১৬. টার্গেট ফিলিস্তিন

আইয়ুবীর মনে পড়ে গেল, মুসলিম আমীর ও শাসক শ্রেণীর মনে এ লালসা ও নেশা ঢুকিয়েই ইহুদী ও খৃস্টানরা মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল ফিলিস্তিন। অধিকার করে নিয়েছিল বহু ছোট ছোট মুসলিম রাজ্য ও পরগনা। যেখানে ইহুদী ও খৃস্টানরা সরাসরি করায়ত্ব করতে পারল না, সে রাজ্যের শাসক শ্রেণীর মধ্যে এ বিষ এমনভাবে ঢুকিয়ে দিল যে, সেসব মুসলমান আমীর ও শাসকরা হয়ে দাঁড়াল ওদের তল্পীবাহক। দেখতে দেখতে ইহুদী ও খৃস্টানরা সর্বক্ষেত্রেই মুসলমানদের এমন মোড়ল সেজে বসলো, কে যে ওইসব আমীরদের বন্ধু আর কে নয়, বুঝে উঠা দুষ্কর হয়ে উঠলো। একজন মুসলমান আমীর বা সেনাপতি, সে যে কার অনুগত, মুসলিম উম্মার নাকি খৃস্টানদের, এ প্রশ্নের কোন নিরেট জবাব ছিল না কারো হাতে। অবিশ্বাসের এক অদৃশ্য ছোবল প্রত্যেকেই অনুভব করছিল নিজ নিজ বুকে

নূরুদ্দিন জংগী ও সুলতান আইয়ুরীর সামনে এ ছিল এক বিরাট সমস্যা। নূরুদ্দিন জংগীর মৃত্যুর পর সুলতান আইয়ুবী এ সমস্যা আরো তীব্রভাবে অনুভব করলেন। আর এ গাদ্দারদের মোকাবেলার জন্যই সর্বক্ষণ তাকে পেরেশান থাকতে হতো। ফিলিস্তিন অভিমুখে যাত্রা করে সুলতান আইয়ুবী পথে নামলে পদে পদে তিনি খৃস্টানদের তল্পীবাহক কালেমা পড়া এসব আমীরদের বাঁধার সম্মুখীন হন। ফলে খৃস্টানদের সাথে মোকাবেলা করার পরিবর্তে ওদের সাথেই তাকে জড়িয়ে পড়তে হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। আর খৃস্টান ক্রুসেডাররা ওদের উৎসাহ ও মদদ দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে বসে এ তামাশা উপভোগ করছিল।

এর আগে সুলতান আইয়ুবী প্রতিটি রণক্ষেত্রে খৃস্টানদের পরাস্ত করে ওদের যে ক্ষতি করেছিলেন, এভাবে ভ্রাতিঘাতি যুদ্ধ বাঁধিয়ে ওরা তার প্রতিশোধ নিচ্ছিল। তারা মুসলমান আমীরদেরকে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য কেবল উৎসাহ নয়, সামরিক সাহায্যও অব্যাহত রাখলো। এ বিব্রতকর লড়াইয়ে সুলতান আইয়ুবী প্রচন্ড মানসিক কষ্ট ভোগ করছিলেন। কিন্তু যখন মরহুম নূরুদ্দিন জংগীর পুত্র আল মালেকুস সালেহের সাথে তাকে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে হলো তখন এ কষ্ট তীব্র আকার ধারণ করলো। পিতার মৃত্যুর পর খৃস্টানদের তল্পীবাহক আমীররা সালেহকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে। তার সাথে যোগ দিয়েছিল মুশালের আমীর সাইফুদ্দিন গাজী ও হারান দূর্গের অধিপতি গুমাস্তগীন। তিনি ভেবেছিলেন, সম্মিলিত বাহিনীর পরাজয়ের পর এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। বিশেষ করে আল মালেকুস সালেহ সন্ধি প্রস্তাব পাঠালে তিনি মনে করলেন, যাক , এতদিন সালেহ তার ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু গোয়েন্দার চিঠিতে তার বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানতে পেরে সীমাহীন পেরেশানীতে পড়ে গেলেন আইয়ুবী। ফিলিস্তিন অগ্রযাত্রা মুলতবী রেখে এ বিশ্বাসঘাতকদের সাথে শেষবারের মত হিসাব নিকাশ চুকিয়ে নিতে সংকল্পবদ্ধ হলেন তিনি।

১১৭৫ সালের এপ্রিল মাস। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে একটি পর্ণ কুটিরে আশ্রয় নিল আল মালেকুস সালেহের ঐক্যজোটের অন্যতম সদস্য সুলতান সাইফুদ্দিন গাজী। অপর সদস্য হারানের সেনাপতি গুমাস্তগীন ভয়ে হারানে না ফিরে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটলো হলবের পথে। তিনজনই তাদের ক্যাম্পের মূল্যবান তাঁবু, রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র ছেড়ে পালিয়েছিল। সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা তাদের সৈন্যদের যুদ্ধবন্দী করার সাথে সাথে সেগুলোও করায়াত্ব করলো।

যুদ্ধবন্দীদের হাজির করা হলো সুলতান আইয়ুবীর সামনে। তিনি তাদের বললেন, ‘খোদার কসম, ক্ষমতার মোহ বা বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আমার সৈনিকরা অস্ত্র ধরেনি। আমরা লড়াই করছি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আমাদের আপাতত টার্গেট ফিলিস্তিন বিজয়। ফিলিস্তিনের এ অগ্রযাত্রার পথে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সালেহ, সাইফুদ্দিন ও গুমাস্তগীন। তাই তাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হয়েছে। তোমাদের সাথে আমাদের কোন দুশমনী নেই। তোমরা মুসলমান, আমাদেরই ভাই। তোমরা যদি এই ভ্রাতৃত্ব মেনে নাও, ওয়াদা করো আর কখনো ইসলামের অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধক হবে না, তবে এখন থেকে তোমরা স্বাধীন। আমি বিনা শর্তে তোমাদের সবাইকে মুক্তি দিচ্ছি। তোমরা এখান থেকেই যার যার বাড়ি চলে যেতে পারো। যারা ইসলামের জন্য আমাদের সাথে ফিলিস্তিন অভিমুখে যেতে চাও, তাদেরকে দাওয়াত দিচ্ছি আমার বাহিনীতে শামিল হওয়ার জন্য’।

সুলতান আইয়ুবীর এ উদারতা ও মহত্ব ছিল জাতির প্রতি তার অসম্ভব ভালবাসা ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধর অনন্য স্বাক্ষর। তিনি যে উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তার ফলও পেয়েছিলেন সাথে সাথে। যুদ্ধবন্দীদের কেউ কেউ ফিরে গেলেও অধিকাংশই আইয়ুবীর বাহিনীতে ভর্তি হয়ে হয়েছিল।

যুদ্ধের ময়দান থেকে আল মালেকুস সালেহ, সাইফুদ্দিন গাজী ও গুমাস্তগীনের পলায়ন কোন সাধারণ ঘটনা ছিল না। এর রাজনৈতিক ও মনস্তাত্বিক প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী। গুমস্তগীন হারানে না গিয়ে হলবে আল মালেকুস সালেহের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। হারান ছিল যুদ্ধের ময়দান থেকে সবচেয়ে কাছে। সুলতান আইয়ুবী তাকে অনুসরণ করে হারানের দিকে যাত্রা করতে পারে এই ভয়ে গুমাস্তগীন নিজের কেল্লার মায়া ছেড়ে পালিয়েছিল। এতেই বুঝা যায়, সে কতটা ভয় পেয়েছিল।

অন্যদিকে একাধারে মুশেলের আমীর, শাসক ও সেনাপতি আশ্রয় নিয়েছিল এক অজ্ঞাত পর্ণকুটিরে। বীর যোদ্ধা ও কুশলী সেনাপতি হিসাবে তার যথেষ্ট সুনাম ছিল। কিন্তু সেই সুনামকে ছাই চাপা দিয়ে সে আশ্রয় নিয়েছিল পর্ণকুটিরে।

এমনটিই হয়। মুসলমান তাঁর ঈমান বিক্রি করে দিলে সিংহ থেকে পরিনত হয় ভেড়ায়। কারণ যে ঈমান তার ঢাল ও  তলোয়ার, তাই সে হারিয়ে ফেলেছে। সাইফুদ্দিন এতই সৌখিন ও বিলাসপ্রিয় ছিল, যুদ্ধের ময়দানেও হেরেমের বাছাইকৃত সুন্দরীদের সে সঙ্গে রাখতো। সাথে থাকতো মদের বোতল ও সুরা পাত্র। আর থাকতো তার অতি প্রিয় সুন্দর সুন্দর পোষাপাখী। কিন্তু পালাবার সময় এ সব আমোদ-স্ফুর্তির উপকরণ ফেলে রেখেই পালাতে হয়েছিল তাকে। তার সহ-সেনাপতি পালাবার সময় তাকে পরামর্শ দিয়েছিল মুশেল যেতে, কিন্তু সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডোদের ভয়ে এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে সাইফুদ্দিন তাঁর দুই সঙ্গীকে নিয়ে মুশেলের পথ থেকে একদিকে সরে পড়েছিলো। ভয় পাচ্ছিল, আইয়ুবীর কমান্ডোরা তার পিছু নিল কিনা!

সাইফুদ্দিন যেদিকে পালিয়েছিল সে অঞ্চলটা ছিল খুবই দুর্গম। কাটাগুল্ম পরিবেষ্টিত পাহাড়ী উপত্যকা, মাঝে মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সবুজ প্রান্তর। আত্মগোপন করার জন্য খুবই উপযুক্ত জায়গা।

তিনি সেই দুর্গম অঞ্চল দিয়ে এগিয়ে যেখানে থামলেন, সে জায়গাটা মুশেল শহর থেকে তখনো বেশ দূরে।

রাত তখন গভীর। কাক জ্যোস্নার মধ্যে কিছু ছোট ছোট পাহাড়ী বাড়ীঘর নজরে এলো তার। সাইফুদ্দিন এগিয়ে গেলো সেই বাড়ীগুলোর দিকে। প্রথম বাড়ীর সামনে গিয়েই দরজায় আঘাত করলো। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে উঠে এলো এক বৃদ্ধ। মুখে তার সফেদ দাড়ি। দরজা খুলেই দেখতে পেলো সামনে তিনজন অশ্বারোহী দাঁড়িয়ে। তারা এমনভাবে হাপাচ্ছিল, দেখেই বুঝা গেল, প্রাণভয়ে কোথাও থেকে পালিয়ে এসেছে। বৃদ্ধ তাদের জিজ্ঞেস করলো, ‘মনে হচ্ছে তোমরা মুশেলের সেনাবাহিনীর লোক! এত রাতে কি মনে করে দরজায় কড়া নাড়লে?’

‘আগে আমাদের একটু পানি খাওয়াও’।

‘অ, হ্যাঁ, তাইতো! গত দু’দিন যাবত যারা আসছে, সবাই এসেই প্রথমে পানি খেতে চায়’। বৃদ্ধ পানি আনতে ভেতরে ঢুকে গেল।

পানি নিয়ে এলে সাইফুদ্দিন তাকে প্রশ্ন করলো, ‘কারা দু’দিন যাবত এদিকে আসছে?’

‘দু’দিন যাবত মুশেলের সৈন্যরা এদিক দিয়ে পালাচ্ছে। তারা পানি পান করার জন্য এখানে থামে, পানি খাওয়া হলেই আবার যাত্রা করে মুশেলের দিকে’।

‘এখান থেকে মুশেল কত দূর?’ সাইফুদ্দিন জিজ্ঞেস করলো।

‘যদি কোথাও না থামো তবে ভোর হওয়ার সাথে সাথেই পৌঁছে যেতে পারবে’। বৃদ্ধ বললো, ‘এ গ্রামও মুশেলের এলাকাধীন’।

‘আমরা বড় ক্লান্ত। যদি রাত কাটানোর মত জায়গা পাই তবে আজ আর এগুবো না। তোমার এখানে কি রাতটুকুর জন্য থাকার মত জায়গা হবে?’ সাইফুদ্দিন বললো।

‘জায়গা তো থাকে মানুষের মনের মধ্যে’। বৃদ্ধ উত্তরে বললো, ‘ এ গরীবের ঘরে যদি তোমরা থাকতে পারো, তবে নিশ্চয়ই জায়গা হবে। নেমে ভেতরে এসো’।

তিনজন ঘোড়া থেকে নেমে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলো। বুড়ো ঘোড়াগুলো বাড়ীর পিছনে নিয়ে বেঁধে রেখে ফিরে এলো কামরায়। মশালের আলোয় আগন্তুকদের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো বৃদ্ধ। মনযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো ওদের পোষাক।

‘আমাকে চিনতে চেষ্টা করছো?’ সাইফুদ্দিন হেসে বললো।

‘তুমি তো কোন সিপাহী নও!’ বৃদ্ধ অবাক হয়ে বললো, ‘তুমি খুব বড় কোন অফিসার বা সেনাপতি হবে!’

‘ইনি মুশেলের আমীর গাজী সাইফুদ্দিন’। সঙ্গী একজন বললো, ‘তুমি কোন সাধারণ লোককে মেহমান রাখোনি। তোমার মেহমানদারীর উপযুক্ত মূল্য তুমি পাবে। আমি সহকারী সেনাপতি আর এ ব্যক্তি এক উর্ধতন সেনা কমান্ডার’।

‘একটি কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শোনো’। বুড়োকে উদ্দেশ্য করে সাইফুদ্দিন বললো, ‘এমনও হতে পারে, আমাকে দীর্ঘদিন তোমার ঘরে অবস্থান করতে হবে। আমি দিনের বেলা বাইরে বের হবো না। আমি এখানে আছি একথা কোনভাবেই জানাজানি হওয়া চলবে না। কারণ কেউ জেনে গেলে বিপদের সম্ভাবনা আছে। যদি এমন কিছু ঘটে যায় তবে আমি তো বিপদে পড়বোই, তোমার ভাগ্যেও দুর্ভোগ ছাড়া কিছুই জুটবে না। অতএব সাবধান! আর যদি তুমি গোপনীয়তা বজায় রাখতে পারো, তবে অশেষ মূল্য পাবে’।

বৃদ্ধ বললো, ‘এটা মুশেলের অঞ্চল। এর সব বাড়ীঘর আপনার। আপনি  আপনার রাজ্যের যেখানে খুশী, যেভাবে খুশী থাকবেন। আমরা আপনার নগণ্য প্রজা। আমাদের যেভাবে হুকুম করবেন সেভাবে চলবো। যতদিন এখানে থাকবেন, অন্তর দিয়ে আপনার খেদমত করবো। আপনি যদি লুকিয়ে থাকতে চান তবে তাই হবে। আমাকে নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আপনার আস্থা অর্জনের জন্য এটুকু বলাই যথেষ্ট মনে করি, আমার কলজের টুকরো ছেলেকে আমি আপনার সেনাবাহিনীতে দিতেও দ্বিধা করিনি’।

‘আমি তাকে সেনাপতি পদে প্রমোশন দেবো’। সহকারী সেনাপতি বললো।

বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘এক পিতা হিসাবে এ কথা শুনে আমার খুশী হওয়া উচিৎ। কোন্‌ বাপ ছেলের উন্নতি চায় না! কিন্তু বড় কষ্টে আজ বলতে ইচ্ছে করে, দয়া করে যদি তাকে আপনি সেনাবাহিনী থেকে নিস্কৃতি দেন তাহলেই আমি বেশী খুশী হবো’। বৃদ্ধের উদাস চোখে ভাসতে লাগলো ছেলের চেহারা।

‘ঠিক আছে, আমি তাকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দেবো’। সাইফুদ্দিন বললো, ‘জানি, প্রত্যেক পিতাই চায়, তার সন্তান যেন বেঁচে থাকে। আমি তাকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে দেবো’।

‘উদ্দেশ্যহীনভাবে বেঁচে থাকার মধ্যে কোন স্বার্থকতা নেই। আমি তাকে এ জন্য সেনাবাহিনীতে পাঠাইনি, লড়াইয়ের সময় দুশমনের সামনে বুক পেতে দেয়ার পরিবর্তে কাপুরুষের মত সে পেছনে পড়ে থেকে জীবন বাঁচাক। এক পিতা হিসাবে সে বেঁচে থাকুক তা আমি অবশ্যই চাই, কিন্তু তারচে বেশী করে চাই, জাতির খেদমতে সে জীবন উৎসর্গ করুক, আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে প্রয়োজনে বিলিয়ে দিক নিজের জীবন’। বৃদ্ধ বললো, ‘আমি তাকে সেনাবাহিনীতে পাঠিয়েছিলাম মহৎ চিন্তা-চেতনা ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে। একদিন এ আদর্শের জন্যেই আমিও অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম। যখন আমি সৈনিক ছিলাম, আপনি তখন জন্মই গ্রহণ করেননি। আল্লাহ আপনার পিতা কুতুবউদ্দিন মুরহুমকে জান্নাতবাসী করুন, আমি তারই অধীনে সেনাবাহিনীতে ছিলাম। কিন্তু আমরা কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি, আর আপনি আমার পুত্রকে ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাচ্ছেন। আমি তার শাহাদাতের আশা করেছিলাম, কিন্তু আত্মঘাতী মৃত্যু আশা করিনি’।

‘সালাহউদ্দিন আইয়ুবী নামে মাত্র মুসলমান’। সাইফুদ্দিন বললো, ‘সে উচ্চাভিলাসী ও ক্ষমতালিপ্সু। সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য সে মরহুম নূরুদ্দিন জংগীর নাবালক পুত্রের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধরেছে। তাই তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কেবল জায়েজ নয়, ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে’।

‘সম্মানিত মুরুব্বি!’ সহকারী সেনাপতি বললো, ‘এসব রাজনৈতিক বিষয় আপনি বুঝবেন না, আমরা ভাল করেই জানি কে মুসলমান আর কে কাফের!’

‘ওরে আমার ছেলেরা! বৃদ্ধ বললো, ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো। আমার বয়স এখন পঁচাত্তর বছর। আমার বাবা নব্বই বছর বয়সে মারা যান। আমার দাদা পঞ্চাশ বছর বয়সে যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হন। দাদাজান তাঁর সময়কার যুদ্ধের ঘটনাবলী ও হতিহাস আমার বাবাকে বলে যান। বাবাও দাদার ও তাঁর যুগের জিহাদের ঘটনাবলী আমার অন্তরে গেঁথে দিয়ে গেছেন। তাই আমি দাবী করতে পারি, আমি যা জানি তোমরা তা জানো না। রাজ্য ও ক্ষমতার নেশায় যেখানে ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, সেখানে একদিন না একদিন কোন এক ভাই পালিয়ে গরীবের কুটিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য নয়। এমন ঘটনা তোমাদের যুগের আগেও বহু ঘটেছে, তাদেরও ঠিকই এমনিই পরিণতি ঘটেছিল। তোমাদের তিন বাহিনীকে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কিভাবে বিতাড়িত করেছে সে দৃশ্য তোমাদের দেখেই বুঝতে পারছি। তোমাদের সাথে যদি আরো সৈন্য থাকতো, তারাও তোমাদের মত পালানোর জন্য এভাবেই পেরেশান ও ব্যতিব্যস্ত থাকতো। গত দু’দিন ধরে যাদেরকে এ পথে পালিয়ে যেতে দেখেছি, সবার মাঝেই ছিল একই রকম আতঙ্ক ও ভয়। কিন্তু যারা দ্বীন-হক্ক ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তারা পরাজয়ের সম্মুখীন হলে পলায়ন না করে প্রাণপণ যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে যায়। যুদ্ধের ময়দান ভরে উঠে তাদের লাশে, কিন্তু তারা পিছু হটে না। কে হকের পথে আছে আর কে নেই, তা সৈনিকদের চোখের দিকে তাকালেই বুঝা যায়’।

‘তোমাকে সুলতান আইয়ুবীর সমর্থক মনে হচ্ছে!’ সাইফুদ্দিন এমন স্বরে কথা বললো, যাতে একই সাথে বিস্ময় ও রাগের ভাব প্রকাশ পাচ্ছিল, ‘তবে তা তোমার  ওপর বিশ্বাস করা যায় না!’

ইতিমধ্যে একটি কিশোরী মেয়ে খাবার নিয়ে কামরায় প্রবেশ করলো। তার পিছনে পিছন এলো এক যুবতী, তার হাতেও খাবারের থালা। সাইফুদ্দিনের দৃষ্টি কিশোরী মেয়েটার ওপর নিবদ্ধ হলো। খাবার রেখে চলে গেল তারা, সাইফুদ্দিন বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলো, ‘মেয়ে দু’টি কে?’

‘ছোটটা আমার মেয়ে’। বৃদ্ধ বললো, ‘আর বড়টা আমার পুত্র বধূ। আমার যে ছেলে আপনার সেনাবাহিনীতে আছে তার বেগম। যখনি আমার বউমার দিকে তাকাই, কেন যেন মনে হয়, আমার বউ মা বিধবা হয়ে গেছে’।

‘তোমার ছেলে এ যুদ্ধে মারা গিয়ে থাকলে আমি তোমাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসাবে দান করবো’। সাইফুদ্দিন বললো, ‘আর তোমার এই মেয়ের জন্যও কোন চিন্তা করো না। তাকে কোন গরীবের ঘরে বউ হয়ে যেতে হবে না। আমি তাকে নিয়ে যাবো আমার মহলে। সেখানে সে রাজরানীর মর্যাদায় থাকবে’।

‘আমি আমার ছেলেকে কারো কাছে বিক্রি করিনি, আর মেয়েকেও কারো কাছে বিক্রি করার ইচ্ছে নেই’। বৃদ্ধ বললো, ‘পর্ণকুটিরে বড় হওয়া মেয়ে কোন সিপাহীর পর্ণকুটিরেই মানাবে ভালো। আমি আর একবার আপনার কাছে আবেদন করছি, আপনি আমাকে আর লোভ দেখাবেন না। আপনি এখন আমার মেহমান! আপনার সমস্ত রকমের খেদমতের ব্যবস্থা করা আমার দায়িত্ব। আমি তাতে কোনরকম ত্রুটি করবো না’।

‘থাক, এসব নিয়ে তোমাকে আর বিরক্ত করবো না। যাও, তুমি শুয়ে পড়োগে!’ সাইফুদ্দিন বৃদ্ধকে বললো, ‘তোমার ওপর বিশ্বাস ও ভরসা করা যায়। তোমার প্রতি আমি এজন্য খুশী যে, আমার রাজ্যে তোমার মত সত্যবাদী ও স্পষ্টভাষী নীতিবান লোক এখনও বেঁচে আছে’।

বৃদ্ধ সেখান থেকে চলে গেল। সাইফুদ্দিন তার সঙ্গীদের বললো, ‘এ ধরনের লোক কখনো ধোঁকা দিতে পারে না। তোমরা এর কন্যাকে দেখেছো, কি ফুলের মত সুন্দর!’

‘একদম খাঁটি মোতি!’ সহকারী সেনাপতি বললো।

‘এদের অবস্থা একটু ভাল হলে তবে এ মোতি সুন্দর ঝুড়িতে পড়বে’। সাইফুদ্দিন হেসে সহকারী সেনাপতিকে বললো, ‘তুমি মুশেলের সংবাদ নাও, সৈন্যদের একত্রিত করো। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর তৎপরতার খবর নাও। আমাকে অতিসত্ত্বর জানাও, আমি মুশেলে আসবো, নাকি আরো কিছুদিন অপেক্ষা করবো’। এরপর কমান্ডারের দিকে ফিরে বললো, ‘তুমি হলবে যাও। ওদের বলবে, আমি নিরাপদ ও সুস্থ আছি’।

সাইফুদ্দিনকে সে বাড়ীতে রেখে রাতের অন্ধকারেই দু’জনে যাত্রা করলো সেখানে থেকে। আমীর সাইফুদ্দিন একা রয়ে গেলো সে বাড়ীতে। শরাবে বিভোর হয়ে সুন্দরী মেয়েদের পাশে নিয়ে মহলে জীবন কাটানো যার অভ্যাস, সেই সাইফুদ্দিন এখন এক কাঁচা বাড়ীর পর্ণকুটিরে মেঝের বিছানায় এলিয়ে দিল তার ক্লান্ত দেহ। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর নিদ্রা এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে।

এর ঠিক একদিন আগের ঘটনা। যুদ্ধের ময়দান থেকে এক সৈন্য পালিয়ে মুশলের দিকে যাচ্ছিল। সে ঘোড়া ছুটালো এবং এক সময় ঘোড়া থামিয়ে চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো, কেউ তাকে অনুসরণ করছে কিনা বা দেখছে কিনা। যখন নিশ্চিত হলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে না, তখন সে ধীরে ধীরে চলতে লাগলো। কখনো ঘোড়া থামিয়ে ভয়ে চারদিক দেখে নিতো। সে চলাচলের রাস্তা থেকে একটু দূর দিয়ে যাচ্ছিল। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল, ভয় ও আতংক তার বুদ্ধি বিবেক আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ঠিকমত কাজ করছে না মাথা।

এক জায়গায় সে ঘোড়া থামালো। চারদিক ভাল করে দেখে নিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে এলো। তারপর কেবলামুখী হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। নামাজ শেষে দোয়ার জন্য হাত উঠিয়ে অঝোর ধারায় কেঁদে বুক ভাসালো। মোনাজাত শেষ হলেও সে সেখান থেকে উঠলো না, সেখানেই দুই হাটুর মধ্যে মাথা লুকিয়ে বসে রইলো। এ লোক ছিল সুলতান সাইফুদ্দিন গাজীর এক সৈনিক।

পরাজিত সৈন্যরা যখন ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাচ্ছিল, সে সময় সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারা তাদের মধ্যে মিশে গেল। সুলতান আইয়ুবী গোয়েন্দা সংস্থাকে আগেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, শত্রুরা যখন পিছু হটে পালাতে থাকবে, তখন কিছু সংখ্যক সাহসী কমান্ডো যেন বেশ বদল করে তাদের সঙ্গে মিশে যায়। শত্রু এলাকায় গিয়ে তাদের গতিবিধি, কার্যকলাপ, সৈন্য গঠনের খবরা-খবর সংগ্রহ করে এবং সময় সুযোগ করে সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

দামেশক থেকে যখন আল মালেকুস সালেহ সৈন্য নিয়ে পালিয়েছিল, সে দলের সাথেও কিছু গোয়েন্দা পালিয়ে তাদের সাথে হলব শহরে প্রবেশ করেছিল।

এ কথা আগেও বলা হয়েছে, সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধের সাফল্যের পেছনে এ গোয়েন্দা বিভাগের অবদান ও ভূমিকা ছিল সরাসরি লড়াইয়ের চাইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই গোয়েন্দা বিভাগের লোক নির্বাচনের সময় অসাধারণ বুদ্ধিমান ও ধীর মস্তিষ্কের লোকদের প্রতি অধিক নজর দেয়া হতো। এরা যে কোন সমস্যায় ত্বরিত সমাধানের যোগ্যতা রাখতো। ক্ষিপ্র গতি ও অস্ত্র চালনায় অসম্ভব দক্ষতা ছিল এদের বৈশিষ্ট্য।

১১৭৫ সালের এপ্রিল মাসে সুলতান আইয়ুবী যখন সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে হলবের পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁর গোয়েন্দা প্রধান হাসান বিন আবদুল্লাহর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দারা তখন বিচ্ছিন্ন শত্রু সেনাদের সাথে মিশে হলব, মুশেল ও হারান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। শত্রুদের পরবর্তী প্ল্যান ও তৎপরতার তথ্য সরবরাহের জন্য তারা ছিল যে কোন ধরনের ঝুঁকি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত।

এদের অনেকে ছিল শত্রুদের পোষাকে, কেউ কেউ গ্রাম্য সাধারণ লোকের বেশে। তাদের সেখানে অবস্থান করা ছিল খুবই জরুরী, কেননা শত্রুর পরবর্তী আক্রমণের পরিকল্পনা ও তৎপরতার আলোকেই সুলতান আইয়ুবীকেও তার পরিকল্পনা সাজাতে হবে।

সুলতান আইয়ুবী শত্রুদের যে ক্ষতি করেছিল তাতে তাদের ধারনা ছিল, শত্রুদের পুনর্গঠিত হতে অনেক সময় লাগবে। শত্রুদের যে তিনটি দল ছিল, সুলতান আইয়ুবী ভালভাবেই জানতেন যে, এ তিন দলের মধ্যে কোন আন্তরিকতা ও মিল নেই। এ তিন দলের প্রত্যেক দলনেতারই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল, আইয়ুবীকে পরাজিত করে ইসলামী সাম্রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতার মালিক নিজে হওয়া। তারা মনে মনে একে অন্যের বিরুদ্ধে থাকলেও অবস্থার প্রেক্ষিতে সুলতান আইয়ুবী তাদের সকলেরই প্রধান শত্রু ছিলেন। এ জন্যই তাদের একত্রিত হওয়া ও এক কমান্ডে যুদ্ধ করা সম্ভব হয়েছিল। গোয়েন্দারা খবর নিয়ে নিশ্চিত হলো, পরবর্তীতেও ঐক্যবদ্ধ কমান্ডেই যুদ্ধ চালানোর পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে।

তবুও সুলতান আইয়ুবী বেশ ভাল মতই বুঝতেন, এমন বিলাসপরায়ণ ও আরামপ্রিয় আমীররা যুদ্ধের ময়দানে অধিক সময় টিকে থাকতে পারবে না। তিনি একথাও বুঝতেন, এ আরাম প্রিয়দের উস্কে দেয়া এবং তাদের পরিপূর্ণ মদদ ও সাহায্য-সহযোগিতা খৃস্টানরাই দিয়ে যাচ্ছে। এসব আমীরদের পাশে খৃস্টানদের উপদেষ্টা সব সময় আছে এবং তারাই যুদ্ধের মূল পরিকল্পনা তৈরী করে দিচ্ছে।

তবে বিপথগামী মুসলমান সেনাপতিদের মধ্যেও এমন দু’চারজন আছে, যারা নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা রাখে। তাদের মধ্যে মুজাফফর ইবনে জয়নুদ্দিন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ লোক সুলতান আইয়ুবীর অধীনে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছে। ফলে সুলতান আইয়ুবীর রণ কৌশল ও যুদ্ধের চাল তার ভাল করেই জানা আছে। খৃস্টান উপদেষ্টারা মুজাফফর উদ্দিনের মত যোগ্য সেনাপতিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিত এবং তাকে দিয়ে সুলতান আইয়ুবীকে সব সময় বিব্রত ও সন্ত্রস্ত করে রাখতে চাইতো।

সুলতান আইয়ুবীকে যে চিন্তা সবচেয়ে বেশী পেরেশান করে রেখেছিল, সেটি হলো, তাঁর রণক্লান্ত সেনাবাহিনী! আল্লাহর সাহায্যের পর এ সেনাবাহিনীই ছিল তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা ও অবলম্বন! এমন প্রলয়ংকারী ও ব্যাপক যুদ্ধের পর তাদের সামান্য বিশ্রাম ও বিরতি না দিয়ে আবারো ব্যাপক সংঘাতে জড়িয়ে পড়া তিনি যৌক্তিক মনে করতে পারছিলেন না। আবার বিরতি দিলে দুশমনের সংগঠিত হওয়ার যে সুযোগ সৃষ্টি হবে, তাও আইয়ুবীর জন্য কেবল বিপদই বাড়াবে। এ অবস্থায় কি করবেন তাই ভাবছিলেন তিনি।

বিগত যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা একেবারে নগন্য ছিল না! যদিও শত্রুদের তিনি পরাজিত করতে পেরেছেন, কিন্তু তার মূল্যও কত দিতে হয়নি! সুলতান আইয়ুবীর জন্য আরো একটি অসুবিধা বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল, তিনি বহুদিন যাবত রাজধানী থেকে বহু দূরে অবস্থান করছেন। খাদ্য ও রসদপ্রত্র সাথে থাকলেও দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালাতে গিয়ে রসদপত্রও প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল।

এসব সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি দ্রুত নিকটবর্তী এলাকা থেকে সৈন্য ভর্তি শুরু করে দিলেন। নতুন সৈন্যদের মধ্যে তলোয়ার চালানো, তীর চালানো ও অশ্বারোহণের ট্রেনিং শুরু হয়ে গেল। সেই সাথে তাদের মধ্যে নতুন প্রেরণা এবং জেহাদী জযবা জাগানোর প্রশিক্ষণও শুরু হলো।

আইয়ুবীর তখন অনেক ব্যস্ততা। নতুন সেনা ভর্তি ও তাদের প্রশিক্ষণের কাজে একদলকে নিয়োজিত করে অন্যদের নিয়ে তিনি বিজিত এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দিলেন। সম্মিলিত বাহিনীর পরাজয়ের ফলে এমন অনেক এলাকা বিনা যুদ্ধে ও প্রতিরোধহীন অবস্থায় করায়ত্ব হয়েছিল, যে সব অঞ্চলে ফৌজি চৌকি স্থাপন করে তাকে নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা জরুরী হয়ে পড়েছিল। তিনি পরগনার পর পরগনা অতিক্রম করে সেসব অঞ্চলে নিজের পতাকা উড়িয়ে এগিয়ে চললেন।

এভাবে যেতে যেতে শেষে তিনি এমন এক এলাকায় পৌছে গেলেন, যেখানে দুর-দুরান্ত পর্যন্ত শস্য শ্যামল সবুজ প্রান্তরের অবারিত সৌন্দর্য খেলা করছিল। এই সবুজের সমারোহ সম্ভব হয়েছিল এখানে পানির অজস্র উৎসধারা থাকায়।

ছুটতে ছুটতে সেনাবাহিনী ও তাদের ঘোড়াগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। উট ও ঘোড়াগুলো সামনে এত ঘাস-পানি দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠল!

এ অপরূপ সৌন্দর্যের সুষমা দেখে সুলতান আইয়ুবীর চোখ জুড়িয়ে গেল। এখানেই ক্যাম্প করার আদেশ দিলেন তিনি। ক্যাম্প করা হলো। ক্যাম্পের দেখাশোনা ও পাহারার জন্য দায়িত্ব দেয়া হলো বাহিনীর একদন সেনা সদস্যকে। গোয়েন্দা ও কমান্ডোরা ছড়িয়ে পড়েছিল আশপাশে, চারদিকে। তাদের আদেশ দেয়ার প্রয়োজন ছিল না, তাদের কাজ চলছিল আপন গতিতে। এই সে স্থান, যে তুর্কমানে সুলতান আইয়ুবী ক্যাম্প করেছিলেন বলে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এর পূর্ণ নাম হুব্বাবুত তুর্কমান, অর্থাৎ ঝর্ণাস্নাত তুর্কমান।

এ ক্যাম্পে অবস্থানকালেই সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে আল মালেকুস সালেহ তার প্রতারণামূলক সন্ধিপত্র পাঠিয়েছিল। তিন চার দিন পর এক গোয়েন্দা মারফত সাইফুদ্দিন গাজীকে লেখা আল মালেকুস সালেহের পত্র থেকে সুলতান এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছিলেন।

সুলতান আইয়ুবীকে এ চিঠি খুবই বিচলিত করেছিল ঠিকই, কিন্তু বিচলিত হয়েও হুট করে কোন অভিযান চালানোর মত অদূরদর্শী সেনাপতি তিনি ছিলেন না। কারণ শত্রুদের মত তারও সেনাবাহিনীকে নতুন করে সাজানোর প্রয়োজন ছিল।

এ ক্যাম্পে বসেই সুলতান আইয়ুবী সেনা অফিসারদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘সেনা ভর্তি দ্রুত করো! ওদেরকে সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উপযুক্ত করে গড়ে তোল। এ কাজ খুব দ্রুত সারতে হবে তোমাদের। আল্লাহ তোমাদের বড় দয়া করেছেন, তিনি তোমাদের এমন শত্রুর সামনে দাঁড় করিয়েছেন, যারা বোকা ও বুজদিল। যদি শত্রুরা হুশিয়ার ও বিচক্ষণ হতো, তবে এ পরাজয়ের পর দ্রুত পেছনে সরে ওরা আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেতো। কিন্তু এমন হিম্মতওয়ালা ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের অভাবে কার্যকর সামরিক শক্তি গড়ে তুলতে সময় লাগবে তাদের।

এ জায়গাটিকে আমার মনে হয় এক জান্নাতের টুকরা। যেমন এর প্রাকৃতিক সুষমা তেমনি অঢেল সম্পদে পরিপূর্ণ এর ভান্ডার। ঘোড়া ও উটগুলোর জন্য এমন আদর্শ জায়গা সহজে পাওয়া যায় না! এখানে আমাদের যুদ্ধের পশুগুলো তৃপ্ত হয়ে ঘাস পানি খেয়ে শক্তি লাভ করবে। পরে যদি দশদিনও আহার পানি না পায় তবুও লড়ে যেতে পারবে। বন্ধুগণ! শত্রুকে ছোট ভাববে না! সৈনিকদের বিশ্রামের প্রতি খেয়াল রেখো, কিন্তু অলস হতে দিও না। ডাক্তারদের বলবে, তারা যেন রাতে না ঘুমায়। আহত ও অসুস্থদের অতি শীঘ্র সুস্থ করে তোল। রুগীদের সেবা-শুশ্রূষা ও যত্ন যেন রাতদিন একই গতিতে চলে’।

তিনি অফিসারদের উদ্দেশ্যে আরো বললেন, ‘মনে রেখো, আমাদের শত্রু আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা নয়। যদিও তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্র ধরতে হচ্ছে, কিন্তু তাদের ব্যাপারে আমাদের অন্তরে থাকতে হবে মহব্বত ও দরদ। তাদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনাই আমাদের উদ্দেশ্য, হত্যা করা নয়। তাদেরকে তিরস্কার করা, গালমন্দ করা বা বিতাড়িত করা তোমাদের কাজ নয়!

দুশমন আমাদের ক্রুসেডাররা, খৃস্টান ও ইহুদীরা। টার্গেট আমাদের ফিলিস্তিন! পথে বসে আপোষে চুল টানাটানি ও ঝগড়া করে সময় ক্ষেপন করলে তাতে দুশমনেরই লাভ। এভাবে যতক্ষণ ওরা আমাদের ব্যস্ত রাখতে পারবে তাতে তাদের উদ্দেশ্যই সফল হবে। এসব উটকো ঝামেলাকে মনে করবে গায়ে পড়া মশা-মাছি। চলতি পথে ওরা এসে গায়ে বসলে হাত চালিয়ে ওদের মারবে ঠিকই, কিন্তু গন্তব্যের পথে ছুটে চলা বন্ধ করে পথের মশা মেরে দিন কাটিয়ে দেয়া চলবে না।

গন্তব্য তোমাদের ফিলিস্তিন।বুকের ভেতর প্রথম কেবলা মসজিদুল আকসার জ্বলজ্বলে ছবি। পথের সমস্ত বাঁধা মাড়িয়ে ফিলিস্তিনের মাটিতে পা রাখতে হবে তোমাদের। তোমাদের দৃষ্টি সেদিকেই নিবদ্ধ রেখো। যদি রাস্তায় কাঁটাঝোপে আটকে পড়ে গায়ের জামা, যে জামা খুলে নেয়ার পরিবর্তে ছিঁড়েখুঁড়ে এগিয়ে যাবে। মুজাহিদের কাছে উদ্দেশ্য হাসিলের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ নেই, থাকতে পারে না’।

যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছিল সম্মিলিত বাহিনীর সেনা সদস্যরা। সাইফুদ্দিন গাজীর সেনাবাহিনীর এক সিপাই একাকী পথ চলছে। সে যাচ্ছিল মুশেলের দিকে, চোখে মুখে তার ভয় ও আতংকের ছাপ স্পষ্ট। এ বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্যই সমরক্ষেত্র থেকে পালিয়েছে। তারা একাকী বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে যার যার আশ্রয়ে ছুটে যাচ্ছে প্রাণপণে। দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ সৈনিক একাকী পালাচ্ছিল, খুঁজছিল কোন নিরাপদ আশ্রয়।

সে ছিল খুবই পেরেশান ও ক্লান্ত। সে রাস্তার এক স্থানে ঘোড়া থামিয়ে নামাজ আদায় করলো। নামাজ শেষে হাত উঠিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরিয়ে দোয়া করলো আল্লাহর দরবারে। তখনো তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। দোয়া শেষ হলেও সে সেখান থেকে উঠলো না, সেখানেই মাথা দু’হাটুর মধ্যে গুঁজে দিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে রইলো।

আরেক অশ্বারোহী এসে থেমে গেল তার পাশে। সিপাইটি চিন্তায় এমনই মগ্ন ছিল, ঘোড়ার পদধ্বনিতেও ধ্যান ভাঙল না তার। আরোহী অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নামলো এবং এগিয়ে গিয়ে সিপাহীর কাঁধে হাত রাখলো। আঁৎকে উঠে মাথা তুলে তাকালো সিপাহী।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top