২. সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কমান্ডো অভিযান

মাত্র তেরশ সৈন্যের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে গেল দু’হাজারের সুদানী বাহিনী। লাশে ভরে গেল মরু ময়দান। বন্দী হল অনেকে। পালিয়ে যাওয়া সৈন্যের সংখ্যা ছিল নিতান্ত নগণ্য।

সুদানীদের দ্বিতীয় বিদ্রোহ সুলতান ওদেরই রক্তে ডুবিয়ে দিলেন। এবার ডিপ্লোম্যাসী নয়, বন্দীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বিদ্রোহে শরীক সকল কমান্ডার এবং কর্মকর্তাদের বন্দী করলেন। গোয়েন্দাদের গ্রেফতার করে মৃত্যুদন্ড দেয়া হল।

সালাউদ্দিন আয়ুবী সেনাকমান্ডারদের ডেকে বললেন, “প্রতিরক্ষার স্বার্থে যত শীঘ্র সম্ভব সুদান আক্রমণ কবতে হবে।”

খলিফা আল আযেদকে পদচ্যুত করে সুলতান আয়ুবী ঘোষণা করলেন, ‘এখন থেকে মিসর আব্বাসী খেলাফতের অধীন থাকবে। খেলাফতের কেন্দ্র থাকবে বাগদাদ।

এরপর তিনি উম্মে আমারাকে আটজন দেহরক্ষীর সাথে নুরুদ্দীন জংগীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

০০ফিলিস্তিনের মেয়ে০০

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কক্ষে পায়চারী করছেন সুলতান সালাউদ্দীন আয়ুবী। একপাশে বসে আছেন বাহাউদ্দীন শাদাদ এবং আলী বিন সুফিয়ান।

আলীর দিকে তাকালেন সুলতান। বিষন্ন দৃষ্টি।

আলী! বেদনা ঝরে পড়ছে সুলতানের কষ্ঠ থেকে, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব, কিন্তু উচ্চাভিলাষী, ক্ষমতালিপসু আমীর ওমরা এবং নেতারা জাতিকে গোপনে বিক্রি করে দেয়ার যে চক্রান্ত করছে তা রোধ করা বড় কষ্টসাধ্য। তোমরা দেখেছ আমাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের কোন অভিযোগ নেই। গাদারী করছে শুধু বড়লোকেরা। আমার সাথে ওদের ব্যক্তিগত শক্রতা নেই। শক্রতা ক্ষমতার জন্য, গদির জন্য লালায়িত ওরা

জুন-জুলাইতে সুদানী বিদ্রোহ দমন করার পর পরই সালাউদ্দিন আয়ুবী খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। এর আগেও সুদানী সেনা বিদ্রোহ দমন করেছেন, বিদ্রোহী নেতা অথবা সেনা কমান্ডারদেরকে শাস্তি দেননি। কুটনীতি এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন।

এবার তা করেননি, পদ এবং মর্যাদার তোয়াক্কা না করে অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দিয়েছেন। অধিকাংশকে দিয়েছেন মৃত্যুদন্ড। কাউকে কারাদন্ড দিয়েছেন, কাউকে তাড়িয়ে দিয়েছেন দেশ থেকে।

‘দু’মাস ধরে দেশের উন্নয়ন এবং কল্যাণের দিকে নজর দিতে পারছিনা’, সুলতান বললেন, ‘অপরাধীদের আনা হচ্ছে, আদালত বসিয়ে আমার। দুর্ভাগ্য আমাদের, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত অধিকাংশই মুসলমান।

সম্মানিত আমীর’, মুখ খুললেন বাহাউদ্দীন শাদাদ, মুসলমান এবং কাফের সমান অপরাধ করলে মুসলমানের শাস্তি বেশী হওয়া উচিৎ। তার কাছে এসেছে সত্য সুন্দর জ্যোতির্ময় দ্বীন। কাফেরের তো ধর্ম এবং বিবেকের দুয়ার রুদ্ধ। মুসলমানদের শাস্তি দিচ্ছেন বলে দুঃখ করবেন না। ওরা গাদ্দার, দেশদ্রোহী। ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বেঈমানদের সাথে গাটছড়া বেঁধেছে।

আমার দুঃখ অন্যখানে শাদাদ। আমি শাসক হয়ে মিসরে আসিনি। সম্রাট হতে চাইলে মিসরের বর্তমান পরিস্থিতি তার জন্য উপযুক্ত। যে শুধু গদিকে ভালবাসে সে মিথ্যাবাদী এবং ষড়যন্ত্রকারীদের দলে টানে। চরিত্রহীন লোকেরা হয় তার বেশী আপন। গালভরা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ছাড়া ওরা জনগণকে কিছুই দিতে পারেনা। তাদের অধিনস্তরা নিজেদেরকে রাজকুমার মনে করে।

আমার হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নাও, তবে কথা দিতে হবে আমার পথে কোন বাধা সৃষ্টি করবে না। যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি ঘর ছেড়েছি তা আমাকে পূর্ণ করতে দাও।

মিসর এবং সিরিয়ার সাথে ঐক্য সৃষ্টির জন্য নুরুদ্দীন জংগী হাজার হাজার জীবন কোরবান করেছেন। আরব মুজাহিদদের খুনে রঙিন হয়েছে নীলের পানি। এই সাম্রাজ্যের সীমা আরো বিস্তৃত করতে হবে। সুদানকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে মিসরের সাথে। খ্রিস্টানদের নিয়ে যেতে হবে মধ্য ইউরোপে। আমার রাজ্য বৃদ্ধির জন্য নয়, বরং খোদার হুকুম প্রতিষ্ঠার জন্য ঐ বিজয় প্রয়োজন। কিন্তু মিসর আমার জন্য চোরাবালিতে পরিণত হয়েছে। এমন একটা এলাকার কথা বল, যেখানে ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহ আর গাদার নেই।

এসব ষড়যন্ত্রের পেছনে খ্রিস্টানদের হাত রয়েছে।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান। ভাবতেও অবাক লাগছে, নিজের যুবতী মেয়েদেরকে অশ্লীলতার ট্রেনিং দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে ওদের বিবেকে বাধছে না। তাদের মনভুলানো হাসি, চোখ ধাঁধাঁনো রূপ যৌবন, পটলচেরা কটাক্ষ, মধুভরা কষ্ঠের আকর্ষণ থেকে মুসলমানদের রক্ষা করা না গেলে জাতির পতন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। এ বড় কঠিন অস্ত্র।”

যতই দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায় কান দিওনা বলে প্রবাদ আওড়াও বাস্তবে তা কোন কাজে আসে না। জিহবা যাদু জানে। ভাষার আঘাত তলোয়ারের চেয়েও তীব্র। ওরা তোমার দুর্বলতা বুঝে এমন ভাষা ব্যবহার করবে যা তোমার তরবারী কোষবদ্ধ করতে বাধ্য করবে। স্বেচ্ছায় তুমি দুশমনের পদতলে রেখে দেবে তোমার অস্ত্র।

আমাদের চাইতে খ্রিস্টানদের দুটি হাতিয়ার বেশী আছে। একটি ভাষার যাদু, অন্যটি মানুষের পাশব শক্তি উস্কে দেয়ার ক্ষমতা। এ পাশবশক্তিকে উস্কে দেয়ার জন্য ওরা ব্যবহার করছে সুন্দরী তরুণীদের। মুসলমান আমীর ওমরা এবং শাসকদের হৃদয় থেকে ওরা মুছে দিচ্ছে ন্যায়-অন্যায়বোধ! শুধু শাসকদের মন থেকেই নয়, সম্মানিত আমীর এমনকি সাধারণ মানুষও এখন পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। অশ্লীলতার বান ডেকেছে আজ অভিজাত ও বিত্তশালী মুসলমানের ঘরে ঘরে, এটা খ্রিস্টানদের বড় রকমের সাফল্য।’

আর এটিই হচ্ছে আমাদের জন্য সবচে’ বড় সমস্যা।’

‘আমি সমগ্র খ্রিস্টান শক্তির মোকাবিলা করতে পারি, কিন্তু তাদের এ আঘাত সামাল দিতে পারছি না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি শিউরে উঠছি। এ অবস্থা চলতে থাকলে মুসলমান থাকবে শুধু নামে। খ্রিস্টানদের মতই হবে ওদের সভ্যতা সংস্কৃতি। অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনায় ওদেরকেও ছাড়িয়ে যাবে। তুমিই বলো, আমার স্বভাব ও আচরণ যদি একজন অমুসলমানের মতই হয় তবে আমাকে মুসলমান বলার স্বার্থকতা কি?’

মুসলমানের দুর্বলতা হচ্ছে ওরা আপন পর চিনে না। বন্ধু আর শক্রর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। সহজেই দুশমনের আকর্ষণীয় ফাঁদে আটকে যায় ওরা।

খ্রিস্টানদের দুর্বলতাও আমি বুঝি। মুসলমানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলেও ওদের হৃদয় চূর্ণ বিচূর্ণ। ফ্রান্স এবং জার্মান একে অপরের শক্র। বৃটেন এবং ইটালী কেউ কাউকে পসন্দ করে না। মুসলমানরা খ্রিস্টানদের শত্রু বলেই কেবল ওরা একত্রিত হয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ওদের মধ্যে রয়েছে বিভেদ, বিসম্বাদ।

অথচ অর্থবিত্ত আর নারীর রূপ যৌবন দিয়ে মুসলমানদেরকে অন্ধ করে রেখেছে ওরা ৷

মুসলিম বিশ্ব ঐক্যদ্ধ হলে অল্প ক’দিনের মধ্যেই ওরা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। ফাতেমী খেলাফত বাতিল করে আমি শক্রর সংখ্যাই বাড়িয়েছি। গদির জন্য ফাতেমীরা সুদানী এবং খ্রিস্টানদের সাথে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে।’

ওদের একজন কবিকে তো কাল মৃত্যুদন্ড দিলেন। আলী বললেন।

এতে আমারও দুঃখ হচ্ছে। আম্মারাতুল ইয়ামানীর কবিতা আমার হৃদয়েও দাগ কেটেছিল। কিন্তু তার শব্দ এবং ছন্দ অগ্নিশিখার মত ইসলামের আচ্ছাদন জ্বালানোর চেষ্টা করছিল।

আম্মারাতুল ইয়ামানী ছিল একজন নামকরা কবি। তখনকার সময় মানুষ কবিকে পীরের মত সম্মান ও মান্য করত। তার কাব্যের ছন্দ এবং শব্দ সৈন্যদের মাঝে সৃষ্টি করত নতুন আবেগ। কবি সমাজে তার এ জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানো শুরু করল। একদিকে সে মানুষকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করত, অন্যদিকে মানুষের মনে ফাতেমী খেলাফতের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করত।

ধীরে ধীরে তার কবিতার বিষয় হয়ে উঠল সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবীর বিরোধিতা। ফাতেমীরা নিয়মিত অর্থ যোগান দিত তাকে। তার শেষ কবিতা ছিলঃ

“ফাতেমী খেলাফতকে ভালবাসার অপবাদ দিচ্ছ আমায়।

আমাকে তোমরা অভিশাপ দাও।

অথচ আমার কাছে তোমরাই অভিশপ্ত।

অশ্রু ঝরাও ফাতেমীদের মহলের প্রাচীরে, দেয়ালের গায়।

মহলে এখনও যারা আছে তাদের বল,

তোমাদের জন্য যে ক্ষত হয়েছে আমার হৃদয়ে

তা মুছবে না কখনো, না কখনোই মুছবে না।

দুর্ভাগ্য ফাতেমীদের

তাদের এ দুর্ভাগ্যের কারণ যে মানুষটি

সে আয়ুবীকে আজো কোন দুর্ভাগ্য স্পর্শ করল না।’

একদিন অকস্মাৎ তার বাড়ীতে তল্লাশী নেয়া হল। দেখা গেল, শুধু ফাতেমীরাই নয়, মুসলমানদের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য তাকে নিয়মিত অর্থ যোগান দিচ্ছে খ্রিস্টানরাও। আয়ুবীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করার জন্য ওরা তাকে নিয়োগ করেছিল। গাদারীর অভিযোগে তাকে দেয়া হল মৃত্যুদন্ড।

যে জাতির কবিরা দুশমনের কাছে বিবেক বিকিয়ে দেয়, সে জাতির ভাগ্যে অপমান এবং লাঞ্ছনা ছাড়া আর কি থাকতে পারে? বললেন সুলতান।

প্রহরী ভেতরে এসে বলল, পদচ্যুত খলিফার দূত এসেছে।’

আয়ুবীর কপাল কুঞ্চিত হল। বললেন, “খেলাফতের গদি ছাড়া এ বুড়ো আমার কাছে আর কি চাইতে পারে?

দূতকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।” দূত ভেতরে এসে সালাম দিয়ে বলল, খলিফার সালাম গ্রহণ করুন।’

‘সে খলিফা নয়।’ সালাহউদ্দীন আয়ুবী বললেন, দু’মাস আগেই সে পদচ্যুত হয়েছে। আল আযেদ এখন গৃহবন্দী।

ক্ষমা চাইছি মাননীয় সুলতান। পুরনো অভ্যাস, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। আল আযেদ আপনাকে সালাম দিয়ে বলেছেন, তিনি ভীষণ অসুস্থ। বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। আপনার সাথে দেখা করার ইচ্ছে। সম্মানিত আমীর, একটু কষ্ট স্বীকার করলে তিনি কৃতজ্ঞ থাকবেন।

সালাহউদ্দীন আয়ুবী নিজের উরু চাপড়ে বললেন, ‘সে আমায় ডাকছে কারণ, সে এখনও নিজকে খলিফা মনে করে।’

তা নয় মহামান্য সুলতান! তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রাসাদের ডাক্তার সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি হার্টের রোগী। একটু রাগ হলেই রোগ বেড়ে যায়। এখনতো বিছানা থেকেই উঠতে পারেননা। দূত একটু থেমে সংকোচ জড়ানো কষ্ঠে বলল, আপনাকে একা যেতে বলেছেন। গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় কথা আছে। অন্য কারও সামনে তা বলা যাবে না।’

তাঁকে সালাম দিয়ে বলো আয়ুবী গোপন কথা সবই জানেন। এখন তিনি যেন খোদার সাথেই গোপন কথা বলেন। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।”

নিরাশ হয়ে ফিরে গেল দূত।

সালাহউদ্দীন আয়ুবী বললেন, সে আমায় একা যেতে বলেছে। এতে কোন ষড়যন্ত্র নেইতো?”

‘আমার মনে হয় প্রাসাদে ডেকে নিয়ে সে আপনাকে শেষ করে দিতে চাইছে।’

প্রহরীকে ডাকলেন আয়ুবী। বললেন, ‘ডাক্তারকে সালাম দাও।

ডাক্তার এলে সুলতান বললেন, আল আযেদের কাছে যাও। আমি জানি সে অনেকদিন থেকেই অসুস্থ। হয়ত তার পারিবারিক ডাক্তার নিরাশ হয়ে গেছে, তুমি গিয়ে তার চিকিৎসা কর। অবস্থা মারাত্মক হলে আমাকে খবর দিও।

সাবেক খলিফা আল আযেদ তার প্রাসাদে গৃহবন্দী। তার প্রাসাদ ছিল পৃথিবীর স্বর্গ। হারেমের শোভা বৃদ্ধি করেছিল দেশ-বিদেশের রূপসী যুবতীরা। তৰী তরুণী দাসী বাঁদীর সংখ্যা ছিল অগণিত। হাজার হাজার পালনের জন্য।

সুলতান আয়ুবীর নতুন বিপ্লব মহলের চেহারা বদলে দিল। খলিফার ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হলেও তার ভোগবিলাস সামগ্রীতে হাত দেয়া হয়নি, কিছু সৈন্য রয়েছে, যাদের কাজ এখন পাহারার সাথে সাথে ষড়যন্ত্রের এ কেন্দ্রের প্রতি গভীরভাবে নজর রাখা।

গৃহবন্দী আল আযেদ একে তো বৃদ্ধ তার ওপর হার্টের রোগী। গদি হারানোর দুশ্চিন্তা, বয়সের ভার আর অতিরিক্ত মদপান ও ভোগবিলাস তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল।

ক’দিনেই চেহারা হয়েছে মরার মত। দু’জন আধ বয়েসী মহিলা এবং একজন চাকর ছাড়া তার কক্ষে কেউ নেই। বৃদ্ধ চোখ খুলে ওদের দেখে আবার বন্ধ করে নিতেন চোখ।

একটু আগে ডাক্তার তাকে ওষুধ খাইয়েছেন। হারেমের দু’জন যুবতী ভেতরে ঢুকল। একজন তার হাত নিজের হাতে নিয়ে শরীরের অবস্থা জানতে চাইল। অন্যজন দু’হাতে তার মুখমন্ডল ধরে সুস্থ হওয়ার জন্য দোয়া করল। এরপর পরস্পর চোখের দিকে তাকিয়ে একজন বলল, বিশ্রাম করুন। এখন আপনার বিশ্রাম নষ্ট করা ঠিক হবেনা। আমরা পাশের কামরায় আছি, প্রয়োজন হলে ডাকবেন। দু’জনই কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।

আল আযেদ দীর্ঘশ্বাস টেনে পাশের মহিলাকে বললেন, ‘এরা আমার সেবা করতে আসেনি। দেখতে এসেছে আমি কখন মরব। আমার সম্পদের সাথেই ওদের সম্পর্ক। ওরা শকুন, ওরা শুধু আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। ওদের লোলুপ দৃষ্টি আমার সম্পদের দিকে। তোমরা তিনজন ছাড়া আমার সমব্যর্থী আর কেউ নেই। না, কেউ নেই, কেউ নেই। যারা ফাতেমী খেলাফতের নামে শ্লোগান তুলত তারা এখন কোথায়?

বুকে হাত চেপে পাশ ফিরলেন বৃদ্ধ। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।

দূত কক্ষে প্রবেশ করে বলল, ‘গভর্নর আসবেন না। তিনি আসতে অস্বীকার করেছেন।”

‘হায় হতভাগ্য আয়ুবী। আল আযেদের কষ্ঠে বিষগ্নতা, আমার মৃত্যুর পূর্বে একবারতো আসতে পারত।

তাঁর বুকের ব্যথা বেড়ে গেলো। থেমে থেমে ক্ষীণ কষ্ঠে তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমি ডাকলে দাসীবাদীরাই এখন আসে না, মিসরের গভর্নর আসবে কেন? এ সবই আমার পাপের শাস্তি। আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ এখন পর্যন্ত আসেনি, ওরা আসবে জানাযায়, প্রাসাদের যা পাবে নিয়ে যাবে।’

কিছুক্ষণ ব্যথায় কাৎরালেন তিনি। দু’জন সেবিকা আতংক নিয়ে তার কথা শুনতে লাগল। শান্তুনা দেয়ার কোন ভাষা এলনা ওদের মুখে। ওরা সে খোদার অভিশাপকে ভয় পাচ্ছিল, যিনি আমীরকে ফকীর আর সম্রাটকে ভিক্ষুকে পরিণত করেন।

ঘরের ভিতর কারো ছায়া পড়ল। চকিতে দরজার দিকে তাকাল ওরা। দেখল শুভ্রকেশধারী এক ব্যক্তি দাড়িয়ে আছেন দরজায়।

ধীরে ধীরে তিনি এগিয়ে এলেন আল আযেদের কাছে। নাড়িতে হাত রেখে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম, আমি গভর্নরের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। আপনার চিকিৎসার জন্য তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন।

‘আমাকে দেখে যাওয়ার সৌজন্যবোধৰ্টুকুও গভর্নর হারিয়ে ফেলেছেন? আমি ডাকলাম, তারপরও এলনা!

কি জানি, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা। তিনি আমাকে ডেকে আপনার চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। আপনার স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন, তা না হলে আমায় পাঠাতেন না।’

আল আযেদ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ডাক্তার তাকে বাধা দিয়ে বললেন, আপনি এখন কথা বলবেন না, তাহলে আপনার রোগ বেড়ে যেতে পারে ‘

‘আমার চিকিৎিসা হয়ে গেছে, যা বলছি মন দিয়ে শোন। এর প্রতিটি শব্দ আয়ুবীকে পৌছে দেবে। নাড়ি থেকে হাত সরাও। তোমাদের পৃথিবীর চিকিৎসা এবং ওষুধ থেকে আমি এখন অনেক দূরে। আয়ুবীকে বলো, আমি তার শক্র নই। দুশমনের চালে আটকে গিয়েছিলাম। আমার অথবা সালাহউদ্দীনের দূর্ভাগ্য, এমন সময় অপরাধ স্বীকার করছি যখন আমি মাত্র কয়েক মুহুর্তের অতিথি।

সালাহউদ্দীনকে বলো, আমার হৃদয়ে সবসময়ই তার জন্য স্নেহ ছিল। তার জন্য ভালবাসা বুকে নিয়েই আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছি। টাকা পয়সা এবং গদির লোভ আমার সব ভালবাসা কেড়ে নিয়েছিল। লোভ এবং মোহ আমার হৃদয়কে এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যা আমাকে ইসলাম থেকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। এ ছিল আমার মস্তবড় ভুল। আজ আমার নেশা ছুটে গেছে।

আমার পায়ের কাছে বসে যারা কথা বলত, তারা এখন আমাকে চেনেনা। যেসব দাসীবাদী আমার চোখের ইশারায় নাচত, তারা আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। উলংগ নৃত্য করেছে যেসব মেয়েরা ওরাও আমাকে ঘৃণার চোখে দেখছে।

মানুষ আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে এবং আল্লাহর কাছেই মানুষকে আবার ফিরে যেতে হবে। সেখানে কারও পাপের বোঝা কেউ বহন করবে না- মানুষের কথায়, চাটুকারদের চাটুকারিতায় এ সত্যকে ভুলে যাওয়া ছিল আমার জীবনের সবচে’ বড় বোকামী। এ ভুল আমি করেছি।

ওসব কমবখতের দল আমাকে খোদার আসনে বসিয়েছিল। যখন আসল খোদার ডাক এসেছে, চোখ খুলে গেছে আমার। আমি বুঝতে পারছি, অপরাধ স্বীকার করার মধ্যেই আমার মুক্তি। সালাহউদ্দীনকে এমন সব তথ্য দেব যা সে জানেনা। তাকে বলো, আমার গার্ড বাহিনীর কমান্ডার রজব মরেনি। সুদানের কোথাও না কোথাও সে আত্মগোপন করে আছে। সে আমাকে বলে গেছে, ফাতেমী খেলাফত পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য সে সুদানী এবং আয়ুবী বিরোধী মিসরীদের নিয়ে সেনাবাহিনী গড়ে তুলবে। সামরিক সাহায্য নেবে খ্রিস্টানদের কাছ থেকে।

সালাহউদ্দীনকে বলো, তার দেহরক্ষীদের দিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে। রাতে যেন একা বের না হয় | রজব তাকে হত্যা করার জন্য ঘাতক বাহিনীর সাথে চুক্তি করেছে। মিসর তার জন্য এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরী।

তাকে বল তুমি যাদের বন্ধু মনে কর তাদের সবাই তোমার বন্ধু নয়, এদের মাঝে অনেক শক্রও আছে। ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য যারা তোমার কষ্ঠে কষ্ঠ মেলায় তাদের মধ্যেও রয়েছে খ্রিস্টানদের পালিত বিষাক্ত সাপ। এমন অনেক আলেম পাবে ক্ষমতার লোভেই যারা ইসলামের পক্ষে কথা বলে।

তিনি কয়েকজনের নাম বললেন, এদের তোমরা মনে কর মস্ত বড় মুজাহিদ। অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদ তাদের পিছনে জানেনা এরা কখনো চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারবেনা। ওরা মুখে বলে পরকালের কথা, কিন্তু বাস্তবে পুঞ্জীভুত সম্পদ ও ক্ষমতা হারাবার ভয়ে সব সময় অস্থির থাকে। একদিন হয়তো তারাও নিবেদিতপ্রাণ ছিল, কিন্তু যতই ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা বাড়ছে ততই তা হারাবার ভয়ও বাড়ছে, আর এ ভয় তাদেরকে ইসলাম থেকে ঠেলে দিচ্ছে দূরে। কেউ কেউ এগিয়ে গেছে আরো এক ধাপ। দুনিয়ার মোহে ওপরে দ্বীনের শ্লোগান দিচ্ছে আর গোপনে শক্রর সাথে হাত মিলাচ্ছে।

এদেরই একজন ফয়জুল ফাতেমী, সেনা সদর দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছে সে। বন্ধু ভেবে তাকে অনেক বড় পদ দিয়ে রেখেছে আয়ুবী। সে তোমাদের বন্ধুবেশী দুশমন। তোমরা জাননা, কিন্তু আমি জানি সে রজবেরই সংগী।

সেনাবাহিনীর মধ্যে তুকী, সিরীয় এবং অন্যান্য আরব বংশোদ্ভূত সদস্যদের ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করোনা। এরাই তোমার অনুগত এবং ইসলামের সৈনিক।

মিসরী সৈন্যদের মধ্যে বিশ্বস্ত অবিশ্বস্ত দু’দলই আছে। তুমি যখন সুদানীদের আক্রমণ করেছিলে দুটো প্লাটুনের কমান্ডার সৈন্যদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলে। আরব সৈন্যরা কমান্ডারের নির্দেশ উপেক্ষা করেই আক্রমণ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল, তা না হলে যুদ্ধের ফল হত উল্টো |

আল আযেদ ক্ষীণ কষ্ঠে থেমে থেমে বলে যাচ্ছেন। ডাক্তার বাধা দিয়েছেন কয়েকবার, তিনি হাতের ইশারায় তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছেন। ঘামে ভিজে যাচ্ছে তার শরীর। যেন কেউ পানি ছিটিয়ে দিয়েছে সারা শরীরে।

ঘাম মুচছে দু’জন সেবিকা। মনে হয় ঝর্ণা বইছে শরীর থেকে। তিনি সামরিক বেসামরিক কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্রের বর্ণনা দিলেন। বললেন, ‘এসব কর্মকর্তাদের মুসলমান মনে করোনা। ওরা নিজেদের ঈমান বিক্রি করে দিয়েছে।

সালাহউদ্দীনকে বলো, আল্লাহ তোমায় সফল করবেন। মনে রেখো, একদল রয়েছে ধোকাবাজ, অন্যদল চাটুকার। চাটুকাররা খোদার আসনে বসিয়ে তোমাকে নিঃশেষ করে দেবে। এরা মোনাফেকদের চেয়েও বেশী ক্ষতিকর। দুশমনকে পদানত করে তুমি যখন নিশ্চিন্তে মসনদে বসবে, তখন আমার মত দুই জাহানের সম্রাট হয়ে যেও না। রাজত্ব আল্লাহর। এ পরিণতি থেকে রক্ষা করে চলো।’

জড়িয়ে এল আল আযেদের কষ্ঠ। চোহারার বিষগ্রতা কেটে গিয়ে ফুটে উঠল প্রশান্তি। আবারো কিছু বলতে চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু নিস্তব্ধ হয়ে গেল কষ্ঠ। মাথা কাত হয়ে গেল একদিকে আল আযেদ চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে গেলেন।

এ ঘটনা ঘটেছিল ১১৭১ সনে।

ডাক্তার সুলতানের কাছে খবর পাঠালেন। প্রাসাদেও এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। কান্না দূরে থাক, সামান্য আফসোসও কেউ করল না। শুধু সেবিকা দুজনার চোখ ছিল অশ্রুভেজা।

সংবাদ পেয়েই সুলতান কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তাকে নিয়ে প্রাসাদে পৌছলেন। চাকর বাকরদের তৎপরতায় তার মনে সন্দেহ জাগল। তিনি নারী পুরুষ এবং হারেমের যুবতীদেরকে বাইরের বারান্দায় বসিয়ে রাখ। যতবড় প্রয়োজনই হোক কাউকে বাইরে যেতে দেবে না। আস্তাবলেও কাউকে যেতে দেবে না। গোটা প্রাসাদ নিজের কজায় রেখো।’

কি আশ্চর্য! সুলতান লক্ষ্য করলেন, যেই আল আযেদ ছিলেন এক সম্রাট, নারী আর মদ ছিল যার জীবন, যার হারেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিল রূপসী তরুনীরা, চাকর বাকর দাস দাসীতে গমগম করেছে যার মহল, তার জন্য এক ফোটা চোখের পানি ফেলার মত কোন লোক নেই।

ডাক্তার সুলতানকে নিভৃতে ডেকে আল যায়েদের শেষ কথাগুলো শুনিয়ে বললেন, আপনার আসা উচিৎ ছিল।

সালাহউদ্দীন আয়ুবী তাকে বললেন, আল আযেদকে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি, আর যে ঈমান বিক্রি করে দেয় তাকে আমি ঘৃণা করি বলেই তখন আসিনি।”

ডাক্তারের কাছ থেকে আল আযেদের শেষ কথাগুলো শুনে সুলতান দুঃখ করলেন। বললেন, আমি এলে আরও কিছু তথ্য বের করতে পারতাম |

আল আযেদ যদিও বিলাসপ্রিয় ছিলেন এবং সালাহউদ্দীন আয়ুবী বিরোধী ষড়যন্ত্রে তিনি সহযোগিতাও করেছেন তবুও আয়ুবীর জন্য তার ভালবাসা ছিল। সুলতান বুঝতে পারছিলেন, আল আযেদের এ আহবানে কোন ষড়যন্ত্র ছিল না। তার অন্তিম কথাগুলো শুনতে পারেননি বলে সুলতান দীর্ঘদিন অনুতাপ করেছিলেন।

আলীকে ডাকলেন সুলতান। আল আযেদের দেয়া নামগুলো দিয়ে বললেন, ‘এদের পেছনে গোয়েন্দা লাগাও। প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। কারও প্রতি যেন নূ্যনতম জুলুমও না হয়। পরে প্রমাণিত হল প্রতিটি লোকই ষড়যন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত।

সুলতান আল আযেদের দাফনের ব্যবস্থা করলেন, দাফন করা হল সাধারণ কবরস্থানে। কালের প্রবাহে সে কবরের চিহ্ন মুছে গেছে।

মহলে তল্লাশী নেয়া হল। সোনা রূপা এবং সম্পদের স্তুপ দেখে হতবাক হয়ে গেলেন সালাহউদ্দীন আয়ুবী।

হারেমের রূপসী এবং অন্যান্য যুবতীদেরকে আলীর হাতে দিয়ে বলা হল, ‘খোঁজ খবর নিয়ে যার যার বাড়ীতে পৌঁছে দাও। ফিরিংগী এবং অমুসলিম মেয়েদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নাও। সন্দেহ হলে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা কর।”

প্রাসাদের সমস্ত ধন সম্পদ সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবী দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালে বন্টন করে দিলেন।

মৃত্যুর পূর্বে আল আযেদ বলেছিলেন, রজব বেঁচে আছে। ফৌজ তৈরী করছে আয়ুবীর সাথে যুদ্ধ করার জন্য। দু’জন দুঃসাহসী গুপ্তচর বাছাই করলেন আলী বিন সুফিয়ান। দু’জনই রজবের পূর্ব পরিচিত। ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে ওদেরকে সুদান পাঠিয়ে দেয়া হল। নির্দেশ দেয়া হল রজরকে জীবিত ধরে আনতে। সম্ভব না হলে হত্যা করতে।

গুপ্তচর দু’জন সুদানের পথ ধরল। রজব তখন শুবাক কেল্লায়।

সুবাক ফিলিস্তিনের খ্রিস্টানদের হেড কোয়ার্টার। এখান থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করে ওরা। ” ..

ওদের অত্যাচারে মুসলিম পরিবারগুলো দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। কারও ইজ্জত নিরাপদ নয়। ফিলিস্তিনের খ্রিস্টানরা ডাকাতের ভূমিকায় লুণ্ঠন করছে মুসলমানদের কাফেলা। মেয়েদের অপহরণ করছে। এ কারণেই সুলতান আয়ুবী ফিলিস্তিন অধিকার করতে চাচ্ছিলেন।

মুসলমানদের প্রথম কিবলা ওরা দখল কুর রেখেছে। আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আছে নির্যাতিত মানুষের বুক ফাটা কান্নায়। ইজ্জত আব্রু লুষ্ঠিত নারীর অশ্রু শুষে নিচ্ছে মরুর বালুকারাশি। কিন্তু মুসলমান আমীর ওমরাদের সম্পর্ক সাধারণ মুসলমানদের চেয়ে অভিজাত খ্রিস্টানদের সাথেই বেশী।

রজব আয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, সামরিক সাহায্যের জন্য এসেছে শুবাক ঘাটিতে। তার সম্মানে নৃত্যগীতের আসর জমানো হল। নাচনেওয়ালী যুবতীদের অধিকাংশই মুসলমান। অল্প বয়সে অপহরণ করে ওদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে পুরুষ ঘায়েলের জন্য। রজব একবারও তা ভাবল না, স্বজাতির মেয়েরা অমুসলিমের আসরে উলংগ নাচছে। সে উপভোগ করছে আর মদপান করছে। সাথে দু’জন মুসলমান কমান্ডার। রাত ভর আসরে মত্ত হয়ে রইল ওরা।

কথা শুরু হল সকালে, বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পুইলজিনান এবং কোনার্ড। এ ছাড়াও ছিলেন ক’জন পদস্থ সামরিক অফিসার।

রাতে রজব ওদের বলেছিল, ‘আয়ুবী সুদানে এক কাফ্রী গোত্রের মন্দির ভেঙে দিয়েছে। হত্যা করেছে পুরোহিতকে। সুদানীরা আক্রমণ করেছিল, সফল হয়নি। সে খলিফা আল আযেদকে সরিয়ে মিসরকে আব্বাসী খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছে। এতে মনে হয় আয়ুবী মিসরের একচ্ছত্র সম্রাট হতে চাইছে।

রজব মিটিংয়ে আরো বলল, আমি সামরিক সাহায্যের জন্য এসেছি। সুদান ফিরে ফৌজ তৈরী করবো। মিসরের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্যও আমি আপনাদের সহযোগিতা কামনা করি।

এ মুহুর্তে দুটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া উচিৎ। বললেন কোনার্ড, “যে গোত্রের মন্দির ভাঙা হয়েছে তাদেরকে প্রতিশোধের জন্য উত্তেজিত করা। অন্যদিকে সুদানের সব ধর্মের লোকদের বলা যে, সুলতান আয়ুবী অন্য ধর্মের ইবাদতখানা, দেবতা এবং মূর্তি ভেঙে ফেলে। আঘাত হানে অন্য ধর্মের ওপর। সে যতদিন বেঁচে থাকবে কোন ধর্মই নিরাপদ নয়। ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করে সুদানীদের আয়ুবীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায় |

মিসরের মুসলমানদেরকেও আমরা আয়ুবীর বিরুদ্ধে দাড় করাতে পারব |”

এক খ্রিস্টান কমান্ডার বলল, মিঃ রজব, মনে কছি না করলে বলব, মুসলমানদের ভেতর ধর্মীয় আবেগ সৃষ্টি করে একজনকে দিয়ে অন্যজনকে হত্যা করানো কঠিন নয়। আমাদের ধর্মে বান্দা এবং খোদার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছেন কোন কোন পাদ্রী। ইসলামেও কোন কোন ইমাম মসজিদ দখল করে খোদার এজেন্সি নিয়ে বসে আছে।

আমাদের সম্পদ আছে। টাকা দিয়ে মৌলভী তৈরী করে আমরাও মিসরের মসজিদে বসিয়ে দিতে পারি। খ্রিস্টানদের মধ্যে অনেকে কোরান এবং ইসলামের জ্ঞানে পারদর্শ। ওদেরকেও মুসলমানদের ইমাম হিসেবে নিয়োগ করা যায়। সালাহউদ্দীনের বিরুদ্ধে মসজিদে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। মৌলবীরা ওয়াজের মাধ্যমে মানুষকে কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ করবে। তখন স্বাভাবিক ভাবেই আয়ুবীর সম্মান কমে যাবে।’

এ কাজ এখনি শুরু করা উচিৎ। বলল রজব, ‘আয়ুবী মিসরে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। শিশু, কিশোর, যুবক সবাই ওখানে ধর্মের সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে। সে আসার পূর্বে মিসরে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। লোকজন মসজিদের খোৎবা শুনত, যেখানে বেশীরভাগ থাকত খলিফার প্রশংসা।

মানুষের জ্ঞানের চোখ খুলে গেলে আমাদের কাজ করতে কষ্ট হবে। দেশ শাসন করতে হলে মানুষকে দৈহিক এবং মানসিকভাবে পরিনির্ভরশীল রাখতে হয়।

মিঃ রজব!’ এক কমান্ডার মৃদু হেসে বলল, আপনার দেশে গোপনে কি হচ্ছে তাই জানেন না আপনি। সালাহউদ্দীন যেদিন আমাদের রোম উপসাগরের পাড়ে পরাজিত করেছিল, সেদিন থেকেই এ কাজ শুরু মুসলমানদের বিকলাঙ্গ করার জন্য সবকিছুই করা হচ্ছে।

ভেবে দেখুন, দু’বছর আগে কায়রো শহরে কয়টা পতিতালয় ছিল, আর এখন কটা? বিত্তশালী পরিবারের তরুণ তরুণীরা অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনায় ডুবে যায়নি?

আমাদের পাঠানো খ্রিস্টান মেয়েরা মুসলমানের ছদ্মবেশ নিয়েছে। হত্যা করাচ্ছে। কায়রোর স্থানে স্থানে এখন আকর্ষণীয় জুয়ার আখড়া। দুটো মসজিদে রয়েছে আমাদের পাঠানো ইমাম। ওরা ইসলামের রূপ পাল্টে দিচ্ছে। জেহাদের তাৎপর্য ব্যখ্যা করছে ভিন্ন ভাবে।

ওখানে আলেমের ছদ্মবেশ নিয়ে আছে আমাদের বেশ কিছু লোক। ওরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বুঝাচ্ছে। বন্ধু এবং শক্রর ধারণা পাল্টে দিচ্ছে। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, ক’বছর পর ওরা নিজেরা মুসলমান বলে গর্ব করলেও ওদের মনমানসিকতায় থাকবে খ্রিস্টানদের সভ্যতা সংস্কৃতি, কথা বলবে আমাদেরই ভাষায়, চিন্তা করবে আমাদের মস্তিষ্ক দিয়ে |

সালাহউদ্দীনের গোয়েন্দারা অত্যন্ত সতর্ক, রজব বলল, ‘গোয়েন্দা প্রধান আলীকে শেষ করতে পারলে আয়ুবী অন্ধ এবং বধির হয়ে যাবে।’

এর অর্থ আপনি নিজে কিছুই করতে পারছেন না! কোনার্ড বলল, একজন সরকারী কর্মচারীকেও আপনি হত্যা করতে পারছেন না। এতটা বুদ্ধিহীন হলে আমাদের লোকদেরকেও ধরিয়ে দেবেন। ওরাও মারা পড়বে, অহেতুক নষ্ট হবে আমাদের সম্পদ।

ঠিক আছে, এ কাজ আমি নিজেই করব। ঘাতকদলের সাথে কথা বলেছি, ওরা সালাহউদ্দীনকে হত্যা করতে প্রস্তুত।

আপনি সুদানের দিক থেকে মিসর সীমান্তে অশান্তি সৃষ্টি করবেন। কোনার্ড বললেন, ‘দেশের ভেতরে আমরা ওদের সভ্যতা সংস্কৃতি ধ্বংস করার তৎপরতা চালাব। আরবের কয়েকজন আমীর ওমরাকে আমরা হাত করে নিয়েছি। মুসলমানদের মধ্যে এখন দু’টো লোকই বেঁচে আছে, নুরুদ্দীন জংগী এবং আয়ুবী। ওদের শেষ করতে পারলে পৃথিবী থেকে ইসলামের সূর্য ডুবে যাবে। তবে আপনাদেরকে অটল থাকতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখেম, এরপর মিসর হবে আপনাদের।

এভাবে আলাপ চলল দীর্ঘক্ষণ। আয়ুবীকে প্রতিহত করার বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়া হল। বিদায়ের সময় রজবের হাতে তুলে দেয়া হল তিনটে অনিন্দ্যসুন্দরী যুবতী। দেয়া হল প্রচুর স্বর্ণমূদ্রা। কায়রোর দু’জন সম্মানিত ব্যক্তির ঠিকানা দিয়ে বলা হল, ‘মেয়ে তিনটিকে গোপনে তাদের কাছে পৌছে দেবেন।

দু’জনের একজন ফয়জুল ফাতেমী। –

‘মেয়েদের কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তিনি জানেন। মেয়েরাও জানে কি করতে হবে উদের। ওরা কয়েকটা ভাষায় পারদর্শী।

বিদায় নিল রজব। সাথে তিনটে মেয়ে এবং দশজন সৈনিক।

আংগুক গোত্রের কাছে যাচ্ছে সে। ওদের দেবতা এবং মন্দির ভেঙেছেন আয়ুবী। মিসর থেকে পালিয়ে এখানেই আশ্রয় নিয়েছিল রজব। জংগী কাফ্রীদের নিয়ে মিসর আক্রমণ করেছিল, সফল হয়নি। গোত্রের বেশীর ভাগই মারা গেছে।

এখনও পাহাড় ঘেরা স্থানকে ওরা দেবতার আশ্রম মনে করে। ভয়ে কেউ ভেতরে ঢোকেনা। গোত্রের ধর্মীয় গুরু আরও তিনজনকে নিয়ে দেবতার আবাসে গেলেন। নিজকে নিজে পুরোহিতের স্থলাভিষিক্ত করলেন। এ তিনজন তার দেহরক্ষী। দেবতার আশ্রমে কেবল এ চারজনই আসা যাওয়া করত।

পাহাড়ের এক নিভৃত স্থানে আস্তানা গাড়ল রজব। ওখান থেকেই একদিন ফিলিস্তিন অভিমুখে ছুটল।

আংগুক গোত্র ছিল ভীত সন্ত্রস্ত্র। দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া যায়নি, পুরোহিত মারা গেছে, ভেঙে ফেলা হয়েছে দেবতার বিগ্রহ। তাছাড়া দেবতার অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিহত হয়েছে হাজার হাজার। যুবক। ঘরে ঘরে মাতম।

কেউ কেউ ভাবতে লাগল, যে দেবতার আশ্রম ভেঙে দিতে পারে, সে নিশ্চয়ই বড় দেবতা ‘

বর্তমান পুরোহিত গোত্রের অবস্থা দেখে বললেন, ‘দেবতাদের কুমীর ক্ষুধার্ত। ওদের খাবারের ব্যবস্থা কর।’

কাফ্রীরা উট, ভেড়া, ছাগল পাঠিয়ে দিল। কিন্তু মানুষের অন্তর থেকে দেবতাকে নাখোশ করার ভয় দূর হল না।

এক রাতে পুরোহিত গোত্রের সবাইকে একত্রিত করলেন পাহাড়ের বাইরে। বললেন, ‘আমি দেবতাদের সাথে কথা বলেছি। সময়মত বলি না দেয়ায় এ বিপদ এসেছে। দেবতারা বলেছেন, এক সংগে দু’টো মেয়ে বলি। দিলেই কেবল এ বিপদ দূর হবে। তা না হলে দেবতা কাউকে ছাড়বে না।

দুঃসাহসী যুবকেরা উঠে দাঁড়াল। মিসৱ থেকে তুলে আনবে দু’টো মুসলমান বা ফিরিংগী মেয়ে।

ফিলিস্তিন থেকে আসছে রজব। সাথে তিন যুবতী এবং দশজন সৈন্য। দীর্ঘ বিপজ্জনক সফর। সে আয়ুবীর ফৌজের বিদ্রোহী এবং পলাতক কমান্ডার। সীমান্তে পেট্রোল ডিউটি দিচ্ছে সুলতানের সৈন্য। ধরাপড়ার আশংকা রয়েছে। অনেক ঘুরপথ দিয়ে চলছে সে। খাবার এবং

ক’দিন পর ওরা দেবতার আশ্রম পাহাড়ে পৌছল। এর একদিন আগে পুরোহিত মেয়ে বলি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

রজব প্রথমেই দেখা করল পুরোহিতের সাথে। তিনটে সুন্দরী যুবতী দেখে পুরোহিতের চোখ ঝলসে উঠল। বলির জন্য উপযুক্ত। মেয়েদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল পুরোহিত। রজব বলল, ‘এদেরকে বিশেষ উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে।”

তিনদিকে পাহাড় ঘেরা এক মনোরম জায়গায় মেয়েদের নিয়ে গেল রজব। তাবু টানাল। সুযোগ পেলেই ওদেরকে কায়রো পাঠিয়ে দেবে। পথে কোন ঝামেলা হয়নি, নিরাপদেই পৌছতে পেরেছে এ খুশীতে রাতে উৎসব জমাল। জমল মদের আসর। খ্রিস্টান সৈন্যরাও অংশ নিল এতে। পান করল মেয়েরাও।

মধ্যরাত। ঘুমিয়ে আছে সবাই। একটা মেয়ের হাত ধরে নিজের তাবুর দিকে যেতে চাইল রজব। উদ্দেশ্য বুঝে ফেলল মেয়েটি। বেঁকে বসল। বলল, আমি পতিতা নই। এসেছি ক্ৰশের দায়িত্ব পালন করার জন্য। আপনার সাথে মদপান করতে পারি, কিন্তু বাজে প্রস্তাবে সাড়া দিতে পারি না।”

রজব হেসে ওকে নিজের দিকে আকর্ষণ করল, হাত ছাড়িয়ে নিল মেয়েটা। রজব বাড়াবাড়ি করতেই ও হাত ছাড়িয়ে এক দৌড়ে সংগী। মেয়েদের কাছে ছুটে গেল। তাবু থেকে বেরিয়ে এল অন্য দু’জন। ওরা বেশ্যা মনে না করেন।’

ক্ষেপে গেল রজব। তোমরা কেমন সতী আমি জানি। তোমাদের পেশাই হল বদমাইশি আর বেশ্যাগিরি।

দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজনেই কেবল আমরা এ পেশা ব্যবহার করি। ভোগবিলাসের জন্য করিনা।

রজব কোন কথা শুনতে নারাজ। তাকে বুঝাতে না পেরে মেয়েরা বলল, আমাদের সাথে দশজন সৈন্য আছে। আমাদের হেফাজতের জন্য এসেছে ওরা। কাল ওদের ফিরে যাবার কথা। কিন্তু আমরা প্রয়োজন মনে করলে ওদের রেখে দিতে পারি বা বাড়বাড়ি করলে আমরা ফিরেও যেতে পারি।

হুমকিটা ঠিকমতই কাজে লাগল, চুপ মেরে গেল রজব। কিন্তু চেহারা দেখে মনে হল সে মেয়েদের সহজে ছাড়বে না।

পরদিন সৈন্যদের বিদায় করে দিল সে। দিন গড়িয়ে গেল। সন্ধ্যায় মেয়েদের সাথে গল্প করছিল রজব, পুরোহিত এলেন চারজন কাফ্রী সাথে নিয়ে। রজবকে বললেন, “আমাদের দেবতা অসন্তুষ্ট। তিনি দু’টি ফিরিংগী অথবা মুসলমান মেয়ের রক্ত চেয়েছেন। এ মেয়েরা বলির জন্য উপযুক্ত। এখান থেকে দু’টো মেয়ে আমাদের দিতে হবে।’

রজবের মাথায় বাজ পড়ল যেন। বলল, ‘এদের বলি দেয়ার জন্য আনা হয়নি, এদের দিয়ে অন্য কাজ করাব। যারা তোমাদের অপমান করেছে তাদের হত্যা করব এদের সাহায্য নিয়ে।”

তুমি মিথ্যে বলছ। পুরোহিত বলল, তুমি ভোগের জন্য এদের এনেছ। এদের দু’জনকে অবশ্যই আমরা বলি দেব।’

রজব অনেক যুক্তি পেশ করল, কোন কিছুই শুনতে রাজি নন পুরোহিত। দেবতা তার মনমানসিকতা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তিনি এগিয়ে পর পর দু’টো মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, “আংগুকের মুক্তি এ দু’টো মেয়ের হাতে।

চলে যাওয়ার জন্য ফিরে দাঁড়ালেন তিনি। রজবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মেয়েদের নিয়ে পালানোর চেষ্টা করোনা। তুমি যেখানেই যাবে, খুজে বের করে ফেলবে আমাদের ছেলেরা।

চলে গেলেন পুরোহিত। মেয়েরা ওদের ভাষা বোঝেনি। ওরা সবাই রজবকে ঘিরে দাঁড়াল। বলল, কি বলেছে কাফ্রীটা।

রজব বলল, ‘পুরোহিত দেবতাদের নামে বলি দেয়ার জন্য তোমাদের দু’জনকে চেয়েছে।’

একটা মেয়ে বলির ব্যাপারে জানতে চাইলে সে বলল, মাথা কেটে রোদে শুকাবে। দেহটা ফেলে দেবে ঝিলে। ওখানে অনেক কুমির রয়েছে।’

বিবর্ণ হয়ে গেল মেয়েদের চেহারা। বলল, আমাদেরকে রক্ষা করার জন্য আপনি কি চিন্তা করেছেন?

‘আমি অনেক বুঝিয়েছি, পুরোহিত কিছুই শুনতে চাচ্ছে না। এখন তার দয়ার ওপর নির্ভর করছে আমাদের জীবন। ওরা বলছে, আমার ফৌজে ওরা যোগ দেবে, তবে তার পূর্বে দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে হবে।

রজবের কথায় ওদের সন্দেহ হল, পুরোহিতকে খুশী করতে চাইবে লোকটা। ওদের বাঁচানোর চেষ্টা সে করবে না। গত রাতেই তাকে চিনে ফেলেছে ওরা। লোকটা ওদের একটু শাস্তুনাও দেয়নি।

মেয়েরা তাবুতে ফিরে গেল। ভাবতে লাগল কি করা যায়। দেবতাকে খুশী করতে বা রজবের ভোগের সামগ্রী হতে ওরা এখানে আসেনি। উদ্দেশ্যহীনভাবে মরতেও চায়না ওরা। সিদ্ধান্ত নিল, ওরা পালিয়ে যাবে। কিন্তু পালিয়ে ফিলিস্তিন পর্যন্ত যাওয়া সহজ নয়। তবু আত্মরক্ষার জন্য ওদেরকে এ ঝুঁকি নিতেই হবে। ওরা শুধু সুন্দরী নয়, জাতির খেদমতের জন্য দীর্ঘ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে ওদের। এভাবে মরার জন্য ওদের ট্রেনিং দেয়া হয়নি।

রাত কেটে গেল। দিনের বেলায় ওরা ঘোড়ার আস্তাবল দেখল। যে পথে এসেছে তাও দেখল খুটিয়ে খুটিয়ে। পুরোহিত এসে রজবকে কি বলে চলে গেল।

রজব মেয়েদের বলল, পুরোহিত আগামীকাল তোমাদের নিয়ে যাবে। বাধা দিলে আমাকে হত্যা করে ঝিলের কুমির দিয়ে খাওয়াবে বলে শাসিয়ে গেছে।’

মেয়েরা পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ কথা রজবকে বলল না।

মরুভূমিতে এত সবুজ কোথেকে এসেছে? কি সুন্দর পরিবেশ। আমাদের একটু ঘুরিয়ে দেখাবেন? বলল শায়লা, মেয়েদের একজন।

রজব ওদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাতে লাগল। হাটতে হাটতে চলে এল ঝিলের কাছে। কিণারে শুয়ে আছে পাঁচটি কুমীর। পানিতে দুৰ্গন্ধ। এক যুবতী বলল, ঝিল কি পাহাড়ের ভেতরে চলে গেছে?

একসঙ্গে তাকাল সবাই। কুমীর দেখে তিনটি মেয়ে একত্রে চিৎকার করে উঠল।

রজব বলল, বলি দেয়া মেয়েদের দেহ এবং গোত্রের অপরাধীদের দেহ এসব কুমীরকে খেতে দেয়া হয়।

এ ভয়ংকর দৃশ্য দেখে ওদের পালানোর চিন্তা আরো দৃঢ় হল। রজবের সাথে ঘুরে ফিরে পালানোর সম্ভাব্য পথ দেখে নিল ওরা।

সুসংবাদ শোনাতে আশ্রম ছেড়ে গাঁয়ে ছুটে গেলেন পুরোহিত। লোকদের ডেকে বললেন, “তোমাদের জন্য সুসংবাদ। আজ থেকে চার রাত পর ভরা পূর্ণিমায় দেবতার আশ্রমে দুটি ফিরিঙ্গী মেয়ে বলি দেয়া হবে। বলিদান শেষ হলেই মন্দির মেরামত করব। এরপর যারা আমাদের দেবতাদেরকে অপমান করেছে তাদের উপর প্রতিশোধ নেব।”

মধ্যরাত। মেয়েগুলো রজবের হাতে তুলে দিচ্ছে মদের গ্রাস। একটার পর একটা গ্রাস নিঃশেষ করে চলেছে রজব। অতিরিক্ত মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে গেল, ভোর পর্যন্ত জাগার সম্ভাবনা নেই।

নিজেদের তাবুতে ফিরে গেল মেয়েরা। সফরের প্রস্তুতি নিতে লাগল। জিন বাধল ঘোড়ার পিঠে, আলগোছে সওয়ার হয়ে দিনের দেখা পথ ধরে এগিয়ে চলল।

কাফ্রীদের চারজন পাহারাদার খানিক দূরে ঘুমিয়ে আছে। ওরা জানত, এখান থেকে পালানোর সাহস কারো নেই। পালিয়ে গেলেও হারিয়ে যাবে বিশাল মরুভূমির বিস্তারে। কিন্তু শ্যামল সবুজ এক ভয়ংকর কারাগার থেকে বেরিয়ে গেল মেয়েরা।

যে পথে রজব ওদের এনেছিল সে পথ ধরেই ওরা ফিয়ে যাচ্ছিল। ওরা ছিল মেধাবী, বুদ্ধিমতি। ওদের ছিল সামরিক ট্রেনিং। তাই ওরা ভাবল, কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কিন্তু ওরা জানত না উষর মরুভূমির সীমাহীন বিস্তৃতিতে ধু ধু বালুর সমুদ্রে হারিয়ে যেতে সময় লাগে না। আদিগন্ত বালির রাজ্যে একজন বুদ্ধিমান মানুষও অবলীলায় সীমানায়। এজন্যই লোকেরা মরুভূমিতে ভ্রমণের সময় দলবদ্ধভাবে বের হয়। মরুভূমির এ বিপদ প্রতিরোধের কোন অস্ত্র ওদের হাতে ছিল না।

নিশীথ রাতের নিস্তব্ধতা মাড়িয়ে কিছু দূর পর্যন্ত ধীরে ধীরেই পথ চলল ওরা। এরপর ঘোড়া ছুটাল তীব্র গতিতে। রাতের উত্তাপহীন মরু বাতাস কেটে যতদূর সম্ভব দ্রুত এগিয়ে চলল ওরা। অনেক দূর গিয়ে গতি কমাল। ততক্ষণে রাত একদিকে হেলে পড়েছে। কমে এসেছে ধরা পড়ার আশঙ্কা। এরপর ঢিলেঢালা ভাবেই পথ চলল বাকী রাতভর।

ভোরে সূর্য উঠল। চারপাশে বালিয়াড়ী। সামনে দূরে দেখা যাচ্ছে উচু উচু পাহাড়। কোন দিকে কোন পথ নেই, যেদিকে চোখ যায় কেবল অন্তহীন বালু আর বালু। ওরা সূর্য দেখে দিক ঠিক করে উত্তরমুখো এগিয়ে চলল।

ঘোড়াগুলো তৃষ্ণাৰ্ত। ওদের পিঠে বাধা মশকে যে পানি আছে তাতে বড়জোর একদিন চলবে। মেয়েরা চারদিক তাকিয়ে কোন খেজুর বাগান বা ওয়েসিস পাওয়া যায় কিনা খুঁজতে লাগল।

আকাশে উঠে এসেছে সূর্য। তাপ বাড়ছে, উত্তপ্ত হচ্ছে মরুর পরিবেশ। কোন দিকে কোন ছায়া নেই, খর্জুর বীথি নেই, একফোটা পানির চিহ্ন নেই কোথাও।

মাথার উপরে উঠে এসেছে সূর্য। রজবের ঘুম তখনো ভাঙ্গেনি। তিনজন কাফ্রীকে সাথে নিয়ে তাবুতে এলেন পুরোহিত। প্রথমেই গেলেন মেয়েদের তাঁবুতে। নেই। ফিরে এসে রজবকে জাগালেন।

মেয়েরা কোথায়? পুরোহিত বললেন, ‘মেয়ে দু’টোকে আমার হাতে তুলে দাও।

‘এমন মূল্যবান মেয়েগুলোকে নষ্ট করবেন না।

কিন্তু পুরোহিত নিজের সিদ্ধান্তে অটল। চিৎকার করে বললেন, “মেয়েরা কোথায়?’

তাবু থেকে বেরিয়ে এল রজব। ডাকল মেয়েদের। মেয়েদের তাবু থেকে কোন জবাব এল না। এগিয়ে গিয়ে মেয়েদের তাবুর ভেতর উকি দিল। তাকাল এদিক ওদিক। না, কোথাও নেই ওরা।

দৃষ্টি ফেলল আস্তাবলে, জিনসহ তিনটি ঘোড়া গায়েব। ফ্যাকাশে হয়ে গেল রজবের চেহারা। পুরোহিতকে বলল, ‘ওরা তোমাদের ভয়ে পালিয়ে গেছে। তোমরা আমার মহা মূল্যবান মেয়েগুলোকে তাড়িয়ে দিয়েছ।

তুমিই ওদের ভাগিয়ে দিয়েছে। পুরোহিত সংগীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওকে বেঁধে ফেল। ও আবার আংগুকের দেবতাদেরকে অসন্তুষ্ট করেছে।’

পুরোহিতের সংগীরা রজবের দিকে এগিয়ে গেল। পুরোহিত একজনকে বললেন, ‘গাঁয়ে যাও। দ্রুত ঘোড়া ছুটাতে পারে এমন যুবকদেরকে এখনি এখানে ডেকে নিয়ে আস। মেয়েরা নিশ্চয়ই এখনো বেশী দূর যেতে পারেনি। ওদের পিছু নাও।

শত অনুনয় বিনয় সত্ত্বেও রজবকে পিছমোড়া করে গাছের সাথে বেঁধে ফেলল ওরা। তার সংগীদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া হল। বলা হল, তাবুর বাইরে পা বাড়ালেই হত্যা করা হবে।

একটুপর জন দ্রুতগামী অশ্বারোহী মেয়েদের পেছনে ছুটল। বালিতে ঘোড়ার ক্ষুরের চিহ্ন স্পষ্ট। ট্রেইল ধরে এগিয়ে চলল ওরা। আট দশ ঘন্টা আগে পালিয়েছে মেয়েরা। কিন্তু কাফ্রীরা মরু সন্তান। চরম কষ্ট সহিষ্ণু উপজাতি। ভয়ংকর বিপদ মোকাবেলা করেই জীবন কাটে ওদের। ধুলোঝড় সৃষ্টি করে ওদের রেখে যাওয়া ট্রেইল ধরে ঘোড়া ছুটল তীব্র গতিতে।

সামনে ট্রেইল নেই। বালু উড়ে ঘোড়ার পদচিহ্ন মুছে দিয়ে গেছে। তবুও অনুমান করে দ্রুত এগিয়ে চলল ঘোড়সওয়ার দু’জন।

চার ঘন্টা একটানা ঘোড়া ছুটিয়েছে ওরা। হঠাৎ দূর দিগন্তে দেখা গেল ধুসর লালচে বালু ধীরে ধীরে উপরে উঠে যাচ্ছে। আতংকিত দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে চাইল ওরা। ছুটে আসছে মরু ঝড় সাইমুম।

ঘোড়া ঘুরিয়ে পেছন দিকে ছুটতে লাগল ওরা। প্রাণপনে সরে যেতে চাইছে ওরা সাইমুমের ছোবল থেকে।

সাইমুমের প্রচন্ডতা ওদের চাইতে আর কেউ বেশী জানে না। এ ঝড় নিমেষে লন্ডভন্ড করে দেয় বালির পাহাড়। কেউ থেমে গেলে বা বসে পড়লে তার উপর মুহুর্তে তৈরী হয়ে যায় আরেকটা বালির পাহাড়। ছুটতে থাকলে উড়িয়ে নিয়ে যায় মাইলকে মাইল দূরে। পাথুরে কোন পাহাড়ের যায়।

আশপাশে তাকাল ওরা। ঝড় থেকে রক্ষা পাওয়ার মত কোন শক্ত পাহাড় নেই ধারে কাছে। ওরা যেতে চাচ্ছিল সামনের পাহাড় শ্রেণীতে, যা এখনও অনেক দূরে।

ঝড় পৌছে গেছে দেবতার পার্বত্য আবাসে। কুমীরগুলো আশ্রয়, নিয়েছে পাহাড়ের গর্তে | মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে গাছগাছালী। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পুরোহিত চিৎকার করে বলছেন, “আংগুকের দেবতা! তোমার এ অভিশাপ তুলে নাও। আমরা খুব শীঘ্রই দু’টাে রূপসী যুবতী তোমার উদ্দেশ্যে বলি দেব।’

পুরোহিত ঝড়কে দেবতার অভিশাপ মনে করছিলেন।

মেয়ে তিনটেও ঝড়ের কবলে পড়ল। আশ্রয় নেয়ার কোন আড়াল ছিল না। ওরা কাফ্রীদের নাগাল থেকে অনেক দূরে এক বিজন মরুতে। ঝড়ের আঘাতে আতংকিত ঘোড়া এলোপাথাড়ি ছুটতে লাগল। সামরিক বাহিনীর ঘোড়া, শত বিপদেও তাই ওরা বিচ্ছিন্ন হলো না। এক সাথে ছুটছে ঘোড়াগুলো, কোথায় গিয়ে থামবে জানেনা ওরা।

সাইমুম সরাসরি ওদের ওপর আঘাত হানেনি। নিস্তেজ একটি শাখার ঝাপটা খেয়েই মেয়েগুলোর অবস্থা কাহিল। কাহিল ঘোড়াগুলোও। ঘোড়াগুলো যেমন দ্রুত ছুটতে পারছে না, তেমনি মেয়েরাও ওদের সামলানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

তৃষ্ণার্ত ঘোড়াগুলো মাঝরাত থেকে একনাগাড়ে ছুটেছে। ক্ষুধা তৃষ্ণায় দুর্বল হয়ে পড়েছে ঘোড়াগুলো। দৌড়াতে দৌড়াতে উপুড় হয়ে পড়ে গেল একটা ঘোড়া সাথে সাথে ছিটকে পড়ল আরোহিনী। ঘোড়াটা ডিগবাজি খেয়ে পড়ল গিয়ে মেয়েটা ওপর। উপরে ঘোড়া, নীচে মেয়েটা। বুঝতে পারল মারা যাচ্ছে ও।

অন্য ঘোড়া দুটাে খানিক এগিয়ে গেল। ওদের থামাতে চাইল মেয়েরা। টেনে ধরল লাগাম। হঠাৎ গতি পড়ে যাওয়ায় সামনের দিকে বুকে পড়ল আরেকটা মেয়ে। ঘোড়ার জিন ঢিলা হয়ে কাত হয়ে গেল একদিকে। মেয়েটা পড়ে গেল নীচে। পা দানিতে আটকে গেল বাম পা। দৌড় থামালেও ঘোড়াটা তার হাঁটা থামাল না, মেয়েটা মাটির সাথে ‘ হেঁচড়াতে থাকল।

তৃতীয় মেয়েটা ওদের কোন সাহায্য করতে পারছে না। ওর নিজের। ঘোড়াও বশে নেই, এলোমেলো ছুটছে সে। কানে ভেসে আসছে মেয়ে দুটাের হৃদয় ফাটা চিৎকার। দীর্ঘক্ষণ এ চিৎকার ধ্বনি তাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। এক সময় থেমে গেল চিৎকার। একটা মেয়ের লাশ ঘোড়ার সাথে হিচড়ে যাচ্ছিল, সেদিকে বোবার মত তাকিয়ে রইল ও ভয়ার্ত ও আতংকিত দৃষ্টি। দুঃসাহসী গোয়েন্দা হলেও ও একটা মেয়ে। হঠাৎ কি হল, নিরবতা ভেঙে সেও চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।।

তার চিৎকার শুনেই কিনা আল্লা মালুম, হঠাৎ থেমে গেল সামনের ঘোড়াটা। ও নিশ্চিত জানে, মরে গেছে তার বান্ধবী। তবু কি এক অব্যক্ত আশা নিয়ে সে তাকিয়ে রইল ওদিকে। জলে ভরে গেল চোখ। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে চাইল পেছন দিকে। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, ঘোড়ায় চাপা পড়া বান্ধবী বা ঘোড়া কিছুই দেখা গেল না সে অন্ধকারে।

তৃতীয় মেয়েটা এখন একা, নাম রেশমা। রেকাব থেকে পা খানিকটা পেছনে সরিয়ে নিল ও। বলগা ছেড়ে দিয়ে দু’হাত আকাশের দিকে তুলল মেয়েটা। চিৎকার করে বলতে লাগল, হে মহান প্ৰভু! হে আকাশের মালিক! আমায় ক্ষমা কর। পাপী আমি, পাপের সাগরে আকণ্ঠ ডুবে আছি। পাপ করার জন্যই এসেছিলাম দুনিয়ায়। বড় হয়েছি পাপের মধ্যে। খোদা আমার! আমি তখন খুব ছোট। বড়রাই আমাকে পাপের পথে টেনে এনেছে। পাপের প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় করেছে আমাকে। ওরা আমায় বলেছে, যাও, এ চোখ ধাধানো রূপ আর দেহ দিয়ে মানুষকে নষ্ট কর, মিথ্যা কথা বল, একজনের হাত দিয়ে আরেকজনকে হত্যা করাও। প্রতারিত কর মানুষকে। ওরা বলেছে, এ হচ্ছে ক্ৰশের পক্ষে পবিত্র দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করলে তুমি স্বর্গ পাবে।

ও প্রলাপ বকছিল আর চিৎকার করছিল পাগলের মত। শ্লথ হয়ে এল ঘোড়ার গতি। কাঁদতে কাঁদতে ও বলল, “তোমার কাছে যে ধর্ম সত্য, আমাকে তার মাজেযা দেখাও প্রভু। আমি তোমার সত্য দ্বীনকে চিনতে চাই। মৃত্যুর আগে একবার দেখতে চাই তোমার মহিমা।

তার বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। অনুশোচনায় পিষ্ট হচ্ছে তার কোমল হৃদয়। সে কোন ধর্মের অনুসারী মৃত্যু ভয় তাও ভুলিয়ে দিয়েছে। সে শুধু  ভাবছে তার পাপে ভরা জীবনের কথা। চেতনার পরতে পরতে সে পাপের অনুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। ও ভাবছে, আমি কি কেবলই পুরুষের ভোগের সামগ্ৰী? মানুষকে প্রতারিত করার জন্যই কি আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে? হায়! এখন আমাকে দেখার আর কেউ নেই।

মাথা ঝাকিয়ে তন্দ্রা দূর করে বিলাপের সুরে ও বলতে লাগল, হে খোদা, আমাকে সাহায্য কর। এখনি আমি মরতে চাই না।

হঠাৎ ওর মনে হল ও এক পিতৃহারা। মৃত্যু সামনে এলে মানুষ অতীতে ফিরে যায়। এক যুবতী তার হারানো অতীতে ফিরে যেতে চাইছিল। কিন্তু ওখানে কিছুই নেই। মা নেই, বাবা নেই, নেই কোন ভাইবোন। ওর শুধু মনে আছে, খ্রিস্টানরা ওকে লালন পালন করেছে। ওরাই এ পথে নিয়ে এসেছে ওকে। ও এক মনকাড়া প্রতারণার যন্ত্র।

নিজের উপর ঘৃণা হল ওর ও ক্ষমা চাইছে, মুক্তি চাইছে। আবার তন্দ্রা এসে জাপটে ধরল ওকে। ঘোড়াটা ধীরে ধীরে হাটছে। থেমে গেছে ঝড়। মরুভূমিতে নেমে এসেছে রাতের আঁধার। প্রকৃতির সে সীমাহীন বিশালতা, অন্ধকারে রাতে ঘোড়ার উপর পরে আছে এক অসহায় মেয়ে।

সীমান্ত রক্ষার জন্য বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়েছিলেন সুলতান আয়ুবী। সীমান্ত রক্ষীদের হেডকোয়ার্টার ছিল মিসর এবং সীমান্তের চার পাঁচ মাইল ভেতরে এক পাহাড়ের কোল ঘেষে। ওধানে ছিল তিন প্লাটুন সৈন্য। থাকত তাবু খাটিয়ে। সীমান্তের বিভিন্ন চেক্টপোষ্টে পাঠিয়ে দেয়া হত সৈনিকদের। এক চেকপোস্ট থেকে আরেক চেকপোস্ট পর্যন্ত টহল বাহিনী নিয়মিত টহল দিয়ে বেড়াত।

আজকের ঝড়ে তাবুগুলোর যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। উট ঘোড়া সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল সৈন্যরা। ঝড় থামার পর ওরা তাবু মেরামতে লেগে গেল। ওদের কমান্ডার একজন তুর্কি। আহমদ কামাল। চমৎকার দেহের গড়ন। ফর্সা আকর্ষণীয় চেহারা।

ঝড় থামতেই তাবু থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মালপত্র এবং উট ঘোড়া দেখলেন। দিগন্ত ফর্সা হয়ে গেছে। একজন সৈনিক দক্ষিণ দিকে ইশারা করে বলল, কমান্ডার, ওই দিকে দেখুন, মনে হয় কোন সওয়ারী।

হ্যা, তাই। দূরে নজর দিয়ে বলল কমান্ডার, এবং মনে হয় সওয়ারী কোন পুরুষ নয় মহিলা।

এ সওয়ারী ও ঘোড়া কি আমাদের?

‘আমাদের সেনাবাহিনীতে এখনও কোন মেয়ে ভর্তি করা হয়নি। দেখছনা চুল ছড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি দু’টো ঘোড়া নিয়ে এসো, অন্ধকার গ্রাস করার পূর্বেই ওর কাছে পৌছতে হবে আমাদের।

মেয়েটাকে নিয়ে ঘোড়াটা তখন ওদের দিকেই আসছিল। ওরাও ঘোড়া ছুটাল ওদিকে। সামনের পথটুকু চোরাবালিতে ভরা। তাই দ্রুত ছুটতে পারছিল না। মেয়েটার কাছে পৌছতে পৌছতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল।

সিপাইকে সাথে নিয়ে কমান্ডার যখন ওখানে পৌছল তখন রাতের অাঁধার নেমে এসেছে। ঘোড়াটা মাথা নুইয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে। ঘাণ শুকে শুকে যাচ্ছে তাবুর দিকেই। আরোহী এক যুবতী। মাথা নোয়ানো। ঘোড়ার ঘাড়ের খানিকটা পেছনে অবিন্যস্ত চুল ছড়িয়ে সামনের দিকে বুকে আছে। অজ্ঞান।

কমান্ডার রেকাব থেকে মেয়েটার পা ছাড়িয়ে পাজাকোলা করে নামিয়ে আনলেন। সিপাইকে বললেন, বেঁচে আছে, মনে হয় ফিরিংগী।

তুমি ওর ঘোড়াটাকে সামলাও।

মেয়েটাকে নিজের ঘোড়ায় তুলে ওরা যতটা সম্ভব দ্রুত ক্যাম্পে ফিরে এল। ওকে এক তাবুতে নিয়ে গেলেন কমান্ডার। চুলে বালি লেগে আছে। পানির ঝটকা দিলেন মেয়েটার চোখে মুখে। এরপর ফোটা ফোটা পানি দিতে লাগলেন মুখের ভেতর।

চোখ খুলল মেয়েটা। তাকাল আহমদ কামালের দিকে। কয়েক মুহূর্ত হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন কমান্ডার। রেশমা বিহবলতা কাটিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কি এখন ফিলিস্তিন?”

এদিক ওদিক মাথা দুলিয়ে কমান্ডার বোঝালেন, এ ভাষা তিনি বোঝেন না। মেয়েটা আরবীতে প্রশ্ন করল, “তুমি কে? আমি এখন কোথায়?’

আমি মুসলিম ফৌজের সাধারণ এক কমান্ডার আহমদ কামাল। বললেন, ‘তুমি এখন মিসরে।’

আতংকে বিস্ফারিত হল মেয়েটার চোখ। যেন এখনি জ্ঞান হারাবে আবার। আহমদ কামাল বললেন, ভয় নেই, সুস্থির হও, নিজকে সংযত কর।”

আহমদ কামালের কথায় তার ভয় ও আতংক মোটেই কমল না, বরং সে আরো অবাক হলো। তার সে অবাক করা ভাব ফুটে উঠল চেহারায়।

আহমদ কামাল আবার বললেন, ‘বুঝেছি, তুমি ফিরিংগী। কিন্তু এখন তুমি আমার অতিথি। ভয়ের কোন কারণ নেই, আমি একজন মুসলমান। মুসলমান অসহায় নারীদের ইজ্জত করতে জানে। তুমি যে ধর্মেরই হওনা কেন, তোমার ইজ্জত আব্রুর হেফাজত করা এখানকার প্রতিটি সৈনিকের পবিত্র কর্তব্য।’

কমান্ডার একজন সেপাইকে ডাকলেন। বললেন, ‘এর জন্য খাবার এবং পানি নিয়ে এস।

পানি আনতেই মেয়ে্টা পানির গ্লাস লুফে নিয়ে ঢকধক করে পানি পান করতে শুরু করল। আহমদ কামাল তার ঠোট থেকে গ্রাস সরিয়ে দিলেন।

আস্তে। আগে খেয়ে নাওঁ, পরে পানি পান কর।’

মেয়েটা খাবার খেল, পানি পান করল। চেহারায় ফিরে এল দ্যুতি।

কমান্ডার ওর গোসলের ব্যবস্থা করলেন। গোসল শেষে তাবুতে ঢুকল ও। তাবুটা ছিল কমান্ডার আহমদ কামালের। কোন তাবু খালি না থাকায় এখানেই এনে তুলেছিলেন তিনি ও যখন গোসল করছিল ততক্ষণে কমান্ডার পর্দা টানিয়ে তাবুটা দুভাগ করে নিলেন। ও তাবুতে ঢুকতেই পর্দা টেনে দিলেন তিনি।

ওর আতংক তখনো কাটেনি। ও জানে, এখন ও শক্রর আশ্রয়ে। এদের কাছে ভাল ব্যবহার আশা করা যায়না। শৈশব থেকেই ওকে বুঝানো হয়েছে মুসলমানরা হল পশু। নারীদের জন্য আস্ত জানোয়ার। এই সাথে ওর মনে ছিল কাফ্রীদের কুমীর এবং মরু ঝড়ের কবলে পড়ার দুঃসহ আতংক।

সংগী দুজনের ভয়ংকর মৃত্যু এখনও ওর চোখে ভাসছে। গোসল করার সময় ওর মনে হয়েছিল, সে এতটাই অপবিত্র যে পৃথিবীর সব পানি ঢাললেও তার সে অপবিত্রতা আর পরিষ্কার করা যাবে না।

এমন অসামান্য রূপবতী তরুণী কোন সাধারণ ঘরের মেয়ে হতে পারেনা, আহমদ কামাল ভাবলেন। এ ফিরিংগী তরুণী এই দুর্গম অঞ্চলে কি করে এল এ ভাবনা তোলপাড় করছিল তার মনে। জিজ্ঞেস করায় যদিও ও বলেছে, ঝড়ের কবলে পড়ে কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ও, কিন্তু সে কথা বিশ্বাস হয়নি কমান্ডারের। গত দু’দিনেও এ অঞ্চলে কোন কাফেলা দেখা যায়নি, গেলে টহল বাহিনীর নজরে তা অবশ্যই পড়তো।

আহমদ কামাল আবারো বললেন, ‘সত্যি করে বলো তো, তুমি, এখানে কি করে এলে?’

বলেছি তো, কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে।

যদি বলতে, তোমাকে অপহরণ করা হয়েছিল, ঝড় তোমাকে অপহরণকারীর কাছ থেকে বিছিন্ন করে দিয়েছে, তবুও বিশ্বাস করতাম। কিন্তু তুমি যা বলছে তা বিশ্বাস করা যায়না। এ স্রেফ মিথ্যা। আমার কাছে মিথ্যে বলার কোন দরকার ছিল না।”

কমান্ডারের সাথের সিপাইটা তাঁবুর পর্দা ঈষৎ ফাঁক করে একটা থলি এবং মশক দিয়ে বলল, “ঘোড়ার জিনের সাথে বাধা ছিল।

থলিটা খুলতে গেলেন কমান্ডার মেয়েটা চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কমান্ডার তা লক্ষ্য করে তার হাতে থলিটা দিয়ে বললেন, নিজেই খোল, খুলে দেখ সব ঠিক আছে কিনা।

মেয়েটা যেন বোবা হয়ে গেছে। থলিটা শিশুর মত পিছনে সরিয়ে নিল।

বলতে পারি না তুমি চলে যাও। কমান্ডার বললেন, তোমাকে আটকে রাখার অধিকারও আমার নেই। কিন্তু যে মেয়েটাকে বিজন মরুতে ঘোড়ার উপর অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে তাকে একা ছেড়ে দিতে পারি না। তোমার হেফাজত করা আমার মানবিক দায়িত্ব। বাড়ীর ঠিকানা বল, সেপাইদের দিয়ে পাঠিয়ে দেব। দেখে মনে হয় তুমি মিসরী নও, সুদানীও নও।

মেয়েটার চোখ থেকে আশ্র বেরিয়ে এল। পেছনের ভয়ংকর আতংকগুলো ওর স্নায়ু অবশ করে রেখেছে। ও থলি আহমদ কামালের দিকে ছুড়ে দিল। থলির মুখ খুললো কমান্ডার। কিছু খেজুর, মেয়েদের ব্যবহার্য সামান্য টুকিটাকি জিনিস এবং একটি পুটুলী পাওয়া গেল। পুটুলীর মধ্যে অনেকগুলো স্বর্ণ মুদ্রা। একটা স্বর্ণের চেইনের সাথে কাঠের তৈরী ক্রশ। কমান্ডার ওকে বললেন, এখানে আমার প্রশ্নের জবাব নেই।

এ স্বর্ণ মূদ্রাগুলো যদি তোমাকে দেই, আমাকে সাহায্য করবে?

মেয়েটা প্রশ্ন করল।

‘কেমন সাহায্য?’

আমাকে ফিলিস্তিন পৌছে দাও। কিন্তু কোন প্রশ্ন করোনা।

তোমাকে অবশ্যই ফিলিস্তিন পৌছে দেব তবে প্রশ্নও করব।

আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করলে অন্য পুরষ্কার পাবে।’

কি পুরষ্কার?

আমার ঘোড়া তোমায় দিয়ে দিব। তিন দিনের জন্য আমার হবে তোমার।”

আহমদ কামাল এর আগে এত স্বর্ণ একত্রে দেখেননি। দেখেননি এমন অনন্যা সুন্দরী যুবতী স্বর্ণমূদ্রার দিকে তাকালেন তিনি। চোখ ঘুরিয়ে নিলেন যুবতীর দিকে। তার রেশম কোমল চুল সোনার তারের মত ঝলমল করছে। তাকালেন ওর মায়াবী চোখের দিকে। ও চোখের যাদু এক সম্রাটকে আরেক সম্রাটের শক্রত্বে পরিণত করার জন্য যথেষ্ট। আহমদ কামাল এক স্বাস্থ্যবান যুবক, সীমান্ত রক্ষীদের কমান্ডার। তাকে জিজ্ঞেস করার বা বাধা দেয়ার কেউ নেই।

তিনি স্বর্ণমূদ্রা এবং ক্রস পুটুলীতে বাধলেন। থলিটা ফিরিয়ে দিলেন মেয়েটার হাতে।

বিনিময় কি খুব কম? মেয়েটার প্রশ্ন।

অনেক কম! ঈমানের মূল্য আল্লাহ ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না।”

মেয়েটা কিছু বলতে চাইল, কমান্ডার তাকে সে সুযোগ না দিয়ে বললেন, আমি আমার কর্তব্য এবং ঈমান বিক্রি করতে পারিনা। আমি আছি বলেই সমগ্র মিসর নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারে। মাস তিনেক পূর্বে করলে ওরা দখল করে নিত কায়রো। ওদের চাইতে তোমাকে বেশী ভয়ংকর মনে হচ্ছে। তুমিতো কোন গোয়েন্দা নও?’

‘না, বরং বল ঝড় এক অত্যাচারীর কবল থেকে তোমায় রক্ষা করেছে।”

মেয়েটার অর্থহীন জবাব শুনে কমান্ডার বললেন, ‘তুমি কে, কোথেকে এসেছ আমার জানার প্রয়োজন নেই। কাল তোমাকে কায়রোয় আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দেব। এর পর কি হবে তা তোমার আর তাদের ব্যাপার।”

অনুমতি পেলে খানিকটা বিশ্রাম করব। কাল কায়রো পাঠানোর সময় তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারব।

গতরাতে ঘুমুতে পারেনি রেশমা। দুঃস্বপ্লের মত ভয়ংকর এক ভ্রমণে ক্লান্ত, শ্ৰান্ত। শোয়ার সাথে সাথেই ও ঘুমিয়ে পড়ল। কমান্ডার তাকিয়ে রইলেন ওর ঘুমন্ত চেহারার দিকে। মেয়েটা ঘুমের মধ্যে বিড় বিড় করছে। মাথা নাড়ছে এদিক ওদিক। দুঃস্বপ্ন দেখছে হয়ত। স্বপ্নের মধ্যেই ও কাঁদছে। কমান্ডার সংগীদের বললেন, ‘মেয়েটাকে সন্দেহ হচ্ছে। ওকে কাল কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হবে।’

সংগীরা কমান্ডারকে জানত। যুবতীকে নিজের তাবুতে রেখেছেন দেখলেন। উন্নত জাতের। জিনের নীচে মিসরী ফৌজের চিহ্ন। মেয়েটা যে গোয়েন্দা এখন আর সন্দেহ নেই।

ঝড়ের কারণে মেয়েদের ধাওয়া করা থেকে কাফ্রীদের বিরত থাকতে হল। জীবন নিয়ে কোনমতে পৌছল দেবতার আশ্রমে। পুরোহিত বললেন, ‘মেয়েগুলো ঝড়ের কবলে পড়েছে। ওদের কেউ বেঁচে নেই। বলি দেয়ার সময়ও চলে গেছে। সুতরাং ওদের পিছু নেয়া বৃথা।

বিপদে পড়ল রজব। বার বার কাফ্রীরা প্রশ্ন করছিল, বল মেয়েরা কোথায়?’

সে শপথ করে বলতে লাগল, আমি জানিনা।

কাস্ত্রীরা এতে সন্তুষ্ট নয়। নির্যাতন শুরু হল। তরবাবীর মাথা দিয়ে খোঁচা মেরে একই প্রশ্ন করতে লাগল ওরা। অত্যাচার চলল রজবের সংগীদের উপরও। ওরা দেশ এবং জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার পরিণাম ভোগ করছিল। সারা রাত চলল এ নির্যাতন ঝাঝরা হয়ে গেল তিনটা দেহ।

কমান্ডারের তাবুতে ঘুমিয়ে ছিল মেয়েটা। সারাটা দিন ঘুমিয়েই কাটাল। জাগল সূর্য ডোবার খানিক আগে। আহমদ কামাল বলল, যাক বাবা, ঘুম তাহলে ভাঙল। দেখো, খাবার রাখা আছে। আবার ঘুমোনোর আগে চারটে খেয়ে নিও।’।

খেয়ে দেয়ে ও ঘুমিয়ে পড়ল আবার। কমান্ডার ঘুমিয়েছিল মেয়েটার কয়েক কদম দূরে। তাবুতে জুলছে প্রদীপের আলো। ধীরে ধীরে রাত গভীর হচ্ছে।

গভীর রাতে হঠাৎ মেয়েটা চিৎকার করে উঠল। চোখ খুলে গেল কমান্ডারের। মেয়েটা বসে আছে। কাঁপছে। চোখে মুখে আতংক।

কাছে এলেন কমান্ডার। মেয়েটা কমান্ডারকে জাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ওদের হাত থেকে আমাকে বাচাও। ওরা আমায় কুমীরের মুখে ছুড়ে দিবে। আমার মাথা কেটে ফেলবে ওরা।’

কারা?”

কাল কাফ্রীরা। মেয়েটার কষ্ট্রে ভীতি। ‘ওরা এখানেও এসেছিল।

কাফ্রীদের বলির কথা জানতেন কমান্ডার। ভাবলেন, একে হয়ত বলি দেয়ার জন্য নেয়া হচ্ছিল। মেয়েটাকে তিনি প্রশ্ন করলেন, “তোমাকে কি বলি দেয়ার জন্য অপহরণ করা হয়েছিল?’

ও কমান্ডারের গলা জড়িয়ে রেখেই বলল, “আমাকে এ নিয়ে আর প্রশ্ন করোনা। আমি দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম।”

কামাল তার ফ্যাকাশে চেহারা দেখে শান্তনা দিয়ে বললেন, এখান থেকে কেউ তোমাকে নিতে পারবে না। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।

আমার আর ঘুম আসবে না। তুমি আমার সাথে কথা বলতে পারবে? একা একা জেগে থাকতে পারব না। আমি তাহলে পাগল হয়ে যাব।”

ঠিক আছে যখন ভয় পাচ্ছ, তোমার সাথে আমিও জেগে থাকব।’

মেয়েটাকে শান্তনা দিয়ে বললেন, যতক্ষণ এখানে আছ ভয়ের কারণ নেই।’

তবে তিনি ওকে কাফ্রী বা নিজের সম্পর্কে আর কোন প্রশ্ন করলেন না। ওরা কথা বলে কাটিয়ে দিল বাকি রাতটুকু। কথার বেশীর ভাগ ছিল তুর্কিস্তান এবং মিসরের গল্প। এক সময় ও ঘুমিয়ে পড়ল।

সূর্য উঠার দেরী নেই। মেয়েটার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বসল সে। দেখল ফজরের নামায পড়ছেন আহমদ কামাল। ও নির্নিমেষ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রইল। নামাজ শেষ করে দোয়ার জন্য হাত তুললেন কমান্ডার। মেয়েটা এক দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘তুমি খোদার কাছে কি চেয়েছ? মুনাজাত শেষ হলে প্রশ্ন করল তরুণী।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top