১৩. পাপের ফল

এই খতীব আপনার প্ল্যান ও সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে আমাদের সামনে আপনাকে অপমান করবে, এটা আমরা কিছুতেই বরদাশত করতে পারি না।’ ‘আমাকে তার কথা শুনতে দাও।’ সাইফুদ্দিন বললেন, ‘আমি সম্মানিত খতীবকে এখনও সম্মানের চোখেই দেখছি।’ ‘বলে যান সম্মানিত খতীব!’ আজিম উদ্দিন ব্যঙ্গ করে বললো, ‘তারপরে আপনাকে এ কথাও বলতে হবে, আপনার আনুগত্য কার প্রতি? আমাদের, না সালাহউদ্দিনের প্রতি?’ ‘আমার আনুগত্য একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূলের প্রতি!’ খতীব আজিম উদ্দিনের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘আমি আপনার প্রশংসা করছি, আপনি বরং আপনার ভাইকে বাস্তবতা ও সত্য অনুধাবনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন। যদিও এরপরই আপনিও আপনার চোখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সত্য থেকে। ইমাদুদ্দিনও আপনাদের ভাই। কখনও কি চিন্তা করেছেন, কেন তিনি সালাহউদ্দিনের সহযোগী হয়েছেন? কেন তিনি আপনার সাহাোয্য এগিয়ে আসেন না? অথচ তার তো আপনাদেরই সহযোগীতা করা উচিত ছিল।’

‘আপনি আমাদের বংশ ও আত্মীয়তায় হস্তক্ষেপ করতে যাবেন না।’ আজিম উদ্দিন বললো, ‘আসলে আপনি আমাদের কাছে প্রমাণ করতে চান, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ! আমাদের সকলেই তাঁর কাছে মাথা নত করতে হবে। কিন্তু আপনার কাছে শুধু জানতে চাওয়া হয়েছিল, এস্তেখারা করে আপনি আমাদের মিশরের সফলতা ও ব্যর্থতা সম্পর্কে আপনার মতামত পেশ করবেন!’ ‘আমার মতামত তো আমি বলেই দিয়েছি।’ খতীব বললেন, ‘যদি আমার কথা আপনারা বুঝে না থাকেন, তবে আরো স্পষ্ট করে বলছি, শুনুন! সালাহউদ্দিন আইয়ুবী আল্লাহ প্রেরিত কোন নবী বা রাসূল নন! তিনি বর্তমান যুগের এক তুফান! এক সাইক্লোন! মরুভূমির তিনি এক অশান্ত সাইমুম! দামেশকের মাটি থেকে উত্থিত এ মরু ঝড় কুফরীর শুষ্ক ঘাস পাতাই শুধু উড়িয়ে নিয়ে নীল নদে ফেলবে না, মূলসহ কুফরীর সকল বৃক্ষই উপড়ে ফেলবে। গাছ থেকে সব ডালপালা, পত্র পল্লব ছিন্ন বিছিন্ন করে উড়িয়ে নিয়ে যাবে নীল নদে।

সুলতান আইয়ুবী আপনাদের ওপর আক্রমণ করেননি। আপনারাই সেই ঝড়ের মুখে সেচ্ছায় ছুটে যেতে চাচ্ছেন! বুঝতে চেষ্টা করছেন না, ঝড় কাউকে রেহাই দেয় না। এ ঝড়ের কবলে পড়লে আপনাদেরও সেই দশা হবে, যে পরিণতি হবে কুফরী শক্তির।’ ‘খতীব!’ সাইফুদ্দিন গর্জন করে বললেন, ‘আমার মন থেকে আপনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মান উঠিয়ে নিবেন না!’ ‘তুমি……..সাইফুদ্দিন!’ খতীব তাঁর স্বর আরো বলিষ্ঠ করে উচ্চ কন্ঠেই বললেন, ‘তুমি এই প্রথিবীর ছোট্ট একটি আঞ্চলের সামান্য এক শাসক! আমাকে সম্মান দেখানোর কোন প্রয়োজন নেই, তুমি দোজাহানের সেই বাদশাহকে ভয় করো, যিনি তোমাকে এই ক্ষমতা প্রদান করেছেন। আমার কথায় মনে কষ্ট পেলে আমার মুখে থুতু নিক্ষেপ করো। তাতেও রাগ না কমলে আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করো। কিন্তু রাসূলের(সা.) আদর্শ ও দ্বীন থেকে সরে যেও না।

রাজ্য ও ক্ষমতার লোভ তোমার ওপর চেপে বসেছে। এই স্বার্থপর চাটুকার সেনাপতি ও তোমার সরকারের বড় বড় অফিসাররা তোমাকে খুশী করার জন্য তোমকে বাদশাহ বলে! কিন্তু তুমি বুঝতে পারছো না, এটা শুধু তোষামোদ ছাড়া আর কিছু নয়! তোমার জানা উচিত, এই চাটুকাররা তোমার বন্ধু নয়। এরা তোমার শত্রু! দেশের শত্রু! জাতির শত্রু! যখন তোমার ক্ষমতা থাকবে না তখন এই তোষামোদী দল তোমাকে চিনবেও না। বরং তোমার স্থলে যে ক্ষমতায় আসবে, ওরা তারই পা চাটবে। দেখো সাইফুদ্দিন, আমাকে ভুল বুঝো না, আমাকে তোমার শত্রু ভেবো না। ভুলের নৌকায় পা দিয়ে তোমার মহলকে দোজখ বানিয়ে নিও না। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নাও, অতীতে এ রকম ভক্ত চাটুকাররা বহু প্রতাপশালী বাদশাহকে ফকির বানিয়ে দিয়েছে। অতীতে যেমন এ রকম ঘটনা ঘটেছে, হয়তো ভবিষ্যতেও ঘটবে। আমার চিন্তা শুধু তোমাকে নিয়ে। তাদের খপ্পড়ে পড়ে তুমি ধ্বংস হয়ে যাও, এ আমি চাই না।

আফসোস! আজ রাসূলের(সা.) উম্মতরা এক ধ্বংসাত্মক পথে অগ্রসর হচ্ছে। তুমি ভুল করলে, তোমার মত বাদশাহকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে তবেই এ তুফান থামবে।’ ‘নিয়ে যাও একে আমার সম্মুখ থেকে।’ সাইফুদ্দিন রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘একে এমন জায়গায় বন্দী করো, যেখান থেকে এর চিৎকারের আওয়াজ আমার কানে না আসে।’ ক্রুদ্ধ এক সেনাপতি দরজায় দাঁড়ানো রক্ষীকে ভেতরে ডাকলে। কামরায় উচ্চকন্ঠের তর্কাতর্কি শুনে রক্ষী তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, ডাক পেয়েই দ্রুত সে ছুটে ভেতরে ঢুকলো। সেনাপতি তাকে বললো, ‘এই খতীবকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যাও।’ রক্ষীরা সম্মানিত খতীবকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে চললো। কিন্তু খতীব থামলেন না, তিনি তখনো চিৎকার করে বলছিলেন, ‘সাইফুদ্দিন এখনো সময় আছে, ধ্বংসের পথ থেকে ফিরে এসো! ক্ষমতার নেশায় নিজের ঈমান, আমল ও ধর্মকে বিসর্জন দিও না! তোষামোদপ্রিয় ব্যক্তি দেশ এবং জাতিকে বেঁচে খায়। কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করো না। বন্ধুবেশী কাফের শত্রুর চেয়েও মারাত্মক! ফিলিস্তিন আমাদের! ফিলিস্তিন আমার প্রিয় রাসূলের! আল্লাহর ওয়াস্তে জিল্লতির হাত থেকে বাঁচাও জাতিকে!’

রক্ষীরা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কারাগারের দিকে আর তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, ‘কাফেররা তোমাদেরকে পরষ্পরের বিরুদ্ধে এ জন্য লাগিয়ে দিচ্ছে, যাতে তোমরা নিজেরা যুদ্ধে জড়িয়ে প্রিয় ফিলিস্তিনের কথা ভুলে যাও। ফিলিস্তিনে তাদের আধিপত্য স্থায়ী ও প্রতিষ্ঠিত রাখার এ এক মহা চাল! তোমরা যদি পরষ্পর লড়াই করতে থাকো, বাইতুল মুকাদ্দাস তেমাদের ওপর অভিশাপ দিতে থাকবে।’ খতীব আল মাখদুম কাকবুরী যখন চিৎকার করে এসব বলছিলেন আর সৈন্যরা তাকে টেনে কারাগারে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন এ দৃশ্য দেখে শহরের লোকজন রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে গেল। চিৎকার শুনে বহু সৈন্য ব্যারাক ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো, তাদের সকলের প্রিয় ও সম্মানিত খতীবের দুর্দশা ও দুর্গতির এক অভাবিত দৃশ্য! মুহুর্তের মধ্যে খতীবের গ্রেফতারীর সংবাদ সমস্ত মুসালে ছড়িয়ে পড়লো।

সাইফুদ্দিনের লোকজন রটিয়ে দিল, ‘খতীব আল মাখদুম পাগল হয়ে গেছেন। তাকে পাগলা গারদে বন্দী করে রাখা হয়েছে।’ এ সংবাদ এক সময় খতীবের বাড়িতেও গিয়ে পৌছলো। বাড়িতে খতীবের যুবতী এক কন্যা ছাড়া আর কেউ ছিল না। বাপ-বেটির ছোট্ট সংসার খতীবের। স্ত্রী মারা গেলে একমাত্র মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আর বিয়ে করেননি। তিনি তার মেয়ের সেবা যত্নেই বেঁচে আছেন, মেয়েও বাবার আদরে বেঁচে আছেন। দেখলে মনে হয় ওরা বেঁচে আছে শুধু একে অন্যের জন্য। শহরের বহু গণ্যমান্য মহিলা ছুটে এলো খতীবের বাড়িতে মেয়েকে সান্তনা দিতে। কারণ খতীব ছিলেন সকলের কাছেই খুব প্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। মহিলারা মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো, ‘হঠাৎ করে তোমার বাবার এমন কি হলো? সত্যি কি তিনি পাগল হয়ে গেছেন?’ ‘হ্যাঁ!, এমনটিই হওয়ার কথা ছিল!’ মেয়েটি বললো, ‘এমনটিই হওয়ার কথা ছিল!’

তার মধ্যে কোন আফসোস ও ভয়ের চিহ্ন ছিল না। শান্ত ও সমাহিত কন্ঠে সে সবার প্রশ্নের জবাবে বার বার শুধু বলছিল, ‘হ্যাঁ! এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল!’ মুসালের খতীবকে কারাবন্দী করা হলো। ওদিকে হারান দূর্গে গুমাস্তগীন তার দুই সেনাপতি শামস বখত ও সাদ বখতকে কারাগারে বন্দী করে রেখেছে। গুমাস্তগীন এই প্রথম জানতে পারলো, তার দুই সেনাপতিই সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর লোক, তাঁর বিশ্বস্ত ও ঝানু গোয়েন্দা ছিল। রাতে কারাগারে এল গুমাস্তগীন। শামস বখত ও সাদ বখতকে তাদের কামরা থেকে বের করে জেরা করার জন্য নির্যাতন সেলে নিয়ে গেল। সেখানে দু’জন লোককে আগে থেকেই লটকে রাখা হয়েছিল। শক্ত রশিতে দুই হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ওদের। পা মাটি থেকে দু’ফুট উঁচুতে। প্রতিটি পায়ের সাথে দশ সের ওজনের লোহা বাঁধা। শীতের মওসুম। কিন্তু লোক দুটির শরীর থেকে এমনভাবে ঘাম বের হচ্ছিল, যেন তাদের গায়ে কেউ পানি ঢেলে দিয়েছে।

লোক দুটির বাহু কাঁধ থেকে ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম। এই অবস্থায় ওদের ওপর চাবুক পেটা হয়েছে। পিঠ, পেট, বুক, বাহুতে লেগে আছে রক্তের দাগ। কামরা পঁচা রক্তের দুর্গন্ধে ভরপুর। হয়তো আশেপাশে কোথাও পঁচা লাশ আছে, তাই এমন বিকট দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ‘এদের দেখে নাও!’ গুমাস্তগীন দুই ভাইকে বললো, ‘এই কারাগারে আসার আগে তোমরা দুই ভাই আমার সৈন্য বিভাগের সেনাপতি ছিলে। রাজপুত্রের সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করেছো। কিন্তু এত সুখ তোমাদের কপালে সইলো না। দুর্ভাগ্য তোমাদের টেনে নিয়ে এসেছে এই দোজখখানায়। তোমরা বিশ্বাসঘাতক, তোমরা আমার দুই পালিত সাপ! আমার সৈভাগ্য, ছোবল হানার আগেই তোমরা ধরা পড়ে গেছো। আমি তোমাদের কি শাস্তি দেবো এখনও ঠিক করিনি। ইচ্ছে করলে আমি তোমাদের ক্ষমাও করে দিতে পারি। আমাকে শুধু বলো, তোমাদের দুই লোককে দিয়ে যে মেয়েদের তোমরা এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছো, তাদের কোথায় পাঠিয়েছ? এখান থেকে তারা কোথায় গেছে ও কি গোপন তথ্য নিয়ে গেছে?’

গুমাস্তগীনের কথা শুনে শামস বখত ও সাদ বখত দু’জনেই হেসে দিল, কিন্তু তার প্রশ্নের কোন জবাব দিল না। দুই ভাইকে চুপ করে থাকতে দেখে গুমাস্তগীন বললো, ‘চুপ করে থেকো না, আমার প্রশ্নে জবাব দাও। তারা নিশ্চয় সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাচে গেছে? কি, আমি কি মিথ্যা বললাম?’ তারা এবারও কোন উত্তর দিল না। গুমাস্তগীন অসহিষ্ণু কন্ঠে বললো, ‘তাকাও এদের দিকে। দেখো এ দু’জনের কি অবস্থা! এরা যুবক মানুষ, তাই এখনো টিকে আছে। তোমাদের দু’জনকে এ অবস্থায় ফেললে, এতটা অত্যাচার তোমরা সইতে পারবে না। এর অনেক আগেই মনের সব কথা গড়গড় করে বলে দেবে। আমি চাই, তেমন অবস্থায় পৌঁছার আগেই তোমরা সব কথা বলে দাও।’ ‘তারা কোন গোপন তথ্য নিয়ে যায় নি!’ শামস বখত বললেন, ‘এখানে এমন কোন গোপন তথ্য ছিল না যা ওরা নিয়ে যেতে পারে। তোমার সম্পর্কে সুলতান আইয়ুবী সব কিছুই জানেন। তুমি যে খৃস্টানদের সাহায্য নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হচ্ছো, তাও তিনি জানেন। ফলে ওদের নেয়ার কিছু ছিল না। গোপন তথ্য যা প্রকাশ পেয়েছে, তার সবই পেয়েছো তুমি।

আমরা দুই ভাই তোমার সৈন্য দলের সেনাপতি ছিলাম। তুমি আমাদেরকে খুব বিশ্বাসীও মনে করতে। কিন্তু আমরা যে সুলতান আইয়ুবীর লোক ছিলাম এই তথ্যটুকু ওরা না পালালে তুমি কোনদিনই জানতে পারতে না।’ ‘আমি আরো একটি গোপন তথ্য তোমাকে দিচ্ছি।’ শামস বখতের ভাই সাদ বখত বললো, ‘এ এক আকস্মিক ঘটনা। তোমার কাছে দু’জন মুসলমান মেয়ে উপঢৌকন হিসেবে এসেছিল। আমরা যখন জানলাম, মেয়ে দু’টি বড়ই মজলুম ও নির্যাতিতা, ওদের ওপর আমাদের মায়া হলো! কিন্তু কাজী আবুল খাশিব তোমার আগেই মেয়ে দুটিকে তার নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য জেদ ধরলো। আমরা তাকে বিরত করতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু সে আমাদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে নিজের মরণ ডেকে আনলো। মুসলিম দুই যুবতীর সম্ভ্রম বাঁচাতে আমরা বাধ্য হলাম ওদের পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে। ওদের দেখে  মনে হচ্ছিল, ওরা আমারই আপন কন্যা। তাই কাজী আবুল খাশিবের হাতে ওদের তুলে দিতে পারি নি।

কাজী আবুল খাশিবের হত্যা ও মেয়েদের পালানোর ব্যবস্থা করার খবর কানে গেল তোমার। তুমি আমাদের কারাগারে বন্দী করলে। যদি আমরা বন্দী না হতাম তবে আমাদের ইচ্ছা ছিল, সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে তুমি যখন সামরিক অভিযান চালাবে, তখন আমরা আমাদের বাহিনীসহ সুলতান আইয়ুবীর অবরোধে পড়ে অক্ষত অবস্থায় তাঁর কাছে অস্ত্রসমর্পণ করবো। কিন্তু আমাদের সে আশা পূরণ হলো না।’ ‘তবুও আমরা সফল হয়েছি।’ শামস বখত বললেন, ‘তুমি আমাদের যত কষ্ট আর মৃত্যুদন্ডই দাও, আমরা পরাজিত হবো না। তুমি যদি ছাদের সঙ্গে লটকিয়ে আমাদের পায়ের সাথে বিশ সের ওজনের লোহা বেঁধে দাও, আমাদের বাহু আমাদের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নাও এবং তোমার আরো যা মন চায় সব রকম অত্যাচার করে আমাদের মেরে ফেলো, তবু আমরা বিজয়ের গোরব নিয়েই বিদায় নেবো এ পৃথিবী থেকে। আমরা কোন অত্যাচারের ভয়েই ভীত নই। মৃত্যুকেও আমরা ভয় পাই না। তুমি হয়তো জানো না, আল্লাহর রাস্তায় জীবন বিলিয়ে দেয়ার জন্য যারা পগলপারা, তাদের কাছে তীর ফুলের পরশ হয়ে যায়। তোমার অত্যাচার আমাদেরকে আল্লাহর কাছে আরো প্রিয় করে তুলবে।

জান্নাত আমাদের আরো কাছে চলে আসবে। এরচে বড় সাফল্য মানুষের জীবনে আর কি আছে! শোন গুমাস্তগীন, মানুষের শরীর ধ্বংস হয়ে যায় কিন্তু আত্মা অমর থাকে। আল্লাহর রাস্তায় জান কুরবানকারীর আত্মা আল্লাহর কাছে সবচে বেশী প্রিয়।’ ‘খামোশ গাদ্দার!’ গর্জে উঠলো গুমাস্তগীন। ‘আমাকে নসিহত করতে হবে না। আমাকে সেই কথা বল, যে রিপোর্ট তোরা সালাহউদ্দিনের কাছে পাঠিয়েছিস।’ ‘তুমি আমাদের গাদ্দার বলছো!’ শামস বখত বললেন, ‘এটাও একটি গোপন বিষয়, যা একদিন প্রকাশিত হয়ে যাবে। গাদ্দার কে, এ প্রশ্নের উত্তর দেবে ভবিষ্যত। ইতিহাসই নির্ধারণ করবে কে গাদ্দার, কে নয়। গুমাস্তগীন, তোমকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ইতিহাস বড় নির্মম। একদিন সে সবাইকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেবে জাতির আসল গাদ্দার কে ছিল। ইতিহাস বলবে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ফিলিস্তিনকে খৃস্টানদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য জেহাদের ঝান্ডা হাতে যখন অগ্রসর হচ্ছিল, তখন গুমাস্তগীন নামের এক মুসলমান গাদ্দার দুর্গাধিপতি তার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’

‘তোমরা যতি এতই পাকা মুসলমান, তবে ভারকে হিন্দুদের হাতে তুলে দিয়ে নূরুদ্দিন জঙ্গীর কাছে পালিয়ে এলে কেন? ঈমানদারদের কপালে তো পালানোর কলম্ক-কালি থাকে না!’ গুমাস্তগীন বিদ্রূপ করে বললো, ‘তোমরা দেশকে কাফেরের হাতে তুলে দিয়ে এখানে এসে ঈমানদারী ফলাচ্ছো?’ ‘ভারতকে আমরা দিন্দুদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আসিনি, সেখানেও তোমাদের মত মুসলমান রয়ে গেছে।’ সাদ বখত বললো, ‘যারা হিন্দুদের সাথে বন্ধুত্ব করে তোমাদের মত ক্ষমতার পাগল হয়ে গেছে। তাদের চোখে এখন কেবল ক্ষমতা ও গদীর স্বপ্ন। আর হিন্দুরা পূর্ণ কতৃত্ব নিয়ে বসে আছে তাদের সহায়তায়। আফসোস! সে দেশের ভাগ্য মুজাহিদদের হাতে নেই। সেখানকার মুসলিম শাসকরাও তোমাদের মতই গোলাম বানিয়ে রেখেছে সে দেশের ইসলামী জনতাকে। আমাদের একজন মুহাম্মদ বিন কাশিম দরকার ছিল। সেই আবেদন নিয়েই আমরা এসেছিলাম মরহুম জঙ্গীর কাছে। তিনি আমাদের ওয়াদাও দিয়েছিলেন, তোমাদের মত গাদ্দারদের কবল থেকে আরব ভূমি মুক্ত করে আমাদের সঙ্গে যাবেন। কিন্তু আফসোস! সে সুযোগ আর হলো না।’

‘আমি তোমাদেরকে আরও দুই দিন চিন্তা করার সুযোগ দিলাম।’ গুমাস্তগীন বললো, ‘যদি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও তবে এই জাহান্নাম থেকে তোমাদেরকে মুক্ত করে তোমাদের আপন বাড়িতে নজরবন্দী করে রাখবো। আর যদি আমাকে নিরাশ করো, তবে তোমাদের আমি মৃত্যুদন্ড দেবো না, এই অন্ধকার কুঠরীতেই পচেঁ গলে একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে। এখনও চিন্তা করো! দু’দিন পর আমি আবার তোমাদের কাছে আসবো।’ দুই ভাইকে ওখানে রেখেই বেরিয়ে গেলেন ক্রুদ্ধ গুমাস্তগীন। প্রহরী সেলের দরজা বন্ধ করে দিল। অন্তহীন অন্ধকার গ্রাস করলো বন্ধ কুঠুরী। গুমাস্তগীনের কেল্লায় খৃস্টান উপদেষ্টা ছিল। উপদেষ্টাকে সে ভালভাবেই বুঝাতে সমর্থ  হলো, খৃস্টান কমান্ডার নিহত হয়েছে তার ভুল ও অপকর্মের জন্য। তার হত্যার পেছনে কোন ষড়যন্ত্র ছিল না। গুমাস্তগীন বললো, ‘সে আামার মহলের এক মেয়ের হাতে খুন হয়েছে।’ গুমাস্তগীন তাকে আরও জানালো, ‘যে দু’জন সেনাপতি কাজীকে হত্যা করেছে তাদেরকে খুন ও বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে কারাগারে বন্দী করা হয়েছে।’

এরপর সে উপদেষ্টার কাছে পরামর্শ চাইলো, ‘আমি অবিলম্বে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাতে চাই। এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কি?’ ‘আমার তো জানা নেই, সেনাপতি দু’জন কি ধরনের গোপন তথ্য সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে পাঠিয়েছে। এটা না জেনে আমি আপনাকে কি পরামর্শ দেবো বুঝতে পারছি না।’ গুমাস্তগীন বললো, ‘আইয়ুবী এই গোপন তথ্য পেয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগেই আমাদের আক্রমণ করা উচিত, যাতে সে সুবিধা করতে না পারে। আপনারা যদি আমাদের একটু সহযোগীতা করেন তবে আমরা নিশ্চিন্তে অভিযান চালাতে পারি।’ খৃস্টান উপদেষ্টা তাকে  সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিল এবং বললো, ‘ঠিক আছে, আজই আমি একজন লোককে দিয়ে এ খবর কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ সেই রাতেই খৃস্টান উপদেষ্টার পত্র নিয়ে এক লোক রওনা হয়ে গেল সেখান থেকে।

মুসালে খতীব আল মাখদুম কারাগারের এক কুঠরীতে বন্দী। তার কন্যা সায়েকা বাড়ীতে একা। সারাদিন মহিলারা আসা-যাওয়া করলো তার কাছে। খতীব এখন কোথায় কি অবস্থায় আছে জানার জন্য এসব মহিলারা ছিল খুব উদগ্রীব। কিন্তু সায়েকা তাদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সবাইকে শুধু বলতো, ‘যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে। পেরেশান হয়ে লাভ কি?’ মহিলারা এটাকে সায়েকার স্বাভাবিক আক্ষেপ বলেই ধরে নিয়েছে, কেউ এ কথার কোন অন্তর্নিহিত অর্থ খোঁজার চেষ্টা করেনি। কিন্তু তার কথার ভঙ্গি এবং সবাইকে একই উত্তর দেয়ায় দু’টি মেয়ের মনে এ নিয়ে খটকা লাগলো। তারা বললো, ‘সায়েকা, এই যে তুমি সবাইকে বলছো, যা হওয়ার তাই হয়েছে, এর মানে কি?’ সায়েকা এ কথারও জবাব দিল, ‘যা হওয়ার তাই হয়েছে।’ ঘরে আরো মহিলারা থাকায় মেয়েরা এ নিয়ে আর বিরক্ত করলো না তাকে। কিন্তু তাদের মনের খটকা ও সন্দেহ দূর হলো না এ জবাবে।

রাতে যখন সায়েকা একা, তখন সে দুই যুবতী আবার তার কাছে এলো। এরা ছিল সায়েকারই প্রতিবিশী। সায়েকা তাদেরকে ভাল মতই চিনতো। ‘সায়েকা, তুমি সবসময় এ কথা কেন বলছো, ‘এমনটাই হওয়ার কথা ছিল?’ এক মেয়ে জিজ্ঞেস করলো। ‘আল্লাহর এমনটিই মঞ্জুর ছিলো।’ সায়েকা উত্তর দিল, এ ছাড়া আমি আর কিই বা বলতে পারি!’কিছুক্ষণ সবাই নীরব। শেষে অন্য মেয়েটি বললো, ‘যদি এর অর্থ অন্য কিছু হয়, তবে ষ্পষ্ট করে বলো, হয়তো আমরা তোমার উপকারে আসতে পারি।’ ‘আল্লাহ ছাড়া আমাকে আর কেউ সাহায্য করতে পারবে না।’ সায়েকা বললো, ‘আমর সম্মানিত বাবা এমন কোন গুরুতর অপরাধ করতে পারেন না, যার জন্য তাকে জেলে নেয়া যেতে পারে। আমার বাবা মুসালের আমীরকে হয়তো সেই রূঢ় সত্য কথাটি বলে দিয়েছেন, যা তার পছন্দ নয়। তোমরা জেনো, তিনি সবসময় সত্যবাদী ছিলেন এবং সত্য কথা বলতে গিয়ে কোন ভয় ভীতির তোয়াক্কা করতেন না। এ জন্যই আমি বলছি, এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কারণ তিনি তোষামোদ করার মত লোক নন। ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা তোষামোদকারী ছাড়া অন্যকে সহ্য করতে পারেন না।’

‘আল্লাহই ভাল জানেন, তিনি কি বলেছিলেন।’ অপর মেয়েটা বললো, ‘জানি না সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পক্ষে কিছু বলেছেন কিনা। আচ্ছা, তুমি কি বলতে পারো, তিনি মুসালের আমীরের পক্ষের লোক, নাকি সুলতান আইয়ুবীর পক্ষের?’ ‘তিনি সবসময় সত্যের পক্ষের লোক। যাকে তিনি সত্য মনে করেন তিনি কেবল তারই সমর্থক। ’ সায়েকা একটু হেসে বললো, ‘তোমরা কাকে সমর্থন করো?’ ‘আমরা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সমর্থক।’ দুই মেয়েই এক সঙ্গে উত্তর দিল। ‘তিনিও মনে করতেন, সুলতান আইয়ুবীই সত্যের পক্ষে আছেন।’ সায়েকা উত্তর দিল, ‘সাইফুদ্দিন হয়তো তা জানতে পেরেছে।’ ‘তিনি কি মনে মনে তাকে সমর্থন করতেন, নাকি তার সক্রিয় সমর্থক ছিলেন?’ এক মেয়ে বললো। ‘তোমরা কি এখানে গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছো?’ সায়েকা বললো, ‘কেন, মুসালের মুসলমানরা কি সব গাদ্দার! তারা সবাই কি কাফেরদের সমর্থক হয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ! আমরা গোয়েন্দাগিরি করতেই এসেছি।’ এক মেয়ে বললো, ‘আর তোমাকে আশ্বস্ত করতে এসেছি, মুসালের যুবতীরা কাফেরের সমর্থক নয়। তারা আরবের মাটি থেকে কাফেরদের উচ্ছেদ করতে বদ্ধপরিকর। এ লক্ষেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। জাতির এ দুর্দিনে আমরা চোখ-কান বন্ধ করে থাকতে পারি না। কোথায় কি ঘটছে সতর্কতার সাথেই আমরা তা লক্ষ্য করছি। তুমিই চিন্তা করে দেখো, যেই তুমি বললে, ‘এমনটিই হওয়ার কথা ছিল’ আমরা এর মধ্যে রহস্যের গন্ধ পেলাম। আমরা বুঝতে পারলাম, তোমার আব্বা সুলতান আইয়ুবীর সমর্থক হবেন এবং মুসালের গভর্ণর তা টের পেয়েই তাকে বন্দী করেছে।

আমাদের মত তুমিও এ কথা বুঝতে পেরেছো বলেই তুমি সবাইকে বলেছিলে, ‘যা হওয়ার কথা তাই ঘটেছে।’ সায়েকা অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েরা বললো, ‘কিন্তু দেখো, এ রহস্য আমরা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারেনি।’ কিছুক্ষণ কথাবার্তা ও মত বিনিময়ের পর সায়েকা বুঝলো, এই মেয়েরা তাকে ধোঁকা ও বিপদে ফেলতে আসেনি। সে তাদের প্রশ্ন করলো, ‘এখন তোমরা কি করতে চাও? কিইবা করার ক্ষমতা আছে তোমাদের?’ ‘প্রথমে আমাদের জানতে হবে, শ্রদ্ধেয় খতীব সাহেবের ওপর কারাগারে কোন নির্যাতন হচ্ছে কিনা?’ অন্য মেয়ে বললো, ‘যদি তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়, তবে তাঁকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে হবে। সে ব্যবস্থা আমরা করবো।’ ‘আমরা কেমন করে জানবো, কারাগারে তার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা হচ্ছে?’ সায়েকা বললো। ‘আমরা আমাদের চেষ্টাতেই জেনে নিতে পারবো।’ এক মেয়ে বললো, ‘তবে তুমিও আমাদের সাহায্য করতে পারো। তুমি মুসালের আমীরের কাছে যাও। তার কাছে তোমার পিতার সাথে দেখা করার অনুমতি চাও। যদি অনুমতি না দেন তবে আমরা অন্য ব্যবস্থা করবো।’ ‘আমি কাল সকালেই যাবো।’ সায়েকা বললো, ‘আর এ কথাও জিজ্ঞেস করবো, আমার বাবাকে কোন অপরাধে বন্দী করা হয়েছে?’ মেয়েরা বিদায় নিতে যাবে, তাদের মনে হলো, সায়েকা তো এ বাড়ীতে সম্পূর্ণ একা! তারা তাকে বললো, ‘তুমি তো একা! খালি বাড়িতে নিঃসঙ্গ রাত কাটানো বিপদজনক! তার ওপর তুমি এক যুবতী। ঠিক আছে, আমরা রাতে তোমার এখানেই থাকবো।’

কিন্তু সায়েকার তেমন ভয় করছিল না। কোন বিপদেরও আশংকা করছিল না সে। বললো, ‘কি দরকার! আমার কোন ভয় করছে না। আমি একাই থাকতে পারবো।’ মেয়েরা তার এই আপত্তিকে গ্রাহ্য করলো না। তারা বাড়ী ফিরে গিয়ে নিজেদের গার্জিয়ানদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলো রাতে সায়েকার কাছে থাকার জন্য। তখন শীতকাল। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে তারা বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সবাই অতলান্ত ঘুমের জগতে হারিয়ে গেল। মাঝ রাতের একটু পর। প্রকৃতির ডাকে একটি মেয়ের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বাথরুমে যাওয়ার জন্য ঘরের বাইরে এলো সে। বারান্দা পেরিয়ে সে উঠানে নামলো। উঠানের ওপাশে বাথরুম। হঠাৎ উঠানের এক কোণে একটি কালো ছায়া নড়ে উঠলো বলে মনে হল তার। কিন্তু অন্ধকারের কারণে স্পষ্ট দেখতে পেলো না। থমকে দাঁড়ালো মেয়েটি, সামান্য ভয়ও পেল। চুপ করে শুনতে চেষ্টা করলো, কোথাও কোনা আওয়াজ হয় কিনা। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে চেষ্ট করলো, কোন কিছু নড়ে কিনা! কিন্তু না, সব কিছু চুপচাপ, সুনসান। সে আবার এগুনোর জন্য পা বাড়াতে যাবে, মনে হলো আবার ছায়াটি নড়ে উঠলো এবং দেয়ালের ওপাশে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। ভয় ঢুকে গেল মেয়েটির অন্তরে। সে বাথরুমে না গিয়ে দ্রুত ফিরে এলো কামরায়।

কামরায় ফিরেই সে তার সঙ্গের মেয়েটিকে আলতো নাড়া দিয়ে ফিসফিস করে ডাক দিলো, ‘এই!’ ঘুম ভেঙ্গে গেলে মেয়েটির। সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ব্যাপার!’ মেয়েটি যা দেখেছিল বললো তাকে। দু’জনের কাছেই খঞ্জর ছিল। খঞ্জর হাতে নিয়ে ওরা বাইরে বেরিয়ে এলো। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলো, কিন্তু তাদের চোখে সন্দেহজনক আর কিছুই পড়লো না। বারান্দা থেকে এবার উঠানে নেমে এলো তারা। সায়েকাকে তারা কিছুই জানালো না, তাকে জাগালোও না। কিন্তু কেমন করে যেন সায়েকারও ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে বিছানা হাতড়িয়ে দেখলো, যে দুই মেয়ে রাতে তার সাথে শুয়েছিল, ওরা কেউ বিছানায় নেই। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো সে। ঘরে বাতি জ্বালালো। দেখলো, ঘরের দরজা খোলা। সে বারান্দায় এসে নাম ধরে ডাকলো তাদের। তার ডাক শুনে মেয়েরা উঠোন থেকে তাড়াতাড়ি তার কাছে ছুটে এলো। ‘কি ব্যাপার! বাইরে কি করছো তোমরা?’ প্রশ্ন করলো সায়েকা। যে মেয়েটি বাথরুম করতে বেরিয়েছিল সে বললো, ‘বাথরুমে যেতে গিয়ে বাইরে উঠানের পাশে মানুষের ছায়া নড়তে দেখলাম। মনে হলো, এখানে কেউ ওঁৎ পেতে আছে।’

‘এখন কোথায় সে লোক?’ ‘এখন তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না!’ হতাশ কন্ঠে বললো মেয়েটি। ‘যাও, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো।’ সায়েকা তাদেরকে বললো, ‘তোমরা বাইরে এসে কি দেখতে কি দেখেছো, কে জানে! কোন ছায়া দেখলেই তাতে আঘাত হবে, এ বুদ্ধিই বা তোমাদের কে দিল?’ মেয়েটি ঘাবড়ে গিয়ে বললো, ‘মনে হয় এটা কোন মানুষের ছায়া না, হয়তো হুজুরের কোন ভক্ত জ্বীনের! নইলে ভোজবাজীর মত সে অদৃশ্য হয়ে গেল কি করে?’ ‘যারই ছায়া হোক, ও নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। তোমরা নির্ভয়ে ঘুমুতে যেতে পারো।’ সায়েকা বললো। সায়েকার অভয় বাণীতে তারা বরং আরো ভয় পেলো। ভয় তাদের মানুষকে নয়, অন্য কিছুর। তবে কি সত্যি এটা জ্বীনের ছায়া ছিল? নইলে সায়েকা ছায়াকে আঘাত হানতে নিষেধ করলো কেন? তিনজনই বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এলো। এক মেয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘সায়েকা, সত্যি করে বলো তো, আসলেই কি ওটা জ্বীনের ছায়া ছিল?’ ‘জানি না। তবে এরা আমার বাবার ভক্ত ও অনুসারী। তাদেরকে তোমরা জ্বীনই মনে করো, আর যা-ই মনে করো। আমি তাদের কাছে কোনদিন যাইনি। আমার বিশ্বাস, তারা আমাদেরকে পাহারা দিতেই রাতে বাড়ির চারপাশে ঘোরাফেরা করে।’ ‘শ্রদ্ধেয় খতীব যেমন পরহেজগার, তেমনি সম্মানিত। ’ একটি মেয়ে বললো, ‘তাঁর ভক্ত ও অনুসারী যেমন মানুষ, তেমনি জ্বীনেরাও তার ভক্ত হতে পারে।’

‘হতেই পারে!’ সায়েকা বললো, ‘সে জন্যই বলছি, তোমরা তাদের ভয়ও পেও না, আবার তাদের কাছেও  যেও না।’ খতীব সাহেব কারাগারের এক কামরায় বন্দী। তিনি জানেন না, সাইফুদ্দিন তার সাথে কেমন ব্যবহার করবে। একজন প্রহরী টহল দিচ্ছিল তার কামরার সামনে। খতীব তাকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘আমাকে একটি কোরআন শরীফ দিতে পারো?’ ‘কোরআন শরীফ? এখানে……..!’ প্রহরী অবাক হয়ে বললো, ‘এখানে তো হুজুর কোরআন পাঠের লোক আসে না! এই জাহান্নামে আমি কোরআন শরীফ কোথায় পাবো! এখানে শুধু পাপীরাই আসে। আসে চোর, ডাকাত, খুনী। ওদের তো কোরআনের দরকার হয় না! এখানে কোন কোরআন শরীফ নেই। আপনি শুয়ে থাকুন।’ পহরী ডিউটিতে চলে গেল। খতীব সাহেব কোরআনের হাফেজ ছিলেন না, কিন্তু তাঁর অনেক সুরা ও আয়াত মুখস্ত ছিল। তিনি সুললিত কন্ঠে সুরা আর রাহমান পাঠ করতে শুরু করলেন। নিশুতি রাতের বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো খতীব ইবনুল মাখদুমের যাদুময় মিষ্টি কন্ঠের সুর। কারাগারের দুর্বহ পরিবেশে এক মোহময় আবহ সৃষ্টি হলো। কেবল সে কামরা নয়, সমগ্র কারাগারেই ভেসে বেড়াতে লাগলো হৃদয় উজাড় করা সে সুরের মুর্ছনা।

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | ... | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top