বসে আছে আনিস। কায়রোর মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছান্ন, কিন্তু তার চোখে কোন ঘুম নেই। সে খতিয়ে দেখছিল, কোথায় সে বোকামী করেছে, কেমন করে তার গোপন পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেল? কিন্তু ঠিক বুঝতে পারল না কোথায় সে ভুল করেছে।

নিজেকে বড় অযোগ্য ও অপাদর্থ মনে হচ্ছিল। এর মধ্যেই সে কামরার চারদিক খুঁজে দেখেছে, পালাবার কোন পথ বা ফাঁকফোঁকড় আছে কিনা? কিন্তু না, হতাশ হতে হলো তাকে।

মধ্য রাত। অন্ধকারে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে আনিস। হঠাৎ তার মনে হলো, কেউ একজন দরজা খোলার চেষ্টা করছে। উৎকর্ণ হলো সে, কে খুলতে পারে দরজা! যদি শত্রুই খুলবে তবে এত সতর্কতার দরকার কি? আর মিত্রই বা আসবে কোত্থেকে? মিত্রদের কেউ তো এখনো জানেই না, সে এখানে বন্দী হয়ে আছে। এক অনিশ্চিত শংকা নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল আনিস।

আনিস দরজার দিকে পা বাড়াতে যাবে এ সময় খট করে খুলে গেল দরজা। সে দরজার দিকে তাকিয়ে যা দেখলো তা ছিল অবিশ্বাস্য, এক অনিন্দ্যসুন্দর মেয়ে দরজার আলো করে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে প্রদীপ।

এ ছিল সেই দুই মেয়ের একজন, যারা হুজুরের কন্যা পরিচয়ে রমলা থেকে এসেছে। মেয়ের পরণে এখন আর বোরখা ছিল না, তবে ইউরোপীয় মেয়েদের মত উলংগও ছিল না। তার পরণে ছিল মুসলমান, মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী আরবী পোষাক।

মেয়েটি কামরার ভিতর ঢুকতেই কেউ একজন বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে শিকল এঁটে দিল।

মেয়েটির হাতের আলোয় কামরাটি আলোকিত হয়ে উঠলো। গোয়েন্দার দিকে তাকালো মেয়েটি, তার চোখ মুখে মধুর হাসি। আনিস সেই হাসিমাখা মুখের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইল।

‘আমাকে চিনতে চেষ্টা করছো তো?’ মেয়েটি বললো, ‘এত তাড়াতাড়িই ভুলে গেছো সব?’

আনিস স্মৃতি হাতড়ে মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছিল। মেয়েটি তাকে সাহায্য করার জন্য বললো, ‘যখন তুমি আমার শহর থেকে পালিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলে তখন ভাবতে পারিনি তোমাকে আর কখনো হাতের নাগালে পাবো। কিন্তু দুর্ভাগ্য তোমার, নিজের শহরে এসে আজ আবার বন্দী হয়ে গেলে। এবার আর পালিয়ে যাওয়ার কোন মওকা তুমি পাবে না।’

আনিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার দীর্ঘশ্বাসে যেমন প্রশান্তি ছিল তেমনই ছিল অস্থিরতা। তার স্মৃতিপটে তিন বছর আগের একটি দিনের কথা মনে পড়ে গেল। গোয়েন্দাগীরির জন্য তাকে আক্রা পাঠিয়েছিলেন আলী।

আক্রা তখন খৃষ্টানদের দখলে। সেখানে তাদের এক বড় পাদরী থাকতো। তাকে সবাই ডাকতো গ্রেট ফাদার বলে। আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রুসেড রাজারা যেসব বাহিনী পাঠাতো, অভিযানের আগে তার সেনাপতিরা অবশ্যই একবার আক্রা আসতো সেই গ্রেট ফাদারকে অভিবাদন করে দোয়া নিতে। কারণ সামিক দিক থেকে স্থানটি ছিল খুবই গ্রুরুত্বপূর্ণ। আর এই ফাদারের কাছে এমন সব গোপন তথ্য থাকতো, যা অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণে অপরিহার্য বিবেচিত হতো।

এ ব্যাপারটি আলী বিন সুফিয়ানের নজরে এলে তিনি সেখানে নিজস্ব গোয়েন্দা পাঠানোর জরুরী মনে করলেন। তখন সেখানে যে বাহিনী পাঠানো হয় আনিস ছিল সেই দলের একজন।

ওরা সেখানে ছিল খৃষ্টান ছদ্মবেশে। সেখানে ওরা এক গোপন আড্ডা বানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু গোয়েন্দাগীরি হচ্ছে এক মরনঘাতি খেলা। পদে পদে বিপদ, পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি। মুহূর্তে আমূল পাল্টে যায় ঘটনার দৃশ্যপট।

তাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, হঠাৎ একদিন তাদের মধ্য থেকে তিন চারজন ধরা পড়ে যায়। মোকাবেলা করতে গিয়ে দুইজন শহীদ হয়। কিন্তু সৌভ্যাক্রমে আনিস বেঁচে যায়। দুশমনের দুর্ভেদ্য জাল কেটে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয় সে। তারপর সেখান থেকে পালিয়ে সোজা এসে রিপোর্ট করে কায়রো।

আনিসের গায়ের বর্ণ ফর্সা। দেহের গঠন এবং আকৃতিও ছিল খুবই নিঁখুত ও আকর্ষণীয়। সুন্দর মুখের জয় সবর্ত্র প্রদাবটি যদি সত্যি হয় তাহলে তার জীবনের সাফল্যের জন্য তার চেহারাটিই যথেষ্ট। কিন্তু এ বিষয়টি সম্পর্কে কখনোই তাকে সজাগ বলে মনে হয়নি। সে তার সাফল্যের জন্য বুদ্ধি ও মেধাকেই অধীক গুরুত্বপূর্ণ মনে করতো।

আলী বিন সুফিয়ান তাকে খুব বিচক্ষণ ও সতর্ক গোয়েন্দা মনে করতেন। অশ্বারোহী হিসেবে সে যেমন পটু ছিল তেমনি চৌকস ছিল তলোয়ার ও নেজাবাজিতে। সামরিক মহড়ায় সে দর্শকদের অভিভূত করে কুড়িয়ে নিত হাততালী।  এমনকি অভিনয়েও তার দক্ষতা ছিল সকলের ঈর্ষার বস্তু।

হুজের সামনে সে গতকাল যখন কাঁদছিল, হুজুরও ভাবতে পারেননি, এটা বাস্তব নয়, অভিনয়। এতটা স্বাভাবিক ও আন্তরিক ছিল তার অভিনয়।

আক্রাতে এক খৃষ্টান নামে পরিচিত ছিল আনিস। সেখানে সে এক বেদনাময় জীবনের কাহিনী ফেঁদে মানুষের সহানুভূতি কুড়িয়েছিল। সে বলেছিল, ‘হলবে মুসলমান সৈন্যদের অশ্বারোহণ ও যুদ্ধের ট্রেনিং দেখে আমারও সৈনিক হওয়ার ইচ্ছে জাগে। আমি ঘোড়দৌড়ের বাহিনীতে ভর্তি হয়ে ঘোড়সওয়ারী শেখার সাথে গোপনে অস্ত্রের ট্রেনিং নেয়া শুরু করেছিলাম।

মুসলমানরা কেমন করে যেন এ খবর পেয়ে যায়। এক রাতে একদল ডাকাত আমাদের বাড়ীতে হামলা চালায়। তারা আমার পিতা-মাতাকে হত্যা করে এবং আমার দুই যুবতী বোনকে তুলে নিয়ে যায়। আমার ওপর হামলা হতে পারে এই আশংকায় এর কয়েক আগের রাত থেকেই আমি সাবধান হয়ে গিয়েছিলাম। রাতে আমি বাড়ীতে থাকতাম না, থাকতাম এক বন্ধুর বাড়ী। সে রাতে আমি বাড়ী ছিলাম না বলে প্রাণে বেঁচে যাই।

এ হামলায়র পর হলবে আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব ছিল না। আমি পরের দিন এক গোপন জায়গায় লুকিয়ে থেকে রাতের অন্ধকারে হলব থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসি। আসার সময় আমি আমার পৈত্রিক সম্পত্তির কিছুই আনতে পারিনি। সব হলবে ফেলে রেখে কেবল আমার প্রিয় ঘোড়াটি সঙ্গে নিয়ে হলব ত্যাগ করি। অনেক কষ্টে, অনাহারে অর্ধাহারে ভুগতে ভুগতে অবশেষে আমি এই আক্রাতে এসে পৌঁছতে সক্ষম হই।’

তার সুন্দর চেহারা আর মায়াময় চাহনি দেখে সবাই তার কথা বিশ্বাস করে নেয়। গ্রেট ফাদার তার সৈনিক হওয়ার আগ্রহ দেখে তাকে গির্জায় না রেখে স্থানীয় সেনা ছাউনিতে পাঠিয়ে দেন। সেখানে সে অল্প সময়েই নিজেকে একজন ভাল অশ্বারোহী ও যোদ্ধায় পরিণত করতে সক্ষম হয়। সেনা অফিসার তার বুদ্ধি ও দক্ষতা দেখে তাকে অল্পদিন পরেই সেখানকার একজন প্রশিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেন। সেই থেকে সে আক্রার সেনা ক্যাম্পে একজন শিক্ষক হিসেবে কাজ করছিল।

নিয়মিত সৈনকিদের ট্রেনিং দেয়ার কাজ ক্যাম্পের পুরাতন ও নিয়মিত প্রশিক্ষকদের হাতেই ছিল। সে ট্রিং দিত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীতে ভর্তি হতে ইচ্ছুক যুবক-যুবতীদের।

এখানে যারা ট্রেনিং নিতে আসতো তাদের অধিকাংশই ছিল সুন্দরী ও যুবতী মেয়ে। বড় বড় সামরিক অফিসারদের সন্তানরাও ট্রনিং নিতে আসতো। সে জানতে পারল, এ সব মেয়েদের ট্রেনিং দিয়ে মুসলমান এলাকায় গোয়েন্দাগীরি করতে পাঠানো হয়। পরে যেসব পুরুষরা তার কাছে ট্রেনিং নিতে এসেছিল, আনিস খোঁজ নিয়ে জেনেছে, এরা সবাই ছিল খৃষ্টান গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য। সে ওদের সাথে এমনভাবে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের নিকট থেকে দামী দামী তথ্য ও রিপোর্ট সে অনায়াসেই সংগ্রহ করে নিতে পারতো।

যে মেয়েটি এখন কায়রোর শহরতলীর এক গ্রামের গোপন কামরায় বসে তাকে বলছে ‘এবার আর পালিয়ে যাওয়ার কোন মওকা তুমি পাবে না’ সে একদিন আক্রাতে তারই শাগরেদ ছিল। মেয়েটি গোয়েন্দাগীরিতে দক্ষ হলেও অশ্ব চালনা জানতো না। তাকে অশ্বারোহনের ট্রনিং দেয়ার ভার পড়েছিল মার্করূপী আনিসের হাতে।

সুদর্শন মার্ককে প্রথম দেখাতেই ভাল লেগে গিয়েছিল মাইসার। ট্রেনিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে ওদের মধ্যে চলতে লাগলো মন দেয়া-নেয়ার খেলা। এভাবেই উস্তাদ শাগরেদের সম্পর্ক চুকিয়ে ওরা ঘনিষ্ঠ বুন্ধুতে পরিণত হলো। তারপর সেই বুন্ধুত্ব গিয়ে ঠেকলো প্রেমিক-প্রেমিকাতে।

মেয়েটির ভালবাসায় কোন খাঁদ ছিল না। তাই মেয়েটি সিদ্ধান্ত নিল, গোয়েন্দাগীরি পেশা ত্যাগ করে সে মার্কের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার জীবন যাপন করবে।

কিন্তু মার্ক মেয়েটির সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল নিছক দায়িত্বের কারণে। মেয়েটির সাথে তার সম্পর্ক যত মধুর হবে ততই তথ্য সংগ্রহের সুবিধা হবে ভেবে সে মেয়েটির সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।

ওরা দু’জনই ভালবাসার জোয়ারে ভেসেছিল ঠিক, কিন্তু মাইসার মত মার্ক ভালবাসার টানে তার আসল দায়িত্বের বিষয়টি ভুলে যায়নি। মেয়েটির গোয়েন্দাগীরিতে মন ছিল না, তার মন তখন মার্ককে নিয়ে ভালবাসার প্রসাদ নির্মাণে ব্যস্ত।

একদিন আক্রাতে দুই মুসলমান গোয়েন্দা ধরা পড়ে গেল। তাদের একজন কঠিন শাস্তির মুখে তার দলের সমস্ত লোকজনের নাম ঠিকানা বলে দিল। যাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল তাদের মধ্যে ছিল গোয়েন্দা মার্কও। স্বাভাবিক ভাবেই সে মুসলিম গোয়েন্দা, একথা জেনে গেল খৃষ্টানরা।

খৃষ্টানরা মার্কের পেছনে টিকটিকি লেলিয়ে দিল। তারা মার্কের প্রতিটি গতিবিধির ওপর কড়া দৃষ্টি রাখা শুরু করলো। একজন গোয়েন্দা হিসাবে খবরটি জেনে গেল মাইসাও। সে একদিন আশ্চর্য হয়ে মার্ককে জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা, তুমিতো আর গোয়েন্দা নও, আর মুসলনামও নও? কিন্তু আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা তোমাকে সন্দেহ করছে কেন? তুমি কি জানো তোমার উপর আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ কড়া দৃষ্টি রাখছে?

আনিসের জন্য এ ছিল এক অতি মূল্যবান খবর। মাইসার কাছ থেকে এ খবরটি সময় মত না পেলে তার জীবন প্রদীপ হয়তো সেখানেই নিঃশেষ হয়ে যোতো। প্রশ্ন শুনে মার্ক হেসে বলেছিল, ‘আমাকে সন্দেহ করছে শুনে খুশী হলাম। এতে প্রমাণ হলো, আমাদের গোয়েন্দারা যথেষ্ট তৎপর। এভাবে প্রতিটি লোককেই মাঝেমধ্যে যাচাই বাছাই করা দরকার। যখন সন্দেহ দূর হবে তখন আপনাতেই দৃষ্টি সরিয়ে নেবে।’

মুখে এ কথা বললেও ভেতরে ভেতরে সে খুব অস্থিরতা বোধ করছিল। রাতে সে এমন একজনের সাথে দেখা করল, আক্রার সাধারণ মুসলমান গোয়েন্দারা যার সম্পর্কে কিছুই জানতো না। কেবল কমাণ্ডাররা জানতো, বিপদে পড়লে তার সাহায্য নেয়া যেতে পারে।

সে লোক আনিসকে দেখেই বললো, ‘আমি তোমার সাথে দেখা করবো ভাবছিলাম। তোমার দলের অনেক সদস্যের নাম পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেছে। সেই তালিকায় তোমার নামও আছে। তোমার জন্য আর এক মুহূর্তও আক্রা থাকা নিরাপদ নয়। তোমাকে এখনি এখান থেকে পালাতে হবে। আমার পরামর্শ হচ্ছে, এখান থেকে বেরিয়ে তুমি আর তোমার আস্তানায় ফিরবে না, সোজা কায়রোর পথ ধরবে।’

এ লোকের পরামর্শই হুকুম। আনিস সেখানে আর দেরী না করে তাকে সালাম জানিয়ে বেরিয়ে এলো।

কামরা থেকে বেরিয়ে পথে নেমেই আনিস টের পেলো, দুটি লোক তাকে অনুসরণ করছে। সে অনুসরণকারীদের খসানোর জন্য আক্রার বিভিন্ন পথে হাঁটলো, নানা রকম চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।

অবশেষে সে এক ঘোড়ার আস্তাবলের কাছে এসে থেমে গেল। যে লোক দু’জন তাকে অনুসরণ করছিল এবার তারা এগিয়ে এলো তার কাছে। আনিস আস্তবলে ঢুকে দ্রুত হাতে একটা ঘোড়ার মুখে লাগাম পরিয়ে বাইরে নিয়ে এলো। আস্তাবল থেকে বেরিয়েই সে ওদের সামনে পড়ে গেল। লোক দু’জন তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় যাচ্ছো?’

এ প্রশ্নের যে জবাবই দেয়া হোক না কেন, লোক দু’জন তাতে সন্তুষ্ট হবে না, জানে আনিস। তার বুদ্ধি তাকে বললো, ‘এখন আর কোন কথা নয়, জলদি পালাও।’

সে লাফিয়ে ঘোড়ার উপর উঠে সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। এক লোক তাকে বাঁধা দিতে গেল, সঙ্গে সঙ্গে সে ঘোড়ার পায়ের তলে পিষে গেল। আনিস প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে আক্রা থেকে বের হয়ে এলো।

‘মাইসা, আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি।’ সে মেয়েটিকে বললো। তিন বছর পর তারা দু’জন একে অপরকে দেখছে। ‘আমি তোমাকে এখানে এই অবস্থায় দেখে মোটেই বিস্মিত নই। কারণ আমি জানি তুমি এখন পরিপূর্ণ এক গোয়েন্দা।’

‘তিন বছর আগে তোমার ফাঁদে পড়ে আমি গোয়েন্দাগীরি ত্যাগ করতে চেয়েছিলাম। গোয়েন্দাগীরি ছেড়ে আমি তোমাকে নিয়ে ঘরও বাঁধতে চেয়েছিলাম।’ তখন তুমি যদি বলতে, তুমি মুসলমান এবং গোয়েন্দা, তবুও তোমার সঙ্গে আমি প্রতারণ করতাম না। বরং তোমার সঙ্গে বিনা দ্বিধায় পালিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিলাম। তুমি পালিয়ে যাওয়ার পর যখন জানতে পারলাম, তুমি মুসলমান এবং গোয়েন্দা ছিলে তখনও তোমার প্রতি আমার কোন ঘৃণা জন্মায়নি। কিন্তু তোমাকে হারিয়ে আমি ভীষণ ব্যথা পেয়েছিলাম। আমার ভালবাসাকে অপমান করেছো বলে কষ্ট পেয়েছিলাম।’

‘কেন, এখন কি তোমার মনে আমার জন্য কোন ভালবাসা নেই।?’ আনিস বললো, ‘এখন তো তুমি আমার দেশেই আছো। এখানে যেমন আমার জীবনের নিরাপত্তা আছে, তেমনি তুমি চাইলে তোমার নিরাপত্তা দেয়ার সামর্থও আজ আমার আছে। তুমি জানো, সেদিন পালিয়ে আসা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। মৃত্যু আমাকে এমনভাবে তাড়া করেছিল যে, তোমার কাছ থেকে বিদায় নেয়ারও কোন উপায় ছিল না। আমি তোমাকে ধোঁকা দেইনি। নিরূপায় হয়ে বিচ্ছেদ মেনে নিয়েছিলাম। তবে আজ যদি তুমি আমার সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারো, কথা দিচ্ছি, আর কখনো ওমন বিচ্ছেদে তোমাকে পড়তে দেবো না।’

‘মন্দ বলোনি। হ্যাঁ, স্বীকার করি তোমার প্রতি ভালবাসা আমার এখনও আছে।’ মেয়েটি বললো, ‘কিন্তু সেই ভালবাসাকে ছাপিয়ে আছে আমার দায়ীত্বের বোঝা। আর এ জন্য তুমিই দায়ী। আমি তো তোমার জন্য গোয়েন্দাগীরি ছেড়েই দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমিই তা হতে দাওনি। তুমি আমার ইচ্ছাকে পদদলিত করে আমাকে এই জঘন্য পেশায় ডুবে থাকতে বাধ্য করেছো।

তুমি আমাকে ত্যাগ করার পর সেখানকার মরুভূমির ওপর দিয়ে অনেক লূ-হাওয়া বয়ে গেছে। আমার অন্তরের প্রেম আর ভালবাসা শুকিয়ে গেছে সেই লূ-হাওয়ায়। আম ট্রেনিং শেষে পরিপূর্ণভাবে মন দিতে বাধ্য হয়েছি গোয়েন্দাগীরিতে। এখন আমি কোন অনাড়ি গোয়েন্দা নই, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এক ঝানু গোয়েন্দা। এই ঝানু গোয়েন্দা হতে গিয়ে নিজের সব সুকুমার বৃত্তিগুলোকে কোরবানী করতে হয়েছে। এমন সব জঘন্য ও অপবিত্র কাজে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে, যার কথা কোনদিন কল্পনাও করনি। আমি এখন আর কোন প্রেম ভিখারী নারী নই, আমি এখন ছলনাময়ী এক নিষ্ঠুর ডাইনী।

তোমাকে নিয়ে যতদিন স্বপ্ন দেখেছি ততদিন তোমার ধর্মের প্রতি আমার কোন আক্রোশ বা ঘৃণা ছিল না। হয়তো তোমার সাথে তাোমার ধর্মকেও ভালবেসে ফেলতে পারতাম। কিন্তু আজ? আজ ইসলামের প্রতি চরম আক্রোশ ও ঘৃণা নিয়ে আমি ছুটে চলেছি তার বিনাশ  সাধনের জন্য। এখন আমি জানি, মুসলমান নিধন করতে পারলেই নিঃশেষ হবে ইসলাম। তোমার প্রতারণা মুসলমাদের প্রতি আমার আক্রোশ ও নিষ্ঠুরতা আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

শোন আনিস, তোমার প্রেমে যখন হাবুডুবু খাচ্ছিলাম তখন তোমার জন্য মরতেও আমার কোন দ্বিধা ছিল না। আর এখন? এখন আমি এমন নিষ্ঠাবান গোয়েন্দা যে, প্রয়োজনে নিজের সকল ভাল লাগা বালবাসাকে নিজ হাতে হত্যা করতেও দ্বিধায় কাঁপবে না আমার হাত।

এখন তুমি আমার এক বন্দী ছাড়া আর কেউ নও। আমি আমার মিশনকে ধোঁকা দিতে পারবো না। আমি যার সঙ্গে এসেছি তিনি জানতেন না তুমি গোয়েন্দা। আমিই তাকে বলে দিয়েছি, তুমি এক গোয়েন্দা। আমি তাকে আক্রার সব কাহিনী বলে দিয়েছি। যদি আমি তোমাকে উঠান দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখে না ফেলতাম তবে আমরা সবাই গ্রেফতার হয়ে যেতমা। অতএব বুঝতেই পারছো, তোমাকে আমিই ধরিয়ে দিয়েছি।’

‘যে পীর সাহেব অদৃশ্যের খবর বলতে পারেন, তিনি মুসলমান না খৃষ্টান?’ গোয়েন্দা আনিস তাকে প্রশ্ন করলো।

‘এখন এ প্রশ্ন করে আর কি হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা তোমার জন্য অবান্তর।’ মেয়েটি বললো।

‘গোয়েন্দাগীরির এটাই তো বড় দোষ। রক্ত মাংসের সাথে একাকার হয়ে মিশে গেে তা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়।’ গোয়েন্দা বললো, ‘মৃত্যুর আগেও জানার আগ্রহ থেকেই যায়। এখন এ সংবাদ বলতে তোমারই বা এত আপত্তি কেন? এখন তো কোন খবর আর আমিবাইরে পাঠাতে পারবো না।’

‘ইনি মুসলমান!’ মেয়েটি বললো, ‘ইনি মুসলমানের দুর্বলতা সম্পর্কে এত কিছু জানেন যে, তাকে আমরা উস্তাদের উস্তাদ বলি!’

কামরার দরজা খুলে গেল। হুজুর এক লোকের সঙ্গে কামরায় প্রবেশ করলো। মেয়েটিকে বললো হুজুর, ‘যদি তোমার কথা শেষ হয়ে থাকে তবে বাইরে যাও।’

মেয়েটি দাঁড়িয়ে আনিসের দিকে কয়েক পলক করুণ নয়নে তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ ঘুরে শ্লথ পায়ে বাইরে চলে গেল।

কালো দাড়িওয়ালা হুজুর  তাকে প্রশ্ন করলো, ‘বুদ্ধিমান যুবক, আমাকে শুধু এটুকুই বলো, আমাদের পরিচয় তুমি কাকে কাকে বলে দিয়োছো। তুমি কি আলী বিন সুফিয়ানকে বলে দিয়েছো, আমি এক সন্দেহজনক লোক?’

‘না সত্যই আমি গোয়েন্দা, কিন্তু এখানে গোয়েন্দাগীরির জন্য আসিনি।’ গোয়েন্দা বলিষ্ঠভাবে উত্তর দিল।

হুজুরের হাতে ছিল চামড়ার চাবুক। আনিসের কথা শেষ হওয়ার আগেই সে চাবুক আঘাত হানল তার পিঠে। একবার নয়, ক্রমাগত কিছুক্ষণ দ্রুত চাবুক চললো যে আনিস ঘটনার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে গেল।

হুজুর হঠাৎই আবার মারপিট থামিয়ে বরলো, ‘আমি শুধু সত্যি কথাটা শুনতে চাই।’

আনিস এ কথার কোন জবাব না দেয়ায় হুজুর আবার চাবুক তুলল। দু’তিনবার চাবুক তুলতেই আকস্মাৎ খুব জোরে শব্দ করে খুলে গেলো দরজার পাল্লা। মেয়েটি দ্রুত ভিতরে ঢুকে বললো, ‘ওকে আর মারবেন না।’ সে হুজুরের দু’টি হাত আকড়ে ধরে অনুনয় করে বললো, ‘ওর কাছ থেকে আপনি যা জানতে চান আমাকে বলুন। আমি ওর কাছ থেকে সব কথা আদায় করে আপাকে বলে দিচ্ছি।’

‘না, আমি কিছুই বলবো না।’ আনিসের কণ্ঠে দৃঢ়তা।

আনিসের কথা শেষ হতেই হুজুর সঙ্গে সঙ্গে আবার চাবুক তুললেন। তিনি চাবুকটি উঠিয়ে মারতে যাবেন, মেয়েটি দৌড়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো এবং চিৎকার করে বললো, ‘একে মেরো না। এর শরীরের প্রতিটি আঘাত আমার অন্তর ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে।’

‘তুমি একে বাঁচাতে চাও?’ সঙ্গের লোকটি গর্জন করে উঠলো।

‘না!’ মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘ও যদি কিছু না বলে তবে তলোয়ারের এক আঘাতে ওর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দাও। কিন্তু এভাবে নির্যাতন করে কষ্ট দিয়ে মোরো না।’

কিন্তু এ আবেদনে কোন ফল হলো না। হুজুর সঙ্গের লোকটিকে চোখে ইশারা করে বররে, ‘একে বাইরে নিয়ে যাও।’

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটাকে টেনে বাইরে নিয়ে গেল লোকটি। ওকে পাশের কামরায় নিয়ে অন্য মেয়েটাকে বললো, ‘দরজা বন্ধ করে দাও। দেখো মাইসা যেন বাইরে যেতে না পারে।’

লোকটি ফিরে এলো কামরায়। আনিসের ওপর এবার শুরু হলে তথ্য আদায়ের জন্য অকথ্য নির্যাতনের নতুন মাত্রা। দুইজনে পালা করে তাকে দিচ্ছিল নানা রকম লোমহর্সক শাস্তি। এ শাস্তি চললো রাতভর।

সারা রাত ওরা তাকে শুতে দিল না, বসতেও দিল না। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে উত্যক্ত করলো তাকে, কিন্তু সে নির্বিকার। অনেক প্রলোভন দেখানো, কিন্ত তাতেও কাজ হলো না ।

প্রলোভনেও কাজ না হওয়ায় আবার শুরু হলো তার উপর আঘাতের পর আঘাত। সেই অসহ্য আঘাত খেয়েও মূর্তির মত অটল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে।

এভাবে আঘাতের পর আঘাত খেয়ে এক সময় সে লুটিয়ে পড়লো। সকালের দিকে জ্ঞান হারালো আনিস।

ভোর। সারা রাত কেঁদে কেঁদে সকালের দিকে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সে সামান্য সময়ের জন্য মাত্র। সহসাই সে আবার জেগে উঠলো এবং চারদিক তাকিয়ে দেখলো ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই রাতের অন্ধকার কেটে ফর্সা হয়ে এসেছে প্রকৃতি। মাইসা লক্ষ্য করে দেখলো, এখন আর চাবুকমারা বা আনিসের আর্তনাদ কিছুই শোনা যাচ্ছে না। সে সহসা উঠে বসলো এবং দ্রুত কামরায় কবাট খুলে বাইরে এসে গিয়ে ঢুকলো আনিসের কামরায়।

আনিস তখন অর্ধ-মৃত অবস্থায় মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছিল। তার সারা গায়ে চাবুক ও তলোয়ারের খোঁচার রক্তাক্ত দাগ। সে মেঝেতে পড়েছিল বেহুশ হয়ে। এখন তাকে আঘাত করা আর আদর করা সমান করা। কারণ কোন কিছুই অনুভব করার মত অবস্থা তার নেই।

মেয়েটি কামরায় ডুকে দেখলো রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে আনিস। সে আনিসের এই করুণ পরিণতি সহ্য করতে পারলো না। কতক্ষণ বিহ্বল চিত্তে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল, শেষে সইতে না পেরে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর। আনিসের বুকের ওপর পড়ে থেকে অনেক্ষণ অঝোর ধারায় কাঁদলো। বার বার বললো, ‘হায়ঁ! এ আমি কি করলাম! এ দশা যে আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’

অনেক্ষণ পরে বুক থেকে মাথা তুলে বলরো, ‘আমি তো তোমাকে অনেক বার বলেছি, তুমিই আমর প্রথম ও শেষ ভালবাসা। তোমার কষ্টই আমার কষ্ট, তোমার মৃত্যুই আমার মৃত্যু।

আরো কিছুক্ষণ পরের কথা। মেয়েটি মনে তার দায়িত্বের কথা স্মরণ হলো। দায়িত্বের কথা  মনে হতেই তার চোহারা পরিবর্তিত হয়ে গেল। বলল, ‘হ্যাঁ, আমার দায়িত্ব! আমি তো আমার দায়িত্ব ঠিকঠাক মতই পালন করেছি। আমি ও তো একে ধরিয়ে দিয়েছি! আমিও তো বলেছি, ওকে মেরে ফেলো। কিন্তু এতো কষ্ট! এতো কষ্ট! হায় খোদা, এ আমি কি করলাম।

আনিস তখনো বেহুশের মত পড়েছিল। মাইসার মনে হলো, সামান্য নড়ে উঠলো আনিস। হ্যাঁ, তাইতো!। তাহলে তার চেতনা ফিরে আসছে! সে তার হৃদস্পন্দ শোনার জ্যন্য আনিসের বুকের উপর কান পাতলো। আবার নড়ে উঠলো আনিস। আলগোছে একটি হাত তুলে দিল মাইসার পিঠের ওপর।

মেয়টি তেমনি পড়েছিল তার বুকের ওপর। পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে এলো আনিসের। চোখ মেলেই দেখতে পেলো মাইসাকে। ক্ষীণ স্বরে বরলো, ‘তুমি চলে যাও। শেষে এমন না হয় যে, আমি আমর কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই। এই কঠিন শাস্তি ও মৃত্যু আমার পাওনা ছিল। তুমি তোমার দায়ীত্বের উপরে কুবরানী হতে চাও, আমি আমার ধর্মের উপরে কুবরানী হতে চাই। দোহাই তোমার, আমাকে বাঁধা দিও না। আমার জীবন আজ কাণায় কাণায় ভরে উঠেছে। আমি আমার প্রভুর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছি। আমার বেহেশতী বন্ধুরা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তুমি যাও মাইসা! আমার বুকের ওপর থেকে সরো! দোহাই খোদার, সরে যাও তুমি!’

মেয়েটি এতক্ষণ ফুঁপিয়ৈ কাঁদছিল। আনিসের কথা শুনে পাগলের মত বিলাপ শুরু করলো, ‘দোহাই আনিস, থামো! চুপ করো! মরতে যদি হয় এক সাথেই মরবো। নিয়তি আমাকে আবার তোমার কাছে টেনে এসেছে আমরা এক সাথে থাকবো বলে। বাঁচলে আমরা এক সাথেই বাঁচবো আর মরতে হলেও এক সাথেই মরবো। . . . . .’

মেয়েটির বিলাপ তখনো চলছিল, হুজুর কামরায় ঢুকে এ দৃশ্য দেখে কঠিন সিদ্ধান্তে এলো। সঙ্গের লোকটিকে বললো, ‘এই হতভাগী মেয়েটাকে অন্য কোন কামরায় নিয়ে বন্দী করে রাখো।’ তারপর পড়ে থাকা গোয়েন্দার পিঠে শপাং করে একটি বাড়ী দিয়ে বললো, ‘কিহে মুজাহিদ! জবান খুলবে, নাকি আরও অষুধ দিতে হবে?

গত রাতটি আলী বিন সুফিয়ানের কেটেছে অসম্ভ ব্যস্ততায়। সাদা দাড়িওয়ালা যে লোককে অনুসরণ করে কায়রো এসে পাকড়াও করেছিলেন তাকে রাতভর জেরা করে জেনে নিয়েছেন সমস্ত তথ্য। কালো দাড়িওয়ালা হুজুর কে তার এখানে আসার উদ্দেশ্য ও মিশন কি, অবশেষে সবই তিনি জানতে পেরেছেন। এই করতে করতেই দিনের অর্ধেক সময়ও অতিবাহিত হয়ে গেল।

তখনি তার মনে পড়লো গোয়েন্দা আনিসের কথা। আনিসের কথা মনে হতেই আলী বিন সুফিয়ান অধীর হয়ে উঠলেন। সে এখনো এলো না কেন? তিনি ব্যাকুল হয়ে আনিসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো আলী বুঝতে পারলেন, তাঁর পাঠানো গোয়েন্দা নিশ্চয় কোন বিপদে পড়েছে। হয়তো হুশিয়ার দরবেশ সন্দেহবশত তাকে গ্রেফতার করে নিয়েছে।

দিনের শেষ প্রহর। আলী বিন সুফিয়ান আর অপেক্ষা করা সমীচিন মনে করলেন না। তিনি আনিসকে উদ্ধারের জন্য একটি কমাণ্ড দল গঠন করে রাতের অন্ধকার নেমে আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

যে বাড়ীটিকে ওরা আস্তানা বানিয়েছিল তা তিনি আগেই দেখে এসেছিলেন। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে তিনি সেই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

তাঁর কমান্ডো বাহিনী এত দ্রুতবেগে গ্রামে প্রবেশ করলো যে, গ্রামের কেউ কাউকে সতর্ক করার সুযোগ পেল না। গ্রামে ঢুকে চোখের পলকে তারা বাড়ীটিকে ঘিরে ফেলল। তারপর বড়ীর দেয়ালের সাথে ঘোড়া লাগিয়ে লাফিয়ে পড়লো ভেতরে। বাড়ীর ভেতরের কেউ কিছু টের পাওয়ার আগেই কমাণ্ডোদের লাথির আঘাতে ভেঙ্গে গেল দরজা। কামরায় ঢুকে ওরা বাড়ীর সকলকেই গ্রেফতার করে নিল।

আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা তখনো বেহুশের মত পড়ে ছিল মেঝেতে। তার প্রাণবায়ু বেরোনোর জন্য যেন শেষ চেষ্টা করছে।

অপরদিকে পাশের কামরায় ছিল মেয়েটি। কমাণ্ডোরা ওকে গ্রেফতার করার জন্য গিয়ে দেখে মেয়েটি বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার বিছানা।

ওরা তাড়াতাড়ি মেয়েটিকে ধরে তুলতে গিয়ে দেখলো মেয়েটির বুকে একটি ছুটি বিদ্ধ হয়ে আছে। তখনো মারা যায়নি সে, কমাণ্ডোদের দেখে মুখে কষ্ট করে হাসির রেখা টেনে কোন করমে বললো, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়, আমি নিজেই আত্মহত্যা করেছি।’

কথাটুকু বলে সে শেষ নিশ্বাঃস ত্যাগ করলো। কিন্তু কেউ জানতে পারলো না, কেন মেয়েটি আত্মহত্যা করলো।

পর দিন। সেই গ্রাম ও আশপাশের গ্রামের অনেক লোক বাড়ীর সামনে এসে জড়ো হলো। আলী বিন সুফিয়ান কালো দাড়িওয়ালা হুজুরকে সবার সামনে দাঁড় করীয়ে বললেন, ‘কি উদ্দেশ্য এবং কি মিশন নিয়ে তুমি ও তোমার সাথীরা এখানে এসেছো সবার সামনে খুলে বলো।’

লোকটি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আলী বললেন, ‘চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেই তুমি পার পেয়ে যাবে মনে করো না। তোমরা কে এবং কেন এখানে এসেছো সব আমি জানি। আমি এও জানি, রমলা থেকে ফেরার পথে সৈনিকদের যে কাহিনী তুমি শুনিয়েছিলে তা ভুল। কোত্থেকে কেমন করে রাতের আঁধারে তোমার কাছে খাবার পোঁছাতো সে রহ্যসও আমি উদ্ধার করেছি। তুমি সত্যি কথা জনতার সামনে স্বীকার করলে তোমার শাস্তি খানিকটা লাঘব হতে পারে। আর যদি তুমি মুখ খুলতে অস্বীকার করো তবে আমার হাতে এমন অস্ত্রও আছে যাতে তোমার মুখোশ খুলে যাবে। কেন তুমি সৈন্য বাহিনী ও সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে দুর্ণাম ছড়াচ্ছো, এর উত্তর যদি তুমি না দাও তবে তোমার হয়ে সে উত্তর দেবে কাল যাকে সাদা দাড়ি পরিয়ে কায়রো পাঠিয়েছিলে তোমার সেই বন্ধু।

 

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top