১৪. তুমুল লড়াই

সেখানেও পড়ে ছিল অসংখ্য লাশ। বিশ্রী দুর্গন্ধে বাতাস গুমোট। সুদানী সেনাপতি নাকে রুমাল চেপে আগে আগে যাচ্ছিল। এক জায়গায় ছয় সাতজন মিশরী কয়েদীকে উল্টো করে বেঁধে লটকে রাখা হয়েছিল। তাদের বাহুর সাথে বাঁধা ছিল ভারী পাথর। আরেকটু এগুতেই দেখতে পেল, একজন মিশরীকে ক্রশ বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। তার হাতের পাঞ্জা পেরেক দিয়ে গেঁথে রেখেছে দেয়ালের সাথে। তখনো রক্ত ঝরছে সে হাত থেকে!

আর এক জায়গায় টেবিলের ওপর এক কয়েদীকে দেখতে পেলো। কয়েদীকে পিঠমোড়া করে বাঁধা হয়েছে টেবিলের সাথে। পাঁয়ের সাথে শিকল বাঁধা। টেবিলের সাথে লাগানো বিশাল চাকা। চাকা যখন ঘুরাতো তখন সে লোকের হাত ও পায়ে এমন টান পড়তো যে, তা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হতো। মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করতো কয়েদী।

ইসহাককে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেকানো হলো জেলখানা। কোথায় কেমন শাস্তি দেয়া হচ্ছে সব দেখলো ইসহাক। স্থানে স্থানে রক্ত জমা হয়ে আছে। কোথাও কয়েদীরা বমি করছে। কোথাও বেহুশ হয়ে পড়ে আছে কেউ। মাস্তির বিচিত্র রূপ দেখিয়ে সুদানী সেনাপতি বললো, ‘আপনার কোন শাস্তি প্রয়োজন তা বলে দেবেন, আমি সেখানেই নিয়ে যাব আপনাকে। আর যদি আপনি এ শাস্তি ছাড়াই আমার কথা মেনে নেন, তবে তাতে আপনারই মঙ্গল হবে’।

‘যেখানে খুশী সেখানে যাও, জাতির সাথে বেঈমানী ও গাদ্দারী করতে পারবো না আমি’। ইসহাক দৃঢ়তার সাথে বললো।

‘আমি তোমাকে আবরও বলছি, আমরা তোমাকে দিয়ে যা করাতে চাই, তার বিনিময়ে তোমাকে আমরা মুক্তই করবো না, পাহাড়ী এলাকার সুলতানও বানিয়ে দেবো। কিন্তু তুমি আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছো। এখন শুদু এই শর্ত দিতে পারি, যদি মেনে নাও তবে তোমাকে কোন শাস্তি দেয়া হবে না। তোমাকে সুদানী বাহিনীর কোন ভাল পদে নিয়ে নেয়া হবে’।

‘আমি তোমাদের কোন পদ চাই না, আমাকে যা খুশী শাস্তি দাও’। ইসহাক বললো।

তার পায়ে শিকল বেঁধে ছাদের সাথে সে শিকল আটকে দেয়া হলো। উল্টো হয়ে শূন্যে ঝুলে রইল ইসহাক। সেনাপতি প্রহরীকে বললো, ‘সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবেই রাখবে। সন্ধ্যার পর উপরের ওই লাশের কামরায় ফেলে রেখে আসবে। আশা করা যায়, এতেই তার মাথা ঠিক হয়ে যাবে’।

কতক্ষণ তার জ্ঞান ছিল বলতে পারে না সে। সন্ধ্যার সময় অজ্ঞান অবস্থায় তাকে ওপরের কামরায় রেখে আসা হলো। যখন তার জ্ঞান ফিরলো, দেখলো সে লাশের পাশে পড়ে আছে। এক কোণায় সামান্য পানি ও কিচু খাবার রাখা। সে খাবার খেলো এব পানি পান করলো। তারপর লাশের দিকে ফিরে বললো, ‘আমি তোমর সাথে গাদ্দারী করবো না বন্ধু! আমি শীঘ্রই তোমার কাছে আসছি’। কথা বলতে বলতে এক সময়ে ঘুমিয়ে গেল সে।

মাঝ রাতে তাকে আবার জাগানো হলো এবং তাকে নিয়ে গিয়ে চাকার সাথে বেঁধে দেয়া হলো। সুদানী সেনাপতি দাঁড়িয়েছিল টেবিলের পাশে। বললো, ‘হাজার হাজার মুসলমান আমাদের সাথে আছে। হয়ত তুমি পাগল হয়ে গেছ, নইলে এমন মোহনীয় প্রস্তাব পায়ে ঠেলতে না। তুমি ভাবছো, তুমি ইসলামের জন্য জীবন কোরবানী দিচ্ছো। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী তার বাদশাহী কায়েম করতে তোমাদের মত পাগলদের হত্যা করাচ্ছে। আর সে হতভাগা নিজে মদ ও মেয়ে নিয়ে পড়ে আছে। হুর গেলমান দিয়ে ভরা তার হেরেম। আর তোমরা এমনই হতভাগা, তার জন্য জীবন দিয়ে ভাবছো ইসলামের মহা খেদমত করে চলেছো’।

‘ওরে পাপিষ্ঠ সেনাপতি!’ ইসহাক বললো, ‘আমি তোমাকে আমাদের আমীর ও সুলতানের বিরুদ্ধে মিথ্যা দোষারোপ করতে বাঁধা দিতে পারছি না। কিন্তু তুমিও আমাকে তার আনুগত্য ও আমার ঈমানের পথে অটল থকাতে বাঁধা দিতে পারবে না। আমর গোত্রের কোন মুসলমানও তোমাদের সেনা দলে ভর্তি হবে না’।

‘তুমি হয়তো জান না, আরবে মুসলমানরা-মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছো। রক্ত প্রবাহিত করছে একে অন্যের’। সুদানী সেনাপতি বললো, ‘আর খৃষ্টানরা ফিলিস্তিনে বসে তামাশা দেখছো। সমস্ত আমীর ও মুসলিম শাসকরা সম্মিলিতভাবে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে’।

‘তারা হয়তো দুনিয়ার মোহে তোমাদের মত ফেরেববাজদের পাল্লায় পড়ে গেছে, আমি তা করবো না’। ইসহাক আরো বললো, ‘যারা বিদ্রোহ করেছে তারা এ দুনিয়াতেই শাস্তি বোগ করবে। পরকালে তো অসীম শাস্তি রয়েই গেছে। তুমি অযতা আমার পেছনে সময় নষ্ট করছো। আমাকে যে শাস্তি দেয়ার দাও, যা খুশী ব্যবহার করো, কিন্তু তোমাদের আশা আমাকে দিয়ে পূরণ হবে না’।

‘দেখো, কোনো গোয়ার্তুমী করছো? তোমর একটু ইশারা পেলে তোমার গোত্রের সব মুসলমান আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে’। সেনাপতি বললো, ‘আর আমার তো এ কাজ বিনা মূল্যে করাতে চাই না। আমরা তোমার ভাগ্য পরিবর্তন করে দেবো’।

‘আমার ভাগ্য পরিবর্তন করার কোন সাধ্য তোমাদের নেই। মিথ্যা বাহাদুরী ছাড়ো। আমি শেষ বারের মত বলে দিচ্ছি, আমি আমার জাতি ও ধর্মের সাথে গাদ্দারী করবো না’। ইসহাক বললো।

তাকে চাকার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল। হাত চাকার সাথে বাঁধা। চারজন হাবশী দাঁড়িয়ে ছিল চাকা বাঁধা লম্বা খুঁটির পাশে। সুদানী সেনাপতি সেদিকে তাকিয়ে তাদেরকে চাকা ঘুরানো জন্য ইমারা করলো। হাবশীর এক পাক ঘুরিয়ে দিল চাকা। চাকা ঘুরানো ক্যাঁচক্যাচ আওয়াজের সাথে বাড়তে লাগল শরীরের ওপর টান। ইসহাকের মনে হলো, কাঁধ থেকে বাহু বসে যাচ্ছে। তার শরীর দিয়ে ঘাম বেরোচ্ছিল শরীর থেকে মনে হচ্ছিল কেউতার গায়ে পানি ঢেলে দিয়েছে।

‘এখনও চিন্তা করো কি করবে? তার কানে সুদানী সেনাপতির শব্দ ভেসে গেল।

‘না কিছুতেই ঈমান বিক্রি করবো না?’ইসহাক অতি কষ্টে উচ্চারণ করলো।

‘একে কিছুক্ষণ  এভাবেই থাকতে ও মানবে না, ওর বাপ মানবে। বেয়াড়া ঘোড়া কি করে বাগ আনকে হয়, আমি জানি’। সেনাপতি বললো।

ইসহাক চোখ বন্ধ করে বিতবিড় করে কোরআন তেলাওয়াত করতে শুরু করলো। সেনাপতি চলে গেল।

ইসহাকের শরীরের সমস্ত জোড়া যেন খুলে যাচ্ছিল। ছিঁড়ে যাচ্ছিল চামড়া।

তার মুখ উপরের দিকে। চোখ খুললো ইসহাক। তার মনে হলো, সে আল্লাহর দরবারে পৌঁছে গেছে। সে বলতে লাগলো, ‘হে ইহ ও পরকালের প্রভু! আমি তোমার অপরাধী এক বান্দা। আমাকে পাপমুক্ত করার জন্য আমাকে আরোবেশী করে শাস্তি দাও। তোমারই মেহেরবানীতে আমি এখনও তোমার সঠিক পথে টিকে আছি। তুমি যেভাবে ইচ্ছা আমাকে শাস্তি দাও, কিন্তু তোমার পথে টিকে থাকার নেয়অমত থেকে আমাকে বঞ্চিত করো না’। ইসহাক আবার চোখ বন্ধ করে কোরআন তেলাওয়াত করতে লাগলো।

‘তুমি চিৎকার করছো না কেন?’ ইসহাকের পাশে দাঁড়ানো প্রহরী বললো, ‘খুব জোরে জোরে চিৎকার করো, তাকে কষ্ট ও বেদনা কিছুটা লাঘব হয়’।

‘কই, আমি তো এখন আর কোন কষ্ট পাচ্ছি না’। ইসহাজ বললো, ‘তোমরা যত খুশী নির্যাতন চালাও, আমার আর কষ্ট হবে না। আমার প্রভু আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছেন। তিনি তো আগুনের কুণ্ডলীকেও ফুলের বাগানে পরিণত করতে পারেন। কষ্টকে সুখে পরিণত করে দেয়ার ক্ষমতাও তিনি রাখেন। তাইতো মুমীন কোন নির্যাতনকেই ভয় পায় না। তোমাদের প্রতিটি নির্যাতনে আমি এখন তৃপ্তিকর সুখ পাবো। তোমরা যত খুশী অত্যাচার করবে তত দ্রুত আমি আমার মালিকের দিকে এগিয়ে যাবো’।

কয়েদখানার জল্লাদরা পশুর মতই হিংস্র হয়। এক জল্লাদ হাবশী প্রহরীদের বললো, আরও চাকা ঘোরাও’।

হাবশীরা আরো একটু চাকা ঘুরালো। ইসহাকের দেহ থেকে বাহু আলাদা হওয়ার শব্দ হলো মট করে। দরজায় দাঁড়ানো সিপাহী দৌড়ে এসে বললো, ‘কি করছো তোমরা! এ তো মারা যাবে! জলদি চাকা নিচু করো’। একে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জলদি চাকা নামাও’।

‘এ লোক বলছে তার কোন কষ্ট হচ্ছে না’। জল্লাদ বললো।

‘তার কি কোন জ্ঞান আছে?’ তোমরা যে পরিমাণ চাকা ঘুরিয়েছো তাতে মানুষ মারা যায়। এ লোক তো বেহুশে কথ বলছে’।

‘আমি স্বজ্ঞাসেই আছি বন্ধু!’ ইসহাক দুর্বল স্বরে বললো, ‘আমি আমার আল্লাহর সাথে কথা বলছি’।

দুই সিপাহী একে অন্যের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকালো। একজন বললো, ‘দেখো তো একে তেমন শক্তিশালী মনে হয় না। এ অবস্থায় মহিষের মত হাবশীও বেহুশ হয়ে প্রাণ ত্যাগ করে। এ কোন বড় দরবেশ হবে। নিশ্চয়ই তার কাছে আল্লাহর গায়েবী শক্তি আছে’।

‘হ্যাঁ! তুমি ঠিকই বললো’। ইসহাক বললো, ‘আমার কাছে আল্লাহর শক্তি আছে। আমি আল্লাহর কালাম পড়ছি। এ কালামের জোর চাকার চাইতে অনেক বেশী। তোমরা চাকা আরও জোরে ঘুরিয়ে দেখো, আমার দেহ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে, তবুও তোমরা এই একই সুর শুনতে পাবে’।

এ সৈনিক ও প্রহরীরা ছিল নিরক্ষর ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। ব্যক্তি পূজা ও শক্তি পূজায় মত্ত থাকতো ওরা। ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতো না। পীর-ফকির ও দরবেশদেরকে তারা খোদার মতই শক্তিমান মনে করতো।

তারা ভাল মতই জানতো, এ চাকার বাঁধা মানুষ চাকার সামান্য নড়াচড়াতেই চিৎকার দিয়ে বাড়ী মাথায় করে তোলে। তখন তাদের যা বলা হয় তাই মেনে নেয়। চাপ সামান্য বেশী হলেই বেহুশ হয়ে পড়ে। কেউ কেউ মারাও যায়। কিন্তু এ ব্যক্তি প্রচণ্ড চাপ সহ্য করেও বেঁচে আছে! স্বজ্ঞানে আছে! সিপাইরা বুঝতে পারলো, এ ব্যক্তি কোন সাধারণ লোক নয়। নিশ্চয়ই সে অলৌকিক শক্তির অধিকারী।

‘তুমি আকাশের খবর জানো?’ এক সিপাই প্রশ্ন বললো।

‘হ্যাঁ, আমার খোদা জানেন’। ইসহাক উত্তর দিল।

‘তোমার খোনা কোথায়?’

‘আমার মনের মধ্যে!’ ইসহাক উত্তর দিল।

‘আমরা গরীব মানুষ!’ এক সিপাই বললো, ‘এখানে তোমার মত লোকদের হাড্ডি গুঁড়ো করে বালবাচ্চাদের জীবন বাঁচাই। তুমি কি আমাদের ভাগ্য পরিবর্তণ করতে পারো?’

‘হ্যাঁ, এখান থেকে বের হতে পারলে পারি!’ ইসহাক বললো, ‘আমি যা পড়ছিলাম, তোমাদেরকে তা বুঝিয়ে দেব। তোমাদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যাবে’।

‘আমরা চাকা নিচু করছি’। এক সিপাই বললো, ‘সেনাপতিকে আসতে দেখলে চাকা উপরে তুলে দেবো’।

‘না! ইসহাক বললো, ‘তোমাদের এমন ছলচাতুরী আমার পছন্দ নয়। এ ধরনের প্রতারণা আমার ঈমান বিরোধী!’

‘কিন্তু আমরা যে তোমাকে সাহায্য করতে চাই’। এক সিপাই বললো, ‘আপনি যখন যা বলবেন, আমরা তাই করবো। যদি সম্ভব হয় তবে আপনাকে কয়েদখানা থেকে মুক্ত করে দেবো’।

সেনাপতি এসে পড়লো।

‘কেমন লাগছে?’ স্বজ্ঞানে আছ তো? কৌতুকের স্বরে ইসহাককে জিজ্ঞেস করলো সেনাপতি।

‘আমার আল্লাহ আমাকে এখনও বেহুশ করাননি’। ইসহাক উত্তর দিলো।

সেনাপতির ইশারায় চাকা ঘুরাতে লাগলো হাবশী সৈনিকরা। ইসহাক স্পষ্ট বুঝতে পারলো, তার দেহ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। তার জীন্দেগীর সফর শেষ হয়ে আসছে। সে কাতর স্বরে যতদূর সম্ভব জোরে আল্লাহর কালাম পাঠ করতে লাগলো। চাকা আরও ঘুরানো হলো। তার শরীর থেকে এমন শব্দ হতে লাগলো, যেন জোড়া খুলে যাচ্ছে’।

‘তুমি মনে করো না, আমরা তোমাকে জানে মেরে ফেলবো’। সুদানী সেনাপতি বললো, ‘তুমি বেঁচে থাকবে আর তোমার সাথে প্রতিদিন এমন ব্যবহার করা হবে। আমরা তোমাকে মেরে ফেলে কষ্ট থেকে মুক্ত করবো না’।

ইসহাক কোন উত্তর দিলো না, আপন মনে কোরআন পাঠ করতে থাকলো।

সেনাপতির নির্দেশে চাকা নিচু করা হলো। সেনাপতির সাথে আরেকজন অফিসার এসেছিল, সেনাপতি তাকে বললো, ‘বড় কঠিনপ্রাণ মনে হচ্ছে। এত কিছু করেও তাকে বেহুশই করা গেল না। আমরা যতি এরচে বেশী চাপ দেই, তবে সে মারা যাবে। কিন্তু তাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে’।

‘আমি শুনেছি, তার চৌদ্দ পনেরো বছরের একটি মেয়ে আছে। তার বিবিও আছে। এ দু’জনকে ধোঁকা দিয়ে এখানে নিয়ে আসুন’।

‘না, ওই এলাকা থেকে ওদের বের করা যাবে না। এখানে কোন সুদানী সৈন্য গেলে সে জীবিত ফিরে আসতে পারবে না’। বললো সেনাপতি।

‘ইসহাক কারাগাবে আছে, তার অবস্থা মরণাপন্ন। মরার আগে সে তোমাদের একবার দেখতে চায়। তার আবেদনে সদয় হয়ে সরকার তোমাদেরকে তার সাথে দেখা করার অনুমতি দিয়েছে’। আমাদের কোন দূত তাদেরকে এ কথা বলতে পারে। সে যাবে সাধারণ নাগরিকের বেশে, সৈনিকের পোশাক পরে সেখানে যাওয়ার দরকার নেই। আমার বিশ্বাস, এ কথা শুনলে ওরা না এসে পারবে না’।

‘হ্যাঁ! এটা ভাল বলেছো। তাদের ধোঁকা দিয়ে এভাবে ডাকলে ওরা আসতে পারে। ওখানকার মুসলমানরা আমাদের কোন সৈন্যকে তাদের এলাকায় প্রবেশ করতে না দিলেও, দূতকে হয়তো আটকাবো না’।

‘তার বউ ও বেটিকে ডেকে এনে উলঙ্গ করে দাঁড় করিয়ে দেব তার সামনে। অফিসার বললো, ‘তারপর বলবো, আমাদের শর্ত মেনে নাও নইলে তোমার সামনেই তোমার স্ত্রী ও কিশোরী কন্যার ইজ্জত লুট করা হবে’।

কামরার সিপাইরা সেনাপতি ও অফিসারের কথোপকথন শুনছিল।  সেনাপতি তাদের একজনকে ডাকলো। বললো, ‘তোমাদের কমাণ্ডারকে ডেকে নিয়ে এসো’।

একটু পর কমাণ্ডার এসে স্যালুট দিয়ে দাঁড়াল সেনাপতির সামনে। সেনাপতি কমাণ্ডারকে বললো, ‘তোমাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে পাঠাচ্ছি। আমার কথঅ মন দিয়ে শোন। এ অভিযানে তোমাকে সফল হতেই হবে’।

তারপর তাকে ইসহাকের গ্রামের ঠিকানা ও যাওয়ার রাস্তা ভালমত বুঝিয়ে দিল। কেন তাকে পাঠানো হচ্ছে তাও বুঝিয়ে বললো। তাকে বলা হলো, ‘অবশ্যই তুমি মুসলমানদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে এবং সম্মানের সাথে তাদের সাথে কথা বলবে। তুমি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর খুব প্রশংসা করবে। এভাবে কার্যোদ্ধার করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবে তুমি’।

কমান্ডার তখনি যাত্রা করলো ইসহাকের বাড়ীর উদ্দেশ্যে। ইসহাককে চাকার মেশিন থেকে নামিয়ে সেই কামরায় ফেলে রাখা হলো, যেখানে এক মিশরীর লাশ পঁচে গলে পড়েছিল।

ইসহাক আর উঠে বসতে পরছিল না। শরীরের মাংশপেশী যেন ছিঁড়ে গেছে তার। জোড়াগুলো আলগা হয়ে গেছে। কিন্তু সে আল্লাহর ধ্যানে এমনি নিমগ্ন হয়ে রইলো যে, কোন ব্যতা বেদরার অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করতে পারলো না। আল্লাহর স্মরণ তার শারীরিক ব্যথা বেদনা ভুলিয়ে দিলো। কিন্তু সে জানতো না, তাকে এমন মানসিক যাতনা দেয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে, যাতে তার অন্তরাত্মা বেদনায় ছটফট করে উঠবে। তারই চোখের সামনে তার মেয়ে ও বিবিকে এনে নির্যাতন করবে। সেই কয়েদখানা থেকে তার গ্রাম ছিল অনেক দূর, আর পার্বত্য পথও ছিল দুর্গম। অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে সে অঞ্চলে ছুটলো কমান্ডার। সারাদিন আর সারা রাত বিরতিহীন ঘোড়া ছুটিয়ে ভোরে গিয়ে পৌঁছলো সেই দুর্গম অঞ্চলে।

এইমাত্র সকাল হয়েছে। পূর্বাকাশ ফর্সা করে উঠতে শুরু করেছে রক্তিম সূর্য। কমাণ্ডার নির্দিষ্ট বাড়ী খুঁজে বের করার আগে একটু জিরিয়ে নিতে চাইল। বাগানের পাশে এক বৃক্ষের সাথে ঘোড়া বেঁধে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল সে।

সুদানী সেনাপতি ও অফিসার বেরিয়ে গিয়েছিল কারাগার থেকে। ডিউটি বদলের সময় হয়ে এলো সৈনিক ও প্রহরীদের। একটুরপর ডিউটিতে আসবে অন্য সৈনিক। কারাকক্ষের সিপাইরা পরামর্শে বসলো। তাদের চোখে ইসহাক অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন দরবেশ। একে কষ্ট দিলে তাদের ভাগ্যে কি দুর্ভোগ নেমে আসে সে চিন্তায় তারা অস্থির হয়ে পড়লো। তারা আরো পেরেশান হয়ে গেল এই ভেবে, দু’এক দিনের মধ্যেই এটা মেনে নেয়া ও সহ্য করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়লো। খোদার একজন দরবেশের পর্দানশীন সম্মানিত স্ত্রী ও কন্যার ওপর যদি কোনরূপ নির্যাতন চালানো হয়, যদি তাদের সম্ভ্রমের হানি ঘটে, তবে এ জন্য উপস্থিত সবার ওপরই আল্লাহর গজব নেমে আসবে।

এক সিপাই বললো, ‘তিনি তো বলেছেন, তিনি বের হতে পারলেই আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেবেন। আমরা তাকে মুক্ত করার চেষ্টা করি না কেন?’

‘কিন্তু কিভাবে তাকে মুক্ত করবো?’

বহু আলোচনা করেও তাকে মুক্ত করার কোন যুৎসই বুদ্ধি ওরাবের করতে পারলো না। শেষে সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করলো, ‘আমরা এ দরবেশকে মুক্ত করতে না পারলেও তার স্ত্রী-কন্যাকে কিছুতেই এখান পর্যন্ত আনতে দেবো না’।

বিশ্রাম শেষে সুদানী কমান্ডার আবার ঘোড়ায় চেপে বসলো। একটু এগুতেই একদল লোকের সাথে দেখা হলো তার। সে ওদের জিজ্ঞেস করলো, ‘ইসহাক নামের কাউকে চেনেন? মস্তবড় যোদ্ধা। এ পাহাড়ী অঞ্চলেই কোন গ্রামে তার বাড়ী। তিনি মিশরের সেনাবাহিনীর একজন বড় অফিসার’।

সে অঞ্চলে ইসহাকের খুন নাম-ডাক ছিল। তাকে সবাই চিনতো। ওরা বললো, ‘কেন? তার বাড়ী খুঁজছেন কেন আপনি? তিনি কোথায়? কেমন আছেন?’

ওদের প্রশ্নে উদ্বেগ ঝরে পড়ছিল। কমান্ডার বললো, ‘তিনি আহত অবস্থায় যুদ্ধবন্দী হয়ে ধরা পড়েন সুদানী বাহিনীর হাতে। এখন সুদানের কারাগারে আছেন। তার অবস্থা খুবই খারাপ। তিনি তার স্ত্রী ও  কন্যার সাথে দেখা করার শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আতি তাদের দু’জনকে নিতেই এখানে এসেছি’।

লোকগুলো এ খবরে বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়লো। তারা একজনতে তার সাথে দিল ইডসহাকের বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। পাহাড়ী প্রান্তর দিয়ে কিছু দূর এগিয়েই তারা ইসহাকের গ্রামে গিয়ে পৌঁছলো।

ইসহাকের বাড়ীতে উপস্থিত হতেই তার বৃদ্ধ পিতার সাথে তাদের সাক্ষাৎ হলো। সুদানী কমাণ্ডার ঝুঁকে করমর্দন করে খুব মার্জিত ভাষায় বিনয়ের সাথে বললো, ‘আপনার পুত্র এমন বীর, আমাদের সেনাপতিও তাকে ঝুঁকে সালাম করে। সে খুব বীরত্বের সাথেই যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু মরুভূমিতে কয়েক দনি পানির অভাবে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। শেষে আহত হয়ে বন্দী হয়ে যায়। তার চিকিৎসা চলছে। সুদানের সামরিক বাহিনীর শ্রেষ্ট ডাক্তাররা তার চিকিৎসা করছে। কিন্তু তাতেও তার অবস্থার তেমন উন্নতি হচ্ছে না। এত ভাল চিকিৎসার পরও তার শরীর দিন দিনি খারাপ হচ্ছে। সেনাপতি তাবে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে নির্দেশ দিয়েছেন ডাক্তারদের। চিকিৎসকরা তাকে নিয়ে শংকিত। এ অবস্থায় তিনি তার কন্যা ও বিবিকে শেষ বারের মত দেখতে চেয়েছেন। সেনাপতি আমাকে বলেছেন, ‘তুমি জলদি ওর গ্রামে যাও। দ্রুত ওর বিবি-বাচ্চা নিয়ে ফিরে আসবে’।

‘তোমরা যদি তাকে এতই সম্মান করো, তবে তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছ না কেন?’ ইসহাকের বাবা বললেন, ‘আমাদের পারিবারিক চিকিৎসই সবচে ভাল চিকিৎসা করতে পারবে’।

‘সুদানের সরকার বলেছে, তিনি আমাদের মেহমান!’ কমাণ্ডার উত্তর দিল, ‘মেহমানকে অসুস্থ অবস্থায় বিদায় করা মেজবানের জন্য অসম্মানজনক। আর এ অবস্থায় তিনি সফরও করতে পারবেন না। তাতে তার আরও ক্ষতি হবে। আমি আশা করি, সুস্থ হলে তাকে সুদান সরকার সম্মানের সাথেই বিদায় দেবে’।

‘আমার ছেলে বাড়ী নেই। তার স্ত্রী-কন্যা এখন আমার হেফাজতে। আমি বুড়ো মানুষ, সফর করতে পারবোন না। ওদেরকে আমি এখন কার সাথে পাঠাই? আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি বউমার সাথে বুঝে আসি’।

‘আপনি ওদের বলবেন, কন্যা ও স্ত্রীকে কাছে পেলে এবং তাদের সেবাযত্ন পেলে তিনি হয়তো জলদি সুস্থ হয়ে উঠবেন’।

‘কিন্তু ওখানে ওরা কোথায় উঠবে? কিভাবে থাকবে?’

‘এরা সেখানে গেলে সুদান সরকারই তাদের সম্মানের সাথে থাকার ব্যবস্থা করবেন’। কমাণ্ডার বললো, ‘আমাদের ওখানে বীরদের খুব সম্মান করা হয়। আমাদের ধর্ম যদিও পৃথক, কিন্তু আপনারা ও আমরা এক জাতি, সুদানী। আমরা দেশের ও মাটির সম্মান করি। যদিও ইসহাক সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কমান্ডার, তাতে কোন পার্থক্য নেই, আমরা স্বদেশী ভাই। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে আমরা খুব বড় যোদ্ধা ও বীর হিসেবে মান্য করি। তিনি খৃষ্টানদেরকে একদম হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দিয়েছেন’।

‘তবে তোমরা আইয়ুবীকে শত্রু মনে করো কেন?’

সম্মানিত মুরব্বী!’ কমান্ডার বললো, ‘এভাবে কথায় সময় নষ্ট করা আমার ঠিক হচ্ছে না। রাজনৈতিক আলোচনা একবার শুরু হলে তা আর শেষ হতে চায় না। আমাকে আমার দায়িত্ব পালন করতে দিন। আপনার পুত্র বধু ও নাতনীকে দ্রুত আপনার পুত্রের কাছে পৌঁছানো আমার সবচে বড় জিম্মাদারী। আপনার নাতনী ও পুত্র বধু এখন আমার সঙ্গে যেতে প্রস্তুত আছে কিনা একটু দেখে আসুন’।

পর্দার পিছন থেকে নারী কণ্ঠের শব্দ ভেসে এলো, হ্যাঁ, আমরা প্রস্তুত’।

‘কোন পুরুষ কি সাথে যাবে না’। বৃদ্ধ প্রশ্ন করলো, ‘আমিও কি যাবো তোমাদের সাথে?’

‘আব্বা, রাস্তা অনেক দূর! আপনি এত দীর্ঘ পথ ঘোড়ার পিঠে বসে সফর করতে পারবেন না। এ ধকল সহ্য হবে না আপনার। তারচে আমরা মা-মেয়ে দু’জনই যাই’।

কারাগারের সিপাইরা ডিইট শেষে বাড়ীতে ফিরে গেল। প্রতিজ্ঞা মত এক সিপাই তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টে, কাপড় দিয়ে মুখ ও মাথা ভাল করে ঢেকে, ঘোড়ার জন্য কিছু ঘাস ও পানি সঙ্গে নিয়ে বাড়ীর কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে এলো বাড়ী থেকে। তারপর তীব্রবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল কমান্ডারের পথ ধরে।

ইসহাকের বাড়ীর ঠিকানা সে ভালবমই মুখস্ত করে নিয়েছিল। সেনাপতি যখন কমান্ডারকে রাস্তা বুঝিয়ে দিচ্ছিল, তখন এ সিপাই পাশে দাঁড়িয়ে তা খুব মনযোগের সাথেই শুনছিল। তার মনে একটা বিশ্বাস ছিল, তে পথ ভুল করবে না।

কমান্ডার তার অনেক আগেই রওনা দিয়েছিল। সে কারণে কমান্ডারের আগেই ইসহাকের বাড়ী পৌঁছে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার ইচ্ছে, বাড়ী থেকে বের হওয়ার আগেই তাদের বাঁধা দেয়া। যতি তা সম্ভব না হয় তাহলে ফিরতি পথে ওদের আটকাতে হবে। ফলে প্রাণপণে সে ঘোড়া ছুটিয়ে চললো।

পরবর্তী বই ক্রসেড-১৫

উমরু দরবেশ

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 5 | 6 | 7 | 8 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top