১৫. উমরু দরবেশ

সুদানের আক্রমণের আশংকায় সীমান্তে রক্ষীদের প্রহরা আরও দৃঢ় করা হলো। সীমান্তে রক্ষীদের সংখ্যা বাড়ানো হলো। এ ছাড়াও আলী বিন সুফিয়ান তাঁর গোয়েন্দা বিভাগের অসংখ্য লোককে সীমান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলেন। এরা যাযাবর ও মুসাফিরের পোষাকে সীমান্তে ঘোরাফিরা করতো। এদের যোগাযোগ ছিল সীমান্তের ফাঁড়িগুলোর সঙ্গে। এদের জন্য সীমান্ত ফাঁড়িতে ঘোড়াও মজুদ থাকতো। সীমান্ত বাহিনীর টহলদার গ্রুপের সাথেও এদের যোগাযোগ ছিল। তাদের জন্য আরও একটা ব্যবস্থা ছিল, আলী বিন সুফিয়ানের কিছু দক্ষ গোয়েন্দা বণিকের বেশে সুদানের সাথে অবৈধ কারবার করতো। তাদেরকে মালামাল দিয়ে সীমান্ত পার করে দেয়া হতো; এরা সুদানে গিয়ে জানাতো, তারা মিশরের সীমান্ত রক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে এসেছে। সুদানে খাদ্য-শস্যের অভাব ছিল তীব্র। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর দক্ষ প্রশাসন ও কড়া তদারকির কারণে মিশরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে গিয়েছিল। ফলে বাড়তি খাদ্যশস্য স্মাগলিং করার জন্য পৃথক করে রাখা হতো। আইয়ুবীর গোয়েন্দারা সেগুলো সীমান্তের ওপারে পাচার করে অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি সংগ্রহ করতো প্রয়োজনীয় তথ্য।

সুদানের যে বণিকরা মিশরের বণিকদের সাথে এ কারবার করতো তাদেরও অধিকাংশই ছিল আইয়ুবীর গোয়েন্দা। এরা মিশরের জন্য সারা দেশ ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে আনতো। বণিকের বেশে গোয়েন্দাগিরি করার সুবিধা ছিল অনেক। খাদ্যশস্যের অভাবের কারণে এসব চোরাকারবারীদের চাহিদা ছিল সর্বত্র। প্রশাসন টের পেলেও তাদের কিছু বলতো না, কারণ দেশের খাদ্য ঘাটতির অভাব ওরাই পূরণ করছিল। সুলতান আইয়ুবীও নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, ‘চোরাপথে সুদানে আরও কম দামে শস্য চালান দাও, যেন সুদানের সবখানে গোয়েন্দারা সহজে বিচরণ করতে পারে।’

এভাবে সুদানের সর্বত্র মিশরের গোয়েন্দারা ছড়িয়ে পড়ল। ফলে সুদানের সরকার ও সৈন্যদের সব কার্যকলাপের সংবাদ নিয়মিত কায়রোতে পৌঁছে যেতে লাগল।

আলী বিন সুফিয়ান সীমান্তের কয়েক স্থানে ঘাঁটি বানিয়ে রেখেছিলেন। কোন সংবাদ ওপার থেকে এসে পৌঁছুলে সঙ্গে সঙ্গে সে খবর কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। বিদ্যুতগতি ঘোড়া সেখান থেকে ছুটে যেতো কায়রো। এ জন্য সেখানে নিয়োজিত থাকতো আলাদা অশ্বারোহী। তারা রাত দিন বিরামহীনভাবে পথ চলতো কায়রোর উদ্দেশ্যে।

সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী জানতেন, সুদানে একটি বিস্তীর্ণ পাহাড়ী অঞ্চল আছে, যেখানে শুধুমাত্র মুসলমানরাই বাস করে। সে অঞ্চলের অধিকাংশ লোক মিশরের সেনাবাহিনীর সমর্থক। যুবকরা সবাই মিশরের সেনা সদস্য। তিনি আরও জানতেন, ওখানকার মুসলমানরা সুদানের সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয় না। এর কি কারণ তা তিনি জানেন না, তবে দীর্ঘকাল ধরেই এমনটি চলে আসছে।

সুলতান আইয়ুবীর শাসনকাল শুরু হওয়ার আগের কথা। মিশরের সেনাবাহিনীতে তখনো সুদানী মুসলমান ও হাবশীরা ছিল। তাদের কমান্ডারও থাকতো সবসময় সুদানী।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সুলতান হওয়ার আগে তাদের প্রধান সেনাপতি নাজীই (পাঠকের হয়তো স্মরণ আছে, কমান্ডার নাজীর নাম। ক্রুসেড সিরিজের প্রথম বইতে তাদের প্রধান সেনাপতি নাজীর বিস্তারিত বর্ণনা আছে) মিশরের সর্বেসের্বা শাসনকর্তা ছিল। তখন মিশরের শাসন চলতো কেন্দ্রীয় খেলাফতের অধীনে। সে হিসেবে মিশরের শাসক ছিলেন আমীর। সেনাপতি নাজী তখন আমীরের মর্যাদাও ভোগ করতো। কি খলিফা, কি আমীর সবাই ছিল দারুণ স্বেচ্ছাচারী।

খৃস্টানরা মিশরকে কেন্দ্রীয় খেলাফত থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ধ্বংসাত্মক কাজ শুরু করে দিয়েছিল। নাজী তখন তাদের দোসর। সে মিশরের সুদানী সৈন্যদের পৃথক করে তাঁর অধীনে নিয়ে নিল। এ সৈন্যের সংখ্যা দাঁড়ালো প্রায় পঞ্চাশ হাজার।

সুলতান আইয়ুবী মিশরের শাসন ভার গ্রহণ করলে প্রথম সংঘর্ষ বাঁধলো নাজীর সঙ্গেই। সুলতান আইয়ুবী নাজীর বিদ্রোহ দমন করে বিদ্রোহী সেনাপতিদের বন্দী এবং সৈন্যদেরকে মিশরের অন্যান্য সৈন্যের সাথে একীভূত করে নতুন বাহিনী গঠন করেছিলেন। যারা নাজীর সহযোগী হয়েছিল তাদের ব্যপারে যখন সুলতানের এ আদেশ জারী হলো, তারা আনুগত্য পরিবর্তন করে মিশরের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাইলে তাদেরকে মিশরের বাহিনীতে ভর্তি করে নেয়া হবে, তখন সুদানের সমস্ত মুসলমান সৈন্য মিশরের বাহিনীতে ফিরে এলো। তারা এও জানতে পারলো, তাদেরকে খৃস্টানদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল।

সুলতান আইয়ুবীর বাহিনীতে যোগদান করে তারা একাধিক যুদ্ধে বিক্রমের সাথে লড়াই করে তাদের বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিল। সুলতান আইয়ুবী তাদের যুদ্ধের কৌশল ও গতি নিকট থেকে লক্ষ্য করে তাদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। পরে তাদেরকে সামরিক এবং সেই সাথে ধর্ম, ঈমান ও জাতীয় মর্যাদাবোধের ব্যাপারেও ট্রেনিং দিলেন। তিনি তাদের বুঝাতে সক্ষম হলেন, মুসলমানের শত্রু কোন ব্যক্তি মানুষ নয়, যিনিই ইসলামের দুশমন তিনিই মুসলমানের শত্রু। মানবতার সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দেয়াই মুসলমানের ধর্ম। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো মুসলমানের দায়িত্ব। মেয়েদের সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করা তাদের কর্তব্য। মানবতার বিরদ্ধে কোন অমুসলমান দাঁড়ালে সেটা যেমন অপরাধ, তেমনি অপরাধ কোন মুসলমান দাঁড়ালেও। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা ফরজ, নীতির প্রশ্নে কারো সাথে আপোসের কোন অবকাশ নেই। বংশ, গোত্র, বর্ণ নয়, মানুষকে বিচার করতে হবে আদর্শ দিয়ে। এ জন্যই সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য বাহিনী যখন আরবের বিদ্রোহী মুসলিম আমীরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ময়দানে এগিয়ে গেলো, এসব সুদানী সেনারা একবারও দ্বিধায় ভোগেনি, কেউ বলেনি, মুসলিম হয়ে মুসলমানের বিরুদ্ধে আমরা অস্ত্র ধরতে পারবো না।

কায়রোর গোয়েন্দা সংস্থার কাছে রিপোর্ট এলো, সুদান সরকার নানাভাবে পাহাড়ী এলাকার মুসলমানদের আনুগত্য আদায়ের চেষ্টা করছে। মিশরের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পরিবর্তে সুদানী বাহিনীতে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছে তাদের। কিন্তু পাহাড়ী মুসলমানরা সরকারের এ আদেশের প্রতি কর্ণপাত না করায় তারা এ ব্যাপারে উৎপীড়ন-নির্যাতনও চালাচ্ছে। পাহাড়ীদের বাধ্য করতে সামরিক অভিযানও চালিয়েছে। কিন্তু এর ফল ভালো হয়নি। পাহাড়ীদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে গেছে সুদানী বাহিনী। সুদান সেনাবাহিনীর সিনিয়র এক অফিসার গোপনে সে এলাকায় এলে আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছে। পাহাড়ী এলাকা দুর্ভেদ্য, ফলে সুদানীদের সামরিক অভিযান সেখানে সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। স্বাধীনচেতা মুসলমানদের আত্মরক্ষার জন্য অঞ্চলটি খুবই উপযোগী। পাহাড়ের ঘেরাও এবং উপত্যকার সারি সব সময় তাদেরকে শত্রুদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখে। সেখানকার মুসলমানরা স্বভাব-যোদ্ধা, তাদের সাহস ও অটুট মনোবলই তাদের নিরাপত্তার জামিন।

সুলতান আইয়ুবী আলী বিন সুফিয়ানের মাধ্যমে তাদের সব খবরই জানতে পেরেছিলেন। তিনি মিশরের গোয়েন্দা বাহিনীর যে সব সদস্য চোরাকারবারী হিসাবে দক্ষতা অর্জন করেছিল তাদের দ্বারা সেই পাহাড়ী এলাকায় ভারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করলেন। অল্প দিনের মধ্যেই সেখানকার মুসলমানদের হাতে এত অস্ত্র জমা হয়ে গেল যে, সারা বছর যুদ্ধ চালালেও তাদের অস্ত্র ঘাটতি দেখা দেবে না। তারা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিভিন্ন লোকের বাড়ী ও পাহাড়ের গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখলো। তাদের অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে সুলতান আইয়ুবীর যুক্তি ছিল, স্বাধীনচেতা এসব মুসলমানরা যেন প্রকৃত পক্ষেই স্বাধীন থাকতে পারে সে জন্য তাদের সব রকম সাহায্য করা অন্য মুসলমানদের নৈতিক দায়িত্ব।

আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দারা চোখ-কান খোলা রেখেই সে এলাকায় অবস্থান করছিল। তারা কেবল তথ্য সন্ধানী গোয়েন্দাই ছিল না, দক্ষ এবং পরীক্ষিত কমান্ডো যোদ্ধাও ছিল। সেখানকার মুসলমান নারী পুরুষ সকলেই শারীরিক ও মানসিকভাবে যুদ্ধের জন্য পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিল। এদের মধ্য থেকে এলাকার নিরাপত্তা বিধানের জন্য পাঁচ হাজার শক্ত সামর্থ যুবক যোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তোলা হলো একটি বাহিনী। আলী বিন সুফিয়ানের পাঠানো কমান্ডো অফিসাররা তাদের প্রশিক্ষণ দিল। আইয়ুবীর পাঠানো অস্ত্রগুলো হাওলা করে দেয়া হলো তাদের। সুদানী হাবশী সৈন্যদের থেকে এদের প্রকৃতি আলাদা। হাবশীরা যুদ্ধ করে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে। খৃস্টানরা তাদের যে বর্বরতার ট্রেনিং দিয়েছে তাই ওদের সম্বল। যুদ্ধের ময়দানে তাদের চাল-চলন হয় পশুর মত। দুশমন দুর্বল হলে তারা ব্যাঘ্র হয়ে যায়, আবার শত্রু সামনে অগ্রসর হলে নিজেকে বাঁচিয়ে সরে পড়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে ওরা।

সম্প্রতি এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। মিশরের কিছু মুসলমান গাদ্দার সেনাপতি অর্থ-সম্পদের লোভে সুদানে চলে এসেছিল। এসব সেনাপতিরা সুদানের সামরিক বাহিনীকে ট্রেনিং দিয়ে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে। তারপরও সুদান সরকার মিশরের ওপর প্রকাশ্যে আক্রমণ চালাতে এখনও ভয় পায়। এ জন্যই সুদান সরকার পাহাড়ী মুসলমানদেরকে সুদানী বাহিনীতে ভর্তি করার ব্যাপারে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। খৃস্টান উপদেষ্টারাও জানে, পঞ্চাশ হাজার হাবশী সৈন্যের বিরুদ্ধে পাঁচ হাজার মুসলিম সৈন্য যথেষ্ট।

সুদানের মুসলিম অধ্যুষিত পাহাড়ী অঞ্চলে একটা বিরাট কাণ্ড ঘটে গেছে। সুদানী কারাগারের এক প্রহরী সুদানের সামরিক বাহিনীর এক কমান্ডারকে হত্যা করে মুসলিম অঞ্চলে এসে আশ্রয় নিয়েছে। যথাসময়ে এ সংবাদ আলী বিন সুফিয়ানের কানেও এসে পৌঁছল। সংবাদ বাহক আলী বিন সুফিয়ানকে এ সম্পর্কে বিস্তারিত ঘটনা শোনানোর পর বললো, ‘আমি ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য সে প্রহরীর সাথেও আলাপ করেছি। তার মুখে আরো শুনেছি, সুদানের কারাগারে ইসহাক নামে এক মিশরী অফিসার প্রচুর নির্যাতনের পরও এখনো বেঁচে আছে। কারাগারে তাঁর উপর অকথ্য উৎপীড়ন চালানো হচ্ছে। সুদান সরকার তাঁর কাছ থেকে কয়েকটি শর্ত আদায় করতে চায়। শর্তগুলো হলো, তাকে স্বপক্ষ ত্যাগ করে সুদানীদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। তার নিজ এলাকা মুসলিম প্রধান পাহাড়ী অঞ্চলের মুসলমানদেরকে সুদান সরকারের প্রতি অনুগত করার জন্য তাকে চেষ্টা করতে হবে। পাহাড়ী যুবকদেরকে মিশরের পরিবর্তে সুদানী সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সুদানীরা মনে করে, সে অঞ্চলের ওপর ইসহাকের এমন প্রভাব রয়েছে, সে শুধু রাজী হলেই হয়। বিনিময়ে তাকে ওই এলাকার সরদার বানিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু বন্দী এর কোন প্রস্তাবই কবুল না করে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করায় তার ওপর চলছে অব্যাহত নির্যাতন। প্রহরীর মতে এত নির্যাতনের পর কারো বেঁচে থাকাটা এক অলৌকিক ঘটনা। কোন মানুষ এর অর্ধেক নির্যাতনও সইতে পারে না।’

‘ইসহাককে এখন কারাগার থেকে মুক্ত করা আমাদের জন্য ফরজ হয়ে গেছে।’ আলী বিন সুফিয়ান গোয়েন্দার কাছ থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পর সুলতান তকিউদ্দিনকে বললেন, ‘আপনি তো ভালো করেই জানেন, কারাগারে যুদ্ধবন্দীদের ওপর কি দুঃসহ উৎপীড়ন চালানো হয়। বন্দী করতে পারলে আমরাও তো পাথরকে দিয়ে কথা বলাই। এমনও হতে পারে, অত্যাচার সইতে না পেরে ইসহাক সুদানীদের শর্ত কবুল করতে বাধ্য হবে। আমি আরও জানতে পারলাম, আমাদের আরও দু’তিনজন কমান্ডার তাদের কারাগারে আছে। তাদের সকলের ওপরই চালানো হচ্ছে অকথ্য উৎপীড়ন। তাই আপনার কাছে আমার জোর দাবী ও পরামর্শ হচ্ছে, অবিলম্বে আমাদের কিছু কমান্ডোকে সুদানের মুসলিম এলাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। আমি আশংকা করছি, সুদানী কমান্ডার হত্যার প্রতিশোধ নিতে তারা অচিরেই আবার মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালাবে।’

‘অন্য দেশে কমান্ডো পাঠানোর আগে সে বিষয়ে আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।’ তকিউদ্দিন বললেন, ‘যত সাবধানেই পাঠানো হোক, এর গোপনীয়তা একদিন প্রকাশ হয়ে যেতে পারে। পরিণামে শেষে প্রকাশ্য যুদ্ধও বেঁধে যেতে পারে।’

‘এতসব চিন্তা করার মত সময় এখন আর আমাদের হাতে নেই।’ আলী বিন সুফিয়ান বললেন, ‘অতিসত্ত্বর আমাদের দু’টি কাজ করতে হবে। এক, সতর্ক ও দ্রুতগামী একজন কাসেদকে চিঠি দিয়ে এখনই সম্মানিত সুলতান আইয়ুবীর কাছে পাঠাতে হবে যাতে তাঁর সুচিন্তিত নির্দেশ জেনে নিতে পারি। আর দ্বিতীয় কাজ হলো, আমি নিজে গোপনে সুদান প্রবেশ করতে চাই। সেখানকার মুসলমানদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে আমার। স্বচক্ষে তাদের অবস্থা দেখলে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। আমি চাই, সেখানে যেন কোন সামরিক হস্তক্ষেপ না হয়। খৃস্টান ক্রুসেডাররা সেখানেও ছায়ার মত লেগে আছে। তারা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির যে কোন সুযোগকে কাজে লাগাবে। যুদ্ধ শুরু হলে সেই সুযোগে তারা ওখানকার মুসলমানদের আদর্শ ও বিশ্বাসের ধারা পাল্টে দিতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে স্থানীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে। মসজিদে তাদের পোষা মৌলভী পাঠিয়ে উল্টোপাল্টা ফতোয়া দিয়ে মুসলমানদের বিপথগামী করতে পারে। তারা এমন চক্রান্ত এর আগে মিশরেও করেছে। আমার ভয় হচ্ছে, সেই চক্রান্ত এবার সেখানকার মুসলমানদের ওপর চালিয়ে তাদের বিশ্বাস ও আকীদাকে কলুষিত ও বিপথগামী করার চেষ্টা করবে খৃস্টানরা। আপনি ভাল করেই জানেন, আমাদের মূর্খ সমাজ এ অবস্থায় নিজের ঈমানের হেফাজত করতে পারে না। শত্রুদের আবেগময় কথা ও জ্বালাময়ী ভাষণে তারা সহজেই বিপথগামী হয়ে যায়। শত্রুরা ভাল করেই জানে, মুসলমানদের যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করা কঠিন কিন্তু তাদের ঈমান ও আকিদা বিনষ্ট করতে পারলে, সে লোকের মুসলমান থাকা না থাকায় কিছু যায় আসে না। চেতনাহীন মুসলমানকে মেষপালের মতই যেদিকে খুশী তাড়িয়ে নেয়া যায়। আপনার অনুমতি পেলে আমি এখনই সেখানে রওনা করতে প্রস্তুত। আর আমার পরামর্শ হচ্ছে, আপনি অতিসত্ত্বর সুলতান আইয়ুবীর কাছে কাসেদ পাঠিয়ে দিন।’

‘এখানে আপনার অনুপস্থিতিতে কে আপনার দায়িত্ব পালন করবে?’ সুলতান তকিউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন।

‘কেন, গিয়াস বিলকিস করবে!’ আলী বিন সুফিয়ান উত্তর দিলেন, ‘তার সঙ্গে আমার একান্ত সহযোগী জাহেদীনও থাকবে। আমার অভাব ওরাই পূরণ করবে, আপনার কোন অসুবিধা হবে না।’

‘আপনার অভাব কি তাদের দ্বারা পূরণ হবে?’ তকিউদ্দিন বললেন, ‘আপনি শত্রু রাজ্যে যাচ্ছেন, যদি সেখান থেকে সহিসালামতে ফিরে আসতে না পারেন তবে মিশর অন্ধ ও বধির হয়ে যাবে।’

‘আমি না ফিরলেও এ দেশ ও জাতি ঠিকই থাকবে।’ আলী বিন সুফিয়ান হেসে বললেন, ‘ব্যক্তি জাতির জন্য প্রাণ দেয় বলেই জাতি বেঁচে থাকে। সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গী নেই, দেশ ও জাতি কি শেষ হয়ে গেছে? মনে করুন সুলতান আইয়ুবীও একদিন থাকবেন না, তাই বলে কি জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে? আর তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধের ময়দান থেকে ডেকে এনে কি তাঁকে ঘরে বন্দী করে রাখতে হবে? যদি তিনি তলোয়ারের সামনে বুক ফুলিয়ে না দাঁড়াতেন তবে এতদিনে ক্রুসেড বাহিনী সমস্ত দেশ করায়ত্ব করে নিতো। মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলেই তিনি নিজে বাঁচতে পেরেছেন, বাঁচাতে পেরেছেন দেশ এবং জাতিকে। মহামান্য সুলতানের সেই কথা আমার খুবই ভাল লাগে, তিনি বলেন, ‘কখনও ঘরে বসে শত্রুর আক্রমণের অপেক্ষা করবে না। শত্রুর দিকে কড়া দৃষ্টি রাখো। তারা তোমাকে আক্রমণ করতে প্রস্তুত হলে, আঘাত হানার আগেই তুমি তাদের ওপর আক্রমণ চালাও।’ আমি তাঁর এ আদেশ স্মরণ করেই সুদান যাচ্ছি। শত্রু যদি মুসলিম এলাকায় আধিপত্য কায়েম করেই বসে, তখন তাদের উৎখাত করার জন্য আমরা প্ল্যান করতে বসবো, মহামান্য আইয়ুবী কখনোই এ নীতিতে বিশ্বাসী নন।’

‘ঠিক আছে, আপনি রওনা হোন।’ তকিউদ্দিন বললেন, ‘আমি এক্ষুনি সুলতানের কাছে চিঠি লিখে কাসেদকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

আলী বিন সুফিয়ান সুদানে প্রবেশ করার প্রস্তুতি নিতে চলে গেলেন। তকিউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে কাতিবকে ডেকে পাঠালেন এবং চিঠি লিখাতে শুরু করলেন। তিনি সুদানের মুসলিম এলাকার ঘটনা বিস্তারিত লেখানোর পর এ কথাও লিখালেন, ‘এই পত্র আপনার কাছে পৌঁছার আগেই আলী বিন সুফিয়ান সুদানে পৌঁছে যাবেন।’ তকিউদ্দিন আলী বিন সুফিয়ানের পরামর্শও লিখে জানালেন এবং এ ব্যাপারে সুলতান আইয়ুবীর কি মত তা তাড়াতাড়ি জানাতে বললেন।

কাসেদকে চিঠি দিয়ে তকিউদ্দিন বললেন, ‘প্রত্যেক ফাঁড়িতে ঘোড়া পরিবর্তন করে নেবে। পথ চলবে তীব্র গতিতে। কোথাও অহেতুক সময় নষ্ট করবে না। পানাহার সারবে চলতি ঘোড়ার পিঠে। রাস্তায় শত্রুর হাতে ধরা পড়লে গোপনে নষ্ট করে ফেলবে চিঠি।’ তকিউদ্দিনের চিঠি ও নির্দেশ নিয়ে কাসেদ তখুনি রওনা হয়ে গেলো সুলতান আইয়ুবীর উদ্দেশ্যে।

উমরু দরবেশ শহর থেকে অনেক দূরে চলে এসেছেন। আশেপাশে কোন বসতি নেই। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। উমরু দরবেশ রাতে বিশ্রামের জন্য নিরাপদ একটা জায়গা খুঁজছেন। অনেক দূরে গাছের চিহ্ন দেখতে পেলেন তিনি। আশা করলেন, সেখানে নিশ্চয়ই পানির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তার এ মুহূর্তে পানির কোন প্রয়োজন নেই। নিজের এবং উটের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ পানি তার সঙ্গেই আছে। সফরে বেরুনোর সময়ই তিনি পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন। কারণ তিনি মরূদ্যান থেকে দূরে অবস্থান করতে চাচ্ছিলেন, যাতে মরু ডাকাত দলের হাত থেকে আত্মরক্ষা করা যায়। তাঁর সঙ্গে ছিল আশী। আশী পর্দানশীন মুসলিম মহিলাদের মত কালো বোরকা পরে পথ চলছিল উমরু দরবেশের সঙ্গে। আশী কেবল যুবতীই নয়, রূপে-গুণেও অনন্যা। তার কমনীয় চেহারায় কোন ডাকাতের দৃষ্টি পড়লে তাকে রক্ষা করা মুস্কিল হয়ে পড়বে। সীমাহীন বালির পাহাড়ের মাঝে এক টুকরো ছোট্ট পাথুরে পাহাড় নজরে পড়লো উমরু দরবেশের। মরূদ্যানের চাইতে এ পাহাড়ের পাদদেশই তার কাছে অধিক নিরাপদ বলে মনে হলো। তিনি সে পাহাড়ের পাশে গিয়ে উটকে থামিয়ে দিলেন। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে উট থেক নেমে এলেন নিচে। তারপর তাঁবু টানিয়ে যখন ভেতরে যাবার কথা চিন্তা করছিলেন তখন দেখলেন দূরে দু’জন অশ্বারোহী। অশ্বারোহীরা তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।

তিনি আশীকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে তাঁবুর পর্দা নামিয়ে দিলেন আর নিজে তাঁবুর বাইরে প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে রইলেন। তার জোব্বার মধ্যে শুধু খঞ্জর নয়, তলোয়ারও লুকানো আছে। খঞ্জর আছে আশীর কাছেও। তীর ধনুকও আছে তাঁবুর মধ্যে। ওগুলো বাইরে আনার কোন প্রয়োজন অনুভব করলেন না উমরু দরবেশ। অশ্বারোহীদের এগিয়ে আসতে দেখে তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, যদি তারা ডাকাতই হয় তবে তিনি একা কি তাদের মোকাবেলা করতে পারবেন? পরক্ষনেই তাঁর মনে হলো, আশী শুধু মনোরঞ্জনের মেয়েই নয়, সে যুদ্ধও করতে জানে। তীরন্দাজী ও তলোয়ার চালানোর প্রশিক্ষণ তার ভালই নেয়া আছে। এ মেয়ে গোয়েন্দা হওয়ার প্রশিক্ষণ পেয়েছে খৃস্টানদের কাছ থেকে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের আগে এদের কোন অভিযানে প্রেরণ করা হয় না।

অশ্বারোহীরা এগিয়ে আসছিল, উমরু দরবেশ সেদিকে তাকিয়ে থেকেই আশীকে বললেন, ‘তীর-ধনুক হাতে নাও। যদি এরা ডাকাতের দল হয় তবে আড়াল থেকেই তীর চালিয়ে যাবে।’

অশ্বারোহীরা তাঁবুর কাছে এসে থামলো। একজন ঘোড়ার পিঠে থেকেই বললো, ‘তুমি কে? কোথায় যাচ্ছো?’

উমরু দরবেশ আকাশের দিকে হাত ইশারা করে একটু মাথা ঝুঁকিয়ে কাঁপানো স্বরে বললেন, ‘যার বুকে আসমানের খবর আছে তার কি কোন ঠিকানা আছে?’ একটু থেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত জড়ানো স্বরে বললেন, ‘আর আমি কে তা আমি নিজেই জানি না। এক সময় আমি একটা কিছু ছিলাম; আকাশ থেকে একটা খবর এলো। আর সে খবর আমার বুকের মধ্যে শব্দ করে উঠলো। আমার বিবেক প্রকাশ করলো আমি কে; এবং কথায় যাচ্ছি! আমার বুকের মধ্যে আলো নেমে এসেছে, সেই আলোই বলতে পারে, এতে আমার ইচ্ছার কোন প্রাধান্য নেই। আমি সামনেই যাচ্ছিলাম। খুব সম্ভব কাল সকালে পিছনের দিকে যাত্রা করবো।’

দু’জনই ঘোড়া থেকে নেমে পড়লো। একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার কথায় বুঝা যাচ্ছে, আপনি একজন পীর দরবেশ। আমরা দু’জনই মুসলমান, আপনি কি কোন গায়েবী সংবাদ জানেন? আমাদের মত গোনাহগারদের সরল রাস্তা দেখাতে পারবেন?’

‘আমিও মুসলমান!’ উমরু দরবেশ ভাব-গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘তোমরা মুসলমান হলেও এখন আমি আমার চোখের সামনে কেবল তোমাদের ধ্বংসই দেখতে আচ্ছি। একদিন আমিও তোমাদের মত জিজ্ঞেস করতাম, কোনটি সোজা রাস্তা। কেউ বলতে পারলো না। রক্তাক্ত ময়দানে লাশের মধ্যে সবুজ রংয়ের জোব্বা পরা এক সাদা দাড়িওয়ালা বুজুর্গ লোককে দেখতে পেলাম; তিনি আমাকে লাশের মধ্য থেকে উঠালেন এবং সোজা সরল পথ দেখালেন। পরক্ষণেই তিনি লাশের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।’ চুপ করলেন উমরু দরবেশ। আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন আগন্তুকদের দিকে। বললেন, ‘তোমরা পাহাড়ী এলাকার বাসিন্দা হলে সে অঞ্চলে ফিরে যাও। মিশরের নাম মন থেকে মুছে ফেলো। মনে রেখো, মিশর ফেরাউনের দেশ। সেখানে যে শাসকই আসুক, তাকে মিশরের মাটি ও আবহাওয়া ফেরাউন বানিয়ে দেয়।’

‘এখন তো সেখানকার শাসক সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী।’ এক অশ্বারোহী বললো, ‘তিনি তো একজন পাক্কা মুসলমান।’

‘তার নাম তো মুসলমান ঠিকই!’ উমরু দরবেশ এমন স্বরে বললেন, যেন তিনি স্বপ্নের ঘোরে কথা বলছেন, ‘তিনিই তো তোমাদের ধ্বংস ডেকে আনছেন। বাঁচতে চাইলে তোমরা যে মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছো সে মাটির সম্মানে রক্ত প্রবাহিত করো। তোমরা সুদানের সন্তান! সুদান তোমাদের জীবন, সুদান তোমাদের স্বপ্ন। আল্লাহ্‌ সুদানে তোমাদের পয়দা করেছেন সুদানের সেবা করার জন্য। যারা জন্মভূমির হোক আদায় করে না তাদের কপালে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি থাকতে পারে!’

‘কিন্তু সুদানের শাসক তো একজন বিধর্মী, কাফের!’ এক অশ্বারোহী বললো।

‘তিনি মুসলমান হয়ে যাবেন।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘তিনি ইসলামের পথেই আছেন, কিন্তু তার সেনাবাহিনীর সবাই বিধর্মী বলে তিনি মুসলমান হিসাবে পরিচয় দিতে পারছেন না। তোমরা সবাই চলে যাও। তীর, ধনুক, তলোয়ার ও বর্শা হাতে নিয়ে উট ও ঘোরায় সওয়ার হয়ে চলে যাও ময়দানে! প্রতিরোধ করো দুশমন! তাদের বলো, আমরা এদেশের প্রহরী, সুদানের রক্ষীবাহিনী।’ তিনি উচ্চস্বরে বললেন, ‘যাও! এখান থেকে চলে যাও!’

দু’জনেই ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। কিছুদূর যাওয়ার পর একজন অপরজনকে বললো, ‘না, নেমকহারামী করবে না, ছলনাও করবে না।’

‘আমারও তাই ধারণা।’ অপরজন বললো, ‘লোকটিকে বিশ্বাসীই মনে হয়। সে তার কথা ও ট্রেনিং মোটেও ভুলে যায়নি।’

‘আশীর মত একটি সুন্দরী মেয়ে পুরস্কার পেলে আমরাও মা-বাবাকে ভুলে যেতাম, নিজের জাতির বিরুদ্ধে চলে যাওয়া তো আরো সহজ।’ অন্য আরোহী বললো।

‘যাক, আমরা ফিরে গিয়ে বলতে পারবো, সব ঠিকই আছে। আশীও আছে তার সাথে।’

‘লোকটিকে খুবই সতর্ক মনে হয়! সতর্কতার কারণেই সে মেয়েটাকে পর্দার আড়ালে আমাদের থেকে দূরে রেখেছে।’

‘হ্যাঁ, লোকটা যে পরিমাণ সতর্ক তাতে আমার মনে হয় তাদের হেফাজতের জন্য আর আমাদের পাহারার প্রয়োজন নেই।’

‘প্রয়োজন না হওয়ারই কথা।’ অপরজন বললো, ‘সে একজন সৈনিক। তার কাছে অস্ত্র আছে, তীর-ধনুক আছে, আর আশীও ট্রেনিংপ্রাপ্ত।’

এ দুই অশ্বারোহীর দু’জনই সুদানী গোয়েন্দা! উমরু দরবেশের পিছনে গোয়েন্দাগিরী করার জন্য এদের পাঠানো হয়েছে। তিনি সুদানীদের নির্দেশ অনুযায়ী ঠিক মত কাজ করছেন কি না এটা তদারক করা ওদের দায়িত্ব। উমরু দরবেশও সুন্দর অভিনয় করে তাদের দেখিয়ে দিলেন, তিনি ওদের ট্রেনিং মোটেই ভুলেননি। লোক দু’জন তার অভিনয়ে মুগ্ধ ও খুশী হয়ে ফিরে গেল।

‘এরা ডাকাত নয়।’ উমরু দরবেশ তাঁবুর মধ্যে গিয়ে আশীকে বললেন, ‘ওরা বিদায় হয়ে গেছে।’

‘এরা ডাকাতের চেয়েও ভয়াবহ!’ আশী কঠিন কণ্ঠে বললো, ‘ভাগ্য ভাল যে, তুমি ওদের কৌশলে বিদায় করতে পেরেছ।’

‘কেন, এদের মধ্যে তুমি ভয়াবহতার কি দেখলে!’

আশী বললো, ‘যারা তোমাকে এদিকে পাঠিয়েছে এরা তাদেরই গোয়েন্দা। এরা তদন্ত করে দেখতে এসেছে, তুমি এখনো তাদের অনুকূলে কাজ করছো, নাকি তাদের প্রতিকূলে কিছু করছো।’

‘তুমি ওদেরকে চেনো?’

‘আমি তো এক বৃক্ষের অন্য এক শাখা।’ আশী বললো, ‘ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন হলে আমি তো শুকিয়ে মরে যাবো।’

‘তবে তো তোমার থেকেও সাবধান থাকা দরকার!’ উমরু দরবেশের কণ্ঠে কৌতুক।

আশী হেসে বললো, ‘তা আর পারলে কই? নিজেই তো আমাকে পুরস্কার হিসাবে চেয়ে নিয়ে এলে!’

রাতে তার উভয়েই তাঁবুর ভেতর গভীর ঘুমে মগ্ন। হঠাৎ কাছেই কোথাও নেকড়ে বাঘ গর্জন করে উঠল। নেকড়ে বাঘের গর্জন শুনে তাঁবুর পাশে বেঁধে রাখা উট দাঁড়িয়ে গেল। নেকড়ের গর্জনের জবাবে উটও আশ্চর্য ধরনের গর্জন শুরু করলো। এ বিচিত্র গর্জন শুনে আশীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙ্গতেই আশী ভয়ে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে গেল। সে উমরু দরবেশকে জাগালো এবং ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, ‘নেকড়ে!’

উমরু দরবেশ বাইরের শব্দ ও গর্জন শুনে আশীকে বললেন, ‘ভয়ের কিছু নেই। এটা নেকড়ে বাঘের আওয়াজ! এরা এখন আর কাছে আসবে না, কারণ উট দাঁড়িয়ে গেছে। নেকড়ে বাঘ উটের কাছে আসে না।’

সহসা নেকড়েরা নিজেদের মধ্যেই লড়াই শুরু করে দিল। এক সাথে গর্জন করে উঠল একাধিক নেকড়ে। তাতে এমন ভয়ঙ্কর শব্দ হলো যে, আশী ভয়ে চিৎকার দিয়ে উমরু দরবেশের কলে গিয়ে লাফিয়ে পড়লো। উমরু দরবেশ বিছানায় বসেছিলেন, তিনি আশীকে এমনভাবে বাহু বন্ধনে আশ্রয় দিলেন, যেমন মা তার শিশুকে আগলে রাখে। আশীর সমস্ত শরীর ভয়ে কাঁপছিল। মুখ দিয়ে কোন কথাই বলতে পারছিল না সে। নেকড়ে বাঘ পরস্পর লড়াই করতে করতে দূরে চলে গেল। আশী উমরু দরবেশকে জরিয়ে ধরে তার কোলে তেমনি পড়ে রইলো।

উমরু দরবেশ আশীকে সান্তনা দিয়ে বললেন, ‘নেকড়ের দল চলে গেছে, এখন নিশ্চিন্তে গিয়ে শুয়ে পড়ো।’

‘না!’ আশী তার মাথা কোল থেকে বের করে কম্পিত স্বরে বললো, ‘আরও একটু এমনিভাবে থাকতে দাও।’

উমরু দরবেশ এমন অবস্থা মোটেই পছন্দ করলেন না। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, মেয়েটি কি স্বপ্নের জালে তাকে আটকাতে চাচ্ছে? তিনি আরও কঠিন এবং পাষাণ হয়ে গেলেন। মেয়েটির নরম শরীর লেপ্টে আছে তার শরীরের সাথে। ওর রেশম কোমল চুল তাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, এ মেয়ে যদি আরও কিছু সময় তার কোলে পড়ে থাকে তবে অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়। কারণ তিনিও তো মানুষ! তিনি মনকে যথাসাধ্য বাঁধতে চেষ্টা করে গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘উঠো আশী, ঘুমোতে যাও!’

আশী তার কোল থেকে মাথা উঠালো। রাতের অন্ধকারে মেয়েটির চেহারার অভিব্যক্তি দেখতে পেলেন না উমরু দরবেশ। আশী অন্ধকারে হাতড়িয়ে উমরু দরবেশের মুখ খুঁজে নিয়ে সে মুখ দুই হাতে চেপে ধরে বললো, ‘তুমি এক রাতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, তোমার মা-বাবা কে, এখন তারা কোথায়?’ তোমার অন্য সাথি, যার সাথে তোমার আগেই আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল, সেও একই প্রশ্ন করেছিল। তোমাদের এ প্রশ্ন আমাকে খুবই বিচলিত করে রেখেছিল। আমি আমার অতীত জীবনের সমস্ত স্মৃতি রোমন্থন করেও এর কোন সদুত্তর খুঁজে পাইনি। শৈশবের কথা ভাবতে গিয়ে শিশুকালের কিছু স্মৃতির আবছা আভাস ভেসে উঠলো মনের কোণে। কিন্তু সে স্মৃতি মনের মধ্যেই আবার হারিয়ে গেলো। আজ যখন তুমি আমাকে দু’টি বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে আগলে রেখেছিলে, তখন আমার মনে শিশুকালের স্মৃতি প্রভাত আলোর মতই স্পষ্ট হয়ে উঠলো। মনের কোণে জেগে উঠল বহু পুরাতন স্মৃতি। আমি তখন অতি ক্ষুদ্র এক বালিকা। আমার বাবা আমাকে এমনিভাবে দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরে বুকে চেপে রেখেছিল।’

সে নীরব হয়ে গেল এবং সেই পুরাতন স্মৃতির মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করতে লগল। উমরু দরবেশ অবাক হয়ে শুনছিল তার কাহিনী। সহসা সে শিশুর মত চঞ্চল স্বরে বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ, আমার বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। এমনই এক মরু অঞ্চল ছিল সেটা। আমার মনে নেই, তখন রাত না দিন ছিল। তবে বেশ মনে পড়ছে, আমরা এক কাফেলার সাথে কোথাও যাচ্ছিলাম। সহসা অনেক ঘোড়সওয়ার এসে কাফেলা ঘিরে ফেললো। তাদের হাতে তলোয়ার ও বর্শা। সে এক বিভীষিকাময় কাহিনী! সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। আজ যখন তোমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম এবং তুমি তোমার বাহু দিয়ে আগলে ধরলে আমায়, তখনই চট করে স্মৃতি ভেসে উঠল আমার স্মরণে। একটু একটু করে এখন সব কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে আমার। সে সময় বাবা ঠিক তোমার মতই আমাকে কোলে চেপে রেখেছিল। হ্যাঁ, ঠিক তোমার মত! আমার এখন মনে পড়ছে, এক সময় আমার বাবার বাহু শিথিল হয়ে গেল। তিনি পিছনের দিকে ঢলে পড়লেন। শেষবারের মত আমাকে জোরে চেপে ধরলেন বুকের সাথে। বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই মা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, হয়তো আমাকে উদ্ধারের শেষ চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মা বেশীক্ষণ আমাকে ধরে রাখতে পারলেন না। এক দিকে ঢলে পড়লেন তিনিও। চারদিকে তখন রক্ত, রক্ত আর রক্ত! আমার চোখে এখনও সে রক্তের ধারা ভাসছে। হঠাৎ কে যেন হাত দিয়ে আমাকে উঠিয়ে নিলো সে রক্তের সমুদ্র থেকে। একজন বলে উঠলো, ‘আরে! এ যে একদম খাঁটি হীরা! যৌবনকালে দেখবে এর রূপ ও সৌন্দর্য!’ আমি তখন যে চিৎকার দিয়েছিলাম সে কথাও মনে পড়ছে। আজ যেমন চিৎকার দিয়েছিলাম সেদিনও ঠিক এমন করেই চিৎকার দিয়েছিলাম আমি।’

উমরু দরবেশ তার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আমি সমস্ত ঘটনাই বুঝতে পেরেছি। তুমি এক মুসলিম পরিবারের কন্যা! তুমি ফিলিস্তিনের অথবা তার আশপাশের কোন এলাকার সন্তান। খৃস্টানরা তখন সুযোগ পেলেই মুসলমানদের কাফেলা লুট করতো। এখনও তাদের অধীনে যেসব মুসলিম অঞ্চল আছে সেখানে তারা নিয়মিত লুটতরাজ চালায়। তারা ধনসম্পদ, সোনাদানা আর মনিমুক্তাই শুধু লুট করে না, তোমার মত মেয়েদেরও ওরা লুট করে নিয়ে যায়। এখন আমি বুঝতে পেরেছি, কি করে তুমি এদের হাতে এসে পড়েছো।’

‘আমি যখন একা নিজেকে বুঝতে ও জানতে চেষ্টা করি তখন আমার সামনে আমার মত বহু মেয়ে শিশুকে দেখতে পাই।’ আশী বললো, ‘আমাকে খুব উন্নত খাবার ও দামী দামী পোষাক  পরতে দেয়া হতো। শেতাঙ্গ পুরুষ ও নারীরা আমাদেরকে খুব আদর ও যত্ন করতো। তার আমার মন থেকে অতীতের স্মৃতি মুছে ফেলেছে। আমি তাদের সংস্পর্শেই বড় হয়েছি। স্থানটি ছিল জেরুজালেম শহর। শিশুকাল সেখানেই কেটেছে আমার। বেহায়াপনা ও নির্লজ্জের যাবতীয় শিক্ষা সেখানেই আমি পেয়েছি। ওরাই আমাকে শিখিয়েছে মদ পান করতে, শিখিয়েছে আরবী ও সুদানী ভাষা।

আমি যখন যুবতী হলাম, আমাকে সেই কাজে নিয়োগ করা হলো, যে কাজে তুমি আমাকে দেখতে পেয়েছো। বিপদ থেকে বাঁচার জন্য আমাদেরকে দেয়া হয়েছে তলোয়ার ও তীরন্দাজীর ট্রেনিং। আজ হঠাৎ ভীত ও আতংকিত অবস্থায় তোমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তেই মনে পড়ে গেল বাবার কথা। আমাকে নিয়ে বাবার আবেগ যেমন পবিত্র, তেমনি তোমার আবেগও পবিত্র। এ জন্যই আমি বলেছিলাম, আমাকে তোমার কোলে আরও কিছুক্ষন থাকতে দাও। বাবার কোলের আদর ও স্নেহের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল আমার। আমি আবার সে আদরের জন্য কাঙাল হয়ে গেলাম। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো তোমার কন্যা হয়ে থাকবো। এখন আমি খৃস্টান ও সুদানীর কবল থেকে মুক্ত। এখন আমি আর কারো নিয়োগ করা গোয়েন্দা নই, আমি শুধু তোমার হারিয়ে যাওয়া কন্যা। তোমার খেদমতে আমি কাটিয়ে দেবো সারাটা জীবন। যে  মেয়ে এতদিন পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত ছিল তার জীবন হয়ে উঠবে পবিত্র ও সৎ। যেমন জীবন হয় এক সাচ্চা মুসলমানের। কারণ আমি তো মুসলমানেরই কন্যা। তুমিই আমাকে চিনিয়ে দিয়েছো আমি কে? ছি! ছি! মুসলমান পিতার কন্যা হয়ে এতদিন আমি মুসলমানের বিরুদ্ধেই কাজ করেছি! শোন, আজ থেকে আমার নবজন্ম হলো। এখন আর আমাকে সে কাজ করতে দেবো না, যে কাজে তুমি বের হয়েছো। আমার হৃদয়ে ঈমানের যে এলো তুমি জ্বালিয়ে দিয়েছো সে আলোর কসম, তোমাকে আমি কিছুতেই সুদানী বা খৃস্টানদের পক্ষে কাজ করতে দেবো না।’ আশীর চেহারায়, চোখে-মুখে এবং প্রতিটি উচ্চারণে নতুন আলোর আবেগ টলমল করছিল।

‘কিন্তু কিছুদিন আমাকে এ কাজ করতেই হবে।’ উমরু দরবেশ বললেন, ‘তবে যখন সময় আসবে তখন তুমি আমাকে সেই কাজে দেখতে পাবে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি বন্দীশালা থেকে বের হয়ে এসেছি। সে উদ্দেশ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি আমি।’

‘কি সেই উদ্দেশ্য?’

‘সময় হোক, সবই জানতে পারবে।’

‘ঠিক আছে, আমিও কথা দিচ্ছি, সর্বাবস্থায় আমি তোমাকে সাহায্য করে যাবো।’ পাশাপাশি আবার দুই আলাদা বিছানায় শুয়ে পড়লো দু’জন। দু’জনই চুপচাপ, কিন্তু কারো চোখেই ঘুমের কোন চিহ্নও নেই। এক বিদঘুটে চিন্তা এসে পাকড়াও করলো উমরু দরবেশকে। তিনি ভাবতে লাগলেন, এ অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে পাহাড়ী অঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার পর আমি তার কি পরিচয় দেবো? কি করবো তাকে নিয়ে? মেয়েটি এক অনাথ ও এতীম মুসলমান। এ অবস্থায় তাকে খৃস্টান বা সুদানীদের হাতে আর তুলে দেয়া যায় না। তাদের হাতিয়ার বানানোর কবল থেকে মুক্ত করতে হবে আশীকে। শুয়ে শুয়ে উমরু দরবেশ আশীকে মুক্ত করার নানা রকম পরিকল্পনা আঁটতে লাগলেন। আশীর চিন্তা তার সমগ্র সত্ত্বাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। তার মনে পড়ে গেলো, এ মেয়ে শৈশব থেকে বড় হয়েছে খৃস্টানদের কাছে। তারা তাকে যেভাবে গড়ে তুলেছে সে শিক্ষা ও সংস্কার সহজে পরিবর্তন সম্ভব নয়। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গেল মেয়েটির আবেগদীপ্ত কথা। তিনি ভেবে দেখলেন, মেয়েটির অন্তরে সত্যের যে উপলব্ধি এসেছে তাতে আশা করা যায়, সে খুব দ্রুত নতুন সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেবে। কারণ সে বুঝতে পেরেছে তার পরিচয়। মুসলমান হিসাবে নতুন আবেগ ও উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করবে সে। তার মনে এরই মধ্যে খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে তার কথা থেকেই তা বুঝা যায়। আবার অন্য চিন্তা এসে ভর করলো উমরু দরবেশের মনে। তার মনে হলো, এটা তো মেয়েটির ছলনা নয়! এ মেয়েকে কতটুকু বিশ্বাস করা যায়! আশীকে নিয়ে এমনি সব গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন উমরু দরবেশ।

রাত ভোর হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে উমরু দরবেশ গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়েটির দিকে। আশী বললো, ‘কি দেখছেন অমন করে?’

‘ভাবছি তোমাকে কতটুকু বিশ্বাস করা যায়। গোয়েন্দা মেয়েদের ছলনার তো অভাব নেই। এখনো তুমি আমাকে শত্রু মনে করছো না, তার নিশ্চয়তা কি?’

আশীর চোখ ছলছল করে উঠলো। কিভাবে সে বিশ্বাস করাবে, সে যা বলেছে তাই তার মনের কথা? এর মধ্যে কোন চাতুর্য বা ছলনার চিহ্নও নেই? সে উমরু দরবেশের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করলো। তার চেহারায় বেদনার ছায়া। উমরু দরবেশই আবার মুখ খোললেন। বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি, আমার কথায় তুমি কষ্ট পেয়েছো। কিন্তু তুমি জানো না আশী, তোমাদের মত মেয়েদের ছলনার জালে আটকা পড়ে কত মুসলমান ধ্বংস হয়েছে। মুসলিম জাতির অধঃপতন ও ধ্বংসের পিছনে তোমাদের মত মেয়েদের কী ভয়ংকর ভূমিকা তা জানি বলেই ওকথা আমি বলেছি।’ উমরু দরবেশ কিছুক্ষণ চুপ করে আবার বললেন, ‘তুমি কেবল যুবতীই নও, অসম্ভব সুন্দরী এবং রূপসীও! তোমার একটু হাসি, একটু চাহনী, মুখের একটু মিষ্টি কথাই একজন পুরুষ মানুষকে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট। তার ওপর মানুষকে আকর্ষণ করার জন্য তোমাদের দেয়া হয়েছে বিস্তর প্রশিক্ষণ। যে কোন মানুষকে প্রলুব্ধ করে তার মনে পশুপ্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলার ক্ষমতা তোমার আছে। আমি কোন অক্ষম পুরুষ নই! কয়েক বছর যুদ্ধের ময়দানে এবং তারপর সুদানের কারাগারে বন্দী থাকার ফলে সুদীর্ঘ সময় বাড়ীর স্নেহ-ভালবাসার পরিবেশ থেকে আমি বঞ্চিত। একই তাঁবুর মধ্যে পাশাপাশি শুয়ে রাত কাটিয়েছি আমরা। তুমি আমার এত কাছে ছিলে, হাত বাড়ালেই তোমার নাগাল পেতাম। কিন্তু আল্লাহর শোকর, তিনি আমাকে রক্ষা করেছেন। আমি সারা রাত আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করেছি, আল্লাহ্‌ যেন আমাকে হেফাজত করার ক্ষমতা দেন। আল্লাহর অসীম দয়া, তিনি এ বান্দার দোয়া কবুল করেছেন এবং আমাকে পবিত্র থাকতে সাহায্য করেছেন। রাতে তোমার কথা শোনার পর থেকে আমি সীমাহীন পেরেশানী ও দুশ্চিন্তায় আছি। আমি ভেবে পাচ্ছি না, আমি তোমাকে শত্রু ভাববো, না আপনজন মনে করবো। এখনও আমি সে কথাই চিন্তা করছি। আমি কিছুতেই এ দুশ্চিন্তার সমাধান করতে পারছি না। এ অবস্থায় তোমাকে শত্রু মনে করাই ভাল। তাতে তুমি শত্রু হলে আমার আফসোস থাকবে না। আর যদি তুমি বন্ধু হও তবে তা তোমাকেই প্রমাণ করতে হবে। তুমি কি প্রমাণ করতে পারবে, তুমি সম্পূর্ণ বিশ্বাসী ও বন্ধু!’

‘আমি তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমার মনে তুমিই বিশ্বাস ও ঈমানের আলো জ্বালিয়েছো।’ আশী বললো, ‘সেই আলোর কসম ছাড়া আর কোন প্রমাণ পেশ করার ক্ষমতা এ মুহূর্তে আমার নেই। তবে তোমাকে এটুকু কথা দিতে পারি, তুমি যদি সুদানীদের সঙ্গ ত্যাগ করতে চাও, তবে আমাকে তোমার বিশ্বস্ত সহযোগী হিসাবে পাবে। নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যদি তাদের ধোঁকা দিতে চাও, আমার পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে তোমার সঙ্গে। এতে আমার জীবন চলে গেলেও আমি পিছু হটবো না। কাল যে দুই মুসাফির তোমার কাছে এসেছিল, তারা যে সুদানীদের গোয়েন্দা আমিই তো তা তোমাকে বলেছিলাম।’

‘আমাকে একটু চিন্তা করতে দাও আশী!’ উমরু দরবেশ বললেন ‘তোমার এ সাবধান বাণী থেকে আমি জানতে পারলাম, সুদানীরা আমার চারপাশে গোয়েন্দার বহর লাগিয়ে রেখেছে। তোমাকে তো ওরা এ জন্যই আমার সাথে পাঠিয়েছে, যাতে আমার প্রতিটি তৎপরতা তুমি কাছ থেকে দেখতে পারো। ফলে আমি তোমাকেও তাদেরই একজন মনে করছি। যদি আমার কথা ও আচরণে তোমার মানসিক পরিবর্তন ঘটেই থাকে, আপাতত তা ভুলে যাও। তুমি বরং সে কাজই করো যেমনটি তোমাকে বলা হয়েছে। আমিও ঠিক সে মতই কাজই করতে থাকবো, যেমন আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমি তো তোমাকে বলেছি, আমি বিশেষ উদ্দেশ্য লাভের আশায় বের হয়েছি, কিন্তু আমি তাদের মিশনকেও ত্যাগ করতে পারছি না। আমি জানি তাদের মিশন ত্যাগ করলে আমার কি ভয়ংকর পরিণাম হবে। একাধিক তীরের নিশানা আমার দিকে তাক করা আছে, কিন্তু আমি তা দেখতে পাচ্ছি না। যখন তীর আমার বুকে এসে বিঁধবে তখন আমি দেখতে পাবো।’

‘আমি সর্বাবস্থায় তোমার সঙ্গে থাকবো।’ আশী বললো, ‘সময় এলে আমি প্রমাণ করে দেখাবো, আমার ঈমান খাঁটি, আমিও এক সাচ্চা মুসলমান। আগে না জানলেও এখন আমি জানি, আমার শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে মুসলিম পিতার রক্ত।’

উমরু দরবেশ তাঁবু গুটিয়ে সুদানের মুসলিম পাহাড়ী এলাকায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। প্রস্তুতি শেষ হলে আশী এবং উমরু দরবেশ দু’জনেই উটের পিঠে চড়ে বসলেন।

এগিয়ে চললো তিনটি উটের ক্ষুদ্র কাফেলা। উটের ওপর আরোহণ করে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। চারদিকে অথৈ বালির সমুদ্র। সামনে বালি, পেছনে বালি। দু’পাশে বালির ছোট ছোট ঢেউ।

সুদানের মুসলিম এলাকা এখনো অনেক দূরে। দুই উটে ওরা দু’জন, তৃতীয় উটের উপর তাদের মালামাল ও তাঁবু। আশীর অর্ধ উলঙ্গ দেহ এখন কালো কাপড়ে ঢাকা। তাকে দেখে কেউ বলতে পারবে না, এ মেয়ে বারবণিতা, যাকে খৃস্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য দীর্ঘ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করেছে।

ওদের সাথে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে দূর দিয়ে সমান্তরাল গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এক ঘোর সওয়ার। বার বার ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে ওদের গমন পথের দিকে। উমরু দরবেশ কয়েকবারই সে অশ্বারোহীকে দেখলেন। ভাবলেন, সুদানীদের কোন চর হবে এ আরোহী। সুদানীরা যে তার পিছনে ছায়ার মত লেগে আছে, সে তো তার জানাই আছে। কিন্তু তার মনে হঠাৎ অন্য খেয়াল জাগতেই ভয় ও আতঙ্কে তার বুক শুকিয়ে গেল। গোয়েন্দারা হলে তার তো একা থাকার কথা নয়! অন্তত তার একজন সঙ্গী তো থাকতোই! তাহলে কি এ লোক কোন মরু ডাকাত? মরু ডাকাতরা কি পরিমান ভয়ংকর হয় তা তো আর অজানা নেই উমরু দরবেশের। পলকে তিনি পেরেশান হয়ে আবারও তাকালেন সে আরোহীর দিকে। নির্বিকার ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে সে আরোহী। সে সে ওদের অনুসরণ করছে তা তার চলার ভঙ্গিতে এখন স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।

‘আশী!’ তিনি আশীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘তুমি কি ওই অশ্বারোহীকে লক্ষ্য করেছো? অনেকক্ষণ ধরে এ আরোহী আমাদের অনুসরণ করে চলেছে।’

‘হ্যাঁ, আমিও অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছি।’

‘এ লোক কি সুদানের গোয়েন্দা? নাকি কোন মরু ডাকাত?’

‘কি জানি! গোয়েন্দা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। ওরা সাধারণত এভাবে একাকী পথ চলে না।’

‘আশী! মরু ডাকাত হলে তো খুব ভয়ের কথা! আমরা মাত্র দু’জন। মরুভূমির দুর্ধর্ষ ও সুসংগঠিত ডাকাত দলের বিরুদ্ধে আমরা দু’জন কি মোকাবেলা করতে পারবো!’ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তার কন্ঠে।

‘এত ঘাবড়াচ্ছ কেন? তুমি সৈনিক, আমিও অস্ত্র চালাতে জানি। আমরা নিরস্ত্রও নই।’ আশীর সাহসী কণ্ঠ, ‘রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় আক্রান্ত হলে হয়তো সাবধান হওয়ার সুযোগ থাকতো না। কিন্তু এখন দিন। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করে যেতে পারবো। আমাকে নিয়েই যদি তোমার ভয়, তাহলে শুনে রাখো, তোমার পাশে থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি লড়ে যেতে পারবো। আমাকে জীবিত ধরে নিয়ে যাওয়ার সাধ্য কারো হবে না।’

ভয় এবং আশঙ্কা নিয়েই তারা মরুভূমির সে ভয়ংকর পথ অতিক্রম করে চলতে লাগলো। মাথার ওপর কড়া রোদ। এক সময় সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পড়লো। এগিয়েই চললো ওরা। তাদের অনুসরণ করে তখনো সে আরোহী সেভাবেই পথ চলছে। দূরে আবছা করে ভেসে উঠল কাঙ্খিত পাহাড়ী এলাকা। আরেকটু এগুতেই আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে লাগলো পাহাড়ের চূড়া।

সুউচ্চ পাহাড় চূড়া তখনও বহু দূরে। কিন্তু মুসলিম অধ্যুষিত পাহাড় চূড়া চোখে পড়তেই উমরু দরবেশের মনোবল ও শক্তি বেড়ে গেল। তার মনে হলো, গন্তব্য আর বেশী দূরে নয়। আশীকে বললো, ‘আমরা এসে পড়েছি আশী! ওই পাহাড় চূড়াই আমাদের গন্তব্যস্থল।’

উট চলতে লাগলো, তারা গন্তব্য স্থানের কাছাকাছি চলে এলো। এখানেই সুদানীদের নির্দেশ মোতাবেক মিশনের কাজ শুরু করতে হবে তাদের। উমরু দরবেশ এ এলাকারই বাসিন্দা। উটের ওপর বসে থেকেই তিনি যেন জন্মভূমির মাটির ঘ্রাণ পাচ্ছেন। পুলকিত উমরু দরবেশের চেতনা যখন জন্মভূমির মাটির স্পর্শ পাবার জন্য লালায়িত তখনই তিনি লক্ষ্য করলেন, সে অশ্বারোহী দূরত্ব কমিয়ে সোজা ছুটে আসছে তাদের দিকে। উমরু দরবেশের উৎফুল্ল চেহারায় চিন্তার ভাঁজ পড়লো। তিনি চলার গতি কমিয়ে দিয়ে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন অশ্বারোহীর দিকে। একটু পরই তাদের কাছে এসে পৌছুলো অশ্বারোহী।

‘তোমাদের ক্যাম্প ও অবস্থান হবে সামনের ওই পাহাড়ী অঞ্চলে।’ অশ্বারোহী উমরু দরবেশের কাছে এসে বলল, ‘তুমি আমাকে চেন না, কিন্তু আমি তোমাকে চিনি। তুমি যাতে নির্বিঘ্নে তোমার মিশনের কাজ চালিয়ে যেতে পারো সে জন্য আমরা আশেপাশেই থাকবো। তুমি এখানে একা ও নিঃসঙ্গ নও। তোমার যে কোন বিপদে সাহায্য করার মত লোক সব সময়ই তোমার কাছাকাছি থাকবে। আশা করি তুমি তোমার মিশনের গুরুত্ব ও কথা ভুলে যাওনি!’

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top