১৩. পাপের ফল

‘হ্যাঁ, আমরা সেখান থেকেই আসছি!’ কমান্ডার বললো, হলবে তিন বাহিনী প্রধান মিলিত হয়েছেন। ওখানেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে, হলব, হারান ও মুশালের বাহিনী একত্রিত হয়ে আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সম্মিলিত অভিযান চালাবে। এ সিদ্ধান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমাদের ডেকে বললেন, ‘এখনি রওনা হও। শামস বখত ও সাদ বখতকে বলবে, জলদি বাহিনীকে তৈরী করতে। আমরা তিনজনে মিলে অভিযানের খুঁটিনাটি বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরী করছি। পরিকল্পনা তৈরী হয়ে গেলে আমি নিজে চলে আসবো বা কি করতে হবে খবর পাঠাবো। দু’একদিনের মধ্যেই যেনো বাহিনী অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ করে ফেলে। আইয়ুবীকে কোন কিছু বুঝতে না দিয়েই আমরা অতর্কিতে তার ওপর সম্মিলিতভাবে ঝাপিয়ে পড়বো।’ সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়ে গেলাম আমরা। আমি বললাম, ‘উনারা তো কারারুদ্ধ! আপনার কোন আদেশপত্র…’ তিনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘সে জন্যই তো তোমাকে পাঠাচ্ছি। ওরা আমার ওপর গোস্বা করে থাকতে পারে, তুমি ওদের মান ভাঙ্গিয়ে রাজি করাবে। সেনাপতিদের মনে ক্ষোভ বা অভিমান থাকলে ওরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে লড়াই করতে পারবে না। কেল্লাধিপতির এ আদেশের ওপর আর কোন কথা চলে না, তাই কোন লিখিত আদেশের জন্য আর তাকে চাপ দিতে পারিনি।’ দারোগার কন্ঠে দ্বিধা, ‘কিন্তু লিখিত আদেশ ছাড়া…’ শান্ত হলে কমান্ডোদের ইনচার্জ বললো, ‘দেখো, এটা যুদ্ধের সময়। আমাদের সেনাবাহিনী হলব ও মুশালের সৈন্যদের সাথে মিলিত হয়ে একযোগে সুলতান আইয়ুবীর ওপর আক্রমণ চালাবে। যদি আমরা সময় নষ্ট করি তবে সুলতান আইয়ুবী আমাদের ওপর আক্রমণ করে বসতে পারে। ভয় তো সেখানেই। তুমিও জানো, গুমাস্তগীন কি কারণে হলবে গিয়েছেন। আর এটাও জানো, এ দুই সেনাপতি ছাড়া আমাদের পক্ষে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। আমরা হলব থেকে ছুটে এসেছি এ দুই সেনাপতিকে জাতীয় মর্যাদায় গার্ড-অব-অনার দিয়ে নিয়ে যেতে। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না, আমাদের হাতে যুদ্ধের পতাকা! সেনাপতি ছাড়া এ জাতীয় পতাকার সম্মান কে রক্ষা করবে? বেশী কথা বলার সময় এটা নয়, তুমি যদি এ পতাকাকে অসম্মান করো, তার পরিণতির জন্য আমরা দায়ী থাকবো না। যা করার দ্রুত করো।’ দারোগা তাদেরকে ভিতরে নিয়ে গেল। ঘোড়া রেখে ওরা চললো সেই কারা কক্ষে, যেখানে সেনাপতিদ্বয় বন্দী আছেন। সাধারণ কারাবন্দীদের এলাকা পার হয়ে ওরা বিপদজনক কারাবন্দীদের জন্য সুরক্ষিত ও দুর্ভেদ্য কারাঞ্চলে প্রবেশ করলো। ভূগর্ভস্থ এ অঞ্চলের দুটি আলাদা কামরায় দুই সেনাপতি বন্দী আছেন। প্রথমে ওরা প্রবেশ করলো শামস বখতের কামরায়। দলনেতা তাঁকে সামরিক কায়দায় স্যালুট করে বললো, ‘হারানের আমীর গুমাস্তগীন আপনার মুক্তির আদেশ দিয়েছেন। আপনার ঘোড়া ও আপনার নিজস্ব রক্ষী আমার সঙ্গে পাঠিয়েছেন। আইয়ুবীর বিরুদ্ধে হলব, হারান ও মুশালের সম্মিলিত বাহিনীর অভিযানে অংশ গ্রহণের জন্য হারানের ফৌজ নিয়ে আপনাকে জলদি হলব যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলেছেন।’ ‘মনে হচ্ছে এখন তার মদের নেশা কেটে গেছে? আমি তো এ কথাই তাকে বুঝাতে চাচ্ছিলাম যে, সম্মিলিত জোটে আমাদের অংশ গ্রহণ করা দরকার আর যত দ্রুত সম্ভব আইয়ুবীর বিরুদ্ধে অভিযানে বের হয়ে যাওয়া দরকার। তিনি আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বললেন, ‘বেয়াদব, কি করতে হবে আমি বুঝবো। কোনটা দরকার আর কোনটা নয়, সেটা কি তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে?’ তা, এখন তিনি একাই যুদ্ধ করুন, আমাদের দরকার কি? আমরা কারাগারে কয়েকদিন বিশ্রাম করে নেই!’ কমান্ডার বললো, ‘দেখুন, এটা মান-অভিমানের সময় নয়। আমি মহামান্য দুর্গাধিপতির আদেশ নিয়ে এসেছি। আপনার কাছে এ আদেশ পৌঁছানো আমার দায়িত্ব ছিল, এখন কি করবেন সে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব আপনার।’

দারোগা তাদের কথোপকথন মনোযোগ দিয়ে শুনলো। এতে তার মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সন্দেহ সব দূর হয়ে গেল। সে এগিয়ে বললো, ‘আপনাদের মুক্তির আদেশ হয়ে গেছে, এখন আপনি মুক্ত।’ দারোগা কামরার তালা খুলে দিল। সেখান থেকে ওরা গেল সাদ বখতের কক্ষে। সেনাপতি সাদ বখত দলনেতাকে দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলো, ‘ও তুমি এসে গেছো? সব কিছু ঠিক আছে তো?’ দলনেতার পেছনে দারোগাকে সে লক্ষ করেনি। দারোগা বোকা বা গর্দভ ছিল না। তার সারাটি জীবন কেটেছে এই কারাগারে। সে এ কথার মর্ম ঠিক ঠিক উপলব্ধি করতে পারলো এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের বোকামীর কথা স্বরণ করে শিউরে উঠলো। দরোজা খোলার পরিবর্তে সে ফিরে আগত কমান্ডারকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘দুঃখিত, লিখিত আদেশ ছাড়া আমি এদের মুক্তি দিতে পারবো না।’ কমান্ডার তার হাতে থাবা মেরে তার হাত থেকে চাবির গোছা ছিনিয়ে নিল। তার দুই সঙ্গী দু’পাশ থেকে দারোগাকে চেপে ধরলো। দু’জনের হাতেই খঞ্জর বেরিয়ে এসেছে। তারা দারোগার পিঠে খঞ্জর ঠেকিয়ে তার কানে কানে বললো, ‘আমরা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর লোক। তুমি তো ভাল করেই জানো, সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনী কতটা কুশলী ও দক্ষ। জোরে শব্দ করো না, জানে মারা পড়বে।’ কমান্ডার দ্রুত চাবি ঢুকিয়ে তালা খুলে ফেললো। খোলা দরোজা দিয়ে বেরিয়ে এলো সাদ বখত। কমান্ডোরা দারোগাকে ঠেলে সেই খালি কামরায় এমন ভাবে ঢুকিয়ে দিলো, কেউ দেখলে ভাবতো, তিনি কক্ষ পরিদর্শনে ঢুকছেন। দারোগার সঙ্গে কমান্ডোরাও গিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তারা দারোগাকে দরজার আড়ালে নিয়ে গেল। এক কমান্ডো এমন জোরে দারোগার গলা পেঁচিয়ে ধরলো যে, দারোগার চোখ উল্টে গেল। ছটফট করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যে ঠান্ডা হয়ে গেল দারোগা। তাকে আস্তে করে কয়েদীরা যে বিছানায় শোয় সে বিছানায় লম্বা করে শুইয়ে দিলো। পরে লাশের ওপর কম্বল চাপিয়ে দিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে এলো কমান্ডোরা। তারা বাইরে বেরিয়ে এসেই দরজার তালা লাগিয়ে দিল। কেল্লার ফটকের চাবি দারোগার কাছেই ছিল, বেরোনোর আগে দারোগার পকেট হাতড়ে সে চাবি নিয়ে এসেছে। তালা মারা শেষ হলে এক সাথেই সব চাবি পকেটে পুরে গেটের দিকে রওনা দিল দলটি। ওরা কারাগারের ভূগর্ভস্থ সেল থেকে বের হয়ে এলো। কারাগারের ভূগর্ভস্থ সেলে আলাদা প্রহরী ছিল। ওরা নিজেদের ডিউটিতে ব্যস্ত থাকলেও দূর থেকেই দেখতে পেলো, কারাগারের দারোগা দুই কয়েদীকে মুক্ত করছে। কিন্তু বেরোনোর সময় দলের মধ্যে দারোগা আছে কিনা খেয়াল করেনি ওরা। দুই প্রহরী পালা করে সেলের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল। সেনাপতি সাদের কামরা অতিক্রমের সময় জানালা দিয়ে প্রহরী দেখতে পেলো এক কয়েদী কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। এটা দেখে সে খুব অবাক হলো! সে জানতো এ কামরায় সেনাপতি সাদ বন্দী আছেন। দারোগা নিজে এসে এইমাত্র তাকে মুক্ত করে নিয়ে গেল, তাহলে শুয়ে আছে কে? এ কামরায় তো আর কোন বন্দী ছিল না! সে শুয়ে থাকা কয়েদীর দিকে ভাল করে তাকালো। তার সর্বশরীর কম্বলে ঢাকা, এ জন্য তাকে চেনা যাচ্ছে না। প্রহরী এবার গিয়ে উঁকি দিল শামস বখতের কামরায়। এ কামরায় কেউ নেই, সম্পূর্ণ খালি। সে আবার ফিরে এলো সাদ বখতের কামরার সামনে। কম্বলে ঢাকা কয়েদীর দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে ডাকলো, কিন্তু কয়েদী কোন সাড়া দিল না।

কামরায় তালা লাগানো। প্রহরী জানালার ফাঁক দিয়ে বর্শা ঢুকিয়ে দিয়ে কয়েদীকে খোঁচা দিল, তাতেও কয়েদী সাড়া না দেয়ায় প্রহরী বর্শার মাথা দিয়ে কম্বল সরিয়ে ফেললো। কম্বল সরে যেতেই কয়েদীর মুখ দেখে ভয়ে সে এমন জোরে চিৎকার দিল যে, সে চিৎকার ভূগর্ভস্থ কারাগারের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুললো। বিস্ফোরিত চোখে সে কারাগারের দারোগার সদ্য মৃত লাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। অন্য প্রহরী চিৎকার শুনে ছুটে এলো সেখানে। সে এ দৃশ্য দেখে সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার শুরু করলো, ‘সাবধান! সাবধান! কে কোথায় আছো সাবধান হও সবাই। কারাগারের কয়েদী পালিয়েছে।’ দুই প্রহরী ডিউটি ফেলে পালিয়ে যাওয়া কয়েদীদের ধরার জন্য ছুটলো উপরের দিকে। সেই সাথে চলতে লাগলো হাঁকডাক ও চিৎকার। সাথে সাথে সমগ্র কারাগারে বেজে উঠলো বিপদ সংকেত। ভয়ংকর শব্দে বেজে চললো পাগলা ঘন্টা। দুই সেনাপতিসহ কমান্ডো দলটি তখন গেটের কাছে পৌঁছে গেছে। প্রহরীরা ছুটলো ওদের পেছনে। মেইন গেটের চাবী তখন কমান্ডো দলের কমান্ডারের কাছে। সে জীবনের মায়া ত্যাগ করে সর্বশক্তি দিয়ে ছুটলো গেটের দিকে। কারণ, সে জানে, তালা খুলে একবার বাইরে যেতে পারলে বাঁচার তবু একটু আশা আছে, কিন্তু ভেতরে ধরা পড়ে গেলে নিজেদের মরণই শুধু ডেকে আনা হবে না, সেই সাথে এ দুই সেনাপতির মুক্তির আশাও চিরতরে ত্যাগ করতে হবে। গেটে পৌঁছে গেল কমান্ডার, তালার ভেতর চাবি ঢুকিয়ে চাপ দিল। ছুটন্ত প্রহরীরা তখনো চিৎকার করে বলছে, ‘ধরো, ধরো, কয়েদীরা পালিয়ে যাচ্ছে, গ্রেফতার করো ওদের। ওরা দারোগাকে হত্যা করে পালাচ্ছে!’ পাগলাঘন্টির আওয়াজে নরক গুলজার হয়ে উঠেছিল কারাগার। সমস্ত প্রহরী হাতের কাজ ফেলে ছুটছিল পাগলের মতো। পাচিলের ওপর যারা ডিউটি দিচ্ছিল, তারা লাফিয়ে নামলো নিচে। বাইরে যেসব গার্ড ছিল তারা ভেতরে কি ঘটছে জানার জন্য জমা হচ্ছিল গেটে। কেউ কেউ গেট খোলার জন্য বাইরে থেকে গেটে থাপ্পড় দিচ্ছিল। এই মহা হুলুস্থুলের মধ্যে দরজা একটু ফাঁক হতেই বাইরের গার্ড ও সৈন্যরা হুড়মুড় করে ঢুকতে শুরু করলো কেল্লার ভেতর। তাদের ধারনা, হয়তো কারাকক্ষের কয়েদীদেরা বিদ্রোহ করেছে, নয়তো কোথাও আগুন লেগেছে। যে সব প্রহরী ও গার্ড বাইরে থেকে হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করছিল সেই ভিড়ের মধ্যে পলাতক কমান্ডো ও দুই সেনাপতি হারিয়ে গেল এবং ভিড়ের ঠেলাঠেলির মধ্য দিয়েই তারা নিরাপদে বাইরে বেরিয়ে যেতে সমর্থ হলো। গেটের বাইরেই তাদের ঘোড়াগুলো বাঁধা ছিল। তারা ঘোড়ার উপরে আরোহণ করে রওনা করতে যাবে, এক টহল প্রহরীর নজরে পড়ে গেল তারা। প্রহরী তাদের সতর্ক করে বললো, ‘কে তোমরা? থামো, নইলে মারা পড়বে!’ তারা প্রহরীর দিকে এক পলক তাকিয়েই ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। প্রহরী তাড়াতাড়ি ধনুকে তীর জুড়ে পলায়নপর লোকদের দিকে তীর বর্ষণ শুরু করলো। দু’টি তীর এক কমান্ডোর পিঠে বিদ্ধ হয়ে গেল, আর এক তীর বিদ্ধ হলো সেনাপতি শামস বখতের অশ্বের পিছনে। তীরবিদ্ধ কমান্ডো পিঠে দু’টি তীর নিয়েও নিজেকে কোনমতে সামলে নিয়ে ছুটে চলা অব্যাহত রাখলো। সেনাপতি শামস বখতের অশ্ব তীর খেয়ে পাগলের মত ছুটলো আর লাফাতে লাগলো। সেনাপতি শামস বখত ঘোড়াকে নিয়েন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু ঘোড়ার উল্টাটাল্টা লাফানো থামাতে পারলেন না। বহু কষ্টে তিনি তার ঘোড়াকে আহত কমান্ডোর ঘোড়ার পাশে নিয়ে গেলেন এবং দ্রুত লাফিয়ে নিজেকে কমান্ডোর ঘোড়ার উপর ছুঁড়ে দিলেন। কমান্ডো সামনের দিকে ঝুঁকে গেল। সেনাপতি শামস বখত তার হাত থেকে ঘোড়ার লাগাম টেনে নিয়ে পিছনে বসেই তীব্র গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা প্রহরীর তীরের আওতার বাইরে শুধু নয়, দৃষ্টিরও আড়ালে চলে যেতে সক্ষম হলো। সেনাপতি পিছনে তাকালেন। কারাগার থেকে অনেক দূরে চলে এসেছেন তারা। কিন্তু তিনি লক্ষ করে দেখলেন, কারাগারের দিক থেকে দশ বারটি ঘোড়া ছুটে আসছে। এখনো তারা বেশ দূরে, তবে তীব্র গতিতে ছুটে আসছে ওরা। একেবারেই খোলামেলা ও উন্মুক্ত প্রান্তরে ছিল ওরা। আশেপাশে লোকালয়, পাহাড় বা এমন কোন জায়গা নেই যেখানে লুকানো যায়। উপায়ান্তর না দেখে তারাও প্রাণপণে ঘোড়া ছুটালেন। তাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র খুব অল্প। দুই সেনাপতিই নিরস্ত্র, এক কমান্ডো এরই মধ্যে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পড়েছে। সে আর মোকাবেলা করার মত অবস্থায় নেই, যে কোন মুহুর্তে শহীদ হয়ে যেতে পারে। অবিরাম ছুটছে কাফেলা। প্রাণপণে, উর্ধশ্বাসে। পেছনে সমান তাল ছুটে আসছে ধাওয়াকারীরা। অনেকক্ষণ হয়ে গেল, উভয়ের মাঝে দূরত্ব কমছেও না, বাড়ছেও না। দু’দলই মারিয়া হয়ে ছুটছে।

হঠাৎ সেনাপতির চোখের সামনে দূরে পাহাড় শ্রেণী ও টিলার সারি ভেসে উঠলো। তিনি সবাইকে উৎসাহিত করার জন্য বললেন, ‘বন্ধূরা! আরো জোরে! ওই দেখো পাহাড় দেখা যাচ্ছে!’ এক সময় ওরা এসে পৌঁছলো সেই পাহাড়ের পাদদেশে। ক্লান্ত, শ্রান্ত। শরীরের পেশীগুলো কোন ঘোষনা না দিয়েই যেনো ঘুমিয়ে পড়তে চাচ্ছে। কিন্তু ঘুমালে তো চলবে না, পেছনে তাড়া করে ছুটে আসছে দুশমন। সেনাপতি শামস বখত সবাইকে শুনিয়ে বললেন, ‘সবাই এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ো। একা একা লুকিয়ে যাও।’ তারা সবাই ছিল সুশিক্ষিত কমান্ডো যোদ্ধা। পিছু ধাওয়াকারীরা এখনো অনেক দূরে। সময় নষ্ট না করে ওরা একে অন্যের থেকে পৃথক হয়ে পাহাড়ের গোপন স্থানে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘোড়াগুলোও ওরা গোপন জায়গায় লুকিয়ে ফেললো। এখন কেউ পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়ালে, একটু আগে এখানে কোন মানুষ বা ঘোড়া ছিল সে কথা কল্পনাও করতে পারবে না। দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়েছিল ওরা। শিকারী বাঘের মত নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিল দুশমনের জন্য। বেশী সময় লাগলো না, কিছুক্ষণের মধ্যেই ধাওয়াকারীরা সেখানে পৌঁছে গেল। কিন্তু তারা এদিক ওদিক দৃষ্টি বুলিয়ে কোন মানুষ বা ঘোড়ার সন্ধান পেলো না। ওদের কমান্ডার একবার ভাবলো, পাহাড়ে তল্লাশী চালায়, কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো, এরা আইয়ুবীর সুশিক্ষিত কমান্ডো বাহিনী। এদের খুঁজে পাওয়া কোন সহজ ব্যাপার নয়! বরং একবার ওদের নাগালে চলে গেলে জীবন নিয়ে ফিরে যাওয়াও হয়তো সম্ভব হবে না কোনদিন। তার মনে পড়লো, আইয়ুবীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কমান্ডো বাহিনী প্রতিপক্ষের বিশাল বাহিনীকে তছনছ করে দিয়েছে, এমন ঘটনা অতীতে বহুবার ঘটেছে। তার ওপর তাদের সাথে আছেন গুমাস্তগীনেরই দুই জাদরেল সেনাপতি। এ অবস্থায় আর সামনে অগ্রসর হওয়া হবে নিছক বোকামী। তারা মনোবল হারিয়ে হতবিহবল চিত্তে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। শেষে কমান্ডার বললো, ‘আর এগিয়ে কাজ নেই। ওদের নাগাল আমরা কোনদিনই পাবো না।’ ওরা ওখান থেকে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে চললো কারাগারের দিকে। হলবের বাইরে এক স্থানে তিন প্রদেশের মুসলিম আমীরদের কনফারেন্স হচ্ছে। বৈঠক শেষ হলো সুলতান আইয়ুবীর ওপর আক্রমণের প্ল্যান চূড়ান্ত করে। বেশীর ভাগ প্ল্যান-পরামর্শ দিল খৃস্টান উপদেষ্টারা। সিদ্ধান্ত হলো, আক্রমণের জন্য গুমাস্তগীনের বাহিনী সামনে থাকবে। তার পাশে সাহায্যকারী হিসেবে থাকবে হলবের সৈন্য বাহিনী। প্রথম আক্রমণ করার পরে সুলতান আইয়ুবীর প্রতি আক্রমণের আঘাত সামাল দিতে এগিয়ে যাবে সাইফুদ্দিনের বাহিনী। কিন্তু সাইফুদ্দিন এলাকায় ফিরে গিয়ে নিজের পূর্ব সিদ্ধান্তে অটল রইল। সে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে তার বাহিনীকে দুই ভাগ করে এক অংশ তার ভাই আজুদ্দিনের অধীনে ছেড়ে দিল। সম্মিলিত কমান্ডকে প্রতারণা করে বললো, ‘এটা সংরক্ষিত বাহিনী। এদেরকে সংকট মুহুর্তে ব্যবহার করা হবে।’ এদিকে তার ভাইকে বললো, ‘তুমি হলব ও হারানের সেনাবাহিনীর অবস্থা লক্ষ্য করে সামনে অগ্রসর হবে। যদি যুদ্ধের অবস্থা আমাদের প্রতিকূলে যায়, তবে আমাদের সৈন্যদেরকে মুশালে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। ওদের নিয়ে তুমি মুশালের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করবে। আর যদি আক্রমণে অংশ নিতে হয় তবে আমাদের স্বার্থ কিভাবে রক্ষা করা যায় সেদিকে লক্ষ রাখবে।’

রমজান শুরু হয়ে গেল। সম্মিলিত বাহিনী সিদ্ধান্ত নিলো, যুদ্ধের সময় রোজার কোন প্রয়োজন নেই। চতুর্থ রমজানে তিন বাহিনীর সৈন্যরা নিজ নিজ শহর ছেড়ে সমরাঙ্গণের দিকে অগ্রসর হলো। তাদের সকলের টার্গেট হিম্মাতের পর্বতশ্রেণী। হিম্মাতের অনতিদূরে সকলের মিলিত হওয়ার কথা। সবাই এসে জড়ো হওয়ার পর পরিকল্পনা অনুযায়ী শুরু হবে আক্রমণ। এ অভিযান শুরু হওয়ার দু’দিন আগে সুলতান আইয়ুবী তাঁর সৈন্য সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ দেখছিলেন। এ সময় তার কাছে সংবাদ পৌছে, ‘হারান থেকে সেনাপতি শামস বখত ও সাদ বখত এসে পৌঁছেছেন। তাদের সাথে একটি লাশও রয়েছে।’ সুলতান আইয়ুবী ঘোড়া ছুটিয়ে সেখানে গেলেন। অশ্ব থেকে লাফিয়ে নেমেই দুই সেনাপতিকে আলিঙ্গন করলেন। পরে দুই কমান্ডোর সাথেও আলিঙ্গন করলেন। এ দুই কমান্ডো ছিল প্রসিদ্ধ দুই গোয়েন্দা অফিসার। সাহসী ও চৌকস গোয়েন্দা হিসাবে তাদের জুড়ি মেলা ভার। দীর্ঘদিন ধরে ওরা গুমাস্তগীনের সেনা দলে কাজ করছিল। কোলাকুলি শেষ করে সুলতান লাশের পাশে গেলেন। মুখের কাপড় সরিয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর লাশের গালে চুমো খেয়ে এক অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এ লাশ দামেশকে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। ‘জান্নাতুস শোহাদায়’ স-সম্মানে একে দাফন করা হবে।’ ‘মুহতারাম সুলতান! আপনি আর রিস্তানের পর্বত শৃঙ্গে বসে আছেন কেন? যুদ্ধের ব্যাপারে কি চিন্তা করছেন?’ সেনাপতি শামস বখত তাঁর কাহিনী শোনানোর আগে যুদ্ধের কথা শুরু করলেন। ‘আমি মিশর থেকে সৈন্য সাহায্য আসার অপেক্ষা করছি।’ সুলতান আইয়ুবী বললেন, ‘গতরাতে সংবাদ পেয়েছি, আজই সাহায্য এসে পৌঁছে যাবে। কায়রো থেকে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হলো বলে ওদের অনেক সময় লেগে গেল।’ এরপর সেনাপতিদের নিয়ে বসলেন সুলতান। তাদেরকে বিস্তারিত ভাবে জানালেন এখানকার সৈন্য সংখ্যা ও সৈন্যদের প্রস্তুতি সম্পর্কে। সেনাপতিদের কাছ থেকে জেনে নিলেন হারানের যুদ্ধ পস্তুতির খবর। সেই দিনই বিকেল বেলা। সুলতান আইয়ুবী সমস্ত সেনা কমান্ডারদের ডাকলেন এবং দুই সেনাপতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাদের। পুরাতন সামরিক অফিসারগণ সেনাপতি শামস বখত ও সাদ বখতকে কাছে পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠলো। তাদের অধিকাংশই এ দুই ব্যক্তিত্বের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এ দু’জনকে ওরা কেবল শ্রদ্ধাই করতো না, ভালও বাসতো। সুলতান আইয়ুবী দুই সেনাপতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এসব কমান্ডারকে বলো, দুশমন যুদ্ধের কি প্রস্তুতি নিয়ে আসছে। তাদের আক্রমণের ধারা কেমন হবে। শত্রু সেনারা কতটা আঘাত হানতে পারবে। তাদের সামরিক যোগ্যতা, দক্ষতা কেমন এবং ঈমানী বল কেমন?’ সেনাপতি শামস বখত বললেন, ‘মুজাহিদ কমান্ডার ভাইয়েরা! সৈন্য সব সময়ই সৈনিক থাকে। শত্রুদেরকে কমজোর ও আনাড়ী মনে করার কোন কারণ নেই। আমাদের এ কথা ভুললে চলবে না, যে শত্রুরা আমাদের মোকাবেলায় আসছে তারাও মুসলমান। আমাদের মত তারাও যদ্ধের ময়দানে পিঠ দেখানোর শিক্ষা পায়নি। সৈনিকদের মধ্যে ইসলামী চেতনা এবং জেহাদী জযবাও আছে। তাদেরকে বুঝানো হয়েছে, সুলতান আইয়ুবী রাজ্যলিপ্সু এবং খেলাফতের দুশমন। সুতরাং তার বিরুদ্ধে জেহাদ করা ফরজ। পরে তারা পূর্ণ শক্তি দিয়েই যুদ্ধ করবে। তাদের মন-মগজে আরো ধারনা দেয়া হয়েছে, সুলতান আইয়ুবীর সৈন্য অর্থাৎ আপনারা পশুর মত জংলী ও নারী শিকারী। এভাবেই খৃস্টান উপদেষ্টারা তাদেরকে আপনাদের চরম দুশমন বানিয়ে নিয়েছে। শত্রুর মনে আপনাদের ব্যাপারে তাই বিরাজ করছে প্রচন্ড ঘৃণা।’ সাদ বখত বললেন, ‘তবে আশার কথা হচ্ছে, তারা তিনটি নেতৃত্বে বিচ্ছিন্ন থাকবে।

যতদূর জানি, এ তিন নেতার কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। ওরা আমাদের তৎপরতার দিকে যেমন নজর রাখবে, তেমনি নজর রাখবে পরষ্পরের প্রতি। তিনটি দলের নেতাই যুদ্ধে নামছে নিজের আধিপত্য বিস্তারের জন্য। ব্যক্তি স্বার্থটাই তাদের কাছে বড় কথা। সাইফুদ্দিন ও গুমাস্তগীন দু’জনই নিজের স্বার্থ ও ক্ষমতার নেশায় যুদ্ধ করতে আসছে। এসব সেনাপতির কাছে জীবনের মূল্য অনেক বেশী। কিন্তু সুলতান আইয়ুবীর নেতৃত্বে আমরা যারা ময়দানে নামবো, আমাদের অবস্থা হবে ভিন্ন। জেহাদের ময়দানে আমরা যতটা নির্ভয় ও বেপরোয়া, আমাদের নেতা তারচে অধিক ক্ষিপ্রতা ও দুঃসাহসের সাথে আমাদের পরিচালনা করবেন। জীবন ও মৃত্যুর ফায়সালা জমীনে নয়, আসমানে হয়, এ কথা তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আশা করা যায়, দুশমন সঠিক পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারবে না। যে বাহিনীর সেনাপতিরা জান বাঁচানোর জন্য পেরেশান থাকবে, সে বাহিনীর সৈন্যরা কিছুতেই জান কবুল হয়ে লড়াই করতে পারবে না। তবুও আপনাদেরকে খুব সাবধান হয়ে যুদ্ধ করতে হবে। এবার ওদের যুদ্ধের পরিকল্পনা শুনুন। ওরা আপনাদেরকে এই পাহাড়ী অঞ্চলে অবরোধ করে মারতে চায়। বিজয়ের সম্ভাবনা না দেখলে খৃস্টানরা ওদের সহায়তায় এগিয়ে আসবে না। রিমান্ডের পলায়নে ওদের মনে ভীতি ঢুকে গেছে আপনাদের সম্পর্কে। তাই ওরা সামনে আসতে চায় না। ওদের অবরোধের পরিকল্পনা থেকেই বুঝা যায় জানের মায়া ওদের কত বেশী। ওরা নিজেদের প্রাণ ক্ষয় না করেই যুদ্ধের জয় চায়। বন্ধুরা, আমি আগেই বলেছি, ওরা তিন বিচ্ছিন্ন দল এগিয়ে আসছে ঐক্যবদ্ধভাবে, কিন্তু এ ঐক্যের পাশাপাশি পরষ্পরকে নিয়ে ওদের মনে আছে শঙ্কা, সংশয় ও সন্দেহ। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সংশয় যে বাহিনীর সঙ্গী হয় কোনদিন সে বাহিনী জয়ের মুখ দেখতে পারে না।’ সাদ বখতের বক্তব্য তখনও শেষ হয়নি, দূরে কয়েকটি ঘোড়া দেখা গেল। পূর্ণগতিতে তারা ছুটে আসছে আর রিস্তানের দিকে। সাদ বখত কথা থামিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। অন্যরাও তাকালো সেদিকে। একটু পর। ঘোড়া থেকে নেমে এলেন খতিব ইবনুল মাখদুম, তার কন্যা সায়েকা, কারাগারের দারোগা ও একজন গোয়েন্দা। সুলতান আইয়ুবী খতিবকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁকে পরামর্শ সভায় যুক্ত করে নিয়ে বললেন, ‘মাননীয় খতিব, আল্লাহর শোকর আপনারা এসে পড়েছেন। আমরা দুশমনের তৎপরতা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। মুশালে কি রকম সামরিক তৎপরতা চলছে আমাদের জানা দরকার। আপনি দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত। আপনি কি এখন একটু বিশ্রাম নেবেন, না এই অফিসার ও কমান্ডোদের সামনে বলবেন, ওখানে কেমন সামরিক তৎপরতা চলছে?’ খতিব বিন্দুমাত্র বিশ্রামের ধার ধারলেন না। তিনি বললেন, ‘মাননীয় সুলতান, আমার কোন বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। মুশালের যুদ্ধ প্রস্তুতি জানতে চাচ্ছেন? তাহলে শুনুন, মুশালের আমীর এমন এক ব্যক্তি, যে ফালনামা দেখে সিদ্ধান্ত নেয় এবং নারী ও মদ ছাড়া যার সময় কাটে না। এ আমীর কেমন করে তার সৈন্য পরিচালনা করবে?’

খতীব উপস্থিত কমান্ডোদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘মুজাহিদ ভাইয়েরা আমার! যার বুকে ঈমানের লেশ নেই সে যুদ্ধক্ষেত্রে বেশীক্ষণ টিকতে পারে না। মুশালের আমীর আমাকে ডেকে নিয়ে বললো, খতীব সাহেব, এ যুদ্ধে আমি সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করবো, নাকি পরাজিত হবো ফালনামা দেখে আমাকে বলে দিন।’ আমি তাকে বললাম, ‘তোমার এ পদক্ষেপ যেহেতু কোরআনের নির্দেশের বিরুদ্ধে, অতএব তোমার পরাজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। তোমার বাঁচার একটাই উপায়, হয় তুমি মুজাহিদদের সাথে মিশে যাও, নইলে ওদের পথ থেকে সরে দাঁড়াও।’ এ অপরাধে সে আমাকে কারাবন্দী করলো। সে কোরআনকে জাদুর কিতাব মনে করে। আমি আপনাদের কোরআনের কেরামতির কথা শোনাবো, কারণ কোরআনই আমাকে মুশালের কারাগার থেকে বের করে এখানে পৌঁছে দিয়েছে।’ এরপর তিনি তার মুক্তির কাহিনী বর্ণনা করলেন। বললেন, ‘সাইফুদ্দিন আমার মেয়েকেও ছিনতাই করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমার বেটিকেও আল্লাহ তার কুদরতি হাতে রক্ষা করেছেন। তাই আমি আপনাদের বলতে চাই, যদি আপনারা কোরআনের নির্দেশের ওপর অটুট থাকেন, আর জিহাদকে ধর্ম ও জাতির স্বার্থে অব্যাহত রাখেন, তবে বিজয় এসে আপনাদের পায়ে চুমু খাবে। তবে আমি মাননীয় সুলতানের কাছে একটি পরামর্শ রাখতে চাই। আমি জানি, আমাদের প্রতিপক্ষ যে তিনটি শক্তি একজোট হয়ে লড়াই করতে আসছে তারা কেউ কাফের নয়। ওখানকার অধিকাংশ সৈনিককে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। ক্ষমতার মোহে অন্ধ আমীররা সুলতানের নামে মিথ্যা অপবাদ রটিয়ে সুলতানকে ওদের সামনে উপস্থিত করেছে ইসলামের দুশমন হিসাবে। ফলে ওরা আমাদের নয়, ইসলামের দুশমনকে পরাস্ত করার জন্য জিহাদের জযবা নিয়ে ময়দানে আসছে। ওদের এ ভুল ভাঙ্গানোর কোন উপায় এখন নেই। আমাদের উচিত হবে, যত কম সংখ্যক লোক ক্ষয়ের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে আনা। সত্য উদ্ভাসিত হলে ওদের অনেকেই সপক্ষ ত্যাগ করে আমাদের কাতরে এসে শামিল হবে। এ অবস্থায় সরাসরি লড়াই যত কম করা যায় ততই মঙ্গল। কমান্ডো আক্রমণই এখনকার যুদ্ধ পলিসি হওয়া উচিত। কিন্তু এ পলিসি চালু রেখে ওদের এমনভাবে ব্যতিব্যস্ত রাখতে হবে, যেন তারা রাতে শান্তিতে ঘুমাতে না পারে।’

কারাগারের যে দারোগা খতীবকে মুক্ত করতে সাহায্য করেছিল, খতিবের পরামের্শ তাকে সেনাবাহিনীতে যুক্ত করে দেয়া হলো। সুলতান আইয়ুবী পরদিন খতিবকে এবং তার মেয়ে সায়েকাকে দামেশকে পাঠিয়ে দিলেন। মিশর থেকে আসা ফৌজের দায়িত্ব তুলে দেয়া হলো সেনাপতি শামস বখত ও সাদ বখতের হাতে। আরেকটি ব্যাপক সংঘাত ও সংঘর্ষের মোকাবেলা করার জন্য এখন মুজাহিদরা পূর্ণ প্রস্তুত।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 4 | 5 | 6 | 7 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top