১৫. উমরু দরবেশ

যে সময় সুলতান আইয়ুবী এ চিঠি লিখে কাসেদকে দিচ্ছিলেন, ঠিক সে সময় উমরু দরবেশের তাঁবুতে বসেছিল ওই তিন লোক, যারা মানুষের ভীর হওয়ার আগেই উমরু দরবেশের ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং অগ্রসর হওয়ার নাম করে ডিগবাজী খেয়ে পড়েছিল আর ভান করছিল যেন কেউ তাদের সামনে থেকে ধাক্কা দিয়েছে। লোকজন ততক্ষণে তাদের অভিনয় ধরতে না পেরে সকলেই মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে চলে গিয়েছিল।

লোকজন চলে যেতেই উমরু দরবেশ বাইরে থেকে উঠে তাঁবুর মধ্যে চলে গেলেন। তাঁর তিন সঙ্গী জনতার সাথে বেশ কিছু দূর অগ্রসর হয়ে তারপর আবার ফিরে এলো তাঁবুতে। জনগণের দৃষ্টি এড়িয়ে তাঁবুতে ফিরেই তারা উমরু দরবেশের মুখোমুখি বসল। এ তিনজনই ওই এলাকার বাসিন্দা ছিল। সুদান সরকার থেকে তারা নিয়মিত ভাতা ও পুরস্কার পেতো।

‘আমার তো ভয় ধরে গিয়েছিল কাপড় জ্বলবে না।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘কারণ কাপড়ের নিচে দাহ্য তেল কম ছিল আর উপরে পানি একটু বেশীই পড়ে গিয়েছিল।’

‘এখনও তোমার এ বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান হয়নি, এ তেল শুধু পানির ওপর ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলেও জ্বলবে!’ তাদের একজন বললো, ‘আমি এটা আগেই পরীক্ষা করে নিয়েছিলাম।’

‘লোকজনের উপরে এ ভেল্কিবাজী কেমন প্রভাব ফেলেছে?’ উমরু দরবেশ প্রশ্ন করলেন।

‘আমারা অনেক দূর পর্যন্ত তাদের সাথে গিয়েছিলাম।’ একজন বললো, ‘তারা তোমার পানিতে আগুন ধরানোর কেরামতি দেখে ভড়কে গেছে। কেউ কল্পনাও করেনি, পানিতে আগুন ধরানো যায়। তোমার কথা বলার ভঙ্গিও ছিল চমৎকার। তাদের অন্তরে তোমার প্রতিটি কথাই খোদাই হয়ে গেছে। খোদার কসম, ওরা তোমার সব কথাই বিশ্বাস করেছে!’

‘ছি! বন্ধু!’ উমরু দরবেশ তাকে বাঁধা দিয়ে বিজ্ঞের মত বললেন, ‘তুমি খোদার কসম খেয়ো না। খোদার কসম খাওয়ার কোন অধিকার আমাদের নেই। এ অধিকার তো আমরা কবেই হারিয়েছি। কারণ আমরা এখন যা করছি তা সবই খোদার নির্দেশের বিপরীত।’

‘মনে হচ্ছে এখনও তোমার মুনে খোদার ভয়-বিশ্বাস রয়েই গেছে!’ তাদের একজন বললো, ‘উমরু দরবেশ, তুমি তো খোদার প্রতি ঈমান বিক্রি করেই আমাদের সাথে এসেছো।’

অপর লোকটি তার পাশে বসা আশীর উরুতে থাবা মেরে উমরু দরবেশকে বললো, ‘তুমি একটু খেয়াল করে দেখো, এ ঈমান বিক্রির বিনিময়ে কেমন অমূল্য সম্পদ তুমি পেয়ে গেছো। এ মেয়ে খৃস্টান বাদশাহর অন্দর মহলের অমূল্য হীরার টুকরো, অথচ সুদান সরকার তোমাকে এ অমূল্য সম্পদই দান করেছেন।’

উমরু দরবেশ আশীর দিকে গভীর চোখে তাকালো। আশী তাঁর দিকেই নির্ণিমেষ নয়নে তাকিয়েছিল, তাকে তাকাতে দেখেই চোখ টিপে দিলো। তার কপালে ছিল দুশ্চিন্তার ভাঁজ। উমরু দরবেশ এ ইশারা বুঝতে পারলেন। একটু হেসে তিনি বললেন, ‘আমি তা বলিনি, যে খোদার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, তার কসম আমরা খেতে যাবো কেন? তার কসম খেয়ে তোমরাই তো বার বার তাঁর কথা স্মরণ করছো! হ্যাঁ, তবে একটি কথা তোমরা সত্যি বলেছো। আসলেই এত মূল্যবান হীরা পাওয়ার যোগ্য আমি নই। যাক, এখন ওসব বাদ দাও। ভোরের মিশন তো শেষ, এখন বলো, রাতের জন্য কি ব্যবস্থা করলে?’

‘সব কিছু ঠিকঠাক। ও নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’ একজন বললো, ‘তুমি তো আমার কাজ সম্পর্কে জানোই। কোথাও ফাঁক রাখি না আমি। দেখলে না, এক রাতের মধ্যে গ্রামের লোকদের তোমার পিছনে কেমন করে নিয়ে এলাম? আর তাদেরকে এমন কৌশলে তোমার ভক্ত করে দিলাম যে, কেউ একটু সন্দেহ বা প্রশ্ন করারও সুযোগ পায়নি।

রাতে তুমি এ নির্বোধদের তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখাবে। যেমন খোদা তাঁর নবী হযরত মুসা (আঃ) কে দেখিয়েছিলেন।’

‘নিশ্চয়ই দেখাবো। আমার তো বেশ ভালই লাগছে, এত মানুষের ভক্তি পাবো, জীবনে কি তা কোনদিন কল্পনা করেছিলাম!’

‘আরো শ্রদ্ধা ভালবাসা পাবে তুমি। শুধু দরকার একটু নিখুঁত অভিনয়। তোমাকে কি করতে হবে সব কি তোমার স্মরণ আছে? আমাদের লোকজন কিন্তু সবাই প্রস্তুত।’ অন্য একজন বললো।

‘আমাদের এখন এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।’ তৃতীয় ব্যক্তি বললো, ‘তুমি এখন আর তাঁবু থেকে বের হয়ো না।’

‘ঠিক আছে। সন্ধ্যায় আবার দেখা হবে।’ বললেন উমরু দরবেশ। তিনজনই সেখান থেকে বের হয়ে পাহাড়ের পেছনে দিয়ে নেমে ঘুরে গ্রামের দিকে হাঁটা দিল।

সূর্য ডোবার সাথে সাথেই লোকজন আসতে শুরু করলো। সকালে উমরু দরবেশের কথা যারা শুনে গিয়েছিল এবং স্বচক্ষে পানিতে আগুন লাগার কেরামতি দেখেছিল, তারা যতদূর সম্ভব সে সংবাদ পৌঁছে দিয়েছিল মানুষের কানে কানে। ছোট্ট সে পাহাড়ী অঞ্চলের এমন কোন ঘর ছিল না, যে ঘোরে এ আশ্চর্য ঘটনা এবং খোদার দূতের আগমনের খবর পৌঁছেনি। তারা মহা উৎসাহে প্রচার করছিল, ‘আজ রাতে উমরু দরবেশ তুর পাহাড়ের সেই তাজাল্লি দেখাবেন, যেমনটি খোদা দেখিয়েছিলেন হযরত মুসা (আঃ) কে।’

সন্ধ্যা। জনতার সাথে মিশে সেখানে উপস্থিত হয়েছে সুদানের গোয়েন্দা বিভাগের বেশ ক’জন সদস্যও। তারাও জানপ্রাণ দিয়ে গুজব ছড়ানোর কাজ করেছে আজ সারাদিন। সন্ধ্যার পরে জনতার ছয়লাবের সাথে তারা উমরু দরবেশের তাঁবুর সামনে জড়ো হতে লাগলো। কিন্তু তাঁবুর পিছনে ও ডানে বামে কারো দাঁড়ানোর অনুমতি ছিল না।

উমরু দরবেশ তখনও তাঁবুর মধ্যে। বাইরে দু’টো মশাল জ্বলছে। মশালের লাঠির গোড়া মাটিতে পোঁতা।

তাঁবুর বাইরে সমবেত লোকজন খোদার দূতকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। এ অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছিল তাদের কথাবার্তা ও আচরণে। হাজার হাজার জনতার কণ্ঠের মিলিত আওয়াজে গমগম করছিল পুরো এলাকাটা।

হঠাৎ তাঁবুর পর্দা একটু নড়ে উঠলো। জনতা উৎকর্ণ হয়ে তাকালো সেদিকে। তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসেছে এক অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে। মেয়ে নাকি পরী ঠিক বুঝতে পারল না জনতা। কলরব থেমে গেল মুহূর্তে। কাউকে চিৎকার করে বলতে হলো না, কথা থামাও, শোরগোল করো না। তাকে দেখামাত্র লোকগুলি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।

সুসজ্জিত হয়ে তাঁবুর বাইরে এল আশী। পরণে তাঁর জমকালো পোষাক। জরির কাজ করা লম্বা-চওড়া কালো কাপড়ের কামিজ। কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত সারা অঙ্গে জরি ও চকমকি পাথর বসানো। মশালের আলোয় তারকারাজির মত চমকাচ্ছিল ওগুলো। মাথায় রেশমী কাপড়ের হালকা উড়না। তাতেও জমকালো কারুকার্য করা। তার রেশমের মত কোমল মাথার চুল দুই কাঁধের ওপর দিয়ে সামনে ছড়ানো। হালকা উড়নার মধ্য দিয়ে কাঁধ ও গলার উজ্জ্বলতা চাঁদের মত জ্বলজ্বল করছিল। এমনিতেই আশী ছিল অপরূপ সুন্দরী, তার ওপর মোহিনী সাজসজ্জা এবং অঙ্গসঞ্চালনের নৈপুণ্য যাদুর মত প্রভাব ফেলল উপস্থিত দর্শকদের মাঝে। তার প্রতিটি অঙ্গসঞ্চালনেই আশ্চর্য এক মাদকতাময় আবেদন ছড়িয়ে পড়ছিল। মানুষের দেহের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ছিল বিহবলতার অচিন পরশ।

পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী এ লোকগুলোর চোখে মেয়েটিকে মনে হচ্ছিল বেহেশতের হুর। তার চালচলন ও পোষাকের জৌলুশে আটকে গেল বিমুগ্ধ হাজার চোখ। অবাক হয়ে লোকগুলো তাকিয়ে রইল তার দিকে, যেন কোন জাদুকন্যা ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের চোখের সামনে।

আশীর হাতে দেড় গজ লম্বা ও একগজ প্রস্ত একটি কার্পেটের জায়নামাজ। সে জায়নামজটি দুই মশালের মাঝখানে এনে বিছিয়ে দিল। জায়নামাজ বিছানো শেষ হলে সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত আকাশের দিকে বাড়িয়ে ধরে ঊর্ধ্বমুখে নিশ্চল মূর্তির মত দাঁড়িয়ে গেল। লোকগুলোর সব ক’টি চোখ সমস্ত মনোযোগ দিয়ে দেখছিল তাকে। এই ফাঁকে আস্তে সরে গেল তাঁবুর পর্দা। উমরু দরবেশ যেন শূন্যের ওপর দিয়ে ভেসে এসে সেই জায়নামাজের ওপর দাঁড়ালেন, অন্তত লোকগুলোর তাই মনে হলো। তিনিও আশীর মত দুই বাহু আস্তে আস্তে আকাশের দিকে তুলে ধরলেন। নির্বাক লোকগুলো তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তিনি আস্তে আস্তে বিড় বিড় করে কিছু পাঠ করতে লাগলেন।

‘হে খোদার দূত।’ বললো তিনজনের একজন, ‘তোমার সকালের কথা আমাদের মনে গেঁথে আছে। তুমি বলেছিলে তুমি আমাদের তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখাবে। যদি তুমি অসন্তুষ্ট না হও, তবে তোমার কাছে আমরা সেই তাজাল্লি দেখার আরজ করতে চাই।’

‘মিশর ফেরাউনের দেশ!’ উমরু দরবেশ উচ্চ স্বরে বললেন, ‘ফেরাউন মারা গেছে। কিন্তু আল্লাহ্‌ যাকে মিশরের বাদশাহ করেন সেই ফেরাউন হয়ে যায়। এটা মিশরের মাটি, পানি ও আবহাওয়ার প্রভাব। এ জন্যই আল্লাহ্‌র কালেমা পাঠকারীও ফেরাউন হয়ে যায়। হযরত মুসা (আঃ) ফেরাউনের খোদাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং নীল নদের পানি দুই ভাগ করে দেখিয়েছিলেন। এখন মিশর পুনরায় ফেরাউনের অধিকারে চলে গেছে। সেখানে মদের স্রোত বয়ে চলেছে। পর্দানশীন কুমারী মেয়েদের সম্ভ্রম বিনষ্ট হচ্ছে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের অসীম রহমত, এখনো তিনি এ অঞ্চলের লোকদেরকে মিশরের নব্য ফেরাউনের শাসন থেকে মুক্ত রেখেছেন। দোজাহানের মালিক আল্লাহ্‌ তোমাদের ঈমানকে দৃঢ় ও অটুট রাখার স্বার্থে আমাকে পাঠিয়েছেন তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দিয়ে। ফেরাউনের কুপ্রভাব যেন তোমাদের মনে না আসতে পারে, যাদের মনে মিশর সরকারের প্রতি দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে তারা যেন তাদের সে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে সে জন্য আমি তোমাদেরকে তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখাবার ওয়াদা করেছি। নিশ্চয়ই আমি সে ওয়াদা পূরণ করবো। তোমরা অবশ্যই আল্লাহ্‌র নূরে-তাজাল্লি দেখার সুযোগ পাবে।’

‘কখন! কোথায়?’ ব্যগ্রতা সেই লোকের কণ্ঠে।

‘এখনই দেখতে পাবে। তবে তার আগে সবাই পশ্চিম দিকে মুখ করে হাঁটু গেড়ে বসো এবং সেজদায় লুটিয়ে পড়ে আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করো। আমার কাছে নয়, সত্যের নিশানা চাও তাঁর কাছে। তাঁর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। তার যা হুকুম পৃথিবীতে শুধু তাই ঘটে। তিনিই তোমাদের আশা পূর্ণ করবেন।’

লোকজন পশ্চিমমুখী হয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়লো। কয়েক মিনিট কেটে গেল এভাবে। চারদিক নিঝঝুম, চুপচাপ। হাজার হাজার লোক, কিন্তু কোথাও টু শব্দটি নেই।

মিনিট পাঁচেক পর উমরু দরবেশ দরাজ কণ্ঠে বললেন, ‘এবার মাথা তোল।’ লোকগুলো মাথা তুলে আবার উমরু দরবেশের দিকে মুখ করে বসলো। উমরু দরবেশ দু’বাহু আকাশের দিকে বাড়িয়ে আবেগভরা কণ্ঠে বললেন, ‘হে খোদা, তুমি তোমার বিপথগামী বান্দাদেরকে তোমার তাজাল্লি দেখাও, যেমন তুমি হযরত মুসা (আঃ) কে তুর পাহাড়ে দেখিয়েছিলে।’

তিনি সামনে ঝুঁকে মাটি থেকে মশাল হাতে উঠিয়ে নিলেন। রাতের অন্ধকার ততক্ষনে গভীর হয়ে উঠেছে। পাহাড় ও উপত্যকার গাছপালা কালো অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেছে। শুধু দুই মশালের আলোয় আশপাশের সামান্য এলাকা আলোকিত। এ আলোয় উমরু দরবেশ ও আশীকে ছাড়া আর কাউকে দেখা যাচ্ছিল না।

উমরু দরবেশ মশাল উঁচু করে ধরলেন। তারপর পাশের পাহাড়ের চুড়ার দিকে ইশারা করে বললেন, ‘ওদিকে তাকাও, ওখানে যে পাহাড় আছে সে দিকে তাকালেই তোমরা খোদার নূর দেখতে পাবে।’

লোকগুলো তাকালো সেদিকে। না, নিরেট অন্ধকার ছাড়া সেখানে আর কিছুই নেই।

উমরু দরবেশ মশাল আরও উঁচু করে ডানে বামে দুলালেন। জোরে জোরে বলতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহ্‌, তোমার নূরের তাজাল্লি দেখাও। আমাদের হৃদয়কে আলোকিত করো প্রভু। তোমার কুদরতের মহিমা দেখাও খোদা।’

তাঁর বিগলিত অনুনয় তখনো থামেনি, পাহাড়ের চূড়ায় আবছা আলোর আভাস দেখা গেল। আলো ক্রমশঃ বাড়তে বাড়তে চারদিকে আলোকিত করে তুলল। লোকজন অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো সে আলোর দিকে। আলো আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠতে লাগলো এবং ধীরে ধীরে কমতে লাগলো তার উজ্জ্বলতা। তারপর এক সময় একদম নিভে গেল। লোকগুলো হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে, যেখানে এইমাত্র হারিয়ে গেল খোদার নূর। এ বিস্ময়কর ঘটনায় জনতা এতটা হতবাক হলো যে, তারা যেন বোবা এবং পঙ্গু হয়ে গেছে।

এ সময় শোনা গেল উমরু দরবেশের কণ্ঠ, ‘যদি তোমরা খোদার এ তাজাল্লিকে তোমাদের অন্তরে ঠাঁই  না দাও, তবে যে অগ্নিশিখা তোমরা দেখতে পেলে সে অগ্নিশিখা তোমাদের এ শস্য শ্যামল উপত্যকা, সবুজ অরণ্য ও এ পাহাড়ী অঞ্চলকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে মরুভূমি বানিয়ে দেবে।’ উমরু দরবেশ বললেন ‘আমিও তাকে বাঁধা দিতে পারবো না। তিনিই তোমাদেরকে এখানে ডেকেছেন। তোমরা সবাই তাঁর হুকুম মতো চলবে।’

উমরু দরবেশ তার তাঁবুর মধ্যে চলে গেলেন। আশী লোকদের ইশারা করলো চলে যাওয়ার জন্য। জনতা ধীরে ধীরে সেখান থেকে বিদায় হতে লাগলো। হাজার হাজার লোক নেমে যাচ্ছে পাহাড় থেকে। কারো মুখে কোন কথা নেই। রাস্তায়ও লোকগুলো নীরব ছিল, যেন একে অন্যের সাথে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছে। দরবেশের কোন কথাতেই এখন আর কারো কোন সন্দেহ নেই।

তারা যখন পাহাড় ছেড়ে গ্রামে গিয়ে পৌঁছুল, হঠাৎ সামনের লোকেরা দেখতে পেল পেছন থেকে এক লোক দৌড়ে ওদের দিকে ছুটে আসছে আর চিৎকার করে বলছে, ‘ভাইসব, তোমরা একটু দাঁড়াও!’

লোকজন দাঁড়ালে সে সবার সামনে গিয়ে ওদের দিকে মুখ করে ঘুরে দাঁড়াল। সে কিছু বলবে বুঝতে পেরে থেমে গেল লোকজন। দেখলো, এ লোক আর কেউ নন, তাদের গ্রামের মসজিদের সম্মানিত ইমাম সাহেব।

আকাশ থেকে নেমে এসেছে চাঁদের হালকা আলো। সে আলোয় ইমাম সাহেব দেখতে পেলেন, গ্রামের প্রায় সব লোকই তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি দু’হাত উপরে তুলে ওদের পথ আগলে ধরে বললেন, ‘মুসলমান ভাইসব, তোমরা তোমাদের ঈমান নষ্ট করো না। এতক্ষণ তোমরা যা দেখলে তা বুঝাতে চেষ্টা করো। মুসলমান ভাইয়েরা আমার! তোমরা যা দেখলে এর সবই যাদুর খেলা! এগুলো নিছক ভেল্কিবাজি! আল্লাহ্‌র প্রিয় নবী ও তাঁর শেষ রাসূলের পর আর কোন নবী ও রাসূল আসবেন না এবং কেউ আসেনওনি। আল্লাহ্‌ এমন পাপিষ্ঠ লোককে তাঁর আলো ও তাজাল্লি দেখাতে পারেন না, যে ব্যক্তি একটি বেহায়া যুবতীকে প্রদর্শনী করে বেড়ায়। যে লোক আল্লাহ্‌র বিধান লঙ্ঘন করে যুবতী নারীকে হাজার হাজার মানুষের সামনে প্রদর্শন করতে পারে তার কি কোন লজ্জা ও ঈমান থাকতে পারে?’

‘এ কোন যুবতী মেয়ে মানুষ নয়, এ তো জ্বীনের পরী!’ একজন বললো।

‘জ্বীন মানুষের রূপে কোন দিন সামনে আসে না।’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘আর জ্বীন কখনও মানুষের দাস-দাসী হতে পারে না। ভাইসব, আমি বলছি, তোমরা তোমাদের বিশ্বাস নষ্ট করো না, ঈমানকে দৃঢ় ও মজবুত রাখো। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ফেরাউন হতে পারেন না, তিনি একজন আল্লাহ্‌র প্রিয় বান্দা, খাঁটি মুসলমান! তিনি নবুয়ত দাবি করেননি, তিনি তোমাদের দ্বীন ও মিল্লাতের একজন একনিষ্ঠ খাদেম ও সেবক। তিনি কাফেরদের অত্যাচার থেকে মুসলমানদের বাঁচাবার জন্য সারা জীবন শত্রুর সাথে যুদ্ধ করেছেন! এখনো তিনি যুদ্ধের ময়দানে! লড়াইয়ের ময়দানে টিকতে না পেরে তার শত্রুরা তোমাদের ঈমান নষ্ট করার জন্য এ জঘন্য পথ বেছে নিয়েছে!’

‘সম্মানিত ইমাম!’ একজন প্রশ্ন করলো, ‘আপনি কি জীবনে কোন দিন পানিতে আগুন ধরাতে দেখেছেন? বলুন, জবাব দিন।’ বেপরোয়া কণ্ঠে জানতে চাইল লোকটি।

‘আরে ওর কথায় কান দিও না।’ অন্য একজন বললো, ‘এ বেচারা তার ইমামতি ঠিক রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে আছে।’

‘আমরা স্বচক্ষে যা দেখলাম তা কি আপনি অবিশ্বাস করতে বলেন?’ অন্য একজন বললো, ‘আপনার কাছে এমন কি প্রমাণ আছে যে , আপনি দরবেশের কেরামতিকে অবিশ্বাস করতে বলেন?’

‘তোমরা দয়া করে সেই পাহাড়ে চলো, যেখানে তাজাল্লি দেখানো হয়েছে।’ ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমি তোমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবো, এ স্রেফ ভেল্কিবাজী! ডাহা মিথ্যাচার ও প্রতারণা! আর যদি আমি তা প্রমাণ করতে না পারি তবে তোমরা আমাকে যে শাস্তি দাও তাই মাথা পেতে নেবো, এমনকি তোমরা যদি আমাকে সেখানেই হত্যা করতে চাও, তাতেও আপত্তি করবো না। আমার এ অনুরোধটুকু তোমরা রাখো। খোদার কসম! তোমরা ঈমান হারিয়ে বাড়ি ফিরে গেছো, এটা দেখার চেয়ে মরণই আমার ভাল।’

উপস্থিত লোকদের মনে দোটানার সৃষ্টি হলো। ইমাম সাহেবও এ এলাকারই লোক। ছোটবেলা থেকেই সবাই তাকে দেখছে। তিনি একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি হিসাবেই সবার কাছে পরিচিত। ফলে তাঁর কণ্ঠ ও কথায় প্রভাবিত হলো অনেকেই। কিন্তু কারো কারো মনে দরবেশের কেরামতির প্রভাবই তখনো প্রবল ছিল। এ জনতার মধ্যে শামিল ছিল সুদানী গোয়েন্দারাও। তাদেরই একজন এগিয়ে এসে বললো, ‘আমরা খোদার নূর দেখেছি। দরবেশ যা বলেছে তাতে সন্দেহের কিছু দেখছি না। তিনি আমাদের আল্লাহ্‌র পথে চলার জন্য ডাক দিয়েছেন। এ কাজে কেউ বাঁধা দিক তা আমরা চাই না। কেউ এমন দুঃসাহস করলে তার পরিণতি মারাত্মক হবে বলে দিলাম।’

সঙ্গে সঙ্গে আরো দু’তিনজন তাকে সমর্থন করলো এবং ইমাম সাহেবের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে তেড়ে এলো তার দিকে। ইমাম সাহেবের কথায় যারা প্রভাবিত হয়েছিল, এ প্রতিবাদ দেখে তারা চুপসে গেল। ইমাম সাহেব তাদের বুঝাতে চাইলেন, কিন্তু তারা ইমাম সাহেবকে ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে বাড়ীর দিকে রওনা হলো। তাদের দেখাদেখি বাকীরাও ঘরের পথ ধরলো।

কিছুক্ষণ ইমাম সাহেব সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। লোকেরা তাকে রেখে এগিয়ে গেলে বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন তাদের চলে যাওয়া। শেষে একাই অন্ধকারের ভেতর দিয়ে সে পাহাড়ের দিকে যাত্রা করলেন, যেখানে নূরের তাজাল্লি দেখানো হয়েছিল।

পথ চলছেন তিনি একা। অন্ধকার রাত। ভয়াবহ কংকরময় এবড়ো থেবড়ো পাহাড়ী রাস্তা। একটি জঙ্গল অতিক্রম করে তিনি এক উঁচু টিলায় পৌঁছলেন। টিলায় দাঁড়িয়ে চারদিকে নজর বুলাচ্ছেন তিনি, হঠাৎ মানুষের কণ্ঠ কানে এলো তার। আওয়াজ ভেসে আসছিল সামনের দিক থেকে, সেদিকে তাকালেন তিনি। দেখলেন দু’ব্যক্তি কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। তারা ইমাম সাহেবের দিকেই এগিয়ে আসছিল। তিনি আর না এগিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন।

তাদের পদধ্বনি ক্রমশঃ নিকটতর হলো। লোক দু’জন তাঁর কাছে এগিয়ে এলে চাঁদের ক্ষীণ আলোয় তিনি দেখতে পেলেন, ওদের মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। ইমাম সাহেব তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কারা?’ তারা এর কোন জবাব না দিয়ে একজন ইমাম সাহেবের সামনে দাঁড়াল, অন্যজন চলে গেল ইমাম সাহেবের পিছনে। ইমাম সাহেব কিছু বুঝে উঠার আগেই পেছনের লোকটি পিছন থেকে ইমামের গলা জড়িয়ে ধরে তাঁকে মাটিতে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করলো। ইমাম সাহেব ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে পেরে কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে চট করে কোমর থেকে খঞ্জর বের করে হাতে নিলেন। সামনের লোকটি থাবা দিয়ে ধরে ফেললো খঞ্জর ধরা হাতটি। ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেলো ওদের মধ্যে। ইমাম সাহেব একা এবং অসহায় অবস্থায়। তাঁর খঞ্জর ধরা হাতটি একজনের কব্জায় আবদ্ধ, অন্যজন তাঁর গলা আঁকড়ে ধরে আছে। লোকটি তার হাতের চাপ বাড়াচ্ছে। শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় ছটফট করতে লাগলেন ইমাম সাহেব। তাঁর নিঃশাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়, চাপ কমাতে না পারলে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাবেন তিনি। তিনি মুক্ত হবার জন্য মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা চালালেন। সর্বশক্তি দিয়ে প্রচণ্ড জোরে লাফ দিয়ে উঠলেন তিনি এবং সঙ্গে সঙ্গে জোড়া পায়ে সামনের লোককে সজোরে লাথি মারলেন। লাথি লোকটির বুকে লাগলো। পিছনের লোকের হাত থেকে ছুটে গেল তার গলা এবং লোকটি পেছনের দিকে ছিটকে পড়ল। সামনের লোকটিও লাথির আঘাতে চিৎ হয়ে পড়ে গিয়েছিল। তারা উঠে বসার আগেই ইমাম সাহেব মুহূর্তে নিজেকে মুক্ত করে খঞ্জর হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি একটি রক্তাক্ত লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়ে রুখে দাঁড়াতেই লোক দু’টি উঠে ভয়ে পালিয়ে গেল।

তাদের পালানোর কারণ ছিল, তারা দু’জনেই সে গ্রামের  লোক ছিল যেখানে ইমাম সাহেব ইমামতি করতেন। মুখোশ খুলে গেলে ইমাম সাহেব তাদের চিনে ফেলতে পারেন, এ ভয়েই তারা  পালাচ্ছিল। ইমাম সাহেব তাদের ডাকলেন, ভয় দেখালেন, কিন্তু তারা ফিরলো না। ইমাম সাহেব তাদের পিছু ধাওয়া না করে সেই পাহাড় চুড়ার দিকে পূনরায় যাত্রা করলেন।

উমরু দরবেশের তাঁবুতে বসেছিল সে তিনজন লোক, যারা সবসময় তার সাথে যোগাযোগ রাখতো। গ্রামবাসী সেজে যারা দিনের বেলায় তাকে সহযোগিতা করেছিল। তারা উমরু দরবেশকে বললো, ‘কেল্লা ফতে দরবেশ! তোমার অভিনয় দারুন হয়েছে। আমাদের মিশন একশো ভাগ সফল। লোকজন সে মনোভাব নিয়েই ফিরে গেছে, যেমনটি আমারা আশা করেছিলাম।’

‘তোমরাও চমৎকার খেল দেখিয়েছো!’ বললেন দরবেশ।

তারা বললো, ‘আগামীকাল রাতে এ খেল আমরা দেখাবো অন্য গ্রামে। তার পরদিন আরেক গ্রামে। সুদান ও মিশরের মুসলিম প্রধান প্রতিটি এলাকায় আমরা এখন থেকে এ খেলা দেখিয়েই যেতে থাকবো। তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দিয়ে অন্ধ করে দেবো তাদের চোখ, তাদের অন্তর। তুমি পারবে দরবেশ, সুদান সরকারকে আমরা জানাবো তোমার এ কৃতিত্বের কথা। আজ তাহলে আসি।’

আশী ও উমরু দরবেশের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল ওরা। আশী একাকী বসে রইলো উমরু দরবেশের কাছে। ‘তুমি কি তোমার এ সফলতায় খুশী হয়েছো?’ আশী প্রশ্ন করলো।

‘আশী!’ উমরু দরবেশ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমি তোমাকে এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে ভয় পাই।’

‘তুমি কি চাও, আমি চিরকাল খৃস্টান ও সুদানীদের আশ্রিতা হয়েই বেঁচে থাকি?’ আশী বললো, ‘তুমি আমার মধ্যে ঈমানের আলো জ্বেলে দিয়ে এখন নিজেই আমাকে অবিশ্বাস করছো!’

‘আশী! আমি তোমাকে অবিশ্বাস করি এ কথা কখনো বলিনি। এটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয়, এটা কর্মকৌশলের নীতি।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘তবে শুধু মুখের কথায় নয়, বিশ্বাস প্রমাণ করতে হয় নিজের কর্ম দিয়ে।’

‘আমাকে বলো, আমাকে কি করতে হবে। আমি কি করবো? কি করলে প্রমাণ হবে আমি বিশ্বাসী। তুমি যা বলবে, আমি তাই করবো।’

‘এখন যা করছো তাই করতে থাকো।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘যখন সময় হয় তখন তোমাকে বলে দেবো, তোমাকে কি করতে হবে।’

‘এমন তো হতে পারে, তোমার বলার সুযোগই থাকবে না।’ আশী বললো, ‘তুমি তো দেখছো, তোমার আশেপাশে গুপ্তচর লেগেই আছে। যদি তুমি সামান্য সন্দেহজনক কাজ করো, এ গোয়েন্দারা তোমাকে গোপনে খুন করে ফেলবে এবং আমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাবে। তারচে তুমি আগেই আমাকে বলে দাও, তোমার ইচ্ছাটা কি? তাহলে তোমাকে আমি সবসময় সতর্ক করতে পারবো। কারণ গোয়েন্দারা তো আমাকে তাদেরই একজন মনে করে।’

আশীর বলার ভঙ্গি এমন আন্তরিক ও অকপট ছিল যে, মেয়েটি তাকে ধোঁকা দেবে না উমরু দরবেশের মনে এ বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি হলো। তিনি বললেন, ‘তবু তোমার কর্তব্যনিষ্ঠা দেখে আমার ভয় হয়, তুমি আসলে কার?’

‘তুমিও তো কর্তব্যে খুব নিপূনতা ও সাফল্য দেখাচ্ছ। আমিও তো মনে করতে পারি, তুমি জাতিকে ধোঁকা দেয়ার পাকা সংকল্প করে বসে আছো। ঈমানের পথে চলার কোন ইচ্ছাই এখন আর তোমার মনে অবশিষ্ট নেই।’

তর্কে টিকতে না পেরে উমরু দরবেশ বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি তোমাকে আমার ইচ্ছার কথা বলবো। তবে তোমাকে এ কোথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তুমি যদি তোমার অঙ্গীকার পূরণ না করে আমাকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করো, তবে তুমিও আর এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে না। আমি মরতে ভয় পাই না এবং প্রয়োজন হলে কাউকে খুন করতেও হাত কাঁপবে না আমার।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘আমি তো পথেই তোমাকে বলেছি, একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্ন আমি এ পথে বের হয়েছি। আমার আশা ছিল, এখানে আমার নিজের এলাকায় এসে আমার সে উদ্দেশ্য সফল করতে পারবো। কিন্তু এখানে এসে দেখতে পাচ্ছি, সুদানী গোয়েন্দারা আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। আমার উদ্দেশ্য সাধনের পরিবর্তে এখন আমি আমার জাতির বুকে ছুরি বসাচ্ছি। একান্ত বাধ্য হয়েই আমি আমার আসল উদ্দেশ্য গোপন করে রেখেছি। তুমি দেখতেই পাচ্ছো, আমার কার্যকলাপ জাতির ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছে। যদি আমি এমন কার্যকলাপ অব্যাহত রাখি তবে সেদিন বেশী দূরে নয়, এখানকার মুসলমানরা সবাই সুদানের গোলামীর শিকলে বাঁধা পড়ে যাবে। আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে জাতীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে এতদিন ওরা যেভাবে চলছিল, সে ঐতিহ্য ওরা হারিয়ে ফেলবে চিরদিনের মত।’

‘তুমি এখন কি করতে চাও?’ আশী প্রশ্ন করলো।

‘আমি ইসহাকের গ্রামে যেতে চাই।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘সেই ইসহাক, যিনি সুদানি কারাগারে কয়েদী অবস্থায় পড়ে আছেন। যার কামরায় তুমিও ছিলে একরাত।’

‘ওই লোককে আমি জীবনে কোনোদিন ভুলতে পারবো না।’ আশী বললো, ‘তোমার মত আমি তারও একজন একনিষ্ঠ ভক্ত!’

‘আমি আগে তার বাড়ীতে যেতে চাই।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘তারপরে আমি যাবো আমার গ্রামে। আমি প্রথমে চিন্তা করেছিলাম এখান থেকেই আমি নিখোঁজ হবো। তারপর লোকদের বলবো, তারা যেন সুদানীদের হাতকড়া থেকে মুক্ত হতে চেষ্টা করে।’

‘মনে হচ্ছে তুমি নিয়ম মাফিক কোন পরিকল্পনা করোনি।’ আশী বললো, ‘আমাকে যখন কোন কাজে পাঠানো হয়, তখন তারা আমাকে নিখুঁত পরিকল্পনা দিয়ে দেয়।’

‘আমি কারাগারের কঠিন শাস্তিতে অসহ্য হয়ে বের হয়ে এসেছি।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘তখন আমার একটাই চিন্তা ছিল, কারাগার থেকে কি করে বের হওয়া যায়। এর বেশী চিন্তা করার মত অবস্থা ছিল না আমার। শুধু এতটুকুই আশা ছিল, বেরোতে পারলে একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। এখানে এসে বুঝতে পারছি, অবস্থা বড়ই জটিল। সুদানীদের ঘেরাটোপ আমার উদ্দেশ্য সাধনকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে।’

‘এখন আমাকেও একটু চিন্তা করতে দাও।’ আশী বললো, ‘যদি আমার ঈমান দৃঢ় হয়ে থাকে, যদি আমি খোদার পথের পথিক হয়ে থাকি, তবে আল্লাহ্‌ আমার মাথায় এমন কোন বুদ্ধি দিয়ে দিতে পারেন, যা তোমার উদ্দেশ্য সফল করার সহায়ক হবে। দেখি আমি কোন উপায় বের করতে পারি কিনা।’

‘আমাদের এখন একজন জ্ঞানী ও বিশ্বস্ত লোকের পরামর্শ প্রয়োজন। তেমন লোকের সাক্ষাৎ পেলেই কেবল এ সমস্যার সমাধান হতে পারে।’

উমরু দরবেশের তাঁবু থেকে দু’আড়াই মাইল দূরে মিশরের একটি বাণিজ্য কাফেলা এসেছে। কাফেলায় মাত্র চারজন বণিক ও ছয়টা উট। কাফেলার সরদার এক বুড়ো। তার লম্বা পাকা দাড়ি, কিন্তু সুঠাম শরীর। চেহারায় খেলা করছে প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার ব্যক্তিত্বময় অভিব্যক্তি। তার এক চোখে সবুজ রংয়ের কাপড়ের পট্টি, যেন সে চোখটি নষ্ট হয়ে গেছে। মাত্র দু’রাত আগে এ কাফেলা সুদানের সীমান্ত পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে। সুদানে গোপনে খাদ্য পাচারকারীদেরই একটি দল এ কাফেলা। অন্য স্মাগলাররাও আছে সেখানে।

সুদানে তখন খাদ্য শস্যের চরম সংকট চলছিল। সুদান সরকার তাই এসব চোরাকারবারীদের ব্যাপারে ছিল নির্লিপ্ত। সরকার এদের দেখেও দেখতো না, জেনেও জানতো না। ফলে কোন রকম সরকারী বিধি নিষেধের ভয় ছিল না চোরাকারবারীদের। এ স্মাগলারদের অধিকাংশই ছিল মিশরের গোয়েন্দা। ফলে মিশরের সীমান্ত পুলিশও ওদের কোন রকম বাঁধা দিত না। আর সুদানের সীমান্ত রক্ষীরা তো এদের পথ নিষ্কণ্টক করার জন্যই ব্যতিব্যস্ত থাকতো। ফলে এ কাফেলা বিনা বাঁধা ও ঝামেলায় সীমান্ত পার হয়ে সুদানে প্রবেশ করলো। এ কাফেলা সুদানের কোন শহর বা কোন অঞ্চল যাচ্ছে এ নিয়ে সুদানী রক্ষীদের কোন মাথাব্যথা ছিল না। তবু সতর্কতার জন্য সুদানে প্রবেশ করেই তারা মুসলিম প্রধান পাহাড়ী অঞ্চলের পথ না ধরে অন্য দিকে চলতে লাগলো।

সুদান সরকার পাহাড়ী মুসলিম এলাকায় গুপ্তচর ছড়িয়ে রেখেছিল। যেহেতু পাহাড়ী মুসলমানরা সুদান সরকারের অনুগত নয়, তাই নতুন কোন কাফেলা এলে তাদের দিকে কড়া নজর রাখার দায়িত্ব ছিল তাদের। সরকার চাচ্ছিল, খাদ্যশস্য ও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে ওখানকার জনজীবন যেন দুর্বিসহ হয়ে উঠে। এ জন্য খাদ্যবাহী চোরাকারবারীরা সে এলাকায় গেলে তাদেরকে হেনস্তা করার নির্দেশ ছিল এ গুপ্তচরদের।

সরকারের এ মনোভাব জানতো কাফেলার সরদার। তাই তিনি সারা রাত পথ চলে ভোর বেলা উটগুলোকে টিলার মধ্যে লুকিয়ে  ফেলতেন। সারাদিন টিলার আড়ালে থেকে রাত হলে আবার পথে নামতেন। এভাবেই পথ চলছেন তিনি। সীমান্ত পেরিয়ে চলে এসেছেন দেশের অনেক গভীরে।

দিন শেষে আবার নেমে এলো রাতের অন্ধকার। কাফেলা যাত্রা শুরু করলো এবং রাতের দ্বিপ্রহরে গিয়ে পৌঁছল তাদের সেই আকাঙ্খিত পাহাড়ী এলাকায়। এক স্থানে তাঁবু গেড়ে কাটিয়ে দিল বাকী রাতটুকু।

ভোর রাতে কাফেলা একটি গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলো। তখনো সূর্য উঠেনি। কাফেলার সরদার এক বাড়ীর সামনে গিয়ে থামলেন ও দরজায় করাঘাত করলেন। কিছুক্ষণ পর বাড়ীর গেট খুলে এক ব্যক্তি হাতে হারিকেন নিয়ে বাইরে এলো। কাফেলার সরদার তার কানে কানে কিছু বললেন। লোকটি তাদের খোশ আমদেদ জানিয়ে বললো, ‘আপনারা সবাই জলদি ভেতরে প্রবেশ করুন, উটগুলো আমরা হেফাজত করছি।’

চারজন বণিক সে বাড়ীতে মেহমান হিসেবে প্রবেশ করলো। বাড়ীর মালিক বাড়ীর সবাইকে জাগালেন এবং কয়েকজন পড়শীকে ডেকে পাঠালেন। পড়শীরা এলে ছয়টি উট বন্টন করে দিলেন তাদের কাছে। ওরা সেগুলো নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে যার যার বাড়ী ফিরে গেল। কাফেলার সরদার বললেন, ‘তোমরা উটের পিঠের মাল-সামান জলদি নামিয়ে লুকিয়ে ফেলো।’

ওরা উটের পিঠের মালসামান নামিয়ে দেখলো তাঁর মধ্যে তীর ও যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া কোন খাদ্যশস্য নেই। ওরা তীর, ধনুক, তলোয়ার, বর্শা ও খঞ্জরগুলো দ্রুত লুকিয়ে ফেললো। তিন চার ড্রাম গোলা বারুদ ও পেট্রোল ছিল, সেগুলোও লুকিয়ে রাখলো গোপন জায়গায়। তারপর ফিরে এলো আগের বাড়ীতে।

‘আমি কি এখন তোমাদের সামনে খোলামেলা কিছু কথা বলতে পারি?’ কাফেলার সরদার বললেন।

‘কোন ভয় নেই, এরা সবাই আমাদের নিজস্ব লোক!’ মেজবান বললো।

কাফেলার সরদার তাঁর লম্বা দাড়ি খুলে ফেললেন এবং চোখ থেকে সবুজ পট্টি সরিয়ে দিলেন। কৃত্রিম দাড়ি সরাতেই তাঁর আসল সুন্দর করে ছাটা দাড়ি বেরিয়ে পড়লো। একদম নতুন মানুষে পরিণত হয়ে গেলেন তিনি। মালসামান লুকিয়ে রেখে যারা এসে সমবেত হয়েছিল মেহমানের কাছে তাদের এক ব্যক্তি কাফেলার সরদারকে আপন চেহারায় দেখতে পেয়ে থতমত খেয়ে গেল। সরদার হেসে বললেন, ‘আমাকে তাহলে এতক্ষণ চিন্তে পারোনি, তাই না?’

‘আলী বিন সুফিয়ান!’ লোকটি বলে উঠলো, ‘সত্যি আমি আপনাকে এতক্ষণ চিন্তে পারিনি।’ তারপর লোকটি দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমাদের কি পরম সৌভাগ্য যে, আপনি নিজেই এসে গেছেন। এখানকার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ! অবস্থার নাজুকতায় আমি কোন কূলকিণারা পাচ্ছিলাম না! আপনি এসে গেছেন, এবার পরিস্থিতি সামাল দিন।’

‘হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছিলাম, এখানকার অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে যাবে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আমি যখন সংবাদ পেলাম, সুদানের কারাগারের এক প্রহরী সুদানের সামরিক বিভাগের কমান্ডারকে হত্যা করেছে, আর জানতে পারলাম, সুদান সরকার মিশরী যুদ্ধবন্দীদের আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইছে, তখনই বুঝেছিলাম, এখানে ভয়ংকর কোন ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠেছে।’

এ বহুরূপী লোকটি ছিল সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান। তিনি এখন যে বাড়ীতে এসে উঠেছেন, সেটিই এখানকার মিশরীয় গোয়েন্দাদের প্রধান ঘাঁটি। বাড়ীর মালিক একজন সুদানী! সুলতান আইয়ুবীর এক বিশ্বস্ত ভক্ত। এখানকার গোয়েন্দা প্রধান একটু পর আলী বিন সুফিয়ানকে শোনাল এক নতুন খবর।

‘চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, খোদার এক দূত এসেছেন, যিনি পানিতে আগুন ধরাতে পারেন।’ বাড়ীর মালিক আলী বিন সুফিয়ানকে জানালেন, ‘তিনি মানুষের মাঝে আজগুবী কথা বলে বেড়াচ্ছেন। খোদা নাকি তাঁকে মৃত লাশের মধ্য থেকে উঠিয়ে এনেছেন। তিনি লোকজনদের বলে বেড়াচ্ছেন, ‘মুসলমানদের গিয়ে বলো, তারা যেন সুদানের ভক্ত ও অনুগত হয়ে যায়। কারণ সুদানের মাটি তোমাদের মা।’

তিনি উমরু দরবেশ সম্পর্কে সব কথা আলী বিন সুফিয়ানকে জানালেন।

‘আমার এটিই বড় ভয় ছিল, শত্রুরা এবার মুসলমানদের ঈমানের ওপর আঘাত হানবে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘সে কারণেই আমি নিজে এসেছি। খৃস্টানরা ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক কাজের নিপূণ ওস্তাদ আর আমাদের জাতি সব সময় হুজুগে মাতাল। খৃস্টানদের কথার যাদুতে মজে যায় ওরা। আমাদের সরল সহজ মুসলমান ভাইদের মনে সন্দেহ সৃষ্টিতে দক্ষ কারিগরের মতই কাজ করে ওরা।। আমার জানা দরকার এ ফেৎনার মূল কোথায়! উমরু দরবেশকে আমি ভাল মতই চিনি। তিনি আমাদের সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার ছিলেন। সুদানিদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন তিনি। এমন কথা তাঁর মুখ থেকে বলার কথা নয়। তাকে কখনো দুর্বল ঈমানের লোক মনে হয়নি। সত্যি যদি তিনি এসে থাকেন এবং এসব কথা বলে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি সুদানীদের ফাঁদে পা দিয়েছেন অথবা এর মধ্যে কোন রহস্য আছে। যাই হোক, আমাকে এর আসল কারণ জানতে হবে।’

এ অঞ্চলে মিশরের গোয়েন্দা ও কমান্ডোদের সংখ্যা নেহাৎ কম ছিল না। আলী বিন সুফিয়ান মেজবানকে বললেন, ‘তুমি কিছু বিশ্বস্ত গোয়েন্দা ও কমান্ডোকে ডেকে আনার ব্যবস্থা করো। এ দুষ্কর্মের সমুচিত জওয়াব দিতে হবে।’

সূর্য তখন উঠি উঠি করছে। গোয়েন্দা ও কমান্ডোদের ডেকে আনার জন্য লোকজন ছুটলো এদিক-ওদিক। তারা বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই এক অশ্বারোহী তীর বেগে ছুটে এসে সেই বাড়ীর সামনে থামলেন। আরোহী ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে যখন ভেতরে প্রবেশ করলেন, সবাই দাঁড়িয়ে গেল তাঁকে সম্মান জানাতে। এই সেই ইমাম, যিনি উমরু দরবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। লোকেরা তাঁর কথা না শুনে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে চলে গিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে তাঁর ওপরই আক্রমণ চালিয়েছিল দু’ব্যক্তি। ইমাম সাহেব তাদের প্রতিহত করলে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ বাড়ীটি যে মিশরী গোয়েন্দাদের গোপন মিলন কেন্দ্র, এ কথা তিনি জানতেন। পাহাড় থেকে ফিরে প্রথমে তিনি মসজিদে যান, সেখান থেকে বাড়ী ফিরেই চড়ে বসেন ঘোড়ার ওপর। কালবিলম্ব না করে সাথে সাথে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন এ গ্রামের দিকে। তিনি বুঝতে পারছিলেন, উমরু দরবেশের কার্যকলাপ ভিলকিবাজী ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি এখানে ছুটে এসেছেন সে কথা জানাতে এবং কি করে এ ভিলকিবাজী ও প্রতারণা বন্ধ করা যায় তা জানতে। তাকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়ালে আলী বিন সুফিয়ানও উঠে দাঁড়ালেন। কারণ, ইমাম সাহেব ও আলী বিন সুফিয়ান কেউ কাউকে চিনতেন না।

ইমাম সাহেবকে আলী বিন সুফিয়ানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘ইমাম সাহেব, উমরু দরবেশ সম্পর্কে সবকিছু আমাকে খুলে বলুন। এ কি আসলেই উমরু দরবেশ, নাকি তাঁর নামে অন্য কেউ এসব করে বেড়াচ্ছে?’

তিনি তাঁকে উমরু দরবেশের কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন। কিভাবে উমরু দরবেশ লোকদের সম্মোহিত করছে, ভিলকিবাজির খেলা দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে এসব বলে বললেন, ‘না, এ লোক উমরু দরবেশই। আমরা তাঁর গ্রামের বাড়ীতে লোক পাঠিয়ে খবর নিয়েছি এবং তাঁকে চিনে এমন লোক দিয়ে সনাক্ত করিয়েছি।’ ইমাম সাহেব আরো বললেন, ‘যদি তার এ কার্যকলাপ ও প্রচার বন্ধ করা না হয় তবে এখানকার মুসলমানরা ধ্বংস হয়ে যাবে। এ লোক নিজেকে খোদার দূত দাবি করছে। আজ রাতে উমরু দরবেশ সামনের গ্রামে ভিলকিবাজী দেখাবে।’

ইমাম সাহেব ও উপস্থিত লোকজন এর কি বিহীত করা যায় এ নিয়ে আলোচনায় বসলেন। অধিকাংশই বললেন উমরু দরবেশকে হত্যা করা হোক।’ আলী বিন সুফিয়ান এ মতের সাথে একমত হতে পারলেন না। তিনি সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘উমরু দরবেশকে হত্যা ছাড়াই সঠিক পথে আনা যাবে। আর তাঁর মুখ দিয়েই বলানো হবে, সে যা দেখিয়েছে তা সবই ভেলকিবাজী! সব মিথ্যা! কিন্তু তাঁকে হত্যা করা হলে লোকেরা তাকে আরও বেশী সত্য বলে মনে করতে থাকবে।’ আলী বিন সুফিয়ানের সাথে অন্য যে তিনজন বণিকের বেশে এসেছিলেন তারা মিশর সেনাবাহিনীর পরীক্ষিত সৈনিক ও গোয়েন্দা। আলী বিন সুফিয়ান আবার আগের চেহারায় ফিরে গেলেন। এক চোখে সবুজ কাপড়ের পট্টি বাঁধলেন আর মুখে লাগালেন লম্বা পাকা দাড়ি। সঙ্গী তিনজনকে বণিকের বেশেই তৈরী হতে বলে লোকদের ঘোড়া সাজাতে বললেন, আরও কয়েকজনকে বললেন ঘোড়া ও উটে চড়ে তার পিছু নিতে। সবাই তৈরী হলে ইমাম সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সেদিকে যাত্রা করলেন, যেখানে উমরু দরবেশ আজ রাতে তুর পাহাড়ের নূর দেখাবে বলে প্রচার করেছে।

উমরু দরবেশ পরদিন সকালে সূর্য উঠার সাথে সাথেই আশীকে নিয়ে নতুন ঠিকানায় যাত্রা করলেন। তাঁর সঙ্গী-সাথীরা সে এলাকায় আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। তারা হুজুরের আগমন বার্তা প্রচার করছিল জোরেশোরে। আশী ছাড়াও তাঁর হেফাজতের জন্য তাঁর সঙ্গে চললো সেই তিন লোক, যারা তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল।

উমরু দরবেশের আগমন বার্তা দূর-দূরান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। পথে তিনি এক গ্রামের পাশে এসে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা বিরতি করলেন এবং সেখানে তাঁবু টানিয়া বিশ্রাম নিলেন। তারপর দুপুরের পর পরই নির্ধারিত গ্রামে পৌঁছে উপযুক্ত স্থান বেছে নিয়ে তাঁবু খাটিয়ে রাতের প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। আশীও প্রস্তুত হয়ে গেল।

তাঁবুর সামনে দু’টি মশাল জ্বালিয়ে রাখা হলো। উমরু দরবেশের সাথীরা আশপাশের গ্রামে গিয়ে খোদার দূতের মোজেযার কাহিনী প্রচার করে তিনি যে সেখানে আস্তানা গেড়েছেন সে কথা বলে বেড়াতে লাগলো। লোকজন খোদার দুতকে দেখার জন্য ছুটলো তাঁর আস্তানার দিকে। যারা গতকাল উমরু দরবেশের কেরামতি দেখেছিল তারাও দুরের পথ অতিক্রম করে সেখানে এস পৌছুলো।

সন্ধ্যা হতে তখনো বেশ বাকী। এখনো আছরের আজান হয়নি, এরই মধ্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে তাঁবুর সামনের খোলা প্রান্তর। আশী তাঁর সেই চমকপ্রদ পোষাক পড়ে পরী সেজে বেরিয়ে এলো তাঁবুর বাইরে। আগের দিনের মতই শুরু হলো তাদের অভিনয়। উমরু দরবেশ দুই মশালের মাঝখানে একটি ছোট জায়নামাজ বিছিয়ে সেখানে গিয়ে বসলেন। তাঁর সামনে পড়ে আছে কিছু শুকনো কাপড়, যেমন পড়েছিল গত কালের প্রদর্শনীর সময়। এক ব্যক্তি ঠিক আগের মতই প্রশ্ন করলো, ‘আপনার কথা আমরা কেন বিশ্বাস করবো? আপনি কি আমাদের কোন মোজেযা দেখাতে পারবেন?’

উমরু দরবেশও আগের মতই অভিনয়ের স্বরে বলতে লাগলেন, কারো কাছে যদি কোন পানির পাত্র থাকে তবে সে যেন পানি দিয়ে তাঁর সামনে পড়ে থাকা কাপড়গুলো ভিজিয়ে দেয়। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে উমরু দরবেশের খেলা দেখতে লাগলেন আলী বিন সুফিয়ান ও তার সঙ্গীরা। তিনি উমরু দরবেশকে দেখেই চিনতে পারলেন। মিশরের সেনাবাহিনীর কোন ব্যাটেলিয়নের কমান্ডারকে চিনতে না আলী বিন সুফিয়ান, তা তো হয় না! উমরু দরবেশকে চিনতে পেরে তিনি যে কেবল তাজ্জব হলেন তাই নয়, ব্যথিতও হলেন, শেষ পর্যন্ত উমরু দরবেশও বেঈমানের তালিকায় নাম লেখালো!

আলী বিন সুফিয়ানকে আগেই জানানো হয়েছিল, উমরু দরবেশ পানিতে আগুন জ্বালাতে পারেন। আলী বিন সুফিয়ান অভিজ্ঞ এবং দূরদর্শী মানুষ। তিনি জানেন, পানিতে কখনও আগুন জ্বালানো সম্ভব নয়। মনের সন্দেহ দূর করার জন্য তিনি ছোট একটি মশকে করে কিছু পানি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। উমরু দরবেশ যার কাছে পানি আছে তাঁকে কাপড়ের ওপর পানি ঢালতে আহবান জানানোর সঙ্গে সঙ্গে এক লোক দ্রুত অগ্রসর হয়ে কাপড়ের ওপর পানি ঢেলে দিল।

আলী বিন সুফিয়ানও সঙ্গে সঙ্গে সামনে অগ্রসর হয়ে মাটি থেকে একটি মশাল তুলে নিয়ে উঁচু করে ধরলেন এবং উপস্থিত লোকদের বললেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে যে কোন একজন সামনে এসো।’ আলী বিন সুফিয়ানের তিন সঙ্গীর একজন সামনে এসে দাঁড়ালো।  তিনি মশাল তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এ কাপড়ের ওপর মশালের শিখা স্পর্শ করো।’ লোকটি থতমত খেয়ে প্রথমে আলীর দিকে, তারপর উমরু দরবেশের দিকে এবং সবশেষে জনতার দিকে ফিরে তাকালো। আলী বিন সুফিয়ান দর্শক জনতাকে উদ্দেশ্য করে আবারও বললেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকেও যে কোন লোক এ ভেজা কাপড়ে আগুন ধরাতে পারবে।’ আলী মশাল ধরা লোকটির দিকে আবার ফিরে তাকাতেই সে মশালের শিখা কাপড়ের কাছে নিয়ে গেল। দপ করে কাপড়ে জ্বলে উঠলো আগুন। উমরু দরবেশের দলের এক লোক তেড়ে এলো আলীর দিকে। বলে উঠলো, ‘তুমি কোথাকার জাদুকর হে! তুমি জলদি সরে যাও এখান থেকে, নইলে খোদার দূতের ইশারায় তোমার ওপর গজব নেমে আসবে।’

উমরু দরবেশ চুপ করে থেকে বিস্মিত চোখে আলী বিন সুফিয়ানকে দেখছিলেন। আলী বিন সুফিয়ান তাঁর কোমরে জড়ানো কাপড় খুলে উমরু দরবেশের সামনে রেখে তাতে পানি ঢেলে বললেন, ‘যদি তুমি খোদার দূত হও তবে এ কাপড়ে আগুন ধরাও।’ তিনি মশাল উমরু দরবেশের সামনে এগিয়ে দিলেন। কিন্তু উমরু দরবেশ নির্বাক এবং নিশ্চল, যেন তিনি আলী বিন সুফিয়ানের কথা শুনতেই পাননি অথবা শুনলেও তাঁর কথা তিনি কিছুই বুঝেননি এমন একটি ভাব নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে।

জনতার মধ্যে শুরু হলো পরস্পরের কানাকানি ও ফিসফিসানি। আলী বিন সুফিয়ানের লোকেরা বলতে লাগলো, ‘এ ব্যাটা নিশ্চয় ভন্ডপীর! নইলে এখন আগুন ধরাচ্ছে না কেন?’ ওদিকে উমরু দরবেশের সঙ্গীরাও তৎপর হয়ে উঠলো। তারা বলতে লাগলো, ‘হুজুরের ধ্যানে বিঘ্ন ঘটিয়েছে বলে নাখোশ হয়েছেন হুজুর। হুজুরের সাথে যে লোক বেয়াদবী করেছে তাঁর বিচার না করলে হুজুরের ইশারায় এখানে গজব নেমে আসবে। ধরো, পাকড়াও করো সে বেআদবকে।’ একটা বিশৃঙ্খলা ও হট্টগোল বেঁধে গেল সেখানে। প্রত্যেকেই কোন না কোন পক্ষ অবলম্বন করলো। কেউ এ দলে তো তার সঙ্গী চলে গেল অন্য দলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জনতা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল।

দূর থেকেও শোনা যাচ্ছিল ইমাম সাহেবের আওয়াজ। তিনি উচ্চ কণ্ঠে বলছিলেন, ‘এ লোক দাগাবাজ, প্রতারক! তোমরা এ ভণ্ড দরবেশকে পাকড়াও করো, দেখবে তার সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে।’

উভয় পক্ষের মূল বাদানুবাদকারীরাই ছিল গোয়েন্দা বিভাগের লোক। ঝগড়া এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছুলো যে , তা এক যুদ্ধের রূপ নিল। জনগণ যখন এ বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত তখন আলী বিন সুফিয়ান উমরু দরবেশের সামনে গিয়ে বললেন, ‘উমরু দরবেশ!’ তিনি খুব আস্তে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঈমান বিক্রি করে কত মূল্য পাওয়া গেল?’

‘তুমি কে?’ উমরু দরবেশ জিজ্ঞেস করলেন।

‘অনেক দূর থেকে এসেছি বন্ধু!’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তোমার সুনাম ও খ্যাতি সীমান্তের ওপার থেকে শুনেছি, তাই তোমাকে দেখতে এসেছি।’

উমরু দরবেশ সাবধানে এদিক-ওদিক তাকালেন ও অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন। শেষে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘সত্যি কথা বলার আগে জানতে চাই, তোমাকে কতটুকু বিশ্বাস করতে পারি?’

‘আমার দাড়ির উপর হাত দাও।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন ‘এটা কৃত্রিম দাড়ি। ঈমানের যে মূল্য তুমি পেয়েছো, তাঁর দিগুণ মূল্য পাবে আমার কাছে। এ ভেলকিবাজী ও তামাশা বন্ধ করো। আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো।’

‘আমি  তো খুনীদের বেষ্টনীর মধ্যে বন্দি আছি।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘আমার নিজস্ব বলে কিছু নেই। খুনিদের ইশারায় আমি বাঁদর নাচ নাচছি শুধু।’

‘খুনি এখন দু’পক্ষেই। আমার কথা যদি না শোনো তাহলেও তুমি মারা যাবে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘তুমি জানো না এখানে আমার কত লোক আছে। তোমার সঙ্গে কতজন আছে?’

‘আমার জানা নেই।’ জবাব দিয়েই উমরু দরবেশ প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার নাম কি?’

‘এখন বলা যাবে না বন্ধু, সময় হলে জানতে পারবে।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘আমি যে প্রশ্ন করি তাঁর উত্তর দাও! তুরের তাজাল্লিটা কি? স্পষ্ট করে বলো, তোমার নিরাপত্তার জিম্মা আমি নিচ্ছি।’

‘যখন তুমি উঠবে তখন তোমার ডান দিকে তাকাবে।’ উমরু দরবেশ বললেন, উঁচু পাহাড়ের পাশে একটি উঁচু সমতল উপত্যকা, সেখানে একটি বিরাট গাছ আছে। সন্ধ্যার আগেই সেখানে তোমার লোক লুকিয়ে রাখবে, যেমন তুমি পানিতে আগুন লাগার রহস্য জানতে পেরেছ, তুরের তাজাল্লির খবরও জানতে পারবে। কিন্তু আমাকে এ খেল দেখানোর অভিনয় করতে দিতে হবে, নতুবা তুমি কিছুই জানতে পারবে না। তোমার দায়িত্ব সেখান থেকে যেন কোন আগুনের শিখা না উঠে। আমার নিখোঁজ হওয়া ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা তো তুমি আগেই নিয়েছ। এখন আমার ভেলকিবাজী হবে, এখান থেকে নিখোঁজ হওয়া। কিন্তু ইসহাককে সুদানের কারাগার থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব নিয়ে আমি কারাগার থেকে বের হয়ে এসেছি, তার কি হবে?’

‘সেটাও আমি দেখবো।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

‘ঠিক আছে। এখন তাহলে উঠো আর ঘোষণা করে দাও, রাতে তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখানো হবে।’

আলী বিন সুফিয়ানের পরিবর্তে যদি অন্য কেউ হতেন তবে তিনি উমরু দরবেশের এ অস্পষ্ট কথা হয়তো বুঝতেই পারতেন না। কিন্তু আলী বিন সুফিয়ান ছিলেন এ ময়দানের এক পাকা খেলোয়াড়। তিনি ইশারাতেই সব বুঝে নিতে পারতেন।

আলী বিন সুফিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, ‘তোমরা বিবাদ থামাও। খোদার এ মনোনীত ব্যক্তি বলছেন, তাঁর কাছে অলৌকিক ক্ষমতা আছে। আমি তাঁর ধ্যান নষ্ট না করলে তিনি ঠিকই ভেজা কাপড়ে আগুন ধরাতে পারতেন। তিনি ওয়াদা করেছেন, রাতে তিনি তুর পাহাড়ের তাজাল্লি দেখাবেন। আমরা দেখতে চাই আসলেই তিনি খোদার দূত কি না। তাই আমি চাই, এখন আর নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি না করে আমরা রাতের জন্য অপেক্ষা করি। যদি তিনি সত্যি তা দেখাতে পারেন আমরা তাঁর সব কথা মেনে নেবো। আর যদি না পারেন তবে বুঝতে হবে তিনি ভণ্ড, প্রতারক। তাহলে আমরা তাকে ছাড়বো না। আমার কথা তোমরা বুঝতে পারছো?’

লোকজন হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে তিনি বললেন, ‘তাহলে এখন সবাই বাড়ী ফিরে যাও। সন্ধ্যার পর আমরা তাঁর কেরামতি দেখতে আসবো।’

আলী বিন সুফিয়ান সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন। উমরু দরবেশের সঙ্গীরা এসে ঘিরে ধরলো তাঁকে। প্রশ্ন করলো, ‘লোকটির সঙ্গে আপনার কি কথা হলো?’

তিনি উচ্চ স্বরে বললেন, ‘এ লোকের মনে আমার কামেলিয়াত সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। আমি তার সন্দেহ দূর করে দিয়েছি। বলেছি, রাতে তুর পাহাড়ের নূর দেখো। যদি দেখাতে না পারি তখন আমাকে অবিশ্বাস করার অধিকার তোমার রইলো। কিন্তু দেখাতে পারলে তোমাকে আমার মুরীদ হতে হবে। লোকটি আমার কথায় সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেছে।’

‘কিন্তু এ ব্যক্তি কে?’ একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘এ লোক তো আমাদের ভেজা কাপড়ে আগুন জ্বালানোর রহস্য বের করে ফেলেছে!’

‘ও নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।’ উমরু দরবেশ হেসে বললেন, ‘আজ রাতেই আমি তাঁর সন্দেহের সমাধান করে দেবো।’

‘এ লোক রাতে এলে তাঁকে হত্যা করে ফেলতে হবে। এ রকম ধুরন্ধর লোককে বাঁচিয়ে রাখলে যে কোন সময় আমাদের ফেঁসে যাওয়ার ভয় আছে।’ বললো আরেকজন।

‘না! এখনই তাকে খুন করার দরকার নেই! অযথা খুনোখুনি আমাদের মিশনে ভণ্ডুল করে দিতে পারে।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘আগে তাঁকে বাগে আনার চেষ্টা করি। দেখা যাক রাতে তাঁকে গোমরাহ করা যায় কি না! আর যদি তাতেও কাজ না হয় তখন তাঁকে তাঁবুতে ডেকে আনতে হবে। সুযোগ বুঝে তোমরা তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top