১৪. তুমুল লড়াই

‘আমার মাথায় খুবই সহজ ও ঝুঁকিহীন পদ্ধতি আছে’।

গুমাস্তগীন বললেন, ‘আমি তোমদেরকে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সাজিয়ে হিম্মাত পর্বত শ্রেণীতে পাঠাতে চাই। তার রক্ষীবাহিনীতে খুব বাছাই করে লোক নিয়োগ করা হয়। নিয়োগের আগে তাদের বংশ পরিচয়ও নেয়া হয়। সে কারণে তোমরা যাওয়ার সাথে সাথেই রক্ষী বাহিনীতে নিয়োগ পাবে, তা মনে করো না। অবশ্য একটি কাজ করলে সফল হওয়ার সম্ভানা আছে। গোয়েন্দা জানিয়েছে, দামেশকের লোকেরা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পক্ষে বিরাট উদ্দীপনা নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য আসছে। সুলতান আইয়ুবী সে সব স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়মিত সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে নিচ্ছেন। তোমরা এ সুযোগ নিতে পারো’।

তিনি একটি কাঠের বাক্স খুললেন। তার মধ্য থেকে নতুন পোশাক বের করে ফেদাইনদের বললেন, ‘তোমরা এই পোশাক পরে সুলতান আইয়ুবীর কাছে যেও। এটা তাঁর রক্ষীবাহিনীর পোশাক। তোমাদের একজনের হাতে সুলতান আইয়ুবীর পতাকা থাকবে। অন্য আটজনের হাতে লাঠির সাথে সেনাবাহিনীর পতাকা থাকবে। তোমরা সোজাসুজি সুলতান আইয়ুবীর কাছে যেতে চাইবে। কিন্তু তাঁর রক্ষীরা তোমাদের বাঁধা দিলে তোমরা আবেগ ও উদ্দীপনার সাথে বলবে, আমরা স্বেচ্ছাসেবক, দামেশক থেকে এসেছি। আমরা সুলতাম আইয়ুবীর রক্ষী দলে ভর্তি হতে চাই। এ জন্য আমরা সুলতান আইয়ুবীর রক্ষী দলে ভর্তি হতে চাই। এ জন্য আমরা তার রক্ষী দলের পোশাক পর্যন্ত তৈরী করে নিয়ে এসেছি। সুলতান আইয়ুবীর হেফাজতের জন্য আমরা আমাদের জীবন কোরবান করতে চাই। আমাদেরকে সুলতান আইয়ুবীর রক্ষী দলে অথবা কমাণ্ডো বাহিনীতে ভর্তি করে নাও। তারা গড়িমসি করলে বলবে, আমরা কিছুতেই ফিরে যাবো না। কিন্তু শেষ পর্যন্তও তোমাদেরকে সুলতানের কাছে যেতে না দিয়ে অনুনয় বিনয় করে বলবে, আমরা অনেক দূর থেকে বড় আশা নিয়ে এসেছি। আমাদেরকে অন্তত একবার সুলতানের সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ দাও, তিনি আমাদের আর্জি মঞ্জুর না করলে আর তোমাদের বিরক্ত করবো না।

আমি তোমাদেরকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, তিনি আবেগের বড় মূল্য দেন। তিনি তোমাদের সাথে অবশ্যই সাক্ষাৎ করবেন। লাঠির মাথায় পতাকা জড়ানো বর্শা তো তোমাদের হাতেই থাকবে। যদি তিনি বাইরে সাক্ষাৎ দেন, তবে তোমরা ঘোড়া ছুটিয়ে তার কাছে যাবে। কিন্তু অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নামবে না। কাছে গিয়ে বর্শ দিয়ে দেহ ঝাঝরা করে ঘোড়া ছুটিয়ে পালিয়ে আসবে। তোমরা সকলেই তো জীবন বাজী রেখে শপথ করেছো। আমার মনে হয়, সাহস ও বুদ্ধি খাঁটিয়ে কাজ করতে পারলে তোমরা সকলেই জীবিত ফিরে আসতে পারবে। আমার বিশ্বাস, সুলতান আইয়ুবীকে ক্ষত-বিক্ষত দেখলে তার সৈন্যদের মাঝে নৈরাশ্য নেমে আসবে। যুদ্ধ করার পরিবর্তে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে যাবে সবাই। যখন সৈন্যরা হতবিহবল হয়ে ভাবতে থাকবে, এমনটি কি করে ঘটলো, কি হলো, কি ব্যাপার এবং এ নিয়ে হৈ চৈ করতে তাকবে তখন তোমরা ঘোড়া ছুটিয়ে নির্বিঘ্নে চলে আসতে পারবে। আমি তোমাদেরকে এমন তাজাদম আরবী ঘোড়া দিচ্ছি, যেগুলোর পিছু ধাওয়া করা বাতাসের পক্ষেও অসম্ভব’।

‘এটা তো খুবই চমৎসার পরিকল্পনা!’ ফেদাইন খুনীদের সরদার উৎসাহিত হয়ে বললো, ‘আমাদের সেই সাথী হতভাগারা আনাড়ী ও কাপুরুষ ছিল। কি লজ্জার কথা, তারা শয়ন অবস্থায় পেয়েও তাকে হত্য করতে পারলো না, উল্টো তাঁরই হাতে মারা গেল। আর যারা বেঁচে গেল তারা ধরা পড়লো। এখন আমরা যাচ্ছি, যদি আমরা তার শিরচ্ছেদ করতে নাও পারি, তবে একথা অবশ্যই শুনতে পাবেন, সুলতান আইয়ুবী আর জীবিত নেই’।

‘আর আমি যদি তাঁকে হত্যা করে ফিরে আসতে না পারি তবে? তবে….’ এক ফেদাই হেরেমের সুন্দরী মেয়েদের দিকে ইশারা করে শয়তানী হাসি হেসে বললো, ‘ওই সুন্দরীকে আমার চাই’।

গুমাস্তগীনও শয়তানী হাসি হেসে বললেন, তোমাদের মধ্যে যেই জীবিত ফিরে আসুক, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে খুন করে আসতে পারলে আমি তাকে এমন পুরস্কার দেবো, যাতে তার দীল ঠাণ্ডা হয়। খৃষ্টানরা তাকে যে পুরস্কার দেবে তার থেকে অনেক বেশী ধন-সম্পদ আমি তাকে দেব, যে ধন-সম্পদের কথা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। আর তোমাদের মধ্যে যে সুলতান আইয়ুবীর শির কেটে আনতে পারবে, তাকে তার পছন্দ মত দু’টি সুন্দরী মেয়ে চিরদিনের মত দান করে দেবো’।

ফেদাইনদের চোখগুলো লোভে বড় হয়ে গেল। সেখানে খেলা করতে লাগল চিকচিকে অসভ্য উল্লাস। তারা খুশীতে চিৎসার দিয়ে উঠল এবং হো হো করে হাসতে লাগলো। গুমাস্তগীন তাদের ধমক দিয়ে বললেন, ‘থামো। আগে কাজ পরে পুরস্কার। এসো তোমাদেরকে দামেশক থেকে হিম্মাত পর্বতশৃঙ্গের দিকে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেই। তোমরা এখান থেকে বেরিয়ে ঘুরপথে দূর দিয়ে ঘুরে দামেশকের রাস্তায় গিয়ে পৌঁছবে। কিন্তু লক্ষ্য রাখবে, রাস্তায় কেউ তোমরা কে এবং কোত্থেকে আসছো জিজ্ঞেস করলে শুধু এ কথাই বলবে, আমরা দামেশক থেকে আসছি। এখন যুদ্ধের ময়দানে যাচ্ছি। কারণ রাস্তায় তোমরা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর গোয়েন্দা ও কমাণ্ডো বাহিনীর সামনে পড়বে। যাও, এখন বিশ্রাম করো, রাতে যাত্রা করবে’।

‘রাতে! কেন, এখন রওনা করা যায় না?’ এক ফেদাইন জিজ্ঞেস করলো।

‘না, দিনের বেলা এখান থেকে রেরোনো ঠিক হবে না’। গুমাস্তগীন উত্তর দিলেন, ‘তোমাদেরকে অনেক রাস্তা ঘুরে যেতে হবে। দু’দিন পর গিয়ে পৌঁছবে সেখানে। আস্তে ধীরে পথ চলবে। ঘোড়াগুলোকে কিছুতেই ক্লান্ত করবে না। ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে পড়লে পালানো সময় বিপদে পড়ে যেতে পারো’।

গুমাস্তগীন কাঠের বাক্স থেকে পোশাক বের করে ওদের হাতে দিতে দিতে বললেব, ‘নাও, পরে দেখো গায়ে ঠিকমতো লাগে কিনা!’ এরপর আস্তাবলের দারোগাকে ডেকে বললেন, ‘একটু আগে যে ঘোড়াগুলোকে আমি বেছে আলাদা করে রেখেছি, এদের জন্য সে নয়টি ঘোড়া নিয়ে এসো’।

মাঝ রাতের পর নয়জন অশ্বারোহী ক্যাম্প থেকে বের হয়ে সোজা দামেশকের পথে রওয়ানা হলো। অগ্রবর্তী অশ্বারোহীর হাতে সুলতান আইয়ুবীর পতাকা, অন্য আটজনের বর্শার ফলকের মাথায় সুলতান আইয়ুবীর সেনাবাহিনীর ছোট ছোট পতাকা জড়ানো।

গুমাস্তগীন যে দিন তার সেনাপতি ও কমাণ্ডারদের সামনে উত্তেজিত ভাষণ দিয়েছিলেন, সে দিনেরই ঘটনা। হলবে সাইফুদ্দিনও তার সৈন্যদের সামনে অনুরূপ আগুন ঝরা ভাষণ দান করলেন।

সাইফুদ্দিনের ভাষণ শেষে সৈন্যদের সামনে উঠে দাঁড়ালেন হলবের সেনাপতি। ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তিনি বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন। তারপর বজ্রকণ্ঠে সৈন্যদের বললেন, ‘এই সেই সালাহউদ্দিন, যিনি গত বছরও হলব অবরোধ করেছিলেন। তোমরাই এ সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও তাঁর অপরাজেয় বাহিনীকে বিতাড়িত করেছিলে। কাবার প্রভূর কসম! সুলতান সালাহউদ্দিন ও তাঁর বাহিনী যে দূর্গ বা শহর অবরোধ করে, জয় ছিনিয়ে না নেয়া পর্যন্ত তারা ক্ষান্ত হয় না। সেই তিনি কেন হলব জয় করতে পারলেন না? কেন অবরোধ উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন? কারণ তোমরা সিংহ! তোমরা জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করার সৈনিক! তোমরা শহর থেকে বাইরে বেরিয়ে তাঁর ওপর যে আক্রমণ চালিয়েছিলে, তিনি সে আক্রমণ সহ্য করতে পারেননি। বিজয় তাদেরই হয়, যাদের আল্লাহ বিজয় দান করেন। আর আল্লাহ তাদেরই বিজয় দান করেন, যাদের ওপর আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি তোমাদের ওপর ছিল বলেই তোমরা সেদিন বিজয়ী হয়েছিলে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর ওপর আল্লাহ কেন করে খুশী থাকবেন? তিনি তো ডাকাত! লুটেরা! তিনি অবৈধভাবে দামেশকের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছেন। তার দাপটের কাছে মানুষের জান-মাল নিরাপদ নয়, নিরাপদ নয় নারীর সম্মান ও ইজ্জন। তার কারণেই আমাদেরকে দামেশক ছেড়ে হলবে আসতে হয়েছে। হে আল্লাহর সৈনিক! মুসলমান হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাচ্ছো, আইয়ুবীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার সময় এ কথা চিন্তা করার কোন অবকাশ নেই। ওই মুসলমান কাফেরের চেয়েও খারাপ, যে মুসলমানের দেশ কেড়ে নিয়ে সেখানে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে। এ জালেমের বিরুদ্ধে জেহান করাকে প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ করে দিয়েছে। তাই তোমাদের যদি দেশের ওপর মায়া থাকে, নিজের ওপর মায়া থাকে আর নিজের বুকে থাক ঈমানী আগুন, তাহলে জালেম আইয়ুবীর বিরুদ্ধে জেহাদ করা, তাকে হত্যা করে দেশ এবং জাতিকে রক্ষা করা তোমাদের ওপর ফরজ হয়ে গেছে।

হে খেলাফতের রক্ষীরা! তোমাদের শত্রু নয়, তোমাদের শত্রু এখন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও তাঁর সৈন্য বাহিনী। খৃষ্টানরা নয়, তোমাগেদর শত্রু এখন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও তাঁর সৈন্য বাহিনী। খৃষ্টানদেরকে মুসলমানের শত্রু তিনিই বানিয়েছেন। নূরুদ্দিন জঙ্গী জাতির ওপরে সবচে বড় অবিচার করে গেছেন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে মিশরের আমীর করে। অথচ এ ব্যক্তি সামান্য একটি সেনাদলের কমাণ্ডার হওয়ারও যোগ্য ছিল না। আমি তাকে আমার বাহিনীতে সাধারণ সৈন্য হিসেবেও রাখবো না।

বন্ধুরা! ‘পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে’ আইয়ুবীর এখন সেই পাখা গজিয়েছে। মৃত্যুই তাকে টেনে নিয়ে এসেছে এ পাহাড়ী অঞ্চলে। এখন তাঁর সামনে আছে তোমাদের উদ্যত তলোয়ার ও বর্শা। সামনে আছে তোমাদের ঘোড়সওয়ার বাহিনী। আর তাঁর পিছনে নিরেট পাহাড় ও পার্বত্য অঞ্চল।

তোমাদের এ বিশাল বাহিনী তার গুটিকয় সৈন্যের সামনে যখন যাবে, আমার আফসোস হচ্ছে, পিঁপড়ের মত পিষে মারার জন্য অনেকেই তার কোন সৈন্য ভাগে পাবে না।

বন্ধুরা আমার! তোমাদেরকে হলব অবরোধের প্রতিশোষ নিতে হবে। প্রতিশোষ নিতে হবে তার জুলুম ও বর্বরতার। এখন যদি তোমরা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে সেই পাহাড়ী প্রান্তরে পিষে মারার জন্য ছুটে না যাও, তবে মনে রেখো, এই অহংকারী জালেম আবারও সোজা হলবের পথ ধরবে। কারণ তাঁর দৃষ্টি হলবের দিকেই নিবদ্ধ হয়ে আছে। তিনি তোমাদেরকে তার গোলাম বানাবে, তোমাদের বোন ও বেটিরা তার সেনাপতিদের হেরেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে, যদি তোমরা এটা না চাও, তবে এখনই তার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি আমার এ কথার গুরুত্ব বুঝতে না পারো, তবে তাকাও নূরুদ্দিন জঙ্গীর মাসুম সন্তানের দিকে। যে নূরুদ্দিন জঙ্গী সারাটা জীন মিল্লাতের সেবায় কাটালো, বলো, কি অপরাধ করেছিল তার নাবালেগ সন্তান? কেন তাকে জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হতে হলো? কে করলো তার এতবড় সর্বনাশ? তাকাও মুশালের আমীর সাইফুদ্দিনের দিকে। তাকাও হারানোর দুর্গাধিপতি গুমাস্তগীনের দিকে। কেন সবাই আজ আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে? কেবল আইয়ুবী হকের পথে আছে আর অন্য সবাই মিথ্যাবাদী? আইয়ুবী! তুমি আর কতো ধোঁকা দেবে আমাদের? নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আর কতো রক্ত ঝরাবে মুসলমানের? সালাহউদ্দিন! ক্ষমতার নেশায় ইসলামের তিন-তিনটি শক্তির বিরুদ্ধে একত্রে মাথা তুলতে গিয়ে যে বোকামী তুমি করেছো, এবার তার মাশুল দিতে হবে। তোমাকে দলিত-মথিত করার জন্য ওই দেখো যুদ্ধের ময়দানে ছুটে আসছে মুসলমানদের সম্মিলিত সামরিক শক্তি।

বন্ধুরা আমার! জাতির গাদ্দারকে পিষে মারার এ অভিযানে তোমরা কারো চেয়ে পিছিয়ে থাকার পাত্র নও, এ কথা তোমাদের প্রমাণ করতে হবে। দেশ, জাতি ও ঈমানের স্বার্থে আপন ভাইদের গলায় ছুরি চালাতেও তোমাদের কারো হাত কাপবে না, আমি কি তোমাদের কাছে এ আশা করতে পারি?’

সৈন্যরা ততক্ষণে তেতে আগুন হয়ে উঠেছে। ভেতরে সবার মনে জ্বলছে প্রতিহিংসার আগুন। সেনাপতির প্রশ্নের জবাবে সৈন্যরা আবেগ ও উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে সমস্বরে ধ্বনি তুললো, ‘আইয়ুবীর গোলামী, মানি না মানবো না; বুকের ভেতর জ্বলছে আগুন, নিভবে পেলে আইয়ুবীর খুন; আইয়ুবীর খুন চাই, আইয়ুবী তোর রক্ষা নাই!’ সৈনিকদের গগন বিদারী শ্লোগানে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো।

সাইফুদ্দিন হাত ইশারায় সৈন্যদের থামতে বললেন। তাদের শোরগোল এটকু কমলে তিনি বললেন, ‘কেবল শ্লোগান দিলে হবে না। এ মুহূর্তে আমাদের কি করণীয় সে সম্পর্কে আলেমদের ফতোয়া শোন’। তিনি দু’জন আলেমের ফতোয়া সৈন্যদের সামনে পড়ে শোনালেন। ফতোয়ায় বলা হলো, ‘আইয়ুবীর বিরুদ্ধে জেহাদ করা প্রতিটি সক্ষম মুসলমানের জন্য ফরজ। যারা যুদ্ধ করবে, যুদ্ধের সময় তাদের কারো রোজা রাখার দরকার নেই’।

এ ফতোয়ায় সৈন্যরা খুবই খুশী হলো। সাইফুদ্দিন বললেন, ‘আমরা সে সময় আক্রমণ চালাবো, যখন সালাহউদ্দিনের সৈন্যরা রোজা রেখে দুর্বল হয়ে পড়বে। আমাদের পরের মঞ্জিল হবে দামেশক। কারণ অপরিসীম সম্পদ ও অর্থ পড়ে আছে সেখানে। দু’দিন পর সে সব সম্পদ হবে তোমাদের’।

একদিকে সম্মিলিত বাহিনী তাদের প্রস্তুতি শেষ করে তৈরী হচ্ছিল যুদ্ধের জন্য। অন্যদিকে সুলতান আইয়ুবী তার সৈনিকদেরকে আট-দশ জনের ছোট ছোট কমাণ্ডো গ্রুপে ভাগ করে তাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন যুদ্ধের পরকিল্পনা। সুলতান আইয়ুবী তাঁর সৈন্যদেরকে কোন উত্তপ্ত ভাষণ দিয়ে বা আবেগময় কথা বলে তাদের উত্তেজিত করার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তাঁর দৃষ্টি শুধু ঐ জমিনের ওপর স্থির ছিল, যে ময়দানে তাঁকে যুদ্ধ করতে হবে। সে ময়দানের উঁচু-নিচু টিলা-টক্কর থেকে কিভাবে অধিক থেকে অধিকতর সুবিধা লাভ করতে পারবেন, তাই শুধু চিন্তা করছিলেন তিনি। তিনি কথা বলছিলেন সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্ট ভাষায়। আর এসব কথা বলছিলেন কেবল তাঁর জুনিয়র ও সিনির কমাণ্ডারদের সাথে। তার প্রতিটি কথাতেই ছিল বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়।

তিনি কেবল তখনই একটু বেশী আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন, যখন তাঁর ফিলিস্তিনী মুসলমান ভাইদের কথা স্মরণ হয়।

তাদের উদ্ধারের পথে বাঁধা হয়ে আছে আজ তারই স্বজাতি মুসলমানরাই মুসলমানদের অগ্রগতির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ কথা স্মরণ হলেই তিনি বেদনায় বিমর্ষ হয়ে পড়েন। আফসোস‍! এ সমস্যার কোন সহজ সমাধান নেই। আপোষ-মীমাংসার জন্য দূত পাঠিয়ে এ জন্য তিনি নিজেকে লজ্জিতও করেছেন। তাই এখন যুদ্ধ ছাড়া তাঁর সামনে আর কোন বিকল্প পথ খোলা নেই।

তিনি মিশর থেকে আসা সৈন্য সাহায্য কিভাবে ব্যবহার করবেন সে পরিকল্পনা সমাপ্ত করেছেন। এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন শত্রুর আত্রমণের। শত্রুর পথপানে চেয়ে থাকতে থাকতে তার চোখে জ্বালা ধরে গেল। তিনি তার উপদেষ্টাদের বললেন, শত্রুরা হয়ত চাচ্ছে, আমি পাহাড়ী এলাকার বাইরে গিয়ে ওদেরকে আক্রমণ করি। কিন্তু আমি পাহাড়ী এলাকা ছাড়তে একদম প্রস্তুত নই’।

সুলতান আইয়ুবী যদি চাইতেন, তবে তিনি তাঁর কমাণ্ডো বাহিনী দিয়ে শত্রুদের ক্যাম্প এরই মধ্যে তছনছ ও ধ্বংস করে দিতে পারতেন। তাঁর যুদ্ধের এটা একটা বিশেষ পদ্ধতি। কিন্তু এবারই প্রথম তিনি তাঁর এ বিশেষ পদ্ধতিটি ব্যবহার করেননি। কমাণ্ডো বাহিনীকে তিনি সজ্জিত করে রেখেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি জানতে চাচ্ছিলেন, শত্রুরা কোন চালে যুদ্ধ করতে চাচ্ছে। এ জন্য তিনি গভীর মনযোগের সাথে শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করে চলেছেন।

দামেশক। সুলতান নূরুদ্দিন জঙ্গী নেই, কিন্তু তাঁর শৌর্য বীর্য নিয়ে ঝলসে উঠলেন তাঁর বিধবা স্ত্রী। যুদ্ধের ময়দানে যেতে পারেননি তিনি, যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করলেন না। তার মতে এ যুদ্ধ সুলতান আইয়ুবীর নয়, এ যুদ্ধ সমগ্র জাতির। তিনি আরও মনে করেন, কোন ক্ষুদ্র ময়দানে এ যুদ্ধ সীমাবদ্ধ নয়, যুদ্ধ চলছে সমগ্র দেশে। অতএব তিনি যেখানে আছেন সেখানে থেকেই এ যুদ্ধে ভূমিকা রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন।

সুলতান আইয়ুবী প্রতি মুহূর্তেই সারা দেশের কোথায় কি ঘটছে সংবাদ পাচ্ছিলেন। জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর তৎপরতার খবর পেয়ে তিনি কেবল খুশীই হলেন না, নতুন আশা, উদ্দীপনা ও সাহসেও সঞ্জীবিত হলেন।

সুলতান আইয়ুবী দামেশক থেকে বের হবরা পর এই মহীয়সী মহিলা নিজ উদ্যোগে একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গড়ে তুলতে শুরু করেন। যুদ্ধের ময়দান থেকে আহত সৈনিকদের বের করে আনা, দ্রুত রক্ত বন্ধ করা, জখমে ঔষধ দিয়ে ব্যাণ্ডেজ করা, এসব ট্রেনিং দিতে শুরু করেন তাদের। সেই সাথে তিনি তাদেরকে তলোয়ার চালানো, বর্শা নিক্ষেপ ও তীরন্দাজীর প্রশিক্ষণও দিয়ে যাচ্ছেন। এ কাজে তিনি ব্যবহার করছেন অবসরপ্রাপ্ত পুরুষ সেনা অফিসারদের।

সুলতান আইয়ুবী যুদ্ধের ময়দানে নারীদের টেনে নেয়া পছন্দ করেন না, এ কথা তিনি জানতেন। মেয়েদেরকে সেনাবাহিনীতে পৃথক কোন বাহিনী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করবেন আইয়ুবী, একমটিও তিনি আশা করেননি। তারপরও তিনি মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছেন এক অন্তর্গত প্রেরণায়; যদি পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে যায়! যদি মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষায় নিজেদেরই এগিয়ে যেতে হয়!

জেহাদের জন্য মেয়েদের উদ্ধুদ্ধ করা এবং ট্রেনিং দেয়ার কাজ অব্যাহতভাবে চলতে লাগল। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কাউকে এ কথা বলতে হয় না, তোমার মেয়েকে নার্সিং ও সামরিক ট্রেনিংয়ে পাঠাহে হবে। বরং লোকেরা স্বতঃস্ফুর্তভাবেই মেয়েদের ট্রেনিংয়ে পাঠিয়ে দেয়। দামেশকের পথে হাঁটতে গেলে দেখা যায়, দশ বারো বছরের কিশোরীরাও এখন কাঠের তলোয়ার বানিয়ে মাঠে মাঠে তলোয়ার ফাইট খেলে।

একদিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর কাছে এলো নতুন চারটি মেয়ে। সুলতান আইয়ুবীই ওদেরকে দামেশকে পাঠিয়েছেন। ওদের একজন হচ্ছে ফাতেমা, যাকে সুলতান আইয়ুবীর এক গোয়েন্দা গোমাস্তগীনের অন্দর মহল থেকে বের করে এনেছিল। দ্বিতীয় জন মুশালের খতিব ইবনুল মাখদুমের কন্যা মানসুরা কায়েকা-[তার বিস্তারিত পরিচয় পাবেন ক্রুসেড-১৩ পাপের ফল-এ]। আর অন্য দু’জন ছিল সেই মেয়ে, যাদেরকে হলব থেকে গুমাস্তগীনের কাছে উপহার স্বরূপ পাঠানো হয়েছিল এবং সেনাপতি শামস বখন ও শাদ বখত হারানোর কাজীকে হত্যা করে তাদের মুক্ত করে পাঠিয়ে দিয়েছিল আইয়ুবীর কাছে। এ দুজনের নাম ছিল হুমায়রা ও সাহারা।

এদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে সুলতান আইয়ুবীর কাছে পাঠানো হলে সুলতান তাদেরকে সেখান থেকে দামেশকে পাঠিয়ে দিলেন। এভাবেই অভিভাবকহীন এ চার মেয়ে ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছলো জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর কাছে।

যখন নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর হাতে ওদের তুলে দেয়া হলো, তখন দামেশকের মেয়েরা সেখানে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। ওরা দেখতে পেল, কেউ সেখানে অসি চালনা শিখছে, কেউ তলোয়ার চালাচ্ছে, কেউবা আবার আহত সৈনিককে কিভাবে দ্রুত ব্যাণ্ডেজ করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। মেয়েরাএ সব দেখে উদ্দীপিত ও উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। আবেদনের সুরে বললো, ‘মোহতারেমা’, আমাদেরও আপনি এ প্রশিক্ষণার্থীদের দলে শামিল করে নিন’।

তিনি বললেন, ‘তোমাদের এ আশা অচিরেই পূরণ হবে। আমি তোমাদের নাম তালিকাভুক্ত করে নিচ্ছি। কিন্তু তার আগে তোমরা কে কোত্থেকে কিভাবে এখানে এলে সে কাহিনী শুনতে চাই’।

মেয়েরা প্রত্যেকেই জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর কাছে তাদের ঘটনার জীবন কাহিনী তুলে ধরলো। তিনি তন্ময় হয়ে তাদের কাহিনী শুনলেন এবং বললেন, ‘তোমাদের জীবন কাহিনী তো বড়ই বৈচিত্রময়! এ কাহিনী সবারই জানা দরকার’।

তিনি তাদেরকে প্রশিক্ষণরত মেয়েদের কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে আবার তারা উপস্থিত মেয়েদের সামনে তাদের জীবনের ইতিহাস তুলে ধরলো। তাদের শোনালো, শত্রুরা তাদের ওপর কি কি নির্যাতন করেছে। খতিবের মেয়ে মানসুরা ছিল শিক্ষিত ও যথেষ্ট বুদ্ধিমতি। সে মেযেদের বললো, ‘মেয়েদের বড় সম্পদ তার সম্ভ্রম। শত্রু যখন কোন দেশ বা শহরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে, তখন বিজয়ী সেনা বাহিনীর হাতে প্রথমেই ধরাশায়ী হয় নারী জাতি। দীর্ঘদিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এসব সৈন্যদের লোলুপ দৃষ্টি গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মেয়েদের ওপর। তখন ওরা আর মানুষ থাকে না, হয়ে যায় বন্য পশুরও অধম। তোমরা হুমায়রা ও সাহারার কাছ থেকে শুনতে পেয়েছ, যে অঞ্চলে খৃষ্টানদের আধিপত্য রয়েছে, সেখানে খৃষ্টানরা মুসলমান নারীদের ওপর কি ভয়াবহ নির্যাতন চালাচ্ছে। সেখানে কোন মুসলমান মেয়েরা সম্ভ্রমই নিরাপদ নয়। আল্লাহ না করুক, যদি কোন দিন দামেশকেও খৃষ্টানদের আধিপত্য বিস্তার হয়, তবে তোমাদের অবস্থাও হবে সেইসব নির্যাতীতা বোনদের মত। যদি আজ আমরা দেশ ও জাতির জন্য কোরবানী দিতে এগিয়ে না আসি, তবে পরিস্থিতি আমাদেরকে একদিন এমন কোরবানী দিতে বাধ্য করবে, যার কথা কল্পনা করতেও আমার গা শিউরে ওঠে। খৃষ্টানরা আমাদের পুরুষদের বানাবে তাদের গোলাম আর আমাদের বানাবে তাদের দাসী। তোমরা হয়তো জাতো, তারা আমাদের অনেক ওমরাকে ক্রয় করে নিয়েছে। ফলে এখন খৃষ্টানরা যেমন আমাদের শত্রু, তেমনি শত্রু খৃষ্টানদের দোসর মুসলমানরাও। যদি আমরা বিজয় লাভ করতে চাই, তবে প্রতি মুহূর্তে শত্রু-মিত্র সম্পর্কে আমাদের থাকতে হবে সতর্ক সজাগ। জেহাদের প্রেরণায় সব সময় আমাদের থাকতে হবে উজ্জীবিত। আমার শ্রদ্ধেয় পিতা বলেন, যে জাতি সেই সন্তানদের ভুলে যায়, যারা বিজাতি ও কাফেরদের বর্বরতার শিকার হয়েছে, সে জাতি বেশী দিন টিকে থাকতে পারে না।

প্রিয় বোনেরা! আমরা সম্মানিত সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পতাকাতলে সববেত হয়েছি নিজেদের দ্বীন ও ঈমানকে হেফাজত করার জন্য। দ্বীতের কারণেই আজ আমরা তার অনুসারী! তিনি যদি দ্বীনের জন্য তাঁর জীবনকে বাজি রাখতে পারেন, তবে আমরা কেন পারবো না? তিনি যদি শাহাদাতের গৌরব অর্জনের জন্য নিজেকে পেশ করতে পারেন আল্লাহর দরবারে, তবে আমাদেরকে কেন তিনি সে গৌরবের হিস্যা থেকে বঞ্চিত করবেন? তিনি আমাদের নেতা, তাঁর হুকুমে আমরা আগুনে ঝাঁপ দিতে পারি, ফাঁসিতে ঝুলতে পারি, কিন্তু জেহাদের ময়দান থেকে সরে দাঁড়াতে পারি না। তাঁর এ নিয়ম আমরা মানতে রাজী নই যে, নারীরা যুদ্ধের ময়দানে যেতে পারবে না। নারীদেরকে এত দুর্বল মনে করা উচিত নয়। আজো যুবতী ও সুন্দরী মেয়েদেরকে ধনী ও আমীরদের মহলের সৌন্দর্য বাড়াতে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আমাদেরকে পুরুষের ভোগের সামগ্রী বানানো হচ্ছে। এতে জাতির অর্ধেক শক্তি দুর্বল ও বেকার হয়ে যাচ্ছে। শত্রুরা যে সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসেছে, তার তুলনায় আমাদের সৈন্য অর্ধেকও নয়। আমরা পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধ করবো এবং পুরুষ সৈন্যের ঘাটতি পূরণ করবো। আমরা মুশালে গোয়েন্দাদের সঙ্গে ছিলাম, সেখানে আমরা যুদ্ধ করে এসেছি। পরিস্থিতির কারণে আমরা সেখান থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। আমার আচ্চা আবেগের অতিশয্যে মুশালের আমীরের কাছে দ্বিধাহীন চিত্তে তার মতামত ও সত্যকে ব্যক্ত করে ফেলেছিলেন। এর মাধ্যমে তার ঈমানের দৃঢ়তা প্রকাশ পেলেও হয়তো এটা ছিল হেকমতের খেলাফ। যদি তিনি সেখানে গ্রেফতার না হতেন তবে আমাদের প্ল্যান হতো অন্য রকম। আমরা আমাদের আরাধ্য কাজ সমাধা না করেই সেখান থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।

আমার কথায় তোমাদের মনে হতে পারে, সুলতান আইয়ুবী দ্বীন কায়েমের সংগ্রামে মেয়েদের অংশ গ্রহণের বিরোদী। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। এটা সঠিক হলে তিনি মোহতারেমা জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর তত্বাবধানে এই যে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চলছে, তা বন্ধ করে দিতেন.! মুশালে আমরা যে তৎপরতা চালাচ্ছিলাম, তাও নিষিদ্ধ করতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এই ব্যাপকতর সংঘাত, সংঘর্ষ ও যুদ্ধেল নেতা হিসাবে তিনি যা চিন্তা করেছেন, ঠিকই করেছেন। তিনি চান, আমরা যেন আগে আমাদের স্বামী, ভাই ও সন্তানদের জেহাদের ময়দানে পাঠিয়ে দেই। জাতির যেসব সন্তান গাদ্দার হয়ে গেছে তাদেরকে যেন গাদ্দারীর পথ থেকে ফিরিয়ে আনি। জাতির মদ্যে যেন জাগরণ ও প্রাণস্পন্দন জাগিয়ে তুলি। আর সব সময় যেন চোখ-কান খোলা রেখে পাহারা দেই পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে। তিনি আমাদের সামরিক প্রশিক্ষণ অনুমোদন করে এ কথাও বুঝাতে চান আমাদের, সময় যদি কখনো নারীদের খুন দাবী করে ইসলামের জন্য, তিনি সে দাবী অগ্রাহ্য করবেন না। তাই সময় আমাদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেয়ার দাবী জানাচ্ছে। তিনি যখন সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার জন্য আমাদের ডাক দেবেন, তখন যেন আমরা তাদের বোঝা হয়ে না যাই। অদক্ষতা ও অযোগ্যতার অভিযোগ যেন আমাদের বিরুদ্ধে না উঠতে পারে সে জন্য পর্যাপ্ত ট্রেনিং দরকার আমাদের। আমাদের যোগ্যতাই বলে দেবে জেহাদের এ পর্যায়ে কোন ভূমিকা আমাকে পালন করতে হবে’।

সায়েখার এ ভাষণ এবং অন্য তিনজনের জীবন কাহিনী শুনে উপস্থিত মেয়েদের প্রাণে নবতরঙ্গের হিল্লোল বয়ে গেলো। জেহাদী জযবা ও জোশে উদ্দীপিত হয়ে উঠলো প্রতিটি অন্তর। চারশ মেয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল ওখানে। কয়েকদিন পরই তাদের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হলো। ময়দানে যাওয়ার জন্য প্রতিটি মেয়েই ছিল বলতে গেলে এক পায়ে খাঁড়া। তাদের আগ্রহ জযবা দেখে জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে সুলতান আইয়ুবীর কাছে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

নবাগত এ চার মেয়ে মাত্র কয়েক দিন হয় প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছে। তখনো তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়নি, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েদের সাথে তারাও যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। কিন্তু তাদেরকে ট্রেনিং শেষ করার তাগিদ দিয়ে বলা হলো, ‘আগে ট্রেনিং শেষ করো, এরপর নিশ্চয় তোমাদের আশা পূরণ করা হবে’।

কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য ওরা জেদ ধরে বসলো। বললো, ‘আমাদের আপনি ময়দানে পাঠিয়ে দেখুন, আমরা আপনাকে নিরাশ করবো না। এখানকার প্রশিক্ষণ হয়তো আমাদের পূর্ণ হয়নি, কিন্তু জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের যে ট্রেনিং দিয়েছে, তার কোন তুলনা হয় না’। কিন্ত এবারও তাদের আবেদন অগ্রাহ্য হলো।

তাদের মনের মধ্যে তখন ধিকিধিকি জ্বলছিল অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার অসহ্য যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার কথা স্মরণ হতেই মনের ভেতর প্রতিশোধের স্পৃহা জেগে উঠলো। কিন্তু যুদ্ধে যাবার অনুমতি না পাওয়ায় তার সাথে শামিল হলো অক্ষমতার খেদ। ফাতেমা, হুমায়রা ও সাহারা তিনজনই মনের দুঃখে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে যখন তারা চোখ ফুলিয়ে ফেললো তখন মায়া হলো মরহুম জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর, তিনি দয়পরবশ হয়ে চারশ নারী স্বেচ্ছা বাহিনীর সাথে এ চারজনকেও যুক্ত করে দিলেন। তাদের সাথে রওনা হলো একশো সুশিক্ষিত পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক। এ স্বেচ্ছাবাহিনীর কমাণ্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত হলো হাজ্জাজ আবু ওয়াক্কাস।

জঙ্গীর মহিয়সী বিধবা পত্নী হাজ্জাজ আবু ওয়াক্কাসকে একটি লিখিত চিঠি দিয়ে বললেন, ‘এ চিঠি ভাই সালাহউদ্দিনকে দেবে। আমি সবকিছু চিঠিতেই বলে দিয়েছি। তুমি তাঁকে বলবে, এ মেয়েদেরকে যুদ্ধে আহত সৈন্যদের সেবা ও চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। এ মেয়ে ও পুরুষ রক্ষীদের প্রতি তুমি সতর্ক দৃষ্টি রাখবে এবং তোমার নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখবে। পুরুষদের সবাইকেই কামণ্ডো আক্রমণের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। মেয়েরাও যুদ্ধ করতে পারবে। আহতদের সেবা করা ছাড়াও প্রয়োজনে তাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যেতে পারবে আইয়ুবী। আমি মেয়েদের বলে দিয়েছি, শত্রুদের হাতে পড়লে তোমরা কেউ জীবিত ফিরে আসবে না। তারা নিজেরাও অঙ্গীকার করেছে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা লড়বে, কিছুতেই শত্রুর হাতে ধরা দেবে না’।

স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর চারশ মেয়ে ও একশ পুরুষ অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে বসলো। দামেশক শহরের সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে এলো তাদের বিদায় অভিনন্দন জানাতে। তারা যখন চলতে শুরু করলো, জনতা রাস্তার দু’পাশে দাড়িয়ে তাদের গায়ে ফুল ছিটিয়ে দিতে লাগলো। এক কবি মাইকে তখন কবিতা পড়ছে,

‘সামনে এগয়ে চলো বীর মুজাহিদ

মুক্তির মিছিলে-দাও সাড়া দাও

জেহাদের ময়দান ডাকছে ব্যাকুল

তোমার দৃপ্ত পা-সামনে বাড়াও।

ভাইদের সাথে আজ বোনেরা শামিল

পুষ্পিত হাতে হাতে বিষমাখা তীর

বিষ্ময়ে হতবাক বিমুগ্ধ নিখিল

অবাদ তাকিয়ে দেখে মহীয়সী বীর’।

উল্লসিত জনতা ধ্বীন দিতে থাকে, ‘দামেশকের বীর সন্তান, সামনে এগিয়ে যাও, সালাহউদ্দিন আইয়ুবীকে বলবে, দামেশকের সমস্ত নারী-পুরুষ আইয়ুবীর সৈনিক’।

মুরুব্বীরা তাদের দিকে হাত নেড়ে দোয়া করছিল, ‘আল্লাহ তোমাদের সফলতা দান করুন। ইসলামের কোন শত্রুকে জীবিত রেখে যেন তোমাদের ঘরে ফিরতে না হয়।

শহরের অনেক লোক ঘোড়া ও উটে চড়ে শহর থেকে বেরিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত তাদের সাথে এগিয়ে গেল। এক সময় হাজ্জাজ কাফেলা থামিয়ে আগত লোকদের দিকে ফিরে বললেন, ‘বন্ধুরা, এবার ফিরে যাও। এখন ফিরতি পথ না ধরলে ইফতারের আগে তোমরা শহরে পৌঁছতে পারবে না’।

রমজান মাস। বিকেলে এক জায়গায় তাঁবু টানানোর নির্দেশ দিলেন বাহিনী প্রধান হাজ্জাজ আবু ওয়াক্কাস। বিশ্রামের জন্য থেমে গেল কাফেলা। ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসছিল। যাত্রা বিরতির পর মেয়েরা রান্না-বাড়ার কাজে লেগে গেল। পুরুষরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাঁবু টানাতে।

তখন চলছিল এপ্রিল মাস, পুরো শতের মওসুম। রাতে ভীষণ ঠাণ্ডা পড়ে। কাফেলার ঘোড়ার সাথে উঠের বহরও ছিল। উটের পিঠে ছিল সামানপত্র ও তাঁবু। কিছু তাঁবুর মধ্যে তলোয়ার, বর্শা ও তীর-ধনুক লুকানো ছিল। স্বেচ্ছাসেবকরা উটের পিঠ থে সেসব তাবু নামাচ্ছিল।

সূর্য অস্ত যাওয়ার একটু আগে বারোজন অশ্বারোহী এসে উপস্থিত হলো সেখানে। সুলতান আইয়ুবীর টহল বাহিনী। চলাচলের পথ নিরপদ রাখার দায়িত্ব ছিল এদের ওপর। তারা কাফেলার কাছে এসে দেখতে পেল, কাফেলার মেয়েদের সংখ্যাই বেশী, পুরুষ কম। তারা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর গতিবিধি ও তৎপরতা লক্ষ্য করতে লাগল।

অশ্বারোহীদের আসতে দেখে কাফেলার সরদার হাজ্জাজ আবু ওয়াক্কাস সামনে এগিয়ে গেল। টহল বাহিনীর কমাণ্ডার চিল আনতানুস! সে আবু ওয়াক্কাসকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমরা কারা? কোত্থেকে আসছো?’

আবু ওয়াক্কাস তাকে জানালো ‘আমরা স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী। সুলতান আইয়ুবীর পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য দামেশক থেকে এসেছি’।

আনতানুস তাকে আরো কিছু প্রশ্ন করে যখন নিশ্চিত হলো আবু ওয়াক্কাস সত্যি কথাই বলছে, তখন বললো, ‘কিন্তু তোমার বাহিনীতে পুরুষের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যাই দেখছি বেশী!’

‘জ্বী, আপনি ঠিকই বলেছেন। এর সবাই মরহুম নূরুদ্দিন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর তত্বাবধানে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ময়দানে যাচ্ছে। আহত সৈনিকদের চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি সুলতান অনুমতি দিলে এরা সরাসরি যুদ্ধেও অংশ গ্রহণ করতে পারবে’।

কমাণ্ডেদের দেখে অনেকেই তাদের কাছে দিয়ে জটলা করে ওদের কথা শুনতে লাগলো। যুদ্ধের খবর শোনার জন্য সবাই ছিল উদগ্রীব। তারা প্রশ্ন করলো, ‘যুদ্ধের খবর কি?’

আনতানুস বললো, ‘যুদ্ধ এখনও শুরু হয়নি। তবে কখন শুরু হয়ে যায় তা বলা যায় না’।

পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরাও এসে জড়ো হয়েছিল সৈনিকদের পাশে। আনতানুস কথা বলতে হঠাৎ নীরব হয়ে গেল। তার দৃষ্টি আটকে গেল এক মেয়ের ওপর। সে একটু অবাক হয়েই বললো, ‘ফাতেমা! তুমি কেমন করে এখানে?’

ফাতেমাও এমনটি ভাবেনি। সেও অবাক হয়ে অধীর আগ্রহে তাকেয়ছিল আনতানুসের দিকে। আনতানুস তার নাম উচ্চারণ করতেই ভিড় ঢেলে সে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল এবং তার হাত ধরে বললো, ‘আনতানুস! তুমি এখানে!’

এই সে ফতেমা, যাকে আনতানুস গুমাস্তগীনের মহল থেকে মুক্ত করেছিল। আবু ওয়াক্কাস তাদের পরিচয়ের কাহিনী শুনে বললো, ‘আল্লাহ মেহেরবান! তিনি এভাবেই মুমীনের ইচ্ছা পূরণ করেন’।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | 1 | 2 | 3 | 4 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top