১১. চারদিকে চক্রান্ত


কিছুক্ষণ পরেই একটি বিরাট পাল তোলা নীেকা এসে কুলে ভিড়লো। নীেকার মধ্য থেকে একজন দাঁড়িয়ে বললো, ‘সাবধান! কেউ কোন শব্দ করবে না।”
পরিপূর্ণ নিরবতার মধ্য দিয়ে কালো হাবশী সুদানীরা নৌকা থেকে একে একে নেমে এলো। একটু পরই তার পাশে এসে ভিড়লো আরও একটি নৌকা। সে নৌকা থেকেও নেমে এলো হাবিশীরা।
দুটাে নৌকাই বেশ বড়। কম করেও দুইশ হাবশী নদীর কিণারে নেমে এসেছে।
দ্রুত মাল খালাস করলো। ওরা। মাল মানে, যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম ও অন্ত্রপাতি, মালখালাস হতেই মাল্লাদের বলা হলো, জলদি নীেকা ফিরে নিয়ে যাও ।
মাল্লারা তাড়াতাড়ি পালের রশি টেনে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে তীর থেকে দূরে সরে গেল। ধীরে ধীরে নৌকা হারিয়ে গেল অন্ধকারে। এভাবেই নৌকায় করে হাবশী সেনাদের আমদানী চলতে থাকলো। নদীর পাড়ে নেমেই ওরা দ্রুত পাহাড়ের দুৰ্গম অঞ্চলে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল।
দুই সিপাহী ক্যাম্পে ফিরে এলো। ততক্ষণে ক্যাম্পের নাচগানের আসর শেষ হয়ে গেছে। রাতভর নাচ দেখে ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়ে নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরে যাচ্ছে সৈন্যরা। নাচ-গানের জন্য পৃথক তাবুর ব্যবস্থা করেছিল কমাণ্ডার। একটি মেয়েকে তার খুব পছন্দ হয়ে গেল। দেখতে মেয়েটি অল্প বয়স্ক ও চঞ্চল। কমাণ্ডার ভাবলো, এরা কেবল নর্তকীই নয়, নিশ্চয়ই পেশাদার নিশিকন্যাও। সে বাজনাদারকে বললো, “এই মেয়েটিকে আমার তাবুতে পাঠিয়ে দিও।”
এরা কোন সাধারণ নাচের পার্টি ছিল না, বরং এ লোকগুলো ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। তথ্য সংগ্রহের জন্য আসেনি ওরা, তাদের মিশন ছিল, ক্যাম্পের সৈন্যদের যে কোন মূল্যে ভুলিয়ে ভালিয়ে ক্যাম্পে আটকে রাখা। যাতে সুদান থেকে হবেশী সেনারা নিরাপদে মিশরে প্রবেশ করতে পারে।
তাদের আরও বলে দেয়া হয়েছিল, পারলে কমান্ডার দুজনকে মুঠোয় নিয়ে এসো। ওরা পরেও কাজে লাগতে পারে।”
কমাণ্ডার মেয়েটাকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা প্ৰকাশ করতেই সঙ্গে সঙ্গে তার আশা পূরণ করা হলো। মেয়েটাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো কমাণ্ডারের তাবুতে।
কমাণ্ডার ছিল মধ্য বয়সী, নর্তকী পূর্ণ যৌবনা। তাঁবুতে যাওয়ার সাথে সাথে মেয়েটির লাস্যময়ী ভাব ও উচ্ছলতা একদম উবে গেল । যে মেয়েটি লম্মফবম্বফ করে নেচে গেয়ে হাসি তামাশায় দর্শকের মন মাতিয়ে রেখেছিল, নিভে গেল তার দীপ্তি। যে মেয়ের মিষ্টি হাসি কেড়ে নিয়েছিল সবার মন, হারিয়ে গিয়েছিল সে হাসি।
তাঁবুতে তখনও প্ৰদীপ জ্বলছে। মেয়েটি জড়োসড়ো হয়ে তাবুর এক কোণে বসে কমাণ্ডারের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে রইল। কমাণ্ডার বললো, “কি ব্যাপার, তুমি আমন চুপসে গেলে কেনো? আমি ডাকায় মন খারাপ করেছো?”
“আমি কখনও পান করিনা। আমার বাবাও কোন দিন মদ পান করেনি!’ নর্তকী বললো।
“তুমি মদের কথা বললে কেন? আমি তো তোমাকে বলিনি, তুমি মদ পান করো?”
“যারাই ঘরে ডাকে, তারা প্রথমেই বলে, একটু পান করো সুন্দরী। তারপর বলে, আমাকে একটু ঢেলে দেবে?”
“তুমি ঠিকই বলেছো, কথায় বলে, মদ ছাড়া নারী ও নারী ছাড়া মদ একদম বিস্বাদ!” কমাণ্ডার হেসে বললো, তবে তুমি শুনলে অবাক হবে, আমি কোনদিন মদ পান করিনি, আর ভিন্ন নারীর স্বাদ কেমন তাও জানিনা।”
“ও, তবে তো তুমি এক আনাড়ী পাপী!” নর্তকী বললো, “আমি একটি কথা বললে মন খারাপ করবো?”
“কি কথা?”
কথাটি হলো, ‘গোনাহ করাতে যে মজা, গোনাহ না করার মজা কিন্তু তার চেয়েও বেশী। তুমি পুরুষ মানুষ, এই নির্জন তাঁবুতে আমার মত সুন্দরী মেয়ের কাছ থেকে এ কথা শুনতে হয়তো তোমার ভাল লাগবে না। হয়তো মনে মনে আশ্চর্য ও বিরক্ত হবে। কিন্তু একটু গভীর ভাবে চিন্তা করো, তোমার চেহারাই বলছে, আজ প্রথম তুমি পাপ করার ইচ্ছা পোষণ করেছ। এতো ঠাণ্ডায়ও তোমার কপালে ঘামের ফোটা দেখা যাচ্ছে। এই যে জীবনভর তুমি পাপ থেকে বেঁচে থাকলে, এর মাঝে কি কোন প্রশান্তি নেই?”
“তুমি ঠিকই বলেছ।” মধ্য বয়সী কমাণ্ডার বললো, “আমাকে যখন সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল, তখন পাপ থেকে বাচার শিক্ষাও দেয়া হয়েছিল। ট্রেনিংয়ের সময় শারীরিক প্রশিক্ষণের সাথে চারিত্রিক প্রশিক্ষণও অন্তর্ভুক্ত থাকতো। এই কারণেই তো সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী একশ সৈন্য নিয়ে ক্রুসেডদের এক হাজার সৈন্যকে রক্তে ভাসিয়ে দিতে পারতো।”
“কিন্তু এখন তোমার কাছ থেকে একজন দুর্বল মেয়ে অস্ত্ৰ কেড়ে নিতে পারে।” নর্তকী বললো, “তুমি তোমার এতদিনের চারিত্রিক শক্তি সামান্য এক মেয়ের হাতে তুলে দিতে চাও?’
কমাণ্ডার এ কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠলো। সে সহসাই বলে উঠলো, “আমি এমনটি আশা করিনি। তুমি এখানে এসে এ ধরনের কথা বলবে, ভাবিনি। আমি তো চিন্তা করেছিলাম, তুমি এই নির্জনে এসে তোমার চঞ্চল অভিনয়ে, মান অভিমানে আমাকে পাগল বানিয়ে দেবে। তোমার সেই হাসি, গান ও নাচের ভঙ্গি কোথায়, যা আমাকে বাধ্য করেছে তোমাকে ডাকতো?”
কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো কমাণ্ডার। তারপর এক সময় মাথা তুলে বললো, “তোমার দলের লোকদের কাছে আমি তোমাকে ভিক্ষা চাই! তোমার দলনেতাকে বলো, বিনিময়ে আমি দুটি আরবী ঘোড়া দেবো।”
“তোমার তলোয়ারও কি দিয়ে দেবে?” মেয়েটি ব্যঙ্গ করে বললো, “তোমার বর্শা, তোমার ঢাল, তোমার খঞ্জর অর্থাৎ তোমার সমস্ত হাতিয়ার কি দিয়ে দেবে?”
সে ব্যগ্র কণ্ঠে বললো, “হ্যা, দেবো, দেবো, সব দিয়ে দেবো!” কিন্তু পরক্ষণেই তার সন্বিত ফিরে এলো। অশান্ত কষ্ঠে সে। বললো, না! সিপাহী কখনও তার হাতিয়ার ছাড়া চলতে পারে না ।’
সে তাবুর মধ্যেই দ্রুত পায়চারী করতে লাগলো।
হঠাৎ থেমে রাগের সাথে বলে উঠলো, “একজন নর্তকীর মুখে এসব কথা শোভা পায় না। তুমি কি আমার হাত থেকে মুক্তি চাও? এ জন্যই কি এমন কৌশল করছো, যেন আমি তোমার শরীরে হাত না লাগাই?”
“হ্যা! আমি তোমার থেকে আমার দেহ রক্ষা করতে চাই।” মেয়েটি বললো ।
‘কেন, তুমি কি অক্ষত? তুমি কি বলতে চাও, তোমার দেহ এখনো পবিত্র?”
“না।’ নর্তকী বললো, “আমি আমার দেহটাকে পবিত্ৰ মনে করি না, এমন দাবীও করি না। কিন্তু আমি আপনার দেহটাকে অপবিত্র করতে চাই না। একজন অপবিত্র লোককে অপবিত্র করায় কোন গ্লানি থাকে না, কিন্তু একজন পবিত্র মানুষকে অপবিত্র করার গ্লানি সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়।” কমাণ্ডার তার এ কথা শুনে নির্বোধের মত হয় করে তাকিয়ে রইলো। নর্তকী এবার আরো তোক্ষ্ণ তীর ছুঁড়ে মারলো। বললো, কোন মেয়েই তার বাবার দেখকে নাপাক করতে চায় না।
“আহ!” কমাণ্ডার চিৎকার দিয়ে থামিয়ে দিল ওকে । তারপর দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে বললো, “ও, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো তুমি। আমি বুড়ো হয়ে গেছি, আর তুমি যে যুবতী!” সে মাথা নত করে বসে রইলো ।
নর্তকী উঠে কমাণ্ডারের কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “এত নিরাশ হচ্ছেন কেন? আমি তো আপনাকে ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না। আপনাকে ছলনাও করছি না। যদি আপনি শুধু একজন পুরুষ রূপেই থাকতে চান, তবে আমি না হয় নর্তকী হয়েই থাকবো। আর নিজের মনকে এই বলে বুঝ দেবো, আমার সামনে এমন একটি পুরুষ পড়েছিল, যে লোক আল্লাহর অভিশাপে পড়ে গিয়েছিল। আমি আপনাকে পিতার মত দেখেছি ও দেখছি। আপনি আমার আর দুটো কথা শুনুন, তারপর যা মনে চায়। তাই করবেন, আমি মোটেই বাঁধা দেবো।
না ।’
“কি কথা?”
“আপনার কি মেয়ে আছে?”
“হ্যা, একটি মেয়ে আছে।” কমাণ্ডার উত্তর দিলো।
“তার বয়স কত হবে?”
‘বারো বছর।”
“যদি আপনি মারা যান, আপনার স্ত্রী অসহায় ও দারিদ্রের চাপে আপনার মেয়েকে কোন যাত্রা পাটি বা নাচের দলে বিক্রি করে দেয়, আপনার আত্মা কি শান্তি পাবে? তখন কি আপনার আত্মা মরুভূমি ও এই পাহাড়ে পর্বতে চিৎকার করে বেড়াবে না? আহাজারি করবে না?”
কমান্ডার বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে।
নর্তকীও অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। দু’জনই চুপচাপ।
একটু পর মেয়েটি আবার বললো, “ভুল বুঝবেন না আমায়। মনে করুন আপনি মরে গেছেন, আপনার মেয়ে এক পাপিষ্ঠের সাথে তার তাবুতে বসে আছে। আর সে পাপিষ্ঠ তাকে বলছে, মদ আনো, মদ ছাড়া নারীর কোন মজা নেই।” কমাণ্ডারের ঠোঁট রাগে, অপমানে ও আত্মধিক্কারে কাপছিল। সে সহসা গর্জন করে উঠলো, “বেরিয়ে যাও এখান থেকে, বেরিয়ে যাও পাজি মেয়ে ।”
মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, যদি আমার বাবা জীবিত থাকতেন, তবে তিনি আমাকে আপনার তাবুতে এভাবে দেখতে পেলে দু’জনকেই খুন করে ফেলতেন।”
কথাগুলো বলার সময় আবেগে থর থর করে কাঁপিছিল তার গলা। চোখ থেকে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রুর ফোঁটা। কমাণ্ডার উঠে তাবুর মধ্যে পায়চারী করতে লাগলো। নর্তকী কমাণ্ডারের মানসিক অবস্থা ও রাগকে উপেক্ষা করলো না। বললো, “আমি আপনাকে বৃদ্ধ মনে করে ঘূণা করেছি, এটা ঠিক না। আমি তো আমার দাদার বয়সী লোকের সাথেও রাত কাটিয়েছি। বয়সের ভার যাকে ভেতর থেকে গুড়ো করে দিয়েছে, সেও তার অর্থের গরমে নিজের লাশের মধ্যে প্ৰাণ সঞ্চার করতে চায়। আপনি এখনও ততটা বুড়ো হননি। কিন্তু আপনার চেহারার সঙ্গে আমার বাবার এত মিল যে, আমি শেষ পর্যন্ত একজন নর্তকী থেকে এক কন্যা হয়ে গেছি।
আমি আপনাকে যে কথাগুলো বললাম, এসব কথা আমার মাথায় আগে কোনদিন আসেনি। এতদিন আমি জানতাম, আমি শুধু নাচতে জানি এবং মানুষকে আঙ্গুলোর ইশারায় নাচাতে জানি। কিন্তু আমি যে এক বাপের কন্যা হতে পারি, আজই প্রথম জানলাম। আমার কথা শুনে আপনি যতো বিস্মিত হচ্ছেন, আমি নিজে বিস্মিত হয়েছি তার চেয়েও বেশী।”
কমাণ্ডার তার দিকে তাকালো, ততক্ষণে তার রাগ পড়ে গেছে।
মেয়েটি আবার বললো, “আমার মা ও বাবার চেহারা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। তাদের কোলে পিঠে মানুষ হয়েছিলাম বড় আদরে। তাদের শরীরের উষ্ণতা ও গায়ের গন্ধ এখনো আমি মনে করতে পারি।
আপনার মেয়ের বয়স বারো, আমার তখন বয়স ছিল নয়দশ। মা-বাবা আমাকে খুব আদর করতেন। আমার বাবা মিশরের সেনাবাহিনীতে ছিলেন। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ক্ষমতায় আসার আগেই তিনি শহীদ হন।
আমার মা তখনও যুবতী। আমরা ছিলাম গরীব। মা আমাকে একটি লোকের হাতে তুলে দিলেন। সে লোক আমার সামনেই মার হাতে আমার মূল্য গুণে দিলো।
লোকটি মাকে বললো, “আপনার মেয়েকে আমি বড় ঘরে ভাল পাত্র দেখে বিয়ে দেবো।”
বিদায় নেয়ার সময় আমি কেন্দে ফেলেছিলাম। মা আমাকে সান্তুনা দিয়ে বলেছিলেন, “লোকটি তোমার বাবার বন্ধু। সে তোমাকে তোমার বাবার মতই আদরে রাখবে।”
আমি বারো বছর ধরে আছি লোকটির সাথে । লোকটি আমাকে শুধু আশ্বাস দিচ্ছে, “তোমার নাচ-গান শেখা হলেই তোমাকে ভাল বর, ভাল ঘর দেখে বিয়ে দিয়ে দেবো।”
কিন্তু এখন আমি বড় হয়েছি। বুঝতে পারছি, লোকটি আমার বাবার বন্ধু নয়, বাবাকে সে দেখেওনি কোনদিন। এ লোক কোনদিন আমাকে বিয়ে দেবে না। আমাকে বিয়ে দিলে যে তার আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে!
এ লোক আমাকে নর্তকী হতে বাধ্য করলো। নেচে গেয়ে মানুষের মনোরঞ্জনই পেশা হয়ে গেলো আমার। অবশ্য এ লোক আমাকে স্নেহ করেন না, এমন নয়। তিনি আমার মালিক এবং আমার উস্তাদও । আমার সঙ্গে তিনি খুব সদয় ব্যবহার করেন। আমাকে ভাল ভাল খেতে দেন, পরতে দেন ।
যখন আমি পরিপূর্ণ যুবতী হলাম তখন আমি নিজেকে নতুন করে চিনতে শিখলাম। বুঝতে শিখলাম আমার জীবনের মূল্য। আর যেদিন আমি তা বুঝতে পারলাম, সেদিন থেকেই আমার আশা ভরসা ও সব স্বপ্ন কল্পনা নিঃশেষ হয়ে গেল।
আমি এখন এক মনোরম মাটির পুতুল। মানুষ এ পুতুল আদর করে মজা পায়, কিন্তু তাতে পুতুলের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আপনাকে দেখে এ পুতুলে আবার প্রাণ ফিরে এলো। জেগে উঠলো বাবা মায়ের সেই আদর ও সোহাগের স্মৃতি।
কথা বলছিল মেয়েটি, কিন্তু তার চোখ দিয়ে অনর্গল গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু । সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো, “এখন আমার এমন মনে হচ্ছে, যেন আমার বাবার আত্মা এই তাবুর আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। এই তাঁবুতে আসার আগে আমি কি ছিলাম। আর এখন কি হয়ে গেলাম! এমনটি কখনও হয়নি আমার। এখন মনে হচ্ছে, আমার পিতার আত্মা আমার চারপাশে ব্যাকুল হয়ে ছুটাছুটি করছে।”
“তোমার নাচ দেখে বুঝতে পারছি, তুমি বেশ দামী নর্তকী।
আমীরদের মহল ও চোখ ধাঁধানো সরাইখানাতেই মানায় তোমাকে । কিন্তু তুমি শহর ছেড়ে এই মরুভূমিতে কেন এসেছে?” শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো কমাণ্ডার ।
‘আমি উপযুক্ত মূল্য পেয়েই এখানে এসেছি।’ নর্তকী বললো, ‘আমি দলের কাউকে চিনি না। আমাকে শুধু বলা হয়েছে, সীমান্তে যেতে হবে। আর সেখানে যে সকল সেনা ফাড়ি রয়েছে, সেখানকার সিপাহী ও কমাণ্ডারদের মনোরঞ্জন করতে হবে। এর জন্য আমি নতুন করে কোন মূল্য নিতে পারবাে না। সৈন্যদের বিনা মূল্যে নাচ দেখাতে ও খুশী করতে হবে আমাকে ৷”
“তুমি জানো না, সৈন্যরা দীর্ঘদিন আত্মীয় পরিজন থেকে দূরে থাকতে থাকতে এক সময় নেকড়ে হয়ে যায়? জেনে শুনে তুমি এই নেকড়ের খাঁচায় আসতে রাজি হলে?”
‘কেন আসবো না! আমি কি এক শহীদ পিতার সন্তান নাই? দেশের জন্য আমার বাপ জান দিতে পারলে আমি কি দেশের সেবায় নিয়োজিত মুজাহিদদের একটু মনোরঞ্জনও করতে পারবাে না! যে সব সিপাহী ও কমাণ্ডার মিশরের সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত, তাদের আমি সেবা করতে পারছি, এটাই তো আমার বড় পাওয়া!
এই সিপাহীদের খুশী করাই আমার ডিউটি। আমার এই নাচগানে মুজাহিদ পিতার উত্তরসূরীরা যদি চাঙ্গা হয়ে উঠে, শহীদ পিতার আত্মা শান্তি পায়, তবে কেনো আমি তা করবো না।
কমাণ্ডার এক বাপ হারা মেয়ের বিলাপ শুনছিল, শুনছিল এক নর্তকীর দেশপ্রেমের কাহিনী। বললো, “আমি দুঃখিত, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। এতদিন জানতাম, দেশপ্রেম সৈনিকদের নিজস্ব সম্পদ। আমার সে ভুল ধারনা ভেঙে গেছে, ধোঁকা ও প্ৰবঞ্চনার পর্দা সরে গেছে আমার চোখ থেকে । আজ বুঝতে পারছি, দেশপ্রেম কোন শ্রেণী বা গোষ্ঠীর নয়, দেশপ্রেম দেশের সকল মানুষের সবচে প্রিয় ও আদরের সম্পদ। এর জন্য যে কোন ত্যাগ যে কোন সময় হাসিমুখে যারা বরণ করে নিতে পারে, তারাই সত্যিকার মুজাহিদ। তুমি আমাকে কি ভ্ৰান্তি ও ধোঁকার হাত থেকেই না বাঁচালে!”
“আমি আপনাকে কি ধোঁকা থেকে বাঁচাবো, আমার নিজের জীবনটাই তো এক মহা ধোঁকা। এ জীবন যেমন নিজের জন্য ধোঁকা তেমনি অপরের জন্যও । কিন্তু তাই বলে আমি স্বদেশের মুজাহিদদের নাপাক করতে পারবো না। ওই ক্যাম্পের কমাণ্ডার আমাকে তার তাবুতে ডেকেছিল।
আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে চলে এসেছি। কিন্তু আপনার কাছে শুধু এ জন্যই এসেছি, আপনার চেহারা অবিকল আমার বাবার মত।’
নর্তকী নতজানু হয়ে বসে ভক্তি সহকারে কমাণ্ডারের একটি হাত তুলে নিয়ে প্রথমে চোখে মুখে লাগালো, পরে সে হাতে চুমো খেল। কমাণ্ডার অপর হাত মেয়েটির মাথায় বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার নাম কি?”
কথা, তাহলে কি উপায় হতো আমাদের? আমাদের গোপন উদ্দেশ্য কোন নর্তকীকেই বলা উচিৎ হবে না।
নর্তকীদের আমরা তাদের পাওনার অতিরিক্ত মজুরী দিয়েছি। এখন একটু বাড়তি কাজ পড়ে গেলে খুশী হয়েই তারা তা করে দেবে।’
“কিন্তু যদি আমরা তাকে আমাদের উদ্দেশ্য ও প্ল্যানের কথা বাগিয়ে নিতে পারতো। হয়তো দেখা যেতো, কমাণ্ডার জালে ফেসে গেছে নিজেই হাবশী সৈন্যদের মিশরে প্রবেশের ব্যবস্থা করছে।”
“আমাদের কমাণ্ডার আমাদের চেয়ে বেশী বুদ্ধি রাখেন। এ সব নর্তকী মেয়েরা আমাদের হাতের অস্ত্র। হাতের অস্ত্রকে কেউ কোনদিন গোপন তথ্য জানায় না।”
কমাণ্ডার প্রশান্ত মনে নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়েছিল। নর্তকী তাকে ভীষণ এক পাপ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, এ জন্য সে মনে মনে শান্তি ও স্বস্তি বোধ করছিল। তার বুকে জেগে উঠেছিল পিতার মমত্ববোধ ও স্নেহ।
নর্তকী তার প্রশান্ত চেহারার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো। যখন কমাণ্ডারের চোখ ঘুমে বুজে এলো এবং জোহরার অশ্রু ভেজা চোখ দুটো আবার ঝাপসা হয়ে এলো, তখন সে তাবু থেকে বেরিয়ে নিজের তাবুতে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
রাত তখন সামান্যই বাকী ছিল। এক সময় তাও শেষ হয়ে গেল। ফজরের আজান হলো। সৈন্যরা উঠে অজু করে নামাজ পড়লো। নাচের দলের লোকদের যখন ঘুম ভাঙলো, তখন অনেক বেলা। সূৰ্য অনেক উপরে উঠে। উত্তাপ ছড়িয়ে গরম করে তুলছে মরুর বালু।
মেয়েদের জানা ছিল না, এরপর তাদের কোথায় যেতে হবে। বাদক দলের সাথে পথ চলাই তাদের কাজ। ওরা যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই সঙ্গে যাবে এরা।
বাদক দল যাওয়ার জন্য তৈরী হলো । কমাণ্ডারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলো ওরা। কমাণ্ডার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, জোহরা দৌড়ে তার কাছে এলো এবং বললো, “আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করে দিন।”
কমাণ্ডার তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। জোহরা তার অন্য হাতটি ধরে তার চোখের সাথে লাগালো। সে চোখ থেকে তখন অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। অশ্রু ঝরা চোখেই বিদায় নিল জোহরা।
নীলনদের দিকে চলে গেল ওরা। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে খুব বেশী দূর যায়নি, কোথেকে দুই উটের আরোহী এগিয়ে এলো। ওদের কাছে এসে উটের ওপর থেকে নামলো আরোহীরা। উট দু’টিকে বসিয়ে নর্তকী দু’জনকে উটের পিঠে বসালো, উট আবার যাত্রা শুরু করলো।
এই দুই উটওয়ালা সন্ত্রাসী দলের লোক, কাছেই কোথাও লুকিয়ে ছিল ওরা। এরা নীলনদের পাড়ে অবস্থানরত বণিক দলের সাথে গিয়ে মিলিত হলো ।
দুই দল এমনভাবে মিলিত হলো, দেখে মনে হলো, এরা একে অন্যকে চেনে না।
পুরুষরা মিশনের কার্যক্রম ঠিক করার জন্য বৈঠকে বসবে,তাই নর্তকী দু’জনকে ওখান থেকে সরিয়ে দিতে চাইল।
এ কাজে এগিয়ে এলো বণিক দলের মেয়েরা। ওরা দুই নর্তকীকে পুরুষদের থেকে আলাদা করে নদীর কূলে নিয়ে গেল। মেয়ে চারজন প্ৰথমে নিজেদের পরিচয় দিল। বললো, “আমরা আমাদের স্বামীদের নিয়ে কাফেলার সাথে বেড়াতে এসেছি।”
এরপর ওরা জানতে চাইল নর্তকীদের পরিচয় । জোহরা ও অন্য নর্তকী বললো, “আমাদেরকে নাচগান করে সীমান্ত এলাকার সৈন্যদের মনোরঞ্জনের জন্য ভাড়া করে আনা হয়েছে।”
ওদিকে পুরুষদের বৈঠকে মিশনের মূল বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। বাদক দল তাদের দুই রাতের কাজ ও সাফল্য বর্ণনা নাচগানের সুযোগে প্রায় দুইশ হাবশীকে মিশরে প্রবেশ করানো হয়েছে।”
বণিক দল বর্ণনা করলো তাদের দুই মেয়ের সাফল্যের কথা। বললো, “এই সুযোগে আমরাও দু’শোর বেশী হাবশী ভেতরে প্ৰবেশ করিয়েছি।”
আলাপ আলোচনার পর তারা এই সিদ্ধান্তে এল, “নাচগানের চেয়ে নদী পথেই বেশী করে হাবশী সৈন্য ভেতরে প্রবেশ করানো নিরাপদ ও সুবিধাজনক। এ পথ উনমুক্ত থাকলে নীেকাযোগে বেশী করে সৈন্য আমদানী করা যাবে। এ জন্য বণিক দলের দুই মেয়ে যেভাবে দুই সীমান্ত প্রহরীকে কব্জা করেছে। প্রয়োজনে অন্যান্য সকল মেয়েকেই এ ভূমিকায় নামতে হবে।
এতে করে নির্বিবাদে প্রতি রাতে অনেক নৌকা আসতে পারবে। সে জন্য নর্তকী মেয়ে দুটিকেও এখানেই রেখে দিতে হবে। কিন্তু তাদের কাছে কোন গোপন তথ্য ফাঁস করা যাবে না।’
বাজনাদাররা জোহরা ও তার সাথের নর্তকীকে বললো, “তোমাদের কাজ এখন শেষ! নদীর পাড়ে এ জায়গাটি খুবই সুন্দর ও মনোরম। আমরা কয়েকদিন এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অবসর বিনোদনের জন্য এমন চমৎকার জায়গা আর হয় না। এসে যখন পড়েছি, কয়েকদিন বেড়িয়ে না গেলে জীবনভর দুঃখ থাকবে। বলি কি, তোমরাও থেকে যাও এখানে।
তারা নর্তকী দু’জনকে এমন প্রলোভন দিল যে, শেষে তারা সেখানে থাকতে রাজী হয়ে গেল ।
কাফেলার মেয়েরাও তাদের সাথে অন্তরঙ্গ এবং খোলামেলা ব্যবহার করলো। ফলে অপরিচিতের দূরত্ব ঘুচে গেল। স্বচ্ছন্দভাবেই ওদের সাথে মিশে গেল দুই নর্তকী।
কাফেলার লোকদের থেকে সামান্য একটু দূরে তাবু টানানো হলো ওদের জন্য।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো, কিন্তু ঘুম এলো না জোহরার চোখে । বার বার তার স্মরণ হতে লাগলো কমাণ্ডারের কথা । তার চরিত্র, তার ব্যবহার জোহরার মনে অক্ষয় স্মৃতি হয়ে আছে। তার স্নেহমাখা কথা, মাথায় হাত বুলিয়ে বাপের মতই আদর করা, সবকিছু ছবির মত ভেসে উঠেছিল তার অন্তর রাজ্যে। এই কমাণ্ডারের মধ্যে সে সত্যি তার পিতার ছবি দেখতে পেয়েছিল ।
কমাণ্ডারের প্রতি আরো একটি কারণে কৃতজ্ঞতায় তার মন ভরে উঠেছিল। এই প্রথম কোন পুরুষ তাকে নাগালের মধ্যে পেয়েও খেলার সামগ্ৰী না বানিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করেছে। এ ছাড়া কমাণ্ডার তাকে চুমকি না বলে তার বাবার মত জোহরা বলে ডেকেছে ।
তার সঙ্গী নর্তকী ঘুমিয়ে পড়েছিল। দলের বাজনাদারেরাও ঘুমিয়ে গিয়েছিল। সে বিছানায় উঠে বসলো এবং একসময় ধীরপদে বাইরে চলে এলো ।
সেনাক্যাম্পে যাওয়ার রাস্তা তার স্পষ্ট মনে আছে। জোহরার কি মনে হলো, সে দীর্ঘ পদক্ষেপে দ্রুত ক্যাম্পের দিকে হেঁটে চললো ।
নির্জন রাতে একাকী পথ চলার মত দুঃসাহসী কোন মেয়ে ছিল না জোহরা। কিন্তু কি এক আবেগের তাড়না তাকে ভয়শূন্য করে ফেললো। সে নিৰ্ভয়ে এগিয়ে চললো ক্যাম্পের দিকে ।
এক সময় শেষ হলো তার পথ চলা, ক্যাম্পে পৌঁছে গেল সে।
প্রহরী তাকে দেখেই চিনতে পারল । সে প্রহরীকে বললো, “কমাণ্ডারের কাছে যাচ্ছি।”
প্রহরী তাকে বাঁধা দিল না, কারণ গত রাতেও এই মেয়ে দীর্ঘক্ষণ কমাণ্ডারের তাবুতে ছিল, জানে সে। জোহরা সরাসরি কমাণ্ডারের তাঁবুতে গিয়ে প্রবেশ করলো।
কমাণ্ডার গভীর ঘুমে নিমগ্ন। কিন্তু সৈনিক সুলভ সতর্কতা তাকে জাগিয়ে দিল। ঘুম ভাঙতেই অন্ধকারে চোখ মেলে তাকাল কমাণ্ডার। একটি কোমল হাতের মুঠোর মধ্যে নিজের হাতটিকে আবিষ্কার করে বিস্মিত হলো সে। হাতের, কোমলতাই বলছিল, এটা কোন পুরুষের হাত নয়!
সে দ্রুত উঠে হতচকিত হয়ে বললো, ‘কে তুমি?”
“আমি জোহরা!”
কমাণ্ডারের বিস্ময় তখনো কাটেনি। বললে, “তুমি! এত রাতে! এখানে!
‘ভয় পাচ্ছে কেন? বাপের কাছে মেয়ে আসবে না?” জোহরা তাকে বললো, “কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বার বার কেবল তোমার কথাই মনে হচ্ছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল তোমাকে একটু দেখি। ভয় নেই, তুমি শুয়ে থাকো, একটু পরই আমি চলে যাবো ।”
কমাণ্ডার বাতি জ্বাললো। জিজ্ঞেস করলো, “এখন কোথেকে এসেছে?”
জোহরা সব খুলে বললো।
জোহরার কথা শুনে কমাণ্ডার কামরা থেকে বের হয়ে গেলো ।
দুটি ঘোড়া রেডি করে জোহরাকে বললো, চলো।”
জোহরাকে একটি ঘোড়ার পিঠে উঠিয়ে দিয়ে অন্যটিতে উঠে বসলো নিজে। ঘোড়া চলতে শুরু করলো।
চলার পথে জোহরা আবেগে অনর্গল কথা বলতে লাগলো। কমাণ্ডার তাকে তার উচ্ছাস প্ৰকাশে কোন রকম বাঁধা দিল না। যথেষ্ট দরদ ও মমতা নিয়ে শুনতে লাগলো তার কথা ।
আরেকটু পরেই তারা গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। এখান থেকেই ওরা দেখতে পাচ্ছিল বাগান ও ক্যাম্প । জোহরা কমাণ্ডারকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘এবার আপনি ফিরে যান।”
কমাণ্ডার তার মাথায় হাত রেখে আদর করলো। আশির্বাদ করে বললে, “ভাল থেকো।”
জোহরা ক্যাম্পে ফিরে দেখলো ক্যাম্পের এক লোক জেগে বসে আছে। সে জোহরাকে জিজ্ঞেস করলো, “ কোথায় গিয়েছিলে?”
জোহরা বললো, ঘুম আসছিল না, তাই একটু নদীর পাড়ে হাঁটতে গিয়েছিলাম।”
লোকটি তাকে সাবধান করে দিয়ে বললো, “তোমার আচরণ সন্দেহজনক। তুমি ঠিক করে বলো, এত রাতে একা তুমি কোথায় এবং কেন গিয়েছিলো? মিথ্যে বলো না, যা সত্যি তাই বলে ফেলো।”
জোহরা তাকে সত্যি ঘটনা বলতে চাচ্ছিল না। সে আবারো বললো, বললাম তো, নদী পাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম।”
“এখন থেকে তুমি আমার আদেশ ছাড়া এক পাও বাইরে যেতে পারবে না।” লোকটি আদেশের সুরে বললো।
“আমি তােমার কেনা দাসী নই।” জোহরা বললো, “আমাকে যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলে সে কাজ আমি শেষ করেছি। যে মূল্য দিয়েছিলে, সে মূল্য পরিশোধ করেছি। এখন আর আমি কারো আদেশের ধার ধারি না ।”
“তুমি কি তোমার মালিকের কাছে জীবিত ফিরে যেতে চাও না?” সে লোক বললো, “যদি চাও তৰে আমার অবাধ্য হয়ো না। আমি নিষেধ করছি, আমাকে না বলে কোথাও যেয়ো না তুমি।”
দুই সিপাহীই প্রতি রাতে টহল দেয়ার বাহানায় নদীর পাড়ে গিয়ে ওই মেয়েদের সাথে মিলিত হতো। দুই মেয়ে দু’জনকে নিয়ে যেত আলাদা আলাদা জায়গায় । সেখানে নানা রকম প্ৰলোভনে আটকে রাখতো তাদেরকে ।
সৈন্যরা যখন মেয়েদের নিয়ে পাহাড়ের গুহায় সময় কাটাতো, সেই সময় হাবশী সৈন্য বোঝাই পাল তোলা নৌকা এসে ভিড়তো কুলে। সঙ্গে সঙ্গে হাবশী সৈন্যরা লাফিয়ে নেমে হারিয়ে যেতে পাহাড়ের অন্তরালে, অদৃশ্য গোপন আস্তানায়।
এভাবে অল্প সময়ের মধ্যেই পাহাড়ের গোপন আস্তানায় হাবশী সৈন্যদের বিশাল বহর জমা হয়ে গেল। এখন তারা যে কোন সময় আক্রমণ চালিয়ে ফাঁড়ি দুটোর সৈন্যদের নিঃশেষে ধ্বংস করে দিতে পারে ।
কিন্তু তাদের কমাণ্ডার বুদ্ধিমান। সে জানে ফাঁড়িতে আক্রমণ করলে সে সংবাদ সঙ্গে সঙ্গে কায়রো পৌছে যাবে। তার পরিণাম হবে খারাপ। কায়রো থেকে নতুন সেনাবাহিনী এসে দায়িত্ব নেবে ক্যাম্পের। এতে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমস্যা হবে । অতর্কিতে কায়রো দখলের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে পারে তারা। তাই এ ধরনের আত্মঘাতি আক্রমণের ধারে কাছেও গেল না সে ।
পাহাড়ী এলাকায় হাবশীদের সংখ্যা ক্ৰমেই বেড়ে চলেছে। সুদানে প্ৰস্তুতি নিচ্ছে ক্রুসেডাররা। এই মিশনের কমাণ্ডার, যে কায়রোতে এই অতর্কিত আক্রমণের নেতৃত্ব দেবে, সবকিছু বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে ।
কয়েক দিনের মধ্যেই সীমানা পেরিয়ে সে এই পাহাড়ী ক্যাম্পে হাজির হবে । তারপর এখানে জমায়েত হাবশীদের নিয়ে পৌছবে কায়রোর আশেপাশে এবং সুযোগ মত আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নেবে কায়রো।
সেনাপতি আলকিন্দি এখন কায়রোতে অবস্থান করছেন। নিজের দায়িত্ব পালন করতেই কায়রো গিয়েছেন তিনি। তার গতিবিধি ও হাবভাব দেখে কেউ সন্দেহ করতে পারবে না, এ লোক কোন ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত। এই অতি বিশ্বস্ত লোকটিই বিশ্বাসঘাতকের প্রধান হয়ে ছোবল হানতে যাচ্ছে আইয়ুবীকে ।
প্রতিদিন রাতে সীমান্তের রিপোর্ট নিয়ে গোপনে তার কাছে পৌছে যায় কাসেদ। গত রাতে কত হাবশী সেনা পাহাড়ী অঞ্চলে এসে পৌছেছে, এখন সেখানে তাদের সংখ্যা কত, সবই সময় মত জানতে পারেন তিনি ।
সুদানীরা জানিয়েছে, এ আক্রমণের মূল নেতা তিনিই থাকবেন। অন্যান্য দলনেতারা তার হুকুমেই আক্রমণের নেতৃত্ব দেবে। তাই তিনি তার প্ল্যান প্রোগ্রাম গুছিয়ে নিচ্ছিলেন ।
হাবশী সৈন্যের সংখ্যা এক হাজারে পৌছে গেছে। অভিযানে বেরিয়ে পড়ার সময় হয়েছে, জানানো হলো তাদের। তারা বললো, “কিন্তু নরবলি? নরবলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তো আমরা কোন অভিযানে শরীক হতে পারবো না।”
আলকিন্দির লোকেরা এ প্ৰস্তাব অগ্রাহ্য করতে চেষ্টা করলো । কিন্তু হাবশীরা তাদের দাবীতে অটল। তাদের সাথে যে ধর্মগুরু এসেছে, সে বললো, “এ বিধান লংঘন করলে এরা যুদ্ধ করতে পারবে না। বলি দেয়া মানুষের রক্ত না ছোঁয়া পর্যন্ত তাদের মধ্যে যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি হয় না।”
আলকিন্দির লোকেরা বিপাকে পড়ে গেল। কোথায় পাবে তারা বলি দেয়ার জন্য জীবন্ত মানুষ!
হাবশীরা বলতে লাগলো, “হয় নরবলি দাও, নইলে আমরা দেশে ফিরে যাবো।”
তাদের ধমীয় নেতাকে বলা হলো, হাবশীদের মধ্য থেকে দু’একজনকে ধরে বলি দিয়ে দিলেই তো হয়ে যায়!”
ধর্মগুরু বললো, “এ কোরবানী গ্ৰহণযোগ্য হবে না। বলির জন্য সেই অঞ্চলের মানুষ আনতে হবে, যে অঞ্চলে আক্রমণ করা হবে। যারা যুদ্ধ করতে এসেছে তাদের কোরবানী বৈধ নয়।
‘ শেষ পর্যন্ত তাকে বলা হলো, “ঠিক আছে, আক্রমণের আগের দিন মিশর থেকে এক লোককে ধরে এনে আপনার হাতে তুলে দেয়া হবে।”
পুরোহিত রাজি হলো না। বললো, বলির লোক এখনই চাই। কারণ তাকে ভাল খাইয়ে দাইয়ে মোটা তাজা করতে হবে। তারপর দেখতে হবে সে লোক আপন দেবতার আরাধনা করে কি না।’
বলি দেয়ার বিষয়টি বেশ জটিল হয়ে উঠল । পুরোহিত একটার পর একটা নতুন নতুন ফ্যাকড়া সৃষ্টি করতে লাগলো। বললো আমরা ইচ্ছা করলেই যাকে তাকে বলি দিতে পারবো না। আমাদের হিসাব করে দেখতে হবে, দেবতা পুরুষের কোরবানী চান না। নারীর কোরবানী? নাকি দু’জনের কোরবানীই চেয়ে বসেন দেবতা তাও জানতে হবে। এবং সে চাহিদা অনুযায়ীই বলি সম্পন্ন করতে হবে।”
সেই রাতেই আলকিন্দির কাছে সংবাদ গেল, হাবশীরা যুদ্ধের আগেই কোরবানীর জন্য মানুষ চায়।” আলকিন্দি বললো, তাতে চিন্তার কি আছে? পথঘাট থেকে কাউকে ধরে তাদের হাতে তুলে দাও।”
“কিন্তু পুরোহিত এখনো বলেনি, তাদের দেবতা পুরুষ, নারী, নাকি উভয়েরই রক্ত চায়? এটা জানার আগে আমরা কাকে ধরবো? কেমন করে ধরবো?”
‘আমি এত কথা শুনতে চাই না। তাদের যে দাবীই থাক, পূরণ করে দাও।” আলকিন্দি বললো, কয়েকদিন পর যখন আমি কায়রোর উপরে আক্রমণ চালাবো, তখন কত লোক মারা যাবে তার কোন ইয়াত্তা নেই! দু’একজন লোক দু’দিন আগে মারা গেলে এমন কি আর ক্ষতি হবে!’
আলকিন্দি তার গোয়েন্দার সাথে কথা বলছিল, একজন খৃস্টান এসে ভেতরে ঢুকলো। তার পরণে মিশরীয় পোষাক। ভেতরে প্রবেশ করেই সে তার কৃত্রিম দাড়ি ও মেকাপ খুলে ফেললো।
আলকিন্দি জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে পেরেশান মনে হচ্ছে?”
‘হাবশীরা তাদের ধমীয় বিধান পূর্ণ করতে চায়। তারা এখনি বলি দেয়ার জন্য মানুষ চাচ্ছে।”
আপনি কি চিন্তা করেছেন?’ ‘
‘আমি চিন্তা করেছিলাম, আক্রমণের একদিন আগে একটি লোক ধরে ওদের হাতে সঁপে দেবো।”
“আপনি ঠিকই চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু ওরা কি তা মানবে?’
‘না’!’ খৃস্টান বললো, “তারা এক্ষুণি কোরবানী চায়।” “এ অবস্থায় আপনার পরামর্শ কি?”
“আপনি তাদের ধমীয় রসম পালন করার সুযোগ করে দিন। আপনি তো কখনও সুদানে যাননি, তাই জানেন না কেমন করে আমরা এতগুলো লোক সংগ্রহ করেছি। এই নরহত্যার চিন্তা আমিই তাদের মাথায় ঢুকিয়েছিলাম। ধর্মের কথা বলে কৌশলে তাদেরকে ওখানে নিয়ে এসেছি। .
সুলতান আইয়ুবী আপনাকে শুধু যুদ্ধ করতেই শিখিয়েছেন, মানুষ ব্যবহারের কৌশল শেখাননি। মানুষকে বিনা তলোয়ারে হত্যা করার কৌশল আমাদের খৃস্টানদের কাছ থেকে শিখে নিন। অন্যের ধর্মকে ব্যবহার করতে শিখুন।
তাদের উপরে ধর্মের উন্নয়াদনা চাপিয়ে দিয়ে তাদের জ্ঞান বুদ্ধিকে নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিন। তাদের অর্থহীন ও বাজে ধমীয় অনুষ্ঠানকে নিন্দা ও সমালোচনা না করে তাদের আরও উৎসাহিত করে নিজেও তাদের সঙ্গে লোক দেখানো অংশীদার হয়ে তাদেরকে হাতের মুঠোয় রাখুন।
সাধারণ মানুষকে ধর্মের নামে ধোঁকা দেয়া অন্য যে কোন কৌশলের চেয়েও বেশী কার্যকর হয় । আমরা যত মুসলমানকে আমাদের সঙ্গী বানিয়েছি, তাদেরকে সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছি এই ধোঁকা ও কৌশলের মাধ্যমে। মুসলমানরা ধমীয় আবেগেই আমাদের জালে এসেছে। আর এই হাবশীরা তো একদম জংলী । এদেরকে আমরা এক বছরের বেশী সময় ধরে নির্বোধি বানিয়ে রেখেছি। সুদান থেকে রওনা হওয়ার আগে আমরা দু’জন সুদানীকে তাদের হাতে দিয়ে বলেছি, এরা মিশরী লোক। তারা তাদেরকে জবাই করে তবেই সুদান থেকে রওনা দিয়েছে।” ‘হাবশী পুরোহিত কি বলেছে, সে পুরুষ লোক চায়, না নারী” আলকিন্দি জিজ্ঞেস করলো।
“সে কি চায় তা ওখানে গেলেই জানতে পারবেন। আমি মনে করি, এখনি আপনার সেখানে যাওয়া বিশেষ দরকার।’ খৃস্টানটি বললো, তবে আমি আপনাকে অন্য রকম পদ্ধতি ও কৌশলে তাদের সামনে উপস্থিত করতে চাই। আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, হাবশীদের মতো এত বেশী পশু, বর্বর এবং খুনপিয়াসী যোদ্ধা আর কোন জাতিতে পাবেন না। এ পর্যন্ত এদের সংখ্যা চার হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। যদি আমরা তাদের উপরে ধমীয় ভূত চাপিয়ে রাখতে পারি, এবং তাদের এ বিশ্বাস দিয়ে রাখতে পারি যে, এ যুদ্ধ আমাদের জন্য নয়, এ যুদ্ধ তাদেরই জন্য, তবে তাদের এক হাজার সৈন্যই কায়রোর সমস্ত সৈন্যকে লাশে রূপান্তরিত করে দেবে।
আমি তাদের জানিয়েছি, আমরা তাদেরকে তাদের ভগবানের ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। আর সেই ভগবানের জমিন এখন শক্ৰদের অধিকারে ।”
খৃস্টানটির প্রস্তাবে রাজি হলো আলকিন্দি। বললো, “হ্যা, আমি যাবো ওখানে। ”
আলকিন্দির সাথে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে সুদানী ও ক্রুসেডারদের মধ্যে চুক্তি হয়ে গেছে। চুক্তি মোতাবেক মিশরকে দুটি ভাগে ভাগ করা হবে। এক অংশের সুলতান হবে। আলকিন্দি আর অবশিষ্ট অর্ধেক সুদানকে দিয়ে দেয়া । হবে। হাবশী সৈন্যদের যোগাড় করার সময়ও সুদানীরা এরকম চুক্তি করেছিল।
সে যুগের প্রসিদ্ধ ব্যক্তি কাজী বাহাউদ্দিন শাদাদ তার ডাইরীতে লিখেছেন, “আলকিন্দি খৃস্টানদের ও সুদানীদের সাহায্যে সভ্যতা ও কৃষ্টি বিবর্জিত পশু প্রকৃতির হিংস্র স্বভাব হাবশীদের ওপর তাদের ধর্মীয় ভূত চাপিয়ে দিয়ে তাদের মধ্যে যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করেন এবং আলকিন্দি নিজেই তাদের ভগবান হয়ে গিয়েছিলেন। হাবশীদেরকে বলা হয়েছিল, এই লোক তোমাদের ভগবান, যিনি কয়েকশ বছর আগে ভগবানদের নেতার কাছে গিয়েছিলেন।”
ডাইরীতে সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ূবীকে সুলতান ইউসুফ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, এ মহান মুজাহিদের আসল নাম ছিল ইউসুফ সালাহউদ্দিন। কাজী বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ তাকে স্নেহ ও আদর করে সুলতান ইউসুফ বললেও ইতিহাসে তিনি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী নামেই প্ৰসিদ্ধ হন। তিনি জানতেও পারলেন না, তার অনুপস্থিতিতে মিশরে কি ভয়ংকর খেলা চলছে। তকিউদ্দিন নিশ্চিন্ত, আলকিন্দির মত বিশ্বস্ত সেনাপতি সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। আলী বিন সুফিয়ানও টের পেলেন না আলকিন্দির ষড়যন্ত্রের কোন খবর। কিন্তু বসে নেই আলকিন্দি। বসে নেই সুদানী ও খৃস্টান ষড়যন্ত্রকারীরা। দশ হাজার হাবশী নিগ্রো সেনা প্ৰস্তৃত মিশরে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য। যে কোন মুহুর্তে তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে ঘুমন্ত কায়রোবাসীর ওপর।

(সমাপ্ত)

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 2 | 3 | 4 | 5 | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top