১৪. তুমুল লড়াই

এ ঘোষনার সাথে সাথে সুলতানের অশ্বারোহী সৈন্যদল সামনে অগ্রসর হয়ে ময়দানে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়লো। গুমাস্তগীনের সৈন্যদের যুদ্ধ করার শক্তি ও মনোবল আগেই ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাদের অর্ধেকের মত সৈন্য মারা গেছে অথবা আহত হয়ে ময়দানে পড়ে আছে। তাদেরকে গুমাস্তগীন বুঝিয়েছিল, তোমরা অতি সহজেই বিজয় লাভ করবে। জয়ের আশা নিয়েই তারা ময়দানে এসেছিল, কিন্তু যুদ্ধের ময়দান বলছে, গুমাস্তগীন তাদেরকে জাহান্নামে টেনে নিয়ে এসেছে। ফলে এ ঘোষণা শোনার সাথে সাথে তারা অনুভব করলো, বন্দী অবস্থায় হলেও এ পৃথিবীতে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগ কেউ নষ্ট করতে চাইলো না, সবাই দ্রুত নিজ নিজ অস্ত্র সমর্পণ করতে শুরু করলো।

সুলতান আইয়ুবীর পরিকল্পনা সফল হতে যাচ্ছিল, এ সময়ে দেখা দিল নতুন বিপর্যয়। ডান দিকের খোলা ময়দানে ঝড়ের বেড়ে ছুটে আসছে এক নতুন বাহিনী। এ বাহিনী অনেক বড় ও বিশাল।

এ দিকটা নিয়ে প্রথম থেকেই চিন্তায় ছিলেন আইয়ুবী। তিনি সেদিক  তাকিয়ে দেখলেন, মরুভূমির জড়ের মত শত্রু সেনাদল ছুটে আসছে সে দিক দিয়ে। আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে ধুলির মেঘে। সে তুলনায় সুলতান আইয়ুবীর বাহিনী নিতান্ত ক্ষুদ্র।

তিনি সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু পর শত্রু সেনাদের পতাকা দেখতে পেলেন তিনি। এ পতাকা হলবের বাহিনীর। সুলতান আইয়ুবী হলব অবরোধ করে তাদেদ শক্তি ও মনোবল দেখেছেন। তিনি জানেন, এ সৈন্যদল গুমাস্তগীন ও  সাইফুদ্দিনের সৈন্যদের থেকে ভিন্ন ধরনের। তাদের বীবত্ব ও কৌশলও তাদের থেকে শ্রেষ্ঠ এবং উন্নত।

সুলতান আইয়ুবী কখনও আপন শক্তি সম্পর্কে ভুল ধারণায় থাকতেন না। তিনি উপলব্ধি করলেন, তার সামান্য সৈন্য এদের গতি রোধ করতে পারবে না। তাঁর হাতে যে রিজাভ বাহিনী আছে এদের মোকাবেলায় তা ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এখনই তা ব্যবহার করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি শক্তি নয়, বুদ্ধি দিয়ে এর মোকাবেলায় সমাধান খুঁজছিলেন। পাশে দাঁড়ানো সেনাপতিদের বললেন, ‘তোমরা আগের পরিকল্পনা মতই যুদ্ধ চালিয়ে যাও’।

রিজার্ভ বাহিনী ছাড়াও তাঁর ব্যক্তিগত একটি বিশেষ বাহিনী ছিল। বাছাই করা অশ্বারোহীদের তিনি এ বাহিনীতে রেখে দিয়েছিলেন।

তিনি দু’জন অশ্বারোহীকে ডেকে বললেন, ‘উপত্যকার ওপর থেকে যে তীরন্দাজরা এতক্ষণ তীর বর্ষণ করছিল, তাদের কমান্ডারকে বলো, স্থান বদল করতে। পর্বত শৃঙ্গের ওদিকের যুদ্ধ এখন শেষ। এখন ওদের বলো, পিছনের দিকে সরে এসে নতুন করে পজিশন নিতে’।

তারপর তিনি তার স্পেশাল বাহিনীর সালারকে আদেশ দিলেন, ‘বাহিনী সমরাঙ্গণে নিয়ে এসো। আমি নিজে কমাণ্ড করবো’।

অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি তাঁর বিশেষ বাহিনী নিয়ে উপত্যকা থেকে নেমে এলেন। সুলতান আইয়ুবীর সাথে কখনও তার নিজস্ব পতাকা থাকতো না। কারণ শত্রু যাতে জানতে না পারে তিনি কোথায় আছেন। কিন্তু এবার তিনি বাহিনীকে হুকুম দিলেন, ‘আমার নিশান ঊর্ধ্বে তুলে রাখো। দুশমন যাতে বুঝতে পারে, আমি কোথায় আছি’।

কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তার বইতে লিখেছেন, ‘এই যুদ্ধে নিজস্ব নিশান উড়িয়ে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তাঁর বাহিনীকে জানাতে চাচ্ছিলেন, তিনি নিজে ময়দানে নেমে এসেছেন এবং সেনাবাহিনীর কমাণ্ড এখন তিনি নিজেই করছেন। ওদিকে হলববাসীদেরও বলে দিতে চাচ্ছিলেন, এবার তোমরা সরাসরি সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে মোকাবেলায় নেমেছো’।

সুলতান আইয়ুবীর প্রতিটি ইঙ্গিত ও ইশারা মুখস্ত ছিল তার বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের। তিনি তাড়াতাড়ি ধেয়ে আসা বাহিনীর গতি রোধ করার জন্য অশ্বারোহীদের পজিশন দাঁড় করিয়ে দিলেন। দুই অশ্বারোহী সামনে, তারপর চার, তারপর ছয়, তারপর পরের সবগুলো আট আট করে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু তারা কোথাও অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বরং এই ভঙ্গিমায় নিজস্ব অবস্থান অটুট রেখে ওরা ছুটছিল তীব্র বেগে।

এ অশ্বারোহী বাহিনী ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসা শত্রুদের সামনে ছুটে গেল টর্নেডোর গতিতে। দু’দলে যখন টক্কর লাগলো, যেন ভূমিকম্পের মত কেঁপে উঠল ময়দান। সুলতান আইয়ুবী বাহিনীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন যুদ্ধের তীব্রতা। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছিলেন সৈনিকদের। হলবের অশ্বারোহীরা অল্পক্ষণের মধ্যেই সামলে নিল নিজেদের। তারা ডান ও বাম দিকে ছড়িয়ে পড়ে সুলতানের বাহিনীর পাশ কেটে সামনে চলে গেল। যাবার সময় পথে যাকে পেল তাকে বর্শাবিদ্ধ করলো, তলোয়ার দিয়ে কারো মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলো।

হলবের অশ্বারোহী বাহিনীর পিছনে ছিল তাদের পদাতিক বাহিনী। সুলতানের অশ্বারোহী বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে ওরা এগিয়ে যেতেই সুলতানের অশ্বারোহী বাহিনীর সামনে পড়ে গেল সেই পদাতিক বাহিনী। সুলতান কালবিলম্ব না করে সমগ্র শক্তি নিয়ে ওদের পদাতিক বাহিনীর ওপর ঝাপিয়ে পড়লেন। এ আক্রমণ ছিল এমন তীব্র ও বেপরোয়া যে, হলবের পদাতিক বাহিনী চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগল। তারা মোকাবেলা করলো বটে, কিন্তু আইয়ুবীর অশ্বারোহীদের বিদ্যুতগতি বর্শা ও তলোয়ারের আঘাতে তারা কচুগাছের মত ধরাশায়ী হতে লাগল।

অনেকের ইহলীলা সাঙ্গ হয়ে গেল ঘোড়ার পদতলে পিষে। পঙ্গপালের মত এগিয়ে আসছিল হারানের পদাতিক বাহিনী। সুলতানের অশ্বারোহী বাহিনী তাদের কচুটাকা করে এগিয়ে যাচ্ছিল সম্মুখপানে। নিজেদের বাহিনীর এ অনভিপ্রেত  দুর্গতি দেখে দুশমনের অশ্বারোহী বানিনী ঘুরে দাঁড়াল। তারা সুলতান আইয়ুবীর অশ্বারোহী দলের পেছন দিক থেকে প্রবল আক্রমণ চালালো। সুলতান আইয়ুবী এই দ্বিমুখী আক্রমণের মোকাবেলা করতে করতে মাঠের বা’দিকে সরে এলেন। এতক্ষণে দুশমন বাহিনী বা’দিকের পাহাড়ের গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকা স্থান থেকে শুরু হলো শত্রুদের ওপর তীর বর্ষণ। কিন্তু তাতে হলবের সৈন্যদের মনোবল ভাঙ্গলো না।

সুলতান আইয়ুবী তাঁর অল্প সংখ্যক অশ্বারোহীদের শৃংখলাবদ্ধ করে এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অব্যাহত রাখলেন। তীরন্দাজদের তীর ছুটলো বৃষ্টির মত। প্রতি মুহুর্তে লুটিয়ে পড়ছিল হলবের অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈনিক। কিন্তু সৈন্য সংখ্যার আধিক্যের কারণে এত তেমন বিচলিত হলো না হলবের সেনাবাহিনী।

ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, ‘যদি সুলতান আইয়ুবী এমন বেপরোয়াভাবে সেদিক ময়দানে ঝাঁপিয়ে না পড়তেন তবে এ যুদ্ধের ফলাফল হতো ভিন্ন রকম’।

এ যুদ্ধে আরো একজন অসম্ভব সাহসিকতা ও রণকুশলতার প্রমানক দিয়েছিলেন। তাঁর নাম মুজাফফর উদ্দিন। মুজাফফর উদ্দিন ছিলেন সুলতান আইয়ুবীর সহ-সেনাপতি। সুলতানের কাছ থেকেই তিনি শিখেছিলেন যুদ্ধের কলাকৌশল। তিনি সুলতান আইয়ুবীর চাল ভাল মত বুঝতেন। ফলে সৈন্য সংখ্যার আধিক্য হলে সে যুদ্ধে কি কৌশল গ্রহণ করতে হয় তা তার ভালই জানা ছিল। মুজাফফর উদ্দিন এ যুদ্ধে সে কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন সর্বোচ্চ সতর্কতায়।

সুলতান আইয়ুবীর কাসেদ প্রতি দশ মিনিট পর পর তাঁকে ময়দানের অবস্থা অবহিত করছিল। পুরো বাহিনী কোথায় কি অবস্তায় আছে এটা সুলতান যেমন জানতেন, তেমনি জানতেন মুজাফফর উদ্দিন। ফলে সমগ্র বাহিনীকে তিনি এমনভাবে পরিচালনা করলেন, অচিরেই দুশমনকে তিনি নিয়ে গেলেন সেই মৃত্যু ফাঁদে, যে ফাঁদে ফেলে একটু আগে তারা কাবু করেছিলেন গুমাস্তগীনের বাহিনী।

সেখানে তীরন্দাজ বাহিনী পজিশন নিয়ে বসেছিল শত্রুর অপেক্ষায়। তারা তীর বর্ষণ করে বেধড়ক শত্রুদের কাবু করে চললো।

সুলতান আইয়ুবী সৈন্য সংখ্যার স্বল্পতা লক্ষ্য করে তাঁর পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আনার চিন্তা করলেন। রিজার্ভ বাহিনীকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। ঠিক তখনই এক কাসেদ এসে সংবাদ দিল, ‘সুলতান, দামেশক থেকে আগত পাঁচশ’ অশ্বারোহী স্বেচ্ছাসেবী ময়দাদে ছুটে আসছে’।

সুলতান আইয়ুবী ক্ষেপে গেলেন। বললেন, ‘কে তাদের আসতে বলেছে? তাদের তো আহতদের সেবা করার ডিউটি দেয়া হয়েছিল!’

তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ম-শৃংখলা বজায় রাখতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি ময়দানের দিকে তাকালেন। যুদ্ধের সামগ্রিক অবস্থা বেম জটিল। কৌশলগত দিক থেকে আইয়ুবীর বাহিনী সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও সৈন্য সংখ্যা এতই কম যে, শেষ পর্যন্ত ফলাফল কি দাঁড়ায় বলা মুশকিল। যুদ্ধের ময়দান এখন দাবী করছে আরো সৈন্য। তিনি তাকালের এগিয়ে আসা বাহিনীর দিকে। ইচ্ছে করলে তিনি এদের ফিরিয়ে দিতে পারেন। তিনি ডাকার আগেই তাদের ময়দানে চলে আসার প্রেক্ষিতে এটাই তার করা উচিত। কিন্তু তিনি নীরব হয়ে গেলেন। তিনি জানেন, আরোহীদের মধ্যে চারশ মেয়ে ও একশ পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক। তাদের নেতৃত্বে আছে হাজ্জাজ আবু ওয়াক্কাস। নিশ্চয়ই তারা সেনাপতি শামসুদ্দিনের অনুমতি নিয়েই এসেছে।

পাঁচম অশ্বারোহী যেভাবে আসছে, তাতে সুলতান বুঝতে পালেন, এরা কেবল সেনাপতি শামসুদ্দিনের অনুমতি নিয়েই আসছে এমন নয় বরং তারা তারই কমাণ্ডে এগিয়ে আসছে। তিনি কাসেদকে বললেন, ‘আল্লাহ, এদেরকে আমি ময়দানে ডেকে আনিনি। তুমি নিজে থেকে ওদেরকে এ কঠিন ময়দানে পাঠিয়ে দিয়েছো। তুমি ওদের মুহাফিজ হয়ে যাও, ওদের কাজকে তুমি সহজ করে দাও। আল্রাহ, আমাদের এই মা ও বোনদের অন্তরের দিকে তাকিয়ে তুমি এদের বিজয় দান করো’।

মোনাজাত শেষ করে সুলতান আবার ময়দানের দিকে মনযোগী হলেন.! দেখলেন, নবাগত এই অশ্বারোহী দল শত্রু সেনাদের ক্রমশ পাহাড়ী উপত্যকার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দুশমনের পদাতিক বাহিনী দলিত মথিত হচ্ছে তাদের অশ্ব পদতলে।

এ বাহিনীর আগমনে শত্রু সেনাদের অগ্রাভিযান থেমে গেলো। এতক্ষণে টনক নড়লো হলবের যোদ্ধাদের। বুঝতে পারলো যতটা সহজ মনে করেছিল, বিজয় ততটা সহজ নয়।

সুলতান আইয়ুবী এবার তাঁর সংরক্ষিত বাহিনীকে ময়দানে নিয়ে এলেন। তারা ময়দানে আসতেই দুশমন পুরোপুরি কোনঠাসা হয়ে গেল। মরিয়া ময়ে লড়ছিল তারা। মুসলমানদের হাতে হতাহত হচ্ছিল মুসলমান। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে কাঁপছিল মাটি।দু’পক্ষ তেকেই উচ্চকিত হচ্ছিল এ গগণবিদারী শ্লোগান।

আকাশ নীরব হয়ে দেখছিল এ ভ্রাতিঘাতি যুদ্ধ। খৃষ্টানরা খেলা দেখছিল, মুসলিম নিধনের খেলা। ইতিহাসের গতি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। মেয়েরা মোকাবেলা করছিল স্বজাতিরই ভাই ও গুরুজনদের। পিতার বিরুদ্ধে লড়ছিল পুত্র। যুদ্ধের ময়দান রক্তে রঞ্জিত হচ্ছিল। জাতির গর্ব ও অহংকার পিষে যাচ্ছিল ঘোড়ার পদতলে।

দিনভর চললো এ রক্তাক্ত লড়াই। সারা দিনের যুদ্ধের শেষে দেখা গেল, হলববাসীদের মনোবল শেষ হয়ে গেছে। তাদের সৈন্যরা অস্ত্র সমর্পণ শুরু করেছে।

আইয়ুবীর রিজার্ভ বাহিনী ততক্ষণে তাদের অবরোধ করে ফেলেছিল। সেনাপতিরা অধিকাংশই পালিয়ে গিয়েছিল ময়দান ছেড়ে। আহতদের আর্তচিৎকারে কাঁপছিল রাতের বাতাস। সারাদিনের যুদ্ধ মেষে ক্লান্ত মেয়েরা ক্লান্তির কথা ভুলে আহতদের খুঁজে খুঁজে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিচ্ছিল। এভাবেই কেটি গেল সারাটা রাত।

সকাল হলো। রাতের অন্ধকার যে দৃশ্য ঢেকে রেখেছিল, প্রভাতের আলোকরশ্মি সে দৃশ্য উন্মুক্ত করে দিল সবার সামনে। এ দৃশ্য ছিল আরো করুণ, আরো বেদনাদায়ক। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত শুদু লাশ আর লাশ! কোথাও মানুষের লাম, কোথাও পশুর। শত শত মৃত ঘোড়া ও মানুষের লাশের বিভৎস দৃশ্য। এ দৃশ্য চোখে দেখা যায় না, এমনি করুণ!

যুদ্ধবন্দীদের সরিয়ে নেয়া হয়েছিল ময়দান থেকে। তাদের রাখা হয়েছিল অনেক দূরে। জখমীদের রাখা হয়েছিল ময়দানের কাছেই। সকাল বেলা নতুন তরে তাদের ঔষধ ও পট্টি বাঁধার কাজে লেগে গেল গতকালের যুদ্ধ ক্লান্ত এবং রাতভর নির্ঘুম সৈনিক ও স্বেচ্ছাসেবকরা।

একদল স্বেচ্ছাসেবককে দায়িত্ব দেয়া হলো লাশের সৎকারের। তারা প্রথমেই লাশের স্তুপ থেকে খুজেঁ বের করলো মেয়েদের লাশ। সেগুলো কবর দিয়ে নজর দিল ময়দানে পদে থাকা অন্যান্য লামের দিকে।

একজন খুনী মানুষের দেহকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে পারে কিনউত মানবাত ও সভ্যতাকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ক্ষমতার নেমায় পাগল জাতীয় নেতৃবৃন্দ। ক্ষমতার মোহ তাদেরকে এমন অন্ধ ও বধির করে ফেলে যে, তারা মানুষের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ দেখতে পায় না, শুনতে পায় না বিবেকেরে হাহাকার। নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তখন তারা অগণিত মানুষেকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিতে ইতস্তত করে না। আপোষে ও ঠাণ্ডা মাথায় যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলে হত্যা করে আপন সম্প্রদায়, এমনকি আত্মীয় পরিজন। এই ভয়াবহ বিবেকহীন আচরণের মারাত্মক পরিণাম তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন সুলতান আইয়ুবী। রণাঙ্গণের দৃশ্যে অন্তর তার হাহাকার করে উঠল। তিনি সেনাপতিদের বলছিলেন, ‘মানুষের অন্তর থেকে এই মোহ দূর করতে হবে। ইসলাম কোন ব্যক্তির হাতে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার বিরুদ্ধে জেহাদের নাম। যদি পৃথিবীতে এ জেহাদ জারী না থাকে তবে ভাই বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করবে। পুত্র হত্যা করবে পিতাকে। আর এই বিবাদের ঘনঘটায় শয়তান এসে বাসা বাঁধবে মানুষের মগজে। যদি এ বাদশাহীর নেশা আমার নির্মূল করতে না পারি, তবে আল্লাহর এ দুনিয়ায় আধিপত্য কায়েম হবে শয়তানের। কাফেররা এ জাতির আমীর ও বাদশাহদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ধ্বংস করে দেবে সেই জাতিকে, যাদেরকে আল্লাহ মানবতা ও সভ্যতার রক্ষক নিযুক্ত করেছেন।

হলব, হারান ও মুসালের পরাজিত সৈন্যদের অবস্থা এমন ছিল না যে, তারা পুনরায় আইয়ুবীকে আক্রমণ করবে। দৃশ্যতঃ যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুলতান আইয়ুবী জানতেন, কখন যুদ্ধ শুরু করতে হয় এবং কোতায় গিয়ে শেষ করতে হয়। তিনি কোন রকম বিরতি না দিয়েই কমাণ্ডো বাহিনীকে আবার যুদ্ধের জন্য  প্রস্তুত হতে বললেন। বাহিনী প্রস্তুত হলে তিনি কেবলমাত্র অশ্বারোহী কমাণ্ডোদের সঙ্গে নিলেন। অবশিষ্ট বাহিনীকে ক্যাম্পে রেখে তিনি বেরিয়ে পড়লেন ক্যাম্প ছেড়ে।

সে রাতে প্রথমে তিনি গিয়ে চড়াও হলেন গুমাস্তগীনের ক্যাম্পে। গুমাস্তগীনের ক্যাম্প তছনছ করে ক্যাম্পের সৈন্যদের কন্দী করার পর গিয়ে উপস্থিত হলেন সাইফুদ্দিনের ক্যাম্পে। ক্যাম্পের অবশিষ্ট সৈন্যদের পরাজিত ও বন্দী করে হাজির হলেন হারান থেকে আগত আল মালেকুস সালেহের ক্যাম্পে। রাতের অন্ধকারে এমন আকস্মিক ও ধ্বংসাত্মক আক্রমণ চালালেন যে, কেন্দ্রের মাটি পর্যন্ত কেঁপে উঠলো তাতে। ভোর হওয়ার আগেই সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত ও বিধ্বস্ত করে দিলেন তিনি। এ আক্রমণে সুলতান আইয়ুবী আরো আগেই সফলতা ছিনিয়ে আনতে পারতেন, কিন্তু তাঁর বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল, প্রতিপক্ষকে না মেরে বন্দী করা। এ পলিসির কারণেই সম্মিলিত বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সৈন্য ধরা পড়েছিল আইয়ুবীর সেনাদের হাতে।

৫৭০ হিজরীর ১৯ রমজান! মোতাবেক ১১৭৫ খৃষ্টাব্দের ১৩ এপ্রিল। বোর রাতে সেহরী খাওয়ার পর সুলতান আইয়ুবী তাঁর প্ল্যানের শেষটুকও কাজে লাগালেন। সম্মিলিত বাহিনীর আলাদা ক্যাম্পগুলো দখল রকারপর তিনি সরাসরি আঘাত হানলেন সম্মিলিত বাহিনীর হেডকোয়ার্টার বলে পরিচিত অফিসিয়াল ক্যাম্পে। এ আক্রমণে উল্লেখযোগ্য তেমন কোন বাঁধা দিল না কেউ।

গুমাস্তগীন ও সাইফুদ্দিন তাদের ক্যাম্পে আক্রমণ হতেই অন্ধকারের সুযোগে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। তাদের জমকালো ক্যাম্প দুটোতে পড়েছিল তাদের নিজস্ব মূল্যবান তৈজসপত্র, হেরেমের বেগম ও নাচ-গানের মেয়েরা। আরো ছিল বাজনাদার ও চাকর-বাকররা। সুলতান আইয়ুবীর সৈন্যরা গুমাস্তগীন ও সাইফুদ্দিনের তাবুতে হানা দিয়ে দেখলো তারা সেখানে নেই।

মেয়েরা সৈন্যদের দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগলো। সৈন্যরা তাদের দরে সুলতান আইয়ুবীর সামনে হাজির করলো। সুলতান তাদের সবাইকে মুক্ত করে দামেশকে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। সাইফুদ্দিনের ক্যাম্পে সুন্দরী মেয়ে ছাড়াও পাওয়া গেল সুন্দর সুন্দর অসংখ্য পাখী। পাখীগুলো খাচায় বন্দী ছিল, সুলতান ওদের মুক্ত করে আকাশে উড়িয়ে দিলেন।

সে রাতেই সুলতান আইয়ুবীর সামনে একটি মেয়েকে হাজির করা হলো। সে শত্রুদের ক্যাম্পে লাশের স্তুপের মধ্যে কারো মুখ খুঁজে ফিরছিল। সুলতান আইয়ুবীর কমাণ্ডোরা গত রাতে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলা-বারুদ ধ্বংস করার জন্য এখানেই আক্রমন চালিয়েছিল।

মেয়েটিকে দেখেই সুলতান আইয়ুবী চিনতে পারলেন। বললেব, ‘তুমি তো গোয়েন্দা আনতানুসের সঙ্গে হারান থেকে এসেছিলে। এখানে কি খুঁজছো?’

‘জ্বী!’ বললো মেয়েটি, ‘আমার নাম ফাতেমা, আমি নারী বাহিনীর সাথে দামেশক থেকে এসেছি। আনতানুস আহত ছিল। আমার বিশ্বাস, গত রাতে সে এখানেই আক্রমণ করতে এসেছিল। আমি আনতানুসের লাশই খুঁজছি’।

সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘না ফাতেমা, তাকে আর খুঁজো না তুমি। এখানে যত লাশ দেখছো, ভেবে নাও সবই তার লাশ। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, এর কোন লাশে এখন আর আনতানুস নেই। সে চলে গেছে তার মালিকের কাছে। নিশ্চয়ই তার কাজে তার মালিক খুশী হয়েছেন, তাঁকে উত্তম পুরস্কার দেবেন তিনি’।

ফাতেমার চোখে অতলান্ত কষ্ট ও বেদনা টলমল করছিলো। উদগত কান্না রোধ করে সে বললো, ‘আমাকে ক্ষমা করুন সুলতান। আনতানুস নিজেও বলতো, কমাণ্ডোদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায় না। তু আমার হৃদয় মানেনি’। ফাতেমার চোখ থেকে বেরিয়ে এলো অবাধ্য অশ্রু। অশ্রুঝরা কণ্ঠেই সে সুলতানকে বললো, ‘আনতানুস আমাকে বলেছিল, এসো ফাতেমা, আগে দ্বীনের জন্য আমরা নিজেদের কোরবানী করি। জাতির প্রতিটি যুবক-যুবতীর সামনে যে ফরজ অপেক্ষা করছে আগে তা পালন করি। তারপর যখন বুঝবো আল্লা আমাদের গোনাহ মাফ করেছেন, তখন নিজেদের জীবন ও হাসি আনন্দ নিয়ে ভাববো। আর যদি সে ফরজ আদায় করতে গিয়ে জীবন বিলিয়ে দিতে হয়, তাহলে আমাদের সাক্ষাৎ হবে আল্লাহর দরবারে’। ফাতেমা কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘সে তো তার ফরজ পালন করে চলে গেল, কিন্তু আমার ফরজ যে এখনো আদায় হয়নি। হায়! যদি গুমাস্তগীনকে হত্যা করে আমিও আমার ফরজ আদায় করতে পারতাম!’

ফাতেমার বিষাদময় চেহারা ও কান্না দেখে কেউ অশ্রু সংবরণ করতে পারলো না। সুলতান নিজেও মাথা নত করে ঠোট কামড়ে তাঁর আগে দমন করছিলেন।

পরদিন ভোর। আইয়ুবী তার সালারদের বললেন, ‘দামেশক থেকে যে মেয়েরা যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিল তাদের সবাইকে ফেরত পাঠিয়ে দাও। ওদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। শত্রুদের পরাজিত করার ক্ষেত্রে ওরা যে সাহায্য হরেছে, সে কথা আমি কোনদিন ভুলব না। সে সময় সাহায্যের কি প্রয়োজন ছিল তা আমি আর আমার নিয়ন্তা আলেমুল গায়েবই জানি! এ জন্যই মেয়েরা আমাকে না জানিয়ে ময়দানে চলে এলেও তাদের আমি ফেরত পাঠাতে পারিনি। কিন্তু এখন যুদ্ধ শেষ। ওরা যে জন্য এসেছিল সে কাজ সমাধা হয়ে গেছে। তাই এখন আর ওদের এখানে থাকার কোন প্রয়োজন নেই’।

মেয়েদের অসন্তোষ ও কড়া প্রতিবাদ সত্ত্বেও সুলতান আইয়ুবী তাদের দামেশকে পাঠিয়ে দিলেন। তার সামনে এখন অনেক কাজ। তিনি এখন কোথাও থামতে চাচ্ছিলেন না। শত্রুদের সম্মিলিত বাহিনীর এ পরাজয় থেকে তিনি আরও ফায়দা নিতে চাচ্ছিলেন। তিনি আদেশ দিলেন, ‘সেনাবাহিনী, প্রস্তুত হও। তোমাদের এখন হলবের অভিযানে যেতে হবে’।

তিনি সেনাপতিদের সামনে তাঁর পরবর্তী প্ল্যান ব্যাখ্যা করছিলেন। এ সময় দেখতে পেলেন এক অশ্বারোহী তীর বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে তাঁর তাবুর দিকেই এগিয়ে আসছে। অশ্বারোহীর হাতে বর্শা। বর্শার মাথায় কোন কিছু বিদ্ধ করে নিয়ে আসছে। সে আরো কাছে এগিয়ে এলো, সুলতান আইয়ুবীর বডিগার্ডরা তার পথ রোধ করে দাঁড়াল। সুলতান আইয়ুবী দেখলেন, অশ্বারোহীর বর্শার মাথায় মানুষের ছিন্ন মস্তক। সুলতান আইয়ুবী তাকে সামনে আসার অনুমতি দিলেন।

সুলতানের সামনে এসে দাঁড়াল অশ্বারোহী। তাকে দেখেই চিনতে পারলেন সুলতান। এ সেই আজাদ বিন আব্বাস। দামেশকে যাওয়ার পথে এ গোয়েন্দাই রক্ষীদের হাত থেকে পালিয়ে গিয়েছিল।

সে লাফিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নিচে নামল। বর্শবিদ্ধ মাথা সুলতান আইয়ুবীর পায়ের কাছে রেখে বললো, ‘আমি আপনার ফেরারী আসামী। আমি বলেছিলাম, আমাকে ক্ষমা করে দিন, আমি আমার পাপের কাফফারা আদায় করবো। কিন্তু আপনি আমার নিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। রাস্তায় আমি চিন্তা করে দেখলাম, আমার মধ্যে অর্থের লোভ ও আমাকে গাদ্দার বানিয়েছে আমার বাবা।

তাই বাবাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। পালিয়ে যাওয়া ছাড়া এ কাজ সমাধা করার কোন উপায় ছিল না। আমি শুধু এ জন্যই সেদিন পালাতে বাধ্য হয়েছিলাম।

আমি সোজা হলবে গিয়ে দেখামাত্র বাবাকে হত্যা করলাম। তারপর তার মাথা কেটি নিয়ে ছুটে এলাম আপনার দরবারে। এতেও যদি আমার গোনাহের কাফফারা আদায় না হয়ে থাকে, তবে আমাকে আবার বন্দী করুন। তারপর আমাকে যা খুশী শাস্তি দিন। দরকার মনে করলে এমনি করে আমার মাথা কেটে ফেলে দিন’।

সুলতান আইয়ুবী তাকে হাসান বিন আবদুল্লাহর অধীনে দিয়ে দিলেন। বললেন, ‘একে যদি বিশ্বাসযোগ্য মনে করো ত বে তাকে তোমার বাহিনীতে ভর্তি করে নিতে পারো। সে আমার একটা গুরুতর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে। আমি চিন্তা করছিলাম, শত্রুদের গোয়েন্দা এখানকার পুরো তথ্য নিয়ে পালিয়ে গেল, তারপরও শত্রু কিভাবে আমার ফাঁদে এসে পড়লো। এখন বুঝতে পারছি, সে তথ্য জানাতে নয়, বাবাকে হত্যা করতে  গিয়েছিল’।

পরের দিন। সুলতান আইয়ুবী তাঁবুতে শুয়ে বিশ্রাম করছিলেন। কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন টের পাননি। হঠাৎ বাইরের শোরগোলে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হলো, বাইরে কিছু লোক কথা কাটাকাটি করছে।

সুলতান আইয়ুবী দারোয়ানকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাইরে কি হচ্ছে?’

দারোয়ান বললো, ‘নয়জন লোক আপনার রক্ষী দলের পোশাক পরে, আপনার পতাকা বহন করে এখানে এসে হাজির হয়েছে। বলছে, তারা দামেশক থেকে এসেছে। তারা স্বেচ্ছাসেবক হয়ে আপনার দেহরক্ষী হতে চায়। তাদেরকে বাঁধা দেয়া হলে তারা বললো, ‘এত দূর থেকে বহু আশা ভরসা নিয়ে আমরা এসেছি। আমাদেরকে তার দেহরক্ষী দলে নিয়োগ না করলে অন্তত তার সাথে আমাদের একবার দেখা করার সুযোগ দিন। তিনি আমাদের কবুল না করলে, তিনি যা বলবেন আমরা তাই করবো’।

এ নয়জন ছিল শেখ মান্নান ও গুমাস্তগীনের পাঠানো ফেদাইন খুনী। তাদের কৌমল সফল হলো। সুলতান আইয়ুবী দারোয়ানকে বললেন, ‘তাদের পাঠিয়ে দাও’।

ওরা তাবুর দরজায় এলে তাদের হাত থেকে বর্শ রেখে দিয়ে ওদের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হলো। তাঁবুতে প্রবেশ করে সঙ্গে সঙ্গে ওরা খঞ্জর ও তলোয়ার বের করলো। সুলতান আইয়ুবীর দুই রক্ষী তাদের সাথে ভেতরে এসেছিল। মুহুর্তের জন্য তারা হতভম্ব হয়ে গেল।

এক ফেদাইন তলোয়ার বের করে সুলতান আইয়ুবীকে আক্রমণ করে বসলো। সুলতান আইয়ুবী পলকে এক পাশে সরে দ্রুত তলোয়ার তুলে নিলেন হাতে। আক্রমণকারী দ্বিতীয়বার তলোয়ার তোলার আগেই সুলতানের তলোয়ার তার পেটের ভেতর সেঁধিয়ে গেল। তাবুর স্বল্পপরিসর জায়গায় ঢুকে পড়েছিল বারো জন লোক। জায়গার অভাবে এর মধ্যে স্বাধীনভাবে তলোয়ার চালানো সম্ভব ছিল না কারো পক্ষেই।

সামনের জন লুটিয়ে পড়তেই অন্য ফেদাইনরা সুলতানকে একযোগে আক্রমণ করলো। সুলতানের দুই রক্ষী সুলতানের পাশেই দাঁড়ানো ছিল, তারা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের মোকাবেলা করতে লাগলো। ভেতরে তলোয়ারের ঝনঝনানি শুনে ছুটে এলো বাইরের রক্ষীরা।

তাঁবুর মধ্যে ঢুকেই তারা হামলাকারীদের পেছন থেকে আক্রমণ করলো। এবার দু’দিক থেকে আক্রান্ত হলো আট ফেদাইন খুনী। কিছুক্ষণ তলোয়ার ও খঞ্জরে ঠোকাঠুকি হলো। বডিগার্ডদের প্রকিআক্রমণে ফেদাইনরা বেকায়দায় পড়ে গেল এবং আইয়ুবীকে খুন করার পরিবর্তে নিজেকে কি করে খুনের হাত থেকে বাঁচানো যায় সে চেষ্টা করতে লাগলো।

দু’তিন জন ফেদাইন খুনী একসাথে রক্ষীদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে কোন রকমে তাবুর বাইরে চলে এলো। রক্ষীরাও সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার চালাতে চালাতে বাইরে বেরিয়ে এলো ওদের সাথে।

সুলতান আইয়ুবীর তলোয়ারের সামনে কেউ টিকতে পারলো না। পাঁচ খুনী মারা গেল সুলতান ও সঙ্গী গার্ডদের হাতে। অবশিষ্টদের তিন জন পালাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু তাদের হত্যা না করে জীবিত গ্রেফতার করা হলো।

এক ফেদাইন খুনী আহত হয়ে পড়েছিল তাঁবুর মধ্যে। রক্তে লার হয়ে গেছে তার কাপড়। তখনো ক্ষত স্থান থেকে রক্ত ঝরছিল, লোকটি চুপিসারে উঠে বসলো। এক বডিগার্ড দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘সুলতান বসুন!’ সাথে সাথে সুলতান আইয়ুবী বসে পড়লেন। খুনীর তলোয়ারের আঘাত শূন্যে মাতার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। বডিগার্ড আততায়ীর বুকে আমূল ঢুকিয়ে দিল বর্শার ফলা। সেও মারা গেল সঙ্গে সঙ্গে। সব মিলে ছয় জন মারা গেল, ধরা পড়লো তিন জন।

সুলতান আইয়ুবীর ওপর আল্লাহর অসীম করুণা, তিনি এবারেও অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন।

বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ লিখেছেন, ‘শেখ মান্নানের প্রেরিত এ ফেদাইন খুনীরা শপথ করে এসেছিল, সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা নাক রে কেউ জীবিত ফিরে যাবে না। তারা সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করতে পারেনি, তবে তাদের কেউ জীবিতও ফিরে যেতে পারেনি। যারা জীবিত ধরা পড়েছিল মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তাদের সে শপথকে পূর্ণ করা হয়’।

 

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 5 | 6 | 7 | 8 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top