২. সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কমান্ডো অভিযান

সবাই তাকাল মেয়েটার দিকে। তার মুখ থেকে কিছু শুনতে চায় সবাই। মেয়েটা বলল, তাকে আমার নাম বলেছি আছেফা। আশ্চর্য! এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক আমার ফাদে পা দিল! সে কখনও মদ খায়নি, আমি তাকে অভ্যস্ত করিয়েছি। ঘরে তার স্ত্রী সন্তান রয়েছে। ওদের ভুলেই গেছে সে। আল বারককে ফাসানোর বিস্তারিত কাহিনী বর্ণনা করল যুবতী।

বৃদ্ধ বলল, এ তিন মাসে ও আমাকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। সুলতান বিশাল সেনাবাহিনী তৈরী করেছেন। অর্ধেক থাকবে মিসরে, অর্ধেক খ্ৰীষ্টান রাজাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য বাইরে নিয়ে যাবে। তার লক্ষ্যস্থল ফিলিস্তিন। আল বারক বলেছে, আয়ুবী পরিকল্পনা নিয়েছে সর্ব প্রথম মুসলমান শাসক ও সামন্ত প্ৰভুদের ঐক্যবদ্ধ করার।’

“তার মানে আল বারক এখন আমাদের লোক?’

না। বৃদ্ধের জবাব, সে আয়ুবীর যেমন একান্ত অনুগত তেমনি এ মেয়েটার প্রতিও তার টান অপরিসীম।”

‘আমি সুলতানের একজন অন্ধ ভক্ত। ইসলামের ব্যাপারে আমি যেমন ভীষণ আগ্রহী তেমনি মুসলিম জাতির উন্নতিই আমার একমাত্র স্বপ্ন। ইসলামের এমন একজন সেবিকার সাথে আলাপ করার সময় সে কোন রকম রাখঢাক করে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনা। খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ল মেয়েটা।

হ্যাঁ, তাতো হবেই। অমন যুবতী দেহের আকর্ষণ যার, তার কাছে আবার গোপনীয়তা কি?

বৃদ্ধ বলল, তাকে আমাদের সংগী করতে পারছি না, তার দরকারই বা কি? সে তো এখন আমাদের হাতের পুতুল।”

সুলতান আয়ুবী আর কি করতে চায়? প্রশ্ন করল আরেক সদস্য।

তার মাথায় এখন ঘুরপাক খাচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্ন। খ্ৰীষ্টান রাষ্ট্রগুলোতে ইসলামের পতাকা উড়াবার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সে। আমাদের গোয়েন্দাদের তৎপরতা নস্যাৎ করার জন্য আলীকে দিয়ে তৈরী করেছে গোয়েন্দা বাহিনী। আল বারকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সে আলাদাভাবে ত্যাগী ও কর্মঠ যুবকদের নিয়ে এক বাহিনী গঠন করেছে। ট্রেনিংও শুরু হয়েছে ওদের। ট্রেনিং শেষ হলে ওদেরকে আমাদের দেশে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য পাঠাবে। তার এসব পরিকল্পনা অত্যন্ত ভয়ংকর।

বিড়ালমুখো ঢেঙ্গা লোকটা মুখ খুলল এবার। বলল, “সেনা মহড়ার মাধ্যমে মুসলমানদের মনে সে আশার আলো জাগিয়ে তুলেছে। যুবকরা ফৌজে ভর্তি হচ্ছে প্রতিদিন। ছ’সাত হাজার নতুন সৈন্য ইতিমধ্যে যোগাড়ও করে ফেলেছে। ভর্তি এখনও চলছে। অনেক সুদানীও রয়েছে এর মধ্যে। আয়ুবী যথেষ্ট পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিচ্ছে।

“এ তো এক মারাত্মক পরিকল্পনা!

হ্যা, তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বাহিনী বড় হলেই যুদ্ধে জেতা যায় না, যুদ্ধজয়ের প্রধান শর্ত যে শৃঙ্খলাবোধ তা আমরা ভেঙে দিচ্ছি। আয়ুবীর সেনাবাহিনীকে জুয়া এবং ব্যভিচারে লিপ্ত করার কাজ বেশ ভালই এগুচ্ছে। সেনাবাহিনীতে আমাদেরও অনেক লোক ভর্তি হয়েছে। ওরা ইতিমধ্যেই জুয়া খেলা জমিয়ে তুলেছে। আর কে না জানে জুয়া ও নারী মানুষকে নানা অপকর্ম, চুরি এবং খুনখারাবীতে সহজেই পৌছে দেয় |

তা দেয় ঠিক, কিন্তু খুনখারাবী ব্যাপকভাবে শুরু হচ্ছে কই?

হবে, হবে। যে সব বেশ্যাদের ট্রেনিং দিয়ে ছাউনির আশপাশে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ওরা যে পেশাধারী তা প্রকাশ করে না। সুলতানের সৈন্যদের। বিপথগামী করা ছাড়াও ওদের সাথে প্রেমের অভিনয় করে। গত পরশু এক মেয়ের জম্য দু’জন যুদ্ধ করে নিহত হয়েছে, এ তো সবে শুরু।

কিন্তু আয়ুবী এ সংবাদ পেয়ে আলী এবং আল বারককে তদন্তের নির্দেশ দেয়ায় বুঝা যাচ্ছে ও এ ব্যাপারে সচেতন। এখন ধড়পাকড় শুরু না হলেই হয়।

‘আমি ভাবছি এখন থেকে কিছুদিন ক্যাম্পের কাছে যেতে মেয়েদেরকে নিষেধ করবো।’

আছেফা জানাল, সে পাঁচ ছ’দিন পর পর পর বৃদ্ধকে সংবাদ পৌছায়। আল বারককে মদের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সে চলে আসে বৃদ্ধের কাছে।

মিটিং চলল গভীর রাত পর্যন্ত। আলোচনা হল অন্যান্য মিনি পতিতালয়গুলো নিয়ে। ফল আশাব্যঞ্জক। এতে সন্ত্রান্ত বংশের যুবকদের নষ্ট করা যাচ্ছে দ্রুত। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মেয়েগুলো এক্ষেত্রে যথেষ্ট সফলতা দেখাচ্ছে। এখন মুসলমান মেয়েদেরকেও অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনার দিকে নিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে ছড়িয়ে দিতে হবে নেশার দ্রব্য।

গোপন বৈঠক শেষ হল। বেরুল একজন। তার পনের মিনিট পর আর একজন, এভাবে সবাই।

শেষ পর্যন্ত রইল যুবতী ও অন্য একজন গোয়েন্দা। নেকাবে মুখ ঢেকে যুবতীও গোয়েন্দাটির সাথে বেরিয়ে এল।

আল বারক দ্বিতীয় বিয়ের কথা গোপন রাখলেন, কাউকে বললেন না। দীর্ঘদিন এক স্ত্রী নিয়ে ঘর করেছেন, চল্লিশে এসে বিয়ে করলেন এক যুবতীকে, তার ভয় ছিল বন্ধুরা এ জানতে পারলে তাকে উপহাস করবে। কিন্তু অতি বুদ্ধিমানরা সহজ কথা একটু দেরীতেই বোঝে, এ কান ও কান করে তার এ বিয়ের কথাটা যে শেষ পর্যন্ত সবাই জেনে গেছে এ কথাটাও বুঝতে পারল না আল বারক।

ΟΟΟ

সেনানিবাসের চারপাশে আলী গোয়েন্দাদের গভীর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলল। একদিন আলীর কাছে রিপোর্ট করল এক গোয়েন্দা, মেলার পর শহরে জুয়া এবং বেহায়াপনা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আল বারকের ঘর থেকে একটা মেয়েকে বেরুতে দেখা গেছে। গত তিন মাসে চারবার গভীর রাতে কালো বোরকা পরে মেয়েটা বের হয়েছে। কিছু দূর গেলে তার সাথে যোগ দেয় একজন পুরুষ।

প্রথম দু’বার তেমন গুরুত্ব না দেয়ায় এর বেশী অনুসরণ করা হয়নি। তৃতীয়বার আমাদের এক গোয়েন্দা মেয়েটার পিছু নেয়। শহরের এক সন্ত্রান্ত বাড়ীতে এসে ঢুকে ওরা। একটু পর মেয়েটাকে ওখানে রেখে পুরুষটা চলে যায়।

গত রাতেও তার পিছু নিয়েছিল গোয়েন্দা। এক পৌঢ়ের সাথে ওরা শহরের সম্মানিত বাড়িটায় পৌছল। লুকিয়ে রইল গোয়েন্দা। ভেতরে ওদের অনেকক্ষণ কাটল। একসময় বেরিয়ে এল একজন। তার পনের মিনিট পর আরো একজন। এভাবে এক এক করে এগার জন বেরিয়ে গেল। সব শেষে বেরোল মেয়েটা এবং একজন পুরুষ।

গোয়েন্দাটা অন্ধকারে ওদের পিছু নিল। আল বারকের বাড়ীর কাছে এসে পুরুষটা সোজা পশ্চিম দিকে চলে গেল, ভেতরে ঢুকে পড়ল মেয়েটা।

রিপোর্ট পেয়ে আলী যেমন চিন্তিত হল তেমনি খুশিও। খুশী হল এ, জন্য যে, আলী গোয়েন্দাদের বলেছিল, ‘ব্যক্তি যত বড়ই হোক সন্দেহ হলেই রিপোর্ট করবে। এমনকি সুলতান আয়ুবীর কোন কাজে সন্দেহ হলেও রিপোর্ট করতে হবে. তার লোকেরা কথাটা তাহলে গুরুত্বের সাথেই নিয়েছে।

আলী আল বারকের স্ত্রীকে ভাল করেই জানত। রাতে অন্য পুরুষের সাথে বাইরে যাবার মত মহিলা তিনি ছিলেন না। তার কোন যুবতী মেয়েও নেই। এ নিয়ে আলী অনেক ভাবল।

বন্ধুর জন্য কিছু করা দরকার। আবার ভাবল, শহর ভাসমান পতিতায় ভরে গেছে। তবে কি তিনি কোন বাজে মেয়ের খপপরে পড়লেন!

গোয়েন্দা বিভাগের এক মেয়েকে পাঠালেন তার বাড়ীতে। মেয়েটা গিয়ে বলল, আমি এক গরীব ও দুস্থ মহিলা। স্বামী মারা গেছে, এক মাত্র ছেলেও বেকার। আমাকে একটু দয়া করুন। আমার জন্য কিছু সাহায্য ব্যবস্থা করে দিন।

ওকে ভিক্ষুকের মত দেখাচ্ছিল না। দরিদ্র হলেও মনে হচ্ছিল যথেষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। আল বারক তখন ঘরে ছিলেন না। স্ত্রীর সাথে গল্প জুড়ে দিল সে। ভদ্রমহিলা তাকে বসতে দিলেন। বললেন, সাহেবতো এখন বাড়ি নেই। তুমি অপেক্ষা করো।

এটাই চাইছিল সে। একসময় ঘুরতে ঘুরতে চলে এল শোবার ঘরের পাশে। দেখল আছেফাকে। কথায় কথায় বলল, “আপনার এ মেয়ের কি বিয়ে হয়েছে?”

ও আমার মেয়ে নয়, আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি মাস তিনেক আগে ওকে বিয়ে করে এনেছেন।”

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, তিনি তো এলেন না। আমি না হয় পরে দেখা করবো। আপনি সাহেবকে একটু বলবেন, আমাকে যেন একটু দয়া করে ‘ বেরিয়ে এল গোয়েন্দা মহিলাটি। রিপোর্ট করল এসে আলীকে।

এ সংবাদ শুনে আলী হতবাক হল। বুঝতে পারল, তার এ নতুন স্ত্রী-ই রাতের সে বাইরে যাওয়া যুবতী। কিন্তু রাতের আঁধারে সে কোথায় যায়? কেন যায়? কার কাছে যায়?

মহা চিন্তা এসে ঘিরে ধরল আলীকে।

আলী আল বারকের প্রথম স্ত্রীকে সংবাদ পাঠাল একটু দেখা করার জন্য। খবর পেয়ে শান্ত মনেই আলীর সাথে দেখা করতে এল ভদ্রমহিলা।

আল বারক তখন অফিসে ব্যস্ত। আলী মহিলাকে অত্যন্ত সম্মান করত। তাকে বসতে বলে বলল, “শুনেছি আল বারক দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন?”

‘আল্লাহর কাছে হাজার শোকর দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, চতুর্থ বা পঞ্চম করেননি।’

নতুন বৌ দেখতে কেমন?

‘ভীষণ সুন্দরী।

সুন্দরীদের তো আবার পাখা থাকে, উড়াল দেয় না তো? কৌতুক করে বললেন আলী, মানে, আপনি কোন সন্দেহ করছেন না তো!’

গভীর চিন্তায় ডুবে গেল মহিলা, কোন জবাব দিল না। আল বারকের স্ত্রীর এ মৌনতা থেকে যা বুঝার বুঝে নিল আলী। বলল, যদি বলি ও প্রায় রাতেই বাড়ী থেকে বেরিয়ে যায়, কিছু মনে করবেন না তো?”

মৃদু হেসে মহিলা বলল, আমিও ভাবছিলাম এ নিয়ে কার সাথে কথা বলব? আসলে আমার স্বামী এখন তার গোলাম। আমার সাথেও কথা বলেন না।”

আপনি স্বামীকে কিছু বলেন না? ওর ব্যাপারে স্বামীর সাথে কথা বলতে গেলে ভাববে হিংসা করছি।

ওর যা মেজাজ, সাথে সাথেই আমাকে না আবার বাড়ী থেকে বের করে দেয়, এই ভয়ে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছি না।’

মেয়েটার স্বভাব চরিত্র কেমন?

“মেয়েটাকে আমার ভাল মনে হয় না। আমাদের ঘরে মদের গন্ধও ছিল না। এখন বোতলকে বোতল শূন্য হয়ে যায়।’

“কি বললেন? মদ!’ চমকে উঠলেন গোয়েন্দা প্রধান আলী। আল বারক মদ ধরেছেন?”

‘শুধু ধরেন নি, মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকেন। মেয়েটা মাঝে মধ্যেই ওকে মদ খাইয়ে রাতে বেরিয়ে যায়, ফেরে অনেক রাতে। আমি নিজে দেখেছি। যে রাতে ও বেরিয়ে যায় সে রাতে আমার স্বামী বেহুশ হয়ে পড়ে থাকেন। সকালেও উঠেন অনেক দেরী করে। ভাবতে পারেন কি বদমাইশ মেয়ে, স্বামীকে ধোকা দিয়ে রাত কাটায় বাইরে?

‘মেয়েটা বদমাইশ নয়, গোয়েন্দা। ধোকা দিচ্ছে দেশ এবং জাতিকে।

‘গোয়েন্দা! চমকে উঠলেন মহিলা। আমার ঘরে গোয়েন্দা!

‘আপনি জানেন আমি এক শহীদ কন্যা। আল বারক একজন খাঁটি মুসলমান। ইসলামের জন্য তার জীবন পণ। আমি আমার সস্তানদের জেহাদের জন্য তৈরী করছি, আর আপনি বলছেন আমার সন্তানের পিতা এক গোয়েন্দার খপপরে পড়েছে? সন্তানের পিতাকে আমি কোরবানী দিতে পারি, কিন্তু ইসলাম এবং জাতিকে কোরবানী দিতে পারি না। আমি দু’জনকেই হত্যা করব।”

রাগে কাঁপতে লাগলেন তিনি।

অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করলেন আলী। বললেন, ‘ও যে গোয়েন্দা তা নিশ্চিত হতে হবে। জানতে হবে আল বারক সত্যিই কি ওদের দলে ভিড়েছেন, না মদ খাইয়ে স্বার্থ উদ্ধার করা হয়। ওর অন্য সংগীরা হয়।

এ অবস্থায় মহিলার কি কি করা উচিত সে ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দিয়ে তাকে বিদায় জানালেন আলী।

মহিলা ফিরে গেলেন। মনে হল, আলীর কথা মত ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করবেন। কিন্তু আল বারকের স্ত্রীর মনে হচ্ছিল, যে কোন সময় সে ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে। সে তো হারেমের মেয়ে নয়, স্বামীর অনুগত এক স্ত্রী। দেশ এবং জাতির জন্য আত্ম্যোৎসর্গকারী বংশের সন্তান।

আলবারকের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখার জন্য গোয়েন্দা লাগালেন আলী। গোয়েন্দারা সারারাত জেগে থেকে তাকে পাহারা দিতে লাগল।

পাহারা জোরদার করার দুদিন পর। রাতে ঘুমিয়ে আছেন আলী। গাঢ় ঘুম। কিন্তু ঘুম যত গভীরই হোক, আলীর নির্দেশ ছিল, জরুরী কোন খবর থাকলে সাথে সাথে তাকে সে খবর দিতে হবে। প্রয়োজনে ডেকে তুলতে হবে ঘুম থেকে।

সে রাতে চাকর তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, ‘ওমর এসেছে, আতংকিত চেহারা ‘

কক্ষ থেকে তীরের মত বেরিয়ে এলেন আলী। দুতিন লাফে আঙিনা পার হয়ে গেটের বাইরে এলেন। ওমর বলল, চাকরকে পাঠিয়ে দশ বারজন সওয়ার ডেকে নিয়ে আসুন। আপনার ঘোড়া তৈরী করান। কি হয়েছে পরে বলছি।”

চৌদ্দজন সওয়ার এবং নিজের ঘোড়া আনার জন্য চাকরকে পাঠিয়ে দিলেন আলী।

‘এবার বল ওমর, কি সংবাদ নিয়ে এসেছ?

‘আমি এবং আজর আপনার নির্দেশে আল বারকের বাড়ীর ওপর নজর রাখছিলাম। কিছুক্ষণ পূর্বে তার বাড়ী থেকে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা এক মহিলা বেরিয়ে এল। সে পঞ্চাশ কি ষাটগজ দূরে গেছে, বাড়ী থেকে সর্বাঙ্গ ঢাকা আরেকজন মহিলা আগের মেয়েটার পিছু নিল।

দ্রুত পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে গেল মহিলা। হঠাৎ প্রথম মহিলা টের পেয়ে গেল যে তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। দাড়িয়ে পড়ল সে। আমরা দু’জন লুকিয়ে দেখতে লাগলাম।

দু’মহিলা মুখোমুখি হল। তাদের মধ্যে কি কথা হল বুঝা গেল না, আগের মেয়েটা হাত তালি দিল। আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একজন লোক।

দ্বিতীয় মহিলাকে ধরতে চাইল সে। মহিলা তাকে আঘাত করল। অন্ধকারে অস্ত্রটা শনাক্ত করতে পারিনি। পুরুষটা তাকে পালটা আঘাত করল। প্রথম মেয়েটা বলল, ‘ওকে তুলে নাও।

দ্বিতীয় মহিলা প্রথম মহিলাকে আক্রমণ করল। চিৎকার করে উঠল প্রথম মহিলাটি। দ্বিতীয় মহিলা আবার আঘাত করার আগেই পুরুষটা ঝাপিয়ে পড়ল তার ওপর। ও প্রতিহত করল। পুরুষের আক্রমণ। ততোক্ষণে দু’জন মহিলাই আহত।

আমি এসেছি আপনাকে সংবাদ দিতে, ওরা কোথায় যায় তা দেখার জন্য আজরকে রেখে এসেছি সেখানে।

আকস্মিক অভিযানের জন্য আলী কিছু যুদ্ধবাজ সৈন্য তৈরী রাখতেন। ওরা ছিল অভিজ্ঞ এবং সাহসী। ঘুমুত ঘোড়ার পাশে। মাথায় থাকত ঘোড়ার জিন এবং অস্ত্র। দিনে রাতে যখনি প্রয়োজন প্রস্তুতি নিত কয়েক মিনিটের মধ্যে।

আলী বিন সুফিয়ান কাপড় পরে তৈরী হতে না হতেই ওরা এসে পৌছল। আলীর নেতৃত্বে ঘোড়া ছুটাল ওরা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌছে গেল আল বারকের বাড়ির পাশে, ঘটনাস্থলে।

দু’জনের হাতে মশাল। মশালের আলোয় তারা দেখতে পেল লাশের মত পড়ে আছে দু’জন মানুষ। একজন দ্বিতীয় মহিলা, অন্যজন ওমরের সংগী আজর।

অন্তিম সময় ঘনিয়ে এলেও দু’জনই এখনো জীবিত। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি। কাছে গৈলাম। হঠাৎ পেছন থেকে আক্রান্ত হলাম খঞ্জর দিয়ে তিনটে আঘাত করল আমাকে। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই আক্রণকারী পলিয়ে গেল। আগের মেয়েটি আল বারকের বাড়ী যায়নি। প্রতিদিনকার মত ওদিকেই গেছে।’

আলী মহিলাকে দেখলেন। আল বারকের প্রথমা স্ত্রী।

তিনি দু’জন সওয়ারের মাধ্যমে ওদেরকে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বাকী সওয়ারদের নিয়ে তিনি ছুটলেন অভিজাত সেই বাড়ীর দিকে। বিশাল প্রাচীন বাড়ি। বাড়িটার চারপাশ ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে – আরও কয়েকটা বাড়ি। দেখতে ছোটখাট পাড়া মনে হলেও আসলে, পুরোটা মিলেই একটা অভিন্ন বাড়ি।

বাড়ীর পেছন থেকে ঘোড়ার হেষা ধ্বনি ভেসে এল। আলী দুদিক থেকে সওয়ারদের পেছনে পাঠালেন। দু’জনকে দাড় করালেন প্রধান ফটকে। বললেন, ‘কেউ বেরোলেই বন্দী করবে। পালাতে চাইলে তীর মেরে শেষ করে দিবে।

ঘুরে পেছনে যাচ্ছে সওয়াররা, অশ্বক্ষুরের শব্দ ভেসে এল। আলী এক সওয়ারকে বললেন, দ্রুত কমান্ডারকে গিয়ে বল এ বাড়ীটা ঘেরাও করে ভেতরের সবাইকে গ্রেপ্তার করতে।’

সওয়ার ক্যাম্পের দিকে ছুটলো, আলী উচ্চস্বরে অন্য সৈন্যদের বললেন, ঘোড়া ছুটাও। ওদের অনুসরণ কর। একজন আরেকজনের প্রতি নজর রেখো।”

তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। সেনাবাহিনীর বাছাই করা ঘোড়া তীব্রগতিতে ছুটে চলল। পলায়নকারীরাও খাটি অশ্বারাহী। ক্ষুরের শব্দে মনে হয় ঘোড়াগুলোও বেশ ছুটতে পারে।

আঁকাবাঁকা গলিপথের শহরে ঘোড়া ছুটাতে কিছু সমস্যা হয়েছিল। শহর ছাড়িয়ে এল ওরা, সামনে খোলা ময়দান।

অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু শব্দ লক্ষ্য করে ছুটতে হচ্ছে। খোলা মাঠে পলায়নকারীদের জন্য লুকানো কষ্টকর হয়ে পড়ল। দিগন্তে ওদেরকে ছায়ার মত দেখা যাচ্ছে।

চারজন, চলছে পাশাপাশি। আলীর নির্দেশে দু’জন সওয়ার ছুটন্ত ঘোড়া থেকে তীর ছুড়ল। সম্ভবতঃ লাগেনি। ওদেরকেও বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ল ওরা। একজন থেকে অন্যজনের দূরত্ব বেড়ে যেতে লাগল।

আলীর দল তীব্র বেগে ছুটছিল। কমে এল দূরত্ব। সামনে টিলা। টিলায় খেজুরগাছ, ঝোপ ঝাড়।

ওদের ঘোড়া দুভাগ হয়ে গেল। একভাগ ঝোপের ডানে, এক ভাগ।

বায়ে। টিলা পেরোল ওরা। এরপর অদৃশ্য হয়ে গেল দৃষ্টি থেকে।

ধাওয়াকারীরা টিলায় উঠল। অনেক দূরে দেখা চারটে ছায়া। ছুটছে বিচ্ছিন্ন ভাবে।

আলী উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘চার ভাগ হয়ে ওদের ধাওয়া করো। ঘোড়া আরও জোরে ছুটাও। দূরত্ব কমিয়ে আন। ধনুতে তীর জুড়ে নাও।

সওয়াররা চার ভাগে ভাগ হয়ে ছুটতে লাগল। সবাই ধনুতে তীর গেথে নিল। বেড়ে গেল ঘোড়ার গতি। অশ্বক্ষুরধ্বনির মাঝে তীর ছোড়ার শন শন শব্দ হল।

একজন চিৎকার দিয়ে বলল, ‘একটাকে শেষ করেছি।

আলীর আরেক সংগী তীর ছুড়ল। ছুটন্ত ঘোড়া থেকে নিক্ষিপ্ত তীর ওদের গায়ে লাগল না। দূরত্ব আরো কমে এল। আহত হয়ে একটা ঘোড়া পা ভেঙে পড়ে গেল। আলীর এক সংগী দ্রুত আরোহীর কাছে পৌছে ঘাড়ে বর্শা দিয়ে আঘাত করল। নুয়ে আঘাত ঠেকাল সে। আরেকজন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তার গলা। তার সামনে বসা একটা মেয়ে। অজ্ঞান।

সৈনিকরা পলায়নকারীদের ধরে ফেলল। ডাকাডাকি করে এক জায়গায় সবাইকে জড়ো করা হল।ওদের আহত ঘোড়া দু’টো মরুভূমিতে ছেড়ে দেয়া হল। পলায়নকারী পাঁচ জন, এর মধ্যে একজন তরুণী।

ওদের একজন বলল, আমাদের সাথে যা ইচ্ছে কর। কিন্তু মেয়েটা আহত। আশা করব ওকে বিরক্ত করবে না।

ঘোড়ার জিনের সাথে বাধা মশাল জ্বালানো হল। মেয়েটা সত্যি আহত। অনন্যা সুন্দরী। পাকা খেজুরের মত টসটসে চেহারা। কাপড় রক্তে ভেজা। কাঁধে, ঘাড়ের কাছে খঞ্জরের আঘাতের চিহ্ন।

আলীর এক সহকারী আঘাত পরীক্ষা করল। গভীর ক্ষত। রক্ত ঝরে মরার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চেহারা। এখনো অজ্ঞান। চোখ দুটো বন্ধ |

আলী একটা কাপড় ছিড়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দিলেন। ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল।

তাড়াতাড়ির প্রশ্ন অবান্তর। ওরা এখন শহর থেকে অনেক দূরে। বন্দীদের মধ্যে ছিল এক বৃদ্ধ।

দলটা কায়রোর দিকে ফিরে চলল। সূর্যোদয়ের সময় পৌছুল কায়রো। সুলতান আগেই শুনেছিলেন রাতের ঘটনা।

আলী হাসপাতাল গেলেন।

আজর এবং আল বারকের স্ত্রীর জ্ঞান ফিরলেও অবস্থা আশংকাজনক। ডাক্তার মেয়েটার দিকে নজর দিল।

সুলতানও হাসপাতালে এলেন। আলীকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আল বারকের জন্য লোক পাঠিয়েছিলাম। আশ্চর্য কথা শোনাল সে। আল বারক নাকি বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। কক্ষে মদের সোরাহী এবং গ্লাস। সে কি মদও ধরেছে? স্ত্রী আহত হয়ে বাইরে পড়ে আছে এ অনুভূতিও তার নেই? আমি মহিলার সাথে কোন কথা বলিনি। ডাক্তার নিষেধ করেছেন।”

আল বারকের এক স্ত্রী নয় দু স্ত্রীই আহত। মরুভূমি থেকে যে মেয়েটাকে এনেছি সে তার দ্বিতীয় স্ত্রী। কথা বলার মত হোক, আমরা অনেক বড় শিকার হাতে পেয়েছি সুলতান।

সূর্য উঠার অনেক পর জাগলেন আল বারক। চাকর বলল, সুলতান তাকে স্মরণ করেছেন।”

হাসপাতালে ছুটে এলেন তিনি। তার দু’ স্ত্রী আহত। পাশে চার গোয়েন্দা। এদের সাথে বৃদ্ধকে দেখে আশ্চর্য হলেন তিনি। তাকে তিনি আছেফার স্বামী মনে করছিলেন।

এদের বিচারের ভার নিজের হাতে নিলেন সুলতান। কারণ এর সাথে প্রতিরক্ষা সচিব জড়িয়ে পড়েছেন।

সুস্থ হওয়ার পর ওদের জবানবন্দী নেয়া হল। আল বারকের প্রথম স্ত্রী বললেন, যখন শুননলাম মেয়েটা গোয়েন্দা, ভীষণ রাগ হল। ইচ্ছে হল

স্বামীকে এবং তাকে হত্যা করে ফেলি। কিন্তু আলী যখন বললেন। সংগীদের খোঁজ নেয়ার জন্য গোয়েন্দাকে জীবিত ধরতে হয়, রাগ সামলে বাড়ী গেলাম। নজর রাখলাম মেয়েটার ওপর। এমনকি রাতের ঘুমও ছেড়ে দিলাম। সুযোগ বুঝে তার শয়ন কক্ষের দরজায় একটা ফুটো। করলাম। রাতে তাকিয়ে থাকতাম ছিদ্র পথে।

রাতে দেখতাম মেয়েটা আল বারককে মদ খাওয়াচ্ছে। অর্ধ উলংগ দেহ। তার সাথে অশ্লীল আচরণ করছে। এমনভাবে সুলতানের কথা বলছে যেন সুলতান তার পীর মুর্শিদ। গালাগালি করছে খ্ৰীষ্টানদের। বিশেষ করে খ্ৰীষ্টানদের বিরুদ্ধে সুলতানের সামরিক পরিকল্পনার কথাই বেশী বলল। আল বারক হড়হড় করে সুলতানের সব পরিকল্পনার কথা তাকে বলে দিলেন।

এরপর এল প্রতীক্ষিত রাত। আছেফ আল বারককে মদ পান করাতে লাগল। পশু হয়ে উঠল সে। দু’টো গ্রাস নিয়ে পাশের কক্ষে চলে গেল আছেফা। মদ ভরে ফিরে এল। একটা তাকে দিল, অন্যটা নিল নিজে। এরপর অশ্লীলতার সীমা ছাড়িয়ে গেল।

এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। কাপড় পরল আছেফা। ধীরে ধীরে ডাকল তাকে। জবাব না পেয়ে আস্তে করে ধাক্কা দিল। আল বারক চোখ খুললেন না। সম্ভবতঃ মেয়েটা তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছে।

মধ্যরাত। আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢেকে কক্ষের আলো নেভাল মেয়েটা, বেরিয়ে এল বেড়ালের মত নিঃশব্দে।

ক্রোধে ফেটে যাচ্ছিলাম আমি। বোরকা পরে একটা খঞ্জর সাথে নিয়ে কক্ষ থেকে বেরোতে যাব, দেখলাম এক চাকরানীর সাথে ফিস ফিস করে কথা বলছে ও। বুঝলাম ও চাকরানীটাকেও হাত করে নিয়েছে।

বেরিয়ে গেল আছেফা। চাকরানী ফিরে গেল তার ঘরে। সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। পায়ের শব্দ লক্ষ্য করে আমি দ্রুত হাটতে লাগলাম। আমি দেখতে চাচ্ছিলাম ও কোথায় যাচ্ছে?

আছেফা সম্ভবতঃ আমার পায়ের শব্দ শুনেতে পেয়েছে। মোড় ঘুরে দাড়িয়ে পড়ল ও। অন্ধকারে ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না, মোড় ঘুরেই ওর মুখোমুখি পড়ে গেলাম।

হঠাৎ মুখোমুখি হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না কি করব। বললাম, ‘কোথায় যাচ্ছ আছেফা?”

ওর পাহারায় লোক আছে জানতাম না। দেখিনি কাউকে। আছেফা হাত তালি দিল। হেসে বলল, আপনি আমার পেছনে এসেছেন, না কোথাও যাচ্ছেন?’

অকস্মাৎ কেউ পেছন থেকে আমাকে জাপটে ধরল। এক ঝটিকায় নিজেকে মুক্ত করে দ্রুত খঞ্জর টেনে নিলাম। আঘাত করলাম লোকটাকে। ও পড়ে গেল। লোকটা দ্রুত উঠে আমার পেটের পাশে আঘাত করতে চাইল, সরে গেলাম আমি।

সরতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম আছেফার গায়ে। ঘুরে আমি আছেফাকে আক্রমণ করলাম। খঞ্জর ঢুকে গেল তার কাঁধে, ঘাড়ের পাশে। চিৎকার দিল ও।

লোকটা ছুটে এসে আমাকে আঘাত করল। পড়তে পড়তে সামলে নিলাম। আবার তাকে আঘাত করলাম তাকে। কিন্তু এ আঘাতও ঠেকাল ও।

আছেফা এসে জাপটে ধরল আমাকে। লোকটা আমাকে আঘাত করল, পড়ে গেলাম আমি।

আজর বলল, ‘ওমর চলে যাওয়ার পর দেখলাম দু’জন মহিলাই মাটিতে পড়ে আছে। সাথের লোকটা প্রথম মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গেল। দ্বিতীয় মহিলা আহত হয়ে পড়ে আছে মাটিতে।

আমি আড়াল থেকে বেরিয়ে এলাম। মহিলার অবস্থা আশংকাজনক। তার কাছে বসলাম। হঠাৎ কেউ আমাকে পেছন থেকে, খঞ্জর দিয়ে আঘাত করল। পরপর তিনবার। এরপর পালিয়ে গেল। তারপরের কথা আমার মনে নেই।’

সন্ধার দিকে আল বারকের প্রথম স্ত্রী এবং আজরের অবস্থা খারাপের দিকে মোড় নিল। ডাক্তারদের শত চেষ্টায়ও তাদের বাঁচানো গেল না।

আল বারকের স্ত্রী আলীকে বলেছিলেন, ‘আমি আমার স্বামীকে কোরবানী দিতে পারি। কিন্তু জাতি এবং দেশের ইজ্জতকে কোরবানী দিতে পারিনা। তিনি জাতির জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিলেন। সুলতান আইয়ুবীর নির্দেশে আল বারককে জেলে নেয়া হল। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমি স্বেচ্ছায় ঐ অপরাধ করিনি। এরা আমায় ধোকা দিয়েছে।’

কিন্তু তিনি মদ আর সুন্দরীর মোহে সামরিক এবং বেসামরিক তথ্য খ্ৰীষ্টানদের দিয়েছেন তা প্রমাণিত হল। সুলতান হত্যাকারীকে ক্ষমা করতে পারতেন, কিন্তু মদ পান, ব্যাভিচার এবং শক্রর কাছে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য পাচারের অপরাধ ক্ষমা করতেন না।

সেদিনই আছেফার জবানবন্দী গ্রহণ করা হল। আহত হওয়ার চাইতে ও ভয় পেয়েছিল বেশী। সে ছিল গোয়েন্দা, সৈনিক নয়।

রাজকুমারী রূপে রাজকুমারদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার ট্রেনিং তাকে দেয়া হয়েছিল। এ পরিণতির কথা কখনও সে ভাবেনি।

মুসলমানদের হাতে পড়ায় ও বেশী শংকিত ছিল। ওর ভয় ছিল মুসলমানরা তাকে পশুর মত ব্যবহার করবে। ওর চিকিৎসা করবে না। তার কাছে যাওয়া প্রতিটি লোকের কাছেই সে এ শংকা প্রকাশ করেছে।

ও কাদছিল ভয় পাওয়া শিশুর মত। আলী তাকে অনেক বোঝালেন। বললেন, ‘এক আহত মুসলমান মেয়ের সাথে যেমন ব্যবহার করা হয়, তোমার সাথেও তাই করা হবে। কিন্তু ও সুলতানের সাথে দেখা করতে চাইছিল।

সুলতানকে তার কথা বলা হল। তিনি এলেন। তার মাথায় হাত হাত দিয়ে বলল ভয় করোনা, তুমি আমার মেয়ের মত।

আমি শুনেছি সুলতান আয়ুবী তলোয়ারের নয়, হৃদয়ের সম্রাট। কাঁদতে কাঁদতে বলল আছেফা, যে সম্রাটকে পরাজিত করার জন্য সকল খ্ৰীষ্টান রাজারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। এক অসহায় মেয়ের সাথে প্রতারণা করতে তাঁর কি ভাল লাগবে? আমায় বিষ দিতে বলুন। এ অবস্থায় আমি কোন কষ্ট সইতে পারব না।’

তুমি চাইলে আমি সবসময় তোমার কাছে থাকব। তোমাকে ধোকাও দেব না, কষ্টও দেব না। তুমি সুস্থ হও। ডাক্তার বলেছেন, তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইলে চিকিৎসা করাতাম না, এ অবস্থায়ই জেলে পাঠিয়ে দিতাম। লবণ ছড়িয়ে দিতাম তোমার ক্ষতস্থানে। তুমি চিৎকার দিয়ে অপরাধ স্বীকার করতে। বলে দিতে সংগীদের নাম। কিন্তু আমরা মেয়েদের সাথে এমন ব্যবহার করি না। আল বারকের প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। তুমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো আমি ‘

সুস্থ হলে আমার সাথে কেমন ব্যবহার করবেন?

‘তুমি যুবতী এবং সুন্দরী’ এখানকার কোন পুরুষ তোমাকে সে চোখে দেখবে না। মনের সকল সন্দেহ মুছে ফেল। তোমার সাথে ব্যবহার হবে ইসলামী বিধান অনুযায়ী।

অভিজাত ওই বাড়ীতে তল্লাশী নেয়া হল। কারো বসতবাড়ী নয় ওটা। বাড়ীটি ছিল খ্ৰীষ্টান গোয়েন্দাদের আড্ডাখানা। ভেতরেই ছিল আস্তাবল। ওখান থেকে পাঁচ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হল।

এ পাচজন এবং পলায়নকারী চারজন কোন জবানবন্দী দিতে অস্বীকার করল। ওদূের পাঠানো হল নির্দিষ্ট কক্ষে, যেখানে পাথরও মুখ খুলতে বাধ্য হয়।

শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ স্বীকার করল, মেয়েটাকে দিয়ে সে-ই আল বারককে ফাঁসিয়েছে। প্রথম থেকে পুরো ঘটনা শোনাল সে। অন্যরাও বলতে বাধ্য হল। মানুষ যে বাড়ীকে সম্মানের চোখে দেখত, সেখানে ছিল অনেকগুলো মেয়ে। গুপ্তচরবৃত্তি, সরকারী কর্মকর্তাদের ফাসানো এবং যুবকদের চরিত্র হননের জন্য ওদের ব্যবহার করা হত।

ওরা বলল, ফৌজে নিজের লোক ভর্তি করে ওরাই সৈন্যদেরকে জুয়া, চুরি এবং ব্যভিচারে অভ্যস্ত করে তুলেছে। শহরে ছড়িয়ে দিয়েছে পাঁচশরও বেশী পতিতা। মিনি পতিতালয় খুলেছে। সুদানীদের উস্কানি দিয়েছে বিদ্রোহ করার জন্য।

ওরা প্রশাসন এবং ফৌজের বড় বড় ক’জন অফিসারের নাম বলল। এসব অফিসার সুলতানের বিরুদ্ধে কাজ করছে।

আছেফা ছিল খ্ৰীষ্টান। নাম ফিলমেংগো। বাড়ী গ্রীসে। তের বছর বয়স থেকে তাকে ট্রেনিং দেয়া শুরু হয়। তাকে শেখানো হয়েছে বিভিন্ন ভাষা, মিসরের সংস্কৃতি, আচার আচরণ।

মুসলমানদের এলাকায় কাজ করার জন্য এরকম হাজার হাজার মেয়ে  তৈরী করা হয়েছে। অনেককে এদিকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সুস্থ হওয়ার পর অকপটে সবই বলেছে আছেফা, কিছুই গোপন করেনি।

আছেফা সম্পূর্ণ সুস্থ হল পনের দিন পর। তাকে বলা হল, তোমাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে।

সে বলল, আমি সন্তুষ্ট চিত্তে এ শাস্তি গ্রহণ করছি। আমি ক্রশের মিশন সফল করেছি।’

ওকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া হল। অন্যদের এখনো প্রয়োজন ছিল। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী অনেক লোক ধরা হল। এদের দু’একজন ছিল মুসলমান। সবাইকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হল।

আল বারককে দেয়া হল একশ বেত্ৰাঘাত।

তিনি সইতে পারেন নি। তার মৃত্যুর পর সরকার তার সন্তানদের দায়িত্ব গ্রহণ করল।

তার বাড়ীতে সরকারী খরচে চাকর বাকর এবং কেয়ারটেকার নিয়োগ করা হল। ওরা আল বারকের সন্তান নয়, এক শহীদ মায়ের সন্তান |

অপহরণঃ

১১৭১ এর জুন। মরুভূমির সূর্যের প্রচন্ড উত্তাপে জ্বলছিল মিসর। সালাহউদ্দীন আয়ুবীর কাছে খলিফা আল আযেদের দূত এসে বলল, ‘খলিফা আপনাকে স্মরণ করছেন।

কেন ডেকেছেন বলেছেন কিছু?

‘জ্বীনা।

মেজাজ বিগড়ে গেল আয়ুবীর। দূতকে বললেন, খলিফাকে আমার সালাম দিয়ে বলে তিনি খুব ব্যস্ত। তাঁকে আরো বলো, আমার সামনে যে কাজ পড়ে আছে তা খলিফার কাছে হাজির হওয়ার চাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তবে জরুরী কোন কিছু হলে তিনি যেন তা জানিয়ে তলব করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া খোশগল্প করার জন্য দরবারে হাজিরা দেয়ার সময় আমার নেই।”

দূত ফিরে গেল।

সালাহউদ্দীন আয়ুবী কক্ষে পায়চারি করতে লাগলেন। চোখে মুখে তার উৎকণ্ঠা।

তখন ফাতেমী খেলাফতের যুগ। খলিফারা ছিলেন সম্রাটের মত। জুম্মার খোতবায় আল্লাহ এবং রাসুলের (সা.) নামের সাথে তাদের নামও উচ্চারণ করতে হত। এসব খলিফারা ছিল বিলাসপ্রিয়, নারী ও মদে মাতোয়ারা।

নুরুদ্দীন জংগী এবং সালাহউদ্দীন আয়ুবী না থাকলে এরা হয়ত মুসলিম দেশগুলোকে বিক্রি করে ফেলত।

আল আযেদও ছিলেন এমন একজন খলিফা। সালাহউদ্দীন আয়ুবী মিসর আসার পর তাকে তিনি কয়েক বারই ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনিও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে খলিফার দরবারে ছুটে গেছেন। কিন্তু ওখানে স্রেফ গল্পগুজব ছাড়া আর কিছুই হয়নি।

আয়ুবী যেন নিজেকে দেশের প্রধান মনে না করেন, খলিফা হলেন দেশের সর্বেসর্বা। আয়ুবীকে এ অনুভূতি দেয়ার জন্যই এত ডাকাডাকি।

কিন্তু খলিফা আল আযেদ, আয়ুবীকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্য আয়ুবীকে ভালও বাসতেন। আয়ুবী গেলে তাকে কাছে বসিয়ে কথা বলতেন। তবে আচরণে হামবড়া একটা ভাব থাকত। কথাবার্তায় প্রকাশ পেত রাজকীয় দেমাগ। যতবারই আয়ুবীকে ডেকেছেন, প্রয়োজনীয় কোন কথা বলেননি তিনি।

খ্রিষ্টানদের পরাজিত এবং সুদানীদের বিদ্রোহ দমনের পর আয়ুবী খলিফাকে এড়িয়ে চলতে লাগলেন। খলিফার প্রাসাদের শান-শওকত আয়ুবীর মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তিনি ভাবতে পারতেন না, মূল্যবান তৈজষপত্র, কারুকার্যখচিত স্বর্ণের প্লেট গ্লাস আর হীরা-মুক্তা বসানো মদের সোরাহী ও পানপত্র সংগ্রহ করাই কোন খলিফার একমাত্র কাজ হতে পারে।

পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার কঠিন দায়িত্ব যে খলিফার ওপর ন্যস্ত, কি করে তার হারেম ভরা থাকে সুন্দরী তরুণীতে, এ কথা কিছুতেই বুঝতেন না আয়ুবী। অথচ আরব, মিসর, মরক্কো, সুদান এবং তুরস্ক ছাড়াও খলিফার হারেমে থাকত ইহুদী এবং খ্রিষ্টান মেয়ে। এটাই ছিল সে সময়ের বিলাসপ্রিয় খলিফাদের প্রাসাদের চিত্র।

আল আযেদের দেহরক্ষীদের সবাই ছিল সুদানী। ওমরাদের মধ্যেও ছিল বিদ্রোহী সুদানী বাহিনীর কমান্ডার এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। আয়ুবী এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। আয়ুবীর নির্দেশে খলিফা আল আযেদের প্রাসাদ কর্মচারীদের সাথে গুপ্তচরদের অন্তৰ্ভূক্ত করলেন আলী বিন সুফিয়ান। হারেমের দু’জন মেয়েও হাত করে নেয়া হল।

ওদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্রমানিত হল, খলিফা সুদানীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন। ষাট পয়ষট্টি বছর বয়সেও যুবতীদের মাহফিলেই সময় কাটতেন তিনি। আর তাঁর এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিল আয়ুবী বিরোধী সুদানী ও অন্যান্যরা।

১১৭১ এর দ্বিতীয় কি তৃতীয় মাসে খলিফার হারেমে এল নতুন এক যুবতী। খাপখোলা তলোয়ারের মত ঝলসানো রূপ। যেমন রূপ তেমনি প্রাণবন্ত ও সপ্রতিভ।

তাকে নিয়ে এসেছিল আরবী পোষাক পরা চার ব্যক্তি। সাথে ছিল প্রচুর উপটৌকন সামগ্ৰী। মেয়েটাও উপহার হিসেবেই এসেছে। নাম উন্মে আমারা। যেমন চৌকস তেমনি বুদ্ধিমতী। অল্প ক’দিনেই রূপের চমক আর মুখের যাদু দিয়ে মেয়েটা খলিফাকে বশ করে ফেলল।

আয়ুবী রাজপ্রাসাদের সব অপকর্মের কথা জানতেন। কিন্তু তখনও ক্ষমতায় বাগডোর মজবুতভাবে ধারণ করতে পারেননি বলে খলিফার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে পারছিলেন না।

পূর্বের গভর্ণররা সব সময় খলিফার সামনে নত হয়ে থাকত। এতে মিসর হয়ে পড়েছিল বিদ্রোহীদের স্বৰ্গরাজ্য। নামে ইসলামী খেলাফত হলেও সেখানে ইসলামের পতাকা মাটিতে লুটাচ্ছিল। খ্রিষ্টানদের সাথে মুসলিম সেনাবাহিনীর বড় বড় অফিসারদের ছিল গোপন সম্পর্ক। এরাই কায়রো এবং ইস্কান্দারিয়ায় ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের পূর্নবাসন করেছিল।

সুদানী সেনাবিদ্রোহ দমন করলেও তাদের কিছু জেনারেল চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারত। রাজপ্রাসাদের সাথে এদের ছিল গভীর সম্পর্ক। তাছাড়া দেশের কিছু মানুষ তখনও খেলাফতকে মনে করত ইসলামের রক্ষক। ওরা খলিফাকে সম্মান করত। আবার কিছু ছিল যারা এ আবেগকে আহত করতে চাইতেন না।

এ ছাড়া চাটুকার ও খোশামুদে তো ছিলই। গভর্নর হওয়ার স্বপ্ন দেখত ওরা। কিন্তু ওদের আশার গুড়ে বালি দিলেন আয়ুবী।

ওদের চর দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়েছিল। খ্রিষ্টানদের আক্রমণের ভয় ছিল বলে সালাহউদ্দীন আয়ুবী এদের বিরুদ্ধে তখনো কোন পদক্ষেপ নিতে পারেননি।

সার্বিক পরিস্থিতি ভাল্ভাবে জানা থাকায় আয়ূবী বিলাসী খলিফাকে ঘাটাতে চাননি। কিন্তু এবার খলিফার কাছে যেতে তিনি সরাসরি অস্বীকার করলেন।

দূত বেড়িয়ে যেতেই সালাউদ্দিন আয়ুবী প্রহরীকে ডেকে বললেন আলী বিন সুফিয়ান, বাহাউদ্দীন শাদাদ, মুফতি ঈসা আল হুকারী এবং : আল নাসেরকে এক্ষুণি আমার কাছে আসতে বল।

○○○

কয়েক মিনিট পর। সালাহউদ্দীন আয়ুবীর চারজন বিশিষ্ট সভাসদ বসে আছেন সুলতানের সামনে। আয়ুবী বললেন, আপনাদেরকে আজ এক বিশেষ উদ্দেশ্যে ডেকে এনেছি। এই মাত্র খলিফার দূত আমাকে নিতে এসেছিল। আমি যাইনি। ইসলামের নামে ভোগ-বিলাস, নারী আর মদে ডুবে থাকতে খলিফাকে আমরাই সুযোগ করে দেই। পাপাচার না করেও আমরা হই পাপাচারের অংশীদার।

আল্লাহর হুকুম এবং রাসুল(সঃ) এর সুন্নাহর বিরুদ্ধে চলার অধিকার আমাদের নেই, অথচ আমরা তাই করে চলেছি। আমি মনে করি পাপ করা আর পাপের দোসর হওয়া সমান অপরাধ। তাই পাপ না করেও পাপের দোসর হিসাবে আমরা খলিফার মতই অপরাধী।

এ পথ থেকে আমাদের সরে দাঁড়ানো উচিত। এখন থেকে তাই আমি জুম্মার খোৎবা থেকে খলিফার নাম বাদ দিতে চাই। এ ব্যাপারে আপনাদের অভিমত কি?’

পদক্ষেপটা সময়ের আগে হয়ে যাচ্ছে না, শাদ্দাদ বললেন। ‘খলিফাকে মানুষ নবীর মত সম্মান করে। এতে হয়ত সাধারণ মানুষ ক্ষেপে যেতে পারে।’

‘এখন নবীর মত সম্মান করে, সসালাহউদ্দীন আয়ুবী বললেন, ক’দিন পর তাকে খোদা ভাববে। আমরা যারা আল্লাহ এবং রাসূলের (সা.) নামের সাথে তার নাম জুড়ে দিচ্ছি, তারাই তাকে খোদা এবং নবীর আসনে বসিয়েছি। এ অপরাধ যতটুকু না তাঁর তারচে বেশী অপরাধী আমরা।”

‘আমি একমত। বললেন মুফতি ঈশা, খোৎবায় আল্লাহ এবং রাসূলের সাথে মানুষের নাম উচ্চারিত হবে কোন মুসলমান তা সহ্য করতে পারে না। তাও এমন একটা লোক, যে মদ্যপ এবং ব্যাভিচারী। এতদিন খলিফাকে নবীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে সে ভিন্ন কথা, আমি শহরের ধর্মীয় ইমাম হিসাবে সুলতানের সাথে একমত পোষণ করছি। তবে খোৎবা থেকে খলিফার নাম বাদ দিলে রাজনীতি বা সেনাবাহিনীতে কি প্রতিক্রিয়া হবে তা আপনারা জানেন।

‘প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক। শাদাদ বললেন, ‘বিরোধিতা কেবল খেলাফতের পক্ষ থেকেই আসবে না, খেলাফতের সুবিধাভোগীরাও এর বিরুদ্ধে কোমর বেধে নামবে। কিন্তু তাই বলে দিনের পর দিন মানুষকে আমরা অন্ধকার ও কুসংস্কারে ডুবিয়ে রাখতে পারিনা।

হকের পথে চলতে চাইলে এটুকু ঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে। ঝুকি ছাড়া কোন বিকল্প ছিলনা কোন কালে  এখনো নেই। আমি চাই এ কুসংস্কার দূর হোক, প্রয়োজনে সাহসিকতার সাথে আমরা উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলা করব।”

আমরা একটি বেদয়াত থেকে মুক্তি চাইছি। যদি খলিফাকে সোজা পথে আনা সম্ভব হতো তবে হয়তো আমরা এ ঝুঁকি এড়াতে পারতাম। কিন্তু আমরা সবাই জানি তা কখনো হবার নয়। খলিফার মন রক্ষা করার চাইতে শরিয়ত পালন করা অনেক বেশি জরুরী, মুফতি ইশা আবারো কথা বললেন।

সাধারণ মানুষের মতামত আমি বেশী জানি’, গোয়েন্দা প্রধান আলী বললেন, ‘ওরা খলিফাকে চেনেনা, কখনও খলিফার চেহারাও দেখেনি। আমি হলপ করে বলতে পারি, সাধারণ মানুষ খলিফার চাইতে সালাহউদ্দীন আয়ুবী নামের সাথে বেশী পরিচিত এবং তাকে তারা ভালও বাসে।

তিনি আরো বললেন, ‘আমার ব্রাঞ্চের রিপোর্ট অনুযায়ী আপনার দু’বছরের শাসনামলে মানুষ তাই পেয়েছে, যার আশাও তারা করেনি। শহরে কোন ক্লিনিক বা হাসপাতাল ছিলনা। সামান্য রোগেও মানুষ মারা যেত। এখন সরকারী ভাবে হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা নিশ্চিন্ত। ছিনতাই, রাহাজানি এবং সন্ত্রাস নেই। অন্যান্য অপরাধের পরিমানও কম। ইচ্ছে করলেই মানুষ আপনার কাছে যে কোন অভিযোগ পৌছাতে পারে।

আপনি আসার আগে মানুষ সরকারী আমলা, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীকে ভীষণ ভয় করত। ওরা এখন নিজেকে জাতি এবং দেশের অংশ মনে করে।

খেলাফত ওদের দিয়েছে অন্যায় এবং নির্যাতন, আপনি দিয়েছেন ন্যায় ইনসাফ এবং অধিকার। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, সাধারণ মানুষ খেলাফতের নয় প্রশাসনের সিদ্ধান্তই মেনে নেবে।

জানিনা আমি দেশে ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি কিনা। মানুষকে তার অধিকার দিতে পেরেছি কিনা তাও আমার জানা নেই, কিন্তু জাতিকে এক অপ্রয়োজনীয় কু-সংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ রাখতে পারিনা আমি, চলতে দিতে পারিনা শিরক এবং কুফরী। যে কুসংস্কার ধর্মের অঙ্গ হয়ে গেছে, তা ভেংগে টুকরো, টুকরো করে ফেলা আমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করি। না হলে এর থেকে জন্ম নেবে আরো পাপ, আর সে পাপের দায়ভাগ পোহাতে হবে আমাকে।

এ নিয়ম চলতে থাকলে দেখা যাবে কাল আমিও খোৎবায় আমার নাম জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করছি। এক প্রদীপ থেকে আরেক প্রদীপ জ্বালানো হয়। যে দ্বীপ শিখা শিরকের পথ আলোকিত করে আমি সে দ্বীপ নিভিয়ে দিতে চাই।’

মনযোগ দিয়ে কথা শুনছেন চার প্রধান সভাসদ। তাদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবী।

তিনি আবেগঘন কষ্ঠে বললেন, আপনাদের কারো অজানা নয় যে, রাজপ্রাসাদ এখন ব্যাভিচারের আখড়ায় পরিনত হয়েছে। সুদানীরা যে রাতে আমাদের আক্রমণ করেছিল, সে রাতেও হারেমে মেয়েদের সাথে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে ছিলেন খলিফা। খোদার সৈনিকেরা যখন শহীদ হচ্ছিল তখনও তার হাতে ছিল মদের পিয়ালা। আপনারা সেদিন ব্যর্থ হলে ইসলামের পতাকা মিসর থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিত।

নিয়ম অনুযায়ী খলিফাকে সব কিছু অবহিত করা দরকার বিজয়ের পর আপনাদের পক্ষ থেকে বিজয়ের খবর নিয়ে আমি গিয়েছিলাম খলিফার দরবারে। তিনি সে বিজয়ের খবর শুনে তিনি কি করলেন? মাতাল ষাড়ের মত চিৎকার করে তিনি বললেন, শাবাশ! আমি খুব খুশী হয়েছি। আমার বিশেষ দূতের মাধ্যমে তোমার কাছে উপহার পাঠাব।’

আমি বললাম, খলিফাতুল মুসলেমিন, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আপনাকে বা আমার পিতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নয়, বরং আল্লাহ এবং রাসুলকে খুশী করার জন্য আমার ওপর যে কর্তব্যের বোঝা আপনি দিয়েছিলেন আমি তা পালন করেছিমাত্র।’

বৃদ্ধ খলিফা বললেন, সালাহউদ্দীন, তুমি এখনও শিশু, কিন্তু কাজ করেছ বড়দের মত ’ এমনভাবে কথা বললেন যেন আমি তার চাকর। ” অপ্রিয় হলেও আমি আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য এরা শ্বেতহস্তি বিশেষ, যা পোষার জন্য ব্যয় হয় প্রচুর, কিন্তু মানবতার জন্য তা কোন কাজে আসে না।”

সালাহউদ্দীন আয়ুবী পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে বললেন, এটা নুরুদ্দীন জংগীর চিঠি। পাঁচ ছ’দিন আগে পেয়েছি আমি। তিনি লিখেছেন, “খেলাফত তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। বাগদাদের অধিনস্ত দু’জন খলিফার ওপর এখন কেন্দ্রের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। মিসরের খলিফাও যেন কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। প্রয়োজনে সে খ্রিস্টান বা সুদানীদের সাথে গাঠছড়া বাধতে কুষ্ঠিত হবেনা। আমি ওদের ষড়যন্ত্রের আশংকা করছি। মিসরের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও ভাল নয়, ওখানে আরেকটি বিদ্রোহের সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য সতর্কতা জরুরী।

মিসরের খলিফাকে তার তৎপরতা প্রাসাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করবেন। খ্রিস্টানদের সহযোগিতা নিয়ে তিনি যেন মুসলিম বিশ্বের কোন অনিষ্ট করতে না পারে সে ব্যাপারে আপনাকে সজাগ থাকতে হবে। প্রয়োজনে যে কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করবেন না। আমি আপনাকে সামরিক এবং আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছি। সুদানীদের প্রতিও কড়া দৃষ্টি রাখবেন।

-নূরুদ্দীন।

চিঠিপড়া শেষ করে আয়ুবী বললেন, খলিফা যে শ্বেতহস্তি এতে সন্দেহ নেই। আপনারা দেখেছেন, খলিফা ভ্রমণে বের হলে অর্ধেক ফৌজকে ছড়িয়ে দেয়া হয় তার নিরপত্তা দেখার জন্য। তার চলার পথে গালিচা বিছিয়ে দেয়ার জন্য, ফুল ছোঁড়ার জন্য জনগণকে বাধ্য করা হয়। তার ভ্রমণের জন্য অপব্যয়ের টাকা জনকল্যাণে এবং দেশরক্ষার কাজে ব্যয় হতে পারত।” জনগণ এবং বিভিন্ন ধর্মের লোকদের বোঝাতে হবে যে, ইসলাম শুধু রাজা বাদশার ধর্ম নয়, ইসলাম মরুচার বেদুঈন কৃষক-শ্রমিক এবং খেটে খাওয়া মানুষের ধর্ম। আল্লাহ মানুষকে যে মর্যাদা দিয়েছেন, ইসলাম মানুষকে সে মানবতাই শিক্ষা দেয়।

সালাহউদ্দীন আয়ুবীর বক্তব্য শেষ হলে কথা বললেন বাহাউদ্দীন শান্দাদ, নিজে শাসন ক্ষমতা দখল করার জন্যই খলিফার বিরোধিতা করছেন আপনার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আসতে পারে।’

সত্য সবসময় বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে এবং হচ্ছে, বললেন সালাহউদ্দীন আয়ুবী। আজকে মিথ্যা এবং বাতিলের শিকড় এতটা মজবুত হতে পেরেছে এজন্য যে, বিরোধিতার ভয়ে লোকেরা সত্য বলা আজ ছেড়েই দিয়েছে। বুকের ভেতর আটকে গেছে সত্যের কন্ঠ। রাজকীয় বিলাস-ভ্রমণ এবং বাদশাহী দাপট প্রজাদের স্বাধীন চেতনা হরণ করেছে। সাধারণ মানুষকে ক্ষুধার্ত রেখে, মানুষের উপর জোর করে বাদশাহী চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে এমন শিকলে বাধা হয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) যে শিকল ছিড়ে টুকরো টুকরো করেছিলেন।

আমাদের রাজারা জাতিকে পতনের সর্বনিম্ন স্তরে পৌছে দিয়েছেন। ভোগ বিলাসের জন্য তারা খ্রিস্টানদের সাথে বন্ধুত্ব করছেন। ওদের ভোটগ্ৰহণ করছেন। ফলশ্রুতিতে খ্রিষ্টানরা ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব। আপনি বিরোধিতার কথা বলেছেন শাদাদা এ বিরোধিতায় ভয় পেয়ে সত্যকে তুলে ধরা থেকে পিছিয়ে থাকলে আল্লাহ যেদিন পাকড়াও করবেন সেদিন কি জবাব দেবেন?

‘মহামান্য আমীর’ সামরিক প্রধান আল নাসের বললেন, ‘আমরা বিরোধিতাকে ভয় পাই না। আপনি আমাদের যুদ্ধের ময়দানে দেখেছেন। অবরুদ্ধ হয়েও নিঃশঙ্কচিতে লড়াই করেছি আমরা। যুদ্ধ করেছি ক্ষুধা তৃষ্ণা নিয়ে। যখন আমরা নগন্য ছিলাম তখনও শত্রুর অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করে দিয়েছি। সুলতান! আপনার একটা কথা সবসময়ই মনে পড়ে আমার। আপনি বলেছিলেন, ‘বাইরের আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব কিন্তু ভেতর থেকে আক্রান্ত হলে চমকে গিয়ে ভাবতে হয়, এসব কি হচ্ছে। শাসক যখন দেশের দুশমনে পরিণত হবে তখন আপনার তরবারী খাপের। মধ্যেই নিশপিশ করবে, বাইরে আসতে পথ পাবে না।’

আপনি ঠিকই বলেছেন, আমার তরবার কোষের ভেতরই নিশপিশ করছে, শাসকদের বিরুদ্ধে কোষমুক্ত হতে চায় না। শাসকদের আমি সব সময়ই সম্মান করি। শাসকরা জাতির গৌরব, দেশের অহংকার। বলতে পারেন, আমাদের শাসকদের কি সে সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা রয়েছে?

আমি শুধু খলিফা আল আযেদের কথাই বলছি না। আলীকে জিজ্ঞেস করুন। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রিপোর্ট অনুযায়ী হলব, মুসেল, দামেস্ক, মক্কা এবং মদিনার খেলাফতও ভোগ বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। ওখানকার আমীর এবং গভনররা নিজেরাই স্বাধীন শাসক। খেলাফত এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, আমীর ওমরা এবং গভর্নররা তাকে নিজ নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছে।

আমি জানি, এ ছিন্নভিন্ন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে গেলে এরা আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে আমাদের সামনে বাঁধার পাহাড় দাড় করাবে। এরপরও আমি ভীত নই। আমার বিশ্বাস আপনারাও এতে ভয় পাবেন না। আপনাদের মতামতকে আমি সম্মান করি। আগামীতে কোন সুনির্দিষ্ট এখন থেকে খোৎবায় আর খলিফার নাম থাকবে না।”

সুলতানের সাথে একমত হলেন সবাই। এরপর সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে যে যার কাজে ফিরে গেলেন।

খলিফার খাস কামরা। দূত ফিরে গিয়ে বলল, কোন জরুরী কাজ থাকলে সালাহ উদ্দীন আয়ুবী আসবেন। এখন তিনি ভীষণ ব্যস্ত। কি জন্য ডেকেছেন তা জানাতে বলেছেন তিনি।’

খাস কামরায় খলিফার পাশে বসেছিল উম্মে আমারা। দুতের মুখে।

সালাহউদ্দীন আয়ুবীর জবাব শুনে সে বলল, ‘সালাহউদ্দীন আপনার নফর। আপনিই তাকে মাথায় চড়িয়েছেন। এ বেয়াদবকে পদচু্যত করছেন না কেন? সৈন্য পাঠিয়ে কেন তাকে বন্দী করছেন না?

‘পরিনাম ভাল হবেনা বলেই তাকে পদুচ্যুত করছি না। খলিফার কষ্ঠে ক্ষোভ। সেনাবাহিনী তার হাতে। সে আমার বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারে।’

রজব ছিল সুদানী বাহিনীর এক সালার। বর্তমানে খলিফার গার্ড বাহিনীর কমান্ডার। গার্ড বাহিনীর সবাই ছিল সুদানী কাফ্রী। রজবই ওদের বাছাই করেছিল। সে ছিল চাটুকার এবং সুলতান আয়ুবীর ঘোর বিরোধী।

দূতের খবর শুনেই তাকে ডেকে পাঠালেন সুলতান। রজব এসে কুর্নিশ করে দাঁড়াল একপাশে।

ক্রোধকম্পিত কষ্ঠে খলিফা বললেন, ‘সালাহউদ্দীন আয়ুবী! আমি আগেই জানতাম কমবখত স্বাধীনচেতা বেয়াড়া। আমি তাকে ডেকেছিলাম, সে আসতে অস্বীকার করেছে। বলেছে কোন জরুরী কাজ থাকলে আসবে, নয়তো তার কাছে আমার ডাকের কোন গুরুত্ব নেই। এখন তার হাতে নাকি খুব জরুরী কাজ….’

বলতে বলতে খলিফার হেঁচকি উঠল। সাথে কাশি। দুহাতে বুক চেপে ধরলেন তিনি। বিবর্ণ হয়ে গেল চেহারা। ক্ষীণ কষ্ঠে বললেন, আমি যে অসুস্থ বদবখত তাও দেখল না। আমি হার্টের রোগী। রাগ করা ঠিক না। আমি শরীর স্বাস্থ্যের চিন্তায় অস্থির, আর সে আছে জরুরী কাজ নিয়ে |

আপনি তাকে কেন ডেকেছিলেন আমাকে বলুন।

‘ডেকেছিলাম যেন সে বুঝে তার উপরও একজন আছে।

বুক চেপে কাৎরাতে কাত্রাতে বললেন খলিফা। তুমি বলেছিলে সে স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। আমি বার বার তাকে এখানে ডেকে আনতে চাই। চাই নির্দেশ দিতে যেন সে আমার সামনে মাথা নুইয়ে রাখে। কোন জরুরী কাজ হলেই তাকে ডাকব এমন তো কথা নেই।’

উম্মে আমারা মদের পেয়ালা খলিফার ঠোটের সামনে তুলে ধরল।

আপনাকে একশ বার বলেছি রাগ করবেন না। হৃদরোগের জন্য রাগ ভীষণ ক্ষতিকর।

একটা স্বর্ণের কৌটা থেকে কিছু পাউডার জাতীয় জিনিস খলিফার মুখে তুলে দিল মেয়েটা। খলিফা তার রেশম কোমল চুলে বিলি কেটে বলল, ‘তুমি না থাকলে এতদিনে আমি মরেই যেতাম। সবার আকর্ষণ আমার সম্পদ আর আমার মর্যাদার সাথে। আমার কোন স্ত্রীও আমাকে ভালবাসে না। তুমি আছ বলেই আজো বেঁচে আছি।

খলিফাতুল মুসলেমীন। রজব বলল, আপনার মনটা খুব নরম। ভীষণ ভাল মানুষ আপনি। এ জন্যই সালাহউদ্দীন এত সাহস পায়। সে যে আরব বা ফাতেমী বংশের নয় বরং একজন কুর্দি, তা আপনি ভুলেই গেছেন। বাইরের লোককে এত বড় পদ না দিলে আজ এমন সমস্যা দেখা দিত না। মানি, সে একজন ভাল সৈনিক। সে যুদ্ধ করতেও জানে, করাতেও জানে, শুধু এজন্যেই তাকে মিসরের গভর্নর করতে হবে?

খলিফা মন দিয়ে তার কথা শুনছে দেখে সে বলল, ‘একবারও কি ভেবে দেখেছেন, সেনাবাহিনীতে যখন সুদানীরা ছিল, নাজি এবং এডরোসের মত সেনাপতি ছিল, তখন প্রজারা আপনার কুকুরের সামনেও মাথা নোয়াত। আপনার নির্দেশ পালনের জন্য এক পায়ে খাড়া থাকত সুদানী সালাররা। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, অধিনস্তকে ডাকলেও সে আসতে সরাসরি অস্বীকার করার দুঃসাহস দেখায়। আমি অবাক হয়ে ভাবি, সুদানীদের এতবড় ফৌজকে যে খেলনার মত নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে, কোন দিন জানি সে আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়।’ রজব!’ গজে উঠলেন খলিফা। এ জন্য তুমিই দায়ী।

রজবের চেহারার রং বদলে গেল। চমকে সরে গেল উম্মে আমারা। খলিফা তাকে টেনে জড়িয়ে ধরে মোলায়েম কষ্ঠে বললেন, ভয় পেয়েছে? ভাল ছিল ও আমাকে আগে বলেনি কেন? চুপ করে আছ কেন রজব? গভর্নর যখন তার আসন পাকাপোক্ত করেছে তখন বলছ এরা খেলাফতের দুশমন।

‘আপনি রাগ করবেন ভেবে ভয়ে বলিনি। আপনার সাথে পরামর্শ করে বাগদাদের খলিফা আয়ুবীকে পাঠিয়েছে, আমি খেলাফতের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন সাহসে মুখ খুলব। আজ আপনার সাথে গভর্নরের ঔদ্ধত্বের কারনেই শুধু বলেছি।

আমি কয়েকদিনই সালাউদ্দিনকে হুজুরের সাথে বেয়াদবি করতে দেখেছি। যে কোন বিপদ সম্পর্ক আপনাকে অবহিত করা এবং আপনাকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য।”

উন্মে আমারা খলিফার গালে গাল ঘসছিল। কিছুক্ষণ খেলা করল আঙ্গুল নিয়ে। এরপর দু’হাত খলিফার দুগলে রেখে মুখের কাছে মুখ লাগিয়ে বলল শরীর ঠিক হয়েছে?

খলিফা মেয়েটার চিবুক নেড়ে বললেন, ওষুধের চাইতে তোমার আদরের প্রভাব অনেক বেশী। খোদা তোমাকে যে রূপ ও আবেগ দিয়েছেন আমার রোগ মুক্তির জন্য তাই যথেষ্ট।’

মেয়েটার মাথা নিজের বুকের সাথে মিলিয়ে রজবের দিকে তাকালেন। রজব! পরকালে আমাকে যখন বেহেস্তে দেয়া হবে, আমি খোদার কাছে হুরের বদলে উম্মে আমারাকে চাইব।

উম্মে আমারা শুধু সুন্দরী নয়, বুদ্ধিমতী এবং মেধাবী। হুজুরের প্রাসাদতো যড়যন্ত্রের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। ও এসে সব ঠিক করেছে। এখন কেউ কারো বিরুদ্ধে টু শব্দটি করতে পারে না।

রজব সালাহউদ্দীন আয়ুবীর বিরুদ্ধে খলিফার কান ভারী করতে লাগল। উন্মে আমারা বলল, ’ওর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং সালাহউদ্দীনের একটা বিহিত করুন।

তুমি কি বলছিলে রজব!’

‘গভর্নরের বিরুদ্ধে কিছু বললে আপনি রাগ করবেন ভেবে মুখ খুলিনি। সালাহউদ্দীন একজন যোগ্য সেনাপতি।

তার এ গুণটা আমার খুব পসন্দ। যুদ্ধের মাঠে সে ইসলামের পতাকা অবনমিত হতে দেয়না। যুদ্ধের ময়দানে মুসলিম বিশ্বের মর্যাদা রক্ষা করার মত এমন একজন সেনাপতিই আমাদের প্রয়োজন।

আমি ক্ষমা চাইছি খলিফাতুল মুসলেমিন! খেলাফত আমাদের যুদ্ধের ময়দানে পরীক্ষা করেনি। সালাহউদিনের ব্যাপারে বলতে বাধ্য হচ্ছি, সে মুসলিম বিশ্বের জন্য লড়াই করছেনা, করছে নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য।

যে কোন সৈনিককে জিজ্ঞেস করে দেখুন, সে এমন রাজ্যের জন্য যুদ্ধ করে যার কোন সীমা থাকবে না। এতে বুঝা যায়, সে নিজেই বাদশা হতে চাইছে। তাকে সহযোগিতা করছে নুরুদ্দীন জংগী। আয়ুবীর হাতকে শক্তিশালী করার জন্য সে দু’হাজার অশ্বারোহী এবং দু’হাজার পদাতিক সৈন্য পাঠিয়েছে। সৈন্য পাঠাতে জংগী কি বাগদাদের খলিফার অনুমতি নিয়েছিল? মিসরে ফৌজি সাহায্য প্রয়োজন আছে কিনা, আপনাকে কেউ কি একথা জিজ্ঞেস করেছিল? যা হয়েছে সব খেলাফতের অজান্তে।

তুমি ঠিকই বলছ। আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করেনি। এখন মনে পড়ছে ফৌজতো ফিরেও যায়নি। পুরনো সৈন্যদের কৃষক এবং ভিখিরী বানানোর জন্যই এ সাহায্য এসেছিল। নাজি, এডরোস, কাকিশ, আবদ, ইয়াজদাম, আবি আজরের মত সেনানায়করা এখন কোথায় হুজুর কখনো ভাবেননি। আয়ুবী এদের গোপনে হত্যা করেছে। ওদের অপরাধ ওরা আয়ুবীর চাইতে যোগ্য। এ হত্যার জন্য দায়ী কে? সালাহউদ্দীন প্রশাসনের লোকদের সামনে বলেছে মিসরের খলিফা এদেরকে গাদ্দারী এবং বিদ্রোহের অপরাধে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন।

“মিথ্যে কথা’, খলিফা খেকিয়ে উঠলেন, ‘ঢাহা মিথ্যা কথা। সালাহউদ্দীন আমাকে বলেছিল এরা দেশদ্রোহী। আমি বলেছি, সাক্ষী প্রমাণ নিয়ে মামলা কর।

অথচ কি আশ্চর্য, মামলা না করে সে নিজেই বিচারকার্য শেষ করল, খলিফার অনুমোদন পর্যন্ত নিল না। খলিফার অনুমোদন ছাড়া কোন রায় যে কার্যকরী করা যায় না এ কথা কি তার জানা ছিলনা?

সে সব হতভাগ্য সেনাপতিদের অপরাধ তারা খ্রিষ্টান সম্রাটদের সাথে সুসম্পর্ক গড়েছিল। তারা চেয়েছিল যুদ্ধ বন্ধ করতে। যুদ্ধ কোন জাতির জন্য কল্যাণকর নয়। আপনি হয়ত বিশ্বাস করবেন না, খ্রিষ্টানরা আমাদেরকে শক্ৰ মনে করে না। নুরুদ্দীন জংগী এবং শেরে কুহীর আক্রমণের ভয়েই ওরা যুদ্ধের জন্য তৈরী থাকে। শেরে কুহী মরে গিয়ে আয়ুবীকে তার স্থানে রেখে গেছে। এ লোকটার জীবন কাটবে খ্রিস্টানদের সাথে যুদ্ধ করে। এতে আমাদের শক্র সংখ্যাই বৃদ্ধি পাবে। সালাহউদ্দীনের স্থানে অন্য কেউ গভর্নর হলে খ্রিস্টান রাজারা আপনার কাছে আসতো বন্ধু হয়ে। এত রক্তপাত হতোনা। এভাবে হারিয়ে যেতনা আমাদের অভিজ্ঞ সেনাপতিরা।

তাহলে রোম উপসাগরে খ্রিস্টানরা আক্রমণ করল কেন?

সালাহউদ্দীন আয়ুবী ওদেরকে আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য করেছে। আক্রমণ হচ্ছে সে জানল কিভাবে? আসলে সে-ই এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। প্রতিরোধের ব্যবস্থাও পূর্ব থেকেই করে রেখেছে। না হয় সে কি ফেরেস্তা যে ভবিষ্যতের কথা বলতে পারবে?

তার কারণে হাজার হাজার শিশু পিতৃহীন হয়েছে। বিধবা হয়েছে অসংখ্য নারী। অথচ আমার সামনেই আপনি তাকে ধন্যবাদ দিলেন।।

সুদানী ফৌজ ছিল আপনার অনুগত। রাতের অন্ধকারে সে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিল, এজন্যও আপনি তাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। আসলে আপনি খুব সহজ সরল। কারও ধোকা আর প্রতারণা বুঝতে পারেন না।

খলিফার সাথে মেয়েটার অশ্লীল তৎপরতা তার মদের পিপাসা বাড়িয়ে দিল। খলিফা এখন তার হাতের পুতুল। রজবের প্রতিটি কথা তাঁর মনের গভীরে দাগ কাটতে লাগল।

উম্মে আমারার প্রতি খলিফার দৃষ্টি নিবন্ধ, এ সুযোগে রজব আয়ুবীর উপর একটা মিথ্যে আঘাত করল। বলল, সালাহউদ্দীন এখন মেয়েদের নিয়ে শয়তানী শুরু করেছে। সুন্দরী মেয়েদের এনে কদিন আমোদ ফুর্তি করে। এরপর গুপ্তচরীর অভিযোগ এনে মেরে ফেলে। মারার সময় প্রচার করে, খ্রিষ্টানরা মিসরে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য এবং যুবকদের চরিত্র নষ্ট করার জন্য এসব মেয়েদের পাঠিয়েছিল।

আমি এ শহরের মানুষ। এখানকার বেশ্যালয়গুলোতে রয়েছে মিসর এবং সুদানী মেয়ে। খ্রিস্টান দু’একটা মেয়ে থাকলেও গুপ্তচর নয়। ওরা পেশাজীবী। আমাকে হারেমের তিন চারটে মেয়ে বলেছে, আয়ুবী ওদের নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে নষ্ট করেছে।” উম্মে আমারা বলল।

খলিফার চোখ দুটো রাগে রক্তজবার মত লাল হয়ে উঠল। সগর্জনে তিনি বললেন, আমার হারেমের মেয়ে! একথা আমাকে আগে বলনি কেন?”

আপনি অসুস্থ। এ খবর শুনলে আপনার শরীর আরো খারাপ হবে। এখন কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। আমি এমন ব্যবস্থা করেছি, কেউ ডাকলেও কোন মেয়ে আর বাইরে যাবে না।’

আমি তাকে দোররা মারব, এর প্রতিশোধ নেব আমি।

প্রতিশোধ নেয়ার অনেক পথ আছে। বলল রজব, সাধারণ মানুষ এখন আয়ুবীর পক্ষে। কিছু করতে গেলে তারা আপনার বিরুদ্ধে চলে যাবে।

‘এ অপমান কি আমি মুখ বুজে সহ্য করব?

আপনার অনুমতি এবং সহযোগিতা পেলে ও যেভাবে সেনাপতিদের মত আয়ুবীকেও গুম করে দেয়া যাবে।’ – ‘কিভাবে করবে?” ‘

ঘাতক দলের মাধ্যমে।

তবে ওদের চাহিদা অনেক বেশী।”

যত টাকা লাগে আমি দেব। তুমি ব্যবস্থা কর।’

Ο Ο Ο

দুদিন পর জুম্মা। খোৎবায় খলিফার নাম না নেয়ার জন্য মুফতি ঈসা আল হুকারি খতিবকে অনুরোধ করেছিলেন। খতিব ছিলেন তুর্কি। ইতিহাসে তার পুরো নাম পাওয়া যায়না। আমিরুল আলম হিসেবে পরিচিত।

সে যুগের পুরনো দলিল দস্তাবেজ থেকে জানা যায়, তিনি কয়েকবারই এ বিদআত বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। কারও মতে সুলতান আয়ুবী তাকে এ পরামর্শ দিয়েছিলেন। দু’জন ঐতিহাসিকের মতে এ কৃতিত্বের দাবিদার মুফতি ঈসা। মূলতঃ এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সালাহউদ্দীন আয়ুবী। ধর্মগুরু হিসেবে তা বাস্তবায়ন করেছেন খতিব এবং মুফতি ঈসা।

জুম্মার দিন। মসজিদের মাঝামাঝি কাতারে বসেছেন সালাউদ্দীন আয়ুবী। আলী বিন সুফিয়ান বসেছেন আরো দুসারি পেছনে। আয়ুবীর উপদেষ্টা এবং কর্মকর্তারাও বসে আছেন বিভিন্ন স্থানে।

আলী সমগ্র মসজিদে গোয়েন্দাদের ছড়িয়ে দিয়েছেন। খতিব মিম্বরে উঠলেন। খোৎবা পাঠ করলেন, খলিফার নাম নিলেন না। তার এ পদক্ষেপ খেলাফতের আইনের বিরুদ্ধে মারাত্মক অপরাধ। নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেবল খলিফাই মসজিদে অনুপস্থিত ছিলেন।

নামাজ শেষ হল। উঠে দাঁড়ালেন সালাউদ্দীন আয়ুবী। খতিবের সাথে হাত মেলালেন। তার জুব্বায় চুমো খেয়ে বললেন, “আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করুন।’

খতিব বললেন, “এ নির্দেশ দিয়ে আপনি বেহেস্তে নিজের জন্য ঘর তৈরী করে নিলেন।”

চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়েও কি ভেবে আবার দাড়ালেন আয়ুবী। খতিবকে বললেন, খলিফা আপনাকে ডাকলে সোজা আমার কাছে চলে আসবেন। আমিও আপনার সাথে যাব।”

অপরাধ না নিলে বলব, বাতিল এবং শিরকের বিরুদ্ধে কাজ করা এবং হক কথা বলা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তবে আমি একাই শাস্তি ভোগ করব। এ জন্য আপনার সাহায্য নেবনা। খলিফা ডাকলে আমি একাই যাব। আপনার নির্দেশে নয় বরং খোদার নির্দেশেই খোৎবা থেকে খলিফার নাম বাদ দিয়েছি। আপনাকে ধন্যবাদ সুলতান।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top