১৪. তুমুল লড়াই

‘এ নিয়ে তোমাদের কোন দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। শত্রুদের জন্য ফাঁদ তৈরি করা আছে’। কমাণ্ডার বললো ‘যুদ্ধ শত্রুরা যেখানে আশা করছে সেখানে হবে না। আমরা তাদেরকে সেখানে টেনে নিয়ে আসব, যেখানে তাদের জন্য আমরা ফাঁদ তৈরী করে রেখেছি’। কমাণ্ডার আজাদের কথার ফাঁদে পড়ে সুলতান আইয়ুবীর সমস্ত প্ল্যানের কথা বলে দিল তাকে। তারা কিভাবে সৈন্য ভাগ করেছে, কিভাবে ফাঁদ পেতেছে সবই অবলীলায় ফাঁস করে দিল তার কাছে।

তাদের আলোচনা শুনে মানসুরার মনে সন্দেহ সৃষ্টি হল! আজাদকে দুশমনের গোয়েন্দা ভাবতে কষ্ট হলো তার, কিন্তু তার উদ্দেশ্য যে ভাল নয়, এটা সে ঠিকই বুঝতে পারল।

সে রাতেরই ঘটনা। রাত তখন দ্বি-প্রহর! ঘুমিয়ে পড়েছিল মানসুরা, কিন্তু কিভাবে যেন তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙতেই তার মনে পড়ে গেল আজাদের কথা। হঠাৎ আজাদের তাঁবু থেকে অস্ফুট স্বরে কথার বলার শব্দ ভেসে এলো তার কানে। মানসুরা সম্পূর্ণ সতর্ক ও উৎকর্ণ হয়ে বিছানায় বসে পড়ল। সে শুনতে পেলো, কেউ বলছে, ‘তুমি এক্ষুণি বেরিয়ে যাও। যথেষ্ট তথ্য তুমি জেনেছ। আর আমিও যা জানি সব বলে দিয়েছি। আমার পক্ষে এখান থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। ভালই হলো, তুমি এসে গেছ। এখন জলদি কেটে পড়ো। তুমি পালিয়ে গেলে কেউ কিছু মনে করবে না, সবাই ভাববে, ভয় পেয়ে পালিয়েছো তুমি’।

‘ঠিক বলেছো তুমি’।

লোকটি আজাদকে কোন রাস্তা ধরে পালাবে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বললো, ‘তোমাকে এখান থেকে পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। তারপরও ভোর হওয়ার আগেই তুমি সেখানে পৌঁছে যেতে পারবে। একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছার চেষ্ট করো। হয়ত এমনও হতে পারে। এখানে ফাঁদ পাতা আছে, মজবুত ফাঁদ। তারা যেন কোন অবস্থাতেই পর্বতশৃঙ্গের মধ্যে না আসে। খোদা হাফেজ!’

লোকটির চলে যাওয়ার পদধ্বনি শুনতে পেল মানসুরা। লোকটি চলে যেতেই মানসুরা তাঁবুর পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিলো। দেখলো, আজাদ তার তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পর আজাদ তাবুর মধ্যে ঢুকল এবং সঙ্গে সঙ্গেই আবার বাইরে বেরিয়ে এসে একদিকে হাঁটা ধরলো। সে যাত্রা শুরু করতেই তাঁবুর অন্য মেয়েদের না জানিয়ে মানসুরা তার বিছানার তলা থেকে খঞ্জর বের করে সঙ্গে সঙ্গে তাবুর বাইরে বেরিয়ে এল এবং সন্তর্পনে তার পিছু নিল।

আকাশে হালকা মেঘ। সে কারণে চাঁদের আলো অস্পষ্ট। মানসুরা আজাদের অস্পষ্ট অবয়বকে অবলম্বন করে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে তার পিছু পিছু চলতে লাগলো। আজাদ পাহাড়ের একটি টিলা পাঁর হয়ে এক উপত্যকায় নেমে গেল। মানসুরাও তাকে অনুসরণ করে নেমে এল সেই উপত্যকায়।

পথে কোন প্রহরী চোখে পড়ল না মানসুরার। এতে মানসুরা বুঝে গেল, যে ব্যক্তি আজাদের কাছে এসেছিল সে তাকে এমন পথ বলে দিয়েছে, যাতে সে সৈন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে যেতে পারে। মানসুরা কোন ডিউটিরত সৈনিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু তার জানা ছিল না, এ পথে কোথায় সৈন্য আছে, বা আদৌ আছে কিনা? সে মনে মনে প্রার্থনা করছিল, যদি কোন টহল গ্রুপের সাক্ষাত পেতো, তবু এর একটি সুরাহা সে করতে পারতো। কিন্তু এ ব্যাপারেও তাকে নিরাশ হতে হলো।

পাহাড়ী রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো ওরা। আগে আজাদ, পেচনে মানসুরা। আরেকটু আগিয়ে এক সংকীর্ণ গিরিপথ ধরলো আজাদ। মানসুরা একটু থমকে দাঁড়াল। গিরিপথে প্রবেশ করবে কিনা ভাবল মুহুর্তকাল, তারপর দ্বিধা কাটিয়ে সেও ঢুকে পড়ল সেই সংকীর্ণ পথে।

গিরিপতটি বেশী বড় ছিল না। অল্প সময়েই ওরা পেরিয়ে এল গিরিপথ।

সামনে খোলা প্রান্তর। সে প্রান্তরের এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোট বড় নানা আকারের গাছ। গাছের নিচে ঘন অন্ধকার।

আজাদ একটি গাছের আড়ালে অন্ধকারে গিয়ে থেমে গেল। মানসুরা চট করে লুকিয়ে পড়ল এক ঝোপের আড়ালে। আজাদ ডানে-বামে এবং পেছনে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল কেউ তাকে অনুসরণ করছে কিনা! কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে যখন সে নিশ্চিত হলো, কেউ তাকে অনুসরণ করছে না, তখন সে আবার চলতে শুরু করল। এভাবে একটু পর পরই গাছের আড়ালে গিয়ে আজাদ থেকে যেতো এবং পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখতো কেউ তাকে দেখছে কিনা। মানসুরাও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সাবধানে তাকে অনুসরণ করে যেতে লাগলো।

মেয়েদের তাবু থেকে অনেক দূর চলে এসেছিল ওরা সামনে আরেকটি পার্বত্য গিরিপথ। আজাদ সে গিরপথে প্রবেশ করল। পেছন পেছন ঢুকল মানসুরাও। প্রচণ্ড শীত। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, সেই সাথে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে হচ্ছে তুষারপাত।

মানসুরার ঠাণ্ডা পা ঠকঠক করে  কাঁপছিল। শরীরও কাঁপতে লাগলো শীতে। হঠাৎ কোন পাথরে হোঁচট খেল মানসুরা। আওয়াজ পেয়ে চট করে পেছনে তাকালো আজাদ। ধমকে দাড়িয়ে কোথায় আওয়াজ হলো বুঝতে চেষ্টা করলো। মানসুরা বড় এক পাথরের আড়ালে বসে পড়লো। সন্দেহজনক কিছু দেখতে না পেয়ে আজাদ আবার চলতে শুরু করলো। আজাদ বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে গেলে মানসুরা উঠে আবার তার পিছু নিল। গিরিপথ থেকে ওরা খোলামেলা এক উপত্যকায় বেরিয়ে এলো। উপত্যকাটি সবুজ ও সমতল। মসৃন মাটিতে পা পড়তেই আজাদ দ্রুত পা চালালো। মানসুরা তার সাথে পাল্লা দতে গিয়ে ছুটতে শুরু করলো। কিন্তু সে তো এক নারী। প্রচণ্ড শীত আর এবড়ো থেবড়ো রাস্তায় দীর্ঘ পথ হেঁটে সে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। আবেগের বশে সে আজাদের পিছু ধাওয়া করছিল, কিন্তু কিভাবে তার গতি রোধ করা যাবে, এর পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে, তখন সে চিন্তা তার মাথায় আসেনি। এখন যদি আজাদ দৌড় দেয় তবে সে তাকে আর অনুসরণ করতে পারবে না।

সে সন্দেহের বশে নয় বরং আজাদ শত্রুদের খবর দিতে যাচ্ছে এটা নিশ্চিত হয়েই তার পিছু নিয়েছিল। আশা ছিল, পথে কোন প্রহরীর সাহায্য পাবে। এখন সে আশা আর নেই। কি করে আজাদকে বাঁধা দেবে ভাবতে লাগল মানসুরা। চিন্তু করে দেখল তাদে যদি ধরতে হয় তবে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। মানসুরার সঙ্গে ধারালো খঞ্জর আছে। মুশালে তাকলে সে বাবার কাছে খঞ্জর ও তলোয়ার চালানোর প্রশিক্ষণও নিয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল শুধুমাত্র ট্রেনিং। শত্রুর সাথে কোন দিন তার মোকাবেলা হয়নি। এখন এই স্বাস্থ্যবান এক সুপুরুষ কমাণ্ডো সৈনিককে মানসুরা কিভাবে কাবু করবে? মোকাবেলা করতে গেলে যে নিজেরই ধরাশায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশী!

এসব চিন্তা করতে করতে অগ্রসর হচ্ছিল মানসুরা। আজাদ সহসা থেকে গেল এবং পিছন ফিরে তাকালো। মানসুরা এবারও দ্রুত এক গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে সমর্থ হলো। গাছের গোড়ায় অজস্র পাথর। মানসুরার পায়ের চাপে হঠাৎ সে পাথর পিচলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পড় গেল মানসুরা। রাতের নিস্তব্ধতায় সে পতনের শব্দ বেশ জোরালো হয়ে বাজল আজাদের কানে। আজাদ শব্দের উৎসের দিকে তাকালো। মানসুরা মাটিতে পড়ে ছিল, সুতরাং এবারও তাকে দেখতে পেলো না আজাদ। সে গাছের দিকে এগিয়ে এলো। মানসুরা মাটিতে শুয়ে থেকেই দেখতে পেলো আজাদ এগেয়ে আসছে। সে শক্ত হাতে খঞ্জর চেপে ধরে চুপচাপ সেভাবেই পড়ে রইল।

আজাদ গাছের কাছে এসে গেল। মানসুরা দেখলো, তার হাতে খোলা তলোয়ার। আজাদ তার পাশ কেটে এগিয়ে যাচ্ছিল, মানসুরা সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে তার পা জড়িয়ে ধরে জোরে টান দিল। আজাদ মুখ থুবড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চোখের পলকে মানসুরা তার পিঠের ওপর চড়ে খঞ্জরের তিক্ষ্ম মাথা তার ঘাড়ে চেপে ধরল।

আজাদ তখনো জানে না কে তাকে আক্রমণ করেছে। সে শুধু অনুভব করলো, তার ঘাড়ের ওপর চেপে আছে ধারালো খঞ্জর। একটু নড়লেই তা ঢুকে যাবে তার শাহরগ ভেদ করে। তার তলোয়ার হাতের মুঠো তেকে ছিটকে দূরে কোতাও পড়ে আছে সে জানে না। আজাদ বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করলো না। চুপচাপ শুয়ে থেকে অস্ফুটস্বরে প্রশ্ন করল, ‘কে তুমি?’

‘তোমার যম। যার হাত থেকে তুমি জীবন নিয়ে পালাতে পারবে না’।

মানসুরার উত্তর শুনে আশার বিদ্যুৎ খেলে গেল তার মনে। বলল, ‘ও, তুমিএক নারী?’

‘হ্যাঁ! তুমি আমার কণ্ঠস্বর শুনেই তা বুঝতে পেরেছ’। মানসুরা বললো, ‘আর তুমি আমাকে ভাল করেই চেনো। আমি মানসুরা’।

‘ওরে ও পাগলী মেয়ে!’ আজাদ একটু সাহস পেয়ে হেসে বললো, ‘তুমি একি খেলা শুরু করেছো? আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। সরো, উঠতে দাও। তোমার খঞ্জর আমর চামড়ায় বিঁধে যাচ্ছে, ওটা সরাও জলদি’।

‘এটা কোন খেল তামাশা নয়। আগে বলো তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?’

‘আল্লাহর কসক! আমি কোন মেয়ের পিছনে যাচ্ছি না’। আজাদ কৌতুকের স্বরে বললো, ‘তোমার চেয়ে সুন্দরী কি আর আছে? সত্যি বলছি, তোমাকে দেখার পর সব মেয়েই আমার কাছে কুৎসিত হয়ে গেছে। বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে প্রতারণা করিনি’।

‘আমাকে নয়, তুমি আমার জাতির সঙ্গে প্রতারণা করতে যাচ্ছো। সত্যি করে বল তো, তুমি আমার জাতির সাথে গাদ্দারী করতে যাচ্ছিলে না!’ একটু দম নিল মানসুরা। তারপর গাঢ়স্বরে বললো, ‘তুমি আমাকে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী মনে করতে, আমিও তোমাকে সুন্দর সুপুরুষ ভেবেছিলাম। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন আমিও তোমার জন্য ভাল নই! আর তুমিও আমার কাছে ভাল মানুষ নেই। তুমি আমার স্বপ্ন ও আশাকে ধূলিস্মাৎ করতে তাবুর আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এসেছো। হয়তো এটাই তোমর দায়িত্ব। তুমি যেমন তোমার কর্তব্য পালন করছো, আমি তেমনি আমার ফরজ পালন করছি। তুমি যদি আমার স্বামী হতে, আমার সন্তানদের বাবা হতে, তবুও আমর খঞ্জর তোমর গর্দান থেকে সরানোর কথা ভাবতাম না আমি’।

‘তুমি আমাকে কি মনে করে হত্যা করতে চাচ্ছো?’ জিজ্ঞেস করলো আজাদ

‘কিছু মনে করে নয়। সন্দেহের বশে আমি তোমার পিছু নেইনি। তুমি মুসলিম নামের কলঙ্ক। তুমি খৃষ্টান ও তাদের দোসর মুসলমানদের গোয়েন্দা’। মানসুরা বললো, ‘আমি জানি, তুমি তোমার বন্ধুদেরকে সাবধান করতে যাচ্ছিলে। তাদের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছিলে ইসলামী লশকরের গোপন তথ্য। বলতে যাচ্ছিলে, সাবধান! তোমরা আইয়ুবীর ফাঁদে পা দিও না। তাকে আক্রমণ করতে এসে তেমারা পর্বত-শৃঙ্গের ভেতর ঢুকে পড়ো না। ওখানে আইয়ুবী তোমাদের জন্য ভয়ঙ্কর ফাঁদ পেতে রেখেছে’।

‘গেঁয়ো মেয়ের মত কথা বলো না তো! গোয়েন্দা কাকে বলে তুমি জানো? আমি তো শত্রুদের অবস্থান দেখতে যাচ্ছিলাম যাতে যুদ্ধের সময় আমরা সহজে তাদের ওপর চড়াও হতে পারি!’

‘আমি খুব ভাল করেই জানি, গোয়েন্দা কাকে বলে’। মানসুরা বললো, ‘আমি এক জাদরেল গোয়েন্দার কন্যা। ইবনুল মাখদুম কাকবুরীর নাম কি কখনও শুনেছো? তিনি মুশারেল মসজিদের খতিব ছিলেন। আমি তার কন্যা শুধু নই, তার দলের এক বিশ্বস্ত গোয়েন্দাও। আমি আমার বাবাকে কারাগারের গোপন কক্ষ থেকে উদ্ধার করে মুশাল থেকে পালিয়ে এসেছি। তুমি তো একদম আনাড়ী গোয়েন্দা! অভিজ্ঞ গোয়েন্দা কখনো কারো তাঁবুর পাশ দাঁড়িয়ে গোপন কথা বলে না’।

‘মানসুরা, আমার পিঠের ওপর থেকে নামো। আগে খঞ্জর সরাও, আমাকে কথা বলতে দাও। তুমি তো এখনও আসল কথাই শোননি। আমি কি জরুরী কথা বলি, আগে শোন’।

‘তোমার মুখ  তা খোলাই আছে!’ মানসুরা বললো, ‘বলো, তোমার জরুরী কথা বলো, আমি মনোযোগ দিয়েই শুনবো’।

আজাদ মানসুরার এ কথায় হতাশ হয়ে পড়ল। সে কি বলবে, কি করবে বুঝতে পারল না। কোন নারী এতটা দৃঢ়তার পরিচয় দেবে ভাবতে পারেনি সে। সে আর কোন কথা বললো না। তার শরীর অসাড় হয়ে পড়লো। সে আশাভঙ্গের বেদনায় নিজেকে মাতে এলিয়ে দিল।

মানসুরার সামনে এখন একটাই প্রশ্ন, কেমন করে তাকে বাঁধবে, কেমন করে সঙ্গে নিয়ে যাবে তাকে। যদি তাকে হত্যা করার প্রশ্ন হতো, তবে কোন অসুবিধা ছিল না তার। হাতে খঞ্জরে একটু চাপ দিয়েই এ গাদ্দারের ইহলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারে সে। কিন্তু মানসুরার ইচ্ছে, তাকে সুলতান আইয়ুবীর কাছে জীবিত হাজির করা। গোয়েন্দা দলে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, গোয়েন্দাদের কাছে অনেক রকম তথ্য থাকে। ধরতে পারলে তাদের জীবিত রাখতে হয়।

মনে মনে মনসুরা আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। বলতে লাগলো, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমাকে মদদ দাও। এ গাদ্দারকে যেন আমি সুলতান আইয়ুবীর হাতে তুলে দিতে পারি’, সে তৌফিক দাও আমাকে’।

সহসা তার মাথায় একটি বুদ্ধি এলো। সে চিন্তা করে দেখলো, সে যদি এখানে বসে চিৎকার করে তবে সে চিৎকার কারো না কারো কানে পৌঁছবেই। রাতে চিৎকারের আওয়াজ নিশ্চয়ই অনেক দূর পৌছে যাবে। যদি আশেপাশে কোথাও কোন সৈন্য বা প্রহরী থাকে, তবে তারা অবশ্যই তার সাহায্যে ছুটে আসবে। দুশমন এলাকা এখনো অনেক দূর। তার চিৎকার শুনে কেউ যদি এগিয়ে আসে তবে সে আইয়ুবীর সৈন্য ছাড়া আর কেউ হবে না।

মায়মুনা সহসা সেই দুঃসাহসিক কাজটিই করে বসলো। সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো, ‘আশেপাশে কে কোথায় আছো, জলদি এসো-ও-ও! আমাকে বাঁচাও-ও-ও! জলদি এসো-ও-ও! আমাকে বাঁচাও-ও-ও……..’

আজাদ অসাড় হয়ে পড়েছিল মাটিতে। সমানে চিৎকার করে চলছিল মানসুরা। গর্দান থেকে সরে পড়েছিল খঞ্জর। মানসুরার এ অন্যমনস্কতার সুযোগ হঠাৎ জোরে মাটি থেকে লাফিয়ে উঠলো আজাদ। পিঠের ওপর থেকে ছিটকে পড়ে গেল মানসুরা। আজাদ উঠে তার তলোয়ারের দিকে ঝুঁকলো, মানসুরা চোখের পলকে উঠে বসে সর্বশক্তি দিয়ে আজাদের পিঠে ধাক্কা লি। তলোয়ার আর তোলা হলো না তার, হাচড়ে পাঁচড়ে কোন রকমে উঠেই দে ছুট। অসহায়ের মত আজাদের ছুটন্ত অবয়বের দিকে মুহুর্তকাল তাকিয়ে রইল মানসুরা, তারপরই মনে হলো, ‘আরে! একটি করছি আমি? ও তো পালিয়ে যাচ্ছে!’

সাথে সাথেই মানসুরাও উঠে দাঁড়ালো এবং চিৎকার করতে করতে ছুটলো তার পিছনে। সে অনুভব করলো, তার পায়ে আবর ফিরে এসেছে পূর্ণ শক্তি।

রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে সে চিৎকারের শব্দ পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলছিল। আইয়ুবীর নৈশ প্রহরীদের নাকে পৌঁছল সে চিৎকারের শব্দ। প্রহরীরা অবাক হলো, এমন গভীর রাতে কোন মেয়ে আর্তনাদ করছে এ নির্জন পার্বত্য প্রান্তরে!

তারা যেদিক থেকে মানসুরার আর্তনাদ ভেসে আসছিল সে দিকে ছুটে গেলো। ছুটতে ছুটতে আজাদ এক পার্বত্য নদীর তীরে এসে পৌঁছল। সামনে নদী দেখে বাধ্য হয়ে থমকে দাঁড়ালো সে। মানসুরাও এসে পৌঁছল নদীর তীরে। ঠিক সেই মুহুর্তে দু’জন প্রহরী সেনা সেখানে এসে পৌঁছে গেলো। আজাদ নিরূপায় হয়ে ঝাঁপ দিল নদীতে। মানসুরা চিৎকার করে বললো, ‘ওকে যেতে দিওনা, ও এক গুপ্তচর, জ্যান্ত ধরে আনো ওকে’।

প্রহরীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। একটু পর ওরাআজাদকে ধরে নদীর তীরে তুলে আনলো। আজাদ ধস্তাধস্তিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাকে নদীর পাড়ে ঘাসের ওপর শুইয়ে রাখা হলো। এতক্ষণ প্রহরীরা ঘটনা প্রবাহের সাথে এমনভাবে জতিয়ে পড়েছিল যে, কোন কিছু খতিয়ে দেকার সুযোগ পায়নি। এবার সুস্থির হয়ে ওরা তাকালো যুবতীর দিকে। মানসুরা ধৃত যুবক আজাদের দিকে তাকিয়েছিল। আজাদ ও মানসুরাকে দেখে প্রহরীদের মনো হলো, হয়তো এটা প্রেমঘটিত কোন ব্যাপার স্যাপার হবে। কিন্তু এ মেয়ে যে বলছিল, ‘ও গুপ্তচর!’ ঘটনা কি জানার জন্য ওরা মানসুরাকে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি চিৎকার করছিলে কেন?’

মানসুরা এ প্রশ্নের উত্তরে সব ঘটনা ওদের খুলে বললো। ওরা কেমন করে এ যুদ্ধের ময়দানে পৌঁছেছে তার উল্লেক করে বললো, ‘এ যুবক দামেশক থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এখানে এসেছিল। গ্রুপ বিভাজনের সময় সে আমাদের গ্রুপে পড়ে। কিন্তু তার চালচলন ও কথাবার্তায় আমার সন্দেহ হয়, সে দুশমনের গোয়েন্দা। কিন্তু এখন আমি সে সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠে গেছি। সে যে দুশমনের গোয়েণ্দা এ ব্যাপারে এখন আমি নিশ্চিত। একে সুলতান আইয়ুবীর কাছে নিয়ে চলো’।

‘হ্যাঁ, চলো। সেখানে গেলেই বুঝা যাবে কে গুপ্তচর’। আজদ বললো, ‘বন্ধুরা! তোমরা আমার কথা শোন! নারী যে এত ছলনাময়ী আগে জানতাম না। এ মেয়ে আমাকে ফাঁসানোর জন্য এমন জঘন্য পথ ধরবে ভাবিনি। গুপ্তচর আমি নই, এ মেয়ে। আমাকে নয়, তোমরা আগে ওকে বন্দী করো’।

এক প্রহরী বললো, ‘তোমাদের কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যুক আমরা জানি না। ঠিক আছে, আগে সুলতানের ওখানে চলো, সেখানে গিয়েই দেখবো, কে গুপ্তচর, তুমি, নাকি এই মেয়েটা?’

আজাদ টহলদার সেনাদের বললো, ‘আসলে আমরা কেউ গুপ্তচর নই। মানসুরা, যথেষ্ট হয়েছে। আমি তো বার বার বলছি, ওই মেয়েকে আমি ভালবাসি না। আমি তোমাকেই ভালবাসি। ও আমাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটানোর জন্য তোমাকে মিথ্যে বলে বিভ্রান্ত করেছে। ঠিক আছে, আমি ওয়াদা করছি, আর কোনদিন তার সাথে আমি কথাও বলবো না। এবার ক্যাম্পে চলো’।

‘আজাদ! আর কতো ভণ্ডামী করবে? কবে তোমার কাছে আমি প্রেম নিবেদন করেছি যে, আমাকে তুমি তোমার প্রেমিক সাজিয়ে ওদের হাত থেকে নিস্তার পেতে চাইছো?’

টহল সৈনিক মানসুরার দিকে ফিরে বললো, ‘দেখো মেয়ে, আমাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করো না। সত্যি করে বলো, তোমরা কে? যদি দু’জন এদিকে বদমাইশী করতে এসে থাকো, তাও খুলে বলো। প্রেমিককে রাগের বশে গুপ্তচর হিসাবে ফাঁসিয়ে দিলে পরে কিন্তু এর জন্য পস্তাতে হবে’।

মানসুরা বললো, ‘তোমাদের সন্দেহ দূর করার জন্য এটুকু বলাই আশা করি যথেষ্ট হবে, আমি মুশালের খতীব ইবনে মাখদুমের কন্যা। বাবার কাছেই আমি গোয়েন্দাবৃত্তির ট্রেনিং পেয়েছি। নইলে ও যে গুপ্তচর তা হয়তো আমি টের পেতাম না। তোমরা আমাদের দু’জনকেই ধরে আইয়ুবীর দরবাকে পেশ করে দাও, তিনিই আসল সত্য উদঘাটন করবেন’।

মানসুরার কথা মুনে আজাদের সব আশা ভরসা ধুলিস্মাৎ হয়ে গেল। সে আবার লুকোচুরি বাদ দিয়ে স্বরূপে আবির্ভুত হলো। বললো, ‘বন্ধুরা, আমার একটি কথা শোন। তোমরা এখানে কত টাকা বেতন পাও? সামান্য ক’টা টাকা ও দুই বেলার রুটির জন্য তোমরা এখানে মরতে এসেছো। আমার সাথে চলো, আমি তোমাদের শাহজাদা বানিয়ে দেবো। এর চেয়ে সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ে দেব তোমাদের। অর্থ-সম্পদে ধনী বানিয়ে দিব’।

প্রহরীরা হেসে বললো, ‘ঠিক আছে বন্ধু। তোমার প্রস্তাব খুবই লোভনীয়। পরে না হয় আমরা তোমার সাথেই যাবো, কিন্তু আগে একটু কষ্ট করো। চলো আমাদের সঙ্গে, আগে সুলতান আইয়ুবীর সাথে একটু দেখা করি’।

সুলতান আইয়ুবীর তাঁবুর পাশেই হাসান বিন আবদুল্লাহর তাঁবু। প্রহরীরা আজাদ ও মানসুরাকে তাদের কমাণ্ডারের কাছে নিয়ে গেল। ঘুমিয়ে ছিলেন কমাণ্ডার। তিনি তাদেরকে নিয়ে সে রাতেই হাসান বিন আবদুল্লাহর তাঁবুতে হাজির হলেন। হাসান বিন আবদুল্লাহকে জাগিয়ে তাঁর কাছে মানসুরা ও আজাদকে সমর্পণ করলেন।

মানসুরা হাসান বিন আবদুল্লাহকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললো। যখন মানসুরা তাকে পিছু ধাওয়া করার বর্ণনা শোনাচ্ছিল, হাসান তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন মানসুরাকে। হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার চেহারা আমার কাছে খুবই পরিচিত লাগছে। সম্ভবত তুমিই মুশাল থেকে পালিয়ে এসেছিলে, তোমার সাথে মুশালের খতিব ইবনুল মাখদুমও ছিলেন’।

‘আমি তারই একমাত্র কন্যা!’ মানসুরা বললো।

‘তুমি আমাকে বিস্মিত ও হতবাক করে দিয়েছ!’ হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘আমাদের মেয়েদের সাহস ও বীরত্বে আমরা সকলেই কমবেশী চমৎকৃত, কিন্তু গোয়েন্দাবৃত্তিতে কেউ এমন তীক্ষ্ণ সতর্কতা, বুদ্ধি ও মেধার পরিচয় দিতে পারে তা আমাদের জানা ছিল না’।

‘আমাকে আমার শ্রদ্ধেয় পিতা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন’। মানসুরা বললো, ‘আমার কানে এমন দু’টি শব্দ এসেছিল, যা থেকে আমি বুঝে নিয়েছিলাম, ব্যাপারটা কি ঘটতে যাচ্ছে’।

আজাদের দেহ তল্লাশি চালিয়ে কিছু কাগজ পাওয়া গেলো। কাগজের ওপর হিম্মাত পর্বত শ্রেণীর একটি নিখুঁত নকশা এবং তাতে সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য বাহিনীর পজিশন সুন্দরভাবে চিহ্নিত ছিল। এতে স্পষ্ট বুজা গেল, সুলতান আইয়ুবীর যুদ্ধের পূর্ণ প্ল্যান শত্রুদের হাতে চলে যাচ্ছিল।

হাসান বিন আবদুল্লাহ কাগজটি আজাদের সামনে মেলে ধরে বললেন, ‘এর পরেও কি কোন সন্দেহ থাকতে পারে, তুমি দুশমনের গোয়েন্দা নও? যদি তোমার কিছু বলার থাকে, বলে ফেলো। যদি নির্দোষ হও তবে আমার কাছে তার প্রমাণ পেশ করো। তুমি যে খৃষ্টান নও, মুসলমান –তাও তোমাকে প্রমাণ করতে হবে’।

‘আমি গোয়েন্দা নই, এ ব্যাপারে আমি হাজার বার আল্লাহর কসম খেতে পারি’।

হাসান বিন আবদুল্লাহ৮ তার মুখের ওপর এমন জোরে ঘুঁষি মারলেন যে, আজাদ চিৎ হয়ে পড়ে গেল। হাসান বিন আবদুল্লাহ ধীর কিন্তু গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘কাফেরদের চর সেজে আবার আল্লাহর কসম খাওয়া! আমি এখন আর তোমার কাছে জানতে চাই না, তুমি গুপ্তচর কি না। আমি শুধু জানতে চাচ্ছি, এখানে তোমার কয়জন সঙ্গী সাথী আছে। তুমি যদি বাঁচতে চাও, তবে তাদের প্রত্যেকের নাম ঠিকানা বলে দাও। তারা কে কোথায় কি অবস্থায় আছে কোন রকম চালাকির আশ্রয় না নিয়ে তা পরিস্কার করে বলে দাও’।

‘আমি মুসলমান!’ আজাদ অনুনয় করে বললো, ‘আমি সব কথাই বলে দেবো, আমাকে ক্ষমা করুন! আমি সুলতানের প্রথম সারিতে যুদ্ধ করবো’।

‘আগে আমার কথার জবাব দাও’। হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘কোন রকম শর্ত আরোপ না করে আমি যা জিজ্ঞেস করছি শুধু তার জবাব দাও’।

আজাদ ছিল চরম ধড়িবাজ ও পাকা গোয়েন্দা। সে বললো, ‘বিশ্বাস করুন, আমি এখানকার আর কাউকে চিনি না। দামেশক থেকে আমি একাই এসেছি’।

‘এই মেয়ে তোমার তাঁবুতে অন্য যে লোকটির কথা শুনেছিলে, সে লোকটি কে?’

‘আমি তাকে চিনি না!’ আজাদ উত্তর দিল, ‘সে লোকটি রাতের বেলা এসে সংকেতের মাধ্যমে আমার সাথে পরিচিত হয়েছিল এবং রাতের অন্ধকারেই আমাকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে চলে গিয়েছিল’।

হাসান বিন আবদুল্লাহ তার দু’জন কর্মীকে ডাকলেন। তাদের বললেন, ‘একে টর্চার সেলে নিয়ে যাও। জিজ্ঞেস করে বের করো কারা এর সঙ্গী আর তারা কোথায় আছে?’ তিনি মানসুরাকে বললেন, ‘তুমি এবার তোমার তাঁবুতে গিয়ে শুয়ে পড়ো। ফজরের জামাতের পর তোমাকে আবার ডাকা হবে’।

সুলতান আইয়ুবী ফজরের নামাজ আদায় করলেন। হাসান বিন আবদুল্লাহও তার সাথে জামাতে শরীক হলেন। নামাজ শেষে তিনি সুলতানকে বললেন, ‘খতিব ইবনুল মাখদুমের কন্যা রাতের অন্ধকারে এক গুপ্তচরকে পাকড়াও করেছে’। তিনি সমস্ত ঘটনা সুলতানকে শোনালেন। সুলতান বললেন, ‘ইসলামের বীর নারীরা যুগে যুগে এমনি সব ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বিবি খাওলার উত্তরসুরী এব মেয়েদের ত্যাগ তিতীক্ষা এবং কোরবানীও স্মরণীয় হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। জাতি চিরকালই ওদের নিয়ে গর্ব করবে। সে গুপ্তচর কোথায়?’

‘ও আমার তত্বাবধানেই আছে’। হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘আগে আমি তার কাছ থেকে আমার যা জানা দরকার জেনে নেই, তার পরে আপনার কাছে নিয়ে আসবো। সে এক সুদর্শন যুবক। নিজেকে দামেশকের নাগরিক বলছে। এখানে সে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে এসেছিল’।

আজাদকে একটি গাছের ডালের সঙ্গে উল্টো করে লটকানো হলো। তার মাথা মাটি থেকে দেড়গজ উপরে ঝুলছে। নিচে আগুনের জ্বলন্ত কয়লার টুকরা। এক সৈনিক একটু পর পর আগুনে কি যেন ছিটিয়ে দিচ্ছিল। যার ধোঁয়া ও ঝাঁঝালো গন্ধে আজাদ ছটফট করছিল আর কাশতে কাশতে মরছিল।

হাসান বিন আবদুল্লাহ এসে তাকে নিচে নামালেন। তার চোখ অন্ধকার হয়ে এসেছিল। শরীরের সব রক্ত এসে জমা হয়েছিল মুখের ওপর। তাকে দাঁড় করিয়ে দেয়ার পরও সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। কিছুক্ষণ বেহুশের মত মাটিতে পড়ে রইলো। তার চোখে মুখে পানির ছিটা দেয়া হলো। একটু পর তো কেবল চোখ খুললো সে। হাসান বিন আবদুল্লাহ তাকে বললেন, ‘এ তো কেবল শুরু। যদি সব কথা খুলে না বলো তবে তোমার শরীরের হাঁড় একটা একটা করে আলাদা করে দেয়া হবে’।

সে পানি খেতে চাইলো। হাসান বিন আবদুল্লাহ বললেন, ‘তোমাকে দুধ পান করাবো। আমার প্রশ্নের জবাব দাও’।

তিনি এক সিপাইকে বললেন, ‘ওর জন্য দুধ নিয়ে এসো। সেই সাথে একটি ঘোড়া এবং রশিও নিয়ে আসবে। রশি ওর পায়ের সাথে বেঁধে ঘোড়ার পিছনে বাঁধতে হবে’।

এ কথা শুনেই আজাদ তার দুই সহযোগীর নাম বললো। এ দু’জনও স্বেচ্ছাসেবক দলের ছিল। তরাতে যে তার সাথে কথা বলছিল, সে তাদেরই একজন। সে দামেশকে গুপ্তচরদের আড্ডার ঠিকানাও দিল হাসান বিন আবদুল্লাহকে। তিনি তৎক্ষনাৎ সেই দুই স্বেচ্ছাসেবককে গ্রেফতার করার আদেশ দিলেন।  এরপর আজাদকে দুধ পান করিয়ে নিয়ে গেলেন সুলতান আইয়ুবীর কাছে।

‘তুমি কোন অঞ্চলের বাসিন্দা?’ সুলতান আইয়ুবী জিজ্ঞেস করলেন।

‘দামেশকের!’

‘কার সন্তান তুমি?’

আজাদ দামেশকের এক জায়গীরদারের নাম বললো।

‘হ্যাঁ, আমার মনে হচ্ছে আমি তাকে চিনি’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘সে তো এখানে দামেশকেই আছে?’

‘না, আল মালেকুস সালেহের সৈন্যরা দামেশক থেকে পালিয়ে গেলে বাবাও পালিয়ে হলবে চলে যান’।

‘আর তোমাকে গুপ্তচরগিরী করার জন্য দামেশকে রেখে যান, তাই না?’ সুলতান আইয়ুবী তার কথার রেশ ধরে বললেন।

‘আমি নিজেই দামেশকে থেকে গিয়েছিলাম’। আজাদ বললো, ‘আমার বাবা এক লোকের হাতে চিঠি দিয়ে জানালেন, গোয়েন্দাগিরী করো। বাবার নির্দেশেই আমি এ পথে আসি’। সে জোড় হাত করে সুলতান আইয়ুবীর কাছে ক্ষমা চেয়ে বললো, ‘আমি সত্যি মুসলমান! আমাকে বাবাই বিপথগামী করেছে। আপনি আমাকে এখানেই রেখে দিন। আমি আমার গোনাহের কাফারা আদায় করতে চাই’।

‘আল্লাহ তোমার গোনাহ ক্ষমা করুন’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি আল্লাহর বিধানে কোন হস্তক্ষেপ করতে চাই না। এখানে তোমার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তও নিতে বসিনি। আমি শুধু আল্লাহর কুদরত ও মহিমা দেখছি, আর যত দেখছি ততাই বিস্মিত ও অভিভুত হচ্ছি। বলতে পারো, কোন সাহসে একটি যুবতী মেয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র এক গোয়েন্দাকে পাকড়াও করতে রাতের আধারেঁ একাকী পথে বের হয়? আর সেই বা কেমন পুরুষ, যার হাত থেকে একজন নারী তলোয়র ফেলে দিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়?’

আজাদ এ কথার কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। সুলতান তাকে বললেন, ‘কথা বলো যুবক, আমার প্রশ্নের জবাব দাও। বলো, তোমার মত সুদর্শন ও বলিষ্ঠ এক যুবককে একটিমাত্র মেয়ে কেমন করে কাবু করল?’

‘যদি সে পিছন থেকে আমার পায়ের গোড়ালী অকস্মাৎ সজোরে টেনে না ধরতো, আমি পড়তাম না’।

‘তবুও তুমি পড়ে যেতে’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘যার ঈমান বিক্রি হয়ে গেছে, সে যে কোন আঘাতেই পড় যায়। আর সে পলে মুখ থুবড়েই পড়ে। যদি তুমি সত্যের পথে থাকতে, ঈমানদারদের সাথে থাকতে, তবে তোমাকে দশ জন কাফেরও ফেলতে পারতো না। তুমি জানো না, আসল শক্তি বাহু ও তলোয়ারে নয়, ঈমানের বলই আসল বল’।

এরপর সুলতান তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি এখানে কি কি দেখেছো?’

‘আমি এখানে অনেক কিছুই দেখেছি’। আজাদ বললো, ‘আমাকে বলা হয়েছিল, মিনজানিক কামান ও তীরন্দাজ বাহিনী কোথায় আছে, সে সন্ধান নিতে। আমি সেগুলো দেখে নিয়েছি। এছাড়া আমার দুই সাথী আমাকে আরও কিছু তথ্য দিয়েছে’।

‘তোমার আগে তোমার কোন সাথী কি এমন কোন তথ্য নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে পেরেছে?’ সুলতান আইয়ুবী জিজ্ঞেস করলেন।

‘না’। আজাদ উত্তরে বললো, ‘আমার জানা মতে, আমরা তিনজন ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। বিশ্বাস না হয় আপনি ওদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। আপনার কাছে আমি মোটেও মিথ্যে বলবো না’। সে কাতর কণ্ঠে বললো, ‘আপনি আমাকে দয়া করুন, একটু সুযোগ দিন। আমি আর কোনদিন বিপথে যাবো না’।

‘সে ফয়সালা মিশরের কাজী করবে’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘আমি তোমার সাথে এ জন্যই কথা বলছি, তুমি মুসলমানের সন্তান! তোমার তো আমাদের সাথেই থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তুমি বিপথে চলে গেছ।

যুবক, আমি জানি দামেশকে তোমার ভালবাসার ফাঁদে একাদিক মেয়ে আটকা পড়ে আছে। তোমার চেহারা ও শরীরের গঠন যে কোন মেয়ের মন কেড়ে নেয়ার মত। কিন্তু এখন সে সব মেয়েরা তোমাকে ধিক্কার দেবে। তোমর মুখে ওরা থু দেবে। আল্লাহও তোমর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আমি বলতে পারি না, দামেশকের কাজী তোমাকে কি শাস্তি দেবেন। যদি তিনি তোমার মৃত্যুদন্ড দান করে, তবে মরার আগে আল্লাহর কাছে তোমার পাপের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিও। অন্তত: মরার আগে মুসলমান হয়ে মরতে পারবে’।

‘আমার বাবাকে কি শাস্তি দেবেন?’ আজাদ রাগের সঙ্গে বললো, ‘এ পাপের পথে তিনিই আমাকে টেনে নামিয়েছেন। তিনিই আমার অন্তরে অর্থের লালসা সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আমার মন থেকে ঈমানের আলো সরিয়ে দিয়েছেন’।

‘আল্লাহর বিধান তাকেও ক্ষমা করবে না’। সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘অর্থের নেশা ক্ষণস্থায়ী জীবনের জন্য, ঈমানী শক্তি চিরন্তন জীবনের কল্যাণের উৎস। এ উৎসধারা কোনদিন শেষ হয় না’।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top