১২. গোপন বিদ্রোহী

 সুলতান আইয়ুবীর যতই নিন্দা করুক, তার প্রতিবাদ করবে না। বরং তাদের কথায় সায় দিয়ে খৃষ্টান সেনাপতিদের কাছ থেকে তাদের মনের কথা বের করে নেবে।

 তারা কিভাবে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে খুঁটিয়ে বের করার চেষ্টা করবে। বেশী করে মনোযোগ শুনবে খৃষ্টানদের কথা’।

 এরপর আনতানুস সেই দুই সেনাপতির কথা জিজ্ঞেস করলো, যারা হিন্দুস্তানী হিসাবে পরিচিত ছিল।

 ‘শামস বখত ও সাদ বখতকে আমি খুব ভাল করে চিনি’। ফাতেমা বললো, ‘গুমাস্তগীন তাদের ছাড়া কোন সিদ্ধান্তই নেয় না। তারা প্রায়ই এখানে আসে। তারা গান বাজনায়ও শরীক হয় কিন্তু তারা মদ পান করে না’।

 ‘তুমি তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করবে!’ আনতানুস বললো, ‘কথায় কথায় তাদের কে প্রশ্ন করবে, ‘আর রিস্তানে কি এখন বরফ গলছে?’

 সেও তোমাকে প্রশ্ন করবে, ‘কেন, তুমি কি আর রিস্তান যাবে নাকি?’

 তুমি হেসে বলবে, ‘ইচ্ছা তো তাই ছিল’।

 তারপরে তারা তোমার সাথে কথা বলবে। আর সম্ভবতঃ জিজ্ঞেস করবে, ‘ওদিক দিয়ে কে আসছে?’

 তখন তুমি বলবে, ‘সেখানে গেলেই জানতে পারবে’।

 ফাতেমা বল লো, ‘আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না’।

 ‘আমি যেভাবে বললাম সেভাবে কাজ করো। ধীরে ধীরে সব বুঝতে পারবে’। আনতানুস বললো, ‘ফাতেমা! আমি তোমাকে কখনও এমন ঝুঁকি ও ঝামেলায় ফেলতাম না। কিন্তু কঠিন দায়িত্বের খাতিরে, ইসলাম ও মুসলিম জাতির অস্তিত্বের খাতিরে বাধ্য হলাম।

 আমার সবচেয়ে প্রিয় যে প্রাণ, সেটাও এই ফরজ পালনের জন্য কোরবানী করতে বাধ্য আমি। ভয় পেয়ো না ফাতেমা, আমরা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এসেছি, মরার পর আবার তার কাছেই ফিরে যাবো। সামনে যে কঠিন বিপদ ও পরীক্ষা রয়েছে, সে বিপদ আমরা হাসি মুখে বরণ করে নেবো তার সন্তুষ্টির আশায়।

 যদি আমরা দু’জন কখনো বন্দী হয়ে যাই, যদি কয়েদখানার দুর্ভোগ নেমে আসে আমাদের জীবনে, অথবা যদি আমরা মরেও যাই, তবু আমাদের রক্ত বৃথা যাবে না। মহান আল্লাহ কখনো আমাদের কোরবানী ভুলে যাবেন না। ইসলামের খেদমত ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষায় আমাদের এ রক্ত দান আমাদের পরকালীন মুক্তি ও জান্নাতের জামিন হবে।

 ‘এ ব্যাপারে তুমি আমাকে পাহাড়ের মতই অটল ও সুদৃঢ় পাবে’। ফাতেমা বললো, ‘তুমি আমার মনে সেই প্রেরনা জাগিয়ে দিয়েছো, এতদিন আমি যার স্বপ্ন দেখেছি। আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ও সাধনাকে সফল করার পথ বের করে দিয়েছো তুমি। আমার প্রতিটি পুন্যের বদলা তুমি আল্লাহ্‌র কাছ থেকে পাবে’।

 ‘আমি চলে যাচ্ছি’। আনতানুস বললো, ‘তোমার দায়িত্ব পালন আজ এবং এখন থেকেই শুরু করো’।

 আনতানুস চলে গেল। ফাতেমা তার চলে যাওয়া পথের দিকে বহুক্ষন ধরে তাকিয়ে রইলো।

 সে যখন তার চোখের আড়াল হয়ে গেল,তখন ফাতেমা অনুভব করলো, সে একা নয়, তার পাশে আরও একজন দাঁড়িয়ে আছে।।

 সে চমকে তাকিয়ে দেখলো, মহলের একটি মেয়ে সত্যি তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সেও ফাতেমার মত যুবতী ও সুন্দরী। মেয়েটি তাকে বললো, ‘ফাতেমা তোমার এই ভালবাসার পরিনতি কি হবে সে বিষয়ে একটু ভেবে দেখেছো? তুমি মুক্ত নও। আমার মনের আবেগও ঠিক তোমার মতই। আমিও খাঁচা ভেঙ্গে উড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করেছি। কিন্তু এটা সম্ভব নয়।

 চিন্তা করে করে আমি কোন কল কিনারা পাইনি। শেষে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছি আমার জীবন। মনকে প্রবোধ দিয়েছি এই বলে, আমার কপালে যা লেখা ছিল তাইতো আমি পেয়েছি! তুমিও তোমার মন কে বুঝাও অবাস্তব স্বপ্ন কল্পনা পিষে মারো। যদি মনের শান্তি পেতে চাও তবে আরও অনেক পথ আছে’।

 ‘কি বলতে চাও তুমি?’

 ‘একজন রক্ষী সেনাকে এত উচ্চ সম্মান দিওনা’।

 ‘আমি কাকে কতটুকু সম্মান দেবো, সেটা আমার ব্যাপার । এ নিয়ে তোমার নাক না গলালেও চলবে’। ফাতেমা বিস্ময় ও ক্রোধের সাথে বললো।

 ‘কিন্তু তুমি যে চড়া মুল্যে এ সওদা কিনতে চাচ্ছো, সে বড় কঠিন মূল্য। এত চড়া যে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না’।

 ‘কি বলতে চাও তুমি? চড়া কি অ-চড়া তার তুমি কি জানো?’

 ‘আমি যা জানি তার সবটা তোমাকে বলিনি’। মেয়েটি বললো, ‘দেখো, আমার কাছে কোন কথা গোপন করার চেষ্টা করো না। তোমাদের অনেক কথাই আমি শুনেছি। তুমি তার সাথে যে অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছো, সে এক কঠিন কারবার! তার জন্য অশেষ মূল্য দিতে হবে তোমাকে’।

 এই বলে সে সেখান থেকে চলে গেল। ফাতেমা সেখানেই অন্ধকার বাগানে চিন্তাযুক্ত মনে একাকী পায়চারী করতে লাগলো। তার মনে পড়লো, আনতানুস তাকে বলে গেছে, ‘আজ থেকেই কাজ শুরু করো’।তার আরো মনে পড়লো, সে তো আন তানুসের কাছে স্বীকার করেছে, সে সর্বদা দৃঢ়চিত্ত ও অটল থাকবে। সে আপন মনেই বলতে লাগলো, ‘মহলে তো এমন কত গুজবই চলে আসছে!’ মেয়েটির ওপর তার ভীষণ রাগ হলো, সে তাকে অভিশাপ দিতে লাগলো। কিন্তু তারপরই তার মনে হলো, অধিকাংশ মেয়েই তো অন্য মেয়ের দোষ ত্রুটি মালিকের কাছে বলে তাকে ছোট করতে ও বিপদে ফেলতে চায়। কিন্তু ে মেয়ে তো তা করেনি!

 কোন মেয়ে অন্যের ত্রুটি দেখলে তখনি তাকে বুঝিয়ে সাবধান করে, যখন সে তার মঙ্গল চায়। এ মেয়ে যখন আমাকে সাবধান করেছে তখন তার ওপর এটুকু ভরসা অন্তত করা যায়, সে এ কথা মালিকের কানে দেবে না। এ কথা মনে হতেই সে একটু শান্তি ও স্বস্তি পেলো।

 যে কোন মুহূর্তে যে কোন অঘটন ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা সে উড়িয়ে দিতে পারলো না। স্বস্তির বদলে অজানা ভয় ও শঙ্কার এক হীমশীতল স্রোত বুকে নিয়ে সময় কাটতে লাগলো তার। দু’তিন দিন কেটে গেল, কোন অঘটন ঘটলো না। চতুর্থদিন রাতে শামস বখত ও সাদ বখতের সাথে সাক্ষাৎ হলো তার। গুমাস্তগীন মাহফিল সাজিয়ে বসেছে। সেনাপতি, খৃষ্টান উপদেষ্টা ও উচ্চ সামরিক অফিসারদের মনোরঞ্জনের দিকে সব সময়ই সে বিশেষ খেয়াল রাখে। এ ব্যাপারে সে খুব উদারহস্ত।আমোদ- স্ফূর্তির মাধ্যমে তাদের সে সব সময় নিজের হাতের নাগালে রাখতে চায়।

 এ দু’তিন দিনে আনতানুস ফাতেমাকে ভালই ট্রেনিং দিয়েছে। সে ট্রেনিংয়ের ফলে ফাতেমা এ জলসায় আনন্দের সাথেই শরীক হয়ে গেলো। গুমাস্তগীন ফাতেমার এমন পরিবর্তন দেখে একটু আশ্চর্য হলো, মনে মনে খুশীও হলো।

 সে মেহমানদের সাথে প্রাণ খুলে হাসছিল, কথা বলছিল। এ দেখে বেশ পুলকিত বোধ করলো গুমাস্তগীন। ফাতেমা এক সময় সেনাপতি শামস বখতের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। নানা কথার ফাঁকে এক সময় বললো, ‘এখন কি আর রিস্তানে বরফ গলা শুরু হয়েছে?’

 সেনাপতি শামস বখত চমকে উঠলো। গুমাস্তগীনের মত সতর্ক ও শক্ত মানুষের কেল্লার অন্দর মহলের কোন নারীর এমন গোপন তথ্য জানার কথা নয়। এমনটি আশা দুরাশা মাত্র। কারণ, এটা সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দাদের একটা গোপন কোড। এ প্রশ্নের মাধ্যমে গোয়েন্দারা একে অপরকে চিনতে পারে। এ শব্দ একমাত্র নির্দিষ্ট গোয়েন্দা ছাড়া আর কেউ উচ্চারন করতে পারে না।

 শামস বখত ভাল করেই জানতো, এ কেল্লায় এমন কোন গোয়েন্দা বন্দী নেই যার কাছ থেকে সে এ শব্দ শুনতে পারে। শামস বখত দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে সুত্রের পরবর্তী সংলাপ উচ্চারন করলো, ‘কেন তুমি কি আর রিস্তান যেতে চাও?’

 ফাতেমা হেসে বললো, ‘ ইচ্ছা তো তাই ছিল’।

 সেনাপতি শামস বখত কথা বলতে বলতে তাকে নিয়ে একদিকে সরে গেলো। অন্যান্য লোকেরা সবাই মদের নেশায় চুর হয়ে রয়েছে।

 শামস বখত তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি তো জানো আমি সেনাপতি?’

 ‘আমি তার চেয়েও আরো বেশী জানি’।

 ফাতেমার হাসির মধ্যে কোন উপহাসের ভাব ছিল না, বরং সহজ সরল আত্মবিশ্বাসে দীপ্ত ছিল সে হাসি।

 ‘কে এসেছে?’ শামস বখত গোপনে জিজ্ঞেস করলেন।

 ‘সময় হলে তাকে আপনি নিজেই দেখতে পাবেন’।ফাতেমা বললো।

 ‘তুমি কি জানো, আমাকে ধোঁকা দেওয়ার পরিনাম কি হতে পারে?

 ‘ধোঁকা নয়’। ফাতেমা বললো, ‘আপনি অগ্রসর হয়ে দরোজার দিকে চলে যান। গেটে দু’জন রক্ষীকে দাঁড়ানো পাবেন। জিজ্ঞেস করবেন, ‘জেরুজালেম থেকে কে এসেছে?’

 সেনাপতি শামস বখত দরোজার দিকে এগিয়ে গেলো। সেখানে দু’জন রক্ষী দাঁড়িয়ে ছিল, যাদেরকে তিনি চিনতেন। তাদের তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে জেরুজালেম থেকে এসেছো?’

 আনতানুস সামনে এগিয়ে বললো, ‘জ্বি, আমি জেরুজালেম থেকে এসেছি’।

 শামস বখত তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি যখন আর রিস্তান থেকে এসেছ তখন সেখানে বরফ গলা শুরু হয়েছে নিশ্চয়ই’।

 ‘কেন, আপনি কি আর রিস্তান যাচ্ছেন?’ আনতানুস জিজ্ঞেস করলো।

 ‘ইচ্ছা তো তাই ছিল’। সেনাপতি হেসে ফেললেন।

 যখন তার পূর্ণ বিশ্বাস এসে গেল, আনতানুস সত্যি একজন গোয়েন্দা, তখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই মেয়েটা তো আমাদের সাথে প্রতারনা করছে না?’

 ‘না’। আন তানুস উত্তর দিল, ‘সাক্ষাতের সুযোগ দিন, সমস্ত কথাই বলে দেব’।

 ‘শামস বখত এক সেনাপতি, সুযোগ সৃষ্টি করা তার পক্ষে কঠিন ছিল না। সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হলো। আনতানুস হাজির হলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন,

 ‘তুমি কেমন করে ফাতেমাকে জালে আটকালে? আর তাকে কেমন করেই বা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছো, যার দরুন তাকে তুমি গোপন সংকেতও জানিয়ে দিয়েছো?

 আন তানুস শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব ঘটনা তার কাছে বর্ণনা করলো। কেমন করে এ মেয়ের সাথে সাক্ষাৎ হলো, তাদের মাঝে কি কথা হয়েছে, কিছুই বাদ দিল না।

 ‘আমি একটি ভয়ের আশংকা করছি’। সেনাপতি শামস বখত বললেন, ‘তুমি তরুন যুবক! সুন্দর চেহারার সুগঠিত পুরুষ! মেয়েও যুবতী, সেই সাথে অসাধারণ সুন্দরী! তার আবেগে সীমালংঘন করার সম্ভাবনা আছে, নইলে তুমি তার কামরায় যাওয়ার দুঃসাহস করতে না।

 এতে যে ভয়ানক ঝুঁকি ও বিপদ আছে তুমি সেদিকে খেয়াল করোনি। এই অসাবধানতা ঠিক হয়নি। মেয়েদের মধ্যে ভালবাসা ও বিশ্বাসযোগ্যতা দুটোই উষ্ণ থাকে। তুমি তাকে ভালবাসাও দিয়েছো এবং পূর্ণ বিশ্বাসও তাকে দান করেছো। কিন্তু এ বয়সী মেয়েদের আবেগ চঞ্চল ও ক্ষণস্থায়ী হয়।

 আমার ভয় হচ্ছে, তোমার প্রেমের আবেগ তোমার দায়িত্ববোধকে না ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস করে দেয়।

 যৌবনের জ্বালা ও প্রেমের আবেগ একত্রিত হয়ে বারুদ হয়ে যায়। তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করাতে পারবে, তোমার অন্তরে ঐ মেয়ের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হয়নি? আমি তোমার বিশ্বাসের পরীক্ষা নিতে চাই’।

 ‘আমি সে মেয়েকে শুধু কাজ সমাধা করার খাতিরেই তাকে বশীভুত করতে চেয়েছি’। আনতানুস বললো, ‘কিন্তু আমি এ কথাও অস্বীকার করতে পারবো না, আমি তাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলিনি। আমি আপনাকে আল্লাহ্‌ ও রাসুলের কসম খেয়ে বলছি, এ ভালবাসা আমার দায়িত্ববোধের ওপর কখনোই প্রাধান্য পাবে না’।

 এরপর দু’জনের মাঝে তাদের দায়িত্ব নিয়ে নানা কথা হলো। সেনাপতি শামস বখত তাকে কিছু নির্দেশ দান করে বিদায় দিলেন।

 সে দিনই শামস বখত তাঁর ভাই সাদ বখতকে বললেন, ‘সুলতান আইয়ুবী এখানে আরও একজন লোক পাঠিয়েছেন। তার নাম আনতানুস। সে এখানকার রক্ষী দলে অন্তর্ভুক্ত হতে সক্ষম হয়েছে’।

 এ দুই ভাইয়ের নিজস্ব গার্ড বাহিনী আছে। তাদের আর্দালী, দুই বডিগার্ড এবং চাকর সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো সৈনিক। শামস বখত তার ভাইকে আরো বললেন, ‘আমাদের কাছে আরও একজন লোক এসেছে ঠিকই, কিন্তু সে এখানে এসেই এক সমস্যা বাধিয়ে বসেছে। সে কেল্লার মালিকের নিজস্ব পুকুর থেকে একটি মাছ বড়শিতে গেঁথে ফেলেছে। এটা মোটেও আনন্দের নয়, বরং একটা ভয়ের কারণ’।

 শামস বখত তার নিজস্ব লোকদের কাছে এ সমস্যা ও ভয়ের কারণ সবিস্তারে বর্ণনা করে তাদের সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘এখন পর্যন্ত হারান প্রদেশে আমাদের একটি গোয়েন্দাও গ্রেফতার হয়নি। আমার ভয় হচ্ছে, আনতানুস গ্রেফতার হয়ে যাবে।

 আমরা তার প্রতি দৃষ্টি রাখবো। শেষ পর্যন্ত তোমাদের সকলকেই প্রস্তুত থাকতে হবে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য। যদি সে ধরা পড়ে যায় তবে আমাদের অনেক বিপদ ও লাঞ্চনা সহ্য করতে হবে।

 আরও ভয় হচ্ছে, সে শাস্তির ভয়ে আমাদের সবার নাম, পরিচয় বলে দিতে পারে। তখন বিষয়টা সামাল দেয়া খুব কঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু সুলতান আইয়ুবীর কথা মনে করে ভয় ও লজ্জিত হচ্ছি এই কারণে, তিনি যখন বলবেন, ‘দু’জন সেনাপতি ও ছয়জন কমান্ডো মিলে একজন গোয়েন্দাকে রক্ষা করতে পারলে না, তখন ক জবাব দেবো?’

 ‘আপনারা আছেন, আমরা এখানে আরো ছয়জন আছি, তখন এখানে আরেকজন পাঠাবার কি দরকার ছিল?’ এক সঙ্গী বললো।

 ‘হয়তো এরও প্রয়োজন ছিল’। অন্য একজন বললো, ‘যে প্রয়োজন পূরণ করার জন্য তিনি নতুন একজনকে পাঠানো দরকার মনে করেছেন। গুমাস্তগীনের অন্দর মহলের খবর আমাদের হাতে নেই। সেখানকার খবরও নেয়া আবশ্যক’।

 ‘তোমরা এ নিয়ে আর বিতর্কে যেও না। আমার মনে হয়, এ সিদ্ধান্ত হাসান বিন আব্দুল্লাহর। এ নিয়ে আমাদের বিতর্ক না করলেও চলবে। শুধু আমি তোমাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করেছি, সে ব্যাপারে খুব হুশিয়ার ও সাবধান থাকবে। আরেকটি কথা, এমনও হতে পারে, মেয়েটিকে এখান থেকে সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। কোন গোপন ও নিরাপদ স্থানে তাকে রাখার প্রয়োজন হতে পারে, এ বিষয়েও সতর্ক থেকো’।

 ‘আমরা যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত আছি’। সকলেই সমস্বরে বললো, ‘শুধু আমাদের দরকার সময় মত সংবাদ পাওয়া’।

 ‘সংবাদ যথা নিয়মে পৌঁছবে, এজন্য নতুন করে কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব নয়’। শামস বখত বললেন, ‘এমনও হতে পারে, যখন আন তানুস যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে বা তার হাড় গুঁড়ো হচ্ছে, তখন এসে সংবাদ এসে পৌঁছাবে আমাদের কাছে। সে অবস্থাও আমাদের মেনে নিতে হবে। বেশী নড়াচড়া করতে গেলে আরো বড় রকম সমস্যা বেঁধে যেতে পারে। দোয়া করো সে রকম যেনো কিছু না ঘটে’।

 ‘আপনারা দুই ভাই সেনাপতি, আপনারা কি মনে করেন, আমরা অন্য কারো সাহায্য ছাড়াই যুদ্ধে সুবিধা করতে পারবো?’ গুমাস্তগীন সেনাপতি শামস বখত ও সাদ বখতকে প্রশ্ন করলেন, আপনারা দু’জনই জানেন, সুলতান সালুদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে আমরা কয়েকজন প্রকাশ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে সামরিক জোট গঠন করলেও ভেতরে ভেতরে সবাই পৃথক পৃথক প্ল্যান নিয়ে বসে আছি।

 সুলতান আল মালেকুস সালেহ তো শিশুমাত্র। তিনি যে সব আমীরদের হাতের খেলার পুতুল, তারা তো সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে পরাস্ত করতে পারলে, আল সালেহকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রত্যেকেই স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা দিয়ে দেবে।

 মুসাল প্রদেশের গভর্নর সাইফুদ্দিন আমার বন্ধু। সুলতান আইয়ুবীর সেও একজন শত্রু। কিন্তু সেও একজন স্বাধীন সুলতান হতে চায়, পৃথক রাজ্য ঘোষণা করতে চায়।

 আপনাদের ভালভাবেই জানা আছে, আমি হারান প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অধিক মাত্রায় সৈন্য সংগ্রহ করে বাহিনী করেছি। আমি খৃষ্টান শাসক রিজন্যাল্ট ও তার সমস্ত বন্দী সৈন্যদের এ শর্তেই মুক্তি দিয়েছি, সালাউদ্দিনের সাথে যখন মোকাবেলায় নামবো তখন খৃষ্টানরা আমাকে সহযোগিতা করবে। তারা সুলতানের বাহিনীর পিছন ও পাশ থেকে হামলা করে তাদের গতি আমার দিক থেকে অন্য দিকে সরিয়ে দিবে’।

 ‘যদি আমারা সফল হই, তবে একটি বিশাল এলাকা আপনার পতাকা তলে এসে যাবে। আমি আশা করি, আমরা সুলতান আইয়ুবীকে পরাজিত করতে পারবো। আমরা জানি, তাঁর রণকৌশল কি! যদি তাঁর সেনাবাহিনী জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করে তবে আমরা তাঁর চেয়েও বেশী বাহাদুরী দেখিয়ে যুদ্ধ করবো।

 সালাউদ্দিন একবার হলবের মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। হলবের অধিবাসীরা তার গতি রোধ করে ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে।

 সেই ঘটনা আমাদের সৈন্যদেরও মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে। হলবের অধিবাসীদের চেয়ে আমাদের সৈন্যরা কোন অংশেই কম নয়। সাহস ও বীরত্বে তারা হলববাসীরও পেছন ফেলে দেবে। তাছাড়া আপনার মত অভিজ্ঞ সেনা নায়কের নেতৃত্ব তো আছেই’। বললেন সেনাপতি শামস বখত।

 সাদ বখত সবকিছু নীরবে শুনছিল, গুমাস্তগীন তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার অভিমত কি?’

 ‘আমি মনে করি, আমাদের বিজয় নিশ্চিত। ময়দানে আমাদের সৈন্যরা আপনাকে নিরাশ করবে না’। বললো সাদ বখত।

 দু’ভাইয়ের কেউ তাকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিল না, সুলতান আল মালেকুস সালেহ খৃষ্টান শাসক রিমান্ডকে অগ্রিম স্বর্ণ মূল্য দিয়ে তার সমর্থন আদায় করেছিল। সুলতান আইয়ুবী হলব অবরোধ করলে রিমান্ড সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু সুলতান আইয়ুবীর কমান্ডো বাহিনীর প্রতিরোধে পড়ে যুদ্ধ না করেই স্বসৈন্যে দেশে ফিরে যায়।

 সেনাপতি দুই ভাই কোন বিষয়েই গুমাস্তগীনের সঙ্গে বিতর্কে গেল না। তার সমালোচনা না করে বরং তাকে উৎসাহিত করলো। ১২৭

 তারা পরামর্শ দিল, ‘এখন সুলতান আইয়ুবী আর রিস্তান পাহাড়ী এলাকায় বসে আছে। আর রিস্তান পর্বত শ্রেণীকে হিম্মাতের শৃঙ্গ বলা হয়। এই পাহাড়ী প্রান্তরে থাকতে থাকতে শীতে আইয়ুবীর সৈন্যরা এখন কাহিল হয়ে পড়েছে। ওখানেই যদি আমরা তাকে আক্রমণ করি তবে তাঁকে সহজেই পরাজিত করা সম্ভব’।

 ‘আমার কাছে এমন ধরনের সংবাদ আসছে, সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা নাকি আমাদের মাঝে বিচরন করছে। আমাদের প্রতিটি খবর তাঁর কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে’।

 গুমাস্তগীন বললেন, ‘আপনারা দুই সেনাপতি এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন ও তল্লাশী চালাবেন’।

 ‘এ কথা বলার প্রয়োজন করে না! আমরা সতর্ক আছি’। সাদ বখত বললো, ‘আমরা জানি সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দারা খুব হুশিয়ার। আমরাও এখানে গোয়েন্দা ছড়িয়ে রেখেছি, যাদের প্রতি সন্দেহ হয় ও সন্ধান পাওয়া যায়, তাদের খবর গোপনে জানাতে বলেছি। গোয়েন্দা সংস্থা আমাদেরকে অবহিত করবে’।

 ‘আমি এ ব্যাপারে খুব কঠিন!’ গুমাস্তগীন বললো, ‘যদি আমার আপন সন্তানের ব্যাপারেও সন্দেহ হয়, সে অপরের গোয়েন্দা, তাকে যাঁতাকলে পিষে মারবো। বিন্দুমাত্র দয়া দেখানো হবে না তার প্রতি’।

 গুমাস্তগীনের মনে এমন কোন সন্দেহ ও ধারনাই আসেনি, সে যে সেনাপতিদের সাথে কথা বলছে, তারা কখনো সুলতান আইয়ুবীর গোয়েন্দা হতে পারে। অথচ এরা ছিল আইয়ুবীর বাহিনীর দুই জাঁদরেল সেনা অফিসার।

 গুমাস্তগীনের সাথে কথা শেষ করে তাঁরা যখন একা হলো, তখন তারা নিজস্ব পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করলো। তারা সিদ্ধান্ত নিলো, অভিযান চালানোর আগেই সুলতান আইয়ুবীকে বিস্তারিত সংবাদ জানিয়ে দেয়া হবে। যুদ্ধের সামান্য মহড়া দেখিয়ে সুলতান আইয়ুবীর অবরোধের মাঝে পড়ে গিয়ে তারা আত্মসমর্পণ করবে।

 দীর্ঘ সময় ধরে দুই ভাই পরিকল্পনার খুঁটিনাটি প্রতিটি দিক নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলো।

 তখনো পর্যন্ত গুমাস্তগীন কবে আক্রমণ করবে তা ঠিক হয়নি।দুই ভাই-ই আক্রমনের নির্দিষ্ট সময় জানা জরুরী মনে করলো।

 তারা গুমাস্তগীঙ্কে দ্রুত আক্রমণ করার জন্য চাপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল এবং আরো সিদ্ধান্ত নিল, আক্রমনের দিন তারিখ ও সময় ঠিক হলে তা সুলতানকে সময়মত জানিয়ে দেবে।

 সে রাতে গুমাস্তগীনের মহলে আনতানুসের ডিউটি ছিল না, কিন্তু ফাতেমার সাথে দেখা করার জন্য সে ছিল পেরেশান। ফাতেমা তার কাজে যথেষ্ট সাফল্য দেখিয়েছে। প্রতিদিন রাতেই বাগানে ওদের দেখা হতো। নিয়মিত খবর পেতো আনতানুস। কিন্তু এ সপ্তাহে তার ডিউটি পড়েছে দিনে। ফলে রাতের বেলা ফাতেমার সাথে দেখা করা মুস্কিল হয়ে গেল তার জন্য।

 আনতানুস থাকতো কেল্লার বাইরে তাদের জন্য নির্দিষ্ট গার্ডরুমে। ফটক হয়ে রাতে কেল্লায় প্রবেশের কোন সুযোগ ছিল না তার। অন্য দিকে কেল্লার দেয়াল ছিল খুবই উঁচু। সে দেয়াল টপকে কেল্লায় প্রবেশও খুব সহজ সাধ্য ছিল না।

 বাইরে থেকে যদিও বুঝার কোন উপায় ছিল না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার পেরেশানী বেড়েই যাচ্ছিল। একদিকে দায়িত্ব পালনের অনুভূতি, অন্যদিকে ভালবাসার টান, কোনটাই তার কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

 একই রকম অস্থিরতায় ছিল ফাতেমাও। সে আনতানুসের কাছে খবর পাঠালো, ‘রাতের নির্দিষ্ট সময়ে বাগানে চলে এসো। জানি, প্রধান ফটক দিয়ে আসতে পারবে না। সে জন্য বাগানের পেছনে দেয়ালের পাশে যে উঁচু গাছ আছে, তার অন্ধকারে চলে এসো। ওখানে দেয়ালের বাইরে রশি ঝুলানো থাকবে, সে রশি বেয়ে চলে আসবে বাগানে’।

 দিন গড়িয়ে রাত এলো। মহলে আজ বিরাট ও জমজমাট মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।

 গুমাস্তগীন এমন সব বড় বড় মেহমানদের আমন্ত্রন জানিয়েছে, যারা যুদ্ধের সময় কোন না কোন ভাবে তার সাহায্য আসবে। এদের মধ্যে খৃষ্টান সামরিক কমান্ডার যেমন আছে, তেমনি আছে মুসাল থেকে আগত কয়েকেজন মুসলমান সামরিক অফিসার, যারা গোপনে তাকে সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছিল। গুমাস্তগীন কিছু বেসামরিক লোককেও দাওয়াত করেছিল, এদের কাছে ছিল অঢেল অরথ-সম্পদ। এদের সবার সাথেই গুমাস্তগীন বেশ আন্তরিক ও সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। যুদ্ধের সময় এরা সবাই যে তাকে সাহায্য করবে এতে তার কোন সন্দেহ ছিল না।

 মাহফিল এখনো শুরু হয়নি, জলসায় এসে উপস্থিত হলো সেনাপতি শামস বখত ও সেনাপতি সাদ বখত। তাদের সঙ্গে প্রবেশ করলো গুমাস্তগীনের প্রধান বিচারক কাজী ইবনুল খাশিব আবুল ফজল।

 ফাতেমার জন্য আজকের জলসা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।মাহফিলের মর্ম এখন সে বুঝতে পেরেছে। সে তার মর্জি ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে চমৎকার সাজগোজ করলো। এমনিতেই সে ছিল অসম্ভব রুপসী। তার রূপ ও যৌবন পুরুষের চোখগুলোকে আকর্ষণ করতো চুম্বকের মত।

 মাহফিলে সে রুপের বন্যা বইয়ে দিল। যেখানে উচ্চপদস্থ খৃষ্টান ও মুসলিম সামরিক অফিসাররা বসেছিলো, সেও গিয়ে বসলো তাদের পাশে। ওখানে বসে উৎকর্ণ হয়ে তাদের আলাপ আলোচনা শুনতে লাগলো। সে এমনভাবে জায়গা বদল করতো ও কান পেতে শুনতো, যাতে কারো কোন সন্দেহ না হয়। ঘুরতে ঘুরতে সে শামস বখত ও সাদ বখতের কাছে চলে এলো। তাঁরা তাকে সতর্ক থাকার উপদেশ দিয়ে বললো, ‘কোন গোপন তথ্য পেলে আমাদের জানিয়ে দিও। আনতানুসের সাথে বেশী সাক্ষাৎ করতে যেও না’।

 কিন্তু সে যে আনতানুস কে আজ রাতেই আসতে বলেছে এ কথা ওদের কাছে বললো না।

 আজকের মাহফিলে বাইরে থেকেও নামকরা নর্তকী আমদানী করা হয়েছিল। মহলেরও সব সুন্দরী নর্তকী, গায়িকা ও তরুনীদের বলা হয়েছিল, মাহফিলের সৌন্দর্য ও আকর্ষণ বৃদ্ধির ব্যাপারে বিশেষভাবে যত্নবান হতে।

 এদের পোশাক আশাক ছিল বড় বিচিত্র ধরনের। কেউ আঁটসাঁট পোশাক পড়ে সারা অঙ্গে ঢেউ তুলে তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কারো পরনে ছিল অতিশয় পাতলা পোশাক, কারো পরনে স্বল্পবাস। যেন যৌবন প্রদর্শনীর হাত বসেছে এখানে। মেয়েরা কেউ নাচছিল, কেউ গাইছিল, কেউ সঙ্গ দিচ্ছিল মেহমানদের।

 অন্দর মহলের মেয়েদের প্রতি নির্দেশ ছিল, তারা যেন অতিথিদের খুশী করতে ও তাদের আপ্যায়ন করতে কোন ত্রুটি না করে।

 কেন কি কি উদ্দেশ্যে এ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে মেয়েদেরকে সে কথাও বলে দেয়া হয়েছিল। বোতলের পর বোতল উজাড় হচ্ছিল বিদেশী মদ।

 ফাতেমা রাজহংসীর মত সাবলীল ভঙ্গীতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আসরময়। মেহমানদের সাথে মেলামেশা করছিল খোলা মনে। তার অভিনয়ে কোন খুঁত ছিল না।মাহফিলের সৌন্দর্য ও আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলছিল নর্তকী ও গায়িকারা। তাদের নুপুর নিক্কন ও সুরের সম্মোহনে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে উপস্থিত লোকজন।

 রাত গভীর হলো। তখনো নাচ-গান পুরোদমেই চলছে। ও দেখলো,আনতানুসের আসার সময় হয়ে এসেছে। ফাতেমা ক্রমশঃ অধীর হয়ে উঠছে। কারণ আনতানুসকে বেশীক্ষণ বসিয়ে রাখতে গেলে বিপদের সম্ভাবনাই বাড়বে কেবল। সে সবার অলক্ষ্যে আসর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। ইচ্ছা, আন তানুসের সাথে দেখা করেই আবার ফিরে আসবে মাহফিলে।

 সন্ধ্যার পরপরই সে এক দাসীকে দিয়ে দেয়ালে রশি ঝুলিয়ে রেখে এসেছিল। আনতানুস কে বলেছিল,দেয়াল সংলগ্ন বড় ১৩৩ গাছের নিচে দাঁড়াতে। রশি বেয়ে দেয়াল টপকে এ গাছের আড়ালেই থাকবে আনতানুস।

 ফাতেমা ভেতরে ভেতরে আসর থেকে বেরোনোর জন্য ছটফট করছিল। কিন্তু নারীর স্বাভাবিক অভিনয় গুণ দিয়ে সে তার অস্থিরতা লুকিয়ে রাখছিল। সে সময় ফাতেমা এক খৃষ্টান কমান্ডারের সাথে বলছিল। এই খৃষ্টান খুব সাবলীল আরবীতে কথা বলছিল ওর সাথে। ফাতেমা সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ প্রকাশ করল কমান্ডারের কাছে। ইচ্ছে, এই ক্রুসেড কমান্ডার তার মনের কথা ব্যক্ত করুক তার কাছে।

 তার ইচ্ছে সফল হলো, সে বলতে লাগলো, ‘তোমার এই ক্ষোভ বেশী দিন থাকবে না। তার পতনের দিন ঘনিয়ে এসেছে।

 তারপর তারা কেমন করে সুলতান আইয়ুবীকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করবে তার এক চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিতে দিতে সে ফাতেমার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে তার গায়ে হাত দিল। ফাতেমা তাকে প্রথমে বাঁধা দিল না। কারণ সে মূল্যবান সব তথ্য দিচ্ছিল ফাতেমাকে। খৃষ্টান কমান্ডার তাকে মাহফিল থেকে সরিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। ওরা হাঁটছে আর কথা বলছে। ফাতেমার হাত খৃষ্টান কমান্ডারের মুঠোয় আবদ্ধ।

 ফাতেমা এগুতে চাছিল না, কিন্তু কমান্ডারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করতে পারছিল না। সে মৃদু আপত্তি জানালো কমান্ডার তা গায়েই মাখলো না। ওকে টানতে টানতে বাগানে ১৩৪নিয়ে এলো।

 বাগানের এক অন্ধকার কোণায় এসে থামলো কমান্ডার। ফাতেমা অনুভব করলো, আনতানুস এসে পড়েছে। যদিও ফাতেমা তাকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু তার মন বলছে, আনতানুস আশেপাশেই কোথাও আছে এবং ঠিকই তাকে দেখতে পাচ্ছে।

 সে এখান থেকে সরে পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো। কমান্ডারকে বললো, ‘এসো আমরা মাহফিলে ফিরে যাই’!

 কিন্তু কমান্ডার ফিরে যেতে রাজী হলো না। তাকে বললো, ‘এতো উতলা হচ্ছো কেন? রাজনীতি ছাড়াও তোমার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। সে কথা বলতেই তো তোমাকে এই নিরিবিলিতে নিয়ে এলাম। আমার কথা, আমার আচরণ নিশ্চয়ই তোমার ভাল লাগবে’।

 ফাতেমা এ কথার কোন জবাব দিল না। সে দ্রুত এখান থেকে সরে পড়ার তীব্র তাগাদা অনুভব করছিল, কিন্তু কি বলে কমান্ডারকে রাজী করাবে ভেবে পেল না। কমান্ডার তার কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে ঘাসের ওপর বসে পড়ে এক রকম জোর করেই তাকেও টেনে পাশে বসিয়ে দিলো। তারপর আবেগতপ্ত কণ্ঠে তার রুপের আকাশ ছোঁয়া প্রশংসা।

 ফাতেমা তাকে বাঁধা দিতে চেষ্টা করলো, কিন্তু কমান্ডার তখন মদ ও রুপের নেশায় বিভোর। সে ফাতেমার শরীরে হাত দিতে চেষ্টা করলো। ফাতেমা ১৩৫বললো, ‘একটু চিন্তা করো, আমি কেবল পরস্ত্রীই নই এমন এক জনের স্ত্রী, যে এই কেল্লার মালিক। আর যাই হোক তুমি তার ভাগের রসে আঙ্গুল ডুবাতে পার না!’

 ‘আরে, তেমন আদেশ আছে বলেই না এমন সাহস পাচ্ছি! তুমি যাকে স্বামী বলছো সে কি আসলেই তোমার স্বামী! সে তো স্বামীর পরিচয়ে তোমাদের জোগাড় করে রেখেছে আমাদের জন্যই!’

 কমান্ডার বল লো, ‘নিশ্চয়ই ব্যাপারটা তুমিও ভাল করেই জানো, সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে পরাজিত করে নিজে বাদশাহ স্বার্থে তার সমস্ত স্ত্রীদেরকে মেহমানদের জন্য, বিশেষ করে আমাদের জন্য আজ রাতে হালাল করে দিয়েছে সে!’

 ফাতেমা তখনো তার রাগ ও অস্থিরতা সামলে হেসে বল লো, ‘সে এক নির্লজ্জ ও নিমকহারাম মানুষ!’ কারণ সে ঠিকই জানতো, কমান্ডার মিথ্যা বলছে না।

 কমান্ডার ও হেসে দিল। বললো, ‘তুমি ঠিকই বলেছো, তোমাদের জাতটাই অদ্ভুত। এমন নিমক হারাম জাত পৃথিবীর আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই।সামান্য একটু লোভের মূল্য, নিজের একটু ব্যক্তিগত স্বার্থ দেখলে যে মানুষ তার ঈমান বিক্রি করে দিতে পারে, নিজের স্ত্রী, মা-মেয়ে বা বোনের ইজ্জত কি তার চেয়েও মুল্যবান? যে তার ঈমানই বিক্রি করে দিতে পারে, বেগমদের ইজ্জত বিক্রি করতে তার বিবেকে বাঁধবে কেন? ১৩৬

 ফাতেমার কাছে এ প্রশ্নের কোন জবাব ছিল না। সে অন্তহীন কষ্ট আর ব্যথা বুকে চেপে স্থির পাথরের মত সেখানে বসে রইল।

 কমান্ডার বল লো, ‘তুমি এক নির্বোধ মেয়ে মানুষ। তোমার মালিক তোমাকে আনন্দ স্ফূর্তির অবাধ সুযোগ দিয়ে রেখেছে, তুমি কেন সে আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে? তোমাকে সুখী করার সময় তোমার স্বামীর জীবনেও হবে না। তাহলে কে পৃথিবীর সুখ ও আনন্দ হাতের মুঠোয় পেলে তা তুমি দূরে ছুঁড়ে ফেলবে?’

 ফাতেমার অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল অস্থির যন্ত্রণায়। এমনিতেই আন তানুসের উপস্থিতির কথা মনে করে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল তার বুকে। তার ওপর গুমাস্তগীনের এই অমানুষের মত আচরণ তার চিত্তকে ফালা ফালা করে দিচ্ছিল।। যদি এই মানুষটার মধ্যে সামান্য আত্মসম্মানবোধও থাকতো তবে সে এমন আত্মঘাতি প্রস্তাব দিতে পারতো না মেহমানদের। কমান্ডার যেটাকে অবাধ স্বাধীনতা বলছে, সেটা তো স্রেফ আত্মহননের নামান্তর!

 আফসোস, সে তার বিয়ে করা স্ত্রীদের খৃষ্টান মেহমানদের হাতে তুলে দিয়ে বলছে, ‘খবরদার মেহমান যেন অসন্তুষ্ট না হয়!’ গুমাস্তগীন সেই দুরাচারের নাম, যে তার স্ত্রীদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে সুলতান আইয়ুবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সহযোগিতা নিচ্ছে।

 ফাতেমা জালে আটকে পড়া ভয়ার্ত হরিণীর মত ছটফট ১৩৭ করছিল। সে এই খৃষ্টান কমান্ডারের মুখে থুথুও দিতে পারছে না, তাকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়েও যেতে পারছে না। নিজের বোকামীতে সে নিজেই আটকে গেছে।

 বেকুবের মত কেন সে আসতে গেল বাগানে? সে স্বেচ্ছায় না এলে এই নির্জন অন্ধকারে কমান্ডার কি তাকে জোর করে নিয়ে আসতে পারতো?

 এক অবর্ণনীয় অসহায়ত্বে পড়ে গেল ফাতেমা। বুঝতে পারছে না, সে এখন কি করবে? কি তার করা উচিত? কি করলে সে এই মহাসংকট থেকে পরিত্রান পাবে?

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 4 | 5 | 6 | 7 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top