১৬. টার্গেট ফিলিস্তিন

‘না! কেউ আসেনি!’ সুদানী সেনাপতি বললো, ‘আমি তো তোমাদের নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম তোমাদের মিশনের খবর শোনার জন্য’।

উমরু দরবেশ এ কথা শুনে একটু আশ্বস্ত হলেন। যাক, এখনও সে গোয়েন্দা এসে পৌছেনি, যে আলীর গোয়েন্দাদের চোখে ধূলো দিয়ে জনতার মধ্য থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। উমরু দরবেশ সেনাপতির কথা বিশ্বাস করলো। কারণ সে গোয়েন্দা জানতো না উমরু দরবেশ খার্তুমের পথ ধরেছে। ফলে তার চলার গতি সেই আবেগ ও শঙ্কা কাজ করেনি, যে ভয় তাড়িত করেছে উমরু দরবেশদের। সমান গতিতে আসলেও তার এসে পৌছতে সময় লাগার কথা। কারণ তাড়া খেয়ে সে নিশ্চয়ই সোজা পথে আসবে না। ঘুর পথে আসতে গেলে সময় তো একটু বেশী লাগবেই।

উমরু দরবেশ সুদানী গোয়েন্দার আগমন বিলম্বে খুশী হলো। সবাইকে বোকা বানিয়ে ইসহাককে নিয়ে সরে পড়ার এটাই সুযোগ। ওই গোয়েন্দা এসে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে আসল ঘটনা জানাজানি হয়ে যাবে। তখন উমরু দরবেশের ভাগ্যে আগের মত আর কারাগারের জীবনও জুটবে না। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া আর কোন শাস্তিই বরাদ্দ করে না এমন অপরাধীর জন্য।

‘এখন আমার ইসহাকের প্রয়োজন’। কোন রকম ভূমিকা  ছাড়াই উমরু দরবেশ বললো, ‘আমি সেখানকার মুসলমানের মগজ ধোলাই করেছি। আমি তাদের সুদান সরকারের অনুগত হতেও রাজী করাতে পেরেছি। আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে তাদের মনে ঘৃণা ও শত্রুতার মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। তাদের অন্তরে আমি এ ধারনা বদ্ধমূল করতে পেরেছি যে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ফেরাউনের উত্তরসুরী। এখন প্রয়োজন সুদানের সুদানের সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য তাদেরকে ডাক দেয়া। এ ডাক কেবল সেই দিতে পারে, যে সেখানকার মুসলমানের আস্থাভাজন ও বিশ্বাসী নেতা। যদি তেমন কাউকে দিয়ে একবার সেখানকার মুসলমানদের এ আহবান জানাতে পারেন, আমার বিশ্বাস, সে এলাকা পুরোপুরি আপনাদের করায়ত্বে এসে যাবে। আমি জানি এবং যাচাই করেও দেখেছি, তাদের একমাত্র বিশ্বস্ত নেতা ইসহাক। সে ছাড়া আর এমন কেউ নেই, যার ডাকে তারা বিনা প্রশ্নে সাড়া দেবে’।

‘কিন্তু ইসহাককে কে বোঝাবে?’ সুদানী সেনাপতি বললো, ‘আমি তো তাকে সে এলাকার আমীর করার লোভও দেখিয়েছি। তাকে এমন কঠিন শাস্তি দিয়েছি, যে শাস্তি ঘোড়াও সহ্য করতে পারে না। আশীকে পাঠিয়েছিলাম তাকে বশ করতে, সেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে’।

‘এখন আমাকে চেষ্টা করতে দিন’। উমরু দরবেশ বললো, ‘তাকে কারাগার থেকে বের করে সেই কামরাতে আনুন, যেখানে আপনি তাকে এবং আমাকে একদিন রেখেছিলেন। আপনি তার শত্রু, কিন্তু আমি তার সঙ্গী এবং বন্ধু’।

‘তুমি কি আশী কি দিয়ে আরেকবার চেষ্টা করবে?’ সুদানী সেনাপতি বললো।

‘না!’ উমরু দরবেশ বললো, ‘এখন আমি আমার কথার যাদুতে তাকে বাধ্য করবো। আমি তার ওপর সেই সম্মোহন বিদ্যা প্রয়োগ করবো, যে বিদ্যার কারণে আমার বংশ দরবেশ বংশ হিসাবে পরিচিত। কেবল একটি রাত, আশা করি সূর্য উঠার আগেই সে আমার জালে বন্দী হবে। আমি বেশী সময় নিতে চাই না। সে এলাকায় আমার অনুপস্থিতি দীর্ঘ হলে তাদের ঘোর কেটে যেতে পারে। ঘোর কাটার আগেই আমি তাদের শোনাতে চাই সে আহবান, যে আহবান শোনানোর জন্য আপনারা এতকাল ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আপনি জানেন, সেখানে মিশরের গোয়েন্দা রয়েছে। আমি সেখানে যে  যাদু চালিয়েছি সে যাদুর প্রভাব নষ্ট করা মত সুযোগ আমি মিশরী গোয়েন্দাদের দিতে চাই না’।

সুদানী সেনাপতি উমরু দরবেশের দুই সঙ্গী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। উমরু দরবেশ বললো, ‘এরা আমার দুই মুরীদ! এরা আমার এমন ভক্ত হয়ে গেছে যে, বাড়ীঘর ছেড়ে মরার আগ পর্যন্ত আমার খেদমতে থাকার জন্য স্বেচ্ছায় চলে এসেছে। ভেবে দেখলাম, কাজকর্ম করানোর জন্য দু’একজন লোক সঙ্গে থাকলে ভালই হয়। তাই ওদের সঙ্গে থাকার অনুমতি দিয়েছি’।

উমরু দরবেশের সেই কাংখিত কামরায় নিয়ে আসা হলো ইসহাককে। সেনাপতি নিজে ইসহাকের সাথে দেখা করে বললো, ‘আমি তোমাদের জাতীয় প্রেরণা ও বিশ্বাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি। তোমার এক বন্ধু উমরু দরবেশ তোমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি আশা করি, তোমাদের সাক্ষাৎ প্রীতিপ্রদ হবে’।

‘আমাকে কারাগারের জঘন্য পরিবেশে রাখো, তারচে জঘন্য নরকের পরিবেশে রাখো অথবা তোমাদের মহলেই রাখো, অত্যাচার করো বা লোভ দেখাও, আমাকে আমার পথ থেকে এক চুলও সরাতে পারবে না’। ইসহাক বললো, ‘তুমি আমাকে মৃত্যুকূপে নিয়ে যাও অথবা রাজপ্রাসাদে, আমি ঈমান বিক্রি করবো না। বন্ধুত্ব আর শত্রুতা সবই আমার কাছে সমান। সব কিছুর ওপর থাকবে আমার বিশ্বাস, আমার ঈমান’।

সুদানী সেনাপতি হেসে দিল, কামরায় প্রবেশ করলো উমরু দরবেশ। উমরু দরবেশকে দেখেই ইসহাক বলে উঠলো, ‘তোমার চেহারাই বলে দিচ্ছে, তুমি এ কাফেরদের কাছে তোমার ঈমান বিক্রি করে দিয়েছো। তোমার স্বাস্থ্য, তোমার চেহারা ও চোখ বলছে, তুমি খুব আরামেই আছো। আমার সঙ্গে কেন দেখা করতে চাও?’।

‘আমি তোমার চেহারায় আমার মত মুক্তির আনন্দ ও চমক দেখতে চাই’। উমরু দরবেশ বললো, ‘একটু আমাকে বলার সুযোগ দাও,কিছুক্ষণের জন্য তোমার মন, তোমার বুদ্ধি আমার কাছে সঁপে দাও। ধৈর্য ও শান্ত মনে আমার কথা শোনো! তাতে তোমার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে না। আমি তোমার ঈমান কিনতে আসিনি। ঈমান নিয়ে ব্যবসা আমি করি না। আমি তোমার বন্ধু, তোমার মঙ্গলাকাংখী। কিসে তোমার কল্যাণ, কিসে অকল্যাণ, কিসে মঙ্গল, কিসে অমঙ্গল- এটুকুই শুধু আমি তোমার সাথে খোলাখুলি ও অন্তরঙ্গ পরিবেশে আলাপ করতে চাই’।

এ আলাপের সময় সুদানী সেনাপতি পাশেই দাঁড়িয়েছিল। ইসহাক তাদের এক মূল্যবান কয়েদী। তার ব্যাপারে কোন রকম ঝুঁকি নিতে রাজী নয় সেনাপতি। উমরু দরবেশও একসময় কয়েদী ছিল। উমরু দরবেশ ধোঁকাও তো দিতে পারে! তাদের দু’জনকে এক কামরায় গোপন আলাপের সুযোগ দেয়া সমীচিন মনে হলো না সেনাপতির। তাই এ আলাপের সময় সে পাশে দাঁড়িয়েই রইলো।

এ আলাপের জায়গাটি কারাগার ছিল না। কিন্তু তাই বলে নিরাপত্তাহীনও ছিল না। চারজন পাহারাদার নিযুক্ত আছে এ বাড়ীতে। দু’জন প্রহরী সামনের ফটকে, অন্য দু’জন পিছনের সংকীর্ণ দরজায়। তাদের সাথে আছে বর্শা ও তলোয়ার। আরো আছে তীর ধনুক। ইচ্ছে করলেই কেউ পালিয়ে যেতে পারবে এমন নয়। উমরু দরবেশ ও ইসহাক এখান থেকে পালিয়ে যাবে এমন কোন ভয় বা আশঙ্কা ছিল না সেনাপতিরও।

উমরু দরবেশ চাচ্ছিলেন সেনাপতি সেখান থেকে চলে যাক, কিন্তু যাওয়ার কোন লক্ষণই দেখা গেল না সেনাপতির হাবভাবে। তার উপস্থিতিতে উমরু দরবেশ ইসহাককে খোলাখুলি কিছু বলতেও পারছে না, ওদিকে যে কোন সময় পাহাড়ী গোয়েন্দা এসে সবকিছু ফাঁস করে দিতে পারে। ভেতরে ভেতরে প্রচন্ডভাবে অস্থির হয়ে পড়লেন উমরু দরবেশ।

আশী গোসল ও বিশ্রামের জন্য পাশের কামরায় চলে গিয়েছিল। সে চলে এলে হয়তো সুদানী সেনাপতিকে সরানোর একটা কায়দা বের করতে পারতো। কিন্তু তার এদিকে আসার নামগন্ধও নেই। সুদানী সেনাপতি শিকড় গেড়ে বসে আসে এক আসনে। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে মূল্যবান কয়েকটি ঘণ্টা। হয়তো সে গোয়েন্দা শহরের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। সে এসে পড়লেই সমস্ত ব্যাপারটা তালগোল পাকিয়ে যাবে।

সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছিল। উমরু দরবেশের দুই সঙ্গী আলীর সেই কমান্ডো দু’জন বারান্দায় বসে উদ্বেগের সাথে তাকিয়েছিল উমরু দরবেশের দিকে। উদ্দেশ্য, তিনি কোন ইঙ্গিত বা ইশারা করলে যেন সাথে সাথে সে হুকুম তামিল করত পারে।

কিছুক্ষণ পর। গোসল ও প্রসাধন সেরে বাইরে এলো আশী। তার সৌন্দর্য তখন ফুটে বের হচ্ছিল। সমস্ত ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয়ে সেখানে খেলা করছিল প্রাণবন্ত সজীবতা। সে কমান্ডোদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

 ‘সেনাপতি কি চলে গেছে?’ আশী জিজ্ঞেস করলো।

‘না! এক কমান্ডার উত্তর দিল, ‘তিনি ভেতরেই আছেন’।

‘তাকে তো সেখান থেকে সরানো দরকার!’ আশী এই বলে সে কামরার দিকে পা বাড়াল।

উমরু দরবেশ আশীকে কামরায় প্রবেশ করতে দেখলো। আশীকে দেখেই তার মনে আশার সঞ্চার হলো। সুদানী সেনাপতিও দেখলো তাকে, যেন বৃষ্টি ধোয়া গোলাপী-সাদায় মাখামাখি এক ফুটন্ত গোলাপ। চোখে তার রঙ লেগে গেল। আশীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। জবাবে আশীও প্রশ্রয়ের হাসি উপহার দিল তাকে। তারপর এগিয়ে সেনাপতির চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে চেয়ারের হাতলে ছড়িয়ে  দিল তার ফর্সা হাত। সেনাপতি সেই হাতের দিকে তাকালো মুগ্ধ চোখে। আশীর প্রসাধনীর মাদকতাময় সৌরভ অনুভব করলো তার চারপাশে। আশী উমরু দরবেশের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করলো। উমরু দরবেশ সুযোগ পেয়ে ইঙ্গিতে সেনাপতিকে সরিয়ে নিতে বললেন আশীকে।

‘ইসহাক ভাই!’ উমরু দরবেশ প্রশ্ন করলেন, ‘আমরা কি সুদানের সন্তান নই?’

‘আমরা সর্বপ্রথম ইসলামের সন্তান!’ ইসহাক উত্তর দিলেন, ‘আমি এখনও মিশরের সেনাবাহিনীর কমান্ডার ও সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর এক অনুগত সৈনিক। যদি সুদানলামের মা হয়, তবে আমি আমার মাকে ইসলামের শত্রুদের হাতে তুলে দিতে পারি না’।

আশী পিছন থেকে সুদানী সেনাপতির কাঁধে আস্তে করে চাপ দিয়ে তার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ‘মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানেই সুদানের সেনাপতির মন কি আমার দিক থেকে উঠে গেল!’ হাসছিল আশী। সেনাপতি তৃষিত কন্ঠে তার হাত ধরে বললো, ‘আমার সাদা গোলাপ। আকাশে যতদিন চাঁদ থাকবে, ততদিন তোমার আকর্ষণ অম্লান থাকবে এ হৃদয়ে’।

‘আমি এমন কঠিন ও কষ্টকর কাজ থেকে ফিরে এসেছি, আবারও সেই জংলীদের কাছে ফিরে যেতে হবে, যাদের কাছে পান করার পানি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। কতদিন এক ঢোক শরাবও পান করার সুযোগ হয় না আমার!’

‘ওহ হো! তাইতো সুন্দরী! আমি ওদের কথার জালে ব্যস্ত হয়ে তোমাকে তো ভুলেই গিয়েছিলাম! পাশের কামরায় যাও, আমি আসছি’।

‘উঁ-হুঁ!’ আশী বললো, আসছি মানে কি? আমি কি ওখানে একা একা বসে মাছি মারবো?’

সেনাপতি তাকালো ইসহাক ও উমরু দরবেশের দিকে। না, এখানে কোন ভয় বা সন্দেহের কিছু নেই। তাছাড়া দু’দিকেই আছে সশস্ত্র প্রহরী। ঠিক আছে, উমরু দরবেশ তার কথার যাদু চালিয়ে যাক, ক্ষতি কি!

আশী পুরুষ বশীভূত করার বিদ্যায় ওস্তাদ! শিশুকাল থেকেই পুরুষদের ফাঁসানোর প্রশিক্ষণ পেয়েছে সে। এ ফাঁদ কেটে সেনাপতিই বা বেরিয়ে যাবে কেন? সুদানী সেনাপতি ধরা দিল ফাঁদে, তার মোহময় হাসিতে ভুলে তার পিছু পিছু চলে গেল পাশের কামরায়। সেখানে গিয়ে এক চাকরানীকে বললো, ‘শরাব লাগাও’।

মদ ওই কামরাতেই ছিল, চাকরানী মদ ও মদের পাত্র ওদের সামনে রেখে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। আশী পিয়ালার মদ ঢেলে সেনাপতির সামনে বাড়িয়ে বললো, ‘খাও’।

আশীর পাল্লায় পড়ে পেয়ালার পর পেয়ালা শরাব পান করে চললো সেনাপতি।

‘নিয়ত পরিষ্কার থাকলে আল্লাহই তাকে সাহায্য করেন’। উমরু দরবেশ ইসহাককে বললো, ‘আমি যা চিন্তা করেছিলাম, তা অক্ষরে অক্ষরে ফলতে শুরু করেছে। সব কথা বলার সময় এখন নয়। আগে এ শহর থেকে বেরোই, তারপর সব কথা তোমাকে খুলে বলতে পারবো। দু’জন কমান্ডো সঙ্গে নিয়ে এসেছি। এখানে সামনের ফটকে দু’জন এবং পিছনের দরজায় দু’জন, মোট চারজন প্রহরী আছে। সামনের ফটকে আমরা যাবো না। আমরা বেরোবো পেছনের দরজা দিয়ে। ফলে আমাদের শুধু পিছন দিকের দুই প্রহরীর ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা যে চারটি ঘোড়া নিয়ে এসেছি সেগুলো ওখানেই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। প্রহরীদের চারটি ঘোড়াও সেখানে রাখা। তোমার জন্য সেখান থেকেই যে কোন একটা নিয়ে নিতে হবে। আমারদের এলাকায় মিশর থেকে কিছু লোক এসেছে। তাদের নেতা অতিশয় বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান লোক। আমি তাঁর কাছে নাম জানতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি তার নাম আমার কাছে প্রকাশ করতে রাজি হননি। তারাই পাহাড়ী অঞ্চলের প্রতি মুহূর্তে কি ঘটছে সে সংবাদ কায়রো পৌছে দিচ্ছে। তাদের সহায়তায় সেখানে সব সুদানী গুপ্তচরকে বন্দী করা হয়েছে। তিনিই তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমার সঙ্গে দু’জন কমান্ডো পাঠিয়ে দিয়েছেন’। থামলেন উমরু দরবেশ। এদিকওদিক তাকিয়ে বললো, ‘সেনাপতিকে সরিয়ে নিয়ে মেয়েটি কোথায় গেল আমি একটু দেখে আসি! মেয়েটাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। তুমি তৈরী হয়ে নাও’।

‘কেন?’ ইসহাক জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঐ বদ মেয়েটার সাথে তোমার কি সম্পর্ক?’

‘বাইরে গিয়ে তোমাকে সব বলবো’। উমরু দরবেশ বললো, ‘সে যেনতেন সম্পর্ক নয়! মেয়েটি মুসলমান!’

উমরু দরবেশ কামরা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। প্রহরীরা দেখেছে, সুদানী সেনাপতিও এ মেহমানকে যথেষ্ট সম্মান ও সমীহ করেন। সে জন্য তারাও তাকে বিপদজনক ব্যক্তি ভাবার পরিবর্তে সম্মানিত মেহমান হিসেবেই দেখছিল। এমন মেহমানকে অসন্তুষ্ট করে সেনাপতির বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি কে নেয়!

তিনি প্রথমে বারান্দায় বসা তার দুই সংগীর কাছে গেলেন। তিনি তাদের বললো, ‘এখুনি প্রহরীদের সামাল দিতে হবে’। তিনি আস্তে করে আশীর কামরার দরজায় ধাক্কা দিলেন। দরজা নড়ে উঠলো, সেনাপতি নেশার ঘোরে জড়িত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘কে, কে ওখানে?’

‘আমি দেখছি!’ বললো আশী। সে উঠে এসে দরজা খুলে সামান্য ফাঁক করে উমরু দরবেশকে দেখতে পেলো। চোখে চোখে কথা হলো ওদের। আশী দরজা বন্ধ করতে করতে বললো, ‘কই, কেউ না তো! সম্ভবত বাতাসের ধাক্কায় দরজা নড়ে উঠেছিল’।

দরজা বন্ধ করে আশী আবার ফিরে এলো সেনাপতির কাছে। তাকে ধরে পালঙ্কে শুইয়ে দিল। সেনাপতি বাহু বাড়িয়ে বললো, ‘তুমিও আসো সুন্দরী! নেশায় নেশায় আমাকে পাগল করে দাও’।

‘তুমি শোও, আমি একটু বাথরুম থেকে আসি’।

আশী ধীর পথে সরে এলো সেখান থেকে। আস্তে করে দরজা খুলে বাইরে চলে এলো এবং সন্তর্পনে বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল দরজা। উমরু দরবেশ আশী ও দুই কমান্ডোকে নিয়ে ইসহাকের কামরায় গেলেন। ততক্ষণে সেই সুদানী গোয়েন্দা শহরে চলে এসেছে। শহরে ঢুকেই গোয়েন্দা হেডকোয়ার্টারের পথ ধরলো সে লোক।

উমরু দরবেশ পেছন দরজার দুই প্রহরীকে ডাকলেন। বললো, ‘ভেতরে যে  কয়েদী আছে তাকে কারাগারে নিতে হবে। তোমরা জানো, তার সাথে কথা বলার জন্যই সেনাপতি আমাকে ডেকেছিলেন। কিন্তু এখানে কথা বলে সুবিধা হচ্ছে না,তাই সেনাপতি বলেছেন কয়েদীকে কারাগারে নিয়ে যেতে। যাও, কয়েদীকে হাত বেঁধে নেয়ে এসো’।

দুই প্রহরী কয়েদীকে আনার জন্য পা বাড়ালো, তিনি বললো, ‘দাঁড়াও! আমিও যাচ্ছি তোমাদের সাথে’।

ওরা তিনজন একত্রে ভেতরে প্রবেশ করলো। ওরা ইসহাকের কামরায় ঢুকার সাথে সাথে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একই সাথে দুই কমান্ডো দুই প্রহরীকে ঝাপটে ধরে তাদের বুকে মুহূর্তের মধ্যে খঞ্জর ঢুকিয়ে দিল। কেন তাদেরকে মারা হলো সে কথা বুঝার আগেই দুই প্রহরী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। সুদানী গোয়েন্দা তখন গোয়েন্দা অফিসের  হেডকোয়ার্টারে পৌছে গেছে। সে যখন সুদানী গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানের সামনে বসে রিপোর্ট করছিল, উমরু দরবেশ তখন ইসহাককে বলছিলেন, ‘ইসহাক! তাড়াতাড়ি! জলদি বের হও!’

ওরা বেরিয়ে এসে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলো। প্রধান ফটকের দুই প্রহরী তখনো জানে না, প্রাসাদের ভেতর কি ভয়ানক কান্ড ঘটে গেছে। জানে না, উমরু দরবেশ ও তাঁর সঙ্গীরা বন্দী ইসহাককে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে তাদের ফাঁকি দিয়ে। তারা নিশ্চিন্ত মনে ফটকে দাঁড়িয়ে ডিউটি দিয়ে চললো।

ইসহাককে নিয়ে উমরু দরবেশ যখন ঘোড়ায় চড়ে বসলো, তখন অনেক রাত। শহরের পথঘাট সুনসান, ফাঁকা। নৈশ প্রহরী ছাড়া সবাই ডুবে আছে ঘুমের অতল তলে। পাঁচটি ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসেছে চারজন পুরুষ ও একজন নারী। যত দ্রুত সম্ভব তারা শহর থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষলো ওরা। সবার সামনে উমরু দরবেশ, তার পেছনে আশী, তার পেছনে ইসহাক এবং সবার পেছনে পাশাপাশি আলী বিন সুফিয়ানের অসম সাহসী জানবাজ দুই কমান্ডো। রাতের নিরবতা খান খান করে তীরবেগে ছুটে চললো ঘোড়া। নৈশ প্রহরীরা কিছু বুঝে উঠার আগেই শহর থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। কারা যায়, কোথায় যায়, একথা জানার আগেই মরুভূমির বিপুল বিস্তারে অন্ধকারে হারিয়ে গেল এ ছোট্ট দলটি। নৈশ প্রহরীরা জানতেও পারলো না, সুদানী কারাগারের দুই মূল্যবান কয়েদী এবং সুদানী গোয়েন্দা বাহিনীর হীরার টুকরো এক মেয়েকে নিয়ে কেটে পড়েছে মিশরীয় দুই কমান্ডো।

পাহাড়ী গোয়েন্দার রিপোর্ট পেয়েই তাকে নিয়ে সেনাপতির কাছে ছটলো গোয়েন্দা প্রধান। পথে বেরিয়েই তারা দেখতে পেলো, পাঁচটি ঘোড়া ঊর্ধশ্বাসে তাদের পাশ কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসব দিকে খেয়াল দেয়ার মত মনমানসিকতা তখন ওদের ছিল না। ওদের মগজে কাজ করছিল একটাই চিন্তা, উমরু দরবেশের মিশন ব্যর্থ হয়েছে, এখবর সেনাপতিকে পৌছাতে হবে। তারা সেনাপতির বাসায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো, তিনি রাতে বাসায় ফেরেননি। সঙ্গে সঙ্গে তারা ছুটলো সেনা অফিসে। ওখান থেকে জানতে পারলো, তিনি বেসামরিক এলাকায় সামরিক বাহিনীর গোপন আস্তানায় আছেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা ছুটলো সেখানে।

তারা সেখানে পৌছে সদর দরজায় করাঘাত করলো। পরিচয় নিয়ে ফটক খুলে দিল পাহারারত প্রহরীদ্বয়। গোয়েন্দা প্রধান  বললো, ‘সেনাপতি এখন কোথায়?’

প্রহরীরা তাদেরকে সেই কামরা দেখিয়ে দিল, যেখানে তিনি আশীকে নিয়ে শরাবের আসর জমিয়েছিলেন। পাহাড়ী গোয়েন্দা ও গোয়েন্দা প্রধান ছুটে গেলো সেই কামরায়।

কামরায় মাতাল সেনাপতি তখন নেশার ঘোরে বেহুশ। তাকে ডাকা হলো, কিন্তু ঘুম ভাঙল না তার। গায়ে ঝাঁকুনি দিয়ে বলা হলো, ‘উঠুন, জরুরী খবর আছে! কিন্তু তাতেও তার হুশ হলো না। শেষে তার নাকে মুখে পানির ছিটা দেয়া হলো। জড়িত কন্ঠে তিনি বললো, ‘কি ব্যাপার, এত রাতে বিরক্ত করছো কেন?’

গোয়েন্দা প্রধান বললো, ‘গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে। জলদি উঠুন!’

এবার ঘুম সম্পুর্ণ টুটে গেল সেনাপতির। তিনি সজাগ হয়েই বললো, ‘উমরু দরবেশ ও তার সাথীরা কোথায়?’

‘সে খবর নিয়েই আমি এসেছি’। বললো পাহাড়ী অঞ্চল থেকে আগত গোয়েন্দা।

‘কি খবর নিয়ে এসেছো?’

‘উমরু দরবেশের মিশন ব্যর্থ হয়ে গেছে। মিশরের গোয়েন্দারা ধরে নিয়ে গেছে আশী, উমরু দরবেশ এবং আমাদের অন্যান্য সাথীদের। একজন নিহত হয়েছে ওদের হাতে’।

‘কি আবোল তাবোল বকছো! আশী এবং উমরু দরবেশ তো এখন এখানেই আছে! তাদের মিশন সম্পুর্ণ সফল হয়েছে। উমরু দরবেশ সেখানকার জনগনকে শেষ পর্যন্ত বোকা বানাতে পেরেছে’।

এবার বিস্মিত হবার পালা গোয়েন্দার। সে অবাক হয়ে বললো, ‘উমরু দরবেশ এবং আশী এখানে! সে কি করে হয়! আমি নিজের চোখে দেখছি, আমাদের সবাই ধরা পড়ে গেছে। আশী এবং উমরু দরবেশকে ঘিরে রেখেছে মিশরের একদল কমান্ডো বাহিনী!’

‘তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। পাশের কামরায় গিয়ে দেখো, উমরু দরবেশ ওখানেই আছে’।

ওরা দু’জন ছুটে গেল পাশের কামরায়। সেখানে আশী, উমরু দরবেশ , তার দুই ভক্ত, কয়েদী ইসহাক, ওরা কেউ নেই। তার বদলে সেখানে পড়ে আছে তাদেরই দুই প্রহরীর রক্তাক্ত লাশ।

গোয়েন্দা প্রধান কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বিশ্বাসই করতে পারছিলো না, চোখের সামনে পড়ে আছে মহলের দুই প্রহরীর লাশ। তখনো লাশ থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। কামরার মেঝে ভেসে গেছে সেই রক্তে। গোয়েন্দা প্রধান ছুটে কামরা থেকে বাইরে এলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকালো ফটকের দিকে। সেখানে দুই প্রহরী নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি চিৎকার করে ডাকলেন, ‘এই উল্লুকের দল, জলদি এদিকে এসো’।

প্রহরীরা ছুটে এলো। গোয়েন্দা প্রধান ত্রস্ত পায়ে গিয়ে ঢুকলো সেনাপতির কামরায়। তার পেছনে পেছনে হতভম্ব সেই গোয়েন্দা। সেনাপতি তখনো মদের নেশা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি, আচ্ছন্নের মত বসেছিল কামরায়। গোয়েন্দা প্রধান বললো, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমাদের দুই প্রহরীকে খুন করে পালিয়েছে বন্দীরা’।

‘কি বলছ তুমি!’ তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো সেনাপতি, ‘ওরা ও ঘরে নেই?’

‘ওখানে আমাদের দুই প্রহরীর লাশ পড়ে আছে। বন্দীরা উধাও’।

‘আশী! আশী কোথায়?’

‘তাকেও কোথাও দেখছি না’।

সেনাপতি ছুটে গেল সে কামরায়। তার পেছন পেছন গেল ফটকের প্রহরীরা। শোরগোল ও ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেল মহলময়। ডাক-চিৎকারে জেগে উঠল মহলের চাকর-চাকরানী ও খাদেমরা। হৈ চৈ ও হট্টগোল শুনে মনে হচ্ছিল, বাড়ীতে ডাকাত পড়েছে। মহল জুড়ে যখন এ হুলস্থ্বল চলছিল, উমরু দরবেশ, ইসহাক, দুই কমান্ডো ও আশী তখন শহর থেকে অনেক দূরে। শিকারীর তাড়া খেয়ে মৃত্যুভয়ে ভীত হরিনীর মত ওরা তখন ছুটছে সেই পাহাড়ী অঞ্চলের দিকে, যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন আলী বিন সুফিয়ান।

এক সময় কোলাহল কিছুটা কমলো। সেনাপতি গোয়েন্দা প্রধান ও পাহাড়ী অঞ্চল থেকে আগত গোয়েন্দাকে নিয়ে এক কামরায় বসলো আলোচনার জন্য। তার কাছ থেকে শুনলো উমরু দরবেশের তৎপরতার বিবরণ। উমরু দরবেশ তাকে বোকা বানিয়েছে বুঝতে পেরে শক্ত হয়ে উঠলো চোয়ালের মাংশপেশী। দাঁতে দাঁত চেপে অস্পষ্ট কন্ঠে সে কেবল উচ্চারণ করলো, ‘হুম’।

গোয়েন্দা প্রধান বললো, ‘এখনি ওদের পিছু ধাওয়া করা দরকার!’

‘রাখো তোমার পিছু ধাওয়া! এখান থেকে ওরা বেরিয়েছে এক-দেড় ঘন্টার আগে। তুমি কি মনে করো ওদের নাগাল পাওয়া এতই সোজা! আহাম্মক, ওরা এখন ছুটছে প্রাণের মায়ায়। যতই চেষ্টা করো কিছুতেই আর ওদের নাগাল পাবে না। ওদের পিছু ধাওয়া করার চিন্তা বাদ দিয়ে কিভাবে আত্মরক্ষা করবে সেই চিন্তা করো। আশী এবং উমরু দরবেশের কাছে এমনসব তথ্য আছে, আমাদের সর্বনাশ করার জন্য যা যথেষ্ট। আমি ভাবছি, মিশরীয় গোয়েন্দা বাহিনী এসব তথ্য পেলে আমাদের ভাগ্যে কি ঘটবে!’

পরদিন মধ্যরাতে উমরু দরবেশ সবাইকে নিয়ে পাহাড়ী এলাকায় প্রবেশ করলেন। আলী বিন সুফিয়ান তাঁর জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তার আস্থা ছিল, মিশন যত জটিল ও দুঃসাহসিকই হোক না কেন, উমরু দরবেশ এ মিশনে সফল হবে। আলী বিন সুফিয়ান প্রথমে ভাবলেন, ইসহাককে নিয়ে ও ফিরে এলেই ওদের তিনি মিশরে পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু পরে ভেবে দেখলেন, পাহাড়ী এলাকায় এরই মধ্যে যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে তার মোকাবেলায় এদের দু’জনকেই এ এলাকায় রেখে দেয়া প্রয়োজন। ওরা এলাকায় থাকলে এবং লোকদের সাথে মেলামেশা করলে মানুষ অন্তরে সাহস ও তৃপ্তি পাবে। সুদানীরা যে ধোঁকাবাজ এ কথা সবার মনে বদ্ধমূল করে দিতে পারলে ভবিষ্যতে ওরা নতুন কোন চাল চাললেও জনগন সহজে তা বিশ্বাস করবে না। সুতরাং উমরু দরবেশের দল ওখানে এসে পৌছার সাথে সাথেই আলী বিন সুফিয়ান তাঁদের দেখা শোনার জন্য কিছু লোককে নিযুক্ত করলেন। এরপর মিশর সেনাবাহিনীর কিছু চৌকস কমান্ডোকে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে দিলেন, যাতে ওরা সুদানীদের যে কোন তৎপরতার খবর দ্রুত সংগ্রহ করতে পারে। ওদের বললেন, ‘যে কোন ধরনের খবর পাওয়ার সাথে সাথে তা কায়রো পৌছানোর ব্যবস্থা করবে। আর ছোটখাট হামলা এলে তা মোকাবেলার জন্য কায়রোর সিদ্ধান্তের জন্য বসে থাকবে না। সুদানী বাহিনী আক্রমণ করলে গোপনে রাতে পিছন থেকে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ওদেরকে এ এলাকা থেকে বিতাড়িত করে দেবে’।

আলী বিন সুফিয়ান সবাইকে যার যার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এক সন্ধ্যায় কায়রোর পথ ধরলেন। সঙ্গী হলো তার সাথে আসা ওপর তিন কমান্ডো। চারজনের ছোট্ট কাফেলা যখন পথে নামলো তখন ওদের বিদায় জানানোর জন্য সেখানে জমায়েত হয়েছিল গ্রামের কয়েক হাজার লোক। লোকগুলোর চোখে মুখে তখন ঈমানের দীপ্তি জ্বলজ্বল করছিল। প্রতিটি হৃদয় আপনজন হারানোর বেদনায় বিধুর ছিল, চোখে ছিল উদগত অশ্রু।

আলী বিন সুফিয়ান ‘খোদা হাফেজ’ বলে ঘোড়ায় চড়ে বসলেন। দেখতে দেখতে আলী ও তাঁর সঙ্গীদের ঘোড়া দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। লোকগুলো বোবা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো ওদের গমন পথের দিকে।

আলী বিন সুফিয়ান যখন সুদানী ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য ছিনিয়ে আনছিলেন বিজয়, বুদ্ধির খেলায় হারিয়ে দিয়ে সেখানে মিশরের সপক্ষে জনমতকে সংগঠিত করছিলেন, আইয়ূবী তখন ত্রিদলীয় জোটকে পরাজিত করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন হলবের দিকে। মুসলিম আমীরদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে সুলতান আইয়ুবীর বিজয় ওদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিল। সম্মিলিত আক্রমণ প্রতিহত করেই ক্ষান্ত হননি সুলতান, আলাদা আলাদা ভাবে গুমাস্তগীন, সাইফুদ্দিন ও আল মালেকুস সালেহের ক্যাম্পে চড়াও হয়ে তাদের তছনছ করে দেন। বাধ্য হয়ে প্রাণের মায়ায় এই তিন শক্তির সৈন্যরা তখন পালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিল। সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করার পর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী পলাতক বাহিনীর পিছু ধাওয়া করলেন। সম্মুখে অগ্রসর হয়ে পথের ছোট ছোট রাজ্য ও কেল্লা একের পর এক বশীভূত করে এগিয়ে চললেন হলবের দিকে।

হলব ছিল সম্মিলিত বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি এবং আল মালেকুস সালেহের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল ও সামরিক কেন্দ্র। সুলতান আইয়ুবী একবার এ শহর অবরোধ করে শেষে অবরোধ উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কারণে। আল মালেকুস সালেহ আইয়ুবীর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে সেখানকার মুসলমানদেরকে তার বিরুদ্ধে এমনভাবে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল যে, তারা মরনপণ করে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সুলতান আইয়ুবী তাদের শৌর্য  বীর্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন।

সুলতান আইয়ুবী তিন বাহিনীকে পরাজিত ও বিতাড়িত করার পর স্বাভাবিকভাবেই তিন বাহিনীর সৈন্যদের পিছু ধাওয়া করলে মোকাবেলা করার পরিবর্তে তারা আত্মসমর্পন করে প্রাণ বাঁচানোর জন্য বন্দীত্ব কবুল করে নেয়। অনেকে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে যোগ দেয় আইয়ুবীর বাহিনীতে।

আইয়ুবী তাঁর বাহিনী নিয়ে দ্রুতগতিতে হলবের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। কারণ তিনি হলববাসীদের নতুন করে প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ দিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি তাঁর সৈন্যদের দু’ভাগে ভাগ করলেন। একদলকে পলায়নপর সৈন্যদের পিছু ধাওয়া ও পথের গুরুত্বপূর্ণ চৌকি, ফাঁড়ি ও ছোট ছোট রাজ্য জয় করার কাজে লাগালেন। এদের নেতৃত্বে থাকলেন তিনি নিজে। অন্য দলটি সাজালেন কমান্ডো বাহিনী দিয়ে। তাদের বললেন, ‘পলায়নপর সৈন্যদের এড়িয়ে ভিন্ন পথে দ্রুত তোমরা হলবের দিকে এগিয়ে যাও। পথে বড় ধরনের সেনাদলকে পালাতে দেখলে ওদের পেরিয়ে গিয়ে সামনে থেকে অবরোধ করে দাঁড়াবে। তাতে ভয় পেয়ে তার কালবিলম্ব না করে আত্মসমর্পন করতে ছুটে আসবে’।

হলবের সৈন্য বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে হলবের দিকে ছুটে যাচ্ছিল। সামনে অগ্রসর হওয়ার পর তাদের কমান্ডাররা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অনেককে একত্রিত করলো। তারপর সবাইকে নিয়ে পূনরায় ছুটলো হলবের দিকে। বেশ কিছুদূর পর যাওয়ার পর ওরা দেখতে পেলো, সামনে সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী রাস্তা অবরোধ করে বসে আছে। হলবের সৈন্যরা রাস্তায় আটকা পড়ে গেল। তাদের আর যুদ্ধ করার শক্তি ছিল না। শক্তি-বলই শুধু নিঃশেষ হয়নি তাদের, সাথে সাথে অস্ত্র এবং রসদও প্রায় ফুরিয়ে এসেছিল। বিশেষ করে খাদ্য এবং পানির সমস্যা ছিল তীব্র।  সামনে আইয়ুবীর বাহিনী পথ অবরোধ করে বসে আছে, পেছনে থেকেও ধেয়ে আসছে আইয়ুবীর ফৌজ, এ অবস্থায় চারদিকে ওরা কেবল মৃত্যুর অন্ধকারই দেখতে পেলো। সৈন্যরা রাস্তায় আটকে পড়ে যখন মৃত্যুর প্রহর গুনছিল তখন সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনীর একটি দল ঘুরে পাশ থেকে অতর্কিত হামলা চালালো তাদের ওপর। তারা প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করার পরিবর্তে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘হলবের সৈন্যরা, তোমরা অস্ত্রসমর্পণ করো। আমরা তোমাদের হত্যা করতে চাই না। তোমাদের সাথে আমাদের লড়াই নেই। আমাদের লড়াই তোমাদের ক্ষমতালিপ্সু শাসকদের সাথে’।

এ ঘোষনা শুনে কেউ আর লড়াই করতে এগিয়ে এলো না, সকলেই অস্ত্রসমর্পণ করে মেনে নিল আইয়ুবীর বশ্যতা। হলবের পথে পথে এ নাটক চলতেই লাগলো।

সুলতান আইয়ুবী ছিলেন রণাঙ্গনের একেবার পিছনে। তাঁর কাছে সংবাদ পৌছতে লাগলো, ‘হলবের সৈন্যরা সর্বত্র অস্ত্রসমর্পণ করছে’। তিনি বললেন, ‘যদি এ সেনাবাহিনী খৃস্টানদের হতো, তবে আমি এদের কাউকে ক্ষমা করতাম না। একজনকেও জীবিত রাখতাম না। কিন্তু এরা যে আমার ভাই! কেন তারা অস্ত্র ধরেছে তাই তারা জানে না। তাদেরকে ভুল বুঝিয়ে আমাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব এরা যদি অস্ত্রসমর্পণ করে তবে এদের কাউকে কোন রকম কষ্ট দেবে না। আমি আমার কষ্ট কাউকে বুঝাতে পারবো না। এদের সবাইকে ক্ষমা করে দেয়ার পরও আমার মনে কোন রকম শান্তি আসবে না। যতদিন বেঁচে থাকি, আমার আত্মা হাহাকার করে বলতে থাকবে, আইয়ুবী, তুমি তোমার মুসলমান ভাইদের বুঝাতে পারোনি, কেবল দ্বীনের জন্যই তোমার এ লড়াই। যদি এটা বুঝাতে পারতে, তবে এরা তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতো না। খালি হয়ে যেত না মুসলিম মায়েদের শত শত বুক। মুসলিম বোনদের অশ্রু ও হাহাকার ভারী করে তুলতো না আকাশ বাতাস। হায়! আমার শাসনকালেই মুসলমানের অস্ত্র নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, এ ব্যর্থতা তো আমার! যদি আমাদের এ ভাইয়েরা আজ বন্ধ ও শত্রু চিনতে পারে, তবে এই জিল্লতির লড়াই থেকে বেঁচে যাই আমি’।

পরের দিনই আল্লাহ সুলতান আইয়ুবীর প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। তিনি দেখলেন, দুই অশ্বারোহী তার দিকে এগিয়ে আসছে। একজনের হাতে সাদা পতাকা। তাদের ডানে বামে আইয়ুবীর বাহিনীর দুই কমান্ডার। নিকটে এসে অশ্বারোহীরা থেমে গেল। আইয়ুবীর এক কমান্ডার অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে তাঁকে সালাম দিয়ে বললো, ‘হলবের শাসক আল মালেকুস সালেহ আপনার কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এ দুই দূত আপোস মীমাংসার প্রস্তাব বহন করে এনেছে’।

এক দূত এগিয়ে সন্ধি প্রস্তাবের পত্রটি সুলতান আইয়ুবীর হাতে সমর্পণ করলো। সুলতান আইয়ুবী পত্র পাঠ করে দূতকে বললেন, ‘আল মালেকুস সালেহকে বলবে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী যখন যুদ্ধের আগে তার কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন, তখন আপনি তার দূতকে ফেরাউনের মত অপমান করে সে সন্ধির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আজ আল্লাহ জাল্লে শানুহু আমাকে এমন শক্তি দিয়েছেন যে, তার সৈন্য শক্তিকে যাঁতায় পিষে শেষ করতে পারি। কিন্তু আমার শত্রু তুমি নও, তুমি তো সেই পিতার সন্তান, যিনি খৃস্টান শক্তিকে নতজানু করে রেখেছিলেন যুগের পর যুগ। আর তুমি খৃস্টানদের সাথে বন্ধুত্বের গাঁটছড়া বেঁধ তোমারই পিতার গড়া সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছো! তাকে গিয়ে বলবে, আমি তাকে ক্ষমা করেছি, আর দোয়া করছি আল্লাহও যেন তাকে ক্ষমা করে দেন’।

সুলতান আইয়ুবী সন্ধি প্রস্তাবে আরো কিছু শর্ত আরোপ করে ওদের সম্মতি নিয়ে সন্ধি প্রস্তাব মেনে নিলেন। সন্ধির প্রথম শর্ত ছিল, আল মালেকুস সালেহ তার সৈন্য বাহিনী হলবে ফিরিয়ে নিতে পারবে। দ্বিতীয় শর্ত হলো, আইয়ুবীর সৈন্যরা যখন হলবে প্রবেশ করবে, তখন তাদের অগ্রযাত্রায় কোন রকম বাঁধা সৃষ্টি করতে পারবে না আল মালেকুস সালেহের সৈন্যরা। এ সন্ধির শর্ত অনুসারে আস-সালেহ তার সৈন্য হলবে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। সাইফুদ্দিনও পিছু সরে পালিয়ে মুশেলের দিকে ফিরে গেল। গুমাস্তগীন তার কেল্লা হারানে ফিরে না গিয়ে হলবে যাত্রা করলো।

সুলতান আইয়ুবী তাঁর সৈন্য অভিযান আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে হলবের পথে গুরুত্বপূর্ণ স্থান তুর্কমানে স্থায়ী ক্যাম্প করে সেখানে অবস্থান নিলেন। এ ক্যাম্পে অবস্থান কালে একদিন একটি অভাবিত ঘটনা ঘটলো। হলব থেকে এক কাসেদ তাঁর কাছে এসে আল মালেকুস সালেহের একটি বিশেষ পত্র তাঁর হাতে তুলে দিল। সুলতান আইয়ুবীর কাছে লেখা হয়নি। চিঠিটি আল মালেকুস সালেহ লিখেছিল সাইফুদ্দিনের কাছে। কিন্তু যে কাসেদকে আল মালেকুস সালেহ নির্বাচন করেছিল এ চিঠি সাইফুদ্দিনের কাছে পৌছে দেয়ার জন্য, সে ছিল মূলতঃ আইয়ুবীর গোয়েন্দা। তাই চিঠিটি সাইফুদ্দিনের কাছে না গিয়ে এসে পৌছলো আইয়ুবী হাতে। চিঠিতে আল মালেকুস সালেহ লিখেছিলঃ

ভাই সাইফুদ্দিন! আপনার চিঠি পেয়েছি। চিঠি পড়ে বুঝতে পেরেছি, আপনি আমার ওপর যথেষ্ট ক্রুদ্ধ হয়েছেন। আপনার এ ক্ষোভের সঙ্গত কারণও আছে। আমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে আত্মসমর্পণ করে তাঁর সাথে সন্ধি করেছি। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের সংকল্প ও শপথের পরিপন্থী। কিন্তু এ ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না। আপনি জানেন, আমার সেনাবাহিনী তাঁর বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্য পড়ে গিয়েছিল। আমার সৈন্যরা ছিল ভীত-সন্ত্রস্ত এবং ক্লান্ত। বহু সৈন্য আগেই নিহত হয়েছিল, বাকীদেরও অনেকে ছিল আহত। তারা কেউ যুদ্ধ করার অবস্থায় ছিল না। এ অবস্থায় আহত সৈন্যদের মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিলে তাতে কোন লাভ হতো না আমাদের। আমার সেনাপতি ও কমান্ডাররা অবস্থাদৃষ্টে আমাকে পরামর্শ দিল, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে সন্ধির নামে প্রতারণা করে তাদের জীবন বাঁচাতে। তাঁদের বেষ্টনী থেকে নিজের সৈন্যদের মুক্ত করার আর কোন পথ না দেখে এ প্রস্তাব আমি মেনে নিতে বাধ্য হই। ফলে কি পরিস্থিতিতে এবং কেন আমি সুলতান আইয়ুবীর কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম নিশ্চয়ই তা বুঝতে পারছেন।

সম্মানিত ভাই গাজী সাইফুদ্দিন! আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি কিছুটা সময় হাতে পাওয়ার জন্য এ সন্ধি করেছি। এ সন্ধি না করলে আমার কাছে আজ আর একটি সৈন্যও থাকতো না। আমি এখন হলবে বসে আমার   সৈন্যদেরকে নতুন করে সাজাচ্ছি। নতুন সৈন্যও ভর্তি করছি। আমি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর দাবী অনুসারে এ শর্ত মেনে নিয়েছি যে, তাঁর বাহিনী হলব অভিমুখে অগ্রসর হলে তাঁর অগ্রগতি প্রতিরোধ করবো না। কিন্তু তিনি যখন এখানে   আসবেন, তখন তার সৈন্যদের এমন ভাবে বাঁধা দেয়া হবে, যে বাঁধার কথা তিনি চিন্তাও করেননি। আপনিও আপনার সৈন্যদেরকে নতুনভাবে আদ্যোপান্ত সাজিয়ে নিন। কারণ সুলতান আইয়ুবীর শক্তি নিঃশেষ করতে হলে আবারো আমাদের মিলিতভাবে যুদ্ধে নামতে হবে’।

এ চিঠিতে আরো অনেক কিছু লেখা ছিল। ঐতিহাসিকরা একমত হয়েছেন, আল মালেকুস সালেহ সুলতান আইয়ুবীকে ধোঁকা দিয়েছিলেন। সাইফুদ্দিনের চিঠির উত্তরে তিনি যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন ভাগ্যক্রমেই তা সুলতান আইয়ুবীর হাতে গিয়ে পড়েছিল। যদি এ চিঠি আইয়ুবীর গুপ্তচরের হাতে না পড়ে অন্য কারো হাতে পড়তো তাহলে আইয়ুবী কোনদিনই এসব তথ্য জানতে পারতেন না। ইউরোপের ঐতিহাসিকরা অবশ্য বলেছেন, চিঠি খামে পুরার সময় ভুলক্রমে তা সুলতান আইয়ুবীর নামের খামে ঢুকানো হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম ঐতিহাসিকরা একমত, সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা বিভাগ সবখানে এমন সতর্ক ও দক্ষতার সাথে নিযুক্ত ছিল যে, তাঁর গোয়েন্দাই এ কাজটি করেছিল।

কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ লিখেছেন, এ চিঠি সুলতান আইয়ুবীকে এমন কঠিন চিন্তায় ফেলেছিল যে, তিনি কয়েক ঘন্টা তার সংগী-সাথীদের সাথেও কথা বলেননি। তাঁবুতে একা বসে এ চিঠির বিষয় নিয়ে চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন। যাইহোক, একসময় তাঁর এ অবস্থা কেটে গেল। তাবুর বাইরে এসে তিনি সঙ্গীদের বললেন, ‘তোমাদের জন্য একই সাথে বেদনা ও খুশীর একটি খবর আছে। বেদনার কারণ হচ্ছে, আল মালেকুস সালেহ সন্ধির নামে আমাদের ধোঁকা দিয়েছে।

খুশীর কারণ হচ্ছে, সে যে ধোঁকা দিয়েছে সেই খবরটি আমরা  জেনে গেছি। আমার কাসেদ আমাকে আজ এমন একটি পত্র দিয়েছে, যাতে শত্রুদের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার বিস্তারিত উল্লেখ আছে’।

তিনি আল মালেকুস সালেহ ও তার দোসরদের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তখনি হলবে চড়াও না হয়ে তিনি দ্রুত আল-জাজিরা, দাইয়ার ও বাকার থেকে নতুন সৈন্য পাঠানোর আদেশ দিয়ে সেনাপতিদের নিয়ে বসলেন নতুন করে যুদ্ধের পরিকল্পনা তৈরীর কাজে। আরো একটি রক্তাক্ত যুদ্ধের নিখুঁত পরিকল্পনা তৈরীতে মগ্ন হয়ে পড়লেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও তাঁর জাদরেল সেনাপতিগন।

তখন ১১৭৫ খৃস্টাব্দের এপ্রিল মাস। সময়টা ছিল মুসলমানদের জন্য পরম পূন্য ও সৌভাগ্যে আহরণের। হিজরী ৫৭০ সালে পবিত্র রমজানের মোবারক মাস শুরু হয়েছে। এ সময় তিনটি রাজ্যের মুসলিম আমীর নূরদ্দিন জংগীর পুত্র আল মালেকুস সালেহ, বিখ্যাত হারান দুর্গের অধিপতি গুমাস্তগীন ও মুশালের আমীর সাইফুদ্দিন গাজী একজোট হয়ে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে মাঠে নেমে চরম পরাজয় বরণ করে পালাচ্ছিল। এদের সহযোগিতা ও বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে এ পথে নামিয়ে ছিল খৃস্টানরা। যুদ্ধের জন্য সরবরাহ করেছিল ঘোড়া, উট, জ্বালানি। সরবরাহ করেছিল যুদ্ধের সব রকম অস্ত্র ও গোলা বারুদ।

এর কারণও ছিল। অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার পর খৃস্টানরা বুঝেছিল,সুলতান আইয়ুবীকে যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করা অসম্ভব। কিন্তু তাঁকে পরাজিত করতে না পারলে তাদের মুল উদ্দেশ্য কোনদিন সফল হবে না। যদিও ফিলিস্তিন এখন তাদেরই দখলে, তাতে দুনিয়া থেকে ইসলাম বিদায় নেবে না। ইসলামকে দুনিয়া থেকে মিটিয়ে দিতে হলে জয় করতে হবে ইসলামের কেন্দ্র ভূমি মক্কা ও মদিনা। জয় করতে হবে আরব ভূমি। কিন্তু আইয়ুবী বেঁচে থাকলে তা সম্ভব নয়। আবার আইয়ুবীকে যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করাও তাদের পক্ষে অসম্ভব। এ অবস্থায় ষড়যন্ত্র ও কূটনৈতিক যুদ্ধই এখন তাদের একমাত্র ভরসা। এ কূটনৈতিক যুদ্ধের উপায় খুঁজেতে গিয়ে খৃস্টানরা মুসলমানদের মধ্যে তিনটি দূর্বলতা আবিষ্কার করলো। এ দূর্বলতার পথ ধরেই মুসলমানদের নিঃশেষ করার সংকল্প করলো খৃস্টানরা দূর্বলতা হিসাবে তারা চিহ্নিত করলো ক্ষমতার লালসা, অর্থ ও সম্পদের লালসা, এবং নারী ও ভোগের লালসা।

ক্রুসেডাররা ইউরোপ থেকে যখন প্রথম এখানে আসে তখন তাদের মনে ছিল সীমাহীন আত্মবিশ্বাস। তারা এ আশা-ভরসা নিয়েই এখানে এসেছিল, উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ও নৌশক্তির বলে মুসলমানদেরকে তারা অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ করে দিতে পারবে। প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস দখলের পর এ আত্মবিশ্বাস তাদের আরো বেড়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল, খানায়ে কাবা এবং মদিনাতুন্নবীও সহজেই তাদের অধিকারভুক্ত হবে। তার এটুকু করতে পারলেই দুনিয়া থেকে ইসলাম বিদায়ের পথ খুলে যাবে।

কিন্তু তারা জানতো না, ধর্ম কোন গাছ নয় যে, তাকে মূল থেকে উপড়ে ফেলা বা কেটে ফেলা যাবে, আর উপড়ে ফেলার সাথে সাথেই তা শুকিয়ে মারা যাবে। অথবা ধর্ম কোন বইয়ের পাতাও নয় যে, তা পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া যাবে। ধর্ম হলো বিশ্বাস ও  চেতনার নাম। যে চেতনা ও বিশ্বাস মানুষের মন ও মগজকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের সকল কর্মকান্ড। মানুষের জীবনের পথ পাড়ি দেয় এ বিশ্বাসের সম্বল বুকে নিয়ে। নিজের চেতনার রঙেই রাঙিয়ে তোলে মানুষ তার কর্ম ভুবন।

মানুষ মারা যায় কিন্তু তার এ বিশ্বাস ও চেতনা মরে না। ফলে মানুষকে হত্যা করলেই কোন মতবাদ ও বিশ্বাস শেষ হয়ে যায় না। বরং তার সাথীদের মনে হত্যাকারীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর বিশ্বাসের প্রতি মমত্ববোধ বেড়ে যায়। যে মমত্ব ও ভালবাসা বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখার অমোঘ শক্তি দান করে। তাকে করে তোলে আরো সজীব ও প্রাণবন্ত।

কোন ধর্মকে নিঃশেষ করার জন্য তাই প্রয়োজন, মানুষের এই বিশ্বাস ও চেতনাকে ধ্বংস করা। মানুষের মনে, তার চিন্তা চেতনায়, বিশ্বাস যত শিথিল হবে, ততই তা এগিয়ে যাবে মৃত্যুর দিকে। মানুষের মন মগজে ক্ষমতার মোহ, বিলাসিতার প্রতি আকর্ষণ ও ইন্দ্রিয়লিপ্সা  যত বাড়বে, চিরন্তন ও শ্বাশ্বত চেতনা ততই ম্রিয়মান হতে থাকবে। কারো চিত্তে আরাম ও আমোদপ্রিয়তা জেঁকে বসলে তার বিশ্বাস ও আদর্শের বন্ধন শিথিল হতে থাকে। মানুষ তখন মানবিকতার পথ ছেড়ে হয়ে উঠে স্বেচ্ছাচারী, বেপরোয়া আর অবাধ্য। সভ্যতার বাগানে অসভ্যতার, অমানবিকতার বিস্তার ঘটে এমন করেই।

আইয়ুবীর বিরুদ্ধে প্রতিটি ময়দানে পরাজিত হওয়ার পর ইহুদী ও খৃস্টানরা মুসলমানদের মধ্যে এই জাল ও মোহ সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে উঠল। প্রথমে মিশরে ও আরবের বিভিন্ন এলাকায় এ জাল বিস্তারের জন্য মাঠে নামলো ওরা। নিজের অজান্তেই মুসলমান আমীররা এ জালে আটকা পড়তে শুরু করলো। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেল মুসলিম সালতানাতের আমীর ওমরাদের মধ্যে। মুসলিম মিল্লাতের দুর্ভাগ্য, দুশমনের এ কৌশল ও চক্রান্ত টেরই পেলো না বড় বড় অনেক মুসলিম নেতৃবৃন্দ। মানুষ যখন জানতেই পারে না সে আক্রান্ত, সে অবস্থায় আঘার প্রতিরোধের তো প্রশ্নই উঠে না। ফলে দুশমনের চক্রান্তের জালে ক্রমেই জড়িয়ে পড়লো মুসলমান আমীর ওমরার দল। প্রথমে ক্ষমতা ও নেতৃত্বের লোভের কাছে পরাজিত হলো তারা। তারপর সম্পদ ও প্রতিপত্তির লোভের কাছে। আর যখন এ দু’টো কারো করায়ত্ব হয়ে গেলো, আরাম আয়েশ হাতছানি দিয়ে ডাকলো তাকে। ভোগের কাছে যখন সে নতি স্বীকার করলো, মদ ও নারীর লোভ পেয়ে বসলো তাকে। এভাবেই ইসলামী আকিদা ও বিশ্বাস ত্যাগ করে তারা হয়ে পড়লো ভোগসর্বস্ব একশ্রেণীর জীব। ফলে এখন আর খৃস্টান নয়, আইয়ুবীকে মোকাবেলা করতে হচ্ছিল এসব ক্ষমতালিপ্সু জীবদের।

সাইফুদ্দিন গাজীকে লেখা আল মালেকুস সালেহের চিঠি পাওয়ার পরের কথা। আইয়ুবীর চোখের সামনে ভেসে উঠলো খৃস্টানদের জঘন্য ষড়যন্ত্র ও কুটিল চক্রান্তের শিকার মুসলিম আমীরদের মুখগুলো।

নূরুদ্দিন জঙ্গী ও সালাহউদ্দিন আইয়ুবী প্রথম যেদিন এ বিষযুক্ত মধুর ছোবলে আক্রান্ত মুসলিম আমীরদের দিকে তাকিয়েছিলেন, বেদনায় শিউরে উঠেছিলেন তারা। আমীরদের চেতনা ও বিশ্বাস কি করে নষ্ট হচ্ছে তার কারণ খুঁজতে গিয়ে তারা আবিষ্কার করলেন দুশমনের এক অঘোষিত নিরব যুদ্ধ। দুশমনের মিছরির ছুরি ও অদৃশ্য তীরের আঘাতে মৃত্যু ঘটছে মুসলমানিত্বের, অথচ সে জানতেই পারছে না মুসলমানের ঔরসের জন্মগ্রহণ করে, মুসলিম নাম নিয়ে জীবন ধারণ করার পরও তার আমল কেন অমুসলমানদের মতই উদ্দেশ্যহীন, চেতনাহীন ও বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top