‘আমি তোমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি, তুমি যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে এসেছো’। আরোহী তার পাশে বসে বললো, ‘কিন্তু তুমি এমনভাবে বসে আছো কেন? তুমি কি আহত! বলো তোমাকে কি সাহায্য করতে পারি?’
‘আমার শরীরে কোন ক্ষত বা জখম নেই’। সিপাহী বুকে হাত রেখে বললো, ‘জখম আমার এই হৃদয়ের গভীরে। এ ক্ষত থেকে যে অবিরাম রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা আমি তোমাকে কেমন করে দেখাবো!’
যে অশ্বারোহী শান্তভাবে তার পাশে বসেছিল, সে ছিল সুলতান আইয়ুবীর এক গোয়েন্দা। পলায়নপর দুশমনের সাথে মিশে শত্রু এলাকায় যাওয়ার জন্য ময়দান থেকে বের হয়ে এসেছিল সে। এ যুবকের নাম দাউদ! ট্রেনিংপ্রাপ্ত গোয়েন্দা বিধায় সে সিপাহীকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে বুঝে ছিল, একে কাজে লাগানো যাবে। সে বুঝতে পেরেছিল, ভীতি ও আতংকের চাইতে আবেগ ও লজ্জা তাকে আহত করেছে বেশী। আর এ মর্মাহত হওয়ার পিছনে কাজ করছে পরাজয়ের গ্লানি। দাউদ সিপাহীর সাথে এমন দরদভরা কন্ঠে কথা বললো, সিপাহী মনে কথা বলার জন্য একজন দরদী মানুষ পেয়ে মনের সব আবেগ ঢেলে দিল তার সামনে।
‘যুদ্ধ করা আমার বংশগত পেশা’। সিপাইটি বললো, ‘আমার বাবা সৈনিক ছিলেন, দাদাও সৈনিক ছিলেন। সৈনিক পেশা যেমন আমাদের জীবিকার্জনের পথ তেমনি এটাই আমাদের আত্মারও খোরাক। কিন্তু আমার বাপ-দাদারা যুদ্ধ করেছে আল্লাহর সৈনিক হিসাবে! ইসলামের জন্য, ধর্ম ও জাতির জন্য। আমি কার জন্য যুদ্ধ করছি? আমি জানি, খৃস্টানরা আমাদের জঘন্যতম শত্রু। তারা আমাদের জাতির শত্রু। আমি এটাও জানি, আমাদের প্রথম কেবলা এখন খৃস্টানদের অধিকারে। আমার বাবা আমাদের শত্রু কে আর বন্ধু কে তা ছোটবেলা থেকেই গল্প করে জানিয়েছেন আমাকে। শুনিয়েছেন আমাদের পূর্বপুরুষদের সংগ্রাম ও যুদ্ধের অনেক ইতিহাস। আমিও ইসলামের জন্যেই সেনা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। দেশ ও জাতির হেফাজতের মহান আদর্শ ছিল আমার সামনে। সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার পর আমাদের বলা হলো, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী খৃস্টানদের বন্ধু ও চরিত্রহীন লোক। তার আগে আমরা জানতান, সুলতান আইয়ুবী খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। জানতাম, খৃস্টানরা তাকে ভীষণ ভয় পায়। কারণ তিনি মুসলমানদের প্রথম কেবলা খৃস্টানদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য সংকল্প করেছেন। কিন্তু এখন শুনলাম নতুন কথা। সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে অনেক খারাপ মন্তব্য করে আমাদের মন বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করে হলো। আমরা আমাদের সুলতান সাইফুদ্দিন গাজীকে সঠিক মনে করতাম। ভাবতাম, পিতার মত তিনিও ইসলামের একজন সেবক।
একদিন আমাদের বাহিনীকে অভিযান চালানোর আদেশ দেয়া হলো। আমরা যুদ্ধের জন্য অভিযানে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর একদিন শত্রুর মুখোমুখি হলাম। যুদ্ধ চলাকালে আমরা জানতে পারলাম, আমরা মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি, লড়াই করছি সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে।
আমি যখন আইয়ুবীর বাহিনীর মুখোমুখি হলাম, তখন শুনতে পেলাম তাদের ঘোষণা। আইয়ুবীর সৈন্যরা চিৎকার করে বলছিল, ‘হে মুসলমান সৈন্যরা! সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ তোমাদের পয়দা করেননি। তোমাদের শত্রু খৃস্টানরা, আমরা নই! তোমরা আমাদের ভাই। এসো, আমাদের সঙ্গী হও। আমাদের প্রথম কেবলা মুক্ত করার জন্য এসো আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করি। বিলাসপ্রিয় নেশাগ্রস্থ শাসকদের পক্ষে যুদ্ধ করো না। ওরা খৃস্টানদের তল্পীবাহক হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে’। আমি তাদের পতাকা দেখেছি, পতাকার ওপর কালেমা তৈয়ব লিখা আছে। ওরে ভাই, আমি তাদের যে জযবা ও আবেগ নিয়ে যুদ্ধ করতে দেখেছি, তাতে এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে, আল্লাহ তাদের সাথেই রয়েছেন, আল্লাহই তাদের সাহায্যকারী। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমরা এক অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছি। কোত্থেকে তীর ছুটে আসছে, কারা মারছে, কোত্থেক ছুটে আসছে আগুনের শিখা, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
এক স্থানে উপত্যকা দু’ভাগ ভাগ হয়ে ছিল। তার কাছেই ছিলাম আমি। আমার মনে মৃত্যুর ভয় নয়, আল্লাহর ভয় ঢুকে গেল। মনে হলো আমি ভুল পথে আছি। এ ভাবনা মনে জাগতেই আমার বাহু শক্তিহীন হয়ে পড়লো। তলোয়ার ধরে রাখি এমন শক্তিও পাচ্ছিলাম না হাতে। ঘোড়ার লাগাম টানারও শক্তি ছিল না। আমি ঘোড়া নিয়ে সে উপত্যকার ফাঁকের মধ্যে লুকিয়ে পড়লাম। আমি কাপুরুষ ছিলাম না, তবুও আমার শরীর কাপছিল। বাইরে তলোয়ারের সাথে তলোয়ারের অগ্নিস্ফু্লিং হচ্ছিল। ঘোড়ার চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। আর আমার কানে সেই ধ্বনি ভেসে আসছিল, ‘এই পবিত্র রমজান মাসে ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো না…’।
আমার মনে পড়ে গেল আমাদের ইমামের ফতোয়া। তিনি ফতোয়া দিয়েছিলেন, যুদ্ধের সময় রোজা মাফ আছে। কিন্তু সুলতান আইয়ুবীর সেনারা সবাই ছিল রোজাদার! তাহলে আমরা কাদের বিরুদ্ধে লড়ছি!
আমি ততক্ষণে প্রতিপক্ষের তিনজন সৈনিককে হত্যা করে ফেলেছিলাম। তাদের রক্তের ছাপ লেগে আছে আমার তলোয়ারে। সৈনিকরা তলোয়ারে শত্রু সেনার রক্ত দেখে গর্ব অনুভব করে, কিন্তু আমি আমার তলোয়ারের দিকে তাকাতেও ভয় পাচ্ছিলাম। কারণ আমার তলোয়ারে লেগে আছে আমার মুসলিম ভাইয়ের রক্ত! আমি যুদ্ধ করার সাহস ও শক্তি হারিয়ে ফেললাম। ময়দানে না গিয়ে আমি সেখানেই লুকিয়ে রইলাম দীর্ঘক্ষণ।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর এক সৈন্য আমাকে দেখে ফেললো। সে হুঙ্কার দিয়ে আমার সামনে এসে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ করলো এবং আমার দিকে বর্শা তাক করে মারতে প্রস্তুত হলো। আমি আমার রক্তাক্ত তলোয়ার তার ঘোড়ার পায়ের তলে ছুঁড়ে ফেললাম এবং বললাম, ‘আমি তোমার এক মুসলমান ভাই। আমি যুদ্ধ করবো না’।
দূরে তখনো ভীষণ যুদ্ধ চলছে। এ সৈন্যটি সম্ভবত কমান্ডো বাহিনীর ছিল। সে এখানে ওখানে লুকানো সৈন্যদের খুঁজে বেড়াচ্ছিল। সে জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে তুমি বুঝতে পারছো, তোমরা আল্লাহর খাস বান্দাদের সাথে লড়াই করতে নেমেছো?’
আমি আমার অপরাধ স্বীকার করে বললাম, ‘এ পাপ আমাদের দিয়ে করানো হচ্ছে। মিথ্যা ও ভুল বুঝিয়ে আমাদের পথভ্রষ্ট করা হয়েছে’।
সে আমার কাছে থেকে বর্শা নিয়ে নিল, তলোয়ার তো আগেই ফেলে দিয়েছিলাম। সে একদিকে ইশারা করে বললো, ‘আল্লাহর কাছে তোমার গোনাহের ক্ষমা চাও আর এই পথ ধরে চলে যাও। পিছনে তাকাবে না, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে তোমার জীবন ভিক্ষা দিলাম’।
আমার চোখে অশ্রু এসে গেল, যুদ্ধের ময়দানে কেউ কখনো প্রতিপক্ষের প্রাণ ভিক্ষা দেয় না। আমি ঘোড়া একটু ফাঁকে নিয়ে তাড়া করলাম আর সে যে রাস্তা বলেছিল সে রাস্তা ধরে ময়দান থেকে সরে এলাম। রাস্তাটি সত্যি নিরাপদ ছিল।
একস্থানে বিশ্রামের জন্য থামলাম এবং শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে সেই তিন শহীদের চেহারা ভেসে উঠলো আমার চোখের সামনে, যাদেরকে আমি যুদ্ধের ময়দানে হত্যা করেছিলাম। তাদের শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছিল। তারা আমার পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছিল। তাদের হাতে কোন অস্ত্র ছিল না, তারা আমাকে কিছু বলছিলও না। কেবল হাঁটছিল আর নীরবে তাকিয়ে দেখছিল আমাকে। আমি এতই ভয় পেলাম যে, ভয়ে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। আমি শিশুর মত কান্না শুরু করে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল!
রাতে খোলা আকাশের নিচে শীতের তীব্রতা ছিল প্রচন্ড। ঘুম ভাঙতেই আমি টের পেলাম, আমার শরীর থেকে দরদর করে ঘাম বের হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি উঠে বসলাম এবং একটু ধাতস্থ হবার পর আমি আল্লাহর কাছে পাপ ও অপরাধের ক্ষমা চেয়ে নফল নামাজ পড়ে কান্নাকাতর কন্ঠে দোয়া করলাম।
আমি তিন চার দিন এভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বড়ালাম। রাতে আমি ঘুমাতে পারি না। দিনের বেলাতেও শান্তিতে থাকতে পারি না। একটু ঘুম এলেই স্বপ্নে আমার হাতে নিহত ওই তিন শহীদ আমাকে ঘিরে ধরে। দিনের বেলা চলার পথেও আমার মনে হতো, তারা যেন আমাকে আশপাশের ঝোঁপঝাড় ও জঙ্গলের আড়াল থেকে লক্ষ্য করছে।
যদি আইয়ুবীর সেই কমান্ডো, যে আমাকে গোপন স্থানে খুঁজে পেয়েছিল, হত্যা করতো, তবে এ বিপদ থেকে আমি নিস্তার পেয়ে যেতাম। সে আমার জীবন ভিক্ষা দিয়ে আমাকে আরো বিপদে ফেলে দিয়েছে। একেক সময় মনে হয়, সুযোগ থাকলে আমার জান আমি নিজেই বের করে দিতাম। হায়! আমি প্রিয় নবী (সাঃ)-এর তিনজন মুজাহিদকে হত্যা করে ফেলেছি! এখন আমার কি হবে!’ সে আগন্তুকের হাত আকড়ে ধরে বললো, ‘তুমি আমার উপকার করতে চেয়েছো, আমাকে খুন করে তুমি কি আমাকে এ যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই দেবে?’
‘না, তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে!’ দাউদ বললো, ‘তুমি যে মারা যাওনি, এটা আল্লাহরই ইচ্ছা! আল্লাহর ফায়সালা ছিল বলেই তুমি যুদ্ধের ময়দান থেকে তুমি জীবিত ফিরে আসতে পেরেছো! এখন দগ্ধ হচ্ছো সীমাহীন অনুশোচনায়! এতে এটাই প্রমাণ হয়, আল্লাহ তোমার দ্বারা কোন মহৎ কাজ সমাধা করাবেন। তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্য করার জন্যই হয়তো আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আত্মহত্যা নয়, পাপের প্রায়শ্চিত্য করার সে সুযোগকে গ্রহণ করাই হবে এখন তোমার কাজ’।
তাহলে তুমি আমাকে বলো, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সম্পর্কে যে সব খারাপ ও উদ্ভট কথা আমাদের শোনানো হয়েছে, তা সব মিথ্যা!’
‘হ্যাঁ, সবই ডাহা মিথ্যা কথা!’ দাউদ উত্তর দিল, ‘এসব শাসকদের সাথে তার বিবাদের কার শুধু এটাই, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী খৃস্টানদের বিতাড়িত কর এখানে আল্লাহর শাসন কায়েম করতে চান, আর তারা খৃস্টানদের সাথে বন্ধুত্ব করে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চায়। খৃস্টানদের নির্দেশেই তারা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে।‘
দাউদ তাকে জানালো, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কি আশা পোষণ করেন। কেন তিনি সম্মিলিত বাহিনীর সৈন্যদের হাতের নাগালে পেয়েও তাদের হত্যা না করার নির্দেশ দিয়েছেন নিজের সৈন্যদের। মুশেলের আমীর সাইফুদ্দিনের প্রসঙ্গ এলে দাউদ তাকে বললো, ‘তিনি এতই বিলাসপ্রিয় যে, যুদ্ধের ময়দানেও তিনি মদ, মেয়ে এবং পোষা পাখি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।‘
‘এখন আমাকে বলো, আমি কিভাবে ওই তিন মুজাহিদের রক্তের মূল্য পরিশোধ করবো!’ সে দাউদকে বললো, ‘যদি এ বোঝা আমার মন থেকে হালকা না হয়, তবে আমি কিছুতেই শান্তি পাবো না। যদি আমাকে বলো, মুশেলের আমীর সাইফুদ্দিনকে হত্যা করলে এর প্রায়শ্চিত্য হবে, তবে আমি তাকে খুন করতেও রাজি।‘
‘প্রায়শ্চিত্য করার সুযোগ তুমি অনেক পাবে’। দাউদ বললো, ‘এর জন্য প্রয়োজন মনকে সুস্থির করা। এ অস্থিরতা নিয়ে তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। এ জন্য সময়ের প্রয়োজন। সময় এলে আমি তোমাকে বলে দিতে পারবো, কি করলে তোমার পাপের কাফফারা আদায় হবে’।
‘তুমি কি ততক্ষণ আমাকে তোমার সঙ্গে রাখতে রাজি হবে?’ ‘মনে হয় আমরা একই পথে পথিক। ক্ষতি কি চলার পথে একজন বন্ধু পেলে। আমি মুশেলে যাবো’। দাউদ নিজের মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বললো, ‘আমি সেখানকার বাসিন্দা! যুদ্ধ চলছে, এ অবস্থায় কোত্থেকে কি বিপদ এসে পড়ে সেই ভয়ে সদর রাস্তা ছেড়ে আমি এ পথ ধরেছি। ভাল কথা, আমি তো তোমাকে জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি, তুমি কে, কোত্থেকে এসেছো, কোথায় যাচ্ছো? তোমার পরিচয়ই তো এখনো জানা হলো না’।
‘আমার নাম হারেস। আমার গ্রাম এখান থেকে বেশী দূরে নেই’। হারেস উত্তরে বললো, ‘মুশেল এখনো অনেক দূরে। তোমার পথেই পড়বে আমাদের গ্রাম। কিন্তু আমি তোমাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, তুমি আমাদের বাড়ীতে থামতে না চাইলেও আমি তোমাকে থামতে বাধ্য করবো। তুমি আমার আহত মনে শান্তি দিয়েছো, জীবনে সবচে বড় বন্ধুর কাজ করেছো। আমি এমন সত্য ও সরল কথা কখনো শুনিনি। আমি মুশেলের সেনাবাহিনীতে আর কখনো যোগ দেবো না। আশা করি তুমি আমাকে মুক্তির পথ দেখাবে’।
‘হেদায়াতের পথে দেখানোর মালিক আল্লাহ। তিনি কাউকে সত্য সঠিক পথ দেখাতে চাইলে কেউ তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে না। এখন আর কথা নয়, চলো রওনা করা যাক’।
সেই সিপাহী উঠতে উঠতে বললো, ‘চলো’।
তারা দু’জন ঘোড়ায় চেপে বসলো। ঘোড়া এগিয়ে চললো হারেসের বাড়ীর দিকে।
মুশেলের আমীর সাইফুদ্দিন গাজী বৃদ্ধের পর্ণকুটিরে মেঝের বিছানায় শুয়ে গভীর নিদ্রায় ডুবে ছিল। গত কয়েক রাত আতংকে তাকে নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে। আজ একটু নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ত হয়ে এমন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল যে, ঘরের দরজায় এসে ওরা যখন টোকা দিল, তখনও তার ঘুম ভাঙ্গল না।
রাত অর্ধেক্র বেশী পার হয়ে গেছে। মধ্য রাতে একবার ঘুম থেকে উঠতে হয়েছিল সাইফুদ্দিনের জন্য, অনেক রাতে আমার ঘুমিয়েছে বাড়ীর লোকজন, তাই ঘুম ভাঙ্গতে সময় লাগলো ওদের। উপর্যুপরি দরজায় করাঘাত শুনে প্রথমেই ঘুম ভাঙ্গল বৃদ্ধের। চোখ খুলে বিছানায় উঠে বসলো বৃদ্ধ। তার মেয়ে এবং পুত্র বধূও জেগে উঠলো। বৃদ্ধ বিরক্তির স্বরে বললো, ‘মনে হচ্ছে সুলতান আইয়ুবীর তাড়া খেয়ে আবার কোন সৈন্য বা কমান্ডার এসেছে। রাস্তার পাশে বাড়ী হওয়ার এই এক বিপদ!’
বৃদ্ধ উটে গিয়ে দরজা খুললো। দেখলো, বাইরের অন্ধকারে দুই অশ্বারোহী দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতেই অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে এলো হারেস। বাবাকে সালাম করে বললো, ‘আব্বা, আপনারা সবাই ভাল আছেন?’
বৃদ্ধ এগিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো পুত্রকে। বললো, ‘বেটা! আমরা ভাল আছি। আমি খুব খুশি হয়েছি, তুমি অবৈধ মৃত্যুর কবল থেকে সরে আসতে পেরেছো। নইলে যতদিন আমি বেঁচে থাকতাম, লোকজন আমাকে বলতো, ‘তোমার ছেলে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে’।
বৃদ্ধ তার ছেলের বন্ধু দাউদের সাথেও মুসাফেহা করলো।
দাউদ কিছু বলতে যাচ্ছিল, বৃদ্ধ তার ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে ফিসফিস করে বললো, ‘তোমাদের প্রধান সেনাপতি আমীর সাইফুদ্দিন গাজী পাশের কামরায় ঘুমিয়ে আছেন। ঘোড়া বেঁধে রেখে তোমরা সন্তর্পনে ভেতরে চলে আসো।‘
‘সাইফুদ্দিন গাজী!’ হারেস বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তিনি কেমন করে এখানে এলেন?’
‘পরাজিত হয়ে পালাতে গিয়ে এখানে চলে এসেছেন!’ বৃদ্ধ চুপি চুপি বললো, ‘তোমরা ভেতরে চলো’।
ঘোড়া বেঁধে রেখে হারেস দাউদকে নিয়ে তার নিজের কামরায় গেল। বৃদ্ধ ছাড়াও সেখানে বসেছিল তার বোন ও স্ত্রী। সে দাউদকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, ‘আমার এ বন্ধুর নাম দাউদ! এর চেয়ে উত্তম বন্ধু আর কেউ হতে পারে না’।
‘তুমিও কি পালিয়ে এসেছো?’ বৃদ্ধ দাউদকে জিজ্ঞেস করলো।
‘আমি সৈনিক নই’। দাউদ উত্তরে বললো, ‘আমি মুশেলে যাচ্ছি। যুদ্ধ আমাকে এ পথে আসতে বাধ্য করলো। পথে হারসকে সঙ্গী হিসাবে পেয়ে গেলাম আর তার সাথে এখানে চলে এলাম’।
‘বাবা, আমাকে বলো মুশেলের আমীর এখানে কেন?’ হারেস তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো।
বৃদ্ধ ওদের জানালো কেমন করে তিনি এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। তার সাথে তার সহকারী সেনাপতি ও একজন কমান্ডার এসেছিল। তিনি তাদের দু’জনকে কোথায় যেন পাঠিয়ে দিয়েছেন।‘
‘তাদের কোথায় পাঠিয়েছেন কিছুই শোনেননি আপনি?’
‘আমার কানে শুধু এ শব্দটুকুই ঢুকেছিল, ‘সৈন্যদের একত্রিত করো। আর আমাকে জানাও, আমি মুশেল চলে আসবো, না কি আরো কিছুদিন লুকিয়ে থাকবো’। আমি তখন দরজার কাছেই ছিলাম।‘
‘আপনার কি মনে হয়, তিনি মুশেলের সেনাবাহিনীকে সংগঠিত করে আবার যুদ্ধে যেতে চাচ্ছেন?’ দাউদ জিজ্ঞেস করলো।
‘হ্যাঁ। যদিও এখন তিনি ভয়ের মধ্যে আছেন, আমাকে বলেছেন কেউ যেন ঘুর্নাক্ষরেও জানতে না পারে তিনি এখানে আছেন। তবু তার চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়নি আমার’। বৃদ্ধ বললো, ‘আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সংকল্প তার অবশ্যই আছে। তিনি সহকারী সেনাপতিকে মুশেল পাঠালেও তার কমান্ডারকে মুশেল নয়, অন্য কোথাও পাঠিয়েছেন।‘
‘আমি তাকে খুন করবো’। হারেস বললো, ‘তিনি মুসলিম মিল্লাতকে বিভক্ত করে দিয়েছেন। মুসলমান সৈনিকদেরকে লেলিয়ে দিয়েছেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়েছেন। খৃস্টানদের খুশী করতে স্বজাতির রক্তে রঙিন করেছেন নিজের হাত। আমি তাকে খুন করবো’। প্রচন্ড রাগ ঠিকরে পড়ছিল তার চেহারা থেকে। দেয়ালের সাথে তার পিতার তলোয়ার লটকানো ছিল, সে সেটি খপ করে হাতে নিল। বৃদ্ধ পিতা পেছন থেকে চেপে ধরলো তাকে। দাউদ ছুটে গিয়ে তার হাত চেপে ধরে ছিনিয়ে নিলো তলোয়ার। হারেস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মেঝের ওপর পড়ে গেল। বৃদ্ধ ছেলেকে বললো, ‘আহাম্মক, আগে আমার কথা শুনে নাও’।
দাউদও তাকে টেনে তুলে বললো, ‘এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সবকিছু ভাল ভাবে চিন্তা করে নেয়া ভাল। আগে নিজেদের মধ্যে একটা যুক্তি পরামর্শ করে নাও।‘
হারেস অবশেষে মেনে নিল তাদের কথা। সে সুস্থির হয়ে বসলো কিন্তু তার রাগ মিটলো না। তার চোখে মুখে রাগের অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছিল।
‘তাকে হত্যা করা কোন কঠিন ব্যাপার নয়!’ বৃদ্ধ তার ক্ষুদ্ধ পুত্রকে শান্ত করতে বললো, ‘তিনি এখন গভীর ঘুমে অচেতন। এখন তো আমার এক দুর্বল বাহুও তাকে হত্যা করতে পারবে। তাঁর লাশও গোপন করা সম্ভব। কিন্তু তার দুই সাথী, যারা চলে গেছে, তারা তো আমাকে ছাড়বে না। তারা সন্দেহ করে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। তোমার যুবতী বোন ও বৌমাকে নির্মমভাবে অত্যাচার করবে। যদি আমি তাদের বলি, মুশেলের আমীর এখান থেকে চলে গেছেন, তারা কিছুতেই সে কথা মানবে না। কারণ তারা তো তাকে এখানেই রেখে গেছে। আবার তারা এখানেই তার কাছে ফিরে আসবে খবর নিয়ে’।
‘মনে হচ্ছে আপনি সাইফুদ্দিনকে ভাল মানুষ মনে করেন?’
হারেস বললো, ‘আপনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের যুদ্ধ করা জায়েজ মনে করেন?’
‘তাকে আমার গৃহে হত্যা করার ব্যাপারে আপত্তির এও এক কারণ’। বৃদ্ধ বললো, ‘আমি তার সঙ্গীদের সামনেই তাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছি, তিনি ভুল পথে চলছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, তুমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পৃষ্ঠপোষক মনে হচ্ছে? তিনি আমাকে লোভও দেখিয়েছেন। বলেছেন, যদি তোমার ছেলে এ যুদ্ধে মারা গিয়ে থাকে তবে তার বিনিময়ে তোমাকে অঢেল অর্থ দান করবো।আমি তাকে বলেছি, আমি কামনা করি আমার ছেলে শহীদ হোক, কিন্তু হারাম মৃত্যু ও হারাম মাল কখনো আমার কাম্য নয়। সাইফুদ্দিন আমার সম্পর্কে সুধারনা পোষণ করেন। তাকে হত্যা করে লাশ গোপন করে দিলে তাতে চরম বিশ্বাসঘাতকতা হবে। তার কমান্ডার ও সহকারী সেনাপতি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গ্রেফতার করবে। বলবে, তুমি সালাহউদ্দিনের সমর্থক হলে মুশেলের আমীরকে হত্যা করেছো!’
‘দাউদ ভাই!’ হারেস দাউদকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি বলো এখন আমি কি করি! তুমি তো আমার মনের কথা জানো। তুমি সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলে, আল্লাহ আমার গোনাহের কাফফারা আদায় করার জন্য জীবিত রেখেছেন। কাফফারা আদায়ের এমন সুযোগ আর কি হতে পারে! যার দরুন অসংখ্য মুসলমান নিহত হয়েছে এবং বেঁচে থাকলে আরো হবে তাকে শেষ করে দেয়াই কি বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমত্তার কাজ নয়?’
‘এই একটি মাত্র লোককে হত্যা করে কোন লাভ হবে না।‘ দাউদ বললো, ‘এর যারা বন্ধু, মিত্র বাহিনী ও উপদেষ্টা আছে, এ লড়াই তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ফসল। তারা হলবে ও হারানে বিশাল বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে। বহু সেনাপতি ও কমান্ডার আছে এ তিন সেনাদলে। মাত্র এক সাইফুদ্দিনকে হত্যা করে এ যুদ্ধ বন্ধ করা যাবে না। এদেরকে নিরস্ত্র করার জন্য অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন যুদ্ধের ময়দান। প্রবল প্রতিরোধ ও চাপের মুখেই তারা অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হবে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীই কেবল তাদের উপযুক্ত দাওয়াই দিতে পারেন’।
‘তুমি ঠিকই বলেছো। এত বড় কাজ একমাত্র সুলতান আইয়ুবী ছাড়া আর কে করবেন’। হারেস বললো, ‘কিন্তু আমার বুকের মধ্যে প্রতিশোধের যে আগুন জ্বলছে, তা কেমন করে নিভবে? তিন মুজাহিদকে হত্যার কাফফারা কেমন করে আদায় করবো আমি?’
মুশেলের আমীরকে অযাচিতভাবে পেয়ে দাউদ খুব খুশী হয়েছিল। সে যে একজন গোয়েন্দা এ কথা হারেস ও তার বাবাকে বলতে ভয় পাচ্ছিল। আবেগ ও উত্তেজনার বশে নিজের পরিচয় প্রকাশ করা কোন গোয়েন্দার কাজ নয়। কিন্তু পরিচয় প্রকাশ না করলে ওদের সাহায্য সহযোগিতা নেয়া দুষ্কর হয়ে উঠতে পারে। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, সাইফুদ্দিন যেখানেই যাক, সে ছায়ার মত তাকে অনুসরণ করবে। তার প্রতিটি তৎপরতা ও ষড়যন্ত্র গভীরভাবে লক্ষ্য করবে। কিন্তু ততদিন কি বলে সে হারেসের গৃহে অবস্থান করবে! এ জন্যই সব কথা হারেস ও তার বাবাকে খুলে বলা দরকার। তার পরিচয় প্রকাশ করলে যে খুব বিপদ হবে, তা মনে হয় না। হারস তো সাইফুদ্দিনকে হত্যা করতেই চেয়েছিল। তার বাবাও সাইফুদ্দিনের কাজকে তার মুখের ওপর ভুল বলেছে। এসব ভেবেই দাউদ বললো, ‘যদি আমি তোমাকে এমন উপায় বলে দেই, যাতে সাইফুদ্দিন ভবিষ্যতে আর দাঁড়ানোর সুযোগ না পায়, তবে কি তোমরা আমার সঙ্গী হবে?’
‘আশা করি আমার ছেলের মত তুমি আবেগের বশে কিছু বলবে না। সুচিন্তিত উপায় বের করতে পারলে তুমি অবশ্যই আমাদের সহযোগিতা পাবে’। হারেসের বাবা বললেন।
‘তাকে হত্যা করা ছাড়া আর কোন সিদ্ধান্তই আমার মনে ধরবে না’। হারেস বললো।
‘হারেস, যদি তুমি তোমার আবেগ ও চিন্তা ভাবনা সব কিছু আমার নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিতে রাজি হও, তবে তোমাকে এমন কাজে লাগাবো, যাতে তোমার আত্মা শান্তি ও তৃপ্তিতে ভরে যায়’। দাউদ হারেসের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বললো।
হারেসের স্ত্রী ও বোন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওদের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। দাউদ তাদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমাকে একটি কোরআন শরীফ দিতে পারো?’
হারেসের বোন তাক থেকে কোরআন নিয়ে বুকে ও চোখে লাগিয়ে চুমো দিয়ে দাউদের দিকে এগিয়ে দিল। দাউদ কোরআন শরীফ খুলে এক জায়গায় আঙ্গুল রেখে পড়তে শুরু করলো, ‘শয়তান তাকে তার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে নিয়েছে, আর আল্লাহর ভয় ও স্মরণ তার মন থেকে দূর হয়ে গেছে। এ দলগুলো শয়তানের বাহিনী। আর স্মরণ রেখো, শয়তানের বাহিনী ধ্বংস ও ক্ষতি সাধনকারী। আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করবে, সে অবশ্যই লাঞ্চিত ও ঘৃণিত হবে’।
এটা আটাশ পারার আঠারো সূরার উনিশ আয়াত। দাউদ আয়াতটি পড়া শেষ করে কোরআন শরীফ বন্ধ করে বললো, ‘এটা পবিত্র আল্লাহর পবিত্র কালাম। আমি কোন মনগড়া কথা বলছি না, এ কথাগুলো সরাসরি আল্লাহই বলেছেন। এ আয়াত স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছে, সম্মিলিত বাহিনী মূলতঃ শয়তানের বাহিনী। কোরআন বলছে, যে লোকেরা আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধিতা করবে, তারা অবশ্যই লাঞ্ছিত ও ঘৃণিত হবে। কিন্তু তারা সে পর্যন্ত লাঞ্ছিত ও পদদলিত হবে না, যতক্ষণ না আমরা তাদের পদদলিত করতে এগিয়ে যাবো। ওরা শয়তানের দল, এ কথা জানার পর ওদের লাঞ্ছিত ও পদদলিত করা আমাদের ওপর ফরজ হয়ে গেছে’।
সে কোরআন দু’হাতের ওপর রেখে হাত সামনে বাড়িয়ে সবাইকে বললো, ‘সবাই যার যার ডান হাত আল্লাহর এ পাক কালামের ওপর রাখো। তারপর আমার সামনে অঙ্গীকার করো, যে গোপন কথা আমি তোমাদের বলবো, তা কখনো প্রকাশ করবে না। শত্রুদের পরাজিত ও ধ্বংস করতে নিজের জীবন আল্লাহর ওয়াস্তে কোরবানী দেবে’।
মেয়ে দু’জনসহ সকলেই কোরআনের ওপর হাত রেখে অঙ্গীকার করলো। কোরআনের শপথ তাদের মনে বজ্রকঠিন সংকল্প সৃষ্টি করে দিল। তাদের চেহারায় সে অভিব্যক্তি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। কামরার মধ্যে বিরাজ করছিল পিনপতন নীরবতা। কারো নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছিল না। সবাই রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে ছিল দাউদের দিকে।
‘তোমরা সবাই কোরআনের ওপর হাত রেখে কসম খেয়েছো’। দাউদ বললো, ‘আল্লাহতায়ালা কোরআন তোমাদের ভাষাতেই অবতীর্ণ করেছেন। তোমরা এ পবিত্র কিতাবের প্রতিটি শব্দ ও বাক্য বুঝতে পারো। যদি তোমরা এ শপথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, সে শাস্তির কথা কোরআনেই উল্লেখ আছে। তোমাদেরকে আল্লাহ তাদের মত লাঞ্ছিত ও পদদলিত করবেন, যেমন শয়তানের বাহিনীকে করা হবে’।
‘তুমি কে?’ বৃদ্ধ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি বড় ওলি-দরবেশের অনুসারী মনে হয়!’
‘আমার কাছে কোন ওলি-দরবেশের বিদ্যা বা জ্ঞান নেই’। দাউদক বললো, ‘আমার কাছে আছে আল্লাহর কালাম ও সেই কালামের নির্দেশ, যা সব সময় আমাকে পথ দেখায়। আমি কোরআনের আলোয় পথ চলতে ও কাজ করতে গিয়ে জানবাজি রেখে এখানে এসে পৌঁছেছি। এ শিক্ষা কোন আলেম ও পীরের কাছ থেকে লাভ করিনি, আমার শিক্ষক ও আমার নেতা সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। আমি মুশেলের বাসিন্দা নই। দামেশকের নাগরিক আমি। সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা হিসাবে আমি এখানে এসেছি। এই সে গোপন কথা, যে কথা গোপন রাখার জন্য আমি তোমাদেরকে কোরআন ছুঁয়ে শপথ করিয়েছি, যেন তোমরা এ গোপন তথ্য ফাঁস করে না দাও। তোমাদের সহযোগিতা দরকার আমার। আমাকে আশ্বাস দাও, তোমরা আমাকে সহযোগিতা করবে?’
‘হ্যাঁ, আমরা কোরআনের কসম করে এ আশ্বাস তোমাকে দিচ্ছি’। বৃদ্ধ বললো, ‘তুমি এখন কিভাবে কি করতে চাও সব খুলে বলো’।
‘আল্লাহর অসীম রহমত আমার ওপর’। দাউদ বললো, ‘আমি যে লোকটির মনে কথা বের করার জন্য সুলতান আইয়ুবীর কাছ থেকে মুশেলের দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম, সে লোকটি এখন এখানে এই কুটিরের চালার নিচে শুয়ে আছে। আল্লাহ আমাকে তার কুদরতি মদদে সঠিক স্থানে পৌছে দিয়েছেন। এখন আমাকে জানতে হবে, সাইফুদ্দিন ও তার সাথীরা পরবর্তীতে কি সংকল্প ও কি কর্মসূচী গ্রহণ করে। যদি এরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে তবে সে তৎপরতার খবর আগেই পৌঁছে দিতে হবে আইয়ুবীর দরবারে। যাতে তিনি তাদের সব ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা বানচাল করে দিতে পারেন। এখন তাদের পরিকল্পনা ও ইচ্ছা জানাই আমার কাজ। আল্লাহ না করুক, তারা যদি সুলতান আইয়ুবীকে অপ্রস্তুত অবস্থায় আক্রমণ করে বসে তাহলে তার কি পরিণাম হবে ভাবতে পারেন?’
‘সৈন্যদের লেলিয়ে দিয়ে যারা মুসলমানদের হত্যা করতে চায়, তাদেরকে কি হত্যার করার অনুমতি দেয়া হবে?’ হারেস জিজ্ঞেস করলো।
পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »