১. গাজী সালাহউদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযান

‘যদি শত্রুরা ওদের পরিচয় জানতে পারে তবে ওদের মৃত্যু অনিবার্য।’

‘হ্যাঁ, প্রচুর টাকার বিনিময়ে আমরা ওদের নিয়েছি। ট্রেনিং দিয়েছি, বিভিন্ন ভাষা শিখিয়েছি। এমন অভিজ্ঞ মেয়েগুলোকে হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না।’

সম্রাট অগাষ্টাস প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা কি মনে কর ওদের বের করে আনা যাবে?’

‘জ্বী। শুধু ক’জন সাহসী লোক প্রয়োজন। হয়ত দু’একদিনের মধ্যে ওরা ওদেরকে কায়রো নিয়ে যাবে। তখন উদ্ধার করতে ঝামেলা হবে। সময় নষ্ট না করলে ক্যাম্পেই ওদের পাব। আমাকে কয়েকজন সাহসী এবং ত্যাগী লোক দিন, আমি ওদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে আসব।’ বলল গোয়োন্দা।

‘অবশ্যই মেয়েদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে।’ ক্রোধ কম্পিত কণ্ঠে বলল এমলার্ক। পরাজয়ের অপমান তার চোখে মুখে। কখনো টেবিলে ঘুষী মেরে, কখনো নিজের উরু চাপড়ে কথা বলছিল সে।

‘আমি মেয়েদের ফিরিয়ে আনবো, হত্যা করব আইয়ুবীকে। রূপসী যুবতীদের দিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ছিন্নভিন্ন করে দেব।’

‘এমলার্ক!’ রিমাণ্ড বললেন, ‘আমি তোমার আবেগকে শ্রদ্ধা করি। ট্রেনিংপ্রাপ্ত মেয়েদরও সহজে হাতছাড়া করতে পারি না। তুমি তো জানোই আমাদের মেয়েরা সিরিয়ায় হারেমগুলো জমিয়ে রেখেছে। আমীর ওমরারা এখন ওদের হাতের পুতুল। নারী এবং সুরার গুণে মুসলিম বিশ্ব এখন তিনভাগে বিভক্ত। ঐক্য ভেংগে গেছে ওদের। শুধু দুটো লোক আমাদের জন্য বিপজ্জনক। একজন নুরুদ্দীন জংগী। অন্যজন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। এদের একজন বেঁচে থাকলেও ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা সহজ হবে না। আইয়ুবী সুদানী বিদ্রোহ দমন করেছে, তার মানে লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত। আমরা তার ওপর লক্ষ্য রাখছি।’

‘নিয়মিত যুদ্ধের পরিবর্তে গেরিলা যুদ্ধে তাকে হারাতে হবে। মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করতে হলে ট্রেনিংপ্রাপ্তা মেয়েদেরকে আমাদের প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন।’

রবার্ট বলল, ‘হ্যাঁ, অভিজ্ঞতা আমাদের তাই বলে। মুসলমানরা নারীদেহের গন্ধ পেলে সব কিছু ভুলে যায়। এ যুদ্ধে ওদের হারাবার সহজ পথ হল ওদর হাতেই ওদেরকে মারতে হবে। বিনোদনের বিভিন্ন পথ উন্মুক্ত করে দাও, ওরা দ্বীন ঈমান ভুলে যাবে। শুধু যুবতী দেহের রূপ ও সৌন্দর্যের বিনিময়ে আরবের অনেক আমীর বাদশা এখন আমাদের হাতের পুতুল।’

মুসলমানদের দুর্বলতাগুলো নিয়ে এদের মধ্যে অনেকক্ষণ কথা হল। সিন্ধান্ত হল, মেয়েদের মুক্ত করা হবে। দুঃসাহসী ক’জন কমাণ্ডো পাঠানো হবে এ অভিযানে।

একটু পর পাঁচজন কমাণ্ডারকে ডেকে আনা হল। ওরা এলে বিস্তারিত পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেয়া হল ওদের।

একজন বলল, ‘আমরা আগে থেকেই দুঃসাহসী কমাণ্ডো ফোর্স তৈরী করে রেখেছি।’

‘কিন্তু এদের বিশ্বস্ত হতে হবে।’ অগাস্টাস বললেস, ‘ওরা কাজ করবে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে। কিছু না করেও এসে বলবে অনেক কিছু করেছি।’

‘শুনে আশ্চর্য হবে, ওদের অনককে আমরা কারাগার থেকে সংগ্রহ করেছি। ওরা ছিল চোর, ডাকাত এবং খুনী। কেউ কেউ যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী। স্বতস্ফর্তভাবেই ওরা আমাদের বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। মেয়েদের উদ্ধার করার জন্য আমি এমন তিনজন লোক দিতে পারব, কুখ্যাত খুনী হিসাবে যাদের ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল।

সকাল পর্যন্ত বিশজনের এক বাহিনী তৈরি করা হল। তাদের একজন মেগনামা মারইউস। সে ছিল রোমের জেলে। ডাক্তাররূপী এক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান করা হল তাকে।

এদের প্রথম কাজ মেয়েদের মুক্ত করা। রবিন এবং তার সংগীদের মুক্ত করতে না পারলে ঝুঁকি নেয়ার দরকার নেই। দ্বিতীয় কাজ হল সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে হত্যা করা।

প্রয়োজনীয় অস্ত্রসহ সেদিনই তাদেরকে নৌকায় তুলে দেয়া হল।

সুদানীরা ব্যর্থ হয়েছে, দমন করা হয়েছে ওদের সেনা বিদ্রোহ। অনেক অফিসার ওদের নিহত হয়েছে। সুলতান আইয়ূবীর অফিসের সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিল অনেকে। পরাজিত ও বিধ্বস্ত চেহারা। অস্ত্র সমর্পণ করে ওরা আনুগত্য মেনে নিয়েছে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর।

আইয়ুবী নিজের কমাণ্ডারদের বিভিন্ন নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সাথে গোয়োন্দা প্রধান। এ বিজয়ে তার ভূমিকা অসামান্য। বলতে গেলে গোয়োন্দা যুদ্ধেই ওদের পরাজিত করা হয়েছে।

হঠাৎ আলীর দিকে তাকালেন সুলতান। বললেন, ‘আলী! ব্যস্তার কারণে সাতটি মেয়ে এবং তার সংগীদের নিয়ে কিছু ভাবতে পারিনি। ওরা ওখনও সাগর পারের ছাউনিতে। যত শীঘ্র সম্ভব ওদের এখানে নিয়ে এস।’

‘এখনি লোক পাঠিয়ে ওদের আনানোর ব্যবস্থা করছি। সুলতান! সম্ভবতঃ সপ্তম মেয়েটার কথা আপনি ভুলে গেছেন। ও এসেছিল সুদানী কমাণ্ডার বালিয়ানের কাছে। বালিয়ান বন্দী হয়নি, নিহত ও আহতদের মধ্যেও নেই। মেয়েটা সম্ভবতঃ বালিয়ানের সাথে পালিয়ে গেছে।’

‘আমার মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ। শোন, এখানে এখন তুমি না হলেও চলবে। বালিয়ান হয়ত রোম উপসাগরের দিকেই পালিয়েছে। খৃস্টান ছাড়া কে আর ওদের আশ্রয় দেবে? যেখানেই পাও, ওকে এনে জেলে পুরে দাও। আর গোয়োন্দাদের একটা দল সাগরের ওপারে পাঠানোের ব্যবস্থা কর।’

‘নিজের দেশেই গোয়েন্দাদের ছড়িয়ে দেয়া বেশী জরুরী।’ নুরুদ্দীন জংগীর পাঠানো সেনা কমাণ্ডার বলল, ‘খৃস্টানদের চাইতে মুসলমান আমীর ওমরারা আমাদের জন্য বেশী ক্ষতিকর। গোয়েন্দাদেরকে ওদের হারেমে ঢুকিয়ে দিতে পারলে অনেক ষড়যন্ত্রই প্রকাশ হয়ে পড়বে। সুলতান জংগী সব সময় উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকেন, বাইরের হামলা ঠেকাবেন, না ঘরের শত্রু প্রতিরোধ করবেন।’

কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন সুলতান আইয়ুবী। বললেন, ‘যাদের হাতে অস্ত্র আছে তারা যদি বিশ্বস্ত এবং দৃঢ় ঈমানের অধিকারী হয় তবে ভেতরের ষড়যন্ত্র এবং বাইরের আক্রমণ আমাদের কিছুই করতে পারবে না। একটা কথা মনে রেখো, মুসলিম বিশ্বের কোন সীমানা নেই। যখনি ইসলামকে সীমার সংকীর্ণতায় আবদ্ধ করা হয়েছে তখনি বিপর্যয় এসেছে। দৃষ্টিকে প্রসারিত করে তোমার দৃষ্টি নিয়ে যাও রোম উপরাগরের উপারে, দেখবে বিশাল জলরাশিও তোমার পথ রুখতে পারবে না। ঘরের যে আগুনকে ভয় পাচ্ছ তা এক ফুঁতে নিভে যাবে, সেখানে জ্বলবে দ্বীন এবং ঈমানের আলো।’

‘আমরা বেঈমানদের মোকাবেলা করার কথা বলছি সুলতান! আমরা নিরাশ হইনি।’ বলল কমাণ্ডার।

‘বন্ধুরা, তোমরা দুটো শব্দ থেকে দূরে থেকো ‘নৈরাশ্য’ এবং ‘মানসিক বিলাস’। মানুষ প্রথমে  নিরাশ হয়, এরপর মানসিক বিলাসিতার মধ্যে দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ায়।

আলী বিন সুফিয়ান বেরিয়ে গেলেন। একজন দ্রুতগামী ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে দিলেন সাগরপারের ছাউনিতে। তাকে বললনে, ‘রবিন এবং মেয়েগুলোকে ঘোড়া বা উটে করে সেনা প্রহরায় রাজধানীতে নিয়ে এসো।’

ওদের পাঠিয়ে দিয়ে দু’জন সেপাই সাথে নিয়ে তিনি নিজে বেরোলেন বলিয়ানের খোঁজে। হেড কোয়ার্টারের বাইরে দাঁড়ানো সুদানী কমাণ্ডাররা বলিয়ান সম্পর্কে কিছু তথ্য দিল। ওরা বলল, ‘বালিয়ানকে যুদ্ধের ময়দানে দেখা যায়নি। উপসাগরের ছাউনিতেও যায়নি সে।’

আলী পৌঁছলেন তার বাড়ীতে। দু’জন বৃদ্ধা চাকরানী ছাড়া কেউ নেই। ওরা বলল, ‘এখানে পাঁচজন যুবতী মেয়ে ছিল। কারো রূপ একটু ম্লান হলেই তাকে সরিয়ে দিত বালীয়ান। নিয়ে আসত তরতাজা উচ্ছল যুবতী। বিদ্রোহের আগে একটা ফিরিঙ্গী মেয়ে এসেছিল। ভীষণ সুন্দরী এবং সতর্ক। আমাদের মালিক ছিল তার হাতের পুতুল। বিদ্রোহের পর সুদানীরা যেদিন আত্মসমর্পন করল সে রাতে তিনি সাতজন ঘোড়সওয়ারসহ মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে যান। উনি চলে যাবার পর হারেমের অন্যান্য মেয়েরা হাতের কাছে যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে ভেগেছে।’

আলী ফিরে আসার জন্য ঘুরলেন, এক দ্রুতগামী সওয়ার তার সামনে এসে লাফিয়ে পড়ল ঘোড়া থেকে। সওয়ারের নাম ফখরুল মিসরী।

হাঁফাতে হাঁফাতে সে বলল, ‘আমি আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছি। বালিয়ান এবং সে মেযেটাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। ওরা কোন দিকে গেছে আমি জানি। ওদের পিছু নিয়েছিলাম আমি। কিন্তু ওদের সাথে সাতজন সশস্ত্র প্রহরী থাকায় আমি ফিরে এসেছি। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। ওদের দু’জনকে নিজের হাতে হত্যা করতে না পারলে আমি শান্তি পাব না। আমি একা, খোদার দিকে চেয়ে আমার সাথে কয়েকজন সিপাই দিন।’

‘ওরা কোথায়?

‘ওরা রোম উপসাগরের দিকে যাচ্ছে। তবে ওরা পথ চলছে খুব সাবধানে। সাধারণতঃ তারা বড় রাস্তা এড়িয়ে পার্শ্ববর্তী সরু রাস্তা মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

ফখরুল মিসরী দ্রুত নুয়ে আলীর পায়ে হাত রেখে অনুনয় করে বলল, ‘আমি ওদের পিছু নেব, হত্যা করব ওদের। দয়া করে আমার সাথে মাত্র চারজন সেপাই দিন।’

আলী তাকে শান্ত করলেন। ‘চারজন নয় বিশ জন সওয়ার দেব। ওরা এত শীঘ্র সাগর পারে পৌঁছতে পারবে না। আমরা ওদের পিছু নিচ্ছি, তুমিও থাকবে আমাদের সাথে।

ওদের খোঁজ পেয়ে আলী এবার নিশ্চিন্ত মনে ওদের পিছু নিলেন।

অনেক পথ অতিক্রম করেছে বালিয়ান এবং মুবি। সাধারণ রাস্তা ছেড়ে এগিয়ে চলেছে ওরা। এসব পথঘাট বালিয়ানের চেনা থাকায় পথ চলতে ওদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন তা জানত না বালিয়ান। ভয়ে পালাচ্ছে সে, মুবির মত সুন্দরী যুবতীকে হাতছাড়া করার ইচ্ছে নেই তার। ওর ধারণা ছিল, মিশর এবং সুদানেই রয়েছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সুন্দরীরা। কিন্তু ইটালীর এ যুবতীর রূপ তাকে অন্ধ করে দিয়েছে। তার জন্য উচ্চপদ, ধর্ম এবং দেশ ছাড়তেও কুণ্ঠিত হয়নি সে।

ও জানত না, মুবি তার কাছ থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। সে যে উদ্দেশ্যে দ্বিগুণ বয়েসী এ লোকের কাছে নিজরের হৃদয়, নিজের ইজ্জত বিকিয়ে দিয়েছে তা বরবাদ হয়ে গেছে।

মুবির মত যুবতীর ভালবাসা পেয়ে বালিয়ান ছিল তৃপ্ত। কিন্তু এখন মুবি তাকে ঘৃণা করছে। একজন নারীর পক্ষে একা পথ চলা সম্ভব নয় বলেই বাধ্য হয়ে তার সাথে যাচ্ছে সে। রবিনকে খুঁজে বের করাই এখন তার প্রধান কাজ। ওকে না পেলে সে ফিরে যাবে সাগরের ওপারে।

অনিচ্ছাসত্বেও তাকে বালিয়ানের ভোগের সামগ্রী হতে হচ্ছে। ও কয়েকবারই বলেছে, ‘বিশ্রাম কম করে তাড়াতাড়ি এগিয়ে চল।’ কিন্তু বালিয়ান একটু ভাল জায়গা পেলেই থেমে যেত।

একরাতে বালিয়ানকে মদ ঢেলে দিচ্ছে মুবি। ইচ্ছে করেই বেশী খাওয়ালো। নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল বালিয়ান। প্রহরীরাও শুয়ে আছে।

ধীরপায়ে এক প্রহরীর কাছে গেল ও। যুবক বয়স। সাহসী। বালিয়ানের বিশ্বস্ত। আলতো স্পর্শে তাকে জাগাল মুবি। নিয়ে গেল খানিক দূরে। বলল, ‘তুমিতো জান আমি কে? কেন এসেছি।’

যুবক কোন কথা না বলে মাথা নাড়ল।

‘তোমাদের জন্য সাহায্যের আশ্বাস নিয়ে এসেছিলাম। চেয়েছিলাম সালাহউদ্দীনকে সরিয়ে তোমাদেরকে ক্ষমতায় বসাব। কিন্তু তোমাদের এ কমাণ্ডার অপদার্থ। বিদ্রোহের পরিকল্পনা করবে তা নয়, প্রতিরতে মাতাল হয়ে আামাকে ভোগ করা শুরু করল। আমি হলাম তা হারেমের বন্দিনী।’

সামান্য বিরতি নিয়ে মুবি আবার বলতে শুরু করল, ‘কোন চিন্তা ভাবনা না করেই ফৌজকে দু’ভাগে ভাগ করল ও। আক্রমণ করল বুদ্ধিহীনের মত। যার ফলে তোমাদের এক বিশাল বাহিনী শেষ হয়ে গেল। তোমাদের পরাজয়ের জন্য এ লোকটা সম্পূর্ণরূপে দায়ী। এখনও সে আমাকে ভোগ করে চলছে। আমাকে বলছে দেশে নিয়ে আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু ওকে আমি ঘৃণা করি।

বিয়ে করতে হলে কাকে করব সে সিদ্ধান্ত আমার। তোমাকে আমি ভালবাসি। তুমি যুবক, সাহসী এবং বুদ্ধিমান। প্রথম দেখার দিন থেকেই তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। এ বুড়ো হাবড়াটার হাত থেকে আমাকে উদ্ধার কর। তোমাকে আমি সাগরের ওপারে নিয়ে যাব। সেনাবাহিনীর বড় পদ এবং ধন সম্পদ থাকবে তোমার পদতলে। কিন্তু একে শেষ না করলে তা সম্ভব নয়। ও ঘুমিয়ে আছে। ওকে হত্যা করে চল আমরা দু’জনে পালিয়ে যাই।’

সৈনিকটার গলা জড়িয়ে ধরল মুবি। মুবির মাতাল করা রূপ তাকে পাগল করে তুলল। কিছুক্ষণ জড়িয়ে রেখে তাকে ছেড়ে সরে বসল ও। যুবক এগোল তার দিকে। আচমকা একটা বশা এসে বিঁধল যুবকের পিঠে। ‘আঃ!’  শব্দ করে লুটিয়ে পড়ল সে। বর্শা টেনে তুলল একজন। বলল, ‘নেমকহারামের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’

আতংকিত চিৎকার বেরিয়ে এল মুবির কণ্ঠ থেকে। দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমরা লোকটাকে মেরে ফেললে!’

পেছন থেকে কেউ তার বাহু খামছে ধরল। ঝাকুনি দিয়ে টেনে নিয়ে চলল বালিয়ানের কাছে।

‘আমরা এ ব্যক্তির পালিত বন্ধু। তার সাথেই আমাদের জীবন মরণ। আমাদের কাউকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপাতে পারবে না। নিমকহারাম তার শাস্তি পেয়েছে।’

‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ ভেবেছ একবারও?’

‘সাগরে ডুবতে যাচ্ছি। তোমার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। বালিয়ান যেখানে যাবে, আমরাও সেখানে যাব।’

বালিয়ান তখনো মাতাল হয়ে পড়ে আছে। ওরা দু’জন শুয়ে পড়ল আবার। পরদিন বালিয়ানকে সব ঘটনা খুলে বলা হল। মুবি বলল, ‘লোকটা আমাকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।’

রক্ষীদের ধন্যবাদ জানাল বালিয়ান। আবার পথ চলতে শুরু করল ওরা। মুবি আবারও দ্রুত চলার জন্য তাগাদা দিতে লাগল। বলল, ‘যতশ্রীঘ্র সম্ভব এগিয়ে যাওয়া উচিৎ।’

বালিয়ান চলল তার নিজস্ব গতিতে। মুবির রূপ যৌবন তাকে বিবেকশূন্য করে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু পরিস্থিতি সম্পর্কেও সে ছিল সজাগ। চারদিক দেখেশুনে সাবধানে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল তার। মুবি বুঝেছে, বালিয়ানের হাত থেকে মুক্ত হওয়া এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। প্রয়োজনে এরা বন্ধুকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হয় না।

বিদ্রোহ পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সুলতান আইয়ুবী আলী বিন সুফিয়ানকে নিজের কাছে রাখা জরুরী মনে করলেন। এ খবর পেয়ে আলী বিন সুফিয়ান ওদের পিছু নেয়া বাদ দিয়ে ছুটে এলেন আইয়ুবীর কাছে। এসেই তিনি এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, ওদের পিছু নেয়ার আর সুযোগ করে উঠতে পারলেন না।

রবিন ও মেয়েদেরকে পনেরজন সেন্ট্রির পাহারায় কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বন্দীরা চলছে উটের পিঠে প্রহরীরা ঘোড়সওয়ার। স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলেছে ওরা। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে। নির্ভয়ে চলছে কাফেলা। কোন দিক থেকে শত্রুর আক্রমণের ভয় নেই। কয়েদীরা নিরস্ত্র, সাথে ছ’টা মেয়ে। ওরা পালিয়ে যাবে সে আশঙ্কাও নেই। কিন্তু প্রহরীরা জানেনা এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়োন্দা। মেয়েরাও অবলা নয়, ওদেরও সামরিক প্রশিক্ষণ রয়েছে। ওদের রূপ যৌবন, মাদকতাময় দেহ এবং যে কাউকে প্রেমের ফাঁদে জড়ানোর মত অস্ত্র রয়েছে ওদের কাছে। ওদের কমাণ্ডার মিসরী।

একটা মেয়ে তার দিকে বার বার  তাকাচ্ছে। চোখে চোখ পড়লেই হাসছে মিষ্টি করে। হৃদয় গলানো হাসি।
কমাণ্ডারের মনে তোলপাড় শুরু হল। বিশ্রামের সময় খাবার দেয়া হল। মেয়েটা খাবার ছুঁলনা। কমাণ্ডারকে জানানো হল এ কথা। কমাণ্ডার মেয়েটাকে ডেকে না খাওয়ার কারণ জানতে চাইল। মেয়েটা কিছুই বলল না, কেবল মায়াময় চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

কমাণ্ডার বললেন, ‘কি ব্যাপার, তুমি খাচ্ছো না কেন?’

মেয়েটা কাঁদকে কাঁদতে বলল, ‘আমার খালী মায়ের কথা মনে পড়ে।’

মায়ের কথা শুনে কমাণ্ডারের মনটা কেমন নরম হয়ে গেল। অনেক বুঝীয়ে শুনিয়ে খেতে পাঠাল তাকে। যাবার সময় মেয়েটা বলল, ‘কেবল আপনাকে খুশি করার জন্যই আমি এখন খাব, নইলে খাওয়ার প্রতি আমার কোন রুচি নেই।’

‘কিন্তু না খেলে যেে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে।’

তীর্যক কটাক্ষ হেনে মেয়েটা বলল, ‘আমি অসুস্থ হলে আপনার কি? আমি কি আপনার ইয়ে. . .’ বলেই লজ্জায় আরক্তিম হয়ে ওখান থেকে সরে পড়ল। মেয়েটার এই কটাক্ষ গেঁথে রইল ওর মনে।

নিশুতি রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে। আলগোছে উঠল কমাণ্ডার। মেয়েটার কাছে গিয়ে আলতো করে টোকা দিল তার গায়ে। চোখ মেলে ওকে দেখেই হাসল মেয়েটা। ওরা সরে এল নিরিবিলি জায়গায়।

মেয়েটা বলর, ‘আমি এক অসহায় তরুণী। ভঅগ্য খারাপ বলে আজ এই করুণ পরিণতি। খৃস্টান সৈন্যরা আমাকে অপহরণ করে নিয়ে তুলেছে জাহাজে। অন্য মেয়েদের সাথে জাহাজেই পরিচয় হয় আমার। তাদেরকেও অপহরণ করা হয়েছে। হঠাৎ জাহাজে আগুন লাগর। আমাদের তুলে দেয়অ হল একটা নৌকায়। নৌকা তীরে ভিড়ল। গোয়েন্দা ভেবে আমাদেরকে বন্দী করল সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সৈন্যরা।

কমাণ্ডার জানত না সুলতানকেও এ কল্পকাহিনীই শুনিয়েছে ওরা।

কমাণ্ডারকে শুধু বলা হয়েছে, ‘এরা অত্যন্ত বিপজ্জনক বন্দী। কায়রোর গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ওদের হস্তান্তর করতে হবে।’

কমাণ্ডার তাকে তার অপারগাতর কথা জানিয়ে বরর, ‘এ ব্যাপারে আমি তোমাদের কোন সাহায্য করতে পারছি না।’

মেয়েটা মাত্র তুনীর মাত্র একটা তীর ছুঁড়েছে। এখনো অনেক তীর বাকী। বলল, ‘আমি তোমার কাছে কোন সাহায্য চাইনা। তুমি সাহায্য করতে চাইলেও আমি বাঁধা দেব। জানিনা তোমাকে কেন এত ভাল লাগে। আমার জন্য তুমি কোন বিপদে পড়বে, তা আমি হতে দেবনা। আমার সমব্যাথী কেউ নেই। মেয়েরা আমার আপন কেউ নয়, পুরুষদের চিনিনা। মনে হল তোমার মনটা বড় ভাল এজন্য তোমার কাছে আমার দুঃখের কথা বলে মনটা হালকা করছি।’ যুবতি কমাণ্ডারে আরো কাছে সরে এল।

কাজ হল এতে। যুবতীর কাঁধে হাত রেখে সহানুভূতির সুরে বলল কমাণ্ডার, ‘তোমাদের জন্য আমার কষ্ট হয়। কিন্তু এ অবস্থায় তোমার জন্য আমি কিউবা করতে পারি।

আরেকটা তীর ছুঁড়ল ও। বলল, তোমাদের সুলতানকে আমার এ দুঃখের কাহিনী শুনিয়েছীলাম। ভেবেছিলাম তিনি দয়া করে আমাদের দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তিনি আমাকে তার তাবুতে ডেকে নিলেন। মদে মাতাল হয়ে সারারাত আমার দেহ নিয়ে খেলা করলেন। ও আস্ত একটা জানোয়ার। মদ খেলে সে আর মানুষ থাকে না। আমার হাড়গোড় সব ভেঙে দিয়েছে।’

কমাণ্ডারের রক্তে আগুন লাগল, জেগে উঠল তার পশু শক্তি। মিসরীয় পৌরুষ নিয়ে সমবেদনার সুরে তার গাযে, মুখে হাত বুলাতে বুলাতে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘আমাদের বলা হয়েছে আইয়ুবী একজন খাঁটি মুমিন। একজন ফেরেস্তা। মদ এবং নারীকে তিনি ঘৃণা করেন। অথচ. . . .’

মেয়েটা তার দেহের ভার কমাণ্ডারের বুকে ছেড়ে দিতে দিতে বলল, ‘আমাকে তো এখন তার কাছেই নিয়ে যাচ্ছ। বিশ্বাস না হলে রাতে দেখো আমি কোথায় থাকি? আমাকে সুলতান জেলে দেবে না, রাখবে তার নিজস্ব হারেমে। ভয়ে এখনি আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।’

এ ধরনের কথায় সুলতানের ওপর কমাণ্ডারের মন বিষিয়ে উঠছিল। কমাণ্ডার জানতো না, যুবতী গোয়োন্দারা এ হাতিয়ার দিয়েই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে। মেয়েটার প্রেমে হাবুডুব খেতে লাগর সে।

‘যদি তুমি আমাকে এ অপমানকর জীবন থেকে মুক্তি দাও, আমি চির জীবনের জন্য তোমার হয়ে যাব। আমার পিতা বিত্তশালী। আমাকে এ অপমানকর জীবন থেকে উদ্ধার করেছ জানতে পালে তিনি তোমাকে আনন্দের সাথেই গ্রহণ করবেন। চলো আমরা সাগরের ওপারে পালিয়ে যাই।’

‘কিন্তু. . . . . .’

‘শোন, কোন কিন্তু নয়। দেশে গিয়ে আমি তোমাকে বিয়ে করব। বাবা তোমায় বাড়ী দেবেন, সম্পদ দেবেন। তুমি নিশ্চিন্তে ব্যবসা করে হেসেখেলে জীবনটা পার করতে পারবে।’

কমাণ্ডার বলল, ‘কিন্তু আমি আমার ধর্মত্যাগ করতে পারব না।’

মেয়েটা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, ‘আমি আমার ধর্ম ছেড়ে দেব।’

এরপর ওরা বিয়ের পরিকল্পনা করতে লাগল। মেয়েটা বলল, ‘আমি তোমাকে বাধ্য করছিনা, ভাল করে ভেবে দেখো কি করবে। আমি শুধু একটা কথা জানতে চাই, আমি তোমাকে যেমন ভালবাসি, তুমিও তেমনটি বাস কিনা। যদি তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও, তবে কায়রো যেতে দেরী করো। একবার কায়রো গেলে তুমি আমার গন্ধও পাবে না।’

মেয়েটা সফর দীর্ঘায়িত করতে চাইছিল, কারণ পলানোর পরিকল্পনা করছিল রবিন। তিনদিনের সফল শেষ হয়ে গেলে তা সম্ভব নয়। ঘুমন্ত প্রহরীদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের হত্যা না করলে পালানো যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সময়ের। ওরা নিশ্চিন্ত না হলে ও সুযোগ পাওয়া যাবে না।

এ জন্য মেয়েটাকে কমাণ্ডারের পেছনে লাগিয়ৈচে ওরা। প্রথম সাক্ষাতেই মেয়েটা সফল। যৌবন পুষ্ট দেহটা কমাণ্ডারকে উজাড় করে দিয়েছে সে। কমাণ্ডার উচ্চপদস্থ কোন অফিসার নয়। এমন সুন্দরী যুবতী সে কখনও দেখেনি। কল্পনা দেবী তার হাতের মুঠোয়। ভুলে গেল সে কর্তব্য এবং ধর্ম।

সকালে কমাণ্ডার ঘোষণা করল, ‘পশুগুলো ক্লান্ত, আজ সফর করব না।’

ঘোষণা শুনে সবাই খুশী। ময়দানের কঠিন নিয়ম কানুনে ওরা হাঁফিয়ে উঠেছিল। কায়রো পৌঁছরর কোন তাড়া ওদের নেই।

বিশ্রাম আর গল্পগুজবে কেটে গেল দিন। কমাণ্ডারের সময় কাটল মেয়েটার কাছে।

রাত নালম। ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। মেয়েটাকে নিয়ে দূরে সরে এল কমাণ্ডার। সুখের অতলে হারিয়ে গেল দু’জনে।

ভোরে কাফেলা রওনা হল। পথ পরিবর্তন করল কমাণ্ডার। বলল, ‘এদিকে যাত্রা বিরতির জন্য সুন্দর জায়গা পাওয়া যাবে। খাওয়ার জন্য পাশের গ্রাম থেকে ডিম এবং মুরগীও আনতে পারবো।

কমাণ্ডার তাদের বিনোদনের সুযোগ দিচ্ছে ভেবে প্রহরীরা ভীষণ খুশী। কিন্তু দু’জন প্রহরী কমাণ্ডারের এসব কাজে খুশী হতে পারেনি। ওরা তাকে বলল, ‘আমরা বিপজ্জনক বন্দীদের নিয়ে যাচ্ছি। ওদের সবাই গুপ্তচর। যতশীঘ্র সম্ভব ওদেরকে সংস্থার হাতে পৌঁছে দেয়া উচিৎ। অকারণে সফর দীর্ঘ করা ঠিক হবে না।’

‘তাড়াতাড়ি পৌঁছব কি দেরীতে পৌঁছব সে দায়িত্ব আমার। এ ব্যাপারে তোমাদের না ভাবলেও চলবে। জবাবদিহী করতে হলে আমি করব।’

ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল প্রহরী দু’জন। তারপরও দু’জন আড়ালে আবডালে শলাপরামর্শ করতে লাগল।

দুপুর। দূর আকাশে একঝাঁক শুকুন উড়ছে। হয়ত লাশ আছে আশপাশে। এলাকাটা বালিয়াড়ি হলেও ছোট ভোট টিলায় মরুবৃক্ষ আছে।

কাফেলা একটা টিলায় পৌঁছল। চড়াই পেরিয়ে বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠে শুকুনের ভিড়। ওরা তাকিে দেলল প্রান্তর জুড়ে অসংখ্য লাশ। সুলতান আইয়ুবীল কমাণ্ডো বাহিনীল আক্রমণে নিহত সুদানী ফৌজ। সুদানীরা লাশ তুলে নিতে পারেনি, পালিয়ে গেছে জীবন নিয়ে। লাশের পাশে পড়ে আছে অস্ত্র। ঢাল, তলোয়ার, নেযা, বল্লম।

ময়দানের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে চলল ওরা। পড়ে থাকা অস্ত্রের দিকে জুলজুল চোখে তাকাল রবিন। কথা বলল সংগীদের সাথে।

ডান দিকে সবুজের সমারোহ। সুপেয় ঝরণা। চোখের ইশারায় কমাণ্ডারকে ডাকল মেয়েটা। এগিয়ে এল মিসরী। মেয়েটা বলল, ‘চমৎকার জায়গা, চলোনা বিশ্রাম করি।’

কাফেলাকে থামতে হুকুম দিল কমাণ্ডার। ঝরণার পাশে থামল ওরা। আরোহীরা  নেমে পড়ল উট এবং ঘোড়া থেকে। পশুগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে। রাতে থাকার জন্য তাবু খাটানো হল দুই টিলার ফাঁকে সবুজ ঘাসে ভরা প্রশস্ত মাঠে।

মরুভূমিতে নেমে এসেছে অন্ধকার রাত। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু কমাণ্ডারের চোখে ঘুম নেই। কখন মেয়েটার কাছে পৌঁছবে এ ভাবনায় অস্থির সে।

জেগে আছে মেয়েটাও। ‘আজ কমাণ্ডারকে মাতাল করতে হবে’ মনে মনে বলল ও।

নীরব রাতে প্রহরীদের নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। মিসরী উঠল। পা টিপে টিপে পৌঁছল মেয়েটার কাছে। টিলা ওপাশে চলে গেল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল অন্য টিলায়। গাছের ছায়ায় গাঢ় অন্ধকার। ওরা একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসল।

ছাউনিতে কমাণ্ডার নেই। প্রহরীরা সবাই ঘুমিয়ে আছে। কোন সেন্ট্রি নেই। এ অপূর্ব সুযোগকে কাজে লাগালো রবিন। নিঃশব্দে সংগীদের জাগাল। হামাগুড়ি দিয়ে দূরে সরে গেল একে একে সবাই।

টিলার আড়াল হয়ে দৌড়াতে লাগল ওরা। পৌঁছল লাশের কাছে। তীর ধনু এবং বর্শা নিয়ে ফিরে এল। ঘুমন্ত প্রহরীদের পাশে এসে দাঁড়াল রবিন। বর্শা তুলল মারার জন্য, অন্য চারজনও তৈরী। ঘুমের মধ্যে একসঙ্গে পাঁচজনকে শেষ করতে পারছে এ আনন্দে উদ্ভাসিত ওদের চেহারা।

নিহতদের চিৎকার সঙ্গীদের কানে পৌছার আগেই বাকীদেরও নিরস্ত্র অবস্থায়ই হত্যা করতে হবে। রবিন পেছনের দিকে তাকাল একবার। দেখল একটু দূরে ঘুমিয়ে আছে উট চালক তিনজন। কমাণ্ডারকে নিয়ে মেয়েটা সরে গেছে দূরে।

রবিন একজন সৈনিকের বুক লক্ষ্য করে বর্শা নামিয়ে আনতে শুরু করেছে, হঠাৎ একটা তীর এসে তার বুকে বিঁধে গেল। অন্য একটা তীর লাগল তার সংগীর গায়ে। ওরা কিছু বুঝে উঠার আগেই আরও দুটো তীর ওদের দুই সঙ্গীর বুকে এসে বিঁধল।

এগিয়ে এল তীর নিক্ষেপকারী সৈনিক দু’জন। কমাণ্ডারের সাথে এদেরই কথা কাটাকাটি হয়েছিল দিনের বেলা।

শুয়েছিল ওরাও। বন্দীরা ওদের পাশ দিয়ে যাবার সময় চোখ খুলে গেল একজনের। তাকিয়ে দেখল বন্দীরা পালিয়ে যাচ্ছে। ওরা একটু দূরে যেতেই পাশের জনকে জাগাল সে। ফিসফিস করে বলল, ‘ওরা পালাচ্ছে।’

‘কারা?’

‘বন্দীরা।’

‘কউ? কোন দিকে গেছে?’ দ্রুত উঠে বসল সে। প্রথম সৈনিকটি হাত ইশারায় বন্দীদের গমনপথের দিকটা দেখাল ওকে। প্রথম সৈনিকটি উঠে দাঁড়াল।  বলল, ‘চল, ওদের পিছু নিতে হবে।’

সাবধানে বন্দীদের অনুসরণ করে এগিয়ে চলল দু’জন। দেখল বন্দীরা অস্ত্র কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসছে।

টিলার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল দু’জন। বন্দীরা ঘুমন্ত প্রহরীদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হতেই এরা তীর ছুঁড়ল। ওরা পড়ে যেতেই কমাণ্ডারকে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসল সৈনিক দু’জন।

তাদের ডাক চিৎকারে জেগে উঠল মেয়েগুলো। সাথে সাথে প্রহরীরাও। মেয়েগুলো লাশের দিকে তাকাল ভয়-বিস্ফারিত নয়নে। প্রত্যেকর বুকে একটা করে তীর বিঁধে আছে।

এদের পরিকল্পনা মেয়েরা জানত। হতাশা ফুটে উঠল ওদের চেহারায়। এদিক ওদিক তাকাল ওরা। দেখল মিসরী কমাণ্ডার ও একটা মেয়ে সেখানে নেই।

যখন বন্দীদের বুকে তীর বিঁধেছে ঠিক সে মুহূর্তে পাশের টিলায় একটা খঞ্জর কমাণ্ডারের পিঠে আমূল প্রবেশ করল। টিলার উপর পড়ে রইল তার লাশ।

মেয়েটাকে নিয়ে টিলার ওপর বসেছিল কমাণ্ডার। ওরা জানতোনা তার খানিক দূরে বালিয়ানের তাঁবু। ঘোড়াগুলো একটু দূরে। মুবিকে নিয়ে এদিকে এসেছিল বালিয়ান, রক্ষীদের চোখের আড়ালে। হাতে মদের বোতল, চাদর বিছিয়ে বসল মুবিকে নিয়ে।

রাতের নীরবতা ভেঙে ভেসে এল অস্ফুট শব্দ। চমকে উঠল ওরা। উৎকর্ণ হয়ে রইল। সতর্ক পা ফেলে দু’জনে এগিয়ে গেল শব্দ লক্ষ্য করে। দেখল, গাছের নীচে দু’টো ছায়ার অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যাচ্ছে।

মুবি আরও এগিয়ে গিয়ে ওদের কথা শুনতে লাগল। মেয়েটার কথা শুনে সে স্পষ্ট বুঝতে পারল যে, এ তার সঙ্গিনীদের একজন।

কমাণ্ডারের তৎপরতা স্পষ্ট। বদামায়েশী করার জন্য অসহায় মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে।

পিছিয়ে এল সে। বালিয়ানকে বলল, ‘লোকটা মিসরী। আমার সঙ্গীনী একটা মেয়েকে ভোগ করার জন্য নিয়ে এসেছে। একে রক্ষা কর। মিসরী তোমায় শত্রু, মেয়েটা বন্ধু। ও আমারচে বেশী সুন্দরী। ওকে এনে তোমার হারেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধী কর।’

বালিয়ান মদ পান করছিল, মুবির কথায় উঠে দাঁড়াল। খাপ থেকে খঞ্জর বের করে শিকারী বেড়ালের মত পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল। কমাণ্ডার কিছু বুঝে উঠার আগেই তার পিঠে আমূল বসিয়ে দিল খঞ্জর। টেনে নিয়ে আবার আঘাত করল।

আকস্মিক এ আক্রমণে ভয় পেয়ে মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। ওকে দূর থেকে ডাকল মুবি। ও ছুটে গিয়ে মুবিকে জড়িয়ে ধরল।

‘অন্যরা কোথায়?’ মুবির প্রশ্ন।

সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে বলল মেয়েটা। বলল, ‘ওরা এখন পনরজন সৈনিকের পাহারায় রয়েছে।’

বালিয়ান দৌড়ে গিয়ে সংগীদের ডেকে নিয়ে এল। সাথে অস্ত্র। কমাণ্ডারকে ডাকতে ডাকতে এদিকে এগুচ্ছিল এক প্রহরী। বালিয়ানের এক সংগী তীর মেরে তাকে হত্যা করল। মেয়েটা ওদের নিয়ে এগিয়ে চলল ক্যাম্পাসের দিকে।

টিলার নীচে আলো জ্বলছে। বালিয়ান টিলার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখল মাটিতে গাঁথা লাঠির মাথায় দুটো মশাল। প্রহরীরা লাশগুলো ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েগুলো জড়ো হয়ে আছে পাশে। তা দেখে মুবি এবং মেয়েটা কাঁদকে লাগল।

বালিয়ান সঙ্গীদের বলল, ‘তীর ছোঁড়।’

একসঙ্গে দু’টো তীর নিক্ষিপ্ত হল। লুটিয়ে পড়ল দু’জন প্রহরী। ওরা তখনও বুঝে উঠতে পারছে না কি ঘটছে, আরো দু’টা তীরে পড়ে গেল আরো দু’জন সৈনিক। একজনের দেহে বিঁধল তিনটে তীর।

উট চালকরা অন্ধাকারে লুকিয়ে পড়ল। মুবি মেয়েদের কাছে ছুটে এল। হঠাৎ ওদের কানে ভেসে এল অশ্বক্ষুরের শব্দ।

‘এখানে আর দেরী করা যাবে না।’ বালিয়ান বলল, ‘ওদের একজন পালিয়ে যাচ্ছে কায়রোর দিকে। এখুনি আমাদের পালানো উচিত।’

প্রহরীদের ঘোড়াগুলো নিয়ে নিজের ক্যাম্পের দিকে চলল বালিয়ান। তার একটা ঘোড়া নেই। আহত মিসরী সিপাইটি এদের ঘোড়া নিয়েই পালিয়েছে। নিজের ঘোড়া পর্যন্ত যেতে পারেনি সে।

চৌদ্দটি ঘোড়ার পিঠে জিন চাপানো হল। মালামাল চাপাল দুটার পিঠে। রওনা হল কাফেলা।

মেয়েরা মুবিকে সব ঘটনা খুলে বলল। কিন্তু রবিনদের মৃত্যুর রহস্য বলতে পারল না। মুবি বলল, ‘আইয়ুবীর ক্যাম্পে রবিনের সাক্ষাৎ যেমন অযাচিত ভাবে পেয়েছিলাম, তোমাদেরও পেলাম তেমনি আকস্মিকভাবে। এতে বলব না, পবিত্র যীশু আমাদের সফল করবেন। যে কাজেই আমরা হাত দিয়েছি, ব্যর্থ হয়েছি। রোম উপসাগরের পাড়ে আমাদের সৈন্যরা পরাজিত হয়েছে। মিসরে পরাজিত হয়েছে আমাদের বন্ধু সুদানী ফৌজ। রবিনের মত লোক নিহত হল। জানিনা কি হবে আমাদের পরিণতি। মনে হয় যীশু আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট।’

‘আমি বেঁচে থাকতে তোমাদের গায়ে কেউ হাত তুলতে পারবে না।’ বালিয়ান বলল, ‘আমার সিংহদের কাজ কি দেখনি?’

রোম উপসাগরের তীরে এসে লাগল একটি নৌকা। নেমে এল তিনজন লোক, পায়ে পায়ে এগিয়ে চলর মুসলিম সেনা ক্যাম্পের দিকে। কথা বলছে ইটালীর ভাষায়।

ক্যাম্পে পৌঁছল ওরা। ওদের কথা শুনে ইটালীর খৃস্টান বন্দীদের ডেকে আনা হল। ওরা বলল, ‘এরা ইটালী থেকে এসেছে হরিয়ে যাওয়া বোনের খোঁজ। সেনাপতির সাথে দেখা করতে চাইছে।’

ক্যাম্পের অধিনায়ক বাহাউদ্দিন শাদ্দাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হল ওদের।

তিনজনের একজন আধ বয়েসী, দু’জন যুবক। দোভাষী বলল, ‘ওদের যুবতী বোনকে খৃস্টান সৈন্যরা তুলে নিয়ে এসেছে। এরা শুনেছে ওদের বোনেরা এখন আইয়ুবীর ক্যাম্পে আছে। বোনদের খোঁজে সাগর পাড়ি দিয়ে এদ্দুর এসেছে এরা।’

তাদের বলা হল মেয়েরা এসেছে তিনজন নয় সাতজন। সাবাই গুপ্তচর। তিনজনই বলল, ‘আমরা গরীব। গুপ্তচরীর সাথে আমাদের বোনদের কোন সম্পর্ক নেই। সাতজনকে আমরা জানিনা। আমাদের বোনদের খোঁজে আমরা এসেছি।

শাদ্দাদ বললেন, ‘যে সাতজন আমাদের কাছে এসেছে, তার মধ্য থেকে পালিয়ে গেছে একজন। বাকী ছ’জনকে আজই কায়রো পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমরা বরং ওখানে যাও। আমাদের সুলতান ভাল মানুষ।

‘বিশ্বাস করুন, আমাদের বোনেরা গোয়েন্দা নয়। আপনারা যাদের পেয়েছেন তারা গোয়োন্দা হলে ওরা আমাদে বোন নয়। আমাদের হতভাগী বোনেরা তাহলে হয়ত সাগরে ডুবে মরেছে। না হয় খৃস্টানদের কাছেই আছে।’

শাদ্দাদের মনটা ছিল নরম। তিনজন গ্রাম্য লোকের দুঃখে তিনিও ব্যথিত হলেন। খাতির যত্ন করে বিদায় করলেন ওদের। চলে গেল ওরা। কোথায় গেল কেউ জানল না।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা নিরাপদ এলাকায় পৌঁছল। এক পাহাড়ের কোলে আঠারজন কমাণ্ডো ওদর জন্য অপেক্ষা করছিল।

তিনজনের মধ্যে বয়সী লোকটি সেগনামা মারইউস। এসেছে মেয়েদের মুক্ত করতে এবং সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করতে। সাগর থেকে পাহাড়ের ভেতর দিকে চলে গেছে এক সংকীর্ণ চ্যানেল। পাড়ে নেমে ওখানে নৌকা লুকিয়ে রেখেছিল ওরা।

ওরা কায়রো যাবে, কিন্তু কোন বাহন নেই। ক্যাম্পের ঘোড়া চুরি করাও সহজ নয়। সুর্য ওঠার এখনও অনেক দেরী, ওরা হাঁটা ধরল। পথে কোন সওয়ারী পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে। বন্দীদের পথেই ধরতে হবে, তা না হলে কায়রো গিয়ে ওদের মুক্ত করা কঠিন হবে।

মৃত্যু হাতে নিয়েই ওরা অভিযানে এসেছে। সফল হলে পুরস্কার পাবে। তা দিয়ে জীবন ভর বসে বসে খেতে পারবে। তিরিশ বছর মেয়াদের জেল খাটছিল মেগনামা মারইউস। ডাকাতির আসামী। আরো একটা কেস ছিল খুনের। ওটার রায় বেরোলে তার ফাঁসি হয়ে যেতো।

তার সাথের দু’জনের শাস্তি ছিল চব্বিশ বছরে। কারাগারের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য ওরা মৃত্যু কামনা করত। এদের শাস্তি মওকুফ করে এ অভিযানে পাঠানো হয়েছে।

এক পাদ্রীর হাতে শপথ করেছে ওরা। পাদ্রী বলেছেন, যত মুসলমান হত্যা করবে, ঈশ্বর তার দশগুণ পাপ মোচন করবেন। সালাহউদ্দীনকে হত্যা করলে ক্ষমা করা হবে সারা জীবনের পাপ। পরকালে পবিত্র যীশুর সাথে একসঙ্গে স্বর্গে থাকবে।

জেল থেকে মুক্তি আর স্বর্গপ্রাপ্তি ও পুরস্কারের লোভে ওরা এসেছে এ দলে। ওদের ভেতর ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা।
জীবন বাজি রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা। হয়ত আইয়ুবীকে হত্যা করবে, নয়তো জীবন বিলিয়ে দেবে। বাকী আঠারজন পরাজিত বাহিনীর সেনা সদস্য। ওদের হৃদয়ে জ্বলছিল প্রতিশোদের আগুন। প্রজ্বলিত আবেগ নিয়ে ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল কায়রোর দিকে।

দ্বিপ্রহর। সুলতান আইয়ুবীর হেডকোয়ার্টারের সামনে এসে থামল এক ঘোড়সওয়ার। ঘোড়ার গা ঘামে জবজবে। ক্লান্তিতে আরোহীর মুখে কথা সরছেনা। নেমে পড়ল আরোহী। কেঁপে উঠল ঘোড়ার শরীর। মাটিতে পড়ে মরে গেল ঘোড়াটা, টানা দেড় দিন একনাগাড়ে দৌড়িয়েছে। এর মধ্যে পেটে দানাপানি পড়েনি, বিশ্রামও জুটেনি কপালে।

সুলতান আইয়ুবীর রক্ষীরা সওয়ারকে ঘিরে ধরল। পানি পান করাল। কথা বলার উপযুক্ত হতেই বলল, ‘কোন সালার অথবা কমাণ্ডারের সাথে দেখা করব।’

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী নিজে বেরিয়ে এলেন। আগন্তুক দাঁড়িয়ে সালাম করে বলর, ‘আমি একটা দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি।’

সুলতান তাকে ভেতরে নিয়ে বললেন, ‘এবার বল।’

‘বন্দী মেয়েরা পালিয়ে গেছে। আমােদরও সবাই নিহত। আমি আহত, তবে কোনরকমে আমি বেঁচে গেছি। ওদের পুরুষ বন্দীদের আমরা হত্যা করেছি। আক্রমণকারী কে জানিনা। আমরা ছিলাম মশালের আলোয়। আক্রমণকারী অন্ধকার থেকে তীর ছুড়েছে।’

সুলতান একজন কমাণ্ডার এবং গোয়োন্দা অফিসারকে ডেকে আনালেন। বললেন, ‘ও কি বলছে শোন।’

সিপাইটি ঘটনা শোনাল। বলল, ‘বন্দী মেয়ের সাথে কমাণ্ডারের সম্পর্কের কথা।’

আইয়ুবী বললেন, ‘তার মানে মিসরেও তাদের কমাণ্ডো বাহিনী রয়েছে।’

‘হতে পারে।’ আলী বললেন, ‘আবার মরু ডাকাত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এমন সুন্দরী যুবতীতো ওদের জন্য মহা মূল্যবান।’

‘ওর কথা মন দিয়ে শোননি তুমি। বন্দীরা লাশের অস্ত্র তুলে এনে আক্রমণ করেছিল ঘুমন্ত প্রহরীদের। আমাদের যে দু’জন প্রহরী এটা দেখেছেন তারা তীর মেরে ওদের হত্যা করার পরপরই আক্রান্ত হয়েছে আমাদের প্রহরীরা। এতে মনে হয় কমাণ্ডো বাহিনী ওদের অনুসরণ করছিল।’

মহামান্য সুলতান, এ মুহূর্তে ওদের ধাওয়া করার জন্য বিশটি ঘোড়া এবং এই সৈনিককে প্রয়োজন। আক্রমণ কে করেছে পরে দেখা যাবে।’ বলল এক কমাণ্ডার।

‘আমার একজন সহকারীকে সাথে পাঠাব।’ আলী বললেন, ‘একে খাবার দাও। খাওয়ার পর ও বিশ্রাম করবে। প্রয়োজনে বিশের অধিক ঘোড়া নিতে পার।’

আগন্তুক বলল, ‘আমি যেখান থেকে ঘোড়া নিয়েছি ওখানে ঘোড়াটা বাঁধা ছিল, কিন্তু কোন লোক ছিল না। সম্ভবতঃ ওরাই আক্রমণকারী। ওখানে আমি আটটি ঘোড়া দেখেছি। নিশ্চয়ই ওরা আটজন ছিল।’

‘কমাণ্ডো বাহিনীতে বেশী লোক থাকেনা। ইনশাআল্লা আমরা ওদের গ্রেফতার করতে পারব।’ কমাণ্ডার বলল।’

‘মনে রেখো ওরা কমাণ্ডো বাহিনী।’ সুলতান বললেন, ‘মেয়েগুলো গোয়েন্দা। ওদের একজন সৈন্য অথবা একটা মেয়েকে ধরতে পারলে মনে করবে দু’শ শত্রু সৈন্য পাকড়াও করেছ। এক নারী কারো তেমন ক্ষতি করতে পারেনা। কিন্তু এক গুপ্তচর মেয়ে একটা দেশ এবং জাতি ধ্বংস করে দিতে পারে। ওরা অত্যন্ত বিপজ্জনক। একবার মিসরে ঢুকে গেলে গোটা সেবানাহিনী অকর্মণ্য হয়ে পড়বে।

সুলতান আরো বললেন, ‘একজন পুরুষ বা মেয়ে গেয়েন্দাকে ধরার জন্য আমি একশত সিপাই কোরবানী দিতে প্রস্তুত। কমাণ্ডোরা ধরা না পড়লে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যে কোন মূল্যেই হোক মেয়েগুলোকে গ্রেপ্তার করতে হবে। জীবিত ধরতে না পারলে তীর মেরে শেষ কর দিও।’

এক ঘন্টা পর বিশজন দুঃসাহসী সৈনিক রওয়ানা হল। পথ দেখাচ্ছিল পালিয়ে আসা প্রহরী। কমাণ্ডার আলী বিন সুফিয়ানের সহকারী জাহেদীন। বিশজনের একজন ছিল ফখরুল মিসরী। আলী জানতো না ওরা মুবি এবং বালিয়ানকেই ধাওয়া করতে যাচ্ছে।

কাফেলার একুশতম ব্যক্তি কমাণ্ডার যাচ্ছেন মেয়েদের পাকড়াও করতে। ওদিকে খৃস্টান কাফেলার একুশতম ব্যক্তিও কমাণ্ডার। তার উদ্দেশ্য মেয়েদেরকে মুক্ত করা। এরা যাচ্ছিল পায়ে হেঁটে। যাদের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে তারা, তাদের কারো জানা ছিল না, দু’দলের কে কোথায় আছে।

এখনো সূর্য ডুবেনি। অনেকদূর এগিয়ে এসেছে খৃস্টান কাফেলা। সামনে চড়াই। উপরে উঠল ওরা। দূরে প্রশস্ত মাঠ, মাঠ পেরিয়ে মরুদ্যান। খেজুর গাছ ছাড়াও বিভিন্ন বৃক্ষে ঘেরা। অনেকগুলো উট দেখা যাচ্ছে। ওদের পিঠ থেকে মাল নামানো হচ্ছে। ঘোড়া রয়েছে বারচৌদ্দটি।

পরস্পরের দিকে তালাক ওরা। যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। এখন ওদের ঘোড়ার ভীষণ প্রয়োজন।

কমাণ্ডার কাফেলা থামাল। বলল, ‘আমরা ক্রুশে হাত রেখে সত্যিকার শপথ নিয়েছিলাম। দেখলে তো ক্রুশের মহিমা। ঈশ্বর আকাশ থেকে এ সওয়ার পাঠিয়েছেন। ঈশ্বরপুত্র তোমাদের সাহায্যের জন্য নেমে এসেছেন আকাশ থেকে।

ক্লান্তির চিহ্ন মুছে গেল ওদের চেহারা থেকে। এখনো চিন্তা করছে না এগুলো হাত করবে কিভাবে?

শ’খানেক উট সেবানাহিনীল জন্য রেশন নিয়ে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে শত্রুর ভয় নেই, এজন্য পাহারা তেমন জোরালো নয়। দশজন ঘোড়সওয়ার পাঠানো হয়েছে। উট চালকরা নিরস্ত্র।

ডাকাতরা ছোটখাট কাফেলা লুট করলেও সামরিক কনভয় আক্রমণ করেনা কখনো। আগেও এভাবে সামরিক ঘাঁটির জন্য রসদ পাঠানো হয়েছে। নির্ভয়ে চলছে রসদবাহী কাফেলা। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে।

খৃস্টান কমাণ্ডার অভিযাত্রীদের নিয়ে গেল পাহাড়ের আড়ালে। বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত ওরা। আবেগ এবং সাহসেরও অভাব নেই। গভীর রাতে দু’জন গিয়ে দেখে এল। ঘুমিয়ে আছে রসদবাহী কাফেলা। সশস্ত্র মাত্র দশজন।

ভের হওয়ার সামান্য আগে রওনা দিল ওরা। সাবধানে এগিয়ে গেল। ঘুমন্ত দশজন প্রহরীকে হত্যা করল। কোচম্যানরা বুঝতেই পারলনা কি হচ্ছে। চিৎকার দিল কেউ, সে চিৎকার থেমে গেল তরবারীর আঘাতে।

ভয় পাইয়ৈ দেয়ার জন্য খৃস্টানরাও চিৎকার করতে লাগর। জেগে উঠল সব কোচওয়ান। শুরু হল হত্যাজজ্ঞ। কমাণ্ডার গলা চড়িয়ে বলল, ‘এগুলো মুসলিম বাহিনীর রেশন। নিশ্চিহ্ন করে দাও। মেরে ফেল উটগুলি। উটচালকদের হত্যা কর।’

খৃষ্টানরা নির্বিচারে তরবারী চালাতে লাগল। বারোটা ঘোড়া দখল করল কমাণ্ডার। ভোরের আলো ফুটল। উট এবং মানুষের লাশে ভরে গেছে মাঠ। কেউ কেউ তড়পাচ্ছে এখনো। পালিয়ে গেছে কেউ। প্রতিরোধ করার মত কেউ নেই।

ঘোড়া নিয়ে সরে পড়ল খৃস্টান অভিযাত্রীরা। ওদের বাহনের প্রয়োজন মিটেছে। এখন ওরা ছুটে চলছে পরবর্তী শিকারের উদ্দেশ্যে।

বালিয়ানের সমগ্র সত্ত্বায় জড়িয়ে আছে মুবি। মদ বিকল করে রেখেছে স্নায়ুগুলো। এখন তার কাছে  সাত সাতটা রূপসী যুবতী। ভুলে গেছে বিপদের কথা।

মুবি বার বার বলছে, ‘কোথাও বিশ্রাম নেয়া ঠিক নয়। তাড়াতাড়ি সাগর তীরে পৌঁছার চেষ্টা কর। আমাদের পেছনে শত্রু ধেয়ে আসছে।’

কিন্তু কে শোনে কার কথা। নিঃশঙ্কচিত্ত মহারাজা সে। হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে মুবির কথা।

মেয়েদের মুক্ত করার পরের রাতে এক জাগয়ায় বিশ্রাম করছিল ওরা। বালিয়ান মুবিকে বলল, ‘তোমরা সাত যুবতী। আমরা সাতজন পুরুষ। দেখেছো আমার বন্ধুরা কত বিশ্বাসী। আজ ওদের পুরষ্কার দিব। আজ আমার ছয় বন্ধুর সাথে থাকবে তোমার ছয় বান্ধবী। তুমি থাকবে আমার সাথে। আজ আমরা আনন্দ করব।’

‘অসম্ভব!’ ক্রোধকম্পিত কণ্ঠে বলল মুবি, ‘আমরা বাজারের মেয়ে নই। ওরা তোমার কোনা বাদী নয় যে, যা ইচ্ছে তা করবে। বাধ্য হয়ে আমি তোমাকে দেহ দিয়েছি। এরা কারো ভোগর সামগ্রী হবে না।’

‘আনন্দ তুমি একাই লুটবে তা তো হয়না সুন্দরী। তোমার বান্ধবীদেরও কিছু ভাগ দাও।’ বালিয়ানের কণ্ঠে তরল রসিকতা।

‘বালিয়ান, তুমি ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ।’ রাগে ফেটে পড়ছে মুবি।

‘তোমরা কতটুকু ভদ্র তা জানা আছে আমার। আমাদের জন্য তো মরা দেহের উপঢৌকন নিয়ে এসেছ। এরা কতজনের শয্যা-সংগী হয়েছে তার হিসেব দিতে পারো? তোমরা কেউ মেরী নও, এ কথা কে না জানে।’

‘কর্তব্য পালন করতে গিয়ে আমরা দেহের উপঢৌকন পেশ করেছি, ভোগের সামগ্রী হওয়ার জন্য পুরুষদের সংগ দেইনি। আমাদের জাতি, ধর্ম আমাদের ওপর এক গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছে। সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা দেহ, যৌবন, রূপলাবণ্য এবং সতীত্বকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি। আমরা দেহ দিয়েছি আমাদের ওপর অর্পিত কর্তব্য ও দায়িত্বের অংশ হিসেবে, ভোগের জন্য নয়। এখন তুমি যা বলছ তা ভোগ বিলাস ছাড়া কিছুই নয়। যেদিন আমরা ভোগ বিলাসে জড়িয়ে পড়ব সেদিন থেকে শুরু হবে খৃস্টানদের পতন। ক্রুশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

‘মুবি, আমার বন্ধুরা জীবন পণ করে ক্রুশের জন্য লড়ছে। ওদের উজ্জীবিত করা তোমাদের দায়িত্ব।’

‘ট্রেনিং দেয়ার সময় আমাদের বলা হয়েছে, এক মুসলিম নেতাকে করায়ত্ত করার জন্য দশ জনের শয্যাসংগী হওয়া শুধু বৈধ নয় বরং পুণ্যের কাজ। মুসলমান ধর্মীয় গুরুকে দেহ দান করাকে আমরা সেরা পূণ্য মনে করি।’

‘তাহলে তুমি খৃস্টানদের  স্বার্থে আমাকে ব্যবহার করছ?’

‘কেন, এখনো সন্দেহ আছে?’

‘কিন্তু আমি তো খৃস্টান নই।’

‘তা নও। কিন্তু খৃস্টানদের সাথে তোমাদের বন্ধুত্বকে কি অস্বীকার করবে? বলতো খৃস্টানদের সাথে তোমাদের এ বন্ধুত্ব কেন?’

‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য, খৃস্টানদের রক্ষার জন্য নয়। আমি মুসলমান কিন্তু প্রথমে একজন সুদানী।’

‘আর আমি সর্বপ্রথম একজন খৃস্টান। এর পর যে দেশের জন্ম নিয়েছি সে দেশের সন্তান।’

বালিয়ানের হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে মুবি বলল, ‘শোন, ইসলাম কোন ধর্ম নয়, এজন্য তুমি দেশকে প্রাধান্য দিচ্ছ। আমার সাথে চল সাগরের ওপারে। দেখবে আমাদের মহান ধর্ম। তখন নিজের ধর্মকে ভুলে যাবে।

‘যে ধর্ম নিজের মেয়েদের অন্যের শয্যাসংগী হওয়াকে পূণ্যের কাজ মনে করে, সে ধর্মকে শত ধিক।’ আচম্বিত জেগে উঠল বালিয়ানের ঈমানী চেতনা। ‘তুমি নিজের সতীত্ব হারাওনি- আমার ইজ্জত লুণ্ঠন করেছ। আমি নই, তুমিই আমায় ভোগ করেছ।’

‘এক মুসলমানের ঈমান ক্রয় করার জন্য সতীত্ব এমন বড় কিছু নয়। আমি তোমার ইজ্জত লুণ্ঠন করিনি, তোমার ঈমান কিনে নিয়েছি। তোমাকে এ অবস্থায় পথে ছেড়ে যাব না। নিয়ে যাব ঝলমলে আলোর কাছে। তোমার ভবিষ্যত এবং পরকাল হিরার মত উজ্জল হয়ে উঠবে।’

‘আমি তোমার সে আলোর কাছে যাব না।’

‘দেখো বালিয়ান, পুরুষ যোদ্ধা। ওরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না। তুমি আমার পণ্য গ্রহণ করেছ। আমি তোমার ঈমান সুরার পাত্রে ডুবিয়ে দিয়েছি। তোমার ঈমান ক্রয়ের জন্য আমি দিয়েছি চড়া মুল্য। তোমার বাঁদী হয়ে, রক্ষিতা হয়ে থেকেছি আমি। হয় আমার সতীত্ব ফিরিয়ে দাও, নয় তোমার ঈমান দাও। তুমি এ ক্রম-বিক্রয় থেকে মুখ ফেরাতে পার না। প্রতারণা করতে পার না এক দুর্বল মেয়ের সাথে।’

‘যে আলো সাগরে ওপারে দেখাতে চাইছ তা এখানেই দেখিয়েছ। আমি দেখতে পাচ্ছি হিরকের মত জ্বলজ্বল করছে আমার ভবিষ্যত।’

মুবি কিছু বলতে যাচ্ছিল, গর্জে উঠল বালিয়ান, ‘খামোশ বদমাশ মেয়ে! সালাহউদ্দীন আইয়ুবী আমার দুশমন হতে পারে কিন্তু আমি রাসূলের দুশমন নই। যে নবীর জন্য আমি সমগ্র মিসর এবং সুদান বিলিয়ে দিতে পারি সে পবিত্র নামের স্বার্থে আমি আইয়ুবীর কাছেও অস্ত্র সমর্পণ করতে প্রস্তুত।’

‘কতবার বলেছি, মদ কম খাও। অত্যাধিক মদপান, রাত জাগা এবং প্রতিদিন আমার সাথে এইসব করে তোমার মাথাটাই বিগড়ে গেছে। আমি যে তোমার স্ত্রী তাও ভুলে গেছো?’

‘আমি এক বেশ্যার স্বামী নই।’

মদের বোতল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল বালিয়ান। বন্ধুদের ডাকতেই ওরা ছুঁটে এল।

‘এ মেয়েরা এখন তোমাদের বন্দী। ওদের কায়রো ফিরিয়ে নিয়ে চল।’

‘কায়রো?’ একজনের হতচকিত প্রশ্ন, ‘আপনি কায়রো ফিরে যেতে চাইছেন?’

‘হ্যাঁ, কায়রো। হতবাক হচ্ছ কেন? এ মরুভূমিতে আর কতকাল ঘুরে মরব? যাও, জলদি ঘোড়া তৈরী কর, আর প্রতিটি ঘোড়ার পিঠে একটি করে মেয়ে বেঁধে দাও।’

বালিয়ানের তাঁবু থেকে আধমাইল দূরে থাকতেই থেমে গেল খৃষ্টান কমাণ্ডার। বিশ্রাম নেয়ার চমৎকার এলাকা। আশপাশে আরো কেউ তাবুঁ ফেলেছে কিনা খোঁজ নেয়ার জন্য রাতে তিনজন উষ্ট্রারোহীকে পাঠিয়ে দিল। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ হয়, উট চলে নিঃশব্দে। তিন আরোহী ছড়িয়ে গেল তিনদিকে।

বালিয়ান যখন মুবির সাথে কথা বলছিল, একটা উট এসে দাঁড়িয়েছিল পেছনে। বালিয়াড়ির আড়ালে। দূর থেকে মশালের আলো দেখে এগিয়ে এসেছিল আরোহী। উটের পিঠে বসে সে মেয়েদের দেখতে পাচ্ছিল। গল্প করছে বালিয়ানের সাথে। দূরে কটা ঘোড়া বাঁধা।

উষ্ট্রারোহী ফিরে এল সংগীদের কাছে। বলল, ‘শিকার তোমাদের পাশেই রয়েছে।’

সময় নষ্ট করল না কমাণ্ডার। হেঁটে রওনা হল। ওরা যখন পৌঁছল বালিয়ান তখন মেয়েদের বেঁধে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছে।

সংগীরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তার দিকে। নেতার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তর্ক জুড়ে দিল ওরা। সময় নষ্ট হতে লাগল। বালিয়ান অনেক কষ্টে বোঝাল যে, কায়রো গেলেই ওদের ভাল হবে।

বিস্ফারিত চোখে বালিয়ানে দিকে তাকাচ্ছিল মেয়েরা। ঘোড়ার পিঠে জিন চড়িয়ে ওরা মেয়েদের ধরে ফেলল।

আচমকা আক্রমণ হল। সুলতান আইয়ুবীর ফৌজ ভেবে বালিয়ান চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আমরা অস্ত্র সমর্পণ করব। মেয়েদের কায়রো নিয়ে যাব।’

একটা খঞ্জর এসে বুকে বিঁধল তার। নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল বালিয়ান চিরদিনের জন্য। তার সংগীরা এত লোকের মোকাবেলা করতে পারল না। নিহত হল সবাই। মুক্ত হল মেয়েরা। কমাণ্ডারকে চিনতে পেরে খুশীতে উদ্বেলিত হয়ে উঠল মুবি। রাতে কাফেলার চারপাশে দাঁড় করানো হল সশস্ত্র সেন্ট্রি।

সুলতান আইয়ুবীর পাঠানো সওয়াররা এখান থেকে অনেক দূরে। রাতেও পথ চলছিল ওরা। সময় নষ্ট করতে চাইল না কেউ। সাথে পথ প্রদর্শক। পথ ভোলেনি সে।

কাফেলাকে সে আক্রমণের স্থানে নিয়ে গেল। মশাল জ্বেলে দেখাল শৃগাল শকুনের আঁধ খাওয়া রবিন এবং অন্যদের লাশ।

সওয়ারীদের দেখে শেয়াল পালিয়ে গেল। রক্ষীদের লাশ একত্রিত করে দ্রুত দাফন সারল কমাণ্ডার। এরপর ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন ধরে এগিয়ে চলল। রাতে ট্র্যাক পেতে কষ্ট হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে ছাউনি ফেলা হল ওখানে।

খৃস্টানদের সবাই জেগে আছে। ওরা আনন্দিত। ভোরেই বেলাভূমির পথ ধরার সিদ্ধান্ত নিল খৃস্টান কমাণ্ডার। মেগনামা মারইউস বলল, ‘এখনো উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বেঁচে আছে সালাহউদ্দীন।’

কমাণ্ডার বলল, ‘মেয়েদের অনুসরণ করে কায়রো পৌঁছতে পারলে তা সম্ভব হত।’

‘কায়রো অনেক দূর। এজন্য এ পরিকল্পনা বাতিল।’

‘মৃত্যু ছাড়া এ পরিকল্পনা কেউ বাতিল করতে পারবে না।’ মেগনামার ঝাঝালো কণ্ঠ। ‘আমরা ক্রুশ ছুঁয়ে তাকে হত্যা করার জন্য শপথ করেছি। কেউ না গেলে আমি একা যাব। শুধু একটা মেয়ে এবং একজন সংগী প্রয়োজন।’

‘কি করতে হবে সে সিদ্ধান্ত আমি দেব।’কমাণ্ডার বলল, ‘তোমাদের কর্তব্য হল আমার নির্দেশ পালন করা।’

‘আমি কারও হুকুম পালন করতে বাধ্য নই। আমরা সবাই ঈশ্বরের আজ্ঞাবহ।’

কমাণ্ডার তাকে ধমকাতে লাগল। মেগনামা মারইউস তরবারী কোষমুক্ত করে কমাণ্ডারের মাথার ওপর তুলতেই অন্যরা মাঝখানে এসে দাঁড়াল।

‘আমি পাপী, অভিশপ্ত। পাপ এবং অবিচারের মাঝে ধুঁকে ধুঁকে মরছিলাম। তোরা কি জান আমার ত্রিশ বছরের শাস্তি কেন হয়েছিল?

পেজঃ ১ম পেজ | ← পূর্বের পেজ | ... | 3 | 4 | 5 | 6 | পরের পেজ → | শেষ পেজ | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top